ভাল ছেলে ইমরানের গল্প!
ইমরান ভাল ছেলে। রোজ বই বগলে নিয়ে স্কুলে যায়। মাথা চিরুনি দিয়ে আচড়ায়। শিক্ষকদের কথা মেনে চলে। ছোটবেলায় বাবা মা শিখিয়ে দিয়েছে, দুষ্টুমি না করতে, সে করে না। বর্তমানে পেশায় ডাক্তার ইমরান ইসলামী ইমান আকিদা অনুসারে জীবন যাপন করে। নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, এবং সব সময় পাঞ্জাবি পড়ে। আরবী ভাষা না বোঝার কারণে সে কোরানের অর্থ বুঝতে পারে না, তবে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে সে প্রতিদিন সকালে সুললিত কণ্ঠে কোরান তিলাওয়াত করে। স্বপ্ন দেখে একদিন দেশে ইসলাম কায়েম হবে। কিন্তু ইসলাম কায়েম হয় না। মনে মনে কামনা করে, একদিন হজ্ব করতে নিশ্চয়ই মক্কায় যাওয়া হবে। যদি আল্লাহ চাহেন! আর আল্লাহ চাইলে দেশের সংসদ সদস্যপদ, এবং পরে মন্ত্রীও হওয়া যাবে। ধর্মমন্ত্রী ইমরানের প্রিয়, সে ছোটবেলা থেকে ধর্মমন্ত্রী হতে চায়।
সারারাত মুকছেদুল মুমেনিনে বর্ণিত স্ত্রীর সাথে ‘সুন্নত হাসিখুশি’ শেষে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ইমরান ওজু করে কোরআন তেলাওয়াত করতে বসলো। আরবীতে সুর করে পড়তে লাগলো একটার পর একটা সুরা। সে আরবী বোঝে না, শুধু উচ্চারণ জানে। বুঝলে সে জানতো সে যা পড়ছে তা বাঙলায় অনুবাদ করলে অর্থ হয়,
তারা চায় যে, তারা যেমন কাফের, তোমরাও তেমনি কাফের হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সব সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অত:পর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না।
সুরা ৪ঃ৮৯
এরপরে সে আরেকটি সুরা পড়ে, যার অর্থও সে জানে না।
যখন নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদিগকে তোমাদের পরওয়ারদেগার যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্খির করে রাখ। আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই তাদের গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে কাটো জোড়ায় জোড়ায়।
সুরা ৮ঃ১২
এরপরে আরেকটি-
তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। সুতরাং তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যে প্রকারে ইচ্ছা অবতীর্ন হও।
সুরা ২ঃ২২৩
এরপরে কোরআনটা বন্ধ করে টুপি মাথায় দিয়ে সে ফেইসবুকে ঢোকে। হোম পেইজ খুলতেই দেখে, কোন উগ্র নাস্তিক নাকি ফেইসবুকে লিখেছে, ইসলামের উগ্রবাদ, মৌলবাদের সাথে ইসলামের মূল কোরান হাদিসের সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে উষ্কানিমূলক বক্তব্য রয়েছে, সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা রয়েছে। কোরআনে কাফের হত্যার কথা বলা হয়েছে, এবং নারী অবমাননাকর বক্তব্য রয়েছে। নারীকে নাকি শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা দেয়া হয়েছে! যেগুলো আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে বর্তমান সভ্য সমাজে চর্চা করা ভয়াবহ ক্ষতিকর। যা কোমল স্বভাবের মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে বিধর্মী প্রতি ঘৃণা এবং বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
কী? এত্তবড় সাহস? শুনেই ইমরান রাগে পাগলের মত চিৎকার করতে শুরু করে। তার ধর্মীয় অনুভূতি আহত হলো। ভেঙ্গে খানখান হলো। দাঁত মুখ খিচিয়ে ইমরান হাহাকার করতে লাগলো। ঈমানি জোশে সামনে পেলে হয়তো সেই নাস্তিককে সে জবাই করে ফেলতো।
অতঃপর তিনি সেই নাস্তিককে মুমিন মুসলমানের সুকোমল ধর্মীয় অনুভূতিতে মিথ্যা বলে আঘাত করার দায়ে অভিযুক্ত করে একটি জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস লেখে। সেখানে সে লেখে, উগ্র জঙ্গিও খারাপ, উগ্র নাস্তিকও খারাপ। কেউই কোরান বুঝে পড়ে না। কোরানে খালি শান্তি আর ভালবাসার কথা বলা। এমনকি শত্রুকেও কোরান ভালবাসতে বলেছে। সব ধর্মের মানুষকে ভালবাসাই কোরানের শিক্ষা। সেই সাথে একটি খ্রিস্টান দম্পতির গল্পো পোস্ট করে ফেইসবুকে। গল্পটি সে বাঁশের কেল্লা নামক পেইজে পেয়েছিল। নিচে অবশ্য লিখে দেয়, সংগৃহীত। কিন্তু কোথা থেকে সংগ্রহ করা সেটা লেখে না। সবাইকে তো আর বলা যায় না, সে বাঁশের কেল্লা নিয়মিত পড়ে!
এসব লিখে খুব শান্তি অনুভব করে ইমরান। যাক আজকে অনেক ভাল কাজ সে করেছে। রাতের বেলা আবার পড়তে শুরু করে কোরআন। সেখানে সে পড়ে সুরা আল মায়িদার ৩২ নম্বর আয়াতটি। এই আয়াতের একটি লাইন সে বাঙলা জানে, পত্রিকায় মাঝে মাঝেই সে লাইনটি পড়ে বলে লাইনটির অর্থ জানে। যেই লাইনটির অর্থ, যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করল, কোনো হত্যাকান্ড কিংবা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য বিচারে শাস্তি বিধান ছাড়া, সে যেন গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করল। এই লাইনটি পড়ে তার মন খুশিতে ভরে ওঠে। নাস্তিকরা কতই না বোকা, এই লাইনটি কী নাস্তিকরা দেখে না? তারা কোরানের মানে বোঝে? কত মানবিক কথাই না কোরান শিখাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে সে অতি উতসাহে পরের আয়াতটিও পড়ে ফেলে। যার অর্থ,
” যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। “
তবে এই লাইনটি সে ডেইলি পত্রিকায় অর্থসহ পড়ে না বলে এর অর্থ জানে না। অর্থ বোঝে না। এরপরে আরেকটি আয়াত পড়ে।
পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। ( সুরা ৪/২৪)
এটার অর্থও সে বোঝে না। এরপরে অতি আবেগে সে খুলে বসে পবিত্র মুসলিম হাদিস। যথারীতি এটার অর্থও সে বোঝে না। আরবীতে লেখার কারণে। সে সুললিত কণ্ঠে আবৃত্তি করে,
আবু সাদ খুদরি বর্ণিত – হুনায়নের যুদ্ধের সময় আমাদের কিছু সৈন্যকে আওতাসে প্রেরণ করলেন ও সেখানে আমরা শত্রুদের পরাজিত করলাম ও বেশ কিছু নারী বন্দী করলাম। কিন্তু নবীর সাহাবিরা সেসব যুদ্ধবন্দিনী নারীদের সাথে যৌনতায় অনিচ্ছুক ছিল কারণ তাদের স্বামীরা তখনও জীবিত ছিল। আর তখনই আল্লাহ নাজিল করল -‘তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়ে যায়-এটা তোমাদের জন্য আল্লাহর হুকুম (সুরা ৪ঃ২৪)’।
সহি মুসলিম, বই- ৮, হাদিস- ৩৪৩২
হাদিসটা পড়ে সে খুব পবিত্র মন নিয়ে ভাবতে লাগলো, ইসলাম কত শান্তির ধর্ম। কেন যে নাস্তিকরা এর বিরুদ্ধে খালি কটূক্তি করে? এমন সময় তার শিক্ষিত সভ্য মার্জিত স্বভাবের স্ত্রী পাশেই বসে ছিল। সে বসা থেকে উঠে ইমরানের গালে কষে একটা চড় মারে। ইমরান ভ্যাবলার মত তার দিকে চেয়ে থাকে। কেন চড় খেলো কিছুই বুঝতে পারে না। অদ্ভুত কাণ্ড! কী আশ্চর্য!
হঠাত তার মনে পড়লো, তার শিক্ষিত আত্মনির্ভরশীল আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন স্ত্রী আরবী জানে, বাঙলা অর্থও।