“একজন মূর্খ পুরোহিত যে সংস্কৃত মন্ত্রের অর্থ না জেনেই শ্রাদ্ধ বা বিবাহের মন্ত্র পড়ায়, তার সামাজিক সম্মান তাঁতি বা মুচীর চাইতে বেশি কেন হবে? তাঁতী বা মুচী পরিশ্রম দ্বারা সমাজের একটা বিশেষ কাজ করে, কিন্তু মূর্খ পুরোহিতকে প্রতারক ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে ? কসাইর ছেলের যদি প্রতিভা থাকে, তাহলে ইউরোপে সে শেক্সপিয়ার হতে পারত, কিন্তু এদেশে প্রাচীন প্রথা অনুসারে সে ‘রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘কালিদাস’ হতে পারত না, হবার চেষ্টা করলে ভগবানের অবতার রামচন্দ্র স্বয়ং এসে তার মাথা কেটে বর্ণাশ্রমধর্ম রক্ষা করতেন।” [1]
এই মন্তব্যটি করেছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। কথা প্রসঙ্গে মেঘনাদ রামচন্দ্রের শূদ্র শম্বুক হত্যার ঘটনার উল্লেখ করেন। রামায়ণে রামচন্দ্রকে এই নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত হতে দেখা যায়। কেবলমাত্র তপস্যা করার অপরাধেই রাম এক শূদ্রের মস্তকচ্ছেদন করেন।
রামায়ণে শূদ্রের মাথা কেটে বর্ণাশ্রমধর্ম রক্ষার করার প্রচেষ্টা আমাদের চোখে যেমন পড়ে, তেমনি মহাভারতে আমরা দেখতে পাই নিচু জাতির হওয়ার কারণে একলব্য দ্রোণাচার্যের কাছে জাতিবৈষম্যের শিকার হন। এরপরও যখন একলব্যের অগ্রগতিকে রোধ করা গেল না, তখন দ্রোণাচার্য আর অর্জুন ষড়যন্ত্র করে একলব্যের আঙ্গুল কাটিয়ে দেন। নিম্ন বর্ণের প্রতি এই যে অবিচার, তার উদাহরণ হিন্দু শাস্ত্রে এবং সমাজে অহরহ।
মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন দ্রোণাচার্য। দ্রোণ কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু ছিলেন ।কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় দ্রোণ কৌরবদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। মহাভারতের প্রধান আরেকটি চরিত্র হলেন অর্জুন। অর্জুন পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। অর্জুন কুন্তীর তৃতীয় পুত্র ছিলেন। মহাভারতের যে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলা হয়ে থাকে, তাতে বিজয়ী হয়েছিলেন পাণ্ডবেরা এবং তাদেরই সর্বদা ধার্মিক হিসাবে দেখানোর প্রচেষ্টা চলেছে। এই তথাকথিত ধার্মিকেরাও কিন্তু অনেকসময় অধার্মিকের ( অন্যায়কারীর) মতো আচরণ করেছিলেন। একলব্যের সাথে যে অন্যায় হয়েছিল, সেই অন্যায়ের সাথে কৌরব ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণ এবং অর্জুন এই দুজনের নাম জড়িয়ে আছে।
কৌরব ও পাণ্ডবরা দ্রোণের কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিখতেন। দ্রোণাচার্য একবার অর্জুনের প্রতি খুশি হয়ে অর্জুনকে এই বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন-
“বৎস! আমি সত্যি বলছি, এই পৃথিবীতে তোমার তুল্য দ্বিতীয় ধনুর্ধর যাতে প্রখ্যাত না হয়, এমন ব্যবস্থা করবো।“
এরপর দ্রোণের যুদ্ধে পারদর্শীতার কথা যখন চারপাশে ছড়িয়ে পরে, তখন হাজার হাজার রাজা ও রাজকুমার তার কাছে ধনুর্বেদ শেখার জন্য চারদিক থেকে আসতে থাকেন। একদিন ‘নিষাদরাজ হিরণ্যধনু’-র পুত্র একলব্য দ্রোণের কাছে উপস্থিত হন। কিন্তু হায়! দ্রোণাচার্য কেবলই একলব্যের জাত দেখে তাকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে অস্বীকার করেন। মহাভারত হতে এই অংশটির উদ্ধৃতি দেওয়া যাকঃ
“একদা নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য দ্রোণের কাছে এলেন।কিন্তু সে অস্পৃশ্য , ম্লেচ্ছ জাতি, সাধারণের সতীর্থ ও সমতুল্য হয়, এটা নিতান্ত অনভিপ্রেত, একথা বিবেচনা করে দ্রোণ তাকে ধনুর্বেদে দিক্ষিত করলেন না।“
দ্রোণ কেমন শিক্ষক ছিলেন? মানুষ হিসাবেই বা তিনি কেমন ছিলেন? এই প্রশ্নগুলি এই অংশটি পড়ার পর মনে উদিত হয়। মহাভারতের সময়কালেও জাতপাত কিভাবে বিদ্যমান ছিল এই অংশেই তার প্রমাণ মেলে। দ্রোণ একজন নিষাদকে, একজন অস্পৃশ্য, ম্লেচ্ছকে কোনোদিনো সাধারণদের সমান হতে দিতে চাননি। এই বর্ণবাদীরা সবসময় উচ্চনীচ ভেদাভেদ তৈরি করে, নিচু জাতির লোকেদের পায়ের তলায় পিষে মারতে চেয়েছে। তারা কখনো তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের তাদের কাধের সাথে কাধ মিলিয়ে চলতে দেয়নি। একজন শিক্ষকের এমন মানসিকতা যে হতে পারে তা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারিনা।
একলব্য দ্রোণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলেও থেমে থাকার পাত্র ছিলেন না। একলব্য বনের মধ্যে দ্রোণের একটি মাটির প্রতিমা নির্মাণ করেন। এই মাটির প্রতিমাকেই গুরু বলে স্বীকার করে নিজে নিজেই অস্ত্রবিদ্যা শিখতে শুরু করেন তিনি। কিছুসময়ের মধ্যেই তিনি ধনুর্বিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
একদিন কৌরব-পাণ্ডব ভাইয়েরা শিকার করার জন্য বনে গমন করেন। মৃগয়ার জন্য একটি কুকুরও সাথে নিয়েছিলেন তারা। সেই কুকুরটি একটি হরিণকে অনুসরণ করতে করতে নিষাদপুত্র একলব্যের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং একলব্যকে দেখে সে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে। তখন একলব্য একসাথে সাতটি তীর সেই কুকুরটির মুখের ভেতর নিক্ষেপ করেন। কুকুরটি সেই অবস্থায় পাণ্ডবদের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। পাণ্ডবেরা কুকুটির মুখে প্রবেশ করা সেই সাতটি তীর দেখে ভীষণ অবাক হয়ে যান। সেই ধনুর্ধর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই কুকুরটির মুখে শব্দভেদী তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। সেই ধনুর্ধরের দক্ষতা বিচার করে পাণ্ডবেরা নিজেদের অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট বুঝতে পেরে ভীষণ লজ্জিত হলেন। এরপর পাণ্ডবেরা বনের ভেতর সেই তীরন্দাজকে খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে এক বনবাসীকে অনবরত তীর বর্ষণ করতে দেখতে পান তারা। পাণ্ডবেরা ‘ঐ বিকৃত দর্শন পুরুষকে’ (১) চিনতে না পারায়, তাকে তার পরিচয় দিতে বলেন। পাণ্ডবদের একলব্য বলেন,
“আমি নিষাদপতি হিরন্যধনুর পুত্র, দ্রোণের শিষ্য, এই আশ্রমে একাই ধনুর্বেদ অনুশীলন করছি!”
পাণ্ডবেরা ঐ বিস্ময়কর ধনুর্ধরের পরিচয় জানতে পেরে গুরু দ্রোণের কাছে গিয়ে উপস্থিত হন এবং দ্রোণকে সবকিছু বিস্তারিত বলেন। অর্জুন দ্রোণকে বলেন,
“গুরু! আপনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, তোমার থেকে আমার অন্য কোনো শিষ্যই উৎকৃষ্ট হবে না, কিন্তু এখন তো এর বিপরীত জিনিস দেখা যাচ্ছে। নিষাদপতির পুত্র মহাবল একলব্য আপনার এক শিষ্য, সে ধনুর্বেদে আমার থেকেও অনেক বেশি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে!“
অর্জুনের কথা শুনে, অর্জুনকে সাথে নিয়ে দ্রোণ সেই বনে গিয়ে উপস্থিত হন। দ্রোণ সেখানে দেখতে পান নিষাদপুত্র একলব্য বারবার তীর নিক্ষেপ করে অভ্যাস করছেন। দ্রোণকে দেখতে পেয়ে একলব্য দ্রোণের ‘পাদবন্দন’ করে নিজেকে তার শিষ্য বলে পরিচয় দেন এবং বিধি অনুযায়ী তার পূজা করেন।
দ্রোণের ‘পাদবন্দন’ এবং পূজা শেষ হলে দ্রোণ একলব্যকে বলেন, “ হে বীর! যদি তুমি আসলেই আমার শিষ্য হয়ে থাক, তবে এখন গুরুদক্ষিণা প্রদান কর।“
দ্রোণের কথা শুনে একলব্য অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন,
“ভগবন! গুরুকে অদেয় কিছুই নেই। এখন আপনাকে কেমন দক্ষিণা দেব, আপনি আজ্ঞা করুন।“
একলব্যের এই কথা শুনে দ্রোণ তাকে বললেন,
“হে বীর! যদি সম্মত হয়ে থাক, তবে ডান হাতের একটি আঙ্গুল কেটে দক্ষিণা হিসেবে আমাকে তা সম্প্রদান কর।
দ্রোণের এই নির্মম কথা শুনেও একলব্য বিচলিত হলেন না। তিনি অত্যন্ত খুশিমনে তার ডানহাতের একটি আঙ্গুল কেটে দ্রোণকে গুরুদক্ষিণা প্রদান করলেন। গুরুদক্ষিণার নামে দ্রোণের ছলের কাছে খুন হল একলব্যের প্রতিভা, তার ভবিষ্যৎ। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একলব্যের আঙ্গুল যদি সেদিন না কাটানো হত, তবে কে হত শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর?
এরপর একটি আঙ্গুল ছাড়াই একলব্য তার অন্য সব আঙ্গুল দিয়ে তীর নিক্ষেপ করে দেখলেন কিন্তু তার তীরের গতিবেগ আর আগের মত রইলো না।
একলব্যকে তার আঙ্গুল কাটতে দেখে তথাকথিত ধার্মিক পাণ্ডবদের অন্যতম অর্জুন ভীষণ খুশি হলেন। তাকে এখন ধনুর্বিদ্যায় আর কে পরাজিত করবে? আর কে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ হবে? মহাভারত অর্জুনের মনোভাবকে ঠিক এইভাবে ব্যক্ত করেছে-
“অর্জুন এমন অদ্ভুত ব্যপার দেখে অতিশয় প্রীত ও প্রসন্ন হলেন। তখন তার অপকর্ষ বিষয়ক আশঙ্কা দূর হল। এই পৃথিবীতে অর্জুনকে কেউই পরাজিত করতে পারবে না, দ্রোণাচার্যের এই প্রতিজ্ঞারও রক্ষা হল।“ [2] [3]
প্রথমেই অস্পৃশ্য বলে দ্রোণাচার্যের কাছে জাতিবৈষম্যের শিকার হন একলব্য । সে নিষাদজাতির বলে, ম্লেচ্ছ বলে, অস্পৃশ্য বলে দ্রোণ তাকে শিক্ষা হতে বঞ্চিত করেন। যখন তিনি একাই ধনুর্বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন তখন কূটচালের মাধ্যমে তার আঙ্গুল কাটিয়ে দেন অর্জুন, দ্রোণাচার্য। এই হল মহাভারতের এক নায়ক অর্জুনের চরিত্র! নিজ যোগ্যতায় একলব্যের চাইতে বেশি পারদর্শী হওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না! একলব্যের ন্যায় অধ্যাবসায় ও সৎসাহস অর্জুনের মধ্যে ছিল না বলেই এমন কূট ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগীকেই সরিয়ে দেন কুন্তিনন্দন অর্জুন! এই বীরের বীরত্বের স্বরূপ? এই ধর্মযুদ্ধের নায়কের চরিত্র? ধিক সেই ধর্মকে! ধিক সেই ধর্মযুদ্ধকে!
টিকা-
১/খুব সম্ভবত নিষাদেরা আর্য সমাজ বহির্ভূত কোনো জাতি ছিল। এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যও আর্যদের থেকে আলাদা ছিল। নিষাদপুত্র একলব্যকে এখানে বিকৃত দর্শন পুরুষ বলা হয়েছে
স্ক্রিনশটঃ
তথ্যসূত্র
- আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দু ধর্ম; ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত মেঘনাদ সাহার প্রবন্ধ [↑]
- কালিপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক অনূদিত মহাভারত/ আদিপর্ব/ ১৩২ অধ্যায়[↑]
- কিশোরী মোহন গাঙগুলির মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদ/ আদি পর্ব/ ১৩৪ অধ্যায় [↑]
Leave a Comment