হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাস: একটি ঐতিহ্য নির্মাণ ও সংরক্ষণের সমালোচনামূলক পাঠ
সূচিপত্র
- 1 ভূমিকা: একটি ঐতিহাসিক ধাঁধা এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণ
- 2 প্রথম পর্ব: মুহাম্মদের যুগ এবং মৌখিক সংস্কৃতির ভিত্তি (আনুমানিক ৬১০-৬৩২ খ্রি.)
- 3 দ্বিতীয় পর্ব: উত্তরসূরীদের যুগ এবং সনদ (Isnad) ব্যবস্থার উদ্ভব (আনু. ৬৩২-৭৫০ খ্রি.)
- 3.1 জ্ঞানের জন্য সফর (আর-রিহলা): তথ্যের ভৌগোলিক বিস্তার ও সংগ্রহের প্রচেষ্টা
- 3.2 সনদ ব্যবস্থার উদ্ভব: একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ না রাজনৈতিক প্রয়োজন?
- 3.3 সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি: সনদ কি আদৌ নির্ভরযোগ্য?
- 3.4 তৃতীয় পর্ব: সংকলনের স্বর্ণযুগ: প্রামাণ্যতার নির্মাণ ও ক্যানন প্রতিষ্ঠা (আনু. ৭৫০-৯০০ খ্রি.)
- 3.5 সংকলনের বিভিন্ন পদ্ধতি ও তার বিবর্তন
- 3.6 ছয়টি গ্রন্থ ও একটি ‘ক্যানন’ নির্মাণ (সিহাহ সিত্তাহ)
- 3.7 বুখারি ও মুসলিম: প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠার কারিগর
- 3.8 সমালোচনামূলক পাঠ: একটি আদর্শিক নির্বাচন প্রক্রিয়া
- 4 চতুর্থ পর্ব: হাদিস সমালোচনার শাস্ত্র: পদ্ধতি, অর্জন এবং সীমাবদ্ধতা
- 5 পঞ্চম পর্ব: মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতা: প্রাচ্যবাদ, প্রতিক্রিয়া এবং নতুন জিজ্ঞাসা
- 6 আধুনিক যুগ: ডিজিটাল বিপ্লব, সংস্কারবাদ এবং নতুন বিতর্ক
- 7 উপসংহার: ইতিহাস, বিশ্বাস এবং এক অমীমাংসিত বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ
- 8 তথ্যসূত্র
ভূমিকা: একটি ঐতিহাসিক ধাঁধা এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণ
ইসলামী ইতিহাস অনুসারে সপ্তম শতাব্দীর আরবের শুষ্ক, ধূলিময় ভূখণ্ডে এক যুগান্তকারী ব্যক্তিত্ব, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, কেবল একটি নতুন একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রচার করেননি, বরং একটি সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থারও গোড়াপত্তন করেন। তাঁর অনুসারীদের কাছে তাঁর প্রচারিত ঐশী গ্রন্থ, কুরআন, দ্রুতই সর্বোচ্চ এবং অকাট্য ধর্মীয় নির্দেশিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর প্রতিটি বাণী, তাঁর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এবং এমনকি তাঁর মৌন সম্মতিও এক বিশাল ও জটিল জ্ঞানকাণ্ডের জন্ম দেয়, যা সম্মিলিতভাবে ‘হাদিস’ নামে পরিচিত। কালক্রমে এই হাদিস ইসলামি সভ্যতা, আইনশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব এবং সামাজিক চেতনার দ্বিতীয় প্রধান উৎস হিসেবে কুরআনের পাশাপাশি প্রায় সমমর্যাদায় স্থান করে নেয়।
আজ, চৌদ্দশ’ বছরেরও বেশি সময় পর, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ তাদের ব্যক্তিগত নৈতিকতা থেকে শুরু করে পারিবারিক আইন, সামাজিক আচরণ, অর্থনৈতিক লেনদেন এবং রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবব্যবস্থা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই হাদিসের উপর নির্ভর করে। কিন্তু একজন ঐতিহাসিকের জন্য এখানে একটি মৌলিক এবং প্রায় অনতিক্রম্য ধাঁধার উদ্ভব হয়: সপ্তম শতাব্দীর একটি প্রধানত মৌখিক সংস্কৃতিতে (oral culture) প্রচলিত হাজার হাজার কথা, কাজ এবং সম্মতিগুলো কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালিত হয়ে শত শত বছর পর লিখিত পাণ্ডুলিপিতে এমন একটি সুশৃঙ্খল, ব্যাপক এবং দৃশ্যত প্রামাণ্য রূপ লাভ করল? বিশেষত এমন এক যুগে, যখন লিখন সামগ্রী ছিল অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য, সাক্ষরতার হার ছিল নগণ্য এবং মানুষের পরিবর্তনশীল স্মৃতিই ছিল তথ্য সংরক্ষণের প্রধান এবং প্রায়শই একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
এই প্রশ্নের উত্তর কোনো সরলরৈখিক গল্পে পাওয়া সম্ভব নয়। এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা একটি জটিল ও বহুস্তরীয় ইতিহাসের মুখোমুখি হই, যা একই সাথে মানুষের অসাধারণ স্মৃতিচারণ ক্ষমতা, জ্ঞান অন্বেষণের জন্য অকল্পনীয় ত্যাগ এবং তথ্য যাচাইয়ের জন্য উদ্ভাবিত এক অনন্য পদ্ধতির আখ্যান। আবার ঠিক তেমনই, এটি একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বা ‘ক্যানন’ (canon) নির্মাণের গল্প, যেখানে রাজনৈতিক সংঘাত, ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক, সামাজিক প্রয়োজন এবং গোষ্ঠীগত আধিপত্য একটি নির্দিষ্ট বয়ানকে ‘বিশুদ্ধ’ বা ‘সহিহ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে এবং অগণিত বিকল্প বয়ানকে প্রান্তিক, দুর্বল বা চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এই দীর্ঘ, শ্রমসাধ্য এবং দ্বন্দ্বমুখর সফরের নামই ‘হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাস’।
এই প্রবন্ধে আমরা কোনো প্রকার ধর্মীয় বিশ্বাস বা পূর্বানুমান ছাড়াই, একজন ঐতিহাসিকের নির্মোহ ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে হাদিস নামক এই বিশাল জ্ঞানকাণ্ডের উদ্ভব, বিকাশ, প্রামাণ্যকরণ প্রক্রিয়া এবং তার অন্তর্নিহিত পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতাগুলোকে বিশ্লেষণ করব। আমরা দেখব, কীভাবে মৌখিক ঐতিহ্য লিখিত রূপ পেল, কীভাবে সত্য-মিথ্যা নিরূপণের জন্য ‘সনদ’ (isnad) বা বর্ণনা-পরম্পরা ব্যবস্থার জন্ম হলো এবং এই পদ্ধতিটি আধুনিক ঐতিহাসিক মানদণ্ডে কতটা নির্ভরযোগ্য। একইসাথে, আমরা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী প্রাচ্যবিদ থেকে শুরু করে আধুনিক মুসলিম সংস্কারবাদী এবং সমসাময়িক গবেষকদের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোও পর্যালোচনা করব, যা এই শাস্ত্রের ঐতিহাসিকতা ও প্রামাণ্যতা নিয়ে গভীর এবং প্রায়শই অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছে। এটি কোনো একক গোষ্ঠীর সাফল্যের উপাখ্যান নয়, বরং একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের নির্মাণ, তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং তার সীমাবদ্ধতা উন্মোচনের এক বস্তুনিষ্ঠ প্রয়াস।
প্রথম পর্ব: মুহাম্মদের যুগ এবং মৌখিক সংস্কৃতির ভিত্তি (আনুমানিক ৬১০-৬৩২ খ্রি.)
যেকোনো ঐতিহাসিক পর্যালোচনার শুরুটা করতে হয় মূল প্রেক্ষাপট থেকে। হাদিসের ক্ষেত্রে সেই প্রেক্ষাপট হলো সপ্তম শতাব্দীর আরব উপদ্বীপ—একটি উপজাতীয়, প্রধানত যাযাবর এবং এক শক্তিশালী মৌখিক সংস্কৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজ। এই সমাজে লিখন ছিল একটি বিশেষায়িত এবং সীমিত দক্ষতা, কিন্তু স্মৃতি ছিল সর্বজনীন এবং অপরিহার্য। প্রাক-ইসলামি আরবে কাব্য (শি’র), বংশলতিকা (নসব) এবং গোত্রীয় বীরত্বগাথা ও যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি (আইয়াম আল-আরব) প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে প্রচলিত হতো। একজন কবির সম্মান নির্ভর করত তাঁর কাব্যিক দক্ষতার উপর, আর একজন নেতার প্রভাব নির্ভর করত তাঁর বাগ্মিতা ও প্রজ্ঞার উপর। এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যেই হাদিসের প্রাথমিক বীজ উপ্ত হয়েছিল। মুহাম্মদের অনুসারীরা, যাদের ইসলামি পরিভাষায় ‘সাহাবী’ বলা হয়, তাঁরা ছিলেন এই সুপ্রতিষ্ঠিত মৌখিক ঐতিহ্যেরই ধারক ও বাহক। তাদের কাছে শোনা কথা মনে রাখা এবং তা অন্যের কাছে বর্ণনা করা ছিল এক স্বাভাবিক ও সহজাত প্রক্রিয়া।
তথ্য সঞ্চালনের পদ্ধতি: শোনা, দেখা এবং অনুমোদন
মুহাম্মদের অনুসারীরা তাঁর জীবন ও শিক্ষাকে তিনটি প্রধান উপায়ে আত্মস্থ ও সঞ্চালন করত:
১. বাচনিক ঐতিহ্য (কওলি): এটি হলো মুহাম্মদ যা সরাসরি মুখে বলেছেন—তাঁর প্রকাশ্য ভাষণ, ব্যক্তিগত কথোপকথন, কোনো অনুসারীর প্রশ্নের উত্তর, বা কোনো বিষয়ে দেওয়া সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এই বর্ণনাগুলো প্রায়শই “ক্বালা রাসূলুল্লাহ” (আল্লাহর রাসূল বলেছেন) এই শব্দগুচ্ছ দিয়ে শুরু হতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো তাঁর জীবনের শেষ দিকে দেওয়া ‘বিদায়ী হজ্জের ভাষণ’, যা একাধিক সূত্রে বিভিন্ন আকারে বর্ণিত হয়েছে। যদিও ভাষণের প্রতিটি শব্দ নিয়ে বর্ণনাকারীদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, এর মূল বার্তাগুলো—যেমন, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বিলোপ, নারীর অধিকার এবং পরস্পরের রক্ত ও সম্পদের পবিত্রতা—মুসলিম সমাজে বহুল প্রচারিত ও গৃহীত।
২. কর্মভিত্তিক ঐতিহ্য (ফেলি): এটি হলো মুহাম্মদ যা নিজে করে দেখিয়েছেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁকে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করত এবং তাঁর প্রতিটি কাজকে অনুকরণের চেষ্টা করত, কারণ তাঁর কর্মকে আদর্শ বা ‘সুন্নাহ’ হিসেবে গণ্য করা হতো। তাঁর প্রার্থনা বা উপাসনার (সালাত) পদ্ধতি, হজ্জ পালনের খুঁটিনাটি নিয়মাবলী, রোজা রাখার রীতি, ব্যবসায়িক লেনদেন, এমনকি খাওয়ার আদব বা পোশাক পরার ধরনের মতো ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনুসারীরা বলত, “আমরা রাসূলকে এভাবে করতে দেখেছি।” এই পর্যবেক্ষণভিত্তিক জ্ঞানই ইসলামি আইনশাস্ত্রের ব্যবহারিক দিকগুলোর ভিত্তি স্থাপন করে।
৩. মৌন সম্মতিসূচক ঐতিহ্য (তাকরিরি): তাঁর অনুসারীরা তাঁর সামনে কোনো কাজ করলে বা কোনো কথা বললে, তিনি যদি তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপত্তি না করে নীরব থাকতেন, তবে সেই নীরবতাকে তাঁর সম্মতি বা অনুমোদন হিসেবে গণ্য করা হতো। এটি এক প্রকার পরোক্ষ বৈধতা প্রদান। যেমন, একটি বিখ্যাত বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁর অনুসারী খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে এক অভিযানে তাঁর উপস্থিতিতে ‘দব্ব’ (এক প্রকার মরুভূমির সরীসৃপ) ভক্ষণ করা হলে তিনি নিজে তা খাননি, কিন্তু খেতে বাধাও দেননি। এই ঘটনাটিকে পরবর্তীকালে ইসলামি আইনশাস্ত্রে দব্ব খাওয়ার বৈধতার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তাঁর অনুসারীদের মধ্যে এই শিক্ষাগুলো গ্রহণের তীব্র আগ্রহ ছিল। উমর ইবনে খাত্তাব নামক একজন প্রভাবশালী অনুসারীর একটি ঘটনা প্রায়শই উল্লেখ করা হয়। তিনি মদিনার উপকণ্ঠে বসবাস করার কারণে প্রতিদিন মুহাম্মদের কাছে আসা সম্ভব হতো না। তাই তিনি তাঁর এক আনসার (মদিনার স্থানীয়) প্রতিবেশীর সাথে পালা করে একদিন পর পর মুহাম্মদের সান্নিধ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। একজন যেদিন যেতেন, তিনি ফিরে এসে অপরজনকে দিনের সমস্ত নতুন ওহি (ঐশী বাণী), হাদিস এবং অন্যান্য ঘটনা বিস্তারিত জানাতেন (al-Bukhari)। এই ঘটনাটি যদি ঐতিহাসিকভাবে সঠিক হয়, তবে এটি প্রমাণ করে যে, মুহাম্মদের শিক্ষা সংরক্ষণের জন্য তাঁর অনুসারীদের মধ্যে প্রথম থেকেই এক ধরনের সচেতন ও কাঠামোবদ্ধ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বিদ্যমান ছিল।
লিখন বনাম স্মৃতি: একটি চলমান ঐতিহাসিক বিতর্ক
একটি বহুপ্রচলিত ধারণা হলো, মুহাম্মদের যুগে হাদিস লেখার চেয়ে মুখস্থ করার উপরই বেশি জোর দেওয়া হতো। এই ধারণার পেছনে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তৎকালীন আরব সমাজের মৌখিক প্রকৃতির কারণে স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত মূল্যবান এবং সম্মানিত একটি দক্ষতা। এই অসাধারণ স্মৃতিশক্তিই হাদিস সংরক্ষণের প্রাথমিক এবং প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল (Siddiqi, 1993)।
তবে বিষয়টি আরও জটিল। ঐতিহ্যগত ইসলামি সূত্রানুযায়ী, মুহাম্মদ প্রথমদিকে হাদিস লিখতে নিষেধ করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, সেই সময়ে কুরআন অবতীর্ণ হচ্ছিল এবং তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁর নিজের কথা (হাদিস) ঐশী বাণী বা কুরআনের আয়াতের সাথে মিশে যেতে পারে, যা এক অগ্রহণযোগ্য সংশোধন বিভ্রান্তি তৈরি করবে। একটি বহুল উদ্ধৃত বর্ণনায় আবু সাঈদ খুদরি থেকে পাওয়া যায়, মুহাম্মদ বলেন, “আমার কাছ থেকে কুরআন ছাড়া আর কিছুই লিখবে না। যে আমার থেকে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু লিখেছে, সে যেন তা মুছে ফেলে” (Muslim ibn al-Hajjaj)।
কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা কি সার্বজনীন ও চিরস্থায়ী ছিল? একাধিক বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, তা ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সাময়িক ও প্রেক্ষাপট-নির্ভর নির্দেশনা। যখন তাঁর অনুসারীরা কুরআন ও তাঁর কথার শৈলী, মর্যাদা এবং উৎসের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হলো, তখন লেখার অনুমতি দেওয়া হয়। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, একজন তরুণ ও উৎসাহী অনুসারী, যিনি মুহাম্মদের মুখ থেকে শোনা সবকিছু লিখে রাখতেন। কিছু কুরাইশ নেতা তাঁকে নিরুৎসাহিত করে বলেন যে, মুহাম্মদ একজন মানুষ হিসেবে কখনো আনন্দের মুহূর্তে কথা বলেন, কখনো রাগের মুহূর্তে; তাই তাঁর সব কথা লেখা উচিত নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর দ্বিধান্বিত হয়ে বিষয়টি মুহাম্মদকে জানালে, তিনি নিজের মুখের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “লেখো, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, এই মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া কিছু বের হয় না” (Abu Dawud)। আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের এই লিখিত সংকলনটি পরবর্তীকালে ‘আস-সাহিফা আস-সাদিকা’ (সত্যনিষ্ঠ পাণ্ডুলিপি) নামে পরিচিতি লাভ করে (Azami, 1977)।
অন্যান্য উদাহরণও পাওয়া যায়। মুহাম্মদের নির্দেশে বিভিন্ন গোত্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তিপত্র (যেমন মদিনা সনদ), বিদেশি শাসকদের কাছে পাঠানো চিঠি এবং যাকাতের (বাধ্যতামূলক দান) হার সম্পর্কিত বিধানাবলী লিখে রাখা হতো। মক্কা বিজয়ের পর দেওয়া একটি ভাষণের পর আবু শাহ নামক ইয়েমেনের এক ব্যক্তির অনুরোধে ভাষণটি লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল (al-Bukhari)। সুতরাং, লিখন প্রক্রিয়া একেবারেই অনুপস্থিত ছিল না, বিশেষ করে প্রশাসনিক ও আইনগত বিষয়গুলোতে।
কিন্তু এখানে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য।
- প্রথমত, এই লিখিত পাণ্ডুলিপিগুলোর কোনোটিই মূল রূপে (original manuscript) আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। আমরা এগুলোর কথা জানতে পারি কয়েক শতাব্দী পরে লেখা জীবনী বা হাদিস গ্রন্থ থেকে, যা তাদের প্রামাণ্যতাকে পরোক্ষ করে তোলে।
- দ্বিতীয়ত, লিখন ছিল একটি সীমিত এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ; এটি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যাপক প্রক্রিয়া ছিল না।
- তৃতীয়ত, লিখন সামগ্রীর (চামড়া, খেজুর পাতা, উটের কাঁধের হাড়, পাথরের ফলক) সীমাবদ্ধতা এবং তৎকালীন সাক্ষরতার নিম্ন হার লিখন প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল (Sprenger, 1856)।
- চতুর্থত, মৌখিক বর্ণনা ও স্মৃতির উপর নির্ভরতার সংস্কৃতি এতটাই প্রবল ছিল যে, লিখিত পাঠ্যের চেয়ে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির মুখ থেকে সরাসরি শোনা জ্ঞানকে অধিকতর খাঁটি মনে করা হতো।
সুতরাং, এটা বলা নিরাপদ যে, মুহাম্মদের যুগে এবং তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরের দশকে, হাদিস সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যম ছিল মৌখিক সঞ্চালন। আর মৌখিক সঞ্চালনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা হলো, তথ্য যখন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সঞ্চালিত হয়, তখন তা অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তিত, সংক্ষিপ্ত, সম্প্রসারিত বা বিকৃত হতে পারে। এই সম্ভাবনাকে অস্বীকার করার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এবং এটিই হাদিসের ঐতিহাসিকতা বিষয়ক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
দ্বিতীয় পর্ব: উত্তরসূরীদের যুগ এবং সনদ (Isnad) ব্যবস্থার উদ্ভব (আনু. ৬৩২-৭৫০ খ্রি.)
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলামি সাম্রাজ্য আরব উপদ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে পারস্য, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সিরিয়া ও মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাঁর প্রত্যক্ষ অনুসারীরা (সাহাবীরা) সেনা কমান্ডার, গভর্নর, বিচারক বা শিক্ষক হিসেবে এই নতুন বিজিত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে মক্কা ও মদিনার বাইরে ইরাকের কুফা ও বসরা, সিরিয়ার দামেস্ক এবং মিশরের ফুসতাতের মতো শহরগুলো জ্ঞানের নতুন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
এই সময়ে একটি নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে, যারা মুহাম্মদকে দেখেনি কিন্তু তাঁর অনুসারীদের (সাহাবী) কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছে। এদের ইসলামি পরিভাষায় ‘তাবেঈ’ বা উত্তরসূরী বলা হয়। সাহাবীরা একে একে মৃত্যুবরণ করতে শুরু করলে মুসলিম সমাজে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়। জ্ঞানের মূল উৎসগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই তা সংগ্রহ করার জন্য এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক তাগিদ ও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়।
জ্ঞানের জন্য সফর (আর-রিহলা): তথ্যের ভৌগোলিক বিস্তার ও সংগ্রহের প্রচেষ্টা
যেহেতু হাদিসের ধারক সাহাবীরা বিভিন্ন দূরবর্তী শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, তাই জ্ঞানপিপাসু উত্তরসূরীরা এক শহর থেকে অন্য শহরে দীর্ঘ ও কষ্টকর সফর শুরু করেন। একটি বা দুটি হাদিস শোনার জন্য বা কোনো একটি বর্ণনার সত্যতা যাচাই করার জন্য মাসব্যাপী উটের পিঠে চড়ে মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার অসংখ্য উদাহরণ তৎকালীন জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যায়। এই জ্ঞানযাত্রাকে ‘আর-রিহলা ফি তলাব আল-ইলম’ (জ্ঞানের সন্ধানে সফর) বলা হয় (al-Khatib al-Baghdadi)। এই সফরগুলো একদিকে যেমন প্রমাণ করে যে, মুহাম্মদের বাণীকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তেমনই অন্যদিকে এটি দেখিয়ে দেয় যে, হাদিস কোনো একক কেন্দ্রে সংরক্ষিত ছিল না, বরং তা ছিল ভৌগোলিকভাবে বিক্ষিপ্ত এবং বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিতে ধারণ করা এক বিশাল ও অসংগঠিত তথ্যভাণ্ডার। এই সফরগুলো বিভিন্ন আঞ্চলিক জ্ঞানকেন্দ্রের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান ঘটিয়ে একটি আন্তঃ-আঞ্চলিক জ্ঞান নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
সনদ ব্যবস্থার উদ্ভব: একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ না রাজনৈতিক প্রয়োজন?
এই যুগেই হাদিস শাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অনন্য এবং একই সাথে সবচেয়ে বিতর্কিত উপাদানটির জন্ম হয়—‘সনদ’ (Isnad) বা বর্ণনা-পরম্পরা। সনদ হলো একটি হাদিসের বর্ণনাকারীদের তালিকা, যা বর্তমান বর্ণনাকারী থেকে শুরু হয়ে মুহাম্মদের একজন সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছায়। যেমন: “ক আমাকে বলেছে যে, সে খ-এর কাছে শুনেছে, খ গ-এর কাছে শুনেছে, গ একজন সাহাবীর কাছে শুনেছে যে, মুহাম্মদ বলেছেন…”। একটি হাদিসের দুটি অংশ থাকে: (১) সনদ (বর্ণনাসূত্র) এবং (২) মতন (মূল বক্তব্য)।
ইসলামি ঐতিহ্য অনুযায়ী, সনদ ব্যবস্থার উদ্ভব একটি মহৎ উদ্দেশ্য থেকে হয়েছিল: সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করা। মুহাম্মদের মৃত্যুর কয়েক দশক পর, বিশেষ করে তৃতীয় খলিফা উসমানের হত্যাকাণ্ড (৬৫৬ খ্রি.) এবং তৎপরবর্তী রাজনৈতিক সংঘাত ও গৃহযুদ্ধ (প্রথম ফিতনা) মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিকভাবে গভীরভাবে বিভক্ত করে ফেলে। উমাইয়া, শিয়া, খারেজি এবং জুবাইরিদের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রতিটি দলই নিজ নিজ মতামতের বৈধতা প্রমাণের জন্য এবং প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য মুহাম্মদের নামে হাদিস তৈরি করতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, আলীর অনুসারীরা (শিয়া) তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য হাদিস তৈরি করে, অন্যদিকে উমাইয়া শাসকরা তাদের শাসনকে বৈধতা দিতে এবং তাদের বিরোধীদের সমালোচনা করে হাদিস প্রচার করে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে, তৎকালীন আলেমরা হাদিস গ্রহণের জন্য একটি কঠোর মানদণ্ড আরোপ করেন। এখন থেকে যে কেউ ‘মুহাম্মদ বলেছেন’ বলে কিছু বললেই তা গ্রহণ করা হতো না; তাকে অবশ্যই বলতে হতো সে কার কাছ থেকে শুনেছে। এই বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খল বা সনদ পরীক্ষা করে হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয় করার প্রথা চালু হয়।
মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (মৃত্যু ৭২৯ খ্রি.) নামক একজন বিখ্যাত তাবেঈর একটি উক্তি এই প্রেক্ষাপটে প্রণিধানযোগ্য: “পূর্বে আমরা সনদ নিয়ে প্রশ্ন করতাম না। কিন্তু যখন বিশৃঙ্খলা (ফিতনা) শুরু হলো, তখন আমরা বলতে শুরু করলাম, ‘তোমাদের বর্ণনাকারীদের নাম বলো’।” এই উক্তিটিকে ঐতিহ্যবাদীরা হাদিস যাচাইয়ের এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূচনা হিসেবে দেখেন (Muslim ibn al-Hajjaj)।
সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি: সনদ কি আদৌ নির্ভরযোগ্য?
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য গবেষক, বিশেষ করে হাঙ্গেরিয়ান প্রাচ্যবিদ ইগনাৎস গোল্ডজিহার (Ignaz Goldziher) এবং জার্মান-আমেরিকান গবেষক জোসেফ শ্যাকট (Joseph Schacht), সনদ ব্যবস্থার ঐতিহাসিকতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলেন। তাঁদের কাজ হাদিস গবেষণায় এক নতুন এবং বিতর্কিত ধারার সূচনা করে।
গোল্ডজিহার তাঁর প্রভাবশালী গ্রন্থ Muslim Studies (1890)-এ যুক্তি দেন যে, হাদিসের একটি বিশাল অংশ মুহাম্মদের কথা নয়, বরং উমাইয়া ও প্রাথমিক আব্বাসীয় যুগের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের প্রতিফলন। তিনি দেখান যে, বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের মতবাদকে শক্তিশালী করার জন্য হাদিস তৈরি করেছে এবং সেগুলোকে মুহাম্মদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। তাঁর মতে, সনদ ব্যবস্থা এই প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করার বদলে, একে আরও সহজ করে দিয়েছিল, কারণ একটি জাল সনদের মাধ্যমে যেকোনো বক্তব্যকে প্রামাণ্য করে তোলা সম্ভব ছিল (Goldziher, 1890)। গোল্ডজিহারের মতে, একটি হাদিসের সনদ যত নিখুঁত ও সম্পূর্ণ, সেটি তত পরবর্তী সময়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ জালিয়াতরা সময়ের সাথে সাথে নিখুঁত সনদ তৈরিতে দক্ষ হয়ে উঠেছিল।
জোসেফ শ্যাকট তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ The Origins of Muhammadan Jurisprudence (1950)-এ এই সমালোচনাকে আরও গভীরে নিয়ে যান। শ্যাকটের বিখ্যাত “argumentum e silentio” (নীরবতা থেকে যুক্তি) এবং “backwards projection” (পশ্চাৎ প্রক্ষেপণ) তত্ত্ব অনুযায়ী, সনদ হাদিস সংরক্ষণের আদিম পদ্ধতি নয়, বরং এটি দ্বিতীয় হিজরি শতকের শেষভাগে এবং তৃতীয় হিজরি শতকের শুরুতে বিকশিত একটি উদ্ভাবন। তিনি দেখান যে, প্রাথমিক যুগের (আনু. ৭৫০ খ্রি. পর্যন্ত) আইনগত বিতর্কে আলেমরা সাহাবী বা তাবেঈদের মতামতকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করতেন, মুহাম্মদের হাদিসকে নয়। যখন মুহাম্মদের বাণীকে সর্বোচ্চ ও অকাট্য দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা বাড়ল (বিশেষ করে ইমাম শাফি’ঈর প্রভাবে), তখন বিদ্যমান আইনগত মতামতগুলোর সমর্থনে একটি কৃত্রিম সনদ তৈরি করে তা মুহাম্মদের সময় পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হতো।
উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক, দ্বিতীয় শতাব্দীর কোনো আইনশাস্ত্রী একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁর শিক্ষক, যিনি একজন তাবেঈ ছিলেন, তাঁর মতামতকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করছেন। পরবর্তী প্রজন্মে, যখন মুহাম্মদের বাণীকে একমাত্র চূড়ান্ত দলিল হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো, তখন ঐ আইনশাস্ত্রীর ছাত্ররা হয়তো বলবেন, তাঁদের শিক্ষক এই মতামতটি একজন সাহাবীর কাছ থেকে শুনেছেন, যিনি এটি মুহাম্মদের কাছ থেকে শুনেছেন। এভাবে একটি তাবেঈর মতামত সময়ের সাথে সাথে মুহাম্মদের হাদিসে রূপান্তরিত হতো। শ্যাকটের মতে, সনদ ওপর থেকে নিচে (মুহাম্মদ থেকে পরবর্তী প্রজন্ম) আসেনি, বরং নিচ থেকে ওপরে (পরবর্তী আলেম থেকে মুহাম্মদ) তৈরি করা হয়েছে (Schacht, 1950)। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সনদ কোনো ‘ডিএনএ টেস্ট’ নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট বয়ানকে বৈধতা দেওয়ার সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণ। যদিও আধুনিক গবেষকরা (যেমন, Wael Hallaq) শ্যাকটের কিছু সিদ্ধান্তকে অতি সরলীকৃত বলে সমালোচনা করেছেন, তাঁর মূল তত্ত্বটি হাদিসের ঐতিহাসিকতা বিষয়ক একাডেমিক আলোচনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
তৃতীয় পর্ব: সংকলনের স্বর্ণযুগ: প্রামাণ্যতার নির্মাণ ও ক্যানন প্রতিষ্ঠা (আনু. ৭৫০-৯০০ খ্রি.)
হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষভাগ থেকে তৃতীয় শতক (আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর শেষ থেকে নবম শতাব্দী) পর্যন্ত সময়কালকে হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময়ে আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তৎকালীন আলেমদের সম্মিলিত উদ্যোগে বিক্ষিপ্তভাবে সংরক্ষিত মৌখিক ও লিখিত হাদিসগুলোকে সুবিন্যস্তভাবে গ্রন্থাকারে সংকলন করার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। এই সংকলন প্রক্রিয়াটি কেবল তথ্য সংরক্ষণ ছিল না, এটি ছিল একটি আদর্শিক বা ‘ক্যাননিক্যাল’ ঐতিহ্য নির্মাণ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে হাদিসের একটি নির্দিষ্ট সংস্করণকে সমাজের চোখে প্রামাণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সংকলনের বিভিন্ন পদ্ধতি ও তার বিবর্তন
১. অধ্যায়ভিত্তিক সংকলন (মুসান্নাফ ও মুয়াত্তা): প্রথম দিকের সংকলনগুলো ছিল মূলত আইনশাস্ত্রীয় (ফিকহি) বিষয়ভিত্তিক। ইমাম মালিক ইবনে আনাসের (মৃত্যু ৭৯৫ খ্রি.) ‘মুয়াত্তা’ এই ধারার প্রাচীনতম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থগুলোর একটি। এতে ইসলামি আইনের বিভিন্ন অধ্যায় (যেমন: পবিত্রতা, সালাত, যাকাত) অনুসারে হাদিস সাজানো হয়। তবে ‘মুয়াত্তা’-তে কেবল মুহাম্মদের কথাই নয়, তাঁর অনুসারী (সাহাবী) এবং উত্তরসূরীদের (তাবেঈ) কথাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি ছিল মূলত মদিনার আইনগত ঐতিহ্যের একটি সংকলন, মুহাম্মদের বাণীর একচেটিয়া সংগ্রহ নয় (Burton, 1994)। একই ধরনের আরও বৃহৎ সংকলনকে ‘মুসান্নাফ’ বলা হতো, যেমন ইমাম আব্দুর রাজ্জাক সানআনী (মৃত্যু ৮২৬ খ্রি.) বা ইবনে আবি শায়বার (মৃত্যু ৮৪৯ খ্রি.) মুসান্নাফ।
২. সাহাবীভিত্তিক সংকলন (মুসনাদ): এরপর একটি নতুন ধরনের সংকলন জনপ্রিয় হয়, যা ‘মুসনাদ’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে হাদিসগুলো বিষয়বস্তু অনুযায়ী না সাজিয়ে বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম অনুযায়ী সাজানো হতো। যেমন, আবু বকর বর্ণিত সমস্ত হাদিস একসাথে, তারপর উমর বর্ণিত হাদিস একসাথে। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের (মৃত্যু ৮৫৫ খ্রি.) ‘মুসনাদ আহমদ’, যা প্রায় ত্রিশ হাজার হাদিসের এক বিশাল সংগ্রহ। এই পদ্ধতির সুবিধা ছিল কোনো নির্দিষ্ট সাহাবীর বর্ণিত সব হাদিস এক জায়গায় পাওয়া, কিন্তু নির্দিষ্ট বিষয়ের হাদিস খুঁজে বের করা ছিল বেশ কঠিন এবং এতে সহিহ ও দঈফ (বিশুদ্ধ ও দুর্বল) হাদিসের মিশ্রণ ছিল।
ছয়টি গ্রন্থ ও একটি ‘ক্যানন’ নির্মাণ (সিহাহ সিত্তাহ)
হাদিস সংকলনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজটি হলো ছয়টি গ্রন্থ সংকলন, যা পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে সুন্নি মুসলিম বিশ্বে ‘সিহাহ সিত্তাহ’ বা ‘ছয়টি বিশুদ্ধ গ্রন্থ’ হিসেবে সর্বোচ্চ প্রামাণ্যতা লাভ করে। এই গ্রন্থগুলোর সংকলন ছিল হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি হাদিসের একটি নির্দিষ্ট সংস্করণকে ‘প্রামাণ্য’ বা ‘ক্যাননিক্যাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, যা মুসলিম বিশ্বের বিশাল একটি অংশের জন্য ধর্মীয় ও আইনগত আদর্শে পরিণত হয়। এই ছয়টি গ্রন্থ হলো:
- ১. সহিহ আল-বুখারি (সংকলক: মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল আল-বুখারি, মৃত্যু ৮৭০ খ্রি.)
- ২. সহিহ মুসলিম (সংকলক: মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, মৃত্যু ৮৭৫ খ্রি.)
- ৩. সুনান আবু দাউদ (সংকলক: আবু দাউদ সিজিস্তানি, মৃত্যু ৮৮৯ খ্রি.)
- ৪. জামি আত-তিরমিজি (সংকলক: আবু ঈসা আত-তিরমিজি, মৃত্যু ৮৯২ খ্রি.)
- ৫. সুনান আন-নাসায়ী (সংকলক: আহমদ ইবনে শুআইব আন-নাসায়ী, মৃত্যু ৯১৫ খ্রি.)
- ৬. সুনান ইবনে মাজাহ (সংকলক: মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মাজাহ, মৃত্যু ৮৮৭ খ্রি.)
এই ছয়টি গ্রন্থের মধ্যে প্রথম দুটি, সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম, সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। সুন্নি মুসলিমদের কাছে কুরআনের পর এই দুটি গ্রন্থই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, যা ‘সহিহাইন’ নামে পরিচিত।
বুখারি ও মুসলিম: প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠার কারিগর
ইমাম বুখারি এবং তাঁর ছাত্র ইমাম মুসলিম হাদিস যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অত্যন্ত কঠোর মানদণ্ড আরোপ করেন বলে ঐতিহ্যগতভাবে দাবি করা হয়। বুখারি প্রায় ছয় লক্ষ হাদিস থেকে যাচাই করে মাত্র সাড়ে সাত হাজারের মতো হাদিস (পুনরুক্তিসহ) তাঁর গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত শর্ত ছিল যে, সনদের প্রত্যেক বর্ণনাকারীর মধ্যে কেবল সমসাময়িক হলেই চলবে না, তাদের মধ্যে জীবনে অন্তত একবার সাক্ষাৎ (Liqa’ বা লিক্বা) হয়েছে বলে প্রমাণিত হতে হবে। তিনি প্রতিটি হাদিস সংকলনের আগে বিশেষ প্রার্থনা করতেন বলে কথিত আছে, যা তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠার পরিচায়ক হিসেবে দেখা হয়।
ইমাম মুসলিমের শর্ত কিছুটা শিথিল ছিল; তিনি সাক্ষাতের প্রমাণের বদলে সমসাময়িকতা (মু’আসারা) এবং সাক্ষাতের সম্ভাবনাকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তবে তাঁর গ্রন্থের বিন্যাস ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। তিনি একটি হাদিসের প্রাপ্ত সমস্ত সনদ ও পাঠভেদকে একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ের অধীনে একসাথে উল্লেখ করেছেন, যা তুলনামূলক গবেষণার জন্য খুবই সহায়ক।
অন্যান্য সুনান গ্রন্থ ও তাদের বৈশিষ্ট্য
- সুনান আবু দাউদ: এই গ্রন্থটি মূলত আইনগত বিধিবিধান (আহকাম) সম্পর্কিত হাদিসের জন্য বিখ্যাত। আবু দাউদ প্রায় পাঁচ লক্ষ হাদিস থেকে ৪৮০০ হাদিস সংকলন করেন। তিনি দুর্বল হাদিস অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় ছিলেন, বিশেষ করে যদি ওই বিষয়ে অন্য কোনো শক্তিশালী হাদিস না পাওয়া যেত।
- জামি আত-তিরমিজি: এই গ্রন্থের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, ইমাম তিরমিজি প্রতিটি হাদিস বর্ণনার পর সেটির মান (সহিহ, হাসান, দঈফ ইত্যাদি) উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও তিনি সেই হাদিস বিষয়ে বিভিন্ন সাহাবী, তাবেঈ এবং প্রখ্যাত আইনশাস্ত্রীদের (ফকিহ) মতামতও তুলে ধরতেন, যা এটিকে একটি তুলনামূলক আইনশাস্ত্রের গ্রন্থে পরিণত করেছে।
- সুনান আন-নাসায়ী: এই গ্রন্থটি বিশুদ্ধতার দিক থেকে বুখারি ও মুসলিমের পরেই স্থান দেওয়া হয়। ইমাম নাসায়ী বর্ণনাকারীদের সমালোচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন বলে পরিচিত।
- সুনান ইবনে মাজাহ: এই ছয়টি গ্রন্থের মধ্যে এটিকেই সবচেয়ে দুর্বল মনে করা হয় এবং এর ক্যাননিক্যাল মর্যাদা নিয়ে প্রাথমিক যুগে কিছুটা বিতর্কও ছিল। এতে বেশ কিছু দুর্বল ও এমনকি জাল হাদিসও স্থান পেয়েছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।
সমালোচনামূলক পাঠ: একটি আদর্শিক নির্বাচন প্রক্রিয়া
ঐতিহ্যগত দৃষ্টিতে বুখারি ও মুসলিমের কাজকে সত্যনিষ্ঠা ও কঠোরতার প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রক্রিয়াকে একটি ‘ক্যানন’ নির্মাণ বা আদর্শিক নির্বাচন প্রক্রিয়া হিসেবেও দেখা যায়। তাঁরা যে হাজার হাজার হাদিস থেকে মাত্র কয়েক হাজার হাদিস নির্বাচন করলেন, তার মানে হলো তাঁরা একটি বিশাল সংখ্যক বর্ণনাকে সচেতনভাবে বর্জন করেছেন। এই নির্বাচন ও বর্জনের পেছনে তাঁদের নিজস্ব ধর্মতাত্ত্বিক (যেমন, মু’তাজিলাদের যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্বের বিরোধিতা) ও আইনগত (যেমন, হানাফী ফিকহের কিছু মতের বিরোধিতা) দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে (Brown, 2009)।
তাঁদের সময়ে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের (শাসনকাল ৮৪৭-৮৬১ খ্রি.) পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আহল আল-হাদিস’ বা ঐতিহ্যবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব তুঙ্গে ছিল। খলিফা মু’তাজিলাদের যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন করেন এবং ঐতিহ্যবাদী সুন্নি মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করেন। বুখারি ও মুসলিমের সংকলনকে সেই প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যবাদী সুন্নি ইসলামের অবস্থানকে সুসংহত ও সংজ্ঞায়িত করার একটি সফল প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁরা এমন হাদিসগুলোকেই নির্বাচন করেছেন যা তাঁদের ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনগত অবস্থানকে সমর্থন করে। সুতরাং, তাঁদের কাজ কেবল নিষ্ক্রিয় সংরক্ষণ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সক্রিয় নির্মাণ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে হাদিসের একটি নির্দিষ্ট সংস্করণকে ‘সহিহ’ বা ‘নির্ভুল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বাকিগুলোকে প্রান্তিক, দুর্বল বা বিদআতী হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়।
চতুর্থ পর্ব: হাদিস সমালোচনার শাস্ত্র: পদ্ধতি, অর্জন এবং সীমাবদ্ধতা
মুসলিম মনীষীরা একটি হাদিসকে গ্রহণ বা বর্জন করার জন্য যে পদ্ধতিগত কাঠামো তৈরি করেছিলেন, তা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত: (১) বর্ণনাকারীদের জীবনী পরীক্ষণ (ইলম আর-রিজাল) এবং (২) হাদিসের পরিভাষা ও শ্রেণিবিন্যাস (মুসতালাহ আল-হাদিস)। এই শাস্ত্রগুলো নিঃসন্দেহে মধ্যযুগের মুসলিম পাণ্ডিত্যের এক অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন, যা তথ্যের উৎস বিশ্লেষণের একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছিল।
১. ইলম আর-রিজাল: বর্ণনাকারীদের জীবনবৃত্তান্তের বিজ্ঞান
এই শাস্ত্রের মূল কাজ হলো সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা। তাঁদের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ, শিক্ষক, ছাত্র, ভ্রমণের বিবরণ, স্মৃতিশক্তি (দ্ববত), সততা ও ধার্মিকতা (আদালাহ) এবং রাজনৈতিক বা ধর্মতাত্ত্বিক মতাদর্শ—এই সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখা হতো। এই তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্যেক বর্ণনাকারীকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। এই প্রক্রিয়াকে ‘ইলম আল-জারহ ওয়াত তা’দিল’ (সমালোচনা ও সত্যায়ন শাস্ত্র) বলা হয়।
- তা’দিল (সত্যায়ন): কোনো বর্ণনাকারীকে নির্ভরযোগ্য (সিকাহ), অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য (সিকাহ সাবত), সত্যবাদী (সাদুক), বা ‘তাঁর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই’ (লা বা’সা বিহী) ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা।
- জারহ (সমালোচনা): কোনো বর্ণনাকারীকে দুর্বল (দঈফ), স্মৃতিতে দুর্বল (সাইয়্যি উল-হিফয), পরিত্যক্ত (মাতরুক), মিথ্যুক (কাযযাব) বা হাদিস জালকারী (ওয়াদ্দা’) হিসেবে চিহ্নিত করা।
এই কাজের জন্য লক্ষ লক্ষ বর্ণনাকারীর জীবনী সম্বলিত বিশাল বিশাল গ্রন্থ (যেমন: ইবনে হাজার আসকালানীর ‘তাহযিব আত-তাহযিব’ বা ইমাম যাহাবীর ‘সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা’) রচিত হয়েছে, যা মধ্যযুগের জীবনচরিত রচনার এক অবিশ্বাস্য উদাহরণ।
২. মুসতালাহ আল-হাদিস: শ্রেণিবিন্যাসের পরিভাষা
সনদ ও মূল বক্তব্যের অবস্থা পরীক্ষা করে হাদিসকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে প্রধান শ্রেণিগুলো হলো:
- সহিহ (নির্ভুল): সর্বোচ্চ মানের হাদিস, যা পাঁচটি কঠোর শর্ত পূরণ করে: (ক) অবিচ্ছিন্ন সনদ, (খ) সকল বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা (আদালাহ), (গ) সকল বর্ণনাকারীর নিখুঁত স্মৃতিশক্তি (দ্ববত), (ঘ) অন্য নির্ভরযোগ্য বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া (শুযুয মুক্ত), এবং (ঙ) কোনো সূক্ষ্ম বা গোপন ত্রুটি না থাকা (ইল্লাত মুক্ত)।
- হাসান (উত্তম): সহিহ-এর মতোই, তবে কোনো একজন বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি নিখুঁত না হলেও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের।
- দঈফ (দুর্বল): সহিহ বা হাসানের কোনো একটি শর্ত পূরণ না হলে হাদিসটি দুর্বল বলে গণ্য হয়। এর অনেক প্রকারভেদ আছে, যেমন: মুরসাল (সনদে সাহাবীর নাম অনুপস্থিত), মুনকাতি’ (মাঝখানে বর্ণনাকারী অনুপস্থিত), মু’দাল (পরপর দুজন বর্ণনাকারী অনুপস্থিত) ইত্যাদি।
- মওদু (জাল): যে কথাটি মুহাম্মদের নামে বানিয়ে বলা হয়েছে। এটি সবচেয়ে নিম্নস্তরের এবং এর বর্ণনাকারী গুরুতর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হতেন।
পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা: একটি আধুনিক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
মুসলিম পণ্ডিতদের তৈরি করা এই পদ্ধতিটি তার নিজস্ব পরিধির মধ্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম, বিস্তারিত এবং প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু একজন আধুনিক ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে এর কিছু মৌলিক পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা এর বস্তুনিষ্ঠতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে:
১. অভ্যন্তরীণ ও আত্ম-সমর্থক ব্যবস্থা (Circular Reasoning): এই পুরো ব্যবস্থাটি একটি বদ্ধ বৃত্তের মতো কাজ করে। বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা হয় পরবর্তী যুগের আলেমদের লেখা জীবনীগ্রন্থের উপর ভিত্তি করে, যাঁরা নিজেরাই একই ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ব্যবস্থার অংশ ছিলেন। তাঁদের মূল উৎস ছিল অন্যান্য বর্ণনাকারীদের সাক্ষ্য, কোন লিখিত দলিল বা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নয়। এখানে কোনো বাহ্যিক বা নিরপেক্ষ মানদণ্ড দিয়ে তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ প্রায় নেই (Cook, 1983)।
২. চরিত্রকেন্দ্রিক, বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক নয়: হাদিস সমালোচনা মূলত বর্ণনাকারীর চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি ‘ধার্মিক’ ও ‘সৎ’ হলেই তাঁর বর্ণিত কথাকে সঠিক ধরে নেওয়ার প্রবণতা প্রবল। কিন্তু আধুনিক ইতিহাস ও মনোবিজ্ঞান আমাদের শেখায় যে, একজন সৎ মানুষও অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল শুনতে, ভুল বুঝতে বা স্মৃতিবিভ্রাটের (confirmation bias, false memory) কারণে ভুলভাবে কোনো ঘটনা বর্ণনা করতে পারেন। এই পদ্ধতি হাদিসের মূল বক্তব্যের (মতন) যৌক্তিকতা, ঐতিহাসিক সম্ভাব্যতা বা অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতিকে ততটা গুরুত্ব দেয় না, যতটা দেয় সনদের বিশুদ্ধতাকে।
৩. ঐতিহাসিক বাস্তবতার অভাব: অনেক ‘সহিহ’ হাদিসেই এমন সব ভবিষ্যদ্বাণী, অলৌকিক ঘটনা বা তৎকালীন আরবের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে বেমানান বিবরণ পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিকভাবে যাচাই করা প্রায় অসম্ভব। যেমন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ঘটনা সম্পর্কিত বর্ণনা। কিন্তু সনদ ‘সহিহ’ হওয়ার কারণে সেগুলোকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করা হয়, যা আধুনিক ঐতিহাসিক পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক।
৪. পক্ষপাতদুষ্টতা (Sectarian Bias): ‘জারহ ওয়াত তা’দিল’ শাস্ত্রে প্রায়শই দেখা যায়, কোনো বর্ণনাকারীকে দুর্বল প্রতিপন্ন করা হয়েছে তাঁর ধর্মতাত্ত্বিক মতাদর্শের কারণে (যেমন, তিনি শিয়া, মু’তাজিলা, কাদারিয়া বা খারেজি পন্থী ছিলেন), তাঁর স্মৃতিশক্তি বা সততার প্রমাণিত দুর্বলতার কারণে নয়। এটি প্রমাণ করে যে, এই শাস্ত্রটি পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ ছিল না, বরং সমসাময়িক ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল (Robson, 1951)। একজন সুন্নি সমালোচকের কাছে একজন শিয়া বর্ণনাকারী সহজাতভাবেই সন্দেহভাজন ছিলেন, যদিও তার সততা ও স্মৃতিশক্তি ভালো হতে পারত।
সুতরাং, হাদিস সমালোচনার এই শাস্ত্রকে মুহাম্মদের কথা নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের একটি নিখুঁত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি না বলে, বরং একটি নির্দিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর দ্বারা তাদের নিজস্ব মানদণ্ডে একটি ঐতিহ্যকে প্রামাণ্যকরণ ও সুসংহত করার একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা অধিকতর যৌক্তিক।
পঞ্চম পর্ব: মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতা: প্রাচ্যবাদ, প্রতিক্রিয়া এবং নতুন জিজ্ঞাসা
হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগের পর এই শাস্ত্রের চর্চা থেমে যায়নি, বরং নতুন দিকে মোড় নেয়। পরবর্তী যুগের (আনুমানিক দশম থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী) আলেমরা মূলত পূর্ববর্তী সংকলিত গ্রন্থগুলোর উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা, ভাষ্য এবং সংক্ষিপ্তসার রচনায় মনোনিবেশ করেন। এটি ছিল এক প্রকার পাণ্ডিত্যপূর্ণ স্থিতিশীলতার যুগ।
ভাষ্য, সমন্বয় ও বিন্যাসের যুগ
- ব্যাখ্যাগ্রন্থ (শারহ): সহিহ বুখারি ও মুসলিমের মতো প্রধান গ্রন্থগুলোর উপর বিশাল বিশাল ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়। ইবনে হাজার আসকালানীর (মৃত্যু ১৪৪৯ খ্রি.) ‘ফাতহুল বারী’ (সহিহ বুখারির ভাষ্য) বা ইমাম নববীর (মৃত্যু ১২৭৭ খ্রি.) ‘শারহে মুসলিম’ এই ধারার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই গ্রন্থগুলো হাদিসের আইনগত, ভাষাগত, ধর্মতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে এবং বিভিন্ন হাদিসের মধ্যেকার আপাত বৈপরীত্যের সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে।
- সমন্বয় ও সংকলন: বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে নির্দিষ্ট বিষয়ের হাদিস একত্রিত করে নতুন ব্যবহারিক সংকলন তৈরি করা হয়, যেমন ইমাম নববীর ‘রিয়াদুস সালেহীন’ (সৎকর্মশীলদের উদ্যান) বা ‘আল-আরবাইন’ (চল্লিশ হাদিস), যা মুসলিম সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
প্রাচ্যবিদদের চ্যালেঞ্জ ও মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়া
ঊনবিংশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের আগমন এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রসারের সাথে সাথে মুসলিম বিশ্ব এক নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ইউরোপীয় গবেষকরা (প্রাচ্যবিদ বা Orientalist) ইসলামি উৎসগুলো নিয়ে ঐতিহাসিক-সমালোচনামূলক পদ্ধতিতে গবেষণা শুরু করেন। ইগনাৎস গোল্ডজিহার এবং জোসেফ শ্যাকটের মতো পণ্ডিতরা হাদিসের ঐতিহাসিকতা ও সনদ ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে যে মৌলিক প্রশ্ন তোলেন, তা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। তাঁদের কাজ মুসলিম বিশ্বে প্রথমে উপেক্ষিত হলেও, বিংশ শতাব্দীতে এটি এক তীব্র বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
এই প্রতিক্রিয়ার দুটি প্রধান ধারা দেখা যায়:
১. প্রতিরক্ষামূলক ঐতিহ্যবাদ: মুহাম্মদ মুস্তফা আজমীর মতো মুসলিম পণ্ডিতরা প্রাচ্যবিদদের তত্ত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। আজমী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Studies in Early Hadith Literature (1977)-এ দেখান যে, প্রাচ্যবিদরা, বিশেষ করে শ্যাকট, হাদিস সংরক্ষণে প্রাথমিক যুগের লিখিত পাণ্ডুলিপিগুলোর (যেমন: ‘আস-সাহিফা আস-সাদিকা’) গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি বেশ কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, হাদিস লিখন প্রক্রিয়া মুহাম্মদের যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল এবং সনদ ব্যবস্থা শ্যাকটের ধারণার চেয়ে অনেক পুরোনো (Azami, 1977)। এই ধারাটি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিকে রক্ষা করতে সচেষ্ট।
২. আধুনিকতাবাদী সংস্কারবাদ: অন্যদিকে, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, ফজলুর রহমান এবং মোহাম্মদ আরকুনের মতো আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদরা একটি ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। তারা হাদিসের একটি নতুন ঐতিহাসিক পাঠের উপর জোর দেন। পাকিস্তানের ফজলুর রহমান (মৃত্যু ১৯৮৮) “জীবন্ত সুন্নাহ” (living sunnah) এবং “মৌখিক হাদিস” (verbal hadith) এর মধ্যে পার্থক্য করেন। তাঁর মতে, হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত আক্ষরিক বাণীগুলোর চেয়ে প্রাথমিক মুসলিম সম্প্রদায়ের সামগ্রিক জীবনাচরণ বা আদর্শিক গতিপথই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করতেন, অনেক হাদিস পরবর্তী যুগের আইনগত বা ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের ফল, যা মুহাম্মদের মূল চেতনার প্রতিফলন নাও হতে পারে। মিশরীয় চিন্তাবিদ নাসর হামিদ আবু জায়েদ (Nasr Hamid Abu Zayd) এবং আলজেরীয় দার্শনিক মোহাম্মদ আর্কুন (Mohammed Arkoun)-এর মতো ব্যক্তিত্বরা হাদিসকে একটি “পাঠ্য” (text) হিসেবে দেখে আধুনিক ভাষাতত্ত্ব ও চিহ্নবিজ্ঞানের আলোকে এর পুনর্ব্যাখ্যার আহ্বান জানান।
আধুনিক যুগ: ডিজিটাল বিপ্লব, সংস্কারবাদ এবং নতুন বিতর্ক
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে হাদিসের বিশাল ভান্ডার এখন সকলের হাতের মুঠোয়। Sunnah.com-এর মতো ওয়েবসাইট বা বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো হাদিস তার সনদ, অনুবাদ, বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং এমনকি বর্ণনাকারীদের জীবনীসহ খুঁজে বের করতে পারে।
এই সহজলভ্যতা একদিকে যেমন জ্ঞানচর্চাকে সহজ করেছে, তেমনই নতুন সংকট ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে:
- ১. কর্তৃত্বের সংকট: প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই সাধারণ মানুষ হাদিস পড়ে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে, যা অনেক সময় চরমপন্থা, বিভ্রান্তি বা ঐতিহ্যবাহী আলেমদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার প্রবণতা তৈরি করছে।
- ২. ঐতিহাসিক চেতনার উন্মোচন: হাদিসের অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি, অবৈজ্ঞানিক বা আধুনিক নৈতিকতার (যেমন: দাসপ্রথা, নারীর সাক্ষ্য) সাথে সাংঘর্ষিক বিবরণ এবং ঐতিহাসিক সমস্যাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্মোচিত হওয়ায় শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে একটি অংশ হাদিসের প্রামাণ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে।
- ৩. কুরআনবাদী আন্দোলন: আধুনিক যুগে ‘কুরআনবাদী’ (Quranist) বা ‘আহল-কুরআন’ আন্দোলনের নতুন করে উত্থান ঘটেছে। তারা হাদিসকে পুরোপুরি মানবসৃষ্ট, অনির্ভরযোগ্য এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী গণ্য করে বর্জন করার কথা বলে। তাদের যুক্তি হলো, কুরআন যেখানে নিজেকে ‘পূর্ণাঙ্গ’, ‘বিস্তারিত’ ও ‘সংরক্ষিত’ বলে দাবি করে (কুরআন ৬:৩৮, ১৬:৮৯), সেখানে মানুষের দ্বারা বর্ণিত, সম্পাদিত এবং ত্রুটির সম্ভাবনাযুক্ত হাদিসের উপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। তারা মনে করে, হাদিস ইসলামে এমন অনেক কিছু প্রবেশ করিয়েছে যার কোনো ভিত্তি কুরআনে নেই।
উপসংহার: ইতিহাস, বিশ্বাস এবং এক অমীমাংসিত বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ
হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাস নিছক তথ্য সংরক্ষণের একটি সরলরৈখিক কাহিনি নয়। এটি একটি জটিল, গতিশীল এবং বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া, যেখানে স্মৃতি, লিখন, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব এবং সামাজিক প্রয়োজন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থেকে এক বিশাল জ্ঞানকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে। এর ঐতিহাসিক পাঠ আমাদের সামনে দুটি প্রধান, এবং প্রায়শই সাংঘর্ষিক, বয়ান উপস্থিত করে।
একদিকে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি বয়ান, যা এই ইতিহাসকে সত্যনিষ্ঠা, আত্মত্যাগ এবং এক অভূতপূর্ব সংরক্ষণ পদ্ধতির এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান হিসেবে উপস্থাপন করে। এই বয়ান অনুযায়ী, মুহাদ্দিসগণ (হাদিস বিশারদ) সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করার জন্য এক প্রায় নিখুঁত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যার মাধ্যমে মুহাম্মদের বাণী ও জীবনাদর্শ প্রায় অবিকৃতভাবে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এই দৃষ্টিতে, হাদিস হলো ঐশী নির্দেশনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কুরআনের অপরিহার্য ব্যাখ্যা।
অন্যদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক-সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, যা হাদিসকে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত ও বিকশিত হওয়া একটি মানবীয় জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে দেখে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, হাদিস আসলে মুহাম্মদের সময়কার বাস্তবতার চেয়ে পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মুসলিম সমাজের বিশ্বাস, বিতর্ক, আইনগত চাহিদা এবং আদর্শিক সংগ্রামেরই বেশি প্রতিফলন ঘটায়। সনদ ব্যবস্থা তথ্য যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি হলেও, এটি একই সাথে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য বৈধতা আদায়ের কৌশল এবং নিজেদের মতবাদকে ঐশী অনুমোদন দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করেছে।
এই দুটি বয়ানের মধ্যে কোনটি সম্পূর্ণ সত্য, তা নির্ধারণ করা হয়তো অসম্ভব এবং অবান্তর। হাদিস নিঃসন্দেহে প্রাথমিক যুগের ইসলাম, তার আইন, সমাজ এবং মানুষের মানসিকতা সম্পর্কে জানার জন্য এক অমূল্য এবং অপরিহার্য ঐতিহাসিক উৎস। কিন্তু একে নির্মোহভাবে ব্যবহার করার জন্য এর নির্মাণ প্রক্রিয়া, এর অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা এবং এর পেছনের ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন থাকা অপরিহার্য।
শেষ পর্যন্ত, হাদিসের ইতিহাস হলো বিশ্বাস ও ইতিহাসের এক চলমান, এবং সম্ভবত এক অমীমাংসিত, সংলাপের উপাখ্যান। এটি আমাদের দেখায়, কীভাবে একটি সভ্যতা তার প্রতিষ্ঠাতার স্মৃতিকে ধারণ, ব্যাখ্যা, প্রামাণ্যকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো তৈরি করেছিল। সেই কাঠামোর শক্তি ও দুর্বলতা, তার অর্জন ও সীমাবদ্ধতা—উভয়কেই নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই মহাকাব্যিক সফরের একটি বস্তুনিষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ পাঠ। এই পাঠ আজও শেষ হয়নি; ডিজিটাল যুগে এসে এটি নতুন মাত্রা ও নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে, যা প্রমাণ করে যে, এই জ্ঞানকাণ্ড এখনও জীবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক।
তথ্যসূত্র
- Azami, M. M. (1977). Studies in Early Hadith Literature: with a critical edition of some early texts. American Trust Publications.
- Brown, J. A. C. (2009). Hadith: Muhammad’s Legacy in the Medieval and Modern World. Oneworld Publications.
- Burton, J. (1994). The Collection of the Qur’an. Cambridge University Press.
- Cook, M. (1983). Muhammad. Oxford University Press.
- Fazlur Rahman. (1979). Islam (2nd ed.). University of Chicago Press.
- Goldziher, I. (1890). Muslim Studies (Muhammedanische Studien). (Translated by C. R. Barber & S. M. Stern). Aldine Transaction.
- Hallaq, W. B. (1999). The Authenticity of Prophetic Ḥadîth: A Pseudo-Problem. Studia Islamica, (89), 75-90.
- Juynboll, G. H. A. (2007). Encyclopedia of Canonical Ḥadīth. Brill.
- al-Khatib al-Baghdadi, A. A. Al-Rihla fi Talab al-Hadith. (Classical work).
- Motzki, H. (Ed.). (2004). Hadith: Origins and Developments. Ashgate Publishing.
- Robson, J. (1951). The Isnad in Muslim Tradition. Transactions of the Glasgow University Oriental Society, 15, 15-26.
- Schacht, J. (1950). The Origins of Muhammadan Jurisprudence. Oxford University Press.
- Siddiqi, M. Z. (1993). Hadith Literature: Its Origin, Development & Special Features. The Islamic Texts Society.
- Sprenger, A. (1856). On the Origin and Progress of Writing Down Historical Facts Among the Musalmans. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 25, 303-329, 375-381.
- (Classical Hadith Collections for specific hadith references):
- al-Bukhari, M. I. I. Sahih al-Bukhari.
- Muslim ibn al-Hajjaj. Sahih Muslim.
- Abu Dawud, S. A. Sunan Abi Dawud.