ইতিহাসে ধর্মইতিহাসধর্মহিন্দুধর্ম

হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস-রহস্যঃ আলবিরুনি, বিবিধ মত

পূর্ববর্তী পর্বঃ-

আলবিরুনির বিবরণ

আলবিরুনী একাদশ শতাব্দীর লোক ছিলেন। আলবিরুনির ভারত ভ্রমণের বিবরণ হতে জানা যায়, হিন্দুরা আগে গোমাংস খেত। যজ্ঞে গরু বলি দেওয়া হত। কোনো কারণে গোমাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এর কারণ হিন্দুরা সঠিক ভাবে জানতো না।  হিন্দুদের কাছ থেকে তিনি গোমাংস নিষিদ্ধকরণের কারণের দু রকমের মতবাদ জানতে পারেন। তবে এই মতগুলি তার গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি । তিনি অনুমান করেছেন অর্থনৈতিক কারণেই গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নিচে আলবিরুনির বিবরণ বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হল-

“যা যা খাওয়া এবং পান করা নিষিদ্ধঃ-

প্রকৃতপক্ষে হত্যা করা তাদের জন্য নিষিদ্ধ যেমনি খ্রিষ্টান এবং Manichaean দের জন্য নিষিদ্ধ। যাইহোক, মানুষের মাংসের প্রতি আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এবং এর বিপরীতে তারা সমস্ত নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করবে। তাই এখানে উল্লেখিত আইন নির্দিষ্টভাবে কেবল ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কারণ তারা হলেন ধর্মের অভিভাবক এবং তাদের লোভ পরিত্যাগ করার নির্দেশ আছে। একই নিয়ম বিশপদের উপরে অবস্থানকারী খ্রিষ্টান clergy র সদস্য যেমনঃ মেট্রোপলিটান, ক্যাথোলিকি, এবং প্যাট্রিয়ার্ক দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, presbyter এবং deacon দের মত নিম্ন স্তরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যদি না কেউ একই সাথে এইসব উপধী ধারণ করে এবং একই সাথে সন্ন্যাসী হয়। 

যেসব প্রাণী খাওয়া বৈধ এবং অবৈধ তার তালিকাঃ-  

শ্বাসরোধ করে নির্দিষ্ট কিছু প্রাণিকে হত্যা করার অনুমতি রয়েছে, বাকিদের নেই। যেসব প্রাণীদের হত্যা করা বৈধ তাদের মধ্যে যাদের হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে তাদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। যেসব প্রাণীদের হত্যা করা বৈধ তারা হল ভেড়া, ছাগল, কৃষ্ণসার , খরগোশ, গণ্ডার, মহিষ, মাছ, জলজ এবং স্থলজ পাখি যেমনঃ চড়ুই, বনঘুঘু, তিতির পাখি, ঘুঘু, ময়ূর এবং অন্যান্য প্রাণী যারা মানুষের কাছে ঘৃণ্য কিংবা ক্ষতিকর নয়।

যে কারণে গোমাংস নিষিদ্ধ হয়েছিলঃ-

যেসব প্রাণী খাওয়া নিষিদ্ধ সেগুলো হল গরু, ঘোড়া, খচ্চর, গাধা, উট, হাতি, পোষা মুরগি, কাক, টিয়া, পাপিয়া, সব রকমের ডিম এবং মদ। শেষেরটি শূদ্রদের জন্য বৈধ। সে তা পান করতে পারে, কিন্তু বিক্রি করতে পারে না, যেহেতু তার মাংস বিক্রি করার অনুমতি নেই।

কিছু হিন্দুরা বলেন, ভারতের আগে গোমাংস খাওয়া বৈধ ছিল এবং সে সময় যজ্ঞে গোহত্যা করা হত।যাইহোক, এর পরবর্তীকালে মানুষের দুর্বলতার কারণে এতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যারা তাদের কর্তব্য পালনে দুর্বল ছিল, যেমন বেদও পূর্বে আসলে কেবল একটিই ছিল , পরে চার ভাগে বিভক্ত হয় মানুষের পঠনের সুবিধার্থে। যাইহোক, এই তত্ত্বটি খুব সামান্যই প্রমাণিত যেহেতু গোমাংস নিষিদ্ধকরণের পেছনে ছোটোখাটো কোনো কারণ নেই বরং এর কারণ আগের কারণের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিকতর নিষেধযুক্ত।

অন্যান্য হিন্দুরা আমাকে বলেছেন, ব্রাহ্মণদের গোমাংস খেয়ে শরীর খারাপ হত কেননা তাদের দেশ হল গরম এবং শরীরের অভ্যন্তর হল শীতল , প্রাকৃতিক উষ্ণতা তাদের কাহিল করে দেয় এবং তাদের হজমশক্তি এতটা দুর্বল হয় যে তারা রাতে খাওয়ার পরে পান এবং সুপারি খেয়ে তা শক্তিশালী করেন। গরম পান দেহের তাপমাত্রা বাড়ায় এবং পানের মধ্যকার চুন আর্দ্রতা শোষণ করে এবং সুপারি দাঁত, মাড়ি এবং পাকস্থলীকে শক্তিশালী করে। তাই তারা গোমাংস খেতে নিষেধ করে, কারণ এটা পুরু এবং শীতল।

 আমি নিশ্চিত নই দুরকম মতবাদের মধ্যে কোনটি সত্য, গোমাংস নিষিদ্ধিকরণের ক্ষেত্রে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, গরু এমন এক প্রাণী যে আমাদের ভার বহন করে , কৃষিতে সাহায্য করে, দুধ দেয় এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যসমূহ এর থেকে পাওয়া যায়। এছাড়াও মানুষেরা এর গোবর ব্যবহার করে, এমনকি শীতকালে এর শ্বাসও নেয়।

এজন্য গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে ,  alhajjaj ও এতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন যখন ব্যাবিলনের মানুষ অভিযোগ করেছিলেন- ব্যাবিলন দিন দিন মরুভূতিতে পরিণত হচ্ছে।“  (1)

(Alberuni’s India, chapter 68 ; Translated by Dr. Edward C. Sachau)

বিভিন্ন জনের মতামত

নানান বিখ্যাত গ্রন্থে গোমাংস সম্বন্ধে যে মতামত রয়েছে এবং বিখ্যাত ব্যক্তিরা হিন্দুদের গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে যে মতামত দিয়েছেন তা নিচে উল্লেখ করা হল।

স্বামী বিবেকানন্দ

বিবেকানন্দ প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংসভক্ষণ সম্বন্ধে অনেক মন্তব্য করেছেন এবং তিনি নিজেও গোমাংস খাওয়ার খুব একটা বিরোধী ছিলেন বলে মনে হয় না। তার উক্তিগুলো নিচে উল্লেখ করা হলঃ-

১)  আমরা যদি গোমাংস এবং মেষের মাংস না খেতাম তাহলে কোনো কসাই থাকতো না। যারা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী এবং যারা ভক্ত হবেন না একমাত্র তাদের ক্ষেত্রে মাংস খাওয়া গ্রহণযোগ্য কিন্তু আপনি  যদি ভক্তি হতে চলেন তবে আপনার মাংস পরিত্যাগ করা উচিত।

(The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 4/Addresses on Bhakti Yoga/The_Preparation)

২) সকল যুগের সকল দেশের সকল মানুষ অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে ধারণারও পরিবর্তন  হওয়া উচিত। গোমাংস খাওয়া একসময় নৈতিক ছিল। জলবায়ু শীতল ছিল, খাদ্যশস্য খুব একটা পরিচিত ছিল না। মাংসই প্রধান সুলভ খাদ্য ছিল। সুতরাং সেই যুগে এবং আবহাওয়ায় গোমাংস  খাওয়া একরকম অপরিহার্য ছিল। কিন্তু গোমাংস খাওয়া এখন অনৈতিক।

৩) “সত্য বটে , বহু বাক্য এক আধটির দ্বারা নিহত হওয়া অন্যায্য। তাহা হইলে চিরপ্রচলিত মধুপর্কাদি প্রথা (১) ‘অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম’ ইত্যাদি (২) দুই একটি বাক্যের দ্বারা কেন নিহত হইল ? বেদ যদি নিত্য হয় , তবে ইহা দ্বাপরের , ইহা কলির ধর্ম ইত্যাদি বচনের অর্থ এবং সাফল্য কি?”

(১) মধুপর্ক বৈদিক প্রথা- ইহাতে গোবধের প্রয়োজন হইত।

(২) অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম।

দেবরেণ সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ।।

অশ্বমেধ, গোবধ, সন্ন্যাস , শ্রাদ্ধে মাংসভোজন এবং দেবর দ্বারা পুত্রোৎপাদন – কলিকালে এই পাঁচটি ক্রিয়া বর্জন করিবে।

( বাণী ও রচনা, ৬ ষ্ঠ খণ্ড/ ১৭ ই আগস্ট, ১৮৮৯ এ প্রমদাবাবুকে লিখিত পত্র )

৪) ব্রাহ্মণেরা একসময় গোমাংস খেতেন এবং শূদ্রাকে বিয়ে করতেন। অতিথির সন্তুষ্টির জন্য একটি গোবৎসকে হত্যা করা হত। শূদ্রেরা ব্রাহ্মণদের জন্য রান্না করতো।

(The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 9/Newspaper Reports/Part III: Indian Newspaper Reports/ A Bengali Sadhu) 

৫) একসময় এই ভারতে গরু না খেলে কোনো ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ থাকতে পারতেন না। আপনি বেদে পড়তে পারেন, কোনো বাড়িতে সন্ন্যাসী, রাজা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ লোক এলে সবচাইতে ভালো বৃষকে হত্যা করা হত। ধীরে ধীরে সকলে  বুঝলেন যেহেতু আমরা কৃষিজীবি জাতি , তাই সেরা সেরা বৃষ হত্যা করা মানে জাতির বিনাশ করা। তাই এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায় এবং গোহত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠে।

(The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 3/Lectures from Colombo to Almora/Reply to the Address of Welcome at Madura) 

৬)  আপনারা আশ্চর্যান্বিত হবেন, যদি আমি আপনাদের বলি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গরু না খেলে ভালো হিন্দু হওয়া যেত না। বিশেষ অনুষ্ঠানে তার অবশ্যই বৃষ বলি দিয়ে খেতে হত। এটা এখন অত্যন্ত বিরক্তিকর।

(The Complete Works of Swami Vivekananda/Volume 3/Buddhistic_India) 

(উপরের তথ্যগুলি আরও বিস্তারিত দেখুন এখান থেকে)

একবার গোরক্ষিণী সমিতির এক লোক বিবেকানন্দের কাছে চাঁদার জন্য এসেছিলেন। তখন বিবেকনন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ভারতে দুর্ভিক্ষে এত লোক যে মারা যাচ্ছে এ বিষয়ে গোরক্ষিণী সভা কি সাহায্য করেছেন? উত্তরে সেই গোরক্ষক বলেন, মানুষেরা তাদের কর্মফলের জন্য মরছে। তখন বিবেকানন্দও বললেন, গরুরাও একি ভাবে তাদের কর্মের জন্য মারা যাচ্ছে, এমনটাও বলা যায়। তারপর গোরক্ষক বলে, কিন্তু শাস্ত্রানুসারে গরু যে মা? তখন বিবেকানন্দ উপহাস করে তাকে বলেন, নইলে এমন কৃতি সন্তান আর কে প্রসব করবে? নিচে সম্পূর্ণ কথোপকথনটি দেওয়া হল-

“ নরেন্দ্র বাবু চলিয়া গেলে পর, গোরক্ষিণী সভার জনৈক উদ্যোগী প্রচারক স্বামীজীর সঙ্গে দেখা করিতে উপস্থিত হইলেন। পুরা না হইলেও ইহার বেশভূষা অনেকটা সন্ন্যাসীর মত- মাথায় গেরুয়া রঙ্গের পাগড়ি বাঁধা , দেখিলেই বোঝা যায়- ইনি হিন্দুস্থানী । গোরক্ষা প্রচারকের আগমন বার্তা পাইয়া স্বামীজী বাহিরের ঘরে আসিলেন। প্রচারক স্বামীজীকে অভিবাদন করিয়া গোমাতার একখানি ছবি তাহাকে উপহার দিলেন। স্বামীজী উহা হাতে লইয়া , নিকট বর্তী অপর এক ব্যক্তির হাতে দিয়া তাহার সহিত নিম্নলিখিত আলাপ করিয়াছিলেনঃ

স্বামীজী- আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কি?

প্রচারক- আমরা দেশের গোমাতাগণকে কসাইয়ের হাত হইতে রক্ষা করিয়া থাকি স্থানে স্থানে পিঁজরাপোল স্থাপন করা হইয়াছে। সেখানে রুগ্ন, অকর্মণ্য এবং কসাইয়ের হাত হইতে ক্রীত গোমাতাগণ প্রতিপালিত হন।

স্বামীজী- এ অতি উত্তম কথা। আপনাদের আয়ের পন্থা কি?

প্রচারক- দয়াপরবশ হইয়া আপনাদের ন্যায় মহাপুরুষ যাহা কিছু দেন, তাহা দ্বারাই সভার ঐ কারয নির্বাহ হয়।

স্বামীজী- আপনাদের গচ্ছিত কত টাকা আছে?

প্রচারক- মারোয়াড়ি বণিক সম্প্রদায় এই কারযের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক । তাহারা এই সৎকারযে বহু অর্থ দিয়াছেন।

স্বামীজী- মধ্য ভারতে এবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হইয়াছে । ভারত গভর্নমেন্ট নয় লক্ষ লোকের অনশনে মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করেছেন । আপনাদের সভা এই দুর্ভিক্ষ কালে কোন সাহায্য দানের আয়োজন করেছে কি?

প্রচারক- আমরা দুর্ভিক্ষাদিতে সাহায্য করি না। কেবলমাত্র গোমাতাগণের রক্ষা কল্পেই এই সভা স্থাপিত।

স্বামীজী- যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাত ভাই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হল , সামর্থ্য সত্ত্বেও আপনারা এই ভীষণ দুর্দিনে তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিত মনে করেননি?

প্রচারক- না। লোকের কর্মফলে … পাপে এই দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল ; ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ হইয়াছে।

প্রচারকের কথা শুনিয়া স্বামীজীর বিশাল নয়নপ্রান্তে যেন অগ্নিকণা স্ফুরিত হইতে লাগিল, মুখ আরক্তিম হইল; কিন্তু মনের ভাব চাপিয়া বলিলেনঃ

যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না , নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণরক্ষার জন্যে এক মুষ্টি অন্ন না দিয়ে পশুপক্ষী রক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে , তার সঙ্গে আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই; তার দ্বারা সমাজের বিশেষ কিছু উপকার হয় বলে আমার বিশ্বাস নেই। কর্ম ফলে মানুষ মরছে—এরূপ কর্মের দোহাই দিলে জগতে কোন বিষয়ের জন্য চেষ্টাচরিত্র করাটাই একেবারে বিফল বলে সাব্যস্ত হয় । আপনাদের পশুরক্ষার কাজটাও বাদ যায় না। ঐ কাজ সম্বন্ধেও বলা যাইতে পারে—গোমাতারা নিজ কর্ম ফলেই কসাইদের হাতে যাচ্ছেন ও মরছেন , আমাদের ওতে কিছু করবার প্রয়োজন নেই।

প্রচারক- (একটু অপ্রতিভ হইয়া) , হাঁ, আপনি যাহা বলিয়াছেন তাহা সত্য, কিন্তু শাস্ত্র বলে – গরু আমাদের মাতা।

স্বামীজী- (হাসিতে হাসিতে) হাঁ গরু আমাদের যে মা , তা আমি বিলক্ষণ বুঝেছি – তা না হলে এমন সব কৃতি সন্তান আর কে সব প্রসব করিবেন?

হিন্দুস্থানী প্রচারক ঐ বিষয়ে আর কিছু না বলিয়া (বোধ হয় স্বামীজির বিষম বিদ্রূপ তিন বুঝিতেই পারিলেন না) স্বামীজীকে বলিলেন যে, সেই সমিতির উদ্দেশ্যে তিনি তাহার কাছে কিছু ভিক্ষা প্রার্থী। …”

(স্থানঃ কলিকাতা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এর বাটী, বাগবাজার। কালঃ ফেব্রুয়ারি (শেষ সপ্তাহ), ১৮৯৭ । complete works of swami Vivekananda/volume 6/ conversations and dialogues/ 1 )

Dr. John Henry Barrow বিশ্ব ধর্ম সভার (১৮৯৩) সভাপতি ছিলেন। তিনি তার Christian conquest of Asia নামক গ্রন্থে বিবেকানন্দের গোমাংস খাওয়ার কথা বলেছেন। এতে তিনি লিখেছেন-

“I knew how common it was in Calcutta for young Brahmans to go to the Great Pastern Hotel and secretly indulge in a meat dinner. And I knew, also, that the Hindus are accustomed to kill the goat before the hideous idol of the goddess Kali, and that no rational argument could be offered which would make the goat loss sacred than the cow. . .  . . . At the close of the first session of the Parliament of Religions, I invited the Swami Vivekananda and other Asiatics to go with me to the restaurant in the basement of the Art Building, and I said to the Swami: ‘What shall I give you to eat?’ and he answered : ‘Give me beef.’ ” This simple remark was a thunder-bolt out of a clear sky. It changed the aspect of the whole meeting, and there were no further remarks about meat-eating.” ( source)

অর্থাৎ , আমি জানতাম কলকাতার ব্রাহ্মণ যুবকদের Great Pastern Hotel এ গিয়ে গোপনে মাংস খাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। এবং আমি আরও জানতাম হিন্দুরা দেবী কালির ভয়ঙ্কর মূর্তির সামনে ছাগল হত্যা করতো এবং কোনো যুক্তির মাধ্যমে ছাগলকে গরুর চাইতে কম পবিত্র প্রমাণ করা যায় না …

বিশ্ব ধর্ম সভার প্রথম অধিবেশনের শেষের দিকে আমি স্বামী বিবেকানন্দ এবং অন্যান্য এশিয়া মহাদেশীয়দের আমার সাথে আর্ট বিল্ডিং এর নিচে অবস্থিত রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং আমি স্বামীকে বললাম – ‘ আপনি কি খাবেন? “ এবং তিনি উত্তর দিলেন- ‘আমাকে গোমাংস দিন’ এই সাধারণ মন্তব্য আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ছিল। এটা পুরো সাক্ষাতের চেহারা পালটে দিয়েছিল, এবং সেখানে আর মাংস খাওয়া সম্বন্ধে মন্তব্য হয়নি।

তবে এর বিপরীতে এই ধরণের দাবীও করা  যেতে পারে, Dr. John Henry Barrow বিবেকানন্দের শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ ছিলেন না। এ বিষয়ে এই ওয়েবসাইটটিতে কিছু আলোচনা আছে। আগ্রহীরা তা দেখতে পারেন।

বিবেকানন্দের সম্বন্ধে আরেকটি কথা জানা যায় যে, তিনি যখন আমেরিকাতে একটি পরিবারের সাথে অবস্থান করছিলেন তখন সেই পরিবারে গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ ছিল। এর ফলে একটি বাচ্চা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বিবেকানন্দকে তা জানালে বিবেকানন্দ নিজে এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে তাকে beef streak কিনে দেন। এই ঘটনাটি swami Vivekananda in the west: New discoveries নামক গ্রন্থে উল্লেখিত আছে –

There is an instance in his Life when a family with whom he was staying in the US stopped serving beef in their home when Swamiji was there. This disappointed a kid in their home. When he told Swamiji that he like beef streaks, the Swami personally took him into a restaurant which served beef streaks.
(Source: Swami Vivekananda in the West: New Discoveries )

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা হলেন ভারতের একজন ইতিহাসবিদ। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যক্ষ। তিনি Indian Council of Historical Research এর একজন সদস্য। তিনি প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস খাওয়া নিয়ে ‘Myth of the Holy Cow’ একটি বই লিখেছেন। এই বইটির জন্য হিন্দু মৌলবাদীরা তাকে মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছিল। প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে এই যে সিরিজ লিখছি, এখানে প্রাথমিক গবেষণার ক্ষেত্রে D.N jha এর ‘Myth of the Holy Cow’ বইটির কাছে ভীষণ ভাবে ঋণী আমি। সকলকে অবশ্যই দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা এর Myth of the Holy Cow বইটি পড়তে অনুরোধ করবো। এখানে সেই বইয়ের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আর আলোচনা করলাম না।আদিম হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাথে মি. ঝা যে আলোচনা করেছেন তাই নিচে সবার জন্য দেওয়া হলঃ-

“ওয়াল স্ট্রিট জার্নালঃ গরুর পবিত্রতা ধারণাটি হিন্দু বিশ্বাসে কোত্থেকে এল?
দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঃ ভারতে বৈদিক যুগে (আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ৮০০ থেকে ১৫০০ সাল ) পবিত্র গরু ধারণাটি ছিল না। বৈদিক আর্যরা গরু বলিদান করত এবং এর মাংস খেত।

বৈদিক লেখায় গরুকে সবচেয়ে বেশি উপমা ও রূপক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে এবং সময়ের পরিক্রমায় এগুলোকে আক্ষরিক অর্থে ধরে নেওয়া হয়।

পরের কয়েক শতকে গরুর পবিত্রতার আংশিকভাবে ধারণা তৈরি হয় এবং প্রাচীন ভারতীয় লেখায় উল্লিখিত বলিদানের উদ্দেশ্যে গরু হত্যা- দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলতে থাকে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালঃ হিন্দুরা কখন গরু খাওয়া ছেড়ে দিল?

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঃ খ্রিস্ট শতকের শুরুর দিক থেকে, প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগে ব্রাহ্মণদের লেখায় গরু খাওয়ায় নিরুৎসাহ এবং গরু জবাই করা আরম্ভ করে।

মৌর্য পরবর্তী গ্রামীণ সমাজে , বিশেষ করে প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগে অভূতপূর্ব কৃষি সম্প্রসারণ হয়েছিল; আর এই সময়ে রূপান্তর ঘটে- এ থেকে মানুষের আচরণ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরির বিষয়টি বোঝা যাবে। ভূমির মালিক ব্রাহ্মণদের সামন্ত প্রভু হিসেবে উদ্ভব হয়, তারা আরো বেশি কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে, যা আগের সময়ে ছিল না। ব্রাহ্মণদের হাতে গরু হত্যা নিষিদ্ধ এবং প্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালঃ আজকাল গরুর মাংস খাওয়া কি হিন্দু ধর্মের সাথে মানানসই নয়?

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঃ প্রাচীন ভারতে বহু শতক ধরে গরুর মাংস খাওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল , তার প্রাচীন ভারতীয় লেখায় বলিষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে। ‘গরু বলয়’ নামে পরিচিত এসব অঞ্চল থেকে ক্রমেই এই রেওয়াজ উঠে যায়। তবে দেশের অনেক অংশে যেমন কেরালা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে এই অভ্যাস (গরু খাওয়া) চালু আছে। কেরালায় ৭২ টি সম্প্রদায় গরু খায় এবং এদের অনেকেই হিন্দু। সুতরাং আমি বলবো না যে গরুর মাংস খাওয়া হিন্দু-আদর্শের সঙ্গে বেমানান। তবে একই সঙ্গে অনেক হিন্দু আছে যারা গরু স্পর্শ করে না, এমনকি কোনো মাছ, মাংসও খায় না। যা এক শ্রেণীর হিন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্য, আরেক শ্রেণীর কাছে নয়।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালঃ ভারতে গোরক্ষা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সে বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?

দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঃ নাগরিকদের খাদ্য অভিরুচি নিয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। এই নিষেধাজ্ঞায় একটি বিষয় অবজ্ঞা করা হয়েছে যে , নিম্ন বর্ণ ও দরিদ্রদের জন্য আমিষের সস্তা উৎস হচ্ছে গরু। এছাড়া মাংস শিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজনের জীবন-জীবিকার উপরও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং এটা ভারতের অর্থনীতিতে নানাভাবে জড়িয়ে আছে।” (source)

ভারত কোষ গ্রন্থে

ভারত কোষ গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখেছেন, “ বৈদিকযুগে শূলগব, গবায়মান প্রভৃতি নানা যজ্ঞে গরু বধ করা হইত এবং মাংস খাওয়া হইত ; বাড়িতে বিশিষ্ট অতিথি আসিলে মধুপর্কের মাংসের জন্য গরু বধ করিতে হইত। সেইজন্য অতিথির এক নাম ছিল গোঘ্ন। কালক্রমে এই সমস্ত অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হইয়া যায় এবং গোবধ এবং গোমাংস ভক্ষণ পাপকার্য বলিয়া পরিগণিত হয়। জানিয়া বা না জানিয়া গোবধ করিলে বা মালিকের কোনো ত্রুটির জন্য গলায় দড়ি বাধা অবস্থায় গরুর মৃত্যু ঘটিলে কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। বর্তমানে ব্রাহ্মণকে সামান্য কিছু অর্থ দান করিয়া প্রায়শ্চিত্তের কর্তব্য নির্বাহ করা হয় । গোবধের প্রায়শ্চিত্তের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দাঁতে কুটা করিয়া নির্বাকভাবে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করার প্রথা আছে । গোমাংস ভক্ষণেরও প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা আছে।

দ্রঃ বল্লাল সেন, দানসাগর; রঘুনন্দং প্রায়শ্চিত্ত তত্ত্বং , Rajendralal Mitra, Beef in Ancient India , Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1872 “

পাণ্ডুরঙ্গ বামন কানে

P.V. Kane ছিলেন একজন ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃত পণ্ডিত। তিনি তার ৬৫০০ র অধিক পেজের History of Dharmashastra গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত। ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত রত্ন’ দ্বারা সম্মানিত করেন। তিনি তার হিস্ট্রি অব ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থের একস্থানে আদিম হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন-

“Before proceeding further some remarks must be made about flesh eating. In the Rg. frequence reference is made to the cooking of the flesh of the ox for offering to gods (particularly Indra). For exemple in Rg. X.86.14 Indra is made to say ‘they cook for me 15 plus twenty oxen’, vide Rg. x.27.2. In Rg. X.91.14 it is stated that for agni were sacrificed horses, bulls, oxen, barren cows and rams. In Rg. VIII.43.11 Agni is styled ‘one whose food is the ox and the barren cow .’ In Rg. X.79.6 it is suggested that the cow was cut up with a sword or axe. In the Rg. itself the cow is frequently called ‘aghnyaa’ (vide Rg. 1.164.27 and 40 ; IV.1.6 ; V.83.8 ; VIII.69.21 ; X.87.16 &c). The word aghnyaa appears to mean ‘one that does not deserve to be killed’ and the Nirukta (XI.43) explains it in that way. It should be noted that that word occurs sometimes in apposition to ‘dhenu’ (as in Rg. IV.1.6 ; VIII.69.2) . So it may be argued that in the time of the Rg. only barren cows if at all were killed for sacrifice or meat cows yielding milk were held to be not fit for being killed . It is only in this way that one can explain the high praise bestowed on the cow in Rg. VI.28.1-8 and in Rg. VIII.101.15 and 16 where the cow is described to be ‘the mother of Rudras, the daughter of vasus, the sister of Aadityas and the centre of necter’ and the sage winds up by praying to the knowing man ‘do not kill the cow , that is innocent and is Aditi herself’. In Rg. VIII.101.16 the cow is called ‘devi’ (goddess). It appears that the cow was being raised to the status of divinity and there was a great revulsion of feeling about the cow. The great usefulness of the cow and the ox for agricultural purposes , in the family economy and as means of exchange must have powerfully contributed to making the cow a divinity. In the griya sutras ( like Asv. 1.24.25 ) Rg. VIII.101.15 is prescribed as the mantra when in the madhuparka ceremony the cow is let loose by the guest. The Atharva Veda (XII.4) fully recognises the cult of the holiness of the cow. That the cow is continued to be offered in sacrifices follows from several Brahmana passages e.g. Tai. Br. III.9.8. In the Sat. Br. 3.1.2.21 it is stated that the great sage Yajnavalkya was wont to eat the meat of cows and oxen provided it was amsala (tender?) The Ait. Br.(6.8) states that the horse, the ox, the goat and ram were sacrificial animals while the kimpurusa, gauramrga, gavya, the camel and sarabha (an mythical animal with eight feet) were not sacrifical and their flesh should not be eaten. The Sat. Br. contains a similar prohibition. The sat. Br. 11.7.1.3 declares that ‘ meat is the best kind of food’…” (History of Dharmasastra vol 2,part 2 , page 772 , 1941 edition)

ড. বি. আর আম্বেদকর

দলিত সমাজের উত্থানে আম্বেদকরের অবদান অপরিসীম। তিনি ভারতের সংবিধান রচনা করেছিলেন। ১৯৯০ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারত রত্ন দ্বারা সম্মানিত করে। প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে আম্বেদকর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এ সম্বন্ধে তিনি তার ‘The Untouchables’ গ্রন্থে ‘Did the Hindus Never Eat Beef’ নামক প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধে তিনি বেদ, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি শাস্ত্রের কোথায় কোথায় গোহত্যা ও গোমাংসভক্ষণের কথা বলা আছে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মধুপর্কে যে গোমাংসের প্রয়োজন হত তিনি তারও উল্লেখ করেছেন। এছাড়া উল্লেখ করেছেন, মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় গরুর চামড়া ব্যবহারের কথা।

গোমাংস নিষিদ্ধকরণের কারণ হিসাবে আম্বেদকর যে মত প্রকাশ করেছেন তা হল-বৌদ্ধরা অহিংসার আদর্শ প্রচার করা শুরু করলে তাদের পরাস্ত করার জন্য ব্রাহ্মণেরা গোহত্যা ও যজ্ঞে পশুহত্যা বন্ধ করে। এমনকি ব্রাহ্মণেরা নিরামিষাশী হয়ে যায় বৌদ্ধদের উপরে স্থান পাওয়ার জন্য।

হিন্দুদের একাংশের অস্পৃশ্য হবার কারণ হিসাবেও আম্বেদকর গোমাংস ভক্ষণের উল্লেখ করেন। তার মতে, গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ হওয়ার পরও হিন্দুদের মধ্যে যারা গোমাংস খাওয়া বন্ধ করেনি তাদের অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

আম্বেদকরের ‘ Did Hindus never Eat Beef’ নামক প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ হয়েছে। সেটা এখান থেকে পড়তে পারেন।

সুকুমারী ভট্টাচার্য

সুকুমারী ভট্টাচার্য তার ‘প্রাচীন ভারতঃ সমাজ ও সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“প্ৰচলিত সংস্কারকে অস্বীকার করতে যাজ্ঞবল্ক্যের বাধেনি। তাঁর রচিত শতপথব্রাহ্মণ-এ আছে: ধেনু বা অনডুহ্ (ষাঁড়)-মাংস ভক্ষণ করলে পতিত হতে হয়। কিন্তু ঠিক তার পরেই যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন, ‘আমি কিন্তু (গোমাংস) ভক্ষণ করব যদি সেটা সুসিদ্ধ (নরম) হয়।’(১) প্রাচীন ভারতে গোমাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল–সে অতি সত্য কথাটাকে চাপা দেওয়ার জন্যে আজকাল কত-না ছলাকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে; যাজ্ঞবল্ক্য টের পাননি তাঁর উত্তরপুরুষকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাই অসংকোচেই বলে গেছেন: যজ্ঞের জন্যে যে-সোম কেনা হল তা হল অতিথির, তাই রাজার জন্যে ব্ৰাহ্মাণের জন্যে মানুষের হাব্য হিসেবে যেমন বড় ষাঁড় বা বড় হাতি বা বড় ছাগল রাঁধা হয় দেবতাদের জন্যেও এঁকে (সোমকে) এই আতিথ্যই করা হয়।(২) আবার বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ পড়ি: গৌরবর্ণ পুত্ৰকামনায় পিতা একটি বেদ পড়বেন, স্ত্রীকে ক্ষীরান্ন ভোজন করাবেন; কপিল পিঙ্গল পুত্ৰকামনায় দুটি বেদ পড়বেন ও স্ত্রীকে দধিযুক্ত অন্ন ভোজন করাবেন; শ্যাম-বৰ্ণ লোহিতাক্ষ পুত্ৰকামনায় তিনটি বেদ পড়বেন ও স্ত্রীকে জলে-সিদ্ধ অন্ন ভোজন করাবেন; পণ্ডিত দুহিতা কামনা করে স্ত্রীকে তিলমিশ্রিত অন্ন ভোজন করাবেন; এবং পণ্ডিত যশস্বী, সভায় সুপ্রতিষ্ঠিত সবাক পুত্ৰকামনায় চতুৰ্বেদ পাঠ করবেন ও স্ত্রীকে বলদের বা বৃষভের মাংসযুক্ত অন্ন ভোজন করাবেন।’(৩) বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এর শেষাংশে একটি কাহিনির অন্তে বলা আছে পাঁচটি পশু ব্ৰাহ্মাণের অভক্ষ্য, কারণ এদের মধ্যে থেকে মেধা (যজ্ঞে হব্যরূপে ব্যবহার্যতা) বেরিয়ে গেছে। এই পাঁচটি হল: মানুষ, অশ্ব, গৌ, মেষ এবং অজ।(৪) স্পষ্ট বোঝা যায় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলি এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুশাসনে প্ৰাণীহত্যা সম্বন্ধে নিষেধবাক্য ও অহিংসার ব্যাপক প্রচারই এ নির্দেশের মূলে। লক্ষণীয়, মানুষ এ তালিকায় বিধৃত, সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক আদিমপ্ৰথা (যুদ্ধে পরাজিতকে হত্যা করে ভক্ষণ)-এর স্মরণে; কিংবা হয়তো মানুষ সর্বত্রই অভক্ষ্য জীবের তালিকায় অগ্রগণ্য, কিন্তু অশ্ব ও গৌ নিশ্চয়ই ভক্ষ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল যেমন মেষ বা অজ; এবং নিষেধ যখন এল তখন সচরাচর-ভক্ষিত মাংসের প্রায় সবগুলির ওপরেই এল। বাকি রইল এণ (হরিণ)-মাংস, শশমাংস ও বার্ধ্রীণস (গণ্ডার)-মাংস, অর্থাৎ যেগুলি মৃগয়ালব্ধ, অতএব অনিশ্চিত। কিংবা হয়তো-বা মৃগয়া রাজাদের বিলাস বলে তার প্রতি কতকটা প্রশ্রয় দেওয়া রইল। আরও লক্ষণীয়: যাজ্ঞবল্ক্য ব্রাহ্মণকেই শুধু অমেধ্য মাংস ভক্ষণে বিরত থাকতে বলেছেন, অর্থাৎ ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য, শূদ্র তখনও অশ্ব, গৌ, মেষ ও অজ-মাংস ভক্ষণ করতে পারে। শুধু যজ্ঞে এগুলি ব্যবহার হতে পারবে না, এবং ব্রাহ্মণ খাবে না। অনুমান করা হয়তো অন্যায় হবে না যে, পূর্বে এ নিষেধ না থাকায় উল্লিখিত প্রাণীগুলি অত্যন্ত অধিক পরিমাণে যজ্ঞের জন্যে নিহত হওয়াতে সমাজে পশুধনের অভাব ঘটছিল; গোধন ক্ষয় হচ্ছিল, অশ্বের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছিল। দেশের পশুসম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যও হয়তো এ-নির্দেশের একটি কারণ।”

টীকা-

১। যো ধেন্বডুহোরশ্নীয়াদন্তগতিরিব… পাপী… তস্মাদ্ধেন্বনডুহোর্নাশ্নীয়াত্তদু হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যোহশ্নাম্যেবাহমংসলং চেদ্ভবতীর্তি। শতপথ ব্রাহ্মণ ৩/১/২/২১

২। অতিথির্বা এষ এতস্যা আগচ্ছতি যৎ সোমঃ ক্রীতস্তস্মা এতদ্ যথা রাজ্ঞে বা ব্রাহ্মণায় বা মহোক্ষং বা মহাগজং বা মহাজং বা পচেত্তদহ মানুষং হবির্দেবানামস্মা এতদাতিথ্যং করোতি। প্রাগুক্ত ৩/৪/১/২

৩। … ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা । বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬/৪/১৪-১৮

৪। এতে পঞ্চ পশবঃ অভবংতে অত উৎক্রান্তমেধা অমেধ্যা অযজ্ঞিয়াস্তেষাং ব্রাহ্মণো নাশ্নীয়াত্তান্। প্রাগুক্ত ৭/৫/২/৩৭

( প্রাচীন ভারতঃ সমাজ ও সাহিত্য/ যাজ্ঞবল্ক্য ও উপনিষদের যুগ ; লেখিকা- সুকুমারী ভট্টাচার্য; গাঙচিল প্রকাশনী)

নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী

নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী হলেন একজন ভারততাত্ত্বিক, পুরাণ গবেষক এবং লেখক। India Today কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রাচীনকালে হিন্দুদের গোমাংস খাওয়ার কথা বলেন। India Today র সেই আর্টিকেলটি থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করছি-

A brief pause and he says, “But what if I quote from the Shatapath Brahman? After all, it is also regarded as a valued Vedic scripture.” (He is clearly enjoying himself, this relentless quoting from the scriptures.) “What if I quote none other than Yajnavalkya – one of the earliest philosophers in recorded history – who questions many metaphysical propositions? Yajnavalkya says, ‘I eat it (beef) only if it is cooked till it is tender’.” The king of the gods, Indra, too is said to be fond of beef, Bhaduri reminds. In the Rig Veda, Indra demands that he be served 15 to 20 cooked oxen.

Bhaduri now adds that it was a custom in the Vedic ages to offer a cow to a priest. And – if not a full cow – beef was a must for the madhuparka or offerings. Later, the practice became symbolic of sacrifice. In the Mahabharata, Vyasa is seen accepting a cow but releasing it thereafter. “Here the cow is neither killed nor consumed. Because, by then, people had understood that the animal was very useful in daily life,” he says

অর্থাৎ, ভাদুড়ী শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লেখিত যাজ্ঞবল্ক্যের কথা বলেন। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন , গোমাংস নরম করে রান্না করা হলে তিনি তা খান। এছাড়া বলেন, দেবরাজ ইন্দ্রের প্রিয় ছিল গোমাংস। ঋগ্বেদে ইন্দ্র ১৫ থেকে ২০ টি রান্না করা বৃষ চাইছেন। বৈদিক যুগে কোনো পুরোহিতকে একটি গরু উৎসর্গ করার রীতি ছিল, সম্পূর্ণ একটি গরু না হলেও , গোমাংস অবশ্যই প্রয়োজন হত মধুপর্ক বা অর্ঘ্যের জন্য। পরে এই অনুষ্ঠানটি প্রতীকী হয়ে পড়ে। মহাভারতে, ব্যাস একটি গরু গ্রহণ করেন কিন্তু তারপর একে ছেড়ে দেন। এখানে গরুকে হত্যা করা হয়না বা ভক্ষণ করা হয় না । কারণ তখন মানুষেরা দৈনন্দিন জীবনে গরুর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল।

আনন্দ বাজার পত্রিকার একটি আর্টিকেল হতে নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর মত জানা যায়। সেখান হতে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করা হল-

হিন্দুদের একাংশের মধ্যে গোমাংস অনুরাগের একটি ধারা যে অতি প্রাচীনকাল থেকে বহমান, সেটাও ঐতিহাসিক সত্য। বেদ-পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর কথায়, “এ দেশে গরু খাওয়ায় নিষেধ এক ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক নির্মাণ। যিশুর জন্মের কয়েকশো বছর আগে থেকে কৃষিজীবী সমাজে দুধেল গরুর উপযোগিতার জন্যই গোমাংস খাওয়ার প্রবণতা কমে আসে।” 

তিনি মনে করাচ্ছেন, ঋগ্বেদ থেকে অথর্ব বেদ সাক্ষী, ইন্দ্র, অগ্নির মতো দেবতারা ষাঁড়ের মাংস খেতে ভালবাসতেন। বাড়িতে ভিআইপি অতিথি এলে গরু কাটা দস্তুর ছিল বলে তাঁদের নামই হয়ে যায় গোঘ্ন। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ বছরটাক আগের ব্রাহ্মণ গ্রন্থে নানা উপযোগিতার জন্য গরু খেতে বারণ করা হচ্ছে। তবে তখনও যাজ্ঞবল্ক্যের মতো নামী ঋষিরা তুলতুলে গোমাংসের প্রতি পক্ষপাত ব্যক্ত করছেন। নৃসিংহবাবুর মতে, বৈদিক যুগে গরু খাওয়ার রীতি ছিল। তবে ক্রমশ যজ্ঞে ষাঁড় ও বন্ধ্যা গরু উৎসর্গের ঝোঁকটাই দেখা যায়। (৮ জুন, ২০১৯ আনন্দবাজার পত্রিকা)

এবিপি আনন্দের একটি বিতর্কে ভাদুড়ী প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস খাওয়া নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিচের ভিডিওটিতে দেখুন-

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙ্গালী রসায়নবিদ। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, “ আবার বৈদিক যুগের খাওয়া ছোঁয়ার বাছবিচার সম্বন্ধে একটা কথা শুনুন- অতিথি সৎকারের জন্য তখন গৃহস্থের বাড়িতে গরু মারা হত, এই জন্যে অতিথির আরেকটি নাম ছিল ‘গোঘ্ন’। স্বর্গীয় রাজেন্দ্রলাল মিত্র অনেক পুরাতন কথা সংগ্রহ করে ‘Beef Eating in Ancient India’ নামক এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সুতরাং স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এখনকার খাদ্যাখাদ্য বিচার , স্পর্শদোষে খাদ্যদ্রব্য অপবিত্র হবার ব্যবস্থা , এসব বেদে শ্রুতিতে কোথাও দেখা যায় না। এমনকি ভবভূতির সময়ও গোমাংস ভক্ষণ বিলক্ষণ প্রচলিত ছিল। মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে মহর্ষি বশিষ্ঠ অতিথি হলে ‘জেন আঅদেষু বসিঠঠমিস্সেসু বচ্ছদরী বিসসিদা’- বাছুর নিহত হল এবং ‘তেন পরাবড়িদেন জ্জেব সা বরাইআ কল্লণিআ মড়মড়াইদা’ – তিনি এসেই সেই হতভাগ্য বাছুরের অস্থিমাংস মড়মড় করে চর্বণ করে ফেললেন ; কেননা ‘সমাংসো মধুপর্ক ইতি অম্লায়ং বহুমান্যমানাঃ শ্রোত্রিয়ায়াভ্যাগতর বৎসতরীংমহোক্ষং বা মহাজং বা নির্বপন্তি গৃহমেধিনঃ , তং হি ধর্মসূত্রকারাঃ সমামনন্তি’ – মাংস সহ মধুপর্ক দান করবে এই বেদবাক্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে গৃহস্থগণ অতিথিরূপে সমাগত বেদাধ্যায়ী বিপ্র বা রাজন্যের অভ্যর্থনার জন্য বাছুর ষাঁড় বা রামছাগল প্রদান করে থাকেন-  ধর্মসূত্রকারগণ এই রীতিকে ধর্ম বলে বিধান দিয়েছেন। – (ভবভূতির উত্তররামচরিত, ৪র্থ অঙ্ক)

(আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বক্তৃতাবলী,  ১৩৪ পৃষ্ঠা)

রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙ্গালী সাহিত্যিক। তিনি মহাভারতের সারানুবাদ করেছিলেন।  তার রচিত সংক্ষিপ্ত মহাভারতের ভূমিকায় লিখেছেন, ” মহাভারত পড়লে প্রাচীন সমাজ ও জীবনযাত্রার একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়াদি সকলেই প্রচুর মাংসাহার করতেন, ভদ্রসমাজেও সুরাপান চলত। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু গ্রন্থ রচনাকালে তা গর্হিত গণ্য হত।”

রাজশেখরের সারানুবাদের অনেক স্থানেই গোমাংসভক্ষণ ও গোহত্যার কথা পাওয়া যায়। সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলঃ

“মাংসে দেবতা পিতৃগণ অতিথি ও পরিজনের সেবা হয় , সেজন্য নিহত পশুরও ধর্ম হয়। শ্রুতিতে আছে, অন্নের ন্যায় লতা পশু পক্ষীও মানুষের খাদ্য। রাজা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রত্যহ দুই হাজার গরু পাক হত। যথাবিধানে মাংস খেলে পাপ হয় না। ধানাদি শস্যবীজও জীব , প্রাণী পরস্পরকে ভক্ষণ করেই জীবিত থাকে , মানুষ চলবার সময় ভূমিস্থিত বহু প্রাণী বধ করে । জগতে অহিংসক কেউ নেই।“ ( বন পর্ব- ৪৪)

“ সংকৃতের পুত্র রন্তিদেব , যার দুলক্ষ পাচক ছিল , যার কাছে পশুর দল স্বর্গলাভের জন্য নিজেরাই আসত , যার গৃহে অতিথি এলে একুশ হাজার বৃষ হত্যা করা হত , কিন্তু তাতেও পর্যাপ্ত হত না , ভোজনের সময় পাচকরা বলত আজ মাংস কম , আপনারা বেশি করে সূপ (দাল) খান। “ ( দ্রোণ পর্ব- ৮)

রোমিলা থাপার

রোমিলা থাপার তার ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থে বৈদিক লোকেদের খাদ্যাভাসের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, “প্রধান খাদ্যদ্রব্য ছিল দুধ, ঘি, শাকসবজি, ফল ও যব। কোনো ধর্মীয় উৎসব বা অতিথি সমাগমের সময় খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন হত। ষাঁড়, ছাগল ও ভেড়ার মাংস , আর মাদক দ্রব্য হিসেবে সুরা বা মধুর ব্যবস্থা থাকতো।” (পৃষ্ঠা ২৪)

এই বইয়ের আরেকস্থানে তিনি লিখেছেন, ” আরযরা যখন এসেছিল তখন তারা ছিল অর্ধ যাবাবর গো-পালক। গোপালনই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। গোধন দিয়েই মূল্য নিরূপিত হত এবং সম্পত্তি হিসেবে গবাদি পশুই সবচেয়ে মহার্ঘ ছিল। গোরুর উল্লেখ তখনকার ভাষার অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবে ‘গোবিষ্ঠি’ শব্দটির প্রাথমিক অর্থ যদিও ছিল গোধন অনুসন্ধান, কালক্রমে অর্থ হয়ে দাঁড়াল- যুদ্ধ করা। অর্থাৎ গোরুচুরি নিয়ে প্রায়ই উপজাতিগুলির পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ হত। গোরুকে সম্ভবত লোকেরা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতীকী প্রাণি হিসেবে ভক্তি করত। বিশেষ কয়েকটি অনুষ্ঠানে গোমাংস খাওয়া মঙ্গলজনক বলে ধরা হলেও অন্য সময়ে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হত। গোধনের অর্থনৈতিক মূল্য গোভক্তির প্রগাঢ়তা বাড়াতেও সাহায্য করেছিল। পরবর্তীকালে গরুকে পবিত্র বলে পূজা করার আপাতযুক্তিহীন মনোভাবের জন্ম হয়েছিল বোধহয় এইভাবেই।” (পৃষ্ঠা ১৯)

( অনুবাদিকাঃ কৃষ্ণা গুপ্ত; প্রকাশনী- ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড; প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ১৯৬০)

রাহুল সাংকৃত্যায়ণ

রাহুল সাংকৃ্ত্যায়ণ তার ভোলগা থেকে গঙ্গা নামক গ্রন্থে প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে লিখেছেন। সেই অংশটি নিচে উল্লেখ করা হল সবার জন্যঃ  

“এই দশপুর রন্তিদেবের রাজধানী ছিল। আর চর্মণবতী নাম কি করে হল সে এক আশ্চর্য কাহিনী। ব্রাক্ষণ সংকৃতির পুত্র, কিন্তু নিজে ক্ষত্রিয় রাজা রস্তিদেব অতিথিসেবার জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। সত্যযুগের ষোলো জন মহান রাজার মধ্যে একজন। রন্তিদেবের ভোজনশালার জন্য প্রতিদিন দু’হাজার করে গরু মারা হত। তাদের চামড়া রসুইখানায় রাখা হত। তা থেকে যে রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত তাতে এক নদীর সৃষ্টি হয়। চর্ম থেকে উৎপত্তি বলে তার নাম চর্মণবতী।”(2)

“বৎস, এ সব কি সত্যিই পুরাণে লেখা আছে?”

“হ্যাঁ দাদু, মহাভারতে পরিষ্কার লেখা আচে?”

“মহাভারতে ,অর্থাৎ পষ্ণম বেদে? গোমাংস ভক্ষণ!”

“রন্তিদেবের ওখানে অতিথিদের খাওয়ার জন্য এই গোমাংস রন্ধনের কজে দু’হাজার পাচক নিযুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে ব্রাক্ষণ অতিথিদের সংখ্যাও এত বেড়ে উঠতে যে, মাংস কম পড়ে যাওয়ার বয়ে পাচকরা, মাংসের বদলে ঝোল বেশী করে নেবার অনুরোধ জানাত। মহাভারতেই আছে-

তত্র ম্ম সৃদাঃ ক্রোশান্তি সুমৃষ্টমণিকুণ্ডলা
সূপং ভূয়িষ্ঠমশ্নীধ্বং নাদ্য মাংসং ‍যথা পুরা।। ”

ব্রাক্ষণেরা গোমাংস খেত, কি বলছ ভাই?”

“মহাভারত হচ্ছে পষ্ণম বেদ-তাতে কি মিথ্যা লেখা হতে পারে দাদু!”

“দুনিয়া কি এত ওলোট-পালোট হয়ে গেল?”

(১২. সুপর্ণ যৌধেয় (কাল : ৪২০ খৃষ্টাব্দ) – ভোলগা থেকে গঙ্গা )

মহাত্মা গান্ধী

মহাত্মা গান্ধী তার ‘হিন্দু ধর্ম কী?’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ” বেদে অশ্ব, গো ইত্যাদি বলির যে কথা পাই, তাকে আমি অন্যায় মনে করি। এই পশু হিংসার কথা মেনে নিলে আমরা সত্য ও অহিংসার বিচারে উত্তীর্ণ হব না। এ আমি সন্তুষ্ট মনে মেনে নিয়েছি। যে সব কথা ধর্মের নামে প্রসিদ্ধ, আমি তার ঐতিহাসিক অর্থ খোঁজার মত ভুল করি না। সে ভাবে অর্থ অন্বেষণে নিজ অযোগ্যতাও স্বীকার করি। যোগ্যতা লাভের চেষ্টাও করি না। কেননা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে জীবহিংসা যদি সঙ্গতও হয়, তবু আমি তো মানি অহিংসা পরম ধর্ম। ওই বিশ্লেষণ আমার কাছে অগ্রহণীয়, তাই তা ত্যাগযোগ্য।”
(অনুবাদঃ মহাশ্বেতা দেবী ; ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া ; ১৯৯৬ ; ISBN 81-237-1653-2)

বিদ্যাসাগর সিনেমা

১৯৫০ সালে তৈরি বিদ্যাসাগর সিনেমাতেও প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস খাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। নিচে সেই সিনেমার প্রাসঙ্গিক অংশ রইলো, দেখতে পারেন-

সোহং স্বামী

সোহং স্বামী ( ১৮৫৮-১৯১৮) ছিলেন অদ্বৈত বেদান্তের একজন গুরু। তিনি সোহং গীতা সোহং সংহিতা, সোহং তত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি তার ‘সোহং গীতা’ নামক গ্রন্থে প্রাচীন হিন্দুদের গোমাংস খাওয়ার কথার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিচে তা উল্লেখ করা হল-

“ভারতের পূর্ব গৌরবের দিনে
যত আর্য ঋষিগণ।

ভোজনের তরে পশু, পক্ষী, মৎস্য

করিতেন সংহনন।।

সমুদ্র শোষক মহর্ষি অগস্ত্য

ছিলেন মৃগয়ারত।

বাল্মীকি আশ্রমে বশিষ্ঠাগমনে

হয়েছিল বৎস হত।।

যাজ্ঞবল্ক্য, যম , অত্রি, পরাশর

ব্যাস, বিষ্ণু, কাত্যায়ন।

অঙ্গীরা, হারীত, বশিষ্ঠ, শাঙ্খাদি

নামে স্মৃতিকারগণ।।

করেছে বিধান আমিষ আহার

জল স্থল ব্যোমচর।

আমিষ ভোজন ছিল না তখন

সাধনের বিঘ্নকর।।

স্থাবর নিচয় জঙ্গমের খাদ্য

দংষ্ট্রির অদংষ্ট্রি যত।

সহস্ত নরের হস্ত-হীন মীন

হয় অন্নে পরিণত।।

মনুস্মৃতি মতে নিরামিষামিষ

কিছু দোষাবহ নয়।

প্রাকৃতিক ক্রমে দুর্বল বলীর

খাদ্য রূপে গণ্য হয়।।

সংহিতা স্মৃতিতে অধ্যয়ণকালে

দেখে শাস্ত্রাধ্যায়ী যত।

আমিষ আহারে বিধি প্রতিষেধ

রয়েছে দ্বিবিধ মত।।

আমিষ আহারী করে বিধিবাক্যে

স্বীয় মত সমর্থন।

প্রতিষেধ বাক্য করিছে গ্রহণ

নিরামিষ ভোজীগণ।।

বলিছে প্রক্ষিপ্ত বিধিবাক্য যত

প্রতিষেধবাদী গণ।

নিষেধ প্রক্ষিপ্ত কিংবা বিধিবাক্য

কর এবে নিরূপন।।

অভ্যাগত জনে শ্রাদ্ধে পিতৃগণে

মধুপর্কে মাংস দান।

যজ্ঞে পশুবধে বেদাদি শাস্ত্রেও

বিধিবাক্য বিদ্যমান।।

এবে মধুপর্কে ঘৃত দধি মধু

দুগ্ধাদি মিশ্রিত করে।

মণ্বাদি শাস্ত্রেতে মাংসের বিধান

আছে মধুপর্ক তরে।।

হইলে অখাদ্য কিংবা অশ্রদ্ধেয়

আমিষ আহার্য যত।

পিতৃগণে কিংবা অভ্যাগতে দান

নহে শিষ্ট অভিমত।।

আয়ুর্বেদ মতে মাংসের মতন

পুষ্টিকর বলাধান ।

বৃষ্য দার্ঢ্যকর ভোজ্যের ভিতরে

নাহি কিছু বিদ্যমান।।

গবাদি পর্যন্ত পশু পক্ষী মৎস্য

আয়ুর্বেদে বিধি হয়।

অখাদ্য বস্তুতে ঋষির ব্যবস্থা

কভু যুক্তিযুক্ত নয়।।

মণ্বাদি শাস্ত্রেও অভক্ষ্যভক্ষ্যরূপে

মৎস্য, মাংস নির্বাচিত।

না করি আহার গুণ নির্বাচন

নহে কভু সম্ভাবিত।।

কাষ্ঠ লোষ্ট্রাহারে শ্রুতি স্মৃতি শাস্ত্রে

নাহি বিধি প্রতিষেধ।

অভক্ষ্য পদার্থ সকলের ত্যাজ্য

নাহি তাতে মতভেদ।।

বিধি প্রতিষেধ দ্বিবিধ বচনে

হইতেছে নিরূপিত।

আমিষ আহার আছে এ ভারতে

চির প্রচলিত।।

বেদ অনুসারে যজ্ঞাদি কর্মে

পশু বধ বিধি হয়।

বেদান্ত শাস্ত্রেও মন্ত্র বিশেষেতে

আছে তার সমন্বয়।।

ছাগ গবাদির পুরুডাশ সহ

দেবগণে সোমদান।

বিধায়ক মন্ত্র আছে চতুর্বেদে

শত শত বিদ্যমান।।

সংস্কারে আবদ্ধ সায়ণাদি কত

নব ভাষ্যকারগণ।

ধেনু, গো শব্দের দুগ্ধার্থ গ্রহণে

করিয়াছে প্রাণপণ।।
মহীধর ভাষ্যে গবার্থ ব্যঞ্জক

শব্দার্থে লক্ষিত হয়।

করিয়াছে মহী সত্যার্থ প্রকাশ

না করি সমাজ ভয়।।

অশ্বমেধ যজ্ঞে যজ্ঞাশ্ব সহিত

নবাধিক ষটশত।

গ্রাম্য বন্য পশু পক্ষী মৎস্য বধ

হয় শ্রুতি অভিমত।।

করেছিল যজ্ঞ রাজা দশরথ

যবে পুত্রলাভ তরে ।

বহু পশু পক্ষী হনন তাহাতে

বাল্মীকি বর্ণন করে।।

অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্ব ঋষভাদি

পশু পক্ষী মীন কত।

করেছিল বধ রাজা যুধিষ্ঠির

বলিছে মহাভারত।।

ভরদ্বাজাশ্রমে শ্রীরামে গামর্ঘ্য

ভরতে ভোজন তরে।

বরাহ কুক্কুট ছাগ মাংস দান

বাল্মীকি বর্ণন করে।।

ছিল বনবাসে শ্রীরাম লক্ষ্মণ

সীতার জীবনোপায়।

মৃগ, গোধা, সেধা বরাহের মাংস

রামায়ণে দেখা যায়।।

কিন্তু কীর্তিবাস তুলসীদাসাদি

সংস্কারান্ধ কবি যত।

করেছে কল্পনা ফল মূলাহার

করি সত্য পরাহত।।

গোমাংস সম্ভূত মধুপর্কে কৃষ্ণ

হয়েছিল অভ্যর্থিত।

দুর্যোধন গৃহে ভারতে এ কথা

আছে স্পষ্ট উল্লিখিত।।

বনবাস কালে নিত্য দ্বিজসেবা

করিত পাণ্ডবগণ।

নানবিধ মৃগ অন্য মেধ্য পশু

করি সদা সংহনন।।

যদি বল এই গবাদি হনন

কলিতে প্রসিদ্ধ নয়।

জনমেজয় গৃহে গামর্ঘ্য গ্রহণে

ব্যাস জাতিভ্রষ্ট হয়।।

মহর্ষি জৈমিনি ধর্ম প্রবর্তক

তার পূর্ব মীমাংসায় ।

যজ্ঞে পশুবধ বিধায়ক সূত্র

কত শত দেখা যায়।।

ব্যাস বিরচিত বেদান্ত দর্শন

করিয়াছে নিরূপন।

যজ্ঞে পশুবধ বেদানুমোদিত

নহে হিংসা কদাচন।।

আচার্য শঙ্কর ছান্দোগ্য ভাষ্যেতে

ব্রহ্ম সূত্র ভাষ্যে আর।

শ্রৌত-যজ্ঞে বধ নহে হিংসা বাচ্য

করিয়াছে অঙ্গিকার।।

নিরামিষাহারী ধর্মধ্বজীগণ

সত্যার্থ গোপন করে।

করেছে শাস্ত্রের মিথ্যা ব্যাখ্যা পরে

স্বমত পোষণ তরে।।

ব্যাকরণে দ্রব করি শ্রৌতপশু

ছাগাশ্ব গবাদি যত।

কল্পনার ছাঁচে বিবিধ আকারে

করিয়াছে পরিণত।।

এক বেদাধ্যায়ী পুত্রলাভ তরে

পুত্রার্থী দম্পতি যত।

ঋতুরক্ষা কালে ক্ষীরান্ন ভোজন

করিবেন বিধিমত।।

দধি পক্ক অন্ন করিবে ভোজন

দ্বিবেদী পুত্রের তরে।

জন্মিবে ত্রিবেদী হলে গর্ভাধান

ঘৃতান্ন ভোজন করে।।

যশস্বী সুবক্তা সর্ব বেদাধ্যায়ী

পুত্রতরে প্রয়োজন।

বৃষ মাংসসহ পক্ক অন্নাহার

ইহা শ্রুতি প্রবচন।।

আরণ্যক ভাষ্যে আচার্য শঙ্কর

করিয়াছে নিরণয়।

উক্ষা বা ঋষভ পুঙ্গব বোধক

তন্মাংস তাৎপর্য হয়।।

‘মাংসৌদন’ শব্দে করিয়াছে শ্রুতি

মন্ত্র অর্থ সুনিশ্চয়।

উক্ষা ঋষভের করিলে ভিন্নার্থ

হয় ভাষা বিপর্যয়।।

বিনা শ্রাদ্ধে যজ্ঞে ঘৃতাদির ন্যায়

গবাহার প্রচলিত।

ছিল পূর্বকালে শ্রুত্যাদি প্রমাণে

হইতেছে প্রমাণিত।।

হে গৌণ ব্রাহ্মণ আর্য জাতি বলি

কর যদি অভিমান।

তবে গোখাদক খ্রিস্ট মুসলমানে

কেন কর হেয় জ্ঞান?

তাহাদের খাদ্য প্রতিষেধ হেতু

করি বৃথা আবদার।

বিদ্বেষ অনল জ্বালিয়া ভারত

করিতেছ ছারখার। ।

উক্ষা ও ঋষভ এই শব্দদ্বয়

গবার্থ ব্যঞ্জক নয়।

উক্ষা এই শব্দে বার্ত্তাকু নামক

উদ্ভিদ আখ্যাত হয়।।

এই রূপ ছলে পাণ্ডিত্যাভিমানী

নিরামিষ ভোজীগণ।

করিছে খণ্ডন শঙ্করাদি ভাষ্য

স্বীয় মত সমর্থন।।

মাংসৌদন শব্দে উদ্ভিদ ব্যবস্থা

কদাপি সঙ্গত নয়।

বার্ত্তাকুর মাংস এরূপ বচনে

ভাষা বিপর্যস্ত হয়।।

সামান্য আহারে যেই দম্পতীর

ক্ষীণ দেহেন্দ্রীয়গণ।

সুস্থ বীর্যবান পুত্র তাহাদের

সম্ভবে না কদাচন।।

সেই হেতু শ্রুতি পরম্পরা ক্রমে

করিয়াছে নিরূপন।

গোরস সম্ভূত খাদ্য শ্রেষ্ঠতর

শ্রেষ্ঠতম মাংসৌদন।।

দুগ্ধ ঘৃতাদিতে শ্রেষ্ঠতম পুত্র

যদ্যপি সম্ভব নয়।

অসার বেগুনে হেন পুত্রোৎপত্তি

কিরূপে সঙ্গত হয়?

এই শ্রুতি মত গোখাদকগণ

করিবে যথার্থ জ্ঞান।

ছাগে এই বিধি ছাগ মাংসভোজী

করিবে না প্রত্যাখ্যান।।

গোহত্যা-সংস্কারে বদ্ধ , নব্য হিন্দু

পাপ ভয়ে মুহ্যমান।

বলে পক্ষান্তরে শ্রুতি ব্রহ্ম বাক্য

করে ধ্রুব সত্য জ্ঞান।।

উভয় সঙ্কটে নিপতিত হিন্দু

স্বমত পোষণ তরে।

বহ্বর্থ্য ব্যঞ্জক অক্ষর শব্দের

বিপরীত ব্যখ্যা করে।।

ইহুদী রোমাণ গ্রীকাদি প্রাচীন

আর্য বংশধরগণ।

ধর্ম কর্মাহারে গবাদি পর্যন্ত

করিতেন সংহনন।।

সেই আর্য জাতি এই ভারতেও

হয়েছিল নিবেশিত।

দেখি শ্রুতি বিধি গোমাংসের তরে

কেন হও বিচলিত?

সেই শাখাজাত নব্য ইউরোপ

আমেরিকাবাসীগণ।

পূর্ব ধর্মত্যাগী কিন্তু তাহাদের

শ্রেষ্ঠ খাদ্য মাংসৌদন।।

গোভোজী পাশ্চাত্য শারীরিক বলে

বীর্যবান সুর হয়।

মানসিক বলে বিজ্ঞান চর্চায়

করিতেছে ভূত জয়।।

জলে জলতলে জলচর সম

করিতেছে বিচরণ।

ব্যোমচর প্রায় করে গতাগতি

করি ঊর্দ্ধে আরোহণ।।

দূরস্থ অথবা মৃত গায়কের

সঙ্গীত শ্রবণ তরে।

অদৃশ্য, অস্পৃশ্য শব্দ, সুর , তান

গ্রামোফোন বদ্ধ করে।।

রেখেছে তাড়িতে কৃতদাসী প্রায়

চির বশীভূত করে।

শকট বহন, বার্তা আহরণ

ব্যজনাদি সেবা তরে।।

পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, শিল্প বানিজ্যাদি

সমৃদ্ধি সাম্রাজ্য বল ।

দৈহিক মানস শক্তি, সত্ত্ব , রজ

গুণ সমন্বয় ফল।।

বিনা ব্রহ্মচর্য বিনা একাগ্রতা

ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার।

বিনা সংযমন পারে কি হইতে

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার?

প্রাচ্য শাস্ত্রচর্চা করিছে পাশ্চাত্য

গোভোজী মানবগণ।

শ্রুতি ভাষ্য, ভাষা বৈদান্তিক গ্রন্থ

করিতেছে প্রচলন।।

যে যোগজ সিদ্ধি অলৌকিক শক্তি

লভে সিদ্ধ যোগীজন।

সে শক্তির ফল জাতি নির্বিশেষে

ভোগিছে পাশ্চাত্যগণ।।

দেখ পক্ষান্তরে মাংসৌদন ত্যাগী

বার্ত্তাকু ভক্ষক যত।

শৌর্য বীর্য বিদ্যা বিজ্ঞানবিহীন

দাসরূপে পরিণত।।

নবীন যৌবনে জীর্ণ দেহেন্দ্রিয়

মস্তিষ্ক কর্দম প্রায়।

বেদ বেদান্তের সুগভীর তত্ত্ব

না করে প্রবেশ তায়।।

বৈদিক ভাষাও হয়েছে দুর্জ্ঞেয়

পশুর ভাষার মত।

করে আলম্বন এবে বেদাধ্যায়ী

ভাষ্য, অনুবাদ যত।।

চতুর্বেদ ভাষ্য করে অধ্যয়ন

আছে হেন কত জন?

বার্ত্তাকু ভক্ষণে কুষ্মাণ্ডের প্রায়

এবে ঋষি সূত গণ।।

ত্যাজিলে গোরস ঘৃত দুগ্ধ দধি

নিরামিষ ভোজীগণ।

হত এতদিনে কিসে পরিণত

কে করিবে নিরূপন?

জাতি নির্বিশেষে বার্ত্তাকু ভক্ষণ,

করে নব্য হিন্দু গণ।

শ্রুতি উল্লিখিত চতুর্বেদী পুত্র

নাহি হয় কি কারণ?

বার্ত্তাকুর গুণে বেদজ্ঞ সন্তান

হয় যদি সম্ভাবিত।

ঋষিদের স্থানে ভীরু মূঢ় গণ

কেন এবে বিরাজিত?

অসার আহারে ক্ষীণ দেহেন্দ্রিয়

দুর্বল মস্তিষ্ক যার।

না হয় সে ভোগী , বিজ্ঞানী বা যোগী

বিফল জনম তার।।

ত্যাজি আধুনিক সংকীর্ণ সংস্কার

কর যদি সুবিচার।

ঋষির উদ্দেশ্যে শ্রুতি প্রবচনে

থাকিবে না ভ্রম তার।।

সভ্যাসভ্য যত মানবসমাজ

দেখ করি সুবিচার।

অসভ্য সমাজ করে বন্য পশু

ফল মূল ব্যবহার।।

প্রজাবৃদ্ধি সহ খাদ্যের অভাবে

হয় ক্রমে প্রয়োজন।

কৃষি বাণিজ্যাদি ছাগ গো অশ্বাদি

নানাবিধ পশুগণ।।

সুসভ্য সমাজে বন্য গ্রাম্য পশু

শস্যাদি আহার্য হয়।

আর্য জাতি তরে প্রাকৃতিক বিধি

কি হেতু প্রযোজ্য নয়?

আমিষ এ শব্দ করি আলম্বন

নিরামিষ সিদ্ধ হয়।

অগ্রেতে আমিষ পরে নিরামিষ

হইয়াছে নিঃসংশয়।।

শ্রুতি স্মৃতি মতে গবাদি পর্যন্ত

ছিল খাদ্য প্রচলিত।

পরে কৃষি তরে গোরক্ষণ হেতু

হইয়াছে নিবারিত।। “

( সোহং গীতা / আহার ; পৃষ্ঠা ১৬২-১৭৮ ; ২য় সংস্করণ, ১৯১২)

বিশ্বকোষ গ্রন্থে

রন্তিদেব (পুং) রমতে ইতি রম সংজ্ঞায়াং তিক্ রন্তিশ্চাসৌ দেবেশ্চেতি। ১ বিষ্ণু । ২ চন্দ্রবংশীয় নৃপতিভেদ ।

গুরুশ্চ রন্তিদেবশ্চ সাংকৃতেঃ পাণ্ডুনন্দন।

রন্তিদেবস্য মহিমা ইহামুত্রে চ গীয়তে।। (ভাগ ৯/২১/২)

মহাভারতে লিখিত আছে যে পূর্বে রন্তিদেব রাজার রন্ধনাগারে প্রতিদিন দুই সহস্র পশু এবং দুই সহস্র গোধন নিহত হইত, রাজা রন্তিদেব সমাংস অন্নদান করিয়া অতুলনীয় কীর্তি লাভ করিয়াছিলেন।

“রাজ্ঞো মহানসে পূর্ব্বং রন্তিদেবস্য বৈ দ্বিজ।

দ্বে সহস্রে তু বধ্যেতে পশুনামন্নহং তদা।।

অহন্যহনি বধ্যেতে দ্বে সহস্রে গবাং তথা।

সমাংসং দদতো হ্যন্নং রন্তিদেবস্য নিত্যশঃ।

অতুলা কীর্ত্তিরভবৎ নৃপস্য দ্বিজসত্তম।।“ (ভারত ৩/২০৭/৮-৯)

মহাভারতের শান্তি পর্বে (২৯ অঃ) লিখিত আছে যে, সংকৃতিনন্দন রন্তিদেব কঠোর তপ করিয়া ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করিয়া এইরূপ বর প্রার্থনা করেন যে , ‘দেবরাজ! আপনার প্রসাদে যেন আমার গৃহে প্রচুর অন্ন ও অতিথির সমাগম হয়। আমার শ্রদ্ধা যেন অপনীত না হয় এবং আমি যেন কখনও কাহার নিকট প্রার্থনা না করি ।‘ ইন্দ্র প্রীত হইয়া তাহাকে এই বর দিলেন। মহাত্মা রন্তিদেব যখন কোনো কর্মানুষ্ঠান করিতেন , তখন গ্রাম্য ও আরণ্যক পশুসকল তথায় স্বয়ং উপস্থিত হইয়া ‘আমাকে দৈব ও পিতৃ কার্যে নিয়োগ করুন’ বলিয়া উপাসনা করিত। এই মহাত্মার যজ্ঞনিহত পশুগণের চর্মরাশি হইতে ক্লেদ নির্গত হওয়ায় এক নদী উৎপন্ন হইয়াছে, ঐ নদী চর্মণ্বতী নামে খ্যাত। তিনি প্রতিদিন ব্রাহ্মণদিগকে বহুতর সুবর্ণ দান করিতেন, ইহার গৃহে পাত্র, ঘট, কটাহ, স্থালী প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যই সুবর্ণময় ছিল। অতিথি সমাগম হইলে তাহার গৃহে বিংশতি সহস্র একশত গো ছেদন করা হইত, তথাপি অতিথিগণ প্রচুর মাংস ভোজন করিতে পাইত না। রাজা রন্তিদেব পুণ্যকর্মাদিগের অগ্রণী ছিলেন।

 (বিশ্বকোষ, ষোড়শ খণ্ড, ২৫৫ পৃষ্ঠা ; শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক সঙ্কলিত ও প্রকাশিত)


(চলবে…)

তথ্যসূত্র-


(1) “On what is allowed and forbidden in eating and drinking

Originally killing in general forbidden to them , as it is to the Chritians and Manichaeans. People however, have the desire for meat, and will always fling aside every order to the contrary. Therefore the here-mentioned law applies in particular only to the Brahmans,  because they are the guardians of the religion, and because it forbids them to give way to their lusts. The same rule applies to those members of the Christian clergy who are in rank above the bishops, viz. The metropolitans, the catholici, and the patriarchs, not to the lower grades , such as presbyter and deacon, except in the case that a man who holds one of these degree is at the same time a monk.

(list of animals lawful and unlawful to be eaten)

As matters stand thus, it is allowed to kill animals by means of strangulation, but only certain animals, others being excluded. The meat of such animals, the killing of which is allowed, is forbidden in case they die a sudden death. Animals the killing of which is allowed are sheep, goats, gazelles, hares, rhinoceroses (gandha) , the buffaloes, fish, water and land birds, as sparrows, ring doves, francolins, doves, peacocks, and other animals which are not loathsome to man or noxious.

(why the meat of cows was forbidden)

What is forbidden are cows, horses, mules, asses, camels, elephants, tamed poultry, crows, parrots, nightingales, all kind of eggs and wine. The latter is allowed to the shudra. He may drink it but dare not sale it, as he is not allowed to sell meat.

Some Hindus say that in the time before Bharata it was allowed to eat the meat of cows, and that there then existed sacrifices part of which was the killing of cows. After that time ,however, it had been forbidden on account of the weakness of man, who were too weak to fulfil their duties , as also the veda , which originally was only one , was afterwards divided into four parts, simply for the purpose of facilitating the study of it to men. This theory, however is very little substantiated , as the prohibition of the meat of cows is not alleviating and less strict measure , but on the contrary, one which is more severe and more restrictive than the former law.

Other Hindus told me that Brahmans used to suffer from the eating of cows’ meat. For their country is hot , the inner part of the bodies is cold, the natural warmth becomes feeble in them, and the power of digestion is so weak that they must strengthen it by eating the leaves of betel after dinner, and by chewing the betel-nut. The hot betel inflames the heat of the body , the chalk on the betel leaves dries up everything wet, and the betel-nut acts as an astringent on the teeth, the gums and the stomach. As this is the case , they forbade eating cows’ meat, because it is essentially thick and cold.

I for my part , am uncertain, and hesitate in the question of the origin of this custom between two different views.

(lacuna in the manuscript)

As for the economical reason, we must keep in mind that the cow is the animal which serves man in travelling by carrying his loads, in agriculture in the works of ploughing and sowing , in the household by the milk and the product made thereof. Further, man makes use of its dung and in winter time even of its breath.

Therefore it was forbidden to eat cows’ meat; as also alhajjaj forbade it, when people complained to him that babylonia became more and more desert. “

(Alberuni’s India, chapter 68 , Translated by Dr. Edward C. Sachau )

(2) রাজ্ঞো মহানসে পূর্ব রন্তিদেবস্য বৈ দ্বিজ

অহন্যহনি বধ্যেতে দ্বে সহস্রে গবাং তথা।। – বন পর্ব ২০৮/২

মহানদী চর্মরাশরূৎক্লেদাত সংসৃজে যতঃ

ততশ্চর্ম ন্বতীত্যেবং বিখ্যাতা সা মহানদী।। – শান্তি পর্ব ১৯/২৩

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *