অভিজিৎ রায়ের মুখবন্ধ

Print Friendly, PDF & Email

আসিফ মহিউদ্দীন লেখক। তিনি লিখেন। না তিনি গাদা গাদা ‘আঁতেলেকচুয়াল’ বই বের করেননি, কোন প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রেও তিনি কলাম লেখেন না। আসিফের বিচরণ ইন্টারনেটে – মূলতঃ বাংলা ব্লগে, ফেসবুকে। এ ধরনের লেখকেরা সাধারণত সবার অগোচরেই থেকে যান। কিন্তু আসিফের ক্ষেত্রে তা হয়নি। আসিফ আক্রান্ত হয়েছেন। মৌলবাদীরা তো তাকে কুপিয়েই মেরে ফেলতে চেয়েছে। পারেনি। হেফাজতী মাওলানারা, যারা আসিফের কেন, কোন ব্লগারদের লেখাই কোনদিন পড়ে দেখেনি, ব্লগের সংজ্ঞা যাদের চিন্তায় কেবল ‘ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালানো’ পর্যন্ত, তারা ব্লাসফেমি আইনে আসিফের বিচার করতে চেয়েছে। আসিফ কেবল মৌলবাদীদেরই রোষের শিকার হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্র-যন্ত্র দিয়েও। যে রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা দেবার জন্য তৈরি বলে আমরা জানি, যে দেশের সংবিধানে ‘নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুরক্ষিত’ থাকার কথা বলে, যে রাষ্ট্রের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার কথায় কথায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ বুলি কপচায়, সেই দেশ, সেই সরকার, সেই রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা আসিফকে তার লেখার জন্য নির্যাতন করেছে, কারাগারে প্রেরণ করেছে একাধিকবার। চাপ প্রয়োগ করে আসিফের ব্লগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সামহোয়্যারইনে। নতুন করে কালাকানুন বানানো হয়েছে যাতে আসিফের মত ব্লগাররা আর কাউকে কখনো ‘জ্বালাতে’ না পারে। কিন্তু এতে করে কি মুক্তচিন্তার গতি স্তব্ধ করা যায়? আমরা তো জানি, একটা সময় বাইবেল বিরোধী সূর্যকেন্দ্রিক সত্য উচ্চারণের কারণে গ্যালিলিওকে অন্তরিন করে রাখা হয়েছিল, ব্রুনোর মত দার্শনিককে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, কিন্তু সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন থামাতে পারেনি ঈশ্বরের সুপুত্ররা।

হাজারো অপন্যাস আর চটুল সাহিত্যের ভীরে আসিফের ব্লগ আর ফেসবুক স্ট্যাটাস যেন একপ্রস্ত সুবাতাস। আসিফের লেখা অজ্ঞেয়বাদী মুক্তচিন্তক রবার্ট গ্রিন ইঙ্গারসোলের উক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয় – ‘বিশ্বাসী মন খাঁচায় বন্দী পাখি, আর মুক্তমন যেন মুক্ত বিহঙ্গ – ঘন মেঘের পর্দা ভেদ করে উড়ে চলা অবিশ্রান্ত এক ডানামেলা ঈগল’। এই নীলিমায় ডানামেলা ঈগলদের ডানা ভেঙে খাঁচায় বন্দী করে রাখতে চেয়েছিল সরকার। গত বছর পয়লা এপ্রিল জামাতি আর হেফাজতি মোল্লাদের তোষামোদ করতে গিয়ে যেভাবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রগতিশীল ব্লগারদের হাতকড়া পরিয়ে পাকড়াও করা হয়েছিল, তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এর পর থেকেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্লগারদের মুক্ত করতে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। আমাদের সে আহবানে সাড়া দিয়ে সারা বিশ্বের মুক্তচিন্তক আর মানবতাবাদীরা রাস্তায় নেমেছেন প্ল্যাকার্ড হাতে। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সিএফআই, অ্যাথিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস সহ বহু সংগঠনই বিবৃতি দিয়েছিল সরকারের বাক স্বাধীনতার উপর এই আগ্রাসনের প্রতিবাদে। আমি নিজেও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলাম আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। আর বাংলাদেশে ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টরা তো কয়েক দফা করে পথে নেমেছেন। আসিফ সহ অন্যান্য ব্লগারদের অবশেষে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, রাজীব হায়দারকে হত্যা করে কিংবা আসিফকে ছুরিকাঘাত কিংবা কারাবন্দী করে জনযুদ্ধ বন্ধ করা যায়নি, যায় না। স্মরণ করি মিখাইল বুলগাকভের উপন্যাস ‘মাস্টার এণ্ড মার্গারিটার’ বিখ্যাত উদ্ধৃতি –‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না’। মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে নাশ করা যায় না। মুক্তপথের সৈনিকদের ওপর ক্রমাগত আগ্রাসনে বোঝা যাচ্ছে রাষ্ট্র আর ধর্ম দুই ‘পালোয়ান’ই কতোটা মরিয়া। এখন আর ব্লগার এবং ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্টদের প্রভাবকে তারা অস্বীকার করতে পারছেন না। মুক্তচিন্তার প্রসারে তারাই আসলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তাই বেছে নিয়েছে সহিংসতা আর নির্যাতনের পথ। আসিফ প্রমাণ করে দিয়েছে নপুংসক ঈশ্বরের আর ‘শান্তির ধর্মের’ সাচ্চা সৈনিকদের আদর্শ আর ঠুনকো বিশ্বাস যুক্তির সামনে কত অসহায়, কত মুমূর্ষু। বিজ্ঞান, যুক্তি আর মানবতার আঘাতে যেন তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে ধর্মের অচলায়তন। শান্তির মুখোশ ভেদ করে উঁকি দেয় ধর্মের সফেদ মুখ। বড় কুৎসিত সেই রূপ। আসিফ যেন অভিমন্যুর মতোই ব্যূহভেদ করে ভেতরকার কদর্য রূপটি আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে। অভিনন্দন আসিফ।

বাংলাদেশের একজন ব্লগারের নামও বহির্বিশ্বে কেউ জানলে, সেটা আসিফ । আসিফ আজ একটি চেতনার নাম, নাম একটি অসমাপ্ত জনযুদ্ধের। যে জনযুদ্ধ মৌলবাদ, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, শোষণ এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপোষহীন। নিঃসীম আঁধারের সমস্ত কালিমা ঘুচিয়ে আলোর নিশান জ্বালাবার ব্রত নিয়েছে যেন আসিফ। স্বর্গলোভ, আত্মা, অমরত্ব, ব্রাহ্মন্যবাদী কপটতা প্রভৃতি অস্বীকারের যুক্তিবাদ আর মুক্তবুদ্ধির যে বহ্নিশিখা সেই চার্বাক, ভৃগুদের হাতে প্রজ্বলিত হয়েছিল এক সময়,যে শিখা জাজ্বল্যমান রেখেছিলেন ভগৎ সিং, আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, কিংবা পশ্চিমে ফ্রান্সিস বেকন, বার্ট্রান্ড রাসেল, রবার্ট গ্রিন ইঙ্গারসোল আর রিচার্ড ডকিন্সের মত বরেণ্য চিন্তাবিদেরা, তরুণ আসিফ আমাদের সময়ে সেই চলমান যুদ্ধের মশালবাহী পাঞ্জেরি।

আসিফকে অভিবাদন আবারো, …।


সম্পাদকের বক্তব্যঃ অভিজিৎ দা যে আমার একটি বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন, সেটা সে সময়ে আমার জানা ছিল না। কলকাতা থেকে আমার একটি লেখার সংকলন বের হয়েছিল, যারা বের করেছেন তারাই অভিজিৎ দা’র এই মুখবন্ধটি বইটিতে যুক্ত করে দিয়েছেন। অভিজিৎ দা নিজেই ইচ্ছে করে আগ্রহ দেখিয়ে লিখে দিয়েছিলে মুখবন্ধটি। আমার জন্মদিনে জন্মদিনের উপহার হিসেবে তিনি সেটি শেয়ারও করেছিলেন ফেইসবুকে। স্মৃতি হিসেবে তাই যুক্ত করে রাখছি আমার ওয়াবসাইটে।

অভিজিৎ দা বাঙলা ব্লগকে কী দিয়েছেন সেই হিসেবে যাবো না। তবে এইটুকু বলতে পারি, তার তিলে তিলে গড়ে তোলা রাস্তায় আমরা এখন অনেক মানুষ। অভিজিৎ দা’র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

ছবিঃ অভিজিৎ রায়ের ফেইসবুক পাতা থেকে।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

One thought on “অভিজিৎ রায়ের মুখবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *