হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস-রহস্যঃ সংস্কৃত সাহিত্য

গোমাংস 32

পূর্ববর্তী পর্বঃ-

হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস-রহস্যঃ বেদ ; হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস-রহস্যঃ বেদাঙ্গ ; হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস-রহস্যঃ ধর্মশাস্ত্র ; হিন্দু ধর্ম ও গোমাংস-রহস্যঃ রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ

শুধু ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে নয়, সংস্কৃত ভাষার নানা সাহিত্যেও গোমাংসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

মেঘদূতে

সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে কালিদাস একটি বিখ্যাত নাম। তিনি ৬৩৪  খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী ছিলেন। মেঘদূত তার বিখ্যাত এক রচনা।তিনি তার মেঘদূতের পূর্বমেঘে মহাভারতে উক্ত রন্তিদেবের স্মৃতিচারণ করেন। মহাভারতে রন্তিদেব যজ্ঞে এত গোহত্যা করেছিলেন যে তাদের রক্তে চর্মণ্বতী নামক নদী উৎপন্ন হয়েছিল।  কালিদাসের মেঘদূতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায় –

আরাধ্যৈনং শরবণভবং দেবমুল্লঙ্ঘিতাধ্বা

সিদ্ধদ্বন্দ্বৈর্জলকণভয়াদ্বীণিভির্মুক্তমার্গঃ।

ব্যালম্বেথাঃ সুরভিতনয়ালম্ভজাং মানয়িষ্যন্

স্রোতোমূর্ত্ত্যা ভুবি পরিণতাঃ রন্তিদেবস্য কীর্ত্তিং।।  মেঘদূত ১/৪৬

অনুবাদঃ এই শরজন্মা ভগবান কার্তিকেয়কে আরাধনা করিয়া , বীণাধারী সিদ্ধমিথুনগণ পথ ছাড়িয়া দিলে , তুমি কিয়ৎ পরিমাণে অধ্বাতিক্রমণপুরসব চর্মণ্বতীর সৎকারার্থ অবতরণ করিও। ঐ নদী গোগণের নিধন হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছে এবং দেখিলে বোধ হয় , যেন মহারাজ রন্তিদেবের কীর্তি সাক্ষাৎ স্রোতোমূর্তিতে পৃথিবীতে অবতরণ করিয়াছে।

পাঁচকরি ঘোষ পদ্যে মেঘদূত ১/৪৬ এর অনুবাদ করেছেন-

“পত্নীসহ সিদ্ধগণ ( যার পূজা তরে

আসি ) বীণাকরে পথ যাইলে ছাড়িয়া –

বৃষ্টিপাতে তন্ত্রীসিক্ত হইবার ডরে,-

শরবনজাত সেই কার্তিকে পূজিয়া ,

কিছুদূরে সসম্ভ্রমে নামিবে (অচিরে)-

রন্তিদেবকীর্তিরূপা যেথা চর্মণ্বতী ,

উদ্ভুত হইয়া তার গোমেধরুধিরে ,

প্রবাহিতা ধরাধামে নদী মূর্তিমতি- “

তিনি রন্তিদেবের সম্বন্ধে লিখেছেন- “ রন্তিদেব- দশপুরাধিপতি চন্দ্রবংশীয় ধার্মিক কীর্তিকুশল রাজা। কথিত আছে , তিনি গোমেধ যজ্ঞোপলক্ষে এত অধিক গোবধ করিয়াছিলেন যে , তাহার রুধিরস্রোতঃ চর্মণ্বতী নাম্নী নদীরূপে পরিণত হইয়াছিল। বলা ভালো, বৈদিক যুগে যজ্ঞার্থ গোবধ পাতক বলিয়া গণ্য ছিল না।“

চর্মণবতী সম্বন্ধে উনি লিখেছেন- চর্মণ্বতী হইল আধুনিক চম্বল । উহা বিন্ধ্যাচল হইতে উত্থিত হইয়া , প্রায় ২৮৫ ক্রোশ দূরে , যমুনায় মিলিত হইয়াছে।

অখিল চন্দ্র পালিত  মেঘদূত ১/৪৬ এর  অনুবাদে লিখেছেন-

“ তুমি কার্তিকেয়ের পূজা করিয়া পুনরায় গমন করিতে থাকিবে। পাছে জল লাগিয়া বীণার তার ভিজিয়া যায়, সেই ভয়ে বীণাধারী সিদ্ধ দম্পতিগণ তোমার পথ ছাড়িয়া দিবে। পরে সম্মুখে দেখিবে চর্মণবতী নদী । সেই নদী রন্তীদেব রাজার গোমেধ যজ্ঞে নিহত গো সকলের চর্মনিঃসৃত রক্ত হইতে জাত। রন্তিদেব রাজার মূর্তিমতী কীর্তি ঐ নদীরূপে প্রবাহিতা ঐ নদীকে সম্মান করিবার জন্য তুমি অবতরণ করিবে।“

চর্মণ্বতীর টিকায় তিনিও লিখেছেন- “ চন্দ্রবংশীয় মহারাজ ভরতের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ সৎকীর্তির পুত্র মহারাজ রন্তিদেব দশপুর রাজ্যে রাজত্ব করিতেন। (দশপুর-মান্দাশোর আধুনিক দশোর) তিনি গোমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করিয়াছিলেন। চর্মনিঃসৃত শোণিত হইতে জাত বলিয়া উহার নাম চর্মণবতী হইয়াছে। চর্মণবতীর আধুনিক নাম চম্বল।“

রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য মেঘদূতের অনুবাদে লিখেছেন-
” মেঘ! এই শরবনজাত কার্ত্তিকদেবকে পূর্বোক্ত প্রথায় অর্চনা করিয়া তুমি যতই অগ্রসর হইতে থাকিবে, ততই এক আশ্চর্য ব্যাপার তোমার চোখে পড়িবে। দেখিবে, আকাশ পথে সিদ্ধ ও তাহাদের গৃহিণীরা জোড়ায় জোড়ায় বীণাবাদন পূর্বক গান গাহিয়া বেড়াইতেছেন। তুমি ছুটিয়া চলিয়াছ দেখিয়া তাহারা তাড়াতাড়ি তোমার পথ ছাড়িয়া দূরে সরিয়া যাইবেন- যদি তোমার জলের ছিটা লাগিয়া তাহাদের এত শখের বীণাগুলির সুর খ্যাঁৎখ্যাঁতে হইয়া যায়। তারপরেই দেখিবে ভূপৃষ্ঠে চর্মণ্বতী (চম্বল) তরতর করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। ভাই রে, ও নদী নয়, নদীর রূপ ধরিয়া উহা রাজা রন্তিদেবের কীর্তিপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন গতিতে বহিয়া যাইতেছে। রন্তিদেব গোমেধযজ্ঞ করিয়া কামধেনু সুরভীর তনয়াদিগকে (গাভীদিগকে) নিহনন করিয়াছিলেন, সেই নিহিত ধেনুদিগের চর্ম হইতে যে রক্তধারা ছুটিয়াছিল, তাহাই স্রোতোরূপে ঐ প্রবাহিতা হইতেছে। তুমি উহার সম্মান রাখিতে ভুলিও না। তার একটু পবিত্র জল স্পর্শ করিবার জন্য খানিকটা নিচুতে নামিও।”
(কালিদাস রচনাবলী (অখণ্ড সংস্করণ) / মেঘদূত ; সম্পাদকঃ অধ্যাপক সমরেশ মৈত্র ও প্রফুল্ল কুমার পাত্র ; পাত্র’জ পাবলিকেশন, চতুর্থ প্রকাশ- জানুয়ারী, ১৯৯৬)


সুধাংশু রঞ্জন ঘোষ মেঘদূতের আলোচ্য অংশের অনুবাদ করেছেন এভাবে-
” হে মেঘ, শরবনজাত এই কার্ত্তিকদেবের অর্চনা করার পর তুমি যতই এগিয়ে যাবে, ততই এক আশ্চর্য ব্যাপার চোখে পড়বে তোমার। দেখবে, আকাশ পথে সিদ্ধ ও সিদ্ধাঙ্গনারা জোড়ায় জোড়ায় বীণা বাজিয়ে গান করে বেড়াচ্ছে। তুমি ছুটে চলেছ দেখে তারা তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে সরে যাবে পাছে তোমার গায়ের জল লেগে তাদের বীণার তার ভিজে যায়। তারপরেই দেখবে চর্মণ্বতী বা চম্বল নদী তর তর বেগে বয়ে চলেছে। ও যেন নদী নয়, রাজা রন্তিদেবের কীর্তিপ্রবাহ নদীর রূপ ধরে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বয়ে চলেছে। রাজা রন্তিদেব গোমেধ যজ্ঞ করে কামধেনু সুরভির তনয়া গাভীদের নিধন করেছিলেন। সে নিহত গাভীদের চর্ম হইতে যে রক্ত ঝরেছিল, সেই রক্তই চর্মণ্বতী বা চম্বল নদীর স্রোতোরূপে বয়ে চলেছে। তুমি তার সম্মান রাখতে তার পবিত্র জল স্পর্শ করার জন্য কিছুটা নিচে নেমো।”
(কালিদাস রচনাসমগ্রঃ গদ্যে মহাকবী কালিদাসের সমস্ত রচনা ; প্রকাশনী- তুলি-কলম; জুন ১৯৯১)

সত্য নারায়ণ চক্রবর্তী মেঘদূত ১/৪৬ এর অনুবাদ করেছেন-

“শরবনে জাত কার্তিকেয়ের এইভাবে আরাধনা করার পর তুমি যাওয়ার উপক্রম করলে বীণাধারী সিদ্ধ দম্পতিরা তোমার বৃষ্টিজালে বীণা ভিজে যাওয়ার ভয়ে তোমার পথ ছেড়ে দেবে। তারপর রন্তিদেবের কীর্তিকে সম্মান জানানোর জন্য তুমি ( চর্মণ্বতী) নদীর উপর ঝুঁকে পড়বে। রন্তিদেবের গোমেধ যজ্ঞের কীর্তিই পৃথিবীতে আজ (চর্মণ্বতী) নদী হয়ে বইছে। “ ( মেঘদূত ও সৌদামনী ; সম্পাদক- সত্য নারায়ণ চক্রবর্তী , প্রকাশক- সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার )  (*)

উত্তর রাম চরিতে

৮ম শতাব্দীর বিখ্যাত সংস্কৃত কবি ও নাট্যকার ভবভূতি রামায়ণ অবলম্বন করে লিখেছিলেন  ‘উত্তররামচরিত’ নামক নাটক। এই নাটকে ঋষি বশিষ্ঠ গোমাংস খেতে দেখা যায়। বাল্মীকির আশ্রমে বশিষ্ঠ উপস্থিত হলে তাকে মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। মধুপর্কে গোমাংস দেওয়ার রীতি ছিল।সেই রীতি অনুসারেই ঋষি বশিষ্ট গোমাংস সহযোগে মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়িত হন। বশিষ্ঠ আস্ত একটা বাছুর একাই খেয়ে ফেলেছিলেন। তা দেখে আশ্রমের এক তপস্বী তামাশা করে বলেছিলেন, বশিষ্ঠ ‘কোনো এক বাঘই হবেন’ , নইলে কিভাবে আস্ত একটা গোবৎসকে কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন?   

উত্তর রামচরিতের আলোচ্য অংশের অনুবাদ  নিচে দেওয়া হল-

“ (দুই তাপসের প্রবেশ)

প্রথম- সৌধাতকি! অধিকসংখ্যক অতিথির সমাগমে পরিপূর্ণ, তাদের অভ্যর্থনার বিপূল আয়োজনে সমৃদ্ধ, ভগবান বাল্মীকির আশ্রমের সৌন্দর্য দেখ।

যেহেতু-

সদ্যপ্রসূতা হরিণীর পানাবশিষ্ট নীবার ধানের উষ্ণ-মধুর মণ্ডপানীয় পর্যাপ্তরূপে পান করেছ আশ্রমমৃগ। বদরীফলযুক্ত শাকসবজিপাকের সৌরভ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে অনুসরণ করছে ঘৃতমিশ্রিত অন্নপাকের সুগন্ধ।। ১ ।।

সৌধাতকি- এই বিচিত্র শ্বেতশ্মশ্রু তপোধনদের স্বাগত জানাই, যারা অনধ্যায়ের কারণ।

প্রথম- (হেসে) সৌধাতকি, গুরুজনদের প্রতি তোমার সম্মান জানানোর কারণটি অদ্ভুত।

সৌধাতকি- হে দণ্ডায়মান! যে অতিথি আজ বিশাল স্ত্রীগণের ধুরন্ধর রূপে সম্প্রতি এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তার নাম কি?

দণ্ডায়ন- তোমার পরিহাসকে ধিক! ভগবান বশিষ্ঠ পুরোভাগে অরুন্ধতীকে এবং সঙ্গে মহারাজ দশরথের মহিষীদের নিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম থেকে এই উপস্থিত হয়েছেন। তবে এভাবে প্রলাপ বকছ কেন?

সৌধাতকি- হু, বশিষ্ঠ!

দণ্ডায়ন- নিশ্চয়ই।

সৌধাতকি- আমি কিন্তু ভেবেছিলাম, ইনি কোনও এক বাঘই হবেন।

দণ্ডায়ন- আঃ, কি বলা হচ্ছে?

সৌধাতকি- তিনি উপস্থিত হয়েই সেই ধূসর বর্ণের কল্যাণী গোবৎসকে কড়মড় করে চিবিয়ে ফেললেন।

দণ্ডায়ন- ‘সমাংস মধুপর্ক’ দিবে এই শাস্ত্রবাক্যানুসারে গৃহস্থেরা অভ্যাগত শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণকে বকনা বাছুর কিংবা বড় ষাঁড় উপহার দেন। ধর্ম শাস্ত্রকারেরা এটিকে কর্তব্যরূপে নির্দেশ করেছেন।

সৌধাতকি- ওহে! তুমি নিগৃহীত হলে।

দণ্ডায়ন- কি রকম?

সৌধাতকি- যেহেতু, বশিষ্ঠ উপস্থিত হওয়ায় বকনা বাছুর বধ করাহল। কিন্তু আজই রাজর্ষি জনক আসায় ভগবান বাল্মীকি কেবল দধি ও মধুদ্বারাই মধুপর্ক সম্পাদন করলেন, বাছুর বাদ দিলেন।

দণ্ডায়ন- যারা মাংসাহার থেকে নিবৃত্ত নন, তাদের জন্য কেউ কেউ এরূপ রীতি স্থির করেছেন। কিন্তু পূজ্যপাদ জনক মাংসাহার বর্জন করেছেন।

সৌধাতকি- কি কারণে?

দণ্ডায়ন- যে মুহূর্তে তিনি সীতাদেবীর সেই দৈবদুর্বিপাকের কথা শুনেছেন, সেই মুহূর্তে তিনি বানপ্রস্থ অবলম্বন করে কয়েক বছর হল চন্দ্রদ্বীপের তপোবনে তপস্যা করছেন। “

( উত্তররামচরিত/ চতুর্থ অঙ্ক ; সম্পাদক- ডঃ সীতানাথ আচার্য শাস্ত্রী এবং ডঃ দেবকুমার দাস ; পাবলিশার- সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার)

উত্তর রামচরিতের আলোচিত অংশের বিমলা দাশগুপ্তের অনুবাদ নিচে দেওয়া হল-

“ (তাপসদ্বয়ের প্রবেশ)

এক। সৌধাতকি! দেখ আজ ভগবান বাল্মীকির আশ্রমে অতিথি সৎকারের  কি বিপুল আয়োজন আরম্ভ হইয়াছে , তাই আশ্রম মৃগেরা প্রেমের বশবর্তী হইয়া প্রথমে সদ্যপ্রসূতা প্রিয়াকে ঈষৎ উষ্ণ সুস্বাদু অন্নের মণ্ড পান করাইয়া অবশিষ্ট ভাগে নিজের উদর পূরণ করিতেছে। আবার ঘৃতপক্ক অন্ন এবং অম্লমিশ্রিত শাকের সুগন্ধে চারিদিক কেমন আমোদিত হইয়াছে।

সৌধাতকি। আজ বুঝি এই পক্কশ্মশ্রুধারীদিগের অধ্যাপনা হইতে বিরত থাকিবার কোন বিশেষ কারণ উপস্থিত হইয়াছে?

প্রথম। (হাস্য পূর্বক) সৌধাতকি! ছি! গুরুজনদের বিষয়ে কি এমন পরিহাস করিতে আছে? তাহারা যে বহু সম্মানের পাত্র; তা কি জান না?

সৌধাতকি। ওহে ভাণ্ডায়ন! ওই বৃদ্ধ দলের অগ্রণীর নাম জান কি?

ভাণ্ডায়ন। থাম হে! তোমার বুঝি আর ব্যঙ্গ করিবার পাত্রাপাত্র জ্ঞান নাই! ইনি যে মুনিবর ভগবান বশিষ্ঠ, নিজের সহধর্মিণী অরুন্ধতীকে অগ্রবর্তিনী করিয়া রাজা দশরথের মহিষীগণসহ উপস্থিত হইয়াছেন। ইহাদের মত মহাজনদের প্রতি তোমার একি প্রলাপবাক্য হে?

সৌধাতকি। হুঃ বশিষ্ঠ।

ভাণ্ডায়ন। হ্যাঁ গো হ্যাঁ , স্বয়ং তিনিই ।

সৌধাতকি। আমি আরো মনে করিয়াছিলাম ব্যাঘ্র বা বৃক হইবে।

ভাণ্ডায়ন। আঃ কি বললে!

সৌধাতকি। এই আগন্তুক যে আসতেমাত্র আমাদের কল্যাণী নাম্নী সেই নিরীহ গোবৎসটিকে মড় মড় শব্দে চর্বণ করিলেন!

ভাণ্ডায়ন। ধর্মশাস্ত্রকারেরা শাস্ত্রের বিধি স্মরণ করিয়া বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ অতিথির অভ্যর্থনার নিমিত্ত , গৃহস্থধর্মাবলম্বীদিগের দধি মধুর সহিত বৎসতরী, বড় ষাঁড় বা ছাগ দান বিহিত মনে করিয়া থাকেন।

সৌধাতকি। বা বেশ ত! নিজেই যে নিজের কথা খণ্ডন করিলে!

ভাণ্ডায়ন। সে কেমন?

সৌধাতকি। তা নাত কি? একত্রে সমাগত বশিষ্ঠাদিকে মধুপর্কের সহিত বৎসাতরী দান করা হইল ! আর রাজর্ষি জনকের জন্য কেবল দধি মধুরই ব্যবস্থা হইল। বৎসতরীর প্রয়োজন হইল না।

ভাণ্ডায়ন। কি জান!  আমিষভোজিদের জন্যই ঋষিগণের এই বিধান , কিন্তু রাজর্ষি জনক নিরামিষাহারী , সুতরাং তাহার সম্পর্কে ভিন্ন ব্যবস্থা চাইত?

সৌধাতকি। কেন ? তার মাংস ভক্ষণ না করিবার কারণ?

ভাণ্ডায়ন। সীতাদেবীর নির্বাসনের কথা শোনা অবধি ক্ষোভে তিনি বানপ্রস্থ ধর্ম অবলম্বন করিয়া চন্দ্রদ্বীপ তপোবনে বহুকাল তপস্যায় নিরত ছিলেন।“  

( প্রকাশক- দি মডার্ন পাবলিশিং হাউজ)

মহাবীর চরিতে

ভবভূতি হলেন অষ্টম শতাব্দীর একজন কবি ও নাট্যকার। তার মহাবীর চরিতেও গোমাংসের কথা পাওয়া যায়।  ভবভূতির মহাবীর চরিত বশিষ্ট ও বিশ্বামিত্র পরশুরামকে রাজা জনকের আতিথেয়তা স্বীকার করতে বলেন। রাজা দশরথের মেনুতে গরুর মাংসও ছিল। মহাবীর চরিতের সেই অংশটি নিচে উল্লেখ করা হল-

দৃশ্য। যজ্ঞ সভা

( বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, জনক ও শতানন্দের প্রবেশ)

বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র- শোনো জমদগ্ন্য!

যজ্ঞ পূর্ত কর্মাদির                   বিঘ্নকারী মহাশত্রু

                    যে রাক্ষসগণ

তাদের দমন করি                   হলেন ইন্দ্রের যিনি

                   মিত্র প্রিয়তম,

বজ্রীর দ্যুলোক সম                  ভুলোকে স্বরাজ্য যিনি

                   করিলা স্থাপন,

যাহার সম্মুখে থাকি                 মোরা দোঁহে করি সদা

                   মঙ্গল চিন্তন,

অধিক বলিব কিবা –                সূর্যোবংশোদ্ভব যিনি

                                   -অধিপতি এই বিশ্ব মাঝে,

সেই পুত্র প্রিয় রাজা                 বয়োবৃদ্ধ দশরথ

                                    অভয় যাচেন তোমা কাছে।।

অতএব আপনি এই নিস্ফল কলহ হতে বিরত হোন। দেখুন-

বৃহৎ বাছুর এক হইয়াছে আনা তব তরে,

অন্ন হইতেছে পাক দিয়া তাহে ঘৃত।

শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ তুমি , আসিয়াছ শ্রোত্রিয়ের ঘরে।

আতিথ্য গ্রহণ করি কর আপ্যায়িত।।

( মহাবীর চরিত/ ৩য় অঙ্ক ; অনুবাদক- শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর )

বালরামায়ণে

দশম শতাব্দীর রাজশেখর এর বালরামায়ণে দেখা যায়, শতানন্দ শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ হিসাবে রাবণকে বরণ করে এবং প্রথা অনুযায়ী তার জন্য ষাঁড় অথবা ছাগলের মাংসের ব্যবস্থা করে।(1)

নৈষধীয় চরিতে

শ্রীহর্ষ হলেন দ্বাদশ শতাব্দীর একজন কবি। তিনি নৈষধীয়চরিত রচনা করেছিলেন।  তার নৈষধীয়চরিতের ১৭ তম সর্গে পাওয়া যায়- কলি দময়ন্তীর স্বয়ম্বরে দময়ন্তিকে লাভ না করে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং নলের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার রাজধানী ধ্বংস করার মনঃস্থির করে। সে এক বৈদিক ধর্মস্থলের কেন্দ্র দেখতে পায়। একসময় বলির গরু দেখতে পেয়ে কলি উৎফুল্ল হয়ে তার দিকে ছুটে যায় কিন্তু সেই গরু তাকে দূরে সরিয়ে দেয়-

हिंसागवीं मखे वीक्ष्य रिरंसुर्धावति स्म सः ।
सा तु सौम्यवृषासक्ता खरं दूरान्निरास तम् ॥  ১৭৩

অর্থঃ- গোমেধ যজ্ঞে বধ করার জন্য আনা গরুকে দেখে কলি রতির ইচ্ছা সদৃশ চিত্তবিনোদে ইচ্ছুক হয়ে দৌড়েছিল কিন্তু সৌম্য অর্থাৎ রমণীয় বৃষভে আসক্তা সদৃশ সোমদেবের সাধক ধর্ম এর সাধিকা সেই গরু দুষ্ট গাধাকে (কলিকে) দূর থেকেই সরিয়ে দিয়েছিল। অথচ যজ্ঞকারীদের মুখে বাণীরূপা গরুকে শুনে সে এইভেবে প্রসন্ন হয়ে দৌড়েছিল যে পশুহত্যার পাপ হওয়ার কারণে সে সুযোগ পাবে কিন্তু সেই গো বাণীকে দেবযজনে আসক্ত দেখে সেই কলি তেজহীন হয়ে দূর থেকেই নিরস্ত হয়ে গেল।

টীকাঃ-  গোমেধ যজ্ঞে বলির জন্য বাঁধা গরুকে দেখে দুষ্ট গাধা কলি মনে করলো, এখন তো গোহত্যার পাপ হবে।  সুযোগ পেয়েছে ভেবে কলি প্রসন্ন হয়ে দৌড়েছিল। কিন্তু যেভাবে দুষ্ট গাধাকে গরু তিরস্কৃত করে থাকে, তেমনি সেই গরুটি তাকে দূর করে দিয়েছিল। অর্থাৎ, গোহত্যার সম্ভাবনাকে কলি নিজের জন্য উপযুক্ত সুযোগ মনে করেছিল কিন্তু যখন সে জানতে পারলো এটা পাপ নয় বরং গোমেধ যজ্ঞ একটি ধার্মিক কার্য , তখন সে দূর হতেই নিরাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল। নারায়ণী টীকায় এই শ্লোকটি পরবর্তী ‘ববাপি নাপশ্যদ…” ইত্যাদি শ্লোকের পরে রয়েছে। ( অনুবাদক- Dr. Dewarshi Sanandhya Shastri , পাবলিশার- Chowkhamba krishnadas Academy)

এই সর্গেরই ১৯৭ তম শ্লোকে আবারো গোহত্যার কথা পাওয়া যায়। সেখানে বলা আছে, একটি নিহত গরুকে দেখে কলি উৎফুল্ল হয়ে তার দিকে ছুটে গিয়েছিল কিন্তু গরুটি অতিথিদের সৎকারের জন্য বোঝার পর সে ফিরে গিয়েছিল-

अधावत्क्वापि गां वीक्ष्य हन्यमानामयं मुदा ।
अतिथिभ्यस्तथा बुद्ध्वा मन्दो मन्दं न्यवर्तत ॥

অর্থঃ- সে (কলি) কোথাও (যজ্ঞশালা প্রভৃতিতে) হত্যা করা গরুকে দেখে দৌড়ে গিয়েছিল কিন্তু তাকে (গরুটিকে) অতিথির জন্য মারা হয়েছে জানতে পেরে , পরাজিত হয়ে ফিরে গিয়েছিল।

টীপ্পনিঃ- গোহত্যার পাপ দেখে কলি খুশি মনে দৌড়ে গিয়েছিল কিন্তু পরে যখন আশাহত হয়েছিল , তখন ক্লান্ত, পরাজিত হয়ে ফিরে গিয়েছিল। অতিথি সৎকারের জন্য সেই গরুটিকে হত্যা করা হয়েছিল, যা বৈধ ছিল। ( অনুবাদক- Dr. Dewarshi Sanandhya Shastri , পাবলিশার- Chowkhamba krishnadas Academy)

(চলবে…)


তথ্যসূত্র-

(1) D.N. Jha , Myth of the Holy Cow

(2) D.N. Jha , Myth of the Holy Cow

(*) ( hindi translation by keshavprasad Mishra)

View Comments (2)

  • আপনার লেখা এবং প্রয়াস বরাবর আমার ভালো লাগে। বর্তমানে গোমাংস নিয়ে বাড়াবাড়ির সময়ে এই লেখাগুলি খুবই প্রাসঙ্গিক।
    তবে এই লেখাটিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কপি পেষ্ট না করে সম্পাদনা করে লিখলে আরও সুখপাঠ্য হতো। গোমাংস ভক্ষণের বিভিন্ন সময়কালের উল্লেখ আপনি করেছেন, তবে সেটা ক্রণোলজিক্যালি করলে ঠিক কোন সময় থেকে গোমাতার সন্তানরা এমন রিজিড হয়ে উঠলো, তার পিছনে কোন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো তা আরও ভালোভাবে বোঝা যেত।

  • আপনার মতামতের জন্য অত্যন্ত ধন্যবাদ। কিন্তু বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর যে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়া লিখলে কেউ এসব সহজেই অস্বীকার করতে পারে এবং তাদের মিথ্যাপ্রচার দ্বারা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারে।

    হিন্দু ধর্মে গোমাংস নিয়ে ৭/৮ টি পর্ব ইতিমধ্যে লেখা হয়েছে। এই লেখাতেও লিংক পাবেন অন্যান্য লেখার। অথবা লেখাটির উপরের দিকে 'হিন্দু ধর্মে গোমাংস' বলে একটা ট্যাগ আছে। তাতে ক্লিক করলেই এ সম্পর্কিত সব লেখা সামনে চলে আসবে। এ বিষয়ে আরও অর্ধেক বাকি আছে এখনো লেখার।

    হিন্দু ধর্মে যেমন গোমাংস খাওয়ার বিধান মেলে, তেমনি নিষেধাজ্ঞাও আছে। কেন গোমাংস খাওয়া বন্ধ হল, কিভাবে গোহত্যা মহাপাপ হল ইত্যাদি নিয়ে অনেকগুলো পর্ব লেখা হবে।

    লেখাটি সংক্ষেপে গল্পের আকারে হয়তো লেখা যেত। কিন্তু আগেই বলেছি এমন লেখা সহজেই অস্বীকার করা যায়। তাই একেকটি অংশের একাধিক অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা আমি করেছি, যাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এতে যারা তথ্য অনুসন্ধানী তাদেরও সুবিধা হবে।

    গোমাংস সম্বন্ধীয় লেখাগুলো সময়ের উপর ভিত্তি করে সাজানো হয়নি, বরং ধর্মীয় টেক্সট হিসেবে গুরুত্বের দিক থেকে সাজানো হয়েছে। প্রথমে বেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ প্রভৃতির কথা আছে, এরপর গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র ইত্যাদির কথা আছে, এরপর ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির কথা আছে, এরপর সংস্কৃত সাহিত্য, পাণিনী, অর্থশাস্ত্র, ত্রিপিটক, চরক,সুশ্রুত ইত্যাদি আছে।

Leave a Comment