আব্বাসীয় খিলাফত (Abbasid Caliphate): ইতিহাসের সোনালী মরীচিকা এবং ক্ষমতার দাবাখেলা
Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 বিপ্লবের প্রেক্ষাপট: ক্ষোভের বারুদ এবং হাশিমী প্রোপাগান্ডা
- 3 কালো পতাকার উত্থান: আবু মুসলিম এবং জাবের যুদ্ধ
- 4 প্রকৃত স্থপতি: আল-মনসুর এবং গোলকধাঁধার শহর বাগদাদ
- 5 হারুনুর রশীদ: মিথ, বাস্তবতা এবং বার্মাকি ট্র্যাজেডি
- 6 বায়তুল হিকমাহ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাবিস্ফোরণ
- 7 মুতাজিলা মতবাদ: যুক্তির জয়গান এবং মিহনা
- 8 অর্থনীতি, সমাজ এবং বিলাসিতা: আব্বাসীয় স্বর্ণযুগের অন্দরমহল
- 9 সাহিত্য এবং বিনোদন: মদের পেয়ালা, কবিতার ছন্দ এবং আদব সংস্কৃতির বিকাশ
- 10 আব্বাসীয় খিলাফত ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য: চিরশত্রুতা, সীমান্ত সংঘাত এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়
- 10.1 বার্ষিক গ্রীষ্মকালীন অভিযান (The Summer Raids): জিহাদ ও লুটের অর্থনীতি
- 10.2 হারুনুর রশীদ ও নাইসেফোরাস: ইতিহাসের বিখ্যাত দ্বৈরথ
- 10.3 আল-মামুন ও আল-মু’তাসিম: আমোরিয়াম বিজয় এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক যুদ্ধ
- 10.4 শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন (Shift of Balance): বাইজান্টাইন পুনরুত্থান
- 10.5 কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়: যুদ্ধের অবসরে
- 10.6 মহাকালের রায়
- 11 অবনতির শুরু: ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ এবং তুর্কি প্রহরীদের উত্থান
- 11.1 তুর্কি বাহিনীর উত্থান: প্রিটোরিয়ানইজম এবং বিচ্ছিন্নতা
- 11.2 সামারার নৈরাজ্য: খলিফা যখন দাবার ঘুঁটি
- 11.3 আব্বাসীয় পুনর্জাগরণ: আল-মুওয়াফফাকের লৌহমুষ্টি এবং ক্ষণস্থায়ী বসন্ত (৮৭০–৯৪৫ খ্রি.)
- 11.4 আব্বাসীয় খিলাফত এবং প্রাদেশিক রাজবংশ: কেন্দ্রবিমুখী ক্ষমতার সমীকরণ
- 11.4.1 তাহিরিদ রাজবংশ: খোরাসানের রাজপ্রতিনিধি এবং আব্বাসীয়দের ঢাল (৮২১–৮৭৩ খ্রি.)
- 11.4.2 সাফফারিদ রাজবংশ: তাম্রকারের বিদ্রোহ এবং বাগদাদের আতঙ্ক (৮৬১–১০০৩ খ্রি.)
- 11.4.3 তুলুনিদ রাজবংশ: মিশরের স্বায়ত্তশাসন এবং স্বর্ণের মোহ (৮৬৮–৯০৫ খ্রি.)
- 11.4.4 সামানিদ রাজবংশ: সুন্নি ইসলামের প্রাচীর এবং পারসিক রেনেসাঁ (৮১৯–৯৯৯ খ্রি.)
- 11.4.5 হামদানিদ রাজবংশ: সীমান্ত প্রহরী এবং শিয়া সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক (৮৯০–১০০৪ খ্রি.)
- 11.4.6 ইখশিদিদ রাজবংশ: বাফার স্টেট এবং ক্ষণস্থায়ী স্থায়িত্ব (৯৩৫–৯৬৯ খ্রি.)
- 11.4.7 সাম্রাজ্য থেকে কমনওয়েলথে রূপান্তর
- 11.5 বাইজান্টাইন আগ্রাসন: আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের অনুঘটক
- 11.6 আব্বাসীয়, ফাতেমীয় ও হাশাশিন: ‘এন্টি-খলিফা’ এবং ছায়াযুদ্ধের ত্রিমাত্রিক সমীকরণ
- 11.7 বুয়াইদদের উত্থান: শিয়া আধিপত্য এবং খলিফার বন্দিদশা (৯৪৫–১০৫৫ খ্রি.)
- 11.8 সেলজুক তুর্কিদের আগমন: সুন্নি পুনজাগরণ এবং সুলতানি যুগের সূচনা (১০৫৫–১১৯৪ খ্রি.)
- 11.9 আব্বাসীয় খিলাফত ও ক্রুসেড: অক্ষমতার কান্না এবং প্রতীকী জিহাদ (১০৯৫–১২৫৮ খ্রি.)
- 11.10 আব্বাসীয় ও আইয়ুবিদ: বৈধতার বিনিময় এবং ক্রুসেডের রাজনীতি (১১৭১–১২৫০ খ্রি.)
- 11.11 সিরিয়ার আইয়ুবিদ ও আব্বাসীয় সম্পর্ক: শেষ প্রহরের টানাপোড়েন
- 11.12 আব্বাসীয়দের শেষ বসন্ত: আন-নাসিরের পুনজাগরণ এবং খাওয়ারিজমীয় জুয়া (১১৯৪–১২৫৮ খ্রি.)
- 11.13 খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য ও আব্বাসীয় খিলাফত: আধিপত্যের সংঘাত এবং সর্বনাশা ভুল
- 11.14 বাগদাদ ও কায়রো (১২৫০–১২৫৮): লিঙ্গ রাজনীতি এবং শেষ বিকেলের কূটনৈতিক লড়াই
- 12 ১২৫৮ সালের মহাপ্রলয়: বাগদাদের পতন এবং সভ্যতার যবনিকা
- 13 ১২৫৮ থেকে ১২৬১: শূন্যতার হাহাকার এবং মঙ্গোল মিথের পতন
- 14 আব্বাসীয় ও মামলুক: কায়রোর ছায়া খিলাফত এবং বৈধতার নাটক (১২৬১–১৫১৭ খ্রি.)
- 14.1 বাইবার্স এবং খিলাফতের পুনরুজ্জীবন: রাজনীতির নতুন সমীকরণ (১২৬১ খ্রি.)
- 14.2 সোনার খাঁচার পাখি: কর্তৃত্বহীনতার ট্র্যাজেডি
- 14.3 আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং ‘সফট পাওয়ার’ ডিপ্লোম্যাসি
- 14.4 ব্যতিক্রমী ঘটনা: খলিফা যখন সুলতান (১৪১২ খ্রি.)
- 14.5 শেষ দৃশ্য: অটোমান বিজয় এবং খিলাফতের স্থানান্তর (১৫১৭ খ্রি.)
- 14.6 ছায়ার আড়ালে ইতিহাসের সাক্ষী
- 15 আব্বাসীয় ইতিহাসের তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ: ইবনে খালদুন থেকে হজসন
- 16 উপসংহার: ইতিহাসের শিক্ষা ও মহাকালের রায়
- 17 তথ্যসূত্র
ভূমিকা
মহাকাল এক বড় অদ্ভুত ও খেয়ালি জাদুকর। তার বিশাল ঝুলিতে নশ্বর মানুষের জন্য কেবল দুটি জিনিসই বরাদ্দ থাকে – বিস্মৃতি অথবা ইতিহাস। আমরা আজ এক বিংশ শতাব্দীর চরম উৎকর্ষের যুগে দাঁড়িয়ে যে আধুনিক সভ্যতা নিয়ে গর্ব করি, যে বিজ্ঞান, দর্শন আর প্রযুক্তির মায়াজাল আমাদের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, তার শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে মধ্যযুগের ধুলোবালি ওড়া এক ধূসর অতীতের দিকে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু বাঁক থাকে, যখন পুরো পৃথিবীর গতিপথ বদলে যায়, যখন পুরনো সব ধ্যান-ধারণা চূর্ণ হয়ে জন্ম নেয় এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা। অষ্টম শতকের মধ্যভাগ ছিল তেমনই এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ। উমাইয়াদের (Umayyads) দাম্ভিকতা আর আরব আভিজাত্যবাদের প্রাসাদে ফাটল ধরিয়ে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটেছিল, যাদের নাম আব্বাসীয় (Abbasids)। এই পরিবর্তন কেবল একটি রাজবংশের পতন আর আরেকটির উত্থান ছিল না; এটি ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে এক বিশ্বজনীন সভ্যতা গড়ার প্রথম ধাপ।
সময়টা ছিল বড় গোলমেলে, যেন এক প্রলয়ের পূর্বাভাস। আরব মরুভূমির তপ্ত বালুকারাশিতে তখন রক্তের দাগ আর বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। ৭৫-এর দশক, তবে সেটা বিংশ শতাব্দীর নয়, অষ্টম শতাব্দীর ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ। এই একটি সাল কেবল শাসকের পরিবর্তন নির্দেশ করে না, এটি নির্দেশ করে মানুষের চিন্তার এক আমূল পরিবর্তন। দামেস্কের (Damascus) সংকীর্ণ আরব জাতীয়তাবাদ থেকে সরে এসে বাগদাদে (Baghdad) গড়ে উঠল এক কসমোপলিটান বা বিশ্বজনীন সাম্রাজ্য, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মেধার মূল্যায়ন হতো। এই সাম্রাজ্যের শাসকরা তরবারির চেয়ে কলমের কালিতে বেশি বিশ্বাস করতেন – এমনটা ভাবা ভুল হবে। তারা কলম ভালোবাসতেন ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে সেই কলম দিয়েই অবলীলায় মৃত্যুর পরোয়ানা সই করতেন। মানুষের মাথার খুলি দিয়ে মিনার বানানো আর লাইব্রেরিতে বসে অ্যারিস্টটল অনুবাদ করা – এই দুটি কাজই তারা সমান দক্ষতায় ও নিপুণতায় করত। একদিকে তারা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরম পৃষ্ঠপোষক, অন্যদিকে ছিল নির্মম স্বৈরাচার। এই অদ্ভুত দ্বান্দ্বিকতা বা ডুয়ালিজম (Dualism)-ই আব্বাসীয়দের ইতিহাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং রহস্যময় দিক।
আজকের এই লেখায় আমরা আব্বাসীয় খিলাফতের সেই দীর্ঘ ৫০০ বছরের ইতিহাসের অলিগলি ব্যবচ্ছেদ করব। আমরা দেখব, কীভাবে একটি সুসংগঠিত গোপন আন্দোলন (Underground Movement) বা ‘দাওয়া’ ধর্মকে পুঁজি করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এল, কীভাবে তারা মরুভূমির বুকে ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ’ (Golden Age of Islam) গড়ে তুলল, এবং কেনই বা সেই প্রবল প্রতাপশালী সাম্রাজ্য মঙ্গোলদের ঘোড়ার খুরের নিচে ধুলোয় মিশে গেল। এখানে কোনো দৈববাণী নেই, নেই কোনো অলৌকিকতার আশ্রয়। আছে কেবল মানুষের আকাশচুম্বী উচ্চাকাঙ্ক্ষা (Ambition), ধূর্ত রাজনীতি (Cunningness), জ্ঞানের প্রতি অদম্য তৃষ্ণা এবং সময়ের নির্মম পরিহাস। ইতিহাস যে কেবল রাজা-বাদশাহদের সাল-তারিখের হিসাব নয়, বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব, লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা আর সমাজ পরিবর্তনের জীবন্ত দলিল – এই লেখাটি সেই যাত্রাপথেই হাঁটবে। আমরা দেখব, শতাব্দী পাল্টালেও মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তি বদলায় না, মানুষ আসলে বদলায় না, কেবল সময় আর প্রেক্ষাপট বদলায়।
এই প্রবন্ধটি আব্বাসীয় ইতিহাসকে সরল সাল-তারিখের বদলে একাধিক থিম্যাটিক ফেজে ভেঙে দেখিয়েছে—বিপ্লব, খোরাসানের গণউত্থান, বাগদাদের নির্মাণ, বায়তুল হিকমাহ ও বিজ্ঞান, মুতাজিলা ও মিহনা, দাসপ্রথা ও জাঞ্জ বিদ্রোহ, সাহিত্য ও আদব, অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়, মঙ্গোল আক্রমণ এবং শেষে ইবনে খালদুন থেকে আধুনিক স্কলারদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। নিচের মানচিত্রটি সেই ফেজগুলো এক নজরে বোঝাবে।
হাশিমীয়া দাওয়াহ নামের গোপন রাজনৈতিক সংগঠন ধর্মীয় ভাষা ও ভবিষ্যদ্বাণী ব্যবহার করে উমাইয়া বিরোধী জনস্রোতকে নিজেদের দিকে টেনে নেয়। “আল-রিদা মিন আল-মুহাম্মাদ”, কালো পতাকা, কারবালার স্মৃতি—সব মিলিয়ে তারা ন্যায়বিচার ও সাম্যের এক স্বপ্ন দেখায়, যার আড়ালে ছিল ক্ষমতা দখলের ঠান্ডা কৌশল।
খোরাসানে আবু মুসলিম কৃষক, কারিগর, মাওয়ালি ও দাসদের নিয়ে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে এক গণবিপ্লব গড়ে তোলেন। আব্বাসীয় নেতারা সামনে না এসে আড়ালে থেকেই “অদেখা ইমাম”-এর নামে আনুগত্য আদায় করেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পর একই আবু মুসলিমকে হত্যা করে তারা বিপ্লবী শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
মনসুর দামেস্ক ও কুফার রাজনৈতিক ঝুঁকি এড়িয়ে দজলা-ফোরাতের মিলনস্থলের কাছে নতুন রাজধানী বাগদাদ স্থাপন করেন—মদিনাতুস সালাম, শান্তির নগরী। এখানে ভূ-রাজনীতি, বাণিজ্য আর সামরিক নিরাপত্তাকে মাথায় রেখে বৃত্তাকার শহর বানানো হয়, যা পরবর্তীতে বিশ্বের বুকে এক নতুন সাম্রাজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
হারুন ও মামুনের সময়ে বায়তুল হিকমাহকে কেন্দ্র করে গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডার আরবি ভাষায় অনূদিত হয়। মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ও সাবিয়ান পণ্ডিতরা মিলিতভাবে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা ও ভূগোল নিয়ে কাজ করেন। সাম্রাজ্য বুঝতে পারে—শুধু তরবারি নয়, প্রয়োজন ইন্টেলেকচুয়াল হেজিমনি।
আল-রাজি, আল-খোয়ারিজমি, ইবনে সিনা ও আলহাজেনের মতো বিজ্ঞানীরা পরীক্ষানির্ভর চিকিৎসা, বীজগণিত, অপটিক্স ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটান। একই সময়ে মুতাজিলা যুক্তিবাদ দরবারের আশ্রয়ে শক্তিশালী হয়, কুরআনের “মাখলুক” হওয়া নিয়ে মিহনা চালু হয়। বিজ্ঞান ও মুক্ত যুক্তির প্রসার আর ধর্মীয় অথরিটির প্রতিক্রিয়া—দু’টোই পাশাপাশি চলে।
বাগদাদে একদিকে ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের কঠোরতা, অন্যদিকে রাতের শহরে সুরা, সুর ও প্রেমের কবিতা। আবু নুওয়াসের মদের কবিতা, পরে তার অনুশোচনার কবিতা, আর আল-জাহিযের আদব গদ্য—সব মিলিয়ে আব্বাসীয় সমাজের দ্বৈততা ও জটিল মানসিকতা ধরা পড়ে। আরব্য রজনীর গল্পগুলোও এই অভিজাত সংস্কৃতির এক সোশ্যাল মিরর।
আব্বাসীয় সমাজের বিলাসিতার ভরকেন্দ্র ছিল বিপুল দাসশ্রম—গৃহদাস, মজদুর, সামরিক দাস-সৈন্য। ইরাকের নোনা জলাভূমিতে কৃষিকাজে নিযুক্ত পূর্ব আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের জাঞ্জ বিদ্রোহ এই শোষণের বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত বিস্ফোরণ। সাম্রাজ্য কয়েক দশক ধরে এই বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকে, যা সামাজিক ভিতকে দুর্বল করে।
হারুনুর রশীদের পর আল-আমিন ও আল-মামুনের গৃহযুদ্ধ, প্রাদেশিক শাসকদের স্বায়ত্তশাসন এবং তুর্কি দাস-সৈন্যদের ওপর অতিনির্ভরতা খিলাফতের কেন্দ্রীয় শক্তিকে ভেঙে দেয়। ইবনে খালদুনের ভাষায়, প্রথম প্রজন্মের লড়াকু গোত্রীয় শক্তি ধীরে ধীরে বিলাসী ও অযোগ্য প্রজন্মে রূপান্তরিত হয়—আসাবিয়্যা ক্ষয়ে গিয়ে পতনের মঞ্চ তৈরি হয়।
আল-মুসতাসিমের দুর্বল নেতৃত্ব, সামরিক প্রস্তুতির অভাব ও ধর্মীয় আত্মতুষ্টির সুযোগ নিয়ে মঙ্গোলরা ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ ঘেরাও করে। শহর ধ্বংস, গণহত্যা এবং লাইব্রেরিগুলো পোড়ানোর ফলে দজলার পানি নাকি কালি আর রক্তে কালো হয়ে গিয়েছিল—এটি কেবল রাজনৈতিক পতন নয়, জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর এক টোটাল ওয়ার।
ইবনে খালদুন আব্বাসীয় ইতিহাসকে আসাবিয়্যা ও প্রজন্মের সাইকেলের আলোকে পড়েন, মাওয়ার্দি দুর্বল খিলাফতের বৈধতা বাঁচাতে বাস্তববাদী রাজনৈতিক তত্ত্ব দাঁড় করান। আধুনিক যুগে হজসন সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ধারার ওপর জোর দেন, ক্রোন সামরিক-রাজনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করেন, আর এডওয়ার্ড সাঈদ দেখান কীভাবে পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি এই ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। প্রবন্ধের শেষ অংশে এই সব ফ্রেমওয়ার্ক একসাথে এনে আব্বাসীয় খিলাফতের একটি বহুমাত্রিক রিডিং উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিপ্লবের প্রেক্ষাপট: ক্ষোভের বারুদ এবং হাশিমী প্রোপাগান্ডা
ইতিহাসের এক নির্মম কৌতুক হলো, যে সাম্রাজ্যকে বাইরে থেকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়, তার ভেতরের হাড়গোড় হয়তো অনেক আগেই ঘুণপোকা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। উমাইয়া খিলাফতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছিল। দামেস্কের সিংহাসনে বসে যখন খলিফারা ভাবছিলেন তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী, ঠিক তখনই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল। কোনো বিশাল সাম্রাজ্যই একদিনে ধসে পড়ে না; তার পতনের শব্দ শোনার বহু আগে থেকেই পতনের আয়োজন সম্পন্ন হতে থাকে। উমাইয়াদের পতনের বীজটি লুকিয়ে ছিল তাদের প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে, যাকে ভদ্র ভাষায় বলা যায় আরব আভিজাত্যবাদ (Arab Aristocracy), আর স্পষ্ট ভাষায় – জাতিগত আধিপত্যবাদ। উমাইয়া শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনায় এক ধরনের সংকীর্ণ আরব-কেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সমস্যাটি ধর্মান্তরকরণে বাধা দেওয়া বা উৎসাহ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; সমস্যাটি ছিল সদ্য মুসলিম হওয়া অনারব জনগোষ্ঠী বা ‘মাওয়ালি’দের (Mawali) সাথে রাষ্ট্রের আচরণে। ইসলাম গ্রহণ করার পরেও এই অনারব মুসলিমদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরবদের সমকক্ষ মনে করা হতো না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওপর অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত কর বা জিজিয়া চাপিয়ে রাখা হতো, যা ছিল মূলত অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য। রাষ্ট্রযন্ত্র এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যেখানে মেধা বা যোগ্যতার চেয়ে আরব গোত্রীয় পরিচয়ই ছিল মুখ্য। এই কাঠামোগত বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক শোষণ মানুষের মনে যে ক্ষোভের জন্ম দেয়, তা আগ্নেয়গিরির লাভা থেকেও বেশি উত্তপ্ত। মানুষ দেখল, শাসকের ঘোষিত ধর্মীয় সাম্য আর রাষ্ট্রীয় আচরণের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। উমাইয়ারা ভুলে গিয়েছিল, তরবারি দিয়ে ভূখণ্ড জয় করা যায়, কিন্তু শাসন টিকে থাকে ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) নীতির ওপর। আর এই ন্যায়বিচারের অভাবটাই ছিল তাদের কফিনের শেষ পেরেক।
মাওয়ালি সংকট: দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের হাহাকার
অনারব মুসলিম, যাদের তৎকালীন পরিভাষায় বলা হতো মাওয়ালি (Mawali) – যেমন পারসিক, তুর্কি, কুর্দি বা কপ্টিকরা – তারা ছিল এই বৈষম্যের প্রধান শিকার। এই ‘মাওয়ালি’ শব্দটি নিজেই ছিল বেশ অপমানজনক, যার অর্থ অনেকটা ‘আশ্রিত’ বা ‘ক্লায়েন্ট’। বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা দরকার। একজন পারসিক হয়তো ইসলাম গ্রহণ করেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরবদের চেয়ে ঢের এগিয়ে আছেন, তার হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস আছে, কিন্তু সামাজিকভাবে তিনি একজন সাধারণ আরব বেদুইনের চেয়েও নিচে। একজন অনারব মুসলিম দেখত, মসজিদে সে আরবদের সাথে একই কাতারে নামাজ পড়ছে, খোদা বা ঈশ্বরের কাছে সে সমান, কিন্তু মসজিদ থেকে বেরোলেই রাষ্ট্র তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার ‘আসল’ অবস্থান। তাকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত কর বা জিজিয়া (Jizya), যা মূলত অমুসলিমদের ওপর ধার্য থাকার কথা। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও এই কর বা ভূমি কর বা খারাজ (Kharaj) থেকে তাদের রেহাই ছিল না। উমাইয়া প্রশাসন ভয় পেত, সবাই যদি মুসলমান হয়ে যায় এবং কর মওকুফ পায়, তবে রাজকোষ খালি হয়ে যাবে। অর্থাৎ, ধর্ম এখানে গৌণ, অর্থনীতি এবং রাজস্ব নীতি (Fiscal Policy) এখানে মুখ্য। একজন সদ্য মুসলিম হওয়া ব্যক্তিকে যখন জিজিয়া দিতে বাধ্য করা হতো, তখন তার মনে হতো রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিচ্ছে তার বিশ্বাসের জন্য।
এই চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অপমান মানুষের মনে যে ক্ষোভের জন্ম দেয়, তা আগ্নেয়গিরির লাভা থেকেও বেশি উত্তপ্ত। বিশেষ করে খোরাসানের মতো অঞ্চলগুলোতে, যেখানে পারসিকরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে এই ক্ষোভ দানা বাঁধছিল বহুদিন ধরে। তারা দেখল, উমাইয়া শাসকরা ইসলামের সাম্যের বুলি আওড়ায়, কিন্তু বাস্তবে তারা আরব গোত্রতন্ত্রের পূজারি। এই দ্বিচারিতা বা ভণ্ডামি (Hypocrisy) মাওয়ালিদের মনে রাষ্ট্রবিরোধী চেতনা জাগিয়ে তোলে। তারা এমন কাউকে খুঁজছিল, যে তাদের এই অপমানের প্রতিশোধ নেবে, যে তাদের সমান অধিকার দেবে। মানুষ তখন আর ধর্মের বাণী শুনতে চায় না, সে চায় বদলা, সে চায় মুক্তি। এই ক্ষোভের বারুদস্তূপের ওপর বসে উমাইয়ারা যখন আয়েশি জীবন কাটাচ্ছিল, তখন আব্বাসীয়রা তৈরি করছিল দিয়াশলাই। মাওয়ালিরা হয়ে উঠল আব্বাসীয় বিপ্লবের পদাতিক বাহিনী, যারা উমাইয়াদের পতন নিশ্চিত না করা পর্যন্ত থামেনি (Kennedy, 2004)।
হাশিমীয়া দাওয়াহ: ছায়ার আড়ালে ক্ষমতার জাল
মানুষ যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন সে মুক্তির পথ খোঁজে, আর সেই পথ দেখানোর জন্য দরকার হয় চতুর নেতৃত্বের। আব্বাসীয়রা ছিল সেই চতুর রাজনীতিকের দল, যারা জানত জনরোষকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে হয়। তারা ছিল মহানবীর চাচা আব্বাসের বংশধর। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে এবং মানুষকে নিজের দলে টানতে হলে ‘ব্র্যান্ডিং’ খুব জরুরি। আব্বাসীয়রা সেই ব্র্যান্ডিংটা করল ইতিহাসের অন্যতম সেরা কৌশলে। তাদের মূল ঘাঁটি ছিল জর্ডানের এক নিভৃত পল্লী হুমায়মাতে, কিন্তু তাদের চোখ ছিল বিশ্ব শাসনের দিকে। তারা সরাসরি বলল না যে “আমরা ক্ষমতা চাই” বা “আমরা সিংহাসন চাই”। কারণ ক্ষমতা চাইলে মানুষ ভাববে এরাও উমাইয়াদের মতোই লোভী। তাই তারা ধর্মকে রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করল। তারা গড়ে তুলল এক বিশাল গোপন নেটওয়ার্ক (Underground Network) বা আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্ট, যার নাম হাশিমীয়া দাওয়াহ (Hashemite Dawah)।
এই ‘দাওয়াহ’ বা আহ্বান ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক তৎপরতা, কিন্তু তার মোড়ক ছিল ধর্মীয়। তারা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে মানুষকে ডাকত না, তারা ডাকত ‘সত্য’ ও ‘ন্যায়বিচার’-এর দিকে। মানুষের চিরন্তন হাহাকার – ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা – সেটিকেই তারা পুঁজি করল। আব্বাসীয়দের এই সংগঠনটি ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। এর গঠনতন্ত্র ছিল আজকের দিনের যেকোনো আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থা বা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির মতো। এর কেন্দ্রে ছিলেন একজন ‘ইমাম‘, যিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতেন। তার নিচে থাকত নুকাবা (Nuqaba) বা নেতাদের একটি দল, যা সাধারণত ১২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতো। এবং তাদের অধীনে থাকত হাজার হাজার দায়ী (Da’i) বা প্রচারক। এই প্রচারকরা বণিক, তীর্থযাত্রী বা সুফি সাধকের ছদ্মবেশে সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াত। কুফা ছিল তাদের নার্ভ সেন্টার। সেখান থেকে নির্দেশ যেত খোরাসানে। তারা হাটে-বাজারে, সরাইখানায় মানুষের কানে কানে বিষ ঢেলে দিত উমাইয়াদের বিরুদ্ধে। তারা বলত, উমাইয়ারা ধর্মত্যাগী, তারা মদ্যপ, তারা এজিদের বংশধর যারা নবী পরিবারকে হত্যা করেছে। এই নেতিবাচক প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডা ওয়ারফেয়ার (Propaganda Warfare) উমাইয়াদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, উমাইয়াদের পতন কেবল সময়ের ব্যাপার এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা (Sharon, 1983)।
এই প্রোপাগান্ডায় আব্বাসীয়রা কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল ব্যবহার করত:
- চরিত্র হনন: উমাইয়া খলিফাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটানো, তাদের মদ্যপান ও নারীসঙ্গের গল্প ছড়িয়ে দেওয়া।
- ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট: কারবালার ঘটনা এবং নবী মুহাম্মদের পরিবারের ওপর উমাইয়াদের নির্যাতনের ইতিহাস বারবার মনে করিয়ে দেওয়া।
- ভবিষ্যদ্বাণী: বিভিন্ন জাল হাদিস ও ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করা যেখানে বলা হতো শীঘ্রই কালো পতাকাবাহী এক দল এসে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।
আল-রিদা এবং শিয়াদের হাইজ্যাক করার কৌশল
আব্বাসীয়দের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চাল ছিল শিয়াদের আবেগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা। শিয়া সম্প্রদায় বিশ্বাস করত, খিলাফতের প্রকৃত হকদার হলো আলীর বংশধররা। আব্বাসীয়রা জানত, আলীর বংশধরদের জনপ্রিয়তা তাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই তারা সরাসরি নিজেদের নাম ঘোষণা করলে জনসমর্থন পাবে না। এখান থেকেই এল তাদের মাস্টারস্ট্রোক স্লোগান – ‘আল-রিদা মিন আল-মুহম্মাদ’ (Al-Rida min Al-Muhammad)। এর অর্থ হলো, তারা নবী পরিবারের (Family of the Prophet) এমন একজনকে ক্ষমতায় বসাতে চায়, যার ওপর সকলের সন্তুষ্টি বা ‘রিদা’ আছে।
লক্ষ্য করুন, তারা কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম বলেনি। তারা বলেনি যে আবুল আব্বাস বা আল-মনসুর খলিফা হবে। এই কৌশলগত অস্পষ্টতা (Strategic Ambiguity) ছিল তাদের তুরুপের তাস। এর ফলে শিয়া (Shia) সম্প্রদায়, যারা আলীর বংশধরদের ক্ষমতায় দেখতে চাইত, তারা ভাবল, নিশ্চয়ই আলীর বংশের কেউ আসবে; তাই তারা জানপ্রাণ দিয়ে আব্বাসীয়দের সমর্থন দিল। আব্বাসীয়রা খুব গোপনে প্রচার করত যে, আলীর পুত্র মুহাম্মদ ইবনে আল-হানাফিয়ার ছেলে আবু হাশিম মৃত্যুর আগে আব্বাসীয় নেতা মুহাম্মদ ইবনে আলীকে খিলাফতের দায়িত্ব বা ওয়াসিয়্যা (Wasiyya) দিয়ে গেছেন। এই তত্ত্বটি ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট, কিন্তু রাজনীতিতে সত্যের চেয়ে গল্পের জোর বেশি। একে বলা হয় কায়সানিয়া মতবাদ (Kaisanites) বা কায়সানি শিয়াদের বিশ্বাস। আব্বাসীয়রা এই মতবাদ ব্যবহার করে শিয়াদের সমর্থন হাইজ্যাক করে নিল। তারা আলীর বংশধরদের রক্ত আর ঘাম ব্যবহার করে নিজেদের সিংহাসনের রাস্তা তৈরি করল। সুন্নিরা এবং সাধারণ আরবরা ভাবল, আব্বাসের বংশধর বা হাশিমী গোত্রের কেউ আসবে, যারা উমাইয়াদের চেয়ে ভালো। সবাইকে ধোঁকা দিয়ে, সবার সমর্থন নিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর এই রাজনীতি আব্বাসীয়রা শুরু থেকেই আয়ত্ত করেছিল। ধর্ম যে মানুষকে একত্রিত করার এবং একই সাথে বিভ্রান্ত করার কত বড় হাতিয়ার হতে পারে, তা এই আন্দোলন না দেখলে বোঝা যায় না (El-Hibri, 1999)।
গোত্রীয় দ্বন্দ্ব: উমাইয়াদের আত্মহনন
উমাইয়াদের পতনের আরেকটি বড় কারণ ছিল আরব গোত্রগুলোর মধ্যকার চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব, যা আব্বাসীয়রা খুব ভালোমতো কাজে লাগিয়েছিল। আরব সমাজ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল – উত্তরের আরব বা মুদারি/কায়েস (Qays/Mudar) এবং দক্ষিণের আরব বা ইয়ামানি (Yaman/Kalb)। এই দুই গ্রুপের রেষারেষি ছিল অনেকটা জাতিগত দাঙ্গার মতো। উমাইয়া খলিফারা নিরপেক্ষ থাকার বদলে প্রায়ই কোনো এক পক্ষের সমর্থন নিতেন। বিশেষ করে শেষের দিকের উমাইয়া খলিফারা কায়েসী গোত্রের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এতে ইয়ামানি গোত্রগুলো, যারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল এবং খোরাসানে প্রভাবশালী ছিল, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আব্বাসীয় বিপ্লবীরা এই ফাটলটি চমৎকারভাবে ব্যবহার করে। তারা ইয়ামানিদের বোঝায় যে উমাইয়ারা তাদের শত্রু। ফলে সেনাবাহিনীর একটা বিশাল অংশ উমাইয়াদের বিরুদ্ধে চলে যায়। একে বলা হয় গোত্রীয় সংহতি বা আসাবিয়্যা (Asabiyya)-র নেতিবাচক প্রভাব। উমাইয়ারা নিজেদের গোত্রীয় রাজনীতির জালে নিজেরাই আটকা পড়েছিল, আব্বাসীয়রা কেবল সেই জালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল (Wellhausen, 1927)।
খোরাসান: বিপ্লবের আঁতুড়ঘর এবং আবু মুসলিমের উত্থান
বিপ্লব কখনো রাজধানীর বিলাসবহুল প্রাসাদের আশেপাশে দানা বাঁধে না, বিপ্লব জন্ম নেয় সীমান্তে, যেখানে কেন্দ্রীয় শাসনের বাঁধন আলগা। আব্বাসীয়রা তাদের আন্দোলনের মূল কেন্দ্র বা ‘লঞ্চপ্যাড’ হিসেবে বেছে নিল খোরাসানকে (Khorasan)। বর্তমান ইরান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই বিশাল অঞ্চলটি ছিল বাগদাদ বা দামেস্ক থেকে অনেক দূরে। ভৌগোলিক দূরত্ব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা – এই দুই মিলিয়ে খোরাসান ছিল বিপ্লবীদের স্বর্গরাজ্য। সেখানকার জনমিতি বা ডেমোগ্রাফি (Demography) ছিল অদ্ভুত। সেখানে ছিল প্রচুর পারসিক মুসলিম, যারা উমাইয়াদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক সুলভ আচরণে ত্যক্ত-বিরক্ত। আবার সেখানে ছিল অনেক আরব সৈনিক, যারা উমাইয়া শাসকদের বেতন বৈষম্য এবং গোত্রীয় রাজনীতির শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ ছিল। খোরাসান ছিল এক বারুদের স্তূপ, দরকার ছিল কেবল একটি স্ফুলিঙ্গের।
এই বারুদে আগুন দেওয়ার জন্য আব্বাসীয়দের দরকার ছিল একজন দক্ষ কারিগরের, একজন জাদুকরের, যিনি মানুষকে সম্মোহিত করতে পারেন। তারা খুঁজে পেল সেই কারিগরকে – আবু মুসলিম খোরাসানি (Abu Muslim Khorasani)। ইতিহাসের পাতায় তিনি এক রহস্যপুরুষ। কেউ নিশ্চিত করে জানে না তার আসল পরিচয় কী, তিনি আরব ছিলেন নাকি পারসিক, নাকি কোনো কৃতদাস। সম্ভবত তিনি ছিলেন একজন পারসিক কৃতদাস, যার মেধা এবং নিষ্ঠুরতা তাকে জিরো থেকে হিরো বানিয়েছিল। ৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় ইমাম তাকে খোরাসানে পাঠান বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। আবু মুসলিম জানতেন, কেবল যুক্তি দিয়ে মানুষকে যুদ্ধে নামানো যায় না, দরকার আবেগ এবং প্রতীক। তিনি মসিহবাদ (Messianism) বা ত্রাণকর্তার ধারণাকে কাজে লাগালেন। তিনি প্রচার করলেন যে, শিগগিরই একজন ত্রাণকর্তা বা মাহদি (Mahdi) আসছেন, যিনি পৃথিবীকে পাপমুক্ত করবেন।
আবু মুসলিমের বাগ্মিতা ছিল প্রলয়ঙ্করী। তিনি খোরাসানের গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করলেন। তিনি সেখানকার আরব গোত্রগুলোর মধ্যকার দীর্ঘদিনের বিবাদ – ইয়ামানি বনাম মুদারি দ্বন্দ্ব – খুব কৌশলে ব্যবহার করলেন। উমাইয়ারা সাধারণত মুদারি বা কায়েস গোত্রের সমর্থন করত, তাই আবু মুসলিম ইয়ামানি গোত্রগুলোকে নিজের দলে ভিরিয়ে নিলেন। অর্থাৎ, তিনি আরবদের দিয়েই আরবদের মারার ব্যবস্থা করলেন। তার নির্দেশে বিপ্লবীরা কালো পোশাক পরল, ওড়ালো কালো পতাকা। এই ‘কালো পতাকা’ বা ব্ল্যাক ব্যানার (Black Banners) ছিল আব্বাসীয়দের প্রতীক। এর পেছনেও ছিল মনস্তাত্ত্বিক খেলা। কালো রং শোকের প্রতীক, আবার এটি আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত দেয়। তারা বলত, এই কালো রং হলো সেই অন্ধকার রাতের প্রতীক, যে রাতের শেষে আসবে নতুন ভোর। আবার কেউ কেউ বলত, এটি শেষ জমানার যুদ্ধের সংকেত। মানুষ এই প্রতীকের নিচে জড়ো হলো পঙ্গপালের মতো (Crone, 1980)।
আবু মুসলিম খোরাসানি কেবল একজন সেনাপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি পারসিক জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামের সাম্যবাদ – এই দুই ভিন্ন ধারাকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। তিনি মাওয়ালিদের বোঝালেন, আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় এলে আরব-অনারব ভেদাভেদ থাকবে না। তিনি কৃষকদের প্রতিশ্রুতি দিলেন কর কমানোর। ফলে তার সেনাবাহিনীতে কেবল সৈনিক নয়, যোগ দিল হাজার হাজার সাধারণ কৃষক, কামার, কুমার। এটি আর কেবল একটি রাজনৈতিক পালাবদল রইল না, এটি রূপ নিল একটি গণবিপ্লবে। ৭৪৮ সালে আবু মুসলিম যখন মার্ভ দখল করলেন, তখন উমাইয়া গভর্নর নাসর ইবনে সায়ার দামেস্কে চিঠি লিখেছিলেন, “আমি ছাইয়ের নিচে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাচ্ছি, যা শিগগিরই দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে। আমি বুঝতে পারছি না যারা এগিয়ে আসছে তারা কি মানুষ নাকি জিন।” খলিফা মারওয়ান সেই চিঠির গুরুত্ব দেননি, যখন দিলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আবু মুসলিমের নেতৃত্বে এই বাহিনী যখন পশ্চিম দিকে ধেয়ে আসছিল, তখন তাদের সামনে কোনো বাধাই টিকতে পারছিল না। কারণ, উমাইয়া সৈন্যরা লড়ছিল কেবল বেতনের জন্য, আর আবু মুসলিমের সৈন্যরা লড়ছিল একটি বিশ্বাসের জন্য, একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্নের জন্য। যদিও সেই স্বপ্ন ছিল আব্বাসীয়দের তৈরি করা এক সুনিপুণ মরীচিকা। আব্বাসীয় নেতারা তখনো আড়ালে, তারা সামনে আনেনি কাকে তারা খলিফা বানাবে। এই ধোঁয়াশা বজায় রাখা ছিল তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের চাবিকাঠি। আবু মুসলিম জানতেন, নেতার নাম ঘোষণা করলেই ঐক্যে ফাটল ধরবে। তাই তিনি ‘অদেখা’ নেতার নামে আনুগত্য আদায় করে নিলেন। রাজনীতিতে অদৃশ্য শক্তি অনেক সময় দৃশ্যমান শক্তির চেয়ে বেশি প্রবল হয়, আব্বাসীয় বিপ্লব তার ধ্রুপদী উদাহরণ (Daniel, 1979)।
পরিশেষে, জাবের যুদ্ধের ময়দানে যখন উমাইয়া বাহিনী আব্বাসীয়দের মুখোমুখি হলো, তখন তা কেবল দুটি সেনাবাহিনীর যুদ্ধ ছিল না। সেটি ছিল দুটি মতাদর্শের যুদ্ধ। একদিকে উমাইয়াদের ক্ষয়িষ্ণু, দাম্ভিক এবং আরব-কেন্দ্রিক রাজতন্ত্র; অন্যদিকে আব্বাসীয়দের নেতৃত্বে এক বহুজাতিগত, ক্ষুব্ধ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় মত্ত জনস্রোত। উমাইয়াদের পতন অনিবার্য ছিল, কারণ তারা সময়ের দেয়াললিখন পড়তে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা বুঝতে পারেনি যে, তরবারি দিয়ে মানুষের শরীর দখল করা যায়, কিন্তু মন দখল করতে হলে দরকার হয় গল্পের, দরকার হয় স্বপ্নের। আব্বাসীয়রা মানুষকে সেই গল্পটিই শুনিয়েছিল – সাম্যের গল্প, সুবিচারের গল্প। যদিও ক্ষমতায় বসার পর সেই গল্পটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে সময় লাগেনি, কিন্তু বিপ্লবের সেই মুহূর্তগুলোতে হাশিমী প্রোপাগান্ডা ছিল অপ্রতিরোধ্য। মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কীভাবে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করা যায়, আব্বাসীয়দের এই উত্থানপর্ব তার এক নিখুঁত পাঠ্যবই।
কালো পতাকার উত্থান: আবু মুসলিম এবং জাবের যুদ্ধ
ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে মাঝে মাঝে এমন কিছু চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে, যারা কোনো রাজা নন, কোনো সম্রাট নন, অথচ রাজাদের ভাগ্য তাদের হাতেই লেখা থাকে। আবু মুসলিম খোরাসানি ছিলেন তেমনই এক চরিত্র – একজন ‘কিংমেকার’, যার নিজের কোনো মুকুট ছিল না, কিন্তু যার ইশারায় মুকুট বদল হতো। তাকে ঘিরে যে রহস্যের ধুম্রজাল, তা আজও ঐতিহাসিকদের ধাঁধায় ফেলে দেয়। কেউ জানে না তার আসল পরিচয় কী। কেউ বলে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ ক্রীতদাস, কেউ বলে তিনি ছিলেন শেষ পারসিক সম্রাটের বংশধর, আবার কারো মতে তিনি ছিলেন আরব। তবে তার পরিচয় বা বংশলতিকা (Genealogy) আব্বাসীয়দের কাছে মুখ্য ছিল না; মুখ্য ছিল তার কারিশম্যাটিক নেতৃত্ব (Charismatic Leadership) এবং সাংগঠনিক দক্ষতা। তিনি ছিলেন সেই জাদুকর, যিনি শূন্য থেকে এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। খোরাসানের রুক্ষ মাটিতে তিনি বিপ্লবের যে বীজ বুনেছিলেন, তা ছিল মূলত মসিহবাদ (Messianism) বা ত্রাণকর্তার ধারণার ওপর ভিত্তি করে। তিনি মানুষকে এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যেখানে কোনো অন্যায় থাকবে না, আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতীক ছিল ‘কালো পতাকা’। আব্বাসীয়দের এই কালো পতাকা কেবল কাপড়ের টুকরো ছিল না; এটি ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতীকবাদ (Political Symbolism)। হাদিসে বর্ণিত শেষ জামানার যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণীকে কাজে লাগিয়ে তারা প্রচার করেছিল যে, পূর্ব দিক থেকে কালো পতাকাবাহী দল আসবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। এই মনস্তাত্ত্বিক খেলায় আবু মুসলিম ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার আহ্বানে হাজার হাজার মানুষ – কৃষক, কারিগর, এবং বঞ্চিত সৈনিকরা – জড়ো হতে লাগল, যেন তারা কোনো রাজনৈতিক যুদ্ধে নয়, বরং এক পবিত্র ধর্মযুদ্ধে নামছে।
৭৪৭ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসে সিকাদঞ্জ গ্রামে আবু মুসলিম প্রথম কালো পতাকা উত্তোলন করেন। সেই মুহূর্তটি ছিল মুসলিম ইতিহাসের এক ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। তিনি কেবল আবেগ দিয়েই কাজ সারেননি, তিনি ছিলেন একজন ঠান্ডা মাথার সামরিক কৌশলী। খোরাসানে বসবাসরত আরব গোত্রগুলোর মধ্যকার চিরন্তন দ্বন্দ্ব – ইয়ামানি বনাম মুদারি – তিনি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। উমাইয়া গভর্নর নাসর ইবনে সায়ার যখন বুঝতে পারলেন কী ঘটছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। নাসরের সেই বিখ্যাত উক্তি, “হে উমাইয়ারা! তোমরা কি ঘুমাচ্ছ? আমি কিন্তু প্রলয় দেখতে পাচ্ছি” – ইতিহাসের পাতায় এক করুণ সতর্কবাণী হয়ে আছে। আবু মুসলিমের বাহিনী যখন পশ্চিম দিকে এগোতে শুরু করল, তখন তাদের থামানোর সাধ্য কারো ছিল না। তারা কুফা দখল করল এবং সেখানেই ৭৪৯ সালে আবুল আব্বাসকে প্রথম খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হলো। তবে আসল ফয়সালা তখনো বাকি। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান তখনো বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছেন। চূড়ান্ত খেলাটি অনুষ্ঠিত হবে টাইগ্রিস বা দজলা নদীর একটি শাখা নদী, গ্রেট জাবের তীরে।
জাবের যুদ্ধ: যেখানে ভাগ্য নির্ধারিত হলো
৭৫০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস। উত্তর ইরাকের হাড়কাঁপানো শীত। জাব নদীর দুই তীরে মুখোমুখি হলো দুই বিশাল বাহিনী। একদিকে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের নেতৃত্বে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী, অন্যদিকে আব্বাসীয় সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনে আলীর (যিনি ছিলেন আবু মুসলিমের অনুগত এবং আব্বাসীয় পরিবারের সদস্য) নেতৃত্বে তুলনামূলক ছোট বাহিনী। কিন্তু যুদ্ধে সংখ্যাতত্ত্ব সব সময় কাজ করে না, যা কাজ করে তা হলো মনোবল (Morale) এবং কৌশল। উমাইয়া বাহিনী ছিল আকারে বিশাল, কিন্তু তাদের ভেতরে ছিল পচনের গন্ধ। সৈনিকরা ছিল ক্লান্ত, বেতন নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং গোত্রীয় দ্বন্দ্বে জর্জরিত। খলিফা মারওয়ান ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা, কিন্তু তার সেনাপতিরা তাকে বিশ্বাস করত না। অন্যদিকে, আব্বাসীয় বাহিনী ছিল ‘খোরাসানি স্পিরিট’-এ উজ্জীবিত। তারা লড়ছিল এমন এক গভীর বিশ্বাস বা মতাদর্শগত প্রত্যয় (Ideological Conviction) নিয়ে, যা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে দেয়।
যুদ্ধের ময়দানে আব্বাসীয়রা এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করল, যা বর্শা প্রাচীর (Spear Wall) নামে পরিচিত। উমাইয়াদের প্রধান শক্তি ছিল তাদের অশ্বারোহী বাহিনী বা ক্যাভালরি। আব্বাসীয় পদাতিক সৈন্যরা হাঁটু গেড়ে বসে বর্শাগুলো মাটির দিকে তাক করে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করল। যখন উমাইয়া অশ্বারোহীরা চার্জ করল, তখন তারা এই বর্শার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ঘোড়াগুলো বর্শার আঘাতে আহত হয়ে নিজেদের সৈনিকদেরই পদদলিত করতে শুরু করল। যুদ্ধের এই পর্যায়ে আব্বাসীয়দের শৃঙ্খলা ছিল দেখার মতো। তারা একচুলও নড়েনি। উমাইয়া বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়লে খলিফা মারওয়ান একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তার সৈন্যরা হয়তো পালিয়ে যাবে, তাই তিনি পেছনের ব্রিজটি কেটে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এটি ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পালানোর পথ বন্ধ দেখে উমাইয়া সৈন্যরা মরণপণ যুদ্ধ করার বদলে আতঙ্কে নদীতে ঝাঁপ দিল। হাজার হাজার সৈনিক তরবারির আঘাতে নয়, বরং জাব নদীর হিমশীতল জলে ডুবে মারা গেল। কথিত আছে, নদীর জল মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং মৃতদেহের স্তূপের কারণে নদীর স্রোত বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। মারওয়ান কোনোমতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন, কিন্তু তার সাম্রাজ্য সেখানেই সলিল সমাধি লাভ করল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, একটি পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যকে কেবল সংখ্যার জোরে টিকিয়ে রাখা যায় না, যদি না তার রাজনৈতিক বৈধতা (Political Legitimacy) থাকে (Kennedy, 2004)।
মারওয়ানের পলায়ন ছিল এক করুণ অধ্যায়। তিনি ইরাক থেকে সিরিয়া, সিরিয়া থেকে প্যালেস্টাইন, এবং শেষ পর্যন্ত মিশরে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু আব্বাসীয়রা ছিল শিকারি কুকুরের মতো নাছোড়বান্দা। তারা তাকে ধাওয়া করে মিশরের এক ছোট গ্রাম বুসিরে ধরে ফেলে এবং হত্যা করে। এর মাধ্যমে উমাইয়াদের ৯০ বছরের শাসনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু আব্বাসীয়রা কেবল জয়েই সন্তুষ্ট ছিল না; তারা চেয়েছিল উমাইয়াদের অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে। এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়, যা রক্ত আর নিষ্ঠুরতার কালিতে লেখা।
আস-সাফফাহ: রক্তপিপাসু নাকি মহাদাতা?
বিপ্লবের পর ক্ষমতায় বসলেন আবুল আব্বাস। কুফার মসজিদে দাঁড়িয়ে তিনি যে প্রথম ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা ছিল একই সাথে ভীতিকর এবং প্রলোভনপূর্ণ। তিনি নিজেকে ‘আস-সাফফাহ’ (As-Saffah) উপাধিতে ভূষিত করলেন। আরবি ভাষায় এই শব্দটির একটি দ্বৈত অর্থ বা অর্থগত অস্পষ্টতা (Semantic Ambiguity) রয়েছে। এর সাধারণ অর্থ হলো ‘রক্তপিপাসু’ বা যে প্রচুর রক্তপাত ঘটিয়েছে। আবার প্রাচীন আরবিতে এর আরেকটি অর্থ হলো ‘মহাদাতা’ বা যে উদারহস্তে দান করে (যেমন করে জবাই করা পশুর রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়)। আবুল আব্বাস হয়তো বুঝিয়েছিলেন যে, শত্রুদের জন্য তিনি যমদূত, আর বন্ধুদের জন্য তিনি অবারিত দাতা। তবে ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে তার প্রথম অর্থটির জন্যই। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, বিপ্লব সফল হওয়ার পর বিপ্লবীরা অনেক সময় পূর্ববর্তী শাসকদের চেয়েও বেশি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। আব্বাসীয়রা প্রচার করেছিল তারা ‘নবী পরিবারের’ শাসন কায়েম করবে, যেখানে থাকবে দয়া আর ন্যায়বিচার। কিন্তু আস-সাফফাহ দেখালেন, রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে হলে দয়া জিনিসটা বিসর্জন দিতে হয়। তিনি উমাইয়াদের প্রতি যে নীতি গ্রহণ করলেন, তাকে আধুনিক পরিভাষায় বলা যায় গণহত্যা (Genocide) বা জাতিগত নির্মূল অভিযান।
আস-সাফফাহ কেবল জীবিত উমাইয়াদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি মৃতদের ওপরও প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এটি ছিল নেক্রোপলিটিক্স (Necropolitics) বা মৃতদেহের রাজনীতির এক জঘন্য উদাহরণ। তার নির্দেশে দামেস্কের উমাইয়া খলিফাদের কবর খোঁড়া হলো। মুয়াবিয়া, এজিদ, আব্দুল মালিক – কারো কবর রেহাই পেল না। কথিত আছে, খলিফা হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের লাশ যখন কবর থেকে তোলা হয়, তখনো তা পুরোপুরি পচেনি। আব্বাসীয়রা সেই লাশকে চাবুক মেরে, জনসম্মখে ঝুলিয়ে রেখে, শেষে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা জনগণকে এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, উমাইয়ারা এতটাই অভিশপ্ত যে তাদের কবরেও শান্তি পাওয়ার অধিকার নেই। এই ধরনের আচরণ কেবল ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল না, এটি ছিল উমাইয়াদের স্মৃতি ও ইতিহাসকে মুছে ফেলার এক ক্যালকুলেটেড ইরেজার (Calculated Erasure) বা পরিকল্পিত বিস্মৃতির রাজনীতি।
রক্তের ভোজসভা: আভিজাত্যের চূড়ান্ত পতন
আস-সাফফাহর নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে লোমহর্ষক এবং কুখ্যাত ঘটনাটি ঘটেছিল ফিলিস্তিনের আবু ফুতরুস নামক স্থানে (মতান্তরে হিরায়)। উমাইয়া রাজবংশের যারা তখনো লুকিয়ে ছিল বা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, আস-সাফফাহ তাদের জন্য এক সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন, “অতীত ভুলে যাও, আমরা এখন ভাই ভাই। এসো, আমরা একসাথে ভোজন করি এবং নতুন যুগের সূচনা করি।” জীবন বাঁচানোর আশায় এবং নতুন খলিফার মহানুভবতায় বিশ্বাস করে প্রায় ৮০ জন উমাইয়া রাজপুত্র এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সেই ভোজসভায় উপস্থিত হলেন। পরিবেশটা ছিল জমকালো। সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ, নরম গালিচা, আর রাজকীয় আতিথেয়তা। কিন্তু এই আতিথেয়তা ছিল এক মরণফাঁদ।
খাওয়া যখন মাঝপথে, সবাই যখন নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুজব করছে, ঠিক তখনই আস-সাফফাহর ইশারায় একদল খোরাসানি রক্ষী খোলা তরবারি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। কোনো কথা বা বিচার ছাড়াই তারা অতিথিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে ভোজসভা পরিণত হলো এক কসাইখানায়। ৮০ জন মেহমানকে সেখানেই পিটিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হলো। কারো কারো মৃত্যু নিশ্চিত হলো, আবার কেউ কেউ হয়তো তখনো আধমরা হয়ে কাতরাচ্ছিল। কিন্তু আস-সাফফাহর নিষ্ঠুরতার তখনো বাকি ছিল। তিনি নির্দেশ দিলেন মৃত এবং অর্ধমৃত দেহগুলোর ওপর চামড়ার বড় বড় চাদর বিছিয়ে দিতে। এরপর সেই চাদরের ওপর আবার নতুন করে খাবার পরিবেশন করা হলো। আস-সাফফাহ এবং তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা সেই লাশের স্তূপের ওপর বসে পুনরায় খাওয়া শুরু করলেন। নিচে তখনো হয়তো কেউ কেউ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল, তাদের গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু আস-সাফফাহ নির্বিকার চিত্তে খাবার উপভোগ করলেন এবং সঙ্গীদের সাথে হাস্যরসে মেতে উঠলেন। তিনি বলেছিলেন, “এই খাবারের মতো সুস্বাদু খাবার আমি জীবনে আর খাইনি, কারণ এর সাথে মিশে আছে আমার শত্রুদের বিনাশের তৃপ্তি।”
এই ঘটনাটি কেবল একটি হত্যাকাণ্ড ছিল না; এটি ছিল ম্যাকিয়াভেলিয়ান (Machiavellian) রাজনীতির এক চরম বহিঃপ্রকাশ, যদিও ম্যাকিয়াভেলির জন্ম হতে তখনো বহু দেরি। আস-সাফফাহ এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন যে, আব্বাসীয়দের বিরোধিতা করার পরিণতি কী হতে পারে। তিনি চেয়েছিলেন উমাইয়া বংশের এমন কোনো পুরুষ যেন বেঁচে না থাকে, যে ভবিষ্যতে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তবে ইতিহাসের পরিহাস হলো, এই হত্যাকাণ্ড থেকে একজন উমাইয়া রাজপুত্র অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন – তার নাম আব্দুর রহমান। তিনি পালিয়ে স্পেনে চলে যান এবং সেখানে এক নতুন উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু প্রাচ্যে আব্বাসীয়রা তাদের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ‘রক্তের ভোজসভা’ বা Banquet of Blood ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে, যা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ক্ষমতার লড়াইয়ে মানুষ পশুর চেয়েও অধম হতে পারে (Hitti, 1970; Lassner, 1980)।
আস-সাফফাহর রাজত্বকাল খুব দীর্ঘ ছিল না, মাত্র চার বছর। কিন্তু এই চার বছরে তিনি যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, তা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করেছিল। তিনি এবং তার ভাই আল-মনসুর মিলে যে রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করেছিলেন, তা ছিল কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রিত। তারা আবু মুসলিম খোরাসানিকে ব্যবহার করেছিলেন উমাইয়াদের পতনের জন্য, আবার কাজ শেষে তাকেও ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করেননি। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা যখন আস-সাফফাহ এবং পরবর্তীতে মনসুরের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াল, তখন তাকেও বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল। যে কালো পতাকার নিচে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল সাম্যের আশায়, সেই পতাকাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল একনায়কতন্ত্রের প্রতীক। আব্বাসীয় বিপ্লব সফল হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। তারা কেবল এক প্রভুর বদলে আরেক প্রভুকে পেয়েছিল, আর সাথে পেয়েছিল একরাশ স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে, বিপ্লব তার নিজের সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে, আর ক্ষমতার মসনদ চিরকালই পিচ্ছিল – তা রক্ত দিয়ে ভেজানো থাকে বলেই হয়তো।
প্রকৃত স্থপতি: আল-মনসুর এবং গোলকধাঁধার শহর বাগদাদ
ইতিহাসের পাতায় আস-সাফফাহ ছিলেন আব্বাসীয় বিপ্লবের অগ্নিমুখ, কিন্তু সেই আগুনের ওপর দাঁড়িয়ে যিনি একটি দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের ইস্পাত-কঠিন কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন, তিনি হলেন আবু জাফর আল-মনসুর (Abu Ja’far al-Mansur)। ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি খলিফার মসনদে বসেন, তখন পরিস্থিতি ছিল নড়বড়ে। চারদিকে বিদ্রোহের আগুন, ঘরের ভেতরে ষড়যন্ত্র, আর বাইরে উমাইয়াদের প্রেতাত্মা। মনসুর ছিলেন একাধারে একজন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক এবং আবেগহীন, ঠান্ডা মাথার খুনি। তার চরিত্রটি ছিল স্ববিরোধিতায় পূর্ণ; তিনি কবিতা ভালোবাসতেন কিন্তু কবিদের হত্যা করতে দ্বিধা করতেন না; তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, আবার চরম কৃপণতার জন্য লোকে তাকে আড়ালে ডাকত ‘আবু আল-দাওয়ানিক’ বা ‘পয়সাওয়ালা বাবা’ বলে। তিনি জানতেন, উমাইয়াদের পুরনো রাজধানী দামেস্কে বসে এই নতুন সাম্রাজ্য চালানো যাবে না। সিরিয়া ছিল উমাইয়াদের দুর্গ, সেখানকার বাতাসও যেন আব্বাসীয়দের শত্রু। অন্যদিকে কুফা বা আনবার – শহরগুলো ছিল অস্থিরমতি শিয়াদের আখড়া। মনসুরের দরকার ছিল একটি ‘টাবুলারাসা’ বা অলিখিত স্লেট, যেখানে তিনি নিজের মতো করে ক্ষমতার মানচিত্র আঁকতে পারবেন। তিনি এমন এক জায়গা খুঁজছিলেন, যা হবে ভূ-রাজনীতি (Geopolitics) এবং বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। দজলা (টাইগ্রিস) ও ফোরাত (ইউফ্রেটিস) – মেসোপটেমিয়ার এই দুই প্রাণভোমরার সংযোগস্থলের কাছাকাছি, প্রাচীন পারসিক রাজধানী টেসিফোনের ধ্বংসাবশেষের কাছে তিনি খুঁজে পেলেন সেই স্বপ্নের মাটি। জায়গাটি ছিল উর্বর, জলপথে বাণিজ্যের জন্য আদর্শ এবং সামরিকভাবে সুরক্ষিত।
মদিনাতুস সালাম: গোলকধাঁধার জ্যামিতিক দর্শন
৭৬২ খ্রিস্টাব্দ। দজলা বা টাইগ্রিস নদীর পশ্চিম তীরে শুরু হলো ইতিহাসের অন্যতম উচ্চাভিলাষী নির্মাণযজ্ঞ। মনসুর তার নতুন রাজধানীর নাম দিলেন ‘মদিনাতুস সালাম’ (Madinat al-Salam), যার অর্থ শান্তির নগরী। কিন্তু ইতিহাসের কৌতুক হলো, শান্তির এই নগরী তার জীবদ্দশাতেই হয়ে উঠেছিল ষড়যন্ত্র আর ক্ষমতার রক্তক্ষয়ী নাট্যমঞ্চ। লোকমুখে অবশ্য এর নাম হয়ে গেল বাগদাদ। এই নামের উৎপত্তি নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকের মতে, এটি প্রাক-ইসলামী যুগের একটি পারসিক নাম, যার অর্থ ‘ঈশ্বরের দান’ (God-given)। আবার কারো মতে, ‘বাগ’ মানে বাগান আর ‘দাদ’ মানে দান। মনসুর অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক শহর, যার নকশা দেখেই শত্রুর বুকে কাঁপন ধরবে। তিনি নির্দেশ দিলেন শহরটি হবে সম্পূর্ণ বৃত্তাকার। এই বৃত্তাকার নগর পরিকল্পনা (Circular Urban Planning) কেবল নান্দনিকতার জন্য ছিল না, এর পেছনে ছিল গভীর রাজনৈতিক প্রতীকবাদ (Political Symbolism) এবং সামরিক কৌশল। বৃত্তের কোনো শুরু বা শেষ নেই; এর সব বিন্দু কেন্দ্র থেকে সমান দূরে। মনসুর নিজেকে এবং তার প্রাসাদকে রাখলেন সেই কেন্দ্রের বিন্দুতে। এর মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে এক নীরব বার্তা দিলেন – খলিফাই হলেন মহাবিশ্বের অক্ষ, পৃথিবী তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ইউক্লিডীয় জ্যামিতির এই রাজনৈতিক প্রয়োগ ইতিহাসে বিরল (Bennison, 2009)।
শহরটির নির্মাণশৈলী ছিল দুর্ভেদ্য। একে ঘিরে ছিল তিনটি বিশাল প্রাচীর। বাইরের প্রাচীরটি ছিল গভীর পরিখা বা খালের দ্বারা সুরক্ষিত। এরপর ছিল ফাঁকা জায়গা, তারপর ভেতরের মূল প্রাচীর। এই প্রাচীরগুলো ছিল এতটাই চওড়া যে, এর ওপর দিয়ে অনায়াসে ঘোড়া দৌড়ানো যেত। শহরের চারটি প্রধান তোরণ ছিল – কুফা তোরণ, বসরা তোরণ, খোরাসান তোরণ এবং দামেস্ক তোরণ। এই চারটি নাম কেবল চারটি দিক নির্দেশ করত না, বরং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের চারটি প্রধান শক্তি কেন্দ্রের প্রতীক ছিল। প্রতিটি তোরণের ওপর ছিল বিশাল গম্বুজ এবং প্রহরী কক্ষ। তোরণগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, সরাসরি শহরে ঢোকা যেত না; বরং একটি বাঁকানো পথ বা বেন্ট এন্ট্রান্স (Bent Entrance) দিয়ে ঢুকতে হতো, যা ছিল তৎকালীন সামরিক স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। এর ফলে শত্রুবাহিনী চাইলেই সোজা আক্রমণ করে গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকতে পারত না। শহরের ঠিক মাঝখানে ছিল খলিফার প্রাসাদ, যার নাম ছিল ‘গোল্ডেন গেট প্যালেস’ বা বাব আল-ধাহাব। প্রাসাদের পাশেই ছিল প্রধান মসজিদ। এই প্রাসাদের চূড়ায় ছিল একটি বিশাল সবুজ গম্বুজ (Green Dome), যা বহু দূর থেকে দেখা যেত। কথিত আছে, গম্বুজের ওপর ছিল একটি অশ্বারোহীর মূর্তি, যার হাতে ছিল একটি বর্শা। বাতাসের গতিতে মূর্তিটি ঘুরত এবং বর্শার ফলা যেদিকে নির্দেশ করত, খলিফা মনে করতেন সেদিক থেকেই শত্রুর আক্রমণ আসবে। এটি হয়তো লোককথা, কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে খলিফার নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কী পরিমাণ মিথ চালু ছিল।
মনসুরের বাগদাদ ছিল একটি কসমিক মডেল বা মণ্ডল (Mandala)। তিনি শহরের ভেতরে সাধারণ মানুষকে থাকতে দেননি। বৃত্তাকার শহরের ভেতরে বা ‘রাউন্ড সিটি’-তে কেবল খলিফার বিশ্বাসভাজন সেনাপতি, উচ্চপদস্থ আমলা এবং তার দেহরক্ষীরা থাকত। সাধারণ বাজার এবং জনবসতি গড়ে উঠেছিল শহরের দেয়ালের বাইরে, যা আল-কার্খ (Al-Karkh) নামে পরিচিত ছিল। মনসুর বলেছিলেন, “আমি চাই না বাজারের হট্টগোল এবং সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস আমার প্রাসাদের পবিত্রতা নষ্ট করুক।” এই নগর বিভাজন (Urban Segregation) ছিল আব্বাসীয় শাসনের এক বড় বৈশিষ্ট্য – শাসক ও শাসিতের মধ্যে দেওয়াল তুলে দেওয়া। উমাইয়া খলিফারা যেখানে জনগণের সাথে মিশতেন, আব্বাসীয়রা সেখানে হয়ে উঠলেন অদৃশ্য দেবতা, যারা কেবল পর্দার আড়াল থেকেই হুকুম দেন। বাগদাদ হয়ে উঠল এক গোলকধাঁধা, যেখানে ঢুকলে বের হওয়ার পথ পাওয়া কঠিন, আর খলিফার কাছে পৌঁছানো তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো (Lassner, 1980)।
নক্ষত্রের ইশারা এবং বিজ্ঞানমনস্কতা: জ্যোতির্বিজ্ঞানের রাজনৈতিক ব্যবহার
বাগদাদ শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনক্ষণ ঠিক করার ঘটনাটি আব্বাসীয়দের মানসজগৎ বোঝার জন্য অত্যন্ত জরুরি। মনসুর কোনো ধর্মীয় নেতা বা ইমামকে ডেকে দিনক্ষণ ঠিক করতে বলেননি। তিনি ডেকেছিলেন তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন নওবাখত (Nawbakht), একজন পারসিক জরাথুস্ট্রবাদী যিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং মাশাল্লাহ (Mashallah), একজন পারসিক ইহুদি। তারা গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে, বিশেষ করে বৃহস্পতি বা জুপিটার গ্রহের অবস্থান দেখে ৭৬২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই তারিখটি নির্ধারণ করেন। তাদের গণনা অনুযায়ী, এই সময়ে সিংহ রাশিতে সূর্যের অবস্থান এবং অন্যান্য গ্রহের বিন্যাস এমন ছিল যে, এই শহরে কখনো কোনো খলিফা যুদ্ধে মারা যাবেন না। অদ্ভুতভাবে, আব্বাসীয় খলিফারা আততায়ীর হাতে বা বিষপ্রয়োগে মারা গেলেও, বাগদাদের ভেতরে কোনো যুদ্ধে বা অবরোধে খলিফার মৃত্যুর ঘটনা ১২৫৮ সালের মঙ্গোল আক্রমণের আগ পর্যন্ত ঘটেনি।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের মতো কেবল আরব ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তারা পারসিকদের সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ (Cultural Assimilation) এবং প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে লাগাতে শুরু করেছিল। মনসুর জানতেন, একটি বিশ্বসাম্রাজ্য চালাতে হলে ধর্মের পাশাপাশি যুক্তি, বিজ্ঞান এবং প্রাচীন জ্ঞানের সংমিশ্রণ দরকার। নওবাখত এবং মাশাল্লাহর মতো অনারব পণ্ডিতদের এই গুরুত্ব দেওয়াটা ছিল এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এখান থেকেই পরবর্তীতে বায়তুল হিকমাহ বা ‘হাউজ অফ উইজডম’-এর বীজের অঙ্কুরোদগম হয়। মনসুর নিজেই ইউক্লিডীয় জ্যামিতি এবং পদার্থবিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি ভারত থেকে আসা কঙ্কহ (Kankah) নামের এক পণ্ডিতের মাধ্যমে ভারতীয় জোতির্বিদ্যার বই ‘সিদ্ধান্ত‘ আরবিতে অনুবাদ করার ব্যবস্থা করেন। বাগদাদ নির্মাণের এই ‘বৈজ্ঞানিক‘ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ‘ পদ্ধতি প্রমাণ করে যে, আব্বাসীয়রা ছিল মূলত একটি প্রাগমেটিক (Pragmatic) বা প্রয়োগবাদী শক্তি, যারা ক্ষমতার প্রয়োজনে যেকোনো উৎস থেকে জ্ঞান নিতে প্রস্তুত ছিল।
আবু মুসলিম: রাজার চেয়েও বড় রাজা এবং বিশ্বাসঘাতকতার রাজনীতি
বাগদাদ যখন ইটের পর ইট গেঁথে মাথা তুলছে, তখন মনসুরের মনে অন্য এক ঝড়। সেই ঝড়ের নাম আবু মুসলিম খোরাসানি। আব্বাসীয় বিপ্লবের এই মহানায়ক তখন খোরাসানের গভর্নর, কিন্তু তার ক্ষমতা খলিফার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন কিংমেকার (Kingmaker)। মনসুর জানতেন, আবু মুসলিমের আঙুলের ইশারায় খোরাসান থেকে লক্ষ লক্ষ সৈন্য বাগদাদে ধেয়ে আসতে পারে। রাজনীতিতে একটি নির্মম সত্য আছে – রাজার কোনো বন্ধু থাকে না, থাকে কেবল স্বার্থ। আর যখন কোনো প্রজা রাজার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন তার বেঁচে থাকার অধিকার ফুরিয়ে যায়। একে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় প্রিটোরিয়ানইজম (Praetorianism) বা সেনাবাহিনীর অত্যধিক ক্ষমতার সংকট, যা মনসুর শুরুতেই দমন করতে চেয়েছিলেন।
মনসুর অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে ফাঁদ পাতলেন। তিনি আবু মুসলিমকে চিঠি লিখলেন, তাকে ‘ভাই’ এবং ‘আংকল’ বলে সম্বোধন করলেন। তিনি তাকে হজ করার পথে বাগদাদে এসে খলিফার আতিথেয়তা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। আবু মুসলিমের উপদেষ্টারা তাকে বারণ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, “বাঘের গুহায় প্রবেশ করবেন না।” কিন্তু আবু মুসলিম ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, যার জন্য এই সিংহাসন, তাকে হত্যা করার সাহস মনসুরের হবে না। ৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে আবু মুসলিম বাগদাদে প্রবেশ করলেন। মনসুর তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, কিন্তু তার মনে ছিল খুনের নেশা।
চূড়ান্ত দিনটিতে মনসুর তার ব্যক্তিগত রক্ষীদের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখলেন। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন, “আমি যখন হাতে তালি দেব, তখন তোমরা বেরিয়ে আসবে এবং এই লোকটির মাথা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলবে।” আবু মুসলিম যখন খলিফার খাস কামরায় প্রবেশ করলেন, তখন মনসুর প্রথমে তার সাথে খোশগল্প শুরু করলেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি অভিযোগের ফর্দ খুললেন। তিনি বললেন, “তুমি অমুক সময়ে আমার আদেশ অমান্য করেছ, তুমি আমার চেয়ে নিজেকে বড় মনে করো।” আবু মুসলিম বিনীতভাবে উত্তর দিচ্ছিলেন, তার অতীতের ত্যাগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, “হে আমিরুল মুমিনিন, আমি সেই ব্যক্তি যে উমাইয়াদের পতন ঘটিয়েছে।” ঠিক তখনই মনসুর চিৎকার করে উঠলেন, “তুই কিছুই করিসনি! যা হয়েছে তা আমাদের ভাগ্যে ছিল, তুই কেবল একটা মাধ্যম ছিলি। এখন তুই আমার সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি।” সাথে সাথে তিনি তালি দিলেন। পর্দার আড়ালে থাকা উসমান ইবনে নাহিক এবং অন্য ঘাতকরা বেরিয়ে এল। আবু মুসলিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই তরবারির আঘাতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল বিপ্লবের নায়কের রক্ত।
আবু মুসলিমের লাশ একটি কার্পেটে মুড়িয়ে রাখা হলো। কিছুক্ষণ পর যখন সেনাপতি জাফর ইবনে হানজালা ঘরে ঢুকলেন এবং খলিফাকে আবু মুসলিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তখন মনসুর কার্পেটটি সরিয়ে লাশটি দেখালেন। সেনাপতি ভয়ে শিউরে উঠলেন। মনসুর তখন এক অট্টহাসি দিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, যা ম্যাকিয়াভেলিয়ান (Machiavellian) দর্শনের সারসংক্ষেপ: “যে ব্যক্তি তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।” আবু মুসলিমের মৃত্যুতে খোরাসানে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু মনসুর অত্যন্ত কঠোর হাতে তা দমন করেন। তিনি প্রমাণ করলেন, আব্বাসীয় খিলাফতে ‘কৃতজ্ঞতা’ বলে কোনো শব্দ নেই, আছে কেবল ‘আনুগত্য’ অথবা ‘মৃত্যু’ (Kennedy, 1990)।
প্রশাসনিক ইস্পাত এবং গোয়েন্দা জাল: উজির এবং বারিদ
মনসুর কেবল শহর বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য এক নতুন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছিলেন। উমাইয়ারা ছিল মূলত গোত্রপ্রধানদের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু মনসুর চাইলেন একটি কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র বা ব্যুরোক্রেসি (Bureaucracy)। তিনি পারসিক মডেলে ‘উজির’ বা ভিজিয়ার (Vizier) পদের প্রবর্তন করলেন। উজির ছিলেন খলিফার ডান হাত, প্রশাসনের প্রধান নির্বাহী। খালিদ আল-বার্মাকিকে তিনি উচ্চ পদে নিয়োগ দেন, যার মাধ্যমে পরবর্তীতে বার্মাকি পরিবারের উত্থান ঘটে। মনসুর বলতেন, “একটি সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য চারটি স্তম্ভের দরকার: একজন ন্যায়পরায়ণ বিচারক, একজন কঠোর পুলিশ প্রধান, একজন দক্ষ অর্থমন্ত্রী এবং একজন বিশ্বস্ত ডাক বিভাগ।”
এই ‘ডাক বিভাগ’ বা বারিদ (Barid) ছিল মূলত তার গোয়েন্দা সংস্থা। মনসুরের গোয়েন্দা জাল ছিল নিখুঁত। বাজারের কুলি থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম – সবাই ছিল তার গোয়েন্দা। বলা হতো, বাগদাদের প্রতিটি দেয়ালে খলিফার কান পাতা আছে। কোনো গভর্নর যদি বিদ্রোহের চিন্তা করত, তবে সেই চিন্তা কাজে পরিণত করার আগেই খলিফার কাছে খবর পৌঁছে যেত। তিনি বাজারদর থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর রসদ – সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখতেন। তার কৃপণতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি প্রতিটি দিরহাম বা রৌপ্যমুদ্রার হিসাব নিতেন, এমনকি তেলের প্রদীপের খরচও নিজে তদারকি করতেন। তিনি বলতেন, “আজকের সঞ্চয় আগামীকালের যুদ্ধের রসদ।” এই কঠোর অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার কারণেই তিনি তার উত্তরাধিকারীদের জন্য একটি উপচে পড়া রাজকোষ রেখে যেতে পেরেছিলেন।
মনসুরের শাসনামলে আলীর বংশধররা বা শিয়ারা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করেছিল। বিশেষ করে মদিনায় মুহাম্মদ আল-নাফস আল-জাকিয়্যা এবং বসরায় তার ভাই ইব্রাহিমের বিদ্রোহ ছিল প্রবল। মনসুর এই বিদ্রোহগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন। তিনি আলীর বংশধরদের অনেককে জ্যান্ত দেয়ালের ভেতর গেঁথে দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তার এই নিষ্ঠুরতা এবং সন্দেহের বাতিক তাকে একাকী করে তুলেছিল। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, শাসকের কাজ ভালোবাসা পাওয়া নয়, শাসকের কাজ ভয় জাগিয়ে রাখা। বাগদাদের গোলকধাঁধায় বসে তিনি যে ক্ষমতার জাল বুনেছিলেন, তা পরবর্তী পাঁচশ বছর ধরে মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তিনি ছিলেন সেই স্থপতি, যিনি জানতেন সৌন্দর্যের চেয়ে শক্তির প্রয়োজন বেশি, আর ভালোবাসার চেয়ে ভয়ের আয়ু দীর্ঘ।
হারুনুর রশীদ: মিথ, বাস্তবতা এবং বার্মাকি ট্র্যাজেডি
ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে এমন কিছু চরিত্রের আগমন ঘটে, যারা তাদের প্রকৃত সত্তাকে ছাপিয়ে এক বিশাল মিথ বা লোককথায় পরিণত হন। আব্বাসীয় খিলাফতের পঞ্চম খলিফা হারুনুর রশীদ (Harun al-Rashid) হলেন তেমনই এক চরিত্র। ৭৮৬ থেকে ৮০৯ সাল পর্যন্ত তার তেইশ বছরের শাসনকালকে বলা হয় আব্বাসীয়দের ‘স্বর্ণযুগ’। কিন্তু আমরা তাকে যতটা না ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে চিনি, তার চেয়ে বেশি চিনি ‘আরব্য রজনী’ বা One Thousand and One Nights–এর জাদুকরী গল্পের মাধ্যমে। গল্পের পাতায় তিনি এক রোমান্টিক নায়ক, যিনি রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে বাগদাদের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান, প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবর নেন, আর তার সঙ্গী থাকে বিশ্বস্ত উজির জাফর বার্মাকি এবং জল্লাদ মাসরুর। কিন্তু রূপকথার এই রঙিন পর্দার আড়ালে যে হারুন লুকিয়ে ছিলেন, তিনি ছিলেন রক্তমাংসের এক জটিল মানুষ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ধর্মপ্রাণ শাসক, যিনি পায়ে হেঁটে হজে যেতেন, আবার অন্যদিকে তিনি ছিলেন এক চরম ভোগবাদী সম্রাট, যার হেরেম ছিল হাজারো নারী আর মদের স্রোতে ভাসমান। তার চরিত্রের এই দ্বৈততা (Duality) বা স্ববিরোধিতাই তাকে ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় এবং ভীতিকর চরিত্রে পরিণত করেছে। তিনি একদিকে বিজ্ঞান ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন সন্দেহবাতিকগ্রস্ত এক স্বৈরাচার, যিনি নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেও হত্যা করতে দ্বিধা করতেন না। হারুনের রাজত্বকাল ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শীর্ষবিন্দু (Cultural and Political Zenith), কিন্তু এই আলোর নিচেই ঘনীভূত হচ্ছিল এক গাঢ় অন্ধকার, যা পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
ঐশ্বর্যের নগরী এবং শার্লামেনের সাথে বন্ধুত্ব
হারুনুর রশীদের সময়ে বাগদাদ কেবল একটি রাজধানী ছিল না, এটি ছিল তৎকালীন পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড। দজলা বা টাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই শহরটি ছিল প্রাচুর্যের এক অবিশ্বাস্য প্রদর্শনী। চীন থেকে আসত রেশম ও পোর্সেলিন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসত মসলা, সুগন্ধি ও রঞ্জক পদার্থ, রাশিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে আসত পশম ও অ্যাম্বার, আর আফ্রিকা থেকে আসত সোনা ও হাতির দাঁত। বাগদাদের বাজারগুলো ছিল বিশ্ব-বাণিজ্যের মিলনমেলা। এই বিশাল বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক বা মার্কেন্টাইল সিস্টেম (Mercantile System) আব্বাসীয় অর্থনীতিকে এক অভাবনীয় উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। খলিফার রাজকোষ বা ‘বায়তুল মাল’ উপচে পড়ছিল দিরহাম আর দিনারে। কথিত আছে, খলিফার স্ত্রী জুবাইদা (Zubaydah) এতটাই বিলাসপ্রিয় ছিলেন যে, তার জুতায় দামি রত্ন খচিত থাকত এবং তিনি রৌপ্যপাত্র ছাড়া জল পান করতেন না। বাগদাদের এই জৌলুস ইউরোপের তৎকালীন অবস্থার সাথে তুলনা করলে মনে হয় যেন দুটি ভিন্ন গ্রহ। যখন বাগদাদের রাস্তায় রাতে ল্যাম্পপোস্ট জ্বলত, তখন লন্ডন বা প্যারিসের রাস্তা ছিল কাদা ও গোবরে পূর্ণ অন্ধকার এক জনপদ।
হারুনের কূটনৈতিক দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি ছিল বিশাল। তার সাথে সুদূর ফ্রান্সের ক্যারোলিনজিয়ান সম্রাট শার্লিমেনের (Charlemagne) বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যদিও তাদের মধ্যে কখনো সরাসরি দেখা হয়নি, কিন্তু দূতের মাধ্যমে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল রিয়েলপলিটিক (Realpolitik) বা বাস্তববাদী রাজনীতি। উভয়েরই সাধারণ শত্রু ছিল স্পেনের উমাইয়া শাসক এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। তাই শত্রুর শত্রু বন্ধু – এই নীতিতে তারা একে অপরের মিত্র ছিলেন। ৮০২ খ্রিস্টাব্দে হারুন শার্লিমেনের কাছে এক জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিনিধিদল পাঠান। তারা সাথে নিয়ে গিয়েছিল দুর্লভ সব উপহার – দামি কাপড়, সুগন্ধি, এবং একটি বিশাল সাদা হাতি, যার নাম ছিল ‘আবুল আব্বাস’। হাতিটি দেখে ইউরোপীয়রা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
তবে উপহারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল একটি জটিল যান্ত্রিক জলঘড়ি বা ওয়াটার ক্লক (Water Clock)। এটি ছিল পিতলের তৈরি। প্রতি ঘণ্টায় এর ভেতর থেকে একটি করে ছোট ধাতব বল নিচে রাখা একটি পাত্রে পড়ত এবং শব্দ হতো। দুপুর বারোটার সময় বারোজন অশ্বারোহী পুতুল বেরিয়ে এসে বৃত্তাকারে ঘুরত। ঘড়িটির কারিগরি দক্ষতা দেখে শার্লিমেনের রাজসভার লোকেরা এতটাই ভড়কে গিয়েছিল যে, তারা ভেবেছিল এর ভেতরে নিশ্চয়ই কোনো ডিমন আছে, যে কলকাঠি নাড়ছে। তারা ভয়ে ঘড়িটি ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছিল। এই একটি ঘটনা প্রমাণ করে, অষ্টম শতাব্দীতে প্রযুক্তিতে এবং যান্ত্রিক প্রকৌশল (Mechanical Engineering) বিদ্যায় প্রাচ্য বা মুসলিম বিশ্ব পাশ্চাত্যের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিল। পাশ্চাত্য যখন কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত, বাগদাদ তখন অটোমেশন নিয়ে খেলছে (Hourani, 1991)।
বার্মাকি পরিবার: সাম্রাজ্যের প্রকৃত চালিকাশক্তি
হারুনুর রশীদের শাসনের জাঁকজমক যতটা খলিফার নিজের কৃতিত্ব, তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব ছিল একটি পরিবারের – বার্মাকিরা (Barmakids)। এই পরিবারের উত্থান এবং পতন আব্বাসীয় ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় অধ্যায়। বার্মাকিদের আদি নিবাস ছিল আফগানিস্তানের বলখ বা বর্তমান মাজার-ই-শরিফ অঞ্চলে। তারা মূলত ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং সেখানকার বিখ্যাত ‘নওবাহার’ (সংস্কৃত ‘নব বিহার’) বৌদ্ধ মঠের প্রধান পুরোহিত বা ‘পরমক’ ছিল তাদের পূর্বপুরুষ। এই ‘পরমক’ শব্দ থেকেই আরবিতে ‘বার্মাকি’ নামের উৎপত্তি। পরবর্তীতে তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাদের অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের নজরে আসে। তারা পারসিক আমলাতন্ত্রের বা সাসানীয় প্রশাসনিক মডেল (Sasanian Administrative Model)-এর ধারক ও বাহক ছিল। তারা জানত কীভাবে বিশাল সাম্রাজ্য চালাতে হয়, কীভাবে কর আদায় করতে হয় এবং কীভাবে রাজকোষ ভরতে হয়।
হারুন যখন খুব ছোট, তখন তার শিক্ষার ভার দেওয়া হয়েছিল ইয়াহইয়া আল-বার্মাকির ওপর। ইয়াহইয়া ছিলেন হারুনের কাছে পিতার মতো। হারুন খলিফা হওয়ার পর ইয়াহইয়াকে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে উজির বা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। ইয়াহইয়া এবং তার দুই সুযোগ্য পুত্র – ফজল এবং জাফর – সাম্রাজ্যের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফজল ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক, আর জাফর ছিলেন খলিফার ব্যক্তিগত সঙ্গী। হারুন জাফরকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, কথিত আছে তাদের দুজনকে এক পোশাকে দেখা যেত। জাফর ছিলেন সুদর্শন, বাগ্মী, এবং ফ্যাশন আইকন। বাগদাদের তরুণরা জাফরের পোশাক ও কথা বলার ভঙ্গি নকল করত। বার্মাকিরা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদার পৃষ্ঠপোষক। তারা সংস্কৃত থেকে আরবিতে বহু বই অনুবাদ করিয়েছিল। তাদের বদান্যতা বা পেট্রোনেজ (Patronage) এতটাই বিখ্যাত ছিল যে, আরবি সাহিত্যে ‘বার্মাকি’ শব্দটি উদারতার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাম্রাজ্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বার্মাকিদের লোক বসানো ছিল। এক কথায়, খলিফা ছিলেন হারুন, কিন্তু শাসন করত বার্মাকিরা। এই অবস্থাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যেতে পারে ডায়ার্কি (Diarchy) বা দ্বৈত শাসন, যদিও কাগজে-কলমে খলিফাই সর্বেসর্বা।
ট্র্যাজেডির রাত: বন্ধু যখন ঘাতক
ক্ষমতা এমন এক নেশা, যা ভাগ করে নেওয়া যায় না। বার্মাকিদের এই আকাশচুম্বী ক্ষমতা, অঢেল সম্পদ এবং জনপ্রিয়তা হারুনের মনে ধীরে ধীরে সন্দেহের বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছিল। খলিফা দেখছিলেন, তার প্রাসাদে যত মানুষ আসে, তার চেয়ে বেশি মানুষ ভিড় করে জাফরের প্রাসাদে। কবিরা খলিফার চেয়ে জাফরের প্রশংসায় বেশি কবিতা লেখে। এই ঈর্ষা বা জেলাসি (Jealousy) ছিল বার্মাকিদের পতনের অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক কারণ। এছাড়া ধর্মীয় কারণও ছিল; বার্মাকিরা ছিল কিছুটা উদারপন্থী, যা রক্ষণশীল মুসলিমরা ভালো চোখে দেখত না। আবার অর্থনৈতিক কারণও ছিল প্রবল – বার্মাকিদের বাজেয়াপ্ত করলে রাজকোষে বিশাল সম্পদ জমা হবে।
তবে ঐতিহাসিকদের মতে, বার্মাকিদের পতনের পেছনে একটি রোমান্টিক এবং স্ক্যান্ডালস গুজবও ছিল, যা ‘আব্বাসা কেলেঙ্কারি’ (Abbasa Affair) নামে পরিচিত। হারুনের বোন আব্বাসা ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। হারুন চাইতেন তার প্রিয় বন্ধু জাফর এবং প্রিয় বোন আব্বাসা – উভয়েই তার সাথে রাতের আড্ডায় বা মজলিশে থাকুক। কিন্তু তৎকালীন শরিয়াহ আইন অনুযায়ী গায়রে-মাহরাম নারী-পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধ। তাই হারুন জাফর ও আব্বাসার মধ্যে একটি নামমাত্র বিয়ে বা ফরমাল ম্যারেজ (Formal Marriage) করিয়ে দেন, এই শর্তে যে তারা কখনো স্বামী-স্ত্রী হিসেবে মিলিত হবে না বা সন্তান নেবে না। কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তি বা হিউম্যান নেচার (Human Nature) সব নিয়ম মানে না। জাফর ও আব্বাসার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং গোপনে তাদের একটি সন্তান হয়, যাকে তারা মক্কায় পাঠিয়ে দেয়। এই খবর যখন হারুনের গুপ্তচরদের মাধ্যমে তার কানে পৌঁছায়, তখন তিনি নিজেকে প্রতারিত মনে করেন। তিনি ভাবলেন, বার্মাকিরা কেবল তার ক্ষমতাই কেড়ে নিচ্ছে না, তার রাজকীয় রক্ত বা রয়্যাল ব্লাডলাইন (Royal Bloodline) কলুষিত করছে।
৮০৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের এক অন্ধকার রাত। হারুন শিকার থেকে ফিরেছেন। তিনি তার বিশ্বস্ত জল্লাদ মাসরুরকে ডেকে পাঠালেন। তিনি মাসরুরকে নির্দেশ দিলেন, “এখনই জাফরের কাছে যাও এবং তার কাটা মাথা আমার কাছে নিয়ে এসো।” মাসরুর নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জাফর তখনো জানতেন না তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। মাসরুর যখন জাফরের কক্ষে প্রবেশ করলেন, জাফর তখন গান শুনছিলেন। মাসরুর খলিফার আদেশ শোনালেন। জাফর প্রথমে ভাবলেন খলিফা হয়তো মাতাল অবস্থায় এই নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মাসরুরকে অনুরোধ করলেন খলিফার কাছে একবার শেষবার নিয়ে যেতে। কিন্তু খলিফা তার মুখ দেখতে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত মাসরুর জাফরের মাথা কেটে খলিফার সামনে পেশ করলেন। জাফর ছিলেন হারুনের ১৭ বছরের সঙ্গী। সেই বন্ধুর ছিন্ন মস্তক দেখে হারুন কেঁদেছিলেন কিনা জানা যায় না, তবে তিনি এরপর ইয়াহইয়া এবং ফজলসহ পুরো বার্মাকি পরিবারকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। তাদের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। জাফরের দেহ দ্বিখণ্ডিত করে বাগদাদের দুই ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে সবাই দেখতে পায় খলিফার ক্ষমতার দাপট।
এই ঘটনাটি ইতিহাসে ‘বার্মাকি ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত। এটি প্রমাণ করে, স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় বা ডেস্পটিজম (Despotism)-এ কারো অবস্থানই নিরাপদ নয়। আজ যে খলিফার ডান হাত, কাল সে লাশ। হারুন পরবর্তী জীবনে এই কাজের জন্য অনুশোচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। একবার তিনি বলেছিলেন, “হায়! যদি আমি জানতাম জাফর আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি।” কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বার্মাকিদের পতনের সাথে সাথে আব্বাসীয় প্রশাসনের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল, কারণ তাদের মতো দক্ষ প্রশাসক আর কেউ ছিল না (Clot, 1989)।
আল-খাইজুরান: পর্দার আড়ালের সম্রাজ্ঞী
হারুনুর রশীদের জীবনে আরেকজন প্রভাবশালী চরিত্র ছিলেন তার মা, আল-খাইজুরান (Al-Khayzuran)। আব্বাসীয় ইতিহাসের নারীদের অবস্থান বুঝতে হলে খাইজুরানকে বোঝা জরুরি। তিনি রাজবংশের কেউ ছিলেন না, ছিলেন ইয়েমেন থেকে আসা এক সামান্য দাসী। খলিফা আল-মাহদি তাকে দেখে মুগ্ধ হন, তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন এবং বিয়ে করেন। কিন্তু খাইজুরান কেবল হারেমের শোভা হয়ে থাকেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন। মাহদির শাসনামলেই তিনি পর্দার আড়াল থেকে বা বিহাইন্ড দ্য সিন (Behind the Scene) রাষ্ট্র পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতেন।
মাহদির মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে আল-হাদি খলিফা হন। হাদি তার মায়ের এই হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। তিনি মাকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। কিন্তু খাইজুরান তা মানতে নারাজ ছিলেন। মা ও ছেলের এই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। ৭৮৬ সালে খলিফা হাদি রহস্যজনকভাবে মারা যান। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, খাইজুরান তার নিজের ছেলেকে দাসীদের দিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে বা বিষ প্রয়োগে হত্যা করিয়েছিলেন, কারণ হাদি তার ছোট ভাই হারুনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলেন। খাইজুরান হারুনকে বেশি ভালোবাসতেন এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ মনে করতেন।
হারুন খলিফা হওয়ার পর খাইজুরানের ক্ষমতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ‘কুইন মাদার’। রাজ্যের বড় বড় নিয়োগ, বদলি – সবই তার ইশারায় হতো। উজিররা খলিফার আগে খাইজুরানের সাথে দেখা করতেন। আব্বাসীয় রাজনীতিতে এই ঘটনাকে হারেমি পলিটিক্স (Harem Politics) বা হারেমের রাজনীতির সূচনা বলা যেতে পারে। নারীরা সরাসরি সিংহাসনে বসতে পারতেন না ঠিকই, কিন্তু তারা সন্তান বা স্বামীকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হতেন। খাইজুরান ৭৮৯ সালে মারা যান। তার মৃত্যুতে হারুন গভীরভাবে শোকাহত হয়েছিলেন এবং নগ্ন পায়ে তার জানাজার পেছনে হেঁটেছিলেন, যা একজন খলিফার জন্য ছিল বিরল ঘটনা। খাইজুরানের জীবন আমাদের দেখায়, মধ্যযুগের পিতৃতান্ত্রিক সমাজেও নারীরা বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারতেন (Abbott, 1946)।
হারুনুর রশীদের শাসনকাল ছিল আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। তিনি বাগদাদকে স্বর্গে পরিণত করেছিলেন, কিন্তু সেই স্বর্গের ভিত্তি ছিল ভয় আর রক্তের ওপর। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, আবার সেই প্রদীপের আলোতেই তার বন্ধুর মৃত্যুদণ্ডনামা লিখেছিলেন। বার্মাকিদের পতন এবং খাইজুরানের প্রভাব – সব মিলিয়ে হারুনের যুগ ছিল আব্বাসীয়দের গৌরবের, একই সাথে তাদের নৈতিক স্খলনেরও এক দলিল।
বায়তুল হিকমাহ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাবিস্ফোরণ
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু মাহেন্দ্রক্ষণ আসে, যখন মানুষের মগজে এক ধরনের মহাজাগতিক বিস্ফোরণ ঘটে – জ্ঞানপিপাসা তখন কেবল কৌতূহল থাকে না, তা হয়ে ওঠে এক সর্বগ্রাসী নেশা। আব্বাসীয় খিলাফতের সময়, বিশেষ করে অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে বাগদাদে ঠিক এই ঘটনাটি ঘটেছিল। মরুভূমির রুক্ষ বালুকারাশির ওপর দাঁড়িয়ে আব্বাসীয় শাসকরা বুঝতে পেরেছিল, তরবারি দিয়ে ভূখণ্ড জয় করা যায়, কিন্তু সভ্যতা গড়তে হলে এবং তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য বা ইন্টেলেকচুয়াল হেজিমনি (Intellectual Hegemony)। তারা প্রাচীন গ্রিক, পারসিক এবং ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারকে নিজেদের করে নেওয়ার এক মহাউদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্যোগ ইতিহাসে অনুবাদ আন্দোলন (Translation Movement) নামে পরিচিত, যা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলেছিল। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগদাদের কিংবদন্তিতল্য প্রতিষ্ঠান ‘বায়তুল হিকমাহ’ বা ‘হাউজ অফ উইজডম’ (House of Wisdom)। এটি আজকের দিনের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস বা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছিল না; এটি ছিল তার চেয়েও বেশি কিছু – একই সাথে গবেষণাগার, মানমন্দির, অনুবাদ ব্যুরো এবং বিদগ্ধজনের আড্ডাস্থল। সাসানীয় আমলের ‘জুন্দিশাপুর একাডেমি’-র আদলে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল মধ্যযুগের সিলিকন ভ্যালি, যেখানে জ্ঞানের কাঁচামাল আসত সারা বিশ্ব থেকে, আর প্রক্রিয়াজাত হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ত সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এখানে বসে মানুষ প্রথমবারের মতো বুঝতে শিখেছিল যে, জ্ঞান কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা ধর্মের সম্পত্তি নয়, বরং এটি সমগ্র মানবজাতির উত্তরাধিকার।
বায়তুল হিকমাহর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন খলিফা হারুনুর রশীদ, তবে এটিকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন এবং এক বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন তার পুত্র খলিফা আল-মামুন (Al-Mamun)। মামুনের জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল অনেকটা পাগলামির পর্যায়ে। কথিত আছে, তিনি একবার স্বপ্নে এরিস্টটলকে দেখেছিলেন। স্বপ্নে তিনি গ্রিক দার্শনিককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ভালো কী?” এরিস্টটল উত্তর দিয়েছিলেন, “যা যুক্তিতে ভালো, তাই ভালো।” এই স্বপ্ন মামুনের জীবনদর্শন বদলে দেয়। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, ধর্ম এবং যুক্তির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই; বরং যুক্তিই হলো সত্যে পৌঁছানোর একমাত্র পথ বা র্যাশনালিজম (Rationalism)। এরপর থেকে তিনি গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞান সংগ্রহের জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠেন। বাইজেন্টাইন সম্রাটদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি সোনাদানা বা ভূখণ্ড চাইতেন না, সন্ধিচুক্তি হিসেবে চাইতেন কনস্টান্টিনোপলের লাইব্রেরিতে পড়ে থাকা ধুলোমাখা পাণ্ডুলিপিগুলো। টলেমি (Ptolemy), গ্যালেন (Galen), ইউক্লিড (Euclid), আর্কিমিডিস – কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। বাগদাদে তখন উটের পিঠে চড়ে আসত জ্ঞানের বহর। মামুনের এই উদ্যোগ ছিল মূলত রাষ্ট্রপরিচালিত এক জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। তিনি বাগদাদের উপকণ্ঠে ‘শাম্মাসিয়া’ মানমন্দির স্থাপন করেন, যেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশের নক্ষত্ররাজি পর্যবেক্ষণ করতেন এবং টলেমির গণনাগুলো নতুন করে যাচাই করতেন।
ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুত্ববাদ: জ্ঞানের কোনো ধর্ম নেই
বায়তুল হিকমাহর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এবং সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল এর ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) এবং বহুত্ববাদী চরিত্র। এখানে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র কোনো বাধা ছিল না। এটি ছিল এক কসমোপলিটান আসর যেখানে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, সাবিয়ান, জরাথুস্ট্রবাদী – সব ধর্মের পণ্ডিতরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতেন। তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল তারা ‘জ্ঞানের সেবক’। এই উদারতা বা ইনটেলেকচুয়াল ওপেননেস (Intellectual Openness) আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগের মূল চালিকাশক্তি ছিল। আব্বাসীয় খলিফারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, জ্ঞান আহরণের জন্য মেধা দরকার, বিশ্বাস নয়। উদাহরণস্বরূপ, এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান অনুবাদক ছিলেন হুনাইন ইবনে ইসহাক (Hunayn ibn Ishaq), যিনি ছিলেন একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান। তাকে বলা হতো ‘অনুবাদকদের শেখ’। তিনি গ্রিক ভাষায় এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, হোমারের কবিতাও তিনি অবলীলায় আবৃত্তি করতে পারতেন। তিনি এবং তার ছাত্ররা গ্যালেনের প্রায় সব চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক বই আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। খলিফা আল-মামুন হুনাইনকে এতটাই সম্মান করতেন যে, তিনি হুনাইনের অনুবাদ করা বইয়ের ওজনের সমান সোনা দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করতেন। চিন্তা করা যায়? জ্ঞানের মূল্য সোনার চেয়েও বেশি ছিল তাদের কাছে। এটি কেবল খলিফার খেয়াল ছিল না, এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নীতি বা স্টেট পলিসি (State Policy), যার মাধ্যমে মেধাবীদের বাগদাদে আকৃষ্ট করা হতো (Gutas, 1998)।
এই বহুত্ববাদের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন সাবিয়ান সম্প্রদায়ের থাবিত ইবনে কুররা (Thabit ibn Qurra)। হারান নামক শহর থেকে আসা এই পণ্ডিত ছিলেন একজন গাণিতিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং মেকানিক। তিনি গ্রিক গণিতবিদ অ্যাপোলোনিয়াস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড এবং টলেমির রচনা অনুবাদ করেন। তবে তিনি কেবল অনুবাদক ছিলেন না, তিনি আর্কিমিডিসের গোলক ও সিলিন্ডার বিষয়ক জটিল জ্যামিতিক সমস্যাগুলোর সমাধান নতুন করে দিয়েছিলেন এবং সংখ্যাতত্ত্বে ‘বন্ধু সংখ্যা’ বা অ্যামিকেবল নাম্বারস (Amicable Numbers)-এর ধারণা দিয়েছিলেন। ইহুদি পণ্ডিতরা হিব্রু এবং সিরিয়াক ভাষা থেকে প্রাচীন জ্ঞান আরবিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করতেন। এই যে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের মিলনমেলা, একে আধুনিক পরিভাষায় বলা যায় ক্রস-কালচারাল পলিনেশন (Cross-cultural Pollination)। এর ফলেই বাগদাদে এমন এক হাইব্রিড বা সংকর জ্ঞানচর্চার ধারা তৈরি হয়েছিল, যা ছিল গ্রিক যুক্তিবাদ, ভারতীয় গণিত এবং পারসিক সাহিত্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই পণ্ডিতরা কেবল প্রাচীন বই অনুবাদ করেননি, তারা সেগুলোর টীকা-টিপ্পনী লিখেছেন, ভুল সংশোধন করেছেন এবং নতুন জ্ঞান যোগ করেছেন। একে বলা যায় জ্ঞানের সৃজনশীল আত্তীকরণ (Creative Assimilation)।

আল-খোয়ারিজমি: আধুনিক গণিতের স্থপতি
বায়তুল হিকমাহর গবেষকদের মধ্যে যার নাম সবার আগে নিতে হয়, তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি (Al-Khwarizmi)। তিনি ছিলেন পারস্যের খোয়ারিজম (বর্তমান উজবেকিস্তান) থেকে আসা এক গণিতবিদ। তার অবদান ছাড়া আজকের ডিজিটাল বিশ্ব কল্পনাও করা যায় না। তিনি ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্বকে (বিশেষ করে শূন্যের ব্যবহার এবং দশমিক পদ্ধতি) আরব বিশ্বে এবং পরে ইউরোপে পরিচিত করান। তার লেখা বিখ্যাত বই কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা (দ্য কম্পেনডিয়াস বুক অন ক্যালকুলেশন বাই কমপ্লিশন অ্যান্ড ব্যালেন্সিং) থেকেই ‘অ্যালজেবরা’ বা বীজগণিত (Algebra) শব্দটির উৎপত্তি। তিনি গণিতকে কেবল বিমূর্ত তত্ত্বে আটকে রাখেননি, তিনি একে বাস্তব সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করেছিলেন। জমির ভাগ-বাটোয়ারা, উত্তরাধিকার আইন, খালের গভীরতা মাপা – সবকিছুর গাণিতিক সমাধান বা অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স (Applied Mathematics) তিনি দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে অজানা রাশি (x, y) ব্যবহার করে জটিল সমীকরণ সমাধান করা যায়। এই বিমূর্তায়ন (Abstraction) গণিতের ইতিহাসে ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।
তার নাম থেকেই এসেছে ‘অ্যালগরিদম’ (Algorithm) শব্দটি। আজকের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, গুগল সার্চ, বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা – সবকিছুর মূলে রয়েছে এই অ্যালগরিদম বা ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি। আল-খোয়ারিজমি যদি সেদিন ভারতীয় গণিত এবং গ্রিক জ্যামিতিকে মেলানোর চেষ্টা না করতেন, তবে হয়তো রেনেসাঁস বা শিল্প বিপ্লব অনেক দেরি করে আসত। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বিশাল অবদান রেখেছিলেন। খলিফা মামুনের নির্দেশে তিনি বিশ্বের একটি নতুন মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, যা টলেমির মানচিত্রের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল ছিল। তিনি পৃথিবীর পরিধি নির্ণয়ের জন্য সিনজার মরুভূমিতে একটি বৈজ্ঞানিক অভিযান চালিয়েছিলেন, যেখানে বিজ্ঞানীরা সূর্যের উন্নতি কোণ মেপে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বের করার চেষ্টা করেছিলেন। তার এই কাজগুলো ছিল এম্পিরিকাল সায়েন্স (Empirical Science) বা পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের আদি রূপ। তিনি ‘জিজ’ বা জ্যোতির্বিজ্ঞান সারণি তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের পূর্বাভাস দেওয়া যেত।
আল-কিন্দি, আল-রাজি এবং ইবনে আল-হাইসাম: ত্রয়ী নক্ষত্র
আব্বাসীয় জ্ঞানচর্চার আকাশে আরও তিনটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন – আল-কিন্দি, আল-রাজি এবং ইবনে আল-হাইসাম। আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি (Al-Kindi) ছিলেন প্রথম মুসলিম দার্শনিক, যাকে বলা হয় ‘আরবদের দার্শনিক’। তিনি গ্রিক দর্শন, বিশেষ করে এরিস্টটল এবং প্লেটোর দর্শনকে ইসলামের একেশ্বরবাদের সাথে মেলানোর এক দুঃসাহসী চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পলিম্যাথ। তিনি বলতেন, “সত্য যেখান থেকেই আসুক না কেন, তাকে গ্রহণ করতে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত নয়, এমনকি তা যদি দূরবর্তী জাতি বা ভিন্ন ধর্মের কাছ থেকেও আসে।” তিনি ক্রিপ্টোগ্রাফি বা সংকেত পাঠোদ্ধার বিদ্যা নিয়েও কাজ করেছিলেন এবং ফ্রিকোয়েন্সি অ্যানালাইসিস পদ্ধতির জনক ছিলেন। সঙ্গীতকেও তিনি গণিতের ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে নির্দিষ্ট সুর মানুষের মেজাজ বা স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা আজকের মিউজিক থেরাপি (Music Therapy)-র পূর্বসূরি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি (Al-Razi), যিনি ইউরোপে ‘রাজেস’ নামে পরিচিত। তাকে বলা হয় মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি পরীক্ষানির্ভর বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম হাম (Measles) এবং গুটিবসন্তের (Smallpox) পার্থক্য সঠিকভাবে নির্ণয় করেন তার বিখ্যাত বই কিতাব আল-জুদারি ওয়া আল-হাসবা-তে। বাগদাদে যখন নতুন হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা করা হয়, তখন স্থান নির্বাচনের জন্য তিনি এক অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি শহরের বিভিন্ন মহল্লায় কাঁচা মাংসের টুকরো ঝুলিয়ে রাখেন। কয়েক দিন পর তিনি দেখলেন কোন এলাকার মাংসটি সবচেয়ে কম পচেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানেই হাসপাতাল হবে, কারণ সেখানকার বাতাস সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং জীবাণুমুক্ত। এই যে পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান, এর চর্চা তখন তুঙ্গে। আল-রাজি ছিলেন একজন মুক্তচিন্তক বা ফ্রি থিঙ্কার (Free Thinker), যিনি কোনো কিছুই অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন না, এমনকি ধর্মীয় ডগমাও নয়। তার রচিত কিতাব আল-হাবি বা ‘দ্য কমপ্রিহেনসিভ বুক’ চিকিৎসাশাস্ত্রে কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপের পাঠ্যপুস্তক ছিল।
ইবনে আল-হাইসাম (Ibn al-Haytham), যিনি ইউরোপে ‘আলহাজেন’ নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের এক দৈত্য। তাকে বলা হয় আলোকবিজ্ঞান বা অপটিক্স (Optics)-এর জনক। তার কিতাব আল-মানাজির বা বুক অফ অপটিক্স (Book of Optics) ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক। গ্রিকরা, বিশেষ করে টলেমি ও ইউক্লিড বিশ্বাস করতেন চোখ থেকে আলো বের হয়ে বস্তুর ওপর পড়ে, তাই আমরা দেখি। একে বলা হতো ‘ইমিশন থিওরি’। ইবনে আল-হাইসাম প্রমাণ করলেন এটি ভুল। তিনি দেখালেন আলো বস্তুর ওপর পড়ে এবং সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। তিনি চোখের গঠন বা এনাটমি (Anatomy) নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন এবং ‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’ বা পিনহোল ক্যামেরার নীতি আবিষ্কার করেন। নিউটনের জন্মের প্রায় ৭০০ বছর আগে তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (Scientific Method)-র ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন – যেখানে হাইপোথিসিস, এক্সপেরিমেন্ট এবং ভেরিফিকেশন অপরিহার্য। তিনি বলতেন, “যে সত্যের সন্ধান করে, সে কোনো বইয়ের ওপর অন্ধবিশ্বাস রাখে না; বরং সে তার যুক্তি দিয়ে সবকিছু যাচাই করে।”
যান্ত্রিক প্রকৌশল: বানু মুসা এবং অটোমেশন
বায়তুল হিকমাহ কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানের কেন্দ্র ছিল না, এখানে প্রকৌশলবিদ্যা নিয়েও প্রচুর কাজ হতো। এ প্রসঙ্গে ‘বানু মুসা’ বা মুসার তিন পুত্র – মুহাম্মদ, আহমদ এবং আল-হাসানের কথা না বললেই নয়। তারা ছিলেন খলিফা মামুনের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তারা কিতাব আল-হিয়াল বা বুক অফ ইনজেনিয়াস ডিভাইসেস (Book of Ingenious Devices) নামে একটি বই লেখেন, যেখানে প্রায় ১০০টি যান্ত্রিক ডিভাইসের বর্ণনা ও নকশা ছিল। এর মধ্যে ছিল স্বয়ংক্রিয় ঝর্ণা, যান্ত্রিক বাঁশি এবং এমন সব পাত্র যা নিজে নিজেই পূর্ণ হতো। তারা ভালভ, ক্র্যাঙ্ক এবং সাইফন প্রযুক্তির ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তাদের তৈরি করা ‘ফ্লুট প্লেয়ার’ বা যান্ত্রিক বাঁশি বাদকটিকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম আদি অটোমাটা (Automata) বা রোবট। আব্বাসীয়রা প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির শক্তিকে বাগে আনার চেষ্টা করেছিল, যা ছিল তৎকালীন সময়ে জাদুর চেয়ে কম কিছু নয় (Saliba, 2007)।
কাগজের বিপ্লব: তথ্যের গণতন্ত্রীকরণ
জ্ঞানের এই মহাবিস্ফোরণের পেছনে একটি প্রযুক্তিগত অনুঘটক ছিল – কাগজ। ৭৫১ সালে আব্বাসীয়রা তালাসের যুদ্ধে (Battle of Talas) চীনাদের পরাজিত করে। এই যুদ্ধে বন্দি হওয়া কিছু চীনা কারিগরের কাছ থেকে মুসলমানরা কাগজ তৈরির গোপন কৌশল শিখে নেয়। এটি ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক ঘটনা। এর আগে লেখার জন্য প্যাপিরাস (যা মিসরে পাওয়া যেত এবং ভঙ্গুর ছিল) অথবা পার্চমেন্ট (প্রাণীর চামড়া, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল) ব্যবহার করা হতো। কাগজ ছিল সস্তা, টেকসই এবং সহজলভ্য। বাগদাদে খুব দ্রুত কাগজের কল বা পেপার মিল (Paper Mill) গড়ে ওঠে এবং সমরকন্দ থেকে শুরু করে স্পেন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে।
কাগজ সহজলভ্য হওয়ায় বইয়ের দাম কমে গেল এবং জ্ঞান আর অভিজাতদের ড্রয়িংরুমে বা রাজপ্রাসাদে বন্দি রইল না। জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ল সাধারণের মাঝে। বাগদাদে তখন ১০০টিরও বেশি বইয়ের দোকান ছিল, যা ‘সুস আল-ওয়াররাকিন’ বা স্টেশনার্স মার্কেট নামে পরিচিত ছিল। লেখকরা তাদের পাণ্ডুলিপি কপি করার জন্য অনুলিপিকারক বা স্ক্রাইব (Scribe) নিয়োগ করতেন। এই ‘পেপার রিভোলিউশন’ বা কাগজ বিপ্লবকে আজকের ইন্টারনেট বিপ্লবের সাথে তুলনা করা চলে। তথ্যের এই প্রবাহ আব্বাসীয় সমাজকে একটি লিটারেট সোসাইটি (Literate Society) বা শিক্ষিত সমাজে রূপান্তর করতে সাহায্য করেছিল। রাস্তায় বসে গল্প বলা বা কবিতা আবৃত্তি করা যেমন বিনোদন ছিল, তেমনি বই পড়া বা লাইব্রেরিতে যাওয়াও ছিল এক ধরনের সামাজিক স্ট্যাটাস। শিক্ষার এই ব্যাপক প্রসার আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগকে দীর্ঘস্থায়ী করেছিল।
বায়তুল হিকমাহ এবং এই অনুবাদ আন্দোলন কেবল মুসলিম বিশ্বের জন্যই নয়, পুরো মানব সভ্যতার জন্য ছিল আশীর্বাদ। প্রাচীন গ্রিক জ্ঞান যা ইউরোপে হারিয়ে গিয়েছিল বা চার্চের অন্ধকারে চাপা পড়েছিল, তা আরবরা সংরক্ষণ করেছিল। পরবর্তীতে যখন বাগদাদ ধ্বংস হয়ে যায়, তখন এই অনুবাদ করা বইগুলোর ল্যাটিন সংস্করণ ইউরোপে পৌঁছেছিল। স্পেনের কর্ডোভা এবং সিসিলি হয়ে এই জ্ঞান ইউরোপে প্রবেশ করে এবং সেখানে রেনেসাঁস (Renaissance) ঘটাতে সাহায্য করে। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা এবং দর্শন – সবকিছুর শেকড় কোনো না কোনোভাবে বাগদাদের সেই বায়তুল হিকমাহর সাথে যুক্ত। আব্বাসীয়রা হয়তো তরবারি দিয়ে পৃথিবী শাসন করতে পারেনি, তাদের সাম্রাজ্য ধুলোয় মিশে গেছে, কিন্তু কলম দিয়ে তারা যা জয় করেছিল, তা কোনো সীমান্ত বা সময় মানে না (Bloom, 2001; Lindberg, 1976)।
মুতাজিলা মতবাদ: যুক্তির জয়গান এবং মিহনা
বাগদাদের জ্ঞানচর্চা যখন তুঙ্গে, তখন সেই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ঢেউ কেবল বিজ্ঞানাগার বা মানমন্দিরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা আছড়ে পড়েছিল ধর্মের গভীর তাত্ত্বিক জগতেও। মানুষ যখন ইউক্লিডীয় জ্যামিতি বাএরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা দিয়ে বিশ্বকে বুঝতে শিখল, তখন তারা সেই একই যুক্তির ছাঁচে ধর্মকেও বিচার করতে চাইল। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মতাত্ত্বিক আন্দোলন, যার নাম মুতাজিলা (Mu’tazila)। এটি কোনো সাধারণ মাজহাব বা উপদল ছিল না; এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্ব (Rationalist Theology) বা কালাম শাস্ত্র (Ilm al-Kalam)-এর পদ্ধতিগত রূপ। এর জন্ম হয়েছিল বসরার হাসান আল-বাসরির আসর থেকে, যখন ওয়াসিল ইবনে আতা কোনো এক পাপীর অবস্থান নিয়ে গুরুর সাথে দ্বিমত পোষণ করে দলত্যাগ করেছিলেন। ‘মুতাজিলা’ শব্দের অর্থই হলো ‘যারা সরে গেছে’ বা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী‘। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফতের রাষ্ট্রীয় মতাদর্শে পরিণত হয়েছিল। মুতাজিলারা বিশ্বাস করত যে, ওহি বা প্রত্যাদেশের (Revelation) চেয়ে মানুষের বিবেক এবং যুক্তি (Reason) অনেক ক্ষেত্রে বেশি শক্তিশালী। তাদের মূল কথা ছিল – ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন তাকে ব্যবহার করার জন্য, অন্ধভাবে প্রাচীন প্রথা বা হাদিস মেনে চলার জন্য নয়। তারা মনে করত, ধর্মগ্রন্থের যেসব আয়াত মানুষের যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে, আক্ষরিক অর্থে নয়। এই রূপক ব্যাখ্যা (Metaphorical Interpretation) বা তাওইল (Ta’wil) ছিল তাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার, যা রক্ষণশীল আলেমদের চক্ষুশূল ছিল।
ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির লড়াই
মুতাজিলা দর্শনের পাঁচটি মূল স্তম্ভ বা উসুল আল-খামসা (Usul al-Khamsa) ছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি হলো তাওহীদ (Divine Unity) এবং আদল (Divine Justice)। তারা নিজেদের বলত ‘আহল আল-আদল ওয়া আল-তাওহীদ’ বা ন্যায়বিচার ও একত্বের অনুসারী। তাদের মতে, ঈশ্বর হলেন পরম ন্যায়বিচারক। তিনি কখনো অন্যায় করতে পারেন না এবং মানুষকে এমন কোনো কাজের জন্য শাস্তি দিতে পারেন না, যা করার ক্ষমতা মানুষের নেই। এখান থেকেই আসে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (Free Will) বা কদর (Qadar)-এর ধারণা। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ এবং উমাইয়া শাসকরা প্রচার করত জাবরিয়া মতবাদ (Jabriyya) বা নিয়তিবাদ। জাবরিয়ারা বলত, মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই, সবকিছু ঈশ্বরের ইশারায় ঘটে। উমাইয়া শাসকরা তাদের স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এই নিয়তিবাদ ব্যবহার করত; তারা বলত, “আমরা যে ক্ষমতায় আছি এবং অত্যাচার করছি, তা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হচ্ছে।” মুতাজিলারা এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করল। তারা বলল, মানুষ তার নিজের কাজের স্রষ্টা। মানুষ যদি ভালো কাজ করে তবে পুরস্কার পাবে, আর খারাপ কাজ করলে শাস্তি পাবে। যদি ঈশ্বর মানুষের ভাগ্য আগেই লিখে রাখেন এবং জোর করে তাকে দিয়ে পাপ করান, তবে তাকে নরকে পাঠানো হবে অবিচার। আর ঈশ্বর কখনো অবিচারক হতে পারেন না। এই যুক্তিবাদী অবস্থান মানুষকে তার কর্মের প্রতি দায়বদ্ধ করেছিল এবং স্বৈরাচারী শাসকদের ‘ঈশ্বরের দোহাই’ দেওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল (Watt, 1948)।
কুরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব: অনাদি বনাম সৃষ্ট
মুতাজিলাদের সাথে রক্ষণশীল সুন্নি বা ঐতিহ্যবাদী (Traditionalist) আলেমদের সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কুরআনের প্রকৃতি নিয়ে এক জটিল দার্শনিক বিতর্ক। প্রশ্নটি ছিল: কুরআন কি ঈশ্বরের মতো অনাদি বা আনক্রিয়েটেড (Uncreated), নাকি এটি ঈশ্বরের সৃষ্টি বা ক্রিয়েটেড (Created)? সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি তাত্ত্বিক ক্যাচাল মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে ছিল গভীর তাত্ত্বিক সংকট (Theological Crisis)। রক্ষণশীলরা এবং ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল বিশ্বাস করতেন, কুরআন হলো ঈশ্বরের কালাম বা কথা, এবং ঈশ্বরের কথা তার সত্তার অংশ, তাই তা অনাদি। কিন্তু মুতাজিলারা যুক্তি দেখাল, যদি আমরা মেনে নিই যে কুরআন অনাদি, তবে আমরা ঈশ্বরের পাশাপাশি আরেকটি অনাদি সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছি। এটি তাদের মতে খ্রিস্টানদের ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদের মতো হয়ে যায় এবং ইসলামের মৌলিক একেশ্বরবাদ (Monotheism) বা তাওহীদের লঙ্ঘন।
মুতাজিলারা বলত, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেই, তার সত্তার সমকক্ষ বা শাশ্বত আর কিছুই হতে পারে না। তাই কুরআন হলো ঈশ্বরের তৈরি করা একটি বস্তু বা সৃষ্টি, যা তিনি জিবরাঈলের মাধ্যমে নবীর কাছে পাঠিয়েছেন। এটি কোনো শাশ্বত সত্তা নয়। এই বিতর্কটি কেবল ধর্মতাত্ত্বিক ছিল না, এটি ছিল রাজনৈতিক। যদি কুরআন অনাদি হয়, তবে তার ব্যাখ্যাকার হিসেবে আলেম বা উলেমাদের ক্ষমতা বেড়ে যায়। আর যদি কুরআন সৃষ্ট হয়, তবে খলিফা (যিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি) সময়ের প্রয়োজনে যুক্তির মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা পরিবর্তন করতে পারেন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন এই বিতর্কে মুতাজিলাদের পক্ষ নিলেন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের ক্ষমতা উলেমাদের চেয়ে বেশি হোক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং তারা ঈশ্বরকে মানুষের মতো হাত-পা বিশিষ্ট সত্তা বা নৃতত্ত্ববাদ (Anthropomorphism)-এর মাধ্যমে কল্পনা করে। মামুন চেয়েছিলেন একটি বিশুদ্ধ, বিমূর্ত এবং যুক্তিনির্ভর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে (Nawas, 1994)।
মিহনা: যুক্তির নামে ইনকুইজিশন
খলিফা আল-মামুন ছিলেন আব্বাসীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শাসক। তিনি বায়তুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে জোয়ার এনেছিলেন, তা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু ইতিহাসের এক অদ্ভুত পরিহাস হলো, যারা মুক্তচিন্তার কথা বলে, তারাই একসময় নিজেদের মতবাদ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। মামুন ভাবলেন, এই ‘মূর্খ’ প্রজা এবং গোঁড়া আলেমদের জোর করে প্রগতিশীল বানাতে হবে। তিনি ৮৩৩ সালে একটি বিশেষ বিচার বিভাগ বা ইনকুইজিশন চালু করলেন, যা ইতিহাসে মিহনা (Mihna) বা ‘অগ্নিপরীক্ষা’ নামে পরিচিত। এর উদ্দেশ্য ছিল সরকারি কর্মচারী, বিচারক এবং আলেমদের ডেকে জিজ্ঞেস করা: “তুমি কি বিশ্বাস করো কুরআন সৃষ্ট?” যারা “হ্যাঁ” বলত, তারা মুক্তি পেত এবং পদোন্নতি পেত। আর যারা “না” বলত বা চুপ থাকতো, তাদের ওপর নেমে আসত খড়গ।
এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মবিশ্বাস পরীক্ষার প্রথম এবং অন্যতম বড় ঘটনা। বাগদাদের প্রধান পুলিশ প্রধান ইসহাক ইবনে ইব্রাহিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই পরীক্ষা চালানোর। শত শত আলেম ভয়ে বা লোভে মুতাজিলা মতবাদ মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু রুখে দাঁড়ালেন কয়েকজন, যাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (Ahmad ibn Hanbal)। তিনি ছিলেন হাদিসপনন্থী রক্ষণশীল সমাজের নেতা। তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো, তিনি বললেন, “কুরআন আল্লাহর বাণী, এর বেশি আমি কিছু জানি না।” তাকে বলা হলো যুক্তি দিয়ে তর্ক করতে, তিনি বললেন, “কুরআন ও হাদিসে যা নেই, তা নিয়ে আমি তর্ক করব না।” মামুনের মৃত্যুর পর তার ভাই আল-মু’তাসিম এবং পরবর্তী খলিফা আল-ওয়াসিক এই মিহনা চালিয়ে যান। ইবনে হাম্বলকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং নির্মমভাবে চাবুক মারা হয়। কথিত আছে, তাকে টানা ২৮ মাস বন্দি রাখা হয়েছিল এবং তার ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা সাধারণ মানুষ সহ্য করতে পারত না। কিন্তু তিনি তার মত থেকে একচুলও নড়েননি। তার এই অনড় অবস্থান তাকে সাধারণ মানুষের চোখে নায়কে পরিণত করে। মানুষ দেখল, একদিকে প্রাসাদের বিলাসিতায় থাকা দার্শনিকরা যুক্তির কথা বলে নির্যাতন করছে, অন্যদিকে একজন বৃদ্ধ আলেম কেবল তার বিশ্বাসের জন্য চাবুক খাচ্ছে। জনসমর্থন মুতাজিলাদের বিপক্ষে চলে গেল। ইতিহাস আমাদের শেখায়, জোর করে যেমন ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি জোর করে প্রগতিশীলতা বা লিবারেলিজম (Liberalism)-ও চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে সম্মান না করলে যেকোনো মহৎ আদর্শই শেষ পর্যন্ত নিপীড়ক বা ফ্যাসিজম (Fascism)-এ রূপ নিতে পারে (Hurvitz, 2002)।
যুক্তির পতন এবং রক্ষণশীলতার বিজয়
প্রায় ১৫ বছর ধরে চলা এই ‘মিহনা’ মুসলিম মানসজগতে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। ৮৪৭ সালে খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল (Al-Mutawakkil) ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন চতুর রাজনীতিবিদ। তিনি বুঝতে পারলেন, মুতাজিলাদের সমর্থন করে তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। জনগণ মুতাজিলাদের ‘নাস্তিক’ বা ‘ধর্মত্যাগী’ মনে করতে শুরু করেছে। নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে এবং সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে তিনি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। তিনি ‘মিহনা’ বাতিল ঘোষণা করলেন এবং মুতাজিলাদের ওপর পাল্টা দমনপীড়ন শুরু করলেন। আহমেদ ইবনে হাম্বলকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হলো এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হলো। মুতাজিলা বইপত্র নিষিদ্ধ করা হলো, তাদের দার্শনিকদের বরখাস্ত করা হলো। বাগদাদের রাস্তায় ঘোষণা দেওয়া হলো, “যে কেউ কুরআনকে সৃষ্ট বলবে, তার রক্ত হালাল।”
এই ঘটনা ছিল মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের এক বড় মোড় বা টার্নিং পয়েন্ট (Turning Point)। এর ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা পূরণ করল এক নতুন মতবাদ, যার নাম আশারি মতবাদ (Ash’arism)। আবুল হাসান আল-আশারি, যিনি নিজে একসময় মুতাজিলা ছিলেন, তিনি যুক্তি এবং ওহির মধ্যে এক মধ্যপন্থা তৈরির চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশারি মতবাদ এবং হাম্বলি মতবাদ যুক্তির চেয়ে বিশ্বাস বা ফিডেইজম (Fideism)-কে বেশি গুরুত্ব দিল। তারা বলল, “ঈশ্বরের হাত আছে, কিন্তু তা কেমন আমরা জানি না (বিলা কাইফা), এবং এটা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না।” মুতাজিলাদের সেই ‘কেন’ এবং ‘কিভাবে’ প্রশ্ন করার সংস্কৃতি আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। দর্শন এবং বিজ্ঞান চর্চা কিছুদিন চললেও, ধর্মতাত্ত্বিক জগতে যুক্তির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এই মিহনা এবং তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াই মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানচর্চার পতনের দীর্ঘমেয়াদি কারণ। যখন ধর্মকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখা হয় এবং যুক্তিকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তখন সেই সমাজের মেধা শুকিয়ে যেতে বাধ্য (Martin & Woodward, 1997)।
মুতাজিলা আন্দোলন ছিল এক অসমাপ্ত বিপ্লব। তারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং যুক্তির যে মশাল জ্বালিয়েছিল, তা মিহনার অন্ধকারে নিভে গিয়েছিল। আব্বাসীয়রা যদি জোর করে এই মতবাদ চাপিয়ে না দিত, তবে হয়তো ইসলামের ইতিহাস অন্যরকম হতো। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভ এবং অসহিষ্ণুতা সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিল। আজও যখন আমরা ধর্ম ও যুক্তির দ্বন্দ্বে পড়ি, তখন মুতাজিলাদের সেই পুরোনো প্রশ্নগুলোই নতুন করে সামনে আসে। তারা প্রমাণ করে গেছে, চিন্তা করার স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি, আবার সেই চিন্তাকে যখন রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো হয়, তখন তা হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
অর্থনীতি, সমাজ এবং বিলাসিতা: আব্বাসীয় স্বর্ণযুগের অন্দরমহল
আব্বাসীয় খিলাফতের রাজনৈতিক ইতিহাস যদি হয় তরবারি ও ষড়যন্ত্রের আখ্যান, তবে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস হলো এক বিস্ময়কর বিশ্বায়ন (Globalization) এবং সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের গল্প। আব্বাসীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল নিঃসন্দেহে বাণিজ্য, যা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে এক বিশাল সংযোগ সেতু তৈরি করেছিল। বাগদাদ কেবল একটি প্রশাসনিক রাজধানী ছিল না, এটি ছিল তৎকালীন বিশ্বের বাণিজ্যিক হৃৎপিণ্ড বা এন্ট্রোপট (Entrepot)। দজলা (টাইগ্রিস) ও ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান এবং পারস্য উপসাগরের সাথে সরাসরি সংযোগ আব্বাসীয়দের সমুদ্র বাণিজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি বানিয়েছিল। সিল্ক রোড (Silk Road) দিয়ে চীনের রেশম, পোর্সেলিন এবং কাগজ আসত; পূর্ব আফ্রিকা বা ‘জঞ্জ’ অঞ্চল থেকে আসত সোনা, হাতির দাঁত, পশুর চামড়া এবং দাস; রাশিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা ‘ভারাঞ্জিয়ান’দের কাছ থেকে আসত উন্নতমানের পশম, আম্বর এবং মোম; আর ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসত মসলা, সুগন্ধি, দামি কাঠ এবং রঞ্জক পদার্থ। এই বিশাল বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক বা মার্কেন্টাইল সিস্টেম (Mercantile System) আব্বাসীয় অর্থনীতিকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যা মধ্যযুগের অন্য কোনো সভ্যতার পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন ছিল। বণিকরা এই সমাজে ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত শ্রেণি, যা সমসাময়িক ইউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, যেখানে বণিকদের নিচু চোখে দেখা হতো। আব্বাসীয় সমাজে বাণিজ্যের এই মর্যাদার পেছনে ধর্মীয় কারণও ছিল; যেহেতু নবী মুহাম্মদ এবং প্রথম খলিফা আবু বকর নিজেরা বণিক ছিলেন, তাই বাণিজ্যকে একটি সৎ এবং অভিজাত পেশা হিসেবে গণ্য করা হতো। সিন্দবাদ নাবিকের (Sinbad the Sailor) দুঃসাহসিক গল্পগুলো হয়তো কাল্পনিক, কিন্তু তা সেই সময়ের বসরা ও সিরাফ বন্দরের বণিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতারই ছায়া। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চীন পর্যন্ত বাণিজ্য যাত্রা বা মেরিটাইম ট্রেড (Maritime Trade) ছিল সেই যুগের প্রেক্ষাপটে এক অকল্পনীয় ঝুঁকি ও সাহসের ব্যাপার।
অর্থনৈতিক লেনদেনের গতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আব্বাসীয়রা এক বৈপ্লবিক আর্থিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, যাকে আধুনিক ব্যাংকিংয়ের আদিম রূপ বলা যেতে পারে। তৎকালীন বিশ্বে যখন ধাতব মুদ্রার ওজনে লেনদেন হতো এবং বিশাল পরিমাণ সোনাদানা বহন করা ছিল ডাকাতদের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তখন আব্বাসীয় বণিকরা উদ্ভাবন করেন ‘সাক’ (Sakk) বা চেক ব্যবস্থা। এই ক্রেডিট সিস্টেম (Credit System) বা ঋণদান পদ্ধতি বাণিজ্যের চেহারা বদলে দেয়। একজন বণিক বাগদাদের কোনো সরাফ বা ব্যাংকারের কাছে টাকা জমা দিয়ে একটি সাক নিতেন এবং সেই কাগজ দেখিয়ে হাজার মাইল দূরে চীন, ভারত বা মরক্কোর কোনো এজেন্টের কাছ থেকে নগদ অর্থ উত্তোলন করতে পারতেন। এই পদ্ধতি কেবল নিরাপত্তাই দেয়নি, বাণিজ্যের মূলধন প্রবাহ বা ক্যাপিটাল ফ্লো (Capital Flow)-কে করেছিল দ্রুততর। এর সাথে যুক্ত ছিল হাওলা ব্যবস্থা (Hawala System), যা অনানুষ্ঠানিক বিশ্বাস-ভিত্তিক অর্থ স্থানান্তরের একটি মাধ্যম ছিল এবং আজও বিশ্বের অনেক প্রান্তে প্রচলিত। আব্বাসীয় দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) এবং দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রার মর্যাদা পেয়েছিল, অনেকটা আজকের দিনের মার্কিন ডলারের মতো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে শুরু করে ইংল্যান্ড পর্যন্ত আব্বাসীয় মুদ্রার সন্ধান পেয়েছেন, যা প্রমাণ করে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবের পরিধি কতটা বিশাল ছিল। এই সমৃদ্ধ অর্থনীতির আরেকটি গোপন ভিত্তি ছিল কৃষি বিপ্লব বা এগ্রিকালচারাল রিভোলিউশন (Agricultural Revolution)। পূর্ব দিক থেকে নতুন নতুন ফসল – যেমন চাল, আখ, তুলা, বেগুন, এবং বিভিন্ন সাইট্রাস ফল – পশ্চিমে আনা হয় এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে সেগুলোর ব্যাপক চাষাবাদ শুরু হয়। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস অববাহিকায় জটিল খাল ব্যবস্থা এবং পারস্যের কানাৎ (Qanat) প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি উৎপাদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল, যা বিশাল জনসংখ্যা এবং বিলাসী জীবনযাত্রার জোগান দিতে সক্ষম ছিল (Watson, 1983)।
আব্বাসীয় সমাজব্যবস্থা ছিল প্রকৃত অর্থেই কসমোপলিটান (Cosmopolitan) বা বিশ্বজনীন। বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আরবি, ফারসি, তুর্কি, গ্রিক, এবং ভারতীয় ভাষার মিশ্রণ শোনা যেত। তবে এই সমাজের ভেতরে একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল, যা আরব ও অনারবদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করত। উমাইয়াদের পতনের পর অনারব মুসলিম বা মাওয়ালিদের মর্যাদা বাড়লেও, আরব আভিজাত্যবোধ পুরোপুরি লুপ্ত হয়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় পারসিক বুদ্ধিজীবী ও আমলাদের মধ্যে গড়ে ওঠে শুউবিয়া আন্দোলন (Shu’ubiyya Movement)। এটি ছিল মূলত একটি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যেখানে অনারবরা সাহিত্য ও কৃষ্টিতে আরবদের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করত। তারা দাবি করত যে, আরবদের যখন কোনো সভ্যতা ছিল না, তখন পারস্য হাজার বছরের ঐতিহ্য লালন করেছে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই আব্বাসীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিল। সমাজ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল – ‘আল-খাসসা’ (অভিজাত শ্রেণি) এবং ‘আল-আম্মা’ (সাধারণ জনগণ)। অভিজাতদের মধ্যে ছিলেন খলিফার পরিবার, উচ্চপদস্থ আমলা, সেনাপতি, বড় বণিক এবং উলেমা বা ধর্মতাত্ত্বিকরা। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল কৃষক, কারিগর, ছোট দোকানদার এবং সমাজের একেবারে নিচুতলায় থাকা দাস শ্রেণি। সমাজে আভিজাত্যের মাপকাঠি কেবল জন্ম বা বংশ ছিল না, বরং শিক্ষা বা আদব (Adab) এবং সম্পদও সামাজিক সচলতা বা সোশ্যাল মোবিলিটি (Social Mobility)-র সুযোগ করে দিত। একজন সাধারণ পরিবারের সন্তানও যদি মেধার প্রমাণ দিতে পারত, তবে সে উজির বা বিচারকের পদে আসীন হতে পারত, যদিও তা ছিল বিরল ঘটনা (Ahsan, 1979)।
বিলাসিতা এবং দাসপ্রথা: আলোর নিচে অন্ধকার
আব্বাসীয় স্বর্ণযুগের জৌলুসের ঠিক নিচেই ছিল দাসপ্রথার এক অন্ধকার জগত। আব্বাসীয় অর্থনীতি এবং গৃহস্থালি জীবনের একটি বড় অংশ ছিল দাসশ্রমের ওপর নির্ভরশীল। দাসপ্রথা বা স্লেভারি (Slavery) তৎকালীন সমাজে এতই স্বাভাবিক ছিল যে, এ নিয়ে খুব একটা নৈতিক প্রশ্ন তোলা হতো না। দাসদের প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেত: গৃহস্থালি দাস, সামরিক দাস বা মামলুক (Mamluk) এবং কৃষি বা শ্রম দাস। গৃহস্থালি দাসরা মূলত আফ্রিকা (নুবিয়ান), মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপ (স্লাভ) থেকে আসত। এদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ দাসীদের কদর ছিল বেশি এবং তাদের দামও ছিল আকাশচুম্বী। সুন্দরী এবং শিক্ষিতা দাসী, যারা গান-বাজনা, কবিতা আবৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কথোপকথনে পারদর্শী ছিল, তাদের বলা হতো ‘কিয়ান’ বা গায়িকা। এই দাসীরা বা কনকিউবাইন (Concubine)-রা অনেক সময় খলিফা বা অভিজাতদের এতটাই প্রিয়ভাজন হয়ে উঠত যে, তারা প্রাসাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। খলিফাদের মায়েদের অনেকেই ছিলেন এই দাসী শ্রেণি থেকে আসা, যা প্রমাণ করে যে মাতৃসূত্রীয় বংশমর্যাদা আব্বাসীয়দের কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অন্যদিকে, তুর্কি দাসদের মূলত সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হতো তাদের যুদ্ধদক্ষতার জন্য। কিন্তু দাসপ্রথার সবচেয়ে অমানবিক রূপটি দেখা যেত দক্ষিণ ইরাকের কৃষি খামারে, যেখানে হাজার হাজার আফ্রিকান দাসকে পশুর মতো খাটানো হতো। এই দাসদের কোনো সামাজিক অধিকার ছিল না এবং তাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ।
- দাস বিদ্রোহ এবং জাঞ্জ বিপ্লব:
আব্বাসীয় সমাজের এই চরম বৈষম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে ইতিহাসের অন্যতম বড় এবং রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় ৮৬৯ সালে, যা জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) নামে পরিচিত। ‘জাঞ্জ’ শব্দটি পূর্ব আফ্রিকা থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণ ইরাকের বসরা অঞ্চলের বিশাল লবণাক্ত জলাভূমি বা সল্ট মার্শ পরিষ্কার করে চাষযোগ্য জমি তৈরি এবং উপরের লবণের স্তর বা সল্টপিটার (Saltpeter) সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার জাঞ্জ দাসকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। তাদের কাজের পরিবেশ ছিল অকল্পনীয় রকমের কঠোর; ম্যালেরিয়া-প্রবণ জলাভূমি, অপর্যাপ্ত খাবার এবং মালিকদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। এই বারুদে আগুন দেনআলী ইবনে মুহাম্মদ নামক এক রহস্যময় নেতা। তিনি নিজেকে আলীর বংশধর দাবি করতেন এবং সম্ভবত তিনি খারিজি মতবাদ (Kharijite Ideology) দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা বলত – “সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিই খলিফা হবে, এমনকি সে যদি ইথিওপিয়ান দাসও হয়।” আলী ইবনে মুহাম্মদ এই দাসদের মুক্তির স্বপ্ন দেখান এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, বিজয়ী হলে তারা তাদের প্রভুদের সম্পদের মালিক হবে এবং প্রভুদের দাস বানাবে।এই বিদ্রোহ কেবল একটি দাঙ্গা ছিল না, এটি ছিল একটি সুসংগঠিত শ্রেণি সংগ্রাম (Class Struggle)বা গণবিপ্লব। বিদ্রোহীরা ‘আল-মুখতারা’ নামে নিজেদের একটি রাজধানী গড়ে তোলে, নিজস্ব মুদ্রা চালু করে এবং প্রায় ১৪ বছর ধরে (৮৬৯-৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ) আব্বাসীয় খিলাফতের হৃদপিণ্ডে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা বসরা শহর দখল করে এবং ব্যাপক লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। আব্বাসীয় সেনাবাহিনী বারবার তাদের কাছে পরাজিত হয়, কারণ বিদ্রোহীরা জলাভূমির ভৌগোলিক সুবিধা বা গেরিলা যুদ্ধকৌশল (Guerrilla Warfare) ব্যবহারে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। এই বিদ্রোহ আব্বাসীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয় এবং বাগদাদের কেন্দ্রীয় শাসনকে নড়বড়ে করে তোলে। শেষ পর্যন্ত খলিফা আল-মুওতমিদের ভাইআল-মুওয়াফফাক এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে দীর্ঘ অবরোধ এবং অ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমার প্রলোভন দেখিয়ে বিদ্রোহীদের মধ্যে ফাটল ধরান এবং বিদ্রোহ দমন করেন। আলী ইবনে মুহাম্মদের মাথা কেটে বাগদাদে আনা হয়। কিন্তু এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, আব্বাসীয়দের ঐশ্বর্যের ভিত্তি ছিল কতটা নড়বড়ে এবং শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে (Popovic, 1999)। - নারীদের অবস্থান এবং হারেম সংস্কৃতি:
আব্বাসীয় সমাজে নারীদের অবস্থান ছিল জটিল এবং বৈপরীত্যে ভরা। প্রাক-ইসলামী বা উমাইয়া যুগের তুলনায় আব্বাসীয় যুগে উচ্চবিত্ত নারীদের জনসমক্ষে চলাফেরা অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত এবং সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পারসিক সাসানীয় ঐতিহ্যের প্রভাবে নারীদের জন্য কঠোর পর্দা প্রথা এবং হারেমি সংস্কৃতি (Harem Culture) চালু হয়। খলিফা এবং অভিজাতদের প্রাসাদে ‘হারেম’ ছিল একটি পৃথক জগৎ, যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে এই চার দেয়ালের ভেতরে থেকেও রাজপরিবারের নারীরা বা এলিট উইমেন (Elite Women)-রা অবিশ্বাস্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী জুবাইদা এবং মা খাইজুরান ছিলেন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জুবাইদা কেবল জনহিতৈষী ছিলেন না, তিনি ফ্যাশন আইকনও ছিলেন। তার পোশাক, জুতো এবং জীবনযাপন বাগদাদের অন্য নারীরা অনুকরণ করত। তিনি মক্কা ও মদিনায় তীর্থযাত্রীদের জলের কষ্ট দূর করার জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে যে খাল খনন করেছিলেন, তা নহরে জুবাইদা (Zubaydah’s Spring) নামে পরিচিত এবং এটি আব্বাসীয় প্রকৌশলবিদ্যার এক অনন্য নিদর্শন। অন্যদিকে, সাধারণ বা গরিব নারীদের জীবনে এই বিলাসিতা বা অবরোধ ছিল না; তাদের কৃষিকাজ, বুননশিল্প বা ছোটখাটো ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে হতো জীবন ধারণের জন্য। সমাজের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল শিক্ষিত দাসী বা ‘জারিয়া‘, যারা অনেক স্বাধীন নারীর চেয়েও বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত এবং পুরুষদের মজলিসে বসে সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে তর্ক করার অধিকার রাখত।
বিলাসিতা, ভোজনরসিকতা এবং সাংস্কৃতিক জীবন
আব্বাসীয় অভিজাতদের জীবনযাপন ছিল চরম বিলাসিতায় মোড়ানো, যাকে হেডোনিজম (Hedonism) বা সুখবাদ বলা যেতে পারে। বাগদাদের প্রাসাদগুলো ছিল স্থাপত্যশৈলীর এক একটি মাস্টারপিস। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য প্রাসাদের মাটির নিচে বিশেষ কক্ষ বা ‘সিরদাব’ (Sirdab) তৈরি করা হতো, যেখানে বাতাসের প্রবাহ এবং জলের ফোয়ারা ঘরকে প্রাকৃতিকভাবে শীতল রাখত – যা ছিল তৎকালীন এয়ার কন্ডিশনিং (Air Conditioning) ব্যবস্থা। তাদের পোশাক-আশাকে ছিল আভিজাত্যের ছাপ; ঋতুভেদে তারা ভিন্ন ভিন্ন রঙের এবং উপাদানের পোশাক পরত। এই ফ্যাশন সচেতনতা বাগদাদে নিয়ে এসেছিলেন আন্দালুসিয়া থেকে আসা বিখ্যাত গায়ক ও ফ্যাশন ডিজাইনার জিরয়াব (Ziryab), যদিও তিনি পরে স্পেনে চলে যান। তিনি টুথপেস্ট, ডিওডোরেন্ট এবং খাবারের টেবিলে কাঁচের গ্লাস ব্যবহারের চল শুরু করেন। আব্বাসীয় রন্ধনশিল্প বা গ্যাস্ট্রোনমি (Gastronomy) ছিল অত্যন্ত উন্নত। কিতাব আল-তাবিখ (Book of Dishes) নামে দশম শতাব্দীর একটি রান্নার বই থেকে জানা যায় যে, তারা হাজার রকমের মসলা, মাংস এবং ফলের সমন্বয়ে জটিল সব খাবার তৈরি করত। বরফ দিয়ে শরবত ঠান্ডা করার পদ্ধতি এবং মিষ্টান্ন হিসেবে চিনির ব্যবহার (যা ইউরোপ তখনো জানত না) ছিল তাদের বিলাসিতার অংশ।
তবে এই অতিরিক্ত বিলাসিতা এবং কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন (Conspicuous Consumption) বা লোক দেখানো ভোগবাদ সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রকট করে তুলেছিল। একদিকে খলিফার প্রাসাদে যখন সোনা ও রত্নখচিত পাত্রে খাবার পরিবেশন করা হতো, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বা ‘আল-আম্মা’রা উচ্চ কর বা ট্যাক্সেশন (Taxation)-এর চাপে পিষ্ট হতো। কবি আবু নুওয়াসের কবিতায় মদের পেয়ালা আর প্রেমের উচ্ছ্বাস যেমন আছে, তেমনি আল-জাহিযের বুক অফ মাইজার্স-এ সমাজের কৃপণতা ও ভণ্ডামির ব্যঙ্গাত্মক চিত্রও ফুটে উঠেছে। এই বিলাসিতাই কালক্রমে আব্বাসীয়দের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ ভোগবাদী শাসকগোষ্ঠী ক্রমশ প্রজা ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
সাহিত্য এবং বিনোদন: মদের পেয়ালা, কবিতার ছন্দ এবং আদব সংস্কৃতির বিকাশ
আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস কেবল মসজিদ, মিনার আর বায়তুল হিকমাহর গম্ভীর জ্ঞানচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এর সমান্তরালে বাগদাদের বুকে প্রবাহিত ছিল এক উচ্ছল, প্রাণবন্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া বিনোদনের ফল্গুধারা। বাগদাদ ছিল একাধারে ধ্রুপদী জ্ঞান ও ধর্মীয় অনুশাসনের কেন্দ্র, আবার অন্যদিকে এটি ছিল সুর, সুরা এবং কবিতার এক মায়াবী জগত। এই দ্বান্দ্বিকতা বা ডুয়ালিজম (Dualism) আব্বাসীয় সংস্কৃতির প্রাণভ্রমরা ছিল। দিনের বেলায় যে বাগদাদ ছিল ফকিহ এবং মুহাদ্দিসদের কঠোর অনুশাসনে কম্পমান, রাতের বেলায় সেই বাগদাদই ডুবে যেত টাইগ্রিসের তীরে অভিজাতদের প্রাসাদে আয়োজিত জমকালো সব মজলিসে। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সাহিত্য এবং বিনোদন কেবল সময় কাটানোর মাধ্যম ছিল না, এটি ছিল সামাজিক মর্যাদা বা সোশ্যাল স্ট্যাটাস (Social Status) এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রধান হাতিয়ার। উমাইয়া যুগের মরু-সংস্কৃতি বা বেদুইন ঐতিহ্য থেকে সরে এসে আব্বাসীয়রা গড়ে তুলেছিল এক পরিশীলিত নগর-সংস্কৃতি বা আরবান কালচার (Urban Culture)। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ছাপ পড়েছিল আরবি কবিতা এবং গদ্য সাহিত্যে। প্রাক-ইসলামী যুগের কাসিদা, যা শুরু হতো ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রেমিকার তাঁবুর স্মৃতিচারণ বা ‘নাসিব‘ দিয়ে, আব্বাসীয় যুগে এসে তা রূপ নিল রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা, বাগানের সৌন্দর্য এবং মদের আড্ডার বর্ণনায়। এই নতুন ধারার সাহিত্যের নাম দেওয়া হলো ‘বদি‘ বা নতুন শৈলী (The New Style), যার মাধ্যমে আরবি সাহিত্য তার সনাতন খোলস ছেড়ে এক আধুনিক এবং কসমোপলিটান (Cosmopolitan) রূপ ধারণ করল। এই সাহিত্যিক বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন একদল কবি, যাদের বলা হতো ‘মুহদাসুন’ বা আধুনিকরা, আর তাদের মধ্যমণি ছিলেন আবু নুওয়াস।
কবিতার নতুন দিগন্ত: আবু নুওয়াস এবং খামরিয়াত
আব্বাসীয় কবিতার আকাশে আবু নুওয়াস (Abu Nuwas) ছিলেন এক ধুমকেতু, যার আলো একই সাথে চোখ ধাঁধিয়ে দিত এবং পুড়িয়ে দিত। তার আসল নাম ছিল আল-হাসান ইবনে হানি আল-হাকামি। মা ছিলেন পারসিক এবং বাবা আরব, এই মিশ্র রক্ত তার মানসজগতে এক ধরনের বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছিল। তিনি ছিলেন খলিফা হারুনুর রশীদের এবং পরে তার পুত্র আল-আমিনের সমসাময়িক ও পানসঙ্গী বা ‘নাদিম’। আবু নুওয়াস আরবি কবিতাকে মরুভূমির রুক্ষতা থেকে বের করে এনে বাগদাদের বিলাসিতা এবং হেডোনিজম (Hedonism) বা সুখবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান। তার কবিতায় উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজের অবদমিত বাসনা, যা ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করত না। তিনি ছিলেন লিবারটিনিজম (Libertinism) বা স্বেচ্ছাচারী জীবনদর্শনের প্রবক্তা। তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল মদ বা ‘খামর’, নারী এবং তরুণ বালকদের প্রতি প্রেম বা পেডেরাস্টি (Pederasty)। এই বিষয়গুলো তিনি এমন এক জাদুকরী ভাষায় প্রকাশ করতেন যে, তার কঠোর সমালোচকরাও তার ভাষাশৈলীর প্রশংসা করতে বাধ্য হতো। তিনি ‘খামরিয়াত’ (Khamriyyat) বা মদের কবিতাকে একটি স্বতন্ত্র ও উচ্চমার্গীয় সাহিত্যিক জঁরা বা লিটারোরি জঁরা (Literary Genre) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে মদের বর্ণনা ছিল কাসিদার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, কিন্তু আবু নুওয়াস মদকে করলেন কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি মদের রঙ, গন্ধ, পাত্রে ঢালার শব্দ এবং পান করার পর মনের অবস্থার যে নিখুঁত ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বর্ণনা দিতেন, তা ছিল অভূতপূর্ব। তিনি লিখতেন, “মদ হলো তরল সূর্য, যা অন্ধকার আত্মাকে আলোকিত করে।”
আবু নুওয়াস কেবল মদ ও প্রেমের কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের বিদ্রোহী বা আইকনোক্লাস্ট (Iconoclast)। তিনি প্রথাগত আরবি কবিতার কঠোর নিয়মগুলোকে ব্যঙ্গ করতেন। প্রাক-ইসলামী কবিরা যেখানে কবিতার শুরুতে বেদুইনদের মতো পরিত্যক্ত ক্যাম্পের জন্য কান্না করতেন, আবু নুওয়াস সেখানে বলতেন, “ওই শুকনো বালুর জন্য কেঁদো না, তার চেয়ে এসো আমরা সরাইখানায় বসে জীবন উপভোগ করি।” তার এই ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি বা স্যাটায়ার (Satire) ছিল রক্ষণশীল সমাজের গালে চপেটাঘাতের মতো। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে কৌতুক করতে ভয় পেতেন না, যা তাকে বহুবার বিপদে ফেলেছিল এবং কারাগারেও যেতে হয়েছিল। তার বিখ্যাত উক্তি, “আমাকে লুকিয়ে মদ দিও না, প্রকাশ্যে দাও, কারণ লুকিয়ে খাওয়াটা পাপের চেয়েও নিচু,” এটি কেবল মদ্যপানের আহ্বান ছিল না; এটি ছিল সমাজের ভণ্ডামি বা হিপোক্রেসি (Hypocrisy)-র বিরুদ্ধে এক দার্শনিক প্রতিবাদ। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, গোপনে পাপ করে বাইরে সাধু সাজার চেয়ে প্রকাশ্যে নিজের দোষ স্বীকার করা অনেক বেশি সাহসিকতার। তার কবিতায় ‘মুজুন’ বা ফ্রিভোলিটি (Frivolity) এবং অশ্লীলতার যে প্রকাশ দেখা যায়, তা ছিল মূলত তৎকালীন বাগদাদের অভিজাত শ্রেণির গোপন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি বা সোশ্যাল মিরর (Social Mirror)। খলিফা আল-আমিন, যিনি নিজেও আমোদপ্রমোদ পছন্দ করতেন, তিনি ছিলেন আবু নুওয়াসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তবে আবু নুওয়াসের জীবনের শেষ দিকে অনুশোচনা বা ‘জুহদিয়াত’ (Zuhdiyyat) জাতীয় কবিতাও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি তার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তার জীবন ও কর্ম আব্বাসীয় সমাজের সেই জটিল মনস্তত্ত্বকে ধারণ করে, যেখানে পাপবোধ এবং পাপের প্রতি অদম্য আকর্ষণ একই সাথে বিরাজ করত (Kennedy, 2005)।
গদ্য সাহিত্যের জাদুকর: আল-জাহিয এবং আদব সংস্কৃতি
কবিতার পাশাপাশি আব্বাসীয় যুগে গদ্য সাহিত্যে এক বিশাল বিপ্লব ঘটে, যাকে বলা হয় আদব (Adab) সাহিত্যের বিকাশ। ‘আদব’ শব্দটির অর্থ কেবল শিষ্টাচার নয়; এটি ছিল এক ধরনের এনসাইক্লোপেডিক জ্ঞান, যার মধ্যে ব্যাকরণ, ইতিহাস, কবিতা, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং নৈতিকতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। একজন আদর্শ আমলা বা ‘কাতিব’-এর জন্য এই আদব জ্ঞান ছিল অপরিহার্য। এই ধারার অবিসংবাদিত সম্রাট ছিলেন আল-জাহিয (Al-Jahiz)। বাসরায় জন্মগ্রহণকারী এই কৃষ্ণাঙ্গ লেখক ছিলেন একজন প্রকৃত পলিম্যাথ (Polymath)। তার পুরো নাম ছিল আবু উসমান আমর ইবনে বাহর। তার চোখগুলো একটু বেশি বড় বা বিস্ফারিত ছিল বলে তাকে ‘আল-জাহিয’ বা ‘বিস্ফারিত নেত্র’ বলা হতো। তিনি ছিলেন মুতাজিলা মতবাদের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং তার লেখায় র্যাশনালিজম (Rationalism) বা যুক্তিবাদের প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাহিত্যের কাজ কেবল বিনোদন দেওয়া নয়, বরং মানুষকে চিন্তা করতে শেখানো। তার গদ্যশৈলী ছিল অনন্য; তিনি গুরুগম্ভীর বিষয়ের সাথে লঘু কৌতুক এবং ব্যঙ্গ মিশিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যে পাঠক কখনোই একঘেয়েমি অনুভব করত না। তিনি বলতেন, “সবচেয়ে ভালো সাহিত্য হলো তাই, যা গম্ভীরতাকে কৌতুক এবং কৌতুককে গম্ভীরতার সাথে মিশিয়ে দেয়।”
আল-জাহিযের রচনাগুলোর মধ্যে কিতাব আল-বুখালা বা বুক অফ মাইজার্স (Book of Misers) হলো সামাজিক ব্যঙ্গরচনার এক অনবদ্য দলিল। এই বইয়ে তিনি তৎকালীন সমাজের কৃপণ ব্যক্তিদের আচরণের অত্যন্ত হাস্যরসাত্মক কিন্তু বাস্তবসম্মত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ অর্থের লোভে নিজের এবং অন্যের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। এই বইটির মাধ্যমে তিনি কেবল কৃপণতাকে উপহাস করেননি, বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব বা হিউম্যান সাইকোলজি (Human Psychology) এবং সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তার আরেকটি কালজয়ী সৃষ্টি হলো কিতাব আল-হায়াওয়ান বা বুক অফ অ্যানিমেলস (Book of Animals)। সাত খণ্ডের এই বিশাল গ্রন্থে তিনি ৩৫০টিরও বেশি প্রাণীর বর্ণনা দিয়েছেন। তবে এটি কোনো সাধারণ প্রাণিবিদ্যার বই নয়। এখানে তিনি প্রাণীদের আচরণের পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান এবং দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, এই বইয়ে তিনি এমন কিছু ধারণা ব্যক্ত করেছেন যা চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের বা ইভোলিউশন থিওরি (Evolution Theory)-র পূর্বসূরি হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ‘স্ট্রাগল ফর এক্সিস্টেন্স’ বা অস্তিত্বের সংগ্রাম, খাদ্য শৃঙ্খল এবং পরিবেশের প্রভাবে প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন বা এনভায়রনমেন্টাল ডিটারমিনিজম (Environmental Determinism) নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “প্রাণীরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে; খাদ্যের জন্য এবং প্রজননের জন্য।” ডারউইনের হাজার বছর আগে একজন মুসলিম তাত্ত্বিক যে এভাবে প্রকৃতির নিয়ম নিয়ে ভেবেছিলেন, তা আল-জাহিযকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে (Pellat, 1969)।
মজলিস সংস্কৃতি এবং সঙ্গীতের ভুবন
আব্বাসীয় বিনোদন জগতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘মজলিস’ বা সাহিত্য ও সঙ্গীতের আসর। খলিফা, উজির এবং ধনী বণিকদের প্রাসাদে নিয়মিত এই মজলিস বসত। এখানে কবি, গায়ক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা একত্রিত হতেন। এই আসরগুলোতে যেমন উচ্চমার্গীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক হতো, তেমনি চলত গান-বাজনা এবং মদ্যপান। মজলিসের প্রাণ ছিল ‘নাদিম’ বা পানসঙ্গীরা। একজন ভালো নাদিমকে হতে হতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী; তাকে জানতে হতো কবিতা, গান, ইতিহাস, এবং কৌতুক, যাতে সে তার প্রভুকে সর্বদা বিনোদিত রাখতে পারে। আব্বাসীয় সঙ্গীত জগত ছিল পারসিক এবং আরব সুরের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ বা ফিউশন (Fusion)। এই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ইশাক আল-মাওসিলি (Ishaq al-Mawsili) এবং ইব্রাহিম আল-মাওসিলি। তারা শাস্ত্রীয় আরব সঙ্গীতের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জিরয়াব (Ziryab), যিনি ছিলেন ইশাকের ছাত্র। কিংবদন্তি আছে যে, জিরয়াবের প্রতিভা দেখে ইশাক ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে বাগদাদ ছাড়তে বাধ্য করেন। জিরয়াব পরে স্পেনের কর্ডোভায় গিয়ে আন্দালুসীয় সঙ্গীতের জন্ম দেন এবং উদ বা আরবীয় লিউট (Lute)-এ পঞ্চম তারটি সংযোজন করেন।
মজলিসের আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ‘কিয়ান’ বা গায়িকা দাসীরা। এই দাসীরা ছিল অত্যন্ত রূপসী এবং বুদ্ধিমতী। তাদের ছোটবেলা থেকে কবিতা, গান এবং আদব কায়দা শেখানো হতো। তারা পুরুষদের সাথে সমান তালে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কে অংশ নিতে পারত। তাদের প্রেম এবং বিরহের গান মজলিসের পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে রাখত। আবুল ফারাজ আল-ইস্পাহানির লেখা কিতাব আল-আঘানি বা বুক অফ সংস (Book of Songs) গ্রন্থে এই সময়ের সঙ্গীত, গায়ক-গায়িকা এবং কবিদের জীবনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এটি কেবল গানের বই নয়, এটি আব্বাসীয় সামাজিক ইতিহাসের এক বিশাল আকর গ্রন্থ। এই বই থেকে জানা যায় যে, সঙ্গীত এবং কবিতা ছিল আব্বাসীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে মিশে থাকা এক অপরিহার্য উপাদান। খলিফা আল-মাহদি থেকে শুরু করে আল-ওয়াসিক পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ বা সঙ্গীতের সমঝদার।
গল্পবলা এবং আরব্য রজনীর আখ্যান
উচ্চমার্গীয় সাহিত্য বা হাই লিটারেচার (High Literature)-এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বিনোদনের জন্য ছিল গল্প বলার ঐতিহ্য। বাগদাদের রাস্তায়, সরাইখানায় এবং বাজারের কোণে কিসসা-কথকরা জড়ো হওয়া মানুষদের শোনাত জীন-পরী, জাদুকর এবং বীরদের গল্প। এই মৌখিক ঐতিহ্যের বা ওরাল ট্র্যাডিশন (Oral Tradition)-এরই লিখিত রূপ হলো বিশ্ববিখ্যাত আরব্য রজনী বা দ্য থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস (The Thousand and One Nights/Alf Layla wa Layla)। যদিও এই গল্প সংকলনটি সরাসরি আব্বাসীয় আমলের সৃষ্টি নয় এবং এর মূল উৎস ভারতীয় ও পারসিক (হাজার আফসানা), তবুও এর বর্তমান রূপটি আব্বাসীয় বাগদাদের পটভূমিতেই গড়ে উঠেছে। এই গল্পগুলোতে খলিফা হারুনুর রশীদ, তার উজির জাফর বার্মাকি এবং জল্লাদ মাসরুরকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখা যায়, যারা ছদ্মবেশে রাতের বাগদাদে ঘুরে বেড়ান। যদিও ঐতিহাসিক হারুন এবং গল্পের হারুনের মধ্যে অনেক পার্থক্য, তবুও আরব্য রজনী আব্বাসীয় সমাজের একটি কাল্পনিক কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য চিত্র তুলে ধরে। এখানে আমরা দেখি বাগদাদের জাঁকজমক, বণিকদের সমুদ্রযাত্রা, জাদুকরী প্রদীপ এবং ভাগ্যের উত্থান-পতন। এই সাহিত্যকে তৎকালীন আদব লেখকরা খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না, একে তারা ‘খুরাফাত’ বা আজগুবি গল্প বলতেন। কিন্তু সময়ের বিচারে এই লোকসাহিত্যই বা ফোকলোর (Folklore) আব্বাসীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করেছে। কালিলা ওয়া দিমনা (Kalila wa Dimna) ছিল আরেকটি জনপ্রিয় গল্পের বই, যা ইবনে আল-মুকাফফা পাহলভি থেকে আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। এটি ছিল মূলত পশুপাখির গল্পের ছলে লেখা রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশিকা, যাকে মিরর ফর প্রিন্সেস (Mirror for Princes) জঁরা বলা হয়। এখানে শিয়ালের চরিত্রের মাধ্যমে রাজদরবারের ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশল শেখানো হতো।
উপসংহার: সংস্কৃতির স্বর্ণালী অধ্যায়
আব্বাসীয় সাহিত্য ও বিনোদন জগত ছিল এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে বিলাসিতা, মেধা এবং সৃজনশীলতার এক অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছিল। আবু নুওয়াসের বিদ্রোহী কবিতা, আল-জাহিযের যুক্তিবাদী গদ্য, এবং মজলিসের সুরলহরী – সব মিলিয়ে বাগদাদ হয়ে উঠেছিল সংস্কৃতির এক গলনপাত্র বা মেল্টিং পট (Melting Pot)। মদের পেয়ালা আর কবিতার ছন্দে আব্বাসীয়রা জীবনকে উদযাপন করেছিল। তারা দেখিয়েছিল যে, একটি সভ্যতা কেবল যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে মহান হয় না, মহান হয় তার সাহিত্য, সঙ্গীত এবং জীবনবোধের গভীরতার মাধ্যমে। তাদের এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রেনেসাঁস এবং আধুনিক আরব সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আব্বাসীয়দের রাজনৈতিক ক্ষমতা আজ লুপ্ত, কিন্তু আবু নুওয়াসের কবিতার পংক্তি বা আল-জাহিযের হাস্যরস আজও সাহিত্যের পাঠকদের মনে সেই সোনালী অতীতের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।
আব্বাসীয় খিলাফত ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য: চিরশত্রুতা, সীমান্ত সংঘাত এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়
মধ্যযুগের ভূ-রাজনীতিতে আব্বাসীয় খিলাফত এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের (পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য) সম্পর্ক ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী, নাটকীয় এবং জটিল আখ্যান। প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে (৭৫০–১২৫৮ খ্রি.) এই দুই পরাশক্তি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্তে একে অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। তাদের এই সম্পর্ককে কেবল নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস বললে ভুল হবে; এটি ছিল ‘শীতল যুদ্ধ’ (Cold War), ‘সীমান্ত সংঘাত’ (Border Skirmishes), এবং মাঝে মাঝে ‘সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক আদান-প্রদান’-এর এক অদ্ভুত মিশ্রণ। আব্বাসীয়রা বাইজান্টাইনদের ডাকত ‘আল-রুম’ (The Romans) নামে এবং তাদের প্রধান মতাদর্শগত ও সামরিক শত্রু মনে করত। অন্যদিকে, কনস্টান্টিনোপলের সম্রাটরা আব্বাসীয়দের দেখত ‘বর্বর ইসমাইলি’ বা ‘দখলদার’ হিসেবে, যারা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো – সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং মিশর – কেড়ে নিয়েছে। এই দুই সাম্রাজ্যের সংঘাত কেবল ভূখণ্ড দখলের জন্য ছিল না; এটি ছিল দুটি ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির বা ওয়ার্ল্ডভিউ (Worldview)-এর সংঘাত। আব্বাসীয় খিলাফত যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করছিল, তখন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যও তাদের মেসিডোনিয়ান রেনেসাঁসের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি পুনর্গঠন করছিল। ফলে আনাতোলিয়া এবং জাজিরা অঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই দুই শক্তির ক্ষমতার পরীক্ষাগার।
বার্ষিক গ্রীষ্মকালীন অভিযান (The Summer Raids): জিহাদ ও লুটের অর্থনীতি
আব্বাসীয়-বাইজান্টাইন সম্পর্কের সবচেয়ে নিয়মিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য ছিল বার্ষিক সামরিক অভিযান, যা আরবি পরিভাষায় ‘সাইফা’ (Sa’ifa) বা গ্রীষ্মকালীন অভিযান এবং শীতকালীন অভিযান বা ‘শাতীয়া’ (Shatiya) নামে পরিচিত। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে আব্বাসীয় সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক গাজী এবং সীমান্ত যোদ্ধারা আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) বাইজান্টাইন সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আক্রমণ চালাত। এই অভিযানগুলো আব্বাসীয় রাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর পেছনে তিনটি প্রধান কৌশলগত ও মতাদর্শগত উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, ধর্মীয়ভাবে ‘জিহাদ’ (Jihad) অব্যাহত রাখা এবং মুসলিম উম্মাহর কাছে খলিফার ‘মুজাহিদ’ বা ধর্মের রক্ষক ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখা। আব্বাসীয় খলিফারা নিজেদের উমাইয়াদের চেয়েও বেশি ধর্মপ্রাণ প্রমাণ করতে চাইতেন, তাই বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধগুলো ছিল তাদের বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) অর্জনের হাতিয়ার। দ্বিতীয়ত, এই অভিযানগুলোর একটি বড় অর্থনৈতিক দিক ছিল – প্রচুর পরিমাণে গণিমতের মাল, বিশেষ করে গবাদি পশু, মূল্যবান ধাতু এবং দাস সংগ্রহ করা। আনাতোলিয়ার উর্বর ভূমি থেকে লুট করা সম্পদ আব্বাসীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল। তৃতীয়ত, এবং কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই আক্রমণগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বাইজান্টাইনদের সবসময় চাপে রাখা বা কনস্ট্যান্ট প্রেশার (Constant Pressure), যাতে তারা সিরিয়া বা ইরাকের মতো মূল মুসলিম ভূখণ্ডে বড় কোনো আক্রমণ চালানোর সুযোগ না পায়।
দুই সাম্রাজ্যের মাঝখানে একটি বিস্তৃত এবং সামরিকায়িত বাফার জোন গড়ে উঠেছিল, যাকে আরবিতে বলা হতো ‘আল-সুগুর’ (Al-Thughur) বা ‘ছিদ্রপথ’। এই অঞ্চলটি বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর সিরিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তারসাস, মালাতিয়া (মেলিটিন), আদানা এবং মাসিসা ছিল এই অঞ্চলের প্রধান দুর্গ-শহর বা গ্যারিসন টাউন। এই শহরগুলোতে আব্বাসীয়রা এক বিশেষ ধরনের যোদ্ধা শ্রেণি বা ‘গাজী’ (Ghazi)-দের বসতি স্থাপন করেছিল, যাদের জীবনই ছিল যুদ্ধের জন্য উৎসর্গীকৃত। তারসাস ছিল এই সীমান্ত যুদ্ধের নার্ভ সেন্টার। এখান থেকেই প্রতি বছর হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক আনাতোলিয়ার গভীরে অতর্কিত হামলা বা রেইড (Raid) চালাত। বাইজান্টাইনরাও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তাদের সীমান্তে ‘আকরিতাই’ (Akritai) নামক সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করেছিল। এই দুই বাহিনীর মধ্যকার সংঘাত লোকগাঁথা এবং মহাকাব্যের জন্ম দেয়, যেমন বাইজান্টাইন মহাকাব্য ডিজেনিস আকৃ্তাস (Digenis Akritas) এবং আরব মহাকাব্য সিরাত দেলহেমা (Sirat Delhemma), যেখানে সীমান্ত যুদ্ধের বীরত্বগাথা বর্ণিত হয়েছে।
হারুনুর রশীদ ও নাইসেফোরাস: ইতিহাসের বিখ্যাত দ্বৈরথ
আব্বাসীয়-বাইজান্টাইন সংঘাতের সবচেয়ে নাটকীয় এবং স্মরণীয় মুহূর্তটি ঘটেছিল ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে, আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগের খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে। ৮০২ সালে বাইজান্টাইন সম্রাজ্ঞী আইরিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসনে বসেন তার অর্থমন্ত্রী প্রথম নাইসেফোরাস (Nicephorus I)। আইরিন আব্বাসীয়দের সাথে শান্তি বজায় রাখার জন্য নিয়মিত কর বা ট্রিবিউট দিতেন, কিন্তু নাইসেফোরাস ছিলেন একজন কঠোর এবং যুদ্ধবাজ শাসক। ক্ষমতায় এসেই তিনি আব্বাসীয়দের কর দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং খলিফা হারুনুর রশীদের কাছে এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “সম্রাজ্ঞী আইরিন তোমাকে কেল্লার চালের (Rook) মতো মনে করতেন এবং নিজেকে মনে করতেন দাবার বোড়ে (Pawn)। তিনি তোমাকে অনেক সম্পদ দিয়েছেন, যা আসলে তোমারই তাকে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন সেই দুর্বলতা কেটে গেছে। অতএব, তুমি আইরিনের দেওয়া সব সম্পদ ফেরত দাও, নতুবা তলোয়ারই আমাদের বিবাদ মেটাবে।” নাইসেফোরাস হারুনকে ‘দাবার ঘুঁটি’র সাথে তুলনা করে চরম অপমান করেছিলেন।
হারুনুর রশীদ এই চিঠি পড়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। তিনি চিঠির উল্টো পিঠেই তার বিখ্যাত জবাব লিখেছিলেন, যা আজও ইতিহাসের পাতায় সাহসিকতা ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে আছে: “পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। আমিরুল মুমিনিন হারুনুর রশীদের পক্ষ থেকে রোমান কুকুর নাইসেফোরাসের প্রতি। আমি তোমার চিঠি পড়েছি। হে কাফেরের পুত্র! এর জবাব তুমি কানে শুনবে না, বরং নিজের চোখে দেখবে।” এরপর হারুন কালবিলম্ব না করে এক বিশাল বাহিনী (কথিত আছে ১,৩৫,০০০ সৈন্য) নিয়ে আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করেন। তিনি বাইজান্টাইনদের একের পর এক দুর্গ দখল করতে থাকেন এবং আনাতোলিয়ার হেরাক্লিয়া (Heraclea) শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। আব্বাসীয় বাহিনীর এই বিধ্বংসী আক্রমণের মুখে সম্রাট নাইসেফোরাস অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন যে তার দম্ভের মূল্য অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত তিনি অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হন। তাকে কেবল বকেয়া করই দিতে হয়নি, বরং নিজের এবং তার পুত্র স্ট্যুরাসিয়াসের মাথার জিজিয়া বা পোল ট্যাক্স (Poll Tax) হিসেবে বিশেষ অর্থদণ্ড দিতে হয়েছিল। এই ঘটনা আব্বাসীয়দের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বা মিলিটারি সুপ্রিমেসি (Military Supremacy)-র এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এবং হারুনুর রশীদকে মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
আল-মামুন ও আল-মু’তাসিম: আমোরিয়াম বিজয় এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক যুদ্ধ
খলিফা আল-মামুন (৮১৩–৮৩৩ খ্রি.) বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালালেও, তার যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা ভিন্ন এবং অনন্য। তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু শাসক। অনেক সময় তিনি বাইজান্টাইনদের পরাজিত করে সোনাদানার বদলে সন্ধির শর্ত হিসেবে প্রাচীন গ্রিক পাণ্ডুলিপি বা ম্যানুস্ক্রিপ্ট (Manuscript) দাবি করতেন। তিনি বাইজান্টাইন সম্রাট থিওফিলাসের কাছে চিঠি লিখে বিখ্যাত গণিতবিদ লিও দ্য ম্যাথমেটিশিয়ানকে বাগদাদের বায়তুল হিকমাহ (House of Wisdom)-তে পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন, যা বাইজান্টাইনরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এটি ছিল এক ধরনের ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক যুদ্ধ’ (Epistemological War), যেখানে আব্বাসীয়রা বাইজান্টাইনদের তাদের নিজেদের (গ্রিক) জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছিল। তবে মামুনের ভাই এবং পরবর্তী খলিফা আল-মু’তাসিমের সময় ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয়-বাইজান্টাইন সংঘাত নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। বাইজান্টাইন সম্রাট থিওফিলাস আব্বাসীয় সীমান্তের জাপেত্রা (Zapetra) শহর আক্রমণ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালান এবং মুসলিম নারীদের বন্দি করেন। কথিত আছে, এক বন্দি নারী চিৎকার করে বলেছিলেন, “ওয়া মু’তাসিমাহ!” (হায় মু’তাসিম, কোথায় তুমি!)।
এই খবর শুনে খলিফা আল-মু’তাসিম প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। তিনি জ্যোতিষীদের নিষেধ উপেক্ষা করে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আনাতোলিয়ার দিকে অগ্রসর হন। তার লক্ষ্য ছিল কোনো সাধারণ শহর নয়, বরং বাইজান্টাইন সম্রাটদের জন্মস্থান এবং আনাতোলিয়ার অন্যতম সুরক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ শহর আমোরিয়াম (Amorium)। মু’তাসিম তার ঢালে ‘আমোরিয়াম’ শব্দটি খোদাই করে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৫৫ দিন অবরোধের পর, আব্বাসীয়রা আমোরিয়ামের প্রাচীর ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে এবং শহরটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। আমোরিয়ামের পতন ছিল বাইজান্টাইনদের জন্য এক বিশাল মানসিক ধাক্কা এবং অপূরণীয় ক্ষতি। আব্বাসীয় কবি আবু তাম্মাম এই বিজয় নিয়ে তার বিখ্যাত কাসিদা রচনা করেন, যেখানে তিনি বলেন – “তলোয়ার বইয়ের (জ্যোতিষীদের গণনা) চেয়েও সত্যবাদী; তার ধারালো কিনারে লেখা থাকে বিজয় ও পরাজয়ের আসল গল্প।” এই বিজয় আব্বাসীয় খিলাফতের সামরিক শক্তির শেষ বড় প্রদর্শনী ছিল, কারণ এরপর থেকেই খিলাফতের অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়।
শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন (Shift of Balance): বাইজান্টাইন পুনরুত্থান
নবম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত আব্বাসীয়রা বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বা অফেন্সিভ (Offensive) অবস্থানে ছিল। কিন্তু দশম শতাব্দীতে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। আব্বাসীয় খিলাফত তখন সামারার নৈরাজ্য এবং বুয়াইদদের উত্থানের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙে পড়ায় সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় রাজবংশ, বিশেষ করে মসুলের হামদানিদদের ওপর বর্তায়। অন্যদিকে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য মেসিডোনিয়ান রাজবংশের অধীনে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সম্রাট নাইসেফোরাস ফোকাস (Nicephorus Phocas) এবং জন জিমিসেস (John Tzimiskes)-এর নেতৃত্বে বাইজান্টাইনরা এক শতাব্দীর রক্ষণাত্মক অবস্থান ছেড়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করে। ৯৬২ সালে নাইসেফোরাস ফোকাস এক ঝটিকা অভিযানে আলেপ্পো দখল করেন এবং হামদানিদ আমির সাইফ আল-দৌলার প্রাসাদ লুণ্ঠন করেন। তিনি নিজেকে ‘সাদা মৃত্যু’ বা ‘হোয়াইট ডেথ’ (White Death) হিসেবে পরিচয় দিতেন। বাইজান্টাইন বাহিনী এরপর আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে এন্টিওক পুনরুদ্ধার করে এবং এমনকি জেরুজালেম ও বাগদাদ পুনরুদ্ধারের হুমকি দেয়। আব্বাসীয় খলিফারা তখন এতটাই দুর্বল ছিলেন যে, তারা এই আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হন এবং বাগদাদের মসজিদে কান্নাকাটি করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। এই সময়টিকে বাইজান্টাইন ইতিহাসের ‘রিকনকোয়েস্টা’ (Reconquista) বা পুনর্দখল বলা যেতে পারে।
কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়: যুদ্ধের অবসরে
যুদ্ধ ও সংঘাত সত্ত্বেও দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল গভীর এবং বহুমুখী। বাগদাদ এবং কনস্টান্টিনোপলে নিয়মিত রাষ্ট্রদূত বিনিময় হতো। ৭৭৫ সালে খলিফা আল-মনসুরের দরবারে যখন বাইজান্টাইন দূতরা আসে, তখন তাদের মুগ্ধ করার জন্য বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ এবং জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদের প্রদর্শনী করা হয়। আবার ৯১৭ সালে খলিফা আল-মুকতাদির বাইজান্টাইন দূতদের সম্মানে এক বিশাল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যেখানে হাতি, জিরাফ এবং যান্ত্রিক বা অটোমেটেড (Automated) গাছ প্রদর্শন করা হয়। এই ‘ডিপ্লোম্যাসি অফ ডিসপ্লে’ বা প্রদর্শনীর কূটনীতি (Diplomacy of Display)-র উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে মানসিকভাবে পরাভূত করা।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দুই সাম্রাজ্য একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। খলিফা আল-মামুনের সময় থেকে শুরু হওয়া অনুবাদ আন্দোলনের মাধ্যমে গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শন আরব বিশ্বে প্রবেশ করে। আবার বাগদাদ থেকে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি, উন্নত সেচ ব্যবস্থা এবং রসায়ন ও চিকিৎসাবিদ্যার নতুন আবিষ্কারগুলো বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইজান্টাইন স্থাপত্যশৈলী, বিশেষ করে গম্বুজ এবং মোজাইকের ব্যবহার, আব্বাসীয় প্রাসাদ নির্মাণে প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি বাইজান্টাইন সম্রাট থিওফিলাস বাগদাদের প্রাসাদের অনুকরণে কনস্টান্টিনোপলে একটি প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন, যা ‘ব্রাইয়াস’ (Bryas) নামে পরিচিত। এটি প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক শত্রুতা থাকলেও একে অপরের সংস্কৃতির প্রতি তাদের এক ধরনের গোপন মুগ্ধতা বা ফ্যাসিনেশন (Fascination) ছিল।
মহাকালের রায়
আব্বাসীয় ও বাইজান্টাইনদের সম্পর্ক ছিল ‘চিরস্থায়ী শত্রুতা এবং অনিবার্য সহাবস্থান’-এর এক দীর্ঘ গল্প। তারা একে অপরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, সীমান্ত রেখা বারবার বদলেছে, শহর ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ কাউকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। তাদের এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত মধ্যপ্রাচ্য ও আনাতোলিয়ার সীমানা নির্ধারণে এবং ইসলামি ও খ্রিস্টান সভ্যতার মিথস্ক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১০৭১ সালে মানজিকার্টের যুদ্ধে (Battle of Manzikert) সেলজুক তুর্কিদের হাতে বাইজান্টাইন সম্রাট রোমানোস ডায়োজেনিসের চূড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে এই সমীকরণে আব্বাসীয়দের প্রত্যক্ষ ভূমিকার অবসান ঘটে এবং আনাতোলিয়ার দরজা তুর্কিদের জন্য খুলে যায়। আব্বাসীয়রা ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেও, বাইজান্টাইনদের সাথে তাদের এই পাঁচশো বছরের দ্বৈরথ ইতিহাসের পাতায় এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে, যেখানে তলোয়ারের ঝনঝনানির ফাঁকে ফাঁকে জ্ঞান ও সংস্কৃতির আলোও ঠিকরে বেরিয়েছে।
অবনতির শুরু: ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ এবং তুর্কি প্রহরীদের উত্থান
ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ: চতুর্থ ফিতনা এবং আব্বাসীয় ঐক্যের ফাটল
৮০৯ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খিলাফতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক হারুনুর রশীদের মৃত্যু কেবল একটি যুগের সমাপ্তিই ছিল না, এটি ছিল এক আসন্ন প্রলয়ের পূর্বাভাস। হারুন তার জীবদ্দশায় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে যে জটিল সমীকরণ তৈরি করে গিয়েছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত তার বংশধরদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৮০২ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় হজ পালনের সময় তিনি তার দুই পুত্র – মুহাম্মদ আল-আমিন এবং আব্দুল্লাহ আল-মামুন – এর মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন, যা ‘মক্কার প্রটোকল’ (The Meccan Protocols) নামে পরিচিত। কাবা ঘরের পবিত্র দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া এই দলিলে উল্লেখ ছিল যে, আরব আভিজাত্যের প্রতীক আল-আমিন বাগদাদের খলিফা হবেন, আর পারসিক মায়ের সন্তান আল-মামুন খোরাসানসহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা হবেন এবং আমিনের পর খলিফা হবেন। হারুন ভেবেছিলেন এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্রাজ্যের দুই প্রধান শক্তি – আরব অভিজাততন্ত্র বা ‘আবনা আল-দাওলা’ (Abna al-Dawla) এবং উদীয়মান পারসিক আমলাতন্ত্র – এর মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (Balance of Power) বজায় থাকবে। কিন্তু তিনি ক্ষমতার রাজনীতির এক চিরন্তন সত্য ভুলে গিয়েছিলেন – রাজতন্ত্রে রক্তের সম্পর্ক গৌণ, ক্ষমতাই মুখ্য।
হারুনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই দুই ভাইয়ের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ উপ্ত হয়। বাগদাদের দরবারে আমিনের উজির ফজল ইবনে রাবি এবং অন্যান্য আরব অভিজাতরা আমিনকে প্ররোচিত করেন মামুনের ক্ষমতা খর্ব করতে। তাদের ভয় ছিল, মামুন ক্ষমতায় এলে পারসিকদের প্রভাব বেড়ে যাবে এবং আরবদের গুরুত্ব কমবে। এই প্ররোচনায় আমিন মক্কার প্রটোকল লঙ্ঘন করেন এবং মামুনের নাম উত্তরাধিকার থেকে বাদ দিয়ে নিজের শিশুপুত্র মুসাকে ভবিষ্যৎ খলিফা ঘোষণা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মামুন নিজেকে খোরাসানের স্বাধীন ইমাম ঘোষণা করেন। এর ফলে যে বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তা ইসলামের ইতিহাসে চতুর্থ ফিতনা (Fourth Fitna) নামে কুখ্যাত। এটি কেবল দুই ভাইয়ের সিংহাসন দখলের লড়াই ছিল না; এটি ছিল আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিদ্যমান দুটি ভিন্ন মতাদর্শ, সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তার সংঘাত।
বাগদাদ অবরোধ: শান্তির নগরীর দহন (৮১২–৮১৩ খ্রি.)
চতুর্থ ফিতনার সবচেয়ে ভয়াবহ এবং ট্র্যাজিক অধ্যায় ছিল বাগদাদ অবরোধ। মামুনের প্রধান সেনাপতি তাহির ইবনে আল-হুসাইন খোরাসানি সৈন্যদের নিয়ে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হন এবং শহরটি অবরোধ করেন। আল-মনসুরের স্বপ্নের নগরী, যা ‘মদিনাতুস সালাম’ বা শান্তির নগরী নামে পরিচিত ছিল, তা পরিণত হয় এক রণক্ষেত্রে। প্রায় এক বছর ধরে চলা এই অবরোধে বাগদাদের সুন্দর প্রাসাদ, বাগান এবং লাইব্রেরিগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ঐতিহাসিকরা এই অবরোধকে তুলনা করেছেন এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের সাথে, যা বাগদাদের আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। বাগদাদের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ‘আইয়ারুন’ (Ayyarun) বা ভবঘুরে যোদ্ধারা, আমিনের পক্ষ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় এক অসম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিল। তারা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বা সামান্য কাপড় পরে পাথর ও লাঠি নিয়ে মামুনের সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এটি ছিল আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এবং একই সাথে তাদের শহরের প্রতি ভালোবাসার এক অদ্ভুত বহিঃপ্রকাশ।
ম্যাঙ্গোনেল বা ক্যাটাপোল্ট দিয়ে ছোড়া পাথরের আঘাতে বাগদাদের বিখ্যাত গোল গম্বুজ এবং গ্র্যান্ড মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাইগ্রিস নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ৮১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাহিরের বাহিনী বাগদাদ দখল করে। খলিফা আমিন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাকে বন্দি করা হয় এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমিনের কাটা মস্তক যখন মামুনের সামনে পেশ করা হয়, তখন মামুন বিজয়ের আনন্দ পেলেও তার ভেতরে এক গভীর অনুশোচনা সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই ভ্রাতৃহত্যা আব্বাসীয় খিলাফতের পবিত্রতা বা স্যাক্রালিটি (Sacrality) চিরতরে নষ্ট করে দিয়েছে। জনগণ দেখল যে খলিফা আল্লাহর প্রতিনিধি হলেও তার শরীর অলঙ্ঘনীয় নয়।
যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাঙন
চতুর্থ ফিতনার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। যদিও আল-মামুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগের স্থপতি ছিলেন এবং বায়তুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি এমন এক সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন যা ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছিল।
- কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা: এই যুদ্ধের ফলে বাগদাদের অবকাঠামো যেমন ধ্বংস হয়েছিল, তেমনি ধ্বংস হয়েছিল খিলাফতের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। খোরাসান থেকে বাগদাদ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলগুলোতে কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি ভীতি বা ডেটারেন্স (Deterrence) কমে গিয়েছিল। প্রদেশগুলো বুঝতে পেরেছিল যে বাগদাদ আর আগের মতো শক্তিশালী নেই।
- আরব আধিপত্যের অবসান: আমিনের পরাজয় ছিল আব্বাসীয় প্রশাসনে আরব অভিজাতদের বা ‘আবনা’-দের একচ্ছত্র আধিপত্যের কফিনে শেষ পেরেক। মামুনের জয়ে পারসিক এবং খোরাসানিদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তীতে তুর্কি প্রহরীদের উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
- সামাজিক বিভাজন: এই যুদ্ধ সমাজকে গভীরভাবে বিভক্ত করে দেয়। বাগদাদবাসী মামুনকে দখলদার হিসেবে দেখত এবং তাকে মেনে নিতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল। মামুন দীর্ঘদিন বাগদাদে প্রবেশ করতে পারেননি এবং মার্ভ থেকে শাসন পরিচালনা করেছিলেন, যা তার প্রজা-বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়েছিল।
ভাইয়ে ভাইয়ে এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র বা হেরিডিটারি মনার্কি (Hereditary Monarchy) ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারের সুনির্দিষ্ট এবং পালনযোগ্য নিয়ম না থাকলে তা রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। হারুনুর রশীদের ‘মক্কার প্রটোকল’ শান্তি আনার বদলে সাম্রাজ্যকে গৃহযুদ্ধের আগুনে ঠেলে দিয়েছিল, যার ক্ষত আব্বাসীয় খিলাফত আর কখনোই পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারেনি।
তুর্কি বাহিনীর উত্থান: প্রিটোরিয়ানইজম এবং বিচ্ছিন্নতা
আল-মামুনের মৃত্যুর পর ৮৩৩ সালে তার ভাই আল-মু’তাসিম (Al-Mu’tasim) খলিফার মসনদে বসেন। মু’তাসিম ছিলেন একজন বাস্তববাদী কিন্তু কঠোর শাসক। তিনি তার বড় দুই ভাইয়ের পরিণতি দেখেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, আরব গোত্রগুলো বা ‘আবনা’ এখন আর নির্ভরযোগ্য নয়, তারা আমিনের পক্ষ নিয়েছিল এবং পরাজিত হয়েছে। অন্যদিকে, পারসিকরা মামুনের আমলে অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে এবং তারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। মু’তাসিম এমন এক শক্তির খোঁজ করছিলেন, যারা হবে জাতিগত রাজনীতি বা এথনিক পলিটিক্স (Ethnic Politics)-এর ঊর্ধ্বে এবং যাদের আনুগত্য থাকবে কেবল খলিফার প্রতি। তার এই অনুসন্ধানের ফল হলো মধ্য এশিয়া (ট্রান্সঅক্সিয়ানা) থেকে হাজার হাজার তুর্কি যুবককে দাস হিসেবে কিনে আনা। এই তুর্কিরা ছিল জন্মগতভাবে যোদ্ধা, দুর্দান্ত অশ্বারোহী এবং তীরন্দাজ। তাদের কোনো স্থানীয় আত্মীয়স্বজন বা সামাজিক পিছুটান ছিল না। মু’তাসিম এদের নিয়ে গঠন করলেন এক বিশেষ ব্যক্তিগত বাহিনী, যা ইতিহাসে মামলুক প্রতিষ্ঠান (Mamluk Institution) বা গুলাম বাহিনী নামে পরিচিত। তিনি ভেবেছিলেন, এই শিকড়হীন বা রুটলেস (Rootless) সৈন্যরা কেবল তাদের মনিব বা খলিফার আদেশের দাস হয়ে থাকবে।
কিন্তু মু’তাসিমের এই সিদ্ধান্ত ছিল এক বড় ধরনের রাজনৈতিক ভুল বা মিসক্যালকুলেশন (Miscalculation)। তিনি বাগদাদে এই তুর্কি সৈন্যদের বসবাস করার অনুমতি দিলে শহরের স্থানীয় আরব ও পারসিক জনগণের সাথে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। তুর্কি সৈন্যরা ছিল উদ্ধত; তারা ঘোড়া নিয়ে বাজারের ভেতর দিয়ে দৌড়ে যেত, সাধারণ মানুষকে অপমান করত। বাগদাদের জনগণ খলিফার বিরুদ্ধে ক্ষুঁসে উঠল। জনরোষ থেকে বাঁচতে এবং তার প্রিয় বাহিনীকে রক্ষা করতে ৮৩৬ সালে মু’তাসিম এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বাগদাদ ত্যাগ করে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে দজলা বা টাইগ্রিস নদীর তীরে ‘সামারা’ (Samarra) নামে এক নতুন রাজধানী গড়ে তুললেন। এই ঘটনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় শাসকের এলিয়েনেশন (Alienation) বা প্রজা থেকে বিচ্ছিন্নতা। সামারা ছিল এক বিশাল সামরিক ছাঁউনি, যেখানে খলিফা তার তুর্কি প্রহরীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকতেন। এর মাধ্যমে খলিফা নিজেই নিজেকে একটি সোনার খাঁচায় বন্দি করে ফেললেন। তিনি সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন এবং পুরোপুরি নির্ভর হয়ে পড়লেন তুর্কি সেনাপতিদের ওপর। এই ব্যবস্থা জন্ম দিল এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক সংকটের, যাকে বলা হয় প্রিটোরিয়ানইজম (Praetorianism) – যেখানে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের রক্ষক হওয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রের মালিক হয়ে ওঠে। তুর্কিরা বুঝতে পারল, খলিফার টিকে থাকা তাদের বাহুবলের ওপর নির্ভরশীল। এই উপলব্ধি বা সেলফ-রিয়ালাইজেশন (Self-realization) তাদের আনুগত্যকে ক্ষমতায় রূপান্তর করতে উৎসাহিত করল (Gordon, 2001)।
সামারার নৈরাজ্য: খলিফা যখন দাবার ঘুঁটি
মু’তাসিমের মৃত্যুর পর তার ছেলে আল-ওয়াসিক ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু আসল ক্ষমতা তখন তুর্কি সেনাপতিদের হাতে চলে গেছে। ওয়াসিকের মৃত্যুর পর ৮৪৭ সালে আল-মুতাওয়াক্কিল (Al-Mutawakkil) খলিফা হন। তিনি ছিলেন একজন রক্ষণশীল এবং কিছুটা স্বাধীনচেতা শাসক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তুর্কিদের ক্ষমতা কমানো দরকার। তিনি তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন এবং আরব ও অন্য গোষ্ঠীগুলোকে আবার সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তুর্কি সেনাপতিরা, বিশেষ করে বোগা আল-শারাবি এবং ওয়াসিফ আল-তুর্কি, খলিফার এই পরিকল্পনা আঁচ করতে পারেন। এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ। ৮৬১ সালের এক অন্ধকার রাতে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নিজের ছেলে আল-মুনতাসির তুর্কি ঘাতকদের সাথে হাত মিলিয়ে পিতাকে হত্যা করেন। আব্বাসীয় ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম রেজিসাইড (Regicide) বা খলিফা হত্যা। এই ঘটনা খলিফার পদের পবিত্রতা বা ইনভায়োলাবিলিটি (Inviolability) ধূলিসাৎ করে দেয়। রক্ষীরা বুঝতে পারল, খলিফার শরীর রক্তমাংসেরই তৈরি এবং তাকে হত্যা করা সম্ভব।
মুতাওয়াক্কিলের হত্যাকাণ্ডের পর শুরু হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়, যা সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra) নামে পরিচিত (৮৬১-৮৭০ খ্রি.)। মাত্র নয় বছরের ব্যবধানে চারজন খলিফা – আল-মুনতাসির, আল-মুসতাইন, আল-মুতাজ এবং আল-মুহতাদি – ক্ষমতায় আসেন এবং করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন বা ক্ষমতাচ্যুত হন। খলিফা নিয়োগ এবং বরখাস্ত করাটা তুর্কি সেনাপতিদের কাছে একটি খেলায় পরিণত হয়। কোনো খলিফা যদি তুর্কিদের বকেয়া বেতন দিতে না পারতেন বা তাদের অবাধ্য হতেন, তবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হতো অথবা মরুভূমিতে ফেলে রাখা হতো। কথিত আছে, খলিফা আল-মুতাজকে রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল এবং মারধর করা হয়েছিল যতক্ষণ না তিনি পদত্যাগ পত্রে সই করেন। খলিফারা হয়ে পড়েছিলেন তুর্কিদের হাতের পুতুল বা পাপেট রুলার (Puppet Ruler)। এই সময় রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে, কারণ তুর্কি সৈন্যরা ক্রমাগত তাদের বেতন বাড়ানোর দাবি করত। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কর আসা বন্ধ হয়ে যায়, কারণ দুর্বল কেন্দ্রীয় শাসনকে কেউ আর তোয়াক্কা করত না। এই নৈরাজ্য প্রমাণ করে যে, সামরিক শক্তি যদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বা সিভিলিয়ান কন্ট্রোল (Civilian Control)-এর বাইরে চলে যায়, তবে তা রাষ্ট্রকেই খেয়ে ফেলে (Kennedy, 2004)।
আব্বাসীয় পুনর্জাগরণ: আল-মুওয়াফফাকের লৌহমুষ্টি এবং ক্ষণস্থায়ী বসন্ত (৮৭০–৯৪৫ খ্রি.)
সামারার নৈরাজ্য (Anarchy at Samarra) (৮৬১–৮৭০ খ্রি.) ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে এক অন্ধকার যুগ, যখন খলিফারা তুর্কি সেনাপতিদের হাতের অসহায় পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। মাত্র এক দশকে চারজন খলিফাকে হত্যা বা ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, রাজকোষ হয়ে পড়েছিল শূন্য এবং সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলো একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, আব্বাসীয় খিলাফতের পতন কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই আব্বাসীয়রা এক অবিশ্বাস্য পুনর্জাগরণের সাক্ষী হয়। ৮৭০ থেকে ৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭৫ বছরের এই সময়কালটি ছিল খলিফাদের হারানো ক্ষমতা ও সম্মান পুনরুদ্ধারের এক মরিয়া প্রচেষ্টা, যা মূলত কয়েকজন শক্তিশালী শাসক ও সেনাপতির লৌহকঠিন ইচ্ছাশক্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল। তবে এই পুনর্জাগরণ ছিল ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতার মতো – এক ক্ষণস্থায়ী বসন্ত, যার পরেই অপেক্ষা করছিল বুয়াইদদের চূড়ান্ত আধিপত্য।
আল-মুওয়াফফাক: পর্দার আড়ালের লৌহমানব: সামারার নৈরাজ্য-এর অবসানের পর যখন খলিফা আল-মু’তামিদ (Al-Mu’tamid) (৮৭০–৮৯২ খ্রি.) সিংহাসনে বসেন, তখন তিনি ছিলেন নামমাত্র শাসক। খিলাফতের প্রকৃত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন তার ভাই আবুল আহমদ তালহা, যিনি ইতিহাসে আল-মুওয়াফফাক (Al-Muwaffaq) নামে পরিচিত। আল-মুওয়াফফাক খলিফা না হয়েও রিজেন্ট (Regent) বা অভিভাবক এবং সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে আব্বাসীয় রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন একজন অসামান্য সামরিক প্রতিভা এবং বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তুর্কি সৈন্যদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা আত্মঘাতী, তাই তিনি আরব এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সৈন্যদের নিয়ে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন। তার সবচেয়ে বড় এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল ধীরে ধীরে খিলাফতের কেন্দ্র সামারার বিচ্ছিন্ন সামরিক ব্যারাক থেকে সরিয়ে ৮৯২ সালে চূড়ান্তভাবে ঐতিহ্যবাহী রাজধানী বাগদাদে ফিরিয়ে আনা। এই পদক্ষেপ খলিফাকে সাধারণ জনগণ, আমলাতন্ত্র এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর সাথে পুনরায় সংযুক্ত করে, যা আব্বাসীয় শাসনের নৈতিক ভিত্তি বা মোরাল লেজিটিমেসি (Moral Legitimacy) পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।
জাঞ্জ বিদ্রোহ দমন: অস্তিত্বের লড়াই: আল-মুওয়াফফাকের শাসনামলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দক্ষিণ ইরাকে সংঘটিত ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দাস বিদ্রোহ – জাঞ্জ বিদ্রোহ (Zanj Rebellion) (৮৬৯–৮৮৩ খ্রি.)। ‘জাঞ্জ’ বলতে পূর্ব আফ্রিকা থেকে আনা কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের বোঝানো হতো, যাদেরকে বসরার লবণাক্ত জলাভূমি পরিষ্কার করার মতো অমানবিক শ্রমে নিযুক্ত করা হয়েছিল। আলী ইবনে মুহাম্মদ নামক এক রহস্যময় নেতার নেতৃত্বে এই দাসরা বিদ্রোহ করে এবং দক্ষিণ ইরাকের বিশাল অংশ দখল করে নেয়। তারা আল-মুখতারা (al-Mukhtara) নামে নিজেদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রায় ১৪ বছর ধরে আব্বাসীয় খিলাফতের হৃদপিণ্ডে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এই বিদ্রোহ আব্বাসীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়, কারণ ইরাকের কৃষিভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। আল-মুওয়াফফাক তার জীবনের প্রায় এক দশক এই বিদ্রোহ দমনে ব্যয় করেন। এটি কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না; জলাভূমির ভৌগোলিক পরিবেশে গেরিলা যুদ্ধের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী অভিযান বা ওয়ার অফ অ্যাট্রিশন (War of Attrition)। আল-মুওয়াফফাক নদীপথে নৌবহর ব্যবহার করে এবং বিদ্রোহীদের রসদ সরবরাহ লাইন কেটে দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের কোণঠাসা করেন। ৮৮৩ সালে আল-মুখতারার পতন এবং আলী ইবনে মুহাম্মদের মৃত্যুর মাধ্যমে এই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। জাঞ্জদের বিরুদ্ধে এই বিজয় আব্বাসীয় খিলাফতের সম্মান ও ক্ষমতা অনেকাংশে ফিরিয়ে আনে।
সাফফারিদ ও তুলুনিদ: কেন্দ্রবিমুখী শক্তির মোকাবেলা: জাঞ্জ বিদ্রোহ ছাড়াও আল-মুওয়াফফাককে সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলোতে গজিয়ে ওঠা স্বাধীন শক্তিগুলোর মোকাবেলা করতে হয়েছিল।
- সাফফারিদদের চ্যালেঞ্জ: পারস্যের সিস্তান অঞ্চলে ইয়াকুব ইবনে আল-লাইস আল-সাফফার নামক এক তাম্রকার বা কপারস্মিথ (Coppersmith) থেকে সেনাপতি হওয়া নেতা সাফফারিদ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং খলিফার কর্তৃত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়াকুব এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাগদাদ দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। বাগদাদের অদূরে দায়র আল-আকুল (Battle of Dayr al-‘Aqul)-এর যুদ্ধে আল-মুওয়াফফাক ব্যক্তিগতভাবে লড়াই করে সাফফারিদ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এই বিজয় প্রমাণ করে যে, বাগদাদের কেন্দ্রীয় শাসন তখনো পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের চেয়ে শক্তিশালী।
- তুলুনিদদের উত্থান: মিশরে আহমদ ইবনে তুলুন নামক আরেক তুর্কি সেনাপতি তুলুনিদ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে কার্যত স্বাধীন হয়ে যান। তিনি মিশর ও সিরিয়ার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বাগদাদে পাঠানো বন্ধ করে দেন। আল-মুওয়াফফাক তার জীবনের শেষ দিকে তুলুনিদদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। তবে তার উত্তরসূরিরা পরবর্তীতে মিশর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।
আল-মুতাদিদের সংস্কার এবং ক্ষণস্থায়ী বসন্ত: আল-মুওয়াফফাকের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র আল-মুতাদিদ (Al-Mu’tadid) (৮৯২–৯০২ খ্রি.) খলিফা হন। পিতার হাতে প্রশিক্ষিত আল-মুতাদিদ ছিলেন একজন কঠোর এবং দক্ষ শাসক। তিনি খিলাফতের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোযোগ দেন। তিনি বাগদাদের আমলাতন্ত্র বা ব্যুরোক্রেসি (Bureaucracy)-কে পুনর্গঠিত করেন, কর ব্যবস্থা সংস্কার করে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করেন এবং কঠোর হাতে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করেন। তার শাসনামলে এবং তার পুত্র আল-মুকতাফির (Al-Muktafi) (৯০২–৯০৮ খ্রি.) সময়ে আব্বাসীয় খিলাফত তার হৃতগৌরবের অনেকটাই ফিরে পায়। ৯o৫ সালে আল-মুকতাফি মিশর পুনরুদ্ধার করে তুলুনিদ শাসনের অবসান ঘটান। এই সময়টাকে আব্বাসীয়দের শেষ বসন্ত বা ইন্ডিয়ান সামার (Indian Summer) বলা যেতে পারে, যখন বাগদাদ আবারও মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিতভাবে রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল।
পতনের নতুন বীজ এবং বুয়াইদদের পদধ্বনি: এই পুনর্জাগরণ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এর কারণ ছিল কাঠামোগত দুর্বলতা বা স্ট্রাকচারাল উইকনেস (Structural Weakness)। আল-মুকতাফির মৃত্যুর পর খলিফা আল-মুকতাদির (Al-Muqtadir) (৯০৮–৯৩২ খ্রি.) মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। তার দীর্ঘ শাসনামল ছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, হারেমের রাজনীতি (বিশেষ করে তার মা শাঘাবের প্রভাব) এবং সেনাপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ। রাষ্ট্রের আয় কমে যায় এবং সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই দুর্বলতার সুযোগে খলিফার ক্ষমতা আবারও কমতে থাকে এবং সেনাপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে আমির আল-উমারা (Commander of Commanders) পদের আনুষ্ঠানিক সৃষ্টি হয়, যা ছিল খলিফার ওপর সেনাপতিদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। খলিফা আবারও হয়ে পড়েন একজন ধর্মীয় প্রতীক। এই অভ্যন্তরীণ ভাঙনের মধ্যেই কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চল ডেলাম থেকে শিয়া বুয়াইদদের উত্থান ঘটতে থাকে। আব্বাসীয়দের পুনর্জাগরণের শিখাটি নিভে আসছিল এবং ৯৪৫ সালে বাগদাদ দখলের মাধ্যমে বুয়াইদরা সেই শিখার ওপর চূড়ান্তভাবে ছাই চাপা দেয়।
আব্বাসীয় খিলাফত এবং প্রাদেশিক রাজবংশ: কেন্দ্রবিমুখী ক্ষমতার সমীকরণ
নবম শতাব্দীর শেষার্ধে আব্বাসীয় খিলাফতের কেন্দ্রীয় শাসন বা সেন্ট্রাল অথরিটি (Central Authority) ধীরে ধীরে দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে বাগদাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা প্রদেশগুলোতে স্থানীয় রাজবংশগুলোর উত্থান ঘটতে থাকে। এই ঐতিহাসিক বিবর্তনকে মধ্যযুগের মুসলিম ঐতিহাসিকরা ‘আমির আল-ইসতিলা’ (Amir al-Istila) বা ‘দখলদার আমিরের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, যখন কোনো উচ্চাভিলাষী সেনাপতি বা স্থানীয় নেতা সামরিক শক্তির জোরে কোনো প্রদেশ দখল করে নিতেন, তখন বাগদাদের খলিফা তাকে থামানোর মতো সামরিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাখতেন না। ফলে খলিফা বাধ্য হয়ে একটি রাজনৈতিক আপস (Political Compromise) করতেন; তিনি সেই দখলদার আমিরকে ওই প্রদেশের বৈধ গভর্নর হিসেবে স্বীকৃতি বা সনদ দিতেন। বিনিময়ে সেই আমির খলিফার প্রতি মৌখিক আনুগত্য প্রকাশ করতেন, জুমার খুতবা (Khutba) পাঠের সময় খলিফার নাম উল্লেখ করতেন এবং নিজের মুদ্রায় বা সিক্কা (Sikka)-তে খলিফার নাম খোদাই করতেন। এই প্রথাগত স্বীকৃতির আড়ালে আব্বাসীয় খিলাফত একটি এককেন্দ্রিক সাম্রাজ্য বা ইউনিটারি স্টেট (Unitary State) থেকে একটি শিথিল কনফেডারেশন বা ইসলামিক কমনওয়েলথ (Islamic Commonwealth)-এ রূপান্তরিত হচ্ছিল। তাহিরিদ, সাফফারিদ, তুলুনিদ, সামানিদ, হামদানিদ এবং ইখশিদিদ রাজবংশগুলোর সাথে আব্বাসীয়দের সম্পর্ক ছিল এই জটিল এবং পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক সমীকরণেরই প্রতিফলন।
তাহিরিদ রাজবংশ: খোরাসানের রাজপ্রতিনিধি এবং আব্বাসীয়দের ঢাল (৮২১–৮৭৩ খ্রি.)
তাহিরিদ রাজবংশ (Tahirids) ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে প্রথম আধা-স্বাধীন বা সেমি-অটোনোমাস (Semi-autonomous) পারসিক রাজবংশ, যারা খোরাসান অঞ্চলে (বর্তমান ইরান, আফগানিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান) শাসন করত। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা তাহির ইবনে হুসাইন ছিলেন খলিফা আল-মামুনের ডান হাত এবং প্রধান সেনাপতি। আমিন ও মামুনের মধ্যকার বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধে বা চতুর্থ ফিতনা (Fourth Fitna)-য় তাহির মামুনের বিজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পুরস্কার হিসেবে ৮২১ সালে খলিফা আল-মামুন তাকে প্রাচ্যের বা খোরাসানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। তাহিরিদরা অন্য অনেক পরবর্তী রাজবংশের মতো বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করেনি; বরং তারা ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের অত্যন্ত বিশ্বস্ত মিত্র এবং প্রক্সি রুলার (Proxy Ruler)।
তাহিরিদদের সাথে আব্বাসীয়দের সম্পর্ক ছিল গভীর আস্থার। তারা নিজেদের স্বাধীন রাজা মনে করত না, বরং খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে গর্ববোধ করত। বাগদাদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ক্লায়েন্ট-প্যাট্রন (Client-Patron) ধরনের। তারা খোরাসান থেকে নিয়মিত কর বা রাজস্ব এবং মূল্যবান তুর্কি ক্রীতদাস বাগদাদে পাঠাত। এই তুর্কি ক্রীতদাসরাই পরবর্তীতে আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড বা গুলাম বাহিনী (Ghulams) হয়ে ওঠে। তাহিরিদদের রাজধানী নিশাপুর ছিল এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র। তারা আরবি ভাষাকে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করত, কিন্তু একই সাথে পারসিক কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিত। তবে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক এবং সামরিক। তারা বাগদাদের জন্য পূর্ব সীমান্তে একটি শক্তিশালী বাফার (Buffer) হিসেবে কাজ করত, যা শিয়া বিদ্রোহ, খারিজিদের আক্রমণ এবং তুর্কি যাযাবরদের আগ্রাসন থেকে সাম্রাজ্যের মূল ভূখণ্ডকে রক্ষা করত। ৮৭৩ সালে ইয়াকুব ইবনে লাইস আল-সাফফারের হাতে তাহিরিদদের পতন আব্বাসীয়দের পূর্বাঞ্চলীয় নিয়ন্ত্রণে এক বিশাল শূন্যতা এবং ফাটল তৈরি করে, যা আর কখনোই পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
সাফফারিদ রাজবংশ: তাম্রকারের বিদ্রোহ এবং বাগদাদের আতঙ্ক (৮৬১–১০০৩ খ্রি.)
তাহিরিদদের পতনের পর সিস্তান অঞ্চলে সাফফারিদ রাজবংশের (Saffarids) উত্থান ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের জন্য সবচেয়ে বড় সামরিক হুমকি এবং একই সাথে একটি সামাজিক বিপ্লব (Social Revolution)-এর প্রতীক। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াকুব ইবনে আল-লাইস আল-সাফফার ছিলেন পারস্যের সিস্তান অঞ্চলের একজন সাধারণ তাম্রকার বা কপারস্মিথ (Coppersmith)। তিনি কোনো অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন না; বরং তিনি স্থানীয় আইয়ারুন (Ayyarun) বা ভিজিলান্টি গোষ্ঠীর নেতা থেকে উঠে এসে নিজের বাহুবলে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। সাফফারিদদের উত্থান ছিল প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে নিচু তলার মানুষের বিদ্রোহ।
অন্য রাজবংশগুলো যেখানে খলিফার কাছ থেকে সনদের জন্য অপেক্ষা করত, ইয়াকুব সেখানে খলিফার কর্তৃত্বকে তোয়াক্কা করতেন না। তিনি খোরাসান দখল করে তাহিরিদদের (যারা আব্বাসীয়দের অনুগত ছিল) বিতাড়িত করেন এবং বাগদাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। খলিফা আল-মু’তামিদ তাকে থামানোর জন্য বলখ, তোখারিস্তান এবং সিন্ধু প্রদেশের শাসনভার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইয়াকুব সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বাগদাদ দখলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, “খলিফার সাথে আমার ফয়সালা হবে তলোয়ার দিয়ে।” ইয়াকুবের এই আগ্রাসন আব্বাসীয়দের অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে। ৮৭৬ সালে বাগদাদের মাত্র ৫০ মাইল দূরে দায়র আল-আকুল (Battle of Dayr al-‘Aqul) নামক স্থানে আব্বাসীয় রিজেন্ট আল-মুওয়াফফাক এবং ইয়াকুবের বাহিনীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। আব্বাসীয়রা কৌশলগতভাবে টাইগ্রিস বা দজলা নদীর বাঁধ কেটে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র প্লাবিত করে দেয়, যা সাফফারিদদের ভারী অশ্বারোহী বাহিনীকে কাদায় আটকে অচল করে দেয়। এই যুদ্ধে আব্বাসীয়দের বিজয় খিলাফতকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। পরবর্তীতে ইয়াকুবের ভাই আমর ইবনে আল-লাইস খলিফার বশ্যতা স্বীকার করেন এবং আব্বাসীয়দের সাথে একটি শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে আব্বাসীয়রা তাদের কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি।
তুলুনিদ রাজবংশ: মিশরের স্বায়ত্তশাসন এবং স্বর্ণের মোহ (৮৬৮–৯০৫ খ্রি.)
মিশরের তুলুনিদ রাজবংশ (Tulunids) ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে প্রথম বড় ফাটল, যা প্রমাণ করে যে, একজন শক্তিশালী তুর্কি গভর্নর চাইলে খলিফাকে উপেক্ষা করে স্বাধীন রাষ্ট্র চালাতে পারেন। এর প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইবনে তুলুন ছিলেন একজন তুর্কি দাস সৈনিকের পুত্র, যাকে আব্বাসীয়রা মিশরের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে পাঠিয়েছিল। ইবনে তুলুন ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী এবং দক্ষ প্রশাসক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাগদাদের ক্ষমতা এবং বিলাসিতা অনেকাংশে মিশরের উর্বর নীলনদ অববাহিকার বিপুল রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল।
ইবনে তুলুন বাগদাদে কর পাঠানো বন্ধ করে দেন এবং সেই অর্থ দিয়ে মিশরে এক বিশাল পেশাদার সেনাবাহিনী (যার মধ্যে সুদানি এবং গ্রিক দাসরাও ছিল) এবং ভূমধ্যসাগরে এক শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। তিনি কায়রোর কাছে আল-কাতাই (Al-Qata’i) নামে নতুন রাজধানী এবং বিখ্যাত ইবনে তুলুন মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজও তার স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষ্য বহন করছে। ইবনে তুলুন কেবল মিশরেই সন্তুষ্ট ছিলেন না; তিনি সিরিয়াও দখল করে নেন। ফারাওদের পর এই প্রথম মিশর থেকে সিরিয়া শাসিত হচ্ছিল, যা ছিল ভূ-রাজনীতির এক বড় পরিবর্তন। আব্বাসীয় রিজেন্ট আল-মুওয়াফফাক তাকে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে মিশরের এবং সিরিয়ার বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। তুলুনিদদের সাথে আব্বাসীয়দের সম্পর্ক ছিল প্রাগমেটিক (Pragmatic) বা প্রয়োজনভিত্তিক। ইবনে তুলুন খলিফাকে ধর্মীয় নেতা মানতেন এবং খুতবায় তার নাম রাখতেন, কিন্তু প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। ৯০৫ সালে আব্বাসীয়রা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে জেনারেল মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমান আল-কাতিবের নেতৃত্বে মিশর আক্রমণ করে এবং তুলুনিদ বংশ ধ্বংস করে অঞ্চলটি সরাসরি বাগদাদের শাসনে ফিরিয়ে আনে। এটি ছিল আব্বাসীয়দের সাময়িক পুনরুত্থানের একটি নিদর্শন।
সামানিদ রাজবংশ: সুন্নি ইসলামের প্রাচীর এবং পারসিক রেনেসাঁ (৮১৯–৯৯৯ খ্রি.)
সাফফারিদ বা তুলুনিদদের মতো সামানিদ রাজবংশ (Samanids) আব্বাসীয়দের বিদ্রোহী ছিল না; বরং তারা ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, অনুগত এবং আদর্শিক মিত্র। ট্রান্সঅক্সিয়ানা (বর্তমান উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান) এবং খোরাসান কেন্দ্রিক এই রাজবংশটি ছিল প্রাচীন পারসিক অভিজাত বা দেহকান (Dehqan) শ্রেণির। তারা সাসানীয় রাজাদের বংশধর দাবি করত, কিন্তু তারা ছিল গোঁড়া সুন্নি মুসলিম। সামানিদদের রাজধানী বোখারা এবং সমরকন্দ হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র।
সামানিদ আমিররা, বিশেষ করে ইসমাইল ইবনে আহমদ, নিজেদের স্বাধীন রাজা হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন। তারা গর্বের সাথে নিজেদের খলিফার ‘বিশ্বস্ত সেনাপতি’ বা মাওলা (Mawla) হিসেবে পরিচয় দিতেন। তারা বাগদাদের খলিফাকে নিয়মিত উপহার এবং কর পাঠাতেন। বিনিময়ে খলিফা তাদের ‘খোরাসানের আমির’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেন এবং তাদের জন্য প্রার্থনা করতেন। আব্বাসীয়রা সামানিদদের পূর্ব সীমান্তে সুন্নি ইসলামের রক্ষক বা বুলওয়ার্ক (Bulwark) হিসেবে দেখত, যারা মধ্য এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে ধেয়ে আসা অমুসলিম তুর্কি যাযাবরদের আক্রমণ থেকে মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করত। সামানিদদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল পারসিক রেনেসাঁ (Persian Renaissance) বা পারসিক নবজাগরণ। তারা আরবি লিপিতে ফারসি ভাষা (New Persian) লেখার প্রচলন করে এবং ফেরদৌসীর শাহনামা (Shahnameh)-র মতো মহাকাব্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। তারা প্রমাণ করে যে, আরবি না হয়েও এবং আরব সংস্কৃতি গ্রহণ না করেও একজন খাঁটি সুন্নি মুসলিম হওয়া সম্ভব। আব্বাসীয় খিলাফতের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক ছিল।
হামদানিদ রাজবংশ: সীমান্ত প্রহরী এবং শিয়া সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক (৮৯০–১০০৪ খ্রি.)
হামদানিদ রাজবংশ (Hamdanids) ছিল উত্তর মেসোপটেমিয়া (মসুল) এবং উত্তর সিরিয়া (আলেপ্পো) কেন্দ্রিক একটি আরব বেদুইন রাজবংশ। দশম শতাব্দীতে যখন আব্বাসীয় খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ছিল এবং বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল, তখন হামদানিদরা খিলাফতের রক্ষাকবচ বা ‘সোর্ড অফ ইসলাম’ (Sword of Islam) হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হামদান ইবনে হামদুন, তবে রাজবংশটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছায় সাইফ আল-দৌলা এবং তার ভাই নাসির আল-দৌলার আমলে।
আব্বাসীয় খিলাফতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত বা ‘আল-সুগুর’ (Al-Thughur) রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব হামদানিদদের ওপর ছিল। তারা বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে নিয়মিত জিহাদ পরিচালনা করত। সাইফ আল-দৌলা বাইজান্টাইন সম্রাটদের বিরুদ্ধে প্রায় ৪০টি সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন, যা তাকে মুসলিম বিশ্বে একজন কিংবদন্তি বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আব্বাসীয় খলিফারা সামরিকভাবে দুর্বল হওয়ায় সীমান্ত রক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হামদানিদদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। হামদানিদরা ছিল শিয়া মতাবলম্বী (দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী), কিন্তু তারা বাগদাদের সুন্নি খলিফার প্রতি নামমাত্র আনুগত্য দেখাত। আলেপ্পোতে সাইফ আল-দৌলার দরবার ছিল তৎকালীন আরব বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কেন্দ্র। বিখ্যাত কবি আল-মুতানাব্বি এবং দার্শনিক আল-ফারাবি তার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। হামদানিদরা প্রমাণ করেছিল যে, শিয়া মতবাদ এবং আরব জাতীয়তাবাদের মিশ্রণে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা গড়ে তোলা সম্ভব, যা আব্বাসীয় খিলাফতের পেরিফেরিতে থেকেও কেন্দ্রীয় গুরুত্ব বহন করত।
ইখশিদিদ রাজবংশ: বাফার স্টেট এবং ক্ষণস্থায়ী স্থায়িত্ব (৯৩৫–৯৬৯ খ্রি.)
তুলুনিদদের পতনের পর আব্বাসীয়রা প্রায় ৩০ বছর সরাসরি মিশর শাসন করে, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতির কারণে তারা আবার নিয়ন্ত্রণ হারায়। এই প্রেক্ষাপটে উত্থান ঘটে ইখশিদিদ রাজবংশের (Ikhshidids)। এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে তুঘজ ছিলেন মধ্য এশিয়ার ফারগানা অঞ্চলের এক তুর্কি সেনাপতি। ৯৩৫ সালে খলিফা তাকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করেন। তিনি দ্রুত নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, তবে খলিফার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখেন।
৯৩৯ সালে আব্বাসীয় খলিফা আল-রাদি মুহাম্মদ ইবনে তুঘজের ক্ষমতা মেনে নেন এবং তাকে ‘আল-ইখশিদ’ (ফারগানার রাজাদের প্রাচীন পারসিক উপাধি, যার অর্থ ‘রাজপুত্র’) উপাধিতে ভূষিত করেন। আব্বাসীয়দের জন্য ইখশিদিদদের গুরুত্ব ছিল মূলত ভূ-রাজনৈতিক বা জিওপলিটিক্যাল (Geopolitical)। পশ্চিমে তখন ফাতেমীয় খিলাফত শক্তিশালী হচ্ছিল এবং তারা মিশরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আব্বাসীয়রা চেয়েছিল ইখশিদিদরা যেন মিশরে একটি শক্তিশালী বাফার স্টেট (Buffer State) হিসেবে কাজ করে, যাতে ফাতেমীয়রা পূর্বে বাগদাদের দিকে এগোতে না পারে। ইখশিদিদরা আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি অনুগত ছিল, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মিশরের সম্পদ ব্যবহার করে নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখা। তাদের শাসন ছিল তুলনামূলকভাবে ক্ষণস্থায়ী। ৯৬৯ সালে ফাতেমীয়রা জওহর আল-সিকিলির নেতৃত্বে মিশর দখল করলে ইখশিদিদ শাসনের অবসান ঘটে এবং আব্বাসীয়রা তাদের পশ্চিমাঞ্চলীয় বাফার জোনটি চিরতরে হারিয়ে ফেলে।
সাম্রাজ্য থেকে কমনওয়েলথে রূপান্তর
এই ছয়টি রাজবংশের (তাহিরিদ, সাফফারিদ, তুলুনিদ, সামানিদ, হামদানিদ, ইখশিদিদ) সাথে আব্বাসীয়দের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নবম ও দশম শতাব্দীতে খলিফার ভূমিকা আমূল পরিবর্তিত হয়েছিল। খলিফা আর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সম্রাট ছিলেন না; তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ধরনের সুজেরেইন (Suzerain) বা আধ্যাত্মিক প্রধান, যার কাজ ছিল বিভিন্ন স্বাধীন সুলতান ও আমিরদের শাসনের বৈধতা দেওয়া। এই ব্যবস্থা আব্বাসীয় খিলাফতকে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র থেকে একটি বিকেন্দ্রীভূত ইসলামি বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছিল। সামানিদদের মতো কেউ ছিল অনুগত মিত্র, সাফফারিদদের মতো কেউ ছিল শত্রু, আবার তুলুনিদ ও ইখশিদিদদের মতো কেউ ছিল সুবিধাবাদী। কিন্তু সবারই একটি সাধারণ প্রয়োজন ছিল – নিজেদের শাসনকে ‘ইসলামি’ প্রমাণ করার জন্য এবং জনগণের আনুগত্য পাওয়ার জন্য বাগদাদের খলিফার সিলমোহর ও আশীর্বাদ। এই ‘পলিটিক্স অফ লেজিটিমেসি’ (Politics of Legitimacy) আব্বাসীয় খিলাফতকে সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার পরেও আরও কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে টিকিয়ে রেখেছিল।
বাইজান্টাইন আগ্রাসন: আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের অনুঘটক
আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের কারণ খুঁজতে গেলে ঐতিহাসিকরা সাধারণত মঙ্গোল আক্রমণ (১২৫৮ খ্রি.) অথবা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার (যেমন সামারার নৈরাজ্য বা তুর্কি প্রহরীদের উত্থান) দিকে বেশি মনোযোগ দেন। কিন্তু দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান এবং তাদের ধারাবাহিক আক্রমণ আব্বাসীয় খিলাফতকে কাঠামোগতভাবে দুর্বল করতে এবং এর পতনকে ত্বরান্বিত করতে এক বিশাল, যদিও কিছুটা পরোক্ষ, ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময়কালকে বাইজান্টাইন ইতিহাসের ‘মেসিডোনিয়ান রেনেসাঁস’ (Macedonian Renaissance) এবং আব্বাসীয় ইতিহাসের ‘শতাব্দীর অবক্ষয়’ বলা যেতে পারে। বাইজান্টাইন আগ্রাসন কেবল সীমান্ত সংঘাত ছিল না; এটি আব্বাসীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল, খলিফার নৈতিক কর্তৃত্ব নষ্ট করেছিল এবং স্থানীয় যুদ্ধবাজদের উত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ: আল-সুগুর এবং রাজস্বের ক্ষতি: আব্বাসীয় অর্থনীতির একটি বড় অংশ নির্ভর করত উত্তর মেসোপটেমিয়া এবং সিরিয়ার উর্বর কৃষি জমি এবং বাণিজ্যপথের ওপর। দশম শতাব্দীতে বাইজান্টাইন সম্রাট নাইসেফোরাস ফোকাস এবং জন জিমিসেস-এর নেতৃত্বে বাইজান্টাইন বাহিনী যখন আনাতোলিয়ার সীমান্ত অঞ্চল ‘আল-সুগুর’ (Al-Thughur) ভেদ করে সিরিয়ার গভীরে প্রবেশ করে, তখন তারা কেবল শহর দখল করেনি, বরং আব্বাসীয়দের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছিল।
- কৃষি ধ্বংস: বাইজান্টাইনরা ‘স্কর্চড আর্থ’ বা পোড়ামাটি নীতি (Scorched Earth Policy) অনুসরণ করত। তারা ক্ষেতের ফসল পুড়িয়ে দিত এবং সেচ ব্যবস্থা ধ্বংস করত, যাতে মুসলিমরা আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
- বাণিজ্যপথ অবরোধ: সিরিয়ার আলেপ্পো, এন্টিওক এবং হামা ছিল সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। বাইজান্টাইনরা এন্টিওক দখল (৯৬৯ খ্রি.) করার ফলে ভূমধ্যসাগরের বাণিজ্যে আব্বাসীয়দের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে বাগদাদের রাজকোষে রাজস্ব আসা কমে যায়, যা কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্বল করে দেয়।
খলিফার নৈতিক কর্তৃত্বের বিনাশ (Loss of Moral Authority): আব্বাসীয় খলিফার প্রধান পরিচয় ছিল ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা এবং ইসলামের রক্ষক। কিন্তু বাইজান্টাইনরা যখন মুসলিম ভূখণ্ডের গভীরে ঢুকে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছিল এবং মসজিদ ধ্বংস করছিল, তখন বাগদাদের খলিফা তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হন।
- আলেপ্পোর পতন (৯৬২ খ্রি.): সম্রাট নাইসেফোরাস ফোকাস যখন আলেপ্পো দখল করে সাইফ আল-দৌলার প্রাসাদ লুণ্ঠন করেন এবং হাজার হাজার মুসলিমকে দাস হিসেবে নিয়ে যান, তখন বাগদাদের খলিফা আল-মুতি কিছুই করতে পারেননি। জনগণ যখন খলিফার প্রাসাদের সামনে গিয়ে সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করছিল, খলিফা তখন বলেছিলেন, “আমার হাতে কোনো টাকা নেই, কোনো সৈন্য নেই।”
- প্রভাব: এই অক্ষমতা জনগণের মনে খলিফার প্রতি বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। তারা বুঝতে পারে যে, খলিফা তাদের রক্ষা করতে পারবেন না। ফলে তারা স্থানীয় শিয়া রাজবংশ (যেমন হামদানিদ বা ফাতেমীয়) বা অন্য কোনো শক্তিশালী নেতার (যেমন তুর্কি আমির) দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাইজান্টাইন আক্রমণ আব্বাসীয় খলিফাকে একজন ‘অপ্রয়োজনীয় প্রতীকে’ পরিণত করেছিল।
স্থানীয় যুদ্ধবাজদের উত্থান এবং কেন্দ্রের ভাঙন: বাইজান্টাইন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বাগদাদের কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ হলে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় নেতারা বা ওয়ারলর্ডস (Warlords) নিজেদের উদ্যোগে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। মসুলের হামদানিদ রাজবংশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হামদানিদ আমির সাইফ আল-দৌলা বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ইসলামের প্রকৃত রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করেন। এই স্থানীয় রাজবংশগুলো শক্তিশালী হওয়ার ফলে তারা বাগদাদকে কর দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং কার্যত স্বাধীন হয়ে যায়। বাইজান্টাইন চাপ সামলাতে গিয়ে আব্বাসীয় খিলাফত খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে। বাইজান্টাইনরা পরোক্ষভাবে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বালকানাইজেশন (Balkanization) বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্তিকে ত্বরান্বিত করেছিল।
ফাতেমীয়দের পথ প্রশস্তকরণ: বাইজান্টাইনরা যখন সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে আব্বাসীয়দের দুর্বল করে দিয়েছিল, তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পশ্চিম দিক থেকে ফাতেমীয় খিলাফত এগিয়ে আসে। বাইজান্টাইন চাপের মুখে আব্বাসীয় গভর্নররা ইখশিদিদ বা হামদানিদদের মতো স্থানীয় শাসকদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন, যারা শেষ পর্যন্ত ফাতেমীয়দের কাছে নতি স্বীকার করে। ৯৬৯ সালে এন্টিওক বাইজান্টাইনদের হাতে এবং মিশর ফাতেমীয়দের হাতে চলে যায়। অর্থাৎ, বাইজান্টাইন আগ্রাসন আব্বাসীয়দের পশ্চিমাঞ্চলীয় বাফার জোন ধ্বংস করে ফাতেমীয়দের জন্য বাগদাদের দিকে এগোনোর রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
ক্রুসেডের পূর্বলক্ষণ: দশম ও একাদশ শতাব্দীতে বাইজান্টাইনদের এই ‘রিকনকোয়েস্টা’ বা মুসলিম ভূমি পুনরুদ্ধার অভিযানই পরবর্তীতে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। বাইজান্টাইনরা দেখিয়েছিল যে মুসলিম বিশ্ব দুর্বল এবং বিভক্ত। ১০৭১ সালে মানজিকার্টের যুদ্ধে সেলজুকদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বাইজান্টাইন সম্রাটরা ইউরোপের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান, যার ফলশ্রুতিতে ক্রুসেড শুরু হয়। আর ক্রুসেড আব্বাসীয় খিলাফতকে আরও কোণঠাসা করে ফেলে।
বাইজান্টাইন আক্রমণ সরাসরি বাগদাদ দখল বা ধ্বংস করেনি (যা মঙ্গোলরা করেছিল), কিন্তু তারা আব্বাসীয় খিলাফতকে ‘মৃত্যুশয্যায়’ ঠেলে দিয়েছিল। তারা আব্বাসীয়দের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করেছিল, খলিফার সম্মান ধুলোয় মিশিয়েছিল এবং সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো হতে বাধ্য করেছিল। বাইজান্টাইন আগ্রাসন ছিল সেই উইপোকা, যা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের খুঁটিগুলো ভেতর থেকে খেয়ে ফেলেছিল, যাতে পরবর্তীতে মঙ্গোলদের সামান্য ধাক্কাতেই পুরো কাঠামোটি ধসে পড়ে।
আব্বাসীয়, ফাতেমীয় ও হাশাশিন: ‘এন্টি-খলিফা’ এবং ছায়াযুদ্ধের ত্রিমাত্রিক সমীকরণ
দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব এক গভীর আদর্শিক স্নায়ুযুদ্ধ (Ideological Cold War)-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বাগদাদের সুন্নি আব্বাসীয় খলিফাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল দুটি ভিন্ন ভিন্ন শিয়া শক্তি – মিশরের ফাতেমীয় খিলাফত এবং পারস্যের আলামুত দুর্গের হাশাশিন বা অ্যাসাসিন সম্প্রদায়। এই সম্পর্ক ছিল ঘৃণা, ভীতি এবং ধর্মীয় প্রোপাগান্ডায় মোড়ানো।
আব্বাসীয় বনাম ফাতেমীয়: ‘এন্টি-খলিফা’ এবং অস্তিত্বের মহাযুদ্ধ
দশম শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্ব এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি হয়, যাকে ঐতিহাসিকরা ‘ইসলামের মহান বিভাজন’ বা ‘ইমামত-এর শীতল যুদ্ধ’ (Cold War of the Imamate) বলে অভিহিত করেন। ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় এবং ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিশরে কায়রো নগরী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফাতেমীয় খিলাফতের উত্থান আব্বাসীয়দের জন্য কেবল কোনো রাজনৈতিক বিদ্রোহ ছিল না; এটি ছিল তাদের ধর্মীয় ও বংশগত বৈধতার ওপর সরাসরি আঘাত।
সাদা বনাম কালো: পতাকার যুদ্ধ ও ‘সূর্যের’ দ্বন্দ্ব: ফাতেমীয়রা নিজেদের নবী মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমা এবং জামাতা আলীর সরাসরি বংশধর দাবি করত। তাদের দাবি ছিল, আব্বাসীয়রা নবীর চাচা আব্বাসের বংশধর হয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, যা অবৈধ। ফাতেমীয়রা তাদের প্রতীক হিসেবে ‘সাদা পতাকা’ গ্রহণ করে, যা ছিল আব্বাসীয়দের শোকের প্রতীক ‘কালো পতাকা’র সম্পূর্ণ বিপরীত। বাগদাদ যদি হয় ‘প্রাচ্যের সূর্য’, তবে কায়রো নিজেকে ঘোষণা করল ‘প্রতীচ্যের সূর্য’ হিসেবে। ফাতেমীয়রা মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং পবিত্র হজের মৌসুমে আরাফাতের ময়দানে আব্বাসীয় খলিফার নাম বাদ দিয়ে ফাতেমীয় খলিফার নামে খুতবা পাঠ শুরু করে। দুই পবিত্র মসজিদের এই নিয়ন্ত্রণ হারানো আব্বাসীয় খলিফাদের জন্য ছিল চূড়ান্ত অপমান এবং তাদের বিশ্বজনীন নেতৃত্বের দাবির ওপর চপেটাঘাত।
বাগদাদ মেনিফেস্টো (১০১১ খ্রি.): কালির আঁচড়ে চরিত্রহনন: ফাতেমীয়দের প্রভাব যখন মিশরের সীমানা ছাড়িয়ে সিরিয়া এবং ইরাকের দিকে ধেয়ে আসছিল, এবং বাগদাদের সাধারণ মানুষের মধ্যেও শিয়া মতবাদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ছিল, তখন আব্বাসীয় খলিফা আল-কাদির অস্তিত্ব রক্ষায় এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেন। ১০১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদের সুন্নি ও শিয়া (বিশেষ করে দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী) শীর্ষ আলেমদের একত্রিত করে একটি দলিল স্বাক্ষর করান, যা ইতিহাসে ‘বাগদাদ মেনিফেস্টো’ (Baghdad Manifesto) নামে পরিচিত। এই দলিলে ফাতেমীয়দের বংশপরিচয় নিয়ে এক ভয়াবহ প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। ঘোষণা করা হয় যে, মিশরের শাসকরা ফাতেমার বংশধর নয়, বরং তারা ‘দায়সান’ নামক এক ইহুদি কামার বা মাজুসি (অগ্নিপূজক) জাদুকরের বংশধর। তাদের ইসলাম থেকে খারিজ বা কাফের ঘোষণা করা হয়। এই ‘প্রোপাগান্ডা ওয়ারফেয়ার’ প্রমাণ করে যে, আব্বাসীয়রা তরবারি দিয়ে ফাতেমীয়দের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে কলমের কালিতে তাদের চরিত্রহনন বা ‘ডিমোনাইজেশন’ (Demonization)-এর পথ বেছে নিয়েছিল।
আল-বাসাসিরির বিদ্রোহ এবং বাগদাদের ‘লজ্জার বছর’ (১০৫৮ খ্রি.): আব্বাসীয়দের দুঃস্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে। আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর তুর্কি সেনাপতি আরসলান আল-বাসাসিরি বিদ্রোহ করেন এবং ফাতেমীয় খলিফা আল-মুসতানসিরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাসাসিরি বাগদাদ দখল করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল-কাইমকে গৃহবন্দি করেন। বাগদাদের মহান মসজিদে আব্বাসীয় কালো পতাকা নামিয়ে ফাতেমীয় সাদা পতাকা উড়ানো হয়। দীর্ঘ ৪০ জুম্মা পর্যন্ত আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদের মিম্বরে মিশরের ফাতেমীয় খলিফার নামে খুতবা পাঠ করা হয়। এই সময় আব্বাসীয় প্রাসাদের ধনসম্পদ, এমনকি মহানবীর পবিত্র চাদর (বুরদা) এবং লাঠিও লুণ্ঠন করা হয়। শেষ পর্যন্ত সেলজুক নেতা তুঘরিল বেগ এসে বাসাসিরিকে পরাজিত করেন এবং খলিফাকে মুক্ত করেন। কিন্তু এই ঘটনা আব্বাসীয়দের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তাদের পায়ের তলার মাটি কতটা নড়বড়ে।
হাশাশিন (নিজারি ইসমাইলি): ছায়ার আড়ালের মৃত্যু এবং ‘স্টেট অফ ফিয়ার’
ফাতেমীয়দের পতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১০৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইসমাইলি শিয়াদের ভেতর থেকে এক কট্টরপন্থী উপদল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যারা নিজারি ইসমাইলি নামে পরিচিত। ক্রুসেডার এবং ইউরোপীয়রা তাদের নাম দেয় ‘হাশাশিন’ বা ‘অ্যাসাসিন’। তাদের নেতা হাসান-ই সাব্বাহ পারস্যের এলবুরুজ পর্বতমালার দুর্ভেদ্য আলামুত দুর্গে ঘাঁটি গাড়েন। আব্বাসীয় খলিফা এবং তাদের রক্ষাকর্তা সেলজুক সুলতানদের জন্য এই হাশাশিনরা হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য আতঙ্ক।
অপ্রতিসম যুদ্ধ (Asymmetric Warfare) এবং ফিদাই বাহিনী: হাসান-ই সাব্বাহ জানতেন যে, তার মুষ্টিমেয় অনুসারী নিয়ে আব্বাসীয় বা সেলজুকদের বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে টিকে থাকা অসম্ভব। তাই তিনি বেছে নিলেন সন্ত্রাসের পথ। তিনি তৈরি করলেন ‘ফিদাই’ (আত্মোৎসর্গকারী) বাহিনী। এই ফিদাইরা ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত গুপ্তঘাতক, যারা ছদ্মবেশ ধারণে পটু ছিল। তারা ভিক্ষুক, সুফি সাধক বা রাজদরবারের ভৃত্যের ছদ্মবেশে লক্ষ্যবস্তুর খুব কাছে পৌঁছে যেত। তাদের কৌশল ছিল ‘সাপের মাথা কেটে ফেলা’ – অর্থাৎ যুদ্ধের ময়দানে হাজার সৈন্য না মেরে কেবল প্রধান সেনাপতি, উজির বা খলিফাকে হত্যা করা। তারা বিশ্বাস করত, এতে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র অচল হয়ে পড়বে। তাদের হামলাগুলো হতো প্রকাশ্য দিবালোকে, জনাকীর্ণ মসজিদ বা রাজদরবারে, যাতে মানুষের মনে সর্বোচ্চ ভীতি বা ‘শক অ্যান্ড অ’ (Shock and Awe) সৃষ্টি হয়।
খলিফা হত্যা: পবিত্র রক্তের স্পর্ধা: আব্বাসীয় খলিফারা হাশাশিনদের প্রধান টার্গেট ছিলেন, কারণ হাশাশিনদের মতে আব্বাসীয়রা ছিল অবৈধ শাসক বা ‘তাগুত’। ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মুস্তারশিদ এবং ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র খলিফা আল-রাশিদ হাশাশিনদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। আল-মুস্তারশিদ ছিলেন সেই বিরল আব্বাসীয় খলিফাদের একজন, যিনি সেলজুকদের হাত থেকে সামরিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তার তাঁবুর ভেতরে ঢুকে হাশাশিনরা তাকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড মুসলিম বিশ্বে এক গভীর ট্রমা তৈরি করে। খলিফার পবিত্র রক্ত, যা একসময় অলঙ্ঘনীয় মনে করা হতো, তা হাশাশিনদের কাছে ছিল কেবল একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তু।
ভীতির রাজত্ব (Reign of Terror): দ্বাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে হাশাশিন ভীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, একে ‘প্যারানয়া’ বা সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা বলা চলে। খলিফা, উজির এবং প্রধান কাজীরা (বিচারক) সবসময় পোশাকের নিচে লোহার বর্ম বা চেইনমেইল পরে থাকতেন। কেউ বিশ্বাসযোগ্য দেহরক্ষী ছাড়া এক পা-ও ফেলতেন না। হাশাশিনরা বাগদাদের বড় বড় আলেমদের হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠাত। যদি কোনো আলেম হাশাশিনদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতেন, তবে পরদিন সকালে তার বিছানায় একটি রক্তমাখা ছোরা এবং একটি চিরকুট পাওয়া যেত, যাতে লেখা থাকত – “পরের বার ছোরাটি বিছানায় থাকবে না, তোমার বুকে থাকবে।” এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কারণে আব্বাসীয় প্রশাসন ভেতর থেকে স্থবির হয়ে পড়েছিল।
আব্বাসীয়দের কৌশল: ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’
মিশরের ফাতেমীয় এবং পারস্যের হাশাশিন – এই দুই দিক থেকে আসা সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে আব্বাসীয়রা টিকে থাকার জন্য এক বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করে:
সেলজুকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার: আব্বাসীয়রা সেলজুক তুর্কিদের ‘সুন্নি ইসলামের রক্ষক’ হিসেবে ধর্মীয় বৈধতা দেয়। বিনিময়ে সেলজুকরা হাশাশিনদের আলামুত দুর্গ অবরোধ করে এবং ফাতেমীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়। সেলজুক উজির নিজাম আল-মূলক (যিনি নিজেও ১০৯২ সালে হাশাশিনদের প্রথম হাই-প্রোফাইল শিকার হন) হাশাশিনদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাগদাদে ‘নিজামিয়া মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসীয়রা বুঝতে পেরেছিল, এই লড়াই কেবল তলোয়ার দিয়ে জেতা যাবে না, জিততে হবে মগজ দিয়ে।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবির উত্থান ও ফাতেমীয়দের পতন: আব্বাসীয়দের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য ছিল সালাহউদ্দিন আইয়ুবিকে সমর্থন দেওয়া। ১১৭১ সালে সালাহউদ্দিন যখন মিশরের ফাতেমীয় খিলাফত বিলুপ্ত করেন, তখন বাগদাদে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাদি সালাহউদ্দিনকে বিপুল উপঢৌকন পাঠান। ফাতেমীয়দের পতন ছিল আব্বাসীয়দের জন্য এক বিশাল ‘নৈতিক বিজয়’। তারা মনে করেছিল, তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বা ‘এন্টি-খলিফা’ ধ্বংস হয়েছে।
ফাতেমীয়রা ছিল আব্বাসীয়দের জন্য ‘রাজনৈতিক ও আদর্শিক’ হুমকি, যারা খিলাফতের দাবিদার ছিল। আর হাশাশিনরা ছিল ‘নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের’ হুমকি, যারা খলিফাদের হত্যা করছিল। আব্বাসীয়রা ফাতেমীয়দের পরাজিত করতে পেরেছিল এবং সেলজুকদের সাহায্যে হাশাশিনদের কিছুটা দমিয়ে রাখতে পেরেছিল। ১২৫৬ সালে মঙ্গোলরা যখন আলামুত দুর্গ ধ্বংস করে হাশাশিনদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তখন আব্বাসীয়রা সাময়িক স্বস্তি পেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো – যে মঙ্গোলরা তাদের শত্রু হাশাশিনদের ধ্বংস করেছিল, মাত্র দুই বছর পর ১২৫৮ সালে সেই মঙ্গোলরাই আব্বাসীয় খিলাফতকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। আব্বাসীয়রা বুঝতে পারেনি যে, বাঘের (মঙ্গোল) সাহায্যে সাপ (হাশাশিন) মারলে, শেষ পর্যন্ত বাঘের পেটে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
বুয়াইদদের উত্থান: শিয়া আধিপত্য এবং খলিফার বন্দিদশা (৯৪৫–১০৫৫ খ্রি.)
আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগকে বলা হয় ‘রাজনৈতিক জিম্মিদশার যুগ’। কেন্দ্রীয় শাসন বা সেন্ট্রাল অথরিটি (Central Authority) যখন সামারার বিলাসিতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং তুর্কি প্রহরীদের অরাজকতায় জর্জরিত, তখন সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে ভাঙন শুরু হয়। একে বলা হয় কেন্দ্রবিমুখী শক্তি বা সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্সেস (Centrifugal Forces)-এর উত্থান। কিন্তু বাগদাদের খলিফাদের জন্য চূড়ান্ত অপমান অপেক্ষা করছিল কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলের রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চল ‘ডেলাম’ (Daylam) থেকে আসা একদল দুর্ধর্ষ যোদ্ধার হাতে – যাদের নাম বুয়াইদ বা বুওয়াইহিদ (Buyids)।
ডেলামাইট ঝড় এবং বাগদাদ দখল: বুয়াইদরা ছিল শিয়া মতাবলম্বী (বিশেষ করে যায়দি এবং পরবর্তীতে দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী) যোদ্ধা। তারা তাদের শারীরিক শক্তি এবং পদাতিক যুদ্ধের কৌশলের জন্য বিখ্যাত ছিল। তিন ভাই – আলী, হাসান এবং আহমদ ইবনে বুয়া – ধীরে ধীরে পারস্যের শিরাজ ও ইসফাহান দখল করে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হন। ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আহমদের নেতৃত্বে বুয়াইদ বাহিনী বাগদাদে প্রবেশ করে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাকফি তখন এতটাই দুর্বল ও অসহায় ছিলেন যে, তিনি কোনো প্রতিরোধ গড়া তো দূরের কথা, উল্টো বুয়াইদ নেতা আহমদকে ‘মুইজ আল-দাউলা’ (রাষ্ট্রের সম্মানবর্ধক) উপাধি দিয়ে স্বাগত জানাতে বাধ্য হন। এর মাত্র কয়েকদিন পরই মুইজ আল-দাউলা খলিফাকে অন্ধ করে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং তার জায়গায় আল-মুতিকে নামমাত্র খলিফা হিসেবে বসান।
আমির আল-উমারা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষমতার উত্থান: বুয়াইদদের ক্ষমতা দখল ইতিহাসের এক বড় প্যারাডক্স বা কূটাভাস। তারা ছিল শিয়া, অথচ তারা সুন্নি খলিফাকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করেনি। এর পেছনে ছিল চতুর রিয়েলপলিটিক (Realpolitik)। বুয়াইবরা জানত, শিয়া খলিফা বসালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি প্রজা এবং সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করবে। তাই তারা খলিফাকে কেবল একজন ধর্মীয় পুতুল বা ‘ফিগারহেড’ হিসেবে রেখে দিল। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক পদের প্রবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করল – ‘আমির আল-উমারা’ (Commander of Commanders)। খলিফার কাজ সীমাবদ্ধ রইল কেবল জুমার খুতবা দেওয়া এবং ধর্মীয় উৎসবে উপস্থিতি নিশ্চিত করার মধ্যে। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনা, সেনাবাহিনী, রাজস্ব আদায় এবং পররাষ্ট্রনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিল বুয়াইদ আমিররা। খলিফার নাম খুতবা এবং মুদ্রায় (Sikka) থাকলেও, তার নিচে আমিরের নাম থাকত, যা ছিল ডি ফ্যাক্টো (De facto) ক্ষমতার প্রতীক।
সাংস্কৃতিক সংঘাত এবং শিয়া সেঞ্চুরি: বুয়াইদ শাসনামলকে ঐতিহাসিকরা ‘শিয়া সেঞ্চুরি’ (Shi’a Century) বলে অভিহিত করেছেন। বাগদাদের বুকে এই সময় অভূতপূর্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দেখা দেয়। বুয়াইদ আমিররা রাষ্ট্রীয়ভাবে শিয়া আচার-অনুষ্ঠান পালন শুরু করেন। তারা মহররম মাসে আশুরা (ইমাম হোসেনের শাহাদাত বার্ষিকী) উপলক্ষে শোক মিছিল এবং জিলহজ মাসে ‘গাদির-ই-খুম’ উৎসব পালন বাধ্যতামূলক করেন। বাগদাদের সুন্নি অধিবাসীদের জন্য এটি ছিল চরম অস্বস্তিকর এবং অপমানজনক। এর ফলে প্রায়ই বাগদাদের রাস্তায় শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা বেধে যেত, আর খলিফা নিজের প্রাসাদে বসে অসহায়ভাবে তা দেখতেন। খলিফার অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছিল যে, তার মাসিক হাতখরচও বুয়াইদ আমিররা বরাদ্দ করত। কথিত আছে, কখনো কখনো অর্থের অভাবে খলিফাকে প্রাসাদের আসবাবপত্র ও দরজা-জানালা বিক্রি করে খাবার জোগাড় করতে হতো। তবে বুয়াইদদের আমলে, বিশেষ করে ‘আজুদ আল-দাউলা’-র শাসনকালে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছিল। বাগদাদের বিখ্যাত ‘আল-আজুদি’ হাসপাতাল বা বিমারিস্তান তাদেরই কীর্তি।
সেলজুক তুর্কিদের আগমন: সুন্নি পুনজাগরণ এবং সুলতানি যুগের সূচনা (১০৫৫–১১৯৪ খ্রি.)
বুয়াইদদের শাসন প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলার পর তাদের নিজেদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ এবং শিয়া-সুন্নি দাঙ্গায় বাগদাদ যখন বিপর্যস্ত, তখন পূর্ব দিক থেকে আরেক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এরা ছিল মধ্য এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে আসা ওঘুজ তুর্কি বা সেলজুক (Seljuqs)। বুয়াইদদের মতো তারা শিয়া ছিল না, তারা ছিল কট্টর সুন্নি মতাবলম্বী। ফলে আব্বাসীয় খলিফাদের কাছে এবং বাগদাদের সুন্নি জনগণের কাছে তারা আবির্ভূত হলো ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে।
তুঘরিল বেগ এবং নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ: ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক নেতা তুঘরিল বেগ (Tughril Beg) বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং বুয়াইদদের উৎখাত করেন। খলিফা আল-কাইম তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান। খলিফা তুঘরিলকে ‘সুলতান’ (Sultan) এবং ‘পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক’ (King of the East and West) উপাধিতে ভূষিত করেন। এখান থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি ইতিহাসে ‘খলিফা’ ও ‘সুলতান’-এর ক্ষমতার পৃথকীকরণ বা সেপারেশন অব পাওয়ার চূড়ান্ত রূপ পায়। খলিফা রইলেন আধ্যাত্মিক নেতা (Spiritual Leader) হিসেবে, আর সুলতান হলেন রাজনৈতিক ও সামরিক শাসক (Temporal Ruler)। বুয়াইদদের সময় খলিফা ছিলেন বন্দি, সেলজুকদের সময়ে তিনি পেলেন সম্মান, কিন্তু ক্ষমতা ফিরে পেলেন না। সেলজুকরা খলিফার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের শাসনের ধর্মীয় বৈধতা বা থিওলজিক্যাল লেজিটিমেসি (Theological Legitimacy) আদায় করে নেয়।
সুন্নি অর্থোডক্সির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং নিজামিয়া মাদ্রাসা: সেলজুক শাসন কেবল তলোয়ারের জোরে টিকে ছিল না, এর পেছনে ছিল এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। সেলজুকদের প্রধান উজির নিজাম আল-মূলক (Nizam al-Mulk) ছিলেন এই যুগের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইসমাইলি শিয়া (যেমন: মিশরের ফাতেমীয়রা) এবং হাশাশিনদের (Assassins) প্রভাব কমাতে হলে কেবল যুদ্ধ যথেষ্ট নয়, দরকার শিক্ষার প্রসার। তাই তিনি সাম্রাজ্যজুড়ে ‘নিজামিয়া মাদ্রাসা’ (Nizamiyya Madrasa) চেইন প্রতিষ্ঠা করেন। বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসা ছিল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ইমাম আল-গাজালির (Al-Ghazali) মতো পণ্ডিতরা শিক্ষকতা করতেন। সেলজুকরা আশারি মতবাদ এবং শাফিয়ি মাজহাবকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এর মাধ্যমে তারা শিয়া মতাদর্শের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সুন্নি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাচীর গড়ে তোলে।
সুলতানি ক্ষমতার দাপট এবং খলিফার নীরবতা: সেলজুকরা খলিফাকে সম্মান করত ঠিকই, কিন্তু তারা কখনোই খলিফাকে সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ দেয়নি। মালিক শাহ এবং তার উজির নিজাম আল-মূলকের সময় সেলজুক সাম্রাজ্য চীন থেকে আনাতোলিয়া (তুরস্ক) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাগদাদের খলিফাকে তখনো সুলতানের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হতো। সুলতানরা নিজেদের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বাগদাদে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করতেন এবং জাঁকজমকপূর্ণ দরবার বসাতেন, যা অনেক সময় খলিফার দরবারকেও ম্লান করে দিত। এই ‘ডায়ার্কি’ বা দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চলতে থাকে ততদিন, যতদিন না সেলজুকরা নিজেদের গৃহযুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই দুই যুগ – বুয়াইদ এবং সেলজুক – প্রমাণ করে যে, আব্বাসীয় খিলাফত নবম শতাব্দীর পর থেকেই কার্যত তার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। খলিফা ছিলেন কেবল ঐক্যের প্রতীক, আর ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিল যার হাতে তরবারি, তার হাতে। বুয়াইদরা দেখিয়েছিল শিয়া প্রভাবের অধীনে খলিফার অসহায়ত্ব, আর সেলজুকরা দেখিয়েছিল সুন্নি আবরণের নিচে সামরিক একনায়কতন্ত্রের রূপ।
আব্বাসীয় খিলাফত ও ক্রুসেড: অক্ষমতার কান্না এবং প্রতীকী জিহাদ (১০৯৫–১২৫৮ খ্রি.)
আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাসে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ (১০৯৫–১২৯১ খ্রি.) এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং বিড়ম্বনাময় অধ্যায়। যখন ইউরোপ থেকে খ্রিস্টান বাহিনী ‘পবিত্র ভূমি’ উদ্ধারের জন্য ধেয়ে আসছিল, তখন মুসলিম বিশ্বের নামমাত্র প্রধান নেতা অর্থাৎ বাগদাদের খলিফা ছিলেন অনেকটাই ‘নির্জীব দর্শক’। আব্বাসীয় খিলাফত ও ক্রুসেডের সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক অদ্ভুত বৈপরীত্য – যেখানে খলিফার ভূমিকা ছিল চোখের জল, ফতোয়া এবং প্রতীকী সমর্থনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রথম ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে এবং আল-আকসা মসজিদে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়, তখন বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন আল-মুস্তাজহির। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, মুসলিম বিশ্বের এই মহাবিপর্যয়ের সময় খলিফার হাতে কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল না। তিনি ছিলেন সেলজুক সুলতানদের হাতের পুতুল। বাগদাদ তখন নিজের গৃহযুদ্ধ এবং সেলজুক রাজপুত্রদের ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, জেরুজালেমের কান্না তাদের কানে পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল।
বাগদাদে উদ্বাস্তুদের হাহাকার: ক্রুসেডের ভয়াবহতা বাগদাদে প্রথম অনুভূত হয় যখন দামেস্ক এবং জেরুজালেম থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু বাগদাদে এসে পৌঁছায়। ঐতিহাসিক ইবনে আল-আসিরের বর্ণনায় এক লোমহর্ষক ঘটনার উল্লেখ আছে – ১১১১ খ্রিস্টাব্দে আলেপ্পো থেকে আসা একদল উদ্বাস্তু রমজান মাসে খলিফার মসজিদে ঢুকে পড়ে। তারা রাগে এবং ক্ষোভে নিজেদের রোজা ভেঙে ফেলে এবং মসজিদের মিম্বর ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে, “যখন আমাদের ভাইদের রক্তে ঘোড়ার পা ডুবে যাচ্ছে, তখন খলিফা কীভাবে নিশ্চিন্তে প্রাসাদে বসে আছেন?” খলিফা আল-মুস্তাজহির এই ঘটনায় কেবল কান্না করেছিলেন এবং সেলজুক সুলতানকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু সেলজুকরা তখন নিজেদের ভাইদের সাথে মসনদ নিয়ে লড়ছে, তাই প্যালেস্টাইনের দিকে তাকানোর সময় তাদের ছিল না। কবি আল-আবিওয়ার্দি তখন খলিফার দরবারে দাঁড়িয়ে সেই বিখ্যাত কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন: “আমরা রক্তকে চোখের জলের সাথে মিশিয়ে ফেলেছি… যখন তলোয়ারের ঝনঝনানি আগুন জ্বালাচ্ছে, তখন তোমরা কি ঘুমাচ্ছ?”
খলিফা যখন ‘বৈধতার স্ট্যাম্প’ (Rubber Stamp of Legitimacy): নিজে যুদ্ধ করার ক্ষমতা না থাকলেও, ক্রুসেডবিরোধী আন্দোলন বা ‘কাউন্টার ক্রুসেড’-এ আব্বাসীয় খলিফাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেটি হলো ‘নৈতিক ও ধর্মীয় বৈধতা’ প্রদান। ইমাদউদ্দিন জঙ্গি, নূরউদ্দিন জঙ্গি এবং পরবর্তীতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি – যারা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করেছিলেন, তারা সবাই খলিফার কাছ থেকে অনুমোদন বা ‘মানসুর’ (Investiture) পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। কারণটা সহজ – খলিফার অনুমোদন ছাড়া তাদের যুদ্ধকে সাধারণ মুসলিমরা ‘জিহাদ’ হিসেবে মানত না, বরং সেটাকে নিছক রাজ্যদখল মনে করত। খলিফা আল-মুকতাফি এবং আল-মুস্তাদি বাগদাদ থেকে এই বীর সেনাপতিদের জন্য ‘কালো পতাকা’ এবং ‘রাজকীয় পোশাক’ (Khil’at) পাঠাতেন। এই প্রতীকী সমর্থন যোদ্ধাদের মনোবল বা মোরাল (Morale) বাড়াতে বিশাল ভূমিকা রাখত। খলিফা ছিলেন জিহাদের ‘স্পিরিচুয়াল মোবিলাইজার’।
খলিফা আন-নাসির এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ: আব্বাসীয় খিলাফতের শেষের দিকে খলিফা আন-নাসির (১১৮০–১২২৫) এই নিষ্ক্রিয়তার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসেন। তিনি ক্রুসেডের রাজনীতিতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি যখন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন, আন-নাসির তখন কেবল দোয়া করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি সালাহউদ্দিনকে অর্থ এবং প্রতীকী সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। বিশেষ করে, তিনি তার পুনরুজ্জীবিত ‘ফুতুওয়াহ’ (Futuwwa) বা আধ্যাত্মিক নাইটহুড সংঘের মাধ্যমে মুসলিম যুবকদের ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তবে আন-নাসিরের কূটনীতি ছিল অত্যন্ত জটিল। অনেক ঐতিহাসিক অভিযোগ করেন যে, আন-নাসির তার প্রধান শত্রু খাওয়ারিজম শাহকে দুর্বল করার জন্য গোপনে ক্রুসেডারদের সাথেও কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখেছিলেন। একে বলা যায় ‘রিয়েলপলিটিক’ বা বাস্তববাদী রাজনীতি – যেখানে নিজের গদি বাঁচাতে খলিফা শত্রুর শত্রুকে (ক্রুসেডার) ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। যদিও এই অভিযোগের পুরোপুরি সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন।
সপ্তম ক্রুসেড এবং বাগদাদের পতন: ক্রুসেডের শেষ পর্যায় এবং আব্বাসীয়দের পতন প্রায় সমসাময়িক ছিল। ১২৪৮-১২৫৪ সালে ফ্রান্সের রাজা নবম লুই (Saint Louis) যখন মিশরে সপ্তম ক্রুসেড পরিচালনা করছিলেন, তখন বাগদাদে মঙ্গোল ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। মুসলিম বিশ্ব তখন দ্বিধাবিভক্ত – একদিকে পশ্চিম থেকে আসা ক্রুসেডার, অন্যদিকে পূর্ব থেকে আসা মঙ্গোল। মজার ব্যাপার হলো, কিছু ক্রুসেডার এবং ইউরোপীয় রাজা আশা করেছিলেন যে মঙ্গোলরা (যাদের অনেকেই নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান বা খ্রিস্টান-বান্ধব ছিল) হয়তো বাগদাদের খলিফাকে ধ্বংস করে ইসলামকে মুছে ফেলবে এবং খ্রিস্টানদের সাথে মৈত্রী করবে। মঙ্গোল নেতা হালাকু খানের স্ত্রী দোকুজ খাতুন ছিলেন খ্রিস্টান, এবং বাগদাদ ধ্বংসের সময় খ্রিস্টানদের বাঁচানোর জন্য তার প্রভাব ছিল। অর্থাৎ, ক্রুসেড এবং মঙ্গোল আক্রমণ – এই দুই ঘটনা একে অপরের সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল, যা আব্বাসীয়দের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
ক্রুসেডের ২০০ বছরে আব্বাসীয় খলিফারা ছিলেন “তলোয়ারবিহীন সেনাপতি”। তারা যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন না, কিন্তু যুদ্ধের বয়ানে (Narrative) তারা ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাদের অক্ষমতা এবং অসহায়ত্ব প্রমাণ করেছিল যে, মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক কেন্দ্র বাগদাদ থেকে সরে কায়রো এবং দামেস্কে চলে গেছে। ক্রুসেড আব্বাসীয়দের সরাসরি ধ্বংস করেনি, কিন্তু এটি মুসলিম বিশ্বকে এতটাই ক্লান্ত ও বিভক্ত করে দিয়েছিল যে, পরবর্তীতে মঙ্গোলদের ধাক্কা সামলানোর শক্তি তাদের আর অবশিষ্ট ছিল না।
আব্বাসীয় ও আইয়ুবিদ: বৈধতার বিনিময় এবং ক্রুসেডের রাজনীতি (১১৭১–১২৫০ খ্রি.)
আব্বাসীয় খিলাফতের শেষ শতকে, যখন বাগদাদের খলিফারা সেলজুক ও খাওয়ারিজমীয়দের চাপে কোণঠাসা, তখন মিশরে উদয় হয় সালাহউদ্দিন আইয়ুবির (Saladin) নেতৃত্বে সুন্নি আইয়ুবিদ রাজবংশ। এই সম্পর্কটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের জন্য এক বিশাল স্বস্তির নিঃশ্বাস এবং রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের চাবিকাঠি। কারণ, এর আগে মিশরে শাসন করত ইসমাইলি শিয়া ফাতেমীয় খলিফারা, যারা ছিল বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় মতাদর্শগত হুমকি।
ফাতেমীয়দের পতন এবং আব্বাসীয়দের নৈতিক বিজয়: ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি মিশরের ফাতেমীয় খিলাফতের পতন ঘটান। এটি ছিল সুন্নি ইসলামের ইতিহাসে এবং বিশেষ করে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাদির জন্য এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। সালাহউদ্দিন কায়রোর মসজিদগুলোতে ফাতেমীয় খলিফার নাম বাদ দিয়ে বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার নামে জুমার খুতবা চালু করেন। প্রায় ২০০ বছর পর মিশর আবারও আব্বাসীয় আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের অধীনে ফিরে আসে। বাগদাদে এই খবর পৌঁছালে খলিফা আল-মুস্তাদি আনন্দে উৎসবের ঘোষণা দেন এবং সালাহউদ্দিনকে ‘সুলতান’ উপাধি ও রাজকীয় পোশাক (Khil’at) উপহার পাঠান। এই ঘটনা আব্বাসীয় খিলাফতকে নতুন করে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বৈধতা বনাম ক্ষমতা (Legitimacy vs Power): আইয়ুবিদ ও আব্বাসীয়দের সম্পর্ক ছিল একটি নিখুঁত ‘সিমবায়োটিক’ বা মিথোজীবী সম্পর্ক। সালাহউদ্দিন ছিলেন কুর্দি বংশোদ্ভূত এবং একজন সেনাপতি; তার শাসনের কোনো বংশগত বা ধর্মীয় বৈধতা ছিল না। তার দরকার ছিল খলিফার অনুমোদন বা ইনভেস্টিচার (Investiture), যাতে তিনি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের বৈধ শাসক এবং ‘মুজাহিদ’ হিসেবে দাবি করতে পারেন। অন্যদিকে, খলিফা আন-নাসিরের দরকার ছিল একজন শক্তিশালী সামরিক মিত্র, যে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়বে এবং আব্বাসীয়দের নাম উঁচিয়ে ধরবে। সালাহউদ্দিন তার প্রতিটি বিজয়ের পর বাগদাদে দূত পাঠাতেন এবং খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন। তবে বাস্তবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন; মিশরের রাজস্ব বা সেনাবাহিনী – কোনোটিতেই খলিফার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
খলিফা আন-নাসির এবং সালাহউদ্দিনের স্নায়ুযুদ্ধ: যদিও প্রকাশ্যে তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর, কিন্তু পর্দার আড়ালে ছিল ক্ষমতার এক সূক্ষ্ম লড়াই। খলিফা আন-নাসির ছিলেন উচ্চাভিলাষী; তিনি চাইতেন সালাহউদ্দিন যেন কেবল খলিফার সেনাপতি হিসেবে কাজ করেন। অন্যদিকে সালাহউদ্দিন চাইতেন খলিফা কেবল তাকে ধর্মীয় আশীর্বাদ দিন, কিন্তু রাজনীতিতে নাক না গলান। একটি বিখ্যাত ঘটনা এই দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তোলে – সালাহউদ্দিন একবার ইরাকের মসুল বা জাজিরা অঞ্চল দখলের চেষ্টা করেন, যা ছিল বাগদাদের খুব কাছে। খলিফা আন-নাসির এতে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং সালাহউদ্দিনকে ওই দিকে অগ্রসর না হওয়ার জন্য কঠোর বার্তা পাঠান। সালাহউদ্দিন খলিফার সম্মানার্থে পিছু হটতে বাধ্য হন, যদিও তার সামরিক শক্তি ছিল খলিফার চেয়ে অনেক বেশি। এটি প্রমাণ করে, খলিফার সামরিক শক্তি না থাকলেও তার ‘নৈতিক প্রভাব’ বা মোরাল অথরিটি (Moral Authority) তখনো প্রবল ছিল।
ক্রুসেড এবং জেরুজালেম বিজয়: ১১৮৭ সালে হিত্তিনের যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজিত করে সালাহউদ্দিন যখন জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন, তখন তিনি সেই বিজয়ের বার্তা এবং কিছু ক্রুসেডার বন্দিকে বাগদাদে খলিফার কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। খলিফা আন-নাসির এই বিজয়কে আব্বাসীয় খিলাফতের বিজয় হিসেবেই প্রচার করেন। আইয়ুবিদরা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য খলিফার কাছ থেকে ধর্মীয় অনুমোদন বা ‘ফতোয়া’ এবং আর্থিক সাহায্য চাইত। খলিফা আন-নাসির নিজেও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রতীকীভাবে কিছু সৈন্য ও অর্থ পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক।
আইয়ুবিদদের পতন এবং আব্বাসীয়দের নিঃসঙ্গতা: ১২৫০ সালে মিশরে মামলুকদের উত্থানের মাধ্যমে আইয়ুবিদ শাসনের অবসান ঘটে। আইয়ুবিদরা আব্বাসীয় খলিফাদের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য দেখাত, মামলুকদের (যারা ছিল মূলত ক্রীতদাস যোদ্ধা) মধ্যে শুরুতে তা কিছুটা কম ছিল। তবে আইয়ুবিদ যুগ ছিল আব্বাসীয়দের জন্য এক সোনালী বিকেল, যখন তারা অন্তত মিশরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ থেকে শিয়া ফাতেমীয়দের ছায়া সরাতে পেরেছিল এবং ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে বিজয়ের অংশীদার হতে পেরেছিল।
সংক্ষেপে, আইয়ুবিদ-আব্বাসীয় সম্পর্ক ছিল “তলোয়ার এবং পাগড়ির মৈত্রী”। সালাহউদ্দিনের তলোয়ার আব্বাসীয় খলিফার পাগড়ি বা সম্মান রক্ষা করেছিল, আর খলিফার পাগড়ি সালাহউদ্দিনের তলোয়ারকে দিয়েছিল পবিত্রতা ও বৈধতা।
সিরিয়ার আইয়ুবিদ ও আব্বাসীয় সম্পর্ক: শেষ প্রহরের টানাপোড়েন
সালাহউদ্দিনের মৃত্যুর পর আইয়ুবিদ সাম্রাজ্য তার পুত্র ও ভাইদের মধ্যে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। মিশর, দামেস্ক, আলেপ্পো এবং হামায় পৃথক পৃথক আইয়ুবিদ আমিরাত গড়ে ওঠে। এই সময় বাগদাদের সাথে আইয়ুবিদদের সম্পর্কের সমীকরণ আরও জটিল হয়ে ওঠে, বিশেষ করে সিরিয়ার আইয়ুবিদ শাসকদের সাথে।
সালাহউদ্দিনের পর তার ভাই আল-আদিল এবং পরবর্তীতে তার বংশধররা যখন সিরিয়ার ক্ষমতায় আসেন, তখন তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। এই গৃহযুদ্ধে আব্বাসীয় খলিফা আন-নাসির এবং তার উত্তরসূরিরা প্রায়ই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতেন। দামেস্ক বা আলেপ্পোর কোনো আইয়ুবিদ আমির যখন অন্য আমিরের দ্বারা আক্রান্ত হতেন, তখন তারা বাগদাদে খলিফার কাছে নালিশ পাঠাতেন এবং খলিফার নৈতিক সমর্থন বা ডিপ্লোমেটিক ইন্টারভেনশন (Diplomatic Intervention) কামনা করতেন। খলিফা আন-নাসির এই সুযোগে আইয়ুবিদদের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে বাগদাদের প্রভাব বজায় রাখতেন। তিনি কখনো এক পক্ষকে সমর্থন দিয়ে, আবার কখনো অন্য পক্ষকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (Balance of Power) রক্ষা করতেন।
সিরিয়ার শেষ আইয়ুবিদ সুলতান আল-নাসির ইউসুফ (Al-Nasir Yusuf)-এর সাথে আব্বাসীয়দের সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে নাটকীয়। ১২৫০-এর দশকে যখন মিশরে মামলুকরা ক্ষমতা দখল করে এবং পূর্ব দিক থেকে মঙ্গোলরা ধেয়ে আসছিল, তখন আল-নাসির ইউসুফ বাগদাদের খলিফা আল-মুসতাসিমের কাছে সাহায্য এবং জোট গঠনের প্রস্তাব পাঠান। তিনি খলিফাকে সতর্ক করেছিলেন যে, মঙ্গোলরা বাগদাদ ধ্বংস করার পর সিরিয়াতেও আসবে। খলিফা আল-মুসতাসিম সিরিয়ার আইয়ুবিদ এবং মিশরের মামলুকদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য ১২৫৩ সালে বাগদাদ থেকে বিশেষ দূত পাঠিয়ে নাবুলুস চুক্তি (Treaty of Nablus) সম্পাদন করেন। খলিফার উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়া ও মিশরকে একত্রিত করে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বাফার জোন তৈরি করা। কিন্তু আল-নাসির ইউসুফ ছিলেন একজন দুর্বল এবং দোদুল্যমান শাসক। তিনি গোপনে মঙ্গোলদের সাথেও যোগাযোগ রাখছিলেন নিজের গদি বাঁচানোর জন্য, যা খলিফার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত, ১২৫৮ সালে বাগদাদের পতন এবং ১২৬০ সালে সিরিয়ায় মঙ্গোল আগ্রাসনের মাধ্যমে আব্বাসীয় এবং সিরিয়ার আইয়ুবিদ – উভয় শক্তিরই করুণ সমাপ্তি ঘটে।
আব্বাসীয়দের শেষ বসন্ত: আন-নাসিরের পুনজাগরণ এবং খাওয়ারিজমীয় জুয়া (১১৯৪–১২৫৮ খ্রি.)
১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ সেলজুক সুলতান তৃতীয় তুঘরিল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন, তখন আব্বাসীয় খিলাফত প্রায় দুই শতাব্দী পর প্রথমবারের মতো বিদেশি ‘অভিভাবকত্ব’ থেকে মুক্ত হয়। বাগদাদের খলিফারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, কেবল ধর্মীয় প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকলে সম্মান মিলবে, কিন্তু প্রাণ বাঁচানো কঠিন হবে। তাই এই শেষ অধ্যায়ে আমরা দেখি খলিফাদের হারানো রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের এক মরিয়া প্রচেষ্টা।
খলিফা আন-নাসির: শেষ মহান কৌশলী (১১৮০–১২২৫ খ্রি.): এই স্বল্পস্থায়ী পুনজাগরণের মূল স্থপতি ছিলেন খলিফা আন-নাসির লি-দিন আল্লাহ। তিনি আব্বাসীয় ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি এবং চতুর শাসক ছিলেন। আন-নাসির বুঝতে পেরেছিলেন, বড় কোনো বিদেশি শক্তির (যেমন সেলজুক) ওপর নির্ভর করা আত্মঘাতী। তাই তিনি ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ নীতি প্রয়োগ করেন। তিনি প্রথমে খাওয়ারিজম শাহদের সাথে জোট বেঁধে সেলজুকদের ইরাক থেকে বিতাড়িত করেন। এরপর তিনি বাগদাদ এবং এর আশেপাশের অঞ্চল নিয়ে একটি ছোট কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। আন-নাসির কেবল কূটনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি ‘ফুতুওয়াহ’ (Futuwwa) নামক আধ্যাত্মিক ও সামাজিক নাইটহুড (Knightly Order) সংস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি নিজেকে এই ফুতুওয়াহর সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করেন এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন আমির ও রাজাদের এই সংঘের সদস্য হতে বাধ্য করেন। এর মাধ্যমে তিনি খলিফার আধ্যাত্মিক আনুগত্যের সাথে একটি চেইন অব কমান্ড তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা ছিল তার রাজনৈতিক ক্ষমতার এক অভিনব হাতিয়ার।
খাওয়ারিজম শাহদের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ: সেলজুকদের পতনের পর মধ্য এশিয়া ও ইরানে নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য (Khwarazmian Empire)। তাদের শাসক আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তিনি নিজেকে ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ মনে করতেন এবং বাগদাদের খলিফার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাইতেন। খলিফা আন-নাসির তাকে বাগদাদে খুতবায় নিজের নাম উল্লেখ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। এর ফলে দুই মুসলিম শক্তির মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়। খাওয়ারিজম শাহ এমনকি খলিফাকে ধর্মতাত্ত্বিকভাবে অবৈধ ঘোষণা করে একজন শিয়া ইমামকে খলিফা হিসেবে দাঁড় করানোর হুমকিও দিয়েছিলেন। ১২১৭ সালে খাওয়ারিজম শাহ বাগদাদ আক্রমণের জন্য বিশাল বাহিনী পাঠান, কিন্তু জাগ্রোস পর্বতমালার ভয়াবহ তুষারঝড়ে তার সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। খলিফা আন-নাসির একে ‘ঐশ্বরিক সাহায্য’ বলে প্রচার করেন।
মঙ্গোল তাস এবং আত্মঘাতী কূটনীতি: ইতিহাসের এক বিতর্কিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো এই সময়ে মঙ্গোলদের সাথে আব্বাসীয়দের সম্পর্ক। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, খলিফা আন-নাসির তার প্রবল শত্রু খাওয়ারিজম শাহকে শায়েস্তা করার জন্য পূর্ব দিক থেকে উদীয়মান শক্তি চেঙ্গিস খানের সাথে গোপন যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, মঙ্গোলরা খাওয়ারিজমদের ধ্বংস করে ফিরে যাবে, আর বাগদাদ নিরাপদ থাকবে। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম বড় কৌশলগত ভুল বা স্ট্র্যাটেজিক ব্লান্ডার্স (Strategic Blunder)। মঙ্গোলরা খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল ঠিকই, কিন্তু তারা সেখানেই থামল না; তাদের লোলুপ দৃষ্টি শেষ পর্যন্ত বাগদাদের ঐশ্বর্যের ওপর পড়ল।
শেষের আগের প্রশান্তি: মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা এবং সাংস্কৃতিক জৌলুস: আন-নাসিরের মৃত্যুর পর তার পুত্র আল-জাহির এবং নাতি আল-মুসতানসির ক্ষমতায় আসেন। আল-মুসতানসিরের শাসনামল (১২২৬–১২৪২ খ্রি.) ছিল বাগদাদের জন্য এক আপেক্ষিক শান্তির সময়। তিনি ১২২৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা (Mustansiriya Madrasa), যা ছিল মধ্যযুগের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুন্নি ইসলামের চার মাজহাব পড়ানোর কেন্দ্র। এই সময় বাগদাদে আবারও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্থাপত্যের চর্চা বৃদ্ধি পায়। দেখে মনে হচ্ছিল আব্বাসীয়রা তাদের হৃত গৌরব ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এটি ছিল ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা।
আল-মুসতাসিম এবং চূড়ান্ত পতন: ১২৪২ সালে সর্বশেষ খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ ক্ষমতায় আসেন। তিনি তার প্রপিতামহ আন-নাসিরের মতো দূরদর্শী ছিলেন না। তিনি ছিলেন দুর্বল চিত্তের, কৃপণ এবং তার দরবার ছিল শিয়া-সুন্নি দাঙ্গায় বিভক্ত। যখন মঙ্গোল নেতা হালাকু খান পারস্যের আলামুত দুর্গ ধ্বংস করে বাগদাদের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখনো মুসতাসিম এবং তার সভাসদরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ব্যস্ত ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন মঙ্গোলরা হয়তো কেবল কর বা ট্রিবিউট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। ১১৯৪ থেকে শুরু হওয়া আব্বাসীয়দের এই ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ গড়ার স্বপ্ন ১২৫৮ সালে হালাকু খানের ঘোড়ার খুরের নিচে চূড়ান্তভাবে পিষ্ট হয়ে যায়।
সংক্ষেপে, ১১৯৪–১২৫৮ সময়কালটি ছিল আব্বাসীয়দের জন্য একটি ‘ফলস ডন’ (False Dawn) বা মিথ্যে ভোরের মতো। তারা সেলজুকদের থেকে মুক্তি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে তাদের ঘরের দরজায় এর চেয়েও ভয়াবহ এক প্রলয় কড়া নাড়ছে।
খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য ও আব্বাসীয় খিলাফত: আধিপত্যের সংঘাত এবং সর্বনাশা ভুল
এবার সেই খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানা যাক। আব্বাসীয় খিলাফতের শেষ অধ্যায়ে খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের (Khwarazmian Empire) সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার ধ্রুপদী উদাহরণ। সেলজুকদের পতনের পর মধ্য এশিয়া ও ইরানে খাওয়ারিজম শাহরা এক নতুন পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাদের উত্থান আব্বাসীয় খলিফা আন-নাসিরের জন্য ছিল শাঁখের করাত – সেলজুকদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও তিনি পড়লেন খাওয়ারিজমীয়দের উচ্চাভিলাষী থাবার নিচে। এই দুই সুন্নি শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস এবং অপরিণামদর্শী কূটনীতি শেষ পর্যন্ত মঙ্গোলদের পথ প্রশস্ত করে দেয়, যা ১২৫৮ সালের মহাবিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব: বাগদাদ বনাম গুরগঞ্জ: দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে খাওয়ারিজম শাহ দ্বিতীয় আলাউদ্দিন মুহাম্মদ (Ala ad-Din Muhammad II) নিজেকে ‘দ্বিতীয় আলেকজান্ডার’ বা সিকান্দার-ই-সানি (Sikandar-i-Sani) মনে করতেন। তার সাম্রাজ্য ট্রান্সঅক্সিয়ানা থেকে পারস্যের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি চাইতেন বাগদাদের খলিফা আন-নাসির তার রাজনৈতিক আধিপত্য বা টেম্পোরাল অথরিটি (Temporal Authority) মেনে নিক এবং বাগদাদের জুমার খুতবায় তার নাম উল্লেখ করুক। কিন্তু খলিফা আন-নাসির ছিলেন আব্বাসীয়দের শেষ মহান এবং স্বাধীনচেতা শাসক। তিনি খাওয়ারিজম শাহের এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। আন-নাসির মনে করতেন, খলিফা হলেন মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ নেতা, কোনো সুলতানের আজ্ঞাবহ হতে পারেন না। এই প্রত্যাখ্যান আলাউদ্দিন মুহাম্মদকে এতটাই ক্ষুব্ধ করে যে, তিনি খলিফা আন-নাসিরকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে একজন শিয়া ইমামকে (যিনি ছিলেন একজন আলাভি সাইয়িদ) খলিফা হিসেবে দাঁড় করানোর হুমকি দেন। এটি ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের বৈধতার বা লেজিটিমেসি (Legitimacy)-র প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
১২১৭ সালের ব্যর্থ অভিযান: প্রকৃতির প্রতিশোধ: ১২১৭ সালে খাওয়ারিজম শাহ আলাউদ্দিন মুহাম্মদ বাগদাদ আক্রমণ করে খলিফা আন-নাসিরকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হামাদান হয়ে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হন। খলিফা আন-নাসির তখন সামরিকভাবে দুর্বল ছিলেন, কিন্তু তিনি কূটনৈতিক চাল এবং আধ্যাত্মিক প্রভাব বা ফুতুওয়াহ (Futuwwa) ব্যবহার করে খাওয়ারিজম শাহকে থামানোর চেষ্টা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিই খলিফাকে রক্ষা করে। জাগ্রোস পর্বতমালার আসাদাবাদ গিরিপথে খাওয়ারিজমীয় সেনাবাহিনী এক ভয়াবহ তুষারঝড়ের কবলে পড়ে। হাজার হাজার সৈন্য ও ঘোড়া শীতে জমে মারা যায়। আলাউদ্দিন মুহাম্মদ এই দুর্যোগকে ‘ঐশ্বরিক শাস্তি’ মনে করে পিছু হটতে বাধ্য হন। খলিফা আন-নাসির এই ঘটনাকে তার আধ্যাত্মিক শক্তির বা কেরামত (Karamat)-এর প্রমাণ হিসেবে প্রচার করেন, যা তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী, কারণ দুই পক্ষের এই শত্রুতা ভবিষ্যতে এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।
মঙ্গোলদের আমন্ত্রণ: ইতিহাসের সর্বনাশা ভুল: খাওয়ারিজম শাহের সাথে খলিফা আন-নাসিরের দ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র ছিল যে, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, খলিফা তার শত্রুকে শায়েস্তা করার জন্য এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রচলিত ঐতিহাসিক মত অনুযায়ী, খলিফা আন-নাসির গোপনে মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এবং তাকে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য আক্রমণ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। খলিফা ভেবেছিলেন, মঙ্গোলরা খাওয়ারিজম শাহকে ধ্বংস করে তাদের লুটপাট নিয়ে ফিরে যাবে এবং বাগদাদ নিরাপদ থাকবে। এটি ছিল ব্যালেন্স অফ পাওয়ার (Balance of Power) রাজনীতির এক মারাত্মক ভুল বা মিসক্যালকুলেশন (Miscalculation)। ১ ২১৮ সালে খাওয়ারিজমীয় গভর্নর ইনালচুক যখন চেঙ্গিস খানের পাঠানো বাণিজ্যিক কাফেলা এবং দূতদের হত্যা করেন (ওতরারের ঘটনা), তখন চেঙ্গিস খান খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মঙ্গোল ঝড়ে খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। আলাউদ্দিন মুহাম্মদ প্রাণভয়ে কাস্পিয়ান সাগরের এক দ্বীপে পালিয়ে যান এবং সেখানেই মারা যান। তার পুত্র জালালউদ্দিন মিংবুরনু মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। খাওয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের এই পতন আব্বাসীয় খিলাফতের এবং মঙ্গোলদের মাঝখানের একমাত্র বাফার স্টেট বা বাফার জোন (Buffer Zone)-কে সরিয়ে দেয়। মঙ্গোলরা খাওয়ারিজম ধ্বংস করার পর থামেনি; তাদের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে বাগদাদ। খলিফা আন-নাসিরের ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ নীতি শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে এবং পুরো মুসলিম বিশ্বের ধ্বংস ডেকে আনে।
জালালউদ্দিনের শেষ চেষ্টা এবং বাগদাদের উদাসীনতা: জালালউদ্দিন মিংবুরনু যখন মঙ্গোলদের তাড়া খেয়ে পারস্য ও ইরাকের দিকে পালিয়ে আসছিলেন, তখন তিনি খলিফা আন-নাসির এবং তার পরবর্তী খলিফাদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, আব্বাসীয় এবং খাওয়ারিজমীয়রা মিলে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে একটি যৌথ ফ্রন্ট গঠন করুক। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফারা খাওয়ারিজমীয়দের এতটাই ঘৃণা করতেন এবং ভয় পেতেন যে, তারা জালালউদ্দিনকে সাহায্য করার বদলে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। খলিফারা মনে করতেন জালালউদ্দিন বাগদাদ দখল করতে আসছেন। এই পারস্পরিক অবিশ্বাস বা মিউচুয়াল ডিসট্রাস্ট (Mutual Distrust) মঙ্গোলদের কাজ সহজ করে দেয়। মঙ্গোলরা একে একে খাওয়ারিজমীয়দের এবং পরে আব্বাসীয়দের ধ্বংস করে। খাওয়ারিজমীয়-আব্বাসীয় সম্পর্ক আমাদের শেখায় যে, অস্তিত্বের সংকটের সময়ও যদি অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটমাট না করা যায়, তবে বাইরের শক্তির হাতে ধ্বংস অনিবার্য।
বাগদাদ ও কায়রো (১২৫০–১২৫৮): লিঙ্গ রাজনীতি এবং শেষ বিকেলের কূটনৈতিক লড়াই
১২৫০ থেকে ১২৫৮ সাল – এই সংক্ষিপ্ত আট বছরের সময়কালটি আব্বাসীয় এবং মামলুক সম্পর্কের ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে বাগদাদের খলিফা ছিলেন আল-মুসতাসিম (যিনি পরে মঙ্গোলদের হাতে নিহত হন) এবং মিশরে সদ্যই আইয়ুবিদ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মামলুকদের উত্থান ঘটছিল। এই সম্পর্কটি ছিল লিঙ্গ রাজনীতি (Gender Politics), বৈধতার সংকট এবং আসন্ন মঙ্গোল ঝড়ের এক জটিল সমীকরণ।
১২৫০ সালে মিশরের রাজনৈতিক পটভূমি আমূল বদলে যায়। আইয়ুবিদ সুলতান আল-সালিহ আইয়ুবের মৃত্যু এবং তার পুত্র তুরান শাহের হত্যাকাণ্ডের পর, মামলুক সেনাপতিরা তুরান শাহের সৎমা এবং সুলতানের বিধবা স্ত্রী শাজার আল-দুর (Shajar al-Durr)-কে মিশরের সুলতানা হিসেবে ঘোষণা করেন। মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এটি ছিল এক বিরল ঘটনা, যা বাগদাদের রক্ষণশীল খলিফা আল-মুসতাসিমের জন্য ছিল অগ্রহণযোগ্য।
শাজার আল-দুর এবং খলিফার সেই বিখ্যাত চিঠি: শাজার আল-দুর যখন কায়রোর মসনদে বসেন এবং তার নামে মুদ্রা জারি করেন, তখন বাগদাদের স্বীকৃতি খুব জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু খলিফা আল-মুসতাসিম একজন নারীকে মুসলিম উম্মাহর শাসক হিসেবে মেনে নিতে সরাসরি অস্বীকার করেন। তিনি কায়রোর মামলুক আমিরদের কাছে একটি অত্যন্ত অপমানজনক এবং ব্যঙ্গাত্মক চিঠি পাঠান, যা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন:
“যদি তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষ অবশিষ্ট না থাকে, তবে আমাদের জানাও, আমরা বাগদাদ থেকে তোমাদের জন্য পুরুষ পাঠিয়ে দেব।”
এই চিঠি ছিল খলিফার ‘সফট পাওয়ার’ বা নৈতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী। খলিফার এই কঠোর অবস্থানের কারণে মিশরের জনমত শাজার আল-দুরের বিরুদ্ধে চলে যায়। বাধ্য হয়ে শাজার আল-দুর মাত্র ৮০ দিন শাসনের পর পদত্যাগ করেন এবং মামলুক সেনাপতি ইজ্জউদ্দিন আইবেক (Aybak)-কে বিয়ে করে তাকে সুলতান ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, বাগদাদের খলিফার একটি চিঠি মিশরের সরকার পরিবর্তনে বাধ্য করেছিল।
আইবেক এবং বৈধতার সংকট (১২৫০–১২৫৭): ইজ্জউদ্দিন আইবেক যখন প্রথম মামলুক সুলতান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন তিনি ছিলেন এক গভীর সংকটে। তিনি ছিলেন একজন সাবেক ক্রীতদাস, তার রক্তে কোনো রাজকীয় আভিজাত্য ছিল না। সিরিয়ার আইয়ুবিদ শাসকরা (বিশেষ করে আন-নাসির ইউসুফ) তাকে জবরদখলকারী বলে ঘোষণা করেন। এই অবস্থায় আইবেকের জন্য খলিফা আল-মুসতাসিমের স্বীকৃতি বা ‘মানসুর’ (Investiture) ছিল জীবন-মরণ সমস্যা। আইবেক বাগদাদে প্রচুর উপঢৌকন এবং দূত পাঠান। খলিফা আল-মুসতাসিম শুরুতে দ্বিধায় ছিলেন, কারণ তিনি সিরিয়ার আইয়ুবিদদের সাথেও ভালো সম্পর্ক রাখতে চাইতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তববাদী রাজনীতি বা রিয়েলপলিটিকের কারণে খলিফা আইবেককে মিশরের সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। খলিফা বাগদাদ থেকে আইবেকের জন্য কালো পাগড়ি এবং রাজকীয় তরবারি পাঠান। এই স্বীকৃতি মামলুকদের শাসনকে ইসলামি আইনের দৃষ্টিতে ‘হালাল’ বা বৈধ করে দেয়।
খলিফার মধ্যস্থতা: সিরিয়া বনাম মিশর: ১২৫০ থেকে ১২৫৮ সালের মধ্যে মিশরের মামলুক এবং সিরিয়ার আইয়ুবিদদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। সিরিয়ার আইয়ুবিদ সুলতান আন-নাসির ইউসুফ কায়রো দখলের চেষ্টা করেন। খলিফা আল-মুসতাসিম বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করলে পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসা মঙ্গোলদের ঠেকানো যাবে না। তাই ১২৫৩ সালে খলিফা বাগদাদ থেকে তার বিশেষ দূত পাঠিয়ে মিশর ও সিরিয়ার মধ্যে শান্তি চুক্তি বা ‘নাবুলুস চুক্তি’ (Treaty of Nablus) সম্পাদন করেন। খলিফার মধ্যস্থতায় ঠিক হয় যে, মিশর মামলুকদের হাতে থাকবে এবং সিরিয়া আইয়ুবিদদের হাতে। খলিফার উদ্দেশ্য ছিল এই দুই শক্তিকে একত্রিত করে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে একটি যৌথ ফ্রন্ট বা ‘বাফার জোন’ তৈরি করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই চুক্তি ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর।
মঙ্গোল ভীতি এবং ব্যর্থ জোট: ১২৫৭ সালের দিকে যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করবেন, তখন খলিফা আল-মুসতাসিম কায়রোর মামলুকদের কাছে সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠান। মামলুক সুলতান তখন ছিলেন আইবেকের কিশোর পুত্র আল-মানসুর আলী (এবং তার অভিভাবক কুতুজ)। মামলুকরা খলিফার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাগদাদ রক্ষার জন্য কোনো সেনাবাহিনী পাঠাতে পারেনি। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল:
- প্রথমত, কায়রো থেকে বাগদাদের দূরত্ব এবং মাঝখানে শত্রুভাবাপন্ন সিরিয়ার আইয়ুবিদদের অবস্থান।
- দ্বিতীয়ত, মামলুকরা তখনো নিজেদের ঘরের শত্রু এবং ক্রুসেডারদের সামলাতে ব্যস্ত ছিল।
১২৫০–১২৫৮ সালের সম্পর্কটি ছিল “পারস্পরিক অবিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীলতা”। খলিফা মামলুকদের নিচু চোখে দেখতেন (দাস হওয়ার কারণে), কিন্তু সিরিয়ার আইয়ুবিদদের ব্যালেন্স করার জন্য তাদের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে মামলুকরা খলিফাকে তাদের ক্ষমতার বৈধতার উৎস মানত, কিন্তু বাগদাদ রক্ষার জন্য নিজেদের ঝুঁকি নিতে চায়নি। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, ১২৫৮ সালে মঙ্গোলরা যখন বাগদাদ ধ্বংস করে, তখন মামলুকরা কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু মাত্র দুই বছর পর ১২৬০ সালে সেই মামলুকরাই আইন জালুতের যুদ্ধে মঙ্গোলদের হারিয়ে বাগদাদের পতনের প্রতিশোধ নিয়েছিল এবং আব্বাসীয় বংশের এক সদস্যকে কায়রোতে এনে খিলাফত পুনরুজ্জীবিত করেছিল।
১২৫৮ সালের মহাপ্রলয়: বাগদাদের পতন এবং সভ্যতার যবনিকা
ইতিহাসের গতিপথ সর্বদা সরলরেখায় চলে না; কখনো কখনো এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন মহাকালের বিশাল চাকা হঠাৎ করে থেমে যায় এবং এক ভয়াবহ বাঁক নেয়। ১২৫৮ সাল ছিল আব্বাসীয় খিলাফত এবং সামগ্রিক ইসলামি সভ্যতার জন্য তেমনই এক মহাপ্রলয়ঙ্করী সন্ধিক্ষণ বা টিপিং পয়েন্ট (Tipping Point)। পূর্ব দিগন্ত থেকে ধেয়ে আসা মঙ্গোল বাহিনী কোনো সাধারণ শত্রু ছিল না; তারা ছিল প্রকৃতির রুদ্ররোষের মতো অপ্রতিরোধ্য, যাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ছিল না। চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খান (Hulagu Khan), যিনি তার বড় ভাই গ্রেট খান বা মঙ্গোল সম্রাট মংকু খানের আদেশে বিশ্বজয়ের নেশায় মত্ত ছিলেন, তার বিশাল বাহিনী নিয়ে বাগদাদের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হলেন। মঙ্গোলদের যুদ্ধকৌশল ছিল ত্রাস সৃষ্টি করা; তারা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ (Psychological Warfare)-এ এতটাই দক্ষ ছিল যে, তাদের আগমনের খবর শুনেই শত্রুপক্ষ মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে পড়ত। বাগদাদের পতনের আগে হালাকু খান পারস্যের দুর্ভেদ্য আলামুত দুর্গ ধ্বংস করে হাশাশিন বা অ্যাসাসিন (Assassins) সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন, যা ছিল বাগদাদের জন্য এক চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফা এবং তার পারিষদবর্গ সেই দেয়াললিখন পড়তে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মঙ্গোলরা তখন অপরাজেয় শক্তি, তাদের ঘোড়ার খুরের নিচে একের পর এক সমৃদ্ধ নগরী ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল, আর বাগদাদ ছিল তাদের তালিকার পরবর্তী শিকার। এই আগ্রাসন ছিল মূলত যাযাবর স্তেপ কৌশল (Nomadic Steppe Strategy) এবং চৈনিক প্রকৌশলবিদ্যার এক মারাত্মক সংমিশ্রণ, যার সামনে বাগদাদের প্রাচীন প্রাচীর ছিল নিতান্তই ঠুনকো।
তৎকালীন খলিফা আল-মুসতাসিম (Al-Musta’sim) ছিলেন আব্বাসীয় বংশের ৩৭তম শাসক, কিন্তু তার চরিত্রে আব্বাসীয়দের সেই তেজ বা প্রজ্ঞা কোনোটিই অবশিষ্ট ছিল না। তিনি ছিলেন দুর্বল চিত্তের, দাম্ভিক, অত্যন্ত কৃপণ এবং বাস্তবতাবর্জিত এক শাসক। তার দরবার ছিল শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে জর্জরিত। খলিফার প্রধান উজির ইবনে আল-আলকামি (যিনি শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন) এবং প্রধান সেনাপতি দাওয়াৎদার (যিনি সুন্নি ছিলেন) একে অপরের ঘোর শত্রু ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, উজির আলকামি গোপনে হালাকু খানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এবং খলিফাকে ভুল বুঝিয়েছিলেন, যা অভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাত (Internal Sabotage) হিসেবে কাজ করেছিল। খলিফার মন্ত্রীরা তাকে বারবার সতর্ক করেছিলেন যে মঙ্গোলদের সাথে কূটনৈতিক সমঝোতায় আসা উচিত অথবা যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কিন্তু খলিফা আল-মুসতাসিম এক ধরনের ধর্মীয় বিভ্রম বা থিওলজিক্যাল ডিলুশন (Theological Delusion)-এর মধ্যে বাস করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি ‘আমিরুল মুমিনিন’ বা বিশ্বাসীদের নেতা, তাই তার কোনো ক্ষতি হলে আল্লাহ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উল্টে দেবেন এবং মরক্কো থেকে খোরাসান পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব তাকে বাঁচাতে ছুটে আসবে। তিনি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার বদলে খরচ কমানোর জন্য সৈন্যদের ছাঁটাই করেছিলেন এবং রাজকোষে টাকা জমিয়ে রাখতেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, মঙ্গোলরা কোনো ধর্ম, খলিফা বা পবিত্রতাকে পরোয়া করে না; তারা কেবল শক্তি চেনে। আর ভূ-রাজনীতির বা জিওপলিটিক্স (Geopolitics)-এর নির্মম বাস্তবতা হলো, শক্তিহীনের কোনো বন্ধু থাকে না।
অবরোধ এবং দেয়ালের পতন: মৃত্যুর আলিঙ্গন
হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণের আগে খলিফাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে চরমপত্র পাঠান। খলিফা আল-মুসতাসিম তখনো নিজের অবস্থান সম্পর্কে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মঙ্গোলদের হুমকি দিয়ে পাল্টা চিঠি লেখেন, যা হালাকু খানকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। ১২৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে হালাকু তার বিশাল বাহিনী নিয়ে বাগদাদ অবরোধ করেন। এই বাহিনীতে কেবল মঙ্গোলরাই ছিল না, তাদের সাথে ছিল জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান এবং কিছু চীনা প্রকৌশলী, যারা অবরোধ যুদ্ধকৌশল (Siege Warfare)-এ পারদর্শী ছিল। তারা বাগদাদের চারপাশে গভীর পরিখা খনন করে এবং প্রাচীর ঘেরাও করে ফেলে, যাতে একটি পিঁপড়াও শহর থেকে বের হতে না পারে। মঙ্গোলরা পাম গাছ এবং পাথর ব্যবহার করে ক্যাটাপোল্ট বা ম্যাংগোনেলজ (Mangonels) তৈরি করে এবং বাগদাদের প্রাচীরের ওপর বৃষ্টির মতো পাথর ও ন্যাপথা বোমা বর্ষণ শুরু করে। খলিফা আল-মুসতাসিম তখন বুঝতে পারলেন বিপদ কত সন্নিকটে, কিন্তু তখন আর করার কিছুই ছিল না। আব্বাসীয় সেনাবাহিনী শহরের বাইরে এসে মঙ্গোলদের বাধা দেওয়ার এক ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। তারা দজলা বা টাইগ্রিস নদীর বাঁধ কেটে দিয়ে মঙ্গোল শিবির প্লাবিত করার চেষ্টা করে, কিন্তু মঙ্গোলরা দ্রুত উঁচু জায়গায় সরে যায় এবং আব্বাসীয় সৈন্যদের ফাঁদে ফেলে হত্যা করে। খলিফার সেনাবাহিনীর পতন ছিল দ্রুত এবং শোচনীয়।
অবশেষে, ৫২৪ বছরের পুরনো আব্বাসীয় রাজধানী তার ভাগ্য মেনে নিল। খলিফা আল-মুসতাসিম উপায়ন্তর না দেখে ১০ ফেব্রুয়ারি, ১২৫৮ সালে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন। তিনি তার পুত্র ও অমাত্যদের নিয়ে হালাকু খানের শিবিরে উপস্থিত হলেন। কিন্তু মঙ্গোলদের নীতি ছিল – শত্রু যখন আত্মসমর্পণ করে, তখন তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ মাথা তোলার সাহস না পায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গোল বাহিনী বাগদাদ শহরে প্রবেশ করল এবং শুরু হলো ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা (Genocide)। মঙ্গোল সৈন্যরা শহরের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি ঘরে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালাল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ – কাউকে রেহাই দেওয়া হলো না। বাগদাদের বিখ্যাত মসজিদ, প্রাসাদ এবং হাসপাতালগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। ঐতিহাসিকদের মতে, এই হত্যাযজ্ঞে প্রায় ২ থেকে ৮ লাখ (কারো কারো মতে ১০ লাখেরও বেশি) মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বাগদাদের রাস্তাগুলো লাশের স্তূপে ভরে গেল, পচা লাশের গন্ধে বাতাস এতটাই ভারী হয়ে উঠল যে, হালাকু খানকে শহরের বাইরে শিবির স্থাপন করতে হয়েছিল। জর্জিয়ান খ্রিস্টান সৈন্যরা, যারা মঙ্গোলদের সহযোগী ছিল, তারা তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় আক্রোশ মেটানোর জন্য বাগদাদের মুসলমানদের ওপর বিশেষ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল। আব্বাসীয়দের গর্বের ধন বাগদাদ, যা একসময় ‘শহরগুলোর মা’ বলা হতো, তা পরিণত হলো এক ভুতুড়ে শ্মশানে। এই ধ্বংসলীলা ছিল টোটাল ওয়ার (Total War) বা সর্বাত্মক যুদ্ধের এক নৃশংস দৃষ্টান্ত (Amitai-Preiss, 1995)।
দজলার কালো জল: জ্ঞানতাত্ত্বিক গণহত্যা
বাগদাদের পতনে সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতিটি কোনো মানুষের মৃত্যু ছিল না, তা ছিল জ্ঞানের মৃত্যু। মঙ্গোলরা বাগদাদের গর্ব বায়তুল হিকমাহ (House of Wisdom) এবং অন্যান্য অসংখ্য লাইব্রেরিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই লাইব্রেরিগুলোতে সঞ্চিত ছিল গ্রিক, পারসিক, ভারতীয় এবং আরব পণ্ডিতদের শত শত বছরের গবেষণালব্ধ জ্ঞান। গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্যের হাজার হাজার দুর্লভ পাণ্ডুলিপি বা ম্যানুস্ক্রিপ্ট (Manuscript) মঙ্গোলরা দজলা (টাইগ্রিস) নদীতে ফেলে দেয়। কথিত আছে, দজলা নদীর জল প্রথমে মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল, আর পরে বইয়ের কালিতে কালো হয়ে গিয়েছিল। একে আধুনিক পরিভাষায় বলা যায় জ্ঞানতাত্ত্বিক গণহত্যা (Epistemicide) – অর্থাৎ একটি জাতির জ্ঞানভাণ্ডার ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্মৃতিকে মুছে ফেলা। নাসির আল-দিন আল-তুসি, যিনি হালাকু খানের সাথে ছিলেন এবং একজন বিখ্যাত পারসিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তিনি কিছু বই রক্ষা করতে পেরেছিলেন, কিন্তু যা হারিয়ে গেল তার পরিমাণ ছিল অকল্পনীয়। এরিস্টটলের অনেক অনুবাদ, আল-খোয়ারিজমির মূল পাণ্ডুলিপি, এবং আল-রাজি ও ইবনে সিনার অনেক কাজ চিরতরে হারিয়ে গেল। মঙ্গোলরা বইগুলোর চামড়ার মলাট ছিঁড়ে তাদের সৈন্যদের জুতোর তলা বানিয়েছিল এবং দর্শনের মহামূল্যবান বইগুলো দিয়ে আস্তাবলের আগুন জ্বালিয়েছিল। মানব সভ্যতার এই ক্ষতি আজও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয় এবং এক দীর্ঘমেয়াদি বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার সূচনা করে।
খলিফার মৃত্যু: স্বর্ণভোজের উপকথা এবং রাজরক্তের কুসংস্কার
খলিফা আল-মুসতাসিমের মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসে নানা নাটকীয় এবং মর্মান্তিক বিবরণ পাওয়া যায়। মঙ্গোলদের একটি বিশেষ কুসংস্কার বা শামানিস্টিক বিশ্বাস (Shamanistic Belief) ছিল যে, কোনো রাজবংশের শাসক বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তির রক্ত মাটিতে ফেলা অশুভ লক্ষণ, এতে আকাশ ও পৃথিবীর আত্মারা রুষ্ট হয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। তাই হালাকু খান খলিফাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করতে চাননি। সর্বাধিক প্রচলিত মত অনুযায়ী, খলিফাকে একটি কার্পেট বা কম্বলে মুড়িয়ে নেওয়া হয় এবং এরপর তার ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে দেওয়া হয়। ঘোড়ার পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে খলিফা মারা যান, কিন্তু তার রক্ত মাটিতে পড়েনি। এটি ছিল মঙ্গোলদের চোখে ‘সম্মানজনক’ মৃত্যু, কিন্তু আব্বাসীয়দের জন্য ছিল চূড়ান্ত অপমান। আরেকটি বিখ্যাত উপকথা বা মিথ (Myth) আছে খলিফার মৃত্যু নিয়ে। বলা হয়, হালাকু খান খলিফাকে একটি মিনারে বা প্রাসাদে আটকে রেখেছিলেন এবং তাকে কোনো খাবার না দিয়ে কেবল তার জমানো সোনা ও রত্নরাজি সামনে রেখে দিয়েছিলেন। খলিফা যখন ক্ষুধার্ত হয়ে খাবারের জন্য মিনতি করছিলেন, তখন হালাকু খান নাকি তাকে বলেছিলেন, “তুমি এই সোনা দিয়ে সৈন্য না বানিয়ে জমিয়ে রেখেছ কেন? এখন এই সোনা খাও।” খলিফা উত্তর দিয়েছিলেন, “সোনা তো খাওয়া যায় না।” তখন হালাকু বলেছিলেন, “তাহলে এই সোনা জমিয়ে রেখে তোমার লাভ কী হলো?” এই ঘটনাটি সত্য হোক বা রূপক, এটি আব্বাসীয় খলিফার মিসম্যানেজমেন্ট (Mismanagement) বা অব্যবস্থাপনা এবং কৃপণতার প্রতি এক ঐতিহাসিক ব্যঙ্গ।
খলিফার মৃত্যুর সাথে সাথে আব্বাসীয় পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকেই হত্যা করা হয়। কেবল খলিফার এক কনিষ্ঠ পুত্রকে মঙ্গোলরা বাঁচিয়ে রাখে এবং তাকে মঙ্গোলীয় এক নারীর সাথে বিয়ে দেয়, যদিও ইতিহাসে তাদের আর কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। আব্বাসীয় খলিফার পতন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীকী সমাপ্তি ঘোষণা করে। বাগদাদের পতনের পর খিলাফত ব্যবস্থা তার সর্বজনীনতা হারিয়ে ফেলে। যদিও পরে মিশরের মামলুক সুলতানরা আব্বাসীয় বংশের এক আত্মীয়কে কায়রোতে নামমাত্র খলিফা হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল কেবল মামলুক শাসনের বৈধতা বা লেজিটিমেসি (Legitimacy) আদায়ের কৌশল। ৫২৪ বছর ধরে যে পরিবারটি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের সমাপ্তি ঘটল ধুলো, রক্ত আর অপমানের এক বিষাদময় উপাখ্যানের মাধ্যমে। ১২৫৮ সালের পর মুসলিম বিশ্ব আর কখনোই এককেন্দ্রিক শক্তির অধীনে আসতে পারেনি, এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই স্বর্ণযুগ আর ফিরে আসেনি (Morgan, 1988)।
ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন মেরুকরণ
বাগদাদের পতন ছিল মধ্যযুগীয় ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি আব্বাসীয়দের বিলাসিতা, প্রজা-বিচ্ছিন্নতা এবং সামরিক দুর্বলতার চরম মূল্য ছিল। তবে এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছিল। বাগদাদের পতনের মাত্র দুই বছর পর, ১২৬০ সালে, এই অপরাজেয় মঙ্গোল বাহিনী ফিলিস্তিনের আইন জালুতের যুদ্ধে (Battle of Ain Jalut) মিশরের মামলুক বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এটি ছিল মঙ্গোলদের অগ্রযাত্রা থামানোর প্রথম বড় ঘটনা। বাগদাদ ধ্বংস হলেও ইসলামি সভ্যতা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি; এর ভরকেন্দ্র বাগদাদ থেকে সরে গিয়ে কায়রো এবং ইস্তাম্বুলের দিকে ধাবিত হয়। আব্বাসীয়দের পতন আমাদের শেখায় যে, সভ্যতা কেবল অতীত গৌরবের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। জ্ঞান, সামরিক শক্তি এবং ন্যায়বিচারের সমন্বয় না থাকলে, সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্যও বাইরের আঘাতে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে। হালাকু খানের ঘোড়ার খুর বাগদাদের মাটি রক্তাক্ত করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই রক্তস্রোত ইতিহাসের পাতায় লিখে দিয়ে গেছে এক চিরন্তন সত্য – অহংকার এবং অযোগ্যতা যখন শাসকের সঙ্গী হয়, তখন পতন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
১২৫৮ থেকে ১২৬১: শূন্যতার হাহাকার এবং মঙ্গোল মিথের পতন
১২৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মঙ্গোল ইলখানাতের প্রতিষ্ঠাতা হালাকু খানের হাতে আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদের পতন ছিল মুসলিম ইতিহাসের এক মহাবিপর্যয় বা ক্যাটাক্লিজম (Cataclysm)। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো খিলাফতের ধ্বংস এবং খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহর নির্মম হত্যাকাণ্ড মুসলিম বিশ্বকে এক গভীর অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয়। বাগদাদ পতনের পরবর্তী তিন বছর (১২৫৮–১২৬১ খ্রি.) ছিল সুন্নি মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অসহনীয় ইন্টাররেগনাম (Interregnum) বা অন্তর্বর্তীকালীন সময়। এই সময়ে জুমার খুতবাগুলোতে খলিফার নামের জায়গায় এক নিস্তব্ধ নীরবতা পালন করা হতো, যা ছিল শরিয়াহ এবং সুন্নি রাজনৈতিক তত্ত্বে এক বিশাল আইনি শূন্যতা। কারণ, ধ্রুপদী সুন্নি মতবাদ অনুযায়ী ইমাম বা খলিফা ছাড়া ইসলামি সমাজ বা রাষ্ট্র বৈধভাবে চলতে পারে না। মঙ্গোলরা যখন একের পর এক শহর ধ্বংস করে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের দিকে ধেয়ে আসছিল, তখন মনে হচ্ছিল ইসলামি সভ্যতার সূর্য হয়তো চিরতরে অস্তমিত হতে চলেছে। দামেস্ক ও আলেপ্পোর পতন ঘটেছিল বিদ্যুৎগতিতে, এবং মুসলিম বিশ্বের শেষ দুর্গ হিসেবে অবশিষ্ট ছিল কেবল মিশরের মামলুক সালতানাত। এই চরম হতাশা ও নৈরাজ্যের মধ্যেই সংঘটিত হয় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক ঘটনা – আইন জালুতের যুদ্ধ, যেখানে মঙ্গোলদের অপরাজেয়তার মিথ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
মঙ্গোল আগ্রাসনের শেষ ঢেউ: সিরিয়ার পতন এবং কুতুজের উত্থান
বাগদাদ ধ্বংসের পর হালাকু খান তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন সিরিয়া ও মিসরের দিকে। ১২৬০ সালের শুরুতে মঙ্গোল বাহিনী ফোরাত নদী অতিক্রম করে এবং আলেপ্পো ও দামেস্ক দখল করে নেয়। সিরিয়ার আইয়ুবিদ শাসকরা মঙ্গোলদের সামনে কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি; বরং অনেকেই মঙ্গোলদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। মঙ্গোল সেনাপতি কিতবুকা নোয়ান, যিনি ছিলেন একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান, দামেস্কে প্রবেশ করে সেখানকার উমাইয়া মসজিদে মঙ্গোলদের বিজয় ঘোষণা করেন। মঙ্গোলদের এই অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার মুখে মিশরের মামলুক সালতানাত ছিল অস্তিত্বের হুমকিতে। সেই সময় মিশরের সুলতান ছিলেন কিশোর আল-মানসুর আলী, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল তার অভিভাবক বা ‘আতাবাউ’ সাইফউদ্দিন কুতুজ (Saif ad-Din Qutuz)-এর হাতে। কুতুজ ছিলেন একজন বিচক্ষণ এবং সাহসী নেতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের প্রয়োজন। তাই তিনি কিশোর সুলতানকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন এবং সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হন। কুতুজ জানতেন যে মঙ্গোলরা শীঘ্রই মিশরের দরজায় কড়া নাড়বে। হালাকু খান কুতুজের কাছে এক ভয়াবহ ও অপমানজনক চিঠি পাঠান, যাতে লেখা ছিল:
“আমরা ঈশ্বরের তলোয়ার। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ক্রোধ থেকে এবং আমাদের পাঠিয়েছেন তাদের ওপর যারা তার অবাধ্য হয়েছে… আমাদের ঘোড়াগুলো বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন, আমাদের তরবারি বজ্রের মতো… তোমরা কোথায় পালাবে? আকাশ ও পৃথিবী আমাদের নিয়ন্ত্রণে।”
কুতুজ এই চিঠির উত্তর দেন মঙ্গোল দূতদের মাথা কেটে এবং কায়রোর জাওইলা গেটে ঝুলিয়ে দিয়ে। এটি ছিল মঙ্গোলদের প্রতি এক সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। কুতুজ জানতেন, এই লড়াইয়ে হয় জিততে হবে, নয়তো নিশ্চিহ্ন হতে হবে। তিনি মিশরের জনগণকে জিহাদের ডাক দেন এবং সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা আইয়ুবিদ ও মামলুক সৈন্যদের একত্রিত করেন। তার সাথে যোগ দেন আরেক মামলুক সেনাপতি রুকনউদ্দিন বাইবার্স, যিনি মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসামান্য রণকৌশল জানতেন।
আইন জালুতের যুদ্ধ: যেখানে ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়েছিল (১২৬০ খ্রি.)
১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনের গ্যালিলি অঞ্চলের আইন জালুত (Ain Jalut) বা ‘গোলিয়াথের ঝর্ণা’ নামক স্থানে মঙ্গোল ও মামলুক বাহিনী মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধটি ছিল বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বা টার্নিং পয়েন্ট (Turning Point), কারণ এর আগে মঙ্গোলরা কখনো এত বড় পরাজয়ের স্বাদ পায়নি। যুদ্ধের সময় হালাকু খান নিজে উপস্থিত ছিলেন না; তিনি মঙ্গোলিয়ায় গ্রেট খান মংকু খানের মৃত্যু এবং উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে বা কুরালতাই (Kurultai)-এ যোগ দেওয়ার জন্য মূল বাহিনী নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি সিরিয়ায় রেখে গিয়েছিলেন তার বিশ্বস্ত সেনাপতি কিতবুকা নোয়ান এবং প্রায় ১০–২০ হাজার সৈন্যের একটি তুমান। মামলুক বাহিনী সংখ্যায় কিছুটা বেশি ছিল, কিন্তু মঙ্গোলদের রণকৌশল ও ভীতি ছিল তাদের প্রধান শক্তি।
মামলুক সেনাপতি বাইবার্স এক চতুর রণকৌশল বা ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট (Tactical Retreat) বা ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। তিনি তার বাহিনীর একটি অংশ নিয়ে মঙ্গোলদের আক্রমণ করে এবং ভান করে পিছু হটতে শুরু করেন। কিতবুকা মনে করলেন মামলুকরা পালিয়ে যাচ্ছে, তাই তিনি তাদের ধাওয়া করতে করতে উপত্যকার গভীরে ঢুকে পড়েন। সেখানে আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা কুতুজের মূল বাহিনী মঙ্গোলদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। মামলুকরা প্রথমবারের মতো যুদ্ধে হ্যান্ড ক্যানন (Hand Cannon) বা আদিম আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে, যা মঙ্গোল ঘোড়াগুলোকে আতঙ্কিত করে তোলে। এক পর্যায়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং মঙ্গোলরা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সুলতান কুতুজ নিজের হেলমেট খুলে সৈন্যদের উৎসাহিত করতে থাকেন এবং চিৎকার করে বলেন, “ওয়া ইসলামাহ!” (হায় ইসলাম!)। শেষ পর্যন্ত মঙ্গোল বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং তাদের সেনাপতি কিতবুকা নোয়ান যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দি হয়ে নিহত হন। এই বিজয় কেবল মিশরকে রক্ষা করেনি, এটি মঙ্গোলদের অপরাজেয়তার মিথ বা মিথ অফ ইনভিসিবিলিটি (Myth of Invincibility) ভেঙে দেয় এবং ইসলামি বিশ্বকে পুনরুজ্জীবিত করে।
বিজয়ের পরের ট্র্যাজেডি: বাইবার্সের উত্থান
আইন জালুতের বিজয়ের পর কুতুজ যখন বিজয়ী বেশে কায়রোতে ফিরছিলেন, তখন পথিমধ্যে এক শিকারি অভিযানের সময় তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন রুকনউদ্দিন বাইবার্স। বাইবার্স মনে করতেন যুদ্ধের বিজয়ে তার অবদান কুতুজের চেয়ে কম ছিল না, কিন্তু কুতুজ তাকে প্রতিশ্রুত আলেপ্পোর শাসনভার দেননি। কুতুজের মৃত্যুর পর বাইবার্স মিশরের নতুন সুলতান হন। বাইবার্সের শাসনকাল (১২৬০–১২৭৭ খ্রি.) ছিল মামলুক সালতানাতের স্বর্ণযুগ। তিনি আইন জালুতের বিজয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। বাইবার্স বুঝতে পেরেছিলেন যে, মঙ্গোলরা আবার ফিরে আসবে, তাই তিনি সিরিয়া ও মিশরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ফর্টিফিকেশন (Fortification) শক্তিশালী করেন এবং ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধেও অভিযান শুরু করেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মাস্টারস্ট্রোক ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের পুনরুজ্জীবন।
১২৬১ সালের পুনর্জাগরণ: শূন্যতার অবসান
১২৫৮ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব ছিল খলিফাবিহীন। বাইবার্স জানতেন, তার শাসনকে বৈধতা দিতে এবং মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে একজন খলিফার প্রয়োজন। ১২৬১ সালে তিনি বাগদাদ থেকে পালিয়ে আসা আব্বাসীয় রাজপুত্র আবুল কাসিম আহমদকে কায়রোতে নিয়ে আসেন এবং তাকে দ্বিতীয় আল-মুসতানসির নামে খলিফা ঘোষণা করেন। এই ঘটনার মাধ্যমে বাগদাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে আব্বাসীয় খিলাফত কায়রোতে পুনর্জন্ম লাভ করে। যদিও এটি ছিল একটি ছায়া খিলাফত (Shadow Caliphate), তবুও এটি সুন্নি মুসলিমদের মনে আশার সঞ্চার করে এবং মামলুক সালতানাতকে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শক্তি জোগায়। আইন জালুতের বিজয় এবং খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা – এই দুটি ঘটনা মিলে ১২৫৮ সালের মহাবিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে নিতে মুসলিম বিশ্বকে সাহায্য করে এবং ইসলামি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়।
আব্বাসীয় ও মামলুক: কায়রোর ছায়া খিলাফত এবং বৈধতার নাটক (১২৬১–১৫১৭ খ্রি.)
১২৫৮ সালে মঙ্গোল নেতা হালাকু খানের নির্মম আগ্রাসনে বাগদাদের পতন কেবল একটি নগরীর ধ্বংস ছিল না, এটি ছিল সুন্নি ইসলামি বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি। বাগদাদের খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংকট তৈরি হয়েছিল, তা মুসলিম উম্মাহর মনস্তত্ত্বে গভীর ক্ষতের জন্ম দেয়। সুন্নি রাজনৈতিক তত্ত্বে বা সুন্নি পলিটিক্যাল থিওরি (Sunni Political Theory)-তে ইমাম বা খলিফার উপস্থিতি অপরিহার্য; কারণ খলিফা ছাড়া জুমার নামাজ, বিচারকার্য এবং জিহাদ আইনত সিদ্ধ হয় না। বাগদাদের পতনের পর দীর্ঘ তিন বছর মুসলিম বিশ্ব ছিল মস্তকহীন, জুমার খুতবাগুলোতে খলিফার নামের জায়গায় নীরবতা পালন করা হতো, যা ছিল এক অশুভ ইঙ্গিত। এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাগদাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে আব্বাসীয় খিলাফত মিশরের কায়রোতে একটি ‘ফিনিক্স পাখির’ মতো পুনর্জন্ম লাভ করে। তবে এই পুনর্জন্ম কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল মামলুক সুলতানদের সুচতুর বাস্তববাদী রাজনীতি (Realpolitik) এবং বৈধতার সংকট (Crisis of Legitimacy) মোচনের এক পরিকল্পিত নাটক। কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত এই খিলাফত বাগদাদের মতো সার্বভৌম ছিল না; এটি ছিল মামলুক সালতানাতের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা এক ছায়া খিলাফত (Shadow Caliphate), যেখানে খলিফা ছিলেন ঐশ্বরিক প্রতীকের আড়ালে এক ক্ষমতাহীন সত্তা।
বাইবার্স এবং খিলাফতের পুনরুজ্জীবন: রাজনীতির নতুন সমীকরণ (১২৬১ খ্রি.)
মিশরের মামলুকরা ছিল মূলত কিপচাক বা তুর্কি বংশোদ্ভূত ক্রীতদাস যোদ্ধা, যারা তাদের আইয়ুবিদ প্রভুদের হত্যা করে বা সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল। ইসলামি আইন এবং মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্রীতদাসদের শাসন করার কোনো বংশগত বা ঐশ্বরিক অধিকার (Divine Right) ছিল না। সাধারণ জনগণ এবং সিরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী আইয়ুবিদ শাসকরা মামলুকদের দেখত ‘জবরদখলকারী’ হিসেবে। মামলুক সুলতান রুকনউদ্দিন বাইবার্স (Rukn al-Din Baybars) ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ১২৬০ সালে আইন জালুতের যুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজিত করে তিনি হয়তো সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বা মিলিটারি সুপ্রিমেসি (Military Supremacy) প্রমাণ করেছেন, কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হতে হলে তার প্রয়োজন ধর্মীয় অনুমোদন। নিজের রক্তে কুরাইশ বংশের আভিজাত্য না থাকায়, তিনি বাগদাদ থেকে পালিয়ে আসা আব্বাসীয় রাজপুত্র আবুল কাসিম আহমদকে (যিনি খলিফা আল-জহিরের পুত্র এবং আল-মুসতাসিমের আংকল ছিলেন) কায়রোতে আমন্ত্রণ জানান।
১২৬১ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যা মামলুক ও আব্বাসীয়দের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে। বাইবার্স অত্যন্ত চতুরতার সাথে এই অনুষ্ঠানটি সাজিয়েছিলেন। তিনি এবং তার প্রধান কাজীরা প্রথমে আবুল কাসিম আহমদের বংশপরিচয় যাচাই করেন এবং তাকে বাগদাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত খিলাফতের বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এরপর তাকে দ্বিতীয় আল-মুসতানসির (Al-Mustansir II) উপাধিতে ভূষিত করে খলিফা ঘোষণা করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বাইবার্স নিজে খলিফার হাতে বাইয়াত (Oath of Allegiance) বা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। এটি ছিল এক বিশাল রাজনৈতিক চাল; কারণ খলিফার কাছে শপথ নেওয়ার মাধ্যমে বাইবার্স নিজেকে খলিফার ‘প্রতিনিধি’ বা ডেপুটি (Deputy) হিসেবে উপস্থাপন করলেন, অথচ বাস্তবে তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। বিনিময়ে খলিফা আল-মুসতানসির বাইবার্সকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সুলতান’ উপাধি দেন এবং তাকে মিশর, সিরিয়া, হিজাজ, ইয়েমেন এবং দিয়ারবকর শাসনের অধিকার বা ইনভেস্টিচার (Investiture) প্রদান করেন। বাইবার্স খলিফার নাম নিজের মুদ্রায় খোদাই করেন এবং জুমার খুতবায় খলিফার নাম উল্লেখ করার নির্দেশ দেন। এই পারস্পরিক লেনদেন বা সিমবায়োটিক রিলেশনশিপ (Symbiotic Relationship) মামলুক সালতানাতকে এক শক্তিশালী ধর্মীয় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়, যা তাদের আইয়ুবিদ এবং মঙ্গোল প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে নৈতিকভাবে এগিয়ে রাখে।
সোনার খাঁচার পাখি: কর্তৃত্বহীনতার ট্র্যাজেডি
কায়রোতে আব্বাসীয় খিলাফতের পুনর্জন্ম হলেও, এর প্রকৃতি বাগদাদের খিলাফতের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। বাগদাদে খলিফারা, এমনকি বুয়াইদ বা সেলজুকদের আমলেও, অন্তত নিজেদের প্রাসাদের ভেতরে স্বাধীন ছিলেন এবং তাদের নিজস্ব উজির ও অমাত্য বাহিনী ছিল। কিন্তু কায়রোতে খলিফাদের অবস্থান ছিল মামলুক সুলতানদের হাতের পুতুল বা পাপেট রুলার (Puppet Ruler)-এর মতো। সুলতানরা খলিফাদের ব্যবহার করতেন কেবল তাদের শাসনের ওপর ধর্মীয় সিলমোহর বসানোর জন্য। খলিফাদের কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল না, কোনো রাজকোষ ছিল না, এবং প্রশাসনিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। তারা কায়রো দুর্গের (Citadel of Cairo) একটি নির্দিষ্ট অংশে বসবাস করতেন, যা ছিল মূলত একটি বিলাসবহুল কারাগার বা গিল্ডেড কেজ (Gilded Cage)। তাদের চলাফেরা ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং সুলতানের অনুমতি ছাড়া তারা জনসমক্ষে আসতে পারতেন না। সুলতানরা খলিফাদের কেবল বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় উৎসব, যেমন – নতুন চাঁদ দেখা, ঈদের নামাজ, অথবা কোনো নতুন সুলতানের অভিষেক অনুষ্ঠানে ‘পবিত্র বস্তু’ হিসেবে প্রদর্শন করতেন।
এই ক্ষমতাহীনতার সবচেয়ে করুণ দৃষ্টান্ত দেখা যায় প্রথম কায়রো আব্বাসীয় খলিফা দ্বিতীয় আল-মুসতানসিরর ক্ষেত্রে। খলিফা হওয়ার পর তিনি বাইবার্সের কাছে বাগদাদ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সেনাবাহিনী দাবি করেন। বাইবার্স একজন অত্যন্ত বাস্তববাদী শাসক ছিলেন; তিনি জানতেন যে বাগদাদে একজন শক্তিশালী খলিফা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলে তা মামলুকদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বাইবার্স চেয়েছিলেন খলিফা তার হাতের মুঠোয় থাকুক, বাগদাদের সিংহাসনে নয়। তাই তিনি লোকদেখানো বা টোকেন সাপোর্ট (Token Support) হিসেবে খলিফাকে মাত্র ৩০০০ বেদুইন সৈন্যের একটি ছোট বাহিনী দিয়ে ইরাকের দিকে পাঠিয়ে দেন। বাইবার্স জানতেন যে মঙ্গোলদের বিশাল বাহিনীর সামনে এই ক্ষুদ্র দল টিকতে পারবে না। তার ধারণাই সত্য হয়; খলিফা আল-মুসতানসির হিট নামক স্থানে মঙ্গোলদের অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন। বাইবার্স খলিফাকে বাঁচাতে কোনো অতিরিক্ত সাহায্য পাঠাননি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এটি ছিল বাইবার্সের এক ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা – একজন উচ্চাভিলাষী খলিফাকে সরিয়ে দেওয়া, যাতে পরবর্তী খলিফারা মামলুকদের ভয়ে থাকে। এরপর বাইবার্স আরেকজন আব্বাসীয় রাজপুত্র আবুল আব্বাস আহমদকে প্রথম আল-হাকিম (Al-Hakim I) নামে খলিফা নিয়োগ করেন এবং তাকে কড়া নজরদারিতে দুর্গের ভেতরে আটকে রাখেন। আল-হাকিম এবং তার পরবর্তী বংশধররা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বেঁচে থাকতে হলে সুলতানের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং ‘সফট পাওয়ার’ ডিপ্লোম্যাসি
মামলুক সুলতানরা যদিও খলিফাকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতাহীন করে রেখেছিলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা খলিফাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করতেন। আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন মামলুকদের সফট পাওয়ার (Soft Power) বা নম্র শক্তির প্রধান উৎস। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্বাধীন সুলতানরা, যারা নিজেদের শাসনের বৈধতা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তারা কায়রোর খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতি বা ম্যানডেট (Mandate) পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকতেন। দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক এবং ফিরোজ শাহ তুঘলক তাদের মুদ্রায় কায়রোর আব্বাসীয় খলিফার নাম খোদাই করেছিলেন এবং খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতিপত্র ও কালো চাদর বা রোব অফ অনার (Robe of Honor) পাওয়ার পর বিশাল উৎসব করেছিলেন। এমনকি মঙ্গোল গোল্ডেন হোর্ডের (Golden Horde) শাসক বারকে খান, যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও কায়রোর খলিফার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন।
এই কূটনৈতিক নাটক মামলুকদের মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। খলিফাকে নিজেদের জিম্মায় রাখার মাধ্যমে মামলুকরা বহির্বিশ্বে প্রমাণ করত যে, কায়রোই এখন মুসলিম বিশ্বের আধ্যাত্মিক রাজধানী এবং মামলুক সুলতানরাই হলেন ‘ইসলামের রক্ষক’ বা গার্ডিয়ান অফ ইসলাম (Guardian of Islam)। যখনই কোনো বিদেশী মুসলিম শাসকের দূত কায়রোতে আসত, সুলতান খলিফাকে পাশে বসিয়ে দরবার সাজাতেন, যাতে আগত দূতরা বুঝতে পারে যে সুলতানের পেছনে খলিফার ঐশ্বরিক সমর্থন রয়েছে। এটি ছিল মামলুকদের পলিটিক্যাল থিয়োলজি (Political Theology) বা রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তাদের প্রায় আড়াইশো বছর ধরে মুসলিম বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে টিকিয়ে রেখেছিল।
ব্যতিক্রমী ঘটনা: খলিফা যখন সুলতান (১৪১২ খ্রি.)
দীর্ঘ আড়াইশো বছরের মামলুক-আব্বাসীয় সম্পর্কের ইতিহাসে একবারের জন্য চাকা উল্টো দিকে ঘুরেছিল। ১৪১২ সালে মামলুক সালতানাতে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বা ফিতনা (Fitna) দেখা দেয়। বুরজি মামলুক সুলতান আল-নাসির ফারাজের হত্যার পর মামলুক আমিররা নিজেদের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হন। গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য আমিররা সাময়িকভাবে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতাইন (Al-Musta’in)-কে সুলতান হিসেবে ঘোষণা করতে সম্মত হন। ইতিহাসে এটিই একমাত্র ঘটনা যেখানে একজন ব্যক্তি একই সাথে ‘খলিফা’ এবং ‘সুলতান’ – উভয় পদের অধিকারী ছিলেন। আল-মুসতাইন শর্ত দিয়েছিলেন যে, তাকে সুলতানের পদ থেকে সরিয়ে দিলেও খলিফার পদে বহাল রাখতে হবে।
খলিফা আল-মুসতাইন প্রায় ছয় মাস মিশরের সুলতান হিসেবে শাসন করেন। তিনি নিজস্ব মুদ্রা জারি করেন এবং উজির নিয়োগ দেন। কিন্তু মামলুক সামরিক অভিজাততন্ত্র বা মিলিটারি অলিগার্কি (Military Oligarchy) একজন বেসামরিক এবং আরব বংশোদ্ভূত শাসকের অধীনে বেশিদিন থাকতে রাজি ছিল না। মামলুক আমির শাইখ আল-মাহমুদি দ্রুত ক্ষমতা দখল করেন এবং আল-মুসতাইনকে সুলতানের পদ থেকে অপসারণ করেন। পরবর্তীতে তাকে খলিফার পদ থেকেও সরিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, মামলুক ব্যবস্থায় প্রিটোরিয়ানিজম (Praetorianism) বা সেনাবাহিনীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য এতই প্রবল ছিল যে, সেখানে খলিফার প্রত্যক্ষ শাসন ছিল অকল্পনীয়। খলিফা ছিলেন কেবল একটি আলংকারিক পুতুল, যাকে প্রয়োজন শেষে সরিয়ে ফেলা হতো।
শেষ দৃশ্য: অটোমান বিজয় এবং খিলাফতের স্থানান্তর (১৫১৭ খ্রি.)
১৫১৭ সাল ছিল মামলুক এবং আব্বাসীয় – উভয়ের জন্যই এক যুগান্তকারী সমাপ্তির বছর। উদীয়মান অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সেলিম (Selim I) মামলুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মারজ দাবিক এবং রিদানিয়ার যুদ্ধে মামলুক বাহিনী অটোমানদের আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও কামানের সামনে টিকতে পারেনি। সুলতান সেলিম কায়রো দখল করেন এবং মামলুক সালতানাতের অবসান ঘটান। কায়রোর শেষ আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন তৃতীয় আল-মুতাওয়াক্কিল (Al-Mutawakkil III)। অটোমানরা তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের বন্দি করে কনস্টান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল) নিয়ে যায়।
ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী, ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া মসজিদে আয়োজিত এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল আনুষ্ঠানিকভাবে সুলতান সেলিমের কাছে খিলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তিনি নবী মুহাম্মদের পবিত্র নিদর্শনসমূহ – যেমন তার তরবারি, চাদর (বুরদা) এবং ঝান্ডা – সুলতান সেলিমের হাতে তুলে দেন। এই ঘটনার মাধ্যমে ৭৬৭ বছর ধরে চলে আসা (৭৫০–১৫১৭ খ্রি.) আব্বাসীয় খিলাফতের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। এর আগে খিলাফত ছিল কুরাইশ বংশের একচেটিয়া অধিকার বা বংশগত খিলাফত (Hereditary Caliphate); কিন্তু অটোমানদের হাতে খিলাফত যাওয়ার মাধ্যমে তা শক্তিনির্ভর বা সার্বজনীন খিলাফত (Universal Caliphate)-এ রূপান্তরিত হয়। অটোমানরা দাবি করে যে, পবিত্র দুই মসজিদের (মক্কা ও মদিনা) রক্ষক হিসেবে তারাই এখন খলিফা হওয়ার যোগ্য, কুরাইশ বংশের রক্ত আর জরুরি নয়। আল-মুতাওয়াক্কিল পরে কায়রোতে ফিরে আসেন এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল ধ্রুপদী ইসলামি যুগের একটি প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক বিদায়।
ছায়ার আড়ালে ইতিহাসের সাক্ষী
আব্বাসীয় ও মামলুকদের সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি ছিল এক ধরনের প্রয়োজনের বিয়ে (Marriage of Convenience)। মামলুকরা খলিফাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল নিজেদের শাসনকে ‘ইসলামি’ রূপ দেওয়ার জন্য এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বৈধতার সংকট কাটানোর জন্য। অন্যদিকে, আব্বাসীয়রা মঙ্গোলদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে মামলুকদের আশ্রয়ে সম্মানজনক জীবন বেছে নিয়েছিল। বাগদাদের খলিফারা যদি ছিলেন মধ্যগগনের ‘সূর্য’, তবে কায়রোর খলিফারা ছিলেন সেই সূর্যের ম্লান ‘প্রতিচ্ছবি’ বা চাঁদ, যাদের নিজস্ব কোনো আলো ছিল না; তারা আলোকিত হতেন সুলতানের অনুগ্রহে। মামলুক যুগের আব্বাসীয় খলিফারা ইতিহাসের পাতায় হয়তো কোনো বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে পারেননি, কিন্তু তারা ইসলামি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বা কন্টিনিউইটি (Continuity) বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা ছিলেন সেই সুতো, যা বাগদাদের সোনালী অতীতকে অটোমানদের আধুনিক যুগের সাথে সংযুক্ত করেছিল। তাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, রাজনীতিতে ক্ষমতা বা পাওয়ার (Power) এবং কর্তৃত্ব বা অথরিটি (Authority) সবসময় এক হাতে থাকে না; কখনো কখনো যিনি মুকুট পরেন, তিনি রাজ্য চালান না।
আব্বাসীয় ইতিহাসের তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ: ইবনে খালদুন থেকে হজসন
ইতিহাস কেবল মৃত রাজাদের হাড়গোড় আর যুদ্ধের সাল-তারিখের সমষ্টি নয়; এটি হলো মানুষের আচরণের এক বিশাল পরীক্ষাগার। আব্বাসীয় খিলাফতের উত্থান ও পতনকে বুঝতে হলে আমাদের কেবল ঘটনার বর্ণনায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আমাদের তাকাতে হবে সেই সব মনীষী ও তাত্ত্বিকদের দিকে, যারা ইতিহাসের এই বিশৃঙ্খল ঘটনাপ্রবাহের ভেতর থেকে একটি শৃঙ্খলা বা সূত্র বের করার চেষ্টা করেছেন। আব্বাসীয় সাম্রাজ্য ছিল এমন এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং ধর্মতত্ত্বের জটিল সমীকরণগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসিক্যাল যুগের মুসলিম চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ – সবাই এই সাম্রাজ্যকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। তাদের তত্ত্বগুলো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কেন বাগদাদের মতো এত শক্তিশালী কেন্দ্র ভেঙে পড়ল, কেন বিপ্লবীরা শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, এবং কীভাবে একটি সভ্যতা তার নিজের ভারেই ধসে পড়ে। আমরা এখানে এমন কয়েকজন তাত্ত্বিক এবং তাদের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করব, যারা আব্বাসীয় ইতিহাসকে দেখার জন্য আমাদের চোখে নতুন লেন্স পরিয়ে দেন।
ইবনে খালদুন এবং আসাবিয়্যার চক্রাকার ইতিহাস
আব্বাসীয় খিলাফতের পতনকে সবচেয়ে নিঁখুতভাবে এবং নিষ্ঠুর সততার সাথে যিনি ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি হলেন চতুর্দশ শতাব্দীর তিউনিসিয়ান ইতিহাসবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুন (Ibn Khaldun)। তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ মুকাদ্দিমা (The Muqaddimah) বা ‘প্রলেগাবেনা’-তে তিনি ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ে যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তা আব্বাসীয়দের ক্ষেত্রে হুবহু মিলে যায়। খালদুনের ইতিহাসের মূল চাবিকাঠি হলো আসাবিয়্যা (Asabiyya) বা সামাজিক সংহতি (Social Cohesion)। তিনি বলেন, রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য কোনো ঐশ্বরিক আশীর্বাদ নয়, এটি টিকে থাকে একটি গোষ্ঠীর পারস্পরিক বন্ধন বা ‘গ্রুপ ফিলিং’-এর ওপর। আব্বাসীয়রা যখন খোরাসান থেকে বিপ্লব শুরু করেছিল, তখন তাদের মধ্যে এই ‘আসাবিয়্যা’ ছিল প্রবল। তারা ছিল মরুভূমির রুক্ষ বা বাদাওয়াহ (Badawah) সংস্কৃতির মানুষ, যারা একতাবদ্ধ ছিল এবং মৃত্যুর ভয় করত না। এই সংহতিই তাদের উমাইয়াদের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু খালদুন দেখান যে, সভ্যতার একটি নির্মম চক্রাকার তত্ত্ব (Cyclical Theory) আছে। যাযাবর বা গ্রামীণ মানুষ যখন তাদের আসাবিয়্যার জোরে শহর দখল করে এবং সভ্যতা বা হাদারা (Hadarah) গড়ে তোলে, তখন তারা শহরের বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। বাগদাদের জৌলুস, রেশম, মদ এবং হারেমের আয়েশ আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম দিকের সেই সংগ্রামী চেতনাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। খালদুন বলেন, একটি রাজবংশ সাধারণত চার প্রজন্মের বেশি তাদের শক্তি ধরে রাখতে পারে না:
- প্রথম প্রজন্ম: যারা কঠোর পরিশ্রম করে এবং আসাবিয়্যার জোরে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে (যেমন: আস-সাফফাহ বা মনসুর)।
- দ্বিতীয় প্রজন্ম: যারা বাপ-দাদার সংগ্রাম দেখেছে কিন্তু নিজেরা কিছুটা বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে (যেমন: হারুনুর রশীদ)।
- তৃতীয় প্রজন্ম: যারা কেবল বিলাসিতাই দেখেছে, ক্ষমতাকে তারা নিজেদের জন্মগত অধিকার মনে করে এবং তোষামোদকারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে (যেমন: আল-আমিন)।
- চতুর্থ প্রজন্ম: যারা রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো যোগ্যতাই রাখে না, ফলে তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ফসকে যায় এবং নতুন কোনো শক্তিশালী ‘আসাবিয়্যা’ সম্পন্ন গোষ্ঠী (যেমন: তুর্কি বা মঙ্গোলরা) এসে তাদের উৎখাত করে।
আব্বাসীয়দের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক এই চিত্রই দেখি। হারুনের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা যখন গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলো, তখন তাদের সেই আদি ‘হাশিমী’ সংহতি ভেঙে গিয়েছিল। তারা তখন নিজেদের গোত্রের ওপর ভরসা না করে তুর্কি ক্রীতদাসদের ওপর নির্ভর করতে শুরু করল। খালদুনের মতে, যখন কোনো শাসক নিজের রক্তের বা গোত্রের লোকদের বিশ্বাস না করে ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর নির্ভর করে, তখন তার পতন অনিবার্য। আব্বাসীয়রা যখন ‘আসাবিয়্যা’ হারিয়ে ফেলল, তখন বাগদাদ কেবল একটি ফলের মতো পেকে ছিল, যা মঙ্গোলদের সামান্য ধাক্কাতেই খসে পড়েছিল। ইবনে খালদুন আমাদের শেখান, বিলাসিতা এবং নগরজীবন বা আরবানাইজেশন (Urbanization) সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ হলেও, এটি মানুষের লড়াই করার মানসিক শক্তিকে পঙ্গু করে দেয় (Ibn Khaldun, 1967)।
আল-মাওয়ার্দি এবং রাজনৈতিক বাস্তববাদ
আব্বাসীয় খিলাফতের শেষের দিকে, যখন খলিফারা বুয়াইদ বা সেলজুক সুলতানদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে এক বিশাল সংকট তৈরি হয়েছিল। খলিফার হাতে কোনো ক্ষমতা নেই, অথচ তাত্ত্বিকভাবে তিনিই সব ক্ষমতার উৎস – এই অদ্ভুত প্যারাডক্স বা কূটাভাস সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন একাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ফকিহ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দি (Al-Mawardi)। তার লেখা আল-আহকাম আল-সুলতানিয়া (The Ordinances of Government) হলো সুন্নি রাজনৈতিক তত্ত্বের বাইবেল। মাওয়ার্দি ছিলেন একজন ঘোরতর বাস্তববাদী (Realist) বা প্রাগমেটিস্ট। তিনি দেখছিলেন যে রাষ্ট্র ভেঙে পড়ছে, তাই তিনি এমন একটি তত্ত্ব দাঁড় করালেন যা বিদ্যমান বিশৃঙ্খলাকে থামিয়ে রাখতে পারে।
মাওয়ার্দি তার তত্ত্বে ‘প্রয়োজনীয়তার নীতি’ বা ডকট্রিন অফ নেসেসিটি (Doctrine of Necessity)-র অবতারণা করেন। তিনি বলেন, একজন আদর্শ খলিফার সব গুণাবলি বর্তমান খলিফার মধ্যে নাও থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে খলিফাকে সরিয়ে দেওয়া যাবে না, কারণ তাতে ফিতনা (Fitna) বা গৃহযুদ্ধ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। তিনি যুক্তি দিলেন যে, অন্যায্য বা দুর্বল শাসন নৈরাজ্যের চেয়ে ভালো। মাওয়ার্দি খলিফা এবং সুলতানের (যারা বাস্তবে ক্ষমতা চর্চা করত) সম্পর্কের একটি আইনি কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বললেন, সুলতানরা দেশ চালাবে, কিন্তু তাদের বৈধতা নিতে হবে খলিফার কাছ থেকে। এটি ছিল মূলত খলিফার সম্মান বাঁচানোর এবং আব্বাসীয় প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখার একটি আইনি ফিকির। মাওয়ার্দির এই তত্ত্ব আব্বাসীয় খিলাফতকে আরও কয়েকশ বছর টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল, যদিও তা ছিল নামমাত্র। তিনি আমাদের দেখান, রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে স্থিতিশীলতা বা স্ট্যাবিলিটি (Stability) অনেক সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি বিপ্লবের চেয়ে বিবর্তনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতেন বিপ্লবের পরে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করা কঠিন (Mawardi, 1996)।
মার্শাল হজসন এবং ‘ইসলামিকেট’ সমাজের ধারণা
আধুনিক যুগে আব্বাসীয় ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যিনি আমূল বদলে দিয়েছেন, তিনি হলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মার্শাল হজসন (Marshall Hodgson)। তার কালজয়ী গ্রন্থ দ্য ভেঞ্চার অফ ইসলাম (The Venture of Islam) আব্বাসীয় সমাজ বিশ্লেষণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। হজসন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা বা টার্মিনোলজি উদ্ভাবন করেন, যা হলো ‘ইসলামিকেট’ (Islamicate)। তিনি ‘ইসলামিক’ (Islamic) এবং ‘ইসলামিকেট’ (Islamicate) – এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য করেন। ‘ইসলামিক’ বলতে তিনি বোঝান যা সরাসরি ধর্মের সাথে যুক্ত (যেমন: নামাজ, রোজা, হাদিস)। আর ‘ইসলামিকেট’ বলতে তিনি বোঝান সেই বিশাল সংস্কৃতিকে, যা মুসলিম শাসিত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল কিন্তু যা ধর্মীয়ভাবে ইসলাম নয়।
আব্বাসীয় সমাজ ছিল মূলত একটি ‘ইসলামিকেট’ সমাজ। উদাহরণস্বরূপ, আবু নুওয়াসের মদের কবিতা, আল-খোয়ারিজমির গণিত, ইবনে আল-হাইসামের অপটিক্স, বা পারসিক ধারার স্থাপত্য – এগুলো ‘ইসলামিক’ বা ধর্মীয় কিছু নয়। এগুলো হলো সেই সময়ের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির অংশ, যা মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি এবং নাস্তিকরা মিলেমিশে তৈরি করেছিল। হজসন দেখান যে, আব্বাসীয়দের সাফল্য কেবল ধর্মের কারণে আসেনি, এসেছিল এই ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার কালচারাল সিন্থেসিস (Secular Cultural Synthesis)-এর কারণে। তিনি আব্বাসীয় সমাজকে বলেছিলেন ওইকুমেন (Oikoumene) বা বিশ্বজনীন সমাজ, যেখানে বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত সংযুক্ত ছিল। হজসনের তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, আব্বাসীয় যুগে কেন এত বিজ্ঞান ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। কারণ তারা ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে সমাজকে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যের ভিত্তিতে চালাতে চেয়েছিল। এই ‘ইসলামিকেট’ সংস্কৃতিই ছিল আব্বাসীয়দের সফট পাওয়ার, যা তরবারির চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ছিল (Hodgson, 1974)।
প্যাট্রিসিয়া ক্রোন এবং নেটিভিস্ট থিসিস
আব্বাসীয় বিপ্লব এবং তাদের সামরিক কাঠামোর কঠোর সমালোচক এবং বিশ্লেষণকারী হলেন ডেনিশ-আমেরিকান ইতিহাসবিদ প্যাট্রিসিয়া ক্রোন (Patricia Crone)। তার বিখ্যাত বই স্লেভস অন হর্সেস (Slaves on Horses) আব্বাসীয় ইতিহাসের এক যুগান্তকারী বিশ্লেষণ। ক্রোন প্রচলিত ইতিহাসের বিরোধিতা করে রিভিশনিস্ট (Revisionist) দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেন। তিনি আব্বাসীয় বিপ্লবকে কেবল একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে দেখেননি, তিনি একে দেখেছিলেন একটি ‘নেটিভিস্ট’ বা জাতীয়তাবাদী পুনরুত্থান (Nativist Resurgence) হিসেবে। তার মতে, এটি ছিল আরব আধিপত্যের বিরুদ্ধে পারসিক বা অনারবদের (মাওয়ালি) একটি বিপ্লব। আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসার পর আরব গোত্রতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয় এবং পারসিক আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
ক্রোনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো আব্বাসীয়দের সামরিক দুর্বলতা বিশ্লেষণ করা। তিনি দেখান যে, আব্বাসীয়রা যখন নিজেদের গোত্রীয় সেনাবাহিনী বা ট্রাইবাল আর্মি (Tribal Army)-কে বিশ্বাস করতে পারছিল না, তখন তারা তুর্কি ক্রীতদাসদের নিয়ে একটি পেশাদার সেনাবাহিনী তৈরি করে। একে তিনি বলেন সামরিক বাহিনীর পেশাদারিকরণ (Professionalization)। কিন্তু এর ফলে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। জনগণ আর যুদ্ধের অংশ রইল না, যুদ্ধ হয়ে গেল খলিফা এবং তার ভাড়াটে সৈন্যদের ব্যাপার। ক্রোন যুক্তি দেন যে, এই বিচ্ছিন্নতাই আব্বাসীয়দের পতনের মূল কারণ। যখন আপনার রক্ষীরা সমাজের অংশ নয়, তখন তারা সমাজের মঙ্গলের চেয়ে নিজেদের পকেটের দিকে বেশি তাকাবে। তুর্কি গার্ডদের হাতে খলিফাদের জিম্মি হওয়া বা প্রিটোরিয়ানিজম (Praetorianism) ছিল এই ভুল নীতিরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্যাট্রিসিয়া ক্রোন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, একটি রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ভাড়াটে শক্তির ওপর নির্ভর করে, তবে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য।
এডওয়ার্ড সাঈদ এবং ওরিয়েন্টালিজমের লেন্স
আব্বাসীয় খিলাফতকে, বিশেষ করে হারুনুর রশীদকে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে দেখেছে, তার সমালোচনা করেছেন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said)। তার মাস্টারপিস ওরিয়েন্টালিজম (Orientalism) গ্রন্থে তিনি দেখান যে, পাশ্চাত্য বা ইউরোপ আব্বাসীয় খিলাফতকে একটি ফ্যান্টাসি বা অলীক কল্পনার জগৎ হিসেবে চিত্রিত করেছে। ‘আরব্য রজনী’র অনুবাদ এবং প্রাচ্যবিদদের লেখার মাধ্যমে তারা বাগদাদকে মায়াবী শহর, উড়ন্ত কার্পেট, জিন-পরী এবং কামুক হারেমের শহর হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সাঈদ বলেন, এই অক্সিডেন্টাল গেজ (Occidental Gaze) বা পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি আব্বাসীয়দের প্রকৃত ইতিহাসকে ঢেকে দিয়েছে।
পাশ্চাত্য আব্বাসীয়দের জ্ঞান-বিজ্ঞান বা প্রশাসনিক দক্ষতাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের বিলাসিতা এবং ‘বর্বরতা’-কে হাইলাইট করেছে। সাঈদের মতে, এটি ছিল এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদ (Epistemological Imperialism)। ইউরোপ আব্বাসীয়দের ইতিহাসকে এমনভাবে লিখেছে যাতে তাদের নিজেদের (ইউরোপের) শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। তারা দেখাতে চেয়েছে, “দেখো, প্রাচ্যের শাসকরা কত অযৌক্তিক এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ, তাই তাদের শাসন করা আমাদের (পশ্চিমাদের) নৈতিক দায়িত্ব।” আব্বাসীয় ইতিহাস পড়ার সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন আমরা এই ওরিয়েন্টালিস্ট ফাঁদে পা না দিই। হারুনুর রশীদ কেবল হারেমের নারীদের নিয়ে সময় কাটাতেন না, তিনি ছিলেন একজন জটিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব – সাঈদের তত্ত্ব আমাদের এই সত্যটি মনে করিয়ে দেয় (Said, 1978)।
মার্শাল হজসন এবং গানপাউডার এম্পায়ারস-এর পূর্বসূরি
যদিও গানপাউডার এম্পায়ারস (Gunpowder Empires) বা বারুদ সাম্রাজ্যের ধারণাটি মূলত পরবর্তী অটোমান, সাফাভিদ এবং মুঘলদের জন্য ব্যবহৃত হয়, কিন্তু আব্বাসীয়দের পতনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আব্বাসীয়রা কেন প্রযুক্তিতে এগিয়ে থেকেও সামরিক প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ল? তাত্ত্বিকরা দেখান যে, আব্বাসীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত কিন্তু তাদের সামরিক প্রযুক্তি ছিল স্থবির। তারা মঙ্গোলদের মতো ক্ষিপ্রগতির অশ্বারোহী বাহিনী বা পরবর্তীতে ইউরোপীয়দের মতো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার আয়ত্ত করতে পারেনি। আব্বাসীয়দের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান ছিল মূলত তাত্ত্বিক এবং নাগরিক জীবনের সুবিধার জন্য (যেমন: কৃষি, চিকিৎসা, স্থাপত্য)। কিন্তু সামরিক ক্ষেত্রে তারা ছিল রক্ষণশীল। এই প্রযুক্তিগত স্থবিরতা (Technological Stagnation) তাদের পতনের একটি বড় কারণ। আধুনিক সমরবিদরা মনে করেন, আব্বাসীয়রা যদি চীনের কাছ থেকে বারুদের ব্যবহার শিখে তা যুদ্ধে প্রয়োগ করত, তবে হয়তো মঙ্গোলদের ঠেকানো সম্ভব হতো। জ্ঞান যখন কেবল বইয়ের পাতায় থাকে এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বা সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি (Survival Strategy)-তে রূপান্তরিত না হয়, তখন তা একটি সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে না।
পরিশেষে, এই তাত্ত্বিকরা আব্বাসীয় ইতিহাসকে কেবল রাজা-রানিদের গল্পের বাইরে নিয়ে গিয়েছেন। ইবনে খালদুন দেখিয়েছেন সামাজিক সংহতির গুরুত্ব, মাওয়ার্দি দেখিয়েছেন বৈধতার সংকট, হজসন দেখিয়েছেন সংস্কৃতির শক্তি, ক্রোন দেখিয়েছেন কাঠামোগত দুর্বলতা আর সাঈদ দেখিয়েছেন দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এই সব তত্ত্ব মিলে আব্বাসীয় খিলাফতের এক বহুমাত্রিক বা মাল্টি-ডাইমেনশনাল (Multi-dimensional) ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। আমরা বুঝতে পারি, বাগদাদের পতন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; এটি ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, কোনো সভ্যতাই অপরাজেয় নয়, যদি না সে নিজেকে সময়ের সাথে পরিবর্তন করতে পারে।
উপসংহার: ইতিহাসের শিক্ষা ও মহাকালের রায়
আব্বাসীয় খিলাফতের ইতিহাস কেবল একটি রাজবংশের উত্থান-পতনের গতানুগতিক গল্প নয়; এটি মানব সভ্যতার এক বিশাল ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার। এখানে আমরা দেখি কীভাবে চরম যুক্তিবাদ আর অন্ধবিশ্বাস পাশাপাশি চলেছে। একদিকে আল-খোয়ারিজমির মতো গণিতবিদরা শূন্যের ধারণা দিয়ে বিশ্বকে বদলে দিচ্ছেন, অন্যদিকে হারেমের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চলছে ক্ষমতার জঘন্য ষড়যন্ত্র। একদিকে আল-রাজি ও ইবনে সিনার মতো মনীষীরা চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছেন, অন্যদিকে জল্লাদ মাসরুর তার ধারালো তরবারি দিয়ে কারও মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। সৃজনশীলতার চূড়ান্ত শিখর এবং ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির অতল গহ্বর – মানুষ যে একই সাথে কতটা মহান এবং কতটা নিচ হতে পারে, তার উজ্জ্বল প্রমাণ এই আব্বাসীয় যুগ। এটি আমাদের দেখায় যে, সভ্যতা কেবল ইমারত বা প্রযুক্তি দিয়ে মাপা যায় না, তা মাপা হয় মানুষের মননশীলতা এবং নৈতিকতার মাপকাঠিতে।
আব্বাসীয়রা আমাদের শিখিয়ে গেছে, জ্ঞানই প্রকৃত শক্তি। তারা তাদের সম্পদ তরবারির চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছিল কাগজে এবং কালিতে। তাদের তৈরি করা জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি এবং অনুবাদ আন্দোলনের ফলেই প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল, যা পরবর্তীতে ইউরোপে রেনেসাঁস ঘটাতে সাহায্য করেছিল। আজ আমরা যে বৈজ্ঞানিক মেথড বা অ্যালগরিদম (Algorithm) ব্যবহার করি, তার অনেক কিছুরই ভ্রূণ জন্ম নিয়েছিল বাগদাদের সেই ধুলোমাখা ল্যাবরেটরিগুলোতে। জ্ঞানকে সহজলভ্য করার এবং তাকে সর্বজনীন করার এই মহৎ প্রয়াস তাদের অমর করে রেখেছে। তারা প্রমাণ করেছে, সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু জ্ঞান অবিনশ্বর।
আবার তাদের পতন আমাদের শেখায়, ক্ষমতা কখনোই চিরস্থায়ী নয়। একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড যদি নিজস্ব জনগণের বদলে ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর নির্ভর করে, তবে তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে বাধ্য। বিলাসিতা, অতিরিক্ত আরামপ্রিয়তা আর প্রজাদের থেকে বিচ্ছিন্নতা আব্বাসীয়দের পতনের বড় কারণ ছিল। শাসকরা যখন প্রাসাদের চার দেয়ালে বন্দি হয়ে পড়ে, চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে, তখন বাইরের ঝড়ের শব্দ তারা শুনতে পায় না। তারা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কল্পনার জগতে বাস করে। আর যখন তারা সেই ঝড়ের গর্জন শোনে, তখন আর পালানোর পথ থাকে না। খলিফা আল-মুসতাসিম তার জমানো সোনা দিয়ে নিজের জীবন বা সম্মান – কোনোটিই বাঁচাতে পারেননি। ইতিহাসের এই নির্মম শিক্ষা আজও প্রতিটি রাষ্ট্র ও শাসকের জন্য সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
আজ বাগদাদের সেই জৌলুস নেই, নেই সেই বৃত্তাকার নগরীর জাদুকরী স্থাপত্য। দজলা নদী হয়তো এখনও বয়, কিন্তু সেই লাইব্রেরি, সেই বিতর্ক সভা, সেই বিজ্ঞানীদের পদচারণা – সব হারিয়ে গেছে মহাকালের অতল গর্ভে। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে আব্বাসীয়রা যে অধ্যায় লিখে গেছে, তা মুছে ফেলা অসম্ভব। তাদের আবিষ্কৃত বীজগণিত দিয়েই আজ আমরা মহাকাশে রকেট পাঠাই, তাদের চিকিৎসাশাস্ত্র আধুনিক মেডিসিনের ভিত্তি, তাদের দর্শন আজও আমাদের ভাবায়। তাদের রেখে যাওয়া জ্ঞান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি কোণে মিশে আছে।
ইতিহাস বড় নির্মম, কিন্তু সে সর্বদা সত্য কথা বলে। আব্বাসীয়দের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় – উত্থান আছে মানেই পতন আছে, সৃষ্টি আছে মানেই ধ্বংস আছে। এই চক্রের বাইরে কেউ নয়। আমরা কেবল এই মহাজাগতিক নাট্যমঞ্চের এক একজন ক্ষুদ্র দর্শক মাত্র। পৃথিবী তার নিজস্ব গতিতে ঘুরতে থাকে, আর সময় তার ডায়েরিতে লিখে রাখে নতুন কোনো সাম্রাজ্যের নাম, যা হয়তো একদিন আব্বাসীয়দের মতোই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। এই নশ্বর পৃথিবীতে কেবল মানুষের কর্ম, সৃষ্টি আর জ্ঞানটুকুই হয়তো কিছুদিন টিকে থাকে, বাকি সব – ক্ষমতা, দম্ভ, সিংহাসন, ধনসম্পদ – সবই ধুলোয় মিশে যায়। মহাবিশ্বের এই বিশাল রঙ্গমঞ্চে আমরা সবাই ক্ষণিকের অভিনেতা, আমাদের অভিনয় শেষ হলে পর্দা নেমে আসবে, আর দর্শক হিসেবে মহাকাল হয়তো মৃদু হেসে পরবর্তী দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করবে।
তথ্যসূত্র
- Abbott, N. (1946). Two Queens of Baghdad: Mother and Wife of Harun Al Rashid. University of Chicago Press.
- Ahsan, M. M. (1979). Social Life Under the Abbasids. Longman.
- Allen, R. M. A. (2000). An Introduction to Arabic Literature. Cambridge University Press.
- Amitai-Preiss, R. (1995). Mongols and Mamluks: The Mamluk-Ilkhanid War, 1260-1281. Cambridge University Press.
- Bennison, A. K. (2009). The Great Caliphs: The Golden Age of the ‘Abbasid Empire. Yale University Press.
- Bianquis, T. (1998). “Autonomous Egypt from Ibn Tulun to Kafur, 868-969”. In C. F. Petry (Ed.), The Cambridge History of Egypt, Vol. 1: Islamic Egypt, 640-1517. Cambridge University Press.
- Biran, M. (2005). The Empire of the Qara Khitai in Eurasian History: Between China and the Islamic World. Cambridge University Press.
- Bloom, J. M. (2001). Paper Before Print: The History and Impact of Paper in the Islamic World. Yale University Press.
- Bonner, M. (1996). Aristocratic Violence and Holy War: Studies in the Jihad and the Arab-Byzantine Frontier. American Oriental Society.
- Bosworth, C. E. (1994). The History of the Saffarids of Sistan and the Maliks of Nimruz (247/861 to 949/1542-3). Mazda Publishers.
- Boyle, J. A. (1968). The Cambridge History of Iran, Volume 5: The Saljuq and Mongol Periods. Cambridge University Press.
- Bray, J. (Ed.). (2006). Writing and Representation in Medieval Islam: Muslim Horizons. Routledge.
- Broadbridge, A. F. (2008). Kingship and Ideology in the Islamic and Mongol Worlds. Cambridge University Press.
- Brooks, E. W. (1923). “The Struggle with the Saracens (717–867)”. In The Cambridge Medieval History, Vol. IV: The Eastern Roman Empire (717–1453). Cambridge University Press.
- Clot, A. (1989). Harun al-Rashid and the World of the Thousand and One Nights. New Amsterdam Books.
- Coppens, P. (2013). The Origins of the Mihna. Journal of Abbasid Studies.
- Crone, P. (1980). Slaves on Horses: The Evolution of the Islamic Polity. Cambridge University Press.
- Daniel, E. L. (1979). The Political and Social History of Khurasan under Abbasid Rule. Bibliotheca Islamica.
- Eddé, A.-M. (2011). Saladin. Harvard University Press.
- El-Cheikh, N. M. (2004). Byzantium Viewed by the Arabs. Harvard University Press.
- El-Hibri, T. (1999). Reinterpreting Islamic Historiography: Harun al-Rashid and the Narrative of the Abbasid Caliphate. Cambridge University Press.
- El-Hibri, T. (2010). The Abbasid Caliphate: A History. Cambridge University Press.
- Frye, R. N. (1975). “The Samanids”. In R. N. Frye (Ed.), The Cambridge History of Iran, Volume 4: The Period from the Arab Invasion to the Saljuqs. Cambridge University Press.
- Gordon, M. S. (2001). The Breaking of a Thousand Swords: A History of the Turkish Military of Samarra (A.H. 200-275/815-889 C.E.). State University of New York Press.
- Gutas, D. (1998). Greek Thought, Arabic Culture: The Graeco-Arabic Translation Movement in Baghdad and Early ‘Abbasid Society (2nd-4th/8th-10th centuries). Routledge.
- Haldon, J. F. (1999). Warfare, State and Society in the Byzantine World, 565–1204. UCL Press.
- Hillebrand, C. (1999). The Crusades: Islamic Perspectives. Edinburgh University Press.
- Hitti, P. K. (1970). History of the Arabs. Palgrave Macmillan.
- Hodgson, M. G. S. (1974). The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization (Vol. 1). University of Chicago Press.
- Holt, P. M. (1986). The Age of the Crusades: The Near East from the Eleventh Century to 1517. Longman.
- Hourani, A. (1991). A History of the Arab Peoples. Warner Books.
- Humphreys, R. S. (1977). From Saladin to the Mongols: The Ayyubids of Damascus, 1193-1260. SUNY Press.
- Hurvitz, N. (2002). The Formation of Hanbalism: Piety into Power. Routledge.
- Ibn Khaldun. (1967). The Muqaddimah: An Introduction to History (F. Rosenthal, Trans.). Princeton University Press.
- Irwin, R. (1986). The Middle East in the Middle Ages: The Early Mamluk Sultanate 1250-1382. Croom Helm.
- Irwin, R. (2004). The Arabian Nights: A Companion. Tauris Parke Paperbacks.
- Juvaini, A. (1997). Genghis Khan: The History of the World Conqueror (J. A. Boyle, Trans.). Manchester University Press.
- Kaegi, W. E. (1992). Byzantium and the Early Islamic Conquests. Cambridge University Press.
- Kaldellis, A. (2017). Streams of Gold, Rivers of Blood: The Rise and Fall of Byzantium, 955 A.D. to the First Crusade. Oxford University Press.
- Kennedy, H. (1990). The Early Abbasid Caliphate: A Political History. Croom Helm.
- Kennedy, H. (2001). The Armies of the Caliphs: Military and Society in the Early Islamic State. Routledge.
- Kennedy, H. (2004). The Prophet and the Age of the Caliphates: The Islamic Near East from the 6th to the 11th Century. Pearson Longman.
- Kennedy, H. (2005). The Court of the Caliphs: The Rise and Fall of Islam’s Greatest Dynasty. Weidenfeld & Nicolson.
- Lapidus, I. M. (2014). A History of Islamic Societies. Cambridge University Press.
- Lassner, J. (1980). The Shaping of ‘Abbasid Rule. Princeton University Press.
- Lev, Y. (1999). Saladin in Egypt. Brill.
- Levanoni, A. (1995). A Turning Point in Mamluk History: The Third Reign of Al-Nasir Muhammad Ibn Qalawun (1310-1341). Brill.
- Lewis, B. (1990). Race and Slavery in the Middle East: An Historical Enquiry. Oxford University Press.
- Lindberg, D. C. (1976). Theories of Vision from Al-kindi to Kepler. University of Chicago Press.
- Lyons, M. C., & Jackson, D. E. P. (1982). Saladin: The Politics of the Holy War. Cambridge University Press.
- Martin, R. C., & Woodward, M. R. (1997). Defenders of Reason in Islam: Mu’tazilism from Medieval School to Modern Symbol. Oneworld Publications.
- Mawardi, A. (1996). Al-Ahkam as-Sultaniyah: The Laws of Islamic Governance (A. Yate, Trans.). Ta-Ha Publishers.
- Montgomery, J. E. (2013). Al-Jahiz: In Praise of Books. Edinburgh University Press.
- Morgan, D. (1988). The Mongols. Blackwell Publishing.
- Nasawi, S. (1891). Histoire du Sultan Djelal ed-Din Mankobirti (O. Houdas, Trans.). E. Leroux.
- Nawas, J. A. (1994). A Reexamination of al-Ma’mun’s ‘Inquisition’. E.J. Brill.
- Northrup, L. S. (1998). From Slave to Sultan: The Career of Al-Mansur Qalawun and the Consolidation of Mamluk Rule in Egypt and Syria. Franz Steiner Verlag.
- Pellat, C. (1969). The Life and Works of Jahiz. University of California Press.
- Popovic, A. (1999). The Revolt of African Slaves in Iraq in the 3rd/9th Century. Markus Wiener Publishers.
- Rashid al-Din. (1998). Jami’ al-tawarikh (Compendium of Chronicles). (W. M. Thackston, Trans.). Harvard University Department of Near Eastern Languages and Civilizations.
- Said, E. W. (1978). Orientalism. Pantheon Books.
- Saliba, G. (2007). Islamic Science and the Making of the European Renaissance. MIT Press.
- Sharon, M. (1983). Black Banners from the East: The Establishment of the ‘Abbasid State – Incubation of a Revolt. Magnes Press.
- Starkey, P. (2006). Modern Arabic Literature. Edinburgh University Press.
- Tabari, A. (1989). The History of al-Tabari Vol. 27: The Abbasid Revolution A.D. 743-750/A.H. 126-132. SUNY Press.
- Thorau, P. (1992). The Lion of Egypt: Sultan Baybars I and the Near East in the Thirteenth Century. Longman.
- Tor, D. G. (2007). Violent Order: Religious Warfare, Chivalry, and the ‘Ayyar Phenomenon in the Medieval Islamic World. Ergon Verlag.
- Treadgold, W. (1997). A History of the Byzantine State and Society. Stanford University Press.
- Vasiliev, A. A. (1935). Byzance et les Arabes. Éditions de l’Institut de Philologie et d’Histoire Orientales.
- Watson, A. M. (1983). Agricultural Innovation in the Early Islamic World: The Diffusion of Crops and Farming Techniques, 700–1100. Cambridge University Press.
- Watt, W. M. (1948). Free Will and Predestination in Early Islam. Luzac & Company.
- Wellhausen, J. (1927). The Arab Kingdom and its Fall. University of Calcutta.
- Winter, M., & Levanoni, A. (Eds.). (2004). The Mamluks in Egyptian and Syrian Politics and Society. Brill.

