fbpx

ধর্মবিদ্বেষ নয়, যুক্তিযুক্ত ঘৃণা প্রকাশের অধিকার

Print Friendly, PDF & Email

লেখার শুরুতেই বলে নিই, শুধুমাত্র নাস্তিক হলেই সে একজন ভাল মানুষ, তা আমি কিছুতেই মনে করি না। একজন মানুষ আস্তিক কিংবা নাস্তিক, হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সংশয়বাদী বা প্রকৃতিবাদী যাই হোক, সে ভাল কিনা মন্দ তা নির্ভর করবে তার কাজের ওপর। তার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ওপর নয়। বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস মানুষের ভাল মন্দ হওয়া নির্ধারণ করে না। পৃথিবীতে প্রচুর নাস্তিক ছিলেন যারা মানুষ হিসেবে ঘৃণ্য এবং বাজে। অনেকেই ছিলেন গণহত্যাকারী, অনেকে রাজনীতিবিদ। এদের মধ্যে স্ট্যালিন মাও সে তুং কিংবা এরকম আরও কয়েকজনার নাম বলা যায়। যদিও তারা নাস্তিকতা নয়, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা এবং কমিউনিজমের বিরোধী সকল মতাদর্শকে ধ্বংস করতেই কাজগুলো করেছেন, তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ব্যক্তিজীবনে নাস্তিক হলেও তারা তাদের কাজ চালিয়েছেন রাজনৈতিক মতাদর্শগত জায়গা থেকে। মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ করার উদ্দেশ্যে ছিল রাজনৈতিক। নাস্তিকতা বা মুক্তচিন্তা প্রচার উনাদের কারও উদ্দেশ্য ছিল না।

নাস্তিক হলেই যেমন মানবতাবাদী হওয়া যায় না, নাস্তিক হলেই মুক্তমনা হওয়া যায় না, নাস্তিক হলেই সৎ আদর্শবান মানুষ হওয়া যায় না। তবে সেই সাথে এটাও সত্যি, নাস্তিকরা ধার্মিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধপ্রবণ হয়। মানবতাবাদ, সাম্যবাদ, সকলের সমান অধিকার এগুলো সকল প্রগতিশীল মানুষেরই মোক্ষ হওয়া উচিত, মানবতাবাদহীন নাস্তিক্যবাদের সাথে তা না হলে ধর্মান্ধতার তেমন কোন পার্থক্য থাকে না। একজন মুক্তমনা প্রথা-রাষ্ট্র-ধর্ম-লিঙ্গ-জাতীয়তাবাদ-যৌনরুচি-বর্ণ সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষকে স্থান দেবে, মানুষের পক্ষে কথা বলবে। কোন নাস্তিক যখনই এসবের উর্ধ্বে নাস্তিকতাকে স্থান দেবে, মানুষে মানুষে বিভেদ করবে, মানবতার চেয়ে ধর্মপরিচয়কে প্রাধান্য দেবে, সে আর দশটা সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধের মতই হয়ে উঠবে।

এটা অবশ্যই সত্য যে, বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রগতিশীলতার ধারাটা একটা সময় এ অঞ্চলের হিন্দুরা নিয়ন্ত্রন করেছিল, ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশে একটি উগ্র হিন্দুবাদী দর্শনের উদ্ভবও ঘটেছিল। এই অঞ্চলে এখনও আওয়ামী সেক্যুলার ধারার অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দুবাদী সংস্কৃতি লালন করেন, যেটা সাধারণ বোধবুদ্ধির আস্তিকের চোখে নাস্তিক্যবাদ বলে ভুল করা হয়। অনেক তথাকথিত সেক্যুলার নেতাকে দেখা যায় মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণ করে নামাজ রোজা করেন না, ইসলামী সংস্কৃতিকে ঘৃণা করেন, অথচ পুজায় দৌড়ে চলে যান, দুর্গা-কালীর প্রসাদ না খেলে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করতে পারেন না। তাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইসলাম বর্জন করে হিন্দুধর্মকে নিয়ে মাতামাতি করা, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যে হিন্দুধর্ম থেকেও সম্পর্ক বিচ্ছেদ, এটা তারা ভুলে যান। সেই ঘরানার লোকের অথবা হিন্দুধর্মের মৌলবাদীদের ইসলাম বিদ্বেষ অবশ্যই বর্জনীয়, কারণ তারা এক বিশ্বাসের বিপক্ষে আরেকটি বস্তাপঁচা বিশ্বাসের পক্ষে কাজ করেন, আরেকটি মৌলবাদের পক্ষে কাজ করেন-প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।

তাহলে নাস্তিক্যবাদ কী?

নাস্তিক্যবাদ বা সংশয়বাদ ইসলাম বা হিন্দুধর্মের প্রগতিশীল অংশের দর্শন নয়, নাস্তিক্যবাদ বা সংশয়বাদ একেবারেই সব ধর্মের বাইরের একটি স্বতন্ত্রধারা। মোটাদাগে নাস্তিক্যবাদ হচ্ছে যুক্তিপ্রমাণহীন কিছু দাবীকে অস্বীকার করার দর্শন, সে সম্পর্কে অনুসন্ধান-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোন তত্ব বাতিল করার প্রজ্ঞা। যখন একজন নাস্তিক কোন ধর্মদর্শনকে বাতিল করবে, যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে তা ভুল প্রমাণ করবে, স্বাভাবিকভাবেই সেই ধর্মটিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হবে। এবং এই দেশ ইসলাম প্রধান বলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম নিয়েই বেশী আলোচনা হবে। যেমন ডকিন্স-হিচেন্স-হ্যারিস খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে বেশী আলোচনা করেছেন, যেমন এপিকুরাস তৎকালীন প্যাগান ধর্মের সমালোচনা করেছেন, গৌতম বুদ্ধ বেদের সমালোচনা করেছেন, আরজ আলী করেছেন ইসলাম হিন্দু এবং খ্রিষ্ট ধর্মের সমালোচনা-বিশেষভাবে ইসলামের। এর কারণ হচ্ছে যে যেই সমাজে বেড়ে ওঠে, যাদের সাথে তর্ক-আলোচনা চালায়, আলোচনার বিষয়বস্তুতেও তারই প্রভাব থাকবে।

যেকারো যেকোন মতাদর্শকে ঘৃণা করবার অধিকার রয়েছে। আমার যেমন অধিকার রয়েছে নাৎসীবাদকে ঘৃণা করার অধিকার, পুঁজিবাদকে ঘৃণা করার অধিকার, তেমনি আরেকজনার অধিকার রয়েছে সমাজতন্ত্রকে ঘৃণা করবার অধিকার। আমার যদি কোন তত্ত্ব মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে কাজ করে বলে মনে হয়, আমি অবশ্যই সেই তত্ত্বকে ঘৃণা করতে পারি, তার কঠোরতম সমালোচনাও করতে পারি। সেই তত্ত্বের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে স্যাটায়ার করতে পারি, ঠাট্টা করতে পারি। আমি মনে করি সবগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর, প্রগতিবিরোধী, এবং জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাম্যবাদী দর্শন বিকাশের পথে প্রধানতম অন্তরায়। তাই আমি অবশ্যই ইসলাম-খ্রিষ্টধর্ম-হিন্দুধর্ম-ইহুদীধর্মের সমালোচনা করতে পারি, ঘৃণাও করতে পারি। এই ঘৃণা ঐ মতাদর্শকে ঘৃণা, মানুষকে নয়।

যেমন ধরুন, বামপন্থীরা ঘৃণা করে সাম্রাজ্যবাদকে, পুঁঁজিবাদকে, আমেরিকা-ইসরাইলের রাষ্ট্রদর্শনকে। আবার এন্টাই ওরিয়েন্টালিস্টরা সমালোচনা করে ইউরোপ আমেরিকাকে। তেমনি নাস্তিকরা ঘৃণা করে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে, সেই সব দেশের নিয়ম কানুনকে। ক’দিন আগেই সৌদী আরবে ৮জন বাঙালির শিরঃচ্ছেদ করা হলো, ইসলামে বিশ্বাসী ধর্মপ্রান মানুষের ভেতরে এই নিয়ে তীব্র ক্ষোভ লক্ষ্য করা যায় নি, বরঞ্চ অনেকেই এই ঘটনাকে স্বাভাবিক এবং ঠিক বলেই মতামত দিচ্ছিলেন। নিজের দেশের মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে মূখ্য হয়ে উঠেছিল ধর্মীয় বর্বর নিয়ম কানুন। নাস্তিকরা সেই বর্বরতার পক্ষে যারা কথা বলে, তাদের সমালোচনাও করবে কঠোরভাবে।

এই শরীয়া আইনের, এই বর্বর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, এর সমালোচনা কোনভাবেই মুসলিম বিদ্বেষ হতে পারে না।  যদিও অনেক মুসলিমই নিজেদের সাথে এই শরীয়া আইনকে এতটাই একাত্ম মনে করেন যে, শরীয়া আইনের সমালোচনা তাদের মুসলিম পরিচয় এবং অস্তিত্বের প্রতি হুমকি বলে ভুল করেন। এটা বড়জোর ইসলাম বিদ্বেষ হতে পারে, ইসলামী নিয়ম কানুনের প্রতি বিদ্বেষ হতে পারে। যেমন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা আসলে আমেরিকার সাধারণ মানুষের প্রতি ঘৃণা নয়, ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সাধারণ খেটে খাওয়া ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা নয়, তেমনি ইসলামের বর্বর নিয়ম কানুনের বিরোধীতা মুসলিম বিদ্বেষ নয়।

এই ব্যাপারটি বেশ জটিল, এর সাথে সাধারণ মানুষের মনস্তত্ব জড়িত থাকে। শেখ মুজিবের যৌক্তিক সমালোচনা অনেকের কাছে বাঙালি বিদ্বেষ বা পাকিস্তানী দর্শনের প্রচার মনে হতে পারে, কিন্তু আদতে সেটা সমালোচনার ধারাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা এবং অজ্ঞতাপ্রসূত জনপ্রিয় ভুল প্রপাগান্ডা। তেমনি মুহাম্মদের বা ইসলামের যৌক্তিক সমালোচনা একজন সাধারণ মুসলিমের কাছে মুসলিমদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এটা খুব সাধারণ মানের ভুল। কারণ মুসলমান কোন জাতি নয়, একটি সম্প্রদায়। ইসলাম কোন জাত নয়, একটি বিশ্বাস বা মতাদর্শ মাত্র।

ধর্মবিদ্বেষ 2

ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন ধর্মবিরোধী মানুষ, আমাকে ধর্মবিদ্বেষী বললেও ভুল হবে না, তবে সেটা অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিদ্বেষী বলতে হবে-মানবধর্ম নয়। আর এই ধর্মবিদ্বেষ মুসলিমদের হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষ অথবা হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম বিদ্বেষ বা আন্তঃধর্ম কলহ নয়, এটা একটি স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে ধর্মগুলোকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ এবং আন্তঃধর্ম কোন্দল ও ধর্মগুলোর মৌলিক ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সত্যনিষ্ঠ সচেতন ঘৃণা। উল্লেখ্য, অনেক প্রগতিশীল মানুষও ধর্ম আর ধার্মিকদের প্রায়শই গুলিয়ে ফেলেন। স্টিফেন হকিং বলেছেন, “The greatest enemy of knowledge is not ignorance, it is the illusion of knowledge.” ধর্মতত্ব এবং সেই ধর্মের অনুসারীদের গুলিয়ে ফেলা জ্ঞান নয়, জ্ঞানের ইল্যুশন মাত্র, এবং সেটা ক্ষতিকর। একজন ধর্মতত্বকে ঘৃণা করতে পারে, তার মানে এই নয় যে সে সেই ধার্মিকদের প্রতি সাম্প্রদায়িক, বা বিদ্বেষী। যেমন আমি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ঘৃণা করি, তাদের রাষ্ট্রীয় মৌলবাদী মানসিকতাকে ঘৃণা করি, কিন্তু পাকিস্তানের একটা শিশুকে ঘৃণা করার প্রশ্নই আসে না। একজন পাকিস্তানী শিশু আমার কাছে ততটাই পবিত্র যতটা আমার নিজের সন্তান।

তেমনি ইসলামের বিরোধীতা আর মুসলিম বিদ্বেষ কোনভাবেই এক হতে পারে না, দুটো স্বতন্ত্র বিষয়। আমি ইসলামের কঠোরতম সমালোচনা করি, আবার আমিই রোহিঙাদের মানবিক আশ্রয়ের পক্ষে কথা বলি। রোহিঙাদের মানবিক আশ্রয়ের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তাদের ধর্মীয় পরিচয় ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না, তারা মুসলিম কি হিন্দু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না; তারা হিন্দু হলেও একই ভাবে তাদের মানবিক অধিকারের পক্ষে দাড়াতাম। একইভাবে, আমেরিকায় বা ফিলিস্তিনে যেই মুসলিম পরিবারটি সাম্প্রদায়িকতার শিকার, তাকেও সমর্থন দেই, এবং মনে করি তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা চরমতম অমানবিক কাজ।

কিন্তু সেই একই সাথে এটাও সত্য, একটা ইসলামিক দেশে একজন অমুসলিমের নুন্যতম মানবিক অধিকার থাকে না। শুধু অমুসলিম কেন, একজন নারী একটি ইসলামিক দেশে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়। এবং আমাদের দেশ কখনও ইসলামিক দেশে পরিণত হলে মানবাধিকার হুমকির সম্মুখীন হবে, ধর্মান্ধরা যতই ইসলাম মানে শান্তি বলে চেঁচাক না কেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মুসলিমদের মধ্যে এই নিয়ে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না, বরঞ্চ মুসলিমরা ইসলামিক দেশগুলোর এই সকল বর্বর প্রথাকে বেশ স্বাভাবিকই মনে করেন এবং তার পক্ষে কথা বলেন। যখন সাধারণ মুসলিমরা ঐ সকল বর্বর প্রথার পক্ষে দাঁড়ায়, স্বাভাবিকভাবে তারাও নাস্তিকদের আক্রমণের শিকার হয়।

বাঙালি সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন,” মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তবে বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক” অথবা “বাঙালি একশো ভাগ সৎ হবে, এমন আশা করা অন্যায়- পঞ্চাশ ভাগ সৎ হলেই বাঙালিকে পুরস্কার দিয়ে উচিত”।

এই প্রবচনগুলো শুনেই য়্যাঁ য়্যাঁ য়্যাঁ করে ছুটোছুটির প্রয়োজন নেই। এই প্রবচনগুলো পড়ে যদি কারো ধারণা হয় হুমায়ুন আজাদ বাঙালি জাতিবিদ্বেষী, সেটা ঐযে-জ্ঞানের ইলিউশন মাত্র, এবং অজ্ঞতার চুড়ান্ত রুপ। এই প্রবচনগুলোতে বাঙালির চরিত্র সত্যনিষ্ঠভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং সমালোচনা করা হয়েছে। সেটা থেকে হুমায়ুন আজাদের বাঙালি বিদ্বেষ খুঁজতে যাওয়াটা বড়ধরণের বোকামি। তেমনি মুসলিমদের হিপোক্রেসী, তাদের অশিক্ষা কুশিক্ষা কুসংস্কার অন্ধত্ব ধর্মের প্রতি অন্ধ মোহ ধর্মের দোহাই দিয়ে আধুনিক সভ্যতা থেকে দূরে সরে যাওয়া মানবাধিকার লংঘন অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য, এবং এই সমালোচনায় “মুসলিম বিদ্বেষ” বলে অ্যায়্যাঁ অ্যায়্যাঁ অ্যায়্যাঁ করে কান্নাকাটির প্রয়োজন নেই, এই সমালোচনা মুসলিমদের অন্ধত্ব মোচনের জন্যেই জরুরী। এখন তো আর সেই সময় নেই, যে কেউ কিছু বললেই নাঙ্গা তলোয়ার হাতে নিয়ে আল্লাহো আকবর বলে জবাই দিয়ে দিলাম, এখন সমালোচনা সহ্য করতে হবে, এবং নিজেদের শুধরে নিতে হবে।

ইসলাম সহ সবগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মোটাদাগে সাম্প্রদায়িক এবং বিদ্বেষী; ধর্মতত্বগুলো পুরিপুরিভাবেই নারীকে দমন করতে চায়, বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রচার করে। এই ধর্মে পুরোপুরি বিশ্বাসী মাত্রই নিজ ধর্মের ঈশ্বরের রাজত্ব কায়েম করতে চায়, নিজের ধর্মের মানুষদের স্বজন ভাবে, অন্যধর্মের মানুষকে নরকের জ্বালানী ভাবে। এগুলো কোনভাবেই সভ্য আচরণ নয়।

ধর্মবিদ্বেষ 4

ঠিক তেমনি ইসলামে (ইসলামের ভিত্তি কোরান হাদিসে) পুরোপুরি বিশ্বাসী মানুষ মাত্রই সাম্প্রদায়িক।শুধু ইসলাম নয়, সকল ধর্মে পুরোপুরি বিশ্বাসী মানুষ মাত্রই সাম্প্রদায়িক। এবং তাদের এই সাম্প্রদায়িক চরিত্রের সমালোচনাটাও যৌক্তিক, তাদের শিক্ষার প্রতি অনিহা, বিজ্ঞান বিমুখতা, প্রগতিকে ভয় পাওয়ার নির্বুদ্ধিতাও সমালোচনার যোগ্য। তাদের অবস্থান বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, মানব সমাজের প্রগতিতে তাদের অবদান যাচাই করতে হবে। তারা যদি “কোরানেই সকল জ্ঞান বিজ্ঞান লেখা আছে” এই ধরনের মতবাদে বিশ্বাস করে এবং সারাজীবন কোরান মুখস্ত করেই পার করে দেয়, সেটার সমালোচনা অবশ্যই জরুরী। তারা যদি বিবর্তনবাদ ইসলাম বিরোধী বলে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ করে, তবে তাদের “সৃষ্টিতত্ব” নিয়ে কৌতুক করাও জরুরী, আঘাত করে ধ্বসিয়ে দেয়াও জরুরী। তারা যদি মাদ্রাসা শিক্ষার নামে মৌলবাদী জঙ্গি উৎপাদন গৃহপালিত জীবের খোয়াড় বানাতে চায়, সেটার তীব্র বিরোধীতাও করতে হবে। তারা যদি নারীকে কালো বস্তায় ঢুকাবার জন্য ইমোশোনাল ব্লাকমেইল করে, সেসবের জবাবটাও তাদের সহ্য করতে হবে।

শ্রদ্ধেয় মুরতাদ আহমদ শরীফ বলেছেন, “ধর্মীয় দর্শনের বিরোধিতা না করে সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা অর্থহীন শুধু নয়, ‘মোনাফেকি’ও বটে। সব ধর্মবিশ্বাসীই মনে মনে সাম্প্রদায়িক -অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মকে অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা-ঘৃণা না করে নিজ ধর্ম পালন করা কার্যত অসম্ভব।” তাই সব ধার্মিকই তাঁর মতে সাম্প্রদায়িক, যদিও সব সাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষ ধার্মিক নাও হতে পারে।

আমরা কামনা করি, ধর্মগুলো সময়ের সাথে, আধুনিক মূল্যবোধের সাথে নিজেদের পরিবর্তন করে নেবে, নারী অধিকার থেকে শুরু করে সকল মানুষের সমান অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। তারা তাদের পৌরানিক কল্পকাহিনীগুলোকে গল্প হিসেবেই গ্রহণ করবে, এবং আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজন্মের জন্ম দেবে। কিন্তু তা হচ্ছে না, বরঞ্চ দুইএকটি ধর্ম দাবী করছে, তাদের ধর্মের সেই আদিম অবস্থায় ফিরে গেলেই তারা ভাল থাকবে। এই কারণেই খেলাফতের আন্দোলন হয়, এই কারণেই ইসলামী শাসন ব্যবস্থা আর শরীয়া আইনের মত মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবস্থার পক্ষে বোমাবাজি হয়। শুধু তাই নয়, হিপোক্রেট ধর্মান্ধদের আহাম্মকি দেখলে রীতিমত মুগ্ধ হতে হয়। তারা এতটাই নিষ্ঠার সাথে আহাম্মকি করেন যে, সেসব দেখে এই সম্প্রদায়ের উপরে করুনা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

এই সেদিনই দেখলাম, সানি লিওনের মুসলিম হবার খবর “বান্দা শরীফ” নামক একটি পেইজ থেকে দেয়া হয়েছে একটি এডিট করা ছবি সহকারে। মুমিন মুসলমানগন এই ছবিটি ৩৫ হাজার বারের বেশি শুধু শেয়ার করেছেন, এই বিশ্বাসে যে সানি লিওন আসলেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। শুধু তাই নয়, গরুর পেটে আল্লাহ থেকে শুরু করে গাছপালা সর্বত্র আল্লাহ লেখা খুঁজে বেড়ানো, কোরানে বিজ্ঞান খুঁজে বেড়ানো এই বিশ্বাস নির্ভর সম্প্রদায় পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞান প্রসারে বিন্দুমাত্র অবদান রাখছে না। আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতার সব সুযোগ গ্রহণ করে তারা তা কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের বিশ্বাস প্রচারে। ফেসবুকে ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অমুক তমুকের ইসলাম গ্রহণ, অমুক গাছ পাতা মাংশে আল্লাহ লেখা, অমুক আয়াতের সাথে বিজ্ঞানের অমুক অংশের মিল। মুসলিমদের কাছে জ্ঞানী মানুষ হচ্ছে মুখস্তবাজ ভুলভাল বকা জোকার নায়েক, যেখানে বাঙালি মুসলমান অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বা আহমদ শরীফের নামটাও জানে না। এই আহাম্মকি সমালোচনার যোগ্য, এবং এগুলো কারো হাস্যরস উৎপাদন করলে মোটেও দোষ দেয়া যায় না।

এই ম্যাস হিস্টিরিয়া, এই আহাম্মকি, এই বোকামী, এই শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখতা এবং বিশ্বাস নির্ভরতা যত বাড়বে, মানুষ তত মূর্খ থাকবে। এবং মানুষ যত মূর্খ থাকবে, তাদেরকে শোষনটাও ততটাই সহজ হবে, ততটাই সুচারুভাবে তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া যাবে। সত্যের সামনে এসে দাঁঁড়ালে তারা আঘাত পাবে, আহত হবে, নিজেদেরকে নির্যাতিত মনে করবে, তাদের বিশ্বাসকে ধ্বসিয়ে দেবে, তবে সেটা মানুষ হিসেবে তাদের অধিকারের পক্ষেই যাবে।

তাই সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা তৈরি এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়া ছাড়া আসলে আস্তিকদের উপায় নেই। এবং অমুক তমুক বিদ্বেষের ধোঁঁয়া তুলে সমালোচনার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টাটা তাদের মধ্যযুগীয় কুয়াতে আরো বেশি জোরে টেনে নিয়ে যাবে, মুসলিম মনন ভরে উঠবে ১৫’শ বছরের পুরনো দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনায়।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


%d bloggers like this: