সূচিপত্র
ভূমিকা
কুরআনের সূরা তারিকের ৫ থেকে ৭ নং আয়াত বলে, বীর্য নির্গত হয় বা আসে মেরুদণ্ড এবং বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে। কুরআনের এই কথাটি কুরআনের অন্যতম বড় বৈজ্ঞানিক ভুল হিসেবে সমালোচিত। কুরআনের এই কথাটি ভুল নয় প্রমাণ করতে ইসলামিস্টরা এপর্যন্ত বেশকিছু ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য কুরআনের এই বক্তব্যটি পর্যালোচনার মাধ্যমে বাস্তবতা উপস্থাপন করা।
আয়াত সমূহ
সূরা আত-তারিক আয়াত ৫
فَلْيَنْظُرِ الْإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ
ফালইয়ানযুরিল ইনছা-নুমিমমা খুলিক।
অতএব, মানুষের দেখা উচিত কি বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে।
সূরা আত-তারিক আয়াত ৬
خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ
খুলিকা মিমমাইন দা-ফিকি।
সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে।
সূরা আত-তারিক আয়াত ৭
يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ
ইয়াখরুজুমিম বাইনিসসুলবি ওয়াত্তারাইব।
এটা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও বক্ষপাজরের মধ্য থেকে।
বীর্য নাকি অন্যকিছু?
উপরে উল্লেখিত আয়াত সমূহ পড়লে আমরা জানতে পারি যে, কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষকে সৃষ্টি করা হয় দ্রুতবেগে নির্গত তরল থেকে যা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে। এখানে সবেগে স্খলিত পানি বা দ্রুতবেগে নির্গত তরল বলতে নিঃসন্দেহেই বীর্যকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, এখানে মানুষ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায় একজন মানুষের মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে আসা এমন এক তরল পদার্থের কথা বলা হয়েছে যা থেকে আরেকজন মানুষ বা সন্তান সৃষ্টি হয়। এখানে মানবদেহের এক প্রকার তরলকে সন্তানের উৎস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং সন্তানের উৎসের সাথে জড়িত তরল অবশ্যই মানবদেহের যৌন তরল হবে, যা বীর্য। অতএব, উপরে উল্লেখিত আয়াত সমূহে সবেগে স্খলিত পানি বলতে নিঃসন্দেহেই বীর্য বুঝানো হয়েছে। তাই সরাসরি বীর্য লেখা হয়নি বলে বীর্য বুঝানো হয়নি এমনটা ভাববার কোনো সুযোগ নেই।
প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের ব্যাখ্যা
ব্যাখ্যা ১ – মানুষ দ্রুতবেগে নির্গত পানি বা নারী-পুরুষের বীর্য থেকে সৃষ্টি হয়। পুরুষের বীর্য নির্গত হয় তার মেরুদণ্ড থেকে এবং নারীর বীর্য নির্গত হয় তার বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে। নারী-পুরুষ উভয়ের বীর্যের মিশ্রণ থেকে সন্তান জন্ম নেয়। (ইবনে কাসির, তাবারী, জালালাইন, খোমেনী, যামাখশারী)
ব্যাখ্যা ২ – আয়াতটি কেবল পুরুষের বীর্যের কথাই বলছে, যা তার মেরুদণ্ড এবং বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে নির্গত হয়। (কুরতুবী, কাইয়িম, উসাইমীন, সাদী)
মন্তব্য
কুরআনে আলোচ্য আয়াতটি যদি এটি বুঝিয়ে থাকে যে, পুরুষের বীর্য নির্গত হয় তার মেরুদণ্ড থেকে এবং নারীর যৌন তরল নির্গত হয় তার বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে, তাহলে আয়াতটি অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। একজন পুরুষের বীর্য তার মেরুদণ্ড থেকে নির্গত হয় না। আর একজন নারীর বুকের পাঁজর থেকে প্রজনন সম্পর্কিত কোনোকিছুই নির্গত হয় না।
একইভাবে, আয়াতটি যদি এটি বুঝিয়ে থাকে যে, একজন পুরুষের বীর্য তার মেরুদণ্ড এবং বুকের পাঁজরের মধ্যে থেকে নির্গত হয়, তাহলেও আয়াতটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। একজন পুরুষের বীর্য না তার মেরুদণ্ড বা বুকের পাঁজর থেকে বেরিয়ে আসে, না এমন কোনো অঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসে যা তার মেরুদণ্ড এবং বুকের পাঁজরের মধ্যে অবস্থিত।
মানুষের বীর্য চারটি গ্রন্থির উৎপাদিত বস্তু দ্বারা গঠিত : অন্ডকোষ শুক্রাণু বা পুংজননকোষ উৎপাদন করে, সেই শুক্রাণু যে তরলে বাহিত হয় তা আসে সেমিনাল ভেসিকল, প্রোস্টেট গ্রন্থি এবং বালবোইউরেথাল গ্রন্থি থেকে। এই ভিডিওটি খুব সুন্দরভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেঃ
মুসলিম অ্যাপোলজিস্টদের ব্যাখ্যা সমূহ
“সুলব শব্দটির নানা অর্থ রয়েছে, যেমনঃ কঠিন, দৃঢ়, শক্ত, অনমনীয়। শব্দটি দ্বারা মেরুদণ্ডের যেকোনো অংশও বোঝায়, বিশেষভাবে কটিদেশীয় অংশ বা কোমর। আর কোমর সেক্স অরগ্যান বা যৌন অঙ্গসমূহের একটি ইউফেমিজম (শ্রুতিকটু পদের পরিবর্তে কোমলতর পদের প্রয়োগ)।“
প্রখ্যাত আরবী-ইংরেজী ডিকশনারি Len’s Lexicon অনুযায়ী ‘সুলব’ শব্দটির অর্থ সমূহ হচ্ছেঃ কঠিন, দৃঢ়, শক্ত, অনমনীয়, মেরুদণ্ড, পিঠের একটি অংশ, কশেরুকা ধারণকারী পিঠের যেকোনো অংশ, কটিদেশীয় অংশ বা কোমর। (1)
এখন কথা হলো, কুরআনের আয়াতটিতে যদি ‘সুল্ব’ শব্দটি দ্বারা আসলেই ‘কোমর’ বুঝানো হয়ে থাকে, তাহলে কি কুরআনের আয়াতটি নির্ভুল প্রমাণিত হয়? অবশ্যই নয়।
অ্যাপোলজিস্টদের এই ব্যাখায় সমস্যা হলো এই যে, ইংরেজি ভাষাতেই ‘কোমর’ শব্দটি দ্বারা কোমল বা পরোক্ষ অর্থে প্রজনন অঙ্গ সমূহ বোঝায়, আরবি ভাষায় নয়। অ্যাপোলজিস্টরা এমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন না যা নিশ্চিত করে যে প্রাচীন আরবরা ‘কোমর’ শব্দটি দ্বারা কোমল বা পরোক্ষ অর্থে প্রজনন অঙ্গ সমূহ বোঝাতো।
Oxford English Dictionary অনুসারে Loins (কোমর) শব্দটির প্রাইমারি ডেফিনেশন (2) নিচে তুলে ধরা হলোঃ
শব্দটির সেকেন্ডারি ডেফিনেশন অনুযায়ী, শব্দটি যৌনাঙ্গ বা লজ্জা স্থান সমূহের জন্য একটি ইউফেমিজম (কোমল বা পরোক্ষ অর্থের প্রকাশ)। Oxford English Dictionary ও Online Etymology Dictionary (3) উভয় ডিকশনারিই তা নিশ্চিত করে:
ইউফেমিস্টিক সংজ্ঞাটি বর্ণনা করা হয়েছে ‘কারো যৌনাঙ্গ বা লজ্জা স্থান সমূহ’ হিসেবে, যা ষোড়শ শতাব্দীর সময় উদ্ভূত হয়। কোনো ইংরেজি শব্দের ষোড়শ শতাব্দীর সময় জন্ম হওয়া একটি সংজ্ঞাকে সপ্তম শতাব্দীতে ব্যাবহৃত হওয়া একটি আরবী শব্দের ওপর আরোপ করা অত্যন্ত হাস্যকর।
“তারায়িব শব্দটির অর্থ বুকের হাড়, বুকের পাঁজর অথবা শ্রোণী ঘোর। আর নারী জননকোষ শ্রোণী ঘোর অঞ্চল থেকে আসে।“
‘তারায়িব’ শব্দটির অর্থ যে ‘শ্রোণী ঘোর’, তার কোনো নির্ভরযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। আরবি-ইংরেজি ডিকশনারি Lane’s lexicon অনুযায়ী ‘তারায়িব’ শব্দটির অর্থসমূহ হচ্ছেঃ বুকের হাড়, বুকের হাড় যা কণ্ঠা এবং স্তনের বোঁটার মধ্যে অবস্থিত, বুকের সেই অংশ যা দুই কণ্ঠার নিচে অবস্থিত, দুই স্তন এবং কণ্ঠার মধ্যবর্তী অংশ, বুকের ডান পাশের চার পাঁজর এবং বাম পাশের চার পাঁজর, দুই হাত এবং দুই পা এবং দুই চোখ, দুই কণ্ঠার নিচে অবস্থিত দুই পাঁজর। তবে, বেশিরভাগ শব্দবিজ্ঞানী ‘বুকের হাড়’ অর্থটিকেই সঠিক অর্থ বলেছেন। (4)
‘বুকের হাড়’ অর্থটিই ‘তারায়িব’ শব্দের সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য অর্থ হতে পারে। কেননা, আরবী ভাষায় এবং আরবী কাব্যে সেটাই সুপরিচিত ব্যবহার। (5)
এছাড়াও, একটি শব্দ দ্বারা যদি একই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুটি স্বতন্ত্র পরিভাষা নির্দেশ করা হয়, তাহলে ভাষার উদ্দেশ্য কি? ধরা যাক, কিছু ব্যক্তি শনিবার আর বুধবারকে “মজাবার” বলে সংজ্ঞায়িত করে। গড়বড় তৈরি করা ছাড়া এমন একটি শব্দের উদ্দেশ্য আর কি হতে পারে? “এই মজাবারে আমার জন্মদিন” এরকম বাক্যের জন্য সবসময়ই আরও ক্ল্যারিফিকেশন প্রয়োজন হবে। আর তাই এটা অনুমান করা অর্থহীন যে এরকম শব্দের অস্তিত্ব আদৌ আছে।
“আধুনিক দেহতত্ত্ব অনুযায়ী, বীর্যের প্রধান উৎস হলো সেমিনাল ভেসিকল থেকে আসা তরল আর এই ভেসিকল সমূহ মেরুদণ্ড এবং বুকের পাঁজরের মধ্যেই পড়ে।” (খাড়াভাবে বা উপর থেকে নিচ বরাবর ধরা হলে)।
এখানে প্রশ্ন এসে যায়, ‘মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজরের মধ্যে’ কথাটি খাড়াভাবে বা উপর থেকে নিচ বরাবর ধরে ব্যাখ্যা করা গ্রহনযোগ্য কিনা। এভাবে ব্যাখ্যা করলে ‘মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজরের মধ্যে’ কথাটি দ্বারা হাত পা ও মাথা বাদে পুরো শরীরেরই ভেতরের অংশকে নির্দেশ করা যাবে। নিচের চিত্রটি দেখুন:
হ্যাঁ অ্যাপোলজিস্টরা এই ব্যাখাটি ব্যবহার করে দাবি করতে পারেন যে সূরা তারিকের ৭ নং আয়াতটি সঠিক। তবে এই ব্যাখাটি কুরআনের আয়াতটিকে আরও বেশি সমস্যার মধ্যে ফেলে দেয়, কেননা এই ব্যাখাটি আয়াতটিকে অত্যন্ত অস্পষ্ট একটি আয়াত হিসেবে প্রমাণ করে।
ধরা যাক, কোনো স্কুলে গণিত পরীক্ষা হচ্ছে এবং সেই পরীক্ষার একটা প্রশ্ন হলো, ‘২৩৯৮৬ এবং ৪৯৬২৭ যোগ করলে কতো হয়?’ রাশেদ নামে একজন ছাত্র এই প্রশ্নের উত্তর লিখলো ‘কোনো এক সংখ্যা’, আবার শফিক নামে একজন ছাত্র উত্তর লিখলো ‘অনেক বড় একটি সংখ্যা’ এবং শ্রাবণী নামে একজন ছাত্রী উত্তর লিখলো ‘৭৩৬১৩’।
‘২৩৯৮৬ এবং ৪৯৬২৭ যোগ করলে কতো হয়?’ এই প্রশ্নের একেবারে সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো ‘৭৩৬১৩’। তবে কি রাশেদ আর শফিকের উত্তর সঠিক নয়? হ্যাঁ তাদের উত্তরও সঠিক। ‘৭৩৬১৩’ সংখ্যাটি কোনো একটি সংখ্যাই। তাই কেউ যদি রাশেদের মতো বলে ‘৭৩৬১৩’ সংখ্যাটি ‘কোনো একটি সংখ্যা’, তাহলে ভুল কিছু বলা হয় না। আবার, ‘৭৩৬১৩’ সংখ্যাটি অনেক বড় একটি সংখ্যাও। তাই কেউ যদি শফিকের মতো বলে ‘৭৩৬১৩’ সংখ্যাটি ‘অনেক বড় একটি সংখ্যা’, তাহলেও ভুল কিছু বলা হয় না। রাশেদ আর শফিকের পরীক্ষার খাতা যে শিক্ষক দেখবেন তিনি কি তাদের এই প্রশ্নের উত্তর সঠিক বলে গ্রহণ করবেন এবং মার্কস দেবেন? অবশ্যই নয়, কোনো যুক্তিবাদী শিক্ষকই এমনটা করবেন না। কেন করবেন না? কারণ রাশেদ আর শফিকের উত্তরটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেন গ্রহণযোগ্য নয়? কারণ, ‘৭৩৬১৩’ সংখ্যাটি কোনো একটি সংখ্যা হলেও সকল সংখ্যাকেই ‘কোনো একটি সংখ্যা’ বলা যায়। আবার, ‘৭৩৬১৩’ সংখ্যাটি অনেক বড় একটি সংখ্যা হলেও এমন সংখ্যার কোনো শেষ নেই যাদের ‘অনেক বড় একটি সংখ্যা’ বলা যায়। তাই ‘২৩৯৮৬ এবং ৪৯৬২৭ যোগ করলে কতো হয়?’ প্রশ্নটির উত্তরে ‘কোনো একটি সংখ্যা’ বা ‘অনেক বড় একটি সংখ্যা’ বলা হলে তা হবে খুবই অস্পষ্ট ও অগ্রহণযোগ্য উত্তর!
একই সমস্যা কুরআনের আয়াতেও এসে পড়ে যদি সূরা তারিকের ৭ নং আয়াতের ‘মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজরের মধ্যে’ কথাটি খাড়াভাবে বা উপর থেকে নিচ বরাবর ধরে ব্যাখ্যা করা হয়। এভাবে ব্যাখ্যা করলে ‘মেরুদণ্ড ও বুকের পাঁজরের মধ্যে’ কথাটি দ্বারা হাত পা ও মাথা বাদে একজন মানুষের পুরো শরীরের ভেতরটাই নির্দেশ করা যায়। একজন পাঠকের এখানে বোঝার কোনো কায়দা নেই যে বীর্য আসলে দেহের কোথায় থেকে বের হয়ে আসে। এখানে এটা বোঝারও কোনো কায়দা নেই যে কুরআনের লেখক আসলেই জানেন কিনা যে একজন মানুষের বীর্য তার দেহের ঠিক কোন জায়গা থেকে বের হয়ে আসে।
তথ্যসূত্র:
- “Sulb” Edward William Lane. An Arabic-English Lexicon. Librairie Du Liban 1968. Vol.4, page 1712
- “loin, n.” The Oxford English Dictionary. 2nd edition, 1989; online version June 2012.
- “Loin”. Online Etymology Dictionary.
- “Taraib” Edward William Lane. An Arabic-English Lexicon. Librairie Du Liban 1968 Vol 1 page 301
- Commentary on the verse “He is created from a water gushing forth, Proceeding from between the back-bone and the ribs” (at-Taariq 86:6-7) – Islam Questions And Answers.
আরও পড়ুনঃ
Leave a Comment