সম্পাদকীয়প্রশ্নোত্তর

মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে স্বর্গ নরক!

দীর্ঘদিন আগে এক ধর্মবিশ্বাসী লোকের সাথে ধর্মতত্ত্বের ত্রুটি নিয়ে আলোচনার সময় সে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি তো ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না। ধরো ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী একটি শিশু, যে ভাবছে মৃত্যুর পরে তার জন্য অপেক্ষা করছে অনেক বার্বিডল, অনেক চকলেট, অনেক খেলনা, তাকে গিয়ে কী তুমি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে বোঝাবে যে আসলে কোন ঈশ্বর নেই? স্বর্গ নরক সবকিছুই অর্থহীন কল্পকাহিনী? সেই শিশুটির শেষ আশ্রয়ের জায়গাটুকু কী তুমি কেড়ে নেবে?

মৃত্যুপথযাত্রী একটি শিশুকে ধর্মের ত্রুটি বর্ণনা করে নাস্তিক বানানো? না। অবশ্যই আমি এই কাজটি করবো না। বরঞ্চ আমার বিশ্বাসের বিপরীতে গিয়ে হলেও শিশুটিকে আরো ভালভাবে বোঝাবো যে, স্বর্গে তার জন্য আরো অনেক অনেক ভাল কিছু অপেক্ষা করছে। অজস্র খেলনা, কম্পিউটার, টিভি, চকলেট, কোকাকোলা অথবা যা সে খেতে চায়, সব সে সেখানে পাবে। স্বর্গের সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে হাসিমুখে শিশুটির মৃত্যু হোক, শিশুটি একটা আশা নিয়ে মারা যাক, মৃত্যুর পরেও কিছু রয়েছে এই সুখানুভূতি তার জন্য থাকুক, এর চাইতে ভাল মৃত্যু আর কিছু হতে পারে না। যুক্তিতর্ক, বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক আলোচনা তার জন্য নয়। তার শান্তিতে মৃত্যু হোক।

যে প্রশ্নটি করেছিল, তাকে বলেছিলাম ধর্মে অবিশ্বাসী হবার আগে আমি একজন মানুষ। মানুষের পরিচয় শুধু সেটুকুই। তার কাছে ধর্মের অসারতা প্রচার করার মত নির্বোধ আমি নই। তার জায়গাতে দাঁড়িয়ে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীয়তা খুবই গৌণ আলোচনা। মিথ্যা বলে হলেও তার মানসিক শান্তি এখানে জরুরী। আমি এরকম মিথ্যাকে অন্যায় মনে করি না।

সে বিজ্ঞের হাসি হেসে বলেছিল, ঐ শিশুটির আবেগটুকুই ধর্মের প্রয়োজনীয়তা। ঐ শিশুটির হাসিটুকুই ধর্মের প্রয়োজনীয়তা। আমি অস্বীকার করিনি। এখানে প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে।

মানুষ অল্প বয়সে নানা বিষয় বিশ্বাস করে। এমনভাবে বিশ্বাস করে যে, সেগুলো তাদের অস্তিত্বের অংশে পরিণত হয়। কিন্তু একটা সময় মানুষ শিক্ষিত হয়, প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়। তখন সে নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। ছোটবেলা আমাকেও মা বলতো, দুষ্টুমি করলে এক ছেলেধরা বুড়ি এসে আমাকে ছালায় ভরে ধরে নিয়ে যাবে। বড় হওয়ার পরে আমি বুঝেছি, সেগুলো বানানো কাহিনী। এরকম কোন ছেলেধরা আসলে নেই। কিন্তু ছেলে ধরা বুড়ির ক্ষেত্রে সবাই একসময় বড় হয়, প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়। ধর্মের গল্পকাহিনীর বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষই প্রাপ্তবয়ষ্ক হতে পারে না। আকাশে কোন ঈশ্বর সাহেব বসে নেই বললে বাচ্চাশিশুদের মত হাত পা ছুড়ে কাঁদতে বসে যায়।

কিন্তু ধরা যাক, সেই একই মৃত্যু পথযাত্রী শিশুটির কাছে একজন পাদ্রী, একজন ইমাম, একজন রাবাই, একজন হিন্দু পুরোহিত এসে নিজ নিজ ধর্মের গুণগান এবং অন্য ধর্মের সমালোচনা শুরু করলো। আল্লা বড় নাকি ভগবান, যীশুর পিতা বড় নাকি শিব, জিহোভা বেশি শক্তিশালী নাকি জিউস, কালী দেবী বেশি করুণাময় নাকি ইব্রাহিমের ঈশ্বর, মৃত্যুপথযাত্রীকে তা বোঝানোর অশ্লীল প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তারা বোঝাতে শুরু করলো এই কষ্ট আসলে ঈশ্বরের পরীক্ষা, এটা হাসিমুখে সহ্য করলেই ঈশ্বর খুশি হবে। তাকে এত প্রচণ্ড কষ্ট দেবার পরেও ঈশ্বরকে পরমকরুণাময় বলে মানতে হবে। হয়তো তার ক্যান্সার হচ্ছে তার শাস্তি, বা পরীক্ষা, তাই তা মেনে নিতে হবে। শিশুটাকে মুসলিম ইমাম বোঝালো যে ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করে মৃত্যু হলে নরকে অনন্তকাল জ্বলতে হবে, শিরক করা মহাপাপ! নরকে সাপের কামড় খেতে হবে, প্রতিদিন নিয়ম করে মারপিট করা হবে ইত্যাদি নানান ভয়ংকর ভয়ংকর কাহিনী। খ্রিষ্টান পাদ্রী বললো যে যীশুকে মেনে না নিলে অনন্তকাল নরকের আগুন অপেক্ষা করছে, ঈশ্বর অপেক্ষায় আছে লাঠি হাতে। তার মগজ গরম পানিতে সিদ্ধ করা হবে। রাবাই-পুরোহিতও একই কাজ করলো। শিবের ভক্তরা আরো কঠিন কঠিন শাস্তির বর্ণনা দিতে শুরু করলো। ভেবে দেখুন তো, তখন কেমন হবে? একজন মৃত্যু পথযাত্রী শিশুকে নিজ ধর্মের দিকে টানা হেঁচড়া, লোভলালসা দেখানো, অন্য ধর্ম পালন করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন এসবই বা কতটুকু মানবিক আচরণ? একজন মানুষকে নিয়ে এক এক ধর্মের, এক এক ঈশ্বরের, এক এক পয়গম্বরের এক কী টানাহেচড়া!

একটা শিশুর জন্য যুক্তিবাদ-মহৎ দার্শনিক চিন্তা-সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ-মানবাধিকারের বুলি-ধর্ম-রাজনীতি-জাতীয়তাবাদী চেতনা-যুদ্ধের কথিত আদর্শিক কারণ, এসবই অর্থহীন। একটা শিশুর জন্য আমরা একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি নি, গোত্রে গোত্রে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, দেশে দেশে বিভক্ত হয়ে একে অপরকে হত্যা করে যাচ্ছি। যা তাদেরকেই সবচাইতে বেশি ভোগাচ্ছে। এইযে এতো ধর্ম যুদ্ধ, গলাকাটাকাটি, এই পৃথিবীর জন্য তো সে দায়ী নয়।

সম্প্রতি সিরিয়ান ৩ বছর বয়সী একটি শিশু, যে বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল, বোমায় যার একটা পা উড়ে গিয়েছিল, মৃত্যুর আগে কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবীর মানুষগুলোকে বলে গেছে, সে ঈশ্বরকে গিয়ে সবকিছু বলে দেবে। মানুষের কাছে তার নালিশ করার কথা ছিল, কিন্তু মানুষ তাকে বোমা দিয়েছে। পৃথিবীর প্রতি, পৃথিবীর মানুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা, আক্ষেপ আর ক্ষোভ নিয়ে মরে গেল শিশুটা। এই লাশ কে বহন করবে? বাঙলাদেশে আজ দুটো শিশু বোমার আঘাতে আহত হয়েছে। একজন মতিহার থানা জামায়াতের আমিরের দশ বছর বয়সী ছেলে হাসানুল হক বান্না এবং আরেকজন ঐ জামাতের আমিরের ছোটভাই জামায়াত নেতা আব্দুস সালাম সবুরের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে মুসান্না। তারা নিজেদের বাড়ির পাশে আম বাগানে খেলতে গিয়ে লুকিয়ে রাখা বোমা বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। জামাত বিরোধী কতিপয় দলান্ধ হয়তো এই ঘটনা শুনে খুশিতে নৃত্য জুড়ে দেবে। যারা মারা গেছে তারা তো আর মানুষ না, জামাত নেতার পুত্র! ঠিক যেমন সুপ্রিম কোর্টে চারজন পুরুষ সন্ত্রাসী মিলে একজন নারীকে পেটানোতে তারা উল্লাশ প্রকাশ করলো! কিন্তু এই ছেলেগুলো জানে না জামাত ইসলাম কী, এই ছেলেগুলো জানে না রাজনীতি কাকে বলে, তারা বোঝে না বোমা কী। এই ছেলেগুলোর আহত হবার দায় কে নেবে? এখানে তারা জামাতী নেতার পুত্র, সেই পরিচয় কী খুব জরুরী?

দিনশেষে ধর্ম, নাস্তিকতা, রাজনীতি, রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ, মতবাদ, এই সবকিছুর চাইতে একটি মৃত্যুপথযাত্রী শিশুর কান্না বড় হয়ে ওঠে। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটি শিশুর শরীর এই সকল ভারী ভারী দর্শনের চেয়ে, যুক্তিবাদের চেয়ে ভারী হয়ে ওঠে। যেই ধর্মের, যেই রাজনীতির, যেই দর্শনের, যেই চিন্তার ক্ষমতা নেই একটি শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ দেয়ার, তার জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকারও তাদের নেই।

( পুরনো লেখা আর্কাইভ থেকে )

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *