বিপদের সময়ে নাস্তিকের মুখে আল্লাহর নাম

Print Friendly, PDF & Email

আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে প্লেনে করে একবার যাচ্ছিলাম আরেকটি দেশে। একটা হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে যোগ দিতে। প্লেনে উঠেই আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, তুমুল তর্ক বিতর্ক শুরু হয়েছিল একটা ব্যাপার নিয়ে। ব্যাপারটা হচ্ছে, ধর্ম কীভাবে এখনো বিশ্ব রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে গেছে। এতদিনে তো এই প্রাগৌতিহাসিক বিষয়টা জাদুঘরে চলে যাওয়া উচিত ছিল। এখনো কেন রাজনীতিতে এটা একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তুমুল আলোচনা হচ্ছিল বন্ধু উডোর সাথে, সেই সাথে যোগ দিয়েছিল থেরেসা, আনা, জোসেফ, ইয়ান, মারসিন, ওয়ালিদ এবং রয়। তুমুল তর্ক বিতর্ক চলছে, চলছে তো চলছেই। হঠাৎ বিমান একটু কেঁপে উঠলো। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় বজ্রপাত হচ্ছে। একটু পরেই বিমান থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কাঁপতে কাঁপতে পুরোই টালমাটাল অবস্থা। এই বিপদের সময়ে বিমানের পাইলট বারবার ঘোষণা দিতে লাগলো, আপনারা দয়া করে সিটবেল্ট বেঁধে নিন, এবং আমরা একটা ঝড়ের মধ্যে পড়েছি। ঝড়ের কারণে বিমানের নিয়ন্ত্রণে খানিকটা ঝামেলা হচ্ছে, আশাকরি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বিমানের নিয়ন্ত্রণ ঠিক করতে পারবো। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বুক কেঁপে উঠলো। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এইরকম সময়ে সবারই আল্লাহ ভগবান ঈশ্বর যীহোভা ইত্যাদির কথা মনে হয়। আমিও ভাবতে লাগলাম, এখন যদি মরে যাই? সারাজীবন তো ধর্মের কম সমালোচনা করলাম না। আল্লাহ নবী যীশু ভগবান কাউকেই বাদ রাখি নাই। এই কী তার শাস্তি? হায় আল্লাহ! আমার এবার কী হবে? এখন উপায়? ইয়া মাবুদ!

তখন মনে হল, এই বিপদ থেকে একমাত্র আল্লাহই আমাকে রক্ষা করতে পারেন। কুলহু আল্লাহ পড়ে তিনবার ফুঁঁ দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, এই দফা বেঁচে গেলে একজন খাঁটি মুমিন হয়ে যাবো। বেঁচে গেলেই না, এই মূহুর্তেই খাঁটি মুসলমান হয়ে গেলাম। এখন থেকে ইসলামী ইমান আকিদা অনুসারে বাকিটা জীবন পাড় করবো। তওবা পড়তে লাগলাম, এবং আল্লাহর কাছে পূর্বের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাইতে শুরু করলাম। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ আকবর …

সাথে সাথে মনে হল, আমার পাশে বসা উডো হচ্ছে একজন গে, ঐদিকে থেরেসা হচ্ছে একজন লেসবিয়ান। এতক্ষণ এসব কথা মনে ছিল না। মনে ইসলাম চাগাড় দিয়ে উঠতেই মনে হতে লাগলও। ঘিন্নায় মুখ বেঁকিয়ে গেল, ছিঃ! এই দুইজন তো প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধী। দুইজনকেই সমকামিতার দায়ে জবাই দেয়া উচিত। অথবা পাথর ছুড়ে মারা উচিত। শরীয়ত অনুসারে সমকামিতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যেন অন্য কেউ সমকামিতার সাহস কোনদিন না করে। এরা এখনো বেঁচে আছে কীভাবে?

এরপরে তাকালাম আনার দিকে। সে একজন রেডিক্যাল ফেমিনিস্ট। নারীর অধিকার নিয়ে খুব সোচ্চার। মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহ যথার্থই বলেছেন। নারী হচ্ছে পুরুষের জন্য শস্যক্ষেত্র। আনাও আমার জন্য শস্যক্ষেত্র। আর সুরা নিসায় বউ পেটাবার কথাও আছে। সম্পত্তিতেও এদের দিতে হবে পুরুষের অর্ধেক। মহানবী এটাও বলেছেন দোজখে নারীর সংখ্যাই বেশি হবে। বুখারী হাদিসে আছে কুকুর, গাধা ও মহিলা হচ্ছে অপবিত্র। এই মেয়ে বোরখা পড়ে না, হিজাব করে না, পর্দা পুশিদা কিছুই নাই। জিনস প্যান্ট পড়ে ঘোরাঘুরি করে। পরপুরুষের সাথে একত্র বসে চা বিড়ি খায়! এই টাইপের বেহায়া বেগানা আউরাতের জন্যেই তো এই ধরণের দুর্ঘটনা হয়। এটাকেও ধরে কঠিন শাস্তি দেয়া উচিত। পিটাইয়া বোরখা পরানো দরকার।

উল্টা দিকে বসা ইয়ান। সে আবার কড়া নাস্তিক। ধর্মের কঠিন সমালোচক। মনে মনে গালি দিয়ে ভাবলাম, শালার নাস্তিকের বাচ্চার কল্লা ফালাই দেয়া দরকার। নাস্তিক হচ্ছে ইসলামের বড় শত্রু। ইসলামের আর সমালোচনা করবি? একটা চাপাতি নিয়ে কোপাইয়া তামাতামা করা উচিত এইটারে। কুচি কুচি করে কাটা উচিত। আবার গানও গায়, গান গায় জন লেননের ইম্যাজিন নো হেভেন… নো রিলিজিয়ন টু … কী জঘন্য গান! জানে না, গান বাজনা ইসলামে হারাম? তাও আবার বলে ধর্মহীন দুনিয়া!

এরপরে তাকালাম জোসেফের দিকে। এই শালা একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করে। হারামি একটা। হারামিটা জানেও না, ট্রিনিটিতে বিশ্বাস করা কত বড় শিরক! এই অপরাধে তারও কঠিন শাস্তি দেয়া উচিত।

এরপরে তাকালাম মারসিনের দিকে। মারসিন একজন ইহুদী। মনে মনে খুব কষে গালি দিলাম। এই ইহুদীদের বাচ্চারাই তো সব নষ্টের গোড়া। বানু কোরাইজা গোত্রের মত এদেরকে একদিন ধরে জবাই করে ফেলা প্রয়োজন। এদের মা বোনদের গনিমতের মাল বানানো উচিত। হাদিসেও আছে, কিয়ামতের সময় ইহুদীদের ওপর গণহত্যা চালাতে হবে। ইমাম মেহেদি একটা একটা ইহুদী ধরবে আর জবাই করবে।

এরপরে তাকালাম ওয়ালিদের দিকে। এই হারামিটা একটা আহমদিয়া। হযরত মুহাম্মদকে এরা শেষ নবী মানে না। ঠিকই আছে, পাকিস্তানে যে এদের কচুকাটা করেছে ঠিকই আছে। ইউরোপে চলে এসেছে দেখে বেঁচে গেছে, কোন মুসলমান দেশে থাকলে আমরা তৈহিদী জনতা এদের দেখাইয়া দিতাম একহাত। শালা!

এরপরে তাকালাম রয়ের দিকে। শালা মালাউন। মূর্তিপূজারী। এদের চরম শাস্তি দেয়া উচিত। এদের ধরে ঘাড়ে পা দিয়ে অপমান করে এদের থেকে জিজিয়া কর নেয়া উচিত। মালাউনকি বাচ্চা কাভি নেহি আচ্ছা।

মাত্র কয়েক মিনিটেই একজন খাঁটি মুসলমান হয়ে যেতে লাগলাম। চারিদিকে যেদিকেই তাকাই, ঘিন্নায় মুখ বেঁকিয়ে উঠতে লাগলো। সবাইকে ঘেন্না করতে শুরু হল। সবাইকে জবাই করতে ইচ্ছা করতে লাগলো। এয়ার হোস্টেস ওয়াইন সার্ভ করতে আসলো, মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ওয়াইন তো হারাম। ওয়াইন সার্ভ করার জন্য এই এয়ার হোস্টেসের কী শাস্তি দেয়া যেতে পারে? ইসলামে এর বিধান কী? আবার কাপড় পড়েছে কীভাবে? বুক টুক সব দেখা যাচ্ছে। এদের জন্যেই তো ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে ধর্ষণ করে। ছেলেদের কী দোষ? এমন কাপড় পড়লে তো ছেলেরা একটু রেপ টেপ করবেই!

আমার মনে তখন রাজ্যের ঘেন্না, সবাইকে ঘেন্না লাগতে শুরু করেছে। সবাইকে জবাই করে ফেলতে ইচ্ছা করতেছে। সবাইকে খুনখারাবী করে ফেলতে ইচ্ছা করতেছে। একটা চাপাতি পেলে ভাল হতো। আল্লাহও আকবর বলে স্লোগান দিয়ে টপাটপ কয়েকটাকে কুপিয়ে ফেলতাম। সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তারাও আমার দিকে একরাশ ঘেন্না নিয়ে চেয়ে আছে। সবার চোখে দেখতে পেলাম ভয়াবহ বিদ্বেষ। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা, এরাও কী মনে মনে ধার্মিক হয়ে গেল? নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে আমি যে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলাম, তার জন্য আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলো? দুর্ঘটনায় পরে সবাই মনে মনে নিজ নিজ ঈশ্বরকে ডাকতে শুরু করলো? সবাই নিজ নিজ ধর্মে খাঁটি ধার্মিক হতে শুরু করলো? আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করলো? যেমন এই যে রয়, এই রয় কী মুসলমান বলে আমাকে ঘেন্না করছে না? আমি হিন্দু নই বলে আমাকে কী সে হত্যা করতে চায়? সে কী মনে মনে ভাবছে, মুসলমান কী বাচ্চা কাভি নেহি আচ্ছা? এখন কী সে আমাকে খুন করবে? বা ঐ যে জোসেফ, যে ক্যাথলিক। সে কী খ্রিস্টান ধর্ম সবচাইতে শান্তির ধর্ম প্রমাণের জন্য আমার গলায় ছুরি চালাবে? তার ঈশ্বর সবচাইতে দয়ালু, তা প্রমাণের জন্য আমাকে হত্যা করবে?

আবার আগের মতই আচমকা ঝড়টা থেমে গেল। বিমানের পাইলট আবার বিমানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন। সিটবেল্ট সাইন অফ হয়ে গেল। আমরা আবার সবাই হেসে উঠলাম। হেসে একজন আরেকজনার দিকে তাকাতে লাগলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, কারো দৃষ্টিতে আর সেই ঘেন্নাটুকু নেই। সবার চোখ স্বাভাবিক। আমার ভেতরেও আর সেই ঘেন্নাটুকু অবশিষ্ট নেই। আমার মনে আর আল্লাহভীতি নেই। বেহেশতে যাওয়ার লোভ নেই। হুর গমনের খায়েস নেই। ভয় নেই। আতঙ্ক নেই। আমরা আবার বন্ধু হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, এইখানে আমরা যারা আছি, তাদের কার ধর্ম পরিচয় কী, কার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন কী, কার জন্ম কোথায়, সেসবই অর্থহীন। আমরা সবাই মানুষ এবং বন্ধু। এই পরিচয়টুকুই যথেষ্ট। আমরা সবাই সবাইকে ভালবাসি।

মন থেকে ইসলাম দুর হতে শুরু করলো। আল্লাহ মুহাম্মদ ইসলাম কোরআন শরীয়তী আইন ঘেন্না বিদ্বেষ সব দূর হতে লাগলো। ভাগ্যিস তা হচ্ছিল, আর কিছুক্ষণ সবার মনের মধ্যে ধর্ম থাকলে এতক্ষণে কয়েকটা লাশ পড়ে যেত। আবার আমরা তর্ক জুড়ে দিলাম। বিমান তখন গন্তব্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। আর একসাথে গান গাইতে শুরু করলাম,

ইম্যাজিন দেয়ারস নো হেভেন,
ইটস ইজি ইফ ইউ ট্রাই
নো হেল বিলো আস
এবোভ আস অনলি স্কাই
ইম্যাজিন অল দ্যা পিপল
লিভিং ফর টুডে…

ইউ মে সে আইম এ ড্রিমার…

গান গাইতে গাইতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে ভাবলাম, এ কীরকম বিতিকিচ্ছিরি স্বপ্ন!

বিঃদ্রঃ নিছক গল্প মাত্র। জীবিত বা মৃত কারো সাথে এই গল্পের কোন সম্পর্ক নেই। মাঝে মাঝেই ইনবক্সে কয়েকজন প্রশ্নটা করেন। আজকে ভাবলাম তাই উত্তরটা দিয়েই দেই। প্রশ্নটা হচ্ছে, আপনি কী কখনোই আল্লায় বিশ্বাস করেন না? ধরেন যখন কোন বিপদে পরেন, তখন মনে মনে কাকে স্মরণ করেন?

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *