নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর – আলি দস্তি

Print Friendly, PDF & Email

কোরানের অলৌকিকতা

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইসলাম ধর্ম । কোরানের অলৌকিকতা

পূর্বে বলা হয়েছে একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য মক্কার পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে মুহাম্মদের প্রতি যে বারবার দাবি করা হয়েছিল, তিনি সে দাবি পূরণে আগ্রহী ছিলেন না। মুহাম্মদের ভাষ্যমতে তিনি শুধুমাত্র শুভসংবাদ এবং সতর্কবাণী পৌছে দিতে এসেছেন। অপরদিকে কোরানের অলৌকিকতার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব পোষণ করতেন। মুহাম্মদ নিজে কোরান তৈরি করেছেন কিংবা অন্য ব্যক্তিরা তার মুখ দিয়ে কোরানের বাণী প্রচার করছে, মক্কার সংশয়বাদীদের এমন দাবির প্রত্যুত্তরে তাদের প্রতি কোরানে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয় : “তারা কি বলে, “সে (মুহাম্মদ) এ বানিয়েছে?” বলো, তোমরা যদি সত্য কথা বল তবে তোমরা এ-ধরনের দশটি সুরা আনো আর আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পার ডেকে আনো। (১১ সুরা হুদ ; আয়াত ১৩)।

একই ধরনের দাবি সুরা বাকারার ২৩ নং আয়াতে রয়েছে : ‘আমি আমার দাসের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মতো কোনো সুরা আনো।’ এবং সুরা ইউনুসের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “তারা কি বলে, সে (মুহাম্মদ) এ রচনা করেছে? বলো, তবে তোমরা এর মতো এক সুরা আনো, আর যদি তোমরা সত্য কথা বল তবে আল্লাহ ছাড়া অন্য যাকে পারো ডাকো। এ-ধরনের চ্যালেঞ্জ এক ধরণের বালখিল্যতা, এবং তা যুক্তির হেত্বাভাসের মধ্যে পড়ে। প্রথমত, কোরানের মতো সুরা যাচাই করার পন্থা বা বৈশিষ্ট্যাবলী কি হবে, এ-বিষয়ে কোরানে কিছু বলা হয়নি।

কেউ যদি কোরানের মতো সুরা রচনা করতে চান, তবে কোন কোন নির্দেশক দিয়ে পরিমাপন করা হবে ঐ সুরা আদৌ কোরানের মতো বা এর সমতুল্য হয়েছে কি-না, বা তার শ্রেষ্ঠত্ব কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? কোরানে এ-বিষয়ের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, কোরান গদ্যছন্দে রচিত অনন্য গ্রন্থ। কোরানের মতো সুরা বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে? কোরানের মতো সুরা যদি কেউ লিখেন সেটা স্বাভাবিকভাবে কোরান হবে না। সেটা ভিন্ন হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওমর খৈয়ামের বিশ্ববিখ্যাত কবিতা বা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের ভাষাজ্ঞান, রচনাশৈলীকে অনুকরণে কেউ কোনো কিছু রচনা করলেও এগুলো মোটেও খৈয়াম বা রবীন্দ্রের সাহিত্য বলে গণ্য হবে না। কারণ তাঁদের রচনা সাহিত্যের জগতে সর্বজনস্বীকৃত অনন্য সৃষ্টি। তেমনি কোরান, তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল, গীতাও এরকম একেকটি অনন্য গ্রন্থ। এগুলোর সাহিত্যমান নিয়ে তুলনা করা, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা জটিল ও দুঃসাধ্য। তৃতীয়, সাহিত্যের দুটি বিষয়ের তুলনা অনেকাংশে আপেক্ষিক। একেক জনের কাছে একেক রকম মনে হতে পারে। হতে পারে বাংলাভাষী কোনো ব্যক্তির দৃষ্টিতে রবীন্দ্র-সাহিত্য হচ্ছে সাহিত্যের মানদণ্ড। একে মাপকাঠি ধরে অন্য সাহিত্য বিচার করা হয়। আবার অন্যের কাছে রবীন্দ্র-সাহিত্য সনাতন-ঘরানার মনে হতে পারে। আধুনিক, উত্তর-আধুনিক সাহিত্যগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক মনে করতে পারেন তুলনামূলক বিচারের জন্য। আবার কারো কাছে গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়ড, ওডিসি হচ্ছে অসাধারণ মহাকাব্য আবার কারো কাছে সেকেলে ধরনের লোকগাঁথা মনে হতে পারে।

ইংরেজ সাহিত্যিক শেক্সপিয়ের, শেলির সাহিত্য সম্পর্কেও এরকম মূল্যায়ন হতে পারে। এ-অবস্থায় অত্যন্ত স্পর্শকাতর ধর্মগ্রন্থ এর বাণীকে সাহিত্যমান অনুযায়ী বিচার করাটা আপেক্ষিক ও জটিল বিষয়। পঞ্চমত, সময়ের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন ঘটে। বাক্য গঠন, ভাবের প্রকাশ, শব্দসম্ভার, শব্দের বানান, ব্যবহার, উচ্চারণসহ একাধিক রূপ এবং ব্যাকরণগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই পরিবর্তন কোনো ভাষার জীবনীশক্তি এবং প্রবহমানতার বহিঃপ্রকাশ। একবিংশ শতকের কোনো ব্যক্তির পক্ষে চাইলে চর্যাপদ-যুগের সাহিত্য রচনা করা সম্ভব নয়। তেমনি হাজার ধরে আরবি ভাষাতেও পরিবর্তনপরিবর্ধন সাধিত হয়ে চলছে। তাই বর্তমানকালে রচিত কোনো সুরা ও কোরানের সুরার মধ্যে ভাষাগত, সাহিত্যমানগত পার্থক্য থাকবেই। ফলে এই দুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা করা বা এরূপ কোনো মূল্যায়ন অনর্থক।-অনুবাদক। মক্কার পৌত্তলিকদের তরফ থেকে কোরান কাল্পনিক কাহিনীতে পরিপূর্ণ বলে আরেকটি অভিযোগ ছিল। আর কেউ যখন তাদের নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, “আমরা তো শুনলাম, ইচ্ছা করলে আমরাও এরকম বলতে পারি, এ তো শুধু সেকালের উপকথা। (সুরা আনফাল ; আয়াত ৩১)। আল-তাবারির দ্যা হিস্ট্রি অব আল-তাবারি’ (ভলিউম ৭) গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, পারস্য দেশ ভ্রমণকারী কুরাইশ গোত্রের বিখ্যাত কবি নদর বিন আল-হারিস (আল-হিরার লাখমিদ রাজার দরবারের রাজকবি ছিলেন একসময়) নবির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তিনি ফেরদৌসি নামে সুন্দর একটি কবিতা লিখে গণজমায়েতে পাঠ করে শুনালেন এবং দাবি করেন কোরানে যেভাবে আদ, সামুদ, লুত, নুহ, সাবা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কাহিনী বলা হয়েছে, তার থেকে অনেক সুন্দর করে পারস্যের বিখ্যাত রুস্তম-ইসফানদার এররাজকীয়ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী-গাথা বলতে পারেন। কবি নদর বিন আল-হারিসকে পরবর্তীতে বদরের যুদ্ধে বন্দী করা হয় এবং নবির আদেশক্রমে আলি বিন আবু তালিব তাঁকে শিরোচ্ছেদ করেন। সুরা বনি-ইসরাইলের ৮৮ নম্বর আয়াতে কবি নদরের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে : ‘বলো, যদি এ-কোরানের মতো কোরান আনার জন্য মানুষ ও জিন একযোগে পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর মতো আনতে পারবে না।’(১৭:৮৮)।

মুহাম্মদ কোরানকে নিজের নবুওতির সনদপত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন। এই কিতাব যে মুহাম্মদ ঐশীগুণে লাভ করেছেন, সেসম্পর্কে মুসলিম পণ্ডিতগণ একমত। যদিও বাগিতা ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে কোরান কতটুকু অলৌকিক, এ-বিষয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। মুসলিম পণ্ডিতগণ সাধারণভাবে উভয়দিক দিয়ে একে অলৌকিক বলে মনে করেন। কোনো নিরপেক্ষ পর্যালোচনা নয়, বরং কোরানের প্রতি আবেগপূর্ণ গভীর বিশ্বাসই এই মতামতের প্রধান অবলম্বন। এক্ষেত্রে অমুসলিম পণ্ডিতেরা এমন অনেক শক্ত ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলোর উপর দাঁড়িয়ে কোরানের বোধগম্যতা ও বাগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কোরানের বক্তব্যের যে ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে সে ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতেরা আগেই ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। বিশিষ্ট তফসিরকারক জালাল উদ্দিন আল-সুয়ূতি (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) রচিত কিতাব আল ইতকান ফি উলুম আল-কোরান’(২৮) এর একটি পুরো অধ্যায় এই বিষয়ে রচিত। শুধুমাত্র উসমানীয় যুগের সংকলিত-সম্পাদিত কোরানের মূল অংশের সমালোচনামূলক সংশোধনের মাধ্যমে পাঠ্যাংশের ক্রমান্বয়িকতার ভুল বিন্যাসই নয়, কোরানের ভাষারীতিও অনেক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে।

মুসলিম পণ্ডিতদের মাঝে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অত্যুক্তি চেপে বসার আগে ইব্রাহিম আন-নাজ্জামের (৭৭৫-৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) মতো অনেক মুতাজিলা দার্শনিক প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন কোরানের বিন্যাস ও বাক্যগঠন অলৌকিক কিছু নয় এবং অন্য কোনো খোদাভীরু মানুষের পক্ষে একই ধরনের কাজ কিংবা এর থেকেও বেশি সাহিত্যমানসমৃদ্ধ কাজ করা সম্ভব। নাজ্জাম বলেন, ভাগ্যগণনাকারীদের ভবিষ্যদ্বাণীকে যে অর্থে অলৌকিক হিসেবে বলা হয়, কোরান সে অর্থে অলৌকিক নয়। তবে পূর্বে সংঘটিত ঘটনাসমূহের সঠিক পরিণামদশী হিসেবে কোরানকে অলৌকিক বলা যেতে পারে। পারস্যের ধর্মতাত্ত্বিক এবং একসময়ের মুতাজিলাপন্থী ইবনে ইসহাক আল-রাওয়ানদির (৮২৭-৯১১ খ্রিস্টাব্দ) মতে, নাজ্জামের এই উক্তিগুলো প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী। আব্দুল কাদের আল-বাগদাদি (মৃত্যু ৪২৯ হিজরি বা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর কিতাবুল-ফারক বায়নাল-ফিরাক’ বইয়ে (এখানে বিভিন্ন ধর্মীয়-সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে) নাজ্জামকে দোষারোপ করার জন্য ধর্মদ্রোহিতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আল-বাগদাদির মতে নাজ্জামের বক্তব্য কোরানের সুরা বনি-ইসরাইলের ৮৮ নম্বর আয়াতের সুস্পষ্ট বিরোধী, যেখানে বলা হয়েছে, ‘কোরান সর্বদাই অ-অনুকরণীয়, মানুষ এবং জিনেরা যৌথভাবে চেষ্টা করলেও একে অনুকরণ করতে পারবে না। ’

নাজ্জামের শিষ্য ও মৃত্যুপরবর্তী গুণগ্রাহীরা, যেমন ইবনে হাজম এবং আল-খাইয়াত নাজ্জামকে সমর্থন করে কলম ধরেছেন। শীর্ষস্থানীয় মুতাজিলাপন্থী অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ নাজ্জামের যুক্তিগুলো প্রচার করেছেন। তারা নাজ্জামের দর্শনের সাথে কোরানের বক্তব্যের কোনো বিরোধ খুঁজে পাননি। তাদের অনেকগুলো যুক্তির মাঝে একটি ছিল, আল্লাহ নবি মুহামদকে কোরানের অনুরূপ আয়াত তৈরির ক্ষমতা দেননি, তবে অন্য যেকোনো সময়ে এবং স্থানে কোরানের আয়াতের অনুরূপ শব্দাবলি তৈরি করা সম্ভব এবং তা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। ধারণা করা হয় সিরিয়ার প্রখ্যাত অন্ধকবি আবু আল আলা আল-মারি (৯৭৩-১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ) আল-ফুসুল ওয়া আল-গায়াত নামের ছড়াধর্মী ধর্মব্যাখ্যানটি (যার একটি অংশ আজও অবশিষ্ট আছে) কোরানের ব্যঙ্গাত্মক অনুকরণে রচনা করেছেন।

কোরানের বাক্যসমূহ অসম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণভাবে বোধগম্য হবার ক্ষেত্রে এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। এতে অনেক বিদেশি শব্দ, অপ্রচলিত আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলোকে স্বীয় সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। লিঙ্গ এবং সংখ্যার অন্বয়সাধন না করে বিশেষণ এবং ক্রিয়াপদের ধাতুরূপ করা হয়েছে। অনেক সময় সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাকরণগতভাবে ভুল সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়েছে এবং ছন্দবদ্ধ অনুচ্ছেদসমূহে এমন অনেক বিধেয় পদ ব্যবহার করা হয়েছে যার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে আলোচ্য মূল বিষয়ের সাথে এগুলোর কোনো মিল নেই। ফলে ভাষাগত এমন অনেক অগ্রহণযোগ্য বিষয়াদি কোরানের সমালোচকদের (যারা কোরানের বোধগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন) সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সমস্যাগুলো নিষ্ঠাবান মুসলমানদের মনেও যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে কোরানের তফসিরকারকরা কোরানের বক্তব্যের ব্যাখ্যা খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। কোরান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মতভিন্নতার পিছনে যেসব কারণ রয়েছে, এ বিষয়টি তাদের মধ্যে অন্যতম।

যেমন সুরা মুদদাসসির-এর প্রথম আয়াতের কথা উল্লেখ করা যায় ; ওহে, তুমি যে কিনা নিজেকে চাদরে ডেকে রেখেছ। এখানে চাদরে ডেকে রাখা বা চাদরাবৃত – এর গ্রহণযোগ্য আরবি শব্দ হচ্ছে মুদদাসসির’। কিন্তু বহুল প্রচলিত একটি মতানুযায়ী এটি হওয়া উচিত মুতাদাসসের । তেমনি সুরা মুজ্জামিলের প্রথম আয়াত ; ওহে, তুমি যে কিনা নিজেকে চাদরে জড়িয়ে রেখেছা এই চাদরাবৃত বা চাদরে জড়িয়ে থাকা শব্দটি আরবি কোরানে মুজ্জামিল পাঠ করা হয়, কিন্তু প্রচলিত

মতানুযায় এটি হওয়া উচিৎ মুতাজামিল। সুরা নিসার ১৬২ নম্বর আয়াত; কিন্তু তাদের মধ্যে যারা স্থিতপ্রজ্ঞ তারা ও বিশ্বাসীরা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও বিশ্বাস করে এবং যারা নামাজ পালনকারী, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে আমি তাদেরকে বড় পুরস্কার দেব। এখানে পালনকারী: শব্দটি কোরানের এই আয়াতে কর্মকারকে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু আস্থা-স্থাপনকারী, বিশ্বাসী, ঋণপরিশোধকারী শব্দগুলো যে নিয়মাত্মক রূপে ব্যবহার করা হয়, তা সেই অর্থে ব্যবহার করা ব্যাকরণসম্মত। সুরা হুজুরাত-এর ৯ নম্বর আয়াত : বিশ্বাসীদের দুই দল দ্বন্দুে লিপ্ত হলে তুমি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবে…। কোরানের এই আয়াতটিতে উল্লেখিত দ্বন্দুে লিপ্ত হলো ক্রিয়াপদটি বহুবচন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এটি বক্তব্য অনুযায়ী শুধুমাত্র দ্বিপক্ষীয় অর্থে ব্যবহার করা উচিত ছিল। সুরা বাকারা-এর ১৭৭ নম্বর আয়াত : ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবিদের উপর বিশ্বাস করলে…।” এই আয়াতটিতে জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে প্রার্থনার দিক পরিবর্তন করার ফলে ইহুদিদের কাছ থেকে যে প্রশ্ন উঠেছিল সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। ভাষাশৈলীর দিক দিয়ে অসাধারণ হলেও আয়াতটিতে আভিধানিক জটিলতা রয়েছে। তফসির আল-জালালাইনের মন্তব্য হচ্ছে আয়াতের দ্বিতীয় অংশে পুণ্য (বা সৎকর্ম, ন্যায়নিষ্ঠা)-এর আরবি শব্দ হিসেবে বের ব্যবহৃত হয়েছে, যার আসল অর্থ হচ্ছে পুণ্যবান ব্যক্তি। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ মুহাম্মদ বিন ইয়াজিদ আল-মুবাররাদের (মৃত্যু : হিজরি ২৮৫ বা ৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ) মতে, এই আয়াতে ব্যবহৃত বের শব্দটি আসলে ‘বার ( ধাৰ্মিক বা পুণ্যবান ব্যক্তি) হিসেবে উচ্চারণ করা উচিত। এটি বের’ শব্দের গ্রহণযোগ্য একটি প্রকরণ। মুহাম্মদ বিন ইয়াজিদের এই মন্তব্যের কারণে তৎকালীন কট্টরপন্থীরা তাঁর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং কোরানবিরোধিতার অভিযোগ তুলে কুৎসা প্রচার করেছিলেন।

সুরা তাহা-এর ৬৩ নম্বর আয়াতটিতে নবি মুসা ও তাঁর ভাই হারুন সম্পর্কে ফেরাউনের লোকদের মন্তব্য প্রকাশ পেয়েছে : ‘ওরা বলল, ‘এরা দুজন নিশ্চয় জাদুকর, তারা জাদুবলে তোমাদেরকে দেশ থেকে তাড়াতে চায়। এবং তোমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে একেবারে নস্যাৎ করতে চায়। (২০:৬৩)। এরা দুজন জাদুকর বলতে ফেরাউনের লোকেরা নবি মুসা ও তাঁর ভাই হারুনকে বুঝিয়েছে। এক্ষেত্রে এরা দুজন শব্দ দুটির ক্ষেত্রে কোরানে আরবি ‘হাদানে শব্দটি নিয়মাত্মকরূপে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এটা এখানে কর্মকারকে (হাদায়নে) হওয়া উচিত ছিল। কারণ তা একটি পরিচিতিমূলক বর্ণনা অংশের পর এসেছে। কথিত আছে যে খলিফা উসমান এবং নবির বিবি আয়েশা এই আয়াতে হাদানে না বলে হাদায়নে পাঠ করতেন। কট্টরপন্থীদের মত অনুযায়ী, কোরান আল্লাহর বাণী। এখানে কোনো ভুল থাকতে পারে না। এখানে মুসলমানদের সর্বসমত সিদ্ধান্ত লিপিবন্ধ আছে। খলিফা উসমান এবং বিবি আয়েশা হাদানের স্থলে হাদায়নে ব্যবহার করতেন তা মিথ্যে এবং দূরভিসন্ধিমূলক। তফসির আল-জালালাইনের মন্তব্য হচ্ছে, আয়াতটিতে এই দ্বৈতবিভক্তি তিনটি ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে। নিয়মাত্মক ও কর্মকারক উভয় ক্ষেত্রেই আয়ন হিসেবে উচ্চারিত হবার প্রয়োজন নেই। যদিও বিশিষ্ট ভাষাবিদ এবং কোরান-বিশেষজ্ঞ আবু আমর বিন আল-আলা (মৃত্যু হিজরি ১৫৪ বা ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) খলিফা উসমান এবং বিবি আয়েশার মতোই এই আয়াতে হাদায়নে উচ্চারণ করতেন।

সুরা নুর-এর ৩৩ নম্বর আয়াতের একটি মনুষোচিত এবং অভিবাদনীয় নির্দেশ থেকে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত নির্দয় এবং অমানবিক একটি আচরণের পরিচয় মেলে তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে, পার্থিব জীবনের টাকা-পয়সার লোভে তাদেরকে ব্যভিচারিণী হতে বাধ্য করো না। তবে কেউ যদি তাদেরকে বাধ্য করে, তাদের ওপর সেই জবরদস্তির জন্য আল্লাহ তো তাদেরকে ক্ষমা করবেন, দয়া করবেন। তৎকালীন আরব-সমাজে দাসী-মালিক যারা নিজেদের দাসীদেরকে দিয়ে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করত এবং উপার্জিত অর্থ নিজেদের পকেটে রাখত, এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে তাদেরকে এ-কাজ থেকে নিবৃত্ত হতে বলা হয়েছে। আয়াতের প্রথম বাক্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক এই কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ এই দাসীদের ক্ষমা করে দেবেন। তবে আয়াতের উপসংহারের বাক্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যেসব ব্যক্তি নিজেদের দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, আল্লাহ সেই ব্যক্তিদের প্রতি দয়া ও করুণা করেছেন। এই প্রচ্ছন্ন বাক্যটি থেকে প্রকৃত অর্থে মহানুভবতার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। কোরান সম্পর্কে মুতাজিলা দার্শনিক ইব্রাহিম আন-নাজ্জামের মতামত পূর্বে বলা হয়েছে। তিনি শুধু একা নন, মুতাজিলা দার্শনিক হিশান বিন আমর আল-ফুয়াতি (মৃত্যু হিজরি ২১৮ বা ৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং আব্বাস বিন সোলায়মানের (মৃত্যু হিজরি ২৫০ বা ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ) মতো আরও অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন যারা একইমত পোষণ করতেন। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন নিষ্ঠাবান ধাৰ্মিক। তারা নিজেদের যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একনিষ্ঠ বিশ্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য তৈরি করতেন না।

প্রভাবশালী আরব মনীষী আবুল-আলা আল-মারি তাঁর নিজের কিছু লেখাকে কোরানের সমতুল্য বলে মনে করতেন। সারকথা হচ্ছে, কোরানে আরবি ভাষার সাধারণ নিয়মাবলী ও গঠনশৈলী থেকে অন্তত একশটি বিচ্যুতি লক্ষ করা যায়। বলা বাহুল্য, কোরানের তফসিরকারকদের এই অসংলগ্নতাগুলোকে ব্যাখ্যা এবং সমর্থনীয় করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তাঁদেরই একজন হচ্ছেন পারস্যের বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ও ভাষাবিদ এবং জার-আল্লাহ (আল্লাহর প্রতিবেশি) খেতাবে ভূষিত আলজামাখশারি, পুরো নাম আবু আল-কাশিম মাহমুদ ইবনে উমর আল-জামাখশারি (জন্ম হিজরি ৪৬৭ বা ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৫৩৮ বা ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দ) যার সম্পর্কে একজন মুরীয় (উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার আরব মুসলমান) লেখক বলেছেন, ‘ব্যাকরণঅনুরাগী এই তাত্ত্বিক একটি গুরুতর ভুল করেছেন। আরবি ব্যাকরণের সাথে মিল রেখে কোরান পড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়। বরং আমাদের উচিত সম্পূর্ণ কোরান যেভাবে আছে সেভাবে একে গ্রহণ করা এবং আরবি ব্যাকরণকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা। ’

একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত দাবিটি সমর্থনযোগ্য। একটি জাতির শ্রেষ্ঠ বক্তা এবং লেখকেরা মাতৃভাষার ব্যাকরণগত নিয়মাবলীকে সম্মান করেন এবং ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে জনসাধারণের কাছে দুর্বোধ্য এবং অগ্রহণযোগ্য শব্দাবলী ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। যদিও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শব্দচয়ন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। প্রাক-ইসলামি যুগে আরবে যথেষ্ট পুথিশাস্ত্র-কাব্যলোকগাঁথা রচিত হয়েছে এবং ব্যাকরণের কাঠামোও দাঁড়িয়ে ছিল। মুসলমানদের কাছে ইসলাম-পূর্ববর্তী সকল সাহিত্য-রচয়িতার সৃষ্টিকর্ম থেকে উৎকৃষ্ট যে কোরান, একে অবশ্যই ব্যাকরণের সাথে সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

তথাপি ওই মুরীয় লেখক কর্তৃক জামাখশারির নিন্দা, লেখকের বক্তব্যকেই পাল্টা সমালোচনার একটি ভিত্তি করে দিয়েছে। কারণ লেখকের বক্তব্য প্রচলিত দাবিকেই উল্টিয়ে দেয়। আর এই দাবিটি হচ্ছে কোরান আল্লাহর বাণী। কোরানের একটি ভক্তি সৃষ্টিকারী মাধুর্যপূর্ণ বাগিতা রয়েছে, যা সকল মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তির মাধ্যমে কোরান অবতীর্ণ হয়েছে, সঙ্গত কারণেই তিনি একজন নবি। মুরীয় লেখকের মতে, কোরান ভুলভ্রান্তিহীন যেহেতু তা আল্লাহর বাণী এবং এতে ব্যাকরণগত যেসব ভুল রয়েছে সেগুলো আরবি ব্যাকরণের নিয়মাবলী পরিবর্তনের মাধ্যমেই সংশোধন করতে হবে। অন্যকথায়, সংশয়ী বা অবিশ্বাসীদের প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদের নবুওতিকে প্রমাণ করতে যেখানে অধিকাংশ মুসলিম কোরানের বাগিতাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, মুরীয় লেখক সেখানে কোরানের স্বগীয় উৎপত্তি ও মুহাম্মদের নবুওতিকে স্বীকার করে সিদ্ধান্তে পৌছালেন যে, কোরানের বিষয়বস্তু এবং শব্দাবলী সম্পর্কিত আলোচনা গ্রহণযোগ্য নয়।

একই সাথে বলা যায়, কোরান আসলেই স্বতন্ত্র এবং অসাধারণ। প্রাচীন আরবের প্রথমদিকের সাহিত্যে এর মতো কোনো দৃষ্টান্ত চোখে পড়েনি। মক্কায় অবতীর্ণ সুরাগুলোয় আমরা অনেক আগ্রহোদীপক এবং চিত্তাকর্ষক কাব্যিক অনুচ্ছেদ দেখতে পাই। এগুলো থেকে নবির চিন্তাশক্তি এবং বক্তৃতা দেবার সহজাত প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় এবং তাঁর মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে সুরা নজম। যদি আমরা এখান থেকে ৩২ নম্বর আয়াতটি উহ্য রাখি যা মদিনায় অবতীর্ণ হলেও কোনো এক অজানা কারণে খলিফা ওসমান এবং তার সংগ্রাহকগণ এই আয়াতকে মক্কি সুরার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

জেরুজালেমের বালিকাগণ, যাদের স্তন গিলিয়াদ পর্বতের ছাগলের ন্যায় শুভ্র, তাদের সাথে কাটানো সময়ের উল্লেখ ব্যতিরেকে সলোমনের গানের একটি চিত্রকল্পীয় হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণের মাধ্যমে সুরা নজম উল্লাসের সাথে প্রচারক হিসেবে মুহাম্মদের ভূমিকা ও তাঁর পয়গম্বরীয় ঔজ্জ্বল্য এবং দূরদৃষ্টি ব্যাখ্যা করেছে। যদিও আরবি ভাষার এই শব্দের ঐক্যতান, ছন্দ এবং সৌন্দৰ্য্য স্বাভাবিকভাবেই অন্য ভাষায় প্রকাশ করা যথেষ্ট কঠিন, তারপরও সুরা নজমের প্রথম ১৮টি আয়াত নিম্নে উল্লেখিত অনুবাদের মাধ্যমে মুহাম্মদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিসত্তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় :

শপথ অস্তমিত নক্ষত্রের তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, পথভ্রষ্টও নয়
আর সে নিজের ইচ্ছেমতো কোনো কথা বলে না।
এ প্রত্যাদেশ যা তার ওপর) অবতীর্ণ হয়।
তাকে শিক্ষা দেয় এক মহাশক্তিধর° /
বুদ্ধিধর (জিবরাইল) আবির্ভূত হল উর্ধ্বে দিগন্তে।
তারপর সে তার কাছে এলো খুব কাছে
যার ফলে তাদের দুজনের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল।
তখন তিনি তার দাসের প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন।
সে যা দেখছিল তার হৃদয় তা অস্বীকার করেনি।
সে যা দেখেছিল তারা কি সে-সম্বন্ধে তর্ক করবে?
নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল,
শেষ সীমান্তে অবস্থিত সিদরা গাছের নিকট
যার কাছেই ছিল জনাতুল মাওয়া।
তখন সিদরা গাছটা ছেয়ে ছিল যা দিয়ে ছেয়ে থাকে।
তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি বা দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি।
সে তার মহান প্রতিপালকের নিদর্শনগুলো নিশ্চয় দেখেছিল। (৫৩:১-১৮) ।

পরামর্শ গ্রহণের জন্য মানুষের কাছে অনেক পথই খোলা রয়েছে এবং সুরা নজমে পরবর্তীতে আল্লাহ নবিকে এ বিষয়টির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন; অতএব যে আমাকে স্মরণ করতে বিমুখ তাকে উপেক্ষা করে চলো; সে তো কেবল পার্থিব জীবনই কামনা করে। ওদের জ্ঞানের দৌড় তো ঐ পর্যন্ত। তোমার প্রতিপালক নিশ্চয় ভালো জানেন কে তাঁর পথ থেকে ভ্ৰষ্ট; আর তিনিই ভালো জানেন কে সৎপথ পেয়েছে। (৫৩: ২৯-৩০)।

শোনা যায়, মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাবের পত্নী উম্মে জামিল একদিন নবির কাছে গিয়ে বিদ্রুপ করে বললেন, “আমরা আশা করছি তোমার ভেতরের শয়তান তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এটি ছিল বাণী নাজিলে বিঘ্ন হবার সময়কালীন ঘটনা। সে-সময় নবি এতোটাই নিরাশ এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন যে, পাহাড়চূড়া থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন। ধারণা করা হয় সুরা দোহা নাজিলের সময়ও এই বিঘ্ন ঘটেছিল, তবে এই সূরাটিও খুবই শ্রুতিমধুর :

শপথ দিনের প্রথম প্রহরের তার শপথ রক্রির যখন তা আচ্ছন্ন করে?
তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি ও তোমার ওপর তিনি অসন্তুষ্ট নন।
তোমার জন্য পরকাল ইহকালের চেয়ে ভালো।
তোমার প্রতিপালক তো তোমাকে অনুগ্রহ করবেনই আর তুমিও সন্তুষ্ট হবে।
তিনি কি তোমাকে ভুল পথে পেয়ে পথের হদিস দেননি?
তিনি তোমাকে কি অভাব দেখে অভাবমুক্ত করেননি?
সুতরাং তুমি পিতৃহীনদের প্রতি কঠোর হয়ে না
আর য়ে সাহায্য চায় তাকে ভৎসনা করো না
আর তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করো। (৯৩১-৯)।

কোরানের প্রতি সুবিচার করলে স্বীকার করতে হবে এটা অবশ্যই বিস্ময়কর। মক্কায় নাজিলকৃত অপেক্ষাকৃত ছোট সুরাগুলোর কাব্যিক ভাব ব্যক্ত করার জাদুকরি ক্ষমতা রয়েছে এবং সেই সাথে বিশ্বাসের প্রেরণাদায়ক। সুরায় ব্যবহৃত ভাষাশৈলীর কোনো নজির আরবি ভাষায় এর পূর্বে দেখা যায়নি। একজন মানুষ যিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি, তার মুখ থেকে ভাবের এমন বহিঃপ্রকাশ সত্যিই বিস্ময়কর। এদিক থেকে বিবেচনা করলে, কোরানকে অলৌকিক হিসেবে গণ্য করা সমর্থনযোগ্য।

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদকে ‘নিরক্ষর’ মানতে রাজি নন। তাঁদের মতে কোরানে ব্যবহৃত ‘উম্মি’ শব্দটির অর্থ আসলে নিরক্ষর নয়, বরং ইহুদি নয় এমন ব্যক্তির কথাই বুঝানো হয়েছে। তাঁরা বক্তব্যের সপক্ষে কোরানে উল্লেখিত পৌত্তলিক, অইহুদি, এবং অ-খ্রিস্টান আরবদের উদাহরণ দেখিয়েছেন। এই অ-ইহুদি’শব্দটি কোরানের সুরা জুমআর আয়াত ২-এ ব্যবহৃত হয়েছে এভাবে: ইনিই সেই ব্যক্তি যাকে অ-ইহুদিদের মধ্য থেকে নবি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরকম উদাহরণ কোরানের আরও কয়েকটি আয়াতে দেখতে পাওয়া যায়, যেমন : সুরা বাকারা ; আয়াত ৭৫; সুরা ইমরান ; আয়াত ২০ ও ৭০; সুরা আ’রাফ ; আয়াত ১৫৭-১৫৮। তথাপি প্রচলিত ধারণা, তথ্য এবং সে যুগের প্রথাসমূহের উপর নির্ভর করে সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে, মুহাম্মদ লিখতে জানতেন না, যদিও শেষ জীবনে হয়তো দু’একটি শব্দ পড়তে পারতেন। কোরানে যেমন বলা হয়েছে: তুমি তো এর পূর্বে কোনো কিতাব পড়নি, বা নিজ হাতে কোনো কিতাব লেখনি যে মিথ্যাবাদীরা সন্দেহ করবে!’ (সুরা আনকাবুত ; আয়াত ৪৮)। ওরা বলে, এগুলো তো সেকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তাঁর কাছে পাঠ করা হয়। (সুরা ফুরকান ; আয়াত ৫)।

কোরানের এই আয়াতগুলো থেকে বিশ্বাস করা হয় যে, নবি মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানতেন না, এটা পৌত্তলিকরা ধারণা করত। নবি মুহামদ লিখতে-পড়তে জানতেন না, এ-বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস ও হাদিসে প্রচুর ভিন্নতথ্য রয়েছে। পশ্চিমের অনেক ইসলাম-বিশেষজ্ঞ যেমন ফরাসি মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্সিম রডিনসন এবং স্কটিস ইতিহাসবিদ উইলিয়াম মন্টোগমেরি’র মতে নবি মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন না। তাঁদের মতে, কোরানে নবিকে একেবারে নিরক্ষর বা লিখতে-পড়তে জানেন না বলে বোঝানো হয়নি বরং শুধু বোঝানো হয়েছে নবি ইতিপূর্বে ইহুদি-খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ (তৌরাত, ইঞ্জিল) পাঠ করেননি। পশ্চিমা পণ্ডিতরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে সুরা আনকাবুতের ৪৮ নম্বর আয়াত হাজির করেন। তাঁদের মতে এই আয়াতে কিতাব বলতে ইহুদি-খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থের কথা কেন্দ্রভূমি এবং নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে ছোটবেলা থেকে একাধিকবার নবি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে মক্কার বাইরে গিয়েছেন। সেই বহির্বাণিজ্যে তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার ছাপ রেখেছিলেন। একজন বণিকের যদি সামান্য অক্ষর জ্ঞান না থাকে এবং হিসাব-নিকাশ চালানোর মতো গণনা দক্ষতা না থাকে তাহলে বাণিজ্যে দক্ষতা অর্জন করা কঠিন। লেখা-পড়া জানা বিবি খাদিজা প্রথমে মুহাম্মদকে বাণিজ্যে দক্ষতার কারণে মুগ্ধ হয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিচালকরুপে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁদের মধ্যে পরিণয়ের দিকে সম্পর্ক গড়ায়। খাদিজার মতো একজন ব্যবসায় সফল-অভিজ্ঞ রমণী তাঁর ব্যবসার বৈদেশিক দায়িত্ব একজন নিরক্ষর ব্যক্তির ওপর ছেড়ে দিবেন কেন? এছাড়া প্রচুর হাদিসেও রয়েছে : (১) উসরা হতে বর্ণিত, ছয় বছরের আয়েশার সাথে বিয়ের কাবিন রসুল মুহাম্মদ নিজেই লিখেছেন। (দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৭, বুক ৬২ নম্বর ৮৮)। (২) ইয়াজিদ ইবনে উকাইশের জন্য। বক্তব্য হচ্ছে : “তোমরা যদি অন্য কোনো ঈশ্বর বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহকে মেনে নাও, মুহামদকে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকার করো, জাকাত দাও, নামাজ পড়ো তবে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাবে। এরপর লোকটিকে জিজ্ঞেস করা হল, এই বার্তা কে লিখে দিয়েছে? লোকটি উত্তর দিল আল্লাহর রসুল’। (দ্রষ্টব্য : আবু দাউদ শরিফ, বুক ১৯, নম্বর ২৯৯৩)। (৩)

আল বারা হতে বর্ণিত, নবি ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় গেলে তাঁকে ঢুকতে দেয়া হয়নি, যতক্ষণ না তিনি রাজি হন মক্কাবাসীর সাথে একটি চুক্তি করতে। তিন দিন অপেক্ষার পর তিনি শান্তি চুক্তি করতে রাজি হলেন। চুক্তিতে লেখা হলো আল্লাহর নবি মুহাম্মদের (দঃ) পক্ষ হতে…। মক্কার লোকেরা প্রতিবাদ করে উঠলেন। তারা মুহামদকে ‘আল্লাহর নবি বলে স্বীকার করতে চাইলেন না। বললেন, মুহামদ, আব্দুল্লাহর পুত্র, এটাই লেখা হোক। এ নিয়ে দ্বন্দুে যখন চুক্তি প্রায় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম তখন মুহামদ হজরত আলিকে নির্দেশ দিলেন, চুক্তিপত্র হতে আল্লাহর নবি শব্দ কেটে দিতে। কিন্তু আলি রাজি না হওয়ায় মুহাম্মদ চুক্তিপত্র হাতে নিয়ে নিজ হাতে কেটে দিলেন এবং আল্লাহর নবি শব্দটির বদলে যোগ করলেন “আব্দুল্লাহর পুত্র। (দ্রষ্টব্য ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ৫, বুক ৫৯ নম্বর ৫৫৩)।-অনুবাদক)।

কোরানকে বিষয়বস্তুগত কারণে অনেকে অলৌকিক মনে করেন। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে এতে এমন কোনো নতুন ধারণা নেই যা পূর্বে অন্যদের দ্বারা ব্যক্ত হয়নি। কোরানের সকল বক্তব্যই স্বীয়-প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বজনস্বীকৃত। কোরানে বর্ণিত কাহিনীসমূহ ইহুদিখ্রিস্টানদের ধর্মীয় লোক-কাহিনীর অবিকল কিংবা সামান্য পরিবর্তিত রূপ। সিরিয়ার ভ্রমণের সময় মুহাম্মদ এই দুই সম্প্রদায়ের রাব্বি এবং সন্ন্যাসীদের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের সাথে আলাপচারিতাও করেছিলেন। এছাড়া আদ এবং সামুদ অধিবাসীর বংশানুক্রমে প্রাপ্ত কিছু কাহিনীর সাথে কোরানে বর্ণিত কাহিনীগুলোরও মিল পাওয়া যায়।

নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে নবি মুহাম্মদের মহত্ত্বকে কোনোভাবেই খাটো করা যায় না। একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অনৈতিক, নিন্দনীয় সমাজ, যেখানে পেশিশক্তি ছাড়া অন্য কোনো আইন কাজ করে না এবং নির্দয়তার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সেই সমাজের একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বঞ্চিত মুহাম্মদ সাহসিকতার সাথে অসংখ্য মন্দকাজ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই সাথে অন্যান্য সম্প্রদায়ের পূর্ব-অভিজ্ঞতাসমূহকে পুনঃপুনঃ ব্যক্ত করার মাধ্যমে উচ্চতর আদর্শ প্রচার করেছিলেন।

মুহাম্মদের এই উদ্যোগ তাঁর সহজাত প্রতিভা, আধ্যাত্মিক শক্তি, নৈতিক জ্ঞান ও ভক্তিভাবের পরিচায়ক। একজন কথিত নিরক্ষর ব্যক্তির মুখ থেকে নিঃসৃত সুরা আবাসা যেন তাঁরই ব্যাকুল হৃদয়ের স্পন্দন। সুরা আবাসা খুবই গীতিময়, সুরালায়িত এবং প্রবল আধ্যাত্মিক, যা হাফিজের কবিতা ছাড়া প্রকাশ করা অসম্ভব। তবে সুরা আবাসা এর ১৭-৩৩ আয়াতগুলোয় অসম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে :

মানুষ ধ্বংস হোক সে কত অকৃতজ্ঞ।
তিনি তাকে কী থেকে সৃষ্টি করেছেন
তিনি তাকে শুরু থেকে সৃষ্টি করেন
তারপর তার জন্য পথ সহজ করে দেন তারপর তার মৃত্যু ঘটান ও তাকে কবরস্থ করেন।
এরপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে পুনর্জীবিত করবেন।
না তিনি তাকে য় আদেশ করেছেন সে তা পালন করে নি।
আমি প্রচুর বারিবর্মণ করি
তারপর ভূমিকে বিদীর্ণ করি
এবং তার মধ্যে উৎপন্ন করি
গাছগাছালির বাগান ফল ও গবাদি খাদ্য।
এ তোমাদের ও তোমাদের আনআমের (চতুস্পদ প্রাণী) ভোগের জন্য।
যেদিন মহানাদ (কেয়ামত) আসবে ( ৮০:১৭-৩৩)।

মূলত অসাধারণ এবং নান্দনিক আধ্যাতিক উপদেশের মাধ্যমে মুহাম্মদ তাঁর চারপাশের মানুষকে একটি অপেক্ষাকৃত ভালোপথে চালিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নৈতিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোরানকে অলৌকিক বলে বিবেচনা করা যাবে না। মুহাম্মদ সেই সকল মূল্যবোধের পুনরাবৃত্তি করেছেন, যেগুলো পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোয় বিশ্বজুড়ের মানবসমাজের বিভিন্ন স্থানেই উদ্ধৃত হয়েছে। কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, জরথ্রস্ত, সক্রেটিস, মুসা, এবং যিশুও একই ধরনের বা কাছাকাছি মূল্যবোধ প্রচার করেছেন।

কোরানে অনেক আইন ও বিধি রয়েছে যা মুহাম্মদকে ইসলামের আইনপ্রণেতা হিসেবে তুলে ধরে। যে বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখা দরকার তা হলো, কোরানে বর্ণিত আইন-কানুন তৈরি হয়েছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর নিমিত্তে এবং নির্যাতিত মানুষের আবেদনের প্রেক্ষিতে। ফলে এই আইনগুলোর মাঝে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে এবং বাতিলকারী এবং বাতিলকৃত উভয় বিধিই কোরানে রয়ে গিয়েছে। একথাও ভুললে চলবে না যেইসলামিক আইন-বিধিবিধানগুলো মুসলমান বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টার ফসল, যা ইসলামি যুগের প্রথম তিন শতাব্দীতে তৈরি হয়েছে। কোরানে বর্ণিত আইনগুলো সংক্ষিপ্ত এবং মুহাম্মদের জন্মের দেড়শ বছর পর তৈরি হওয়া বিশাল সংখ্যক মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এগুলো পর্যাপ্ত ছিল না।

ইসলামে সিয়াম (রোজা বা উপবাস) পালনের প্রথা এসেছে ইহুদিদের ধর্ম থেকে। ইসলাম-পূর্ব আরবে আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মহরম মাসের (হিব্রু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তিশরি’ মাস) দশম দিনে ইহুদিরা রোজা রাখতেন। আরবি ভাষায় আশুরার দিন (হিব্রুভাষায় আশর) নামে এ-দিবস পরিচিত। ইহুদিদের তৌরাতের ভাষ্যানুযায়ী এ-দিনে ঈশ্বরের আশীবাদ নিয়ে নবি মুসা ইসরাইলের সন্তানদের ফেরাউনের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। ইহুদিদের ধর্মে এ-দিনের অনুষ্ঠানের নাম ‘জম কিপার’। ইহুদিরা জম কিপারের সময় প্রায় ২৫ ঘণ্টা উপবাস পালন করেন এবং সিনাগগে গিয়ে প্রার্থনা করেন, দান-খয়রাত করেন। নবি মুহাম্মদের মদিনায় গমনের পরে এবং প্রার্থনার দিক যখন জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে পরিবর্তিত হল, রোজার সময়সীমা তখন একদিন থেকে বেড়ে দাঁড়ালো দশ দিনে, অর্থাৎ মহরম মাসের দশ দিন নামে পরিচিত হলো। পরবর্তীতে মুসলমান ও ইহুদিদের মাঝে যখন চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয় তখন পুরো রমজান মাসকে রোজা পালনের জন্য সংরক্ষণ করা হলো।

প্রতিটি ধর্মে প্রার্থনা প্রচলিত রয়েছে। এক বা একাধিক দেবতার প্রতি ভক্তি নিবেদন এবং বিচার কামনা প্রতিটি ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম ধর্মে একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো প্রার্থনা করা; এবং এই প্রার্থনা ব্যতিক্রমী ইসলামি-পদ্ধতি অনুযায়ী পালন করা হয়। তবে কোরানে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে কোনো প্রকার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়নি। নবি মুহাম্মদের ত্রিশ বছরে মক্কায় অবস্থানকালে এবং মদিনায় হিজরতের প্রথম দেড় বছরে মুসলমানরা ইহুদিদের মতো একই দিক বা অভিমুখে (কিবলা) প্রার্থনা করতেন। যা মূলত জেরুজালেমে অবস্থিত সবচেয়ে দূরের মসজিদ (বা প্রার্থনাস্থান) হিসেবে পরিচিত ছিল।

মক্কায় মুসলমানদের তীর্থযাত্রা হিজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর আরবের বিভিন্ন জাতীয় প্রথাও প্রতিষ্ঠিত ও চিরস্থায়ী রূপ লাভ করে। হজের (জুলহজ মাসে তীর্থযাত্রা) এবং ওমরা’র সকল অনুষ্ঠানাদি, যেমন সেলাইবিহীন ঢিলেঢালা বস্ত্র পরিধান, কালো পাথরকে চুমু খাওয়া কিংবা স্পর্শ করা, সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানো, আরাফাতে অবস্থান এবং শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপের প্রথা ইসলাম-পূর্ব যুগেও আরবে পৌত্তলিকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং সামান্য কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে এগুলো ইসলামে বজায় থেকেছে।

পৌত্তলিক আরবরা কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণকালে লাত, ওজা, মানাতসহ আরও অনেক গোত্র দেবতার নাম উচ্চারণ করত। যেমন ‘হে মানাত, আমি তোমার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত’(লাব্বায়েকা) এবং দেবদেবীদের নাম ধরেও উচ্চারিত হতো। ইসলামে এই ধরনের সম্মোধনের রীতি আল্লাহকে সম্বোধন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায়, ‘লাব্বায়েকা আল্লাহুমা লাকবায়েকা!”

পৌত্তলিক আরবেরা তীর্থযাত্রার মাসে শিকার করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু নবি মুহাম্মদ তীর্থযাত্রার (হজ) যে দিনগুলোতে (ইহরাম) হাজিরা নিজেদেরকে উৎসর্গের জন্য ব্যয় করেন শুধুমাত্র সেই দিনগুলোর জন্য এই নিষেধাজ্ঞাকে বহাল রাখলেন। পৌত্তলিক আরবরা অনেক সময় নগ্ন হয়ে কাবা ঘরকে প্রদক্ষিণ করত। ইসলাম তা নিষিদ্ধ করে সেলাইবিহীন বস্ত্র পরিধানের রীতি প্রচলন করে। পৌত্তলিক আরবদের কোনো কোনো গোত্রে উৎসর্গকৃত প্রাণীর মাংস খাওয়ায় বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু নবি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন।

মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘরে রক্ষিত কুরাইশদের মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করা হয় নবি মুহাম্মদের নির্দেশে এবং মুসলমানরা সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়ানোর যে প্রথা প্রচলিত ছিল তা থেকে বিরত থাকেন। কারণ পূর্ববর্তীকালে এই দুই পাহাড়ের চূড়ায় দুজন দেবীর পাথরের প্রতিমা ছিল এবং পৌত্তলিকরা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তীস্থানে দৌড়ার মাধ্যমে এবং প্রতিমাগুলোকে চুমু দিয়ে কিংবা স্পর্শ করে সৌভাগ্য অর্জনের চেষ্টা করত। যা হোক, এ-বিষয়ে একটি ঐশী বাণী নাজিল হয় ; নিশ্চয় দুটি পাহাড় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে আল্লাহর ঘরে হজ বা ওমরা করে, তার জন্য এই দুটি প্রদক্ষিণ করলে কোনো পাপ নেই। (২:১৫৮)। অর্থাৎ কোরানের এই আয়াত সাফা-মারওয়া পাহাড়ের দৌড়কে শুধুমাত্র পাপমুক্তই করল না, একই সাথে এই দুই পাহাড়কে আল্লাহর নিদর্শনকারী হিসেবে ঘোষণা দিল। (কাবা সম্পর্কে পূর্ববর্তি আব্রাহামিক ধর্মীয় কিতাবসমূহে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। এমনকি উপাস্য আল্লাহ সম্পর্কেও না। এগুলো যদি কেবলমাত্র পৌত্তলিকদের পবিত্র তীর্থস্থান ও উপাস্য না হত তবে পূর্ববর্তী ইসা বা মুসার কিতাবে অবশ্যই কোনো না কোনো উল্লেখ থাকত। কাবার সাথে ইব্রাহিমের যে যোগসূত্র দাবি করা হয় সেটা অপ্রমাণিত এবং অত্যন্ত অস্বাভাবিক -অনুবাদক।)

পারস্যের খোরাসান প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট মনীষী, ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক আবু আল-ফাথ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল করিম আল-শাহরাস্তানি (১০৮৬-১১৫৩ খ্রিস্টাব্দ) ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত কিতাব আল-মিলওয়াল ওয়া আল-নিহাল’কে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনবিদ্যার প্রথমদিককার সুশৃঙ্খল ব্রুপদী গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউনেস্কোর অর্থায়নে বইটির সর্বপ্রথম ফরাসি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৬ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে।-অনুবাদক। আল-শাহরাস্তানি তাঁর ওই ধ্রুপদী বইয়ে লিখেছেন, ইসলামের অনেক পালনীয় বিধি এবং রীতিসমূহ পৌত্তলিক আরবদের প্রথাসমূহের ধারাবাহিক রূপ, যা তারা ইহুদিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন।

ইসলাম-পূর্ব যুগে মা, মেয়েকে এবং পিতার স্ত্রীকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল এবং একই সাথে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাও সামাজিকভাবে গ্রহণ করা হতো না। মৃতদেহকে স্পর্শ করার পর পুণ্যস্নান, পরিষ্কার পানি দিয়ে মুখ ধোয়া, জোরে শ্বাস টেনে পানিকে নাসারন্ধ পর্যন্ত তুলে ফেলা, মাথার চুলে তেল মাখা, মেসওয়াক বা দাঁত খিলাল ব্যবহার করা, মলত্যাগের পর ধৌতকরণ, বগল এবং শ্রোণিদেশের চুল কামানো, খৎনাকরণ এবং চোরের ডান হাত কেটে ফেলা ইত্যাদি রীতি ইসলাম আসার পূর্বে তৎকালীন আরবের পৌত্তলিক অধিবাসীরা পালন করত, যেগুলোর বেশিরভাগ তাঁরা ইহুদিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিল।

পৌত্তলিক আরবদের আইন থেকে ইসলামের যে দুটি আইন ব্যতিক্রমী, সেগুলো হলো পবিত্র যুদ্ধে (জিহাদ) অংশগ্রহণ এবং জাকাত প্রদান করা। অন্য যেকোনো আইনি-কাঠামোতে তুলনামূলক কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ না করার কারণ হল, অন্যান্য আইনপ্রণেতাদের থেকে নবি মুহাম্মদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি রাষ্ট্র গঠন। আর নবি বুঝতে পেরেছিলেন একটি রাষ্ট্র কখনোই সেনাবাহিনী ও আর্থিক উৎস ব্যতীত গঠিত হতে পারে না। জিহাদে অংশগ্রহণের এই ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন ইসলামি আইনটিকে মুহাম্মদের দূরদৃষ্টি এবং বাস্তবতাবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মক্কায় প্রণীত অসাধারণ আধ্যাত্মিক সুরাগুলো যখন অকার্যকরী প্রমাণিত হলো, তখন যে একমাত্র সমাধানটি তিনি খুঁজে পেলেন তা হল, যুদ্ধের মাধ্যমে ফয়সালা করা।

যুদ্ধ করতে সক্ষম একটি সেনাবাহিনী, যেখানে প্রতিটি সৈনিকই যুদ্ধ করতে বাধ্য, এমন একটি সেনাবাহিনীকে ভরণ-পোষণ করা ব্যয়সাপেক্ষ। গনিমতের মাল এবং সম্পত্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হয়তো সৈন্যদের যুদ্ধে আগ্রহী করে তুলতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিক নিরাপদ এবং স্থায়ী একটি আয়ের উৎসের প্রয়োজন রয়েছে যা কিনা ইসলামি আইনে জাকাতের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে।

নবসৃষ্ট সমাজের সীমাবদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয় দিকগুলো মুহাম্মদের গঠনমূলক চিন্তাধারায় স্থান পেয়েছে। তাঁর সকল উদ্যোগই এই সমাজের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করেছেন। যেমন নেশাজাতীয় দ্রব্য নিষিদ্ধকরণ। এটি আরেকটি ব্যতিক্রমী ইসলামি-আইন যা প্রাথমিকভাবে সামাজিক পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে প্রণীত হয়েছিল। আরবরা আবহাওয়াগত কারণে উষ্ণ রক্তের, সহজে উত্তেজিত হয়ে যায় এবং উচ্ছঙ্খল প্রকৃতির হবার কারণে অবাধ-লভ্য নেশাজাতীয় পানীয় পান করে তারা বিভিন্ন অশোভন আচরণ করত এবং সমাজে বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরি করত। এই নিষেধাজ্ঞা তিনটি ধাপে জারি হল : প্রথমত, সুরা বাকারার এই আয়াত :-লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলো, দুয়ের মধ্যেই মহাদোষ, মানুষের জন্য উপকারও আছে, কিন্তু উপকারের চেয়ে ওদের দোষই বেশি।’(২:২১৯)। পরবর্তীতে সুরা নিসার এই আয়াত যা মদিনায় একজন লোক মাতাল অবস্থায় নামাজে হাজির হলে আয়াতটি নাজিল হয়েছিল ; হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছে যেয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা কী বলছ তা বুঝতে পার…। (৪:৪৩)। সবশেষে সুরা মায়িদার দুটি আয়াতে এই নিষেধাজ্ঞা চিরস্থায়ী রূপ লাভ করে হে বিশ্বাসিগণ মদ, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্যপরীক্ষার তীর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো যাতে তোমরা সফল হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শক্রতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে এবং আল্লাহর ধ্যানে ও নামাজে তোমাদেরকে বাধা দিতে চায়! তা হলে তোমরা কি নিবৃত্ত হবে না?’(৫৯০-৯১)। সুরা বাকারার ২১৯ নম্বর আয়াত এবং সুরা মায়িদার ৯০ নম্বর আয়াতের উভয়টিতেই মদ্যপানকে জুয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং শেষ আয়াতে মূর্তিপূজা এবং তীরের মাধ্যমে ভাগ্যপরীক্ষা করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যেগুলো ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকরা সাহায্য লাভের আশায় করত। সুরা মায়িদার ৯১ নম্বর আয়াতে মদ ও জুয়াকে এগুলোর বিষয়গত কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল একটি বিশ্রী ঘটনা ঘটার পর। এই আয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মদ্যপান ও জুয়া খেলা আরবদের মধ্যে অশান্তি এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে।

বহুগামিতা, বিবাহবিচ্ছেদ, ব্যভিচার, অবৈধযৌনসম্পর্ক, পায়ুসঙ্গম এবং আরও অনেক বিষয়ে কোরানের প্রত্যাদেশগুলো রচিত হয়েছে মূলত ইহুদি-আইনের সংশোধিত রূপ হিসেবে এবং আরবে প্রচলিত পূর্ববর্তী প্রথাগুলোর অনুসরণে। অলৌকিকতা আসলে শতাব্দীকাল ধরে ধোঁয়াশার জালে ঘেরা নয় এবং একমাত্র দুর্বল চিত্তের নিকট গ্রহণীয় সংস্কার নয়। বরং এটি জীবন্ত এবং অর্থবহ বিষয়। কোরানের বাগিতা কিংবা এর নৈতিক এবং আইনি-দৃষ্টিভঙ্গির কোনোটিই অলৌকিক নয়। একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এবং দরিদ্র ব্যক্তি মুহামদ প্রায় একা নিজ জাতির তীব্র বাধা অতিক্রম করে একটি স্থায়ী ধর্ম প্রতিষ্ঠায় সফলকাম হয়েছেন। গোত্র-প্রথায় বিভক্ত বিচ্ছিন্ন জাতিগুলোকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছেন। এর ফলে বেপরোয়া মানুষগুলোকে অনুগত লোকে পরিণত করে নবি নিজস্ব ইচ্ছায় চালিত করতে পেরেছেন।

নবি কোরানকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেছেন এবং একে নিজের নবুওতির প্রত্যয়নপত্র রূপে দাবি করেছেন। তাঁর মতে কোরান আল্লাহর প্রেরিত বাণী এবং জনতার কাছে বার্তা প্রেরণের মাধ্যম হচ্ছেন মুহাম্মদ। আরবি ওহি শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রত্যাদেশ কিংবা উন্মোচিত করা; কোরানে এটি ষাটবার ব্যবহৃত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা একজন ব্যক্তির মনে কোনো কিছু ঢুকিয়ে দেয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এটি আবার দ্রুত সঞ্চারণশীল ইঙ্গিতাৰ্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ-কারণে প্রতিটি প্রত্যাদেশের পর নবি উদ্বিগ্ন থাকতেন যাতে একজন হস্তলিপিকর তা তৎক্ষণাৎ লিখে ফেলেন। নবির এই তাড়াহুড়া করার প্রবণতার প্রমাণ কোরানে

পাওয়া যায়। যেমন সুরা তাহায় বর্ণিত হয়েছে: তোমার ওপর আল্লাহর প্রত্যাদেশ সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে কোরান পড়তে তুমি তাড়াতাড়ি করো না আর বলো, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও। (২০:১১৪)। এবং সুরা কিয়ামায় বর্ণিত হয়েছে : “এ (প্রত্যাদেশ) তাড়াতাড়ি (আয়ত্ত) করার জন্য তুমি এর সঙ্গে তোমার জিব নেড়ো না। এ-সংরক্ষণ ও আবৃত্তি করানোর (ভার) আমারই। সুতরাং যখন আমি পড়ি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ করো। তারপর এর বিশদ ব্যাখ্যার (দায়িত্ব) আমারই। (৭৫:১৬-১৯) |

নবি মুহাম্মদের এই তাড়াহুড়া করার প্রবণতা থেকে ‘ওহি নাজিলের সময় তাঁর মানসিক অবস্থার পরোক্ষ-পরিচয় পাওয়া যায়। তার অন্তরাত্মা সেই সময় যে আলোয় আলোকিত হত, তা কোনো স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা ছিল না। আবু সাইদ আল-কাদরি (মৃত্যু হিজরি ২৬১ হিজরি বা ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ) মদিনাবাসী সাহাবি। তিনি প্রচুরসংখ্যক হাদিসের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, নিবি মুহাম্মদ অনুরোধ করেছেন, কোরান ব্যতীত আমার অন্য কোনো ভাষ্য লিখে রেখ না! কেউ যদি কোরান ছাড়া আমার কোনো ভাষ্য লিখে রাখে, তাহলে সে যেন সে-গুলো মুছে ফেলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ওহি নাজিলের সময়ে নবি মুহাম্মদ অসংলগ্ন হয়ে পড়তেন। সম্ভবত একটি তীব্র আভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হতো। সহি বুখারির একটি হাদিস রয়েছে,

নবির স্ত্রী আয়েশা থেকে বর্ণিত : হারেস বিন হিশাম একবার নবিকে প্রশ্ন করেছিলেন, (ওহি নাজিল হওয়ার) এই অনুভূতিগুলো কেমন?” নবি জবাব দিলেন, “সবচাইতে তীব্র হলো ঘণ্টাধ্বনির মতো যেগুলো বন্ধ হবার পরেও আমার মনে বেজে যায়। কোনো কোনো সময় একজন ফেরেশতা মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হন এবং আমি বিষয়টি অনুধাবন করা মাত্র তিনি অদৃশ্য হয়ে যান।

বিবি আয়েশার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘ওহি লাভের সময় নবির ভ্রন্থেকে ঘাম নির্গত হতো, এমনকি শীতের দিনেও আয়েশার বক্তব্যের সমর্থনে বুখারি, সাফওয়ান বিন বালির (মক্কা বিজয়ের পর তাঁর পিতা ইসলাম গ্রহণ করেন) প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে বলেন : ওহি নাজিলের সময়কালে বালি মুহামদকে পর্যবেক্ষণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একদিন একজন ব্যক্তি সুগন্ধি-মাখা একটি আলখাল্লা পরে এসে নবির কাছে জানতে চাইল সে এই কাপড় পরে ওমরা পালনকালে উৎসর্গের ভাবাবস্থা অর্জন করতে পারবে কিনা। মুহাম্মদের উপর তখন ওহি নাজিল হয়। হজরত ওমর বালিকে সামনে আসার সংকেত দিলেন। বালি ভেতরে প্রবেশ করে দেখলেন নবি প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছেন, তিনি নাক ডাকছিলেন এবং তাঁর ওপর আল্লাহ-প্রদত্ত গায়ের রঙ ঠিকরে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর নবি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলেন এবং প্রশ্নকারীকে আহ্বান করলেন। নবি তাঁকে বললেন, সে যেন প্রথমে ওই আলখাল্লাটি পরিষ্কার পানি দিয়ে তিনবার ধুয়ে একে সুগন্ধিমুক্ত করে এবং তারপর হজের বিধানের মতোই নিজেকে ওমরা পালনে উৎসর্গ করে।’

মুহাম্মদের মানবিকতা

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইসলাম ধর্ম । মুহাম্মদের মানবিকতা

নিবিরা আর দশজনের মতোই সাধারণ মানুষ ছিলেন। তবে তাঁদের উপস্থিতির জন্য তোমার এলাকায় পরশমণি বর্ষিত হয়েছে।– জালালুদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ)(৩৫)

প্রাথমিক যুগের অধিকাংশ ইসলাম-বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেছেন আধ্যাতিক স্বতন্ত্রতা ব্যতীত নবি মুহাম্মদ আসলেই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন। এই সত্যটি কোরানের সুরা কাহাফে রয়েছে : ‘বলো, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র উপাস্য।’ (১৮:১১০)। সুন্নি বিশেষজ্ঞদের অনেকে মুহাম্মদকে পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং দোষক্রটির উর্ধ্বে বিবেচনা করেননি। তারা নবির নবুওতিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ উপহার হিসেবে দেখতেন। তাঁরা মনে করতেন আল্লাহ নবির দায়িত্ব পালনের জন্য এমন একজন মানুষকে নির্বাচন করেন যার জ্ঞান, দূরদৃষ্টি এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানবীয় গুণাবলী রয়েছে কিংবা যাকে মানুষের দিক-নির্দেশের দায়িত্ব অর্পণকালে এসব অনন্য গুণাবলী উপহার দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরা একজন মানুষের ওপর তখনই নবুওতির বিশ্বাস করি যখন আমরা তাঁকে স্রষ্টার বার্তাবাহক হিসেবে মনে করি। ওই বিশেষজ্ঞরা এমন কোনো যুক্তি দেখাননি যাতে মনে হয়, আমরা একজন মানুষকে বিশ্বাস করি কারণ স্রষ্টা তাঁকে আমাদের থেকে অধিকতর জ্ঞান এবং নৈতিক গুণাবলী দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাদের এই মতামত কোরানের বিভিন্ন আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেমন সুরা শুরার এই আয়াত : ‘এভাবে আমি আমার আদেশক্রমে তোমার কাছে এক আত্মা (ফেরেশতা) প্রেরণ করেছি যখন তুমি জানতে না কিতাব কী, বিশ্বাস কী। কিন্তু আমি একে করেছি আলো যা দিয়ে আমি আমার দাসদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি; তুমি তো কেবল সরল পথই প্রদর্শন কর।’ (৪২:৫২)। এই একই বিষয় পূর্ববর্তী আয়াতেও আলোচিত হয়েছে। এবং সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে এবং সুস্পষ্টরূপে আলোচিত হয়েছে সুরা আন’আমে, যেখানে মুহাম্মদকে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য লোকেদের জবাব দেওয়া হয়েছে ; বলো, আমি তোমাদেরকে বলি না যে আমার কাছে আল্লাহর ধনভাণ্ডার আছে। অদৃশ্য সম্পর্কেও আমি জানি না। তোমাদের এ-ও বলি না যে আমি ফেরেশতা। আমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ হয় আমি শুধু তা-ই অনুসরণ করি। বলো, “অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না? (৬:৫০)। সুরা আ’রাফে মুহাম্মদকে এই বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে : ‘বলো, আল্লাহর ইচ্ছা আমার নিজের ভালোমন্দের ওপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমার অনেক ভালো হতো আর মন্দ কোনোকিছু আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা মাত্র। (৭:১৮৮)। সুরা আ’রাফের আয়াতটি হেজাজের পৌত্তলিকদের প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন করেছিল, মুহাম্মদ যদি সত্যই অলৌকিক জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, তাহলে তিনি কেন ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে বিশাল মুনাফা অর্জন করছেন না।

এ-বিষয়ে কোরানের আয়াত সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার। হাদিস ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য নবির জীবনবৃত্তান্ত প্রমাণ করে মুহাম্মদ কখনোই নিজেকে দোষত্রটির উর্ধ্বে এবং গায়েবি বিষয় নিয়ে জ্ঞান আছে, এমন দাবি করেননি। একটি নির্ভরযোগ্য হাদিস অনুযায়ী, ‘তিনি একবার পৌত্তলিকদের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নবাণে বিব্রত হয়ে বলেছিলেন, তারা আমার কাছে কি চায়? আমি আল্লাহর এক বান্দা। আল্লাহ আমাকে যা শেখান তাই আমি জানি।’ মুহাম্মদের সত্যবাদিতা এবং সততাকে প্রশংসা করা হয়েছে সুরা আবাসার ১-১১ নম্বর আয়াতে যেখানে তার প্রতি সুস্পষ্ট একটি দৈব-তিরস্কার রয়েছে :

সে (মুহাম্মদ) ব্ৰুকুচকে মুখ ফিরিয়ে নিল
কারণ তার কাছে এক অন্ধ এসেছিল।
তুমি ওর সম্বন্ধে কী জান?
সে হয়তো পরিশুদ্ধ হ’ ত
ব? উপদেশ নিত ও উপদেশ থেকে উপকার পেত?
য়ে নিজেকে বড় ভাবে
বরং তার প্রতি তোমার মনোয়োগ!
যদি সে নিজেকে পরিশুদ্ধ না করে, তবে তাতে তোমার কোনো দোষ হতো না!
অথচ যে কিনা তোমার কাছে ছুটে এল
আর এাল ভয়ে-ভয়ে
তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে!
কক্ষনে (তুমি এমন করবে না, এ এক উপদেশবাণী (৮০:১-১১)।

নবি মুহামদ কিছু ধনী এবং প্রভাবশালী লোককে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে সৎপন্থা অবলম্বন করেছিলেন। এটা সমর্থনযোগ্য একটি উদ্যোগ। কারণ পৌত্তলিকরা প্রশ্ন তুলেছিল ; দু-দলের মধ্যে কোনটি মর্যাদায় শ্রেয় আর সমাজ হিসেবে কোনটা উত্তম। (১৯৭৩)। যে কোনো অবস্থাতে গণ্যমান্যদের সমর্থন অর্জন করা মুহাম্মদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। একদিন তিনি যখন হেজাজের একজন প্রভাবশালী লোকের সাথে কথা বলছিলেন এবং তাঁকে ইসলামে বিশ্বাস করানোর জন্য একাগ্রতায় নিমজ্জিত ছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ বিন ওম মাকতুম নামের একজন সদ্য ইসলাম-গ্রহণকারী অন্ধব্যক্তি মুহামদকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘আল্লাহ আপনাকে যা কিছু শিখিয়েছেন তার কিছুটা আমাকেও শেখান। নবি ওই অন্ধব্যক্তির কথায় কর্ণপাত না করে বাড়ি চলে গেলেন। এরপরই এই মহৎ সুরা আবাসার আয়াতগুলো নাজিল হয়, যেখানে নবিকে পরিষ্কারভাবেই তিরষ্কার করা হয়েছে। পরবর্তীতে যখনই আব্দুল্লাহ বিন ওম মাকতুমের সাথে নবির দেখা হত, তিনি তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। সুরা মুমিনের একটি আয়াতে নবিকে ধৈর্যশীল হতে বলা হয়েছে ; অতএব তুমি ধৈর্য ধরো, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। তুমি তোমার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও সকাল-সন্ধ্যায় তোমার প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা ঘোষণা করো। (৪০:৫৫)। এই আয়াতে নবির চরিত্রে দোষ দেখিয়ে তাঁকে নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। সুতরাং মুহাম্মদের কোনো দোষত্রুটি নেই বলে পরবর্তীকালের মুসলমানদের মনে যে গভীর অন্ধবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে তা কোরানের এই ভায্যের বিরোধী।

একই বিষয়টি সুরা ইনশিরাহ এর প্রথম তিন আয়াতে ভিন্নভাবে ফুটে ওঠেছে ; আমি কি তোমার বক্ষ উন্মুক্ত করিনি? আমি হালকা করেছি তোমার ভার, যা ছিল তোমার জন্য খুব কষ্টকর।’ (৯৪:১-৩)। আরবি কোরানে ব্যবহৃত ‘ওয়েজরশব্দটি (বাংলা অর্থ ‘ভার বা বোঝা) সূরা ফাতহ এর প্রথম দুটি আয়াতে ধানব শব্দ (বাংলা অর্থ ‘পাপ) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে : আল্লাহ তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছেন। এ এজন্য যে, তিনি তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রটিগুলো মাফ করবেন, তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন এবং তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করবেন।(৪৮:১-২)। অতএব কোরানের এই স্পষ্টভাবে বর্ণিত এবং অপরিবর্তনযোগ্য আয়াতগুলো প্রমাণ করে, নবি মুহাম্মদ যাকে পরবর্তীতে মুসলমানরা সকল দোষক্রটির উর্ধ্বে এবং অলৌকিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু নিজেকে মোটেও সেরকম মনে করতেন না এবং কোরানেও সেভাবে ফুটে ওঠেনি। যৌক্তিক চিন্তা এবং জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী যে কারো কাছে মুহাম্মদের এই আধ্যাত্মিক উৎকৃষ্টতা এবং সততা আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়।

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস, সামাজিক প্রথাসমূহ যেগুলো গণিতশাস্ত্রের নিশ্চয়তা এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রায়োগিক প্রমাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, সে-সব বিষয়ে মানুষ নিজের যুক্তির কর্মদক্ষতা দেখাতে সবসময়ই অনিচ্ছা পোষণ করে এসেছে। পক্ষান্তরে তারা প্রথমেই বিশ্বাস অর্জন করেছে এবং নিজেদের বিশ্বাসের পক্ষের বক্তব্য দিয়ে মস্তিষ্ক পূর্ণ করেছে। স্বীকার করতে হবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো ইসলামের ওলামারাও এই বৈশিষ্ট্যের বাইরে নন। নবি মুহাম্মদ সকল দোষত্রটির উর্ধ্বে-নিজেদের এই বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ হয়ে এবং তা প্রমাণের আশায় তারা কোরানের স্পষ্ট আয়াতগুলো পর্যন্ত ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

নবি মুহাম্মদের মানবীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় এ-প্রসঙ্গে একটি গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্য খোজেস্তানের সুস্তান শহরে একজন খ্যাতিমান সুফি সাধক ছিলেন, তাঁর নাম শাহ আল-তুস্তারি (৮১৮-৮৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। একদিন এই সাধকের কাছে তাঁর অনুসারীগণ গিয়ে বললেন, লোকজন বলাবলি করছে, আপনি নাকি পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারেন। আল-তুস্তারি বললেন, ‘মুয়াজ্জিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, তিনি একজন সৎ ব্যক্তি। অনুসারীগণ মুয়াজ্জিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে জবাব দিলেন : ‘আমি এ-বিষয়ে কিছু জানি না। তাঁকে কখনো আমি পানির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখিনি। তবে আমার মনে আছে তিনি একদিন পুণ্যস্নানের জন্য সাঁকোর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি পা পিছলে পানিতে পড়ে যান। ডুবেও যেতেন, যদি না আমি তাঁকে টেনে তুলতাম। এ-ঘটনার একটি দিক যা কোনো নিরপেক্ষ সত্যসন্ধানী অস্বীকার করতে পারবেন না তা হলো, প্রমাণের প্রাচুর্য।

হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার” মনে করেন হাদিসের সংকলন এবং মুহাম্মদের প্রথম দিককার জীবনীকারকগণ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতাকে যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এবং স্বচ্ছতার সাথে চিত্রায়িত করেছেন তা বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের ঐতিহাসিক নথিপত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না; এবং কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই এগুলো মুহাম্মদকে মানবীয় নৈতিক, ভালোমন্দ, দোষ-গুণের অধিকারী হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।

এই তথ্যগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে নবি মুহাম্মদকে অলৌকিক ক্ষমতাধর অতিমানব বানাবার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বরং দেখানো হয়েছে তিনি তাঁর সাহাবি এবং সহযোগীদের নিয়ে একটি সমতাস্থলে অবস্থান করতেন। তাৎক্ষণিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৫ম হিজরিতে (৬২৭ খ্রিস্টাব্দ) মদিনায় পরিখার যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষের আর সবার মতো নবিও একইভাবে খননকাজ করেন। প্রচলিত আছে জীবনের প্রশান্তি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে তিনটি জিনিস পছন্দ করি: সুগন্ধি, নারী এবং সবার উপরে নামাজ। মুহাম্মদের জীবনাচরণে কঠোর এবং বিশ্বজনীন নয় এমন বিষয়াবলী খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। নবিকে মানবীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে রাখার চেষ্টা কোরান, হাদিস এবং নবির জীবন চরিতের সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নবি মারা যাবার পর থেকে এই প্রচেষ্টা শুরু হয়। তাঁর মৃত্যুর একদিন পর হজরত ওমর (অথবা অন্য কোনো শীর্ষস্থানীয় সাহাবি) খোলা তরবারি নিয়ে হুমকি দিলেন, মুহাম্মদের মৃত্যুখবর যে প্রচার করবে, তিনি তার গলা কেটে ফেলবেন। তখন হজরত আবু বকর কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করে প্রতিবাদ করলেন: তোমার মৃত্যু হবে, এবং তাদেরও। (সুরা জুমার ; আয়াত ৩০)। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ওমর নয়, আবু বকরই সঠিক ছিলেন। হিজরি ১১ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) মুহাম্মদের মৃত্যুর পর মদিনা থেকে যত সময় এবং স্থানের দূরত্ব বাড়তে থাকল মুসলমানরাও তাদের কল্পনাগুলোকে ততটাই প্রসারিত করতে লাগলেন।

মুসলমানরা অতিরঞ্জন আর কাব্যিকতাকে এতোটাই প্রসারিত করলেন যে দুটি প্রধান ভিত্তিমূল, যেগুলো প্রতিদিনের পাঁচবার নামাজের সময় বলা হয় এবং কোরানের বিভিন্ন আয়াতেও উদ্ধৃত আছে, সেগুলো তাঁরা ভুলে গেলেন : মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা এবং বার্তাবাহক। তাঁরা মুহামদকে সৃষ্টির আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন এই বলে যে : আপনি না থাকলে এই মহাবিশ্ব তৈরি হতো না। পারস্যের সুফিবাদী শায়েখ নজম আল-দিন দায়া রাজি (মৃত্যু হিজরি ৬৫৪ বা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দ) নামের গভীর বিশ্বাসী লেখক তাঁর “মেরসাদ আল-ইবাদ’ বইয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন: ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা, যিনি শুধুমাত্র হওউচ্চারণ করেই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারতেন, সেই আল্লাহই সর্বপ্রথম মুহাম্মদকে আলো হিসেবে তৈরি করেছিলেন এবং মুহাম্মদ যখন আলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তখন সেই আলো লজ্জায় ঘামতে শুরু করল এবং সেই ঘামের ফোঁটা দিয়ে আল্লাহতায়ালা অন্য নবি ও ফেরেশতাদের আত্মা তৈরি করলেন।’

মুহাম্মদের আধুনিক জীবনীকারক মিশরীয় বংশোদ্ভুত মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ওস-সামান লিখেছেন : মুহাম্মদ আসলেই অন্যান্য নবির মতোই মানুষ ছিলেন। তাঁর জন্ম, মৃত্যু আর সকল মানুষের মতোই হয়েছিল। মুহাম্মদের নবুওতি তাঁর মানুষ পরিচয়ের জন্য কখনো কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আর সকলের মতোই তিনিও রাগতেন, সন্তুষ্ট, বিমর্ষ এবং উল্লসিত হতেন। তিনি একবার আসওয়াদ ইবনে আব্দুল মোতালেব ইবনে আসাদের প্রতি এতোটাই ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন যে, তাঁকে অভিশাপ দেন এই বলে‘আল্লাহ যেন তাঁকে অন্ধ করে দেন এবং তাঁর পুত্রকে পিতৃহারা করেন।

মুহাম্মদ ইজ্জত দারওয়াজা (১৮৮৮-১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ) ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ-ইতিহাসবিদ, তিনি নবি মুহাম্মদের ওপর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর বইয়ে কোরানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কোনো নিজস্ব বক্তব্য প্রদানে বিরত থেকেছেন। মুহাম্মদ এবং ইসলামের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা এবং ভক্তির উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া যায় দুই খণ্ডে রচিত এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। তিনি পরিতাপের সাথে শেষ পর্যন্ত উপসংহারে পৌছেছেন যে, মধ্যযুগের বিশিষ্ট হাদিস-ভাষ্যকারক আল-কাসতালিনি” (জন্ম হিজরি ৮৫১ বা ১৪৪৮ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৯২৩ বা ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামি গ্রন্থ রচনায় সম্পূর্ণ উচ্ছন্নে গিয়েছিলেন এবং নিজের মনগড়া কাহিনী একের পর এক আরোপণ করেছিলেন তাঁর গ্রন্থে যেগুলোর কোনো ভিত্তি দারওয়াজা নিজে কোরান এবং বিশ্বাসযোগ্য হাদিস ও অন্যান্য তথ্যবিবরণে খুঁজে পাননি। কাসতালিনির মতো অন্ধবিশ্বাসীরা কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কারণ নবি মুহামদ যেন মানবজাতিতে জন্মগ্রহণ করতে পারেন; এবং এই কারণে মুহাম্মদ হলেন মানবজাতি সৃষ্টির প্রাধন কারণ। কাসতালিনি আরও মনে করতেন লওহ, কলম, আরশ বা সিংহাসন, কুরসি বা চেয়ার থেকে শুরু করে আকাশ, পৃথিবী, জিন, মানুষ, বেহেশত, দোজখ সবকিছুই নবি মুহাম্মদের নুর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাঁরা সুরা আন’আমের এই আয়াতের বক্তব্য ভুলে গেলেন : রিসালাতের দায়িত্ব আল্লাহ কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।’(৬:১২৪)। একই সাথে তাঁরা ইসলামের মৌলিক মূলনীতিও ভুলে গেলেন, যেখানে বলা হয়েছে কেবল আল্লাহই অস্তিত্বশীল জগতের চূড়ান্ত কারণ।

ফিলিস্তিনি লেখক দারওয়াজা আরও লিখেছেন যে, কোরানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সকল নবিকে মরণশীল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ মানবজাতিকে দিক-নির্দেশনা দেবার জন্য পাঠিয়েছেন। সুরা আম্বিয়ার ৭-৮ আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে : তোমার পূর্বে আমি প্রত্যাদেশ দিয়ে মানুষই পাঠিয়েছিলাম; তোমরা যদি না জান তবে উপদেশপ্রাপ্ত সম্প্রদায়দেরকে জিজ্ঞাসা করো। আর তাদেরকে এমন দেহবিশিষ্ট করিনি যে তাদের খাবার খেতে হতো না; তারা চিরস্থায়ীও ছিল না। ( ২১:৭-৮)। অর্থাৎ আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য নির্বাচিত হওয়া ছাড়া মুহাম্মদ আর কোনো ক্ষেত্রেই মানবজাতির বাইরের কেউ নন। কোরানে এই বক্তব্য বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে যেগুলো ফিলিস্তিনি লেখক ইজ্জত দারওয়াজা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। প্রাসঙ্গিক আরও আয়াত আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি : বলো, আমার প্রতিপালকের পবিত্র মহিমা! আমি এক সুসংবাদদাতা রসুল ছাড়া আর কী? আল্লাহ কি মানুষকে রসুল করে পাঠিয়েছেন? ওদের এই কথাই লোকদেরকে বিশ্বাস করতে বাধা দেয় যখন ওদের কাছে পথের নির্দেশ।(১৭:৯৩-৯৪)। ওরা বলে, এ কেমন রসুল যে খাবার খায় হাটে-বাজারে চলাফেরা করে! তার কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয় না যে তার সঙ্গে থাকবে ও ভয় দেখাবে।’ (২৫৭)। প্রত্যাদেশের মাধ্যমে তোমার কাছে এ-কোরান প্রেরণ করে আমি তোমার কাছে সবচেয়ে ভালো কাহিনী বর্ণনা করেছি, যদিও এর পূর্বে তুমি ছিলে অসতর্কদের অন্তর্ভুক্ত।’(১২:৩)। আমি তোমার পূর্বেও কোনো মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে? ( ২১:৩৪)। মুহাম্মদ রসুল ছাড়া আর কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রসুল গত হয়েছে। (৩:১৪৪)। যখন তুমি জানতে না কিতাব কী, বিশ্বাস কী। (৪২:৫২)। বলো, আমি তো রসুলদের মধ্যে এমন নতুন কিছু নই। আর আমাকে ও তোমাদেরকে নিয়ে কী করা হবে আমি তা জানি না। আমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ হয় আমি তা-ই অনুসরণ করি। আমি এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র। (৪৬:৯)।

নবি মুহাম্মদের মনুষ্যত্ব, তাঁর মানবীয় গুণাবলী এবং ক্রটির ইঙ্গিত ইসলামের ইতিহাসের অনেকগুলো সমর্থিত সূত্র থেকে পাওয়া যায়। হিজরি ৪ সালে মাওনার বানু আমির ও বানু সেলিম গোত্রের সাথে লড়াইয়ে নবির পক্ষের প্রায় ৭০জন সাহাবি নিহত হন। এ-ঘটনায় নবি অসম্ভব বেদনাত হয়ে পড়েন। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন, “হে আল্লাহ! মোদারদেরকে (উত্তর-আরবীয় গোত্রসমূহ) পদদলিত করুন। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ওহুদের যুদ্ধে নবি পরাজিত হন এবং সেই যুদ্ধে নবির চাচা হামজা বিন আব্দুল মোতালেব মারা যান। আবিসিনিয়া থেকে আগত এক ক্রীতদাস ওয়াশি ইবনে হার্ব কুরাইশদের পক্ষ হয়ে লড়াইয়ে হামজার নাক-কান কেটে ফেলেন এবং তরবারি দিয়ে পেট ফুটো করে দেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা বদর যুদ্ধে নিহত তাঁর পিতা উতবা ইবনে রাবিয়া হত্যার প্রতিশোধ নিতে হামজার পাকস্থলি চিরে ফেলেন এবং মুখ দিয়ে রক্তমাখা যকৃত চুষেন। হামজার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ দেখে নবি এতোটা রাগান্বিত হন যে, তিনি চিৎকার করে বলেন, আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, পঞ্চাশ জন কুরাইশকে আমি ছিন্নভিন্ন করে দেব। এ-রকম আরও অসংখ্য ঘটনাবলীর মাধ্যমে তৎকালীন আরবদের মনের নির্দয়তা ও প্রতিহিংসার পরিচয় মেলে। তৎকালীন সামাজিক পরিবেশ এমনই ছিল যে একজন অভিজাতবংশীয় নারী যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে মৃতব্যক্তির পাকস্থলী চিরে ফেলত এবং যকৃত চুষে ছুড়ে ফেলত। যুদ্ধের সময় হিন্দ বিনতে উতবাসহ আরও অনেক সন্ত্রান্ত কুরাইশ নারী মক্কার যোদ্ধাদের মাঝে গিয়ে মেয়েলি আকর্ষণ এবং বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করতেন।

ইবনে হিশামের নবি মুহাম্মদের জীবনচরিত” থেকে জানা যায়, বাজিলা গোত্রের কিছু লোক মদিনায় এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে মুহাম্মদের কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। মুহামদ তাঁদেরকে বললেন, উটের দুধ পান করলে তাঁরা সুস্থ হয়ে যাবে। তিনি তাঁদেরকে মদিনার বাইরে অবস্থিত তাঁর পশুপাল রক্ষণাবেক্ষণকারীর নিকট পাঠালেন। উটের দুধ খাওয়ার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু কোনো কারণে তাঁরা নবির সেই পশু রক্ষণাবেক্ষণকারীকে হত্যা করে। তাঁরা ওই ব্যক্তির চোখে ফলক ঢুকিয়ে উটের সাথে বেঁধে ছেড়ে দেয়। মর্মান্তিক এই খবরটি শোনার পর নবি খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কর্জ ইবনে জাবেরকে প্রেরণ করেন তাঁদেরকে ধরে নিয়ে আসার জন্য। এরা ধরা পড়ার পর নবির নিকট নিয়ে আসা হলো। নবি তাঁদের হাত-পা কাটার জন্য এবং চোখ উপড়ে ফেলার নির্দেশ দিলে তা বাস্তবায়িত হয়।

বুখারি হাদিসে উল্লেখ আছে নবি বলেছিলেন, “আমি একজন মানুষ, আমি রাগ, দুঃখ, কষ্ট অনুভব করি। ঠিক যেমনি অন্য সব মানুষ রেগে যায়। অন্যান্য সূত্র থেকে এই হাদিসের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। সাহাবি আবু রহম আল-গিফারি বলেছেন, একবার এক অভিযানে তিনি যখন নবির পাশে চলছিলেন, তখন তাঁর বাহক পশুটি আকস্মিকভাবে তাঁকে এমনভাবে নবির কাছাকাছি নিয়ে যায় যে, তাঁর প্রশস্ত পা নবির হাঁটুর নিচে আঘাত করে এবং নবি এতে মারাত্মক ব্যথা পান। নবি তখন রেগে গিয়ে আবু রহমকে নিজের চাবুক দিয়ে আঘাত করেন। আবু রহম খুবই বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এই ঘটনায়, কারণ তিনি মনে করেছিলেন তাঁর এই অশোভন আচরণের জন্য তাঁর সম্পর্কে একটি আয়াত নাজিল হতে পারে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নবি সিরিয়া অভিযানকারী সৈন্যদলের নেতৃত্ব তরুণ বয়সী ওসামা বিন জায়েদকে প্রদান করেন। আবু বকরের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবি আছেন এমন একটি সৈন্যদলের দায়িত্ব একজন বিশ বছর বয়সী ব্যক্তিকে প্রদানের ফলে সৈন্যদলের মাঝে অসন্তোষ ও অসমতির ধ্বনি শোনা যেতে লাগল। অসন্তুষ্টির তালিকায় নবির কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবিও ছিলেন। অসন্তোষের কথা শুনে নবি প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন, তিনি অসুস্থ অবস্থায় শয্যাত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। তারপর ঘোষণামঞ্চে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ওসামাকে নিযুক্ত করায় কার কি অভিযোগ রয়েছে? নবির শেষ সময়ের অসুস্থতায় তাঁর একজন স্ত্রী মায়মুনা আবিসিনিয়ায় থাকাকালীন সময়ে শেখা জ্ঞান দিয়ে একটি ওষুধ তৈরি করেন। এ-ওষুধ অজ্ঞান থাকা অবস্থায় নবিকে খাওয়ানো হয়। তিনি হঠাৎ জেগে উঠেন এবং রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে এই কাজটি করেছে? উপস্থিত সবাই জানালেন, মায়মুনা ওষুধটি তৈরি করেছেন এবং আপনার চাচা আব্বাসকে দিয়ে ওষুধটি খাওয়ানো হয়েছে? নবি তখন নির্দেশ দিলেন ওষুধটি আব্বাস ব্যতীত উপস্থিত সবাইকে খাওয়ানো হোক। রোজা রাখা সত্ত্বেও সে-সময় মায়মুনা ওষুধটি পান করেছিলেন।

নবুওতির ২৩ বছর ধরে মুহাম্মদের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং মানবিক অনুভূতির প্রকাশ প্রচুর ঘটনার বিবরণ থেকে জানতে পারা যায়। বিশেষ করে মদিনায় ১০ বছর অবস্থানকালীন সময়ের ঘটনাবলী। আয়েশা সম্পর্কিত মিথ্যা কথা বলার ঘটনা, মারিয়াকে স্বীয় আরোপিত অবজ্ঞা, জয়নাবকে বিয়ে করার জন্য তাড়াহুড়ো করা এবং বিচ্ছেদের সময়সীমা অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে জয়নাবকে নিজের ঘরে নিয়ে আসা ইত্যাদি ঘটনার প্রেক্ষিতে মুহাম্মদের মানসিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। এতোসব সাক্ষ্যপ্রমাণের উপস্থিতি এবং কোরানে অসংখ্যবার মুহাম্মদকে কোনো প্রকার অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি স্পষ্টভাবে বলার পরও তিনি মারা যাওয়ার সাথে সাথে অতিধাৰ্মিক এবং অলৌকিকতায় বিশ্বাসীরা বলতে শুরু করলেন, নবি সব-ধরনের অলৌকিক এবং বিস্ময়কর কাজ করে গিয়েছেন। সময় ও স্থান যতোই প্রসারিত হতে লাগল ততোই কল্পকথার পরিধি বৃদ্ধি পেতে লাগল।

যদিও অনেক ইসলামি পণ্ডিত এই ধরনের কল্পকাহিনীকে অসম্ভব ও অযোগ্য বলে মনে করতেন। তার কিছু উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। কাজি আয়াদ ইবনে মুসা (১০৮৩-১১৪৯ খ্রিস্টাব্দ) একজন আন্দালুসীয় বিচারক, ধর্মতাত্ত্বিক। তিনি নবি মুহাম্মদকে প্রশংসা করে কিতাব আস-শিফা বি তারিফ হোকুক আল-মুস্তফা নামে একটি বই রচনা করেছেন। প্রত্যাশার বিপরীতে বইটি মুহাম্মদের আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি নিয়ে রচিত নয়। বইটি পড়ে পাঠক আশ্চর্যন্বনিত হয়েছেন এই ভেবে যে, লেখকের মতো একজন শিক্ষিত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সম্ভবত নির্বোধ নন, এমন ব্যক্তি কিভাবে নবি মুহাম্মদ সম্পর্কে এ-রকম লেখার কথা চিন্তা করতে পারেন। নবি মুহাম্মদের দাস এবং প্রসিদ্ধ হাদিস বর্ণনাকারী আনাস বিন মালেকেকে(৩৯) উদ্ধৃত করে, কাজি আয়াদ তাঁর বইয়ে নবি মুহাম্মদকে অলৌকিক যৌনক্ষমতার অধিকারী বলে মন্তব্য করেছেন। নবি নাকি প্রত্যহ নিজের এগারো জন স্ত্রী’র সাথে দৈহিক মিলন করতে পারতেন। নবির যৌনক্ষমতাকে কাজি আয়াদ ত্রিশজন সাধারণ পুরুষের যৌনক্ষমতার সমতুল্য বলে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। এমন কী, আনাসকে সাক্ষী করে কাজি আয়াদ তাঁর বইয়ে নবি মুহাম্মদের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করিয়েছেন: সাধারণ মানুষ থেকে চারটি ক্ষেত্রে আমি শ্রেষ্ঠ। এগুলো হচ্ছে উদারতা, সাহস, সঙ্গম এবং ঘন ঘন বালশ (আরবি এই শব্দের অর্থ শত্রু নিপাত করা)। এই বক্তব্যটি যদি আনাস বিন মালেকের মুখ থেকেও নিঃসৃত হয় তবু একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি তা বিশ্বাস করতে পারেন না। সত্য ঘটনা হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের নবি মুহাম্মদ কখনো আত্মপ্রচারে নিমগ্ন ছিলেন না। আর কোরানে কোথাও মুহাম্মদের দয়ালু মনোভাব এবং সাহসের উল্লেখ নেই। শুধু সুরা কলমে উল্লেখ আছে : ‘তুমি অবশ্যই সুমহান চরিত্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছ। (৬৮:৪)।

যদি কাজি আয়াদ নিজের দানশীলতা এবং নিভীকতার জন্য আত্মপ্রচারণা করতেন তাহলেও তা বিচারযোগ্য ছিল। কিন্তু অপর ব্যক্তির মুখ দিয়ে এমন এক ব্যক্তিকে যৌন ক্ষমতা এবং মানুষ হত্যা নিয়ে গর্ব করানোর কোনো অধিকার কাজি সাহেবের নেই। বিশেষ করে এই ব্যক্তিটি নবি মুহাম্মদ, তিনি কখনো এ-ধরনের কথা বলেন নি। আসল কথা হচ্ছে, সত্যকে পাশ কাটিয়ে কাজি আয়াদ নিজস্ব যৌনবাসনার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চেয়েছেন। নবিকে মানুষের উর্ধ্বে স্থান দেয়ার অভিপ্রায় থেকে তিনি এতো দূর পর্যন্ত অগ্রসর হলেন যে, তিনি তাঁর বইয়ে নবির মলমূত্র ও থুথুকে দিয়েও কথা বলিয়েছেন। তিনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, কিছু ওলামার বক্তব্য অনুযায়ী, এগুলো নাকি সম্পূর্ণ পবিত্র। নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে তিনি গল্প ফাঁদলেন, নবির ব্যক্তিগত এক দাসী উমে আয়মান একদা নবির মূত্র পান করে শোথরোগ (শরীরে পানি সঞ্চারের ফলে ফোলারোগ) থেকে আরোগ্য লাভ করেন। নবি নাকি ওই দাসীকে বলেছেন, তাঁর মূত্রপানের ফলে সে আর কোনোদিন পেটের পীড়ায় ভুগবে না। উদ্ভট আরেকটি বিষয় হচ্ছে কাজি আয়াদ তাঁর বইয়ে এও দাবি করেছেন, নবি যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হতেন তখন পাথর এবং গাছগাছালি তাঁর চারপাশে এসে বেড়া দিত, যাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে পারেন। একজন পাঠক এই ধরনের আজগুবি বক্তব্য পড়ে সহজেই বুঝতে পারবেন, মুহাম্মদকে মানুষের উপরে স্থান দিতে গিয়ে কাজি আয়াদ অন্ধবিশ্বাসে আপ্লুত হয়ে কতটুকু সীমা অতিক্রম করেছিলেন। কাজি সাহেবের এই ধরনের কষ্টকল্পনা রচনার চেয়ে তিনি বরং সহজে বলতেই পারতেন, নবি মুহাম্মদকে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো খাওয়া-দাওয়া ও প্রাকৃতিক কর্ম করতে হতো না। তাহলে অন্তত তাঁকে হাঁটাচলা করা পাথর ও গাছগাছালির গল্প তৈরি করতে হতো না।

এ-ধরনের প্রলাপবাক্য শুধু কাজি আয়াদ একা উচ্চারণ করেননি। পূর্বে উল্লেখিত হাদিস-ভাষ্যকারক আল-কাসতালিনির মতো আরও ভজন খানেক লেখক রয়েছেন যারা শতাধিক অযৌক্তিক হাস্যকর কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করেছেন, যার ফলে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে নবি মুহাম্মদকে অকারণেই স্বতন্ত্র সমালোচনা ও বিদ্রুপের সমুখীন হতে হয়। নবিকে দিয়ে এটাও বলানো হয়েছে যে, আদমকে সৃষ্টি করার সময় আল্লাহ আমাকে আদমের কোমরে স্থাপন করেছিলেন, পরবর্তীতে নুহ, ইব্রাহিমের কোমরেও আমাকে তিনি প্রতিস্থাপন করেন। মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের আগ পর্যন্ত আমি তাঁদের পবিত্র কোমর ও গর্ভে অবস্থান করেছি। তার মানে কি এই যে, প্রতিটি মানুষ ঝোপ ঝাড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠেছে। স্বাভাবিকভাবে মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের আগে যদি মানুষের অস্তিত্বশীল হবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এই ঝোপঝাড়ের যুক্তির মাঝেও কোনো অসংগতি থাকার কথা নয়।

কাজি আয়াদ আরও বলেছেন, নবি মুহাম্মদ যখন কোনো জায়গা দিয়ে অতিক্রম করে যেতেন, তখন সেখানকার পাথর, গাছগাছালি তাঁর কাছে হেঁটে চলে এসে বলত : হে আল্লাহর দূত আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। চলাচল করতে সক্ষম, কণ্ঠস্বর্যন্ত্র এবং জিহ্বাসম্পন্ন প্রাণীরাও যদি এসে একথা বলত তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু মস্তিক, স্নায়ু, দৃষ্টি ও ইচ্ছাশক্তিহীন অজৈব পদার্থ কিভাবে নবিকে চিনতে পারল! সম্ভাষণ জানানো তো দূরের কথা। কেউ কেউ বলবেন এটা সম্পূর্ণ অলৌকিক বিষয়। তাই যদি হয় তাহলে মুহাম্মদের বাণীকে বিশ্বাস করার শর্ত হিসেবে কুরাইশরা যখন অলৌকিক কার্যাবলী দেখানোর দাবি তুলেছিল, সে-সময় কেন তা প্রদর্শিত হয়নি? কুরাইশরা যে-ধরনের অলৌকিকতা দেখতে চেয়েছিল তা আহামরি কিছু নয়। তাঁরা দাবি করেছিল মুহাম্মদ যেন পাথর থেকে পানি নির্গত করেন কিংবা পাথরকে সোনায় পরিণত করেন। যদি পাথর মুহামদকে সম্ভাষণ জানাতে পারে তবে ওহুদের যুদ্ধে একটি পাথর কিভাবে মুহাম্মদের শরীরে আঘাত করে তাঁকে আহত করল? অলৌকিকতার-পূজারীরা এই পাথরকে নাস্তিক’ বলে চিহ্নিত করবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই!

সুন্নি এবং শিয়া লেখকদের অসংখ্য বইয়ে বলা হয়েছে নবি মুহাম্মদের কোনো প্রতিবিম্ব ছিল না। তিনি সামনে-পিছনে সমানভাবে দেখতে পেতেন। শাহরানি’ (মৃত্যু হিজরি ৯৭২ বা ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর বই কাশফ আল-ঘোমায় লিখেছেন : নবি মুহাম্মদ চতুর্দিকে সমানভাবে দেখতে পেতেন এবং রাতের বেলাতেও তিনি দিনের মতো পরিষ্কার দেখতে পেতেন। তিনি যখন একজন লম্বা মানুষের সাথে হাটতেন, তখন তাঁকে লম্বা দেখাত এবং তিনি যখন বসতেন তখন তাঁর কাঁধ অন্যদের চেয়ে উঁচু থাকত।

এই ধরনের বক্তব্যপ্রদানকারী মুসলমান লেখকেরা আসলে মুহাম্মদের মহানুভবতা, নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী, দক্ষতা নির্ণয়ে একেবারেই অক্ষম। তাঁদের চিন্তাভাবনা পুরোপুরি সেকেলে। যে কারণে তাঁরা বাহ্যিক অবয়ব, শারীরিক সক্ষমতাকে কেবলমাত্র শ্ৰেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে মনে করেছেন। একজন মানুষকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর করতে যে আধ্যাত্মিক, বৌদ্ধিক এবং নৈতিক সক্ষমতাই বিচার্য, এগুলি তাঁদের স্কুলচিন্তাধারায় স্থান পায়নি। শুধু তাই নয় তাঁদের মনে কখনো এই প্রশ্ন আসেনি কোনো অলৌকিক ঘটনা কেন মুহাম্মদকে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে সাহায্য করেনি। তারা এও প্রশ্ন তুলেননি, মুহাম্মদ কেন কথিত দাবি অনুযায়ী লিখতে-পড়তে পারতেন না? নবিকে প্রতিবিম্বহীন এবং মাথা ও কাঁধের দিক দিয়ে অন্যদের তুলনায় উচ্চতর করার হাত দিয়ে কোরান লিখলেন না? সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই অলৌকিকতা-সন্ধানকারীরা নিজেরা মুসলিম ছিলেন, তাঁরা কোরান পড়েছেন এবং কোরানের অর্থ বোঝার জন্য যথেষ্ট আরবি জানতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা বিভ্রমের শিকার হয়ে সেগুলোকে ব্যাকুলভাবে “সত্য হিসেবে প্রচার করেছেন, যেগুলো কিনা সরাসরিভাবে কোরানের বক্তব্যের পরিপন্থী।

কোরানের যেসব আয়াত মুহাম্মদকে সকল মানবীয় গুণসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে সেইসব আয়াত নিখুঁতভাবে পরিষ্কার এবং এগুলোকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই। মক্কায় অবতীর্ণ সুরা তাহা এর ১৩১ নম্বর আয়াতে নবিকে বলা হয়েছে ; আমি অবিশ্বাসীদের কাউকে-কাউকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য হিসেবে ভোগবিলাসের যেউপকরণ দিয়েছি তার দিকে তুমি কখনও লক্ষ্য কোরো না। তোমার প্রতিপালকের দেয়া জীবনের উপকরণ আরও ভালো ও আরও স্থায়ী। ( ২০:১৩১)। একইভাবে মক্কায় অবতীর্ণ সুরা হিজরে বলা হয়েছে : “আমি তাদের (অবিশ্বাসীদের) কতককে ভোগবিলাসের যে-উপকরণ দিয়েছি তার দিকে তুমি কখনও চোখ দিয়ো না। আর (ওরা বিশ্বাসী না হওয়ার জন্য) তুমি দুঃখ করো না। তুমি বিশ্বাসীদের প্রতি বিনয়ী হও। (১৫:৮৮)। এই আয়াতগুলোর বক্তব্য থেকে এটা স্বাভাবিকভাবে বোঝা যায়, নবি মুহাম্মদের মনে কোনো ধরনের উচ্চাশা ভর করেছিল। হয়তো তিনি আশা করছিলেন কুরাইশ নেতাদের মতো তিনিও বিপুল ধনসম্পদ এবং পুত্রসন্তানের অধিকারী হবেন।

মুহাম্মদের বেশিরভাগ প্রতিপক্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে তাঁরা পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন এবং তাঁদের অবস্থানকে টলাতে সক্ষম যে কোনো ধরনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। একইভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর মুহাম্মদের অনুগামী হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁদের মধ্যেও দাবি আদায় ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই পরিস্থিতিতে নবি বিমর্যবোধ করলেন এবং কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পক্ষে টানার আশা করলেন। তাঁদের উপরেই ইসলামের ভবিষ্যত নির্ভর করছে বলে তিনি স্থির করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এই পথে যেতে নিষেধ করলেন। সুরা সাবায় এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে : “যখনই আমি কোনো জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করেছি সেখানকার বিত্তশালী অধিবাসীরা বলেছে, “তুমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা অবিশ্বাস করি। আর ওরা আরও বলত, আমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি বেশি, সুতরাং আমাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না। (৩৪:৩৪-৩৫)।

সুরা আন’আমের ৫২ নম্বর আয়াতে নবিকে যেভাবে সম্বোধন করার হয়েছে তাতে একজন চিন্তাশীল পাঠক চমকিত না হয়ে পারেন না : যারা তাদের প্রতিপালককে সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ডাকে তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয়, আর তোমার কোনো কর্মের জবাবদিহির দায়িত্বও তাদের নয় যে তুমি তাদের তাড়িয়ে দেবে, তাড়িয়ে দিলে তুমি সীমালঙ্ঘনকারীদের শামিল হবে।’ (৬:৫২)। এই আয়াতে পরোক্ষভাবে তিরষ্কারমূলক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে যা মুহাম্মদের মানবিক চরিত্র ও আচরণের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রমাণ। পৌত্তলিকরা বলে আসছিল যে তাঁরা মুহাম্মদের দলে যোগ দিবেন না। কারণ তাঁর অনুসারীদের কোনো গুরুত্ব নেই। এ-কারণে সম্ভবত তিনি সমাজের প্রভাবশালী ও ধনীদের দলে টানতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং নিজের হতদরিদ্র অনুসারীদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। এই অনুমানটি সুরা কাহাফের ২৭-২৮ আয়াতদ্বয় দ্বারা সমর্থিত হয়েছে : “তুমি তোমার কাছে তোমার প্রতিপালক যে-কিতাব পাঠিয়েছেন তার থেকে আবৃত্তি করো। তাঁর বাণী পরিবর্তন করার কেউ নেই। তুমি কখনোই তাঁকে ছাড়া অন্য কোনো আশ্রয় পাবে না। তুমি তাদের সঙ্গে থাকবে যারা সকালসন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায়, আর তাদের ওপর থেকে মুখ চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে। আর যার হৃদয়কে আমি অমনোযোগী করেছি আমাকে সরণ করার ব্যাপারে, যে তার খেয়ালখুশির অনুসরণ করে আর যার কাজকর্ম সীমা ছাড়িয়ে যায় তাকে তুমি অনুসরণ করো না। (১৮:২৭-২৮)।

তফসির আল-জালালাইনের মতে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল সেই মুহুর্তে যখন ওয়ানা বিন হোসেন নামের একজন উপজাতীয় নেতা এবং তাঁর অনুসারীরা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল -যতক্ষণ পর্যন্ত না মুহাম্মদ তাঁর সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র অনুসারীদের ত্যাগ করছেন। নবির ভ্রান্তি এবং সর্বোপরি একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো তাঁর আচরণের পরিচয় পাওয়া যায় সুরা বনি-ইসরাইলের ৭৩-৭৫ নম্বর আয়াতত্ৰয়ে। যদিও আয়াতগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছিল, তথাপি এগুলোর প্রত্যেকটির অর্থ একই: ‘আমি তোমার কাছে যে-প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি তার থেকে তোমার বিচ্যুতি ঘটানোর জন্য ওরা চেষ্টা করবে যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে কিছু মিথ্যা কথা বানাও, তা হলে, ওরা অবশ্যই বন্ধু হিসেবে তোমাকে গ্রহণ করবে। আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখলে তুমি ওদের দিকে প্রায় কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তুমি ঝুঁকে পড়লে অবশ্যই আমি তোমাকে ইহজীবন ও পরবীজনে দ্বিগুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতাম, তখন আমার বিপক্ষে তোমাকে কেউ সাহায্য করত না।’ (১৭:৭৩-৭৫)। কিছু তফসিরকারকের মতে এই আয়াতগুলো নাজিল হয়েছিল যখন মুহাম্মদ কয়েকজন কুরাইশ নেতার সাথে (প্রথম অধ্যায়ের নবুওতি অর্জনের পর অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) আলোচনা করেছিলেন। সে সময় তিনি সুরা নজম উচ্চারণ করেছিলেন এবং স্বীয় বক্তব্যের জন্য পরবর্তীতে নিজে অনুশোচনা করেছিলেন : ‘এরাই হচ্ছে সেই উড়ন্ত সারস। তাই এদের মধ্যস্থতা আশা করা যেতে পারে। (স্যাটানিক ভার্সেস বা শয়তানের আয়াত নামে পরবর্তীতে প্রচারিত)।

আবু হুরায়রা(৪২) এবং কাতাদার(৪২) বক্তব্য অনুযায়ী এই তিনটি আয়াত মুহাম্মদ ও কুরাইশ নেতাদের মধ্যে আলোচনার পর নাজিল হয়েছিল যেখানে কুরাইশ নেতারা মুহামদকে তাঁদের উপাস্য দেবতাদের সমান করতে কিংবা অন্তত অসমান না করার দাবি জানিয়েছিলেন। বিনিময়ে তাঁরা মুহাম্মদকে শান্তিতে বসবাসের আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং তাঁর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনেও আগ্রহ জ্ঞাপন করেছিলেন। এছাড়া তাঁরা গরীব, গৃহহীন মুসলমানদেরকে নির্যাতন, প্রহার ও রৌদ্রতপ্ত পাথর নিক্ষেপ বন্ধেরও আশ্বাস দিয়েছিলেন। নবি স্বাভাবিকভাবে প্রথমে এই প্রস্তাবের প্রতি নমনীয়ভাব প্রদর্শন করেছিলেন। যদিও তা প্রয়োগের সময়ে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, পৌত্তলিকতা এবং মূর্তিপূজা বিলোপের কুরাইশদের প্রস্তাবিত মীমাংসায় পৌছালে তাঁর এতোদিনের ধর্মপ্রচারের ফলাফল বিলোপ হয়ে যাবে। হয়তো তাঁকে ওমরের মতো নিষ্ঠাপ্রাণ, মাথা নত না করা অসীম সাহসী আলি এবং হামজার মতো বিশ্বাসী যোদ্ধারা বুঝিয়েছেন, যেকোনো প্রকার আপোস গুরুতর ভুল কিংবা পরাজয়ে রূপ নেবে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই হোক, এই তিনটি আয়াত প্রমাণ করে নবি মুহাম্মদের চরিত্রে আবেগময়তা এবং প্রলুব্ধ হবার মতো মানবীয় গুণাবলী বিদ্যমান ছিল।

কোরানের অন্য আয়াত থেকেও এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। সুরা ইউনুসের ৯৪-৯৫ আয়াতদ্বয়ে বলা হয়েছে : ‘আমি তোমার কাছে যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি সন্দেহ হয় তবে তোমার আগের কিতাব যারা পড়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো। তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার কাছে সত্য এসেছে। তুমি কখনও সন্দিহানদের শামিল হয়ো না। আর যারা আল্লাহর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না; হলে, তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবে।(১০:৯৪-৯৫)। একইভাবে সুরা মায়িদাতে বলা হয়েছে : হে রসুল! তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করো, যদি না কর তবে তো তুমি তাঁর বার্তা প্রচার করলে না। আল্লাহ তোমাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (৫৬৭)। একজন বিশ্বাসী মুসলমান, যিনি কোরানকে আল্লাহর বাণী হিসেবেই গ্রহণ করেছেন, তিনি এই আয়াতগুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? নবিকে এভাবে ভৎসনা করার মানে কি?

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এর একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে মানবিক দুর্বলতা এবং নৈতিক ক্রটি নবির শুভসত্তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল। তিনি মানুষকে ভয় করতে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহ তাঁকে অভয় দিলেন -যেকোনো প্রকার নিষ্পেষণ থেকে তিনি তাকে রক্ষা করবেন। কুরাইশ নেতা ওয়ালিদ বিন আল-মুগিরা, আলাস বিন ওয়ায়েল, আদি বিন কায়েস, আসওয়াদ বিন আব্দুল মোতালেব এবং আসওয়াদ বিন আবদে ইয়াগুস প্রমুখ মুহাম্মদের চরিত্র ও ধর্মপ্রচারকে ব্যঙ্গ করে গভীর কষ্ট দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি বিরক্ত হয়ে ধর্মপ্রচার নিয়ে অনুতপ্ত হতে শুরু করেছিলেন কিংবা হয়তো মানুষকে তাদের মতো চলতে দিয়ে নিজের ধর্মপ্রচারকার্য পরিত্যাগ করার চিন্তাভাবনাও শুরু করেছিলেন। তা না-হলে সুরা হিজরের ৯৪-৯৫ নম্বর আয়াতদ্বয় তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হতো না ; অতএব তোমাকে যে বিষয়ে আদেশ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে প্রচার করো আর অংশীবাদীদেরকে উপেক্ষা করো। যারা বিদ্রুপ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট।’ ( ১৫:৯৪-৯৫)। এই সুরার পরবর্তী তিন আয়াতও প্রস্তাবিত ব্যাখ্যা সমর্থন করে ; আমি তো জানি ওরা যা বলে তাতে তোমার মন ছোট হয়ে যায়। তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা করে তাঁর মহিমাকীর্তন করো আর সিজদাকারীদের শামিল হও। তোমার কাছে নিশ্চিত বিশ্বাস (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের উপাসনা করো। (১৫৯৭-৯৯)। কোরানের কয়েকজন তফসিরকারক সুরা হিজরের ৯৯ নম্বর আয়াতে ব্যবহৃত ইয়াকিন শব্দটি মৃত্যুর অনিবার্যতাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধরে নিয়েছেন। মুহাম্মদকে নৈতিক ক্রটির উর্ধ্বে বিবেচনা করার কারণে তাঁরা নবির দুর্বলতাকে স্বীকার করতে কুষ্ঠাবোধ করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে কোরানের ভাষ্যের বিপরীত ব্যাখ্যা প্রণয়ন করেছেন। সুরা হিজরের তিনটি আয়াতের অর্থ সুস্পষ্ট। মুহাম্মদ ব্যাপকভাবে নিরাশায় ভুগছিলেন। যে-কারণে তাঁর মাঝে দ্বিধাবোধ তৈরি হয়েছিল। এমন কী নিজের যোগ্যতা নিয়েও তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল। যদিও আল্লাহকে প্রার্থনা ও প্রশংসার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত তাঁর মনে নিশ্চয়তা ফিরে এসেছিল, তিনি তাঁর গন্তব্যে পৌছাতে পারবেন। সুরা আহজাবের প্রথম আয়াতে মুহামদকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে : হে নবি! তুমি আল্লাহকে ভয় করো। এবং তুমি অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, তত্ত্বজ্ঞানী। (৩৩:১)। তফসির আল-জালালাইন গ্রন্থে এই আয়াতের প্রথম ক্রিয়াপদকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভয় করতে থাক’হিসেবে। আরেকটি তফসির অনুযায়ী যদিও উভয় আদেশই মুহাম্মদের উদ্দেশ্যে নাজিল হয়েছে, তারপরও তা মূলত সমগ্র মুসলিম জাতির জন্যই অবতীর্ণ হয়েছিল। এই তফসিরকারকদের মোহগ্ৰস্ততা তাদের সত্যতা থেকে অনেক বেশি। কারণ এই সুরার পরের আয়াতেই আল্লাহ মুহামদকে বলেছেন ; তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তুমি তার অনুসরণ করো।’(৩৩:২)।

উপরোক্ত আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে নবি স্বাভাবিক ও মানবিকভাবে তাঁর হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন এবং প্রতিপক্ষের দাবি মেনে নিবেন কিনা ভেবে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে এ-কাজে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলা যায়: বিরোধী পক্ষের তীব্র আপত্তি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মুখে নবি যখন নিঃশেষিত হতোদ্যম হয়ে গিয়েছিলেন, তখন নিজেকে পুনরায় আল্লাহর প্রতি সমর্পণের মাধ্যমে ও নিজের অভ্যন্তরীণ ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পুনরায় নিজ কক্ষপথে ফিরে আসেন।

এই ব্যাখ্যাকে যদি অস্বীকার করাও হয় তাহলে অবশিষ্ট একমাত্র ব্যাখ্যা থাকতে পারে তা হলো, নবি মক্কার প্রতিকূল পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য প্রতিপক্ষের দাবির সাথে আপোষ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এ কাজে নিষেধ করেন। মুহাম্মদের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কথা বিবেচনায় নিলে এই ধারণা বিতর্কযুক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা যদি নবির সত্যনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এবং নৈতিক শক্তির কথা বিবেচনা করি তাহলে তা আদৌ সম্ভব নয়। মুহাম্মদ যা বলতেন তিনি তা বিশ্বাস করেই বলতেন এবং তিনি নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত দূত বলেই বিশ্বাস করতেন।

এই অধ্যায়ের শেষে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় ক্যামব্রিজ তফসির(৪৩) (কোরানের একটি প্রাচীন ফার্সি ভাষ্য) থেকে একটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে। এখান থেকে কোরান নাজিল হওয়ার ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে ইসলামের প্রথম কয়েকশ বছরে মুসলমানদের চিন্তাভাবনার একটি বিশদ চিত্র পাওয়া যাবে। এই গল্পটি ওই তফসিরের (পৃষ্ঠা ২৯৫, ভলিউম ২, তেহরান সংস্করণ) রয়েছে এভাবে ; সুরা নজম শুরু হয়েছে, শপথ অস্তমিত নক্ষত্রের শব্দগুলো দ্বারা। সুরা নজম পাঠ করার পর চাচা আবু লাহাবের ছেলে ওতাইবা নবিকে বললেন, তিনি কোরানে বর্ণিত নক্ষত্রে বিশ্বাস করেন না। নবি বিরক্ত বোধ করে তাকে অভিশাপ দিলেন। আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে বললেন: “হে আল্লাহ! তোমার শিকারী কোনো পশু দ্বারা যেন সে পরাজিত হয়। ওতাইবা এ-কথা শোনার পর ভয় পেয়ে গেলেন। কিছুদিন পর ওতাইবা একটি মরুযাত্রীদলের সাথে ভ্রমণ করছিলেন। ওই দলটি হারানে পৌছে যাত্রাবিরতি করে। ওতাইবা নিজের বন্ধুদের মাঝে শুয়ে পড়েন। আল্লাহ একটি সিংহ পাঠালেন, ওতাইবাকে তাঁর বন্ধুদের মধ্য থেকে তুলে নিয়ে গেল এবং তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিলেও অভিশপ্ত দেহাবশেষ ভক্ষণ করল না। ফলে সকল মানুষ জেনে গেল সিংহটি তাঁকে আহারের জন্য ধরে নিয়ে যায়নি, বরং নবির প্রার্থনা পূর্ণ করতে গিয়েছে। এই গল্পের রচয়িতাদের মনে এই কথা একবারো আসেনি, ওতাইবাকে অভিশাপ দেবার পরিবর্তে নবি বরং তাঁকে ক্ষমা করে দেবার জন্য এবং তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারতেন। এতে বরং ইসলামের মহানুভবতা অনেক বেশি প্রচারিত হতো। ইসলাম কী পরম করুণাময়, দয়াময়, জগতের কর্তার প্রতি বিশ্বাস নয়?

হিজরতের পর মদিনাতে ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না। একটি নতুন আইনি কাঠামো এবং আরব রাষ্ট্রের ভিত্তিতে পরিণত হয়। নবুওতির শেষ দশ বছরে মুহাম্মদ যখন মদিনায় অবস্থান করছিলেন তখন ইসলামের সকল আদেশ এবং বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল প্রার্থনা বা কিবলার দিক জেরুজালেম থেকে মক্কার দিকে পরিবর্তন করা। এই ঘটনার ফল দাঁড়াল মুসলমানদের চেয়ে ইহুদিদের থেকে আলাদাভাবে কর আদায় করা হতে লাগল। আরেকটি ঘটনা ঘটল মদিনার আরবরা তাদের দীর্ঘদিনের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় এবং আরব বেদুইনদের মধ্যে জাতীয়তাবোধেরও উন্মেষ ঘটে। কাবা ঘরকে যেসব গোত্র তাঁদের উপাস্য-দেবতার মন্দির হিসেবে ব্যবহার করত তা সকল আরবদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসমাইলের গৃহ হিসেবে পরিগণিত হয়। একইভাবে উপবাসের ক্ষেত্রেও ইহুদিদের অনুকরণ করা বর্জিত হল। ইহুদিরা মহরম মাসের দশম দিন উপবাস পালন করত, যা আরও কয়েকদিন বর্ধিত করা হলো। পরবর্তীতে পুরো রমজান মাসকেই উপবাসের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলো।

তবে বিবাহ, বিচ্ছেদ, রজঃস্রাব, উত্তরাধিকার, বহুগামিতা, অবৈধ যৌনসংগম, পরকীয়া ও চুরির ক্ষেত্রে জরিমানা, প্রতিশোধ, রক্তের দামও অন্যান্য অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে এবং নাগরিক বিষয়াদি যেমন অপরিচ্ছন্নতা, খাদ্যাভাসে নিষেধাজ্ঞা, খৎনার ক্ষেত্রে প্রধানত ইহুদি আইনগুলো ও বৃহত্তর আরব-ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে তা মদিনায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নাগরিক ও অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়ক ইহুদি ও পৌত্তলিক আরবীয় চিন্তাধারা, রীতিনীতি প্রভাবিত আইনসমূহ সামাজিকঅর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে বিনা-প্রশ্নে ব্যবহার করা হয়েছে।

————————–

পাদটীকা

২৬. ইরানের অনেক স্থানে ইমামজাদাদের মাজার পাওয়া যায়। ভক্তরা এখানে এসে মৌখিকভাবে অথবা কাগজে বা দাখিল নামক এক টুকরা কাপড়ে লিখে সাহায্যের আকুতি জানায়। কবরগুলোর অনেকগুলোর উপর গম্বুজ বানিয়ে রাখা হয়েছে যার কতগুলো আবার অনেক পুরনো। এদের মধ্যে কতগুলো কবর হল স্থানীয় সাধকদের। এদের বেশিভাগেরই জীবনী সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তারপরও এদেরকে ইমামদের বংশধর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে।

২৭. আলি দস্তি এই অনুবাদটিকে গ্রহণ করেছেন। আরেকটি অনুবাদে পাওয়া যায় and a guide to every nation ব্যাকরণগতভাবে উভয়ই সঠিক।

২৮. জালালউদ্দিন আল-সুয়তি মিশরীয় বংশোদ্ভূত কোরানের তফসিরকারক। কোরানের তফসির আল-জালালাইনের সহলেখক।

২৯. ইব্রাহিম আন-নাজ্জাম নেতৃস্থানীয় মুতাজিলা দার্শনিক। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের স্বাধীন চিন্তার ফলেই কোরান রচিত হয়েছে। যদিও তাঁর বেশ কিছু লেখা ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে কালের পরিক্রমায়, তবে তাঁর কিছু উদ্ধৃতি অন্যান্য মুতাজিলা দার্শনিকদের (যেমন আল-জাহেজ) লেখায় পাওয়া যায়।

৩০. নবম শতাব্দীর দিককার আবু আল-হাসান আহমেদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে ইশহাক আল-রাওয়ানদি সংশয়বাদী মুতাজিলা দার্শনিক হিসেবে প্রখ্যাত। তাঁর অনেক লেখনী সমসাময়িক গোঁড়া মুসলমান ধর্মতাত্ত্বিক দ্বারা ধর্মদ্রোহী হিসেবে সমালোচিত

হয়েছে।

৩১. আবু মুহাম্মদ আলি বিন আহমেদ বিন হাজম (জন্ম হিজরি ৩৮৪ বা ৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৪৫৬ বা ১০৬৪ খ্রিস্টাব্দ) প্রভাবশালী মুরীয় ধর্মতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ। ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে তাঁর বই আল-মেলাল ওয়াননিহাল মুসলিম দর্শন ও ধর্মের ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত।

৩২. আবুল হোসেন আব্দুর রহিম বিন মুহাম্মদ আল-খাইয়াত (৮৩৫-৯১৩ খ্রিস্টাব্দ) বাগদাদ নিবাসী খ্যাতিমান মুতাজিলা দার্শনিক। তাঁর অনেক লেখা হারিয়ে গেলেও অবশিষ্ট এখনো কিছু বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়।

৩৩. আলি দস্তি তাঁর বইয়ের মূল ফার্সি সংস্করণে ফেরেশতা শব্দ ব্যবহার করলেও সাধারণভাবে জিব্রাইল ফেরেশতার কথা প্রচলিত আছে।

৩৪. শামসুদ্দিন মুহাম্মদ হাফিজ (১৩২৫-১৩৯০ খ্রিস্টাব্দ) পারস্যের খ্যাতিমান কবি।

৩৫. জালালউদ্দিন রুমি পারস্যের সুফিবাদি মৌলভি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি একই সাথে প্রখ্যাত কবি। এশিয়া মাইনর অঞ্চলের কনিয়া অঞ্চলে তিনি বাস করতেন। কাব্যচর্চা ছাড়াও আলকেমির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল।

৩৬. ইজহাক গোল্ডজিহার (খ্রিস্টাব্দ ১৯২১-১৮৫০)বুদাপেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক। ইসলামের ইতিহাস,

মুহাম্মদের জীবনী নিয়ে তাঁর অনেকগুলো ?ITTST2S TTTTTI (FTTF Muhammadanische Studien, 2 vols, Halle 188990, 1E. by C. R. Barber and S. M. Stern, Muslim Studies, 2 vols, London 1967-71; Vorlesungen aber den Islam, Heidelberg 1910, 2nd ed. 1923,1 €. by Felix Arin, Le dogme et la loi de l’Islam, Paris 1920, 2nd ed. 1958, and by A. and R. Hamori, Introduction to Islamic theolegy and law, Princeton 1981; and Die Richtungen der Islamischen Koranauslegung, Leiden 1920.

৩৭. আবুল আব্বাস আহমেদ বিন মুহাম্মদ আল-কাসতালিনি মিশরের কায়রো নিবাসী লেখক। তিনি মুহাম্মদের জীবনী ও হাদিসের ভাষ্য নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

৩৮. দ্রষ্টব্য : পাদটীকা ১৫। আলফ্রেড গিয়োমের অনুবাদের ৬৭৭-৬৭৮ পৃষ্ঠায় সংযোজিত।

৩৯. হিজরতের কিছু পরে নবি মুহাম্মদ আনাস বিন মালেককে দাস হিসেবে গ্রহণ করেন। নবির মৃত্যু পর্যন্ত সাথেই ছিলেন। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছেন। ৯১ বছর বয়সে তিনি বসরাতে মৃত্যুবরণ করেন।

৪০. আব্দুল ওয়াহাব আস-শাহরানি মিশরের একজন প্রসিদ্ধ ধর্মীয় নেতা এবং লেখক।

৪১. আবু হুরায়রা (মৃত্যু হিজরি ৫৮ বা ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ) ইয়েমেন থেকে মদিনায় এসে বসবাস করেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় চার বছর আগে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হাদিস ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত।

৪২, কাতাদা ইরাকের বসরাতে বসবাসকারী একজন অন্ধ বেদুইন। হাদিস-ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত।

৪৩. কোরানের দুর্লভ ফার্সি ভাষার একটি তফসির প্রকাশ করেছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। এক হাজার খ্রিস্টাব্দের দিকে রচিত ফার্সি তফসিরটির মূল লেখক কে জানা যায় না। ধারণা করা হয় ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের দিকে এর প্রতিলিপিকরণ করা হয়েছে। ক্যামব্রিজ তফসির- এ কোরানের ১৯ নম্বর সুরা মরিয়ম থেকে ১১৪ নম্বর সুরা নাস-এর তফসির পাওয়া গেলেও আগের

সুরাগুলোর তফসির পাওয়া যায় নাই। ফার্সি ভাষায় এই তফসিরকে সবচেয়ে প্রাচীন দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০ সালের দিকে পুনরায় তেহরান থেকে দুই খণ্ডে তফসিরটি প্রকাশিত হয়েছে।

দেশান্তর

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । দেশান্তর

ইতিহাস চলমান। তবে এর পাতায় পাতায় আমরা এমন অনেক তারিখ খুঁজে পাই যা বিরাট কোনো পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে আমাদের মনে গেথে থাকে। এমনই একটি দিন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর বা ১২ রবিউল আউয়াল। এই দিন নবি মুহামদ ইয়াসরিব শহরে পদার্পণ করেন। স্রেফ ধর্মীয় কারণে মুসলমানরা নবির এই দেশান্তরকে (হিজরত) একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখে থাকেন। প্রাচীন আরবীয়রা নির্দিষ্ট কোনো যুগের অন্তর্গত ছিল না। খুব সম্ভবত ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আব্রাহার নেতৃত্বে আবিসিনীয় বাহিনী মক্কা আক্রমণ করে পৌত্তলিকতার তীর্থভূমি কাবাঘর ধ্বংস করে ফেলতে চান। এটি হাতির বছর নামেও পরিচিত”। কারণ আবিসিনীয় বাহিনী এই যুদ্ধে শতাধিক হাতি ব্যবহার করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আবিসিনীয় বাহিনী মক্কাবাসীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়। অনেকে সেদিন হতে নতুন দিনপঞ্জি গণনা করতে শুরু করেন। হিজরতের সময় হতে মুসলমানদের নতুন যুগের সূচনার দাবির পিছনে আরেকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। হিজরতের পর থেকে নবির প্রতি আনুগত্যের কারণে মুসলমানদের সাহস অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁরা ক্ষমতা পেয়েছেন এই হিজরতের পর। মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের সদস্যরাও এ-সময় নবিকে নিরাপত্তাদানের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। তাদের পরিচিতি হয় ‘আনসার’ হিসেবে।

তবে ইসলামের নতুন যুগের গণনা শুরু রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ থেকে শুরু হয়নি। একই বছরের প্রথম মাস মহরমের প্রথম তারিখ (১৬ জুলাই, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে গণনা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে তৎকালীন আরবদের মনে এমন কোনো চিন্তা আসেনি যে, ওই বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখটিই পরবর্তীতে তাদের জীবনধারায় এক বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়ে দাঁড়াবে। সমসাময়িক বিশ্বেরও কেউ ভাবতে পারেনি যে একদল মরুবাসী, যারা সভ্যতার ইতিহাসে কখনো কোনো অবদান রাখেনি, যারা উন্নততর গোষ্ঠী রোমান রাজা সিজার ও ইরানি বাদশাহ খসরু-১’র অনুগত হয়ে নিজেদের গর্বিত মনে করত, তারা দ্রুতই প্রাচীন সভ্যতার এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ডের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে। (পারস্যের জরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী এই রাজার নাম খসরু১ আনুশিরুওয়ান’, যার অর্থ ‘অমর আত্মা খসরু। তিনি ৫৩১ থেকে ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাসানিদ রাজবংশের শাসক ছিলেন। তার জন্ম ৫০১ খ্রিস্টাব্দে। পারস্যের ইতিহাসে শিল্পকলার একজন মহান সংস্কারক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত হন।)

এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়া আরবদের নিকট নতুন কিছু ছিল না। একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে, ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে ইয়েমেনের প্রাচীন মারিব(৪৫) বাঁধ ভাঙার পর দক্ষিণ আরবীয় গোষ্ঠীগুলোর উত্তর সীমান্তের দিকে অভিবাসিত হওয়া। সে তুলনায় মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের এবং কুরাইশ পৌত্তলিকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে কিছু অভিবাসীর মক্কা থেকে ইয়াসরিবে স্থানান্তরকে ইতিহাসের আলোকে অগুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। তবে অগুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই এক দশকের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। দশ বছরের মাথায় যে সকল ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন, তারাই মক্কার শাসক হয়ে ওঠেন এবং তাদের প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। প্রতিপক্ষের উপাস্য সকল মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। কুরাইশদের পরিচালিত কাবার চিরাচরিত নিয়মকানুন সব বাদ দেয়া হয়। আবু লাহাব ও আবু জেহেলের উত্তরসূরি আবু সুফিয়ান প্রাণভয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এছাড়া অন্যান্য সকলে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। ছোট ছোট ঘটনার সমন্বয়ে একটি বড় ঘটনার সৃষ্টি হওয়া ইতিহাসে বিরল নয়। উদাহরণ হিসেবে আছে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এবং ইরানে মঙ্গলীয় আগ্রাসন।

মুহাম্মদকে ধর্ম প্রচারকালের শুরু থেকে কুরাইশ প্রধানদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। সম্ভবত তিনি প্রথমে আশা করেননি যে, তার প্রচারিত ধর্ম প্রাথমিকভাবে যৌক্তিক ও অন্যান্য দুই সেমিটিক ধর্মের সাথে সদৃশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এমন বিরোধের সমূখীন হতে হবে। তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে এটা ভেবে দেখেননি যে, তার দীক্ষা গ্রহণের কারণে কুরাইশদের প্রাধান্য ক্ষমতা, অর্থ, বিত্তকে খাটো করে দেবে। তাদের শত্রুভাবাপন্নতা যখন বেড়ে যায় তখন নবি তা প্রতিরোধ করার উপায় বের করার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হন। ইয়াসরিবে চলে যাওয়ার আগে তিনি এ ব্যাপারে আগেই দুটি পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল আবিসিনিয়ায় কিছু মুসলমানকে পর পর দুই দলে বিভক্ত করে পাঠানো। গরিব, অসহায় ও কুরাইশ কর্তৃক নির্যাতিত মুসলমানরা নবির কাছ থেকে আবিসিনিয়ায় যাওয়ার পরামর্শ পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় দলের সদস্যের (যাদের মধ্যে নবির চাচাত ভাই এবং হজরত আলির আপন বড়ভাই জাফর বিন আবু তালেবও ছিলেন) পরিচয় লাভের মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায়। নিগাসের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশাও মুহাম্মদের মনে এসেছিল। আবিসিনিয়ার একজন খ্রিস্টান শাসক হিসেবে নিগাস স্বাভাবিকভাবে পৌত্তলিকতার বিরোধী হবেন। যখন তিনি জানতে পারবেন মক্কায় একদল একেশ্বরবাদী জোট হয়ে পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের চেষ্টা করছেন এবং তাঁরা সেখানে নিগৃহীত হচ্ছে, তখন তিনি তাদের সহায়তা করার জন্য একটি বাহিনী হয়তো পাঠিয়ে দিতে পারেন। নিগ্রহের শিকার না হওয়া ও তুলনামূলক সন্ত্রান্ত পরিবার থেকে আসা জাফর বিন আবু তালিবের অংশগ্রহণের কারণ এ থেকে বোঝা যায়। একই সময়ে কুরাইশরা আমর ইবনে আল-আস ও আব্দুল্লাহ বিন আবু রাবিয়াকে আবিসিনিয়ার বাদশাহ নিগাসের কাছে কিছু উপহারসহ পাঠিয়ে দেন। তাদের আশা ছিল এতে করে মুসলমানদের প্রস্তাবিত কোনো বিষয়ে নিগাস যেন রাজি না হন এবং সম্ভব হলে তাদের ঐতিহ্য রক্ষার্থেও তিনি যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ছিল ৬২০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা। নিজের চাচা ও আশ্রয়দাতা আবু তালিব এবং বিবি খাদিজাকে হারানোর পর তাঁকে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্রভাবাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তিনি তায়েফ-নিবাসী বানু সাকিফ গোষ্ঠীর নিকট থেকে সাহায্য আশা করেছিলেন, যাদের সাথে তার মাতৃবংশীয় সম্পর্ক ছিল। তায়েফে অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে বানু সাকিফদের অবস্থান সমানের দিক থেকে অনেক উচুতে ছিল। তায়েফের জনগণ মক্কার অবস্থান ও বেদুইনদের মাঝে কুরাইশদের সমানকে ঈর্ষার চোখে দেখত। কুরাইশদের আধিপত্য এড়ানোর জন্য তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নিজেদের শহরকে আরবীয়দের মিলনমেলায় পরিণত করতে চাইত। এটা কোনো কলপনা নয় বরং প্রমাণিত সত্য। কারণ নবিকে সাকিফ-প্রধানদের সাথে একটি সাক্ষাতের কথা স্মরণ করতে দেখা গেছে। সাকিফ-প্রধানরা বলেছিলেন, তায়েফকে নতুন ধর্মের কেন্দ্র ও পবিত্র ভূমি ঘোষণা করা হয় তবে তায়েফের জনগণ অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করবে। এর আগে তায়েফের আরেকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বানু আমেরও নবির কাছে এরকম একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। তাঁরা অনুরোধ করেছিল তাদের সাহায্যে যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে তবে কুরাইশদের স্থলে তাদেরকেই যেন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী বানিয়ে দেয়া হয়। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে নবির তায়েফ যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের রাস্তা পরিষ্কার করা। তাঁকে সাহায্য করার ইচ্ছা যদি বানু সাকিফদের মধ্যে থাকত তবে কুরাইশদের পরাস্ত করা সম্ভব ছিল। এ-কারণে তিনি গোপনে তার মুক্ত ক্রীতদাস ও পালিত পুত্র জায়েদ বিন হারিসকে নিয়ে অন্য কোনো সঙ্গী ছাড়াই তায়েফ সফরে গিয়েছিলেন। তবে তার আশা অবশ্য ভঙ্গ হয়েছিল, কারণ বানু সাকিফ-প্রধানরা তাঁকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

আরব বেদুইনদের মাঝে আধ্যাত্মিক বিষয়ে কখনো তেমন আগ্রহ ছিল না। এমনকি আজও মুহাম্মদের চৌদ্দ শতক পরেও তারা ধর্মকে পার্থিব অর্জন হিসেবে দেখে। বানু সাকিফরা ভবিষ্যতের মুক্তির কথা ভেবে নিজেদের জীবিকার প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তায়েফ মূলত গ্রীষ্মকালে ব্যস্ত হয়ে উঠত। তায়েফের জনগণ মক্কার পর্যটকদের কাছ থেকে এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে আয়-উপার্জন করতেন। কুরাইশরা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং তাঁকে কোনোরূপ সাহায্য দিতে দেখলে আরও বেশি শত্রভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারে। কাজেই নবির অপ্রমাণিত প্রতিশ্রতির তুলনায় তায়েফের জনগণের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দিকে নজর দেয়াটাকে বানু সাকিফদের যৌক্তিক মন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। লাভ ক্ষতির এমন সমীকরণের সামনে থেকে তায়েফের-প্রধানরা মুহাম্মদকে সাহায্য করতে শুধু অস্বীকৃতিই জানাননি, তার প্রতি বিদ্বেষও সৃষ্টি করেছিল। তাঁরা নবিকে আঘাত করেছিল, অপমানিত করেছিল, এমনকি নবির শেষ অনুরোধটিও পর্যন্ত তাঁরা রাখেননি। যা ছিল তার এই অসফল সফর প্রসঙ্গে কুরাইশদেরকে কিছু না জানানো। কিন্তু কুরাইশরা ঠিকই বার্তা পেলেন। ফলে মক্কায় নবির বিরোধীরা আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠেন। শেষে পৌত্তলিকদের কিছু নেতা মুহাম্মদের নবুওতি ভাবনার (যা তাদের অবস্থান ও বিত্তের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছিল) সমাপ্তি টানার উপায় বের করার জন্য সমাবেশে মিলিত হন। যে তিনটি প্রস্তাব উঠে এসেছিল সেগুলো ছিল নবিকে নির্বাসিত করা, কারাবন্দী করা অথবা হত্যা করা। এক্ষেত্রে তাঁরা শেষ প্রস্তাবটিই বেছে নেন।

তায়েফের পাশাপাশি হেজাজের আরেকটি শহরও অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে মক্কার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছিল। সেটি ছিল ইয়াসরিব, যা মদিনা (স্থানীয় ইহুদিদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ “নগর)(৪৭) নামে পরিচিত। আরবের জনপ্রিয় মূর্তিগুলোর সুসজ্জিত উপাসনালয়গুলোর কারণে মক্কা শহরটি আরবদের কাছে, বিশেষ করে বেদুইন ও কুরাইশদের কাছে ধর্মীয় তীর্থভূমি বলে বিবেচিত হতো। কাবার রক্ষণাবেক্ষণ ও এর পরিদর্শকদের প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্বে নিয়োজিত যা মক্কায় একেবারে ছিল না। সেইসাথে বাণিজ্যিক উন্নয়ন ও তিনটি ইহুদি গোত্রের কারণে অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার হারের সন্তোষজনক অবস্থানের ফলে ইয়াসরিবের সাংস্কৃতিক-সামাজিক মান মক্কার তুলনায় উচ্চতর অবস্থায় ছিল। তারপরও হেজাজের শহরগুলোর মধ্যে ইয়াসরিবকে মক্কার পরে দ্বিতীয় স্থানে গণ্য করা হতো।

ইয়াসরিবের অধিবাসীদের মধ্যে কুরাইশদের সাথে শত্রভাবাপন্ন দুটি আরবীয় গোষ্ঠী বসবাস করত। এরা হচ্ছে আউস এবং খাজরাজ। দুই গোষ্ঠীরই আবার ইয়াসরিবের দুই-একটি ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আউস এবং খাজরাজ ছিল কাহতানি আরব, অর্থাৎ ইয়েমেন-বংশোদ্ভূত। আদনানি বা উত্তর আরবীয় বংশোদ্ভূত কুরাইশদের সাথে তাদের বিরোধ বহু প্রাচীন। কৃষি ও বাণিজ্যে অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে আউস এবং খাজরাজ গোত্র তাদের ইহুদি প্রতিবেশীদের মতো অগ্রসর ছিলেন না। তাদের অনেকে ইহুদিদের অধীনে কাজ করতেন। ফলে কিছু নির্দিষ্ট ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে মিত্রতা থাকলেও যেসব ইহুদিদেরকে তাঁরা প্রভু মানতেন, তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাকে সহজভাবে নেননি। মক্কায় নবি মুহাম্মদের উত্থান ও ইসলামের প্রচার এবং কুরাইশদের সাথে তার বিরোধের সংবাদ হেজাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ইয়াসরিবের অনেকেই এ-বিষয়ে অত্যন্ত উৎসুক ছিলেন। মক্কা থেকে আগত ইয়াসরিবের পর্যটকদের বর্ণনা শুনে কিছু সংখ্যক আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোক ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কথা ভাবতে থাকেন। নবি মুহামদ ও তার সঙ্গীদের যদি এখানে আনা যায় এবং কোনোভাবে যদি মুহাম্মদের সাথে জোট বাঁধা যায়, তবে হয়তো অনেক সমস্যারই সমাধান হতে পারে। যেহেতু মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরাও কুরাইশ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তাই এতে করে কুরাইশদের সংহতির দেয়ালও ভেঙে ফেলা যেতে পারে। মুহামদ ও তার সঙ্গীদের সাথে গড়ে তোলা জোটের সাহায্যে আউস এবং খাজরাজের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের জাতিগত বিদ্বেষও মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে। তাছাড়া মুহাম্মদ একটি নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছেন। এই ধর্ম যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তবে ইহুদিরা আর তাদের উপর অবস্থান করতে পারবে না। মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের সাথে সমঝোতার ফলে ইয়াসরিবের তিন ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে আউস ও খাজরাজের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারে।

৬২০ খ্রিস্টাব্দের হজ মৌসুমে ইয়াসরিবের ছয়জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে দেখা করেন এবং মুহাম্মদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পরের বছর একই সময়ে মক্কার বাইরে আল-আকাবায় বারো সদস্যের একটি দল নবির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা দেখলেন নবির শিক্ষার একটা সুদূরপ্রসার প্রভাব রয়েছে এবং নবির চাওয়াও খুব বেশি কিছু নয়। সবাইকে ব্যাভিচার,

সুদের ব্যবসা, মিথ্যাচার পরিহার করতে হবে এবং মানব নির্মিত মূর্তির পরিবর্তে এক আল্লাহ- তে বিশ্বাস করতে হবে। সেই বারো জন ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ইয়াসরিবে ফিরে আসেন ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের জানান যে, তাঁরা মুসলমান হয়ে গিয়েছেন এবং মুহাম্মদের সাথে তাদের চুক্তিও হয়েছে। তাদের কাজ ও প্রস্তাবনা ইয়াসরিবের অনেক স্থানে স্বীকৃতি লাভ করে। পরের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারীর একটি বড় প্রতিনিধিদল মুহাম্মদের সাথে একই স্থানে দেখা করতে যান এবং দ্বিতীয় চুক্তি সম্পন্ন করেন।

দেশান্তরের বিষয়টি মুহাম্মদের মনে হঠাৎ করে জেগে ওঠেনি। যে-সব মুসলমান আবিসিনিয়ায় গিয়েছিলেন তাদের সূত্রে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। সুরা জুমার’র এই আয়াতে রয়েছে বলো, হে বিশ্বাসী দাসগণ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো। যারা এ-পৃথিবীতে ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। (৩৯:১০)। আল-আকাবা চুক্তিতে অবশ্যই মুহাম্মদের আশার প্রতিফলন ঘটেছিল। তের বছর ধরে মক্কায় তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কিছু সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলমান তাদের আরব-চরিত্রের কারণে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় পূর্বের ধর্মে ফিরে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে যখন তাঁরা দেখলেন মুহাম্মদের আদর্শ খুব একটা বিস্তার লাভ করছে না এবং মুসলমান বলে তাদেরকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে। ধনী ও প্রভাবশালী পৌত্তলিকরা তাদের অনেককে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করেছিল। তায়েফের বানু সাকিফদের সাথে নবির যোগাযোগ শুধু ব্যর্থই হয়নি, এতে করে কুরাইশদের সাথে তার শক্রতা তীব্রতর হয়ে গিয়েছিল। যদিও নিজ গোষ্ঠী বানু হাশেমি তাঁকে রক্ষা করে আসছিল, তবে তাঁরা শুধু শারীরিকভাবে আহত হওয়া থেকে রক্ষা করতেন। তাঁরা কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নেবে এমনটা আশা করা সম্ভব ছিল না। আউস এবং খাজরাজদের সাথে স্থাপিত মিত্রতা অবশ্য এই আশা পূরণ করতে পারত। তাদের সমর্থন থাকলে কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল। মক্কায় ইসলাম দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি তবে ইয়াসরিবে সেটা সম্ভব ছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কুরাইশদের সাথে আউস এবং খাজরাজ গোষ্ঠীর ঈর্ষাকাতরতা। এছাড়া ইয়াসরিবের উন্নত বাণিজ্য ও কৃষিব্যবস্থার কারণে মুসলমানরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজও খুঁজে নিতে পারবেন।

আল-আকাবায় নবি এবং আউস ও খাজরাজদের মধ্যে আলাপকালে আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেব (তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি, তবে নিজের ভাতিজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন) হাজির হন। তিনি অন্যদেরকে তাদের অবস্থান ও ইচ্ছার ব্যাপারে স্পষ্ট হতে বলেন। ইয়াসরিবের প্রতিনিধিদের আব্বাস সরাসরি বলেন: তাঁরা এবং মুহাম্মদ কুরাইশদের হামলার শিকার হতে পারে; এবং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাঁরা মুহাম্মদকে ততটাই প্রতিরক্ষা দিবে যতটা তাঁরা নিজেদের স্ত্রীসন্তানদের দিয়ে থাকে এবং তাঁরা যেন মিথ্যা প্রতিশ্রতি দিয়ে মুহাম্মদকে বিভ্রান্ত না করেন। এ-সময় খাজরাজ গোত্রের প্রতিনিধির মধ্য থেকে আল-বারা বিন আল-মারুর উত্তেজনার বশে বলেন, তাঁরা সবাই নির্ভীক, লড়াকু যোদ্ধা এবং তাঁরা সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত আছেন। একজন বয়োজ্যষ্ঠ ও অভিজ্ঞ আউস প্রতিনিধি আবুল হাসিম বিন তায়েহান নবিকে বলেন: ইহুদিদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা আপনার ও আপনার সঙ্গীদের সাথে করা চুক্তির কারণে ভেঙে যেতে পারে।

হয়তো আপনার আদর্শ আরও এগিয়ে যাবে। তখন আপনি কি আমাদের ছেড়ে দিয়ে আপনার নিজ গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করে ফেলবেন? প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবু মুহাম্মদ আব্দুল মালিক বিন হিশাম (মৃত্যু হিজরি ২১২/২১৮ বা ৮২৮৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) , যিনি ইবনে হিশাম নামে বেশি পরিচিত, তার সম্পাদিত দ্যা লাইফ অব দ্যা প্রফেট গ্রন্থ অনুসারে নবি তখন হেসে উত্তর দিয়েছিলেন: রক্তের জন্য রক্ত, ধ্বংসের জন্য ধ্বংস। আমি আপনাদের সাথে থাকব, আপনারা আমার সাথে থাকবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করবে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব আর যারা আপনাদের সাথে শান্তি বজায় রাখবে আমিও তাদের সাথে শান্তি বজায় রাখব।;

এখানে ‘রক্ত’, ‘ধ্বংস’ শব্দগুলোর উল্লেখ বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লবী জ্যাঁ পল মারাতের উক্তি ‘আমি রক্ত চাই’- এর কথা মনে করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য আবুল হাসিম বিন তায়েহানের প্রশ্নের উত্তরে আরেকটি কথা নবি বলেছিলেন বলে জানা যায়, লাল ও কালোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সম্ভবত এর দ্বারা তিনি সকল বর্ণের সাথে যুদ্ধের কথা বুঝিয়েছিলেন; আরবীয় হোক আর অনারবীয় হোক। এ-বক্তব্য নবি মুহাম্মদের ভবিষ্যত চিন্তা ও গোপন অভীপ্সার কথা জানান দেয়। আবুল হাসিমকে দেয়া উত্তর নির্দেশ করে, এটা ছিল নবি হৃদয় থেকে বের হয়ে আসা আর্তনাদ, দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আউস ও খাজরাজদের সমর্থন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দিতে পারে। এতে করে নবি ইসলামের প্রসারে আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন, বিরোধী কুরাইশদের বিরোধিতার জবাব দিতে পারবেন এবং দীর্ঘদিনের নিজস্ব চিন্তাও প্রকাশ করতে পারবেন। মক্কায় গত তের বছর ধরে তার প্রচার খুবই ক্ষীণ প্রভাব ফেলেছে, সমগ্র আরবের সামনে এখন ইসলামকে আনা সম্ভব হবে।

মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন

আমাদের চারপাশে অনেক ঘটনাই আছে যা আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও পরবর্তীতে তা পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। নেপোলিয়ন বা হিটলারের কাহিনী এক্ষেত্রে উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে। নবি মুহাম্মদের ইয়াসরিবযাত্রাকে দেখলে হয়তো একটি সাধারণ অভিবাসন ছাড়া কিছুই মনে হয় না, কিন্তু আরবের নিয়তি ও বিশ্ব-ইতিহাসের এক বিশাল পরিবর্তনের শুরু আসলে এর মাধ্যমেই হয়েছিল। নবির অভিবাসন-পরবর্তী ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির কারণ, পরিপ্রেক্ষিত ও সামাজিক প্রেক্ষাপট উদ্ধারে নিয়োজিত গবেষকদের গবেষণার দুয়ারও খুলে দিয়েছিল।

এই সকল বিষয়ের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিল, অন্যতম এই ঐতিহাসিক চরিত্রের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন। যদিও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের বিষয়টি অনেকের কাছে সন্তোষজনক নাও মনে হতে পারে। তাই একে মুহাম্মদের অন্তঃপুরুষের প্রস্ফুটন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। হিজরত তাই ঐতিহাসিক এক পটপরিবর্তনের সূচনা হয়তো করেছিল, তবে সেটা নবি মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনকে অনুসরণ করে হয়েছিল, যা নিবিড়ভাবে তুলনামূলক মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

তখন পর্যন্ত নবি মুহাম্মদ ধর্মানুগত ছিলেন এবং তার সময়ের অনৈতিক কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতেন। তিনি ইহজগতের শেষসীমা এবং শেষ বিচারের দিনের চিত্রকে হাতের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। মক্কায় থাকাকালে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উপর তার ধারণাকে ভিত্তি করে তিনি সঙ্গীদের মহাবিশ্বের স্রষ্টার বশে আনতে, সহিংসতা, অবিচার ও গরিবদের প্রতি অনাচার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। আর মদিনায় (ইয়াসরিব) যাওয়ার পর তিনি দূরদর্শী রাজনীতিবিদ এবং সুদক্ষ এক যোদ্ধার রূপ ধারণ করেছেন। যিনি তরবারি দিয়ে লড়াই করে সকল প্রতিরোধ ভেঙে নিজস্ব ধর্মের বিস্তার ঘটিয়েছেন এবং একটি রাষ্ট্রের প্রধান হয়েছেন। সময়ের আবর্তে একজন ত্রাণকর্তা মসিহ ডেভিডে (নবি দাউদ) পরিণত হতে পারেন। একজন মানুষ যিনি বিশ বছরেরও অধিক সময় একজন স্ত্রীর সঙ্গেই জীবনযাপন করেছেন, তিনিই পরে অধিক নারীসঙ্গ লাভ করেছেন।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলসের মতে, মানুষ সর্বদাই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু এই পরিবর্তনের ধীর গতি এবং সহজে ঠাহর করতে না পারার কারণে আমরা একজন পঞ্চাশ বছর বয়স্ক মানুষের থেকে তেমনটাই আশা করি যেমনটা তিনি বিশের কোঠায় থাকতে করতেন। যেখানে ওই ব্যক্তি ধীরে লয়ে কিন্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছেন। বয়স বাড়লে তার শারীরিক সক্ষমতা যেমন হ্রাস পায় তেমনি তার মানসিকতা, সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে পরিপক্ক হয়ে ওঠে। একজন বিশ বছরের তরুণ আর একজন পঞ্চাশ বছরের ব্যক্তির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল প্রথমজনের থাকে প্রচণ্ড শারীরিক ও আবেগময় আকাঙ্ক্ষা আর দ্বিতীয়জনের থাকে অভিজ্ঞতা অর্জন ও চিন্তা করার মতো সময়। উপযুক্ত মনে হলেও এই ধারণটি সবসময় সত্যি হয় না এবং নবি মুহাম্মদের ক্ষেত্রেও তা ভুল ছিল। মদিনায় যাওয়ার পর যে বয়সে অধিকাংশ মানুষের শারীরিক ও মানসিক কর্মতৎপরতা কমতির দিকে থাকে, সেই ৫৩ বছর বয়সে এক নতুন মুহাম্মদকে দেখা যায়। মক্কায় তের বছর ধরে তিনি যেভাবে মানবতার বাণী প্রচার করে গেছেন, মদিনায় কাটানো জীবনের শেষ দশ বছরে তিনি আর তেমনটি ছিলেন না। আল্লাহর প্রতি অনুগত নবি এরপর তার নিজের গোষ্ঠীকে বশে আনতে ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর ওপর (যারা এতদিন তাঁকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে আসছিল) কর্তৃত্ব স্থাপনে শক্তিমান এক নবির রূপধারণ করেন। সুরা শোআরা-তে বলা হয়েছে : “তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে সতর্ক করে দাও।”(২৬:২১৪)। সুরা শুরা-তে বলা হয়েছে তুমি সতর্ক করতে পার নগরমাতার (মক্কার) অধিবাসীদেরকে ও তার আশেপাশে যারা বাস করে তাদেরকে… (৪২:৭)। মদিনায় তিনি সতর্ককারী রূপ ত্যাগ করেন, শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধের বর্ম পরিধান করেন, ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সমস্ত আরবকে এক পতাকা তলে নিয়ে আসার লক্ষ স্থির করেন।

যিশু এবং জেরেমিয়ার আধ্যাত্মিক ধর্মপ্রচারের কথা সারণ করিয়ে দেবার মতো এবং আত্মাকে জাগরিত করবার মতো মূৰ্ছনা ও কাব্য আমরা মক্কি সুরাগুলোর মধ্যে খুঁজে পাই। যার ছিটেফোঁটা দেখা গিয়েছে মদিনার সুরাগুলোর মধ্যে। কাব্যিক ও ছন্দময় সুরগুলো সেখানে আদেশমূলক নিয়ম-নির্দেশনার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মদিনায় সকল নিয়ম ও নির্দেশনা একজন সেনাপতির মাধ্যমে প্রদান করা হত যিনি বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ক্ষমা করতেন না। আদেশ অমান্য, নিয়ম ভাঙা বা অবহেলার জন্য গুরুতর শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার° নবির এই আকসিক পরিবর্তনকে অভ্যন্তরীণ তাড়না হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আর অ্যাডলফ হারন্যাক একে অতিমানবের মনোকষ্ট এবং তার অসাধারণ শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ-ধরনের তাড়না মহান ব্যক্তিদেরকে সকল দ্বিধাবোধ, অবসাদ এবং নৈরাশ্য প্রতিরোধে সক্ষম করে তোলে। বাধা যতোই মৃত্যুসম হোক না কেন তা প্রতিরোধে তাদেরকে ভয়শূন্য করে তোলে। অন্য কোনো কিছু দ্বারা তাদের এই সাধারণ মানুষের চেয়ে অধিক অর্জনের কৃতিত্বকে ব্যাখ্যা করা যায় না। হিজরতের পরবর্তী সময়কালে নবি মুহাম্মদের মধ্যে আমরা যে পরিবর্তনসমূহ লক্ষ করি তা শুধুমাত্র সে সময়কার ঘটনাবলীর মাধ্যমেই নয়, মক্কা ও মদিনায় অবতীর্ণ বিভিন্ন সুরার মাধ্যমেও তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মক্কি সুরা মুজ্জামিল-এ নবিকে নিষেধ করা হয়েছে এই বলে যে: “লোকে যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধরো, আর সৌজন্য সহকারে ওদেরকে এড়িয়ে চলো। বিলাসবস্তুর অধিকারী অবিশ্বাসীদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আমার কাছে শিকল, জ্বলন্ত আগুন…’ ( ৭৩:১০১২)।

তফসির আল-জালালাইনে বলা হয়েছে, অবিশ্বাসীদের প্রতি লড়াই এবং তাদেরকে হত্যা করার যে নির্দেশনা কোরানে দেয়া হয়েছে, তার পূর্বে অবিশ্বাসীদের সাথে শিষ্টাচার বজায় রেখে দূরত্ব মেপে চলার নির্দেশনা কোরানে নাজিল হয়েছে। এই বক্তব্যটি আরও বাস্তবসম্মতভাবে সত্য হবে, যদি বলা হয়ে থাকে নবি আউস ও খাজরাজ গোত্রের সহায়তা নিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করার পূর্বে সুরা মুজামিলের উক্ত আয়াতগুলি তৈরি হয়েছে। যখন নবি এবং তার সাহাবির কাছে তরবারি ভিন্ন আর কোনো কিছুই ভরসা করার মতো ছিল না, তখনই সুরা বাকারার (মাদানি সুরা) এই নির্দেশটি আসে: আর যেখানেতাদেরকে তোমরা পাবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করবে আর যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে, তোমরাও সেখান থেকে তাদেরকে বের করে দেবে। ফিৎনা হত্যার চেয়ে মারাত্মক। (২:১৯১)। অথচ মক্কি সুরা আনআম-এ আমরা দেখি উল্লেখ করা হয়েছে: ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকে, তাদেরকে তোমরা গাল দেবে না, তা হলে, তারা অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গাল দেবে। এভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের চোখে তাদের কার্যকলাপ শোভন করেছি। তারপর তাদের প্রতিপালকের কাছে তারা ফিরে যাবে। তখন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে জানিয়ে দেবেন।’ (৬:১০৮)।

বহুবচন অর্থে প্রেরিত এই উপদেশ বাণীটি নবি এবং তার স্পষ্টবাক সাহাবি ওমর ইবনে আল-খাত্তাব কিংবা হামজা বিন আব্দুল মোতালেব, কার প্রতি প্রেরিত হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। যা হোক, মুসলমানদের ক্ষমতা যখন বৃদ্ধি পেল কুরাইশদের উপাস্য দেবতাদেরকে অভিশাপ দেয়াটা আর আটকে থাকল না। অবিশ্বাসীদের প্রতি শান্তিপূর্ণ ও আন্তরিকভাবে যোগাযোগকে নিষেধ করা হলো। মদিনায় অবতীর্ণ সুরা মুহাম্মদ-এর বক্তব্য অনুযায়ী তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, তোমরাই প্রবল, আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি তোমাদের কর্মফল ক্ষুন্ন করবেন না। 🙁 ৪৭:৩৫)।

কোরানের একই সুরায় কখনো কখনো দুটি অসঙ্গতিপূর্ণ আয়াতের উপস্থিতি রয়েছে । সুরা বাকারা কালপঞ্জি অনুসারে নবির হিজরতের পর প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল, তবে এর দৈর্ঘ্য দেখে অনুমান করা যায় সম্পূর্ণ সুরাটি একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়নি। এক বা দুই বছরের বেশি সময় ধরে খণ্ডিত আকারে এটি অবতীর্ণ হয়েছে। সেই সময়ের প্রথমদিকে অবতীর্ণ হওয়ার উপাত্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। সৎপথ ভ্রান্তপথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং যে অসত্য দেবতাকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করবে সে এমন এক শক্ত হাতল ধরবে যা কখনও ভাঙবে না। (২:২৫৭)। অপরদিকে একই সুরার ১৯৩ নম্বর আয়াত, যা সম্ভবত মুসলমান সম্প্রদায় শক্তিশালী হবার পরে অথবা তাদের শক্তিশালী হবার সাথে সম্পর্কিত কোনো ঘটনার পরে অবতীর্ণ হয়েছিল, যেখানে শক্তি প্রয়োগের আদেশ দেয়া হয় এভাবে: তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিৎনা দূর হয় ও আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তারা যদি বিরত হয়, তবে জুলুমকারীদের ছাড়া কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। (২:১৯৩)। সুরা তওবা (সুরা আল-বারা নামেও পরিচিত) কালপঞ্জি অনুসারে কোরানের সর্বশেষ সুরা, এখানে শক্তিপ্রয়োগের আদেশকে অনস্বীকার্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে : (১) যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ- তে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে…। (৯:২৯) । (২) আত্মীয়স্বজন হলেও অংশীবাদীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবি ও বিশ্বাসীদের জন্য সংগত নয়। (৯:১১৩) । (৩) হে নবি! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো ও ওদের প্রতি কঠোর হও। ওদের বাসস্থান জাহান্নাম। আর কী সে মন্দ পরিণাম!’ (৯:৭৩)। (৪) হে বিশ্বাসিগণ! অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ করো। আর তারা তোমাদের কঠোরতা দেখুক… (৯:১২৩)।

মদিনায় অবতীর্ণ সুরা তাহরিম-এর ৯ নম্বর আয়াতে একই ভাষায় বলা হয়েছে: হে নবি! অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো ও তাদের প্রতি কঠোর হও। ওদের আশ্রয়স্থান জাহান্নাম। (৬৬.৯)। প্রাথমিকভাবে কোথাও কোথাও শক্তিপ্রয়োগ কিংবা রূঢ় আচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়নি। যেমন মদিনায় অবতীর্ণ সুরা হজ-এ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমোদন দেয়া হলেও এতে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদটি আদেশসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। ( ২২:৩৯) একই সুরার পরবর্তী আয়াতে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় আচরণকে সুনির্দিষ্টভাবে দেখানো হয়েছে: তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করা হয়েছে শুধু এজন্য যে তারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। ( ২২:৪০)। পারস্যের ইসলামি পণ্ডিত আল-জামাখশারির মতে পৌত্তলিক বা ইসলামে অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধ করার প্রথম অনুমোদনটি আসে ৭০টিরও বেশি কোরানের আয়াতের পরে এবং ওই আয়াতগুলোতে সহিংসতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছিল। যুদ্ধ অনুমোদনের যথার্থতা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে নবি মুহাম্মদ মানব চরিত্রকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছেন। মক্কা থেকে বিতাড়িত হবার স্মৃতিচারণে মুসলমানদের হয়তো কুরাইশদের ওপর প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা তাড়িত করত। কোরানেও এই অকাট্য চিন্তার অলঙ্কারময় বর্ণনা অন্য একটি প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে ইজরাইলের সন্তানদের নাম করে, কিন্তু বক্তব্যটি প্রযোজ্য ছিল মুসলমানদের জন্য: “তারা বলল, যখন নিজেদের ঘরবাড়ি ও সন্তানসন্ততি থেকে দূরে পড়ে আছি তখন কেন আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবো না?”(২:২৪৬)। যদি কোরানের বর্ণনায় এই যুদ্ধটি ছিল বনি-ইসরাইলের সন্তানদের কিন্তু ব্যক্তিগত দুঃখজনক সূতিও মুসলমানদেরকে প্রতিশোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্দীপ্ত করে থাকতে পারে।

নবি যখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন তখন যুদ্ধের কোনো প্রশ্নই ছিল না। সুরা আনআম-এর ৬৮ নম্বর আয়াতে দেখা যায়, নবি তখন পৌত্তলিকদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন এবং তারা নবির সাথে অভদ্র আচরণ ও কোরানের আয়াত নিয়ে উপহাস করত: ‘তুমি যখন দেখ তারা আমার নিদর্শন (কোরানের আয়াত) নিয়ে নিরর্থক আলোচনায় মেতে আছে তখন তুমি দূরে সরে যাবে যেপর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে যোগ দেয়। আর শয়তান যদি তোমাকে ভুল করায়, তবে খেয়াল হওয়ার পরে সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবে না। (৬৬৮)। মক্কায় অবতীর্ণ সুরা আনকাবুত-এ কিতাবিদের মর্যাদা দিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে : “তোমরা কিতাবিদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে, তবে ওদের মধ্যে যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের সাথে নয়। আর বলো, “আমাদের ওপর ও তোমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য তো একই, আর তারই কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করি।”(২৯:৪৬) সুরা আনকাবুতের এই নির্দেশনাটি কেবল নবি মুহাম্মদের জন্য নয়, বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে বিধায় তা সমগ্র মুসলমান জাতির জন্যই জারি করা হয়েছে। মক্কা ও মদিনায় অবতীর্ণ (প্রথম দিকের) বিভিন্ন আয়াতে অমুসলমান কিতাবিদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেমন সুরা আল-ই-ইমরান-এ বলা হয়েছে বলো, আমি ও আমার অনুসারীরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তুমি তাদেরকে ও সাধারণ জনতাকে’ বলো, তোমরা কি আত্মসমর্পণ করেছ?” (৩:২০)। যারা বিশ্বাস করে ও যারা ইহুদি হয়েছে এবং যারা খ্রিস্টান ও সাবেয়ি (ইসলাম-পূর্ব যুগের দক্ষিণ আরবের বাসিন্দা, বাইবেলীয় বর্ণনায় সাবা রাজ্যের অধিবাসী), যারা আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার আছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (২৬২)। প্রায় একই বক্তব্য দেখা যায় সুরা মায়িদার ৭৭ নম্বর আয়াতে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বোঝা যায় এই আয়াতগুলো সম্ভবত হিজরতের পরবর্তীকালে এক বা দুই বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

মদিনায় এক দশক অতিক্রান্ত হবার পর, বিশেষ করে মক্কা বিজয়ের পর সুরা তওবা যেন অমুসলিম কিতাবিদের (খ্রিস্টান, ইহুদিদের) ওপর বজ্রাঘাত হানে। যে মানুষগুলোর সাথে এতোদিন আল্লাহর আদেশে মুসলমানরা নম্রভাবে ভাব বিনিময় করতেন, কোনো ধরনের হুমকি প্রদান করতেন না তাদেরকে এই সুরার আয়াতগুলিতে ইসলামকে স্বীকার না করলে ভবিষ্যত শাস্তির বার্তা প্রদান করা হয়। এতোদিন কেবল নবির কাজ ছিল জনতার কাছে সতর্কবার্তা পাঠানো, উপদেশ প্রদান করা, দশ বছর পর মৃত্যুদণ্ডের ভীতি প্রদর্শনের বার্তা দিলেন। সুরা তওবার এই আয়াতে নির্দেশ দেয়া হলো : যাদের ওপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহ ও তার রসুল যা হারাম করেছেন তা হারাম করে না ও সত্যধর্ম অনুসরণ করে না তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যে-পর্যন্ত না তারা বশ্যতা স্বীকার করে আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ স্বেচ্ছায় জিজিয়া দেয়। (৯:২৯)। সুরা বাইয়িনা-তে বলা হলো, বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হবার পর কিতাবি ও অংশীবাদীরা সৃষ্টির অধম প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। (৯৮৬)। মদিনার ইহুদিদের উচ্ছেদ, খায়বার ও ফাদাক ইহুদি-গ্রাম দখল এবং মক্কা বিজয়ের পর নবি মুহাম্মদ এই ঐশ্বরিক নির্দেশের কথা প্রদান করেন। এ-ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর ভিন্নমতাবলম্বীদের সাথে পূর্বের মতো নম্র ও যৌক্তিক বাক্য ব্যবহার করে কথোপকথনের প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে যুদ্ধের ময়দানে তরবারির ভাষায় ফয়সালা হবে সবকিছুর।

একটি সুগঠিত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । একটি সুগঠিত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা

ইয়াসরিবে গমনের পর নবি মুহাম্মদ তার স্থানীয় সমর্থক (আনসার) আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোক এবং অভিবাসী মুসলমানদের (মুহাজির) সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। আনসাররা মুহাজিরদের পালক ভ্রাতা হিসেবে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেন। মুহাজিররা কর্মঠ ছিলেন। তাঁরা ইয়াসরিবে এসে কৃষি-শ্রমিক এবং বাজারে দোকানের কাজ জুটিয়ে নেন। তথাপি এখানে তাদের অবস্থান সহজ কিংবা নিরাপদ, কোনোটাই ছিল না। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে কুরাইশদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে তাঁরা নির্ভরযোগ্য জীবিকার অন্বেষণ করছিলেন,যা তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারবে। নবি মুহাম্মদ নিজে কোনো পেশা গ্রহণ করেননি। মুহাজির ও আনসারদের অনুদানের ওপর নির্ভর করতেন। তিনি এ-সময় কঠোর সময়কাল অতিক্রম করছিলেন। তাঁকে প্রায়শ রাত্রিকালীন আহার না করে শয্যায় যেতে হতো কিংবা কয়েক দিনের ক্ষুধা এক দিনে উপশম করতে হত। ফলে ইয়াসরিবে এসে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমূখীন হতে হলো। বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে একটি কম বিপজ্জনক এবং স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত্তি খুঁজে নিতে হবে। এ-সমস্যার সমাধানে নবির গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ নিচে আলোচনা করা হয়েছে।

ইসলাম-পূর্ব সময় থেকে আরব গোত্রগুলোর সম্পদ বৃদ্ধির একটি ঐতিহ্যগত প্রথা হচ্ছে এক গোত্র কর্তৃক অন্য গোত্রকে আক্রমণ, অপরের গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পদ দখলে নেয়া। কৃষিভিত্তিক স্থায়ী পেশা বা জীবিকা অর্জনের পথ খুব দুরূহ থাকায় তৎকালীন আরবের বেশিরভাগ গোত্র এভাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। ইয়াসরিব-অভিবাসী মুসলমানদেরও নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য অন্য কোনো উপায় ছিল না। ফলে তাঁরা বিদেশ যাত্রী, বাণিজ্যিক কাফেলা কিংবা শক্রগোত্রের ওপর হঠাৎ আক্রমণের পন্থা বেছে নিলেন। আরবি গাজওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে আকস্মিক আক্রমণ’। এই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনো বাণিজ্যিক কাফেলা কিংবা গোত্রের ওপর আকস্মিক আক্রমণ করে তাদের সম্পদ ও নারীদের ছিনিয়ে নেয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে এভাবে অর্জিত সম্পদ আরব অঞ্চলের শুষ্ক রুক্ষ পরিবেশে জীবনযাপনকে তাৎক্ষণিকভাবে সহজ করে দিত।

একবার নবির কাছে সংবাদ পৌছাল কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা আমর বিন আল-হাদরামির নেতৃত্বে বিশাল মালামালের বহর নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নবি আব্দুল্লাহ বিন জাহেশ এর নেতৃত্বে মুহাজিরদের একটি দলকে ওই কাফেলার সম্পদ দখলের জন্য প্রেরণ করেন। মুহাজিররা নাখলা নামক একটি যাত্রাবিরতির স্থানে আকসিক আক্রমণ এলেন মুহাজিররা। সাথে দুইজনকে জিমি করেও নিয়ে আসা হলো। ইসলামের ইতিহাসে এই সফল অভিযানকে নাখলার অভিযান’নামে অভিহিত করা হয়।

মুহাজিরদের নাখলা-অভিযানের ঘটনা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে মক্কায় এবং ইয়াসরিবে। কারণ এটি ছিল মুসলমানদের প্রথম আক্রমণ এবং যা রজব মাসের প্রথম দিনে সংঘটিত হয়েছিল। প্রাচীন আরব-রীতি অনুযায়ী চারটি মাসে (মহরম, রজব, জিলকুদ ও জিলহজ) আক্রমণ করা নিষিদ্ধ, যার মধ্যে রজব মাস একটি। স্বাভাবিকভাবে এই আক্রমণের পর কুরাইশরা তীব্র ঘৃণা প্রদর্শন করল মুহাজিরদের প্রতি। অন্যান্য গোত্র থেকেও তেমনি প্রতিক্রিয়া নির্গত হলো। ইতিহাস-পাঠে মনে হয় এই প্রতিকূল প্রেক্ষাপট নবিকেও শঙ্কার মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ও তার লোকজনের প্রতি শীতল আচরণ করলেন। ভবিষ্যতপন্থা নির্ধারণেও কিছুটা সংশয়ী মনোভাব প্রকাশ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন জাহশ দাবি করলেন এই আক্রমণ জুমাদা আস-সানি মাসের শেষ দিনে করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি সমাধানের পথ পাওয়া গেল। কিন্তু যুদ্ধে লব্ধ মাল নিয়ে সমস্যা রয়ে গেল, যা মুহাজিরদের প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানে প্রয়োজনীয় ছিল। এ-কারণে কুরাইশদের দাবির মুখে মালগুলো ফিরিয়ে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। হয়তো কয়েকজন সাহাবি নবিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যা ঘটে গেছে তা আর বদলানো যাবে না এবং কোনো প্রকারের অস্বীকারমূলক বক্তব্য মুহাজিরদের অপরাধী এবং শক্রকে নির্দোষ বানাবে। মুহাজিরদের অর্থনৈতিক অবস্থার মুক্তির জন্য গনিমতের মালের প্রয়োজনীয়তার কথা নিশ্চিতভাবে তাদের মনে কাজ করছিল।

একটি সুস্পষ্ট এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সমাধান আসে সুরা বাকারার এই আয়াতে: পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, বলো, সেই সময় যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় আল্লাহর পথে বাধা দেয়া, আল্লাহকে অস্বীকার করা, কাবাশরিফে উপাসনায় বাধা দেয়া ও সেখানকার অধিবাসীদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া। ফিৎনাং হত্যার চেয়েও ভীষণ অন্যায়। পারলে তারা সব সময় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যে-পর্যন্ত না তারা তোমাদের ধর্ম থেকে তোমাদেরকে ফিরিযে দেয় (২:২১৭)। নাখলা অভিযানের পর কুরাইশ এবং আরও কয়েকটি শক্রভাবাপন্ন গোত্রের ওপর সফল গাজওয়া পরিচালিত হলে মুহাজিরদের আর্থিক অবস্থানে পরিবর্তন আসে। এ-অভিযানগুলো নবি এবং সাহাবিদের ক্ষমতার শীর্ষে পৌছানোর রাস্ত করে দেয় এবং সমগ্র আরবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল চূড়ান্ত রূপ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যে পদক্ষেপটি মুসলমানদের মর্যাদা ও আর্থিকভিত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল তা হচ্ছে ইয়াসরিবের ইহুদি সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।

ইয়াসরিবে তিনটি ইহুদি গোত্র বাস করত। এরা হচ্ছে বানু কায়নোকা, বানু-নাজির ও বানু কুরাইজা। এই ইহুদি গোত্রগুলি ইয়াসরিবে কৃষি ও শিল্পে নিজস্ব দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। ধর্মীয় শিক্ষা ও সাহিত্যের চর্চার মাধ্যমে তারা ইয়াসরিবের অন্য দুটি গোত্র আউস ও খাজরাজের চেয়ে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী হয়ে ওঠে। ইহুদিরা অনেক আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোককে কৃষিশ্রমিক ও দোকান-গুদামের বিক্রময়কর্মী ও প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করে। আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা এ-জন্য প্রতিনিয়ত হীনমন্যতায় ভুগতেন এবং ইহুদি গোত্র তিনটির প্রতি ঈর্ষা অনুভব করতেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা নবি মুহাম্মদের সাথে আল-আকাবা চুক্তি সম্পাদন করার মূল কারণ ছিল ইয়াসরিবে ইহুদিআধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের হীনমন্যতা থেকে মুক্ত করা। ইয়াসরিবে আগমনের পর নবির মধ্যে প্রথমে একটি বিচক্ষণ পরিণামদৰ্শিতা বজায় ছিল। তিনি ইহুদিদের সাথে যে কোনো প্রকার বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। ইহুদিরা ছিল শক্তিশালী ও বিত্তশালী। তিনি তাদের সাথে অনাক্রমণমূলক একটি চুক্তিও (আহদ আল-মুয়ারা) করেছিলেন, যা উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে। চুক্তিতে ঠিক হল মুসলমান ও ইহুদিরা নিজস্ব ধর্মীয় সমাজে বসবাস করবে এবং কুরাইশ ও অন্য যে কোনো গোত্র থেকে আক্রমণ করা হলে উভয় ধর্মাবলম্বী যৌথভাবে ইয়াসরিবকে রক্ষা করবেন। একই সাথে উভয় পক্ষই মধ্যে একটি সাধারণ সম্পর্কের যোগসূত্র হচ্ছে উভয় গোষ্ঠী পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা পরিহার করেছিলেন এবং প্রার্থনার সময় উভয় গোষ্ঠীই একই দিকে তাদের মাথা নত করতেন।

ইয়াসরিবে মুসলমানরা যখন দুর্বল ছিলেন তখন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমন-কি ইয়াসরিবে অভিবাসনের দেড় বছর ধরে নবি প্রার্থনার জন্য কিবলার দিক দূরতম মসজিদকে (জেরুজালেমে অবস্থিত) অনুসরণ করতেন তখনও কোনো বিরোধ বাধেনি। কিন্তু পরে কিবলার দিক পরিবর্তন করে মক্কার কাবাঘরের দিকে করা হয়। এই পদক্ষেপের পর থেকে ইহুদিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তাদের প্রশ্নের জবাব আসে সুরা বাকারা-এর এই আয়াতে: পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই; কিন্তু পুণ্য আছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সব কিতাব ও নবিদের ওপর বিশ্বাস করলে করলে…। (২:১৭৭)। এই নির্দেশনাটি আসলে ইহুদিদের জন্য ছিল একটি সতর্কবার্তা। তাদের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল যখন ছোটোখাট আকসিক অভিযান ও মক্কার বাণিজ্যিক কাফেলার ওপর গাজওয়ার সাফল্য আসতে লাগল। ইহুদিদের উৎকণ্ঠার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গেল বদরের ময়দানে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কুরাইশদের বিপক্ষে নবি এবং সাহাবিদের বিজয়ের মাধ্যমে। এবার ইয়াসরিবের ইহুদিরা মুখোমুখি হলেন আউস ও খাজরাজ গোত্রের সাথে। যাদের একদা কিছুই ছিল না, তারপরও ইহুদি মালিকদের অধীনে তাঁরা কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন না। ইহুদিরা দেখলেন মুহাজির আর আনসাররা নবি মুহাম্মদের পতাকাতলে মিলিত হয়ে একটি শক্তিশালী জোটবদ্ধ সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যার আসল নাম ইসলাম। ইসলামের উত্থানে মক্কায় গিয়ে পরাজিত কুরাইশদের প্রতি সহমর্মিতা জানালেন। কুরাইশদেরকে মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তাগিদ দিলেন। এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় সুরা নিসা-এর এই আয়াতে: তুমি কি তাদেরকে দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল? তারা প্রতিমা ও অসত্য দেবতার ওপর বিশ্বাস করে। তারা অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলে যে, বিশ্বাসীদের চেয়ে এদের পথই ভালো।’(৪:৫১)। এই আয়াতে পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা নিষেধকারী ধর্মশাস্ত্রের অধিকারী বলে দাবি করা লোকদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে যারা কিনা আবার পৌত্তলিকদের সাথেই ঐক্য গড়ে তোলে এবং নবি মুহাম্মদের একেশ্বরবাদী অনুসারীগণের তুলনায় সেই সব পৌত্তলিকদের বড় দেখানোর চেষ্টা করে।

এ-সন্ধিক্ষণে ইয়াসরিবের বাজারে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানু কায়নোকার গোত্রের সাথে সংঘর্ষ বাধে। এর সমাপ্তি ঘটে মুসলমানদের দ্বারা কায়নোকা গোত্রের রাস্তা দখলের মাধ্যমে। ইয়াসরিব নিবাসী একজন আনসার নারী কায়নোকা গোত্রের একজন স্বর্ণকারের দোকানে গিয়েছিলেন। স্বর্ণকার নারীকে দেখে কৃত্রিম ভালোবাসা দেখাতে শুরু করে এবং ওই নারী তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিশোধ স্পৃহার বশবর্তী হয়ে স্বর্ণাকার তখন নারীকে হয়রানি করেন এবং চেয়ারের সাথে ওই নারীর ঘাগরা ও ব্লাউজ পিন মেরে আটকে দেয়। নারীটি যখন ওঠে দাঁড়ান তখন পোশাকের নিম্নভাগ উন্মোচিত হয়ে যায় এবং উপস্থিত লোকজন হাসিতে ফেটে পড়ে। ওই নারী উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানালে একজন মুসলমান তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। ক্রুদ্ধ মুসলমান ওই স্বর্ণকারকে হত্যা করেন। এ-খবর শোনা মাত্র অন্য ইহুদিরা স্বর্ণাকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং ওই মুসলমান ব্যক্তিকে তারা হত্যা করেন। গোটা ঘটনাটিই দ্রুত দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। মুসলমানরা নবির কাছে বিচারের দাবি জানান। তাঁরা নবির অনুমতিক্রমে বানু কায়নোকা গোত্রের বসতিতে প্রবেশের রাস্তা জোরপূর্বক দখলে নিলেন এবং কায়নোকা গোত্রের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হল। পনের দিন পর প্রস্তাবিত কিছু শর্ত মেনে বানু কায়নোকা গোত্র আত্মসমর্পণ করে। শর্তগুলো হল তাদের জীবন রক্ষা পাবে তবে ইয়াসরিব ছেড়ে চলে যেতে হবে। যাবার আগে তারা সমস্ত সম্পদ একত্রে জমা করবে, সেখান থেকে ভারবাহী পশু বহনে সক্ষম সম্পদগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো ওই স্থানে রেখে যাবে যা ইয়াসরিবের গৃহহীন, দরিদ্র মুহাজিরদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

এ-ঘটনার পর ইয়াসরিবে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সুসংহত হয়। আর স্বাভাবিকভাবে ইহুদি গোত্রগুলো আতঙ্কিত মুহাম্মদ বিন মাসলামা। বানু-নাজির গোত্রের কাব বিন আল-আশরাফের রক্তের দাম নির্ণয়ে নবি এবং তার অনুসারীদের সাথে বিতর্ক হয়। এ-সময় সুযোগ বুঝে নবিকে হত্যা করতে গেলে মুসলমানদের সাথে লড়াই বেধে যায় বানু-নাজির গোত্রের। নবির আদেশে যুদ্ধ শুরু হলে মুসলমানরা বানু-নাজির গোত্রের বসতিতে প্রবেশের রাস্তা অবরোধ করে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন। বানু-নাজির পূর্ব থেকেই যুদ্ধের কৌশল কিছুটা আন্দাজ করায় তারা বানু কায়নোকা থেকে তীব্রভাবে পাল্টা আক্রমণ করে। মুসলমানরাও সাহসিকতার সাথে লড়াই করছিলেন। বানু-নাজিরের লড়াকু প্রতিক্রিয়া দেখে নবি আশঙ্কা করলেন মুসলমানরা হয়তো যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে পারবেন না, তারা আরবের ঐতিহ্যগত পরিবর্তশীলতায় বশীভূত হয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে যাবে। তিনি দ্রুত আদেশ দিলেন বানু-নাজির গোত্রের খেজুরগাছগুলো যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

উট এবং ভেড়ার মতো খেজুরগাছও আরবের অন্যতম খাদ্য ও সম্পদের উৎস। বানু-নাজির এ-ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা নবিকে প্রশ্ন করে: কিভাবে এই কাজটি করা সম্ভব হল?”, তাহলে কিভাবে আপনি নিজেকে সতর্ককারী হিসেবে এবং মন্দ ও ধ্বংসের বিরোধী হিসেবে দাবি করেন, যেখানে আপনি নিজেই একটি উৎপাদনশীল উৎসভাণ্ডার ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই প্রশ্নবাণে নবি পশ্চাৎপদ হননি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নাজিল হলো সুরা হাশর-এর এই আয়াতগুলো: আল্লাহ ওদেরকে নির্বাসন দেয়ার সিদ্ধান্ত না করলে পৃথিবীতে অন্য শাস্তি দিতেন; আর পরকালে ওদের জন্য রয়েছে আগুনের শাস্তি। উহা এজন্য যে ওরা আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। আর কেউ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করলে, আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর। তোমরা যে কত খেজুরগাছ কেটেছ আর কতক না-কেটে রেখে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে। উহা এজন্য যে, এ দিয়ে আল্লাহ সত্যত্যাগীদেরকে অপদস্থ করবেন।’(৫৯:৩-৫)। এই আয়াতত্ৰয়ের গৃঢ় অর্থ হচ্ছে শেষ পরিণতি দ্বারাই যুদ্ধজয়ের পদক্ষেপগুলো নির্ধারিত হয়। অমানবিক হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের এই কৌশল তৎকালীন আরব গোত্রগুলোর কাছে গৃহীত হয়েছে। অষ্টম হিজরিতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) সাকিফ গোত্রের সাথে লড়াইয়ে এবং তায়েফ দখলের সময়েও নবি এই আয়াতগুলো ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে (৬১ হিজরি) নবির দৌহিত্র এবং হজরত আলির পুত্র হোসেন বিন আলিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য উমাইয়া সেনারাও প্রাসাদে নারী-শিশুসহ সকলের জন্য খাদ্য-পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা হোক, বানু-নাজির গোত্র শেষ পর্যন্ত বিশ দিন পর আত্মসমর্পণ করে। খাজরাজ গোত্রের কয়েকজন নেতার মধ্যস্থতায় এই মতৈক্যে পৌছানো হলো বহনযোগ্য সকল সম্পদ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের জন্য জমা রেখে তারা নিরাপদে ইয়াসরিব ত্যাগ করবে।

ইয়াসরিবে অবস্থানকারী বাকি একমাত্র ইহুদি গোত্র ছিল বানু কুরাইজা। ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে (হিজরি ৫ম বর্ষে) তাদের অবস্থা খারাপ হয়। অভিযোগ পাওয়া গেল তারা ইয়াসরিবে থেকে মক্কার কুরাইশদের সাথে যোগাযোগ করছে এবং কুরাইশদেরকে সাহায্য করতেও রাজি হয়েছে। নবি কৌশলে কুরাইজার মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছেন, ফলে তারা শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান বাহিনীকে সহায়তা করেনি। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান যখন মদিনা দখলের আশা ত্যাগ করে অবরোধ তুলে নিলেন মুসলমানরা তখন বানু কুরাইজার রাস্তা পচিশ দিন ধরে অবরোধ করে রাখেন। কুরাইজা গোত্র তখন তাৎক্ষণিকভাবে অন্য গোত্রের ন্যায় আত্মসমর্পণের চুক্তি করে সহায়সম্পত্তি জমা দিয়ে নিরাপদে স্থান ত্যাগ করার জন্য রাজি ছিল। কিন্তু আবু সুফিয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে নবি তাদের উপর খুব রুষ্ট ছিলেন। ফলে তিনি তাদেরকে এই সুযোগ দিলেন না। তিনি হয়তো আরও চিন্তা করেছিলেন ইসলামের গরিমা বৃদ্ধির জন্য এবং প্রতিপক্ষের প্রতি ভীতিপ্রদ সতর্কবার্তার জন্য ধ্বংসও প্রয়োজন আছে। পূর্বের দুইটি ইহুদি গোত্র খাজরাজ গোত্রের নেতাদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পেয়েছিল। কুরাইজা গোত্র এবার আউস গোত্রের সাহায্য কামনা করলেন। নবিও মুসলমানদের পক্ষে আউস গোত্রের একজনকে মধ্যস্থতাকার নিয়োগ দিলেন। তার নাম সাদ ইবনে মুয়াজ। তিনি পূর্ব থেকেই কুরাইজা গোত্রের ওপর ক্ষিপ্ত এবং কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অবরোধ চলার সময় তিনি লড়াইয়ে আহত হয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ সাদ ইবনে মুয়াজ রায় দিলেন কুরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করা হবে, তাদের নারী-শিশুকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হবে এবং তাদের সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

এই সিদ্ধান্ত অন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও তা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না। কারণ আউস গোত্রের লোকেরা সাদ ইবনে মুয়াজের রায় মেনে নিয়েছিলেন। একটি টেকসই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সময় অনেক নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধেও তাই এ-রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইয়াসরিবের বাজারে কিছু পরিখা খনন করা হয়েছিল যাতে যুদ্ধের সময় নিরাপদে স্থান ত্যাগ করা যায়। ওই পরিখাগুলো কুরাইজা গোত্রের আত্মসমর্পণকৃত সাতশজন (ভিন্নসূত্র মতে এক হাজার সংখ্যক) পুরুষ ইহুদির শিরোচ্ছেদকৃত দেহ দাফন করা হয়। অবশ্য সাদ ইবনে মুয়াজের নির্দেশ অমান্য করে একজন ইহুদি নারীকেও হত্যা করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন কুরাইজা গোত্রের হাসান আল-কুরাইজির স্ত্রী। তিনি বিবি আয়েশার বান্ধবী ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে তিনি বিবি আয়েশার সাথে কথা বলছিলেন। পরে তিনি সহাস্যে এবং উৎফুল্ল চিত্তে শিরোচ্ছেদের স্থানে হেঁটে গেলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বানু কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে অবরোধের সময় তিনি মুসলমানদের ওপর পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন। ওই নারী সম্পর্কে বিবি আয়েশার বক্তব্য ছিল: ‘আমি তার মতো সুন্দরী, ভদ্র এবং দয়ালু মহিলা কখনো দেখিনি। তিনি যখন শিরোচ্ছেদের স্থানে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, আমি তাকে বললাম, আপনাকে নির্ঘাৎ হত্যা করা হবে। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, বেঁচে থাকাটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।’

ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ

হিজরতের পর প্রথম দশকে আমরা ইয়াসরিবে নতুন একটি রাষ্ট্রের সূচনা দেখতে পাই। মক্কায় তের বছর ধরে নবি মুহামদের লক্ষ ছিল মানুষের নিকট ইসলাম প্রচার করা, উপদেশ দেয়া ও শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা। ইয়াসরিবে এসে তার নবুওতের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে। মানুষকে প্রভাবিত করে তাদেরকে নতুন ধর্মীয় বিধি গ্রহণ করানো মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ-পর্যায়ে এসে সকল ধরনের কৌশলই প্রয়োগের বিবেচনা করা হয়েছিল। আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার যেসব ধারা শেখানো হয়েছিল তা এখানে গুরুত্ব রাখেনি।

সেসময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, বিনা উস্কানিতে হামলা এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট উপগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ যারা মোটেও আগ্রাসী মনোভাবের ছিল না। গুপ্তচরেরা জানিয়েছিল এরা মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণু হতে পারে। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই এধরনের সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। কুরাইশদের বাণিজ্যিক গাড়িবহরে হামলার মাধ্যমে মুহাজিররা অনেক দিন থেকে লাভবান হয়েছিলেন। এতে যেমন কুরাইশরা আহত হয়েছিল, তাদের পণ্য দখল করা গিয়েছিল তেমনি মুহাজিরদের সামরিক দক্ষতা ও মর্যাদা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল; এবং সর্বোপরি সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকেও ভয় দেখানো সম্ভব হয়েছিল। ওই একই সময়ে ইসলামের বেশিরভাগ আইন ও বিধিবিধান প্রকাশ করা হয়েছিল এবং ইসলামি অর্থনৈতিক ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল।

নবি মক্কায় থাকাকালে কোনো আইন প্রয়োগ করা হয়নি। ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ইজহাক গোল্ডজিহার এ-প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : মক্কায় যা নাজিল হয়েছে তা একটি নতুন ধর্মের সূচনা করে না। মক্কায় নাজিল হওয়া কোরানের আয়াতগুলোর বেশিরভাগই ধর্মপ্রাণ হওয়ার, একমাত্র আল্লাহর উপাসনা ও প্রশংসা করা, অন্যদের প্রতি খেয়াল রাখা এবং পানাহারের ক্ষেত্রে পরিমিত পরিমাণ বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মক্কায় শুধু পাঁচটি ফরজ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যেমন : (এক) এক আল্লাহর অস্তিত্বে এবং নবিদের কাজে বিশ্বাস রাখা, (দুই) নামাজ পড়া, (তিন) জাকাত প্রদান করা। তখন স্বেচ্ছায় মুক্তহস্তে দানের মাধ্যমে এটা করা হতো। (চার) রোজা রাখা। তখন ইহুদিদের মতো করে পালন করা হতো। (পাঁচ) হজ। তখনকার কাবা ঘর পরিদর্শনের কথা বোঝানো হয়েছে।

বিশিষ্ট তফসিরকারক জালালউদ্দিন সুয়তির মতে মক্কায় থাকাকালীন সময়ে ইসলামি আইনে কোনো শাস্তির নির্দেশ ছিল না। কারণটা স্বাভাবিক। কোনো আইন তখনো কার্যকর হয়নি। আল-তাবারির মতে যে সুরাগুলোতে কোনো ধরনের আইনগত বাধ্যবাধকতা করে দেয়া হয়েছে সেগুলো নিঃসন্দেহে মদিনায় নাজিল হয়েছে। বিবি আয়েশাকেও বলতে শোনা গিয়েছে, মক্কার কোরানের একমাত্র বিষয় ছিল বেহেশত আর দোজখ। হালাল আর হারামের নীতিমালা ইসলামের প্রসারের পর সৃষ্টি করা হয়েছে।

নবির জীবনের শেষ দশকে যে আইন ও নীতিমালা প্রণিত হয়েছে তা ইসলামকে শুধু যে আইনগত অনুমোদন দিয়েছে তাই নয় একটি আরব রাষ্ট্র গঠনের রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছে। নবির প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল নামাজের জন্য কিবলাকে জেরুজালেমের সবচেয়ে দূরের মসজিদ (আল-আকসা মসজিদ) থেকে সরিয়ে মক্কার কাবা শরিফের দিকে নিয়ে আসা। ফলে ইহুদিদের থেকে পৃথকভাবে ধর্মাচরণ করা সম্ভব হয়। এতে করে ইসলাম ধর্মের স্বতন্ত্রতা তৈরি হওয়ার ফলে মদিনার মুসলমানরা হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারে। আরবের প্রায় সকল গোষ্ঠী কাবা শরিফকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত। পৌত্তলিক উপাসনালয় থেকে কাবা একসময় সকল আরবীয়দের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম ও ইসমাইলের ঘরে পরিণত হয়। রোজা রাখার ক্ষেত্রেও নবি ইহুদিদের নিয়ম অনুসরণ থেকে সরে আসেন। মহরম মাসের দশম দিন থেকে রোজা রাখার নিয়ম পরিবর্তন করে রমজান মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন রোজা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে পুরো রমজান মাসই রোজা রাখা হবে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শাস্তি ও ক্ষতিপূরণসহ আরও বিভিন্ন ফৌজদারি আইন প্রণয়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নাপাক, খৎনা এবং খাদ্য ও পানীয়ের উপর নিষেধাজ্ঞার আইনগুলোও এসময় প্রণীত হয়। যদিও এসব আইনের বেশিরভাগই ইহুদি বা অন্যান্য পৌত্তলিক আরবীয় আইন থেকেই নেয়া হয়েছিল তবুও স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য বেশ কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন এখানে আনা হয়েছিল। ইহুদি ও পৌত্তলিকতার ছোঁয়া থাকলেও এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এসবের উদ্দেশ্য ছিল সমাজে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্র-সম্প্রদায়ের সবার মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা। প্রত্যেক সম্প্রদায় বা জাতির সভ্যতার মধ্যেই অন্য সম্প্রদায়ের সভ্যতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিটি ধর্মেই বেশকিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান থাকে যা সম্পাদনের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। এগুলোর সংগঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছুটা হলেও কোনো ধরনের গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই মক্কার উদ্দেশ্যে হজযাত্রা এবং সেখানে গিয়ে হাজিদের পালন করা আচার-আচরণের পিছনে কোনো দার্শনিক যুক্তি খুঁজে পান না।

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে নবি মুহামদের কাবার উদ্দেশ্যে যাত্রার সিদ্ধান্তটি বেশ আশ্চর্যজনক ছিল। তিনি কি সত্যিই কাবাকে ‘আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করতেন? না-কি তার যেসব অনুসারীর কাছে কাবা দর্শন করা প্রাচীনকাল থেকে মেনে চলা এক ঐতিহ্য ছিল, তাদের জন্যই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কুরাইশদের সাথে হতাশাজনক হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে। সেই কুরাইশদের সাথে যারা মুসলমানদেরকে কাবা শরিফে প্রবেশে বাধা দিতো। তাহলে ওই সিদ্ধান্ত কি মুসলমানদের সামরিক শক্তি দিয়ে কুরাইশদের মোড়লিপনা থামাতে এবং সাধারণ মক্কাবাসীকে নিজের নতুন ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য নেয়া হয়েছিল? যে ব্যক্তি নিজের নতুন ধর্ম ও আইনকে আরব জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং নিজের কাছের মানুষদের সকল ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ছুড়ে ফেলেছিলেন, তিনিই আবার কিভাবে পুরানো ধর্মের প্রধান অংশটিকে নতুন মোড়কে তার নিজের ধর্মে যোগ করলেন? ইসলামের প্রধান স্থপতি ও আইনপ্রণেতা নিরাকার বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদকে সবার উপরে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন, মানুষকে বলে এসেছেন যে, এক আল্লাহের ওপর বিশ্বাসই সফলকাম হওয়ার একমাত্র পথ। তিনি বলেছেন : . তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যে বেশি সাবধানি। (৪৯:১৩)। তবে কি নবি জাতিগত অনুভূতিতে বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন? কাবা ঘরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকে কি তিনি আরবের জাতীয় পরিচিতির প্রতীক বানাতে চেয়েছিলেন? যাই হোক না কেন, এই সিদ্ধান্তটি এতটাই বিস্ময়কর ও ইসলামি নিয়ম-নীতি হতে বিচ্যুত ছিল যে মুসলমানদের অনেকেই কিছুটা মনোক্ষন্ন হয়েছিলেন। অনেকেই সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে চলাচলের নিয়মের বিরোধিতা করেছিলেন, কারণ এটা আরবীয় পৌত্তলিকদের ধর্মাচার ছিল। কিন্তু সুরা বাকারা-এর এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামে স্থায়ীভাবে স্থান দেয়া হয়েছিল : নিশ্চয় দুটি পাহাড় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। (২:১৫৮)।

হজের সময় হজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরে চুমু খাওয়া সম্পর্কে একটা বহুল প্রচলিত হাদিস আছে। নবির সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান সাহাবিদের অন্যতম হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাব ওই কালো পাথরকে উদ্দেশ্য করে একদা বলেছিলেন ; আমি জানি তুমি একটা পাথর ছাড়া কিছুই নও, মানুষকে সাহায্য করা বা ক্ষতি করার তোমার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি আল্লাহর রসুলকে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে কখনো চুম্বন করতাম না। বরং কাবাঘর হতে বহিষ্কৃত করে তোমাকে দূরে নিক্ষেপ করতাম। সূত্র ; বুখারি শরিফ, ভলিউম ২, বুক ২৬ নম্বর ৬৬৭- অনুবাদক)। প্রভাবশালী ইসলামি দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি’ হজ সম্পর্কে বলেছেন, তিনি হজের আনুষ্ঠানিকতার কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পাননি, কিন্তু তারপরও তা করেছেন, কারণ এটা একটি প্রতিপাদিত ঘটনা। ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণকারী সুফি সন্ন্যাসী রাবেয়া বসরি (৭১৭-৮০১ খ্রিস্টাব্দ) হজ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “হজে গিয়ে আমি শুধু ইট আর একটি ভবন দেখেছি। এর থেকে আমি কি পুণ্য অর্জন করবো?” পারস্যের বিশিষ্ট সুফি সাধক বায়োজিদ বোস্তামি (৮০৪-৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ) হজে যাবার পূর্বে এক বৃদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করেন। বৃদ্ধ ব্যক্তি তাঁকে বলেছিলেন: “আমাকে ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ কর। কাবাতে গিয়ে তাওয়াফ করা আর আমাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করা একই কথা। সুবিধা হলো তোমার সময় বাঁচবে আর দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে। বায়েজিদ তাই করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। FE : Benjamin Walker, Foundations of Islam: The Making of a World Faith, Rupa & Co, Nwe Delhi, India, 2002, pp. 216, – অনুবাদক) । কোরানের সুরা তওবা-তে একটি আয়াত আছে যা এই ধোঁয়াশার ওপর কিছুটা আলোকপাত করে। হে বিশ্বাসীগণ! অংশীবাদীরা তো অপবিত্র; তাই এ-বছরের পর তারা যেন মসজিদ-উল-হারামের কাছে না আসে। যদি তোমরা দারিদ্রের ভয় কর তবে জেনে রাখো আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের অভাব দূর করতে পারেন। (৯:২৮)। তফসির আলজালালাইন-এর বক্তব্য অনুযায়ী এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ আরবদেরকে বিজয় ও সম্মান দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন। এই সুরা (তওবা) সময়ের ক্রমানুসারে কোরানের সর্বশেষ সুরা। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দ বা হিজরি ১০ সালে মক্কা বিজয়ের পর এটি নাজিল হয়েছিল। অমুসলিম গোষ্ঠী কর্তৃক মক্কা ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের কারণে মক্কার মানুষদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কথা ছিল। কারণ তাদের ব্যবসার প্রতিপত্তি ও জীবন-জীবিকার মান অন্যান্য আরবীয় গোষ্ঠীর নিয়মিত ভ্রমণের উপর নির্ভর করত। যদিও মক্কাবাসীরা এবং নবি একই গোষ্ঠীর ছিলেন তবে তাদের বেশিরভাগই মুসলিম হয়েছিলেন বাধ্য করার কারণে। মক্কা যদি তার জৌলুশ হারাতো, তবে ইসলাম-ত্যাগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ারও ঝুঁকি ছিল। তাই মুসলমানদের জন্য মক্কা-ভ্রমণকে (হজ) বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার মাধ্যমে এই ঝুঁকিকে প্রশমিত করা হয়েছে। এমন বিশ্লেষণকে আপাতত শুধু অনুমান-নির্ভর বলা যায়। এ-বিষয়টি আসলে কতটুকু সত্য তা শতভাগ কখনো জানা যাবে না। ইসলামের হজ-ব্যবস্থায় পূর্বের পৌত্তলিকদের রেওয়াজ বহাল রাখার কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। বিশ্বনন্দিত আরব কবি আবুল-আলা আল-মারি**হজনিয়ে মন্তব্য করেছেন এভাবে: ‘এই পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। (শয়তানের প্রতি) পাথর ছুড়তে আর কালো পাথর চুম্বন করতে। কী উদ্ভট কথাই না তারা বলে! তবে কি সত্য অবলোকন করতে গিয়ে মানুষ অন্ধত্ব বরণ করেছে।

মদিনায় সুরা-পান ও জুয়া খেলা নিষিদ্ধকরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এবং তা প্রয়োগ করা হয়েছিল। মদিনায় শুরুর দিকে জাকাত প্রদানকে কেন ঐচ্ছিক ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে জাকাতকে কর আদায়ের অন্যতম প্রক্রিয়ায় কেন রূপান্তরিত করা হয়েছিল তা বুঝতে পারা মোটেও কঠিন কিছু না। আর ওই একই সময়ে ধর্মীয় যুদ্ধ বা জিহাদকে আইনগত ভিত্তি প্রদান করা হয়েছিল যার সদৃশ আর কোনো বিধান ছিল না। প্রথমে যুদ্ধের অনুমতি শুধুমাত্র সুরা হজে এই আয়াতের মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল: “যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। ( ২২:৩৯)।

এক পর্যায়ে ক্রিয়াপদগুলোকে নির্দেশনামূলক বানিয়ে ও বাক্যের ভাবকে আরও জোরালো করে যুদ্ধকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুরা বাকারা, সুরা আনফাল, সুরা তওবাসহ বিভিন্ন মাদানি সুরাতে বলপ্রয়োগের নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে। লক্ষণীয় হচ্ছে মক্কি সুরায় পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে মাদানি সূরাগুলো এমন সব বিষয় দিয়ে পূর্ণ, যা পাঠ করলে মনে হয় অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে জিহাদ করা অনেক বেশি বাধ্যতামূলক নবি আরবদের নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের নিয়ে তরবারি ব্যবহার না করে একটি ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করা কতটা কঠিন তা বুঝতে পেরেই এই সিদ্ধান্তটি বেছে নিয়েছেন। কারণ সমগ্র আরবের মূল সংস্কৃতির মধ্যে যুদ্ধ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে গাঁথা। তাই আরবীয়দের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে যুদ্ধকে অস্বীকার করার কোনো পথ ছিল না। জিহাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে মানুষের মূল্যবান মানবিক অধিকারগুলোকে অবজ্ঞা করার প্রয়োজন হতো। যেমন চিন্তা করার স্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের স্বাধীনতা। আর এ-কারণে আরবের আশেপাশে বিভিন্ন অঞ্চলে সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছিল, যেগুলোর জবাব দেয়া সহজ ছিল না। যেমন, একটি ধর্ম বা মতবাদ প্রচার বা পালনে মানুষকে তরবারির দ্বারা বাধ্য করা কতটুকু যৌক্তিক? মানবিকতা ও ন্যায় বিচারের নীতির সাথে এগুলো কি আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ?

স্পষ্টত আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনাচার ও ভ্রষ্টাচার বিভিন্ন আঙ্গিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। তবে নূ্যনতম প্রজ্ঞার অধিকারী কোনো ব্যক্তির কাছে সাধারণ মানুষের চিন্তার বা বিশ্বাস করার স্বাধীনতাকে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক কেড়ে নেয়ার চেয়ে নির্মম ও অযৌক্তিক স্বৈরাচার আর কিছু হতে পারে না। প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে কোনো শাসকের অমানবিক প্রচেষ্টাকেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকেও শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় চিন্তা করতে বা শাসকগোষ্ঠীর মতবাদ অনুসারে চলতে বাধ্য করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সকল জাতিকেই কোনো না কোনো সময় এ ধরনের পীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সংকীর্ণ অবস্থানে দেখেছি। এমন প্রবণতা সাধারণ জনগণের মধ্যেও দেখা যায়, যখন তারা অন্যের মতামত ও বিশ্বাসকে মূল্য দিতে অপারগ হয়ে স্বৈরাচারী নীতিতে নিজেরাও বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। মানবজাতির ইতিহাসে বিভিন্ন অন্ধকার যুগের সূত্রপাত এই ধরনের রক্ষণশীল পন্থার কারণেই হয়েছিল। এই উগ্রতা বা গোঁড়ামি মানুষদের ভিন্নমতাবলম্বী অন্য মানুষকে পোড়াতে, শিরোচ্ছেদ করতে, ফাঁসিতে ঝোলাতে, অঙ্গহানি করতে ও বন্দী করে রাখতে এমনকি জাতিগত গণহত্যা সাধনেও উদ্বুদ্ধ করেছে। বর্তমান যুগে আমরা বিভিন্ন দেশে নাৎসি ও কমিউনিস্ট শাসকদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার ঘটনা উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই।

ইতিহাসের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অনেক দেশে চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়েছে এ-নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যে প্রশ্নটি এখানে চিন্তার উদ্রেক ঘটায় তা হলো মানবাধিকারের এই লঙ্ঘনগুলো কি আধ্যাত্মিক স্রষ্টার দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি তো পূর্বে জানিয়েছিলেন : ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। (২:২৫৬)। এছাড়া তার সিদ্ধান্ত হচ্ছে : . . . যার ধ্বংস হওয়ার কথা সে যেন (সত্যাসত্যের) প্রমাণ স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যার জীবিত থাকার কথা সে যেন (সত্যাসত্যের) প্রমাণ স্পষ্ট প্রকাশের পর জীবিত থাকে। (৮:৪২)। আল্লাহ তো নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “আমি তোমাকে বিশ্বের জন্য আশীৰ্বাদ হিসেবে পাঠিয়েছি। (২১:১০৭) এবং তুমি অবশ্যই সুমহান চরিত্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছ। (৬৮:৪)।

মক্কায় থাকাকালীন ৯০ তম সুরা বালাদ নাজিলের সময় আবুল আসাদ নামের একজন দাম্ভিক ব্যক্তির কথা পূর্বে বলা হয়েছে। তার বিপুল সম্পদ ছিল। শারীরিকভাবেও তিনি অনেক শক্তিশালী ছিলেন। ওকাজ মেলায় তিনি কাপেটের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিতেন, যদি কেউ তার পায়ের নিচ থেকে ওই কার্পেট সরাতে পারে তবে তাকে বড় অঙ্কের অর্থ পুরস্কার দেয়া হবে। যুবকেরা অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে কাপেট টানাটানি করত। কিন্তু কার্পেট ছিড়ে না যাওয়া পর্যন্ত টানতে থাকত আর আসাদ যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেখান থেকে কেউ তাঁকে সরাতে পারতেন না। এমন দাম্ভিক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা সত্ত্বেও সুরা বালাদে নবি মুহাম্মদের অগাধ বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোরানের এই সুরার সুমিষ্টতা অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা যায় না। তথাপি এই সুরার ৪ থেকে ১৭ নম্বর আয়াতের অর্থ দুর্বল অনুবাদের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করছি ; আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করেই সৃষ্টি করেছি। সে কি মনে করে যে কেউ কখনও তাকে কাবু করতে পারবে না? সে বলে, আমি প্রচুর ধনসম্পদ ব্যয় করেছি। সে কি মনে করে যে তাকে কেউ দেখেনি?আমি কি তাকে দুটো চোখ, জিহা আর ঠোঁট দিইনি? আর দুটো পথই কি আমি তাকে দেখাইনি? সে তো কষ্টসাধ্য পথ অবলম্বন করেনি? তুমি কি জান কষ্টসাধ্য পথ কী? সে হচ্ছে, দাসমুক্তি কিংবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান এতিম আতীয়কে বা দুর্দশাগ্রস্ত অভাবীকে; তার ওপর তাদের শামিল হওয়া যারা বিশ্বাস করে, পরস্পরকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দেয় ও উপদেশ দেয় দয়াদাক্ষিণ্যের।’ (৯০৪-১৭)।

যে পৈত্রিক-ধর্মত্যাগী ব্যক্তি মক্কায় তার নিজস্ব বিশ্বাস ও অন্যদের প্রতি আল্লাহর অনুকম্পা প্রচার করে গিয়েছেন দীর্ঘ তের বছর ধরে, সেই মানুষটিই মদিনায় গিয়ে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যুদ্ধের নির্দেশ দিতে থাকলেন: তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেয়া হল। (২:২১৬), . . . যে সত্যধর্ম অনুসরণ করে না তাদের সাথে যুদ্ধ করবে…’ (৯:২৯), কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম চাইলে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না… (৩.৮৫), ‘যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে মোকাবিলা কর তখন তাদের ঘাড়েগর্দানে আঘাত করো। শেষে যখন তোমরা ওদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করবে তখন ওদেরকে শক্ত করে বাঁধবে…। (৪৭:৪)

এরকম কয়েক ডজন কঠোর আয়াত মদিনায় নাজিল হয়েছিল। মক্কায় ‘লোহার মূল্য’ উল্লেখ করা হয়নি, তবে মাদানি সুরা হাদিদ-এ বলা হয়েছে: আর আমি দিয়েছি লোহা, যার মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য নানা উপকার; আর এ এজন্য যে, আল্লাহ যেন জানতে পারেন কে না-দেখে তাঁকে ও তার রসূলদেরকে সাহায্য করে। (৫৭:২৫)। এ আয়াত থেকে মনে হতে পারে, মক্কায় হয়তো নবির কাছে লোহা (লোহা দিয়ে তৈরি অস্ত্র) ছিল না, কিংবা লোহা ব্যবহারের সুযোগ ছিল না কিংবা আল্লাহ রসুলের দুর্ভোগ চিহ্নিতকরণের উপায় নির্ধারণে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। মক্কায় থাকতে আল্লাহ মুহাম্মদকে আদেশ করেছিলেন: ‘তুমি মানুষকে হিকমত ও সৎ উপদেশ দিয়ে তোমার প্রতিপালকের পথে ভাক দাও ও ওদের সাথে ভালোভাবে আলোচনা করো। তার পথ ছেড়ে যে বিপথে যায় তার সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক ভালো করেই জানেন। আর যে সৎপথে আছে তাও তিনি ভালো করে জানেন। ( ১৬:১২৫)।

এভাবে একটি আধ্যাত্মিক কাঠামো থেকে ইসলাম ক্রমেই আক্রমণ-প্রতিরক্ষাভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। ইসলামের অগ্রযাত্রা গাজওয়া থেকে লব্ধ মালামাল ও জাকাতের মাধ্যমে অর্জিত রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মদিনায় হিজরতের পরে নবির যাবতীয় পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্তগুলো একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে নেয়া হয়েছে। অবশ্য যুদ্ধবন্দী হত্যা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ তার নির্দেশে সংঘটিত বেশকিছু কাজই বিদেশি পণ্ডিতদের কাছে নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে।

বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে নবি অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছিল, তিনি কি এই যুদ্ধবন্দীদের কিছু মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিবেন, যার মাধ্যমে ইসলামের যোদ্ধাদের বেতন দেয়া যেতে পারে? নাকি তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা উচিত হবে? নাকি তাদেরকে গৃহবন্দী করে রাখা হবে? তখন বাস্তববাদী ও দূরদর্শী সাহাবি হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাব (যাকে ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়) পরামর্শ দিলেন, যুদ্ধবন্দীদের মেরে ফেলাই যৌক্তিক হবে। ওমরের মতে মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্তি দেয়া ঠিক হবে না, কারণ এতে করে তারা পুনরায় শত্রুপক্ষের বাহিনীতে যোগ দিয়ে আরও তীব্রভাবে যুদ্ধ করতে পারে। আবার এদেরকে দাস হিসেবে রাখলে বা অন্তরীণ করে রাখলে তাদের পাহারা দিয়ে রাখার পেছনে অনেক খরচ হবে প্রতিনিয়ত। তাই যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করলে তাদের সমস্ত গোষ্ঠী যেমন ভয় পেয়ে যাবে তেমনি ইসলামের সামরিক মর্যাদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। সূরা আনফালের এই আয়াতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়: দেশে সম্পূর্ণভাবে শক্র নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দি রাখা কোনো নবির পক্ষে সমীচীন নয়। তোমরা চাও পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ। (৮৬৭)।

বদর যুদ্ধে বন্দীদের মধ্যে দুইজন হচ্ছেন কুরাইশ বংশের বিখ্যাত সাহিত্যিক নদর বিন আল-হারিস এবং ওকুবা বিন আবু মোয়াইত। উল্লেখ্য নদর বিন আল-হারিস একসময় আল হিরার লাখমিদ রাজদরবারের রাজকবিও ছিলেন। তিনি ফেরদৌসি নামের একটি মনোমুগ্ধকর কবিতাও লিখেছিলেন। নদর পূর্বে বিভিন্ন সময় কোরানের সুরার মতো কবিতা লেখার দাবিও করেছিলেন। তিনি দাবি করতেন, কোরানের আদ-সামুদ-লুতের বর্ণনার চেয়ে তিনি আরও সুন্দর করে পারস্যের বিখ্যাত রুস্তমইসফানদার এররাজকীয়ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী-গাথা বলতে পারেন। নবি নদর ও ওকবা দুজনকে শিরোচ্ছেদ করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সাহাবি আল-মিক্‌দাদ বিন আমর চেয়েছিলেন নদরের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দিতে। তিনি নবিকে বললেন, “এই লোক আমার বন্দী। তাই সে আমার গনিমতের মাল হিসেবে বিবেচ্য। নবি মিক্‌দাদকে জিজ্ঞেস করলেন, নদর লোকটি কোরানের আয়াত নিয়ে পূর্বে যেসব কটুক্তি করেছে, তা কি ভুলে গেছ? নদর সম্পর্কে কোরানে মন্তব্য করা হয়েছে: যখন তাদের কাছে আমার আয়াত আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, “আমরা তো শুনলাম, ইচ্ছা করলে আমরাও এরকম বলতে পারি, এ তো শুধু সেকালের উপকথা। (৮:৩১)। শেষ পর্যন্ত নদরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। মিকুদাদও তার উপর থেকে নিজের দাবি তুলে নিয়েছিলেন। নদরের মাথা কেটে ফেলা হয়েছিল। এর পরে যাত্রা বিরতিতে কবি ওকবা বিন আবু মোয়াইতকে নবির সামনে হাজির করা হয়। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ আসিম বিন সাবিতকে দেয়া হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিককার নবির জীবনী-লেখক ইবনে ইসহাক তার সিরাত রসুল আল্লাহ’ বইয়ে জানিয়েছেন, সাহাবি আসিম বিন সাবিত ওকবা বিন মোয়াতকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ওকবা কাঁদতে কাঁদতে নবিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমি মারা গেলে আমার সন্তানদের কি হবে? নবি উত্তরে বলেছিলেন: জাহান্নামের আগুন। ( দ্রষ্টব্য ; মুসলিম শরিফ, চ্যাপ্টার ৩৮, বুক নম্বর ১৯ নম্বর ৪৪২১-৪৪২২ – অনুবাদক)।

মক্কা বিজয়ের পর নবি মুহাম্মদের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধবাদীদের জন্য একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে সেখানে কিছু ব্যতিক্রম ছিল। ছয়জন পুরুষকে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যার নির্দেশ দেয়া হলো। এমনকি কাবা ঘরে দেখলেও তা প্রযোজ্য ছিল। এরা হচ্ছেন : সাফওয়ান বিন উমাইয়া, আব্দুল্লাহ বিন আল-খাতাল, মিকাস ইবনে সাবাবা আল-লায়থি, ইকরিমা বিন আবু জেহেল, আল হুরায়েস ইবনে নুকায়েদ বিন ওহাব এবং আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ। শেষোক্ত ব্যক্তি মদিনায় হজরত উসমানের পিতামাতা কর্তৃক পালিত সন্তান ছিলেন। তিনি একসময় নবি মুহাম্মদের বেশ প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। বিভিন্ন অনুলিখনের সময় নবি একবার এক আয়াতের শেষে যখন বলেছিলেন ; এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ (আরবিতে আজিজ’, ‘হাকিম) শব্দগুলো যোগ করার জন্য, আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ বাক্যটি সংশোধন করে পরামর্শ দিলেন, এবং আল্লাহ সব জানেন ও বিজ্ঞ’(আরবিতে আলিম’, ‘হাকিম) লেখার জন্য। নবি অমত করলেন না, লেখার অনুমতি দিলেন। কোরান আল্লাহর বাণী হলে নিশ্চয়ই কারো পক্ষে পরিবর্তন-সংযোজন করা সম্ভব নয়। তাহলে আব্দুল্লাহ বিন সাদের মতো একজন সাধারণ অনুলেখক কোরানের আয়াতের পরিবর্তন করে চলছেন, এটা সাদের মনেও সন্দেহ সৃষ্টি করে। তিনি কোরানের অলৌকিতায় সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই ইসলাম ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের দলে যোগদান করেন। পারস্যের ফার্স রাজ্যে জন্মগ্রহণকারী ইসলামি পণ্ডিত ও কাজি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আলবায়দাওয়ি (মৃত্যু ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দ) তার “আছরার উত-তাজিল ওয়া আছরার উত-তায়িল শিরোনামের কোরানের তফসিরে বলেছেন : নবি একদিন কোরানের সুরা মুমিনুন-এর ১২ থেকে ১৪ পর্যন্ত আয়াত লেখার জন্য আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহকে বললেন। আয়াতগুলো হচ্ছে : ‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। তারপর তাকে বীর্যরূপে এক নিরাপদ আধারে রাখি, পরে আমি বীর্যকে তৈরি করেছি একটি জমাট রক্তপিণ্ডে, তারপর রক্তপিণ্ড থেকে মাংসপিণ্ড তৈরি করেছি, তারপর মাংসপিণ্ড থেকে হাড় তৈরি করে, অতঃপর হাড়গুলোকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। ( ২৩:১২-১৪)। নবি এতটুকু বলার পর আব্দুল্লাহ বিন সাদ বলে উঠলেন, নিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!” নবি বললেন, “এই বাক্যটি লাগিয়ে দাও। আবদুল্লাহ বিন সাদ তখন হতবাক হয়ে গেলেন। মানুষের বক্তব্য কোরানের আয়াতে সংযুক্ত হয় কিভাবে? তার মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। আল্লাহর নামে প্রচারিত কোরানের বাণী তাহলে কার? শেষে আব্দুল্লাহ বিন সাদ ইসলাম ত্যাগ করে কুরাইশ দলে যোগ দিয়ে প্রচার করতে থাকেন; ‘কোরান আল্লাহর ঐশীবাণী নয়, এটা নবি মুহাম্মদের নিজস্ব বক্তব্য। আমি নিজেও কোরানের কয়েকটি আয়াত সংশোধন করে দিয়েছি। পারস্যের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আল-তাবারি (৮৩৯-৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) কোরানের ৬ নম্বর সুরা আনআম-এর ৯৩ নম্বর আয়াতের তফসিরে আব্দুল্লাহ বিন সাদ- এর “মুরতাদ হয়ে যাওয়া নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। তার বহুল প্রচারিত হিস্ট্রি অব আল-তাবারি’বইয়ে (ইংরেজিতে অনুদিত দ্যা লাস্ট ইয়ারস অব দ্যা প্রফেট, ভলিউম ৯, পৃ. ১৪৮) আব্দুল্লাহ বিন সাদ- এর মুরতাদ হয়ে যাওয়া এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ আছে। – অনুবাদক)।

তথাপি আব্দুল্লাহ বিন সাদের ভাগ্য ভালো। মক্কা বিজয়ে পর হত্যা- তালিকায় নাম থাকার সংবাদ তিনি দুধভাই হজরত উসমানের মাধ্যমে পেয়ে যান। প্রাণ বাঁচাতে ভীত আব্দুল্লাহ বিন সাদ হজরত উসমানের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। উসমানও দুধভাইকে রক্ষার জন্য মক্কা বিজয়ের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা প্রশমনের আগ পর্যন্ত কিছু দিন লুকিযে রাখেন। পরে তিনি একদিন সুযোগ মতো সাদকে নিয়ে নবির সামনে উপস্থিত হন ও তাঁকে ক্ষমা করে দেবার অনুরোধ জানান। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর নবি সম্মতিসূচক উত্তর প্রদান করেন। নবি হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন উসমানের মধ্যস্থতা মেনে নেন। ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত ইবনে সাদ আল-বাগদাদি (৭৮৪-৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ) তার কিতাব আল-তাবাকাত আল-কবির বইয়ে (ভলিউম ২, পৃ. ১৭৪) উল্লেখ করেছেন, হজরত উসমান তার দুধভাইকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কয়েকজন সাহবি যখন নবিকে তার এই দীর্ঘ নীরবতার কারণ জিজ্ঞাসা করেন, নবি উত্তরে বলেন: আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবু সারাহ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি প্রাণভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আমি ভেবেছিলাম আব্দুল্লাহ বিন সাদ আমার সামনে এসে কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়াবেন এবং তোমাদের মধ্যে কেউ একজন তার গর্দান কেটে ফেলবে। এমনটা বলার কারণ হলো নবি পূর্বেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, যেকোনো স্থানে সাদের রক্ত ঝরানো জায়েজ হবে, যদি তা কাবা শরিফের পর্দায় লেগে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। মদিনার এক আনসার নবির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বললেন: নবি কেন ইশারা করেননি? নবি পুনরায় জানালেন, আল্লাহর রসূলদের চোখ মিথ্যা হতে পারে না। অর্থাৎ তিনি নীরব থাকার ভান করে চোখ দিয়ে হত্যা করার ইশারা দিতে পারেন না। হজরত উসমান খলিফা হওয়ার পর আব্দুল্লাহ বিন সাদকে উত্তর আফ্রিকা আক্রমণে আরব সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। এই যুদ্ধে আব্দুল্লাহ বিন সাদ তার দায়িত্ব এতো সুচারুরূপে পালন করেছিলেন যে উসমান মিশর দখলকারী আমর ইবনে আল-আসকে সরিয়ে আব্দুল্লাহ বিন সাদকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

হত্যা- তালিকায় উল্লেখিত আব্দুল্লাহ বিন আল-খাতালসহ তার ফারহানা ও কারিবা নামের দুইজন দাসীও ছিলেন। যারা নবিকে ব্যঙ্গ করে গান গাইতেন। তাদের তিনজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ও সারা নামের দুইজন নারীকে একই কারণে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সারাবানু আব্দুল মোতালেব গোত্রের আমর বিন হাশিমের মুক্তদাসী ছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা নবির প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়ায় তাঁকে ক্ষমা করা হয়েছিল। আর মুক্তদাসীসারা নবির কাছে অনুনয়-বিনয় করে প্রাণভিক্ষা পেলেও পরে হজরত ওমর তাঁকে ঘোড়ার নীচে পদদলিত করে হত্যা করেন।

বানু-নাজির গোত্রের ইহুদি কাব বিন আল-আশরাফের হত্যাকাণ্ডের কথা পূর্বে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। কাবের পিতা ছিলেন তাঈ গোত্রের এবং মাতা বানু-নাজির গোত্রের। বদরের যুদ্ধের পর ইসলামের ক্রমবর্ধনশীলতা দেখে কাব মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কুরাইশদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং লড়াই অব্যহত রাখার অনুরোধ জানান। কিছুদিন পর ৬২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন এবং মুসলিম নারীদের নিয়ে প্রণয়াত্মক কবিতা লিখেন। এ কবিতায় তিনি নিজের কামজনিত ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছিলেন। নবি এসংবাদ শুনে ক্ষুব্ধ হন। তিনি সাহাবিদেরকে বলেন, “আমার হয়ে কাব বিন আল-আশরাফকে শায়েস্তা করার জন্য কে আছ? তখন মুহাম্মদ বিন মাসলামা নামের একজন সাহাবি নিজের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। নবি তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন। মুহাম্মদ বিন মাসলামার সাথে ছিলেন আবু বিন জবর আল-হারিস বিন আউস, আব্বাস বিন বশির এবং কাবের এক জ্ঞাতি ভাই আবু নায়েলা। আবু নায়েলাকে সঙ্গে রাখার কারণ ছিল কাব যেন সন্দেহ করতে না পারেন এবং ইয়াসরিবের শেষ প্রান্তে অবস্থিত তার সুরক্ষিত বাড়িতে লুকিয়ে না থাকেন। নবি শহরের শেষ মাথা পর্যন্ত তাদের সাথে যান এবং সেখান থেকে তাদের বিদায় জানিয়ে আল্লাহর নিকট তাদের সাহায্য করার জন্য দোয়া করেন। মাসলামার নেতৃত্বে তারা কাবের বাড়ির ভেতরে ঢুকেন। আবু নায়েলাকে দেখে কাব বিন আল-আশরাফ সন্দেহ করেননি। তিনিও তাদের সাথে বাড়ি থেকে বের হয়ে কথা বলতে থাকেন এবং শহরের দিকে হাঁটতে থাকেন। এক- পর্যায়ে মাসলামাসহ বাকিরা কাবের ওপর চড়াও হন এবং ধস্তাধস্তির পর তাকে হত্যা করেন।

ইয়াসরিবে পৌছে মাসলামা দেখেন নবি গভীর রাত অবদি জেগে আছেন এবং শুভ সংবাদের অপেক্ষা করছেন। হজরত জাবির বিন আব্দুল্লাহর বর্ণীত হাদিস অনুযায়ী . . . . মুহাম্মদ বিন-মাসলামা দুজন সঙ্গী (আবু বিন জবর আল-হারিস বিন আউস এবং আব্বাস বিন বশির) নিয়ে প্রথম দিন কাব বিন আল-আশরাফের কাছে গিয়ে বললেন, “ওই মানুষটি (নবি মুহাম্মদ) আমাদের কাছে কর দাবি করছেন, তিনি আমাদেরকে বড়ই জ্বালাতন করছেন। কাব বললেন, ঈশ্বরের কসম! ওই লোকটির উপদ্রবে তোমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। মাসলামা বললেন, ‘যেহেতু আমরা তাকে নবি বলে মেনে নিয়েছি, তাই সহজে ছেড়ে আসতে পারি না। আমরা এখন দেখার অপেক্ষায় আছি কোন পথে কিভাবে তার ধ্বংস হয়। আমরা এসেছি তোমার কাছে, তুমি যদি এক বস্তা খাদ্য আমাদের কর্জ দিয়ে সাহায্য করো। কাব রাজি হলেন। মাসলামা যাবার আগে বললেন, “আমরা আগামীকাল আসবো। পরের দিন গভীর রাতে তারা আসলেন। পথিমধ্যে মাসলামা তার সঙ্গীদেরকে বললেন, আমি যখন কাবের মাথা দুহাতে চেপে ধরবো তখনি তোমরা তাকে আক্রমণ করবে। কাব ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, এতো গভীর রাতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কাব বললেন, আমার বন্ধুরা এসেছে একটু সাহায্য চায়। কাবকে নিয়ে ঘর হতে বের হওয়ার পর কিছু দূর গিয়ে মাসলামা বললেন, কী দারুণ মিষ্টি সুগন্ধ তোমার চুলে, আমি কি একটু শুকে দেখতে পারি? সহাস্য মুখে গর্বিত কণ্ঠে কাব বললেন, আরব দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী আমার ঘরে, তাই এই সুগন্ধ! মাসলামা চুলের সুগন্ধ শুকার ভান করে চুলসহ কাবের মাথা শক্ত করে দুহাতে চেপে ধরেন। সাথে-সাথে সঙ্গীরা দুদিক থেকে কাবের পাঁজর বরাবর তরবারি ঢুকিয়ে দেন। তারপর মাসলামা কাবের মস্তক কেটে নবির পায়ের কাছে নিয়ে রাখলেন। দ্রষ্টব্য : বুখারি শরিফ, ভলিউম ৫, বুক ৫৯, নম্বর ৩৬৯ – অনুবাদক)।

আরেকজন প্রভাবশালী ইহুদি ও আউস গোত্রের পুরনো বন্ধু সালাম বিন আবিল হুকায়েক ইয়াসরিব থেকে খায়বার চলে গিয়েছিলেন। খাজরাজদের কয়েকজন ওই ইহুদি নেতা সালামকে হত্যার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবি অনুমতি দেন এবং আব্দুল্লাহ বিন আতিককে দলের নেতা হিসেবে নিয়োগ দেন। তারা তাদের কাজ ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করেছিলেন এবং ফিরে আসার পর নবিকে সমস্বরে ‘আল্লাহ মহান বলে সংবাদটি প্রদান করেছিলেন। কাব ও সালাম নিহত হওয়ার পর আরেকজন ইহুদি ধর্মাবলম্বী ইয়াসির বিন রেজামকে হত্যা করার জন্য আব্দুল্লাহ বিন রাওহার নেতৃত্বে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। ইয়াসির খায়বারে গিয়ে বেদুইনদের একটি বড় গোষ্ঠী বানু গাতাফানকে নবির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উৎসাহিত করছিলেন। হোজায়েল গোষ্ঠীর নেতা খালেদ বিন সুফিয়ান নাখলায় নিজের গোত্রের লোকদেরকে নবির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উস্কানি দিয়েছিলেন। নবি সংবাদটি শুনে আব্দুল্লাহ বিন ওনায়েসকে পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্দেশ দেন। পরে খালেদকে হত্যা করা হয়।

রেফা বিন কায়েস নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালালে নবি ক্ষুব্ধ হন এবং ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আব্দুল্লাহ বিন হাদ্রাদকে নির্দেশ দেন। আব্দুল্লাহ প্রথমে তীর ছুড়ে রেফাকে হত্যা করেন, পরে কুড়াল দিয়ে মস্তক আলাদা করে ফেলে নবির সামনে নিয়ে আসেন। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে হত্যার জন্য মক্কার একজন পেশাদার খুনি আমর ইবনে উমাইয়াকে নিয়োগ করা হয়। আবু সুফিয়ান বিষয়টি টের পেয়ে পালিয়ে যান। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও আমর ইবনে উমাইয়া আবু সুফিয়ানকে হত্যা করতে পারেননি। উমাইয়া রাগের মাথায় একজন নিরীহ কুরাইশকে হত্যা করেন এবং অন্যজনকে গ্রেফতার করে ইয়াসরিবে নিয়ে যান। ১২০ বছর বয়সী একজন বয়োবৃদ্ধ আবু আফাককে হত্যা করা হয়েছিল কারণ তিনি নবির সমালোচনা করেছিলেন। নবির নির্দেশে সালেম বিন ওমর এই কাজ করেছিলেন। বয়োবৃদ্ধ মানুষকে হত্যা করায় ইয়াসরিবের ইহুদি নারী কবি আসমা বিনতে মারওয়ান ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি বানু খাতমা গোত্রের অধিবাসী। তার স্বামী ইয়াজিদ বিন জায়েদ, এবং পাঁচটি সন্তান নিয়ে তাদের সংসার। আসমা বিনতে মারওয়ান নবির বিরুদ্ধে একাধিক কবিতা লিখে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি ইয়াসরিববাসীকে উত্তেজিত করতে চেয়েছিলেন মুহাম্মদের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে। বদর যুদ্ধের পর ইসলামের প্রসার মেনে নিতে পারেননি। তিনি কবিতায় আউস, খাজরাজসহ ইয়াসরিবের বিভিন্ন গোত্র, যারা নবিকে সহযোগিতা করতেন এবং যারা নিস্পৃহ ছিল উভয়কে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিককার নবির জীবনী-লেখক ইবনে ইসহাক তার সিরাত রসুল আল্লাহ (ইংরেজিতে অনুদিত দ্যা লাইফ অব মুহাম্মদ) বইয়ে বলেছেন, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসের ২৫ তারিখ নবির নির্দেশে উমায়ের বিন আদিয়া আল-খাতামি ঘুমন্ত অবস্থায় পাঁচ শিশুসন্তানসহ আসমা বিনতে মারওয়ানকে হত্যা করেন।

বদর যুদ্ধের দুই বন্দী আবু আজ্জা আল-জুমাহি ও মুয়াবিয়া বিন মুগিরাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়ে ইয়াসরিবে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন নবি। ওহুদের যুদ্ধে নবি-বাহিনীর পরাজয় হলে মুয়াবিয়া পালিয়ে আত্মগোপন করেন এবং আবু আজ্জা পুরোপুরি মুক্তির জন্য আবেদন করেন। নবি তৎক্ষণাৎ আবু আজ্জাকে এবং মুয়াবিয়া বিন মুগিরাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন। উভয় নির্দেশই পালন করা হয়। জোবায়ের বিন আল-আওয়াম আবু আজ্জার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।

ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের প্রথম দিকে ইসলামের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ক্রমে যখন ইসলামের প্রসার বাড়তে থাকে, নবির সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় তখন তিনি তখন মুহাম্মদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। তিনি নবি মুহামদের বিরোধিতা করে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচার করতে শুরু করেন। মুসলমানরা তাঁকে মুনাফেকদের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক পর্যায়ে হজরত ওমর খাজরাজের নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবায়েরকে হত্যা করাই উচিৎ বলে মন্তব্য করেন। তবে নবির আরেক অনুসারী, খাজরাজ গোত্রের সাদ বিন উবায়দা আব্দুল্লাহর প্রতি সদয় হবার অনুরোধ করেন। তিনি আরও বলেন, “আমাদের শাসক হবার ইচ্ছা যাতে আব্দুল্লাহ বিন উবায়েরের পূরণ না হয়, সেজন্য আল্লাহই আপনাকে আমাদের কাছে প্রেরণ করেছেন। অন্যথায় আমরা এতোদিন তার মাথায় মুকুট পরিয়ে তার হাতে সীলমোহর তুলে দিতাম।

বর্তমানকালের মিশরীয় বুদ্ধিজীবী মুহামদ হোসেন হায়কলের (১৮৮৮-১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ) লেখা দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ নামের নবি মুহাম্মদের জীবনী-গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : নবি হজরত ওমরের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি যদি তখন তোমার কথা অনুসরণ করে আব্দুল্লাহ বিন উবায়কে হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করতাম তবে তার গোত্রের আত্মীয়-স্বজনেরা প্রতিশোধ নেবার জন্য আমাদের ওপর আক্রমণ করত। কিন্তু আমি এখন আদেশ দিলে তার আত্মীয়রা বরং সেটা আগে পালন করবে। হায়কলের মতে, আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের এর ছেলে অন্য কারো হাতে নিজের পিতার মৃত্যু দেখার চেয়ে নিজেই তার পিতাকে হত্যা করতে আগ্রহী ছিলেন। নবি নির্দেশ দিলে তিনি নিজেই এমনটা করবেন বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মিশরীয় ইসলামি পণ্ডিত জালালউদ্দিন আল-সুয়তি (১৪৪৫-১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) মন্তব্য করেছেন, কোরানের সুরা নিসা-এর ৮৮ নম্বর আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের প্রেক্ষিতে এসেছে: তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে যে, তোমরা মুনাফিকদের সম্বন্ধে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলে, যখন আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন? আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও? আসলে আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনও কোনো পথ পাবে না। (৪৮৮)। সুয়তির বর্ণনায়, আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের প্রতি ক্রোধের কারণে নবি তার অনুসারীদের বলেছিলেন যে, লোকটি সবসময় নিজ বাড়িতে প্রতিপক্ষ শিবিরের লোকজন নিয়ে বৈঠক করেন এবং বিপদ ঘটানোর চেষ্টা করেন, সে লোকটিকে সরিয়ে দিতে কেউ রাজি আছেন কি-না? ঘটনাক্রমে আব্দুল্লাহ বিন উবায়কে একসময় ক্ষমা করা হয়। এরপর তিনি হিজরি ৯ সালে (৬৩১ খ্রিস্টাব্দ) মারা যান। নবি তার শেষকৃত্যের আয়োজনও করেছিলেন।

যেসব হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র পরাক্রম প্রদর্শন কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে সংগঠিত হয়েছিল, সেগুলোকে কৌশলে অনেক সময় অনেকে ইসলামের জন্য নিবেদিত সেবা বলে চালিয়েছেন। যেমন ইয়াসরিবে এক ইহুদি দোকানদার ভালো ব্যবসা করতেন। অনেক মুসলমান ক্রেতার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। যেদিন নবি বানু কুরাইজা গোত্রের সকল ইহুদি পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দেন, সে-সময় মুহায়সা বিন মাসুদ দৌড়ে এসে ইবনে সুনাইনা নামের ওই নিরীহ দোকানদারটিকে হত্যা করেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য মুহায়সা বিন মাসুদকে একজনই মাত্র তিরস্কার করেছিলেন, সে হচ্ছে তার আপন ভাই।

অষ্টম হিজরিতে রোমানদের বিরুদ্ধে যখন সমর অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিল তখন নবির কাছে বার্তা আসে, শোয়ালেম নামের এক ইহুদির বাড়িতে বেশকিছু লোকের সমাগম হয়েছে। কিভাবে রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এই যুদ্ধ প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। নবি তখন সাহাবি তালহা বিন ওবায়দুল্লাহসহ কয়েকজনকে সে-বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। একজন মাত্র মানুষ আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলেন। কিন্তু পালাতে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। সুরা তওবার একটি আয়াতে যেসব মুসলিম গরমের কারণে এই অভিযানে যোগ দিতে পারেনি, তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে: আর তারা বলল, গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না। বলো, জাহান্নামের আগুনই সবচেয়ে গরম। (৯:৮১)।

নবুওতি ও শাসন

তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । নবুওতি ও শাসন

নবি হিসেবে মুহাম্মদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মক্কি সুরা বিশেষ করে সুরা মুমিনুন এবং সুরা নজম পাঠ করতে হবে। এই সুরায় মুহাম্মদকে যিশুর মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আর রাষ্ট্রনেতা, শাসক, আইনপ্রণেতা হিসেবে মুহাম্মদের ভূমিকা জানতে আমাদের পড়তে হবে সুরা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা মুহাম্মদ, এবং সবশেষে সুরা তওবার মতো মাদানি সুরাগুলো। মদিনায় হিজরতের তিন-চার বছর পর ইহুদি গোত্রগুলো নির্মুল হলে এবং বানু মুস্তালিক গোত্রকে (মদিনার পশ্চিমে বসবাসকারী একটি বেদুইন উপজাতি) পরাজিত করার পর নবি মুহাম্মদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মুহাম্মদের জীবনী লিখতে গিয়ে ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। একবার ইহুদি ধর্মের বানু-নাজির গোত্রের হাওয়া বিন আক্তাবের কন্যা সাফিয়া স্বপ্নে দেখেন চাঁদ তার কোমরে নেমে এসেছে। সাফিয়া তার স্বামী কেনানা বিন আবু রাবিয়াকে স্বপ্নের ঘটনাটি বললে তিনি ক্রোধে সাফিয়ার চোখে জোরে আঘাত করেন। ফলে সাফিয়ার চোখ ফুলে উঠে। কেনান বিন রাবিয়া স্ত্রীকে গাল দিয়ে বলেন: তুমি কি হেজাজের রাজার স্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখ নাকি? পরবর্তীতে খায়বার দখলের পর নবি সাফিয়াকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। ইবনে হিশামের বর্ণনায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ আছে। বানু কায়নোকা গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন সালাম ইসলাম গ্রহণ করলে ইহুদিরা তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন। তারা বলতেন, তুমি ভালো করেই জানো নবুওত শুধুমাত্র ইহুদি সন্তানরাই লাভ করতে পারে। এটি আরবদের জন্যে নয়। তোমার মুনিব কোনোভাবেই নবি নন, তিনি একজন রাজা মাত্র। মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে যখন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেবকে বলেন ; তোমার ভাতিজার দখলে তো আছে বিশাল অঞ্চল। আব্বাস ফিরতি জবাব দিলেন : “হ্যাঁ। নবুওত প্রাপ্তির জন্যই এই রাজত্ব।”

হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাব ইসলামের ইতিহাসে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তিনি নবি মুহাম্মদের কাছে খুব বিশ্বস্ত এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। ওমরের চারিত্রিক এই গুণাবলীর কারণেই ইসলাম প্রচারের শুরু থেকে নবি ওমরকে তার ঘনিষ্ঠজনের বৃত্তে নিয়ে আসেন। কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মুহাম্মদের সম্মতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন হজরত ওমর। তার কাছে এসন্ধি ছিল এক ধরনের পরাজয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে নবি কয়েকজন সাহাবি ও বেদুইন অনুসারীদের সাথে মক্কার বাইরে অবস্থান নিয়ে হজ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কুরাইশরা এ-সংবাদ শোনা মাত্র মুহাম্মদের প্রবেশ ঠেকাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মক্কা থেকে ছয় মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে মুসলমানরা সমঝোতার চেষ্টা করেন। শেষে উভয়ে এই শর্তে উপনীত হয় যে, মুসলমানেরা এ-বছর মদিনায় ফিরে যাবে তবে পরের বছর তারা কাবায় হজ করতে পারবেন। এ-প্রস্তাবে ওমর ভেবেছিলেন কুরাইশরা নবিকে তাদের সব শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছে। তাই তিনি আবেগ-তাড়িত হয়ে মুহাম্মদের কাছে এবিষয়ে জানতে চান। নবি তখন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং চিৎকার করে বলেন : ‘তোমার মা তোমার জন্য শোক করুক।’ নবির মুখে এ অভিশাপের কথা শুনে ওমর নিজেকে সংবরণ করেন। যে নবি হুদায়বিয়ার সন্ধি করেছিলেন আর যে নবি দশ/বারো বছর আগে প্রবল আগ্রহ নিয়ে ওমর ও হামজাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, দুজনের পার্থক্য আছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশদের নিকট আত্মসমর্পনের যুক্তিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিত্তি দিতে নাজিল হয় সুরা ফাতাহ-এর প্রথম আয়াত : ‘আল্লাহ তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছেন। (৪৮:১)। বর্তমানে সবাই স্বীকার করেন হজরত আবু বকরের কুশলী ভূমিকা ওমরসহ অনেকের অসন্তুষ্টি কমাতে ভূমিকা রেখেছিল।

যদিও হুদায়বিয়ার সন্ধি এক দৃষ্টিতে মুসলমানদের পিছপা হওয়া এবং এজন্য নবিকে ওমরসহ কয়েকজন সাহাবির অসন্তুষ্টির সমুখীন হতে হয় তবু এ-সন্ধি থেকে নবির গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। নবি হয়তো এ-সময় কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি কারণ তিনি সম্ভবত নিশ্চিত ছিলেন না, মুসলমানরা আদৌ কুরাইশদের পরাজিত করতে পারবে কিনা। ফলে একটি সাময়িক আপোস বা সন্ধি তার কাছে অধিক নিরাপদ ছিল। নবি জানতেন মুসলমানদের একটি পরাজয় কুরাইশদের শক্তিশালী করবে। তাছাড়া এ পরাজয় বেদুইনদের ওপর মুসলমানদের প্রভাব হ্রাস করবে এবং ইহুদিদের ক্ষোভ উসকে দিবে। যা মুসলমানদের ভবিষ্যতকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। এসব দিক বিবেচনা করেই সম্ভবত নবি কুরাইশদের সাথে সন্ধি করেন। তিনি সম্ভবত কুরাইশদের শর্তাবলী মেনে নিয়েছিলেন এই চিন্তা করে যে, শর্ত মানার ফলে তার প্রভাব ও মর্যাদা সমুন্নত থাকবে এবং পরবর্তী বছর তার অনুসারীরা হজ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে পরাজয়ের কোনো শঙ্কা থাকবে না।

হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মুহাম্মদ যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেবিষয়ে অনুধাবণ করা যায় তার পরবর্তী খায়বার যুদ্ধযাত্রা থেকে। মুহাজিরদের অনেক নিকট-আত্মীয় তখনো মক্কায় বাস করতেন। তাই নবি জানতেন, মুহাজিরদের অনেকে সে-জন্যে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে প্রাণপণে লড়াই করবেন না। কিন্তু ইহুদিদের শেষ শক্তিশালী ঘাঁটি খায়বার আক্রমণে সেধরনের কোনো শঙ্কা নেই। বরং খায়বারের যুদ্ধ জয় মুসলমানদের মনোবল ও গনিমতের মাল দুই-ই বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। সুরা ফাতহ-এর কয়েকটি আয়াতে এ-সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। যেমন এই আয়াতে বলা হয়েছে : বিশ্বাসীরা যখন গাছের নিচে তোমার কাছে তোমার আনুগত্যের শপথ নিল তখন আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হলেন। তাদের অন্তরে যা ছিল তিনি তা জানতেন…। (৪৮:১৮)।

হুদায়বিয়ায় যখন কুরাইশদের সাথে নবির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী মনে হয়েছিল, তখন নবি মুসলমানদের নিয়ে একটি গাছের নিচে দাঁড়ান। কুরাইশদের যেকোনো প্রতিরোধের মুখে যুদ্ধ করে যাবার শপথ গ্রহণ করেন সবাই। ইসলামের ইতিহাসে এই শপথের নাম ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির শপথ’( বায়াত অর-রেদওয়ান)। মানে আল্লাহ এই শপথ থেকে খুবই আনন্দিত হয়েছেন। আর তাদের জন্য স্থির করলেন আসন্ন বিজয়। (৪৮:১৮) । যুদ্ধে (তারা) লাভ করবে বিপুল সম্পদ। (৪৮:১৯)। আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা যুদ্ধ- লভ্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হবে। তিনি তোমাদের জন্য এ ত্বরান্বিত করবেন। (৪৮:২০)। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবি দ্রুত মদিনাতে ফিরে আসেন এবং সেখানে এক পক্ষ কাটিয়ে খায়বারের উদ্দেশ্যে সৈন্য নিয়ে যাত্রা করেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন মুসলমানেরা হুদায়বিয়ার সন্ধি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলতে পারে। আবার তিনি এ-ও জানতেন, খায়বার যুদ্ধ জয় হলে সন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেয়ে গনিমতের মালের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন সবাই।

গনিমতের মাল হস্তগত করার বিষয়টি বেদুইনদের এতোই আন্দোলিত করেছিল যে, যারা কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে যেতে রাজি ছিলেন না তারাও পর্যন্ত খায়বার আক্রমণে সঙ্গী হতে রাজি হয়ে গেলেন। সুরা ফাতহ-এর ১৫ নম্বর আয়াতে এ-সম্পর্কেই বলা হয়েছে: তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা ঘরে থেকে গিয়েছিল তারা বলবে, আমাদেরকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও। (৪৮:১৫)। এর পরের আয়াতে আল্লাহ নবিকে নির্দেশ দিয়েছেন, “যে-সব মরুবাসী আরব ঘরে থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলো, তোমাদেরকে ডাকা হবে এক প্রবলপরাক্রান্ত জাতির সাথে যুদ্ধ করতে। তোমরা ওদের সাথে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না ওরা আত্মসমর্পণ করে। তোমরা এ-নির্দেশ পালন করলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালো পুরস্কার দেবেন। কিন্তু তোমরা যদি আগের মতো পালিয়ে যাও তিনি তোমাদেরকে দারুণ শাস্তি দেবেন। (৪৮:১৬)। খায়বারের জলাশয়ে কাছে কয়েকটি রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। প্রথম দিনে সালাম বিন মেশকাম প্রাসাদটি আক্রমণ করেন মুসলমানরা। কিন্তু দখলের আগে ভয়াবহ লড়াইয়ে ৫০ জন মুসলমান যোদ্ধা প্রাণ হারান। অন্যদিকে হজরত আবু বকরের নেতৃত্বে নাওম প্রাসাদ আক্রমণ করা হয়। কিন্তু সফল হতে পারেননি। হজরত ওমরের নেতৃত্বে আক্রমণ করেও দখল নেয়া যায়নি প্রাসাদটি। অবশেষে হজরত আলি প্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে জাবির প্রাসাদের পানি-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফলে প্রাসাদে অবস্থানকারীরা বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়। বাইরে এসে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে একের পর এক কয়েকটি প্রাসাদের পতন ঘটে। সবশেষে মুসলমানেরা আস-সুলেমান এবং আল-ওয়াথি প্রাসাদদ্বয়ে পৌছেন। এই প্রাসাদ দুটিতে পূর্ব থেকে ইহুদি নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। ইহুদিরা শেষমেশ যুদ্ধ বিরতির আবেদন করেন। নবি যুদ্ধবন্দীদের বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ইহুদিদের কৃষি জমির মালিকানা মুসলমানদের হাতে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যদিও ইহুদিরা সে জমিতে কাজ করতে পারবে এবং তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক মুসলমানদের দেবে।

খায়বার যুদ্ধ থেকে নবির কাছে গনিমতের ভাগ পড়ে সাফিয়া নামের ইহুদি রমণী। সেই সাফিয়া, যিনি স্বপ্নে চাঁদকে তার কোমরে নামতে দেখেছিলেন এবং স্বামীকে তা বলার পর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। মদিনায় ফেরত আসার আগে নবি সাফিয়াকে বিয়ে করেন। খায়বারের পূর্বে ফাদাকের জলাশয়ের কাছে অন্য ইহুদি গোত্র বসবাস করত, তাও মুসলমানরা দখল নিতে সক্ষম হোন। এ-জন্যে তাদের কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। খায়বারের ইহুদিদের পরিণতির কথা বলতে ফাদাকের ইহুদিরা ভয়ে বিনা যুদ্ধে আত্মসমৰ্পন করেন এবং তাদের উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক মুসলমানদের দিতে রাজি হোন। মদিনার দক্ষিণে ওয়াদি আল-কোরা ও তায়মাতে বসবাসকারী ইহুদিরাও মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন এবং আরোপিত শর্ত হিসেবে জিজিয়া কর দিতে রাজি হন। এভাবে মুসলমানদের বিজয় রথ এগুতে থাকে। হেজাজের সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল নবি মুহাম্মদের শাসনাধীন হয়। এটা উল্লেখ্য যে খায়বার যুদ্ধ জয়কে নবি অত্যন্ত দক্ষতার সহিত কূটনীতিতে কাজে লাগিয়েছেন। যুদ্ধ জয়ের পর বেদুইনদের বানু গাতাফান গোষ্ঠীকে নবি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। এই গোষ্ঠী ইহুদিদের সাথে বেশ সম্পর্কিত ছিল। তারা নবির সাহচর্যে না এসে ইহুদিদের সাথে থাকলে হয়তো মুসলমানদের এ-যুদ্ধ জয় করা অনেক কষ্টসাধ্য হতো। বানু গাতাফান গোষ্ঠীকে তাই গনিমতের মালের অর্ধেকই দিয়ে দেন নবি।

হিজরতের পরে নবির কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসময় নবি ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সময় দিয়েছেন বেশি। যুদ্ধ জয়ে মুসলমানদের অন্যতম কৌশল ছিল ‘গাজওয়াবা আকস্মিক আক্রমণ করা। অন্য অনেক পদ্ধতি অনুসরণ করে আক্রমণ করা হতো, তবে তা সুনির্দিষ্ট গুপ্তচরদের পাঠানো গোপন তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এভাবে কয়েকটি কুরাইশ বাণিজ্যিক কাফেলাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করা হয়। এসব আক্রমণ যেমন বিপক্ষ দলকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি প্রাপ্ত গনিমতের মাল বিজয়ী মুসলমানদের আরও নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা হতে উৎসাহিত করেছে।

হিজরি ৩ সালে (৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) মদিনার নিকট ওহুদ পাহাড়ের ময়দানে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজয় মুসলমানদের জন্য ছিল একটি বিরাট ধাক্কা। কিন্তু এই পরাজয় অবধারিত ছিল না। যুদ্ধে পরাজিত মুসলমানদের মদিনায় ফেরত না পাঠিয়ে আবু সুফিয়ানের কুরাইশ দল মক্কায় ফেরত চলে যায়। এই যুদ্ধে নবির রণকৌশল অনুসরণ করা হয়নি। নবির নির্দেশ মেনে মুসলমানরা পাহাড়ের ঢালে অবস্থান নেননি। নিলে অবশ্য এই যুদ্ধে হারতেন না। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে কেউ কেউ গনিমতের মাল আগেভাগেই হস্তগত করার জন্য যার যার জায়গা ছেড়ে যান। ফলে যুদ্ধে পরাজিত হন।

হিজরি ৫ সালে (৬২৭ খ্রিস্টাব্দে) মুসলমানরা পুনরায় বিপদের সমুখীন হোন। কুরাইশ এবং বেদুইনরা সমিলিতভাবে মদিনা দখলের চেষ্টা করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ-ঘটনাকে বলা হয় খন্দকের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে মুসলমানরা মদিনার চারপাশে এক ধরনের পরিখা খনন করেন যা আগে কখনো দেখা যায়নি। প্রচলিত আছে যে, এই পরিখা নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ইরানি নাগরিক সালমান আল-ফার্সি। কুরাইশদের পক্ষে পুনরায় নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। একজন কুরাইশ যোদ্ধাও পরিখা পার হয়ে মদিনায় প্রবেশ করতে পারেননি। মুসলমানদের জন্য ঝুঁকি ছিল মদিনার ভেতরে থাকা ইহুদি বানু কুরাইজা গোষ্ঠী কুরাইশদের সাথে যোগ দিতে পারে। কুরাইজা গোষ্ঠী যদি কুরাইশদের সাথে যোগ দিতো তবে মুসলমানরা এ যুদ্ধে পরাজিত হবার ও ইসলামের প্রসার থমকে যাবার সম্ভাবনা ছিল। নবি মুহাম্মদের কৌশলের কারণে সে যাত্রায় বিপদ কেটে যায়। দুই সপ্তাহ পর কুরাইশরা যুদ্ধ থেকে ক্ষান্ত দেন।

ও কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দু সৃষ্টির জন্য নিযুক্ত করেন। নোয়াম বিন মাসুদের সাথে মদিনার ইহুদি ও কুরাইশদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। ফলে উভয়েই তাকে নবি মুহাম্মদের প্রতিপক্ষ ভেবেছিলেন এবং তার বক্তব্য বিশ্বাস করেছিলেন। নোয়াম বিন মাসুদের ভূমিকার ফলে বানু কুরাইজা ও কুরাইশ বাহিনী একে অপরকে অবিশ্বাস করেন। অবশেষে বানু কুরাইজাদের তরফ থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে এবং হঠাৎ করে শৈতপ্রবাহে টিকতে না পেরে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যান। কুরাইশরা মক্কা ফেরত যাবার পরই নবি সশস্ত্র সৈনিকের একটি দল প্রেরণ করেন বানু কুরাইজাদের রাস্তায়। বানু কুরাইজা ভেবেছিল আবু সুফিয়ানের বাহিনীকে সাহায্য না করায় মুসলমানরা বোধহয় এবার সহনশীল আচরণ করবে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যতের হুমকি মনে হওয়াতে নবি তাদেরকে মদিনা থেকে সমূলে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুরাইজাদের বিনাশ ইসলামের বিকশিত শক্তি সম্পর্কে অন্যদের ভীত করবে, মুসলমানদের জন্য বিশাল গনিমতের ব্যবস্থা হবে, তেমনি মদিনার আউস ও খাজরাজ গোষ্ঠীর লোকেরা ইসলামের পতাকার প্রতি আরও অনুগত হবেন।

৬২৫ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে বানু-নাজির গোত্রের খেজুর গাছের বাগানে মুসলমানদের আগুন দেয়া ছিল ঘৃণিত একটি কাজ। যুদ্ধে পরাস্ত করার অন্য কোনো উপায় দেখে নবি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোরানের সুরা হাশর-এর ২-১৭ নম্বর আয়াত নবির সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক ভিত্তি দেবার জন্য নাজিল হয়েছে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা একই ধরনের কঠোর পদ্ধতি গ্রহণ করেন তায়েফ-নিবাসী বানু সাকিফদের অবরোধ করে রাখার সময়। অবরোধের মাধ্যমে মুসলমানরা বানু সাকিফদের বাইরে থেকে খাদ্য আসা বন্ধ করে দেন। কিন্তু শীঘ্রই মুসলমানরা বুঝতে পারেন, বানু সাকিফদের আবাসস্থলের ভেতরে খাদ্যের বড় মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে অবরুদ্ধ করে রাখলেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অন্যদিকে নবি আরব মুসলমান সৈনিকদের অস্থির চরিত্রের কথা চিন্তা করেন। অচিরেই সৈনিকেরা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়বেন। তাই দ্রুত যুদ্ধ জয়ের কথা চিন্তা করে বানু সাকিফদের আঙ্গুরের ক্ষেত পুড়িয়ে দেবার আদেশ দেন। জীবিকার উৎস হিসেবে বানু সাকিফদের নিকট এই আঙ্গুরের ক্ষেত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা নবির কাছে একজন দূত প্রেরণ করে মুসলমানদের এ-রকম ধংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। বিনিময়ে সমস্ত আঙ্গুর ক্ষেতের মালিকানা মুসলমানদের দিয়ে দেবার প্রস্তাব দেন। নবি তায়েফ অবরোধ স্থগিত করে মক্কা ফিরে যান এবং হাওয়াজেন গোত্র থেকে নেয়া গনিমতের মাল বন্টন করেন। বানু সাকিফ গোত্রের এক নেতা মালেক বিন আউসকে প্রস্তাব দেন, মালেক ইসলামে দীক্ষিত হলে তার স্ত্রী-সন্তানদের মুক্তি দেবার সাথে সাথে একশত উট প্রদান করা হবে। প্রস্তাবে রাজি হয়ে মালেক বিন আউস নিজের ধর্ম-গোত্র ত্যাগ করে নবির উপস্থিতিতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সব ঘটনা ইসলামের প্রাথমিক যুগে লিখিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে লেখা আছে এবং তা নির্ভরযোগ্যও। ইসলামের প্রাথমিক বছরগুলোর ঘটনা নবি মুহাম্মদের মানসিকতা ও নতুন ধর্ম হিসেবে ইসলামের দ্রুত প্রসারের লৌকিক ব্যাখ্যা প্রদান করে।

মক্কা জয়ের পর এবং তায়েফ জয়ের পূর্বে নবি হাওয়াজেন গোত্রকে পরাস্ত করে প্রচুর গনিমতের মাল লাভ করেন। গনিমতের মাল বন্টনের সময় মুসলমানরা ভয় পেতেন, নবি উদারভাবে নব্য মুসলমানদের গনিমতের মাল সব দান করে ফেলবেন। যেভাবে তিনি মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান, তার সন্তান মুয়াবিয়া, আল-হারেস বিন আলহারেস, আল-হারেস বিন হিশাম, সোহেল বিন অমর এবং হাওয়াতেব বিন আব্দুল ওজাকে ১০০টি করে উট উপহার দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় মদিনার আনসারগণ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সাদ বিন ওবাদা নবির কাছে আনসারদের এ ক্ষোভের কথা জানান। নবি তখন আনসারদের ডেকে পাঠান, তাদের বক্তব্য শোনার জন্য। নবির এই কার্যক্রম তার কূটনৈতিক ও অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা প্রমাণ করে। নবি আনসারদের উদ্দেশ্যে বলেন, ও আমার আনসারেরা এটা কি ভালো নয় যে অন্যরা উট নিয়ে ফিরে গেল আর তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর দয়া নিয়ে?” মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে নবি মুহাম্মদ সম্পর্কে যে দলিল বা তথ্য ইসলামের ইতিহাসের প্রথমদিককার ঐতিহাসিকরা প্রকাশ করেছেন তাতে নবির চরিত্রে ধর্মপ্রচারকের সাথে একজন রাষ্ট্রনায়কের চিত্রও ধরা পড়ে। মুহাম্মদের জীবনী নিয়ে যে কোনো একনিষ্ঠ পাঠক পড়াশুনা করলে এ-ধরনের অসংখ্য প্রমাণ পাবেন।

তফসির আল-জালালাইনে সুরা নিসা-এর ১০৫-১০৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় নীচের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। তমা বিন ইবরিক নামের একজন ব্যক্তি একজন সৈনিকের পোশাক চুরি করে তা ইহুদি ব্যক্তির ঘরে লুকিয়ে রাখেন। পোশাকের মালিক পোশাকটি লুকানো স্থানে খুঁজে পান। পোশাকের মালিক যখন পোশাক চুরির জন্যে তমাকে দায়ী করেন তখন তমা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ওই ইহুদি ব্যক্তিকে ‘চোর বলে দাবি করেন। তমার আত্মীয়রা এ-বিষয়টি নবির সামনে উপস্থাপন করেন এমনভাবে যে, তমা একজন মুসলমান তাই নবি যেন তমার পক্ষপাতিত্ব করেন। কিন্তু নবি তা করেননি। পক্ষপাতিত্বের চেয়ে তিনি সত্যকেই প্রাধান্য দিলেন। সুরা নিসার ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ; আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানুষের মধ্যে সেই মতো বিচার করতে পার আল্লাহ তোমাকে যেমন জানিয়েছেন। তুমি বিশ্বাসঘাতকদের জন্য তর্ক করো না। (৪:১০৫)। সুরা হজুরাত-এর ৯ নম্বর আয়াতেও একই ধরনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এখান থেকে নবি মুহাম্মদের নেতৃত্বের গুণাবলীই যে প্রকাশিত হয় শুধুতাই নয়, সেই সাথে তৎকালীন আরব মুসলমান সমাজের অবস্থা ও দলাদলির চিত্রও উঠে এসেছে। আয়াতটি হল: বিশ্বাসীদের দুই দল দ্বন্দুে লিপ্ত হলে তুমি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবে। তারপর তাদের এক দল যদি অন্য দলের বিরুদ্ধে সীমা ছাড়িয়ে যায়, তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে তাদের ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা করে দেবে, সুবিচার করবে। আয়াতটি একই সাথে পরিষ্কার এবং বোধগম্য। তফসির আল-জালালাইনে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ আছে যেখানে তৎকালীন আরবের সমাজিক অবস্থা ও নবি অনুসারীদের মধ্যকার মনোমালিন্যের বিষয়টি ফুটে ওঠেছে ; নবি একবার একটি গাধার পিঠে চড়ছিলেন এবং যখন তিনি আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন গাধাটি শুকনো মলত্যাগ করে। ইবনে উবায় দুর্গন্ধের জন্যে নিজের নাক চেপে ধরেন। তখন সেখানে উপস্থিত আনসারদের এক নেতা আব্দুল্লাহ বিন রাওহা বলেন, ইবনে উবায়, আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, রসুলের কাছে তোমার শরীরে ব্যবহার করা সুগন্ধির চেয়ে গাধার এই মলের গন্ধ কম অসহনীয়। ইবনে রাওহার এই বক্তব্য নিয়ে তার অনুসারীদের সাথে ইবনে উবায়ের অনুসারীদের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে লাঠি-জুতা নিয়ে দুই পক্ষ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে।

মক্কা বিজয়ের পর কবি বোজায়ের বিন জোহায়ের বিন আবু সালমা তার ভাই কবি কাব বিন জোহায়েরকে একটি চিঠি লিখেন : যে কবিরা নবির নামে কবিতা লিখেছেন কিংবা নবির মনে কষ্ট দিয়েছেন, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। যারা এধরনের কাজ করেছিল তাদের অনেকেই এখন মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাই আপনি নিরাপদে থাকতে চাইলে নবির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত। অতীত কাজের জন্য যারা ক্ষমা প্রার্থনা করছেন নবি তাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন না। অন্যথায় আপনার উচিত মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়া যাতে মুসলমানরা আপনাকে দেখতে না পায়। কাব ঠিক করলেন তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন। জীবন বাঁচাতে তিনি নবির প্রশংসা করে একটি কবিতা লেখেন যা আলখাল্লার কবিতা নামে পরিচিত। কারণ নবি কবিতাটি শুনে এতো খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি কাবকে তার নিজের একটি আলখাল্লাল উপহার দিয়েছিলেন।

ওই সময়ে আরবের মানুষ সরল এবং অনানুষ্ঠানিক জীবনযাপন করতেন। তাই তারা তাদের নেতার সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ করতেন। তাদের কাছে একমাত্র বাধ্যবাধকতা ছিল কোরানের নির্দেশ মেনে চলা। তারা নবি মুহামদকে নিজেদের একজন মনে করতেন। কিন্তু এধরনের সম্পর্ক বেশি দিন থাকেনি। নিয়ম-কানুনের বাধ্যবাধকতা ও রীতিনীতি মেনে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নবি মুহাম্মদকে সমান দেখানো প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। সুরা হুজুরাত-এর ১-৫ নম্বর আয়াতে এবং কোরানের আরও কিছু আয়াতের মাধ্যমে নবির জন্য তার অনুসারীদের আদব-কায়দা নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে ; হে বিশ্বাসিগণ! আল্লাহ ও তার রসুলের আগে যাওয়ার চেষ্টা করো না। (৪৯:১)। যেহেতু আল্লাহর উপস্থিতি চোখে দেখা যায় না, তাই এই আয়াতের মৰ্মার্থ হচ্ছে, বিশ্বাসিগণ, তোমাদের সামনে নবি উপস্থিত থাকলে নবি স্থান ত্যাগ করা না পর্যন্ত তোমরা কোনো কথা বলো না বা কোনো কাজ করো না। পরবর্তী আয়াত হচ্ছে: “হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নবির কণ্ঠস্বরের ওপরে নিজেদের কণ্ঠস্বর উচু করো না আর নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচুগলায় কথা বলো তার সঙ্গে সেভাবে উচুগলায় কথা বলো না। (৪৯:২)। এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে তারা যেন হজরত ওমরের মতো কোনো আচরণ না করেন। যেমন, হজরত ওমর হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অন্যদের সমুখেই সন্ধির শর্তাবলী নিয়ে উচ্চস্বরে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং মুহামদকে ‘আল্লাহর রসুলনা বলে শুধু মুহাম্মদ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ‘যারা আল্লাহর রসুলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে পরিশোধন করেছেন, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলতে পারে। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’(৪৯:৩)। স্পষ্টত আরবেরা এধরনের আদব-কায়দার সাথে পরিচিত ছিলেন না। নবি মুহাম্মদের ক্ষমতা গ্রহণের পরই তারা এসব পালন করা শেখে। ( হে নবি!) যারা ঘরের পেছন থেকে তোমাকে উচুগলায় ডাকে তাদের বেশির ভাগই হচ্ছে নির্বোধ। (৪৯:৪)। নবির বাড়ির পেছন দিকে তার স্ত্রীরা থাকতেন। সেদিক দিয়ে যারা চলাফেরা করত এবং নবিকে শুধু মুহামদ বলে সম্বোধন করত, তা নবি পছন্দ করতেন না। (অথবা আল্লাহ এই আচরণ পছন্দ করতেন না, কারণ এই বাক্যগুলো তো আল্লাহর!) একটা সময় পর্যন্ত এই ধরনের সম্বোধন স্বাভাবিক ছিল। নবি তার সার্থী ও অনুসারীদের নিয়ে একসাথে কাজ করতেন। যুদ্ধের জন্য পরিখা পর্যন্ত খনন করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। তোমার বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা যদি ধৈর্য ধরত তা হলে তাই হতো তাদের জন্য ভালো।’(৪৯:৫)। মুসলমানদের জন্য শিষ্টাচারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি হয় সুরা মুজাদালা-এর এই আয়াতের মাধ্যমে: হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা রসুলের সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলে তার আগে কিছু সদকা দেবে।’(৫৮:১২)। অর্থাৎ নবির সাথে আদব-কায়দা প্রদর্শন কেমন হবে তা পরিষ্কার হয় এই আয়াত থেকে। কিন্তু যেসব দরিদ্র মুসলমানের নিকট এই নিয়ম মেনে চলা কষ্টসাধ্য মনে হয়েছিল তাদের জন্য পরবর্তী আয়াতে শৈথিল্য প্রদর্শন করা হয়েছে : “যদি তোমরা সদকা দিতে না পার, তবে আল্লাহ তোমাদের দিকে মুখ তুলে চাইবেন…। (৫৮:১৩)।

নবির বাড়িতে প্রবেশের বিধি-নিষেধ আবার আসে সুরা আহজাব-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে: হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদেরকে অনুমতি না দেয়া হলে, খাবার তৈরির জন্য অপেক্ষা না করেণ, খাওয়ার জন্য নবির বাড়ির ভেতরে ঢুকবে না। তবে তোমাদেরকে ডাকা হলে তোমরা যাবে ও খাওয়ার পর চলে আসবে। কথাবার্তায় তোমরা মেতে যেও না; এমন ব্যবহার নবির বিরক্তির সৃষ্টি করে। সে তোমাদেরকে উঠে যাওয়ার জন্য বলতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন না…। (৩৩:৫৩)। এই আয়াত নিয়ে মন্তব্যের প্রয়োজন নেই, কারণ তখন যা ঘটতো তারই সাক্ষী দিচ্ছে এই আয়াত। সাহাবিরা প্রায়ই আগে থেকে না-জানিয়ে নবির বাড়িতে প্রবেশ করতেন। খাবারের জন্য অপেক্ষা করতেন এবং খাবারের পর একে অন্যের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করতেন। মুহাম্মদ রসুল হবার পর থেকে এ-ধরনের আচরণ আশোভন হিসেব বিবেচনা করা হয়। মুহাম্মদের সাথে সাধারণ মানুষের কিছুটা দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। কিন্তু সেটা মুহাম্মদের পক্ষে সরাসরি বলা অস্বস্তিকর। কিন্তু আল্লাহর জন্য নয়, কারণ তিনি এ-সকল অস্বস্তির উর্ধ্বে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, আল্লাহ তার রসুলের কণ্ঠে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সঠিক ব্যবহারের শিক্ষা প্রদান করেন। এই ব্যখ্যার ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করে একই আয়াতের পরের বাক্যটি। যদিও এক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর ভিন্নতা রয়েছে ; তোমরা তার (নবির) স্ত্রীদের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ-বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য পবিত্রতর…। (৩৩:৫৩)। হজরত আয়েশা বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রসুল মুহাম্মদ ও আমি একবার এক থালা থেকেই খাবার খাচ্ছিলাম। তখন হজরত ওমর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রসুল ওমরকে আমাদের সাথে খাবারের আমন্ত্রণ জানালেন। ওমর আমাদের সাথে খেতে বসলে ওমরের আঙুল আমার আঙুলকে স্পর্শ করে। ওমর নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যদি পূর্বে আমার উপদেশ কর্ণপাত করতেন, তবে কারো চোখ তাকে (আয়েশা) দেখতে পারতো না। এরপর-ই পর্দা সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াত নাজিল হয়।

আব্দুল্লাহ বিন আল-আব্বাসের বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী সুরা আহজাবের ৫৩ নম্বর আয়াত নাজিলের কারণ হচ্ছে হজরত ওমরের মন্তব্য। যেখানে হজরত ওমর নবিকে বলেন, আপনার স্ত্রীরা অন্য স্ত্রীলোকের মতো নয়। সুরা আহজাবের ৩২ নম্বর আয়াতও শুরু হয়েছে একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে: “হে নবিপত্নীগণ! তোমরা তো অন্য নারীদের মতো নও। (৩৩:৩২)। কেন রসুলের স্ত্রীরা অন্যদের থেকে আলাদা হবেন? কারণ সোজা কথায় নবি মুহাম্মদের মর্যাদা অন্য সাধারণ মানুষের মতো একই পর্যায়ে ছিল না। নবির মর্যাদা ধরে রাখার জন্যে তার স্ত্রীদের মর্যাদাও ধরে রাখতে হবে। তাদেরকে প্রাচ্যের রাজকুমারীদের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। সুরা আহজাব-এর ৫৩নম্বর আয়াতের (যার অংশবিশেষ ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে) শেষ বাক্য উপরোক্ত বিষয়বস্তুকে সমর্থন করে: . . . তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া বা তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা সংগত হবে না। আল্লাহর কাছে এ গুরুতর অপরাধ। (৩৩:৫৩)। নবি মুহামদ তার স্ত্রীদের নিয়ে খুব সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ইজরাইলের প্রাচীন রাজাদের মতো তার স্ত্রীরা কোনো পরপুরুষ থেকে অস্পৃশ্য থাকবেন। এমন কি নবি মারা গেলেও। সাধারণ ধর্মান্তরিত মুসলমান থেকে নবি মুহাম্মদের মর্যাদা বেশি তা কোরানের ভিন্ন আরেকটি আয়াত থেকে ধারণা পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের পর সুরা হুজুরাত-এর ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: আরব মরুবাসীরা বলে, “আমরা বিশ্বাস করলাম। বলো, তোমরা বিশ্বাস করনি। বরং বলো, আমরা আত্মসমৰ্পন করার ভাব দেখাচ্ছি। কারণ এখনও তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মায়নি। (৪৯:১৪)।

সদ্য মুসলমান হওয়া ব্যক্তিরা যখন বলেন, তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, বল প্রয়োগ কিংবা যুদ্ধের ফলে ভীত হয়ে ধর্মান্তরিত হননি, তখন সুরা হুজুরাত-এর ১৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয় ‘ওরা মনে করে ওরা আত্মসমর্পণ করে তোমাকে ধন্য করেছে। বলো, তোমাদের আত্মসমর্পণ আমাকে ধন্য করেছে মনে করো না, বরং বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করে আল্লাহই তোমাদেরকে ধন্য করেছেন। (৪৯:১৭)। অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেই বিশ্বাসী প্রমাণিত হয় না। নবির মতো ইসলামের জন্য উৎসর্গিকৃতও বোঝা যায় না। ফলে তাদের সাথে নবির মান-মর্যাদা তুলনীয় নয়।- অনুবাদক। সদ্য ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া মুসলমানদের অত্যুৎসাহী মনোভাব আর গরিমার কথা জানতে পেরে নবি তাদের সমালোচনা করেন এবং সদকা দিতে নির্দেশ দেন। মক্কি সুরা ফাজর-এ এরকম ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। এই সুরাটি তিনি কাবা ঘরের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠ করে মক্কাবাসীকে শুনিয়েছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে আরবি কোরানের এই মনোমুগ্ধকর আর চাঞ্চল্যে ভরা সুর আক্ষরিক অনুবাদের মধ্যে ফুটে ওঠে না। তথাপি এই সুরার কিছু আয়াত দুর্বল অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা হল: তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক কী করেছিলেন আদ বংশের ইরাম গোত্রের ওপর যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের”, যার সমতুল্য কোনো দেশে তৈরি হয়নি? আর সামুদদের ওপর? যারা কুরা উপত্যকায় পাথর কেটে ঘর বানিয়েছিল? আর বহু শিবিরের অধিপতি ফেরাউনের ওপর? যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছিল, ও সেখানে অশান্তি বাড়িয়েছিল। তারপর তোমার প্রতিপালক তাদের ওপর শাস্তির কশাঘাত হানলেন। তোমার প্রতিপালক তো সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।’ (৮৯৬-১৪)। না, আসলে তোমরা পিতৃহীনকে সম্মান কর না, তোমরা অভাবগ্রস্তদের অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না, আর তোমরা উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে-যাওয়া ধনসম্পদ পুরো খেয়ে ফেল, আর তোমরা ধনসম্পদ বড় বেশি ভালোবাস। ( ৮৯:১৭-২০)।

লাগাম টেনে ধরার দরকার ছিল। সুরা নিসা-এর এই আয়াতে দেখতে পাই : হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে বের হবে তখন পরীক্ষা করে নেবে। আর কেউ তোমাদের মঙ্গল কামনা করলে বা শ্রদ্ধা জানলে ইহজীবনের সম্পদের লোভে তাকে বলো না, তুমি বিশ্বাসী নও। কারণ আল্লাহর কাছে অনায়াসলভ্য সম্পদ (গনিমতের মাল) প্রচুর রয়েছে। তোমরা তো পূর্বে এমনই ছিলে! তারপর আল্লাহ তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, সুতরাং তোমরা পরীক্ষা করে নেবে। তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। (৪৯৪)। এই আয়াতটি যে ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয় তা হচ্ছে: এক অভিযানের সময় নবির কয়েকজন অনুসারী সোলায়াম গোত্রের এক মেষ-পালককে আক্রমণ করেন। সেই মেষ-পালক তাদেরকে সালাম জানিয়ে সম্ভাষণ করেছিলেন, যা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত প্রিয় ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু অনুসারীরা ধরে নিলেন, মেষ-পালকটি ভীত হয়ে তাদেরকে সালাম দিয়েছেন তাই মেষ-পালককে হত্যা করতে দ্বিধা করলেন না। আর মেষগুলো গনিমতের মাল হিসেবে দখলে নেন তারা।

আরব সমাজে সে-সময় প্রচলিত আদব-কায়দার আরও কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় সুরা হুজুরাত-এর ১১ নম্বর আয়াতে : ‘হে বিশ্বাসিগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো হতে পারে; আর কোনো নারীও অপর নারীকেযেন উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণীর চেয়ে ভালো হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। আর তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা খারাপ কাজ। (৪৯:১১)। এই আয়াত নাজিল হওয়া সম্পর্কে জানা যায়, তামিম গোত্রের কয়েকজন আমার, শোয়েবসহ কয়েকজন গরীব-অসহায় মুসলমানদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকারা করেছিলেন। কোরানে এরকম ডজনখানেক আয়াত রয়েছে যা মানুষের মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, আদব-কায়দার প্রতি দিকনির্দেশনা দেয়; যেমন, কোন অবস্থায় কী করতে হবে, কী করা যাবে না, কিভাবে কী বলতে হবে এবং কখন নিশ্চপ থাকতে হবেইত্যাদি। একই সাথে এই আয়াতগুলি থেকে নবি মুহামদের সময় আরব মানুষের সামাজিক আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

7 thoughts on “নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর – আলি দস্তি

  • September 19, 2018 at 3:20 AM
    Permalink

    আল্লাহ ছিলেন কাবার মন্দিরের রক্তপিপাসু অপদেবতা ; মুহাম্মদ আল্লাহর মূর্তি ধ্বংস করিয়াছিলেন ; এবং আল্লাহর ভক্তরা কারবালা ময়দানে , মুহাম্মদের বংশ ধ্বংস করিয়াছিল ; সেই আল্লাহর নাম নিয়ে প্রত্যহ তাদের এখনো চেঁচামেচি ;

    Reply
    • October 7, 2018 at 10:42 PM
      Permalink

      Mr Asit, do you really think that only cursing hatred can bring ignorant believers in light ? We have to learn how to make self-criticism.
      2. Now let’s come to the point : and that’s much more effective than cursing . If we carefully notice Muhammad’s life in Mecca , what we learn actually ? He used soft and decent tactics . Again, no spiritual power benefited him or came in work . In 13 years of Mecca, only few influential persons were converted to Islam. Why they converted themselves, that’s a separate and dufferent debate. I can only say for now that those first Converted to Islam were very wise and had a vision of bright future. For them, it was a career. No angel, no miracle or spiritual power came to work in in use except tactics , psychological manipulation or game, I. e, using fear of punishment after life, greed, and helplessness of man . When Muhammad went to Madina, his status changed , became stronger financially by robbery of commerce groups (banijjo kafela), then his language of Quran changed. It was not decent any more.

      Reply
  • January 16, 2022 at 10:38 AM
    Permalink

    When you heard the name prophet Muhammod…say Muhammod (sallahu alyhe wa sallam)

    Reply
  • December 30, 2023 at 2:00 PM
    Permalink

    I have one question to Asif,

    Who invented this law that if anyone leave islam that will create problem of his married life? Is it mentioned in Quran and Hadith? In this case whats your solution?

    A man love his wife most u know that

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *