স্বতন্ত্র ভাবনাদর্শনমানবাধিকার

মাজার ভাঙা, মানুষের অধিকার, ইমানুয়েল কান্ট ও দুটো বিশেষ বিবেচনা

মাজার ভাঙাটা মাজার কর্তৃপক্ষের প্রোপার্টি রাইটের লঙ্ঘন, আরেকজনকে ক্ষতি না করে নিজের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকারের লঙ্ঘন। মোটকথা, মাজার ভাঙ্গা হলো মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। তাই এটা অপরাধ। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। এই জায়গায় যদি সুফিদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম প্রচার, হিন্দু-মুসলমানদের ইনক্লুসিভ প্লেস হিসেবে মাজার, সুফিদের সোশ্যাল ওয়ার্ক এর মত ইতিবাচক জিনিসগুলো সামনে আনা হয়, তাহলে একইভাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর কাহিনী, ঝাড় ফুঁকের নামে অত্যাচার, বাচ্চা হওয়ার নামে মেয়েদের স্ট্যাচুটরি রেপের মত মাজার সম্পর্কিত নেতিবাচক ব্যাপারগুলো সামনে চলে আসছে। এর মাধ্যমে মাজার ভাঙ্গা নিজেই যে অপরাধ সেই আলোচনাটা ঘুরিয়ে মাজারের অস্তিত্বটা সমাজের জন্য ভাল না খারাপ সেই আলোচনা চলে আসছে, আর মাজারের অস্তিত্বের ভাল-খারাপের ভিত্তিতেই মাজার ভাঙ্গা ঠিক না বেঠিক তার ন্যায্যতা প্রতিপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে মাজার ভাঙ্গা নিজেই অপরাধ, কারণ এটা মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। আর এটাই হচ্ছে এখন। ব্লগার হত্যার ক্ষেত্রেও দেখা যায় মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, বিচার পাবার অধিকারের লঙ্ঘনের আলাপ চলে যায় নিহত ব্লগারের চরিত্র কেমন ছিল, তার ভিত্তিতে ভিক্টিম ব্লগারের অস্তিত্ব সমাজের জন্য ভাল কি খারাপ ছিল, আর তার ভিত্তিতে হত্যার ন্যায্যতা প্রতিপাদনের দিকে। সমস্যাটা এখানেই।

নৈতিকতার ভিত্তির প্রশ্নে দুটো গুরুত্বপূর্ণ নীতি হচ্ছে পরিণামবাদ (consequentialism) ও ডিঅন্টোলজি (deontology)। পরিণামবাদে কোনো কিছু করা উচিত কি অনুচিত তা নির্ধারিত হবে সেই কাজের ইউটিলিটি বা উপযোগের ভিত্তিতে, তা ভাল ফল না খারাপ ফল আনবে তার ভিত্তিতে। অন্যদিকে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) দ্বারা বিকশিত ডিঅন্টোলজি অনুসারে কোনো কাজ করা ঠিক না বেঠিক তা কাজের ফল নয়, বরং কর্তব্য, নীতি, নিয়মের ভিত্তিতে তা নির্ধারিত হবে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই পরিণামবাদের বিবেচনা করা গেলেও, আইনের ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার, সামাজিক সুবিচার, সাম্য, মানবিক মর্যাদার বিবেচনা করা হয় বলেই, বিশেষ করে মানুষের অধিকারের প্রশ্নে ডিঅন্টোলজিকাল এথিক্সকে (deontological ethics) নীতির মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, আর করাটাই উচিত। মানুষের অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা তার ভিত্তিতেই অপরাধ, অন্যায় ঠিক করতে হবে। এখানে ভিক্টিমের অস্তিত্ব থাকলে বা না থাকলে ভাল কি খারাপ হতো – টাইপের উপযোগবাদী আলাপ এখানে সমস্যা তৈরি করে। আর এগুলো যদি করাও হয়, বা এর ডিসকোর্স (discourse) নিয়ে আলাপ করা হয়, সেক্ষেত্রেও সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে মানবাধিকারের ব্যাপারটাই সবার আগে থাকে। অন্য কোনো আলাপ সামনে এলে সেটাকে এই deontology-র আলাপে, বা মানুষের অধিকারের আলাপে নিয়ে যেতে হবে। এটার ভিত্তিতেই গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ (civil society) থেকে চাপ আসতে হবে, সরকারকে চাপ দিতে হবে, সামাজিক নৈতিক মাপকাঠি পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে, এটার ভিত্তিতেই বিচার ব্যবস্থা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবে এই জায়গায় উপযোগবাদী আলাপগুলোকে বাদ দিয়ে কান্টের ডিঅন্টোলজিকাল আলোচনার মধ্যে থাকাটা নিশ্চিত করা, বা সম্পর্কিত মানবাধিকারের বিষয়টাকে সামনে আনার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আমি দুটো জিনিসকে বিবেচনায় নিতে বলবো –

প্রথমত, মানুষের মধ্যে প্রবণতা আছে যে, তারা ডিঅন্টোলজি থেকে পরিণামবাদ বা উপযোগবাদের দিকে চলে যেতে চায়। এই ব্যাপারটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক জায়গা থেকেই কাজ হয়েছে। সামাজিক নৃতাত্ত্বিক ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ (Clifford Geertz) দেখাচ্ছেন, মানুষ প্রায়ই সামাজিকভাবে গঠিত বর্ণনার মাধ্যমে অপরাধকে বোঝে এবং বিচার করে, অপরাধের ধারণা এবং তার বিচার শুধুমাত্র আইনগত কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সমাজের সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী গঠনগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। এখান থেকে বলা যায়, ভিক্টিমের চরিত্রের দিক, সে বাঁচলে ভাল কি খারাপ হতো সেই আলোচনা, মানে তার জীবন না থাকার ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জায়গাও চলে আসে। আলবার্ট বান্দুরা (Albert Bandura) তার নৈতিক বিচ্ছিন্নতা (moral disengagement) তত্ত্বে দেখাচ্ছেন, মানুষ প্রায়ই গুরুতর অপরাধের থেকে নিজেদের নৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, বিশেষ করে যখন সেই অপরাধ তাদের সামাজিক মাপকাঠির সাথে সাংঘর্ষিক হয়। এটা ফ্রয়েডের প্রতিরক্ষা কৌশলের (defense mechanism) সাথেই সম্পর্কিত (এক্ষেত্রে যুক্তিসিদ্ধকরণ (rationalization) ও স্থানান্তর (displacement) )। আর অনেকে তো ভিক্টিম ব্লেইমিং-এর (victim blaming) দিকেই চলে যান, আলবের্তো মেলুচ্চির (Alberto Melucci) মতো সমাজবিজ্ঞানী যেমন দেখাচ্ছেন, সমাজে দোষারোপ প্রায়ই স্থানান্তরিত হয় শিকারের দিকে, যাতে অপরাধকে সহজে ন্যায্য বলে মনে হয়। আর যদি সমাজের একটা বড় অংশ ব্লগার হত্যা, মাজার ভাঙার মত ব্যাপারগুলোতে সমর্থন দেয়, তখন সলোমন অ্যাশের (Solomon Asch) কনফর্মিটি পরীক্ষা (conformity experiment) বলছে, মানুষ প্রায়ই নিজের নৈতিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু হলেও, সামাজিক মাপকাঠি বা গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের সাথে একমত হওয়ার চেষ্টা করবে। সব মিলিয়ে মানুষ সবসময় ডিঅন্টোলজিকাল আলাপকে ফলাফলবাদী-উপযোগবাদী আলাপে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখাবেই।

দ্বিতীয়ত, ইমানুয়েল কান্ট দুটো নীতির ভিত্তিতে ডিঅন্টোলজিকাল এথিক্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন : সার্বজনীনতার নীতি – আমি নিজের সাথে যেমন আচরণ চাইব না, অন্যদের ক্ষেত্রেও তেমনটা চাইব না; মানবতার নীতি – মানুষকে মাধ্যম নয়, লক্ষ্য ধরতে হবে। মানুষকে কখনও কম্প্রোমাইজেবল ধরা যাবে না, মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন সত্তা বলেই সবসময় মানুষের স্বায়ত্তশাসন, মানুষের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। এখানে কান্টও জানতেন যে, একটা ক্ষেত্রে এই দুটো নীতি লঙ্ঘনের সম্ভাবনা আছে, তা হলো ঈশ্বরের প্রসঙ্গে। ঈশ্বরের বিধান যেখানে সামনে আসে সেখানে মানুষ নিজে তার বিধান লঙ্ঘন করলে নিজেকেই হত্যা করতে পারে বলে সার্বজনীন নীতি খাটে না, আর ঈশ্বরের বিধানের জন্য মানুষ মানুষকেই বধযোগ্য (executable) ভাবতে পারে বলে মানবতার নীতিও খাটবে না। (ব্লগার হত্যা, মাজার ভাঙ্গা দুটো ক্ষেত্রেই এই ডিঅন্টোলজিতে এই ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারটা প্রযোজ্য হচ্ছে)। আর সেজন্য কান্টও মুতাযিলা তাত্ত্বিকদের মতই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, ঈশ্বর নিজেও নৈতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে নন, ঈশ্বর নৈতিক নিয়মের অধীন। এই জায়গাতেই মুতাযিলা তাত্ত্বিকরা যেখানে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে একটা ন্যায়ের সিস্টেমে ফেলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, মানুষের স্বায়ত্তশাসনে জোর দিতে পেরেছিলেন, কান্ট-ও সেটা করতে সক্ষম হন। মানবাধিকারকে নীতিবিদ্যার কেন্দ্রে স্থাপন করতে পারেন, যা আধুনিক বিচারব্যবস্থার গঠনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এদিকে বর্তমান ইসলামী আলোচনায় মুতাযিলা একরকম নিষিদ্ধ ধারণা, কারণ এদের মতে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে একটা ন্যায়ের সিস্টেমে ফেলাটাই ছিল ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে সংকুচিত করা।

আমার কথা হচ্ছে, উপরের এই দুটো পয়েন্টের জন্য আমাদের দেশের লোকেরা সবসময়ই ডিঅন্টোলজিতে, মানবাধিকারের প্রশ্নে অনীহা দেখাবে। মানুষ বারবার বিচারের বা নীতির ক্ষেত্রে মানুষের গুরুত্বকেই ভুলে যাবে, মানবাধিকারকে তাচ্ছিল্য করবে। এখানে যদি তাদের মধ্যে ডিঅন্টোলজি প্রতিষ্ঠা করতে হয়, আমার মতে উপরে উল্লেখ করা প্রথম পয়েন্টের ক্ষেত্রে মানুষের অধিকারের গুরুত্বগুলোকে তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ফলবাদী-উপযোগবাদী যুক্তিগুলো ব্যবহার করে মানবাধিকারের গুরুত্ব কনটেক্সচুয়ালাইজ (contextualize) করে প্রচার করা যেতে পারে। এখানে সামনে আনা হবে যে, বিচারবহির্ভূত হত্যা নিজেই সব মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলছে, আইনশৃঙ্খলাকে ঝুঁকিতে ফেলছে, আইনের প্রতি আস্থা নষ্ট করছে বলে কোন ব্যক্তি অনেক খারাপ চরিত্রের হলেও, ধর্মের সমালোচনা করলেও মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, কেউ বধযোগ্য হতে পারে না। মাজারের সাথে সম্পর্কিত অনেক খারাপ দিক থাকলেও, এটা সমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্য, স্থিতিশীলতার জন্য, সমাজে সমতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, সম্পত্তির অধিকার (property rights) রক্ষা করতে হবে, তাই মাজার ভাঙ্গা যাবে না। মানে মানবাধিকারকে কেবল কান্টের সার্বজনীনতার নীতি বা মানবতার নীতির অধীনে না রেখে তাকে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে কনটেক্সচুয়ালাইজ করতে হবে, কারণ প্রথম পয়েন্ট অনুযায়ী মানুষ আল্টিমেটলি সেই প্রবণতাই দেখায়। আর দ্বিতীয় পয়েন্টের ক্ষেত্রে বলা যায়, মানুষের স্বায়ত্তশাসন মানুষের অচেতন অংশ থেকেও অন্তত ধর্ম সম্পর্কিত ব্যাপারে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাই ধর্মতাত্ত্বিক ভাবেও মানুষের মানবাধিকার, মানুষের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ, কাজকর্ম, প্রচারণার দরকার আছে, যাতে ধর্মাবলম্বীদের মনের সচেতন (conscious) বা অচেতন (unconscious) স্তর থেকেও মানবাধিকারের প্রসঙ্গে অনীহাটা কমে যায়।


তথ্যসূত্র

  • Kant, I. (1785). Groundwork of the metaphysics of morals. Cambridge University Press.
  • Kant, I. (1797). The metaphysics of morals. Cambridge University Press.
  • Mill, J. S. (1863). Utilitarianism. Parker, Son, and Bourn.
  • Geertz, C. (1973). The interpretation of cultures. Basic Books.
  • Geertz, C. (1983). Local knowledge: Further essays in interpretive anthropology. Basic Books.
  • Bandura, A. (1999). Moral disengagement in the perpetration of inhumanities. Personality and Social Psychology Review, 3(3), 193–209. https://doi.org/10.1207/s15327957pspr0303_3
  • Freud, A. (1937). The ego and the mechanisms of defense. International Universities Press.
  • Melucci, A. (1996). Challenging codes: Collective action in the information age. Cambridge University Press.
  • Asch, S. E. (1956). Studies of independence and conformity: A minority of one against a unanimous majority. Psychological Monographs: General and Applied, 70(9), 1–70. https://doi.org/10.1037/h0093718
  • Fakhry, M. (1991). Ethical theories in Islam. Brill.
  • Hourani, G. (1985). Islamic rationalism: The ethics of ‘Abd al-Jabbar. Oxford University Press.

One thought on “মাজার ভাঙা, মানুষের অধিকার, ইমানুয়েল কান্ট ও দুটো বিশেষ বিবেচনা

  • A Proud Kafir

    Most Important Writing….!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *