লালসালু – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
সূচিপত্র
লেখক পরিচিতি
লালসালু বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। এর লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (আগস্ট ১৫, ১৯২২ – অক্টোবর ১০, ১৯৭১) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাশিল্পী। কল্লোল যুগের ধারাবাহিকতায় তার আবির্ভাব হলেও তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতায় পরিশ্রুত নতুন কথাসাহিত্য বলয়ের শিলান্যাস করেন। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উত্তরসূরি এই কথাসাহিত্যিক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করলেও বিষয়, কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গিতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন।
০১. শস্যহীন জনবহুল এ-অঞ্চল
শস্যহীন জনবহুল এ-অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশটাকে পর্যন্ত যেন সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে। ঘরে কিছু নেই। ভাগাভাগি, লুটালুটি আর স্থান বিশেষে খুনাখুনি করে সর্বপ্রচেষ্টার শেষ। দৃষ্টি বাইরের পানে, মস্ত নদীটির ওপারে, জেলার বাইরে— প্রদেশেরও! হয়তো-বা আরো দূরে। যারা নলি বানিয়ে ভেসে পড়ে তাদের দৃষ্টি দিগন্তে আটকায় না। জ্বালাময়ী আশা; ঘরে হা-শূন্য মুখথোবড়ানো নিরাশা বলে তাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রখরতা। দূরে তাকিয়ে যাদের চোখে আশা জ্বলে তাদের আর তর সয়না, দিনমানক্ষণের সবুর ফাঁসির শামিল। তাই তারা ছোটে, ছোটে।
অন্য অঞ্চল থেকে গভীর রাতে যখন ঝিমধরা রেলগাড়ি সর্পিল গতিতে এসে পৌঁছয় এ-দেশে তখন হঠাৎ আগাগোড়া তার দীর্ঘ দেহে ঝাঁকুনি লাগে, ঝনঝন করে ওঠে লোহালক্কড়। রাতের অন্ধকারে লণ্ঠন জ্বালানো ঘুমন্ত কত স্টেশন পেরিয়ে এসে এইখানে নিদ্রাচ্ছন্ন ট্রেনটির সমস্ত চেতনা জেগে সজারুকাঁটা হয়ে ওঠে। তাছাড়া এদের বহির্মুখ উন্মত্ততা আগুনের হল্কার মতো পুড়িয়ে দেয় দেহ। রেলগাড়ির খুপরিগুলো থেকে আচমকা-জেগে-ওঠা যাত্রীরা কেউ-বা ভয় পেয়ে কেউ-বা অপরিসীম কৌতূহলে মুখ বাড়ায়, দেখে আবছা-অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে থাকা লোকদের। কোথায় যাবে তারা? কিসের এত উন্মত্ততা, কিসের এত অধীরতা? এ-লাইনে যারা নোতুন তারা চেয়ে-চেয়ে দেখে। কিন্তু এরা ছোটে। ছোটে আর চিৎকার করে। গাড়ির এ-মাথা থেকে ও-মাথা। ইতিমধ্যে আত্মীয়স্বজন, জানপছানের লোক হারিয়ে যায়। কারো জামা ছেঁড়ে, কারো টুপিটা অন্যের পায়ের তলায় দুমড়ে যায়। কারো-বা আসল জিনিসটা, অর্থাৎ বদনাটা—যা না হলে বিদেশে এক পা চলে না—কী করে আলগোছে হারিয়ে যায়। হারাবে না কেন? দেহটা গেলেই হয়—এমন একটা মনোভাব নিয়ে ছুটোছুটি করলে হারাবেই তো। অনেকের অনেক সময় গলায় ঝোলানো তাবিজের থোকাটা ছাড়া দেহে বিন্দুমাত্র বস্ত্র থাকে না শেষ পর্যন্ত। তারা অবশ্য বয়সে ছোকরা। বয়স হলে এরা আর কিছু না হোক শক্ত করে গিরেটা দিতে শেখে।
অজগরের মতো দীর্ঘ রেলগাড়ির কিন্তু ধৈর্যের সীমা নেই। তার দেহ ঝনঝন করে লোহালক্কড়ের ঝঙ্কারে, উত্তাপলাগা দেহ কেঁপে-কেঁপে ওঠে, কিন্তু হঠাৎ উঠে ছুটে পালায় না। দেহচ্যুত হয়ে অদূরে অস্পষ্ট আলোয় ইঞ্জিনটা পানি খায়। পানি খায় ঠিক মানুষের মতোই। আর অপেক্ষা করে। ধৈর্য্যের কাঁটা নড়ে না।
কেনই বা নড়বে? নিশুতি রাতে যে-দেশে এসে পৌঁছেছে সে-দেশে এখন অন্ধকারে ঢাকা থাকলেও সে জানে যে, তাতে শস্য নেই। বিরান মাঠ, সরভাঙ্গা পাড় আর বন্যাভাসানো ক্ষেত। নদীগহ্বরেও জমি কম নেই।
সত্যি শস্য নেই। যা আছে তা যৎসামান্য। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি। ভোরবেলায় এত মক্তবে আর্তনাদ ওঠে যে, মনে হয় এটা খোদাতা’লার বিশেষ দেশ। ন্যাংটা ছেলেও আমসিপারা পড়ে, গলা ফাটিয়ে মৌলবীর বয়স্ক গলাকে ডুবিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে পড়ে। গোঁফ উঠতে না উঠতেই কোরান হেফ্জ করা সারা। সঙ্গে সঙ্গে মুখেও কেমন—একটা ভাব জাগে। হাফেজ তারা। বেহেশতে তাদের স্থান নির্দিষ্ট।
কিন্তু দেশটা কেমন মরার দেশ। শস্যশূন্য। শস্য যা-বা হয় তা জনবহুলতার তুলনায় যৎসামান্য। সেই হচ্ছে মুশকিল। এবং তাই খোদার পথে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসার চেতনায় যেমন একটা বিশিষ্ট ভাব ফুটে ওঠে, তেমনি না খেতে পেয়ে চোখে আবার কেমন-একটা ভাব জাগে। জীর্ণদেহ নরম হয়ে ওঠে, আর স্বাভাবিক সরুগলা কেরাতের সময় মধু ছড়ালেও এদিকে দীনতায় আর অসহায়তায় ক্ষীণতর হয়ে ওঠে। তাতে দিন-কে-দিন ব্যথা-বেদনা আঁকিবুঁকি কাটে। শীর্ণ চিবুকের আশে-পাশে যে ক-টা ফিকে দাড়ি অসংযত দৌর্বল্যে ঝুলে থাকে তাতে মাহাত্ম ফোটাতে চায়, কিন্তু ক্ষুধার্ত চোখের তলে চামড়াটে চোয়ালের দীনতা ঘোচে না। কেউ কেউ আরো আশা নিয়ে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ে। বিদেশে গিয়ে পোকায় খাওয়া মস্ত মস্ত কেতাব খতম করে। কিন্তু কেতাবে যে বিদ্যে লেখা তা কোন এক বিগত যুগে চড়ায় পড়ে আটকে গেছে। চড়া কেটে সে-বিদ্যেকে এত যুগ অতিক্রম করিয়ে বর্তমান স্রোতের সঙ্গে মিশিয়ে দেবে এমন লোক আবার নেই। অতএব কেতাবগুলোর বিচিত্র অক্ষরগুলো দূরান্ত কোনো এক অতীতকালের অরণ্যে আর্তনাদ করে।
তবু আশা, কত আশা। খোদাতা’লার ওপর প্রগাঢ় ভরসা। দিন যায় অন্য এক রঙিন কল্পনায়। কিন্তু ক্ষুধার্ত চোখ বৈরীভাবাপন্ন ব্যক্তিসুখ-উদাসীন দুনিয়ার পানে চেয়ে-চেয়ে আরো ক্ষয়ে আসে। খোদার এলেমে বুক ভরে না তলায় পেট শূন্য বলে। মসজিদের বাঁধানো পুকুরপাড়ে চৌকোণো পাথরের খণ্ডটার ওপর বসে শীতল পানিতে অজু বানায়, টুপিটা খুলে তার গহ্বরে ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে আবার পরে। কিন্তু শান্তি পায় না। মন থেকে-থেকে খাবি খায়, দিগন্তে ঝলকানো রোদের পানে চেয়ে চোখ পুড়ে যায়।
এরা তাই দেশ ত্যাগ করে। ত্যাগ করে সদলবলে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নলি বানিয়ে জাহাজের খালাসি হয়ে ভেসে যায়, কারখানার শ্রমিক হয়, বাসাবাড়ির চাকর, দফতরির এটকিনি, ছাপাখানার মেশিনম্যান, টেনারিতে চামড়ার লোক। কেউ মসজিদে ইমাম হয়, কেউ মোয়াজ্জিন। দেশময় কত সহস্র মসজিদ। কিন্তু শহরের মসজিদ, শহরতলির মসজিদ—এমন কি গ্রামে-গ্রামে মসজিদগুলো পর্যন্ত আগে থেকে দখল হয়ে আছে। শেষে কেউ-কেউ দূরদূরান্তে চলে যায়। হয়তো বাহে-মুলুকে, নয়তো মনিদের দেশে। দূর-দূর গ্রামে—যে-গ্রামে পৌঁছতে হলে, কত চড়া-পড়া শুষ্ক নদী পেরোতে হয়, মোষের গাড়িতে খড়ের গাদায় ঘুমোতে হয় কত রাত। গারো পাহাড়ে দুর্গম অঞ্চলে কে কবে বাঁশের মসজিদ করেছিল—সেখানেও।
এক সরকারী কর্মচারী সেখানে হয়তো একদিন পায়ে বুট এঁটে শিকারে যায়। বাইরে বিদেশী পোশাক, মুখমণ্ডলও মসৃণ। কিন্তু আসলে ভেতরে মুসলমান। কেবল নোতুন খোলসপরা নব্য শিক্ষিত মুসলমান।
সে এ-দুর্গম অঞ্চলে মিহি কণ্ঠের আজান শুনে চমকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তার শিকারের আশাও কিছু দমে যায়।
পরের মৌলভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে বনবাসে দিন কাটানোর ফলে লোকটার চোখেমুখে নিঃসঙ্গতার বন্য শূন্যতা।
–আপনার দৌলতখানা?
শিকারি বলে।
–আপনার নাম?
নাম শুনে মৌলভীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাছাড়া মুহূর্তে খোদার দুনিয়া চোখের সামনে আলোকিত হয়ে ওঠে।
শিকারিও পাল্টা প্রশ্ন করে। বাড়ির কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ মৌলভীর মনে স্মৃতি জাগে। কিন্তু সংযত হয়ে বলে, এধারের লোকদের মধ্যে খোদাতা’লার আলোর অভাব। লোকগুলো অশিক্ষিত, কাফের। তাই এদের মধ্যে আলো ছড়াতে এসেছে। বলে না যে, দেশে শস্য নেই, দেশে নিরন্তর টানাটানি, মরার খরা।
দূর জঙ্গলে বাঘ ডাকে। ক্বচিৎ কখনো হাতিও দাবড়ে-কুঁদে নেমে আসে। কিন্তু দিনে পাঁচ-পাঁচবার দীর্ঘ শালগাছ ছাড়িয়ে একটা ক্ষীণগলা জাগে—মৌলবীর গলা। বুনো ভারি হাওয়ায় তার হাল্কা ক-গাছি দাড়ি ওড়ে এবং গভীর রাতে হয়তো চোখের কোণটা চকচক করে ওঠে বাড়ির ভিটেটার জন্যে।
কিন্তু সেটা শিকারির কল্পনা। আস্তানায় ফিরে এসে বন্দুদের নল সাফ করতে করতে শিকারি কল্পনা করে সে-কথা, তবে নোতুন এক আলোর ঝলকে মৌলবীর চোখ যে দীপ্ত হয়ে ওঠে সে কথা জানে না; ভাবতেও পারে না হয়তো।
০২. একদিন শ্রাবণের শেষাশেষি
একদিন শ্রাবণের শেষাশেষি নিরাক পড়েছে। হাওয়াশূন্য স্তব্ধতায় মাঠপ্ৰান্তর আর বিস্তৃত ধান ক্ষেত নিথর, কোথাও একটু কম্পন নেই। আকাশে মেঘ নেই। তামাটে নীলাভ রঙ দিগন্ত পর্যন্ত স্থির হয়ে আছে।
এমনি দিনে লোকেরা ধানক্ষেতে নৌকা নিয়ে বেরোয়। ডিঙ্গিতে দু-দুজন করে, সঙ্গে কেঁচ-জুতি। নিম্পন্দ ধান-ক্ষেতে প্ৰগাঢ় নিঃশব্দত। কোথাও একটা কাক আর্তনাদ করে উঠলে মনে হয়। আকাশটা বুঝি চটের মতো চিরে গেলো। অতি সন্তৰ্পণে ধানের ফাঁকে ফাঁকে তারা নৌকা চালায়; ঢেউ হয় না, শব্দ হয় না। গলুই-এ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একজন–চোখে ধারালো দৃষ্টি। ধানের ফাকে ফাকে সাপের সর্পিল সূক্ষ্মগতিতে সে-দৃষ্টি একেবেঁকে চলে।
বিস্তৃত ধানক্ষেতের এক প্ৰান্তে তাহের-কাদেরও আছে। তাহের দাঁড়িয়ে সামনে–চোখে তার তেমনি শিকারীর সূচাগ্র একাগ্ৰতা। পেছনে তেমনি মূর্তির মতো বসে কাদের ভাই-এর ইশারার অপেক্ষায় থাকে। দাড় বাইছে, কিন্তু এমন কৌশলে যে, মনে হয় নীচে পানি নয়, তুলো।
হঠাৎ তাহের ঈষৎ কেঁপে উঠে মুহুর্তে শক্ত হয়ে যায়। সামনের পানে চেয়ে থেকেই পেছনে আঙল দিয়ে ইশারা করে। সামনে, বায়ে। একটু বাঁয়ে ক-টা শীষ নড়ছে–নিরাকপড়া বিস্তৃত ধানক্ষেতে কেমন স্পষ্ট দেখায় সে-নড়া। আরো বায়ে। সাবধান, আস্তে। তাহেরের আঙলি অদ্ভুত ক্ষিপ্ৰতায় এসব নির্দেশই দেয়।
ততক্ষণে সে পাশ থেকে আলগোছে কোঁচটা তুলে নিয়েছে। নিতে একটু শব্দ হয়নি। হয়নি তার প্রমাণ, ধানের শীষ এখনো ওখানে নড়ছে। তারপর কয়েকটা নিশ্বাসরুদ্ধ-করা মুহুর্ত। দূরে যে-কটা নৌকা ধান-ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে এমনি নিঃশব্দে ভাসছিল, সেগুলো থেমে যায়। লোকেরা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধনুকের মতো টান হয়ে ওঠা তাহেরের কালে দেহটির পানে। তারপর দেখে, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো সে-কালে দেহটির উধ্বাংশ কেঁপে উঠল, তীবোর মতো বেরিয়ে গেলো একটা কোঁচা। সা-ঝাক্।
একটু পরে একটা বৃহৎ রুই মুখ হাঁ করে ভেসে ওঠে।
আবার নৌকা চলে। ধীরে ধীরে, সন্তৰ্পণে।
এক সময় ঘুরতে ঘুরতে তাহেরদের নৌকা মতিগঞ্জের সড়কটার কাছে এসে পড়ে। কাদের পেছনে বসে তেমনি নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাহেরের পানে তাঁর আঙলের ইশারার জন্যে। হঠাৎ এক সময়ে দেখে, তাহের সড়কের পানে চেয়ে কী দেখছে, চোখে বিস্ময়ের ভাব। সেও সেদিকে তাকায়। দেখে, মতিগঞ্জের সড়কের ওপরেই একটি অপরিচিত লোক আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, শীর্ণ মুখে ক-গাছি দাড়ি, চোখ নির্মীলিত। মুহুর্তের পর মুহুর্ত কাটে, লোকটির চেতনা নেই। নিরাকপড়া আকাশ যেন তাকে পাথরের মূর্তিতে রূপান্তরিত করেছে।
কাদের আর তাহের অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে। মাছকে সতর্ক করে দেবার ভয়ে কথা হয় না, কিন্তু পাশেই একবার ধানের শীষ স্পষ্টভাবে নড়ে ওঠে, ঈষৎ আওয়াজও হয়–সেদিকে দৃষ্টি নেই।
এক সময়ে লোকটি মোনাজাত শেষ করে। কিছুক্ষণ কী ভেবে ঝট করে পাশে নামিয়ে রাখা পুটুলিটা তুলে নেয়। তারপর বড় বড় পা ফেলে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকে। উত্তর দিকে খানিকটা এগিয়ে মহব্বতনগর গ্ৰাম। তাহের ও কাদেরের বাড়ি সেখানে।
অপরাহ্নের দিকে মাছ নিয়ে দু-ভাই বাড়ি ফিরে দেখে খালেক ব্যাপারীর ঘরে কেমন একটা জটিল। সেখানে গ্রামের লোকেরা আছে, তাদের বাপিও আছে। সকলের কেমন গম্ভীর ভাব, সবার মুখ চিন্তায় নত। ভেতরে উঁকি মেরে দেখে, একটু আলগা হয়ে বসে আছে সেই লোকটা–নৌকা থেকে মতিগঞ্জের সড়কের ওপর তখন তাকে মোনাজাত করতে দেখেছিল। রোগ লোক, বয়সের ধারে যেন চোয়াল দুটো উজ্জল। চোখ বুজে আছে। কোটরগত নিমীলিত সে চোখে একটুও কম্পন নেই।
এভাবেই মজিদের প্রবেশ হলো মহব্বতনগর গ্রামে। প্রবেশটি নাটকীয় হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু গ্রামের লোকেরা নাটকের পক্ষপাতী। সরাসরি মতিগঞ্জের সড়ক দিয়ে যে গ্রামে এসে ঢুকবে তার চেয়ে বেশী পছন্দ হবে তাকে, যে বিলটার বড় অশ্বত্থ গাছ থেকে নেমে আসবে। মজিদের আগমনটা তেমনি চমকপ্ৰদ।। চমকপ্ৰদ এই জন্যে যে, তার আগমন মুহুর্তে সমগ্ৰ গ্ৰামকে চমকে দেয়। শুধু তাই নয়, গ্রামবাসীদের নিবুদ্ধিতা সম্পর্কে তাদের সচেতন করে দেয়, অনুশোচনায় জর্জরিত করে দেয় তাদের অন্তর।
শীর্ণ লোকটি চীৎকার করে গালাগাল করে লোকদের। খালেক ব্যাপারী ও মাতব্বর রেহান আলী ছিল। জোয়ান মদ্দ কালু মতি, তারাও ছিল। কিন্তু লজ্জায় তাদের মাথা হেঁট। নবাগত লোকটির কোটরাগত চোখে আগুন।
–আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ। মোদচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?
গ্ৰাম থেকে একটু বাইরে একটা বৃহৎ বাঁশঝাড়। মোটাসোটা হলদে তার গুঁড়ি। সেই বাঁশঝাড়ের ক-গজ ওধারে একটা পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে গাছপালা। যেন একদিন কার বাগান ছিল সেখানে। তারই একাধারে টালখাওয়া ভাঙা এক প্ৰাচীন কবর। ছোট ছোট ইটগুলো বিবৰ্ণ শ্যাওলায় সবুজ, যুগযুগের হাওয়ায় কালচে। ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো। শেয়ালের বাসা হয়তো। ওরা কী করে জানবে যে, ওটা মোদাচ্ছের পীরের মাজার?
সভায় অশীতিপর বৃদ্ধ সলোমানের বাপিও ছিল। হাঁপানির রোগী। সে দম খিঁচে লজ্জায় নত করে রাখে চোখ।
-আমি ছিলাম গারো পাহাড়ে, মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ।–মজিদ বলে। বলে যে, সেখানে সুখে শান্তিতেই ছিল। গোলাভরা ধান, গরু-ছাগল। তবে সেখানকার মানুষরা কিন্তু অশিক্ষিত বর্বর। তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ খোদার আলো ছড়াবার জন্যেই আমন বিদেশ বিভু-এ সে বসবাস করছিল। তারা বর্বর হলে কী হবে, দিল তাদের সাচ্চা, খাঁটি সোনার মতো। খোদা-রসুলের ডাক একবার দিলে পৌঁছে দিতে পারলে তারা বেচাইন হয়ে যায়। তাছাড়া তাদের খাতির-যত্ন ও স্নেহ-মমতার মধ্যে বেশ দিন কাটছিল; কিন্তু সে একদিন স্বপ্ন দেখে। সে-স্বপ্নই তাকে নিয়ে এসেছে এত দূরে। মধুপুর গড় থেকে তিন দিনের পথ সে দুৰ্গম অঞ্চলে মজিদ যে বাড়ি গড়ে তুলেছিল তা নিমেষের মধ্যে ভেঙে ছুটে চলে এসেছে।
লোকেরা ইতিমধ্যে বার-কয়েক শুনেছে সে-কথা, তবু আবার উৎকর্ণ হয়ে ওঠে।
– উনি একদিন স্বপ্নে ডাকি বললেন…
বলতে বলতে মজিদের কোটরগত ক্ষুদ্র চোখ দুটো পানিতে ছাপিয়ে ওঠে।
গ্রামের লোকগুলি ইদানীং অবস্থাপন্ন হয়ে উঠেছে। জোতজমি করেছে, বাড়িঘর করে গরু ছাগল আর মেয়েমানুষ পুষে চড়াই-উতরাই ভাব ছেড়ে ধীরস্থির হয়ে উঠেছে, মুখে চিকনাই হয়েছে। কিন্তু খোদার দিকে তাদের নজর কম। এখানে ধানক্ষেতে হাওয়া গান তোলে বটে। কিন্তু মুসল্লীদের গলা আকাশে ভাসে না। গ্রামের প্রান্তে সেই জঙ্গলের মধ্যে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বুকে ঝোলানো তামার দাঁত-খিলাল দিয়ে দাঁতের গহবর খোঁচাতে খোঁচাতে মজিদ সেদিন সে-কথা স্পষ্ট বুঝেছিল। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও বুঝেছিল যে, দুনিয়ায় সচ্ছলভাবে দু’বেল খেয়ে বঁচবার জন্যে যে-খেলা খেলতে যাচ্ছে সে-খেলা সাংঘাতিক। মনে সন্দেহ ছিল, ভয়ও ছিল। কিন্তু জমায়েতের অধোবদন চেহারা দেখে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল অন্তর! হঠাপানি-রোগগ্ৰস্ত অশীতিপর বুদ্ধের চোখের পানে চেয়েও তাতে লজ্জা ছাড়া কিছু দেখেনি।
জঙ্গল সাফ হয়ে গেলে। ইট-সুরকি নিয়ে সেই প্ৰাচীন কবর সদ্যমৃত কোনো মানুষের কবরের মতো নোতুন দেহ ধারণ করল। ঝালরওয়ালা সালু দ্বারা আবৃত হলো মাছের পিঠের মতো সে কবর। আগরবাতি গন্ধ ছড়াতে লাগল, মোমবাতি জ্বলতে লাগল। রাতদিন। গাছপালায় ঢাকা স্থানটি আগে স্যাঁতসেঁতে ছিল, এখন রোদ পড়ে খটখাটে হয়ে উঠল। হাওয়ারও ভাপসা গন্ধ খড়ের মতে শুষ্ক হয়ে উঠল।
এ-গ্ৰাম সে-গ্রাম থেকে লোকেরা আসতে লাগল। তাদের মৰ্মদ্ভদ কান্না, অশ্রুসজল কৃতজ্ঞতা, আশার কথা, ব্যর্থতার কথা সালুতে আবৃত মাছের পিঠের মতো অজ্ঞাত ব্যক্তির সেই কবরের কোলে ব্যক্ত হতে লাগল দিনের পর দিন। তার সঙ্গে পয়সা–ঝকঝকে পয়সা, ঘষা পয়সা, সিকি-দুয়ানি-আধুলি, সাচ্চ টাকা, নকল টাকা ছড়াছড়ি যেতে লাগল।
ক্ৰমে ক্ৰমে মজিদের ঘরবাড়ি উঠল। বাহির ঘর, অন্দর ঘর, গোয়াল ঘর, আওলাঘর। জমি হলো, গৃহস্থালী হলো। নিরাকপড়া শ্রাবণের সেই হাওয়া-শূন্য স্তব্ধ দিনে তাঁর জীবনের যে নোতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল, মাছের পিঠের মতো সালু কাপডে আবৃত নশ্বর জীবনের প্রতীকটির পাশে সে জীবন পদে পদে এগিয়ে চলল। হয়তো সামনের দিকে, হয়তো কোথাও নয়। সে-কথা ভেবে দেখবার লোক সে নয়। বতোরঙ্গ দিনে মাগর-মগরা ধান আসে ঘরে, তাই যথেষ্ট। তথাকথিত মাজারেব পানে চেয়ে কাচিৎ কখনো সে যে ভাবিত না তা নয়। কিন্তু তারও যে বঁচবার অধিকার আছে সেই কথাটাই সে সাময়িক চিন্তার মধ্যে প্ৰধান হয়ে ওঠে। তাছাড়া গারো পাহাড়ের শ্রমক্লান্ত হাড় বোবকরা দিনের কথা স্মরণ হলে সে শিউরে ওঠে। ভাবে, খোদাব বান্দা সে নির্বোধ ও জীবনের জন্যে অন্ধ। তার ভুলভ্রান্তি তিনি মাফ কবে দেবেন। তাঁর করুণা অপার, সীমাহীন।
একদিন মজিদ বিয়েও করে। অনেকদিন থেকে আলি-বালি একটি চওড়া বেওয়া মেয়েকে দেখছিল। দেহে যৌবন যেন ব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে, বিশাল তার রূপ। দূর থেকে আবছা আবছা তার প্রশস্ত দেহ দেখে শীর্ণ মজিদ জ্বলে উঠেছিল।
শেষে সেই প্ৰশস্ত ব্যাপ্ত-যৌবন মেয়েলোকটিই বিবি হয়ে তার ঘরে এল। নাম রহীমা। সত্যি সে লম্বা-চওড়া মানুষ! হাড়-চওড়া মাংসল দেহ। শীঘ্ৰ দেখা গেলো, তার শক্তিও কম নয়। বড় বড় হাঁড়ি সে অনায়াসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তুলে নিয়ে যায়, গোয়ার ধামড়া গাইকেও স্বচ্ছন্দে গোয়াল থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। হাঁটে যখন, মাটিতে আওয়াজ হয়, কথা কয় যখন, মাঠ থেকে শোনা যায় গলা।
তবে তার শক্তি, তার চওড়া দেহ–যে-দেহ দূর থেকে আলি-ঝালি দেখে মজিদের বুকে আগুন ধরেছিল–তা বাইরের খোলস মাত্র। আসলে সে ঠাণ্ডা, ভীতু মানুষ। দশ কথায় রা নেই, রক্তে রাগ নেই। মজিদের প্রতি তার সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভয়। শীর্ণ মানুষটির পেছনে মাছের পিঠের মতো মাজারটির বৃহৎ ছায়া দেখে।
ও যখন উঠানে হাঁটে তখন মজিদ চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর মধুর হেসে আস্তে মাথা নেড়ে বলে,
—আমন করি হাটতে নাই।
থমকে গিয়ে রহীমা তার দিকে তাকায়।
মজিদ বলে,—অমন করি হাঁটতে নাই বিবি, মাটি-এ গোস্ব করে। এই মাটিতেই তো একদিন ফিরি যাইবা–থেমে আবার বলে, মাটিরে কষ্ট দেওন গুণাহ্।
এ-কথা আগেও শুনেছে রহীমা। মুরুব্বীরা বলেছে, বাড়ির আত্মীয়ারা বলেছে। মজিদের কথায় বাইরে সালু কাপড়ে আবৃত মাজারটির কথা স্মরণ হয়।
মজিদ নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখে, রহীমার চোখে ভয়।
মধুরভাবে হেসে আবার বলে,—অমন করি কখনো হাঁটিও না। কবরে আজাব হইবে।
শক্তিমত্তা নারীর উজ্জল পরিষ্কার চোখে ঘনায়মান ভয়ের ছায়া দেখে মজিদ খুশী হয়। তারপর বাইরে গিয়ে কোরান তেলাওয়াৎ শুরু করে। গলা ভালো তার, পড়বার ভঙ্গিও মধুর। একটা চমৎকার সুরে সারা বাড়ি ভরে যায়। যেন হাস্নাহানার মিষ্টি মধুর গন্ধ ছড়ায়।
কাজ করতে করতে রহীমা থমকে যায়; কান পেতে শোনে। খোদাতাআলার রহস্যময় দিগন্ত তার অন্তরে যেন বিদ্যুতের মতো থেকে থেকে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। একটি অব্যক্ত ভীতিও ঘনিয়ে আসে মনে। সে খোদাকে ভয় পায়, স্বামী মসজিদকে ভয় পায়।
পুকুরে গোসল করে সিক্ত বসনে উঠানে দাঁড়িয়ে রহীমা যখন চুল ঝাড়ে তখনো চেয়ে চেয়ে দেখে মজিদ। বিছানার পাশে যে-দেহটির তাল পায় না, সে-দেহটিই এখন সিক্ত কাপড় ভেদ করে অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ওঠে। তার চোখ চকচক করে। কিন্তু রহীমার চেতনা নেই।
গলা কেশে মজিদ বলে,—খোলা জায়গায় আমন বে-শরমের মতো দাঁড়াইও না বিবি।
সচকিত হয়ে রহীমা হাত নামায়, বুকে ভালো করে আঁচল দেয়, পেছনে সাপটে থাকা কাপড় আলগা করে দিয়ে এধার-ওধারা যেন বেগান-বোগায়ের লোকের সন্ধানে তাকায়। কিন্তু ঐ তো কেবল মজিদ বসে আছে। দরজার পাশে, হাতে হুঁকা। গলা-সীসার মতো অবশেষে লজ্জা আসে রহীমার সাবা দেহে। দ্রুত পায়ে সে আড়ালে চলে যায়।
মজিদের সামনে এমনভাবে আর দাঁড়ায় না কখনো। গ্রামের লোকেরা যেন রহীমারই অন্য সংস্করণ। তাগড়া-তাগড়া দেহ–চেনে জমি আব্ব ধান, চেনে পেট। খোদার কথা নেই। স্মরণ করিয়ে দিলে আছে, নচেৎ ভুল মেরে থাকে। জমির জন্যে প্ৰাণ। সে জমিতে বর্ষণহীন খরার দিনে ফাটল ধরলে তখন কেবল স্মরণ হয় খোদাকে।
কিন্তু জমি এধারে উর্বর, চারা ছড়িয়েছে কি সোনা ফলবে। মানুষরাও পরিশ্রম করে, জমিও সে শ্রমের সম্মান দেয়। দেয় তো বুক উজাড় করে দেয়।
মাঠে গিয়ে মানুষ মেঠো হয়ে ওঠে। কখনো ঘরোয় হিংসা-বিদ্বেষের জন্যে, বা আত্মমর্যাদার ভুয়ো ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রাখবার জন্যে তারা জমিকে দাবার ছকের মতো ভাগ করে ফেলে। সে-জমিকেই আবার রক্ত দিয়ে রক্ষা করতে দ্বিধা করে না। হয়তো দুনিয়ার দূষিত আবহাওয়ার মধ্যে তারা বর্বরতার নীচতায় নেমে আসে, কিন্তু যখন জমির গন্ধ নাকে লাগে, মাটির এলেখা বড় দলগুলোর পানে চেয়ে আপন রক্তমাংসের কথা স্মরণ হয়, তখন ভুলে যায় সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ। সিপাইর খণ্ডিত ছিন্ন দেহের একতাল অর্থহীন মাংসের মতো জমিও তখন প্ৰাণের চাইতে বড়হয়ে ওঠে। খাবলা খাবল রুঠাজমি, ডোবাজমি, কাদাজমি।– ফাটলধরা জ্যৈষ্ঠের জমি–সব জমি একান্ত আপন; কোনোটার প্রতি অবহেলা নেই। যেমন সুস্থ মুমূর্ষ বা জরাজর্জর আত্মীয়জনের প্রতি দৃষ্টিভেদ থাকে না মানুষের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই তারা খাটে। হয়তো কাঠফাটা রোদ, হয়তো মুষলধারে বৃষ্টি—তারা পরিশ্রম করে চলে। অগ্রহায়ণের শীত খোলামাঠে হাড় কঁপায়, রোদ-পানি-খাওয়া মোটা কর্কশ ত্বকের ডাসা লোমগুলো পর্যন্ত জলো শীতল হওয়ায় খাড়া হয়ে ওঠে।–তবু কোমর পরিমাণ পানিতে ডুবে থাকা মাঠ সাফ করে। সযত্নে, সস্নেহে সাফ করে যত জঞ্জাল। কিন্তু জঞ্জালের আবার শেষ নেই। কার্তিকে পানি সরে এলেও কচুরিপানা জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে জমিতে। তখন আবার দল বেঁধে লেগে যায়। তারা। ভাগ্যকে ঘষে সাফ করবার উপায় নেই, কিন্তু যে-জমি জীবন, সে-জমিকে জঞ্জালমুক্ত করে ফসলের জন্যে তৈরী করে। তার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রমকে ভয় নেই। এদিকে সূৰ্য ক্রমশ দূরপথ ভ্ৰমণে বেরোয়, ঝিমিয়ে আসে তাপ, মেঘশূন্য আকাশের জমাট ঢালা নীলিমার মধ্যে শুকিয়ে ওঠে। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। তখন শুরু হয় আরেক দফা পরিশ্রম। রাত নেই দিন নেই হ’ল। দেয়। তারপর ছড়ায় চার–ছাড়াবার সময় না তাকায় দিগন্তের পানে, না। স্মরণ করে খোদাকে। এবং খোদাকে স্মরণ করে না বলেই হয়তো চারা ছড়ানো জমি শুকিয়ে কঠিন হতে থাকে। রোদ চড়া হয়ে আসে, শূন্য আকাশ বিশাল নগ্নতায় নীল হয়ে জ্বলে।পুড়ে মরে। নধর নধর হয়ে ওঠা কচি কচি ধানের ডগার পানে চেয়ে বুক কেঁপে ওঠে তাদের। তারা দল বেঁধে আবার ছোটে। তারপর রাত নেই দিন নেই বিল থেকে কেঁদে কেঁদে পানি তোলে। সামান্য ছুতোয় প্ৰতিবেশীর মাথায় দা বসাতে যাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না, তাদেরই বুক বিমৰ্ষ আকাশের তলে কচি-নধর ধান দেখে শঙ্কিত হয়ে ওঠে, মাটির তৃষ্ণায় তাদেরও অন্তর খ খ করে। রাত নেই দিন নেই, কেঁদে করে পানি তোলে—মণ-কে-মণ।
এত শ্রম এত কষ্ট, তবু ভাগ্যের ঠিকাঠিকানা নেই। চৈত্রের শেষ দিক বা বৈশাখের শুরু। ধান ওঠে-ওঠে, এমন সময়ে কোনো এক দুপুরে কালো মেঘের সাথে আসে ঝড়, আসে শিলাবৃষ্টি, হয়তো না বলে না কয়ে নিমেষেব মধ্যে ধ্বংস করে দিয়ে যায় মাঠ। কোচবিদ্ধ হয়ে নিহত ছমিরুদিনের রক্তাঙ্গুত দেহের পানে চেয়ে আবেদ-জাবেদের মনে দানবীয় উল্লাস হতে পারে, কিন্তু এখন তারা পাথর হয়ে যায়। যার একরাত্তি জমিও নেই, তারও চোখ ছলছল করে ওঠে। এবং হয়তো তখন খোদাকে স্মরণ করে, হয়তো করে না।
মাঠের প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়ে মজিদ দাঁত খিলাল করে আর সে কথাই ভাবে। কাতারে কাতারে সারবন্দী হয়ে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো কাস্তে নিয়ে মজুররা যখন ধান কাটে আর বুক ফাটিয়ে গীত গায় তখনো মজিদ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে। গলার তামার খিলাল দিয়ে দাঁতের গহবর গুতোয় আর ভাবে। কিসের এত গান, এত আনন্দ? মজিদের চোখ ছোট হয়ে আসে। রহীমার শরীরে তো এদেরই রক্ত, আর তার মতোই এরা তাগড়া, গােটাগোট্টা ও প্রশস্ত। রহীমার চোখে ভয় দেখেছে মজিদ। এরা কি ভয় পাবে না? ওদের গান আকাশে ভাসে, ঝিলমিল করতে থাকা ধানের শীষে এদের আকৰ্ণ হাসির ঝলক লাগে। ওদের খোদার ভয় নেই। মজিদও চায়, তার গোলা ভরে উঠক ধানে। কিন্তু সে তো জমিকে ধন মনে করে না, আপন রক্তমাংসের সামিল খেয়াল করে না? শ্যেন দৃষ্টিতে অবশ্য চেয়ে চেয়ে দেখে ধানকাটা; কিন্তু তাদের মতো লোম-জাগানো পুলক লাগে না তার অন্তরে। হাসি তাদের প্রাণ, এ-কথা মজিদের ভালো লাগে না। তাদের গীত ও হাসিও ভালো লাগে না। ঝালরওয়ালা সালু কাপড়ে আবৃত মাজারটিকে তাদের হাসি আর গীত অবজ্ঞা করে যেন।
জমায়েতকে মজিদ বলে, খোদাই রিজিক দেনেওয়ালা।
শুনে সালু কাপড়ের ঢাকা রহস্যময়, চিরনীরব মাজারের পাশে তারা স্তব্ধ হয়ে যায়।
মজিদ বলে, মাঠভরা ধান দেখে যাদের মনে মাটির প্রতি পূজার ভাব জাগে তারা বুত-পূজারী। তারা গুণাগার।
জমায়েত মাথা হেঁট করে থাকে।
বতোর দিন ঘুরে আসে, আবার পেরিয়ে যায়। মজিদের জমিজোত বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে সম্মানও বাড়ে। গায়ের মাতব্বর ওর কথা ছাড়া কথা কয় না; সলাপরামর্শ, আদেশ-উপদেশ, নাছিহতের জন্যে তার কাছেই আসে, চিরনীরব সালু কাপড়ে আবৃত মাজারের মুখপাত্র হিসেবে তার কথা সাগ্রহে শোনে, খরা পড়লে তারই কাছে ছুটে আসে খতম পড়বার জন্যে। খোদা রিজিক দেনেওয়ালা এ-কথা তারা আজ বোঝে। মাঠের বুকে গান গেয়ে গজব কাটানো যায় না, বোঝে। মজিদও আত্মবিশ্বাস পায়।
মজিদ সাত ছেলের বাপ দুদু মিঞাকে প্রশ্ন করে,–কলমা জানো মিঞা?
ঘাড় গুজে আধাপাকা মাথা চুলকায় দুদু মিঞা। মুখে লজ্জার হাসি।
গর্জে উঠে মজিদ বলে,–হাসিও না মিঞা।
থতামত খেয়ে হাসি বন্ধ করে দুদু মিঞা।
সাত ছেলের এক ছেলে সঙ্গে এসেছিল। সে বাপের অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসে। বাপের মাথা নত করে থাকার ভঙ্গিটা যেন গাধার ভঙ্গির মতো হয়ে উঠেছে।
চোখ কিন্তু তার পিটপিট করে। বলে,—আমি গরীব মুরুক্ষু মানুষ।
খোদাকে হয়তো সে জানে। কিন্তু জ্বলন্ত পেটের মধ্যে সব কিছু যেন বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায়। ভেতরে গনগনে আগুন, সব উড়ে যায়, পুড়ে যায়। আজ লজ্জায় মাথা নত করে রাখে–গাধার মতো পিঠে ঘাড়ে সমান।
এবার খালেক ব্যাপারী ধমকে ওঠে,–কলমা জানস না ব্যাটা?
সে আর মাথা তোলে না। ছেলেটা হাসে।
খালেক ব্যাপারী একটি মক্তব্য দিয়েছে। এরই মধ্যে একপাল ছেলেমেয়ে জুটে গেছে। ভোরে যখন কলতান করে আমসিপারা পড়ে তখন কখনো মজিদের মনে স্মৃতি জাগে। শৈশবের স্মৃতি–যে-দেশ ছেড়ে এসেছে, যে-শস্যহীন দেশ তার জন্মস্থান–সেখানে একদা এক মক্তবে এই রকম করে সে আমসিপারা পড়ত।
অবশেষে মজিদ আদেশ দেয়।
—ব্যাপাবীর মক্তবে তুমি কলম শিখবা।
ঘাড় নেড়ে তখুনি রাজি হয়ে যায় লোকটি। শেষে মুখ তুলে বোকার মতো বলে,
-গরীব মানুষ, খাইবার পাই না।
লোকটির মাথায় যেন ছিটা। যত্রতত্র কাবণ্যে-অকারণে না খেতে পাওয়ার কথাটি শোনানো অভ্যাস তার। শুনিয়ে হয়তো মানুষের সমবেদন আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু লোকে খেতে পায়, পায় না; এতে সমবেদনার কী আছে? প্রশ্ন থাকলে তো সমবেদন থাকবে। ও কী করে আমন গাধার মতো ঘাড়-পিঠ সমান করতে পারে সে-কথা। তো। কেউ জিজ্ঞেস করে না। দৃশ্যটি অবশ্য উপভোগ করে।
মজিদের পক্ষ থেকে খালেক ব্যাপারী ধমকে বলে,
—হইছে হইছে, ভাগ।
একদিন ধাড়িধাড়ি ছেলে কয়েকটি পাকড়াও করে মজিদ।
–কীরে ব্যাটা, খৎনা হইছে?
একটি ছেলে আরেকটিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,
–আর অয় নাই।
সে রেগে বলে–অরও অয় নাই।
শুনে আগুন হয়ে যায় মজিদ; বলে, পরশু দিন জুম্মাবার, সেদিন যদি দুজনেরই একসাথে খৎনা না হয়, তবে মুশকিল হবে।
একবার একটি ছেলে বলে,—হেই কবে আমার খৎনা হইছে!
তার বাপও মাথা নেড়ে সায় দেয়,–ছোট থাকতেই খৎনা দিছি। মিছা কথা না হুজুর।
কিন্তু মজিদ বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছে, ছেলেটির খৎনা হয়নি। গর্জন করে উঠে বলে,
–তোল লুঙ্গি?
বাপ আবার বলে, খোদার কসম, ওর খৎনা হইছে। কিন্তু তার কথায় কান না দিয়ে মজিদ বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে ধ্যা করে তুলে ফেলে তার লুঙ্গি। ছেলেটি পালাবার উপক্রম করছিল, থাবা দিয়ে তার ঘাড় ধরে ফেলে মজিদ। বোপও পালাই-পালাই করছিল, কিন্তু কীভাবে পালায় ভেবে না পেয়ে ওখানেই বোকার মতো চোখ মেলে বসে থাকে। খানিকক্ষণ বাপ-পুতকে একসঙ্গে গালাগাল করে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে এসে মজিদ নিজের বাইরের ঘরে খুটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। বলে,
–আজই নামাজের পর আমিই তোর খৎনা দিমু। দাড়িগোঁফ ওঠা মদ্দের মতো ছেলে ঠিরঠির করে কাঁপতে থাকে। বাপের মুখে রা নেই। শুকিয়ে সে-মুখ আমসি হয়ে গেছে।
সারাটি দুপুর কোরবানীর ছাগলের মতো খুঁটিবন্দী হয়ে থাকে। ছেলেটি। আছরের নামাজের পর মজিদ ছুরি-তেনা নিয়ে আসতেই সে তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠে কান্না জুড়ে দেয়। দেখে বাপের আর সয় না, সেও হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে। বাইরে লোক জমে গিয়েছিল। খালেক ব্যাপারীও এসেছিল ব্যাপার দেখতে। তারা ধমকাতে থাকে বাপকে।
দাঁত কড়াকড়ি করে মজিদের। মাঠে শয়তানের মতো গান যখন ধরে তখন খোদার কথা আর মনে হয় না? বুড়ো ধামড়া ছেলে, খৎনা হয়নি ভাবতেও কেমন লাগে। তওবা, তওবা! ব্যাপারীকে শুনিয়ে মজিদ বলে,
–আপনাগো দেশটা বড় জাহেলের দেশ।
ছেলের কান্না থামে না। মজিদ যখন বাঁশের কঞ্চি ছিলছে তখন সে আরেকবার তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠে বলে,
—আমার বাপেরও খৎনা অয় নাই—তানারে আগে দেন।
মজিদ বিস্ময়ে হতভম্ব। খালেক ব্যাপারীর পানে চেয়ে কয়েক মুহুর্ত নিষ্পলক হয়ে থাকে, মুখে ভাষা জোগায় না। লজ্জায় ব্যাপারীর কান পর্যন্ত লাল।
আধা ঘণ্টার মধ্যে দু-দুটো খৎনা হয়ে গেলে। ব্যাপারটা ঠিক হাটবাজারের মধ্যে যেন হলো। কারণ বাপ-বেটাকে ধরবার জন্যে লোকের প্রয়োজন ছিল বলে, এবং এসব দৃশ্য না দেখে থাকা যায় না। বলে ঘরটায় ভিড় জমে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পেছনে বেড়ার ফুটো দিয়ে দেখল পাড়ার যত মেয়েরা–ছুকরি, জোয়ান, বুড়ী। রহীমা পর্যন্ত না দেখে পারল না। স্বামীর কীর্তিতে উজ্জল হয়ে ওঠা চোখে অন্য মেয়েদের সঙ্গে সেও মুখে আঁচল দিয়ে খানিকট হাসল।
সে-রাতে দোয়া-দরুদ সেরে মাজারঘর থেকে বেরিয়ে এসে বা পাশের খোলা মাঠের পানে তাকিয়ে মজিদ কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দিগন্ত-বিস্তৃত হয়ে যে মাঠ দূরে আবছাভাবে মিলিয়ে গেছে সেখান থেকে তারার রাজ্য। ওধারের গ্রাম নিস্তব্ধ। দু-একটা পাড়ায় কেবল কুত্তা ঘেউ ঘেউ করে।
নীরবতার মধ্যে হঠাৎ মজিদ একটা শক্তি বোধ করে অন্তরে। মহকবতনগর গ্রামে সে শক্তির শিকড় গেড়েছে। আর সে-শক্তি শাখা-প্ৰশাখা মেলে সারা গ্রামকে আছন্ন করে লোকদের জীবনকে জড়িয়ে ধরেছে। সবলভাবে। প্ৰতিপত্তিশালী খালেক ব্যাপারী আছে বটে, কিন্তু তার শক্তিতে আর মজিদের শক্তিতে প্ৰভেদ আছে। আজ অপরাহ্নে যে-দুটি লোককে মজিদ কষ্ট দিয়েছে তারা নির্ভেজাল কষ্টই পেয়েছে। সে-কষ্ট পাওয়ার পেছনে ক্ৰোধ নেই, দ্বেষ নেই। আজ সেই লোকদেরই খালেক ব্যাপারী চাবুক মারুক; প্ৰতিপত্তির ভয়ে তারা মুখে রা না করলেও অন্তরে ঘনিয়ে উঠবে দ্বেষ, প্ৰতিহিংসার আগুন। মজিদের শক্তি ওপর থেকে আসে, আসে ঐ সালু কাপড়ে আবৃত মাজার থেকে। মাজারটি তার শক্তির মূল।
মজিদের সে-শক্তি প্ৰতিফলিত হয় রহীমার ওপর। মেয়েমানুষরা আসে তার কাছে। এ-গ্রামেরই মেয়ে রহীমা। ছোটবেলায় নাকে নোলক পরে হলদে শাড়ী পেচিয়ে পরে ছুটোছুটি করত–সবার মনে সে-ছবি এখনো স্পষ্ট। প্ৰথম বিয়ের সময় তারা তাকে দেখেছে, স্বামীর মৃত্যুর পরও তাকে দেখেছে। কিন্তু ওরাই আজ এসে চেনে না। কথা কয় অন্য ভাবে, গলা নরম করে সুপারিশের জন্যে ধরে। খিড়কির দরজা দিয়ে আসে তারা, এসে সন্তৰ্পণে কথা কয়। কাঁদলেও চেপে চেপে কাঁদে। বাইরে মাজার যেমন রহস্যময় তাদের কাছে, মজিদও তেমনি রহস্যময়।
মজিদ ধরা-ছোয়ার বাইরে। যোগসূত্র হচ্ছে রহীমা।
রহীমা শোনে তাদের কথা। কখনো হৃদয় গলে আসে অপরের দুঃখের কথা শুনে, কখনো ছলছল করে ওঠে চোখ। গভীর রাতে কখনো মাজারের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিনিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে মাছের পিঠের মতো স্তব্ধ, বিচিত্ৰ সেই মাজারের পানে। মাথায় কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা, দেহ নিশ্চল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লাগে, চোখ অবশ হয়ে আসে, মহাশক্তির কাছে পাছে কোনো বেয়াদপি করে বসে সে-ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। কখনো। তবু মুহুর্তের পর মুহূর্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, কোন মানুষ ওখানে ঘুমিয়ে আছেন–যাঁর রুহঃ এখনো মানুষের দুঃখ-যাতনায় কাঁদে, তাদের মঙ্গলের জন্যে আকুল হয়ে থাকে সদাসর্বদা?
কখনো কখনো অতি সঙ্গোপনে রহীমা একটা আৰ্জি জানায়। বলে তার সন্তান নেই; সন্তানশূন্য কোলটি খা-খ্যা করে। তিনি তাকে যেন একটি সন্তান দেন। আজি জানায় চোখের আকুলতায়, এদিকে ঠোঁট পর্যন্ত কঁপে না। অতি গোপন মনের কথা শিশুর সরলতায় সালুকাপড়ে ঢাকা রহস্যময় মাজারের পানে চেয়ে বলে।—না-হয় লজ্জা, নাহয়। দ্বিধা। একদিন হঠাৎ এই সময় দমকা হাওয়া ছোটে, জঙ্গলের যে কটা গাছ আজও অকতিত অবস্থায় বিরাজমান তাতে আচমকা গোঙানি ধরে। হাওয়া এসে এখানে সালু কাপড়ের প্রান্ত নাড়ে, কেঁপে ওঠা মোমবাতির আলোয় ঝলমল করে ওঠে রূপালী ঝালর। রহীমাও কেঁপে ওঠে, কী একটা মহাভয় তার রক্ত শীতল করে দেয়। মনে হয়, কে যেন কথা কইবে আকাশের মহা-তামিস্রার বুক থেকে বিচিত্র এক কণ্ঠ সহসা জেগে উঠবে। আবার স্থির হয়ে যায়, মোমবাতির শিখাও নিষ্কম্প, স্থির হয়ে ওঠে। ওপরে আকাশ-ভরা তারা তেমনি নীরব।
কোনোদিন রহীম। সারা মানবজাতির জন্যে দোয়া করে। ও-পাড়ার ছুনুর বাপ মরণরোগে যন্ত্রণা পাচ্ছে, তাকে শান্তি দাও। খেতানির মা পক্ষাঘাতে কষ্ট পাচ্ছে।—তার ওপর করুণা করে। কারা একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাতে কষ্ট পাচ্ছে তাদের ওপর করুণা করে, রহমতা করে। চার গ্রাম পরে বড় নদী। ক-দিন আগে সে নদীতে ঝড়ের মুখে ডুবে মারা গেছে ক-টি লোক। তাদের কথা স্মরণ করে বলে, ঘরে স্ত্রী-পুত্র রেখে নৌকা নিয়ে যারা নদীতে যায় তাদের ওপর যেন তোমার রহমত হয়।
অনেক সময় অদ্ভুত আৰ্জি নিয়ে মেয়েলোকেরা আসে রহীমার কাছে। যেমন আসে ধান ভাননি হাসুনির মা। বহুদিন আগে নিরাকপড়া এক শ্রাবণের দুপুরে মাছ ধরতে মতিগঞ্জের সড়কের ওপর যারা প্ৰথম মজিদকে দেখেছিল, সেই তাহের আর কাদেরের বোন হাসুনির মা। সে এসে বলে,
-আমার এক আৰ্জি।
এমন এক ভঙ্গিতে বলে যে রহীমার হাসি পায়। কিন্তু মনে মনেই হাসে, গম্ভীর হয়ে থাকে বাইরে। হাসুনির মা বলে,
-আমার আর্জি–ওনারে কইবেন, আমার যেন মওত হয়।
এবার ঈষৎ হেসে রহীমা বলে,
–ক্যান গো বিটি?
-জ্বালা আর সইহ্য হয় না বুবু। আল্লায় যেন আমারে সত্বর দুনিয়া থিক। লইয়া যায়।
সকৌতুকে রহীমা প্রশ্ন করে,
—তোমার হাসুনির কী হইব তুমি মরলে?
সেদিকে তার ভাবনা নেই। আপনা থেকেই যেন উত্তর যোগায় মুখে।
—তুমি নিবা বুবু। তোমারই হাতে সোপর্দ কইরা আমি খালাস হমু।
রাহীমা হাসে। হাতে কাঁথার কাজ। হাসে আর মাথা নত করে কঁথা সেলাই কবে।
একদিন হাসুনির মা এসে বলে,
—আমার এক আর্জি বুবু।
–কও?
-ওনারে কইবেন–বুড়াবুড়ী দুইগারে যানি দুনিয়ার থান লইয়া যায় খোদাতালা।
কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ তুলে চেয়ে রহীমা প্রশ্ন করে,
-ওইটা আবার কেমন কথা হইল?
—হ, খাঁটি কথা কইলাম বুবু। দুইটার লাঠালাঠি চুলচুলি আর ভালো লাগে না।
বুড়ো বাপ তার ঢেঙা দীর্ঘ মানুষ; মা ছোটখাটো, কেঁকড়ানো। কিন্তু দু’জনের মুখে বিষ। ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই আছে। তবে এক একদিন এমন লাগা লাগে যে, খুনখুনি হবার জোগাড়। ঢেঙা লোকটি তেড়ে আসে বারবার, ঘুণধরা হাড় কড়কড় করে। বুড়ী ওদিকে নড়েচড়ে না। এক জায়গায় বসে থেকে মাথা ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে রাজ্যের গালাগাল জুড়ে দেয়। গালাগাল দিয়ে বুড়োকে যখন বিন্দুমাত্র ঘায়েল করতে পারে না তখন শেষ অস্ত্ৰ হানে।
-ওরে মরার ব্যাটা, তুই কী ভাবছস? ভাবছস বুঝি পোলাগুলি তোর জন্মের? আল্লা সাক্ষী–হেগুলি তোর জন্মের না, তোর জন্মের না!
শুনে হাসুনির মায়ের কান লাল হয়ে ওঠে; আর আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসে।
তাহের-কাদের, আর কনিষ্ঠ ভাই রতন–তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা থাকলেও তা আবার স্বার্থের ঘেরে ঢাকা। সামান্য হলেও বাপের জমি আছে, ঘর আছে, লাঙল-গরু আছে। তার দিনও ঘনিয়ে এসেছেআর বর্ষায় টেকে। কিনা সন্দেহ। তারা চুপ করে শোনে।
অন্ধ ক্ৰোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বুড়া বাপ এগিয়ে আসে। ছেলেদের পানে চেয়ে বলে,
-হুনছস কথা, হুনছস?
ছেলেরা সমস্বরে বলে,–ঠ্যাঙা বেটিরে, ঠ্যাঙা।
সমর্থন পেয়ে বুড়ো চেলা নিয়ে দৌড়ে আসে। তাহের শেষে জমিজোতের মায়া ছেড়ে বাপের হাত ধরে ফেলে। কাদের বোঝায়,–থাক, কইবার দেও। খোদাই তার শাস্তি দিবো।
জন্মের কথা নিয়ে মায়ের উক্তি শুনে হাসুনির মায়ের কান লাল হয়ে ওঠে, কিন্তু পরে বুকে যন্ত্রণা হয়। তাই রহীমাকে এসে বলে কথাটা।
–হয় বুড়াবুড়ী দুইটাই মরুক–নয় ওনারে কন, এর একটা বিহিত করবার।
হঠাৎ সমবেদনায় রহীমার চোখ ছল ছল করে ওঠে। বলে,
—তুমি দুঃখ করিও না বিটি। আমি কমুনে।
মেয়েটাকে তার ভালোই লাগে। দুঃস্থা মেয়ে। স্বামী মারা যাবার পর থেকে বাপের বাড়িতে আছে। বাড়িতে তিন-তিনটে মর্দ ছেলে বসে বসে খায়। এক মুঠোর মতো যো-জমি, সে-জমিতে ওদের পেট ভরে না। তাই টানাটানি, আধ-পেটা খেয়ে দিন গুজরান। বসে বসে অন্ন ধ্বংস করতে লজ্জা লাগে হাসুনির মায়ের। সে তো এক নয়, তার হাসুনিও আছে। তাই বাড়িতে ধান ভানে। কিন্তু কিছু একটা মুখ ফুটে চাইতে আবার লজ্জায় মরে যায়।
রহীমা বলে,
-শ্বশুর বাড়িতে যাও না ক্যান?
—অরা মনুষ্যি না।
–নিকা করে না ক্যান?
কয়েক মুহুর্ত থেমে হাসুনির মা বলে, দিলে চায় না বুবু।
জীবনে তার আর সখ নেই। তবে গায়ের আর মানুষের রক্ত তারও দেহে বয় বলে মাঠ ভরে ধান ফললে অন্তরে তার রঙ ধরে। বতোর দিনে বাড়ি বাড়ি কাজ করে হাসুনির মায়ের ক্লান্তি নেই। মুখে বরঞ্চ চিকনাই-ই দেখা দেয়। এমনি কোনো দিনে তাহের খোশ মেজাজে
বলে,
-শরীলে রঙ ধরছে ক্যান, নিকা করবি নাকি?
বুড়ী আমের আঁটির মতো মুখটা বাড়িয়ে বলে,–খানকির বেটি নিকা করবো বলাই তো মানুষটারে খাইছে!
মানুষটা মানে তার মৃত স্বামী। তাহের কৌতুক বোধ করে। বলে, ক্যামনে খাইছস?
হাসুনির মায়ের অন্তর তখন খুশিতে টলমল। কথা গায়ে মাখে না। হেসে বলে,–গিলা খাইছি। মা-বুড়ী আছে সামনে, নইলে গিলে খাওয়ার ভঙ্গিটাও একবার দেখিয়ে দিত।
দূরে ধানক্ষেতে ঝড় ওঠে, বন্য আসে পথভোলা অন্ধ হওয়ায়, দিগন্ত থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে আসে অফুরন্ত ঢেউ। ধানক্ষেতের তাজা রঙে হাসুনির মায়ের মনে পুলক জাগে। আপন মনকেই ঠাট্টা করে বারবার শুধায় : নিকা করবি মাগি, নিকা করবি?
কিন্তু কাকে করে? ওই বাড়ির মানুষকে পেলে করে কী? তেল চকচকে জোয়ান কালো ছেলে। গলা ছেড়ে যখন গান ধরে তখন ধানের ক্ষেতে যেন ঢেউ ওঠে।
পরদিন তাহেরের বুড়ো ব্যাপকে মজিদ ডেকে পাঠায়। এলে বলে,- তোমার বিবি কী কয়?
বুড়ো ইতস্তত করে, ঘাড় চুলকে এধার-ওধার চেয়ে আমতা-আমতা করে। মজিদ ধমকে ওঠে।
-কও না ক্যান?
ধমক খেয়ে ঢোক গিলে বুড়ে বলে,–তা হুজুর ঘরের কথা আপনারে ক্যামনে কই?
কতক্ষণ চুপ থেকে মজিদ ভারী গলায় বলে,–আমি জানি কী কয়। কিন্তু তুমি কেমন মদ, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শোনো হেই কথা?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে এ কথা ঠিক নয়। তখন রাগে সে চোখে অন্ধকার দেখে, চেলা কাঠ নিয়ে ছুটে যায় বুড়ীকে শেষ করবার জন্যে। এর মধ্যে একদিন হয়তো সে শেষই হয়ে যেত—যদি না ছেলেরা এসে বাধা দিত। কিন্তু সে কথাও বলতে পারে না মজিদের সামনে। কেবল আস্তে বলে,–বুড়ীর দেমাক খারাপ হইছে হুজুর। আপনে যদি দেয়া পানি দ্যান…
আবার কতক্ষণ নীরব থেকে মজিদ বলে,
–বিবিরে কইয়া দিও, অমন কথা যদি আর কোনোদিন কয় তাইলে মছিবৎ হইব।
মাথা নেড়ে বুড়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ায়। কয়েক পা গিয়ে থামে, থেমে মাথা চুলকে বলে,—হুজুর, কোথিকা হুনলেন বেটির কথা?
–তা দিয়া তোমার দরকার কী? কিন্তু এই কথা জাইনো কোনো কথা আমার অজানা থাকে না।
সারাপথ ভাবে বুড়ে। কে বলল কথাটা? বাড়ির গায়ে আর কোনো বাড়ি নেই যে, কেউ আড়ি পেতে শুনবে।
এককালে বুড়ো বুদ্ধিমান লোকই ছিল। সারাজীবন দুষ্ট প্রকৃতির বৈমাত্ৰেয় এক ভাই-এর সাথে জায়গাজমি সম্পত্তি নিয়ে মারামারি মামলা-মকদ্দমা করে আজ সব দিক দিয়ে সে নিঃস্ব। জায়গাজমির মধ্যে আছে একমুঠো পরিমাণ জমি, যা দিয়ে একজনের পেট ভরে না। আর এদিকে পেয়েছে খিটখিটে মেজাজ। সবাইকে দু’চোখের বিষ মনে হয়। বুড়ীটার হয়তো তার ছোয়াচ লেগেই আমন হয়েছে। নইলে বহুদিন আগে যৌবনে কেমন হাসিখুশি ছটফট মেয়ে ছিল সে। স্থির থাকত না এক মুহুর্ত, নাচত কেবল নাচত, আর খই-এর মতো কথা ফুটত মুখ দিয়ে। আজ তার সুন্দর দেহমান পচে গিয়ে এই হাল হয়েছে।
বুড়ী যে ছেলেদের জন্ম নিয়ে কথাটা বলতে শুরু করেছে তা বেশীদিন নয়। সাধারণ গালগালি দিয়ে আর স্বাদ হয় না; তাই এমন এক কথা বের করেছে যা বুড়োর আত্মায় গিয়ে খচ করে লাগে। কথাটা মিথ্যা জেনেও প্ৰচণ্ড ক্ৰোধে জ্বলে ওঠে। অন্তরটা।
বুড়ে ভাবে, ছেলেরা বলতে পারে না কথাটা। সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ। তবে কি হাসুনির মা বলেছে? তার তো ও বাড়িতে যাতায়াত আছে।
একটা বিষয়ে কিন্তু গোলমাল নেই তার মনে। অন্তরের শক্তিতে মজিদ ব্যাপারটা জানতে পেরেছে সে কথা সে বিশ্বাস করে না।
যত ভাবে কথাটা তত জ্বলে ওঠে। বুড়ে। যে বলেছে সেকি কথাটার গুরুত্ব বোঝে না? কথাটা কী বাইরে ছড়াবার মতো? এর বিহিত ঘরেই হয়, বাইরে হয় না।–তা যতই আলেম-খোদাবন্দ মানুষ তার বিহিত করতে আসুক না কেন। তাছাড়া, কথাটায় যে বিন্দুমাত্র সত্য নেই কে বলতে পারে? এককালে বুড়ী উড়নি মেয়ে ছিল, তার হাসি আর নাচন দেখে পাগল হতো কত লোক। বৈমাত্রেয় ভাইটির সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের শুরুতে একবার একটা লোক ঘরে ঢোকার জনরব উঠেছিল। একদিন তার অনুপস্থিতিতে সে কাণ্ডটি নাকি ঘটেছিল। কিন্তু ঘরের বউ অনেক ঠ্যাঙনি খেয়েও কথাটা যখন স্বীকার করেনি তখন সে বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে, তা দুষ্ট প্রকৃতির বৈমাত্রেয় ভাইটির সৃষ্টি ছাড়া কিছু নয়।
অন্দরে ঢুকেই সামনে দেখলে হাসুনির মাকে। দেখেই চড়াচড় করে মেজাজ গরম হয়ে উঠে, ঘূর্ণি খেয়ে চোখ অন্ধকার হয়ে যায়। বকের মতো গলা বাড়িয়ে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে এক আছাড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর শুরু হয় প্রহার। প্ৰহার করতে করতে বুড়ার মুখে ফেনা উঠে যায়। আর বলে কেবল একটি কথা।–ওরে ভাতারা-খাইগা জারুণি, তোর বাপরে গিয়া কইলি ক্যামনে ওই কথা?
প্ৰাণের আশ মিটিয়ে বুড়ো তার মেয়েকে মারে। ছেলেরা তখন ঘরে ছিল না বলে তাকে রক্ষা করবার কেউ ছিল না। বুড়ী অবশ্য আঁধারে পা ছড়িয়ে তীক্ষ্ম-কণ্ঠে বিলাপ জুড়ে দেয়, কিন্তু বিলাপ শুনে দমবার পাত্ৰ বুড়ে নয়।
সে-দিন দুপুরে মুখে আঘাতের চিহ্ন ও সারা দেহে ব্যথা নিয়ে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে হাসুনির মা সোজা চলে গেল মজিদের বাড়ি। মজিদ। তখন জিরুচ্ছে আর সে-ঘরেই নীচে পাটিতে বসে রহীমা কঁথায় শেষ কটা ফোঁড় দিচ্ছে।
হাসুনির মা মজিদের সামনে আসে না। কিন্তু আজ সটান ঘরে ঢুকে তার সামনেই রহীমার পাশে বসে মরাকান্না জুড়ে দিলো। প্ৰথমে কিছু বোঝা গেলো না। কথা স্পষ্টতর হয়ে এলে এইটুকু বোঝা গেলো যে, সে রহীমাকে বলছে; ওনারে কন, আমার মওতের জন্য যানি দোয়া করে।
মজিদ হুঁকা টানে আর চেয়ে চেয়ে দেখে। ক্ৰন্দনরত মেয়ে তার ভালোই লাগে। কথায় কথায় ঠোঁট ফুলবে, লুটিয়ে পড়ে কঁদবেএমন একটা বউ-এর স্বপ্ন দেখত প্ৰথম যৌবনে। রহীমার না আছে অভিমান, না আছে চপলতা! অপরাধ, না করে থাকলেও মজিদ বলছে বলে যে-কোনো কথা নির্বিবাদে মেনে নেয়। অমন মানুষ ভালো লাগে না তার।
পরে সব কথা শুনে মজিদের মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে যায়। বুড়ো গিয়ে তার মেয়েকে মেরেছে। মেরেছে এই জন্য যে, সে এসে তাকে কথাটা বলে দিয়েছে।
অনেকক্ষণ গুম হয়ে থেকে মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে রহীমাকে বলে,–অরে। যাইতে কও। আর কও আমি দেখুম নি।
একটু পরে রহীমা বলে,–ও যাইবার চায় না। ডরায়।
মজিদ আড়চোখে একবার তাকায় হাসুনির মায়ের দিকে। কান্না থামিয়ে মজিদের দিকে পিঠি দিয়ে বসে আছে, আর ঘোমটা-টানা মাথা নত করে নখ দিয়ে মাটি খুটিছে। ওধারে ফেরানো মুখটি দেখবার জন্যে। এক মুহুর্ত কৌতুহল বোধ করে মজিদ। তারপর তেমনি গভীর কণ্ঠে বলে–থাক তাইলে এইখানে।
০৩. অপরাহ্নে জমায়েত হয়
অপরাহ্নে জমায়েত হয়। এক বিচার করতে ভরসা হয় না যেন মজিদের। ঢেঙা বুড়ো লোকটা শয়তানের খাম্বা, অন্তরে তার কুটিলতা আর অবিশ্বাস।
খালেক ব্যাপারীও এসেছে। মাতববর না হলে শাস্তি বিধান হয় না, বিচার চলে না। রায় অবশ্য মজিদই দেয়, কিন্তু সেটা মাতকবরের মুখ দিয়ে বেরুলে ভালো দেখায়।
একটু তফাতে মাটিতে বসে চুপচাপ হয়ে আছে তাহেরের বাপ, মুখটি একদিকে সরানো।
খালেক ব্যাপারী বাজখাই গলায় প্রশ্ন করে,–তোমার বিবি কী বলে?
মুখ না তুলে বুড়ে বলে,–হেই কথা আপনার ব্যাক্কই জানেন।
কে একজন গল উঠিয়ে বলে, কথা ঠিক কইরা কও মিঞা।
বুড়ো ওদিকে একবার ফিরেও তাকায় না।
খালেক ব্যাপারী আবার প্রশ্ন করে,–এহন কও, হেই কথা তুমি ঢাকপার চাও ক্যান?
কথাটা যেন বুঝলে না ঠিকমতো–এমন একটা ভঙ্গি করে বুড়ো তাকায় সকলের পানে। তারপর বলে, -এইটা কি কওনের কথা? বুড়ীমাগী ঝুটমুট একখান কথা কয়–তা বইলা আমি কী পাড়ায় ঢোল-সোহরাত দিমু?
ওর কথা বলার ভঙ্গি ব্যাপারীর মোটেই ভালো লাগে না। মজিদ নীরব হয়ে থাকে, কিন্তু উত্তর শুনে তারও চোখ জ্বলে ধিকিধিকি।
লোকটির উত্তরে কিন্তু ভুল নেই। তাই প্ৰত্যুত্তরের জন্য সহসা কিছু না পেয়ে খালেক ব্যাপারী ধমকে উঠে বলে,–কথা ঠিক কইরা কইবার পারো না?
জমায়েতের মধ্যে কয়েকটা গলা আবার চেচিয়ে ওঠে,–কথা ঠিক কইরা কও মিঞা, কথা ঠিক কইরা কও।
বৈঠক শান্ত হলে খালেক ব্যাপারী আবার বলে,—তুমি তোমার মাইয়ারে ঠ্যাঙাইছ ক্যান?
–আমার মাইয়া আমি ঠ্যাঙাইছিা!
–লম্বামুখ খাড়া করে নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় তাহেরের বাপ, যেন ভয়-ডর নেই। অবশ্য হাতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আঙুলগুলো কাঁপছে। ভেতরে তার ক্ৰোধের আগুন জ্বলছে—বাইরে যতই ঠাণ্ডা থাকুক না কেন?
ব্যাপারী কী একটা বলতে যাচ্ছিল, এবার হাত নেড়ে মজিদ তাকে থামিয়ে নিজে বলবার জন্য তৈরী হয়। ব্যাপারটা আগে গোড়া থেকে ব্যাপারীকে বুঝিয়ে বলেছিল সে, এবং ভেবেছিল তার পক্ষে থেকে খালেক ব্যাপারীই কাজটা ঠিকমতে চালিয়ে নেবে কিন্তু তার প্রশ্নগুলো তেমন জুতসই হচ্ছে না। বলছে আর যেন ঠাস করে মুখের ওপর চড় খাচ্ছে।
মজিদ গম্ভীর গলায় বলে,—ভাই সকল! বলে থেমে তাকায় সবার পানে। পিঠ সোজা করে বসেছে, কোলের ওপর হাত। আসল কথা শুরু করার আগে সে এমন একটা আবহাওয়া সৃষ্টি করে যে, মনে হয় ছুবাঙ্ক ফাতেহা পড়ে তার বক্তব্য শুরু করবে। কিন্তু আরেক বার ভাই সকল বলে সে কথা শুরু করে। বলে, খোদাতালার কুদরত মানুষের বুঝবার ক্ষমতা নাই; দোষগুণে তৈয়ার মানুষ। মানুষের মধ্যে তাই শয়তান আছে, ফেরেস্তাও আছে। তাদের মধ্যে গুণাগার আছে, নেকবন্দ আছে। কুৎসা রটনোটা বড় গৰ্হিত কাজ। কিন্তু যারা শয়তানের চতুরী বুঝতে পারে না, যারা তাদের লোভনীয় ফাঁদে ধরা দেয় এবং খোদার ভয়কে দিল থেকে মুছে ফেলে।–তারা এইসব গৰ্হিত কাজে নিজেদের লিপ্ত করে। মানুষের রসনা বড় ভয়ানক বস্তু, সে-রসন বিষাক্ত সাপের রসনার চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। প্ৰক্ষিপ্ত সে-রসন তার বিযে পরিবারকে-পরিবার ধ্বংস করে দিতে পারে, নিমেষে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে সমস্ত পৃথিবীতে।
ঋজু ভঙ্গিতে বসে গম্ভীর কণ্ঠে ঢালাসুরে মজিদ বলে চলে। কথায় তার মধু। স্তব্ধ ঘরে তার কণ্ঠে একটা সুর তোলে, যে সুরে মোহিত হয়ে পড়ে শ্রোতারা।
একবার মজিদ থামে। শান্ত চোখ, কারো দিকে তাকায় না। সে। দাড়িতে আলগোছে হাত বুলিয়ে তারপর আবার শুরু করে,
—পৃথিবীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি তাঁর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধেও মানুষের সে-রসন প্ৰক্ষিপ্ত হয়েছে। পঞ্চম হিজরীতে প্ৰিয় পয়-গম্বরের নিকট বাণী এল; মুস্তালিখ*-এর বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রত্যাবর্তন করবার সময় তাঁর ছোট বিবি আয়েশা কি করে দলচু্যত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। এক নওজোয়ান সিপাই তাকে খুঁজে পায়। পেয়ে তাকে সসম্মানে নিজেরই উটে বসিয়ে আর নিজে পায়দল হেঁট প্রিয় পয়গম্বরের কাছে পৌঁছে দিয়ে যায়। যাদের অন্তরে শয়তানের একচ্ছত্ৰ প্ৰভুত্ব–যারা তারই চক্রান্তে খোদার রোশনাই থেকে নিজের হৃদয়কে বঞ্চিত করে রাখে, তাদেরই বিষাক্ত রসনা সেদিন কর্মতৎপর হয়ে উঠল। হজরতের এত পেয়ারা বিবির নামেও তারা কুৎসা রটাতে লাগল। বড় ব্যথা পেলেন পয়গম্বর। খোদার কাছে কেঁদে বললেন, এরা খোদা পরওয়ার-দেগার, নির্দোষ আমার বিবি কেন এত লাঞ্ছনা ভোগ করবে, কেন এ অকথ্য বদনাম সহ্য করবে? উত্তরে খোদাতালা মানব জাতিকে বললেন—
থেমে বিসমিল্লাহ পড়ে মজিদ ছুরায়ে আন-নূর থেকে খানিকটা কেরাত করে শোনায়। তার গম্ভীর কণ্ঠ হঠাৎ মিহি সুরে ভেঙে পড়ে। স্তব্ধ ঘরে বিচিত্র সুরঝঙ্কার ওঠে। শুনে জমায়েতের অনেকের চোখ ছলছল করে ওঠে।
হঠাৎ এক সময়ে মজিদ কেরাত বন্ধ করে, করে সরাসরি তাহেরের বাপের পানে তাকায়, যে-লোকটা এতক্ষণ একটা বিদ্রোহী ভাব নিয়ে কঠিন হয়ে ছিল, তারও চোখ এখন নরম। বসে থাকার মধ্যে উদ্ধত ভাবাটাও যেন নেই। চোখাচোখি হতে সে চোখ নামায়।
কয়েক মুহুর্ত তার পানে তাকিয়ে থেকে গল উঠিয়ে মজিদ বলে যে, খোদাতালার ভেদ তীরই সৃষ্ট বান্দার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। মানুষের মধ্যে তিনি বিষময় রসনা দিয়েছেন, মধুময় রসনাও দিয়েছেন। উদ্ধত করেও সৃষ্টি করেছেন তাকে, মাটির মতো করেও সৃষ্টি করেছেন। সে যাই হোক, মানুষের কাছে আপনি সংসার, আপনি বালবাচ্চ দুনিয়ার সব চাইতে প্ৰিয়। তাদের সুখ-শান্তির জন্যে সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জীবনের সঙ্গে লড়াই করে। আপনি সংসারের ভালোই ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। কিন্তু যে-মেয়েলোক আপনি সংসার আপনি হাতে ভাঙতে চায় এবং আপনি সস্তানের জন্ম সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে, সে নিজের বিরুদ্ধে কাজ করে, খোদার বিরুদ্ধে আঙুল ওঠায়—তার গুণাহু বড় মস্ত গুণাহ, তার শাস্তি বড় কঠিন শাস্তি।
হঠাৎ মজিদের গলা ঝনঝনি করে ওঠে।
—তুমি কী মনে করো মিঞা? তুমি কী মনে করে তোমার বিবি মিছা বদনাম করে? তুমি কী হলফ কইরা বলতে পারো তোমার দিলে ময়লা নাই?
যে-লোক কিছুক্ষণ আগে খালেক ব্যাপারীর মতো লোকের মুখের ওপর ঠাস ঠাসা জবাব দিচ্ছিল, মজিদের প্রশ্নে সে এখন বিভ্ৰান্ত হয়ে যায়। কোথা দিয়ে কোথায় তাকে আনে মজিদ, সে বোঝে না। মন ঘটতে গিয়ে দেখে সেখানে সন্দেহ–এতদিন পর আজ সন্দেহ! বহুদিন আগে তার বউ যখন চড়াই পাখীর মতো নাচত, হাসিখুশি উজ্জলতায় চারিদিকে আলো ছড়াত, তখন যে জনরব উঠেছিল সে-কথাই তার স্মরণ হয়। কোনোদিন সে-কথা সে বিশ্বাস করেনি। তখন কথাটা যদি সত্যি বলে প্ৰমাণিত হতোও, সে তাকে তালাক দিতে পারত। গলা টিপে খুন করে ফেললেও বেমানান দেখাত না। কিন্তু আজ এতদিন পরে যদি দেখে সেদিন তারই ভুল হয়েছিল, তবে সে কী করতে পারে? বউ আজ শুধু কঙ্কাল, পচন ধরা মাংসের রদি খোলস–তাকে নিয়ে সে কী করবে? অন্ধকার ভবিষ্যতের মধ্যে যে ভীতির সৃষ্টি হবে সে-ভীতি দূর করবে। কী করে?
মজিদ গলা চড়িয়ে ধমকের সুরে আবার বলে,–কী মিঞা? তোমার দিলে কী ময়লা আছে? তুমি কী ঢাকবার চাও কিছু, লুকাইবার চাও কোনো কথা?
মজিদ থামলে ঘরময় রুদ্ধনিশ্বাসের স্তব্ধতা নামে, এবং সে-স্তব্ধতার মধ্যে তার কেরাতের সুরব্যঞ্জনা আবার যেন আপনা থেকেই ঝঙ্কত হয়ে ওঠে। সে-ঝঙ্কার মানুষের কানে লাগে, প্ৰাণে লাগে।
তাহেরের বাপ এধার-ওধার তাকায়, অস্থির-অস্থির করে। একবার ভাবে বলে, না, তার দিলে কিছুই নাই, তার দিল সাফ। বুড়ী বেটির দেমাক খারাপ হয়েছে, তাকে কষ্ট দেবার জন্যেই অমন বুটমুঠ কথা বানিয়ে বলে। কিন্তু কথাটা আসে না মুখ দিয়ে।
অবশেষে অসহায়ের মতো তাহেরের বাপ বলে,–কী কমু? আমার দিলের কথা। আমি জানি না। ক্যামনে কমুদ দিলের কথা?
–কিছু তুমি ঢাকবার চাও, লুকাইবাব চাও?
অস্থির হয়ে ওঠা চোখে বুড়ো আবার তাকায় মজিদের পানে। তার মুখ কুলে পড়েছে, থাই পাচ্ছে না কোথাও।
—তুমি কিছু লুকাইবার চাও, কিছু ছাপাইবার চাও? তুমি তোমার মাইয়ারে তাইলে ঠ্যাঙাইছ ক্যান? তার গায়ে দঁড়া পড়ছে ক্যান? তার গা নীল-নীল হইছে ক্যান?
সভা নিশ্বাস রুদ্ধ করে রাখে। লোকেরাও বোঝে না ঠিক কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছে ব্যাপারটা। তবে বিভ্রান্ত বুড়োটির পানে চেয়ে সমবেদন হয় না; বরঞ্চ তাকে দেখে মনে এখন বিদ্বেষ আর ঘূণা আসে। ও যেন ঘোর পাপী। পাপের জ্বালায় এখন ছটফট করছে। দোজখের লেলিহান শিখা যেন স্পর্শ করেছে তাকে।
হঠাৎ ঋজু হয়ে বসে মজিদ চোখ বোজে। তারপর সে বিসমিল্লাহ পড়ে আবার কেরাত শুরু করে। মুহুর্তে মিহি মধুর হয়ে ওঠে তার গলা, শান্তর ঝরণার মতো বেয়ে বেয়ে আসে, ঝরে ঝরে পড়ে অবিশ্রান্ত করুণায়!
তারপর সর্বসমক্ষে ঢেঙা বদমেজাজী বৃদ্ধ লোকটি কঁদতে শুরু করে। সে কাঁদে, কাঁদে, কেউ ব্যাঘাত করে না তার কান্নায়। অবশেষে কান্না থামলে মজিদ শান্ত গলায় বলে,–তুমি কিংবা তোমার বিবি গুণাহ কইরা থাকলে খোদা বিচার করবেন। কিন্তু তুমি তোমার মাইয়ার কাছে মাফ চাইবা, তারে ঘরে নিয়া যত্নে রাখব। আর মাজারে সিন্নি দিব পাঁচ পইসার।
মজিদ নিজে তার মাফ দাবী করে না। কারণ মেয়ের কাছে চাইলে তারই কাছে চাওয়া হবে। নির্দেশ তো তারই। তারই হুকুম তালিম করবে সে।
বুড়ো বাড়ি গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। তারপর চোখ বুজে চুপচাপ ভাবে। মাথাটা যেন খোলসা হয়ে এসেছে। হঠাৎ তার মনে হয়, সারা গ্রামের জমায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে সে নির্লজ্জভাবে সায় দিয়ে এসেছে বুড়ীর কথায়। সে-কথার সত্যাসত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেনি, বরঞ্চ পরিষ্কারভাবে বলে এসেছে সে-কথা সত্যিই। এবং লোককে এ-কথাও জানিয়ে এসেছে যে, সে একটা দুর্বল মানুষ, এত বড় একটা অন্যায়ের কথা দোষিণীর আপনি মুখ থেকে শুনেও চুপ করে আছে কারণ তার মেরুদণ্ড নেই। সে-কথা সর্বসমক্ষে কেঁদে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে।
হঠাৎ রক্ত চড়াচড় করে ওঠে। ভাবে, উঠে গিয়ে চেলাকাঠ দিয়ে এ মুহুর্তেই বুড়ীর আমসিপান মুখখানা ফাটিয়ে উড়িয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু কেমন একটা অবসাদে দেহ ছেয়ে থাকে। চুপচাপ শুয়ে কেবল ভাবে। পৌরুষের গর্ব ধূলিস্মাৎ হয়ে আছে যেন।
আর সে ওঠেই না। বুড়ী মাঝে মাঝে শান্তগলায় ছেলেদের প্রশ্ন করে,—দেখত, ব্যাটা মরল নাকি?
ছেলেরা ধমকে ওঠে মায়ের ওপর। বলে, কী যে কও! মুখে লাগাম নাই তোমার?
হতাশ হয়ে বুড়ী বলে,–তাই ক। আমার কি তেমন কপালডা!
আর মারবে না প্ৰতিশ্রুতি সত্ত্বেও বড় ভয়ে ভয়ে হাসুনির মা ঘরে ফিরে এসেছিল। ভয় যে, সেখানে যা বলেছে বলেছে, কিন্তু একবার হাতে নাতে পেলে তাকে ঠিক খুন করে ফেলবে বুড়ে। সে এখন অবাক হয়ে ঘুরঘুর করে, উকি মেরে বাপের শায়িত নিশ্চল দেহটি চেয়ে দেখে কখনো কখনো। কখনো বা আড়াল থেকে শুষ্ক গলায় প্রশ্ন করে,–ব্যাপজান, খাইবা না?
বাপ কথা কয় না।
দুদিন পরে ঝড় ওঠে। আকাশে দুরন্ত হওয়া আর দলে-ভারী কালো কালে মেঘে লড়াই লাগে; মহব্বতনগরের সর্বোচ্চ তালগাছটি বন্দী পাখীর মতো আছড়াতে থাকে। হাওয়া মাঠে ঘূর্ণিপাক খেয়ে আসে, তিৰ্যক ভঙ্গিতে বাজপাখীর মতো শো করে নেমে আসে, কখনো ভেঁাতা। প্ৰশস্ততায় হাতীর মতো ঠেলে এগিয়ে যায়।
ঝড় এলে হাসুনির মার হৈ হৈ করা অভ্যাস। হাসুনি কোথায় গেলো রে, ছাগলটা কোথায় গেলো রে, লাল কুটিওয়ালা মুরগিটা কোথায় গেলে রে; তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচামেচি করে, আথালি-পাথালি ছুটোছুটি করে, আর কী একটা আদিম উল্লাসে তার দেহ নাচে।
ঝড় আসছে। হু-হু করে, কিন্তু হাসুনির মা মুরগিটা খুজে পায় না। পেছনে ঝোপঝাড়ে দেখে, বাইরে যায়, ওধারে আমগাছে আশ্রয় নিয়েছে কিনা দেখে, বৃষ্টির ঝাপটায় বুজে আসা চোখে পিট-পিট করে তাকিয়ে কুরকুর আওয়াজ করে ডাকে, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পায় না। শেষে ভাবে, কী জানি, হয়তো বাপের মাচার তলেই মুরগিটা গিয়ে লুকিয়েছে। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে মাচার তলে উকি মারতেই তার বাপ হঠাৎ কথা বলে। গলা দুর্বল, শূন্য শূন্য ঠেকে। বলে,—আমারে চাইরডা চিড়া আইনা দে।
মেয়ে ছুটে গিয়ে কিছু চিঁড়াগুড় এনে দেয়।
বাপ গবগাব করে খায়। ক্ষিধে রাক্ষসের মতো হয়ে উঠেছে।
চিঁড়ে কটা গলাধঃকরণ করে বলে,–পানি দে।
মেয়ে ছুটে পানি আনে। সর্বাঙ্গ তার ভিজে সপসাপ করছে, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। অনুতাপ আর মায়া মমতায় বাপের কাছে সে গলে গেছে। বাপের ব্যথায় তার বুক চিনচিন করে।
বুড়ো ঢকঢক করে পানি খায়। তারপর একটু ভাবে। শেষে বলে,–আর চাইরডা চিড় দিবি মা?
মেয়ে আবার ছোটে। চিঁড়া আনে আরো, সঙ্গে আরেক লোটা পানিও আনে।
দুদিনের রোজা ভেঙে বুড়ো ধনুকের মতো পিঠ বেঁকিয়ে মাচার ওপর অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবে, দৃষ্টি কোণের অন্ধকারের মধ্যে নিবদ্ধ।
বাইরে হাওয়া গোঙিয়ে গোঙিয়ে ওঠে, ঘরের চাল হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটায় গুমরায়। সিক্ত কাপড়ে দূরে দাঁড়িয়ে মেয়ে নীরব হয়ে থাকে। হঠাৎ কেন তার চোখ ছলছল করে। তবে ঘরের অন্ধকার আর বৃষ্টির পানিতে ভেজা দুঃখের মধ্যে সে-অশ্রু ধরা পড়বার কথা নয়।
অবশেষে বাপ বলে–মাইয়া তোর কাছে মাফ চাই। বুড়া মানুষ মতিগতির আর ঠিক নাই! তোরে না বুইঝা কষ্ট দিছি হে-দিন।
মেয়ে কী বলবে। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মুরগি খোজার অজুহাতে বাইরে ঝড়ের মধ্যে দাড়াতেই চোখে আরো পানি আসে হু-হু করে, অর্থহীনভাবে, আর বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় সে-পানি।
সে-দিন সন্ধ্যায় বুড়ে চলে গেলো। কেউ বলতে পারল না গেলো কোথায়। ছেলেরা অনেক খোঁজে। আশেপাশে গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, মতিগঞ্জের সড়ক ধরে তিন ক্রোশ দূরে গঞ্জে গিয়েও অনেক তালাশ করে। কেউ বলে, নদীতে ডুবছে। তাই যদি হয় তবে সন্ধান পাবার জো নেই। খরস্রোতা বিশাল নদী, সে নদী কোথায় কতদূরে তার দেহ ভাসিয়ে তুলেছে কে জানে।
ঘরে বুড়ী স্তব্ধ হয়ে থাকে। যে তাঁর মৃত্যুর জন্যে এত আগ্ৰহ দেখাত সে আর কথা কয় না। হাসুনির মা দূর থেকে মজিদের মিষ্টি মধুর কোরান তেলাওয়াৎ শুনেছে অনেকদিন। সে আল্লার কথা স্মরণ করে বলে,–আল্লা-আল্লা কও মা।
বুড়ী তখন জেগে উঠে কয়েকবার শিশুর মতো বলে, আল্লা, আল্লা…।
মজিদের শিক্ষায় গ্রামবাসীরা এ-কথা ভালোভাবে বুঝেছে যে, পৃথিবীতে যাই ঘটুক জন্ম-মৃত্যু শোক-দুঃখ–যার অর্থ অনেক সময় খুজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে।–সব খোদা ভালোর জন্যেই করেন। তাঁর সৃষ্টির মর্ম যেমন সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা দুষ্কর তেমন নিত্যনিয়ত তিনি যা করেন তার গুঢ়তত্ত্ব বোঝাও দুষ্কর। তবে এটা ঠিক, তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। ঘটনার রূপ অসহনীয় হতে পারে, কিন্তু অন্তনিহিত উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত মানুষের মঙ্গল, তার ভালাই। অতএব যে জিনিস বোঝার জন্যে নয়, তার জন্যে কৌতুহল প্ৰকাশ করা অর্থহীন!
ঠিক সে কারণেই বুড়ো কোথায় পালিয়েছে বা তার মৃতদেহ কোথাও ভেসে উঠেছে কিনা জানিবার জন্যে কৌতুহল হতে পারে, কিন্তু কেন পালিয়েছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতুহল হবার কথা নয়। যারা মজিদের শিক্ষার যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি, তাদের মধ্যে অবশ্য প্রশ্নটি যে একেবারে জাগে না এমন নয়। কিন্তু সে-প্ৰশ্ন দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ক্ষীণ, উঠেই ডুবে যায়, ব্যাখ্যাতীত অজানা বিশাল আকাশের মধ্যে থাই পায়, না। যেখানে জন্ম-মৃত্যু, ফসল হওয়া-না-হওয়া, বা খেতে পাওয়া না-পাওয়া একটা অদৃশ্য শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেখানে একটি লোকের নিরুদ্দেশ হবার ঘটনা। কতখানি আর কৌতুহল জাগাতে পারে! যা মানুষের স্মরণে জাগ্রত হয়ে থাকে বহুদিন, তা সে-অপরাধের ঘটনা। মজিদের সামনে সেদিন লোকটি কেমন ছটফট করেছিল, পাপের জম্বালায় কেমন অস্থির করেছিল –যেন দোজখের আগুনের লেলিহান শিখা তাকে স্পর্শ করেছে। তারপর তার কান্না। শয়তানের শক্তি ধূলিস্মাৎ হয়ে গিয়েছিল সে-কান্নার মধ্যে।
এ-বিচিত্র দুনিয়ায় যারা আবার আর দশজনের চাইতে বেশী জানে ও বোঝে, বিশাল রহস্যের প্রান্তটুকু অন্তত ধরতে পারে বলে দাবী করে, তাদের কদর প্রচুর। সালুতে ঢাকা মাছের পিঠের মতো চিরনীরব মাজারটি একটি দুৰ্ভেদ্য, দুর্লঙ্ঘনীয় রহস্তে আবৃত। তারই ঘনিষ্ঠতার মধ্যে যে-মানুষ বসবাস করে তার দ্বারাই সম্ভব মহারহস্যকে ভেদ করা, অনাবৃত করা। মজিদের ক্ষুদ্র চোখদুটি যখন ক্ষুদ্রতর হয়ে ওঠে। আর দিগন্তের ধূসরতায় আবছা হয়ে আসে, তখনই তার সামনে সে-সৃষ্টি-রহস্য নিরাবরণ স্পষ্টতায় প্ৰতিভাত হয়–সে-কথা এরা বোঝে।
হাসুনির মা’র মনেও প্রশ্ন নেই। মাসগুলো ঘুরে এলে বরঞ্চ বাপের নিরুদ্দেশ হবার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত অর্থ খুজে পায়।–খোদার জিনিস খোদা তুইলা লইয়া গেছে।
তারপর মা’র প্রতি অগ্নি দৃষ্টি হানে।
–বাম আমাগো নেকবন্দ মানুষ আছিল। বুড়ী কিছু বলে না। খেলোয়াড় চলে গেছে, খেলবে কার সাথে। তাই যেন চুপচাপ থাকে।
প্ৰথম প্ৰথম হাসুনির মা মজিদের বাসায় আসত না। লজ্জা হতো। মার লজ্জা নেই বলে তার লজ্জা। তারপর ক্রমে ক্ৰমে আসতে লাগল। কখনো কাচিৎ মজিদের সামনাসামনি হয়ে গেলে মাথায় আধহাত ঘোমটা টেনে আড়ালে গিয়ে দাড়াত, আর বুকটা দুরুদুরু কঁপত ভয়ে। বতোর দিনে এ-বাড়িতে যাতায়াত যখন বেড়ে গেলো তখন একদিন উঠানে একেবারে সামনা সামনি হয়ে গেলে। মজিদের হাতে হুঁকা। হাসুনির মা ফিরে দাঁড়িয়েছে এমন সময়ে মজিদ বলে, –হুঁকায় এক ছিলিম তামাক ভইরা দেও গো বিটি।
কয়েক মুহুর্ত ইতস্তত করে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে হুঁকাটা নেয়। বুক কাঁপতে থাকে ধকধক করে, আর লজ্জায় চোখ বুজে আসতে চায়।
হুঁকাটা দিতে গিয়ে মজিদ কয়েক মুহুর্ত সেটা ধরে রাখে। তারপর হঠাৎ বলে, আহা!
তার গলা বেদনায়ু ছলছল করে।
তারপর থেকে সংকোচ আর ভয় কাটে। ক্ৰমে ক্ৰমে সে খোলা মুখে সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া শুরু করে। না করে উপায় কী! বতোর দিনে কাজের অন্ত নেই। মানুষ তে রহীমা আর সে। ধান এলানো মাড়ানো, সিদ্ধ করা, ভানা–কত কাজ।
একদিন উঠানে ধান ছড়াতে ছড়াতে হঠাৎ বহুদিন পর হাসুনির মা তার পুরানো আজি জানায়। রহীমাকে বলে,–ওনারে কন, খোদায় যানি আমার মওত দেয়।
হঠাৎ রহীমা রুষ্ট স্বরে বলে,–অমন কথা কইওনা, ঘরে বালা আইসে।
পরদিন মজিদ একটা শাড়ি আনিয়ে দেয়। বেগুনি রঙ, কালো পাড়। খুশি হয়ে হাসুনির মা মুখ গম্ভীর করে। বলে,—আমার শাড়ির দরকার কী বুবু? হাসুনির একটা জামা দিলে ও পরত খন।
হঠাৎ কী হয়, রহীমা কিছু বলে না। অন্যদিন হলে, কথা না বলুক অন্তত হাসে। আজ হাসেও না।
০৪. পৌষের শীত
পৌষের শীত। প্ৰান্তর থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে হাড় কঁপায়। গভীর রাতে রহীমা আর হাসুনির মা ধান সিদ্ধ করে। খড়কুটো দিয়ে আগুন জালিয়েছে, আলোকিত হয়ে উঠেছে। সারা উঠানটা; ওপরে আকাশ অন্ধকার। গানগনে আগুনের শিখা যেন সেই কালো আকাশ গিয়ে ছোয়। ওধারে ধোঁয়া হয়, শব্দ হয় ভাপের। যেন শতসহস্ৰ সাপ শিস দেয়।
শেষ-রাতের দিকে মজিদ ঘর থেকে একবার বেরিয়ে আসে। খড়ের আগুনের উজ্জল আলো লেপা জোকা সাদা উঠানটায় ঈষৎ লালচে হয়ে প্ৰতিফলিত হয়ে ঝকঝাক করে। সেই ঈষৎ লালচে উঠানের পশ্চাতে দেখে হাসুনির মাকে, তার পরনে বেগুনি শাড়িটা। যে-আলো সাদা মসূণ উঠানটাকে শুভ্ৰাতায় উজ্জল করে তুলেছে, সে আলোই তেমনি তার উন্মুক্ত গলা-কাঁধের খানিকটা অংশ আর বাহু উজ্জ্বল করে তুলেছে। দেখে মজিদের চোখ এখানে অন্ধকারে চকচক করে।
কিছুক্ষণ পর ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে মজিদ। আশপাশ করে। উঠান থেকে শিসের আওয়াজ এসে বেড়ার গায়ে সিরসির করে। তাই শোনে আর আশপাশ করে মজিদ। তারই মধ্যে কখন দ্রুততর, ঘনতর। হয়ে ওঠে মুহুর্তগুলি।
এক সময়ে মজিদ আবার বেরিয়ে আসে। এসে কিছুক্ষণ আগে হাসুনির মায়ের উজ্জল বাহু-কাঁধ-গলার জন্য যে-রহীমাকে সে লক্ষ্য করেনি, সে-রহীমাকেই ডাকে। ডাকের স্বরে প্রভুত্ব! দুনিয়ায় তার চাইতে এই মুহুর্তে অধিকতর শক্তিশালী, অধিকতর ক্ষমতাবান আর কেউ নেই যেন। খড়কুটোর আলোর জন্য ওপরে আকাশ তেমনি অন্ধকার। সীমাহীন সে-আকাশ এখন কালো আবরণে সীমাবদ্ধ। মানুষের দুনিয়া আর খোদার দুনিয়া আলাদা হয়ে গেছে।
রহীমা ঘরে এলে মজিদ বলে,–পাটা একটু টিপা দিবা?
এ-গলার স্বর রহীমা চেনে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে মূর্তির মতো কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে বলে,—ওইধারে এত কাম, ফজরের আগে শেষ করন লাগবো।
–থোও তোমার কাজ। মজিদ গর্জে ওঠে। গর্জাবে না কেন। যে-ধান সিদ্ধ হচ্ছে সে-ধান তো তারই। এখানে সে মালিক। সে মালিকানায় এক আনারও অংশীদার নেই কেউ।
রহীমার দেহভরা ধানের গন্ধ। যেন জমি ফসল ধরেছে। ঝুঁকে ঝুঁকে সে পা টেপে। ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মজিদ, আর ধানের গন্ধ শোকে। শীতের রাতে ভারী হয়ে নাকে লাগে সে-গন্ধ।
অন্ধকারে সাপের মতো চকচক করে তার চোখ। মনের অস্থিরতা কাটে না। কাউকে সে জানাতে চায় কী কোনো কথা? তারই দেওয়া বেগুনি রঙের শাড়ি-পরা মেয়েলোকটিকে–খড়কুটোর আলোতে তখন যার দেহের কতক অংশ জ্বলজ্বল করছিল। লালিত্যে—তাকে একটা কথা জানাতে চায় যেন। তবে জানানোর পথে বৃহৎ বাধার দেয়াল বলে রাত্রির এই মুহুর্তে অন্ধকার আকাশের তলে অসীম ক্ষমতাশীল প্ৰভুত্ব অস্থির অস্থির করে, দেয়াল ভেদ করার সূক্ষ্ম, ঘোরালো পস্থার সন্ধান করতে গিয়ে অধীর হয়ে পড়ে।
তখন পশ্চিম আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। উঠানে আগুন নিভে এসেছে, উত্তর থেকে জোর ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রহীমা ফিরে এসে মুখ তুলে চায় না। হাসুনির মা দাঁতে চিবিয়ে দেখছিল, ধান সিদ্ধ হয়েছে কি-না। সেও তাকায় না রহীমার পানে। কথা বলতে গিয়ে মুখে কথা বাধে।
তারপর পূর্ব আকাশ হতে স্বপ্নের মতো ক্ষীণ, শ্লথগতি আলো এসে রাতের অন্ধকার যখন কাটিয়ে দেয় তখন হঠাৎ ওরা দুজনে চমকে উঠে। মজিদ। কখন উঠে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়তে শুরু করেছে। হালকা মধুর কণ্ঠ গ্ৰীষ্ম প্ৰত্যুষের ঝিরঝির হাওয়ার মতো ভেসে আসে!
ওরা তাকায় পরস্পরের পানে। নোতুন। এক দিন শুরু হয়েছে খোদার নাম নিয়ে। তার নামোচ্চারণে সংকোচ কাটে।
লোকদের সে যাই বলুক, বতোর দিনে মজিদ। কিন্তু ভুলে যায় গ্রামের অভিনয়ে তার কোন পালা। মাজারের পাশে গত বছরে ওঠানো টিন আর বেড়ার ঘর মগরার পর মগরা ধানে ভরে উঠে। মাজার জেয়ারত করতে এসে লোকেরা চেয়ে চেয়ে দেখে তার ধান। গভীর বিস্ময়ে তারা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, মজিদকে অভিনন্দিত করে। শুনে মজিদ মুখ গম্ভীর করে। দাড়িতে হাত বুলিয়ে আকাশের পানে তাকায়। বলে, খোদার রহমত। খোদাই রিজিক দেনেওয়ালা। তারপর ইঙ্গিতে মাজারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বলে আর তানার দোয়া।
শুনে কারো কারো চোখ ছলছল করে ওঠে, আর আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ। কেন আসবে না। ধান হয়েছে এবার। মজিদের ঘরে যেমন মগরাগুলো উপচে পড়ছে ধানের প্রাচুর্যে, তেমনি ঘরো-ঘরে ধানের বন্যা। তবে জীবনে যারা অনেক দেখেছে, যারা সমঝদার, তারা অহঙ্কার দাবিয়ে রাখে। ধানের প্রাচুর্যে কারো কারো বুকে আশঙ্কাও জাগে।
বস্তুত, মজিদকে দেখে তাদের আসল কথা স্মরণ হয়। খোদার রহমত না হলে মাঠে মাঠে ধান হতে পারে না। তাঁর রহমত যদি শুকিয়ে যায়–বষিত না হয়, তবে খামার শূন্য হয়ে খাঁ খাঁ করে। বিশেষ দিনে সে-কথাটা স্মরণ করবার জন্য মজিদের মতো লোকের সাহায্য নেয়। তার কাছেই শোকর গুজার করবার ভাষা শিখতে আসে।
অপূর্ব দীনতায় চোখ তুলে মজিদ বলে, দুনিয়াদারী কী তার কাজ? খোদাতালা অবশ্য দুনিয়ার কাজকামকে অবহেলা করতে বলেননি, কিন্তু যার অন্তরে খোদা-রাসুলের স্পর্শ লাগে, তার কী আর দুনিয়াদারী ভালো লাগে?
—বলে মজিদ চোখ পিট পিট করে–যেন তার চোখ ছলছল করে উঠেছে। যে শোনে সে মাথা নাড়ে ঘন ঘন। অস্পষ্ট গলায় সে আবার বলে, –খোদার রহমত সব।
আরো বলে যে, সে-রহমতের জন্যে সে খোদার কাছে হাজারবার শোেকর গুজার করে। কিন্তু আবার দু-মুঠো ভাত খেতে না পেলেও তার চিন্তা নেই। খোদার ওপর যারা প্ৰাণ-মন-দেহ ন্যস্ত এবং খোদার ওপর যে তোয়াক্কল কবে, তার আবার এসব তুচ্ছ কথা নিয়ে ভাবনা! বলতে বলতে এবার একটা বিচিত্ৰ হাসি ফুটে ওঠে মজিদের মুখে, কোটরাগত চোেখ ঝাপসা হয়ে পরে দিগন্তপ্রসারী দূরত্বে।
কিন্তু আজ সকালে মজিদের সে-চোখে একটা জ্বালাময় ছবি ভেসে ওঠে থেকে থেকে। গনগনে আগুনের পাশে বেগুনি রঙের শাড়ি পর একটি অস্পষ্ট নারীকে দেখে। স্মৃতিতে তার উলঙ্গ বাহু ও কাঁধ আরো শুভ্ৰ হয়ে ওঠে। তার যে-চোখে দিগন্তপ্রসারী দূরত্ব জেগে ওঠে, সে-চোখ ক্রমশ সূক্ষ্ম ও সূচাগ্র তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
হঠাৎ সচেতন হয়ে মজিদ প্রশ্ন করে,—তোমার কেমন ধান হইল মিঞা?
তুমি বলুক আপনি বলুক সকলকে মিঞা বলে সম্বোধন করার অভ্যাস মজিদের। লোকটি ঘাড় চুলকে নিতিবিতি করে বলে–যা-ই হইছে তাই যথেষ্ট। ছেলেপুলে লইয়া দুই বেলা খাইবার পারুম।
আসলে এদের বড়াই করাই অভ্যাস। পঞ্চাশ মণ। ধান হলে অন্তত একশো মণ বলা চাই। বতোর দিন উঁচিয়ে উঁচিয়ে রাখা ধানের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করানো চাই। লোকটির ধান ভালোই হয়েছে, বলতে গেলে গত দশ বছরে এমন ফসল হয়নি। কিন্তু মজিদের সামনে বড়াই করা তো দূরের কথা, ন্যায্য কথাটা বলতেই তার মুখে কেমন বাধে। তাছাড়া, খোদার কালাম জানা লোকের সামনে ভাবনা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। কী কথা বললে কী হবে বুঝে না উঠে সতর্কতা অবলম্বন করে।
কথার কথা বলে মজিদ, তাই উত্তরের প্রতি লক্ষ্য থাকে না। তার অন্তরে ক্রমশ যে-আগুন জ্বলে উঠছে তারই শিখার উত্তাপ অনুভব করে। সে-উত্তাপ ভালোই লাগে।
লোকটি অবশেষে উঠে দাঁড়ায়। তবে যাবার আগে হঠাৎ এমন একটা কথা বলে যে, মজিদ যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। এবং যে-আগুন জ্বলে উঠছিল অন্তরে, তা মুহূর্তে নির্বাপিত হয়।
সংক্ষেপে ব্যাপারটি হলো এই।–গৃহস্থদের গোলায় যখন ধান ভরে ওঠে তখন দেশময় আবার পীরদের সফর শুরু হয়। এই সময়. খাতির-যত্নটা হয়, মানুষের মেজাজটাও খোলসা থাকে। যেবার আকাল পড়ে সেবার অতি ভক্ত মুরিদের ঘরেও দু’দিন গা ঢেলে থাকতে ভরসা। হয় না পীর সাহেবদের।
দিন কয়েক হলো, তিন গ্ৰাম পরে এক পীর সাহেব এসেছেন। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মতলুব খাঁ তাঁর পুরানো মুরিদ। তিনি সেখানেই উঠেছেন।
প্ৰচণ্ড পথশ্ৰম স্বীকার করে এই দূর দেশে আসেন। সে কতদিন আগে তা পীর সাহেবও সঠিকভাবে জানেন না। কিন্তু এ-অজ্ঞতা স্বীকাৰ্য নয় বলে কোনো এক পাঠান বাদশাহের মৃত্যুর সঙ্গে হিসাব মিলিয়ে সে স্মরণীয় আগমনকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ণীত করা হয়। যে দেশ ছেড়ে এসেছেন, সে-দেশের সঙ্গে আজ অবশ্য কোনো সম্বন্ধ নেইকেবল বৃহৎ খড়গনাসা গৌরবর্ণ চেহারাটি ছাড়া। ময়মনসিংহ জেলার কোনো এক অঞ্চলে বংশানুক্ৰমে বসবাস করছেন বলে তাঁদের ভাষাটাও এমন বিশুদ্ধভাবে স্থানীয় রূপ লাভ করেছে যে, মুরিদানির কাজ করবার প্রাক্কালে উত্তরভারতে কোনো এক স্থানে গিয়ে তাঁকে উর্দু জবান এস্তেমাল করে আসতে হয়েছিল।
পীর সাহেবের খ্যাতির শেষ নেই, তার সম্বন্ধে গল্পেরও শেষ নেই। সে-গল্প তাঁর রূহানি তাকত ও কাশফ নিয়ে। মাজারের ছায়ার তলে আছে বলে সমাজে জানাজা-পড়ানো খোনকার-মোল্লার চেয়ে মজিদের স্থান অনেক উচুতে, কিন্তু রূহানি তাকত তার নেই বলে অন্তরে অন্তরে দীনতা বোধ করে। কখনো কখনো খোলাখুলিভাবে লোকসমক্ষে সে-দীনতা ব্যক্তি করে। কিন্তু এমন ভাষায় ও ভঙ্গিতে যে তা মহৎ ব্যক্তির দীনতা প্ৰকাশের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে এবং প্ৰতিক্রিয়া লক্ষ্য করে মজিদ নিশ্চিন্ত থাকে।
কিন্তু জাঁদরেল পীররা যখন আশেপাশে এসে আস্তানা গাড়েন তখন কিন্তু মজিদ শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ভয় হয়, তার বিস্তৃত প্ৰভাব কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো মিলিয়ে যাবে, অন্য এক ব্যক্তি এসে যে বৃহৎ মায়াজাল বিস্তার করবে তাতে সবাই একে একে জড়িয়ে পড়বে।
অন্যের আত্মার শক্তিতে অবশ্য মজিদের খাঁটি বিশ্বাস নেই। আপন হাতে সৃষ্ট মাজারের পাশে বসে দুনিয়ার অনেক কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না। তবে এসব তার অন্তরের কথা, প্ৰকাশের কথা নয়। অতএব কিছুমাত্র বিশ্বাস ছাড়াও সে আশ্চৰ্য ধৈর্যসহকারে অন্যের ক্ষমতার ভূয়সী। প্ৰশংসা করে। বলে, খোদাতালার ভেদ বোঝা কী সহজ কথা? কার মধ্যে তিনি কী বস্তু দিয়েছেন সে কেবল তিনিই বলতে পারেন।
এবার মজিদের মন কিন্তু কদিন ধরে। থমথম করে। সব সময়েই হাওয়ায় ভেসে আসে পীর সাহেবের কার্যকলাপের কথা। এ-দিকে মাজারে লোকদের আসা-যাওয়াও প্ৰায় থেমে যায়। বতোর দিনে মানুষের কাজের অন্ত নেই ঠিক। কিন্তু যে-টুকু অবসর পায় তা তারা ব্যয় করতে থাকে পীর সাহেবের বাতরস-স্ফীত পদযুগলে একবার চুমু দেবার আশায়। পদচুম্বন অবশ্য সবার ভাগ্যে ঘটে না। দিনের পর দিন ভিড় ঠেলে অতি নিকটে পৌঁছেও অনেক সময় বাসনা চরিতার্থ হয় না। সন্নিকটে গিয়ে তার নূরানি চেহারার দীপ্তি দেখে কারো চোেখ ঝলসে যায়, কারো এমন চোখ-ভাসানো কান্না পায় যে, আর এগোবার আশা ত্যাগ করতে হয়। ভাগ্যবান যারা, তারা পীর সাহেবের হাতের স্পর্শ হতে শুরু করে দু-এক শব্দ আদেশ-উপদেশ বা তামাক-গন্ধ-ভারী বুকের হাওয়াও লাভ করে।
রাত্ৰে বিছানায় শুয়ে মজিদ গম্ভীর হয়ে থাকে। রহীমা গা টেপে, কিন্তু টেপে যেন আস্ত পাথর। অবশেষে মজিদকে সে প্রশ্ন করে, —আপনার কী হইছে?
মজিদ কিছু বলে না।
উত্তরের জন্যে কতক্ষণ অপেক্ষা করে রহীমা হঠাৎ বলে,–এক পীর সাহেব আইছেন না হেই গোরামে, তানি নাকি মরা মাইনষেরে জিন্দা কইরা দেন?
পাথর এবার হঠাৎ নড়ে। আবছা অন্ধকারে মজিদের চোখ জ্বলে ওঠে। ক্ষণকাল নীরব থেকে হঠাৎ কটমট করে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,—মরা মানুষ জিন্দা হয় ক্যামনে?
প্রশ্নটা কৌতুহলের নয় দেখে রহীমা দমে গেলো। তারপর আর কোনো কথা হয় না। এক সময় রহীমা পাশে শুয়ে আলগোছে ঘুমিয়ে পড়ে।
মজিদ ঘুমোয় না। সে বুঝেছে, ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এবার কিছু একটা না করলে নয়। আজও অপরাহ্নে সে দেখেছে, মতিগঞ্জের সড়কটা দিয়ে দলে দলে লোক চলছে উত্তর দিকে।
মজিদ ভাবে আর ভাবে। রাত যত গভীর হয় তত আগুন হয়ে ওঠে মাথা। মানুষের নিৰ্বোধি বোকামির জন্যে আর তার অকৃতজ্ঞতার জন্যে একটা মারাত্মক ক্রোধ ও ঘূণা, উষ্ণ রক্তের মধ্যে টগবগ করতে থাকে। সে ছটফট করে একটা নিস্ফল ক্ৰোধে।
এক সময় ভাবে, ঝালার-দেওয়া সালু কাপড়ে আবৃত৷ নকল মাজারটিই এদের উপযুক্ত শিক্ষা, তাদের নিমকহারামির যথার্থ প্রতিদান। ভাবে, একদিন মাথায় খুন চড়ে গেলে সে তাদের বলেই দেবে আসল কথা। বলে দিয়ে হাসবে হা-হা করে গগন বিদীর্ণ করে। শুনে যদি তাদের বুক ভেঙে যায়। তবেই তৃপ্ত হবে তার রিক্ত মন। মজিদ তার ঘরবাড়ি বিক্ৰী করে সরে পড়বে দুনিয়ার অন্য পথে-ঘাটে। এ-বিচিত্র বিশাল দুনিয়ায় কী যাবার জায়গার কোনো অভাব আছে?
অবশ্য এ-ভাবনা গভীর রাতে নিজের বিছানায় শুয়েই সে ভাবে। যখন মাথা শীতল হয়, নিম্বফল ক্ৰোধ হতাশায় গলে যায়, তখন সে আবার গুম হয়ে থাকে। তারপর শ্ৰান্ত, বিক্ষুব্ধ মনে হঠাৎ একটি চিকন বুদ্ধিরশ্মি প্ৰতিফলিত হয়।
শীঘ্ৰ তার চোখ দুটি চকচক করে ওঠে, শ্বাস দ্রুততর হয়। উত্তেজনায় আধা উঠে বসে অন্ধকার ভেদ করে রহীমার পানে তাকায়। পাশে সে অঘোর ঘুমে বেচাইন। একটি হাঁটু উলঙ্গ হয়ে মজিদের দেহ ঘেঁষে আছে।
তাকেই অকারণে কয়েক মুহুর্ত চেয়ে চেয়ে দেখে মজিদ, তারপর আবার চিৎ হয়ে শুয়ে চোখখোলা মৃতের মতো পড়ে থাকে।
মজিদ যখন আওয়ালপুর গ্রামে পৌঁছলো তখন সূৰ্য হেলে পড়েছে। মতলুব মিঞার বাড়ির সাননেকার মাঠ লোকে-লোকারণ্য। তারই মধ্যে কোথায় যে পীর সাহেব বসে আছেন বোঝা মুশকিল। মজিদ বেঁট মানুষ। পায়ের আঙলে দাঁড়িয়ে বকের মতো গলা বাড়িয়ে পীর সাহেবকে একবার দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু কালো মাথার সমুদ্রে দৃষ্টি কেবল ব্যাহত হয়ে ফিরে আসে।
একজন বললে যে, বটগাছটার তলে তিনি বসে আছেন। তখন মাঘের শেষাশেষি। তবু জন-সমুদ্রের উত্তাপে পীর সাহেবের গরম লেগেছে বলে তাঁর গায়ে হাতীর কানের মতো মস্ত ঝালরওয়ালা পাখা নিয়ে হাওয়া করছে একটি লোক; কেবল সেই পাখাটা থেকে থেকে নজরে পড়ে।
মূখ তুলে রেখে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল মজিদ। সামনে শত শত লোক সব বিভোর হয়ে বসে আছে, কেউ কাউকে লক্ষ্য করবার কথা নয়। মজিদকে চেনে এমন লোক ভিড়ের মধ্যে অনেক আছে বটে, কিন্তু তারা কেউ আজ তাকে চেনে না। যেন বিশাল সূর্যোদয় হয়েছে, আর সে-আলোয় প্ৰদীপের আলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পীর সাহেব আজ দফায় দফায় ওয়াজ করেছেন। যখন ওয়াজ শেষ করে তিনি বসে পড়েন তখন অনেকক্ষণ ধরে তাঁর বিশাল বাপু দ্রুত শ্বাসের তালে তালে ওঠা-নমা করে, আর শুভ্র চওড়া কপালে জমে ওঠা বিন্দু-বিন্দু ঘাম খোলা মাঠের উজ্জল আলোয় চকচক করে। পাখা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি জোরে হাত চালায়।
এ-সময় পীর সাহেবের প্রধান মুরিদ মতলুব মিঞা হুজুরের গুণাগুণ সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলে। এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, সে বলে, পীর সাহেব সূৰ্যকে ধরে রাখবার ক্ষমতা রাখেন। উদাহরণ দিয়ে বলে হয়তো তিনি এমন এক জরুরী কাজে আটকে আছেন যে, ওধারে জোহরের নামাজের সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা হলে কী হবে, তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত না হুকুম দেবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত সূৰ্য এক আঙলি নড়তে পারে না! শুনে কেউ আহা-আহা বলে, কারো-বা। আবার ডুকরে। কান্না আসে। কেবল মজিদের চেহারা কঠিন হয়ে ওঠে। সজোরে নড়তে থাকা পাখাটার পানে তাকিয়ে সে মূর্তিবৎ বসে থাকে।
আধা ঘণ্টা পরে শীতল দ্বিপ্ৰাহরিক আমেজে জনতা ঈষৎ ঝিমিয়ে এসেছে, এমনি সময়ে হঠাৎ জমায়েতের নানাস্থান থেকে রব উঠল। একটা ঘোষণা মুখে মুখে সারা ময়দানে ছড়িয়ে পড়ল।—গীর সাহেব আবার ওয়াজ করবেন।
পীর সাহেবের আর সে-গলা নেই। সূক্ষ্ম তারের কম্পনের মতো হাওয়ায় বাজে তাঁর গলা। জমায়েতের কেউ প্ৰতি মুহুর্তে হা-হা করে উঠেছে বলে সে-ক্ষীণ আওয়াজও সব প্ৰান্তে শোনা যায় না। কিন্তু, মজিদ কান খাড়া করে শোনে, এবং শোনবার প্রচেষ্টার ফলে চোখ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
পীর সাহেবের গলার কম্পমান সূক্ষ্ম তারের মতো ক্ষীণ আওয়াজই আধা ঘণ্টা ধরে বাজে। তারপর বিচিত্র সুর করে তিনি একটা ফারসি বায়েত বলে ওয়াজ ক্ষান্ত করেন।
বলেন, সোহবতে সোয়ালে তুরা সোয়ালে কুনাদ (সুসঙ্গ মানুষকে ভালো করে)। শুনে জমায়েতের অর্ধেক লোক কেঁদে ওঠে। তারপর তিনি যখন বাকীটা বলেন–সোেহবতে তোয়ালে তুরা তোয়ালে কুন্নাদ (কুসঙ্গ তেমনি তাকে আবার খারাপ করে।)–তখন গোটা জমায়েতেরই সমস্ত সংযমের বাঁধ ভেঙে যায়, সকলে হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে।
বসে পড়ে পীর সাহেব পাখাওয়ালার পানে লাল হয়ে ওঠা চোখে তাকিয়ে পাখ-সঞ্চালন দ্রুততর করবার জন্য ইশারা করছেন এমন সময়ে সামনের লোকেরা সব ছুটে গিয়ে পীর সাহেবকে ঘেরাও করে ফেলল। হঠাৎ পাগল হয়ে উঠেছে তারা। যে যা পারল ধরলকেউ পা, কেউ হাত, কেউ আস্তিনের অংশ।
তারপর এক কাণ্ড ঘটল। মানুষের ভাবমত্ততা দেখে পীর সাহেব অভ্যস্ত। কিন্তু আজকের ক্ৰন্দনরত জমায়েতের নিকটবতী লোকগুলোর সহসা এই আক্রমণ তাঁর বোধ হয় সন্থ হলো না। তিনি হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যুবকের সাবলীল সহজ ভঙ্গিতে মাথার ওপরে গাছটার ডালে উঠে গেলেন। দেখে হায় হায় করে উঠল। পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা আর তা শুনে জমায়েতও হায় হায় করে উঠল। সাঙ্গপাঙ্গরা তখন সুর করে গীত ধরলে এই মর্মে যে, তাদের পীর সাহেব তো শূন্যে উঠে গেছেন, এবার কী উপায়?
পীর সাহেব অবশ্য ডালে বসে তখন দিব্যি বাতরস-ভারী পা দোলাচ্ছেন। ফাগুনের আগুনের দ্রুত বিস্তারের মতো পীর সাহেবের শূন্যে ওঠার কথা দেখতে না দেখতে ছড়িয়ে গেলো। যারা তখন ফারসি বয়েতের অর্থ না বুঝে কেবল সুর শুনেই কেঁদে উঠেছিল, এবার তারা মড়া-কান্না জুড়ে বসল। পীর সাহেব কী তাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছেন? কিন্তু গেলে, অজ্ঞ মুর্থ তারা পথ দেখবে কী করে?
জোয়ারী ঢেউ-এর মতো সম্মুখে ভেসে এল জনস্রোত। অনেক মড়া-কান্না ও আকুতি-বিকুতির পর পীর সাহেব বৃক্ষডাল হতে অবশেষে অবতরণ করলেন।
বেলা তখন বেশ গড়িয়ে এসেছে, আর মাঠের ধারে গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘতর হয়ে সে মাঠেরই বুক পর্যন্ত পৌঁছেছে, এমন সময় পীর সাহেবের নির্দেশে একজন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, —ভাই সকল, আপনার সব কাতারে দাঁড়াইয়া যান।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নামাজ শুরু হয়ে গেলো।
নামাজ কিছুটা অগ্রসর হয়েছে এমন সময় হঠাৎ সাবা মাঠটা যেন কেঁপে উঠল। শতশত নামাজ-রত মানুষের নীরবতার মধ্যে খ্যাপা কুকুরের তীক্ষ্মতায় নিঃসঙ্গ একটা গল আর্তনাদ করে উঠল।
সে-কণ্ঠ মজিদের।
—যতসব শয়তানি, বেদাতি কাজকারবার। খোদার সঙ্গে মস্কারা! নামাজ ভেঙে কেউ কথা কইতে পারে না। তাই তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাই নীরবে মজিদের অশ্রাব্য গালাগালি শুনলে।
মোনাজাত হয়ে গেলে সাঙ্গাপাঙ্গদের তিনজন এগিয়ে এল। একজন কঠিন গলায় প্রশ্ন করল, –চাঁচামিচি করত কিছকা ওয়াস্তে?
লোকটি আবার পশ্চিমে এলেম শিখে এসে অবধি বাংলা জবানে কথা কয় না।
মজিদ বললে,–কোন নামাজ হইলো এটা?
—কাহে? জোহরকা নামাজ হুয়া।
উত্তর শুনে আবার চীৎকার করে গালাগাল শুরু করল মজিদ। বললে, এ কেমন বেশরিয়তি কারবার, আছরের সময় জোহরের নামাজ পড়া?
সাঙ্গাপাঙ্গরা প্ৰথমে ভালোভাবেই বোঝাতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা। তারা বললে যে, মজিদ তো জানেই পীর সাহেবের হুকুম ব্যতীত জোহরের নামাজের সময় যেতে পারে না। পশ্চিম থেকে এলেম শিখে এসেছে, সে বোঝানোর পস্থাটা প্ৰায় বৈজ্ঞানিক করে তোলে। সে বলে যে, যেহেতু, ভাদ্রমাস থেকে ছায়া আসলী এক-এক কদম করে বেড়ে যায়, সেহেতু, দুকদমের ওপর দুই লাঠি হিসেব করে চমৎকার জোহরের নামাজের সময়ে আছে।
মজিদ বলে, মাপো। এবং পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা যতদূর সম্ভব দীর্ঘ দীর্ঘ ছয় কদম ফেলে তার সঙ্গে দুই লাঠি যোগ করেও যখন ছায়ার নাগাল পেল না। তখন বললে, তর্ক যখন শুরু হয়েছিল তখন ছায়া ঠিক নাগালের মধ্যেই ছিল।
শুনে মজিদ কুৎসিততমভাবে মুখ বিকৃত করে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকবার মুখ খিস্তি করে বললে,–কেন, তখন তোগো পীর ধইরা রাখবার পারল না সুরুযটারে?
তারপর সরে গিয়ে সে বজ্ৰকণ্ঠে ডাকলে,–মহব্বতনগর যাইবেন কে কে?
মহব্বতনগর গ্রামের লোকেরা এতক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। কারো মনে ভয়ও হয়েছিল।–এই বুঝি পীর সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা ঠেঙিয়ে দেয় মজিদকে! এবার তার ডাক শুনে একে একে তারা ভিড় থেকে খসে এল।
মতিগঞ্জের সড়কে উঠে ফিরতিমুখো পথ ধরে মজিদ একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে থুথু ফেলে, তওবা কেটে, নিশ্বাসের নীচে শয়তানকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করল, তারপর দ্রুতপায়ে হাঁটিতে লাগল। সঙ্গের লোকেরা কিন্তু কিছু বললে না। তারা যদিও মজিদকে অনুসরণ করে বাড়ি ফিরে চলেছে কিন্তু মন তাদের দোটানার দ্বন্দ্বে দোল খায়। চোখে তাদের এখনো অশ্রদ্ধর শুষ্ক রেখা।
সে-রাত্রে ব্যাপারীকে নিয়ে এক জরুরী বৈঠক বসল। সবাই এসে জমলে, মজিদ সকলের পানে কয়েকবার তাকাল। তার চোখ জ্বলছে একটা জ্বালাময়ী অথচ পবিত্র ক্ৰোধে। শয়তানকে ধ্বংস করে মুখ, বিপথচালিত মানুষদের রক্ষা করার কল্যাণকর বাসনায় সমস্ত সত্তা সমুজ্জল হয়ে উঠেছে।
মজিদ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য পেশ করল।–ভাই সকলরা, সকলে অবগত আছেন যে, বেদাতি কোনো কিছু খোদাতালার অপ্রিয়, এবং সেই থেকে সত্যিকার মানুষ যারা তাদেরকে তিনি দূরে থাকতে বলেছেন। এ-কথাও তারা জানে যে, শয়তান মানুষকে প্ৰলুব্ধ করবার জন্যে মনোমুগ্ধকর রূপ ধারণ করে তার সামনে উপস্থিত হয় এবং অত্যন্ত কৌশল সহকারে তাকে বিপথে চালিত করবার প্রয়াস পায়। শয়তানের সে-রূপ যতই মনোমুগ্ধকর হোক না কেন, খোদার পথে যারা চলাচল করে তাদের পক্ষে সে-মুখোশ চিনে ফেলতে বিন্দুমাত্র দেরী হয় না। তাছাড়া শয়তানের প্রচেষ্টা যতই নিপুণ হোক না কেন, একটি দুর্বলতার জন্যে তার সমস্ত কারসাজি ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা হলো বেদাঁতি কাজকারবারের প্রতি শয়তানের প্রচণ্ড লোভ। এখানে এ-কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, শয়তান যদি মানুষকে খোদার পথেই নিয়ে গেলো, তাহলে তার শয়তানি রইল কোথায়।
ভনিতার পর মজিদ আসল কথায় আসে। একটু দম নিয়ে সে আবার তার বক্তব্য শুরু করে।—আউয়ালপুরে তথাকথিত যে-গীর সাহেবের আগমন ঘটেছে তার কার্যকলাপ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে উক্ত মন্তব্যের যথার্থতা প্ৰমাণিত হয়। মুখোশ তার ঠিকই আছে— যে মুখোশকে ভুল করে মানুষ তাঁর কবলে গিয়ে পড়বে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য মানুষকে বিপথে নেয়া, খোদার পথ থেকে সরিয়ে জাহান্নামের দিকে চালিত করা। সেই উদ্দেশ্যই তথাকথিত পীরটি কৌশলে চরিতার্থ করবার চেষ্টায় আছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য খোদা সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু একটা ভুয়ো কথা বলে তিনি এতগুলো ভালো মানুষের নামাজ প্ৰতিদিন মকরূহ করে দিচ্ছেন। তাঁর চক্রান্তে পড়ে কত মুসল্লি ইমানদার মানুষ–যাঁরা জীবনে একটিবার নামাজ কাজ করেননি তাঁরা খোদার কাছে গুণাহ্ করছেন।
এই পর্যন্ত বলে বিস্ময়াহত স্তব্ধ লোকগুলোর পানে মজিদ। কতক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর আরো কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাড়িতে হাত বুলায়।
গলা কেশে এবার খালেক ব্যাপারী বৈঠকের পানে তাকিয়ে বাজাখাই গলায় প্রশ্ন করে, হুনলেন তো ভাই সকল?
সাব্যস্ত হলো, অন্তত, এ-গ্রামের কোনো মানুষ পীর সাহেবের ক্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।
এরপর মহব্বতনগরের লোক আওয়ালপুরে একেবারে গেলো যে না, তা নয়। কিন্তু গেলো অন্য মতলবে। পরদিন দুপুরেই একদল যুবক মজিদকে না জানিয়ে একটা জেহাদী জোশে বলীয়ান হয়ে পীর সাহেবের সভায় গিয়ে উপস্থিত হলো। এবং পরে তারা বড় সড়কটার উত্তর দিকে না গিয়ে গেলো দক্ষিণ দিকে করিমগঞ্জে। করিমগঞ্জে একটি হাসপাতাল আছে।
অপরাহ্নে সংবাদ পেয়ে মজিদ ক্যানভাসের জুতো পরে ছাতা বগলে করিমগঞ্জ গেলো। হাসপাতালে। আহত ব্যক্তিদের পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে শয়তান ও খোদার কাজের তারতম্য আরো বিষদভাবে বুঝিয়ে বলল, বেহেস্ত ও দোজখের জলজ্যান্ত বৰ্ণনাও করল। কতক্ষণ।
কালু মিঞা গোঙায়। চোখে তার বেদনার পানি। সে বলে শয়তানের চেলারা তার মাথাটা ফাটিয়ে দুফাঁক করে দিয়েছে। মজিদ তাকিয়ে দেখে, মস্ত ব্যাণ্ডেজ তার মাথায়। দেখে সে মাথা নাড়ে, দাড়িতে হাত বুলায়, তারপর দুনিয়া যে মস্ত বড় পরীক্ষা-ক্ষেত্র তা মধুর সুললিত কণ্ঠে বুঝিয়ে বলে। কালু মিঞা শোনে কি-না কে জানে, একঘেয়ে সুরে গোঙাতে থাকে।
রাতে এশার নামাজ পড়ে বিদায় নিতে মজিদ হঠাৎ অন্তরে কেমন বিস্ময়কর ভাব বোধ করে। কম্পাউণ্ডারকে ডাক্তার মনে করে বলে,—পোলাগুলিরে একটু দেখবেন। ওরা বড় ছোয়াবের কাম করছে! ওদের যত্ন নিলে আপনারও ছোয়াব হইবো।
ভাঙ-গাঁজা খাওয়া রসকষশূন্য হাড়গিলে চেহারা কম্পাউণ্ডারের। প্ৰথমে দুটো পয়সার লোভে তার চোখ চকচক করে উঠেছিল, কিন্তু ছোয়াবের কথা শুনে একবার আপাদমস্তক মজিদকে দেখে নেয়। তারপর নিরুত্তরে হাতের শিশিটা ঝাকাতে ঝাকাতে অন্যত্র চলে যায়।
গ্রামে ফিরে মজিদ কালু মিঞার বাপের সঙ্গে দুচারটি কথা কম। বুড়ো এক ছিলিম তামাক এনে দেয়। মজিদ নিজে গিয়ে ছেলেকে দেখে এসেছে বলে কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করে। হুক তুলে নেবার আগে মজিদ বলে,–কোনো চিন্তা করবান মিঞা, খোদা ভরসা। তারপর বলে যে, হাসপাতালের বড় ডাক্তারকে সে নিজেই বলে এসেছে, ওদের ষেন আদর ষত্ন হয়। ডাক্তারকে অবশ্য কথাটা বলার কোনো প্ৰয়োজন ছিল না, কারণ, গিয়ে দেখে, এমনিতেই শাহী কাণ্ডকারখানা। ওষুধপত্র বা লেবা শুশ্ৰষার শেষ নেই।
খুব জোরে দম কষে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আরো শোনায় যে, তবু তার কথা শুনে ডাক্তার বললেন, তিনি দেখবেন ওদের যেন অযত্ন বা তকলিফ না হয়। তারপর আরেকটা কথার লেজুড় লাগায়। কথাটা অবশ্য মিথ্যে; এবং সজ্ঞানে সুস্থ দেহে মিথ্যে কথা কয় বলে মনে মনে তাওবা কাটে। কিন্তু কী করা যায়; দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা। সময়-অসময়ে মিথ্যে কথা না বললে নয়।
বলে, ডাক্তার সাহেব তার মুরিদ কি-না তাই সেখানে মজিদের বড় খাতির।
বাইরে নিরুদ্বিগ্ন ও স্বচ্ছন্দ থাকলেও ভেতরে ভেতরে মজিদের মন ক-দিন ধরে চিন্তায় ঘুরপাক খায়। আওয়ালপুরে যে-গীর সাহেব আস্তানা গেড়েছে তিনি সোজা লোক নন। বহু পুরুষ আগে দীর্ঘ পথশ্ৰম স্বীকার করে আবক্ষ দাড়ি নিয়ে শানদার জোব্ববাজুব্বা পরে যে লোকটি এ-দেশে আসেন, তাঁর রক্ত ভাটির দেশের মেঘ পানিতেও একেবারে আ-নোনা হয়ে যায়নি। পানসা হয়ে গিয়ে থাকলেও পীর সাহেবের শরীরে সে-ভাগ্যান্বেষী দুঃসাহসী ব্যক্তিরই রক্ত। কাজেই একটা পাল্টা জবাবের অস্বস্তিকর প্ৰত্যাশায় থাকে৷ মজিদ। মহকবতনগরের লোকেরা আর ওদিকে যায় না। কাজেই, আক্রমণ যদি একান্ত আসেই, আগেভাগে তার হদিশ পাবার জো নেই। সে-জন্যে মজিদের মনে অস্বস্তিটা রাতদিন আরো খচখচ করে।
মজিদ ও তরফ থেকে কিছু একটা আশা করলে কী হবে, তিনগ্রাম ডিঙিয়ে মহকবতনগরে এসে হামলা করার কোনো খেয়াল পীর সাহেবের মনে ছিল না। তার প্রধান কারণ তাঁর জঙ্গীফ অবস্থা। এ-বয়সে দাঙ্গাবাজি হৈ হাঙ্গামা আর ভালো লাগে না। সকরোদদের মধ্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে প্রধান মুরিদ মতলুব খাঁ একটা জঙ্গী ভাব দেখালেও হুজুরের নিস্পৃহতা দেখে শেষ পর্যন্ত তারা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পীর সাহেব অপরিসীম উদারতা দেখিয়ে বলেন, কুত্তা তোমাকে কামড়ালে তুমিও কী উলটে তাকে কামড়ে দেবে? যুক্তি উপলব্ধি করে সাকরেদর নিরস্ত হয়। তবু স্থির করে যে, মজিদ কিংবা তার চেলারা যদি কেউ এধারে আসে। তবে একহাত দেখে নেওয়া যাবে। সে-দিন কালুদের কল্লা যে ধড় থেকে আলাদা করতে পারেনি, সে-জন্যে মনে প্ৰবল আফসোস হয়।
গ্রামের একটি প্রাণী। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করে না। সে অন্দরের লোক, আর তার তাগিদটা প্ৰায় বাঁচা-মিরার মতো জোরাল। পীর সাহেবের সাহায্যের তার একান্ত প্রয়োজন। না হলে জীবন শেষ পৰ্যন্ত বিফলে যায়।
সে হলো খালেক ব্যাপারীর প্রথম বিবি আমেনা। নিঃসন্তান মানুষ। তেরো বছর বয়সে বিয়ে করেছিল, আজ তিরিশ পেরিয়ে গেছে। শূন্য কোল নিয়ে হা-হুতাশের সঙ্গে বুক বেঁধে তবু থাকা যেত, কিন্তু চোখের সামনে সতীন তনু বিবিকে ফি-বৎসর আস্ত আস্ত সন্তানের জন্ম দিতে দেখে বড় বিবির আর সন্থ হয় না। দেখা সওয়ার একটা সীমা আছে, যা পেরিয়ে গেলে তার একটা বিহিত করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আওয়ালপুরে পীর সাহেবের আগমন সংবাদ পাওয়া অবধি আমেনা বিবি মনে একটা আশা পোষণ করছিল যে, এবার হয়তো বা একটা বিহিত করা যাবে। আগামী বছর তনু বিবির কোলে যখন নোতুন। এক আগন্তুক ট্যা-ট্যা করে উঠবে তখন সেও কণ্ঠ কাতর করে বলতে পারবে, তার গাটা কেমন-কেমন করছে, বুক ঠেলে কেবল যেন বমি আসতে চায়। তখন নানিবুড়ীর ডাক পড়বে। শেষে নানিবুড়ী মাথা নেড়ে হেসে রসিকতা করে বলবে, ওস্তাদের মীর শেষ কাটালে। কারণ যৌবনের দিক থেকে সে তানু বিবির মতো জোয়ার-লাগা ভরাগাঙ না হলেও একেবারে টসকোনো নয়, বোঁচা-চ্যাবকা কালো মানুষও নয়। রঙে ছাতা পড়বার উপক্রম করলেও এখনো সে-রঙ ধবধব করে, নাকে সতীনের মতো জ্বলজ্বলে নাকছবি না থাকলেও তা খাড়া, টিকালে। তার সন্তান আকাশের চাঁদের মতো সুন্দর হবেই।
কিন্তু মুশকিল হলো কথাটা পাড়া নিয়ে। প্রথমত, ব্যাপারীকে নিরালা পাওয়া দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, চোখের পলকের জন্যে পেলেও তখন আবার জিহবা নড়ে না। ফিকির ফন্দি করতে করতে এ-দিকে মজিদ কাণ্ডটা করে বসল। কিন্তু আমেনা বিবি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুযোগটা ছাড়া যায় না। সারা জীবন যে মেয়েলোকের সন্তান হয়নি, পীর সাহেবের পানিপড়া খেয়ে সে-ও কোলে ছেলে পেয়েছে।
একদিন লজ-শরমের বালাই ছেড়ে আমেনা বিবি বলেই বসে, পীর সাবের থিক একটু পানিপড়া আইনা দেন না।
শুনে অবাক হয় ব্যাপারী। নিটোল স্বাস্থ্য বিবির, কোনোদিন জ্বরজারি, পেট-কামড়ানি পর্যন্ত হয় না।
—পানিপড়া ক্যান? আমেনা বিবি লজ্জা পেয়ে আলগোছে ঘোমটা টেনে সেটি আরো দীর্ঘতর করে, আর তার মনের কথা ব্যাপারী যেন বিনা উত্তরেই বোঝে।— তাই দোয়া করে মনে মনে।
উত্তর পায় না বলেই ব্যাপারী বোঝে। তারপর বলে,-আইচ্ছা। কিন্তু পরীক্ষণেই মনে পড়ে যে, পীর সাহেবের ত্ৰিসীমায় আর তো ঘোষা যায় না, অবশ্য পীর সাহেবকে মজিদ খোদ ইবলিশ শয়তান বলে ঘোষণা করলেও তবু বউ-এর খাতিরে পানিপড়ার জন্যে তাঁর কাছে যেতে বাধত না, কারণ পীর নামের এমন মাহাত্ম্য যে, শয়তান ডেকেও সে নামকে অন্তরে অন্তরে লেবাস-মুক্ত করা যায় না। গাভুরি-চাষী-মাঠাইলারা পারলেও অন্তত বিস্তর জমিজমার মালিক খালেক ব্যাপারী তা পারে না। কিন্তু সাধারণ লোকে যেটা স্বচ্ছন্দে করতে পারে সেটা আবার তার দ্বারা সম্ভব নয়। তা হলো শয়তানকে শয়তান ডেকে সমাজের সামনে ভরদুপুরে তাকে আবার পীর ডাকা। এবং সমাজের মূল হলো একটি লোক–যার আঙুলের ইশারায় গ্রাম ওঠে বসে, সাদাকে কালো বলে, আসমানকে জমিন বলে। সে হলো মজিদ। জীবনস্রোতে মজিদ আর খালেক ব্যাপারী কী করে এমন খাপে খাপে মিলে গেছে যে, অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের পক্ষে উলটো পথে যাওয়া সম্ভব নয়। একজনের আছে মাজার, আরেক জনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না। জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।
সে জন্যে সে ভাবিত হয়, দু’দিন আমেনা বিবির কান্নাসজল কণ্ঠের আকুতি মিনতি উপেক্ষা করে। অবশেষে বিবির কাতর দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরেই হয়তো একটা উপায় ঠাহর করে ব্যাপারী।
ঘরে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর এক ভাই থাকে। নাম ধলামিঞা। বোকা কিছিমের মানুষ, পরের বাড়িতে নির্বিবাদে খায় দায় ঘুমায়, আর বোন জামাইয়ের ভাত এতই মিঠা লাগে যে, নড়ার নাম করে না বছরান্তেও। আড়ালে আড়ালে থাকে। কাচিৎ কখনো দেখা হয়ে গেলে দুটি কথা হয় কি হয় না, কোনোদিন মেজাজ ভালো থাকলে ব্যাপারী হয়তো-বা শালার সঙ্গে খানিক মস্করাও করে।
তাকে ডেকে ব্যাপারী বললে : একটা কাম করেন। ধলামিঞা?
ব্যাপারীর সামনে বসে কথা কইতে হলে চরম অস্বস্তি বোধ করে সে। কেমন একটা পালাই-পালাই ভাব তাকে অস্থির করে রাখে। কোনোমতে বলে, –কী কন দুলামিঞা?
কী তার কাজ ব্যাপারী। আগাগোড়া বুঝিয়ে বলে। আগে প্রথম বিবির দিলের খায়েশের কথা দীর্ঘ ভনিতাসহকারে বর্ণনা করে। তারপর বলে, ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়, এবং আওয়ালপুর তাকে রওয়ানা হতে হবে শেষরাতের অন্ধকারে, যাতে কাকপক্ষীও খবর না পায়। আর সেখানে গিয়ে তাকে প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ গ্রাম থেকে গেছে। এ-কথা ঘূণাক্ষরেও বলতে পারবে না। বলবে যে, করিমগঞ্জের ওপারে তার বাড়ি। বড় বিপদে পড়ে এসেছে পীর সাহেবের দোয়াপানির জন্যে। তার এক নিকটতম নিঃসন্তান আত্মীয়ার একটা ছেলের জন্যে বড় সখা হয়েছে। সখের চেয়েও যেটা বড় কথা, সেটা হলো এই যে, শেষ পর্যন্ত কোনো ছেলেপুলে যদি না-ই হয় তবে বংশে বাতি জ্বালাবার আর কেউ থাকবে না। মোট কথা, ব্যাপারটা এমন করুণভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে, শুনে পীর সাহেবের মন গলে যেন পানি হয়ে যায়।
বিবির বড় ভাই, কাজেই রেস্তায় মুরুবিবা। তবু ধমকে ধামকে কথা বলে ব্যাপারী। পরগাছা মুরুবিকে আবার সম্মান, তার সঙ্গে আবার কেতাদুরন্ত কথা।
—কি গো ধলামিঞা, বুঝলান নি। আমার কথাডা?
–জি, বুঝছি। কাঁধ পর্যন্ত ঘাড় কাৎ করে ধলামিঞা জবাব দেয়। প্ৰস্তাব শুনে মনে মনে কিন্তু ভাবিত হয়। ভাবনার মধ্যে এই যে, আওয়ালপুর ও মহব্বতনগরের মাঝপথে একটা মস্ত তেঁতুল গাছ পড়ে, এবং সবাই জানে যে, সেটা সাধারণ গাছ নয়, দস্তুরমতে দেবংশি।
কাকপক্ষী যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন অনেক রাত। অত রাতে কী একাকী ঐ তেঁতুল গাছের সন্নিকটে ঘোষা যায়? ভাবনার মধ্যে এও ছিল যে, যে-সব দাঙ্গাহাঙ্গামার কথা শুনেছে, তারপর কোন সাহসে পা দেয় মতলুব খাঁর গ্রামে। তেঁতুল গাছের ফাঁড়িটা কাটলেও ঐখানে গিয়ে পীর সাহেবের দজলা সাঙ্গাপাঙ্গদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া নেহাত সহজ হবে না। নিজের পরিচয় নিশ্চয়ই সে লুকোবার চেষ্টা করবে, কিন্তু ধরা পড়ে যাবে না, কী বিশ্বাস! কে কখন চিনে ফেলে কিছু ঠিক নেই। যে ঢেঙা লম্বা, ধলামিঞা।
–ভাবেন কী? হুমকি দিয়ে ব্যাপারী প্রশ্ন করে।
–জি, কিছু না! তবু কয়েক মুহুর্ত তার পানে চেয়ে থেকে ব্যাপারী বলে,–আরেক কথা। কথাডা যানি আপনার বইনে না। হুনে। আপনারে আমি বিশ্বাস করলাম।
–তা করবার পারেন।
সারাদিন ধলামিঞা ভাবে, ভাবে। ভাবতে ভাবতে ধলামিঞার কালামিঞা বনে যাবার যোগাড়। বিকেলের দিকে কিন্তু একটা বুদ্ধি গজায়। ব্যাপারীর অনুপস্থিতির সুযোগে বাইরের ঘরে বসে। নলের হুঁকায় টান দিচ্ছিল, হঠাৎ সেটা নামিয়ে রেখে সে সরাসরি বাইরে চলে যায়। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ পা ফেলে। হাঁটিতে থাকে মোদাচ্ছের পীরের মাজারের দিকে। হাঁটার ঢঙে দেখে পথে দুচারজন লোক থ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।—তারা ভ্ৰক্ষেপ নেই।
বাইরেই দেখা হয় মজিদের সঙ্গে। গাছতলায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা কইছে। কাছে গিয়ে গলা নীচু করে সে বললে,–আপনার লগে একটু কথা আছিল।
গলাটা বিনয়ে নম্র হলেও উত্তেজনায় কাঁপছে।
খালেক ব্যাপারী তখন যে-দীর্ঘ ভনিতা সহকারে আমেনা বিবির মনের ইচ্ছার কথা প্ৰকাশ করেছিল, তারই ওপর রঙ ফেনিয়ে, এখানে-সেখানে দরদের ফোটা ছিটিয়ে, এবং ফেনিয়ে-ফুলিয়ে দীর্ঘতর কোরে ধলামিঞা কথা পাড়ে। বলে, মেয়েমানুষের মন, বড় অবুঝ। নইলে সাক্ষাৎ ইবলিশ শয়তান জেনেও তারই পানিপীড়া খাবার সাধ জাগবে কেন আমেনা বিবির? কিন্তু মেয়েমানুষ যখন পুরুষের গলা জড়িয়ে ধরে তখন আর নিস্তার থাকে না। খালেক ব্যাপারী আর কী করে। ধলামিঞাকে ডেকে বলে দিলো, আওয়ালপুরে গিয়ে পীর সাহেবটির কাছ থেকে সে যেন পানিপড়া নিয়ে আসে।
মজিদ। নীরবে শোনে। হঠাৎ তার মুখে ছায়া পড়ে। কিন্তু ক্ষণকালের জন্যে। তারপর সহজ গলায় প্রশ্ন করে,—তা কখন যাইবেন আওয়ালপুর?
ধলামিঞা হঠাৎ ফিচকি দিয়ে হাসে।
–আওয়ালপুর গেলে কি আর আপনার কাছে আহি? কী কেলা পানি-পড়াডা দিব হে লোকটা? বেচারীর মনে মনে যখন একটা ইচ্ছা! ধরছে তখন ফকির কাম কি ঠিক হইব?–আমি কই, আপনেই দেন পানিপড়াডা আর কথাডা একদিন চাইপা যান।
অনেকক্ষণ মজিদ চুপ হয়ে থাকে। এর মধ্যে মুখে ছায়া আসে, যায়। তার পানে চেয়ে আর তার দীর্ঘ নীরবতা দেখে ধলামিঞার সব উত্তেজনা শীতল হয়ে আসে। অবশেষে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে সে প্ৰশ্ন করে,–কী কন?
–কী আর কমু। এই সব কাম কী চাপাচাপি দিয়া হয়। এ কী আইন-আদালত না মামলা-মকদ্দমা? দলিল দস্তাবেজ জাল হয়, কিন্তু খোদাতালার কালাম জাল হয় না। আপনে আওয়ালপুরেই যান।
মুহুর্তে ধলামিঞার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে ভয়ে। রাতের অন্ধকারে দেবংশি তেঁতুল গাছটা কী যে ভয়াবহ ৰূপ ধারণ করে, ভাবতেই বুকের রক্ত শীতল হয়ে আসে। তাছাড়া পীর সাহেবের ডাণ্ডাবাজ চেলাদের কথা ভাবলেও গলা শুকিয়ে আসে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হয়তো ভয়টাকে হজম করে নিয়ে ভগ্নগলায় ধলামিঞা বলে,–আপনে না দিলে না দিলেন। কিন্তু হেই পীরের কাছে আমি যামু না।
—যাইবেন না। ক্যান? এবার একটু রুষ্ট স্বরে মজিদ বলে, ব্যাপারী মিঞা। যখন পাঠাইতেছেন তখন যাইবেন না ক্যান?
উক্তিটা দুইদিকে কাটে। কোনটা নিয়ে কোনটা ফেলে ঠিক করতে না পেরে ধলামিঞা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। অবশেষে কথাটার সঠিক মৰ্মাৰ্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা ছেড়ে সরাসরি বলে,–হেই কথা আমি বুঝি না। কাইল সকালে এক বোতল পানি দিয়া যামুনে, আপনি পইড়া দিবেন।
ধলামিঞার মতলব, শেষরাতে উঠে গ্রামের বাইরে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে, দুপুরের দিকে ফিরে এসে মজিদের কাছ থেকে বোতলটা নিয়ে যাবে। আর পীর সাহেবের খেদমতে পৌছে দেবার জন্যে ব্যাপারী যে-টাকা দেবে তার অর্ধেক বেমালুম পকেটস্থ করে বাকিটা মজিদকে দেবে। মজিদ প্ৰায় ঘরের লোক। ব্যাপারীর কাছে তার দাবী-দাওয়া নেই। দিলেও চলে, না দিলেও চলে। তবু কথাটা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে হলে মজিদের মুখকেও চাপা দিতে হয়।
–তাইলে পাকাপাকি কথা হইল। ভরদুপুরে আমি আসুম নে পানিপড়া নিবার জন্য।
তারপর তাড়াতাড়ি বলে, ঠাগের পিছনে বেহুদা টাকা ঢালন কী বিবেক-বিবেচনার কাম? টাকার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট এবং লোভনীয় বটে। কিন্তু তবুও মজিদ তার কথায় অটল থাকে। নিমরাজিও হয় না। কঠিন গলায় বলে,—না, আপনে আওয়ালপুরেই যান।
এতক্ষণ পর ধলামিঞা বোঝে যে, মজিদের কথাটা রাগের। বিবির খাতিরে ব্যাপারী মজিদের নির্দেশের বরখেলাফ কোরে সেই ঠগ-পীরের কাছেই লোক পাঠাবে পড়াপানি আনবার জন্যে।—সেটা তার পছন্দসই নয়। না হবারই কথা। ব্যাপারটা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার মতো। ধলামিঞা ভারী মুখ নিয়ে প্ৰস্থান করে। ঘরে ফিরে আবার ভাবতে শুরু করে। কিন্তু কোনো বুদ্ধি ঠাহর করবার আগেই মজিদ এসে উপস্থিত হয় ব্যাপারীর বৈঠকখানায়।
যতক্ষণ নোতুন। এক ছিলিম তামাক সাজানো হয় কোন্ধিতে, ততক্ষণ দুজনে গরু ছাগলের কথা কয়। দু’এক বাড়িতে গরুর ব্যারামের কথা শোনা যাচ্ছে! মজিদের ধামড়া গাইটা পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। রহীমা কত চেষ্টা করছে কিন্তু গাইটা দানা-পানি নিচ্ছে না মুখে। খাচ্ছেও না কিছু, দুধও দিচ্ছে না এক ফোঁটা।
তামাক এলে কতক্ষণ নীরবে ধূমপান করে মজিদ। তারপর এক সময় মুখ তুলে প্রশ্ন করে,—হেই পীরের বাচ্চ পীর শয়তানের খবর কী? এহনো ঈমানদার মানুষের সর্বনাশ করতাছে না সট্কাইছে?
প্রশ্ন শুনে খালেক ব্যাপারী ঈষৎ চমকে ওঠে, তারপর তার চোখের পাতায় নাচুনি ধরে। চোখ অনেক কারণেই নাচে। তাই শুধু নাচলেই ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ব্যাপারীর মনে হয়, তামাকের ধোয়ার পশ্চাতে মজিদের চোখ হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং সে-চোখ দিয়ে সে তার মনের কথা কেতাবের অক্ষরগুলোর মতো আগাগোড়া অনায়াসে পড়ে ফেলছে।
-কী জানি, কাইবার পারি না। অবশেষে ব্যাপারী উত্তর দেয়। কিন্তু আওয়াজ শুনে মনে হয় গলাটা যেন ধ্বসে গেছে হঠাৎ। সজোরে একবার কেশে নিয়ে বলে, হয়তো গেছে গিয়া।
মজিদ আস্তে বলে,—তাইলে আর তানার কাছে লোক পঠাইয়া কী করবেন?
–লোক পাঠামুতানার কাছে! বিস্ময়ে ব্যাপারী ফেটে পড়ে। কিন্তু মজিদের শীতল চোখ দুটোর পানে তাকিয়ে হঠাৎ সে বোঝে যে, মিথ্যা কথা বলা বৃথা। শুধু বৃথা নয়, চেষ্টা করলে ব্যাপারটা বড় বিসদৃশও দেখাবে। যে করেই হোক, মজিদ খবরটা জেনেছে।
একবার সজোরে কেশে বসে যাওয়া গলাকে অপেক্ষাকৃত চাঙ্গা করে তুলে ব্যাপারী বলে,–হেই কথা আমিও ভাবতাছি। আছে কী না আছে–হুদাহুদি পাঠান। তবু মেয়েমানুষের মন। সতীন আছে। ঘরে। ক্যামনে কখন দিলে চোট পায় ডর লাগে। তা যাক। পাইলে পাইল, না পাইলে নাই। আসলে মন বোঝান আর কী। ঠগ পীরের পানিপড়ায় কী কোনো কাম হয়?
ধাক্কাটা সামলে নিয়ে ব্যাপারী ধীরে ধীরে সব বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করে। বলে, মজিদকে সে বলে বলে করেও বলতে পারেনি। আসল কথা তার সাহস হয়নি, পাছে মজিদ মনে ধরে কিছু।
কথাটা মজিদের যে পছন্দ হয় তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সে হুঁকায় জোর টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে চোখ। গম্ভীর করে তোলে।
ব্যাপারীর মতো বিস্তর জমিজমার মালিক ও প্ৰতিপত্তিশালী লোক তাকে ভয় পায়–শুনে পুলকিত হবারই কথা। ব্যাপারী আরো বলে যে, ধলামিঞাকে বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছে–ঘূণাক্ষরেও কেউ যেন বুঝতে না পারে সে মহব্বতনগরের লোক। তাছাড়া, এ-গ্রামে কেউ যেন তাকে আওয়ালপুর যেতে না দেখে। কারণ, তাহলে মজিদের নির্দেশের বরখেলাপ করা হয় খোলাখুলিভাবে।
-ধলামিঞাকে যতটা বেকুফ ভাবছিলাম, ব্যাপারী বলে, ততটা বেকুফ হে না। হে ভাবছে ভূয়া পানি আইনা ফায়দা কী। তানার যখন একটা ছেলের সখ হইছেই…
মজিদ বাধা দেয়। ধলামিঞার গুণচর্চায় তার আকর্ষণ নেই। হঠাৎ মধুর হাসি হেসে বলে,–খালি আমার দুঃখডা এই যে, আপনার বিবি আমারে একবার কইয়াও দেখলেন না। আমার থিক ঠগ-পীর বেশী হইল? আমার মুখে কী জোর নাই?
—আহা-হা, মনে নিবেন না কিছু। মেয়েমানুষের মন। দূৱ থিকা যা হোনে তাতেই ঢলে।
–কথাডা ঠিক কইছেন। মজিদ মাথা নেড়ে স্বীকার করে। তারপর বলে, তয় কথা কি, তাগো কথা হুনলে পুরুষমানুষ আর পুরুষ থাকে না, মেয়েমানুষেরও অধম হয়। তাগো কথা হুনলে কি দুনিয়া চলে?
ব্যাপারীর মস্ত গোফে আর ঘন দাড়িতে পাক ধরেছে। মজিদের কথায় সে গভীরভাবে লজ পায়। তখনকার মতো মজিদের ভঙ্গিতেই বলে,—ঠিকই কইছেন কথাডা। কিন্তু কি করি। এহন। কাইন্দাকাইটা ধরছে বিবি।
–তানারে কন, পেটে যে বেড়ি পড়ছে হে বেড়ি না খোলন পর্যন্ত পোলাপাইনের আশা নাই। শয়তানের পানিপড়া খাইয়া কি হে বেড়ি খুলবো?
পেটে বেড়ি পড়ার কথা সম্পূর্ণ নোতুন শোনায়। শুনে ব্যাপারীর চোখ হঠাৎ কৌতুহলে ভরে ওঠে। সে ভাবে, বেড়ি, কিসের বেড়ি?
মজিদ হাসে। ব্যাপারীর অজ্ঞতা দেখেই তার হাসি পায়। তারপর বলে,–পেটে বেড়ি পড়ে বইলাই তো স্ত্রীলোকের সন্তানাদি হয় না। কারো পড়ে সাত প্যাঁচ, কারো চোদ্দ। একুশ বেড়িও দেখেছি। একটা। তয় সাতের উপরে হইলে ছাড়ান যায় না। আমার তো চোদ্দ প্যাঁচ।
ব্যাপারী উৎকষ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,–আমার বিবিরড ছাড়ান যায় না?
–ক্যান ছাড়ান যায় না। তয় কথা হইতেছে, আগে দেখন লাগবে। কয় প্যাঁচ তানার। কথাটা শুনে ব্যাপারী আবার না ভাবে যে, মজিদ তার স্ত্রীর উদরাঞ্চল নগ্নদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে দেখবে–তাই তাড়াতাড়ি বলে, এর একটা উপায় আছে।
উপায়টা কী, বলে মজিদ। একদিন সেহরী না খেয়ে আমেনা বিবিকে রোজা রাখতে হবে। সেদিন কারে সঙ্গে কথা কইতে পারবে না এবং শুদ্ধচিত্তে সারাদিন কোরান শরীফ পড়তে হবে। সন্ধ্যার দিকে এফতার না করে মাজার শরীফে আসতে হবে। সেখানে মজিদ বিশেষ ধরনের দোয়া-দরূদ পড়ে একটা পড়াপানি তৈরী করে তাকে পান করতে দেবে। তারপর আমেনা বিবিকে মাজারের চারপাশে সাতবার ঘুরতে হবে।
যদি সাত প্যাঁচ হয় তবে সাত পাঁক দেবার পরই হঠাৎ তার পেট ব্যথায় টনটন করে উঠবে। ব্যথাটা এমন হবে যে, মনে হবে প্রসববেদনা উপস্থিত হয়েছে।
ব্যাপারী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করে,—আর সাত পাকে যদি ব্যথা না ওঠে?
–তয় বুঝতে হইব যে, তানার চোদ্দ প্যাঁচ কি আরো বেশী। সাত প্যাঁচ হইলে দুশ্চিন্তার কারণ নাই।
তারপর মজিদ আবার গরু ছাগলের কথা পাড়ে। এক সময় আড়চোখে ব্যাপারীর পানে তাকিয়ে দেখে, গৃহপালিত জীবজন্তুর ব্যারামের কথায় তেমন মনোযোগ যেন নেই তার। আরো দুচারটে অসংলগ্ন কথার পর মজিদ উঠে পড়ে।
ফেরবার পথে মোল্লা শেখের বাড়ির কাছে কঁঠাল গাছের তলে একটা মূর্তি নজরে পড়ে। মূর্তি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল না, তাকে আসতে দেখে দাঁড়িয়েছে। মগরেবের কিছু দেরী আছে, কিন্তু শীতসন্ধ্যা ধোঁয়াটে বলে দূর থেকে অস্পষ্ট দেখায় সে-মূর্তি। তবু তাকে চিনতে মজিদের এক পলক দেরী হয় না। সে হাসুনির মা। মুখটা ওপাশে ঘুরিয়ে আলতভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
নিকটবর্তী হতেই হাসুনির মা কেমন এক কান্নার ভঙ্গিতে মুখ হাতে ঢাকে। আরো কাছে গিয়ে মজিদ থমকে দাঁড়ায়, দাড়িতে হাত সঞ্চালন করে কয়েক মুহুর্ত তাকে চেয়ে দেখে। তারপর বলে, -কী গো হাসুনির মা?
যে-কান্নার ভঙ্গিতে তখন হাতে মুখ ঢেকেছিল, সে এবার মজিদের প্রশ্নে আস্তে নাকিসুরে কেঁদে ওঠে। কান্নাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আসল উদ্দেশ্য এই বলা যে, যা ঘটছে তা হাসবার নয়, কান্নার ব্যাপার।
আকস্মিক উদ্বেগ বোধ করে মজিদ। মেয়েটার চলন-বিলন কেমন যেন নম্র। বয়স হলেও আনাড়ী বেঠিকপানী ভাব। হাতে নিলে যেন গলে যাবে। মাসখানেক আগে একদিন শেষরাতে খড়কুটোর উজ্জল আলোয় যার নগ্ন বাহু-পিঠ-কাঁধ দেখেছিল মজিদ, সে যেন ভিন্ন কোনো মানুষ। এখন তাকে দেখে শ্বসন দ্রুততর হয় না।
কণ্ঠে দরদ মাখিয়ে মজিদ প্রশ্ন করে,–কী হইছে তোমার বিটি?
এবার নাক ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে হাসুনির মা অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,–মা মরছে!
বজ্রাহত হবার ভান করে মজিদ। আর তার মুখ দিয়ে অভ্যাসবশত সে-কথাটাই নিঃসৃত হয়, যা আজ কতশত বছর যাবৎ কোটি কোটি খোদার বান্দারা অন্যের মৃত্যু সংবাদ শুনে উচ্চারণ করে আসছে। তারপর বলে,–আহা ক্যামনে মরলে গো বেটি?
–এ্যামনে।
এমনি মারা গেছে কথাটা কেমন যেন শোনায়। পলকের মধ্যে মজিদের স্মরণ হয় তাহেরের বৃদ্ধ ঢেঙা বাপের বিচারের দৃশ্য। তার জন্য অবশ্য অনুতাপ বোধ কবে না। মজিদ। কেবল মনে হয় কথাটা। থেমে আবার প্রশ্ন করে,–ছ্যামরারা কই?
–আছে! ধান বিক্রি কইরা ঠ্যাঙের উপর ঠাঙ তুইলা আছে। ছোটডি কয় কেরায়া নায়ের মাঝি হইবো।
–দাফন কাফনের যোগাড়িযন্ত্র করতাছে নি?
—করতাছে। মোল্লা শেখে জানাজা পড়বে।
খেলাল তুলে হঠাৎ দাঁত খোঁচাতে থাকে৷ মজিদ, কপালে ক-টা রেখা ফোটে। তারপর চিন্তিত গলায় বলে,—মওতের আগে খোদার কাছে মাফ চাইছিল নি তহুর মা?
ধাঁ করে হাসুনির মা মুখ ঘুরিয়ে তাকায় মজিদের পানে। দেখতে না দেখতে চোখে ভয় ঘনিয়ে ওঠে।
–মাফ চাইছিল কিনা কেইবার পারি না!
কয়েক মুহুর্ত মজিদ। নীরব থাকে। এ-সময়ে কপালে আরো কয়েকটি রেখা ফুটে ওঠে। কিছু না বললেও হাসুনির মা বোঝে, মজিদ তার মায়ের কবরের আজাবের কথা ভাবে। মায়ের মৃত্যুতে সে তেমন কিছু শোক পেয়েছে বলা যায় না। বার্ধক্যের শেষ স্তরে কারো মৃত্যু ঘটলে দুঃখটা তেমন জোরালভাবে বুকে লাগে না। তবে মায়ের কেঁকড়ানো রাগ-ঝোলা যে মৃত দেহটি এখনো ঘরের কোণে নিম্পন্দভাবে পড়ে আছে সে-দেহটিকে নিয়ে যখন পেছনের জঙ্গলের ধারে কদম গাছের তলে কবর দেওয়া হবে, তখন হয়তো দমকা হাওয়ার মতো বুকে সহসা হাহাকার জগবে। তারপর শীঘ্ৰ আবার মিলিয়ে যাবে সে হাহাকার। কিন্তু তার মা নিঃসঙ্গ সে-কবরে লোক চোখের অন্তরালে অকথ্য যন্ত্রণাভোগ করবে–এ-কথা ভাবতেই মেয়ের মন ভয়ে ও বেদনায় নীল হয়ে ওঠে। কলাপাতার মতো কেঁপে উঠে সে প্রশ্ন করে,
–মায়ের কবরে আজব হইবো?
সরাসরি কথাটার উত্তর দিতে মজিদের মুখে বাঁধে। থেমে বলে,—খোদা তারে বেহেস্তে-নাছিব করো, আহা!
একবার আড়াচোখে তাকায় হাসুনির মা-র দিকে। চোখে মরণভীতির মতো গাঢ় ছায়া দেখে হয়তো বা একটু দুঃখও হয়। ভাবে, তার জন্যে লোকটি নিজেই দায়ী। আর যাই হোক, মজিদের কথাকে। যে অবহেলা করে খাড়া হয়ে দাড়াতে চায় তাকে সে মাফ করতে পারে না।
তারপর দ্রুতপায়ে হাঁটিতে শুরু করে মজিদ। বা ধারে মাঠ। দিগন্তের কাছে ধূসর ছায়া দেখে মনে ভয় হয়। নামাজ কাজ হবে না তো?
পরের শুক্রবার আমেনা বিবি রোজা রাখে। পীর সাহেবের পানিপড়া পাবে না জেনে প্ৰথমে নিরাশ হয়েছিল, কিন্তু পেট বেড়ির কথা শুনে এবং প্যাঁচ যদি সাতটির বেশী না হয় তবে মজিদ তার একটা বিহিত কমতে পারবে শুনে শীঘ্ৰ মন থেকে নিরাশা কেটে গিয়ে আশার সঞ্চার হলো। আস্তে আস্তে একটা ভয়ও এল মনে। প্যাঁচ যদি সাতের বেশী হয়, চোদ্দ কিংবা একুশ? মজিদের নিজের বউ-এর তো সাতের বেশী। সে নাকি একুশও দেখেছে।
ব্যাপারটা গোপন রাখবে স্থির করেছিল আমেনা বিবি; কিন্তু এ-সব কথা হলে বাতাসে কথা হতে শুরু করে। তানু বিবিই গল্প ছড়ায় এবং শুক্রবার সকাল থেকে নানা মেয়েলোক আসতে থাকে দেখা করতে। আমেনা বিবি করে সঙ্গে কথা কয় না। ঘরের কোণে আবছায়ার মধ্যে মাদুরে বসে গুনগুনিয়ে কোরান শরীফ পড়ে। মাথায় ঘোমটা, মুখটা ইতিমধ্যে দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে উঠেছে। পাড়াপাড়শীরা এসে দেখে দেখে যায়, তারপর আড়ালে তনু বিবির সঙ্গে নীচু গলায় কথা কয়। তানু বিবি অবিশ্রান্ত পান বানায় আর মেহমানদের খাওয়ায়।
দুপুরের কিছু আগে মজিদের বাড়ি থেকে রহীমা আসে। হাতে ঘষা-মাজা তামার গ্লাসে পানি। এমনি পানি নয়–পড়াপানি। মজিদ বলে পাঠিয়েছে গোসল করার আগে আমেনা বিবি পেটে পানিটা যেন ঘষে। দোয়া-দরূদ পড়া পানি, তার প্রতিটি ফোটা পবিত্র। কাজেই মাখবার সময় পুকুরের পানিতে দাঁড়িয়েই যেন মাখে।
রহীমা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যায় না। পান-সাদা খায়, তানু বিবির সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা কয়। এক সময় তানু বিবি প্রশ্ন করে, -বইন, আপনেও তো মাজারের পাশে সাত পাক দিছেন না?
–আমি দেই নাই।
–দেন নাই? বিস্মিত হয়ে তা নু বিবি বলে।—তায় তানি ক্যামনে জানলেন। আপনার চোদ্দ প্যাঁচ?
রহীমা লজ্জার হাসি হেসে বলে,—তানি যে আমার স্বামী। স্বামী হইলে এ্যামনেই বোঝে।
–তয় তানি বোঝেন না। ক্যান? তানু বিবির তানি মানে খালেক ব্যাপারী।
রহীমা মুশকিলে পড়ে। দুই তানিতে যে প্রচুর তফাৎ আছে সে কথা কী করে বোঝায়! তানু বিবি একটু বোকা অথচ আবার দেমাকি কিছিমের মানুষ। স্বামী বিস্তর জমিজমার মালিক বলে ভাবে, তার তুলনায় আর কেউ নেই। শেষে রহীমা আস্তে বলে,–তানি যে খোদার মানুষ।
আমেনা বিবিকে গোসল করিয়ে বাড়িতে ফেরে রহীমা। মজিদ উৎকষ্ঠিত স্বরে বলে,—পড়াপানিডা নাপাক জাগায় পড়ে নাই তো?
–না। যা পড়েছে তালাবের মধ্যেই পড়েছে।
সূৰ্য যখন দিগন্ত সীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন জোয়ান-মদ দু’জন বেহারা পাল্কি এনে লাগাল অন্দর ঘরের বেড়ার পাশে।
এক টিলের পথ, কিন্তু ব্যাপারীর বউ হেঁটে যেতে পারে না।
ব্যাপারী হাঁকে,–কই তৈয়ার হইছেন নি?
আমেনা বিবি। আবছায়ার মধ্যে তখনো গুনগুনিয়ে কোরান শরীফ পড়ছে। দুপুরের দিকে চেহারায় তবু কিছু জৌলুষ ছিল, এখন বেলা শেষের মান আলোয় একেবারে ফ্যাকাশে ঠেকে। তার চোখের সামনে আর্কাকাঁকা প্যাচানো অক্ষরগুলো নাচে, আবছা হয়ে গিয়ে আবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ছোট হয়ে আবার হঠাৎ বড় হয়ে যায়। আর শুষ্ক ঠোঁট দুটো থেকে থেকে থারথারিয়ে কেঁপে ওঠে।
তানু বিবি গিয়ে ডাকে,–ওঠ বুকু সময় হইছে।
ডাক শুনে ফাঁসির আসামীর মতো আমেনা বিবি চমকে উঠে৷ ভীতবিহবল দৃষ্টিতে একবার তাকায় সতীনের পানে। তারপর ছুরা শেষ করে কোরান শরীফ বন্ধ করে, গেলাফে ভরে, শেষে পালকম্পর্শের মতো আলগোছে তাতে চুমু খায়। সেটা ও রেহেলা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার মাথা ঘুরে চোখ অন্ধকার হয়ে যায়, আর শরীরটা টাল খেয়ে প্ৰায় পড়ে যাবার উপক্রম করে। তনু বিবি ধরে ফেলে তাকে। তারপর একটু আদা-নুন মুখে দিয়ে ঘরের কোণেই মগরেবের নামাজটা আমেনা বিবি সেরে নেয়।
উঠানের পথটুকু অতিক্রম করতে অত্যন্ত পরিশ্রান্ত বোধ করে আমেনা বিবি। পুরা ত্রিশ দিন রোজা রেখেও যে বিন্দুমাত্ৰ কাহিল হয় না সে একদিনের রোজাতেই একেবারে যেন ভেঙে গেছে। গায়ে মাথায় বুটিদার হলুদ রংঙের একটা চাদর দিয়েছে। সেটা বুকের কাছে চেপে ধরে গুটি গুটি পায়ে হাঁটে। কিসের এত ভয় তাকে পিষে ধরেছেকঘণ্টায় যে-ভয় দীর্ঘ রোগভোগ করা মানুষের মতো তাকে দুর্বল করে ফেলেছে? এক যুগেরও ওপরে যে নিঃসন্তান থাকতে পারল সে যদি জানে যে, ভবিষ্যতেও সে তেমনি নিঃসন্তান থাকবে, তবে এমন মুষড়ে যাবার কী আছে? এ প্রশ্ন আমেনা বিবি তার নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করে।
তবে কথা হচ্ছে কি, তেরো বছরের কথা একদিনে জানেনি, জেনেছে ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে, প্ৰতি বৎসরের শূন্যতা থেকে। সে শূন্যতাও আবার পরবর্তী বছরের আশায় শীঘ্ৰ ক্ষয়ে তেজশূন্য হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ জীবনের শূন্যতার কথা তেমনি বছরে বছরে যদি জানে তবে আঘাতটা দীর্ঘকালব্যাপী সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে তীব্রতায় হ্রাস পাবে, মনে কিছু-বা লাগলেও গায়ে লাগবে না। কিন্তু এক মুহুর্তে সে-কথা জানলে বুক ভেঙে যাবে না, বেঁচে থাকবার তাগিদ কি হঠাৎ ফুরিয়ে যাবে না?
সে-ভয়েই দুকদমের পথ ঘাস শুন্য মসৃণ ক্ষুদ্র উঠানটা পেরুতে গিয়ে আমেনা বিবির পা চলে না; সে-ভয়ের জন্যেই জোর পায় না কোমরে, চোখে ঝাপসা দেখে। একবার ভাবে, ফিরে যায় ঘরে। কাজ কী জেনে ভবিষ্যতের কথা। যাই হোক, দয়ালুদের মধ্যে সেরা দয়ালু। সে খোদার ইচ্ছাই তো অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হবে।
কিন্তু গুটি গুটি করে চলেও পা এগিয়ে চলে। মনের ইচ্ছায় না। হলেও চলে লোকদের খাতিরে। ঢাকঢোল বাজিয়ে যোগাড়যন্ত্র করিয়ে এখন পিছিয়ে যেতে পারে না। পুরুষ হলে হয়তো বা পারত, মেয়েলোক হয়ে পারে না। সমাজ যাকেই ক্ষমা করুক না কেন, বিরুদ্ধ ইচ্ছা দ্বারা চালিত, দো-মনা খুশির বশের মানুষের আয়োজন ভঙ্গ করা নারীকে ক্ষমা করে না। এ-সমাজে কোনো মেয়ে আত্মহত্যা করবে: বলে একবার ঘোষণা কোরে সে মনের ভয়ে আবার বিপরীত কথা বলতে পারে না। সমাজই আত্মহত্যার মাল-মশলা জুগিয়ে দেবে, সর্বতোভাবে সাহায্য করবে যাতে তার নিয়ত হাসিল হয়, কিন্তু ফাঁকি দিয়ে তাকে আবার বাঁচতে দেবে না। মেয়েলোকের মনের মস্করা সহ্য করতে অতটা দুর্বল নয় সমাজ। এখানে তাদের বেহুদীপনার জায়গা নেই।