করোনা ভাইরাসের জন্ম ল্যাবেও নয়, ঈশ্বরের হাতেও নয়- প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফসল
নোভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে অনেক রকম মিথ, মিসইনফরমেশন চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে সবচেয়ে এক্সাইটিং মিথটা ছিল যে এই ভাইরাসটা আসলে একটা বায়োউইপন বা জৈব-অস্ত্র, যা চীনের ল্যাবরেটরি থেকে বাইরে বের হয়ে গেছে, আর তার ফলে তৈরি হয়েছে এই প্যান্ডেমিক।
গত ২২ ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কপোস্ট এর একটি আর্টিকেল প্রচুর পরিমাণে শেয়ার করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ““Don’t buy China’s story: The coronavirus may have leaked from a lab”।(১) সংবাদপত্রটির অপিনিয়ন অংশে প্রকাশিত স্টিভেন মোশের এর লেখা এই আর্টিকেলে দাবি করা হয়, ভাইরাসটি চীনের উহানে অবস্থিত বায়োউইপন ল্যাব থেকে পালিয়ে এসে থাকতে পারে। আর্টিকেলটির অনেক সমালোচনা হয়েছিল সেসময় এসেছিল। অনেকে বলছিল এখানে লজিকের অনেক স্টেপকে অনুসরণ না করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, আবার অনেকে বলছিল আর্টিকেলটি বায়াসড।
এরপর দেখা গেল, ৯ই মার্চে, ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ তার একটি টুইটে ঘোষণা করেন, কোভিড -১৯ একটি বায়োউইপন বা জৈব অস্ত্র।(২) সেই টুইটে তিনি জাতিসংঘের জেনারেল সেক্রেটারি এন্টোনিও গুতেরেসকে তার লেখা একটি চিঠিও সংযোজন করে দেন। অনেকে আবার দাবি করেন বিল গেটসেরও এই “ল্যাবে তৈরি ভাইরাসটির” সৃষ্টিতে ভূমিকা আছে, এক্ষেত্রে সাথে এই ষড়যন্ত্র যুড়ে দেয়া হয় যে, এই রোগের প্রাদুর্ভাবে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অনেক বড় ব্যাবসায়িক লাভ হবে।
যাই হোক, নতুন একটি গবেষণা বলছে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী নোভেল করোনা ভাইরাস SARS-CoV-2 – কে ল্যাবে তৈরি করা হয়নি। নেচার মেডিসিন নামক জার্নালে নতুন একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে।(৩) সেখানে SARS-CoV-2 ভাইরাসের বিবর্তনকে ট্রেস করা হয়েছে, আর এর স্ট্রাকচারের সাথে অন্য করোনা ভাইরাসগুলোর তুলনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেখা গেছে যে কোভিড-১৯ এর সাথে জড়িত SARS-CoV-2 ভাইরাসটি আসলে নেচারাল ইভোল্যুশন বা প্রাকৃতিক বিবর্তনেরই ফল। এই গবেষণাটিতে এই ভাইরাসটির উৎপত্তির ব্যাপারে জানার ক্ষেত্রেও কিছু আশার আলো দেখিয়েছে।
এই পেপারটির লেখক হচ্ছেন, ক্রিপস রিসার্চ এর ইমিউনোলজি এন্ড মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের এসোসিয়েট প্রফেসর ক্রিসচিয়ান এন্ডারসেন, পিএইচডি। তিনি বলছেন, “এপর্যন্ত আমদের কাছে যতগুলো জানা করোনা ভাইরাস স্ট্রেইন এর জিনোম সিকুয়েন্স ডেটা রয়েছে, সেগুলো তুলনা করে খুব নিশ্চিত হয়েই নির্ণয় করা যায় যে, এই SARS-CoV-2 ভাইরাসটির জন্ম প্রাকৃতিক উপায়েই হয়েছে।”(৪)
এন্ডারসেন বলছেন, “SARS-CoV-2 ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর-বাইন্ডিং ডোমেইন অংশের মিউটেশন ও এর অনন্য ব্যাকবোন স্ট্রাকচার – এই দুটো বৈশিষ্ট্য বলছে একে কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সম্ভব নয়।” এই দুটো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আলোচনা করে নেয়া যাক –
১। গবেষণা থেকে পাওয়া এই সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী পরিষ্কারতম ক্লুগুলোর মধ্যে একটি ছিল SARS-CoV-2 এর আণবিক গঠন। গবেষকেরা বলেন এই নোভেল করোনা ভাইরাসের একটি ভিন্ন ধরণের “ব্যাকবোন” স্ট্রাকচার রয়েছে, যা এর আগে দেখা গেছে এমন করোনা ভাইরাসগুলো থেকে ভীষণভাবে আলাদা, আর এটির সাথে বাদুড় ও প্যাংগোলিনে পাওয়া যায় এমন ভাইরাসগুলোর সাথে সম্পর্কিত। যদি কেউ ল্যাবে এই নোভেল করোনা ভাইরাস তৈরি করত, তাহলে তিনি এভাবে সেই করোনা ভাইরাসকে তৈরি না করে ইতিমধ্যে জানা গেছে এমন করোনা ভাইরাসের মলিক্যুলার স্ট্রাকচারের সাথে মিলিয়ে তৈরি করতেন। আর সেই পথ ধরে না গিয়ে তিনি বাদুড় ও প্যাংগোলিনে পাওয়া যাওয়া ভাইরাসের মোলিক্যুলার স্ট্রাকচারের সাথে মিলিয়ে তিনি ভাইরাসটি তৈরি করবেন তা খুবই অপ্রত্যাশিত একটি বিষয়।
২। এই নোভেল করোনা ভাইরাসের রিসেপ্টর-বাইন্ডিং ডোমেইনটা একরকম “লক এন্ড কি” সিস্টেমে কাজ করে। হোস্ট সেলে (যাকে আক্রান্ত করবে) প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য ভাইরাসটি এই সিস্টেমকে ব্যবহার করে। এই রিসেপ্টর-বাইন্ডিং ডোমেইনে রয়েছে স্পাইক প্রোটিন, যা মানুষের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণকারী কোন কোষকে টারগেট করতে প্রচণ্ডভাবে কার্যকরী। গবেষকদের মতে, নতুন ভাইরাসের এক্ষেত্রে এই মাত্রায় কার্যকারিতা সবলভাবে নির্দেশ করছে যে এটির উৎপত্তি নেচারাল সিলেকশন বা বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়েছে।
এছাড়া SARS-CoV-2 ভাইরাসের জিনোমিক সিকোয়েন্সিং এনালাইসিস এও দেখিয়েছে যে কিভাবে এই ইনফেকশনটি অন্য প্রাণীদের থেকে মানুষের শরীরে আসতে পারে এসম্পর্কে দুটো সাম্ভাব্য সিনারিও এর কথা বলছে –
(ক) একটি সাম্ভাব্য সিনারিও হচ্ছে, এই ভাইরাসটি মানুষ ছাড়া অন্য একটি প্রাণীর পোষকদেহে তার এই বর্তমান প্যাথোজেনিক অবস্থায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে, আর তারপর মানব শরীরে প্রবেশ করেছে।
(খ) অন্য সিনারিওটি হল, এই ভাইরাসের একটি অক্ষতিকর ভারশন প্রাণীদেহ থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, আর তারপর এটি তার বর্তমান প্যাথোজেনিক অবস্থায় বিবর্তিত হয়। (এই ভাইরাস নিয়ে আরেকটি থিওরিও আছে, যেটির সম্ভাবনা কম কিন্তু অনেক বেশি চিন্তার। তা হল, এই ভাইরাসের আরেকটি প্যাথোজেনিক স্ট্রেইন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দ্বিতীয়বারের মত মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।)
যাইহোক, আপাতত এটা এখনও জানা সম্ভব হয়নি যে উপরের দুটো সিনারিও এর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বেশি সাম্ভাব্য। কিন্তু তারা এটা বের করবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কেননা এই জ্ঞানটি এই ভাইরাসটিকে বোঝার জন্য আর এটি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য গবেষকদেরকে সহায়তা করবে।
যারা বলছেন, নোভেল করোনা ভাইরাস হল পাপীদের শাস্তির জন্য ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত, তাদের বলছি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন পুরোপুরি প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে, এখানে ঈশ্বরের হাতকে কল্পনা করার কোন প্রয়োজন পড়েনা, ঈশ্বর এখানে অদরকারী ও অনাবশ্যক।
তথ্যসূত্র-
(১) ভাইরাসটি ল্যাবে তৈরি বলে দাবি করা সেই আর্টিকেলটি
(২) আহমাদিনেজাদের টুইট
(৩) পেপারটির লিংক
(৪) ডঃ এন্ডারসেনের বিবৃতি
ভাল ছিল বিষয়টি, যারা বিন্দু মাএ না জেনে বিষটিকে নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি করে, এবং তর্ক বির্তক সৃষ্টি করে তারা আদতেই মূর্খতা ছাড়া কিছু প্রকাশ করে না।
লেখাটা পড়লাম। আশা করি আপনার মূল্যবান সময়ের কিছু অংশ ব্যয় করে আমার এই অনুসন্ধিত্সু মনের লেখাটুকু পড়বেন এবং উত্তর দিয়ে আমাকে বাধিত করবেন। এবং আমার ভুলত্রুটি গুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বিজ্ঞানের বার্তা সবার কাছে পৌছে দেবার জন্য আপনি সচেষ্ট, সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু এত কিছু লেখার পরেও এত গবেষণার পরেও আপনার পুরো লেখাটির শেষ অংশে যা লেখা আছে তাতেই আসল কথা বের হয়ে এসেছে… বোঝা যাচ্ছে গবেষণার সবটুকুই সম্ভাব্যতা এবং ভবিষ্যতে এই সম্ভাব্য গবেষণাগুলো বিজ্ঞানীদের কে সাহায্য করতে পারে। আর, সে অংশটি হলো:-
“যাইহোক, আপাতত এটা এখনও জানা সম্ভব হয়নি যে উপরের দুটো সিনারিও এর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বেশি সাম্ভাব্য। কিন্তু তারা এটা বের করবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কেননা এই জ্ঞানটি এই ভাইরাসটিকে বোঝার জন্য আর এটি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য গবেষকদেরকে সহায়তা করবে।”
আমরা জানি, বিজ্ঞান মানেই সবকিছু কে প্রশ্ন করা। আজকে যেটা Theory হতে পারে, কালকে সেটা নিয়ে অন্য বিজ্ঞানী প্রশ্ন তুলতে পারেন, এবং এই প্রশ্ন তুলতে পারার স্বাধীনতাই় বিজ্ঞানকে অনেকখানি সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানীরাই যেখানে সবকিছু কে প্রশ্ন করেন, সিদ্ধান্তে খুব সহজে পৌঁছাতে চান না, সে দৃষ্টিকোণ থেকে এবং অবশ্যই আপনার প্রতি এবং আপনার জ্ঞান চর্চার প্রতি পূর্ণ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখে এ প্রশ্নটি করতে চাই, জ্ঞানপিপাসু মানুষের জন্য শুধুমাত্র সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কি যুক্তিসঙ্গত?
আবারো আমার ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইছি। পুরো লেখাটা পড়বার জন্য ধন্যবাদ
আশরাফুল মাখলুকাত, আপনি যে দুটো সিনারিওর কথা বলছেন সেগুলো হল প্রাণী থেকে কিভাবে ভাইরাস মানুষের মধ্যে এল এই বিষয়ের সাম্ভাব্য দুটো সিনারিও। এখানে যে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ আছে তা তারা নিজেই স্বীকার করছে, কিন্তু ভাইরাসটি যে ল্যাবে তৈরি হয়নি তা তারা প্রমাণ করে দিয়েছে আর নিশ্চয়তার সাথে দাবিও করেছে। আর এখানে সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। লেখাটি দয়া করে আরেকবার পড়ুন।