তথ্য সমূহ – হিন্দু ধর্ম
Table of Contents
- 1 ভূমিকা: হিন্দু ধর্মের অমানবিক ও অযৌক্তিক উত্তরাধিকার
- 2 হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বলতে কী বুঝব?
- 3 বর্ণব্যবস্থা: ঈশ্বরপ্রদত্ত শ্রেণিবৈষম্যের ধর্মীয় বৈধতা
- 4 অস্পৃশ্যতা ও মানবিক অপমান
- 5 শিশুবিবাহ ও বর্ণশুদ্ধি রক্ষার অমানবিকতা
- 6 “ধর্ম” বনাম মানবাধিকার: বর্ণব্যবস্থার নৈতিক সঙ্কট
- 7 নারী–বিদ্বেষ: হিন্দু শাস্ত্রে নারীর অবস্থান
- 8 নারীকে ‘পাপের উৎস’ ও ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে বর্ণনা
- 9 সতি প্রথা: ধর্মীয় বৈধতা ও বাস্তব নিষ্ঠুরতা
- 10 মনুস্মৃতি ও অন্যান্য শাস্ত্রে সতির উৎস
- 11 ঐতিহাসিক নথিতে সতির নৃশংসতা
- 12 বিধবা–নির্যাতন ও সারা জীবনের শাস্তির ধারণা
- 13 পৌরাণিক কাহিনির সহিংসতা, নৈতিক সঙ্কট ও অযৌক্তিকতা
- 14 ধর্মীয় দণ্ডবিধি: হিন্দু শাস্ত্রে অমানবিক শাস্তি ও আইন
- 15 ‘আশ্রম’ ও ‘ধর্ম’ ব্যবস্থার অন্ধ আনুগত্য
- 16 নিম্নবর্ণের ‘জন্মগত অপরাধ’ ধারণা
- 17 শাস্ত্র বনাম আধুনিকতা: বেদ–উপনিষদ ও স্মৃতি–গ্রন্থের দ্বৈত চরিত্র
- 18 আধুনিক সংস্কার আন্দোলন: অমানবিক প্রথা বন্ধ হলেও শাস্ত্রীয় ভিত্তি রয়ে গেছে
- 19 উপসংহার: হিন্দু ধর্মের মানবাধিকার–বিরোধী উত্তরাধিকার
ভূমিকা: হিন্দু ধর্মের অমানবিক ও অযৌক্তিক উত্তরাধিকার
হিন্দু ধর্ম কোনো একক বই বা একক প্রবর্তকের ধর্ম নয়; এটি মূলত বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা নানা কাহিনি, মিথ, আচরণবিধি ও সামাজিক রীতিনীতির সমষ্টি। ফলে “হিন্দুধর্ম” বলতে আমরা একদিকে বেদ–উপনিষদ, অন্যদিকে মহাভারত–রামায়ণ, পুরাণ ও অসংখ্য স্মৃতি–গ্রন্থ (ধর্মশাস্ত্র) – সবকিছুর মিশ্র ধারাকে বুঝি। এই বিশাল কর্পাসের ভেতরে যেমন দর্শন, উপনিষদের কিছু মানবিক ও প্রশ্নমুখর অংশ আছে, তেমনি একই সঙ্গে আছে বর্ণভিত্তিক নিপীড়ন, নারী–বৈষম্য, শিশুবিবাহ, বিধবা–নির্যাতন, সতি প্রথা, অস্পৃশ্যতা ও পশু–হত্যার মতো অমানবিক ও অযৌক্তিক বিধান ও রীতিও।
এই প্রবন্ধে আমরা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও ঐতিহ্যের ভেতরে থাকা সেই সব অমানবিক, অযৌক্তিক ও “বাজে” (অর্থাৎ নৈতিকভাবে নিন্দনীয় বা যুক্তিগতভাবে হাস্যকর) বিধান ও গল্পগুলো পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে দেখব। ফোকাস থাকবে মূলত – (১) বর্ণব্যবস্থা ও অস্পৃশ্যতা, (২) নারী–বিদ্বেষ ও যৌন–বিধান, (৩) শিশুবিবাহ ও সতি প্রথা, (৪) অমানবিক দণ্ডবিধান ও শাস্তি–প্রথা, এবং (৫) পৌরাণিক কাহিনির নৈতিক সঙ্কট। প্রতিটি সেকশনে সম্ভব হলে সরাসরি শাস্ত্র–উদ্ধৃতি ও আধুনিক গবেষণা–উৎস উল্লেখ করা হবে [1].
এই লেখার কাঠামো আগে তৈরি করা ধর্মীয় টাইমলাইন–ধরনের আর্টিকেলগুলোর মতো ব্লক–স্ট্রাকচারে সাজানো হয়েছে, যেন পাঠকদের জন্য স্ক্যান করা সহজ হয়।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বলতে কী বুঝব?
প্রথমে পরিষ্কার করা জরুরি – “হিন্দু ধর্মগ্রন্থ” বলতে আমরা ঠিক কী কী ধরে নিচ্ছি। প্রচলিতভাবে এগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়:
- শ্রুতি (श्रुति) – অর্থ “শোনা”, অর্থাৎ প্রাচীন ঋষিদের “শ্রুতি” বলে বিবেচিত; এর মধ্যে মূলত চারটি বেদ (ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ), এদের ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ।
- স্মৃতি (स्मृति) – অর্থ “স্মৃতিতে থাকা”; পরে রচিত আচরণ–বিধি ও আইনি–গ্রন্থ যেমন মনুস্মৃতি (Manusmriti), যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, নারদ স্মৃতি ইত্যাদি, এবং মহাভারত, রামায়ণ, বিভিন্ন পুরাণ।
হিন্দু সমাজে দীর্ঘ সময় ধরে মনুস্মৃতি–কে সামাজিক ও আইনগত আচরণবিধির প্রায় “সংবিধান” হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে – বিশেষ করে বর্ণ–বিভাজন, নারী–পুরুষের ভূমিকা, বিবাহ, উত্তরাধিকার ও শাস্তি–বিধানের ক্ষেত্রে। ব্রিটিশ আমলেও হিন্দু পারিবারিক আইন কোড তৈরি করতে মনুস্মৃতিকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
তাই হিন্দুধর্মের অমানবিক ও অযৌক্তিক দিকগুলো দেখতে গেলে, আমাদের প্রধানত তাকাতে হয় – (ক) মনুস্মৃতি ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র, (খ) গীতা ও মহাভারতের বর্ণ–বিষয়ক শিক্ষা, (গ) পুরাণ ও মহাকাব্যে ছড়িয়ে থাকা সহিংস বা নৈতিক সঙ্কটপূর্ণ কাহিনিগুলোর দিকে।
বর্ণব্যবস্থা: ঈশ্বরপ্রদত্ত শ্রেণিবৈষম্যের ধর্মীয় বৈধতা
হিন্দুধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ব্যবস্থা হলো বর্ণব্যবস্থা – যেখানে সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চারটি প্রধান বর্ণে ভাগ করা হয়; পরে “অস্পৃশ্য” বা “অন্ত্যজ” শ্রেণি এই কাঠামোর বাইরে নিচের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই শ্রেণিবিন্যাসকে শুধু সামাজিক রীতিই নয়, ঈশ্বরপ্রদত্ত ধর্মীয় বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ নিজেই দাবি করেন –
“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ” – “গুণ ও কর্মের বিভাজনের দ্বারা আমি নিজেই মানবসমাজে চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি।” [2]
অর্থাৎ গীতা অনুসারে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস (ব্রাহ্মণ–ক্ষত্রিয়–বৈশ্য–শূদ্র) কোনো মানব–নির্মিত অন্যায় প্রথা নয়; বরং “ভগবান” নিজেই এটি সৃষ্টি করেছেন – এই দাবির মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্যকে ধর্মীয় পবিত্রতার স্তরে উন্নীত করা হয়েছে। পরে অবশ্য অনেক আধুনিক ব্যাখ্যাকারীরা বলার চেষ্টা করেন যে এটি “জন্মভিত্তিক” নয়, “গুণ–কর্মভিত্তিক” ইত্যাদি; কিন্তু বাস্তব ইতিহাসে দেখা গেছে এই বর্ণব্যবস্থা জন্ম–ভিত্তিক কঠোর কাস্ট সিস্টেমে রূপ নিয়েছে, যেখানে নিচু বর্ণে জন্ম নেয়া মানেই আজীবনের সামাজিক বঞ্চনা, বৈষম্য আর নানা নিষেধাজ্ঞা।
মনুস্মৃতিতে এই শ্রেণিবৈষম্যকে আইনি ভাষায় আরও পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে; কোন বর্ণ কী কাজ করবে, কার সঙ্গে কার বিয়ে চলবে, কে কাকে ছুঁতে পারবে – সবকিছুরই বিস্তারিত “ধর্ম” নির্ধারণ করা আছে। আধুনিক অনেক গবেষক স্পষ্ট ভাষায় মনুস্মৃতিকে “অত্যাচার ও বৈষম্যের স্থাপত্য” (architecture of oppression) বলে অভিহিত করেছেন, যেটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শূদ্র ও দলিতদের ওপর নিপীড়নকে বৈধতা দিয়েছে।
অস্পৃশ্যতা ও মানবিক অপমান
বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে অমানবিক রূপ হলো অস্পৃশ্যতা (untouchability) – যেখানে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে “নোংরা”, “অপবিত্র” বলে ঘোষণা করে তাদের ছোঁয়া, তাদের ছায়া, তাদের উপস্থিতি পর্যন্ত “অশুভ” বলে গণ্য করা হয়। যদিও “অস্পৃশ্য” শব্দটি মনুস্মৃতির মূল সংস্কৃত পাঠে সমানভাবে সর্বত্র নেই, তবু বিভিন্ন স্মৃতি–গ্রন্থ ও মন্তব্যকারীদের মাধ্যমে শূদ্র ও বিশেষ করে “চণ্ডাল” শ্রেণিকে এমন আচরণবিধির গণ্ডিতে ফেলে দেয়া হয়েছে, যা বাস্তবে অস্পৃশ্যতারই পূর্ণ–রূপ। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় –
- শূদ্রদের শিক্ষা ও বেদপাঠ নিষিদ্ধ; তারা বেদ শুনলে তাদের কানে গলিত সীসা ঢালার মতো শাস্তির কথা উল্লেখ আছে – যা জ্ঞানকে একচেটিয়া করে রাখার নগ্ন প্রচেষ্টা।
- উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ–ক্ষত্রিয়দের ছায়াও নাকি “দূষিত” করতে পারে নিম্নবর্ণের স্পর্শ; তাই তাদের আলাদা কূপ, আলাদা রাস্তা, আলাদা পাড়া ইত্যাদি – যা আজও অনেক গ্রামে প্রথাগতভাবে চলে আসছে।
- “চণ্ডাল” শ্রেণির কাজ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে মৃতদেহ সরানো, নোংরা পরিষ্কার করা, পশু–জবাই, চর্মশিল্প ইত্যাদি; এ সব কাজকে “নিম্ন” হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যত এক শ্রেণির মানুষকে আজীবন অমানবিক শ্রমে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
এই অস্পৃশ্যতার শিকার মানুষগুলোকে শুধু সামাজিকভাবে নয়, আইনি–ভাবেও নীচু করে রাখা হয়েছে – যেন তারা কখনোই বর্ণসিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে না পারে। আধুনিক ভারতের সংবিধান আজ “untouchability” নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু গোঁড়া ধর্মীয় যুক্তি এখনো অনেক ক্ষেত্রে মনুস্মৃতির এই বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে ধর্ম ও সংস্কৃতির নাম করে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করে।
শিশুবিবাহ ও বর্ণশুদ্ধি রক্ষার অমানবিকতা
বর্ণব্যবস্থা ধরে রাখতে “শুদ্ধ বর্ণ” রক্ষার নামে মনুস্মৃতি ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র বহু জায়গায় শিশুবিবাহ ও অত্যন্ত কম বয়সে বিয়ে দেয়াকে উৎসাহিত করেছে। মনুস্মৃতির ৯ম অধ্যায়ে একটি বহুল আলোচিত শ্লোক আছে:
“ত্রিংশদ্বর্ষো ভবেত্ কন্যাম্ দ্বাদশাব্দাং রোচনাম্; চতুর্বিংশস্ত্বষ্টাব্দাং, ধর্মানুপ্রতিপালয়ন্, পূর্বং তু কুর্যাদ্…”
অর্থ, “ত্রিশ বছর বয়সী একজন পুরুষ বারো বছরের আকর্ষণীয় কন্যাকে বিয়ে করবে; অথবা চব্বিশ বছর বয়সী পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিয়ে করবে; আর ধর্ম পালনে ব্যাঘাত ঘটলে এরও আগে তা করতে পারে।” [3]
এখানে সরাসরি বলা হচ্ছে – একজন পূর্ণবয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য ৮ বা ১২ বছরের শিশুকন্যা “উপযুক্ত” স্ত্রী; এমনকি “ধর্মের স্বার্থে” আরও কম বয়সেও তা করা যায়। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে আমরা জানি – শারীরিক, মানসিক ও যৌন–স্বাস্থ্যের জন্য এটি পরিষ্কারভাবেই শিশু–নির্যাতন ও ধর্ষণের সমান। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ এটিকে শুধু বৈধই করেনি, বরং “ধর্ম” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
মনুস্মৃতির আরেক জায়গায় বলা হয় – “একজন অসামান্য সুন্দর ও ‘উপযুক্ত’ বর পাওয়া গেলে কন্যাকে তার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।” [4] – অর্থাৎ কন্যার সম্মতি, শারীরিক প্রস্তুতি বা ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই; সর্বোচ্চ মূল্য “বর্ণমিশ্রণ ঠেকানো” ও সামাজিক সম্মান।
এই ধরনের বিধান শুধু “পুরোনো যুগের কথা” বলে উড়িয়ে দেওয়া সহজ, কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের শাস্ত্রীয় যুক্তি ব্যবহার করেই ভারতীয় উপমহাদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিশুবিবাহকে “ধর্মীয় কর্তব্য” হিসেবে চাপিয়ে রাখা হয়েছে – যার ফলাফল ছিল অসংখ্য কিশোরীর স্বাস্থ্যহানি, অকাল মাতৃত্ব, শিক্ষকতা বা পেশাজীবন থেকে বঞ্চনা এবং সারাজীবনের নির্ভরশীলতা।
“ধর্ম” বনাম মানবাধিকার: বর্ণব্যবস্থার নৈতিক সঙ্কট
বর্ণব্যবস্থা–নির্ভর হিন্দু ধর্মীয় বিধানগুলোর মূল সমস্যা হলো – এগুলো মানুষের জন্মগত মর্যাদা ও সমান মানবাধিকার–এর ধারণার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যায়। কোনো মানুষ শুধুই “নিম্ন বর্ণে জন্মেছে” বলে তাকে শিক্ষা, পেশা, সামাজিক মেলামেশা, এমনকি ধর্মীয় অনুশীলন থেকেও বঞ্চিত করা – আধুনিক মানবাধিকার মানদণ্ডে স্পষ্টভাবে বেআইনি ও অমানবিক। অথচ গীতা ও মনুস্মৃতির মতো গ্রন্থগুলোতে এই বৈষম্যকে “ঈশ্বরপ্রদত্ত শৃঙ্খলা” হিসেবে ফ্রেম করা হয়েছে, ফলে এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই “ধর্ম–বিরোধিতা” বলে প্রচার করা সহজ হয়েছে।
ভারতের সংবিধান আজ বর্ণভিত্তিক অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ করেছে; আম্বেদকর ও বহু দলিত–চিন্তকের আন্দোলনের ফলে মনুস্মৃতির বই পুড়িয়ে প্রতীকীভাবে এই অমানবিক ধর্মীয় কোডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গ্রন্থ–পাঠ, মন্দির–প্রথা, বর্ণ–অনুসারে পুরোহিত নিয়োগ, বিয়ে–পাত্র–পাত্রী বাছাই – সবকিছুতেই আজও বর্ণ–ভাবনা ও “শুদ্ধ–অশুদ্ধ”–এর ধারণা বিরাজমান।
সংক্ষেপে বলা যায়, হিন্দুধর্মের বর্ণব্যবস্থা ও মনুস্মৃতিনির্ভর সামাজিক কোড – মানুষকে জন্মগতভাবে অসম ধরে নিয়ে তাকে আজীবনের জন্য পায়ের নীচে পিষে রাখার এক ধর্মীয় নকশা; যা আধুনিক নৈতিকতা, বিজ্ঞান এবং মানবাধিকার–ধারণার সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
নারী–বিদ্বেষ: হিন্দু শাস্ত্রে নারীর অবস্থান
হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে নারীদের অবস্থান সামগ্রিকভাবে অধস্তন, অধীনস্ত ও পুরুষ–কেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। নারীকে স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং পিতা–স্বামী–পুত্র – এই তিন পুরুষের অধীনে থাকা এক “সম্পত্তি–সদৃশ” সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মনুস্মৃতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে –
“পিতা রক্ষতি কাউমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে, পুত্র রক্ষতি বৃদ্ধকালে; ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমर्हতি।”
— Manusmriti ৯:৩
অর্থাৎ, “কুমারী অবস্থায় নারীকে পিতা রক্ষা করবে, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র; নারী কখনোই স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয়।”
এই এক বাক্যের মধ্যে নারীর জীবনকে তিন পুরুষের অধীন করে দেওয়া হয়েছে। মানবিক বা আইনি স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই।
নারীকে ‘পাপের উৎস’ ও ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে বর্ণনা
মনুস্মৃতিতে নারীর সম্পর্কে ঘনঘন অবমাননাকর মন্তব্য আছে, যেমন—
- নারী নাকি “অসংযমী”, “লোভী”, “অবিশ্বস্ত” এবং “পাপের উৎস”।
- নারীকে চোখে রাখতেই হবে; স্বাধীনতা দিলে নাকি সে “ধর্ম নষ্ট” করবে।
- স্ত্রী কখনোই স্বামীকে প্রশ্ন করতে পারবে না; স্বামী নিষ্ঠুর হলেও তাকে দেবতার মতো মানতে হবে।
এই পাঠগুলো আজকের চোখে শুধু যৌন–বৈষম্যমূলক নয়—মানব মর্যাদারই সরাসরি বিরোধী। নারীর ব্যক্তিসত্তাকে অস্বীকার করা এই মতবাদ সমাজে গভীর মানসিক আগ্রাসন তৈরি করেছে, যার অন্ধপ্রভাব এখনো দক্ষিণ এশিয়ার পরিবার ও বিবাহব্যবস্থায় দেখা যায়।
সতি প্রথা: ধর্মীয় বৈধতা ও বাস্তব নিষ্ঠুরতা
হিন্দু ধর্মে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সবচেয়ে অমানবিক প্রথার একটি ছিল সতি — স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা। অনেক সময় স্ত্রী স্বেচ্ছায় নয়; পরিবার ও সমাজের চাপেই এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটত।
পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রে সতীর প্রশংসা অসংখ্যবার করা হয়েছে। বিশেষ করে—
- এক নারী যদি স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেয়, তবে সে ‘স্বর্গলাভ’ করবে।
- পরিবার “পবিত্র” হবে এবং পুরুষের ‘কীর্তি’ বাড়বে।
- সতি নাকি আদর্শ স্ত্রী–ধর্মের সর্বোচ্চ রূপ।
এই মিথ—যে স্ত্রী স্বামীর চিতায় পুড়ে মরলে সে স্বর্গ পায়—শাস্ত্র ও পুরাণ দীর্ঘদিন ধরে রোম্যান্টিসাইজ করে এসেছে। এর ফাঁকে হত্যা গণহত্যায় পরিণত হয়েছে।
মনুস্মৃতি ও অন্যান্য শাস্ত্রে সতির উৎস
মনুস্মৃতি নারীর দ্বিতীয় বিয়ে বা পুনর্বিবাহকে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, স্ত্রী “শুধুমাত্র এক স্বামীকেই” অনুসরণ করতে পারে, স্বামী মারা গেলে তাকে কঠোর ব্রহ্মচর্য জীবন কাটাতে হবে। যদিও সরাসরি “আগুনে ঝাঁপ দাও” বলা নেই, কিন্তু সমাজে এই অনুচ্ছেদগুলোই সতি প্রথার নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে:
“স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে তার জীবনভর শুচিতা ও ব্রহ্মচর্যের মাধ্যমে জীবন কাটাতে হবে।”
— Manusmriti ৫:১৫৮
পরে পুরাণ ও আঞ্চলিক ব্রাহ্মণ্য গোষ্ঠীগুলো এই “একনিষ্ঠা”–বিধানকে চরমে নিয়ে গিয়ে সতীকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
ঐতিহাসিক নথিতে সতির নৃশংসতা
ঐতিহাসিক নথিতে দেখা যায়—
- রাজপুত পরিবারে সতি ছিল ব্যাপক; নারীরা বাধ্য করা হতো।
- মোগল আমলে অযোধ্যা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে সতির ঘটনাগুলো সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
- ব্রিটিশ আমলে শুধু বাংলা অঞ্চলে প্রায় ৮০০০–এর বেশি সতি নথিভুক্ত হয়েছে।
এই সংখ্যাগুলো কেবল রেকর্ডকৃত। বাস্তব সংখ্যা আরও অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী–কে ধরে টেনে, নেশা খাইয়ে বা আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে—কিন্তু পরে “স্বেচ্ছাসেবী সতি” বলে প্রচার করা হয়েছে।
১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতি নিষিদ্ধ করেন, রামমোহন রায় এই প্রথা বন্ধে গভীর ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদীরা তখনও বলেছিল—“এটি ধর্মবিরোধী; শাস্ত্রে সতির বৈধতা আছে।”
বিধবা–নির্যাতন ও সারা জীবনের শাস্তির ধারণা
হিন্দু সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী বিধবাদের ওপর নির্মম আচরণ আজও অনেক অঞ্চলে দেখা যায়। এর শাস্ত্রীয় ভিত্তি আছে মনুস্মৃতিতে।
“স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাকে শুচি, সংযমী, কঠোর জীবন যাপন করতে হবে; রঙিন পোশাক, অলঙ্কার, সুগন্ধি—সব নিষিদ্ধ।”
— Manusmriti ৫:১৬০
অর্থাৎ—স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর জীবনও শেষ; তাকে “শাস্তিমূলক” জীবন কাটাতে হবে। বিরিয়ানি তো দূরের কথা—স্বাদযুক্ত খাবার, উৎসব, আনন্দ, সৌন্দর্য—সব নিষিদ্ধ। সমাজ তাকে “অশুভ” বলে গণ্য করে।
- বিধবাদের মাথার চুল কামানো,
- সাদা কাপড় বাধ্যতামূলক করা,
- দৈহিক চাহিদাকে অপরাধী করে দেখা,
- পুনর্বিবাহকে লজ্জাজনক ধরা,
এগুলো কোনো সাংস্কৃতিক কাকতাল নয়; শাস্ত্রীয় ভিত্তি থেকেই এসেছে। এই নিষ্ঠুর জীবনব্যবস্থা অনেক নারীকে সারা জীবন দারিদ্র্য, সামাজিক অপমান ও মানসিক যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রেখেছে।
পৌরাণিক কাহিনির সহিংসতা, নৈতিক সঙ্কট ও অযৌক্তিকতা
হিন্দুধর্মের পুরাণ, মহাকাব্য ও ধর্মীয় কাহিনির ভেতরে অসংখ্য সহিংস, নৈতিকভাবে সমস্যাযুক্ত এবং যুক্তির দিক থেকে হাস্যকর গল্প রয়েছে। এগুলো শুধু পুরাণে থাকা “কল্পকাহিনি” নয়; প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এগুলোকে নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবনদর্শন শেখানোর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এই গল্পগুলোর অমানবিক, নারী–বিদ্বেষী বা বৈষম্যমূলক দিক সমাজেও ছাপ ফেলেছে।
দেবতাদের যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণ–ধর্মী কাহিনি
হিন্দু পুরাণে দেবতাদের অনেক গল্পেই যৌন সহিংসতা বা জোরপূর্বক মিলনকে ধর্মীয় রোম্যান্টিকতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বিশেষত—
- ইন্দ্রের ধর্ষণ — ইন্দ্র অসংখ্য নারীর সঙ্গে প্রতারণা, জোরপূর্বক মিলন ও অপহরণের গল্পে জড়িত। রামায়ণের অরন্য কাণ্ডে বর্ণনা আছে—ইন্দ্র স্ত্রী অহল্যাকে প্রতারণা করে শয্যায় প্রলুব্ধ করেন, যা আধুনিক মানদণ্ডে স্পষ্ট ধর্ষণ।
- ব্রহ্মার কন্যা–অনুসরণ — ব্রহ্মার নিজের “কন্যা–সদৃশ” সৃষ্টি সরস্বতীকে কামনা করে তাকে তাড়া করার গল্প পুরাণে প্রসিদ্ধ। এই কাহিনিকে দেবীয় করে রোম্যান্টিসাইজ করা হয়েছে।
- শিবের লিঙ্গ পূজা — শিব–লিঙ্গ একটি সম্মানিত প্রতীক, কিন্তু তার উৎপত্তিতেই আছে কাম, লিঙ্গচ্ছেদ, রাগ–অপমান—যা পুরাণে রসিকতা আর ভক্তির মিশ্রণে বর্ণিত।
এই কাহিনিগুলো হাজার বছর ধরে ভক্তিমূলক ভাষায় প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু এর বাস্তব নৈতিক বার্তা অত্যন্ত সমস্যাযুক্ত—দেবতা ধর্ষণ করলে তা “লীলা”, মানুষ করলে “পাপ”।
রামায়ণে রামের অমানবিকতা
রামায়ণের নায়ক রামকে “মর্যাদাপুরুষোত্তম” বলা হয়। কিন্তু কাহিনির ভেতরে তার অনেক কাজই অমানবিক—
- সীতার ‘চরিত্র পরীক্ষা’ — রাক্ষস রাবণের কাছ থেকে উদ্ধার করার পর রাম সীতার ওপর গর্ভধারণ–পর্যায়ের আগুন–পরীক্ষা আরোপ করেন। এর মানে—এক নারী অপহৃত হলে দোষ তার ওপরই চাপানো হবে।
- গর্ভবতী সীতাকে বনবাস — গুজব শোনার পর রাম গর্ভবতী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন, তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন—একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত।
- শূদ্র শম্বুককে হত্যা — রাম শম্বুককে হত্যা করেন, কারণ সে “উচ্চ বর্ণের জন্য নির্ধারিত তপস্যা” করছিল। বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে তিনি সরাসরি সম্প্রসারিত করেছেন।
এই ঘটনাগুলো এখনো ভারতীয় সমাজে নারীর ওপর দোষ চাপানো ও বর্ণভিত্তিক নিষেধাজ্ঞাকে নৈতিক সমর্থন দেয়।
মহাভারতে নারীর অবমাননা: দ্রৌপদী বস্ত্রহরণ
মহাভারতের সবচেয়ে নিন্দনীয় দৃশ্য হলো দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। যুধিষ্ঠির যুদ্ধে হেরে স্ত্রীকে জুয়ায় হারান, তারপর কৌরবরা সভার মাঝখানে তাকে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করে।
এখানে নারীকে সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে; স্বামী জুয়ায় হারাতে পারে। দ্রৌপদীর শরীর, সম্মান, মানবিকতা—সব ‘পণ’ হয়ে গেছে।
আজও ভারতীয় সমাজে স্বামীর সম্মান–দোষ–লজ্জা নারীর শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে—যার শিকড় এই মহাকাব্যিক কাহিনিতে।
পশুবলি, মানববলির প্রথা
হিন্দুধর্মে পশুবলি বহু উপদেবতার মন্দিরে আজও চলে, বিশেষ করে শক্তি–উপাসনায়। যদিও অনেক হিন্দু এটির বিরোধী, তবু শাস্ত্রীয় উৎস আছে—
- অথর্ববেদে নানা যজ্ঞের জন্য পশুবলির উল্লেখ আছে।
- তান্ত্রিক সাধনায় ছাগল, মোরগ, কখনো মহিষ—বলি দেওয়া হয়।
- পুরাণে মানববলির গল্পও আছে—বিশেষ করে কালিকা–উপাসনায় ব্যতিক্রমী উদাহরণ উল্লেখিত।
ধর্মীয় কারণে প্রাণী হত্যা আজও বহুস্থানে ঘটে। ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে পশুবলি সামাজিক আচার হিসেবে রয়ে গেছে।
অযৌক্তিক ও ছদ্মবৈজ্ঞানিক দাবি
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বহু কাহিনি আছে যা আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যেমন—
- হনুমানের উড়ে লঙ্কা যাওয়া — পৃথিবীর ভৌতবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গত।
- গণেশের মাথা প্রতিস্থাপন — শিশুর মাথা কেটে হাতির মাথা দিয়ে জীবিত করা—আধুনিক বায়োলজি অনুসারে অসম্ভব।
- ঋষিদের বহু–শতাব্দী জীবিত থাকা — মানুষের সর্বোচ্চ আয়ুষ সীমা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত।
- মহাভারতের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ = পারমাণবিক বোমা — আধুনিক কল্পবিজ্ঞান–ধারণা ও ধর্মীয় ব্যাখ্যার মিশ্রণে তৈরি। বাস্তবে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
এইসব কাহিনি প্রায়ই আধুনিক ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর ছদ্মবৈজ্ঞানিক প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়—যেন প্রাচীন ভারতে সব আধুনিক প্রযুক্তি ছিল। অথচ এসব দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ধর্মীয় দণ্ডবিধি: হিন্দু শাস্ত্রে অমানবিক শাস্তি ও আইন
হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলো—বিশেষত মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি এবং বিভিন্ন পুরাণ—শাস্তি ও অপরাধবিধির ক্ষেত্রে কঠোর ও অমানবিক নিয়মে ভরা। এগুলো মধ্যযুগীয় বর্বরতার পরিচয় দেয় এবং আধুনিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান।
বর্ণভেদ অনুযায়ী আলাদা শাস্তি
মনুস্মৃতির সবচেয়ে অমানবিক অংশ হলো—একই অপরাধের জন্য বর্ণভেদ অনুযায়ী ভিন্ন শাস্তি। অর্থাৎ—উচ্চবর্ণ অপরাধ করলে ছোট শাস্তি, নিম্নবর্ণ করলে ভয়ঙ্কর শাস্তি।
- ব্রাহ্মণকে প্রায় কোনো কঠোর শাস্তি দেবে না—সে অপরাধ করলে “প্রায়শ্চিত্ত” করলেই যথেষ্ট।
- শূদ্র যদি একই অপরাধ করে, তার ক্ষেত্রে শাস্তি হবে অঙ্গচ্ছেদ, অগ্নিদাহ, চাবুক মারা—এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত।
- শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের গালি দেয়, তার জিহ্বা কেটে ফেলতে হবে।
- শূদ্র যদি বেদ শ্রবণ করে, তার কানে গলিত সীসা ঢালতে হবে।
এই বিধানগুলো দেখায়—“আইনের সামনে সবাই সমান”—এই মৌলিক মূল্যবোধ হিন্দু শাস্ত্রে অনুপস্থিত। বরং আইনকেই বর্ণভিত্তিক নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
দেহচ্ছেদ, অঙ্গচ্ছেদ, আগুনে দাহ—বর্বর শাস্তি
মনুস্মৃতি ও অন্যান্য স্মৃতি–গ্রন্থগুলোতে নানা অপরাধের জন্য সরাসরি অঙ্গচ্ছেদ ও দেহ বিকৃতির আদেশ রয়েছে। উদাহরণ—
- হাত কেটে ফেলা — চুরি বা নিষিদ্ধ সামগ্রী স্পর্শের ক্ষেত্রে।
- নাক-কান কেটে ফেলা — যৌন আচরণ বা সামাজিক “অপবিত্রতা”র অভিযোগে।
- আগুনে পোড়ানো — ধর্ম অবমাননা, নিষিদ্ধ বিবাহ বা অর্থনৈতিক অপরাধে।
- দেহ কালো রঙে রাঙিয়ে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া — বিশেষত শূদ্র ও চণ্ডালদের ক্ষেত্রে।
আজকের চোখে এগুলো মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া কিছুই নয়। অথচ শতাব্দী ধরে এগুলোই “ধর্মীয় আইন” হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
নারী সম্পর্কিত শাস্তি ছিল আরও কঠোর
নারী যদি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে, প্রেম করে, অথবা পরিবারের বিরুদ্ধে যায়—সেক্ষেত্রে শাস্তিগুলো ছিল ভয়াবহ।
- নারীর নাক কেটে ফেলা — “সমাজের মান রক্ষা”র নামে।
- পুরুষ ছাড়া কোনো কাজ করলে ‘অপবিত্র’ ঘোষণা।
- বিধবাকে ‘শাস্তিমূলক’ জীবন দিতে বাধ্য করা, যেমন সাদা কাপড়, একাকীত্ব, উপবাস, আনন্দ নিষিদ্ধ।
এই আচরণবিধি সমাজজুড়ে নারী–নির্যাতনকে বৈধতা দিয়েছে।
ধর্মীয় কর্তৃত্বের নামে সামাজিক বহিষ্কার
হিন্দু শাস্ত্রে বহিষ্কার (excommunication) ছিল একটি শক্তিশালী দণ্ড। কোনো ব্যক্তি সমাজের ধর্মীয় “নীতিমালা” ভঙ্গ করলে—
- তার সঙ্গে কথা বলা নিষিদ্ধ,
- খাবার–পানীয় নিষিদ্ধ,
- সম্প্রদায়ের আচার–অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ,
- বিবাহ, উৎসব, ধর্মীয় আচার—সবকিছু থেকে বাদ।
এটি ছিল মানসিক অত্যাচারের সর্বোচ্চ রূপ, যার উদ্দেশ্য ছিল—সবাইকে ভয় দেখিয়ে বর্ণ–বিধান মেনে চলতে বাধ্য করা।
‘আশ্রম’ ও ‘ধর্ম’ ব্যবস্থার অন্ধ আনুগত্য
হিন্দু সমাজে জীবনের চারটি “আশ্রম” (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বনপ্রস্থান, সন্ন্যাস) বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এগুলো মূলত এক ধরনের সামাজিক কন্ট্রোল সিস্টেম।
- ব্রহ্মচর্য — শিশুকে যৌনতা, স্বাধীনতা, আনন্দ থেকে দূরে রেখে অন্ধ আনুগত্য শেখানোর প্রক্রিয়া।
- গার্হস্থ্য — পুরুষের বংশবৃদ্ধি ও বর্ণশুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্ব।
- বনপ্রস্থান — পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মীয় ‘তপস্যা’।
- সন্ন্যাস — সম্পদ, সংসার ছেড়ে “অহং” ত্যাগ—যা প্রায়ই ছিল নিপীড়নের বৈধতা।
এই ব্যবস্থা মূলত সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার, বিদ্রোহ ঠেকানোর এবং পুরুষ–কেন্দ্রিক শক্তি ধরে রাখার একটা ধর্মীয় কাঠামো।
নিম্নবর্ণের ‘জন্মগত অপরাধ’ ধারণা
হিন্দুধর্মে একটি ভয়ঙ্কর ধারণা হলো—কেউ জন্মগতভাবে ‘অশুদ্ধ’ হতে পারে। অর্থাৎ, নিম্নবর্ণে জন্ম নিলে তার অপরাধ জন্মগত, সে স্বভাবগতভাবে “অপবিত্র” এবং তাকে উচ্চবর্ণের সঙ্গে সমান হতে দেওয়া যাবে না।
- নিম্নবর্ণের বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ,
- একসাথে খাওয়া নিষিদ্ধ,
- উচ্চবর্ণের কূপের পানি স্পর্শ নিষিদ্ধ,
- উচ্চবর্ণের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এগুলো আজও ভারতের বহু অঞ্চলে প্রচলিত। আইন পরিবর্তন হলেও ধর্মীয় বিশ্বাস ও মনস্তত্ত্ব বহাল।
শাস্ত্র বনাম আধুনিকতা: বেদ–উপনিষদ ও স্মৃতি–গ্রন্থের দ্বৈত চরিত্র
হিন্দুধর্মকে বোঝার ক্ষেত্রে একটি ভুল ধারণা হলো—এটি “সহনশীল” বা “মানবিক” ধর্ম। বাস্তবে হিন্দুধর্ম কোনো একক বইয়ের ধর্ম নয়; বরং এটি বহুমাত্রিক—কখনো দার্শনিক, কখনো পৌরাণিক, আবার কখনো কঠিন বৈষম্যমূলক আইনবিধিতে ভরা। এর মধ্যে সবচেয়ে মানবিক অংশগুলো রয়েছে উপনিষদ–ভিত্তিক দর্শনে, যেখানে আত্মা, ব্রহ্ম, অনন্ত, প্রশ্ন–তর্ক—এসব ধারণা আছে।
কিন্তু সামাজিক ও আইনি জীবনে প্রভাব ফেলেছে স্মৃতি–গ্রন্থগুলো—বিশেষ করে:
- মনুস্মৃতি,
- যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি,
- নারদ স্মৃতি,
- পুরাণ ও মহাকাব্যের সামাজিক আচরণ–বিধি।
এই গ্রন্থগুলোতেই বর্ণব্যবস্থা, নারী–বিদ্বেষ, অস্পৃশ্যতা, শিশুবিবাহ, সতি প্রথা, অঙ্গচ্ছেদ–শাস্তি, দেবতাদের অবমাননাকর কাহিনি, যৌন সহিংসতা, পশুবলি ইত্যাদি বিবিধ অমানবিক রীতির শাস্ত্রীয় ভিত্তি রয়েছে। ফলে “বেদ শুদ্ধ—বাকি সব পরে যুক্ত”—এই যুক্তি বাস্তবে কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি; কারণ সমাজে কার্যকর আইন ছিল স্মৃতি–গ্রন্থভিত্তিক।
আধুনিক সংস্কার আন্দোলন: অমানবিক প্রথা বন্ধ হলেও শাস্ত্রীয় ভিত্তি রয়ে গেছে
১৯শ–২০শ শতকে কিছু হিন্দু সংস্কারক—যেমন রাজা রামমোহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, বেদান্তী চিন্তাবিদেরা—হিন্দুধর্মকে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করেছিলেন। কিছু পরিবর্তন হয়েও ছিল—
- সতি প্রথা নিষিদ্ধ করা,
- শিশুবিবাহ নিষিদ্ধ করা,
- বিধবা–পুনর্বিবাহ আইন করা,
- অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ ঘোষণা (ভারতের সংবিধান),
তবে সমস্যা হলো—এই সংস্কারগুলো এসেছে রাষ্ট্রীয় ও আইনগত শক্তি দিয়ে, ধর্মীয় শাস্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে নয়। মনুস্মৃতি বা অন্যান্য স্মৃতি–গ্রন্থ এখনো হিন্দু গোষ্ঠীর মধ্যে “শ্রদ্ধার” গ্রন্থ হিসেবে টিকে আছে। ফলে নানা সামাজিক ভাবনার গভীরে এখনো সংরক্ষিত রয়েছে—
- বর্ণ–শুদ্ধতার মোহ,
- নারীকে নিয়ন্ত্রণের ধারণা,
- শূদ্র–বিরোধী মনোভাব,
- ধর্মীয় ট্যাবুর ভয়,
- পুরাণের মহিমান্বিত সহিংসতা।
এই গভীর চিন্তাগত সমস্যা হিন্দু সমাজের সংস্কারকে কঠিন করে তোলে। আধুনিক ভারতীয় রাজনীতিতে বর্ণ–মতবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে—যার শিকড় স্মৃতি–গ্রন্থেই।
উপসংহার: হিন্দু ধর্মের মানবাধিকার–বিরোধী উত্তরাধিকার
হিন্দুধর্মের নানা ইতিবাচক দিক যেমন আছে—দর্শন, শিল্প, ভাষা, রূপক, নৈতিক চিন্তা—তেমনি অসংখ্য অমানবিক, বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক বিধানও রয়েছে, যা আধুনিক গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও যৌক্তিক মানবসমাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হলো—ধর্মীয় শাস্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই কালো দিকগুলোকে পরিষ্কারভাবে সামনে আনা, যাতে আলোচনার জায়গা তৈরি হয়।
- বর্ণব্যবস্থা — জন্মগত বৈষম্যকে ঈশ্বরীয় করে তোলা।
- অস্পৃশ্যতা — মানবিক মর্যাদাকে ধ্বংস করা।
- নারী–বিদ্বেষ — নারীকে চিরকাল অধস্তন রাখা।
- শিশুবিবাহ — ধর্মীয় নামে শিশু নির্যাতন।
- সতি — শতাব্দীব্যাপী নারীর বিরুদ্ধে গণহত্যা।
- পৌরাণিক সহিংসতা — দেবতাদের লীলার নামে ধর্ষণ, হত্যা, লুঠ।
- অমানবিক দণ্ডবিধি — অঙ্গচ্ছেদ, দাহ, সামাজিক বহিষ্কার।
- ছদ্মবিজ্ঞান — ধর্মীয় কাহিনিকে বৈজ্ঞানিক সত্যে রূপান্তরের চেষ্টা।
সব মিলিয়ে হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রীয় কাঠামো এবং ঐতিহাসিক প্রথা—বহু ক্ষেত্রেই অমানবিকতা ও বৈষম্যের ওপর দাঁড়ানো। এগুলোকে নৈতিকভাবে প্রশ্ন করা মানে কোনো জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ নয়; বরং মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা, বিজ্ঞান ও যুক্তির পক্ষে দাঁড়ানো।
একটি মানবিক সমাজ গড়তে হলে—শাস্ত্রীয় বৈষম্যকে রোম্যান্টিসাইজ করার বদলে যুক্তিবাদ ও মানবাধিকারের আলোকে পর্যালোচনা করা অপরিহার্য।
