কাঠগড়ায় দর্শন
সূচিপত্র
ভূমিকা
জেফ ফ্রেজার রচিত “ফিলোসফি অন ট্রায়াল” একটি চিন্তা-উদ্দীপক বই যা দর্শনের মূল্যের মৌলিক প্রশ্নটি আমাদের সামনে হাজির করে। দার্শনিক ফ্রেজার এই বইতে এমন একটি প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছেন যে দর্শন হল এমন একটি শৃঙ্খলা যা শুধুমাত্র গ্রন্থ ও তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং বাস্তব জগতে এর কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই! ফ্রেজার দর্শনের সমালোচকদের দ্বারা উত্থাপিত প্রধান যুক্তিগুলির রূপরেখা দিয়ে শুরু করেন, যেমন বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং, যিনি বলেছিলেন যে “দর্শন মৃত।” তারপরে তিনি এই সমালোচকদের দ্বারা করা বিভিন্ন দাবিগুলি পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে যান এবং যুক্তি দেন যে তারা আসলে দর্শন কী তা নিয়ে একটি ভুলের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে এসেছেন। ফ্রেজারের মতে, দর্শন কেবল যুক্তি এবং যুক্তির একটি বিমূর্ত অনুশীলন নয়, বরং একটি ব্যবহারিক হাতিয়ার যা আমাদের চারপাশের বিশ্বের জটিলতাগুলিকে পর্যালোচনা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি যুক্তি দেন যে দর্শন আমাদেরকে আরও ভাল সিদ্ধান্ত নিতে, আরও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে এবং আরও ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।
ফ্রেজার দর্শনের ব্যবহারিক মূল্য বোঝাতে বিভিন্ন উদাহরণ ব্যবহার করেন। তিনি গণতন্ত্রের বিকাশে দর্শনের ভূমিকা, চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে জড়িত নৈতিক বিবেচনা এবং জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য অনুসন্ধানে দার্শনিক প্রতিফলনের গুরুত্ব পরীক্ষা করেন। “ফিলোসফি অন ট্রায়াল” এর অন্যতম শক্তি হল এর বোধগম্যতা। ফ্রেজার একটি স্পষ্ট এবং আকর্ষক নাটক লিখেছেন যা এমনকি জটিল দার্শনিক ধারণাগুলিকে বোঝা সহজ করে তোলে। তিনি পরিভাষা এবং দর্শনের জটিল ভাষা এড়িয়ে যান, এবং এর পরিবর্তে বাস্তব-বিশ্বের উদাহরণ এবং দার্শনিক ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগগুলিতে মনোনিবেশ করেন। নাটকটির আরেকটি শক্তি হল এর বিষয়বস্তু। ফ্রেজার দর্শনের ইতিহাস থেকে সমাজে দর্শনের ভূমিকা সম্পর্কে সমসাময়িক বিতর্ক পর্যন্ত বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বিশ্লেষণাত্মক দর্শন, অস্তিত্ববাদ এবং বাস্তববাদ সহ বিভিন্ন দার্শনিক ধারা থেকে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেন।
আধুনিক বিশ্বে দর্শন বা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের ভূমিকায় আগ্রহী যে কেউ বইটি অবশ্যই পড়া উচিত। তাই সংশয় ডট কমের পাঠকদের উদ্দেশ্যে এই নাটকটির অনুবাদ দেয়া হলো। অনুবাদক মাসুম হাসান এই নাটকে লালন ফকিরকে যুক্ত করেছেন, যা নাটকটিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে।
চরিত্রলিপি/কুশীলব
- লেডি ফিলসোফি [দর্শন (নারী)]
- বিচারক সেইজ
- পেশকার
- রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীঃ মি. কার্প, মি. ব্যাজ, মিস পাইক
- বিবাদী পক্ষের আইনজীবীঃ মিস হওক, মি.ঈগলস, মিস ফ্যালকন
- রেন ডেসকার্টেস (দেকার্তে উচ্চারণ প্রচলিত)
- উইলিয়াম শেক্সপীয়ার
- ফ্রেডরিখ নিটশে
- টমাস জেফারসন
- আলবার্ট আইনস্টাইন
- সক্রেটিস
- লালন
- টিভি রিপোর্টার
- রিপোর্টারের সহকারী
- ক্যামেরাম্যান
- মিসেস ওয়ার্ডস্মিথ
- নিটশের কুকুর
- চিয়ারলিডার/ রেফারি
প্রথম দৃশ্য (আদালত কক্ষ)
পেশকারঃ সবাই দাঁড়ান। [দর্শকদের চারদিকে তাকায়, দেখে যে অনেকেই দাড়ায়নি। এগিয়ে গিয়ে সবাইকে উঠে দাঁড়ানোর ইংগিত দেয়]
দাঁড়ান সবাই। আদালতের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। মহামান্য বিচারক সেইজ আজ বিচারকার্য পরিচালনা করবেন!!
[বিচারক সেইজ প্রবেশ করেন]
বিচারক সেইজঃ পেশকার, আপনি প্রথম মামলাটি শুরু করুন।
পেশকারঃ (গম্ভীর কিন্তু সাড়ম্বরপূর্ণ কন্ঠে) মহামান্য আদালতে এখন “মানুষ বনাম দর্শন” মামলাটির শুনানী শুরু হচ্ছে।
বিচারকঃ বিবাদীকে কাঠগড়ায় হাজির করা হোক।
[পেশকা্র লেডি ফিলোসফি(দর্শন) কে নিয়ে আসে। দর্শন লম্বা ঢিলেঢালা পোষাকে আবৃত এবং বড় ঘোমটা দেয়া। মুখ দেখা যায় না। দড়ির বেল্ট পরিহিত, সন্ত্রাসীদের আলখাল্লার মতো]
বিচারকঃ পেশকার, আপনি অভিযোগসমূহ পাঠ করুন ।
পেশকারঃ বিবাদীকে যেসব অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো- সন্দেহজনক ঘোরাফেরা, ভবঘুরে মনোভাব এবং শান্তি বিনষ্ট। আর বিবাদীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো- তরুন প্রজন্মের মনোজগতকে কলুষিত করা।
বিচারকঃ বিবাদী, আপনার বিরুদ্ধে আনীত আভিযোগগুলো কী আপনি বুঝতে পারছেন?
[দর্শন মাথা ঝাঁকায় (হ্যাঁ বোধক)]
বিচারকঃ রাষ্ট্রপক্ষের মূখ্য উকিল মি. কার্প, আপনিই শুরু করুন।
মি. কার্পঃ উপস্থিত ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলাগণ, মহামান্য আদালত এই মর্মে প্রস্তাবনা করছে যে, নিঃস্বন্দেহে ফিলোসফি -মানে দর্শন হলো অর্থহীন কথামালার ফুলঝুরি যা ব্যক্তিজীবনে কারো কোনো কাজে লাগে না। অথচ, দর্শন প্রতিনিয়ত আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যবান অধ্যয়নে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। দর্শনের সবচে’ বাজে দিকটা হলো সে ভ্রান্ত এবং ভয়ংকর সব ধ্যান-ধারনা দিয়ে ছাত্রদের মনকে কলুষিত করছে। ক্ষুদ্র মৌলকণা থেকে মহাবিস্ফোরণ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের যে অগ্রগতি ঘটেছে, তাতে দর্শনের মতো অসার ধ্যানমগ্নতার কি প্রয়োজন আছে? তার থাকার চেয়ে না থাকা ভালো নয় কী? ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বের সব তথ্য যখন দু’একটি ক্লিক করলেই পাওয়া যাচ্ছে, তাহলে কেনো মানুষ প্রশ্নের উত্তর পেতে নিজেকেই প্রশ্ন করবে? প্রাণীদের উপর বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণ আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে মিথ্যা প্রতিবাদ জানিয়ে কেনো আমরা সভ্যতার অগ্রগতিকে থামিয়ে দিচ্ছি? মহামান্য আদালত, এই মর্মে আমি আমার সহযোগী আইনজীবী মি. ব্যাজ এবং মিস পাইক এর পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে জোরালো আবেদন জানাচ্ছি যে, যেহেতু দর্শন আমাদের সমাজ এবং সমাজের ভবিষ্যতের নিকট হুমকিস্বরূপ, তাই অতিবাস্তব এই বিষয়টি আমলে নেয়া হোক।
বিচারকঃ বিবাদীপক্ষের মূখ্য উকিল মিস ফ্যালকন, আপনি কিছু বলুন।
মিস ফ্যালকনঃ মহামান্য, আমার বেশী কিছু বলার নেই।(দর্শকদের দিকে ঘুরে) জুরির ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ, আমরা বিবাদীপক্ষের আইনজীবী মি. ঈগলস, মিস হওক এবং আমি মিস ফ্যালকন প্রস্তাবনা করছি- এই মামলার সাক্ষীরা কথা বলুক আর কার্যবিধি স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে যাক। আমি নিশ্চিত, বিচারকগণ নিজেরাই বুঝে যাবেন- আমাদের মক্কেল দর্শনকে নিতান্তই ভুলক্রমে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমরা মনে করি, বর্তমান সমাজের একমাত্র ভয়াবহ বিপদ হচ্ছে দর্শনের উপদেশকে অবজ্ঞা করা। কারন, পৃথিবী এখন যেসব চ্যালেঞ্জের এর মুখোমুখি, সেগুলোর সমাধানে কে এগিয়ে আসবে যদি মানুষের দার্শনিক যুক্তি আর দর্শনগত বিচারবুদ্ধি না থাকে?
বিচারকঃ মি কার্প, প্রথম সাক্ষীকে আদালতে হাজির করুন।
মি কার্পঃ মহামান্য, এই মামলার প্রথম সাক্ষী রেন ডেসকার্টেস।
বিচারকঃ পেশকার, রেন ডেসকার্টেসকে ডাকুন।
পেশকারঃ সাক্ষী রেন ডেসকার্টেস হাজির….। রেন ডেসকার্টেস, জন্ম ১৫৯৬।
[রেন ডেসকার্টেস অভিবাদন দিতে দিতে প্রবেশ করে]
ডেসকার্টেসঃ প্লিজ……আমার নামের উচ্চারণ রেন নয়, ররররেন।
পেশকারঃ আচ্ছা, তো মি ররররেন, আপনার হাত তুলুন আর বলুন-“যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না”।
ডেসকার্টেসঃ কিন্তু আমি তো সবসময় তা-ই করি!
বিচারকঃ মি. কার্প, সাক্ষ্য গ্রহণ করুন ।
মি. কার্পঃ Rrrrrr…. Rrrrrr…..(কাশি) উহ! মি. ডেসকার্টেস, আপনার পেশা?
ডেসকার্টেসঃ বিশিষ্ট গণিতবিদ…….এবং দার্শনিক ।
মি. কার্পঃ অবশ্যই, অবশ্যই। আচ্ছা, আপনি কী একবার বলেছিলেন-“আমি ভাবি, অতএব সেই ভাবনাটাই আমি?”
ডেসকার্টেসঃ হ্যাঁ বলেছিলাম। মনে হয় একবার না, অনেকবারই বলেছি।
মি. কার্পঃ আসলে আপনার বাণীগুলোর মধ্যে এই ছোট্ট বাক্যটাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমরা কী ধরে নিতে পারি যে বাক্যটি পশ্চিমা বিশ্বের দর্শন জগতের সবচেয়ে বিখ্যাতগুলোর একটা?
ডেসকার্টেসঃ [হাস্যোজ্জ্বল, কাধ ঝাকিয়ে আংগুল দিয়ে কোটের অংশ ব্রাশ করে] হ্যাঁ, আমার মনে হয় আপনি এটা ভাবতে পারেন।
মি. কার্পঃ আ হা……তাহলে আপনি এটা স্বীকার করছেন?
ডেসঃ হ্যাঁ, অবশ্যই !(কিছুটা বিভ্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন মনে হয়)
মি. কার্পঃ মি. ডেসকার্টেস, মানে… সত্যিই কী ব্যাপারটা এমন যে, আমি যা ভাবি, আমি তা-ই? এই কথাটার মধ্যে গভীর কি দর্শন আছে? সত্যিই কী এটা পৃথিবী কাঁপানো কোনো দার্শনিক চিন্তা? কথাটা কী এমন বোঝায় না –যদি কোনো চিন্তা তৈরি হয়, তবে অবশ্যই একজন চিন্তাবিদও আছেন? আপনারা যেসব দার্শনিক তত্ত্ব পছন্দ করেন এটা তো সেরকম কল্পনাসমৃদ্ধ কোনো মহান বাণী নয়। “আমি ভাবি”-এই কথাটার মধ্যেই তো আমিময় জগতের সুপ্তবীজ নিহিত আছে। সুতরাং “আমি তা-ই”- এই অংশটা কী অতিরঞ্জন নয়? তাহলে তো এমন কথাও বলা যায় যে- “আমি নেই, এবং তবুও আমি ভাবি”!
ডেসকার্টেসঃ স্যার, আমি দুঃখিত কারন, আপনি আমার আসল পয়েন্টটাই মিস করেছেন।
কার্পঃ ওহ নো…… আমার তা মনে হয় না। আমি বলতে চাই- আসলে এখানে আর কোনো পয়েন্ট-ই নেই। কথাটা পুরোপুরি নিরর্থক এবং তুচ্ছ। আপনি বিচারকমহলের কাছে এটাই নিশ্চিত করেছেন যে, দর্শন হলো ইঁদুরের গর্তকে পর্বতে পরিণত করার বিদ্যা। আপনারা দার্শনিকরা সরল কোনো বিষয়কে চমৎকার জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারেন।
মহামান্য, আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।
বিচারকঃ মিস ফ্যালকন, আপনি কী এর বিরুদ্ধে সাক্ষীকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
মিস ফ্যালকনঃ জ্বী, মহামান্য। এটা আমার সৌভাগ্য। মি ডেসকার্টেস, একটু আগে আপনি বলেছেন “আমি ভাবি এবং আমি তাই”-বাক্যটি মানুষ ভুল বুঝতে পারে। তাই আপনি কী আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?
ডেসকার্টেসঃ হ্যাঁ। দেখুন, কিছু সরল প্রশ্নের মাধ্যমে আমি মানুষের বোঝা-না বোঝার ক্ষমতাটা ধরতে চেষ্টা করেছি। যেমন- সত্য হিসেবে আমি কি জানি? বাস্তব জগত কি? তখনি আমি বুঝলাম আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো অবিরত ভুল পথে চলে। আমরা কিছু একটা দেখি, অথচ জিনিসটা আসলে ঐ জায়গায় নেই; আবার অনেক সময় যা থাকে তা দেখতে পাই না। তাছাড়া আমরা স্বপ্নে যা দেখি, সেই সময়টা মনে হয় একেবারে বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্ততপক্ষে না জাগা পর্যন্ত। সুতরাং আমি কিভাবে বুঝব যে ঠিক এই মুহূর্তে আমি স্বপ্নজগতে নেই? অথবা এমনওতো হতে পারে- এখানে উপস্থিত সভ্যগণ(বিচারক ও উকিলদের ইংগিত করে)সবাই স্বপ্নের দেশে হারিয়ে গেছে। তাই সত্যের খোঁজে আমি সবকিছুকেই সন্দেহ করছি। আর আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করছি- কোন ব্যাপারটা আমি নিঃস্বন্দেহে বিশ্বাস করতে পারি? একটাই জবাব পেলাম, আর তা হলো- একমাত্র আমার নিজের অস্তিত্ব।
মিস ফ্যালকনঃ মি. ডেসকার্টেস, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি কিছুটা সন্দেহবাদী!!
ডেসকার্টেসঃ একজ্যাক্টলি! আমি বিশ্বাস করি- প্রত্যেকটা মানুষকেই শুরু করতে হবে আমাদের তথাকথিত সত্যগুলোকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে। নতুবা, অতীতের ভুলগুলোর জন্য প্রতিনিয়ত মূল্য দিতে হবে।
মিস ফ্যালকনঃ হ্যাঁ, আমার মনে হয় বিচারকদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে নিজেকেই সন্দেহ করছেন যে তারা সত্যিই এখন স্বপ্নজগতে আছেন কি না!!
ডেসকার্টেসঃ সেই সত্য সম্ভাবনার ব্যাপারে তারা যুক্তিসংগত বিবেচনা করুক- আমি তা-ই চাই।
পেশকারঃ (স্বগতোক্তি) এটা কেমন কেমন জানি… রহস্যময় লাগছে…
মিস ফ্যালকনঃ আসলেই তাই। আচ্ছা মি. ডেসকার্টেস, আপনাকে তো শুধু আধুনিক দর্শনের জনকই বলা হয় না, বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতির জনকও বলা হয়। কারন, আপনি জ্যামিতির Cartesian Coordinate System develop করেছেন। আপনার এই পদ্ধতির ফলে সরলরেখা আর বক্ররেখার সমতা এসেছে। তবে অনেকেই মনে করেন- আপনার এই তত্ত্ব ছাড়া নিউটন হয়তো ক্যালকুলাস উদ্ভাবন করতে পারতো না। এটা কী সত্য নয়?
ডেসকার্টেসঃ হ্যাঁ, স-ব সত্য। যদিও আমার ধারণা হাইস্কুলের কিছু কিছু ছাত্র মনে করে- আমি যদি বিশ্লেষনমূলক জ্যামিতি উদ্ভাবন না করতাম তবে তাদের জন্য বেশ ভালো হতো।
মিস ফ্যালকনঃ সয়ার আসলেই আপনি জিনিয়াস…এটা সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই।
ডেসকার্টেসঃ না; আমি মানতে পারলাম না।
মিস ফ্যালকনঃ এখন আমি অন্য একটি বিষয় জানতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়তো আপনি আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন; সেজন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু কি এমন হলো যে আপনি আজ আইনজীবী হিসেবে আমাদের মাঝে নেই? বরং এসেছেন সাক্ষী হয়ে?
ডেসকার্টেসঃ আসলে, “বৈজ্ঞানিক সত্য অন্বেষণ এবং কারণ অনুসন্ধানের সঠিক উপায়” এই নামে তখন আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম এবং তারপরই আমি আইনশাস্ত্রকে বিদায় জানালাম।(একটি বই হাতে নেয়, পৃষ্ঠা উল্টায়…) তারপর… নিজের অভ্যন্তরে আর পৃথিবী্র বিখ্যাত বইগুলো ছাড়া অন্য কোথাও জ্ঞানের আনুসন্ধান করবনা বলে মনস্থির করলাম। যুবক বয়সের বাকী অংশ কাটলো ভিন্নভাবে- ভ্রমন করলাম, সেনাবাহিনীতে গেলাম, কোর্টে গেলাম, বহুরূপী ঢং আর বিভিন্ন স্ট্যাটাসের মানুষের সাথে মিশলাম- সব মিলিয়ে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো- তাই নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিলাম। সবসময়ই, সামনে যা এলো তা থেকেই জ্ঞান আহরণ করলাম। (বইটি বন্ধ করে)
তারপরও… যদি আমি দূর্ভাগ্যক্রমে আইনজীবী হয়েই যেতাম, তবে আজ আপনার পাশে দাঁড়িয়ে অবশ্যই ‘দর্শন’ এর পক্ষেই লড়তাম। আমি আপনার সফলতা কামনা করি কারন, আমি বিশ্বাস করি…… ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এখনো দর্শনের প্রজ্ঞা আর তত্ত্বাবধান খুবই দরকার।
আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ ধন্যবাদ মি. ডেসকার্টেস, আপনি আসতে পারেন।
[ডেসকার্টেস চলে যায়]
বিচারকঃ আদালত এখন পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করবে।
মি ব্যাজঃ জ্বী, মহামান্য।
বিচারকঃ জনাব ব্যাজ, সাক্ষী হিসেবে এবার কে আসছে?
মি ব্যাজঃ বিচারকার্যে এখন সাক্ষ্য দেবেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার!
বিচারকঃ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কে ডাকুন।
পেশকারঃ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, জন্ম ১৫৬৪।
[শেক্সপিয়ার অভিবাদন দিয়ে প্রবেশ করে]
পেশকারঃ জনাব শেক্সপিয়ার, অনুগ্রহ করে বলুন… “যাহা বলিব………………………না”।
শেক্সপিয়ার: অবশ্যই (বিচক্ষণ স্বরে) কারণ, শেষ পর্যন্ত সত্য প্রকাশিত হবেই!
মি ব্যাজঃ জনাব শেক্সপিয়ার, আপনার পেশা কি?
শেক্সপিয়ার: কবি এবং নাট্যকার।
মি ব্যাজঃ আপনি তো অনেকগুলো নাটক লিখেছেন, তাই না?
শেক্সপিয়ার: হ্যাঁ, আমার হারিয়ে যাওয়া নাটকগুলো সহ মোট ৪৫ টা। অধিকাংশই কমেডি !!
মি ব্যাজঃ তবে আমি আপনার Tragedy গুলোর খুব ভক্ত। অনেক বছর ধরেই আপনার Tragic নাটকগুলো খুব ভালো চলছে যদিও প্রধান চরিত্রের দুঃখজনক পরিণতির মধ্য দিয়ে সেগুলো শেষ হয়েছে। ব্যাপারটা কেমন যেন, তাই না?
শেক্সপিয়ার: লোকজন আসলে অশ্রুবিলাস ভালোবাসে!
মি ব্যাজঃ জনাব শেক্সপিয়ার, আমরা ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে অন্ধকার এবং যন্ত্রণাময় মুহূর্তগুলোর কথা বলতে চাই। যেমন (নোটবুকের দিকে তাকিয়ে) ম্যাকবেথ এর কথাই ধরুন- আপনার কী মনে আছে, ম্যাকবেথ নাটকের ৫ম অঙ্কের ৫ম দৃশ্যে কি ঘটেছিলো?
শেক্সপিয়ার: অবশ্যই মনে আছে। সিংহাসন লাভের আশায় ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করলো। তখনি সে শুনল- তার স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথ আত্নহত্যা করেছে আর রাজপ্রাসাদও শীঘ্রই দখল হতে যাচ্ছে।
মি ব্যাজঃ ম্যাকবেথের স্বগতোক্তিগুলো কী আপনার মনে পড়ে?
শেক্সপিয়ার: হ্যাঁ… “আজ পার হয়ে আগামীকাল, আগামীকাল, তারপর আগামী দিন; এভাবেই আমাদের জীবন নির্ধারিত সময়ের গন্ডি পার হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে। এক একটি দিন অতিক্রান্ত হয়, আর আমরা মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে থাকি। আমাদের পার হয়ে আসা আঁধার অতীত অলৌকিক প্রদীপ হাতে অবোধ মানুষকে নিয়ে যায় মৃত্যুকূপের দিকে। নিভে যাও, নিভে যাও হে ক্ষণিকের প্রদীপশিখা; এ জীবন তো এক চলমান ছায়া কিংবা কোনো এক অসহায় অভিনেতা- জীবনমঞ্চে যে ক্ষণিকের জন্য সদর্পে পদচারনা করে; তারপর চিরতরে চলে যায় যবনিকার আড়ালে। আসলে জীবন কোনো এক নির্বোধের বর্ণিত কাল্পনিক কাহিনী, অসার বাক্যজালের অর্থহীন প্রলাপমাত্র।”
মি ব্যাজঃ জনাব শেক্সপিয়ার, অনেক কিছু পাওয়ার পরও মনে হচ্ছে, ম্যাকবেথ যেন বলছে- জীবন নিরর্থক এবং অতীত আমাদের কিছুই শেখাতে পারেনি। সবকিছুতেই কেমন শূণ্যতা। আমি বলতে চাই- তাহলে দর্শনের উজ্জ্বল আলো কোথায়, যে আলো গভীর জ্ঞান আর উন্নত জীবনের পথ দেখায়? এর বদলে এমন মনে হচ্ছে- আমরা যেন সবাই গাধা; কেবলি ধূসর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
শেক্সপিয়ার: হুম……আসলে ম্যাকবেথের তখন খুব দুর্দিন যাচ্ছিলো !
মি ব্যাজঃ তবুও… এমন মনে হয় যেন ম্যাকবেথের পার্থিব জগত ধ্বংসবাদকে সমর্থন করে।
মিস ফ্যালকনঃ অবজেকশন, মহামান্য! এটা নিতান্তই একটা নাটক। [শেক্সপিয়ারকে ইংগিত করে] এখানে আমি দর্শনজগতের কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।
মি ব্যাজঃ [ধীরে ধীরে] মহামান্য, আমাকে আরো প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হোক, নিশ্চই এর প্রাসংগিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
বিচারকঃ অবজেকশন ওভাররুলড! Proceed on জনাব ব্যাজ.
মি ব্যাজঃ যা বলছি্লাম… ম্যাকবেথের পার্থিব জগত ধ্বংসবাদের দিকে ধাবমান। আসলে দর্শন এই কাজটাই করে, অর্থাৎ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। ম্যাকবেথের ঐ সংলাপগুলোর চেয়ে অধিক অলংকারপূর্ণ, সুতীব্র আর অধিক পীড়নকারী কোনো বাক্য পুরো পশ্চিমা সাহিত্যের আর কোথাও নেই। [থামে……এগিয়ে যায়…… আবার থামে……সাক্ষীর কাছে যায়] জনাব শেক্সপিয়ার, আপনি নিশ্চই আপনার লেখা আরেকটি নাটকের [নোটবুকের দিকে তাকিয়ে] কথা মনে করতে পারবেন- আর তা হলো The Tragedy of Hamlet.
শেক্সপিয়ার: হ্যাঁ, এখনো বিখ্যাত……Globe Theatre এই নাটকটি প্রদর্শন করে।
মি ব্যাজঃ ঠিক আছে, আপনি কী এখন বলতে পারবেন হ্যামলেট নাটকের ১ম অঙ্কের শেষ দৃশ্যে কি ঘটেছিলো?
শেক্সপিয়ার: অবশ্যই। ঐ দৃশ্যে হ্যামলেট তার সদ্যমৃত পিতার প্রেতাত্নার সাথে কথা বলে জানতে পারে- তার চাচাই তার বাবার আসল খুনী। অথচ হত্যাকারী হ্যামলেটের মা’কে বিয়ে করে সিংহাসন দখল করলো। হ্যামলেট চেয়েছিলো তার বন্ধু হোরেশিও যেন ভূত দেখার ঘটনাটা কাউকে না বলে।
মি ব্যাজঃ ঘটনা জেনে হোরেশিও যখন বিস্মিত হলো, হ্যামলেট তখন কি বলেছিলো?
শেক্সপিয়ার: বলল- “হোরাশিও, তোমার দার্শনিক হৃদয়ে যেসব কল্পনা বিদ্যমান, তার চেয়ে আনেক বেশি কিছু ঘটে স্বর্গে আর এই পৃথিবীতে ।”
মি ব্যাজঃ সে কী ঐ দর্শনের কথা বলেছিলো যা তারা দু’জন Wittenberg University তে একসাথে পড়েছিলো?
শেক্সপিয়ার: জ্বী, it’s right.
মি ব্যাজঃ এটা তো দর্শনের কোনো আলোড়ন সৃষ্টিকারী অধ্যায় নয়, তাই না? বলুন তো, যখন আপনি জানলেন আপনার বাবা খুন হয়েছে, আর আপনার মা সেই খুনীর সাথে একই বিছানায় ঘুমোচ্ছে- তখন দর্শনের কি মূল্য আছে? যখন আমাদের জগতসংসার আমাদেরই চোখের সামনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তখন বসে বসে কল্পনা করা নির্বিকার থাকা ভয়ানক নয় কী?
শেক্সপিয়ার: বুঝতে পারছি… হ্যামলেটের ঐ মুহূর্তের মানসিক আবেগ আপনি যথার্থই ধরতে পেরেছেন!
মি ব্যাজঃ ধন্যবাদ আপনাকে, জনাব শেক্সপিয়ার। আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ মি ঈগলস, সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন।
ঈগলস জনাব শেক্সপিয়ার, আপনি কী ভূত বিশ্বাস করেন?
শেক্সপিয়ার: আমি? না………!
ঈগলসঃ (মুখটিপে হাসি) আমারতো তা মনে হয় না। বলুন, আপনি কী বোদিউস নামের কাউকে চেনেন?
শেক্সপিয়ার: অবশ্যই। তিনি রোমান সিনেটর ছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তার মৃত্যুদন্ড হয়। সম্ভবত, তিনিই ছিলেন বিশ্বের মহান দার্শনিকদের মধ্যে প্রাচীন যুগের সর্বশেষজন, আর মধ্যযুগের প্রথমজন।
ঈগলসঃ আপনি জানেন, কারাগারে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে করতে বোদিউস কি লিখেছিলো?
শেক্সপিয়ার: হ্যাঁ, সে লিখেছিলো The Consolation of Philosophy- অর্থাৎ দর্শনের সান্ত্বনা। এটা লেখা হয়েছিলো বোদিউস আর লেডি ফিলসোফি’র মধ্যে কথোপকথন আকারে। আসলে বোদিউসের চরম হতাশার সময় লেডি ফিলসোফি তাকে একটু শান্তির পরশ দেয়ার চেষ্টা করেছিলো।
[লেডি ফিলসোফি ধীরে ধীরে সামনে আসে, মাথা নোয়ায়, পেশকার তাকে সাপোর্ট করে, সান্ত্বনা দেয়। একটি রুমাল হাতে দেয়; তখন লেডি ফিলসোফি রুমালের মধ্যে জোরে জোরে শব্দ করে নাক ঝাড়ে। রুমালটা তাকে ফেরত দেয়, কিন্তু পেশকার সজোরে প্রত্যাখ্যান করে]
বিচারকঃ বিবাদী কিছু বলতে চান?
[লেডি ফিলসোফি না বোধক মাথা নাড়ে এবং হাত তুলে বোঝায় যে সে ঠিক আছে]
বিচারকঃ Proceed on জনাব Eagles।
ঈগলসঃ জনাব শেক্সপিয়ার, আপনি বলছিলেন যে দর্শনের সান্ত্বনা লেখাটিতে লেডি ফিলসোফি বোদিউসের চরম হতাশার সময় তার পাশে দাঁড়ায়।
শেক্সপিয়ার: হ্যাঁ।
ঈগলসঃ ঐ লেখাটির একটি অংশ ঘটনাক্রমে আমার কাছে আছে। বোদিউস এবং লেডি ফিলসোফি’র মধ্যে কথোপকথন। দয়া করে কি আপনি এটা আমাদের পড়ে শোনাবেন?
শেক্সপিয়ার: (পাঠ করে) “আমার বিশ্বাস- ইতিহাস একটা চাকার মতো। চাকাটা বলছে- গতিশীলতা আমার নিত্যসঙ্গী। আপনারা আমার স্পোকগুলোর উপর উঠে দাঁড়ান; কিন্তু ঘূর্ণনের ফলে ছিটকে পড়লে আমাকে দোষ দেবেন না। সুন্দর সময়গুলো হারিয়ে যায়, খারাপ মুহূর্তগুলোও টিকে থাকে না। ভাগ্যের চিরন্তন পরিবর্তনই আমাদের ট্র্যাজেডি। একই সাথে এটা আমাদের প্রত্যাশারও জায়গা। তবে কি সর্বোত্তম সময়ের মতোই নিষ্ঠুরতম সময়ও প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে?”
মি ঈগলসঃ হা হা হা…… বোদিউস দুর্ভাগ্যের চরম শিখরে, আর তখন দর্শন তাকে শোনাল প্রত্যাশার মধুর বাণী !!¬
শেক্সপিয়ার: হ্যাঁ, আসলে ঐ সিনেটর সম্ভবত হ্যামলেটের তুলনায় কিছুটা বয়স্ক এবং বেশি বিজ্ঞ ছিলো।
(চিন্তা করে) হুমম… ম্যাচিওর্ড বোদিউসকে নিয়ে আমার একটি নাটক লেখা উচিত।
ঈগলসঃ আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ ধন্যবাদ জনাব শেক্সপিয়ার, আপনি যেতে পারেন।
[শেক্সপিয়ার চলে যায় ]
বিচারকঃ রাষ্ট্রপক্ষের আর কোনো সাক্ষী আছে?
[মিস পাইক এগিয়ে আসে]
পাইকঃ জ্বী, মহামান্য।
বিচারকঃ ঠিক আছে, পরবর্তী সাক্ষীকে ডাকুন।
পাইকঃ আমাদের শেষ সাক্ষী- ফ্রেডরিক নিটশে।
বিচারকঃ ফ্রেডরিক নিটশেকে হাজির করা হোক।
পেশকারঃ ফ্রেডরিক নিটশে, জন্ম ১৮৪৪
[ফ্রেডরিক নিটশে সদর্পে প্রবেশ করে এবং অভদ্রের মতো নিজের ক্যাপটা বিচারকের দিকে নাড়তে থাকে]
পেশকারঃ মি. নিটশে, প্লিজ হাত তুলে শপথ করুন- “যাহা বলিব সত্য বলিব……………না”
নিটশেঃ [অতি উৎসাহ নিয়ে, অনেকটা উন্মাদের মতো] হ্যাঁ, হ্যাঁ হ্যাঁ!!
পাইকঃ মি নিটশে, আপনি তো অনেকগুলো বই লিখেছেন, তাই না?
নিটশেঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, অসাধারণ সব বই। যেমনঃ Beyond Good & Evil, Human, All Too Human, ওহ-আমার প্রিয় লেখাগুলো হলো- Twilight of the Idols, (বিচারকের হাতুড়ি নিয়ে নেয় আর জোরে জোরে বলতে থাকে) How to Philosophize with A Hammer!(বিচারকের টেবিলে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে যেন কাল্পনিকভাবে করছে। পেশকার দৌড়ে এসে থামায়, হাতুড়ি কেড়ে নেয়।)(নিটশে বলতে থাকে তবে খুব শান্তভাবে) আসলে এগুলো আমার অনেক লেখার মধ্যে অল্প কয়েকটা।
পাইকঃ আচ্ছা মি নিটশে, আপনি কী কখনো লিখেছিলেন যে- “ঈশ্বর মারা গেছে”?
নিটশেঃ হ্যাঁ, লিখেছিলাম আর ঈশ্বর এই কথার প্রতিউত্তরও করেছিলেন! তিনি দাবী করলেন “নিটশে মারা গেছে”। কিন্তু আপনারা দেখুন (আনন্দসহ) আমি এখানেই আছি।
পাইকঃ মি নিটশে, আপনার দাম্ভিক আচরনে সত্যিই আমরা আতঙ্কিত। দেখুন এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। কোনো ধরণের প্রমাণ ছাড়াই আপনি কিভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেন? “ঈশ্বর মারা গেছে”-এই কথাটি অনুভূতিপ্রবল তরুনদের মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা আপনি একবারও ভাবেননি। ঈশ্বর যাদের কাছে একমাত্র আশার আলো, পথপ্রদর্শক এবং অর্থবহ কেউ একজন, সেইসব লক্ষ কোটি মানব মনের কতটা ক্ষতি হতে পারে তা-ও আপনি ভাবেন নি।
নিটশেঃ আশা? অর্থবহ?? হ্যাঁ, ‘আশা’ এবং ‘অর্থবহ’- এই দু’টিকেই তো আমি উদ্ধারের চেষ্টা করেছি! আমি লিখলাম ‘ঈশ্বর মারা গেছে’-এখানে তো আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করিনি। আসলে আমি ঈশ্বরকে হারানোর ব্যথায় অনুতাপ করছিলাম। সেটা কখন জানেন? ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং আলোকিতকরন বিপ্লবের পর। আমি শুধু লক্ষ করছিলাম তখনকার দার্শনিকদের মধ্যে কার কার কথা সত্য হতে পারে। তখন গোটা ইউরোপ জুড়েই চিন্তাশীলতা এবং মূল্যবোধের শূণ্যতা। আমার সারাজীবনের সংগ্রাম ছিলো- মানবজাতি যেনো তাদের মূল্যবোধ ফিরে পায়, তারা যাতে নিয়তিকে আলিঙ্গন করতে পারে মর্যাদা এবং সাহসের সাথে। আমি আরও চেয়েছি- মানুষ নিজেই নিজেকে অতিক্রম করুক।
পাইকঃ নিজকে অতিক্রম! আপনি কী তাদের সাহসিকতার কথা বলছেন? (সমর্থন না করে) কতটা অহংকারী আর দাম্ভিক হলে মানুষ নিজেকে অতিক্রম করার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারে! তেমন Superhuman এর কথা ভাবতে পারে যারা সভ্য সমাজের প্রথা এবং আইনকানুনের ঊর্ধে!!
নিটশেঃ আপনাদের স্নরণ করিয়ে দেই- একটি সমাজ সবসময়ই অবক্ষয়ের পথে হাঁটে। আসলে আমি ধ্বংসবাদের কথা বলিনি; বলেছি ম্যাকবেথের মতো বীরের ধ্বংসের পুরো উল্টা কথা।
পাইকঃ(বিরক্তিসহ) আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ বিবাদী পক্ষ কি কিছু বলবেন?
মিস হওকঃ আমরা তো বলবই, মহামান্য!
বিচারকঃ Okay, please proceed মিস হওক.
Hawke: মি নিটশে, আপনার একটা লেখা আছে- The Joyful Wisdom মানে “আনন্দময় জ্ঞান”। ওটার একটা অংশ এখন আমার হাতে। দেখুনতো এটি আপনার লেখা কি না… (নিটশে ভালোভাবে দেখে )
নিটশেঃ হ্যাঁ, এটা আমারই লেখা।
হওকঃ লেখাটা আমাদের একটু পড়ে শোনাবেন?
নিটশেঃ (পড়তে শুরু করে) “তোমরা কী সেই পাগল লোকটিকে চেন যে একবার দৌড়াতে দৌড়াতে একটা বাজারে এলো আর একটানা বলে যাচ্ছিলো ‘আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি, আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি’। সেখানে অনেকেই ছিলো যারা ছিলো নাস্তিক। সুতরাং তারা খুব মজা পাচ্ছিলো। একজন বললো ‘ঈশ্বরকে কেন খুঁজছেন, তিনি কী হারিয়ে গেছেন? তিনি কী আমাদের ভয়ে ভীত? নাকি ঈশ্বর সমুদ্রযাত্রায় গেছেন?’
সবলোক হা হা করে মজা করতে লাগলো। পাগলটা লাফ দিয়ে তাদের মাঝে এসে বলল ‘ঈশ্বর কোথায় গেছে আমি জানি- আসলে আমরা ঈশ্বরকে হত্যা করেছি, তোমরা আর আমি। আমরা সবাই তাঁর খুনী। ঈশ্বর মৃত। ঈশ্বর মৃতই থাকেন, কারন আমরাই তাঁকে মেরে ফেলেছি। আমরা কীভাবে নিজেদের সান্ত্বনা দেব যখন সবচে’ ভয়ংকর খুনী আমরা নিজেরাই? এই বিশ্ব যাকে সবচে’ পবিত্র এবং সবচে’ শক্তিশালী হিসেবে অধিকার দিয়েছে- তিনিই তো আমাদের তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার নিচে রক্তরঞ্জিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন! আমাদের মধ্যে কে এই রক্ত মুছতে পারবে? আর কোন জলে আমরা নিজেদের পরিচ্ছন্ন করব?”
হওকঃ ধন্যবাদ মি নিটশে। এই গল্পের পাগলটা কী আপনি নিজেই?
নিটশেঃ (কষ্ট পাওয়ার ভান করে) ম্যাডাম, আমি প্রায়ই পাগল কিন্তু কখনো বদ্ধ উন্মাদ নই।
হওকঃ আচ্ছা আপনি বলুন- ঈশ্বরে বিশ্বাস- এটা কি বিশ্বাসের ব্যাপার না দর্শনের?
নিটশেঃ এটা বিশ্বাসের ব্যাপার। যারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন, তাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু যারা দুর্ভাগা এবং যাদের জীবন হতাশা আর লক্ষ্যহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত আমি শুধু তাদের প্রতি একটা চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দেই- ‘সৃষ্টিশীল অনুভূতি নিয়ে জীবনকে যাপন কর এবং নিয়তিকে আলিঙ্গন কর।
হওকঃ ধন্যবাদ আপনাকে. আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ ধন্যবাদ মি নিটশে, আপনি এখন যেতে পারেন। এই আদালত এখন একটা ছোট্ট বিরতি নিচ্ছে। আধঘন্টার মধ্যে বিচারকার্য আবার শুরু হবে।
২য় দৃশ্য (আদালত প্রাঙ্গণ)
[ একজন নিউজ রিপোর্টার(টিভি) মঞ্চে হেঁটে আসে। সাথে সহকারী এবং ক্যামেরাম্যান। দলটির সাথে আছে একটি ভিডিও ট্র্যাক। সহকারী কদর্যহীন পোষাকে আবৃত একজন মহিলাকে ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসে।]
রিপোর্টারঃ Good afternoon. সুধী দর্শক, আপনারা জানেন, আজ বহুল আলোচিত মামলা ‘মানুষ বনাম দর্শন’ এর বিচারকাজ চলছে। বিচার প্রক্রিয়ার আপডেট জানাতে আমরা এখন কোর্টপ্রাঙ্গন থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছি। আজ সকালে বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ারসহ এ পর্যন্ত ৩জন বিশিষ্ট দার্শনিকের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। দর্শক, সৌভাগ্যক্রমে আমরা শেক্সপীয়ারের বাল্যকালের স্কুলের একজন শিক্ষিকা- মিসেস ওয়ার্ডস্মিথকে পেয়ে গেছি। তাঁর কাছে আমরা বিচারকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইব।
আচ্ছা মিসেস ওয়ার্ডস্মিথ, সাক্ষ্য দেয়ার সময় শেক্সপীয়ারের Performance কেমন ছিলো বলে আপনি মনে করেন?
ওয়ার্ডস্মিথঃ আমি অভিভূত কারন, শেক্সপীয়ার বোদিউসের লেখাগুলো হুবহু স্মরণ করতে পেরেছিলো। আপনারা জানেন- ছোটবেলায় শেক্সপীয়ার মাঝারি মেধার ছাত্র ছিলো আর তাকে নিয়ে অন্য ছেলেরা কখনো মাথা ঘামাতো না। সে ক্লাসরুমে বসে বরাবরই দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকতো আথবা নিজের ডায়েরিতে এলোমেলো কথা লিখতো।
রিপোর্টারঃ এতে করে স্কুলে শেক্সপীয়ার কি কখনো কোনো সমস্যায় পড়েছিলো?
ওয়ার্ডস্মিথঃ না……তবে আমার কাছে প্রায়ই ধরা পড়তো যখন সে ক্লাসরুমে বসে ছোট ছোট কাগজে কিছু লিখে সেগুলো মেয়েদের কাছে চালান করে দিত। কাগজগুলো পড়তে পড়তে মেয়েরা বিমুগ্ধ হয়ে যেত কারণ ওগুলো সবই ছিলো প্রেমের কবিতা। বাচ্চারা যেমন যন্ত্রনা করে, ওর ব্যাপারটা তেমন ছিলো না। সেগুলো ছিলো আপত্তিকর।
রিপোর্টারঃ প্রেমের কবিতা! Interesting! কেমন ছিলো কবিতাগুলো?
ওয়ার্ডস্মিথঃ কবিতাগুলোর অল্প কয়েকটা আমি হাতেনাতে ধরেছিলাম। আপনাকে এটা বলতে পারি- ওগুলো পড়ে আমি লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম। কবিতায় সে সুন্দর শব্দ নিয়ে খেলতো কিন্তু আমার কাছে সেগুলো দুর্বিনীত মনে হতো।
রিপোর্টারঃ শেক্সপীয়ারকে সত্যিকারের জাদুকরের মতো মনে হচ্ছে। তাহলে হোঁচট খেয়ে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলো না সে। তারপর?
ওয়ার্ডস্মিথঃ হুমম…সে তলোয়ারযুদ্ধ খেলতেও পছন্দ করতো। টিফিনের সময় বন্ধুদের সাথে নিয়মিত খেলতো।
রিপোর্টারঃ চমৎকার। শেক্সপীয়ার সম্পর্কে আর কিছু বলার আছে আপনার?
ওয়ার্ডস্মিথঃ না… তবে শেক্সপীয়ারের স্কুলের সবাই আমার কাছে ছিলো পরিবারতুল্য- এটা আমি চিৎকার করে বলতে চাই।
রিপোর্টারঃ আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ওয়ার্ডস্মিথঃ It’s my pleasure! [ক্যামেরায় Good bye দেখায়]
[Assistant পেশকারকে নিয়ে আসে]
রিপোর্টারঃ দর্শক, আমাদের সাথে এখন জয়েন করছেন ‘মানুষ বনাম দর্শন’ মামলার অভিজ্ঞ পেশকার জর্জ ম্যাকক্রাকেন। মি ম্যাকক্রাকেন, বিচারকার্যে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবচে’ উল্লেখযোগ্য ঘটনা কি?
পেশকারঃ [অসভ্য কিন্তু অমায়িক ফর্ম্যাল ভাষায়] হুমম… আমরা Already কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়েছি। আজ মি ডেসকার্টেসের প্রস্তুতি বেশ ভালো ছিলো। বেশভূষায় তাঁকে খুব সম্ভ্রান্ত লাগছিলো।
রিপোর্টারঃ আচ্ছা, মি. নিটশের সাক্ষ্য নেয়ার সময়, আদালত কি কিছু নোট করেছিলো?
পেশকারঃ আমি আসলে তা জানি না। তবে আজ মি. নিটশের চুলের স্টাইল মোটেই ভালো ছিল না। এতটাই এলোমেলো, মনে হচ্ছিলো যেন মাথা পুরোটাই গেছে। যদি তার চুল মাথার ভিতরের অবস্থার ইংগিত দেয়, তাহলে আমি বলব মি. নিটশে একজন বদ্ধ উন্মাদ! তাঁর ঠোঁটেও কি যেনো হয়েছিলো। ঠোঁটের উপর একগোছা গোঁফ… উফফ…যেনো কুকুরছানারা হামাগুড়ি দিয়ে নাকের ডগায় উঠছে।[অট্টহাসি দেয় যেনো মহাখুশি]
রিপোর্টারঃ [কিছুটা বিরক্ত] আচ্ছা আপনি তো বিচারক সেইজ এর সাথে অনেকগুলো মামলার দায়িত্বে ছিলেন। আজ তাঁকে দেখে কি বোঝা গেলো মামলার রায় কি হতে পারে?
পেশকারঃ [চোখ টিপে, ঠোঁট কামড়ায়] Actually, আমি বুঝতে পারলেও তা বলবো না; পাছে আমার চাকুরীটা হারাই! হুমম… বিচারক সেইজের কথা কি আর বলবো… ওর অনেক বয়স হয়ে গেছে। দেখতে খুব অনমনীয় লাগে। তবে মনে হলো তিনি একা কিছুই করবেন না; বিচারকমন্ডলীই মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন। সেইজ সত্যিই খুব সৎ। খুবই ভালো; আর টেনিস খেলোয়াড় হিসেবেও মন্দ না।
রিপোর্টারঃ টেনিস!
পেশকারঃ হ্যাঁ, ও তো মারাত্নক সার্ভ করে! গত শুক্রবার আমরা খেলছিলাম; সেইজ তো স্ট্রেইট জিতে গেলো!
রিপোর্টারঃ আপনি Justice Sage এর সাথে টেনিস খেলেন?
পেশকারঃ হ্যাঁ, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেই তো খেলি। আর আমরা একই ক্লাবে খেলি। আসলে কোর্ট-কাচারিতে চাকরি করলে অনেক কিছুই পাওয়া যায় তবে সবকিছু না। Justice Sage ও একই কথা বলেন।[মুখটিপে হাসি] তাই কোর্টের কাজের পরেই শুরু হয় তাঁর মনোরঞ্জনের আয়োজন। [আবার সিরিয়াস] অবশ্য আপনারা এগুলো জানবেন না কারন এগুলো খুবই সিরিয়াস ব্যাপার… খুউব সিরিয়াস।
রিপোর্টারঃ ধন্যবাদ মি. ম্যাক, মামলার পরবর্তী অংশের জন্য শুভকামনা রইলো।
পেশকারঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।
[Assistant কোলে করে একটি কুকুর নিয়ে আসে]
রিপোর্টারঃ [অতি ব্যস্ত হয়ে] দর্শক আমরা ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছি দার্শনিক নিটশে’র খুব ঘনিষ্ঠ এক সঙ্গীকে। আর সে হলো নিটশে’র পোষা কুকুর ‘ইগো’। ইগো, তুমি কেমন আছ?
ইগোঃ [New Jersy accent] হ্যাঁ, ভালোই তো আছি!
রিপোর্টারঃ তুমি আমাদের বলো- কতদিন ধরে তুমি নিটশেকে চেনো?
ইগোঃ আমরা তো বাল্যকাল থেকেই একসাথে। আসলে আমরা দু’জন ছিলাম রাস্তার গুন্ডা আর ছিঁচকে চোরের মতো। সারাদিন ঘুরতাম আর দেয়ালে দেয়ালে জ্বালাময়ী শ্লোগান লিখতাম।
রিপোর্টারঃ তোমার নাম তো ‘ইগো’ …বলতো, এত সুন্দর নামটি তোমাকে কে দিলো?
ইগোঃ তোমরা জান, নিটশে একবার একটা কথা লিখলো- ‘আমি যখনি উপরে উঠতে থাকি, একটি কুকুর আমাকে অনুসরণ করে, যার নাম ‘অহং’ মানে ইগো’। তাই আমার মনে হয়, আমিই সেই ইগো। না-ও হতে পারি। তবে সবাই আমাকে আরও কয়েকটা খারাপ নামে ডাকে। However, তোমাদের যা খুশি আমাকে ডাকতে পারো; শুধু ডিনারের সময় দেরী ক’রে ডেকো না।
রিপোর্টারঃ অনেকেই বলে- নিটশে’র দর্শনে তোমার অনেক বড় ভূমিকা আছে। এটা কী সত্য?
ইগোঃ হ্যাঁ. It’s true. আমরা যখন হাঁটতে বের হতাম, তখন দর্শন নিয়েই কথা বলতাম। নিটশে হাঁটাহাঁটি খুব পছন্দ করে। সে বলতো- ‘পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত সত্যই আবিষ্কৃত হয়েছে হাঁটার সময়’। Idea গুলো আমরা একজন আরেকজনের বারবার কাছে Pass করতাম। এভাবেই তাঁকে আমি The eternal recurrence অর্থাৎ চিরন্তন পূনরাবৃত্তি’র ধারনা দেই।
রিপোর্টারঃ কি চিরন্তন?
ইগোঃ ঘটনার চিরন্তন পুনরাবৃত্তি। ভেবে দেখ- আমরা মনে করি সময় অসীম আর বিশ্বজগৎ সসীম। সুতরাং, যৌক্তিকভাবেই তোমাকে মানতে হবে, এই মহাজগতের সব ঘটনাই Again……আবার, পুনরায়…… বারবার ঘটতে থাকবে!
রিপোর্টারঃ তোমার কথাগুলো কেমন জটিল মনে হচ্ছে!
ইগোঃ ঠিক আছে, শোন। মহাবিশ্বের সবকিছুই সময়ের সাথে সাথে বদলায়, তাই না? মানে- ঘটনাগুলো নিজেরাই ভেঙ্গেচুরে নতুন ঘটনা তৈরি করছে। সুতরাং একই ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটতে পারে- এমন সুযোগও আছে। এই যে তুমি আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি- এটা একটা ঘটনা। এই ঘটনার Result কখনোই Zero মানে শূন্য হতে পারে না। হতে পারে শুন্যের খুব কাছাকাছি, কিন্তু কখনোই শুন্যের সমান হবে না। কারণ, এটা সম্ভব নয় যে ভবিষ্যতে আর কখনো তুমি আর আমি কথা বলব না। বলতেও পারি। তবে সবকিছু সবসময়ই বর্তমানের মতো একই ভারসাম্যে চলবে। এইবার বুঝছ?
রিপোর্টারঃ Yeeeahhh [ধীরে, যেন অনেকটা অনিশ্চিত]
ইগোঃ I see… আরো শোনো- যদি সময় অসীম হয় তাহলে এটা প্রয়োজনীয় সত্য যে, ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তই শীঘ্রই আথবা পরে যে কোনো সময় ফিরে আসবে। শুধু একবার না, অসীম সংখ্যক বার। এটাকেই বলে চিরন্তন পুনরাবৃত্তি; এবার Clear?
রিপোর্টারঃ I see….এই আইডিয়াটা তুমিই তাহলে নিটশেকে দিয়েছ! মানে চিরন্তন পুনরাবৃত্তির আইডিয়াটা?
ইগোঃ হ্যাঁ, বুঝিয়ে বলি এবার। যখন ভোরে আমার ঘুম ভাঙতো, প্রতিদিনই সে আমাকে পুরোনো, শুকনো, টুকরা টুকরা কতগুলো কুকুরের খাবার দিত। তারপর আমরা Morning Walk এ বেরুতাম। কিন্তু প্রতিদিনই আমরা একই পথে হাঁটতাম। চিন্তা কর- আমি একটা কুকুর; আর তোমরা জান, আমার হাঁটাচলায় অনেক বৈচিত্র দরকার। তাই আমি চেষ্টা করতাম ওকে নতুন কোনো পথে নিয়ে যেতে; সঙ্গে সঙ্গে সে চেইন ধরে টেনে আমাকে ফিরিয়ে আনত। একদিন বললাম, ‘আমরা কী আজ নতুন কোনো পথে হাঁটতে পারি না? এই পথ তো চিরন্তন পুনরাবৃত্তি!’ নিটশে সংগে সংগে দাঁড়িয়ে গেলো। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইগো, তুমি কি বললে?’ তখনি আমি তাঁকে চিরন্তন পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিলাম।
রিপোর্টারঃ তুমি এটা ব্যাখ্যা করে বললে?
ইগোঃ হ্যাঁ, বললাম!
রিপোর্টারঃ নিশ্চই কাজটা খুব কঠিন ছিলো তোমার জন্য।
ইগোঃ হ্যাঁ, কি করব বল! প্রতিদিন সেই একই পুরোনো, শুকনো খাবার দিত। তোমাকে পরের ঘটনা বলছি- শোনো। প্রথমে তো এই আইডিয়াটা তাঁর কাছে হিজিবিজি মনে হলো। সে বললো, ‘আইডিয়াটা ভয়ংকর এবং বিবশকারী!’ তাঁর মাথায় এটা ভারী পাথরের মতো চেপে বসলো। হঠাৎ একদিন সে সিদ্ধান্তে এলো। বললো, ‘আইডিয়াটা একটা চাবির মতো যেটা একটা বন্ধ দরজা খুলে দিতে পারে।’ I mean সেই দরজা যা জীবনে প্রত্যয় আনে, যা নিয়তিকে আলিঙ্গন করতে দেয় আর ভাগ্যকে মেনে নিতে সাহায্য করে। সে আমাকে বললো, ‘মহত্বের জন্য মানুষের প্রথম সূত্র হলো নিয়তিকে ভালোবাসা। কারণ, কেউই Different কোনো পথে চলে না; না যায় সামনে, না যায় পেছনে। মানুষ তার প্রয়োজনটুকুই গ্রহণ করে না শুধু, তা গোপনও রাখতে পারে না। কিন্তু, নিয়তিকে সে খুবই ভালোবাসে।
রিপোর্টারঃ Amazing! অসাধারণ। তুমি কী জান, একটা কুকুর হয়েও তুমি অনেক বিজ্ঞ আর স্পষ্টভাষী?
ইগোঃ এসব আর বলোনা তো…… এখনো একটু ভালো খাবারই পেলাম না! সেই একই পুরোনো, শুকনো, টুকরা টুকরা…যাই হোক, তুমি আমার সাথে খেলতে চাও একটু?
রিপোর্টারঃ না…… আমি দুঃখিত, আমাকে এই অংশটা এক্ষুনি শেষ করতে হবে।
ইগোঃ Fine…… কর……[চলে যায়, assistant নিয়ে যায়]
রিপোর্টারঃ [কানে হেডফোন লাগিয়ে] দর্শক, আমরা জানতে পেরেছি ‘মানুষ বনাম দর্শন’ মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া এক্ষুনি শুরু হবে। তাই এখন আমরা আপনাদের সরাসরি কোর্টরুমে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সাথেই থাকুন!!
৩য় দৃশ্য (আদালত কক্ষ)
পেশকারঃ সবাই দাঁড়ান।
[বিচারক সেইজ প্রবেশ করে ]
পেশকারঃ জনমতের আদালতে বিচারকার্য আবার শুরু হচ্ছে। মহামান্য বিচারক সেইজ এই বিচারকার্যে সভাপতিত্ব করছেন।
বিচারকঃ বিবাদী পক্ষ কি প্রস্তুত তাদের সাক্ষীদের হাজির করতে? [মিস. হওক এগিয়ে আসেন]
মিস. হকঃ হ্যাঁ, মহামান্য বিচারপতি।
বিচারকঃ চমৎকার। please proceed মিস. হক।
মিস. হকঃ মহামান্য, বিবাদী পক্ষের প্রথম সাক্ষী টমাস জেফারসন।
বিচারকঃ টমাস জেফারসনকে ডাকুন!
পেশকারঃ টমাস জেফারসন! জন্ম ১৭৪৩! [জেফারসন প্রবেশ করেন]
পেশকারঃ মি. টমাস জেফারসন Please হাত তুলুন। বলুন- ‘যাহা বলিব সত্য বলিব…………
জেফারসনঃ অবশ্যই। কারণ সত্য মহান আর সত্যই টিকে থাকবে। সত্য ভুলের বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিপক্ষ। আর দন্দ্বমুখর পরিবেশে সত্য নির্ভীক যদি সত্যের স্বাভাবিক ক্ষুরধারকে অসার করে না দেয়া হয়। যুক্তি এবং তর্ক হ’ল সত্যের অস্ত্র। আর ভুলকে প্রশ্রয় দেয়া হ’লে তা বিপজ্জনকভাবে সত্যের বিরোধীতা করে।
পেশকারঃ Sir, “শপথ করলাম” এইটুকু বললেই চলতো!
জেফারসনঃ আমি জানি, কিন্তু এগুলো আমি লিখেছি এবং সেইজন্য আমি গর্বিত।
[পেশকার মাথে নত করে; চলে যায়]
মিস হওকঃ মি. জেফারসন, আপনার পেশা কি?
জেফারসনঃ [প্রত্যেকটি/প্রতি দু’টি পরপর ছোট্ট বিরতিসহ] স্থাপত্যশিল্পী…… উদ্ভাবক……. লেখক…… দেশপ্রেমিক…… উদ্ভিদবিজ্ঞানী……আইনজীবী…… কৃষক…… শিক্ষাবিদ…… প্রতিষ্ঠাতা জনক!
মিস. হওকঃ কোনো এক সময় আপনি তো আমেরিকার President ছিলেন, তাই না?
জেফারসনঃ ও হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাও তো ছিলাম!
মিস. হকঃ আপনি বললেন আপনি একজন লেখক। আপনি কি আপনার একটি লেখা এই আদালতে পড়ে শোনাবেন?
[জেফারসন খুঁজতে থাকে…]
মিস. হওকঃ এই যে, আমার কাছেই আছে। Please পড়ুন।
জেফারসনঃ [পড়ছে, প্রচন্ড আবেগসহ; কিছুটা চিন্তিত] “স্বতঃসিদ্ধ প্রমান হিসেবে আমরা এই সত্যগুলো মানি যে- সকল মানুষই সমান, সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে কিছু চিরন্তন অধিকার দিয়েছেন আর সেগুলোর মধ্যেই নিহিত তার জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের সন্ধান।”
মিস. হওকঃ আপনার এই বিখ্যাত কথাগুলোর সাথে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত, তবুও কথাগুলো যতবার আমরা শুনি, ততবারই আমাদের মন আলোড়িত হয়। এত গভীর ব্যঞ্জনাময় এবং তাৎপর্যপূর্ণ কথা লেখার অনুপ্রেরণা আপনি কোথায় পেলেন? কথাগুলো একটা পুরো জাতিকে বিপ্লবের দিকে নিয়ে গেল আর সরকারের মধ্যেও ব্যাপকভাবে নিরীক্ষাধর্মী বিপ্লব দেখা গেল!
জেফারসনঃ সত্যি বলতে কি, আমি আসলে আমার বিগত দিনের বিখ্যাত চিন্তাবিদদের দর্শন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছি। গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরাস থেকে ব্রিটিশ দার্শনিক John Lock পর্যন্ত অনেকের দর্শনই গ্রহন করেছি।
মিস. হওকঃ ঠিক আছে, আমাদের বলুন, আপনি এই দার্শনিকদের সম্পর্কে জানলেন কিভাবে যাদের দর্শন আপনার কাছে এতটা অনুকরনযোগ্য মনে হলো?
জেফারসনঃ হুমম… উইলিয়াম এন্ড মেরী কলেজে আমি গ্রীক ভাষা, অধিবিদ্যা এবং দর্শন পড়েছিলাম।
মিস. হকঃ ওহ, দর্শন! অর্থাৎ ফিলোসফি।
জেফারসনঃ হ্যাঁ, ফিলোসফি. গ্রীক ভাষায় যার মূল অর্থ জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা।
মিস. হকঃ Very good. জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা! ভালো লাগল। আপনি কি তাহলে গভীর জ্ঞান পছন্দ করেন, জনাব জেফারসন?
জেফারসনঃ Oh yes. বুদ্ধিমত্তার সব শাখাই আমার ভালো লাগে। আর তাইতো আমি ‘আমেরিকান দার্শনিক সমাজ’এ Join করেছিলাম। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার পুরোনো বন্ধু বেন ফ্র্যাঙ্কলিন। তার মতে এই সমাজের কাজ হলো- পান্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞান এবং মানবিক শাখায় কার্যকর জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো।
মিস. হওকঃ Excuse me, আপনি বলছেন “কার্যকর জ্ঞান”। আপনি কি মনে করেন দর্শন কার্যকর জ্ঞানকে আরো উন্নত করতে পারে?
জেফারসনঃ অবশ্যই! সেই সময় দর্শনের অনেকগুলো শাখা ছিল। যেমন- প্রাকৃতিক দর্শন -যেটা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মূল ভিত্তি।
মিস. হওকঃ কাজেই আপনি মনে করেন যে দর্শন [কাঠগড়ায় লেডি ফিলসফি’র দিকে ইঙ্গিত করে] হ’লো বিজ্ঞান ও মানবিক শাখার জননী!
জেফারসনঃ হুমম… খুব ভাল বলেছেন!
মিস. হকঃ Ur honour, আর কোন প্রশ্ন নেই। [Ms. Pike এগিয়ে আসে]
বিচারকঃ Ms. Pike, আপনি সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন।
Ms. Pike: জনাব জেফারসন, আপনি তো আমেরিকান দার্শনিক সমাজের সভাপতি ছিলেন ১৭৯৭ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, তাই না?
জেফারসনঃ হ্যাঁ, ঠিক।
Ms. Pike: কিন্তু ১৮০০ সালের পর থেকে আপনি এর কোনো meeting এ কখনোই উপস্থিত হননি। এটা প্রমান করে যে, দার্শনিক সমাজের কাজের প্রতি আপনি আর তেমন একটা serious ছিলেন না।
জেফারসনঃ আসলে আমি তখন নতুন একটা জাতিকে পরিচালনার কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
Ms. Pike: আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ ধন্যবাদ জনাব জেফারসন. আপনি আসতে পারেন।
জেফারসনঃ [হেঁটে যেতে যেতে] আমি তো তিন তিনবার Resign করতে চেয়েছিলাম। তারাই তো আমাকে পদত্যাগ করতে দিলো না………!
[মি. ঈগলস এগিয়ে আসে]
বিচারকঃ মি. ঈগলস, পরবর্তী সাক্ষী কে?
মি. ঈগলসঃ মহামান্য আদালতের অনুমতিক্রমে এখন হাজির হবেন আলবার্ট আইনস্টাইন.
বিচারকঃ পেশকার, আলবার্ট আইনস্টাইনকে ডাকুন।
পেশকারঃ আলবার্ট আইনস্টাইন, জন্ম ১৮৭৯।
[আইনস্টাইন লাঠি হাতে (walking stick) পায়চারি করতে করতে প্রবেশ করে]
পেশকারঃ আলবার্ট আইনস্টাইন, হাত তুলে বলুন- ‘যাহা বলিব………………… না’।
আইনস্টাইনঃ “সত্য তো তা, যা অভিজ্ঞতা দ্বারা পরীক্ষিত।”
পেশকারঃ Yes or No?
আইনস্টাইনঃ হ্যাঁ।
মি. ঈগলসঃ মি. আইনস্টাইন, আপনার পেশা?
আইনস্টাইনঃ আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানী।
মি. ঈগলসঃ আপনি তো কিছুটা দার্শনিকও, তাই না?
আইনস্টাইনঃ বলতে পারেন Amateur Philosopher মানে সৌখিন দার্শনিক আর কি। কিন্তু খুবই অপেশাদার। এক্ষেত্রে আমি কোনো বিশেষজ্ঞ না।
মি. ঈগলসঃ তাহলে নিশ্চই আপনার দর্শনগত ধ্যান-ধারনা সম্পর্কে কিছু Idea আছে!
আইনস্টাইনঃ ভাষান্তর করতে গিয়ে আমি একবার বলেছিলাম ‘দর্শনশাস্ত্র ছাড়া পদার্থবিজ্ঞান খোঁড়া, আবার পদার্থবিদ্যা ছাড়া দর্শনশাস্ত্র অন্ধ!’
মি. ঈগলসঃ একটু বিস্তারিত বলবেন মি. আইনস্টাইন?
আইনস্টাইনঃ নিশ্চই। Take time!
মি. ঈগলসঃ সময় নেব! কি করতে?
আইনস্টাইনঃ না… আমি mean করেছি, সময়কে উদাহরণ হিসেবে ধরুন। আমি ব্যাখ্যা দিতে পারি যদি আপনার সময় হয়।
মি. ঈগলসঃ Take your time.
আইনস্টাইনঃ একজন পদার্থবিদ সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বলবেন যে, “অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যে পার্থক্য শুধুই একটা মায়া বা বিভ্রান্তি! তবুও তা অনড় এবং অটল। আমি আপনাকে অংক করে দেখিয়ে দিতে পারি!
মি. ঈগলসঃ আপনি তাহলে এখন অংক শেখাবেন আমাকে!
আইনস্টাইনঃ (ধৈর্য্য সহকারে) আমি তা পারি। তারপর আপনাকে অংকের হিসাবে দেখাতে পারি- আসলে অতীত, ভবিষ্যত এবং এই মুহূর্তের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। তাতে কি হবে জানেন? কোনো রহস্যই আর থাকবে না। মনে রাখবেন-‘আমাদের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলো হলো রহস্যময় অভিজ্ঞতা। এই রহস্যময়তাই হলো সব শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানের উৎস’। যার কাছে কথাগুলো অদ্ভুত লাগছে, কথাগুলো শুনে যে বিস্ময়ে হতবাক হয় না এবং ভয়ে আত্মহারা হয়ে থমকে দাঁড়ায়- সে মৃত ব্যক্তির মতোই সুন্দর। দর্শনশাস্ত্র আসলে রহস্যময়তার খোলসের ভেতরে নতুন নতুন ধারনার জন্ম দেয়- অবশ্য, যদি আমরা আমাদের কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতে পারি। আর তাই- দর্শনশাস্ত্র ছাড়া, মানে আমাদের মৌলিক ঔৎসুক্য এবং কল্পনা করার তীব্র ইচ্ছা ছাড়া পদার্থবিদ্যা খোঁড়া।
ঈগলসঃ তাহলে পদার্থবিদ্যা ছাড়া দর্শনশাস্ত্র?……?
আইনস্টাইনঃ অন্ধ। শুধুই অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো। পদার্থবিদ্যার যে সত্যগুলো আমরা আবিষ্কার করেছি……
জনাব Carp: অবজেকশন! এইখানে সত্যের সংজ্ঞাই দেয়া হয়নি।
বিচারক: সাসটেইন্ড.
ঈগলসঃ মহামান্য, যদি আমরা মি. আইনস্টাইনকে সত্যের সংজ্ঞা দিতে বলি, কোর্ট নিশ্চই তার অনুমতি দেবে!
বিচারক: অনুমতি দেয়া হ’ল।
আইনস্টাইনঃ ঠিক আছে। পেশকার সাহেবকে আমি প্রথমেই বলেছিলাম-“সত্য তা-ই যা অভিজ্ঞতা দ্বারা পরীক্ষিত। বিজ্ঞানে কোনো বক্তব্য অথবা তত্ত্বের সত্যতা এককভাবে নির্ভর করে ভবিষ্যৎ ঘটনার ব্যাপারে যথাযথ পূর্বাভাষ দিতে পারার উপর। বৈজ্ঞানিক সত্যমাত্রই তা পরীক্ষামূলক। কারন আমরা কখনোই জানি না বর্তমান পূর্বাভাষ এবং ভবিষ্যতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল একই রকম হবে কী না।
ঈগলসঃ স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক এবং প্রয়োগনীতির প্রবক্তা ডেভিড হিউম তো একই কথা বলেছিলেন, তাই না?
আইনস্টাইনঃ অবশ্যই। এবং আমি বিশ্বাস করি- হিউম তাঁর পরবর্তী সময়ের দার্শনিকদের স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছেন । তাঁর মতে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্যও আপেক্ষিক হতে পারে। দেখুন নিউটনের মাধ্যাকর্ষন সূত্র অসাধারনভাবে যথার্থ । তদুপুরি, মাধ্যাকর্ষন সম্পর্কে আমার তত্ত্ব আরও বেশি যথার্থ । আমি সেই মুহূর্তটা ভুলব না যখন জানলাম স্যার আর্থার ইডিংটন প্রথম বলেছিলেন- আমার থিওরি নিউটনের থিওরি’র চাইতেও বেশি যথার্থ । তিনি পশ্চিম আফ্রিকার একটি দূরবর্তী দ্বীপে গিয়ে তিনি তা-ই দেখলেন এবং দেখালেন যা আমি অনুমান করেছিলাম । তারা থেকে আগত আলোকরশ্মি সূর্যের পাশ ঘেষে আসার সময় বেঁকে যাচ্ছিল (যেন ভয়ে এবং আনন্দে আত্মহারা)। আমার তত্ত্বেও এটাই বলা ছিল । এর কারণ, সূর্যের অভিকর্ষ ক্ষমতা । মহাবিশ্বটাই তো আসলে বাঁকা!
ঈগলসঃ ধন্যবাদ মি. আইনস্টাইন । আপনি সত্যের সংজ্ঞা দিলেন । Just ব্যাখ্যা করুন কিভাবে পদার্থবিজ্ঞান ছাড়া দর্শনশাস্ত্র অন্ধ !
আইনস্টাইনঃ অবশ্যই । আমি ব্যাখ্যা দিচ্ছিলাম এই ব্যাপারটা যে- দুর্বোধ্য বিষয়গুলোকে বোঝার জন্য শুধু বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোই আমাদের কল্পনাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে । অন্যথায় আমরা হারিয়ে যাব । আমি বলতে চাই, “মহাবিশ্বের সবচে’ দুর্বোধ্য বিষয়টা হলো এই যে- মহাবিশ্ব সহজবোধ্য ।”- অন্ততপক্ষে কোনো কোনো ক্ষেত্রে !
ঈগলসঃ আপনি কি বিজ্ঞান এবং দর্শন সম্পর্কে আপনার মূল কথাটা বলবেন?
টাইনস্টাইনঃ বিজ্ঞান হলো ‘জ্ঞান’ আর দর্শন হলো কল্পনা । তবে জ্ঞানের চেয়ে অধিক মুল্যবান হলো কল্পনা ।
ঈগলসঃ আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য।
বিচারকঃ মি. ব্যাজ, এবার আপনার পালা ।
ব্যাজঃ মি. আইনস্টাইন, আমার ধারনা বার্টান্ড রাসেলের লেখা আপনি পড়েছেন । হ্যাঁ, বার্টান্ড রাসেল, (ব্যাঙ্গাত্মকভাবে) বিখ্যাত এবং ব্রিলিয়ান্ট ব্রিটিশ দার্শনিক।
আইনস্টাইনঃ হ্যাঁ. Of course.
ব্যাজঃ আমি এটাও বুঝতে পারছি আপনি রাসেলের ‘জ্ঞানতত্ত্ব’ মানে Theory of Knowledge বইটি পড়েছেন ।
আইনস্টাইনঃ Actually…আমি পড়েছি । ঘটনাক্রমে, এটা নিয়ে কিছু মন্তব্যও লিখেছিলাম ।
ব্যাজঃ Ah ha. কি কারনে আপনি মন্তব্য লিখলেন?
আইনস্টাইনঃ একজন সম্পাদক আমাকে আহ্বান জানালেন মন্তব্য করার জন্য । আসলে এটা ছিল ষড়যন্ত্র, কারন, তখন কোয়ান্টাম মেশিন দ্বারা সৃষ্ট সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পদার্থবিদরা কিছু গভীর দার্শনিক সমস্যায় পড়েছিলেন।
ব্যাজঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ ।আমি আপনার মন্তব্যটা পড়েছি । লক্ষ করলাম আপনি দর্শনশাস্ত্রের সমীকরন করতে চেষ্টা করেছেন । আপনার ভাষায়- দর্শনশাস্ত্র হলো ফাঁকা বুলির সমান ।
আইনস্টাইনঃ সেটা কেবল তখনই যখন দর্শনশাস্ত্র আমাদের ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার ফসল নয় । আসলে আপনি যদি আরও ভাল করে পড়তেন, তবে ‘Theory of Knowledge’ গ্রন্থের শেষ অধ্যায় সম্পর্কে আমার মন্তব্যটা মূল্যয়ন করতে পারতেন । আসলে রাসেল যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন । তাঁর কথায়- “দর্শন ছাড়া কেউ কিছু পুরোপুরি বুঝতে পারে না ।”
ব্যাজঃ (কিছুটা মনমরা হয়ে) আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য!
বিচারকঃ ধন্যবাদ জনাব আইনস্টাইন! আপনি যেতে পারেন ।
[মিস ফ্যালকন এগিয়ে আসে]
বিচারকঃ বিবাদীর পক্ষের আর কোনো সাক্ষী আছে?
মিস ফ্যালকনঃ মহামান্য আদালতে আমাদের শেষ সাক্ষী- মহান দার্শনিক সক্রেটিস।
বিচারকঃ পেশকার, সক্রেটিসকে ডাকুন।
পেশকারঃ সক্রেটিস, জন্ম ৪৬৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।
[সক্রেটিস মঞ্চে প্রবেশ করে। পরনে হাওয়াই শার্ট, টাই, খড়ের রোদটুপি, Shorts, Flip-flop. একহাতে মার্গারিটা(Wine এর ত্রিকোণ গ্লাসহ টুকরা লেবু, টাকিলা ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুত পানীয়)]
সক্রেটিসঃ একচুমুক চলবে নাকি, হাকিম সাহেব? [মার্গারিটা দেখিয়ে]
পেশকারঃ সক্রেটিস, প্লিজ…হাত তুলে বলুন-‘যাহা বলিব………………………না’
সক্রেটিসঃ ঠিক। …………বললাম।
ফ্যালকনঃ জনাব সক্রেটিস…………..!
সক্রেটিসঃ Please…, call me only সক্রেটিস.
ফ্যালকনঃ সক্রেটিস, এই মামলার গুরুত্ব কতটুকু, আপনি কী তা বুঝতে পারছেন? ‘দর্শন’কে অভিযুক্ত করা হয়েছে – সে তরুন প্রজন্মের মনোজগতকে কলুষিত করছে। আর তাই দর্শন এই আদালতে আজ সর্বোচ্চ দন্ডের মুখোমুখি।
সক্রেটিসঃ হ্যা…হ্যা… এখানেই তো!
ফ্যালকনঃ সক্রেটিস, আপনি যা পান করছেন, এটা কী মার্গারিটা?
সক্রেটিসঃ হুমম… ভাগ্য ভালো যে এটা সেই হেমলক বিষ না যা আমার মৃত্যু ঘটাতে পারে!
ফ্যালকনঃ আমরা এ পর্যন্ত কয়েকজন শ্রদ্ধেয় দার্শনিকের সাক্ষ্য নিয়েছি। তাঁরা দর্শনের ইতিহাসের বিচিত্র দিকগুলো সম্পর্কে তাঁদের দার্শনিক মতামত দিয়েছেন। দর্শনের ইতিহাস বিতর্কে পরিপূর্ণ; এমনকি তা ছোটখাট বিষয় নিয়েও। আবার এতে বাদ-প্রতিবাদও অনেক। এছাড়াও দর্শনের ইতিহাসের অনেক জায়গায় হতাশা, নৈরাশ্য, ভয়ংকর বেদনা এবং পাশাপাশি সম্মানজনক বিজয়ও দেখা যায়।
সক্রেটিসঃ আমার মনে হয়- আমি আর প্লেটো সত্যিই ভালো কিছুর সূচনা করেছিলাম!
ফ্যালকনঃ আমি বলবো আপনি করেছেন। তাইতো আমি আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতে চাই; অবশ্য যদি আপনি আপনার মতামত শেয়ার করেন!
সক্রেটিসঃ অবিশ্যই। কিন্তু প্রথমে আপনি বলুন- এই মামলায় আপনারা কেমন Performance করলেন।
ফ্যালকনঃ ভালো!…………… আমার ধারনা, খুউব ভালো।
সক্রেটিসঃ অতীব চমৎকার! আচ্ছা, পুরষ্কার গ্রহণ না করার ব্যাপারে মি. ডেসকার্টেসের যে বক্তব্য তা কী আপনারা Clear করেছেন?
ফ্যালকনঃ হ্যাঁ!
সক্রেটিসঃ আর নিটশে? ও তো ঢিলেঢালা কামানের মতো, প্রায়ই লক্ষ্যবস্তুর বাইরে চলে যায়। তাঁকে কী নির্দিষ্ট পয়েন্ট এ রাখতে পেরেছিলেন?
ফ্যালকনঃ সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি স্যার। মনে হয় সব ঠিকঠাকই ছিলো।
সক্রেটিসঃ Excellent! আপনাকে আর দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। কারণ, আরো গভীরে ভাবলে দেখবেন দর্শন ছাড়া আপনি চলতে পারবেন না। I mean- আপনি কাকে নিয়ে ভাবছেন, কেনো ভাবছেন যেহেতু আপনি সেই চিরন্তন ভাবনাটা জানেন যে, ‘আপনি আসলে কিছুই জানেন না!’ Right?
ঈগলসঃ Absolutely right, Sir.
সক্রেটিসঃ Okay….আর কিছু বলবেন?
ঈগলসঃ No….Uh…. আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য! [মি কার্প এগিয়ে আসে]
বিচারকঃ মি কার্প, আপনি এবার সাক্ষীকে জেরা করুন।
কার্পঃ সক্রেটিস, আপনি তো একজন অদ্ভুত বৃদ্ধলোক। দেখে মনে হয়… যুদ্ধময় দিনগুলোর মতো। এখনো বস্তা বস্তা জামাকাপড় পরে আছেন।
সক্রেটিসঃ হুমম… স্বর্গের বস্তা বস্তা চিজবার্গারের মতো…হা হা হা।
কার্পঃ সক্রেটিস, আপনি কী Honestly বলবেন- বিগত ২০০০ বছরে সত্যিই দর্শনের কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না?
সক্রেটিসঃ আপনি অগ্রগতিকে কিভাবে পরিমাপ করেন?
কার্পঃ আপনাকে এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে!
সক্রেটিসঃ Okay… চলুন তাহলে দু’জনেই প্রশ্ন করি! এভাবে আরো বেশি মজা হবে… হা হা হা।
কার্পঃ Okay… আপনি অগ্রগতিকে কিভাবে পরিমাপ করেন?
সক্রেটিসঃ হুমম… আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন- ২০০০ বছর আগে আপনি যেমন ছিলেন, এখন কী তাঁর চেয়ে ভালো আছেন?
কার্পঃ ২০০০ বছর আগে তো আমি ছিলামই না!
সক্রেটিসঃ কিন্তু আমি ছিলাম! বিশ্বাস করুন, তখন সময়টা Picnic এর মতো মজা করার ছিলো না।
কার্পঃ শুনুন, কেউ দাবী করছে না যে গত ২০০০ বছরে সমাজ কোনো উন্নতি করেছে। সন্দেহ নেই, বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের অবদান ব্যাপক। প্রশ্নটা এখানেই- তাহলে ফিলোসফি, মানে দর্শন কি অবদান রাখলো?
সক্রেটিসঃ আপনি আবার একই জায়গায় ফিরে গেলেন। বিজ্ঞান এবং দর্শনেকে পৃথক করার চেষ্টা করছেন।
কার্পঃ কি?
সক্রেটিসঃ কি নয়, বলুন- কেনো?
কার্পঃ কি কেনো?
সক্রেটিসঃ কেনো… যে কোনো কিছু!
কার্পঃ Huh….
সক্রেটিসঃ আপনি কি কখনো ভেবে অবাক হয়েছেন যে- এই পথের কোনো কিছু এই পথে না থেকে অন্য পথে থাকলো না কেন?
কার্পঃ কেন? অবশ্যই ভেবেছি!
সক্রেটিসঃ ঠিক। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে সবকিছুতেই ‘কেন’ প্রশ্নটি করতে পারে। অন্য প্রানীরা ‘কোথায়’, ‘কি’ এবং ‘কে’ এগুলো ভাবতে পারে; তারা কেউই ‘কেন’ প্রশ্নটি করতে পারে না।
কার্পঃ তো! কি হলো তাতে?
সক্রেটিসঃ মানবজাতি এই ‘কেন’ প্রশ্নটা না জানলে বিজ্ঞানের জন্মই হতো না। কোনো প্রাণী যদি ‘কেন’ দিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে, তখনি তাতে আপনি দর্শন খুঁজে পাবেন। আসলে দর্শন ছাড়া বিজ্ঞান হয় না! পারবেনই না! কাজেই বুঝতে চেষ্টা করেন- এটা শুধু মানুষেরই সক্ষমতা। মানুষ প্রশ্ন করে ‘কেন’, তখনি তার কল্পনাশক্তি জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে কল্পনাকে গোপন রাখতে হয়; আবার মাঝে মাঝে কল্পনাকে বন্য হয়ে অবাধে ঘুরতে দিতে হয়। এভাবে এক সময় আপনি তাই পেয়ে যাবেন যা আপনি খুঁজছেন। কারণ, দেখবেন মাঝে মাঝে আপনি একেবারে আপ্রত্যাশিত জায়গা থেকে আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান! আপনি কি সব ধরনের প্রতিউত্তরের ভবিষ্যৎবাণী করতে পারবেন?
কার্পঃ অবশ্যই না!
সক্রেটিসঃ কাজেই, কিছু লোক যদি প্রশ্ন ক’রে ক’রে দর্শন দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে এই দর্শনের [বিবাদী’র দিকে ইংগিত করে] কি দোষ? দর্শন যা পারে, তাতে আপনিও নির্বাক হয়ে যেতে পারেন!
কার্পঃ স্যার, আপনি আমার একটি প্রশ্নেরও ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলেন না!
সক্রেটিসঃ হ্যাঁ! কিন্তু আপনার প্রশ্নের উত্তরে আমি আপনাকে আরো কিছু প্রশ্ন উপহার দিয়েছি! এগুলো তো উত্তরের চেয়ে অধিক মূল্যবান।
কার্পঃ [ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে] আর কোন প্রশ্ন নেই, মহামান্য!
সক্রেটিসঃ তাহলে তো…… খুবই……দুঃখজনক!
বিচারকঃ আপনি যেতে পারেন, সক্রেটিস।
সক্রেটিসঃ [হাতের গ্লাস তুলে] Cheers!! [দুলতে দুলতে নেমে যায়]
বিচারকঃ মিস ফ্যালকন, বিবাদী পক্ষের কোনো অতিরিক্ত সাক্ষী উপস্থিত আছে?
ফ্যালকনঃ মহামান্য। অতিরিক্ত সাক্ষী নেই, তবে একজন অতিথি সাক্ষী উপস্থিত আছেন ।
বিচারকঃ অতিথি সাক্ষী ! মানে?
ফ্যালকনঃ মানে তিনি কোনো পক্ষের না, তিনি নিরপেক্ষ । তাঁর দর্শন নিরপেক্ষতা এবং মানবিকতার সুমধুর সঙ্গীত রচনা করেছে ।
বিচারকঃ আপনি কী ফকির লালন সাঁইয়ের কথা বলছেন?
ফ্যালকনঃ জ্বী, মহামান্য, কোর্টের অনুমতি পেলে আমরা লালন সাঁইকে হাজির করতে পারি।
বিচারকঃ (একটু ভেবে) অনুমতি দেয়া হলো । পেশকার, লালন সাঁইকে ডাকুন ।
পেশকারঃ অতিথি সাক্ষী ফকির লালন সাঁই হাজির । লালন সাঁই, জন্মসাল ১৭৭৪।
[একতারা হাতে, খিলকা পরিহিত লালন প্রবেশ করে]
পেশকারঃ সাঁইজি, দয়া করে হাত তুলুন; বলুন ‘যাহা বলিব…………………………না’
লালনঃ [একতারা বাজিয়ে গান ধরে] “সত্য কাজে কেউ নয় রাজী, সত্য কাজে কেউ নয় রাজী, সবই দেখি তা না না না”
[আইনজীবীরা সবাই নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে]
বিচারকঃ মিস ফ্যালকন, প্রশ্ন করুন ।
ফ্যালকনঃ মি. লালন ফকির ……
[লালন ধীরে হাত তোলে, ফ্যালকন থেমে যায়]
লালনঃ মা জননী, আমারি শুধু লালন ক’লিই চইলবে; সাঁইজিও কতি পারেন ।
ফ্যালকনঃ(সম্মোহিত হওয়ার মতো ধীরে ধীরে) সাঁইজি, আপনার পেশা?
লালনঃ নেশা করি । সুরের নেশা, আত্নার নেশা, গানের নেশা ।
ফ্যালকনঃ সাঁইজি, আধুনিক বিশ্বে আপনার দর্শন নিয়ে অনেক হৈ-চৈ হচ্ছে । প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য পর্যন্ত মানুষের আধ্যাত্নিক জীবনধারায় আপনার নাম, আপনার দর্শন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে । লোকে বলে লালন দর্শন । আমরা জানি আপনার দর্শন এমন একটা সমাজের কথা বলে যেখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, সবাই মানব প্রেমের গান করে । এটা কেমন সাঁইজি, একটু বলবেন?
লালনঃ
“যেদিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রীষ্টান,
জাতি গোত্র নাহি রবে;
এমন মানব সমাজ কবে গো,
কবে গো সৃজন হবে”
[আইনজীবীরা সবাই সম্মোহিত হয়ে দুলতে থাকে; (কোরিওগ্রাফি)]
ফ্যালকনঃ আচ্ছা সাঁইজি, আপনি কী জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন?
লালনঃ আমারতো মনে হয় ‘মানবজনমই সব, আগেও অন্ধকার, পরেও অন্ধকার’।
“কত লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে
তুমি পেয়েছ ভাই মানবজনম
এ জনম চলে গেলে আর পাব না না না না
আর মিলবে না………”
[আইনজীবীদের ও পেশকারের কোরিওগ্রাফ]
ফ্যালকনঃ সাঁইজি, আপনার অনেক গানে ‘দিব্যজ্ঞান’ শব্দটি পাওয়া যায় । আমার ধারনা দিব্যজ্ঞান আর দর্শন প্রায় কাছাকাছি । আপনি কী আমাদের বলবেন বর্তমান সময়ে দর্শন অথবা এই দিব্যজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না ?
লালনঃ
“সহজ মানুষ, ভজে দেখনা রে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে; সহজ মানুষ”
ফ্যালকনঃ সাঁইজি, আপনার একটা বিখ্যাত গান, অবশ্য গানটি আমারও খুব প্রিয়- ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে’- এই গানে ‘মনের মানুষ’ বলতে আপনি কাকে বুঝিয়েছেন?
লালনঃ মা-জননী, সুর ছাড়া আমি ভাবের কথা বুঝি নে । আপনি সুরে সুরে ক’তি পারবেন?
ফ্যালকনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই । [গান ধরে]
“যখনও রূপ স্মরণও হয়
থাকে না লোক লজ্জারও ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই, (২)
প্রেম যে করে সে জানে, ওই প্রেম যে করে সে জানে,
আমার মনের মানুষেরও সনে, আমার মনের মানুষেরও সনে
মিলন হবে কতদিনে, মিলন হবে কত দিনে,
আমার মনের মানুষেরও সনে, আমার মনের মানুষেরও সনে”
[লালন তালে তালে দুলতে থাকে]
লালনঃ মনের মানুষ আর কেউ না, নিজের বিশুদ্ধ মন, মানবিক মন । মনটাকে শুচি করতি পারলি, আপনি সেই মানুষটার দর্শন পাবেন ।
ফ্যালকনঃ এটা কী তাহলে আত্নশুদ্ধি; মানে অনেকটা গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ লাভের মতো ?
লালনঃ আমি মূর্খ মানুষ, অত কিছু জানিনে । শুধু কতি চাই-
“আত্নতত্ত্ব যে জেনেছে,
দিব্যজ্ঞানী সে-ই হয়েছে;
কু-বৃক্ষে সুফল পেয়েছে(২)
আমার মনের ঘোর গেল না”
ফ্যালকনঃ সাধু! সাধু! আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, মহামান্য!
বিচারকঃ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীগণ, আপনারা কিছু জিজ্ঞেস করুন ।
[মি কার্প এগিয়ে আসে]
কার্পঃ মি লালন…… সরি; সাঁইজি, আপনার সঙ্গীত আধ্যাত্নিক চেতনাসমৃদ্ধ যা মানুষের মাঝে অপূর্ব সম্মোহন সৃষ্টি করে । বর্তমান পৃথিবী যখন শান্তি ও স্বস্তির অন্বেষায় পরিশ্রান্ত, অতিরিক্ত বৈষয়িকতায় আচ্ছন্ন পৃথিবী যখন ভেতরে ভেতরে সর্বশান্ত; তখন আপনার গান আমাদের কাছে এক পরম শান্তনার আশ্রয় । কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে—মানুষ সর্বশান্ত কিংবা হতাশাগ্রস্ত হওয়ার পর আপনার দর্শনে আশ্রয় খোঁজে কেন? আগে কেন আপনার দর্শন মানুষকে সুপথ দেখাতে পারে না?
লালনঃ মানুষ পথহারা হয়ে গেছে । কেউ আর সত্য কতা কয় না, সুপথে চলে না । আমি লালন সাঁই, আগেই সাবধান ক’রে দেছিলাম-
“তুমি দিন থাকিতে দিনের কদর
কেন জানলে না——–(২)
সময় গেলে সাধন হবে না ।
জান না মন খালে বিলে
থাকে না মীন জল শুকালে;
কি হবে আর বারান দিলে
মোহনা শুকনা, থাকে মোহনা শুকনা”
[মি কার্প সম্মোহিত হয়ে দুলতে থাকে । হঠাৎ থেমে নরম সুরে বলে-]
কার্পঃ সাঁইজি, বর্তমান পৃথিবীতে মানবজাতি খুব অনিশ্চিত এবং স্বার্থপর জীবন যাপন করছে । মনে হয় সব আছে, সবাই আছে; আবার পরক্ষণেই মনে হয় কোথাও কেউ নেই । এই দুর্দশাগ্রস্ত মানবজাতির জন্য আপনার পরামর্শ কি?
“সত্য বল, সুপথে চল, ওরে আমার মন
সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবিনে মানুষের দর্শন
পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না
পারে যেতে পারবে না।”
আইনজীবীরা সবাইঃ (একযোগে) সাধু ! সাধু !
কার্পঃ মহামান্য, আমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই ।
বিচারকঃ ফকির লালন, আপনি আসতে পারেন ।
[লালন চলে যেতে যেতে গান ধরে; আইনজীবীরা তালে তালে পিছু যেতে থাকে]
“এই দেশেতে এই সুখ হলো,
আবার অন্য কোথাও হয় না জানি;
পেয়েছি এক ভাঙা তরী,
জনম গেলো সেচতে পানি”
বিচারকঃ মি কার্প, আপনি কী সমাপনী বক্তব্য রাখতে চান?
কার্পঃ জ্বী, মহামান্য [দর্শকদের দিকে ঘুরে]
Ladies and Gentlemen of the Jury, এই আদালতে কোনো যৌক্তিক সন্দেহ ছাড়াই এটা প্রমানিত হলো যে, তরুন প্রজন্মের মনে দর্শনকে বিশ্বাস করা যায় না। সাক্ষীদের বক্তব্যে এটা ছবির মতো পরিস্কার হলো যে, দর্শন বিভ্রান্তি, বিহ্বলতা ও অসার স্বপ্নকে উস্কে দেয়। তিলকে করে তোলে তাল। কাজেই স্কুলগুলোতে দর্শনের কোনো জায়গা থাকা উচিত নয় কারণ, তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতির প্রভাব থেকে বাঁচাতে হবে। আর আমরা সবাই নিশ্চই একমত যে, সমাজের নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে এর সুবিচার দরকার।
বিচারকঃ মিস ফ্যালকন, আপনারা সমাপনী বক্তব্য রাখতে পারেন।
ফ্যালকনঃ Of course, মহামান্য। Ladies and gentlemen of the jury, আপনারা এতক্ষণ ৬জন পৃথিবী বিখ্যাত চিন্তাবিদের কথা শুনলেন। তাঁরা আমাদের জীবনে দর্শনের মূল্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যদিও আমার বিজ্ঞ প্রতিপক্ষের আইনজীবী বন্ধুরা সেগুলোকে অসম্মান করার চেষ্টা করেছেন। জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার প্রতি মানবজাতির যে অতৃপ্ত তৃষ্ণা, তা এই বিশিষ্ট দার্শনিক’রা বোঝেন। তবে এর প্রয়োজনীয়তা শেক্সপীয়ারের চেয়ে বেশি কেউ বোঝেন নি। হ্যামলেট নাটকে মানব মনের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ‘যদি মানুষের ভালো দিকগুলো আর ভালো সময় শুধু আহার এবং ঘুমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়, সে তখন পশুর চেয়ে বেশি কিছু না । অতীত-ভবিষ্যৎ ভেবে যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের যুক্তি-বুদ্ধির ক্ষমতা অসার পড়ে থাকার জন্য দেননি”
আমাদের যুক্তি-বুদ্ধির ক্ষমতা শুধু নির্বিকার ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার জন্যে নয়। যেখানে প্রয়োজন সেখানেই এগুলো ঠিকঠাক ব্যবহার করতে হবে। কাজেই চলুন, এখন থেকে কেউ আর মুক্ত চিন্তায়, স্বাধীন কল্পনায় এবং স্বাধীন মত প্রকাশে একটুও ভয় করবো না। তাই, আমি আপনাদের আহ্বান করবো এই লেডি ফিলোসফিকে নিষ্পাপ হিসেবে বিবেচনা করতে, নতুবা ন্যায়বিচার পরাজিত হবে।
বিচারকঃ ঠিক আছে। বিচারকমন্ডলীর সদস্যগণ, আজকের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে এখন আপনারা এই মামলার রায় দেবেন। আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন বিবাদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সত্যি কি না। বিবাদী এখন সামনে এসে দাঁড়াবে।
[ বিবাদী ধীরে ধীরে দাঁড়ায়, হেঁটে সামনে আসে। বিচারকের দিকে মুখ ঘুরে দাঁড়ায়]
বিচারকঃ পেশকার, আপনি করতালি মাপার মেশিনটা আনুন! [যন্ত্রটি মঞ্চে আনা হয়, দর্শকদের দিকে Front side দেয়া হয়]
বিচারকঃ Alright, ladies and gentlemen of the jury, লেডি ফিলসোফি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ সে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা করে, সে একজন ভবঘুরে এবং শান্তি বিনষ্টকারী। কে কে এগুলো সত্য মনে করেন?
[নিরবতা]
বিচারকঃ কে কে মনে করেন অভিযোগগুলো মিথ্যা এবং লেডি ফিলসোফি নির্দোষ?
[ অনেক হাততালি আর ইয়েস/আমি ইত্যাদি শব্দ শোনা যায়, যন্ত্রটি ডান হাত তুলে সমর্থন দেয়]
বিচারকঃ বিচারকমন্ডলী এই রায় দিলেন যে বিবাদী নির্দোষ।
এখন আপনারা কে কে মনে করেন- তরুণদের মনোজগত কলুষিত করার জন্য বিবাদী দোষী?
[নিরবতা]
বিচারকঃ কে কে মনে করেন যে এই অভিযোগটিও মিথ্যা এবং বিবাদী নির্দোষ?
[ হাততালি আর ইয়েস/আমি ইত্যাদি শব্দ শোনা যায়, যন্ত্রটি ডান হাত তুলে সমর্থন দেয়]
আমার মনে হয় যন্ত্রটি সঠিক রায় দিয়েছে। বিচারকদের রায়ে লেডি ফিলসোফিকে সকল অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হলো। কেইস ক্লোজড! [বিচারক হাতুড়ি দিয়ে টেবিলে আঘাত করে]
[সাথে সাথে লেডি ফিলসোফি তার আলখাল্লা খুলে ফেলে। দেখা যায় সে মহিলা কুস্তিগীর এর পোষাক পরিহিত। দর্শকদের দিকে ঘুরে বিজয়ের সাইন দেখায়। বিজয়ের আবহসংগীত বাজতে থাকে। বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা অভিনন্দন জানায়; রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা মূর্তি’র মতো নিথর হয়ে থাকে। লেডি ফিলসোফি তাঁদের কাছে গিয়ে কুস্তি শুরু করার পজিশন নেয়। লড়ার জন্য আহ্বান জানায়। তারা ভয়ে পিছু হটতে থাকে। সে তাদের দিকে আরো এগিয়ে যায়। তারা এলোমেলো চলনে একজন আরেকজনের উপর পড়তে থাকে। সে তাদের টেবিলের চারদিকে তাড়া করে এবং লাফ দিয়ে টেবিলের উপর উঠে যায়। আবার কুস্তির পজিশন নেয়;একজনকে ধরে ফেলে এবং তার সাথে কিছু কুস্তি খেলা হয়। ইতোমধ্যে বড় একটি মাইক্রোফোন নিয়ে Cheerleader/কুস্তি খেলার রেফারি মঞ্চে আসে এবং দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে-]
রেফারিঃ Audience বলুন- Four!
Audience: 4!
রেফারিঃ Three!
Audience: 3!
রেফারিঃ Two!
Audience: 2!
রেফারিঃ One!
Audience: 1!
রেফারিঃ Action!
[লেডি ফিলসোফি বাকী দুইজন আইনজীবীকে ধাওয়া করে; মঞ্চের পর্দা নামে]
সমাপ্ত
বি.দ্র.:
ক. লালন চরিত্রটি মূল নাটকে নেই। বাংলাদেশের মঞ্চ-উপযোগী করে এটি সৃষ্টি করা হয়েছে।
খ. মঞ্চে অভিনয়ের জন্য পূর্বানুমতি নেয়ার অনুরোধ রইল।
মাসুম হাসান
প্রভাষক, ইংরেজি, সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি এন্ড কলেজ
টঙ্গী – গাজীপুর।
[email protected]
[email protected]
Thanks for the article!
❣️