নৈতিকতার উৎস কি?
নাস্তিকদের কাছে সবচেয়ে বেশি যেসকল প্রশ্ন করা হয়, তারমধ্যে অন্যতম একটি প্রশ্ন হচ্ছে, “যদি ঈশ্বর বলে কিছু না থাকে যদি মৃত্যুর পর পরকাল স্বর্গ নরক বলে কিছু না থাকে তাহলে মানুষের নৈতিকতার উৎস কি?”
নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ করা হয় বা যেসকল ভুল ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে, তারমধ্যে অন্যতম অভিযোগ বা ভুল ধারণাটি হচ্ছে, “যেহেতু নাস্তিকরা ঈশ্বর, পরকাল এবং স্বর্গ নরকে বিশ্বাস করে না সেহেতু নাস্তিকদের কোনো নীতি নৈতিকতা নেই”।
নীতি নৈতিকতা আকাশ থেকে এসে পড়ে না। আমরাই নীতি নৈতিকতার উৎস, আমরাই নীতি নৈতিকতা নির্ধারন করি।
আমরা সবাই সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাই এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে দূরে থাকতে চাই। আর তাই, আমাদের লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন, সুবিধা ও কল্যাণ বৃদ্ধি করা এবং অসুবিধা ও দূর্দশা হ্রাস করা। যেসব আচরণ এই লক্ষ্যের বিরুদ্ধে যায় সেসব আচরণ অনৈতিক বলে গণ্য করা যায় আর যেসব আচরণ এই লক্ষ্যের বিরুদ্ধে যায় না সেসব আচরণ নৈতিক বলে গণ্য করা যায়।
ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করেন, মানুষ কেবল ঈশ্বর এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতি বিশ্বাস থেকেই মানুষ খুন করা থেকে বিরত থাকে। তারা মনে করেন, যেহেতু নাস্তিকরা ঈশ্বর এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করে না সেহেতু নাস্তিকদের কাছে খুন করা খুবই স্বাভাবিক একটি কাজ, নাস্তিকরা ইচ্ছা করলেই খুন করতে পারে।
আমরা কি করে বুঝি যে কাউকে খুন করা যাবে না? সবাই যদি চাইলেই সবাইকে খুন করে বেড়ায় তাহলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বিষয়টি বুঝাটা খুব সহজ যে, আমরা যদি একে অপরকে খুন করে বেড়াই তাহলে আমাদের সমাজ আর মানব সমাজ হয়ে থাকবে না। আমরা সবাই নিজেদের ভালো চাই, কেউ নিজের খারাপ চাই না। আমরা সবাই নিজেদের জন্য সুবিধা চাই, কেউ নিজের জন্য অসুবিধা চাই না। আর আমরা নিজেদের সুবিধার জন্যই এবং অসুবিধা থেকে দূরে থাকার জন্যই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করি, নিজেদের জন্যই আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে বাধ্য। তাই সমাজের সুবিধা সমাজের কল্যাণ নিজেরই সুবিধা নিজেরই কল্যাণ, সমাজের অসুবিধা সমাজের দুর্বিপাক নিজেরই অসুবিধা নিজেরই দুর্বিপাক। সমাজে যদি মানুষ মানুষকে খুন করে বেড়ায় তাহলে সমাজ বলেই আর কিছু থাকে না। আর তাই, মানুষকে খুন করা বা এজাতীয় কাজ ‘খারাপ কাজ’ হিসেবে বিবেচিত। বাস্তবতাই নৈতিকতার ভিত্তি, ১৪০০ বছর আগের কোনো বই নয়।
আরও সহজভাবে বুঝানোর জন্য বলা যায়, ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে হেটে যাচ্ছেন এবং একজন চোর আপনার কান থেকে ফোন থাবা দিয়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে, চোরটি যা করেছে তা একটি অপরাধ, অন্যায় কাজ এবং অবশ্যই খারাপ একটি কাজ। প্রশ্ন হলো, আপনি কেন তা বুঝতে পারবেন? তার কারণ এটি নয় যে কোনো এক গ্রন্থে লেখা আছে ‘চুরি করা খারাপ’। তার কারণ, আপনি জানেন, ফোন চুরি হওয়ার কারণে আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। কারণ, আপনি চান না আপনার কোনো জিনিস আপনার অনুমতি ব্যতীত অন্য কেউ ভোগ করুক। আর তাই, চুরি করা বা এজাতীয় কাজ “ভুল বা অন্যায়” বলে বিবেচিত।
আমরা রাস্তায় ট্রাফিক আইন মেনে চলি। আমরা বাইক চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার করি, আমরা রাস্তা পার হওয়ার জন্য জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করি অথবা ওভার ব্রিজ ব্যাবহার করি, আমরা প্রয়োজন মতো হর্ণ ব্যাবহার করি এবং আরও অন্যান্য অনেক নিয়মাবলি মেনে চলি। এখন কথা হলো, আমরা কেন এসব নিয়মাবলি মেনে চলি? আমরা কেন এসব নিয়মাবলি মেনে চলি সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি যদি আমরা একটু ভাবি যে এসব নিয়মাবলি না মেনে চললে কি হবে বা হয়ে থাকে। আমরা যদি এসব নিয়মাবলি মেনে না চলি যা আমাদেরই সুবিধা সহজতর করতে সাহায্য করে এবং দূর্ঘটনা হ্রাস করে তাহলে আমাদের জীবন চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। নিয়মনীতির অস্তিত্ব এজন্যই আছে যে তারা আমাদের অবস্থার উন্নতি করে, কেবল কোনো বইতে লেখা আছে বলে নয়।
কোনো কাজ কি পরিমাণ সুবিধা বনাম কি পরিমাণ অসুবিধা তৈরি করে সেই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে আমরা সেই কাজকে মূল্যায়ন করতে পারি।
আমরা মানব জাতি যদি টিকে থাকতে চাই তাহলে আমাদের একসাথে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা প্রয়োজন। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করলেই আমরা নিজেদের চাহিদা সহজে পূরণ করতে পারি, স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারি। সমাজে যেমন দরকার চিকিৎসকের তেমনি দরকার কৃষকের, যেমন দরকার ইঞ্জিনিয়ারের তেমনি দরকার কামারের। সবাই একসাথে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করলে সহজেই একে অপরের চাহিদা পূরণ করে সুখেস্বচ্ছন্দে জীবন অতিবাহিত করতে পারি, অপরদিকে একা একা জীবনযাপন করার জন্য নিজেই একইসাথে চিকিৎসক, কৃষক, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কামার হওয়া সম্ভব নয় বলা যায়। সবাই একে অপরের সহযোগী হয়ে সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করতে আমাদেরকে বুঝতে হবে কিভাবে অন্যের অসুবিধা না করতে হয়। নৈতিকতা হচ্ছে, সেই লক্ষ্যের প্রতি কি সাহায্য করে আর সেই লক্ষ্য থেকে কি দূরে নিয়ে যায় তার মূল্যায়ন।
কোনো অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা বা মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই।
ধর্মবিশ্বাসীরা নৈতিকতা বলতে অন্ধভাবে কিছু নিয়মাবলি অনুসরণ করা বোঝেন। তারা নৈতিকতা আর আনুগত্যের পার্থক্য বুঝতে ভুল করেন।
আরও পড়ুনঃ
যারা ধর্ম কে নৈতিকতার উৎস মনে করে তাদের নৈতিকতার সংগা অত্যন্ত ক্ষুদ্র … ধর্ম সাধারণ নৈতকতার কথা খুব জোর দিয়ে বলে – যেমন ঈশ্বরএ অবিশ্বাস, চুরি, মিথ্যা, লোভ, কামনা ইত্যাদি … যেগুলো খুব আদিম, সহজ ভাবে নির্ধারণ করা যায় … আবার একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে যে প্রত্যেক ধর্মেই বিভিন্ন সময় চুরি, মিথ্যা, লোভ, কামনা ইত্যাদির ঘটনা আছে … প্রত্যেক ধর্মের মূল চরিত্রদের একাধিক বৈধ ও অবৈধ স্ত্রী বা সঙ্গিনী … যুদ্ধ জেতার জন্য মিথ্যার আশ্রয়,স্বয়ং আল্লা অনুপ্রাণিত করার জন্য মিথ্যা বলেছে … আর লোভ তো সর্বত্র … ক্ষমতার লোভ
কিন্তু যখন যুদ্ধের মতন জটিল নৈতিকতার প্রশ্ন আসে তখন ধর্ম উল্টো সুর ধরে … প্রত্যেক ধর্ম সরাসরি সমর্থন করে ধর্ম প্রসারের জন্য যুদ্ধ কে … কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহিত করার জন্য যা বললো তা পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ গীতা হয়ে গেল … আল্লা পরিষ্কার বলেদিলো কাফেরদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করতে … আর সেই সব যুদ্ধে হত্যা, অত্যাচার, ধর্ষণ, লুঠপাঠ, অগ্নিসংযোগ সব চলবে … এমনকি যুদ্ধ বন্দীদের দাস হিসাবে এবং যুদ্ধ বন্দী মহিলা দের যৌন দাসী রাখা যাবে আজীবন … এই তো ধর্মের নৈতিকতা উদহারণ !
আসল কারণ হলো সব ধর্মের উৎস আদি যুগের কিছু সীমিত জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ … সে সময় নৈতিকতার সংকীর্ণ সংগা ছিল … আজ আমাদের নৈতিকতার সংগা ধর্মের সীমিত সংগা থেকে অনেক বিস্তারিত … যেমন
১) ঈশ্বরএ অবিশ্বাস – সব ধর্ম মতে এটা অত্যন্ত অপরাধ … ইসলামে অবিশ্বাস কে সবথেকে জঘন্য অপরাধ মানা হয় … এমনকি হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদির থেকেও … মধ্যযুগীও মানসিকতা না হলে কোনো সুস্থ মানুষ একজন অবিশ্বাসীকে একজন হত্যাকারী থেকে বেশি অপরাধী মনে করতে পারে ?
২) প্রাণী হত্যা – কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া সব ধর্মে অবাধ প্রাণী হত্যা শুধু বৈধ নয় কিছু ক্ষেত্রে আবার কষ্ট দিয়ে হত্যা করার নিয়ম … আজ প্রাণী হত্যার নৈতিকতার প্রশ্নে অনেকে স্বেচ্ছায় নিরামিশাষী … কোনো ধার্মিককে নিরামিশাষী পাওয়া কষ্টকর, কারণ তারা ধর্মের বলে দেওয়া নৈতিকতার বাইরে যাবে না
৩) শিশু নির্যাতন ও যৌন শোষণ – কোনো ধর্ম বলে না যে বাল্য বিবাহ অন্যায় ও দোষের … দশ-বারো বছরের শিশুদের ওপর জন্মদান ও মাতৃত্ব চাপিয়ে দেয়াও এক জঘন্য অমানবিক অপরাধ … কিন্তু ধর্মের মাপকাঠিতে তা নৈতিক… ধর্মান্ধরা তা সমর্থন করে
৪) নারীদের অধিকার – যেহেতু সব ধর্ম পুরুষ আবিষ্কৃত তাই সবাই নারীদের ভোগ্য পণ্যর মতো দেখে … একজন পুরুষ একাধিক নারীকে ভোগ করবে কিন্তু উল্টোটা হলে সর্বনাশ ঈশ্বর ক্ষেপে যাবেন
৫) পারিবারিক শারীরিক সম্পর্ক – ধার্মিকদের একটা বড় চিৎকার যে ধর্মে মানা না থাকলে মানুষ যথেচ্ছ পারিবারিক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতো … গোড়া ধর্মান্ধরা কি করতো জানি না তবে নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ যে তা করতো না তার প্রমাণ ইসলাম বা অন্য ধর্ম আবিষ্কারের আগে এমন রীতি ছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি … তবে তো ভাবতে হয় ইসলাম গ্রহণের আগে ওই অঞ্চলের সবাই এই প্রথা অনুসারে নিকট পরিবারের মধ্যে বিবাহ বা সম্পর্ক করতো, তাই কি? … বরং ইসলাম cousin দের বিবাহের অনুমতি দেয় যা অন্য অনেক ধর্মের মতে চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ … অর্থাৎ ধর্মের নীতি শিক্ষার কোনো নিয়ম নেই, এক ধর্মের যা নৈতিক অন্য ধর্মে তা চূড়ান্ত অনৈতিক
শালীনতা ও দুর্ব্যবহারএর প্রশ্নে ধার্মিকদের নীতি বোধ যে একদম তলানিতে তার অসংখ প্রমাণ এই website এ ছড়ানো … ধার্মিকরা নাস্তিকদের সরাররি “তুই” , “নাস্তিকের বাচ্চা”, “ছাগল”, “জারজ” ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে পোস্ট করেছে
আমাদের নীতি-নৈতিকতার উৎস আমাদের চেতনা হাজার বছরের পুরানো কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় … বর্তমানে মানুষের নীতি-নৈতিকতা বোধ যে কোনো ধর্মগ্রন্থ শেখানো নীতির থেকে বহুগুন উন্নত