মর্মন সমাচার
বর্তমান সময়ের সবচে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম কোনটি এই নিয়ে অনেক ধরনের মতভেদ আছে। তেমন কোন রেফারেন্স বা আদমশুমারির রিপোর্ট ছাড়া অনলাইনের বিভিন্ন নর্তনে আর ওয়াজের বিভিন্ন কুর্দনে ইসলামি পণ্ডিতরা বলে থাকেন ইসলাম হচ্ছে সবচে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম । আবার অন্যদিকে ধর্মত্যাগে কল্লা হারানোর ভয় নাই এমনসব পশ্চিমা দেশে বিগত কয়েকবারের আদমশুমারি থেকে দেখা যায় কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন ধর্ম পালন করে না এই গোষ্ঠীর অনুপাতই সবচে বেশি বেড়েছে ইন্টারনেটের ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে । অন্যদিকে আমেরিকার এক কোণায় পড়ে থাকা মর্মন ধর্মের গুরুরা আবার তাদের বিভিন্ন প্রচার প্রচারণায় প্রোপাগান্ডায় ও দাওয়াতে বলছে সবচে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম হচ্ছে তাদের প্রচারিত একমাত্র সত্য ধর্ম । মর্মন চার্চের প্রচার অনুযায়ী পৃথিবীজুড়ে তাদের অনুসারী সংখ্যা ১৬ মিলিয়ন বা এক কোটি ষাট লাখ । সাতশ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় খুবই নগণ্য হওয়ার কারণে অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগেও বিপুল পরিমাণ মানুষ – শিক্ষিত ,অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত সব গোত্রেরই- কোনদিন এই ধর্ম বা বিশ্বাসের নামই শোনেনি । যারা শুনেছে তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো শুনে থাকবে খ্রিস্টান ধর্মের হাজার হাজার শাখার মধ্যে এটাও একটা শাখা ।
আদতে মর্মন ধর্মকে খ্রিস্টান ধর্মের একটা শাখা হিসাবে ধরা হবে নাকি স্বতন্ত্র কোন ধর্ম হিসাবে ধরা হবে এই নিয়ে প্রচুর মতবিভেদ রয়েছে । মূলধারার খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা নিজেদের সুবিধামত কোথাও তাদের খ্রিস্টান ধর্মের একটা শাখা হিসাবে ধরে নিয়ে নিজেদের সংখ্যার সাথে তাদের সংখ্যাও যোগ করে, আবার বিশ্বাস ও ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় তাদের নানান ভুল বিশ্বাস ও যিশুর শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক আদর্শ ও কাজের তুলনা করে তুলোধোনাও করে । অন্যদিকে মর্মনরাও দাওয়াতি কাজের বেলায় যে লোক কোনদিন তাদের ধর্মের নাম শোনেনি তাদের কাছে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে নিজেদের যিশুর অনুসারী বলেই দাবী করে আবার নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস করে মূলধারার খ্রিস্টান ধর্মের সবগুলো শাখাই ভ্রান্ত ও বিপথগামী । একমাত্র তারাই সঠিক পথে আছে । নিজেদের দৈনন্দিন ধর্মীয় আচারও প্রথার মধ্যে যিশুর শিক্ষা বা মূলধারার বাইবেলের চাইতে নিজেদের নবী ও নিজেদের ধর্মগ্রন্থেরই প্রাধান্য থাকে বেশী । এই দিক থেকে দেখলে খ্রিস্টান ধর্মের একটা শাখার চাইতে বরং তাদের আলাদা একটা ধর্ম হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করাই অধিকতর যুক্তিসংগত মনে হয় ।
মর্মনদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের নবী যোসেফ স্মিথ (Joseph Smith) তার আমেরিকার নিউইয়র্ক রাজ্যের পালমাইরায়(Palmyra, New York) তার কৈশোরে ১৮২০ সালের কোন একদিন ঈশ্বর ও যিশুর সাক্ষাৎ পায় বাড়ীর পাশের জংগলে প্রার্থনার সময় । ঈশ্বর ও যিশু তাকে বলে যায় বাইরের দুনিয়ায় যিশুর অনুসারী বলে দাবী করা সবগুলো চার্চ আসলে ভ্রান্ত ও পথচ্যুত । কোন চার্চের কার্যপদ্ধতি ও বিশ্বাস ঠিক তার সন্ধান না করে জোসেফের উচিত হচ্ছে নিজস্ব চার্চ শুরু করা । পাশাপাশি নতুন এক ধর্মগ্রন্থ ও তাকে দেয়া হয় । কিন্তু এই নতুন ধর্মগ্রন্থটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় আরো অনেক পরে । এই ধর্মগ্রন্থের আদি ও আসল রূপ নিয়েও নানান ধরনের গালগল্প ও উদ্ভট কাহিনী চালু হয় জোসেফের নিজের সময়েই । তার নিজস্ব বয়ান অনুযায়ী পালমাইরার কাছে এক টিলায় মাটির নিচে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সে ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা লেখা কিছু স্বর্ণের পাতা পায়, ঈশ্বর ও যিশুর নির্দেশনা অনুযায়ী। তাকে আবার ঈশ্বর ও যিশু কঠিনভাবে নিষেধ করে দেয় সে অথবা অন্য কেউ যাতে কখনোই স্বর্ণের পাতাগুলোর দিকে সরাসরি চোখ না দেয় । তাকানোর সাথে সাথেই যে তাকাবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। স্বর্ণের পাতার লেখাগুলো প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকে হলেও একটা বিশেষ পাথরের মাধ্যমে সেগুলোকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করা যাবে। পাথরটিক নিজের হ্যাটের মধ্যে রেখে হ্যাটের ভিতরে মুখ ডুবিয়ে দিলে স্বর্ণের পাতার লেখাগুলো ইংরেজি হয়ে দেখা যাবে ।
এর মধ্যে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যোসেফ স্মিথ ১৮২৮ সালের দিকে তার বন্ধু মার্টিন হ্যারিসের সাহায্যে বুক অফ মর্মন তথা মর্মন ধর্মের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ কাজ শেষ করে । এই বই অনুযায়ী আমেরিকার মূল ভূমির আদি অধিবাসী বা রেড ইন্ডিয়ানরা আসলে প্রাচীন ইজরায়েলের ইহুদিদের একটা পরিবারের বংশধর যারা পানির নীচে চলা এক ধরনের জাহাজে চড়ে হাজার হাজার বছর আগে আমেরিকাতে এসেছিলো । পরিবারের পিতা লিহাই (Lehi) স্বপ্নে ঈশ্বরের কাছ থেকে আদেশ পায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিজের স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি, পুত্রবধূগণ ও দাসদাসী সমেত আমেরিকাতে যাওয়ার । লিহাই এর বড় দুই ছেলে ল্যামান (Laman) ও ল্যামুয়েল(Lemuel) সন্দেহ ও অবিশ্বাস নিয়ে পিতার সাথে সাগর পাড়ি দেয় । আর ছোট ছেলে নিফাই (Nephi) পুরো সময় জুড়ে পিতার উপর আস্থা রাখে । কালক্রমে তাদের বংশধররা দুই গোত্রে ভাগ হয়ে যায় । ভালো নিফাইটস আর খারাপ লেমনাইটস । ভালো ও মন্দ দলের মধ্যে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী অনেকগুলো যুদ্ধ হয় । এর মধ্যে আবার মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর যিশু ইজরায়েল থেকে স্বর্গে যাবার পথে যাত্রাবিরতি করে যান আমেরিকায় । তখন কিছু যুগ সবকিছু ভালোমতো চললেও যিশুর প্রস্থানের পর আবার নিফাই ও লেমনাই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । ফলাফলে ভালো লোকেরা সব ধ্বংস হয়ে যায় খারাপদের হাতে । আর লেমনাইটদের কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ ঈশ্বর তাদের চেহারাকে অন্ধকার করে দেন । এইসব অন্ধকার চেহারার লোকজনই হচ্ছে আদিবাসী তথা রেড ইন্ডিয়ান । ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিফাইদের মধ্যে একজন , যার নাম ছিলো মর্মন , সে তার স্বজাতির ইতিহাস ও যুদ্ধ ও ধ্বংসের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যায় স্বর্ণের পাতায় । সেই বিবরণই পরে যোসেফ স্মিথ উদ্ধার ও ভাষান্তর করে বুক অফ মর্মন নামে প্রকাশ করে ।
একেবারে মোটা দাগে এই হচ্ছে আমেরিকা ভূখণ্ড নিয়ে মর্মনদের আদিগল্প । বুক অফ মর্মন প্রকাশের পরেও যোসেফ স্মিথ আরো অনেক বার অনেকরকমে ঈশ্বরের কাছ থেকে সরাসরি প্রত্যাদেশ পাওয়ার দাবী করে । সেইসব প্রত্যাদেশ এবং স্বপ্নে পাওয়া বিবরণ জড়ো করে জোসেফ স্মিথের নামে আরো দুইটি বই মর্মন চার্চ প্রকাশ করে । একটি হচ্ছে Doctrines and Covenants, অন্যটি The Pearl of Great Price যেটি নিজে আবার দুই খণ্ডে বিভক্ত , The Book of Moses ও The Book of Abraham নামে । এই তিনটি বইয়ের উপর ভিত্তি করে মর্মন ধর্মের বিশ্বাস ও আচারের বেশিরভাগ অংশ গড়ে উঠলেও জোসেফ স্মিথের মৃত্যুর পরে মর্মন চার্চের শক্তিশালী হয়ে উঠা ও ছড়িয়ে পড়ার বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন বিশ্বাস, তত্ত্ব, আচার । হয়েছে অনেক রকমের সংশোধনও । তার মধ্যে সবচে বড় দুটি হচ্ছে, কালোদের ব্যাপারে চার্চের অবস্থান এবং বহুবিবাহ নিয়ে । মর্মন ধর্ম যেই সময়ে শুরু ও প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সময়কার আমেরিকার আর্থসামাজিক অবস্থা অনুযায়ী কালো ও তামাটে চেহারার লোকজনের গায়ের রং ঈশ্বরের অভিশাপে ওরকম হয়ে গেছে এই ধরণের কথাবার্তাকে কেউ পাত্তা না দিলেও সময়ের প্রবাহ এবং মানুষের নৈতিকতা একটু একটু করে পরিশুদ্ধ হওয়া শুরুর পর তাদের এই ভয়াবহ বর্ণবাদী দর্শনের পথ থেকে সরে আসতে হয় । অন্যদিকে চার্চের প্রথম নবী জোসেফ স্মিথের মৃত্যুর সময় ত্রিশেরও অধিক সংখ্যক স্ত্রী ও উপপত্নী ছিলো । একইভাবে প্রাথমিক যুগের সব বিশিষ্ট মর্মনদেরও ছিলো একাধিক স্ত্রী । অনেক ক্ষেত্রেই দুই অংকের সংখ্যায় । সেই যুগের মর্মনদের একমাত্র শক্ত ঘাঁটি ইউটাহ (Utah) কে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যের মর্যাদায় নেয়ার শর্ত হিসাবে ১৮৯০ সালে বহুবিবাহও নিষিদ্ধ করে মর্মন চার্চ ।
১৮২০ থেকে ১৮৩০ এর দশকে বুক অফ মর্মনের প্রকাশ পর্যন্ত অনেকবার অনেকে জোসেফ স্মিথের কাছে তার স্বপ্নে পাওয়া স্বর্ণের পাতাগুলো দেখতে চেয়েছে । প্রতিবারই সে কোন না কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে । এমনকি শ্বশুরবাড়ীতে শ্বশুরের ঘাড়ের উপর বসে জীবন কাটানোর সময়ে একবার তার শ্বশুর খুব বেশী পীড়াপীড়ি শুরু করলে জোসেফ তাকে একটা বাক্স ধরতে দেয় উপর থেকে । বাক্সের ওজন এমন ছিলো যাতে মোটামুটি স্বর্ণের পাতে সমান হয় । এর বেশি কিছু নয় । কাউকে কোনপ্রকার কিছু দেখতে না দিয়ে কেবল বারবার ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ জারী করার অভ্যাসের কারণে জোসেফ স্মিথের সাথে তার প্রতিবেশী, সহযোগী ও এমনকি আত্নীয়দেরও কলহ লেগেই থাকতো । একবার রাগান্বিত জনতা তার মুখে আলকাতরাও মেখে দেয় । বুক অফ মর্মনের প্রকাশ এবং তার কিছুদিন পরেই চার্চ অফ জিসাস ক্রাইস্ট অফ ল্যাটার ডে সেইন্টস (Chuch of Jesus Christ of Latter Day Saints) অর্থাৎ মর্মন চার্চের শুরুর পরে কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী তৈরি হলেও আশেপাশের লোকজনের দ্বারা নিয়মিত উপহাস, অবিশ্বাস এবং সময়ে সময়ে নির্যাতনেরও শিকার হতে থাকে মর্মনরা । নিউইয়র্কে সুবিধা না করতে পেরে জোসেফ স্মিথ পালাতে বাধ্য হয় পেনসিলভানিয়া, ওহাইয়ো(Curtland, Ohio), মিজৌরি(Independece, Missouri) এবং ইলিনয়(Naveau, Illinois) রাজ্যে । এর মধ্যে আবার নিজেদের অন্তর্দ্বন্দও লাগতে থাকে । ইলিনয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত নাভু(Naveau) শহরে থাকা অবস্থায় জেলের মধ্যে খুন হয় জোসেফ স্মিথ । জোসেফ এর মৃত্যুর পরে নেতৃত্ব যায় ব্রিগাম ইয়ং(Brigham Young) এর হাতে । ইয়ং কয়েক হাজার মর্মনকে নিয়ে হিজরত করে আরো পশ্চিমে । যেতে যেতে বর্তমান ইউটাহ পৌঁছালে সেখানেই নতুন করে সব কিছু পত্তন করা শুরু করে মর্মনরা । সেই থেকে ইউটাহ-ই মূলত মর্মন ধর্মের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে ।
অন্তর্দ্বন্দ্ব, উদ্ভট বিশ্বাস, নির্যাতন, যুদ্ধ, গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যা ও অনেক ক্ষেত্রে গণহত্যার ভয়াবহ ইতিহাস পেরিয়ে বর্তমানের মর্মন ধর্মের যা চেহারা হয়েছে তা থেকে সাদা চোখে বুঝার কোন উপায় নাই এই আপাত শান্তিময়, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পারিবারিক বন্ধনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্যদের তুলনায় অনুকরণযোগ্য চমৎকার জীবন যাপন করা মর্মনদের আদি ইতিহাস কতখানি ভয়ংকর ও কলঙ্কযুক্ত । বর্তমানের মর্মন চার্চ লাখ লাখ কোটি টাকার মালিক এক বিশাল কর্পোরেশন । ইউটাহতে থিতু হওয়ার পর থেকে ও টাকার পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে মর্মন চার্চ সর্বান্তকরণে চেষ্টা করে এসেছে তাদের নবী জোসেফের হাস্যকর ও উদ্ভট দাবীগুলোকে নানান ধরণের ধর্মতত্ত্বের ভারী শব্দ দিয়ে আধ্যাত্মিক কিছুতে পরিণত করতে । চেষ্টা করে এসেছে মূলত জোসেফের ব্যক্তিগত জীবনকে যতখানি সম্ভব আড়ালে রাখা যায় সে ব্যবস্থা করার। প্রথম যুগের মর্মনদের রাষ্ট্রদ্রোহ, গণহত্যা ও একেবারে চাঁছাছোলা ডাকাতি খুন ও প্রতারণার ইতিহাসকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের রুখে উঠা হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করে চলছে । বর্তমান মর্মন চার্চ আদি মর্মনদের স্মৃতি ও কাজের ইতিহাস বিজড়িত সমস্ত জায়গা কিনে নিয়ে স্বাধীন গবেষকদের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে । বুক অফ মর্মনের ভাষান্তরের ইতিহাস প্রায় পুরোপুরিই বিস্মৃত করে দিয়েছে অন্তত মর্মনদের ভিতর থেকে ।
তবে এতকিছু করেও শেষ রক্ষা করা যাচ্ছে না । মর্মনদের ইতিহাস নিয়ে জানাশোনা ও গবেষণা করার ব্যাপারে সবচে চমৎকার সৌভাগ্য হচ্ছে ফটোগ্রাফ, ছাপাখানা, সরকারী দলিলপত্রের সংরক্ষণের যুগে শুরু হওয়া ধর্ম এটি । ফলত মর্মন চার্চ যতই চেষ্টা করুক না কেন সমসাময়িক পত্রিকার খবর, জোসেফ স্মিথের আশেপাশের লোকজনের জীবনী , সেই সময়কার প্রকাশিত বই, সরকারী দলিলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে মর্মনদের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বের করে ফেলছেন বর্তমান ইতিহাসবিদরা । আরো চমৎকার হচ্ছে এইসব ইতিহাসবিদদের মধ্যে অগ্রগামী হচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রেই এক্স-মর্মন বা মুরতাদ মর্মনরা । মর্মন শিশুদের ছোটবেলা থেকে ধর্মকে খুবই সিরিয়াস বিষয় হিসাবে নেয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার কারণে এইসব মুরতাদ মর্মনরা যখন বস্তুনিষ্ঠভাবে তাদের নিজেদের ইতিহাস খুঁড়া শুর করে তখন অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ দক্ষতার সাথে এই কাজ করতে পারে । কারণ তাদের ধর্মের আগাগোড়া, সমস্ত অন্ধকার গলি সম্পর্কে তাদের ধারণা শুরু থেকেই থাকে । বাকী থাকে কেবল সেগুলোকে বস্তুবাদী ও যৌক্তিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা ।
এসব বস্তুবাদী ইতিহাসবিদদের খোঁড়াখুঁড়িতে উঠে এসেছে জোসেফ স্মিথ তার পিতার বাটপারি ব্যবসার কথা । বুক অফ মর্মনের প্রকাশ বা জংগলে প্রার্থনারত অবস্থায় ঈশ্বর ও যিশুর সাক্ষাৎ পাওয়ার দাবী করার অনেক আগে থেকেই স্মিথ পরিবারের ছেলেরা বিশেষত জোসেফ স্মিথ সিনিয়র এবং হাইরাম স্মিথ ও মর্মন নবী যোসেফ স্মিথ হ্যাটের ভিতরে পাথর রেখে তার ভিতরে নিজেদের চেহারা ডুবিয়ে গুপ্তধন, স্বর্ণের ও রুপার খনির অবস্থান শনাক্ত করতে পারে বলে দাবী করতো । আত্নবিশ্বাসের সাথে এই দাবী করে মাঝে মধ্যেই টাকাপয়সাওয়ালা দু-একজনকে প্রভাবিত করে এই সেবার বিনিময়ে টাকা নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করতো স্মিথ পরিবার । সত্যিকারের গুপ্তধন পাওয়া অথবা সোনারূপার খনি শনাক্ত করার কোন উদাহরণ অবশ্য পাওয়া যায় না । স্মিথ পরিবারের , বিশেষত মর্মন নবী জোসেফের এই প্রতারণার বড় শিকার একজন হচ্ছে জোযাইয়া স্টাওল (Josiah Stowell) । জোসেফ স্মিথ তাকে বেশ কয়েকবার গুপ্তধনের সন্ধান দেয়ার কথা বলে জায়গামত নিয়ে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু না পেয়ে কোন না কোন একটা অজুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো । গুপ্তধনের লোভ দেখিয়ে মাসের পর মাস এই প্রতারণা চলছে দেখে শেষমেশ স্টাওলের ভাতিজা জোসেফ স্মিথের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করে দেয় স্থানীয় আদালতে । আদালতে জোযায়া স্টাওল, জোসেফ স্মিথ সিনিয়র ও জোযায়া স্টাওলের দুই মেয়ে সহ আরো বেশ কিছু লোককে সাক্ষী হিসাবে ধরা হয় ।
শুনানির বর্ণনা থেকে জানা যায় জোসেফ স্মিথ তার গুপ্তধন খুঁজতে পারার ব্যবসার কথা স্বীকার করে নেয়, এও স্বীকার করে নেয় যে সে এখন পর্যন্ত কোথাও সত্যিকারের গুপ্তধন বা সোনারূপার খনির সন্ধান পায় নি । দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মামলার বিবরণ জানাজানি হয় মূলত ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত একটা পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে । সেই প্রতিবেদনের লেখিকা মর্মনদের উপর গবেষণা করতে গিয়েছিলেন ইউটাহ । লেখিকার নিজের ভাষ্যমতেই তার দূর সম্পর্কের এক চাচা, যিনি এই মামলার বিচারক ছিলেন তার ধারাবিবরণীর বই থেকে এই বিচারের কাহিনী তিনি ছিঁড়ে নিয়েছিলেন এই লেখার জন্য । ফলত প্রমাণ হিসাবে এই প্রতিবেদন বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে । কিন্তু চমৎকারভাবে আরেক গবেষক নিউইয়র্কের এক পুরনো জেলখানা ভূগর্ভস্থ কাগজপত্রের গুদামে ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঐ সময়ের এক সরকারী খরচের বিবরণ পেয়ে যান । সেখানে জোসেফ স্মিথের মামলার খরচ হিসাবে কাউন্টির কাছে কোন এক বিচারক ২ ডলার ৩৬ সেন্ট দাবী করেন । ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও মামলার খরচ হিসাবে হুবহু সেই ২ ডলার ৩৬ সেন্ট লেখা ছিলো । এই কাগজ খুঁজে পাওয়ার পর মর্মন চার্চের পক্ষে আর এই মামলা বা বিচারের ঘটনা চেপে যাওয়ার উপায় থাকে না । তারা মামলার সত্যতার কথা স্বীকার করে নেয় । সত্য নবীর বিরুদ্ধে সবাই মিলে নির্যাতন হিসাবে দেখাতে চায় ঘটনাটিকে ।
মর্মনদের ইতিহাস খুঁড়তে শুরু করলে এরকম শত শত ঘটনা, শত শত ইঁদুরের গর্ত লুকিয়ে আছে । এবং সৌভাগ্যজনকভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপযুক্ত তথ্য, বিবরণ এমনকি দলিলপত্রও আছে এইসব ঘটনার মূলে ও সত্যে পৌঁছানোর জন্য । বুক অফ মর্মনের বর্ণীত ঘটনাও যে এমন কোন অলৌকিক বা অসাধারণ কোন বর্ণনা নয় সেটাও জানা যায় সমসাময়িক কিছু বই ও প্রচলিত ধারণার কথা থেকে । Solomon Spalding নামে এক লেখকের কথা জানা যায় নিজস্ব থিওরি ছিলো আমেরিকা মহাদেশের বিশাল বিশাল পুরাতন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ নিয়ে । তার ধারণা ছিলো প্রাচীন ইজরায়েল থেকে ইহুদিদের একটা দল সমুদ্র পেরিয়ে এই আমেরিকা মহাদেশে এসে সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো । দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বইয়েরও সত্যিকারের কোন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না । কেবল স্পল্ডিং এর মেয়ের কয়েকটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তার পিতার উদ্ভট থিওরি ও লিখিত বইয়ের কথা । আবার সৌভাগ্যজনকভাবে ঐ সময়ে প্রকাশিত আরো দুইটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি এবং প্রকাশিত কপি পাওয়া যায় এখনো , যেগুলো পড়লে খুব সহজেই বুঝা যায় বুক অফ মর্মনের একটা বিশাল অংশ মূলত এই দুইটি বই থেকে টুকলিফাই করা । বই দুটি হচ্ছে The Views of the Hebrews ও The Late War, The First Book of Napoleon । এছাড়া বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনা ও বর্ণনার স্টাইলের ঢালাও নকল তো উপরি হিসাবে আছেই ।
আবার জোসেফ স্মিথের শহিদী মৃত্যুর পিছনের ঘটনাও আর আড়ালে নেই । জেলখানায় উত্তেজিত জনতার হাতে খুন হওয়ার ঘটনার পিছনে যে ঘটনা, কেনো সে জেলখানায় ছিলো সেই ঘটনার বিবরণও পাওয়া যায় । জোসেফ স্মিথ তার নিজের প্রতিষ্ঠিত ইলিনয়ের নাভু শহরের মেয়র থাকা অবস্থায় সেখানকার মর্মনদের একটা অংশ এই ধর্মের অসারতা ও জোসেফ ও ক্ষমতার কেন্দ্রের লোকজনের যথেচ্ছাচারের ক্ষুব্ধ হয়ে চার্চ থেকে বেরিয়ে যায় । তারা নাভু এক্সপোজিটর(Nauvoo Expositor) নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করে । এদের ক্ষোভের বড় একটা কারণ ছিলো জোসেফ স্মিথ ও চার্চের ক্ষমতাশীলদের যথেচ্ছ বহুগামিতা । সেই সময়ে জোসেফ স্মিথের স্ত্রীর সংখ্যা ছিলো ত্রিশের ঘরে, যার মধ্যে ১৪ বছরের বালিকাও ছিলো কমপক্ষে একজন । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জোসেফ সবাইকে এই বলে বাধ্য করে যে ঈশ্বরের সরাসরি প্রত্যাদেশ আছে তার উপর এতগুলো বিয়ে করার জন্য । তার নিজের তেমন কোন ইচ্ছা নাই কিন্তু ঈশ্বর তাকে আদেশ করেছেন এই বিয়ে না করলে সে এবং হবু কণে ও কণের পরিবারকে ঈশ্বর ধ্বংস করে দিবেন । নাভু এক্সপজিটরে জোসেফ ও তার ঘনিষ্ঠদের এইসব নষ্টামির বিবরণ প্রকাশিত হলে জোসেফ তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে পত্রিকার অফিস ও ছাপাখানা পুড়িয়ে দেয় । এই অপরাধের জন্যই তাকে জেলখানায় বন্দী করা হয় । উত্তেজিত জনতা সেখানেই তাকে ও তার বড় এক ভাইকে খুন করে । খুন হওয়ার আগে জোসেফ স্মিথ নিজেও উত্তেজিত জনতার দুইজনকে গুলি করে খুন করে তারপর জানালা দিয়ে পালাতে গিয়ে মারা যায় । জোসেফের মৃত্যুর পরে ব্রিগাম ইয়ং অবশ্য আরো অনেক বেশি দক্ষতার সাথে গুপ্তহত্যা, গণহত্যা ও ধর্মীয় উন্মাদনার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সফলতার সাথে ইউটাহতে নিজের রাজত্ব বজায় রাখতে পেরেছিলো ।
সমসাময়িক বই ও গালগল্প থেকে টুকলিফাই করে কিছু নিজের কথা মিশিয়ে নতুন ধর্মগ্রন্থের প্রবর্তনা , কেবল নিজে ছাড়া অন্য কেউ দেখে না এমন ধরণের চ্যানেল থেকে পাওয়া ঐশ্বরিক আদেশ, বহুনারী ভোগ করতে চাওয়াকে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা, নিজের উদ্ভট গালগল্প ও আচারের অত্যাচারে লোকজনকে জর্জরিত করে পালিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে আবার একই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ও শেষমেশ কোথাও গিয়ে নিজের ডেরা তৈরি করা , সমালোচকদের খুন ও নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে থামানোর চেষ্টা ; ঠিক যেন কার সাথে মিলে যায় । দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে আরো কিছু শতাব্দীর বেশি পিছনে গেলেই আর ছবি নাই, প্রকাশিত বই নাই, মামলার বিবরণ নাই । কয়েক শতাব্দী পিছনে জন্ম নেয়ার কারণে একই কাজ করে কেউ বিলিয়ন বিলিয়ন অনুসারী পায় ।
লেখক পরিচিতিঃ মাওলানা দুরের পাখি বাঙলা ব্লগস্ফিয়ারে প্রথম যুগের জনপ্রিয় ব্লগার। যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা এবং নাস্তিক্যবাদ বিষয়ক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক।বর্তমানে পেশাগত ব্যস্ততার কারণে খুবই অল্প লেখেন। সামহোয়্যারইন ব্লগে তার পুরনো লেখাগুলো পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো।
আহা । এ তো একদম মুহম্মদের কার্বন কপি