fbpx

মহাভারত যখন জাতপাতকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল

Print Friendly, PDF & Email

মহাভারত এক সুবিশাল গ্রন্থ। এর মধ্যে যেমন ভীষণভাবে জাতপাতের প্রভাব চোখে পড়ে তেমনি এতে এমন অনেক উদাহরণও দেখা যায় যা জাতিবাদী মানসিকতার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করে। মহাভারতে বিদ্যমান জাতপাত সম্বন্ধে আমি পূর্বে লিখেছি । এবার জাতিভেদের বিপক্ষের কিছু উদাহরণও মহাভারত থেকে দেওয়া যাক।

১।

প্রথমে সর্প-যুধিষ্ঠির সংলাপ দিয়ে শুরু করা যাক।

কৌরবদের ষড়যন্ত্রে পাণ্ডবরা বনবাস করতে বাধ্য হলেন। বনবাসকালে একবার ভীমকে এক বিশাল অজগর সাপ জড়িয়ে ধরলো। ভীম ভীষণ শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সেই নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। বিস্মিত হয়ে ভীম সেই সাপকে প্রশ্ন করলেন, “ আমার শরীরে দশ হাজার হাতির সমান শক্তি, এরপরেও কিভাবে তুমি আমাকে বশ করলে? তুমি কে?” উত্তরে সাপ ভীমকে বললো, “আমি তোমার পূর্ব পুরুষ নহুষ, ঋষি অগস্ত্যের অভিশাপে সাপে পরিণত হয়েছি”

এরমাঝে ভীমকে খুঁজতে খুঁজতে যুধিষ্ঠিরও সেই স্থানে  উপস্থিত হলেন, ভীমের কাছে সকল বৃত্তান্ত শুনলেন যুধিষ্ঠির । যুধিষ্ঠির সেই সাপের কাছে অনুরোধ করলেন তার ভাইকে ছেড়ে দিতে। উত্তরে সেই অজগর বললো, “ তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো তবে তোমার ভাইকে ছেড়ে দেব।“  যুধিষ্ঠির সেই সাপের প্রস্তাবে রাজি হলেন।

সর্প- “ হে যুধিষ্ঠির, তোমার কথায় তোমাকে বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে , অতএব ব্রাহ্মণ কে এবং জ্ঞাতব্যই বা কি ? এর উত্তর দাও।

যুধিষ্ঠির- “ যে ব্যক্তিতে সত্য, দান, ক্ষমা, শীলতা, আনৃশংস্য, তপ ও দয়া লক্ষিত হয়, সেই ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ এবং যাকে পেলে আর শোক-দুঃখ থাকে না , সেই সুখদুঃখ বর্জিত নির্বিশেষ ব্রহ্মই জ্ঞাতব্য। যদি আপনার আর কিছু বলার থাকে বলুন।“

সর্প- “ হে যুধিষ্ঠির, অভ্রান্ত বেদ চতুর্বর্ণেরই ধর্ম ব্যবস্থাপক; সুতরাং বেদমূলক সত্য, দান, ক্ষমা, অনৃশংস্য, অহিংসা ও করুণা শূদ্রেও দেখা যাচ্ছে; যদি শূদ্রেও সত্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণ ধর্ম দেখা গেল, তবে শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে! তুমি যা জ্ঞাতব্য বলে নির্দেশ করলে , সুখদুঃখ বর্জিত তেমন বস্তু কোথাও নেই। “

যুধিষ্ঠির-  “ অনেক শূদ্রেও ব্রাহ্মণলক্ষণ ও অনেক দ্বিজাতিতেও শূদ্রলক্ষণ দেখা যায় ; অতএব শূদ্রবংশের হলেই যে শূদ্র হয় এবং ব্রাহ্মণ বংশীয় হইলেই যে ব্রাহ্মণ হয়, এমন নয় ; কিন্তু যে সকল ব্যক্তিতে বৈদিক ব্যবহার লক্ষিত হয় , তারাই ব্রাহ্মণ এবং যে সকল ব্যক্তিতে তা লক্ষিত না হয় , তারাই শূদ্র। আপনি বলেছেন যে ‘সুখদুঃখবিহীন কোন বস্তু নেই, অতএব তোমার কথায় তো জ্ঞাতব্যের লক্ষণ অসঙ্গত হয়েছে’। তা যথার্থ, কেননা অনিত্য বস্তুমাত্রেই হয় সুখ , না হয় দুঃখ অনুভূত হয়ে থাকে , কিন্তু আমার মতে কেবল এক নিত্য পরমেশ্বরই সুখ-দুঃখ বিহীন ; অতএব তিনিই জ্ঞাতব্য। এখন আপনার মত প্রকাশ করুন।“

সর্প- “ হে আয়ুষ্মান, যদি বৈদিক ব্যবহারই ব্রাহ্মণত্বের কারণ বলে স্বীকার করতে হয়, তাহলে যে পর্যন্ত বেদবিহিত কার্যে সামর্থ্য না জন্মে , সে পর্যন্ত জাতি কি কোনো কার্যকারক নয়?”  

যুধিষ্ঠির- “ হে মহাসর্প, বাক্য, মৈথুন, জন্ম ও মরণ মানবজাতির সাধারণ ধর্ম, এই জন্য  পুরুষেরা সবসময় জাতি বিচারে না করে নারীতে সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে , অতএব মানবজাতির মধ্যে সমস্ত বর্ণের এমন সঙ্করতার কারণে ব্রাহ্মণ প্রভৃতি জাতি নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়, কিন্তু তত্ত্বদর্শীর মধ্যে যারা যাগশীল , তারাই ব্রাহ্মণ , এই আর্য প্রমাণানুসারে বৈদিক ব্যবহারেরই প্রাধান্য অঙ্গিকার করেছেন । বেদবিহিত কর্মই ব্রাহ্মণত্বলাভের কারণ বলে নালীচ্ছেদনের পূর্বে পুরুষের জাত কর্ম সমাধান করতে হয়, সেই পর্যন্ত মাতা সাবিত্রী এবং পিতা আচার্যস্বরূপ হন। তিনি যতদিন পর্যন্ত বেদপাঠ না করেন , ততদিন অবধি শূদ্র সমান থাকেন। জাতিসংশয়স্থলে স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন, যদি বৈদিক ব্যবহার না থাকত , তাহলে সকল বর্ণই শূদ্রতুল্য এবং সঙ্কর জাতি সর্বপ্রধান হইত। এই কারণে আগেই বলেছি যে বৈদিক ব্যবহার সম্পন্ন ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ বলে পরিগণিত হয়ে থাকেন। [1] ( বন পর্ব/ ১৮০ অধ্যায়; কালিপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ)

যুধিষ্ঠিরের এই উত্তরে অজগর সর্প খুশি হন এবং ভীমকে মুক্ত করে দেন।

২।

এরপরের উদাহরণ হল মহাভারতে বর্ণিত যক্ষ-যুধিষ্ঠির সংলাপ।

পাণ্ডবদের বনবাসের সময় একবার তারা খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন জলের খোঁজে যুধিষ্ঠির নকুলকে পাঠালেন। জলের কাছে উপস্থিত হয়েই নকুল এক শব্দ শুনতে পেলেন- ‘এই জল আমার অধিকারে আছে, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর পান করো’। নকুল এই কথা গ্রাহ্য করলেন না, জল পান করলেন আর সাথে সাথেই ভূপতিত হলেন। নকুলের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে যুধিষ্ঠির এবার সহদেবকে পাঠালেন। সহদেবও একই গতি প্রাপ্ত হলেন। এরপর অর্জুন এবং ভীমেরও একই অবস্থা হল।

অবশেষে যুধিষ্ঠির গেলেন সেই সরোবরের কাছে ভাইদের খোঁজে। সেখানে যুধিষ্ঠিরও একটি আকাশবাণী শুনতে পেলেন- ‘আমি মৎস্যশৈবালভোজী বক, আমিই তোমার ভাইদের পরলোকে পাঠিয়েছি । আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যদি জল পান কর তবে তুমিও সেখানে যাবে।‘ একথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, “ আপনি কোন দেবতা? পাহাড়ের মত আমার ভাইদের নিপতিত করেছেন। আপনি কে?” উত্তর এল-  ‘আমি যক্ষ’। সেই যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে বললো – জল পান করতে হলে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। যুধিষ্ঠির সেই যক্ষের প্রস্তাবে রাজি হলেন। শুরু হল যক্ষ-যুধিষ্ঠির প্রশ্নোত্তর।

এই প্রশ্নোত্তরের মধ্যে আমাদের আলোচ্য অংশ অর্থাৎ যেস্থানে বর্ণ বিষয়ক আলোচনা আছে, তাই তুলে ধরা হচ্ছে, বাহুল্যভয়ে বাকি অংশ উল্লেখ করা হচ্ছেনা।

যক্ষ- “ ব্রাহ্মণগণের দেবত্ব কি ও তাদের কোন ধর্ম সাধু ধর্ম? তাদের মনুষ্য ভাব কি এবং কি প্রকার ভাবই বা অসাধুভাব?

যুধিষ্ঠির- “ বেদপাঠ তাদের দেবভাব, তপস্যা সাধু ধর্ম, মৃত্যু মনুষ্যভাব এবং নিন্দা অসাধুভাব।

যক্ষ- “ ক্ষত্রিয়গণের দেবভাব, সাধুভাব, মনুষ্যভাব এবং অসাধুভাবই বা কি?

যুধিষ্ঠির বললেন, “ ক্ষত্রিয়দের অস্ত্রশস্ত্র দেবভাব, যজ্ঞ সাধুভাব , ভয় মনুষ্যভাব এবং পরিত্যাগ অসাধুভাব।

যক্ষ- “ কুল , চরিত্র, বেদপাঠ বা বেদার্থের অবধারণ কিসের দ্বারা ব্রাহ্মণত্ব হয়, তা সুন্দর ভাবে নিশ্চয় করে বল।“


যুধিষ্ঠির- “ হে তাত যক্ষ, শ্রবণ করুন ; কুল, বেদপাঠ বা বেদার্থের অবধারণ ব্রাহ্মণত্বের প্রতি কারণ নয় ; একমাত্র চরিত্রই ব্রাহ্মণত্বের প্রতি কারণ, সন্দেহ নেই। ব্রাহ্মণের বিশেষ রূপ যত্ন সহকারে সম্যক প্রকারে চরিত্র রক্ষা করা কর্তব্য ; কারণ যার চরিত্র ক্ষীণ না হয়, সে কিছুতেই ক্ষীন হয় না, যে চরিত্রাংশে হত হয় সেই ব্যক্তিই বাস্তবিক হত। অধ্যেতা, অধ্যাপক ও অপর শাস্ত্রচিন্তকেরা ব্যসনী হলে, তাদের সকলেই মূর্খ বলা যায় ; যিনি ক্রিয়াবান তিনিই পণ্ডিত। চতুর্বেদবেত্তা ব্যক্তিও দুশ্চরিত্র হলে শূদ্র অপেক্ষা অতিরিক্ত হয় না; যিনি অগ্নিহোত্রপরায়ণ ও দান্ত তিনিই ব্রাহ্মণ বলে স্মৃত হইয়াছেন।“  ( বন পর্ব, ৩১২ অধ্যায় ) [2]

যুধিষ্ঠিরের উত্তরে যক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে তার সকল ভাইকে মুক্ত করে দেন। পরে জানা যায় এই যক্ষ প্রকৃতপক্ষে ছিলেন ধর্ম, যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করার জন্যই তিনি এইসকল ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।

৩।

মহাভারতে যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে প্রশ্ন করেন, কিভাবে বর্ণবিভাগ হল? এছাড়াও ভীষ্মকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন যুধিষ্ঠির। এর উত্তরে ভীষ্ম প্রাচীনকালে  ভৃগু-ভরদ্বাজ এই দুই ঋষির মধ্যে হওয়া কথোপকথনের উল্লেখ করেন।  ভীষ্ম বলেন, “ ধর্মরাজ! মহর্ষি ভরদ্বাজ প্রশ্ন করলে তপোধন ভৃগু যা কীর্তন করেছিলেন, আমি সেই প্রাচীন কথা বলছি, শোনো।“ এরপর ঋষি ভৃগুর করা নানা প্রশ্নে ও বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভরদ্বাজ কি কি উত্তর দিয়েছিলেন তার বর্ণন শুরু করেন ভীষ্ম। [3]

এখানে কেবলমাত্র সেই সব অংশের উল্লেখ করা হচ্ছে যেখানে বর্ণ নিয়ে আলোচনা আছে বাকি অংশ এই লেখায় অপ্রাসঙ্গিক হওয়ায় তার উল্লেখ করা হচ্ছে না।

ভৃগু-ভরদ্বাজ সংবাদ  

ভৃগু-  “হে ভরদ্বাজ! ব্রহ্মা প্রথমে তার তেজ থেকে ভাস্কর ও অনলের মত প্রভাসম্পন্ন ব্রহ্মনিষ্ঠ মরীচি প্রভৃতি প্রজাপতিদের সৃষ্টি করে স্বর্গ লাভের উপায়স্বরূপ সত্য, ধর্ম, তপস্যা, শাশ্বত বেদ, আচার ও শৌচের সৃষ্টি করলেন। এরপর দেব, দানব, গন্ধর্ব, দৈত্য, অসুর, যক্ষ, রাক্ষস, নাগ, পিশাচ এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার মনুষ্যজাতির সৃষ্টি হল। তখন ব্রাহ্মণেরা সত্ত্বগুণ, ক্ষত্রিয়েরা রজোগুণ, বৈশ্যেরা রজ ও তমোগুণ ও শূদ্রেরা নিরবিচ্ছিন্ন তমোগুণ প্রাপ্ত হলেন।“

ভরদ্বাজ- “ ব্রহ্মন! সকল মানুষেই তো সব রককের গুণ বিদ্যমান আছে। তাই কেবল গুণ দ্বারা কখনোই মানুষের বর্ণভেদ করা যেতে পারে না। দেখুন সকল মানুষকেই কাম, ক্রোধ, ভয়, লোভ, শোক, চিন্তা, ক্ষুধা ও পরিশ্রমের প্রভাবে ব্যাকুল হতে হয় এবং সকলের শরীর হতেই ঘাম, মূত্র, মল, শ্লেষ্মা, পিত্ত ও রক্ত নির্গত হয়ে থাকে। অতএব গুণ দ্বারা কিভাবে বর্ণ বিভাগ করা যেতে পারে?

ভৃগু- “তপোধন,  ইহলোকে বস্তুত বর্ণের ইতর বিশেষ নেই। সমস্ত জগতই ব্রহ্মময়। মানুষেরা পূর্বে ব্রহ্মা হতে সৃষ্টি হয়ে কাজের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণে পরিগণিত হয়েছে। যে ব্রাহ্মণেরা রজোগুণ প্রভাবে কাম-ভোগ ভালবেসে, রাগের পরাধীন, সাহসী ও তীক্ষ্ণ হয়ে স্বধর্ম পরিত্যাগ করেছেন তারা ক্ষত্রিয়ত্ব, যারা রজ ও তমোগুণ প্রভাবে পশুপালন ও কৃষিকার্য অবলম্বন করেছেন তারা বৈশ্যত্ব এবং যারা তমোগুণ প্রভাবে হিংসার পরাধীন, লোভী, সর্বকর্মোপজীবি, মিথ্যাবাদী ও শৌচভ্রষ্ট হয়ে উঠেছেন তারাই শূদ্রত্ব লাভ করেছেন। ব্রাহ্মণেরা এরকম কর্ম দ্বারাই পৃথক পৃথক বর্ণ লাভ করেছেন। অতএব সকল বর্ণেরই নিত্য ধর্ম ও নিত্য যজ্ঞে অধিকার আছে। পূর্বে ভগবান ব্রহ্মা যাদের নির্মাণ করে বেদময় বাক্যে অধিকার প্রদান করেছিলেন তারাই লোভবশত শূদ্রত্ব লাভ করেছে। ব্রাহ্মণেরা সবসময় বেদ অধ্যয়ণ এবং ব্রত ও নিয়মানুষ্ঠানে অনুরক্ত থাকেন, এই জন্যই তপস্যা বিনষ্ট হয় না। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যারা পরমার্থ ব্রহ্মপদার্থ অবগত হতে পারেন না তারা অতি নিকৃষ্ট বলে পরিগণিত এবং জ্ঞানবিজ্ঞানবিহীন স্বেচ্ছাচারপরায়ণ পিশাচ, রাক্ষস ও প্রেত প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।…” 

ভরদ্বাজ- “তপোধন! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের লক্ষণ কি তা আমাকে বলুন।“

ভৃগু- “ভরদ্বাজ! যারা জাত-কর্ম প্রভৃতি সংস্কারে সংস্কৃত, পরম পবিত্র ও বেদ অধ্যয়ণে অনুরক্ত হয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যাবন্দন, স্নান, জপ, হোম, দেবপূজা ও অতিথি সৎকার এই ছয়টি কাজ করেন, তারা শৌচ পরায়ণ নিত্য ব্রতনিষ্ঠ ও সত্যনিরত হয়ে ব্রাহ্মণের ভুক্তাবশিষ্ট অন্ন ভক্ষণ করেন আর যাদের সত্য, দান, অদ্রোহ, অনৃশংসতা, ক্ষমা, লজ্জা ও তপস্যায় একান্ত আসক্ত দেখা যায়, তারা ব্রাহ্মণ। যারা বেদ অধ্যয়ণ, যুদ্ধ, ব্রাহ্মণদের ধনদান ও প্রজাদের কাছ থেকে কর গ্রহণ করেন তারা ক্ষত্রিয় এবং যারা পবিত্র হয়ে বেদ অধ্যয়ণ, কৃষি, বাণিজ্য প্রভৃতি কাজ করেন তারা বৈশ্য বলে গণ্য হন। আর যারা বেদবিহীন ও আচারভ্রষ্ট হয়ে সর্বদা সব কাজ করেন এবং সব কিছু ভক্ষণ করেন তাদের শূদ্র বলে গণ্য করা যায়। যদি কোনো ব্যক্তি ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে শূদ্রের মত আচরণ করে তাহলে তাকে শূদ্র এবং যদি কোনো ব্যক্তি শূদ্রবংশে জন্মগ্রহণ করে ব্রাহ্মণের মত নিয়মনিষ্ঠ হয় তাহলে তাকে ব্রাহ্মণ বলে নির্দেশ করা যায়। অতএব ব্রাহ্মণের নানা উপায় দ্বারা ক্রোধ ও লোভের শাসন এবং আত্মসংযম করা কর্তব্য। …” [4] [5]

( শান্তি পর্ব/ ১৮৮-১৮৯ অধ্যায়; কালিপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ)

৪।

এছাড়া মহাভারতের শান্তি পর্বের ২৩৯ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

“পণ্ডিতেরা বিদ্বান, সৎকুলসম্পন্ন ব্রাহ্মণ,গো, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডালকে সমান চোখে দেখে থাকেন। সেই অদ্বিতীয় পরমাত্মা স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমস্ত ভূতে ওতপ্রোতভাবে অবস্থান করছেন।“ [6]

৫।

মহাভারতের শান্তি পর্বের ৩১৯ তম অধ্যায়ে বলা আছে-

“জ্ঞান দ্বারাই মানুষ জন্মমৃত্যুরূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খল হতে মুক্তিলাভ করতে সমর্থ হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের কথা দূরে থাকুক, অতি নীচ শূদ্র প্রভৃতি হতেও জ্ঞানোপদেশ প্রাপ্ত হলে তাতে শ্রদ্ধা করা অবশ্য কর্তব্য। … সকল বর্ণই ব্রহ্ম হতে উৎপন্ন হয়েছে , অতএব সকল বর্ণকেই ব্রাহ্মণ বলে গণ্য করা যায় এবং সকল বর্ণেরই বেদপাঠে অধিকার আছে। ফলত সমস্ত বিশ্বই ব্রহ্মময়। ব্রহ্মার মুখ হতে ব্রাহ্মণ, বাহুযুগল হতে ক্ষত্রিয়, নাভি হতে বৈশ্য এবং পদতল হতে শূদ্র উৎপন্ন হয়েছে।“ [6]

তাহলে মহাভারতে জাতিভেদবিরোধী বেশ কিছু উদাহরণও দেখা গেল। কিন্তু এই গ্রন্থ থেকেই জাতিভেদের স্বপক্ষে হাজারো উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। মহাভারতের এই স্ববিরোধীতার কারণ কি? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। এখন এর উত্তর দিতে চাইছি না। পরবর্তীতে এই বিষয়ে বিষদে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। 

তথ্যসূত্রঃ

  1. হরিদাশ সিদ্ধান্তবাগীশের সংস্করণে বন পর্বের ১৫১ তম অধ্যায়ে সর্প আর যুধিষ্ঠিরের কথোপকথনটি রয়েছে[]
  2. কালিপ্রসন্ন সিংহ ও বর্ধমান সত্য প্রকাশ যন্ত্রে প্রকাশিত মহাভারতের অনুবাদ অবলম্বন করা হয়েছে এক্ষেত্রে[]
  3. শান্তি পর্ব /১৮২ অধ্যায় []
  4. হরিদাশ সিদ্ধান্তবাগীশের সংস্করণে শান্তি পর্বের ১৮১-১৮২ তম অধ্যায়ে ভৃগু-ভরদ্বাজের এই কথোপকথন রয়েছে[]
  5. বর্ধমান সত্য প্রকাশ যন্ত্রে প্রকাশিত মহাভারতের এই অংশের অনুবাদও দ্রষ্টব্য[]
  6. কালিপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ[][]

অজিত কেশকম্বলী II

"মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।"

2 thoughts on “মহাভারত যখন জাতপাতকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল

  • March 12, 2021 at 3:34 PM
    Permalink

    সেটার কারণ হচ্ছে সমসাময়িক অবস্থা ও প্রেক্ষাপট…যেমন টা ধরুন: যখন আপনি নির্জন কোনো স্থানে স্বর্ণের গয়না / বেশ কিছু টাকা পড়ে থাকতে দেখবেন? …. খুব কম মানুষই আছে এটার লোভ সামলাতে পারবে …আর যারা পারবে না তাদের মধ্যে শিক্ষিত ,অশিক্ষিত যেমন আছে খুঁজে দেখলে পুলিশ তথা আইনের রক্ষক ও পাওয়া যাবে বেশ কিছু। কিন্তু যখন একই জিনিসই পুলিশ স্টেশন এ পড়ে থাকবে … স্বয়ং চোর ও শতবার ভাববে ধরার আগে ।
    মহাভারতের সবাই ছিল রক্ত মাংসের মানুষ …এমনকি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও মনুষ্য রূপে মানুষের মত করে মানুষকে শিখাতে এসেছেন … সো সাভাবিক স্বয়ং ভগবানের ভুল না হলেও অন্যান্য দের সাময়িক ভুল হওয়া অসম্ভব কিছুই নয় ।

    Reply
  • May 12, 2021 at 12:56 PM
    Permalink

    মানুষ বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন জীব। স্থান কাল পাত্র বুঝেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।
    যেমন জগত ব্রহ্মময় অর্থাৎ মানুষের যে ব্রহ্ম আছে, বাঘের মধ্যেও সেই একই ব্রহ্ম আছে। তাই বলে সেই বাঘের মধ্যে মানুষের মতো আচরণ আশা করা উচিৎ নয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষও বাঘ অপেক্ষা ভয়ঙ্কর হয়ে পরে।
    মনু ১/১১ “যে পরমাত্মা জগত সৃষ্টির কারণ, অগোচর, শাশ্বত তিনি সৎও বটে অসৎও বটে।”
    যেহেতু এক বস্তু থেকেই এত কিছু এসেছে সেহেতু সব কিছুর মধ্যে মূলে কোনো ভেদ নেই, কিন্তু স্থুলে ভেদ যুক্ত।
    দুধ থেকে ‘দই’ আর ‘ছানা’ তৈরি হয়। কিন্তু সেই দই দিয়ে ছানা বা দুধ তৈরি সম্ভব নয়। বিক্রিয়াকে পেছনে ফেরাতে গেলে সেই সকল উপাদান গুলোকে একত্রিত করতে হবে যা বিয়োজিত হয়েছে।

    সেই ভাবে আদিতে সকল প্রজাই ব্রাহ্মণ ছিল। তাদের অপত্যরা বিরাট পুরুষ রূপি সমাজকে সুষ্ঠ ভাবে পরিছালন করার জন্য ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র তে রূপান্তরিত হয়েছে। (মনু -৩/১৯৭-২০১)

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: