শূন্য থেকে উদ্ভূত মহাবিশ্ব এবং শক্তির সংরক্ষণশীলতা
সূচিপত্র
ভূমিকা
মানুষ বহুদিন ধরেই দুটি রহস্যের সাথে লড়াই করে আসছে, সেগুলো হল কেন মহাবিশ্ব কোটি কোটি বছর যাবৎ টিকে আছে আর কি করেই বা এই মহাবিশ্ব এলো। মোটামুটি সকল প্রাচীন সংস্কৃতিই তাদের নিজস্ব সৃষ্টিতত্ত্বের গল্প তৈরি করেছে এবং এদের বেশিরভাগই ঈশ্বরের হাতেই বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছে, আর দার্শনিকরাও বিষয়টা নিয়ে কম ভাবনা চিন্তা করেন নি। কিন্তু বিজ্ঞানেরও বিষয়টি নিয়ে কিছু বলার আছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিদ বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেছেন। তারা বলছেন, আমাদের কাছে এখন মহাবিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কিত জ্ঞান আছে, এবং কিভাবে এটা কাজ করে তা ব্যাখ্যার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোও আছে। আর এই তথ্যগুলোই কিভাবে ও কেন মহাবিশ্ব টিকে আছে এবং মহাবিশ্বের উদ্ভব কিভাবে হল সেগুলোর উত্তর পাওয়ার উপায় বাতলে দিচ্ছে।
যাই হোক, বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটামুটিভাবে বিজ্ঞান যা বলছে তা হল, বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে বর্তমানে দেখা অসংখ্য তারকারাজিশোভিত এই মহাবিশ্ব, সবকিছুরই উদ্ভব ঘটেছে একেবারে ‘নাথিং’ বা ‘কিছু না’ বা ‘শূন্য’ থেকে। এই শূন্য বা নাথিং মানে কিছুই নেই, এমনকি স্থান কালও নেই। আর এর কারণ হচ্ছে ‘“নাথিং” নিজেই অন্তর্নিহিতভাবে আনস্ট্যাবল’। (উক্তিতে নোবেল বিজয়ী ফ্রাংক উইলজেক)
কথাটা অদ্ভূত শোনাতে পারে, বা অন্যান্য কাল্পনিক সৃষ্টিতত্ত্বের গল্পের মতও লাগতে পারে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন এই ধারণাটি আসছে পদার্থবিজ্ঞানের দুটো শক্তিশালী ও সফল থিওরি থেকে, যারা হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও জেনারেল রিলেটিভিটি।
চলুন, এবার দেখা যাক কিভাবে সবকিছুর উদ্ভব ‘কিছু না’ বা শূন্য থেকে হতে পারে।
শূন্যস্থান থেকে পার্টিকেল
প্রথমে আমাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর জগতে একটু দৃষ্টিপাত করতে হবে। এটা পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা যা খুবই ক্ষুদ্র বিষয় যেমন পরমাণু এবং এর চেয়েও ক্ষুদ্র কণা নিয়ে কাজ করে। এটা অত্যন্ত সফল একটি থিওরি এবং আধুনিক জগতের অনেক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রই এটার উপরে নির্ভরশীল।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদের বলে এম্পটি স্পেস বা ফাঁকা স্থান বলতে কিছু নেই। সবচেয়ে পারফেক্ট ভ্যাকুয়ামেও পার্টিকেল ও এন্টিপার্টিকেল থাকতে পারে যারা হঠাৎ অস্তিত্বশীল হয়ে আবার শূন্যে মিলিয়ে যায়। একে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বলে।
এই কথিত ভার্চুয়াল পার্টিকেলগুলো সরাসরিভাবে পর্যবেক্ষণ করার যাবে এমন যথেষ্ট সময় নিয়ে অস্তিত্বশীল থাকে না, কিন্তু আমরা এদের অস্তিত্ব বিভিন্ন এফেক্ট এর মাধ্যমে বুঝতে পারি যেমন কাসিমির এফেক্ট, ল্যাম্ব শিফট্, স্পন্টেনিয়াস এমিশন ইত্যাদি। এই ব্যাপারটি নিয়ে পরে আরও আলোচনা হবে।
শূন্য থেকে স্থান-কাল
গ্যালাক্সির মত বড় বড় বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের কাছে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রটির নাম হল জেনারেল রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা। এটা আলবার্ট আইনস্টাইনের সব থেকে বড় আবিষ্কার এবং এটা আমাদেরকে বলে কিভাবে স্থান, কাল ও মহাকর্ষ কাজ করে।
আপেক্ষিকতা কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে অনেকটাই আলাদা। বর্তমানে এই দুটো ধারণাকে একত্রিত করার অনেক চেষ্টাই করা হচ্ছে। যাই হোক, কিছু তাত্ত্বিক বিশেষ কিছু সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য কিছু এপ্রোক্সিমেশন ব্যবহার করে থিওরি দুটোকে একত্রিত করেছেন, যেমন ব্ল্যাকহোলকে ব্যাখ্যা করার জন্য কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিফেন হকিং এই কাজটি করেছিলেন।
যাই হোক, দুটো থিওরির একত্রিকরণ করতে গিয়ে পদার্থবিদগণ একটি জিনিস পেয়েছেন, আর তা হল, যখন কোয়ান্টাম থিওরিকে সাম্ভাব্য ক্ষুদ্রতম স্কেলে প্রয়োগ করা হবে, স্পেস বা স্থান নিজেই আনস্ট্যাবল হয়ে যাবে। স্থান-কাল তখন মসৃণ এবং ধারাবাহিক না হয়ে, ডিস্ট্যাবলাইজড ও কোয়ান্টাইজড হয়ে যায়, এবং বিভিন্ন স্পেস-টাইম বাবল বা স্থান-কাল বুদবুদের একটি ফোমে পরিণত হবে।
অন্য কথায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই স্থান-কালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদবুদের জন্ম হতে পারে। এরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির লরেন্স ক্রস বলেন, “যদি স্থান ও কাল কোয়ান্টাইজড হয় তাহলে তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হতে পারে। সুতরাং ঠিক যেমন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে ভারচুয়াল পার্টিকেল তৈরি হওয়া সম্ভব, তেমনি ভারচুয়াল স্পেসটাইম তৈরিও সম্ভব”।
আর একটা মজার কথা হল, যদি এরকম বাবল বা বুদবুদ তৈরি হওয়া সম্ভব হয় তাহলে আপনি গ্যারান্টি দিতে পারেন যে এটা হবে। বস্টনের টাফটস ইউনিভারসিটির আলেকজান্ডার ভিলেনকিন বলেন, “কোয়ান্টাম ফিজিক্সে, যদি কোন কিছু নিষিদ্ধ না হয়, তাহলে অবশ্যই এটা কোন নন জিরো প্রোবাবিলিটি নিয়ে ঘটবে”।
বুদবুদ থেকে তৈরি হওয়া মহাবিশ্ব
সুতরাং কেবল পার্টিকেল বা এন্টিপার্টিকেলই যে নাথিংনেস বা ‘কিছু না’ থেকে তৈরি হতে পারে তা নয়, স্পেস-টাইমের বাবলও একই কাজ করতে পারে। কিন্তু একটি অতি ক্ষুদ্র স্পেস টাইম বাবল থেকে ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি সম্বলিত বিশাল মহাবিশ্ব তৈরি হওয়াও চারটি খানি কথা নয়। আর যদি একটি বাবল তৈরিও হয়, চোখের পলকেই এর আবার বিলীন হয়ে যাবার কথা।
আসলে, একটি স্পেস-টাইম বাবল বা বুদবুদের টিকে যাওয়াটা সম্ভব। কিন্তু এটার জন্য তার আরেকটি কৌশল দরকার। এর নাম হল কসমিক ইনফ্লেশন। বেশিরভাগ পদার্থবিদ এখন মনে করেন, মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়েছিল বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। প্রথমে ভর ও শক্তি একটি অকল্পনীয় ক্ষুদ্র ডটে একত্রিত হয়েছিল, এবং এরপর এটা বিষ্ফোরিত হয়। বিংশ শতকের প্রথম দিকের একটি আবিষ্কার থেকে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যা বলে, মহাবিশ্বের প্রসারণ হচ্ছে। যদি সকল গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে একটা সময় অবশ্যই তারা কাছাকাছি ছিল।
ইনফ্লেশন থিওরি প্রস্তাব করে, মহাবিশ্ব পরবর্তীতে যেভাবে প্রসারিত হয়েছে তার তুলনায় এটি বিগব্যাং এর ঠিক পরপরই অনেক দ্রুত প্রসারিত হয়েছিল। ৯০ এর দশকে এম আই টি এর এলান গাথ এই ধারণাটি দেন এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির আন্ড্রেই লিন্ডে এটাকে আরও উন্নত করেন। ধারণাটি হল বিগব্যাং এর পরের এক সেকেন্ডেরও একটি ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে স্পেস এর একটি কোয়ান্টাম সাইজের বাবল বা বুদবুদ খুব দ্রুতগতিতে প্রসারিত হতে শুরু করে। একটি অবিশ্বাস্য রকমের কম সময়ের মধ্যে এটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চেয়েও ক্ষুদ্র আকার থেকে প্রসারিত হয়ে একটি বালুকণার আকার ধারণ করে। যখন এই প্রসারণ শেষ পর্যন্ত ধীর গতি লাভ করে, তখন যে ফোর্স ফিল্ড এটার প্রসারণের জন্য শক্তি দিয়ে আসছিল তা ভর ও শক্তিতে পরিণত হয় এবং আজকের মহাবিশ্ব এই ভর-শক্তি দ্বারাই পরিপূর্ণ। গাথ এই ইনফ্লেশনকে বলেছেন “দ্য আল্টিমেট ফ্রি লাঞ্চ”।
এটা শুনতে অবাক লাগলেও, এই ইনফ্লেশনই বিভিন্ন ফ্যাক্টকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। বিশেষ করে, বিগ ব্যাং এর সময়ে তৈরি হওয়া রেডিয়েশনের ক্ষীণ অবশেষ, যা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড নামে পরিচিত, তা কেন সমগ্র মহাকাশে পারফেক্টলি ইউনিফর্ম বা সবদিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে থাকে তার ব্যাখ্যা এই ইনফ্লেশন দিতে পারে। যদি মহাবিশ্ব প্রথমদিকে এরকম খুব দ্রুতবেগে প্রসারিত না হত, তাহলে এই রেডিয়েশন এরকম ইউনিফর্ম বা সবদিকে সমবণ্টিত না হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত।
বিগ ব্যাং এর পরের ১০^-৪৩ সেকেন্ডের মধ্যকার সময়কে প্লাংক ইপক বলা হয়। এই সময়ের পরে কি হয়েছিল তা মোটামুটি স্পষ্টভাবে কেবল কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও জেনারেল রিলেটিভিটির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা গেলেও এই সময়ের আগে কি হয়েছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং জেনারেল রিলেটিভিটি দুটোর সংমিশ্রনের প্রয়োজন হয় (আগেও এব্যাপারে বলা হয়েছে)। এইসময়ের ঘটনাগুলো গ্র্যাভিটির কোয়ান্টাম এফেক্টের উপরেই নির্ভর করে। আর এও বলা হয়েছে যে অনেক পদার্থবিদ এই বিষয়টা নিয়ে এখন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং জেনারেল রিলেটিভিটিকে একত্রিত করার অনেক প্রচেষ্টা আছে, যাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হল হুইলার-ডিউইট ইকুয়েশন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স এন্ড ম্যাথমেটিক্স এর কিং ইউ কাই এর নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল এই হুইলার-ডিউইট ইকুয়েশনের একটি সল্যুশন ডেভেলপ করেন যা শূন্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিগব্যাং ঘটার প্রথম গাণিতিক প্রমাণ হাজির করে।
হাইজেনবার্গের টাইম-এনার্জি আনসারটেইনটি প্রিন্সিপাল বা সময়-শক্তি অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে, একটি মেটাস্ট্যাবল ফলস ভ্যাকুয়ামে (স্থান, কাল ও পদার্থবিহীন একটি অবস্থা) ভারচুয়াল পার্টিকেল জোড় তৈরি হতে পারে। এই অনিশ্চয়তা নীতি অনুযায়ী কোন সিস্টেমে খুব কম সময়ের জন্য একটি ইন্টারমিডিয়েট স্টেটে শক্তি অনিশ্চিত হয় যায়, আর এরকম অবস্থায় শূন্য থেকে দুটি পার্টিকেল তৈরি হতে পারে যাকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বলা হয় (এক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা নীতি ও শক্তির সংরক্ষণশীলতার ব্যাপারে পরে আলোচনা করা হয়েছে)। সাধারণভাবে এই ভারচুয়াল পার্টিকেলের পেয়ার বা জোড় তৎক্ষণাৎ নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু যদি তারা এই নির্মূল হওয়াকে এড়াতে পারে তাহলে এরা একটি ট্রু ভ্যাকুয়াম বাবল তৈরি করতে সক্ষম হয়। উহানের দলের সমীকরণটি থেকে দেখা যায় যে, এই বাবল বা বুদবুদের এক্সপোটেনশিয়ালি প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা আছে, যার ফলে একটি নতুন মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে। আর এর পুরোটাই শুরু হয় একটি কোয়ান্টাম বিহ্যাভিয়রের মধ্য দিয়ে যার ফলে ইনফ্লেশন স্টেজে প্রচুর পরিমাণে ম্যাটার ও এনার্জির সৃষ্টি হয়। তাদের এই ট্রু ভ্যাকুয়াম বাবলের এক্সপোটেনশিয়াল বৃদ্ধি বিগব্যাং এর পরে হওয়া কসমিক ইনফ্লেশনের সাথে মিলে গেছে। তাদের দেয়া প্রমাণ অনুসারে, একটি নির্দিষ্ট আকার লাভের পর এই বাবলের প্রসারণ থেমে যেতে পারে, অথবা পরবর্তীতে এটি সমবেগে প্রসারিত হতে পারে।
যাই হোক, তারা যে ভিন্ন ভারশনের ইনফ্লেশন প্রস্তাব করেছেন তা গাথ, লিন্ডে ও অন্যান্য পদার্থবিদদের ইনফ্লেশন থেকে কিছুটা ভিন্ন কারণ এই নতুন ইনফ্লেশন মডেলটি স্কেলার ফিল্ডের উপর নির্ভর করে না, শুধুমাত্র কোয়ান্টাম এফেক্টের উপরেই নির্ভর করে। আর তাদের উল্লিখিত এই মেটাস্ট্যাবল ফলস ভ্যাকুয়ামে স্পেস, টাইম, ম্যাটার কিছুই থাকে না। এই আর্টিকেলে নাথিং বা ‘কিছু না’ বলতে যা বোঝানো হচ্ছে এটা তাই। লরেন্স ক্রস, ফ্রাংক উইজেল যাকে ‘ইনহেরেন্টলি আনস্ট্যাবল নাথিং’ বলছেন তাকেই এনারা ‘কোয়ান্টাম পোটেনশিয়াল’ বলছেন।
সমতল মহাবিশ্ব এবং এর গুরুত্ব
এই ইনফ্লেশন আবার জ্যোতির্বিদদের মহাবিশ্বের জ্যামিতিকে নির্ণয় করবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারও দান করে। আর দেখা যায়, কিভাবে মহাবিশ্ব শুধু নাথিং বা শূন্য থেকে উদ্ভূত হল তা বের করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা আমাদেরকে বলে যে, আমরা যে স্থান-কালে থাকি তা তিনটি ভিন্ন আকার ধারণ করতে পারে। এটা টেবিল টপের মত সমতল হতে পারে। আবার এটা গোলকের তলের মত বক্রতলও হতে পারে, যেক্ষেত্রে আপনি যদি একই দিকে যথেষ্ট দূরে গমন করেন তাহলে ঠিক যেখান থেকে আপনি শুরু করেছিলেন ঠিক সেখানেই পৌঁছে যাবেন। আবার ঘোড়ার জিন বা স্যাডেলের মত স্পেসটাইম বাইরের দিকেও বেঁকে যেতে পারে। তাহলে এদের মধ্যে আসলে কোনটা ঘটে?
যাই হোক, স্পেস-টাইম বা বলতে গেলে মহাবিশ্ব সমতল নাকি বক্রতল হবে এই আলোচনায় যাবার আগে আরেকটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করতে হবে, সেটা হল মহাবিশ্বের ঘনত্ব বা ডেন্সিটি এবং ক্রিটিকাল ডেন্সিটি।
মহাবিশ্বের ভাগ্য কি হবে তা একরকম তার প্রসারণের ভরবেগ এবং মহাকর্ষের টানের সংঘাতের উপর নির্ভর করে। প্রসারণের হার হাবলের ধ্রুবকের উপর নির্ভর করে, যেখানে মহাকর্ষের স্ট্রেংথ মহাবিশ্বের ম্যাটার বা পদার্থে ঘনত্ব এবং চাপের উপর নির্ভর করে। যদি ম্যাটারের প্রেশার কম হয় (যেমনটা বেশিরভাগ ধরণের ম্যাটারের ক্ষেত্রেই দেখা যেত) তাহলে মহাবিশ্বের ভাগ্য কি হবে তা তার ঘনত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। যদি মহাবিশ্বের ডেন্সিটি বা ঘনত্ব মহাবিশ্বের ক্রিটিকাল ডেন্সিটির (যা হাবল ধ্রুবকের বর্গের সমানুপাতিক) চেয়ে কম হয় তাহলে মহাবিশ্ব চিরকাল ধরে প্রসারিত হবে। যদি এই ডেন্সিটি ক্রিটিকাল ডেন্সিটির চেয়ে বেশি হয় তাহলে গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ শেষমেষ জিতে যাবে ও মহাবিশ্ব আবার কলাপ্স করবে যাকে বিগ ক্রাঞ্চ বলা হয়। যাই হোক, ১৯৯৮ সালে গবেষক সল পারমাটার, নিক সানটজেফ ও ব্রায়াম শ্মিদের দূরবর্তী সুপারনোভাদের পর্যবেক্ষণের একটি রেজাল্ট সাজেস্ট করে যে মহাবিশ্বের প্রসারণ আসলে ত্বরণে চলছে অর্থাৎ এক্সিলারেট করছে, যা বলে এমন এক ধরণের ম্যাটার আছে যার শক্তিশালী নেগেটিভ প্রেশার আছে, যেমনটা আইনস্টাইনের কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট এর বেলায় ধরা হয়েছিল। কখনও কখনও অদ্ভূত ধরণের এই ম্যাটারকে ডার্ক এনার্জি বলা হয়। সুতরাং মহাবিশ্বের প্রসারণ যে কেবল বস্তুর ঘনত্বের উপর নির্ভর করছে তা সঠিক নয়। আর এর ফলে ক্রিটিকাল ডেন্সিটির চেয়ে এই ঘনত্ব বেশি না কম হবে তার উপর মহাবিশ্বের প্রসারণ আর নির্ভর করছে না। যদি ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের ইভোল্যুশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সকল ক্ষেত্রেই মহাবিশ্ব চিরকালব্যাপী প্রসারিত হবে।
যাই হোক, মহাবিশ্বের জ্যামিতি কি, মানে এটা সমতল না বক্রতল এই আলোচনায় মহাবিশ্বের ঘনত্ব কেন ঢোকানো হল- এই প্রশ্ন করাটা ভ্যালিড। এর কারণ হল মহাবিশ্বের ঘনত্ব এই মহাবিশ্বের জ্যামিতি বা জিওমেট্রিও ঠিক করে দেয়। যদি মহাবিশ্বের ডেন্সিটি ক্রিটিকাল ডেন্সিটিকে অতিক্রম করে তাহলে মহাবিশ্বের জ্যামিতি হবে বদ্ধ এবং তলটি গোলকের তলের মত পজিটিভলি কার্ভড হবে। এর অর্থ হল, দুটি সমান্তরাল ফোটনের পথ ধীরে ধীরে এক বিন্দুতে মিলিত হবে এবং এরা যে বিন্দু থেকে শুরু হয়েছিল সেখানেই ফিরে আসবে (যদি মহাবিশ্ব ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকে)। মহাবিশ্বের ডেন্সিটি যদি ক্রিটিকাল ডেন্সিটির চেয়ে কম হয়, তাহলে এর জিওমেট্রি হবে ওপেন বা মুক্ত এবং এটা ঘোড়ার জিন বা স্যাডেলের সারফেসের মত নেগেটিভ কার্ভের হবে। যদি মহাবিশ্বের ডেন্সিটি ক্রিটিকাল ডেন্সিটির সমান হয় তাহলে মহাবিশ্বের জিওমেট্রি হবে সমতল, এবং সকল দিকে অসীম। বিগ ব্যাং থিওরির বর্ধিতাংশ ইনফ্লেশন থিওরির সরলতম ভারশনটি ভবিষ্যদ্বাণী করে যে মহাবিশ্বের ডেন্সিটি ক্রিটিকাল ডেন্সিটির খুবই কাছে এবং মহাবিশ্বও তাই সমতল।
কিন্তু শুধু থিওরির প্রেডিকশনই তো দেখলে হবে না, পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের রেজাল্ট কি বলে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনধরণের তলের মধ্যে মহাবিশ্ব ঠিক কোনটা, এটা বলার একটা রাস্তা আছে। অংক ক্লাসের একটা জিনিস আপনার মনে থাকতে পারে, সেটা হল, ত্রিভূজের তিন কোণের যোগফল ১৮০ ডিগ্রী। আসলে এটা বলার সময় আপনার শিক্ষক একটা জরুরি বিষয় বাদ দিয়ে গিয়েছিলেন। তা হল, এটা কেবল সমতলের জন্যই সত্য। যদি আপনি একটি বেলুনের তলের উপর একটি ত্রিভূজ অংকন করেন তাহলে তার তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রীর চেয়ে বেশি হবে। আবার আপনি যদি স্যাডেলের মত এমন একটি তলে ত্রিভূজটি আঁকেন যা বাইরের দিকে বেঁকে যায় তাহলে ত্রিভূজটির তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রীর চেয়ে কম হবে।
সুতরাং মহাবিশ্ব সমতল কিনা, এটা বের করার জন্য আমাদেরকে একটি বড় ত্রিভূজের কোণগুলোকে পরিমাপ করতে হবে। আর এখানেই ইনফ্লেশন চলে আসে। এখান থেকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের ঠাণ্ডা এবং উষ্ণ অঞ্চলগুলোর গড় আকার নির্ণয় করা হয়। WMAP (উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ এনিস্ট্রপি প্রোব – ২০০১ সালে নাসা কর্তৃক লাঞ্চ করা একটি স্যাটেলাইট) মহাবিশ্বের জিওমেট্রি সহ বিগ ব্যাং থিওরির মৌলিক প্যারামিটারগুলো পরিমাপ করতে সক্ষম ছিল। সেই অঞ্চলগুলোকে ২০০৩ সালে পরিমাপ করা হয়, এবং এটার দ্বারা জ্যোতির্বিদগণ ত্রিভুজটিকে সনাক্ত করতে সক্ষম হন। যদি মহাবিশ্ব সমতল হয়, তাহলে উজ্জ্বলতম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড ফ্লাকচুয়েশনগুলো (বা উজ্জ্বলতম দাগ) প্রায় এক ডিগ্রী দূরত্বে থাকবে। যদি মহাবিশ্ব ওপেন বা মুক্ত (স্যাডেল এর মত) হয় তাহলে সেই দাগগুলো এক ডিগ্রীর চেয়ে কম দূরত্বে থাকবে, আর যদি মহাবিশ্ব ক্লোজড বা বদ্ধ হয় তাহলে দাগগুলো এক ডিগ্রীর চেয়ে বেশি দূরত্বে থাকবে।
বিভিন্ন গ্রাউন্ড বেজড এবং বেলন বেজড এক্সপেরিমেন্ট যেমন MAT/TOCO, Boomerang, Maxima, DASI এর মাধ্যমে দেখা গেল এই উজ্জ্বলতম দাগগুলো প্রায় এক ডিগ্রী দূরত্বে থাকে। WMAP এর রেজাল্টের আগে ১৫ শতাংশ নিশ্চয়তার সাথে মহাবিশ্বকে সমতল বলা যেত, কিন্তু ২০১৩ সালের WMAP এর রেজাল্ট আসার পর মাত্র ০.৪ শতাংশ মারজিন অব এরর নিয়ে বলে দেয়া যায় যে মহাবিশ্ব সমতল। এটা বলে যে, মহাবিশ্ব চারদিকে অসীমভাবে বিস্তৃত। কিন্তু যেহেতু মহাবিশ্বের একটি সসীম বয়স আছে, সুতরাং আমরা এই মহাবিশ্বের একটি সসীম আয়তনকে পর্যবেক্ষণ করতে পারব। আমরা এখান থেকে এই উপসংহারটিই টানতে পারি যে, আমরা সরাসরিভাবে মহাবিশ্বের যতটুকু দেখি মহাবিশ্ব এর চেয়েও অনেক বিশাল।
এখানে আরেকটা মজার বিষয়, সমতল মহাবিশ্বই কেবল নাথিং বা শূন্য থেকে জন্মাতে পারে। যে ইনফ্লেশন থিওরির সাহায্যে বিগব্যাং এর পরবর্তী প্রসারণকে ব্যাখ্যা করা যায় সেটা ধরে নেয় যে মহাবিশ্বের ঘনত্ব এবং ক্রিটিকাল ডেন্সিটির অনুপাত, ওমেগার মান ১ (মানে দুটো সমান আর কি), আর পর্যবেক্ষণের রেজাল্টেও তাই দেখা যায়। শূন্য থেকে উদ্ভূত মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্যেও এই ওমেগার মান ১ হতে হয়, আর তাই সমতল মহাবিশ্বের এই প্রমাণটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নক্ষত্র, ছায়াপথ থেকে শুরু করে আমরা যে আলো দিয়ে তাদেরকে দেখতে পাই, সকল অস্তিত্বশীল জিনিসই কোন না কোন জায়গা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে পার্টিকেলগুলো কোয়ান্টাম লেভেলে অস্তিত্বশীল হতে পারে। কিন্তু এই সকল ছায়াপথ, গ্রহ-নক্ষত্র তৈরি হতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়।
মহাবিশ্বে এই সমস্ত শক্তি কোথা থেকে এল? তাহলে আরেকটি অদ্ভূত কথা বলি। সম্ভবত মহাবিশ্বকে এরকম কোন শক্তি অর্জন করতেই হয় নি। এর কারণ হল মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ তৈরি করে যার দ্বারা বস্তুটি অন্যান্য বস্তুকে তার দিকে টেনে নিয়ে আসে। এই মহাকর্ষের জন্য একটি ঋণাত্মক শক্তি জড়িত থাকে। আর এই শক্তিই বস্তুগুলো তৈরি হবার জন্য প্রথমে যে ধনাত্মক শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল (আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc^2 অনুসারে ভর ও শক্তি সমতুল্য) তাকে ব্যালেন্স করে (পরবর্তীতে এটা নিয়ে আরও আলোচনা করা হয়েছে)।
এটা অনেকটা দাঁড়িপাল্লার মত ব্যাপার। আপনি যদি একদিকে একটি বস্তু রাখেন তাহলে তাকে ব্যালেন্স করার জন্য অপরদিকেও সমান ভরের আরেকটি বস্তু রাখতে হবে। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে বস্তুর তৈরি হবার ফলে দাঁড়িপাল্লার একদিকে ভারি হয় যা অন্যদিকে গ্র্যাভিটির মাধ্যমে ব্যালেন্স হয়। পদার্থবিজ্ঞানীগণ হিসাব করে দেখেছেন যে, একটি সমতল মহাবিশ্বে বস্তুর শক্তি সঠিকভাবে সেই বস্তুর মহাকর্ষ দ্বারা ব্যালেন্স হয়ে যায়। কিন্তু এটা কেবল সমতল মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেই সত্য। যদি মহাবিশ্ব বক্রতলের হত তাহলে এরা একে অপরকে ব্যালেন্স করতে পারত না।
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনে শক্তির সংরক্ষণশীলতা
এখানে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়, তা হল যেখানে পদার্থ নেই, অর্থাৎ ভর ও শক্তি কিছুই নেই সেখানে হঠাৎ করে ভারচুয়াল পার্টিকেল তৈরি হয় কী করে? আর এখনে শক্তির সংরক্ষণই বা হয় কি করে? অর্থাৎ শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি এখানে কিভাবে কাজ করে?
বিষয়টা ব্যাখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিকাল এপ্রোক্সিমেশন মেথড ব্যাবহার করা হয় যা পারটারবেশন থিওরি নামে পরিচিত। পারটারবেশন থিওরি অনুসারে, কোন সিস্টেম মধ্যবর্তী “ভারচুয়াল স্টেট” বা ভারচুয়াল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে পারে যেখানে তার এনার্জি বা শক্তি সিস্টেম বা ব্যবস্থার প্রাথমিক ও শেষ স্টেট বা অবস্থার শক্তির চেয়ে ভিন্ন হয়। এটা হাইজেনবার্গের দ্বিতীয় অনিশ্চয়তা নীতির কারণে ঘটে যা সময় ও শক্তির সাথে সম্পর্কিত। এই নীতি অনুসারে কোন সিস্টেমে শক্তির সংরক্ষণ হলেও খুব কম সময়ের একটি মধ্যবর্তী অবস্থার ক্ষেত্রে এর শক্তি অনিশ্চিত হয়ে যায়।
ভারচুয়াল ফোটনের একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি সহজে বর্ণনা করা যায়। তার আগে ভারচুয়াল ফোটন ও পদার্থবিজ্ঞানের কিছু ইতিহাস নিয়ে কিছু আলোচনা করে আসা ভাল হবে।
একটি হারমোনিক অসিলেটর ভাইব্রেশনের মাধ্যমে শক্তি বিকীরণ করে। ক্লাসিকাল ফিজিক্সের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম অনুসারে শক্তি তরঙ্গাকারে বিকীর্ণ হবে, কিন্তু ম্যাক্স প্লাংক বললেন শক্তি বিচ্ছিন্নভাবে কোয়ান্টাইজড হয়ে নিঃসৃত হয় যার নাম ফোটন। এখান থেকেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্ম। এই নতুন তত্ত্ব অনুসারে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড এমনভাবে কাজ করে যেন তা ফোটন নিয়ে গঠিত, তাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড আসলে একটি ফোটন ফিল্ড। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে একে ফোটন ভাবলে ফোটনের পরিমাণ তত বেশি হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলোর এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব এমন কিছু ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয় যা আলোর তরঙ্গধর্মিতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, যেমন ফটোইলেক্ট্রিক এফেক্ট। আলো তরঙ্গ হিসেবে কোন ধাতব কণায় আঘাত করে সেই কণায় ভাইব্রেশন বা কম্পন সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু ফটোইলেক্ট্রিক এফেক্টে যেরকম আলোকে ধারব কণায় ধাক্কা দিয়ে ইলেক্ট্রন বের করে নিয়ে আসতে দেখা যায় তাকে আলোর তরঙ্গধর্মিতা নয়, কেবল তার কণাধর্মিতা (ফোটন) দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়।
তো যাই হোক, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ভাইব্রেশন তৈরি করা ছাড়াও আরও কিছু কাজ করতে পারে। এটা চার্জ অবজেক্ট বা আহিত বস্তুতে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বলের সৃষ্টি করতে পারে, আর এই বল বস্তুগুলোর ভরবেগেরও পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। ভাল কথা, কিন্তু এই ব্যাপারটি কি আলোর কণাধর্ম বা ফোটনের সাহায্যেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব? দেখা গেল, একভাবে এটা সম্ভব। এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, এই পারটিকেলগুলো ‘ভারচুয়াল ফোটন’ এর বিনিময় বা এক্সচেঞ্জ ঘটায় যার ফলে এদের ভরবেগেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। ফাইনম্যানের ডায়াগ্রাম দিয়ে ভারচুয়াল ফোটনের বিনিময়কে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আর দুটি পদার্থের মধ্যকার ‘ভারচুয়াল ফোটন’ এর বিনিময়ের ফলে হওয়া ভরবেগের পরিবর্তনের কারণেই তাদের মধ্যে আকর্ষণ বিকর্ষণের সৃষ্টি হয় (কিভাবে এটা হয় সেই বিস্তারিত আলোচনায় গেলাম না)।
যাই হোক এবার আসল কথায় আসি। উপরে যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে আহিত বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ বিকর্ষণের যে কথা বলা হল তাতে মধ্যবর্তী অবস্থার কথা চিন্তা করা হয়েছে যেখানে ভারচুয়াল ফোটন রয়েছে। চিরায়ত বলবিদ্যা বা ক্লাসিকাল মেকানিক্স অনুসারে একটি চার্জ পার্টিকেলের পক্ষে নিজে থেকে এভাবে একটি ফোটন নিঃসরণ করা সম্ভব নয়। ভরবেগের সংরক্ষণশীলতা নীতি অনুযায়ী এর ফোটন সহ থাকা স্টেট বা অবস্থার জন্য অনেক বেশি শক্তির দরকার হয়। যেহেতু এই ইন্টারমিডিয়েট স্টেট বা মধ্যবর্তী অবস্থা খুবই কম সময়ের জন্য থাকে তাই হাইজেনবার্গের শক্তি-সময় অনিশ্চয়তা নীতি অনুযায়ী সেই ক্ষুদ্র সময়ে শক্তির অবস্থা একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে যায়। এর ফলে সেই মধ্যবর্তী স্টেট বা অবস্থায় শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি ভঙ্গ না করেই সিস্টেমটির খুব কম সময়ের জন্য একটি বড় শক্তির অবস্থা দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে যার ফলে তার পক্ষে ‘ভারচুয়াল ফোটন’ বিনিময় সম্ভব হয়।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এই ফেনোমেননটি দেখায় যে, একটি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য সিস্টেমের শক্তি অনিশ্চিত হয়ে যায়, আর কোনভাবে সেই শক্তি খুব সামান্য সময়ের জন্য ধার করে নেয়া হয়। এইসব ভারচুয়াল স্টেট বা অবস্থার সবটুকুই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এপ্রোক্সিমেশন, যেখানে সবসময়ই শক্তি সংরক্ষিত হয়। ফাইনম্যানের ডায়াগ্রামের ক্ষেত্রেও শক্তির সংরক্ষণ ঘটে। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি মুখ্য তা হল, ভারচুয়াল পারটিকেল এমন পরিমাণ শক্তি বহন করতে পারে যা ক্লাসিকাল ফিজিক্সের ল অব মোশন এলাউ করে না। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই হাইজেনবার্গের শক্তি-সময় অনিশ্চয়তা নীতি দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, এবং এখানেও শক্তির সংরক্ষনশীলতা নীতি রক্ষিত হয়।
মহাবিশ্বের প্রসারণে শক্তির সংরক্ষণশীলতা
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মহাবিশ্ব ডার্ক এনার্জির প্রভাবে একটি শক্তিশালী নেগেটিভ প্রেশার তৈরি করে এবং এর ফলে মহাবিশ্বের প্রসারণ এক্সিলারেটেড বা ত্বরিত হয়। এখন প্রশ্ন হল মহাবিশ্বের এই ত্বরিত প্রসারণের ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ কিভাবে হয়। যাইহোক, মহাবিশ্বের প্রসারণে শক্তির সংরক্ষণ কিভাবে হয় এই আলোচনায় যাবার আগে আবার পদার্থবিজ্ঞানের কিছু ইতিহাস এবং আইনস্টাইনের বিখ্যাত আবিষ্কার জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে সামান্য আলোচনা করে নেয়া যাক।
আইনস্টাইন তার জেনারেল রিলেটিভিটিতে স্পেসটাইমের সাথে ভর-শক্তির মিথস্ক্রিয়া বিষয়ক ১০টি পার্শাল ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন প্রদান করেন যেগুলো আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশনস নামে পরিচিত (আসলে ১৬টি ইকুয়েশন ছিল যেগুলোকে কমিয়ে ১০টি করা যায়)। এই ইকুয়েশনগুলোর পদগুলোকে টেনসর আকারে প্রকাশ করে একটি ইকুয়েশন হিসেবে লেখা যায়। এর ফলে সমীকরণটির বামপক্ষে থাকল আইনস্টাইন টেনসর আর ডানপক্ষে থাকল স্ট্রেস-এনার্জি টেনসর। আইনস্টাইন টেনসর হল একধরণের রাইম্যানের মেট্রিক টেনসর। রাইম্যানের মেট্রিক টেনসর ব্যবহার করা হয় কোন স্থানকে প্রকাশ করার জন্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি দ্বিমাত্রিক স্থান যেভাবেই বেঁকে থাকুক না কেন তাকে মাত্র তিনটি সংখ্যার সাহায্যেই প্রকাশ করা সম্ভব, তেমনি চতুর্মাতৃক স্থানকালকে মাত্র ১০টি সংখ্যার দ্বারাই প্রকাশ করা যায় (আসলে টেনসরে উপাদান সংখ্যা ১৬টি, কিন্তু এদের মধ্যে ছয়টি অন্য ছয়টির সাথে মিলে যাওয়ায় ১০টি হয়)। সুতরাং সমীকরণের বামপক্ষের আইনস্টাইন টেনসর স্থানকাল বা টাইমস্পেসকে প্রকাশ করে।
ইকুয়েশনের ডানপক্ষে আছে স্ট্রেস এনার্জি টেনসর। এই টেনসরে আছে ১৬টি উপাদান। এর মধ্যে ১টি এনার্জি ডেন্সিটি, ৬টি মোমেন্টাম ডেন্সিটি, তিনটি প্রেশার এবং ছয়টি শিয়ার স্ট্রেস নির্দেশক। অর্থাৎ এই টেনসরটি স্পেসটাইমে থাকা কোন বস্তু বা শক্তির এনার্জি, মোমেন্টাম, প্রেশার এবং স্ট্রেস প্রকাশ করে থাকে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই টেনসরটি স্পেসটাইমে থাকা ভর-শক্তিকে নির্দেশ করে। সুতরাং আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশনের এই সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে, স্পেসটাইমে থাকা কোন ভর বা শক্তি সেই স্পেসটাইমের মধ্যে একটি কার্ভেচার ও বক্রতার সৃষ্টি করে। বস্তু সবসময় তার ক্ষুদ্রতম পথ অতিক্রম করে কোথাও পৌঁছাতে চায়। সমতল বা ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে এই পথ সরলরৈখিক হলেও বক্রতল জ্যামিতিতে এই পথ বেঁকে জিওডেসিক হয়ে যায়। আর এভাবেই জেনারেলে রিলেটিভিটির সাহায্যে মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করা যায়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
ধরুন একটি গোলকীয় তলে একটি কণা একটি বিন্দু থেকে একটি নির্দিষ্ট দিকে সরলরেখা বরাবর সমবেগে যাত্রা করছে, গোলকীয় তল বলে বিন্দুটি আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। এখন ধরুন একটি নতুন কণা আগের কণা যে বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেখান থেকে একই বেগে সরলরেখা বরাবর একটি ভিন্ন দিকে যাত্রা শুরু করল। দেখা যাবে কণা দুটি দুটোর যাত্রাপথ দুটো বিন্দুতে ছেদ করছে, অর্থাৎ কণা দুটিও দুটি ক্ষেত্রে মিলিত হচ্ছে। উভয় কণাই তাদের ক্ষুদ্রতম উপায় সরলপথে ভিন্ন দিকে সমবেগে যাত্রা করেছিল, কিন্তু তলটি বক্রতল বলে তারা একে অপরের দিকে একটি অসমবেগে কাছে আসে এবং মিলিত হয় যাকে একে অপরের দিকে ত্বরণ বলা যায়। এখন বক্রতলটিকে বেঁকে যাওয়া স্থান-কাল কল্পনা করলে কিভাবে আপাতদৃষ্টিতে এরা একে অপরের প্রতি ত্বরণ অনুভব করলেও বক্রতল কল্পনায় ক্ষুদ্রতম ও সরলতম (স্ট্রেইটেস্ট) পথে চলে তা বোঝা যায়। জেনারেল রিলেটিভিটি অনুসারে মহাকর্ষকে এভাবেই স্থানকালের বক্রতার ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে বস্তু ঠিক করে স্থান-কাল কিভাবে বাঁকবে, এবং স্থান-কাল ঠিক করে বস্তু কিভাবে গমন করবে।
একটা বিষয় এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, তা হল কেবল ভরই যে স্থান-কালে বক্রতার ফলে মহাকর্ষের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এমন নয়, শক্তিও এই প্রভাবে পড়তে পারে। আলোর কোন ভর নেই, কিন্তু এর শক্তি এবং ভরবেগ (মোমেন্টাম) আছে। দেখা যায় স্থানকালের বক্রতায় আলোও জিওডেসিক পথে গমন করে, অর্থাৎ আলোও বাঁকে। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং হল এর একটি উদাহরণ আর এরই মাধ্যমে জেনারেল রিলেটিভিটির সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আইনস্টাইন তার ফিল্ড ইকুয়েশনে মহাবিশ্বকে প্রসারণশীল না ধরে স্থির ধরেছিলেন, আর তাই তিনি মহাবিশ্বকে স্থির রাখতে তার সমীকরণে একটি ধ্রুবক ব্যাবহার করেন যার নাম তিনি দেন “কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট”। কিন্তু ১৯২৯ সালে হাবল প্রমাণ করেন যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের প্রসারণশীলতার প্রমাণ পেয়ে আইনস্টাইন তার কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট সম্পর্কে বলেন, “এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল”।
যাইহোক, আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশনে কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট কোন অসামঞ্জস্যতা তৈরি করেনি। অনেকদিন ধরেই কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টের মানকে শূন্য ভেবে আসা হচ্ছিল। কিন্তু আইনস্টাইনের সবচেয়ে বড় ভুলের মধ্যেও বোধ হয় কোন রহস্য লুকিয়ে ছিল। দেখা গেল এক্সিলারেটিং ইউনিভার্সকে ব্যাখ্যা করার জন্য কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টের একটি ধনাত্মক মান দরকার। আইনস্টাইন ভেবেছিলেন এই কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট একটি স্বাধীন প্যারামিটার। কিন্তু তার ফিল্ড ইকুয়েশনে এই কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টকে সরিয়ে স্ট্রেস এনার্জি টেনসরের একটি অংশ হিসেবে প্রকাশ করা যায়। এখান থেকে দেখা গেল, কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট এর অস্তিত্ব একটি নন জিরো ভ্যাকুয়াম এনার্জির সমতুল্য।
এই বিষয়টির গুরুত্ব ব্যাপক। এই ভ্যাকুয়াম এনার্জি নির্দেশ করছে যে, ফাঁকা স্থান শুধুই ফাঁকা নয়, ফাঁকা স্থানের একটি নিজস্ব শক্তি আছে। যেহেতু এটা স্পেস বা স্থানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তাই এই স্পেসের প্রসারণের ফলে এই শক্তি কমে যায় না, বরং মহাবিশ্ব যত বেশি প্রসারিত হবে, স্পেস বা স্থান তত বৃদ্ধি পাবে, আর এই শক্তিও তত বেশি প্রতিভাত হবে। (অবশ্য এদিকে শক্তি বৃদ্ধি পেলেও শক্তি ঠিকই অন্যভাবে সংরক্ষিত হয়, সেটা পরে আলোচনা করা হবে)।
যাইহোক, নব্বই এর দশকে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আবিষ্কার হয়। যেমন আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে ১৯৯৮ সালে দূরের সুপারনোভা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায় যে মহাবিশ্ব এক্সিলারেট করছে বা এর প্রসারণে ত্বরণ হচ্ছে। এছাড়া আলাদা আলাদাভাবে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড এবং লার্জ গ্যালাক্সি রেডশিফট সারভে থেকেও এটা পাওয়া যায়। এখান থেকে বোঝা যায় যে, মহাবিশ্বের ৬৮ শতাংশ ভরশক্তিই একটি অদ্ভূত অদৃশ্য শক্তি দিয়ে গঠিত যার নাম দেয়া হয় ‘ডার্ক এনার্জি’ (বাকি অংশের ২৭ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার এবং ৫ শতাংশ দৃশ্যমান মহাবিশ্ব)।
ডার্ক এনার্জিকে খুব একটা ভালভাবে বোঝা যায় নি, কিন্তু তার যে বৈশিষ্ট্যগুলো জানা যায় সেগুলো হল, এটি এন্টি-গ্র্যাভিটির কাজ করে, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হবার সাথে সাথে এটা অন্যান্য পদার্থের চেয়ে অনেক কম ডাইল্যুট করে বা ছড়িয়ে গিয়ে অন্যান্য ম্যাটারের মত নিজের ঘনত্ব কমায় না, অন্যান্য ম্যাটারের তুলনায় এরা অনেক দুর্বলভাবে সংঘবদ্ধ হয়, অথবা হয়ই না। আর কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টই হল ডার্ক এনার্জির সরলতম সাম্ভাব্য ধরণ, কারণ এটি স্পেস ও টাইম উভয় ক্ষেত্রেই ধ্রুবক থাকে এবং এটা কসমোলজির বর্তমান মডেল ল্যামবডা সিডিএম মডেল তৈরিতে সহায়ক হয়, যা ২০১৬ সালে অনেক কসমোলজিকাল অবজারভেশনের সাথেই ফিট করেছে।
এখন প্রশ্ন আসে ডার্ক এনার্জি কিভাবে মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিভাবে এটা মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটায়। কয়েকভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়া যায়। প্রথমত, আগেই বলা হয়েছে কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টকে স্ট্রেস এনার্জি টেনসরের একটি অংশ হিসেবে প্রকাশ করা যায় আর এই কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্টই ডার্ক এনার্জি হিসেবে পরিচিত। ডার্ক এনার্জি সহ সকল ভর-শক্তিরই স্ট্রেস এনার্জি টেনসর থাকে যা আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশন অনুসারে স্থান-কালের বক্রতার কারণ হয়। এই স্ট্রেস এনার্জি টেনসরের দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল প্রেশার এবং এনার্জি যা মহাকর্ষের সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণ পদার্থরা যে প্রেশার দেয় তা হল পজিটিভ প্রেশার এবং সে কারণে তারা মহাকর্ষের দ্বারা একে অপরের দিকে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ডার্ক এনার্জির বেলায় এর সাথে যে প্রেশার জড়িত থাকে তা হল নেগেটিভ প্রেশার। ডার্ক এনার্জির এই নেগেটিভ প্রেশার এতই বেশি থাকে যে তা এর পজিটিভ এনার্জিকে ছাড়িয়ে যায়, আর সেকারণে ডার্ক এনার্জি বস্তুকে আকর্ষণ না করে বরং বিকর্ষণ করা শুরু করে। মহাকর্ষের বেলায় যেমন বস্তু ত্বরণে অন্য বস্তুকে কাছে টানত, এক্ষেত্রেও এটাই মহাবিশ্বের প্রসারণে ত্বরণ ঘটায়।
অন্যভাবেও এর ব্যাখ্যা দেয়া যায়। মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটলেও ডার্ক এনার্জি ডাইল্যুট হয় না বা এর ঘনত্ব কমে যায় না। ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব ধ্রুবক থেকে যায়। এখন আমরা জানি যে যেকোন ভর-শক্তিই স্থান-কালের বক্রতা ঘটায়। সুতরাং প্রতিনিয়ত প্রসারণের ফলে আরও নতুন স্থান-কাল যোগ হওয়ায় আরও নতুন ডার্ক এনার্জি তৈরি হবে (যেহেতু এদের ঘনত্ব সমান থাকে, ডাইল্যুট হচ্ছে না এবং এরা নিজেই স্থানের বৈশিষ্ট্য)। এখন এই নতুন ডার্ক এনার্জি পুনরায় স্থান-কালের বক্রতা ঘটাবে। প্রসারণরত মহাবিশ্বের স্থান-কালে নতুন বক্রতা তৈরির অর্থ হল মহাবিশ্বের আরও প্রসারণ হওয়া। এতে ডার্ক এনার্জির ডেন্সিটি অপরিবর্তিত থাকবে, স্পেস-টাইমের কার্ভেচারও অপরিবর্তিত থাকবে আর মহাবিশ্বও একটি নির্দিষ্ট হারে প্রসারিত হবে। উল্লেখ্য যে এই নির্দিষ্ট হারে প্রসারণ অর্থ সমবেগে প্রসারণ নয়। দূরবর্তী ছায়াপথের প্রসারণ যেহেতু গতি হিসেবে হিসাব করা যায় না তাই এটা টাইমস্কেলে হিসাব করা হয়, যেমন মহাবিশ্বের আরও দশ শতাংশ বৃদ্ধি হতে আরও কত সময় লাগবে এরকম। নির্দিষ্ট হারে প্রসারণের ফলে দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি ছায়াপথ যত দূরে চলে যায়, পরের ঠিক তত সময় পর ছায়াপথটি তার দ্বিগুণ দূরত্ব অতিক্রম করে, পরবর্তী একই সময় চারগুণ দূরত্ব অতিক্রম করে। এভাবে নির্দিষ্ট হারে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েও দেখা যায় মহাবিশ্বের প্রসারণ ত্বরণেই হচ্ছে। ফ্রিদম্যানের ইকুয়েশন থেকেও ডার্ক এনার্জি কিভাবে মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটায় তা দেখানো যায়, সেদিকে আর গেলাম না।
এদিকে পদার্থবিজ্ঞানী ভারত বিষ্ণু রাত্রা এবং ফিলিপ জেমস এডুইন পিবলসের মতে ত্বরণে থাকা মহাবিশ্বের কারণ হল কুইন্টেসেন্স নামক ডার্ক এনার্জির একটি ধরণ। এটা ট্রু কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট নয় কারণ সবসময় এটা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। কুইন্টেসেন্স আকর্ষণধর্মী হবে নাকি বিকর্ষণধর্মী হবে তা নির্ভর করে এর গতিশক্তি ও স্থিতিশক্তির অনুপাতের উপর। আজ থেকে দশ বিলিয়ন বছর পূর্বে, অর্থাৎ বিগ ব্যাং এর ৩.৫ বিলিয়ন বছর পর কুইন্টেসেন্স বিকর্ষণধর্মী হয়। অনেক বিজ্ঞানী কুইন্টেসেন্সকে ৫ম মৌলিক বল বলেও মনে করছেন।
এখন আসল প্রসঙ্গে আসা যাক, এই মহাবিশ্বের যখন প্রসারণ হয় তখন এর শক্তি কী করে সংরক্ষিত হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মহাবিশ্ব প্রসারিত হলে, প্রসারিত আয়তনের সমানুপাতে ডার্ক এনার্জির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এসময়ে মহাবিশ্বের পদার্থে থাকা শক্তি অপরিবর্তিত থাকে। তাই আপাতভাবে মনে হয় যে প্রসারণশীল মহাবিশ্বে শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি কাজ করে না। কিন্তু স্পেস বা স্থানের প্রসারণের ফলে গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ডে একটি ঋণাত্মক শক্তি কাজ করা শুরু করে। ডার্ক এনার্জির কারণে মহাবিশ্বের প্রসারণে ত্বরণ ঘটলে এই নেগেটিভ ব্যাকগ্রাউন্ড গ্র্যাভিটেশনাল এনার্জিও বৃদ্দি পায়। এই নেগেটিভ এনার্জি সকল ধরণের পজিটিভ এনার্জিকে ব্যালেন্স করে ফেলে, আর তার ফলে মহাবিশ্বের মোট শক্তি শূন্যই থাকে এবং শক্তিও সংরক্ষিত হয়।
প্রসারণশীল মহাবিশ্বের জন্য স্ট্যান্ডার্ড কসমোলজিকাল মডেলের এই শক্তির সমীকরণটিতে রেডিয়েশন, ডার্ক এনার্জি এবং সাধারণ ম্যাটার অন্তর্ভূক্ত:
E = Mc^2 + Γ/a + (Λc^2/κ) a^3 – (3/κ){(da/dt)^2}a – Ka = 0
এখানে, E হল একটি a(t)^3 আয়তনের প্রসারণশীল অঞ্চলের মোট শক্তি। একটি পারফেক্টলি হোমোজেনাস মহাবিশ্বে এর মান সব সময়ই শূন্য আসবে।
a(t) হল মহাবিশ্বের এক্সপেনশন ফ্যাক্টর যা সময়ের একটি ফাংশন। বর্তমান যুগ বা ইপকে এর মান ১ হিসেবে নরমালাইজ করা হয়। এর মান শূন্য হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং মহাবিশ্বের বৃদ্ধির সাথে সাথে এর মানও বাড়তে থাকে।
da/dt হল সময়ের সাপেক্ষে a এর ডেরিভেটিভ। এটা মহাবিশ্বের প্রসারণের হার নির্দেশ করে।
M হল উক্ত অঞ্চলের মোট ভর।
c হল আলোর বেগ।
Γ হল বর্তমান ইপক বা যুগে কসমিক রেডিয়েশনের নরমালাইজড মান।
Λ হল কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট। এটা ডার্ক এনার্জি নামেও পরিচিত। একে ধনাত্মক ধরা হয়।
κ হল গ্র্যাভিটেশনাল কাপলিং কনস্ট্যান্ট। নিউটনের গ্র্যাভিটেশনাল কনস্ট্যান্ট G দিয়ে একে প্রকাশ করলে, κ = 8πG/c^2
K হল একটি ধ্রুবক যা গোলকীয় বদ্ধ স্থানে ধনাত্মক, স্যাডেলের মত হাইপারবোলিক ওপেন স্পেসে নেগেটিভ এবং ফ্ল্যাট বা সমতল স্থানে শূন্য।
এই সমীকরণটি আমাদেরকে বলে যে, পদার্থের পজিটিভ এনার্জি, রেডিয়েশন এবং ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের প্রসারণের হারের উপর নির্ভরশীল গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ডের নেগেটিভ এনার্জি দিয়ে সঠিকভাবে ব্যালেন্সড হয়ে যায়। মহাবিশ্ব প্রসারিত হলে লেংথ স্কেল a(t) বৃদ্ধি পায়। সাধারণ পদার্থে শক্তির পরিমাণ Mc^2 অঞ্চলটির আয়তনের প্রসারণের পরও একই থেকে যায়। রেডিয়েশন এনার্জি Γ/a এর মান কসমিক রেড শিফট এর কারণে কমে, এবং ডার্ক এনার্জি (Λc^2/κ) a^3 এর পরিমাণ আয়তনের বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে। রেট অব এক্সপেনশন বা প্রসারণের হারকে অবশ্যই এডজাস্টেড হতে হবে যাতে নেগেটিভ গ্র্যাভিটেশনাল এনার্জি পজিটিভ এনার্জির যোগফলকে ব্যালেন্স করতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে প্রসারণশীল মহাবিশ্বের বর্তমান এই মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে ডার্ক এনার্জি তৈরি হওয়ার মহাবিশ্বের সর্বমোট ভর-শক্তির মধ্যে ডার্ক এনার্জি শৎকরা পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা সময় তাই ডার্ক এনার্জি ছাড়া অন্যান্য ভর শক্তি নগণ্য হয়ে যাবে আর এর প্রভাব পড়বে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির উপর। এই বিষয়ে পরে কখনও আলোচনা করা হবে।
কেউ কেউ ভুলবশত দাবী করতে পারে যে প্রসারণশীল মহাবিশ্বে শক্তি সংরক্ষিত হয় না কারণ স্পেস টাইম এখানে স্ট্যাটিক বা স্থির নয়। ল অব এনার্জি কনজারভেশন বা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি আসে নোয়থারের উপপাদ্য থেকে যেখানে ডাইনামিকাল ইকুয়েশন বা গতিশীলতার সমীকরণগুলো সময়ের সাথে সাথে অপরিবর্তিত ছিল। এরা ইকুয়েশনগুলোর ইনভেরিয়েন্স বা অপরিবর্তিনশীলতার সাথে সল্যুশনের ইনভেরিয়েন্সকে গুলিয়ে ফেলে। স্পেস-টাইম পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু প্রসারণশীল মহাবিশ্ব যে সমীকরণগুলো মেনে থাকে তারা পরিবর্তিত হয় না। স্পেস-টাইমকে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ভাবা যায় না, নোয়থার থিওরেম থেকে যখন এনার্জি ইকুয়েশনগুলো ডেরাইভ করতে হয় তখন এটার ডাইনামিক্সকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হয়। আর এখান থেকেই উপরের সমীকরণটি পাওয়া যায় যা বলে প্রসারণশীল মহাবিশ্বে শক্তি আসলেই সংরক্ষিত হয়।
ইউনিভার্স নাকি মাল্টিভার্স?
যাই হোক, এখন পর্যন্ত দেখা গেল একটি মহাবিশ্ব তৈরি করা অনেকটাই সহজ। কোয়ানটাম মেকানিক্স আমাদের বলে যে, নাথিং বা শূন্য নিজেই আনস্ট্যাবল। আর তাই নাথিং থেকে সামথিং বা ‘কিছু না’ থেকে ‘কিছু’ তৈরি হওয়াটাকে একরকম অবশ্যাম্ভাবী বলা যায়। আর এর ফলে একটি ক্ষুদ্র স্পেস টাইমের বাবল থেকে বিশাল ভরযুক্ত, ব্যস্ত মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে। ইনফ্লেশনকে ধন্যবাদ। ক্রস বলেন, “পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে আমরা যেভাবে বুঝি তা অনুসারে মহাবিশ্বের নাথিং বা শূন্য থেকে উৎপত্তি হওয়া সম্ভব, যেই শূন্যে কোন স্থান নেই, কাল নেই, পার্টিকেল নেই, আমরা জানি এরকম কিছুই নেই”।
তাহলে কেনই বা এরকমটা একবারই ঘটবে? যদি একটি স্পেস-টাইম বাবল অস্তিত্বশীল হয়ে তা ইনফ্লেশনের মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারে তাহলে অন্যান্য বাবলগুলো একই কাজ কেন করতে পারবে না?
এর উত্তরে লিন্ডে যা বলেন তা খুবই সরল এবং বিষ্ময়কর। তার মতে, মহাবিশ্ব প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে, আর এই প্রক্রিয়া চিরকাল ধরে চলতে থাকবে।
যখন একটি নতুন মহাবিশ্ব তার ইনফ্লেশন বন্ধ করে দেয়, তখনও এটা এমন স্থান দিয়ে ঘেড়া থাকে যারা ইনফ্লেশন অবিরত রেখেছে। আর সেই ইনফ্লেশনে থাকা স্থান আরও অনেক মহাবিশ্বের জন্ম দেয় যাদের চারপাশেও আরও ইনফ্লেটিং স্পেস বা ইনফ্লেশনে থাকা স্থান থাকে। সুতরাং, একবার যদি ইনফ্লেশন শুরু হয়ে যায়, তাহলে অসীম সংখ্যক মহাবিশ্ব তৈরি হতেই থাকে, যাকে লিন্ডে নাম দিয়েছেন, “এটারনাল ইনফ্লেশন”। আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো একটি অসীম সৈকতে থাকা একটি বালুর কণা।
অন্য মহাবিশ্বগুলো আমাদের মহাবিশ্ব থেকে অনেক ভিন্ন হতে পারে। আমাদের মহাবিশ্বটির পাশের মহাবিশ্বে আমাদের মত তিনটি মাত্রার (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা) বদলে পাঁচটি মাত্রা থাকতে পারে। সেখানে মহাকর্ষ দশ গুণ শক্তিশালী বা হাজারগুণ দুর্বল হতে পারে, সেখানকার বস্তুগুলোও সম্পূর্ণ ভিন্ন পার্টিকেল দিয়ে তৈরি হতে পারে। কে বলতে পারে?
মহাবিশ্বের উদ্ভবের অন্যান্য মডেল
বিগব্যাং ছাড়াও মহাবিশ্বের উদ্ভবের আরও অনেক মডেল আছে। বিজ্ঞানীরা যেমন বিগ ব্যাং থিওরি ভিত্তিক মডেলকে আরও উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তেমনি অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন এর বিকল্পকেও। প্রায়ই নতুন নতুন মডেলের ধারণার কথা খবরে আসছে। বিগ ব্যাং এর বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ বিগ বাউন্সের কথা ভাবছেন, কেউ বা ভাবছেন গ্র্যাভিটন দিয়ে তৈরি কোয়ান্টাম ফ্লুইডের কথা, আবার কেউ ভাবছেন অন্য কিছু। এগুলো নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/wiki/Chronology_of_the_universe
- https://arxiv.org/abs/1207
- https://en.wikipedia.org/wiki/Wheeler%E2%80%93DeWitt_equation
- https://blogs.scientificamerican.com/guest-blog/is-all-the-universe-from-nothing/
- https://arxiv.org/abs/03382
- http://adsabs.harvard.edu/abs/2003hep.ph….4257T
- https://en.wikipedia.org/wiki/Inflation_(cosmology)
- http://math.ucr.edu/home/baez/physics/Quantum/virtual_particles.html
- https://map.gsfc.nasa.gov/universe/uni_shape.html
- https://map.gsfc.nasa.gov/universe/bb_cosmo_fluct.html
- http://iogizmodo.com/how-does-spacetime-get-bent-560618783
- https://en.wikipedia.org/wiki/Dark_energy
- https://tierneylab.blogs.nytimes.com/2009/06/12/the-physics-of-nothing/
খুবি ই গুরুত্বপূর্ণ এবং জ্ঞানগর্ভীী পো…
ধন্যবাদ
উত্তর পেলাম না।
আপনি কোন উত্তরটি খুঁজতেছেন, বুঝিয়ে বলুন।
খুবই প্যাচালো পোস্ট।
ফিজিক্স এর স্টুডেন্ট বাদে অল্প কিছু মানুষই বুঝতে পারবে।
নাই থেকে আছে হয়ে যাওয়াটা আস্তিকদের সবচেয়ে বড় আর্গুমেন্ট। তাই পোস্টটির সাথে একটি conclusion add করে সহজতর করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
পোষ্টটি ভালো লেগেছে খুব তথ্য পূর্ণ এবং পদার্থ বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুতর বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
ভালো লাগলো লেখাটি, পদার্থ বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।