সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত পূর্বপুরুষত্বের হিন্দুত্ববাদী প্রোপাগান্ডা
একটা ইন্ডিয়ান নিউজ মিডিয়ায় একটা প্রোপাগান্ডা দেখলাম। সেখানে হরপ্পা সিভিলাইজেশনের একটি জিনতাত্ত্বিক গবেষণার প্রসঙ্গ এনে বলা হচ্ছে, এতে প্রমাণিত হচ্ছে ভারতবর্ষে এরিয়ান মাইগ্রেশন হয়নি।(১) ঘুরে ফিরে সেটায় হিন্দুত্ববাদী ইন্ডিজেনাস এরিয়ান বা আউট অফ ইন্ডিয়া তত্ত্বের সাফাই গাওয়া হচ্ছে, যেখানে দাবী করা হয় যে “আর্য জাতির” উদ্ভব ভারতবর্ষেই, এরা বাইরে থেকে আসেনি, বরং এখান থেকেই এরা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। কিন্তু একটু ঘেটে দেখলাম সেটা আসলে এরিয়ান মাইগ্রেশন নিয়ে কিছুই বলেনা…
আসল গবেষণাটির লিংক তথ্যসূত্রে দেয়া হয়েছে,(২) আমি সেটা থেকে কী জানা গেল তা সংক্ষেপে বলছি। ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উঠে এসেছে।
গবেষকগণ জানতেন যে সিন্ধু সভ্যতার লোকেদের মধ্যে ইরানিয়ান এনসেস্ট্রি বা ইরানীয় পূর্বপুরুষত্ব ছিল, সাউদ এশিয়ান এন্সেস্ট্রি বা দক্ষিণ এশীয় পূর্বপুরুষত্বও হয়তো ছিল। আবার এটাও নিশ্চিত যে তারা কৃষিকাজ করত। কিন্তু এটা কেউই জানত না যে সিন্ধু সভ্যতার এই লোকেরা ইরানিয়ান অঞ্চল থেকে ঠিক কোন সময়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে সিন্ধুসভ্যতা তৈরি করেছিল। যারা তৈরি করেছিল তারা আসলেই ইরান থেকে আসা কৃষক ছিল (যেখানে খ্রি.পূ. দশ হাজার অব্দের দিকে ফারটাইল ক্রিসেন্টে কৃষির সূচনা হয়), নাকি এরা হার্ডার বা হান্টার-গ্যাদারার বা শিকারী-সংগ্রাহক ছিল। অনেকে ধরে নিয়েছিল যে তারা আসলে ইরানেরই কৃষক ছিল যারা সিন্ধু সভ্যতায় এসে কৃষির সূচনা করে। কিন্তু এই গবেষণা বলল ভিন্ন কথা। আসলে ইরানিয়ান ফার্মার বা ইরানীয় কৃষক নয়, বরং ইরানিয়ান হান্টার গ্যাদারাররাই স্বাধীনভাবে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, তারা স্থানীয় সাউদ এশিয়ান হান্টার-গ্যাদারার বা শিকারী সংগ্রাহকদের সাথে মিশ্রিত হয়ে (যাদের সাথে আন্দামানিজদের জেনেটিক্সে মিল আছে), এবং স্বাধীনভাবে (অর্থাৎ ইরানীয় ফার্মারদের কোন সাহায্য ছাড়াই) সিন্ধু সভ্যতায় কৃষির সূচনা করে।
যেহেতু সিন্ধু সভ্যতার শেষে স্তেপ জিন নিয়ে ইন্দো ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে (যাদেরকে অনেকে আর্য বলে থাকে), সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সিন্ধু সভ্যতার এই স্যাম্পলে স্তেপ জিন পাওয়া যাবার কথা না, পাওয়া যায় নিও। সেই সাথে পাওয়া যায়নি আনাতোলিয়ান ফারমারদের জিনও।
এই আনাতোলিয়ান ফার্মার বা আনাতোলীয় কৃষকদের নিয়েও দু চারটি কথা বলা দরকার। ফার্টাইল ক্রিসেন্টে কৃষির বিস্তারের পর, আনাতোলিয়া বা বর্তমান তুরস্কেও খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দের দিকে কৃষির বিস্তার শুরু হয়। আগে ধারণা করা হত, ফারটাইল ক্রিসেন্টের লোকেরাই আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করে কৃষির সূচনা করে, কিন্তু পরে জানা গেল যে তা হয়নি। বরং আনাতোলিয়ার হান্টার-গ্যাদারাররাই স্বাধীনভাবে কৃষির সূচনা করেছিল, ঠিক যেমন সিন্ধুসভ্যতায় হয়েছিল। কিন্তু তাই বলেকি ইউরোপে কৃষির সূচনায় মাইগ্রেশনের প্রভাব নেই? আলবত আছে। পরবর্তীতে এই আনাতোলিয়ান ফার্মাররাই ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে মাইগ্রেট করে কৃষিকে গোটা ইউরোপে পৌঁছে দিয়েছিল স্টারসেভো-কোরস-ক্রিস কালচার, ফানেল বিকার কালচার, লিনিয়ার পটারি কালচার গঠনের মাধ্যমে। এসব কালচার ইউরোপে ইন্দো ইউরোপীয়দের প্রবেশের পূর্বেই বর্তমান ছিল।
এদিকে এই আনাতোলিয়ান হান্টার-গ্যাদারারদের একটা অংশ (কৃষক নয়) ইরানীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে ইরানীয়দের সাথে মিশ্রিত হয়। এরপর এরাই ইরানিয়ান ফারমার বা ইরানীয় কৃষকগোষ্ঠী (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল উভয়ই) তৈরি করে, অর্থাৎ আনাতোলীয় ও ইরানীয়দের মিশ্রিত জাতি (যদিও ইরানীয় জিনই অধিক) ইরানীয় অঞ্চলের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কৃষির বিস্তার করে। সেহেতু ইরানীয় কৃষকদের মধ্যে ওই আনাতোলিয়ান জিন পাওয়া যায়। সুতরাং বলা যায় যদি ইরানিয়ান ফারমাররাই ভারতবর্ষে এসে সিন্ধুসভ্যতায় প্রবেশ করে কৃষির সূচনা করে থাকত, তবে সিন্ধুসভ্যতার লোকের মধ্যেও আনাতোলিয়ান জিন পাওয়া যেত। কিন্তু তা তো পাওয়া যায়নি, সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ইরানিয়ান ফার্মাররা সিন্ধুসভ্যতায় কৃষির সূচনা করেনি, বরং ইরানিয়ান হান্টার-গ্যাদারার বা ইরানীয় শিকারী-সংগ্রাহকগণ আরও পূর্বে ইরানীয় অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে সিন্ধু সভ্যতায় কৃষিকাজ স্বাধীনভাবে শুরু করেছে।
এদিকে ইউরোপে যেমন আনাতোলিয়ান ফার্মারদের দ্বারাই সমগ্র ইউরোপে কৃষি ছড়িয়ে গেছে, তেমনি সমগ্র ভারতবর্ষেও এই সিন্ধু সভ্যতার লোকেদের দ্বারাই কৃষি ছড়িয়ে থাকতে পারে, যদিও তা এখনও প্রমাণিত হয়নি, গবেষকগণ ধারণা করছেন মাত্র। লক্ষণীয় যে, পরবর্তীতে ভারতবর্ষে আসা ইন্দো-আর্যরা কিন্তু কৃষিজীবি ছিল না, স্তেপ প্যাস্টোরালিস্ট ছিল, তারা কৃষি নিয়ে আসেনি, বরং কৃষিকে গ্রহণ করেছিল।
মোদ্দাকথা হল, অনেক জায়গায় যেমন দাবি করা হচ্ছে যে এই গবেষণা প্রমাণ করছে “আর্যরা” বাইরে থেকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেনি, তা প্রোপাগান্ডা মাত্র, কেননা এরিয়ান মাইগ্রেশন নিয়ে এই গবেষণা কিছু বলছেই না। সুতরাং সাবধান করা হচ্ছে। এরকম প্রোপাগান্ডা দেখে দিকভ্রান্ত হবেন না।
(চিত্রে নীল, কমলা ও লাল দিয়ে যথাক্রমে আনাতোলিয়ান, ইরানিয়ান ও সাউদ এশিয়ান হান্টার-গ্যাদারারদের লিনিয়েজ বোঝানো হয়েছে।)
তথ্যসূত্রঃ
১। Rakhigarhi DNA study questions Aryan invasion theory, claims author
২। মূল গবেষণাপত্রটি পড়ুন এখান থেকে –
An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers
1.আর্যদের সাথে বেদ বা বৈদিক যুগের কোনো সম্পর্ক আছে কী?
2. বৈদিক সংস্কৃত প্রথম কোন লিপিতে লেখা হয়? 1500 বছর ধরে অবিকৃত ভাবে কোনকিছু মুখস্ত করে নিয়ে আসা সম্ভব?
3. আর্যরা কি যজ্ঞ করত, এর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে?
4. সিন্ধু সভ্যতায় স্তূপ কেনো পাওয়া গেছে?
5. আর্যরা কেনো নগরে এসেও নগরে বসবাস করেনি?
6. 1000 খ্রিস্টাব্দে কেনো আলবেরুনি সরস্বতী নদীর চর্চা করেছিলেন?
7. ভারতের সিন্ধু লিপির সাথে ব্রাহ্মী লিপির মিল পাওয়া যায় কেনো?
8. কোনো বৈদশিক পর্যটক কেনো চার বেদের বর্ণনা করেন নি?