সম্পাদকীয়অবশ্যপাঠ্যস্যাটায়ার

আল্লাহর সাক্ষাৎকার। পর্ব – ১

১.

আমি ভালভাবেই জানই, অনেক নাস্তিক মুনাফেক কাফের অবিশ্বাসী লোকজন আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তারপরেও ইমানদার ভাইদের উদ্দেশ্যে বলছি। গতকাল রাতে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে টয়লেটে গিয়ে টয়লেট করে বেসিনের কলটা ছাড়তেই দেখলাম, একজন ধবধবে সাদা পোষাক পড়া দাড়িওয়ালা বুড়ো ভদ্রলোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী ব্যাপার, আপনি আমার ফ্ল্যাটে কীভাবে ঢুকলেন? চাবি পেলেন কোথায়? চুরি করতে এসেছেন নাকি? বেটা চোর!

এই কথা বলেই আর কিছু না ভেবে আমি তাকে চড় থাপ্পর মারা শুরু করলাম। এত রাতে আরেকজনার বাসায় বিনা অনুমতিতে ঢোকা জার্মান আইনে মস্তবড় অপরাধ। সত্যি বলতে কী, এমন হুট করে একজনকে আমার বাসায় দেখে আমি একটু ভড়কেই গিয়েছিলাম। আমার কিলঘুষি খেয়ে সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, আরে করেন কি করেন কি। থামেন থামেন। আমি জিব্রাইল। পেশায় একজন ফেরেশতা। চাকরি করি আল্লাহ পাকের হেড অফিসে। থামেন ভাই, আর মাইরেন না। নাকটা একদম দেখি ফাডায়া দিছেন। আমি তো খালি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

আমি আরেকবার ভিমড়ি খেলাম। এ কী জিব্রাইল বললো, না আজরাইল বললো? কানে ঠিক শুনেছি তো? অবাক হয়ে বললাম, মানে কী? কোথায় নিয়ে যেতে এসেছেন? মিয়া এত রাতে মজা করেন?

সে বললো, শুনেছি আপনি একজন ভয়াবহ উগ্র নাস্তিক। খালি আল্লাহ, আল্লাহর নবী আর ইসলামের কঠোর সমালোচনা করেন। পুরাই ইসলাম বিরোধী, যাকে বলে ইসলাম বিদ্বেষী। তাই আল্লাহ পাক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপনার সাথে সাক্ষাত করে নিজেই আপনাকে উনার দিদার লাভের সুযোগ দেবেন। যেন আপনার মত নাস্তিকের মনে আর কোন সংশয় না থাকে। ঐ যে নিচে তাকিয়ে দেখুন, বোরাক ঘোড়া সাথে নিয়ে এসেছি।

আমি জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম, আরে! আসলেই তো। এক পাখনাওয়ালা ঘোড়া আমার বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে আরেকটি ঘোড়া। ঐটা মনে হয় এই বেটা জিব্রাইল না আজরাইলের।

আমি বললাম, আচ্ছা, আপনি কোন কিডনাপার গ্রুপের লোক না তো? কিংবা আজরাইল না তো?

সে বললো, আরে না না, কী যে বলেন। আমি আজরাইল না। জিব্রাইল। অনেকদিন পরে দুনিয়াতে আসলাম। শেষবার এসেছিলাম সেই শেষ নবী মুহাম্মদের আমলে, আরব দেশে। সবকিছু কেমন বদলে গেছে। সেই ধুধু মরুভূমি, এখন দেখতেছি সুজলা সুফলা সাজানো গোছানো ইউরোপ। বাই দ্যা ওয়ে, এইসব দেশে চাকরিবাকরি পাওয়া যায় নাকি? পার্মানেন্ট ভিসা দেয়?

আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, আরে রাখেন মিয়া ভিসা আর চাকরি। আগে বলেন, আমাকে নিতে কেন এসেছেন? আমি কী নবী রাসুল হয়ে গেলাম নাকি?

সে বললো, আরে না! আল্লাহ পাক অনেকদিন ধরেই আপনার দিকে নজর রাখছেন। আপনার ব্লগ উনি নিয়মিতই পড়েন। এই যে সংশয় নামে ওয়েবসাইট খুলে বসেছেন। আল্লাহ আপনার ফেইসবুকের স্ট্যাটাসও পড়েন। তা দেখেই আপনাকে উনি প্রমাণ দেখাতে চান যে, উনি আসলেই আছেন।

আমি বললাম, তা এত নাস্তিক থাকতে আমাকেই কেন নিতে হবে? তাছাড়া আমার এখন ঘুমাবার সময়। অন্য এক সময়ে আসা যায় না? কাল আবার অফিস আছে।

তিনি বললেন, আসলে, আপনাকে প্রমাণ করে দিতে পারলে এই যুগের অনেক বড় বড় নাস্তিকরাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। আপনি সবচাইতে উগ্র নাস্তিক কিনা, তাই। আর আল্লাহ পাক এখুনি আপনাকে তলব করেছেন। এখুনি যাওয়া জরুরি।

আমি মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা, কী আর করা। যাই না হয়। অনেকদিন ঘুরতে টুরতে যাই না। এই চান্সে মহাকাশ দেখে আসা যাবে। শুনেছি স্টিফেন হকিং নাকি মহাশূন্যে যাচ্ছেন, যদি মহাকাশে তার সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে তো ভালই হয়। নতুন বইটা সম্পর্কে কিছু আইডিয়া পাওয়া যাবে। কিছু বিষয় একদমই বুঝি নাই।

এই ভেবে জামাটা চেঞ্জ করে নিলাম। নিচে নামতেই দেখি, ঘোড়াটা উড়ার জন্য প্রস্তুত। আমি জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ঘোড়া মহাকাশ পাড়ি দেবে? ধুর, মিয়া মজা লন! একটা স্পেসশিপ আনলে হতো না? মহাকাশে অক্সিজেন পাবো কোথায়? অক্সিজেন মাস্ক কই? আর এই ঘোড়া না হয় দুনিয়ায় পা দিয়ে দৌঁঁড়ালো, পাখনা দিয়ে বায়ুমন্ডল অতিক্রম করলো, কিন্তু বায়ুমণ্ডলের ওপরে পাখনা দিয়ে কী হবে? পাখনা দিয়ে মহাকাশ পাড়ি দেবে, ডানা ঝাঁপটে? ফাইজলামি করেন মিয়া?

জিব্রাইল বললো, এই ঘোরা উড়বে বিশ্বাসের জোরে। এত সন্দেহ কইরেন না মিয়াভাই। এত সন্দেহ করলে ঘোড়ায় উড়তে পারবে না।

আমি বললাম, আচ্ছা সবই বুঝলাম। আর এত দূরের পথ, এনার্জি সোর্স কী এই ঘোড়ার? কী ধরণের ফুয়েল ব্যবহার করা হবে?

জিব্রাইল কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে খাস ঢাকাইয়া ভাষায় বললো, এই নাস্তিকদের নিয়ে মহা মুসিবত। আপনেরে ঘোড়ায় চড়তে কইছি চড়েন মিয়া। এত ক্যাচাল করেন ক্যা? বালের চাকরি করি, কোন বেতন বুতন নাই, সরকারি ছুটি নাই, খালি সারাদিন উপাসনা আর উপাসনা। মরার জিন্দেগীতে কিছুই করবার পারলাম না হালায়। এত কথা জিগাইয়েন না। আমি এতকিছু জানি না। আল্লাহর হুকুমে ঘোড়া উড়ে, আমি ক্যামনে জানমু এইসব ক্যামনে কী হয়। আমি কী স্কুলে গিয়া বিজ্ঞান পড়ছি নাকি?

আমি কাচুমাচু করে বললাম, আচ্ছা বস, স্যরি। জানতাম না আপনের চাকরিতে এতো ক্যারফা। লন যাই, আর কিছু জিগামু না।

এরপরে ঘোড়ায় চড়ে বসতেই ঘোড়া উড়াল দিলো। প্রথমে ঘোড়া গেল এক আসমানে। এরপরে প্রতিটা আসমানে এক একজন বর্ডার কন্ট্রোল অফিসার। গম্ভীর মুখে অফিসার জিজ্ঞেস করলো, ভিসা আছে? জিব্রাইল তখন আমার ভিসাটা দেখালেন। বর্ডার কন্ট্রোল অফিসার বিরক্ত মুখে বললেন, ও, আপনেই তাইলে সেই উগ্র নাস্তিক? যান, আপনের আজকে খবরই আছে। বলে একটা সিল মেরে ছেড়ে দিলেন। আমি এইসব কথা শুনে আরো একটু ভড়কে গেলাম আর কী। এরপরে এক এক করে এসে পৌঁছালাম সাত আসমানে। প্রত্যেকেরই দেখলাম বর্ডার কন্ট্রোল অফিসারের বিরক্ত চেহারা। এখানে চাকরিবাকরিতে সম্ভবত ঠিকমত পে করা হয় না। ছুটিছাটাও নাই। বেতনও মনে হয় না দেয়া হয়। এদের বানানোই হয়েছে গোলামি করার জন্য। ভাবলাম, দাসপ্রথা এখনো চালু আছে, এ এক বিস্ময়! এই আধুনিক যুগেও? খুব অন্যায়। এই নিয়ে আল্লাহর কাছে বলতেই হবে। এভাবে ফেরেশতাদের খাটানো উচিত না। অন্তত বছরে বিশটা ছুটি, এবং উৎসবের দিনগুলোতে ছুটি ফ্যামিলি ভ্যাকেশন ইত্যাদি দেয়া উচিত। নইলে একই কাজ করতে করতে এরা তো বোর হয়ে যায়। এই কারণেই মিকাইল ফেরেশতা ঠিকমত কাজকাম করে না। যেইখানে বৃষ্টি দরকার সেইখানে না দিয়ে যেখানে দরকার নাই সেইখানেই দেয়। সবই চাকরিবাকরিতে আনন্দ নাই বলেই তো! এসব ভাবতে ভাবতে সাত আসমানে পৌঁছে গেলাম। ঘোড়া থেকে নামলাম।

২.

ও আচ্ছা, এই তাহলে আল্লাহর আরশ! বাপরে, খুবই রাজকীয় অবস্থা দেখা যায়। আল্লাহর আরশের কাছে আসতেই দেখলাম, চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে গেছে। আল্লাহর নুর বলে কথা! একদমই নুরানী কুদরত চারিদিকে। উজ্জ্বল আলোর ছ্বটা, চারিদিকে সোনা মনি মুক্তো ছড়ানো। কী অদ্ভুত অবস্থা।

ধুম করে এক শব্দ হলো। প্রথমে বুঝলাম না কী। পরে বুঝলাম, এটাই আল্লাহর কণ্ঠস্বর। সে বললো, আসসালামু ওয়ালাইকুম হে আসিফ মহিউদ্দীন। হে নালায়েক উগ্র নাস্তিক! কেমন আছিস?

আমি আসলে একটু ভয়ই পেলাম। গলাটা একদমই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তো আর বুঝতে দেয়া যায় না। নাস্তিকের মান সম্মান বলে কথা। একটু মোটা গলা করে বললাম, ওয়ালাইকুম আস সালাম হে আল্লাহ পাক। আমি ভালই আছি। আপনার শরীর কেমন?

সে হুঙ্কার দিয়ে বললো, এখন বিশ্বাস হলো তো আমাকে? নাকি এখনো কোন সন্দেহ? আরে বেটা, আমার কী শরীর আছে রে? আমি হচ্ছি আল্লাহ! মহান আল্লাহ পাক। অসীম দয়ালু। যাকে তুই সারাজীবন গালমন্দ করেছিস!

আমি বললাম, শরীর না থাকলে এই যে আপনার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, এর জন্য তো একটি ফুসফুস দরকার। জিহবা এবং ঠোঁঁট দরকার। না হলে আপনি উচ্চারণ করছেন কীভাবে? আমরা জানি যে, শব্দ উচ্চারণের জন্য এসব দরকার হয়। তা যদি না হয়, কোন যন্ত্র অবশ্যই দরকার। যেমন রেডিও টিভি আর কি। সেই যন্ত্রে ইলেক্ট্রিসিটিও দরকার। রেডিও টিভিতে কীভাবে সাউন্ড তৈরি হয় তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। তাছাড়া, কোরানে আপনি নিজেই বলেছেন,

আল্লাহ তোমাদিগকে আপন  নফসের ভীতি প্রদর্শন করছেন । আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। (আল ইমরান ৩০)

নফস শব্দের অর্থ হচ্ছে দেহ। বা শরীর। আপনি নিজেই বলেছেন আপনার দেহ আছে। অসংখ্য হাদিসেও বলা আছে, আপনার হাত আছে পা আছে। তাহলে এখন আবার উলটা কথা বলার মানে কী?

আল্লাহ পাক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এরপরে বললেন, বেয়াদব কোথাকার! আমাকে সচোক্ষে দেখবার পরেও তর্ক করছিস? সাহস তো কম না? এখনো বিশ্বাস আনলি না?

আমি বললাম, বিশ্বাস আনা না আনা পরের বিষয়। আমি তো তোমার নবী রাসুলদের মত না, যে যাচাই না করেই বদহজম জনিত দুঃস্বপ্নকে সত্যি ভেবে নেবো। এমনও তো হতে পারে, এটা আমার স্বপ্ন। রাতের বেলা ছাই পাশ খেয়ে এখন বাজে স্বপ্ন দেখছি। বা আমাকে নিয়ে কোন রসিকতা করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই চিপায় চাপায় কোন ভিডিও ক্যামেরা সেট করা। একটু পরেই লোকজন বের হয়ে বলবে, এতক্ষণ ইউটিউবে আপলোডের জন্য এই মজাটা করা হচ্ছিল। প্র‍্যাঙ্ক ভিডিও দেখেন নি? কত লোক বানাচ্ছে আজকাল। ভারতে সাইরাস নামের এক এম টিভির ভিজে বাকরা নামে একটা অনুষ্ঠান বানাতো।

আল্লাহ আরো জোরে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তবে রে বদমাইশ! সাত আসমান নিয়ে আসার পরেও অবিশ্বাস! শালার নাস্তিকদের কলবে আমি সিল মেরে দিছি কী সাধেই! বল, কী হলে তুই বিশ্বাস আনবি?

আমি বললাম, কলবে সিল মেরেছেন আপনি, বিচার বুদ্ধিও দিয়েছেন আপনি। সেগুলো ব্যবহার করেই তো যা বলার বলছি। তাই বেয়াদবি কিছু হলে তার দায় আপনারই। আপনাকে কে বলেছিল কলবে সিল মেরে আমাকে পাঠাতে? আমি আপনের পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিলাম নাকি, আমার কলবে সিল ছাপ্পর মেরে দিন?

– বেয়াদব কোথাকার। কোন মান্যগণ্য করা শিখিস নি?

– মান্যগণ্য অবশ্যই করি। আপনি বৃদ্ধ মানুষ, এত বছর ধরে বেঁচে থাকা কম কষ্টের কাজ না।  

– কোরআন পড়িস নি, সেখানেই তো আমি বলেছি, আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করি।

– যা ইচ্ছা যদি তাই করেন, তাহলে আপনাকে তো জালিম ছাড়া আর কিছুই বলা সম্ভব নয়। যাইহোক, তাহলে এক কাজ করা যেতে পারে। আসুন আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিই। সেটা আমার ব্লগে পোস্ট করবো। সাক্ষাৎকারের মধ্যেই আমার যত সন্দেহ বা সংশয় নিয়ে আলাপ করা যাবে। অন্যরাও এই লেখাটি পড়ে আপনার সম্পর্কে জানতে পারবে, এবং বিশ্বাস আনতে পারবে। কী বলেন?

আল্লাহ বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। জিজ্ঞেস কর কী জিজ্ঞেস করবি।
-তার আগে আপনার সাথে একটা সেলফি নিই আল্লাহ পাক?
-খবরদার বেয়াদব, জানিস না আমি ছবি তোলা হারাম করেছি?
-আচ্ছা ঠিক আছে, স্যরি। ছবি লাগবে না। প্রথমেই আপনাকে যা বলা দরকার, সেটা হচ্ছে তুই তুকারি করবেন না। আপনি আল্লাহ বলে এমন কোন চ্যাটের বাল হয়ে যান নাই যে, অভদ্রের মত তুই তুকারি করবেন। ভদ্রভাবে উত্তর দেবেন। গালাগালি করবেন না।

আল্লাহ আমতা আমতা করে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি করে বললে চলবে? শত হলেও আমি তো বয়সে বড়, নাকি? তোকে আপনি তো আর বলা যায় না।
আমি বললাম, আচ্ছা, তুমিতে আপাতত কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি যে শুরুতে আমাকে সালাম দিলেন, সালামের অর্থ হচ্ছে আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তা আপনি কার কাছে এই কামনা করলেন?

– আরে ওটা তো কথার কথা। এমনিতেই বলি আর কি।
– ও আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে। যাই হোক, শুরু থেকেই শুরু করি। প্রথম প্রশ্ন। আপনার নাম কী?
– আমার নাম? আমার নাম আল্লাহ। আমার নাম স্রষ্টা। রহমানুর রাহিম। আরো ৯৯ টা প্রশংসাসূচক নাম আছে আমার।
– এই নামগুলো কে রেখেছে? আপনার বাবা মা?
– আরে বেয়াদব! আমার নাম আবার কে রাখবে? আমি নিজেই রেখেছি।
– মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার এইসব প্রশংসা সংবলিত নাম আপনি নিজেই নিজেকে দিয়েছেন, তাই তো? নিজেই নিজের নাম রেখেছেন দয়ালু, করুনাময়, ন্যায়বিচারক, ইত্যাদি? বেশ বেশ! এই সার্টিফিকেটগুলো নিজেই নিজেকে দিলেন? আপনি কী নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসওর্ডার নামক মানসিক সমস্যাটির নাম শুনেছেন? এই মানসিক সমস্যাটি হলে কী হয় জানেন?

– বেয়াদব কোথাকার! আমার নাম আমি দিলে তোমার সমস্যা কোথায়?
– না সমস্যা নাই তেমন কিছু। বলছিলাম কী, ইয়ে মানে এটা একটা মানসিক সমস্যা। এইসব সার্টিফিকেট নিজেকেই নিজে দেয়া যায় না। এই ধরণের কথা পৃথিবীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই বলে থাকে। নিজেই নিজেকে অমুক তমুক দাবী করা আর কী! সে যাই হোক। এবারে দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনার সৃষ্টি কীভাবে হলো? কে আপনার স্রষ্টা?
– তবে রে নালায়েক, আমার আবার স্রষ্টা কিসের? আমাকে কেউ সৃষ্টি করে নি। আমি প্রাকৃতিক। আমি কোন সৃষ্টি না।
– তারমানে বলতে চাচ্ছেন, আপনি নিজে একজন নাস্তিক? মানে আপনি আপনার স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না?

– না। আমার কোন স্রষ্টা নাই।
– আপনি কী এই বিষয়ে নিশ্চিত? যেমন ধরুন, ধর্মান্ধ মুসলমানরা সেই মধ্যযুগে এক ধরণের যুক্তি দিতো। যে মায়ের পেটে জমজ বাচ্চা একে অন্যের সাথে আলাপ করছে। একজন বলছে, এই পেটের বাইরে আর কিছু নেই। আরেকজন বলছে, এই পেটের বাইরে আরেক পৃথিবী আছে। এই যুক্তি দিয়ে তারা বোঝাতে চাইতো, মরার পরেও জীবন আছে। সেই একই যুক্তিতে, আপনার এই আরশের বাইরে আরেক মহা-মহা-বিশ্ব আছে কিনা, সেখানে আপনার পাপ পূণ্যের বিচার হবে কিনা, আপনি কী নিশ্চিত? কেউ আপনার দিকে খেয়াল রাখছে কিনা, আপনার দোষগুণ হিসেব করছে কিনা, আপনি কি নিশ্চিত?

আল্লাহ(একটু কনফিউজড ভঙ্গিতে) – এরকম কোন প্রমাণ আমি পাই নি।
– কিন্তু প্রমাণের প্রশ্ন আসছে কীভাবে? আপনি কী প্রমাণ করতে পারবেন, আপনার কোন স্রষ্টা নাই?
– না, তা পারবো না।
– তাহলে মেনে নিতে আপত্তি কিসের?
– বেটা, তুই আসলেই একটা বজ্জাত।
– আপনি কোন প্রশ্নেরই ঠিকমত জবাব দিচ্ছেন না। এটা ঠিক না। আচ্ছা যাইহোক, তাহলে বোঝা গেল, আপনি একজন নাস্তিক। যে স্রষ্টায় বিশ্বাসী না। তাহলে পরের প্রশ্নে যাচ্ছি। আপনি কী দিয়ে তৈরি? নুরের?

– হ্যা, আমি নুরের তৈরি।
– নুর মানে আমরা জানি আলো। আমরা এখন জানি, আলোর কিছু ধর্ম রয়েছে। তার কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। তাহলে আপনি যেহেতু নুরের তৈরি, সূত্র মতে আপনিও সেই সব নিয়মের মধ্যেই থাকবেন। অর্থাত আপনি নিজেই সেই সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই না?
– না, আমি কোন কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রত নই। আমি যা ইচ্ছা করতে পারি।
– মানে আপনি বলছেন, আপনার যা ইচ্ছা তাই আপনি করতে পারেন? কিন্তু আমরা তো জানি, আপনি শুধু ভাল কাজটিই করেন। খারাপ কিছু আপনি করতেই পারেন না। তাহলে আপনি কী নিজেই ভাল কিছু করতে দায়বদ্ধ নন? মানে আপনি ভাল কিছু করার নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন?

– তুই একটা আস্তা বেয়াদব!
– আবারো তুই তুকারি শুরু করলেন। যাই হোক, এবারে বলুন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে আপনি কী করছিলেন?
– কিছুই করছিলাম না। তখন আমি ফেরেশতা বানিয়েছিলাম, জ্বীন বানিয়েছিলাম।
– সেই সবকিছু বানাবার আগে?
– কিছুই করছিলাম না।
– ঠিক কতটা সময় আপনি এরকম বেহুদা বসে ছিলেন?
– অনন্তকাল।

– তা এই অনন্তকাল বেহুদা বসে কী করছিলেন? ভাবছিলেন? নাকি অন্য কোন কাজ?
– ধরো, হুদাই বসে ছিলাম। তো?
– মানে বুঝতে চাচ্ছিলাম, সেই সময়ে কী আপনি জানতেন, যে একদিন আপনি মহাবিশ্ব বানাবেন? আপনি তো শুনেছি ভবিষ্যত জানেন। তাহলে বেহুদা বসে না থেকে আরো আগেই বানালেন না কেন?

– আগে বানাই পরে বানাই তাতে তো কী? আমার ইচ্ছা যখন তখনি বানামু।
– মানে আমার জিজ্ঞাসা ছিল, ধরুন আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমি একটা বাড়ি বানাবো। তাহলে অনন্তকাল বেহুদা বসে থেকে, কোন কাজ কাম না করে অনন্তকাল অপেক্ষার পরে মহাবিশ্ব এবং যাবতীয় কিছু বানাবার কারণ কী? অনর্থক বেহুদা এতদিন বসে ছিলেন কেন? তাছাড়া বিগ ব্যাং তত্ত্ব থেকে যা এখন অনেক কিছুই জানি আর কি। সময় এবং স্থান তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং এর পরে। তার আগে সময় বা স্থানের অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে আপনি কোন সময়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, যে মহাবিশ্ব বানাবেন? সেই সময়ে আপনার আরশটা কই ছিল? কোন স্থানে? আপনিই বা কই বসে ছিলেন?

– এইসব জিজ্ঞেস করতে তোরে এতো দূরে এনেছি নালায়েক?
– আপনি আবারো মুসলমানদের মত গালাগাল শুরু করলেন। আমি তো ভদ্রভাবে প্রশ্ন করছি। আচ্ছা যাইহোক। এরপরে আপনি ফেরেশতা বানালেন আপনার দাসত্ব করার জন্য। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে দাস প্রথা তো উঠে গেছে। এই ফেরেশতাদের এখনো আপনি খাটিয়ে মারছেন, এ তো অন্যায়।

– এদের বানানোই হয়েছে আমার গোলামি করার জন্য।
– যেকারনেই বানানও হয়ে থাকুক। যেমন ধরুন, সৌদি আরবে বাঙালি শ্রমিক নিচ্ছে কাজ করাবার জন্য। কিন্তু তাই বলে শুধু খাটিয়ে মারবে তা তো হয় না। তাদেরও জীবন আছে। তারা আনন্দ ফুর্তি করবে, ঘুমাবে, বিবি বাচ্চার সাথে একটু সময় কাটাবে, তা হলেই তো তারা কাজে আনন্দ পাবে। একসময়ে সাদা চামড়ার মানুষও ভাবতো, কালো চামড়ার মানুষদের সৃষ্টিই করা হয়েছে সাদাদের গোলামী করার জন্য। কিন্তু সেই পুরনো অসভ্য বর্বর ধারণাকে আমরা ত্যাগ করেছি। আপনারও উচিত সেইসব মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসা।

– দেখ আসিফ, এইসব আস্তে বল। ফেরেশতারা শুনতে পেলে তারা না আবার বিদ্রোহ করে বসে।
– তা তো করাই উচিত। অনন্তকাল এদের সেবা আপনি নিয়েছেন, এবারে এদের একটু নিজের ইচ্ছামত স্বাধীন জীবন যাপন করতে দিন না!
– পরের প্রশ্ন করো। চুপ থাক।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। এরপরে জিজ্ঞেসা হচ্ছে, আপনি শুনেছি জ্বীন জাতিকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, নাকি?
– হ্যা, ঠিকই শুনেছো।

– কিন্তু আগুন তো কোন পদার্থ না, যে তা দিয়ে কিছু সৃষ্টি করা যায়। আগুন হচ্ছে জাস্ট একটা ক্যামিকেল রিয়্যাকশন। সেটা তো আলাদা কোন পদার্থ বিশেষ না।
– তোর কাছে আমার বিজ্ঞান শিখতে হবে?
– আপনি রাজনৈতিক নেতাদের মতই প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা, তাহলে পরের প্রশ্ন। শয়তান আপনাকে এত লক্ষ কোটি বছর উপাসনা করলো, তার বিনিময়ে আপনি তাকে এতোবড় শাস্তি কেন দিলেন?

– শয়তান আমার হুকুম পালন করে নি।
-কিন্তু ছোট্ট একটা হুকুম পালন করে নি, সেটা হচ্ছে আদমকে সিজদা না করা। এখন আপনিই বলেন, আমার চাইতে বয়সে ছোট কাউকে এনে যদি আমাকে বলেন, ওকে সিজদা করো, আমি তো কখনই তা করবো না। শয়তানকে তো আমার মনে হয়েছে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন উন্নত চরিত্রের ভদ্রলোক। কাল আপনি বালছাল কাকে না কাকে ধরে আনবেন আর আমার তাঁকে সিজদা করতে হবে নাকি? এটা কী সম্ভব?
-আমি যা হুকুম দেবো সেটাই পালন করতে হবে! এখানে কোন বিচার বিবেচনার সাথেন নেই।
-বাহ, এটা কেমন কথা হলো। বিচার বিবেচনাই যদি না করি, তাহলে আমরা রোবটের চাইতে উন্নত কীভাবে? মগজ খাটানো আপনার এত অপছন্দ কেন?
– পরের প্রশ্ন কর।
– আপনি কোন প্রশ্নেরই ঠিকঠাক জবাব দিচ্ছেন না। আচ্ছা যাই হোক, এবারে বলুন, আদমকে আপনি কী দিয়ে বানালেন?
– সেটা তো কোরানেই লিখে দিয়েছি। মাটি দিয়ে।

– আল্লাহ, আমাকে কী আপনি গর্দভ পেয়েছেন? মাটির ক্যামিকেল এলিমেন্ট আর মানব দেহের ক্যামিকেল এলিমেন্ট এক হলো? কীসের সাথে কী? মানে মামদোবাজির তো একটা সীমা আছে নাকি?
– বেয়াদব, তুই তো এগুলো বিশ্বাস করবিই না।
– আচ্ছা, তাও মানলাম। আপনি আদম হাওয়াকে বানালেন। আদম হাওয়ার ছেলেপেলে হলো। কিন্তু তাদের বংশ বিস্তার কীভাবে হলো? ভাই বোন ছেলে মা এদের যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে?
– তখনকার দিনে এইসব জায়েজ ছিল।
– মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি সময়ে সময়ে আপনার বেঁধে দেয়া নিয়ম পাল্টান? মানে প্রাচীন কালের জন্য এক নিয়ম, আধুনিক সময়ের জন্য আরেক নিয়ম?

এই প্রশ্নটা করতেই, অবাক কাণ্ড, দেখলাম ইসলাম ধর্মের মহানবী হযরত মুহাম্মদ এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যীশু খ্রিস্ট গলাগলি করে আল্লাহর আরশে প্রবেশ করলেন। তাদের একসাথে গলাগলি করে ঢুকতে দেখেই আমি মূর্ছা গেলাম।

(ক্রমশ)

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

17 thoughts on “আল্লাহর সাক্ষাৎকার। পর্ব – ১

  • Asif vhi, please make effort to made a telifilm about this topic, it will change whole muslim world!

    Reply
  • Sanvi Salehin

    দারুণ হয়েছে

    Reply
  • Ayon Rahman Holud

    asif vaiya apni paren…
    ..selut apnake…
    ami tho ekjon musolman ..
    allah jodi theke thake thobe amader allah muhammoder allah na…
    gaza kheye muhammodh ja bolchen tha mene neya ekjon gazakhur e pare..
    ami tho abar ghuhay ghiye gaza khay na….

    Reply
  • Sabuj Acharjee

    দারুন সাক্ষাৎকার টেলিফিল্ম হওয়া দরকার।

    Reply
  • স্মৃতিজিৎ

    আপনার ট্যালেন্টকে কুর্নিশ ! পরের পর্ব পড়ার অদম্য ইচ্ছা রইল । আপনার এই লেখা নিয়ে ফিল্ম হওয়া দরকার । ভালো থাকবেন দাদা !

    Reply
  • পর্ব-২ লিখবেন না?

    Reply
  • I Love Myself

    ভাল লিখেছেন। এগিয়ে যান

    Reply
  • মুজতবা আলি

    খুব মজা হলো ভাই। প্লিজ পর্ব ২ লিখুন

    Reply
  • নতুন পর্বের আশায় রইলাম।

    Reply
  • Peter olil

    Questionগুলো আমার মাথাতেও ঘুর পাক খাচ্ছে…ভাই এই পৃথিবীর উত্পত্তি কিভাবে??? এটা মাথায় আসছে না…বিষয় টা ভেঙে বলবেন????

    Reply
  • we want 2nd part ……

    Reply
  • পরের পর্ব গুলো কবে আসবে?অপেক্ষা করছি????

    Reply
  • Feroze Ahmed

    চমৎকার লিখেছেন ভাইয়া, তবে নবী মুহাম্মদ আর যিশুর সাথেও একটু কথাবার্তা বলতেন। আর বেহেস্ত দোজখ একটু ঘুড়েই আসতেন।

    Reply
  • Nogor full

    ভাই একা একা সবকিছুর মজা নিলেন!আমাকে সাথে নিলে কি হতো? যাক পরের বার মনে করে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবেন।

    Reply
  • rahim Mondol

    ভাইরে ভাই সেই মজা পাইছি সেই সেই।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *