ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস মানেই কি ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাস?
নাস্তিকতা নিয়ে সারা পৃথিবীজুড়েই অসংখ্য ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে আমার মতে সবচেয়ে বড় ভুল ধারণাটি হচ্ছে, ‘নাস্তিকরা মনে করে ঈশ্বর বলে কিছু নেই’। কেবল আস্তিকদের মধ্যেই যে এই ভুল ধারণাটি বিরাজ করে তা কিন্তু নয়, দুঃখজনকভাবে এমন অনেক নাস্তিকও আছেন যারা ভুল ধারণাটি পোষণ করেন।
ধর্মবিশ্বাসী লেখক, ব্লগার এবং ইউটিউবারদেরকে প্রায়ই সাধারণ মানুষকে নাস্তিকরা অন্ধবিশ্বাসী বলে বোঝানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। অনুসারীদেরকে তারা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, নাস্তিকরা মনে করে ঈশ্বর নেই। আমি জানিনা, তারা কেনো তাদের দর্শকদের সামনে নাস্তিকতাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেননা। তাদের কি নাস্তিকতার মতো সহজ একটি বিষয়ও বোঝার সামর্থ্য নেই? নাকি ধর্ম রক্ষার্থে নাস্তিকতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা তারা জরুরী মনে করেন? আমি জানিনা।
যাইহোক, এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ‘নাস্তিক মাত্রই এমন একজন ব্যক্তি যিনি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর বলে কিছু নেই’ এ প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করা। আশাকরি, প্রবন্ধটি অনেককেই তাদের ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে।
সূচিপত্র
ঈশ্বর আছে বিশ্বাস না করার মানেই ঈশ্বর নেই বিশ্বাস করা?
নাস্তিকতা শব্দটির অর্থ ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস বা বিশ্বাসের অভাব। নাস্তিক শব্দটির অর্থ একজন ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননা বা যার ভেতর ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের অভাব আছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করা বা ঈশ্বর আছে বিশ্বাস না করাই নাস্তিকতা। নাস্তিকতা কেবল এতটুকুই, কেবল ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, তার বাইরে কোনোকিছুই নাস্তিকতা নয়। কিন্তু, নাস্তিকতার সাথে অনেকেই অনেককিছু জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কারো কাছে নাস্তিকতা মানে ঈশ্বর নেই বিশ্বাস করা, কারো কাছে একটি মতবাদ, কারো কাছে ধর্ম, আবার কারো কাছে একটি দর্শন। না, নাস্তিকতা কোনো বিশ্বাস নয়, কোনো মতবাদ নয়, কোনো ধর্ম নয়, এমনকি কোনো দর্শনও নয়।
আস্তিক এবং দুঃখজনকভাবে নাস্তিকদেরও একাংশ বোঝেননা যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করার মানেই ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাস করা নয়, ঈশ্বর আছে বলে বিশ্বাস না করার মানেই ঈশ্বর নেই বলে বিশ্বাস করা নয়৷ না, ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস আর ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাস এক নয়।
ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস আর ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাস যে এক বিষয় নয় তা আমেরিকান এথিস্ট অ্যাকটিভিস্ট ম্যাট ডিলাহান্টি একটি দুর্দান্ত উপমার সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছিলেন। [1] অনুরূপ একটি উপমা ব্যবহার করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি।
ধরুন, আপনি এবং আপনার একজন বন্ধু রাস্তায় গল্প করতে করতে হাঁটছেন, হাঁটতে হাঁটতে একসময় রাস্তার এককোণে একটি মাটির ব্যাংক পড়ে থাকতে দেখলেন। ব্যাংকটিতে ঠিক কয়টি কয়েন আছে সেটা আপনিও জানেননা, আপনার বন্ধুও জানেনা। সংখ্যাটি জোড় নাকি বিজোড় সেটা আপনাদের দুজনের কেউই জানেননা। কিন্তু, আপনারা উভয়েই এবিষয়ে একমত হতে পারেন যে, সংখ্যাটি হয় জোড় নাহয় বিজোড় হবে।
আপনার বন্ধু দাবি করলেন, সংখ্যাটি জোড়। এখন, আপনি কি আপনার বন্ধুর দাবিটি বিশ্বাস করবেন? আপনি যদি খুব বোকা না হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি অন্ধভাবে দাবিটি বিশ্বাস করে ফেলবেননা। আপনি বরং আপনার বন্ধুকে প্রশ্ন করবেন যে, ‘সংখ্যাটি যে জোড় তার প্রমাণ কি?’ এখন, তার উত্তরে যদি আপনার বন্ধু বলে ‘তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করো সংখ্যাটি বিজোড়?’, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই প্রতুত্তরে বলবেন ‘না তো, আমি তো বলছি না সংখ্যাটি বিজোড়’।
লক্ষ্য করুন, আপনার বন্ধুর দাবি সংখ্যাটি জোড়, আপনি দাবিটি প্রত্যাখ্যান করার সাথেসাথে তিনি ধরে নিয়েছেন, আপনি মনে করেন সংখ্যাটি বিজোড়। আপনার বন্ধু বুঝতে পারেননি যে, আপনি সংখ্যাটি জোড় মনে করেননা মানেই এটা নয় যে আপনি সংখ্যাটি বিজোড় মনে করেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে, আপনি যেমন সংখ্যাটি জোড় মনে করেননা, ঠিক তেমনি বিজোড়ও মনে করেননা, বরং, মনে করেন সংখ্যাটি জোড়ও হতে পারে আবার বিজোড়ও হতে পারে।
কোনোকিছু বিশ্বাস না করা তার বিপরীত কিছুতে বিশ্বাস করা নয়।
ঈশ্বর বলে কিছু আছে কিনা তা আমরা কেউই জানি না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। আস্তিকরা ঈশ্বর আছে বিশ্বাস করেন, নাস্তিকরা করেননা। নাস্তিকরা ঈশ্বর আছে বিশ্বাস করেননা মানেই এটা নয় যে তারা ঈশ্বর নেই বিশ্বাস করেন।
আমি ঈশ্বর আছে বলেও বিশ্বাস করি না, ঈশ্বর নেই বলেও বিশ্বাস করি না। আমার কাছে দুটোই অপ্রমাণিত। আমার ‘ঈশ্বর আছে’ বলে বিশ্বাস না করাটাই নাস্তিকতা।
অর্থ্যাৎ, একজন নাস্তিক মাত্রই এমন একজন ব্যক্তি নয় যিনি ঈশ্বর নেই বলে বিশ্বাস করেন। তবে হ্যাঁ, একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, নাস্তিকদের একটি বড় অংশের বিশ্বাস, ঈশ্বর বলে কিছু নেই।
অজ্ঞেয়বাদ কি নাস্তিকতার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি যৌক্তিক অবস্থান?
ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এমন অনেক মানুষকেই বলতে দেখা যায়, ‘আমি নাস্তিক না, আমি অজ্ঞেয়বাদী।’ তারা মনে করেন, আস্তিকরা ঈশ্বর আছে বিশ্বাস করেন এবং নাস্তিকরা ঈশ্বর নেই বিশ্বাস করেন, আর যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো ঈশ্বরের অনস্তিত্বেরও এখন অব্ধি কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি সেহেতু অজ্ঞেয়বাদ বা ‘ঈশ্বর থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে’ অবস্থানটাই বেশি যুক্তিযুক্ত।
ঈশ্বর আছে বিশ্বাস করলেই আপনি আস্তিক, না করলেই আপনি নাস্তিক। আপনি আস্তিক নন মানেই নাস্তিক। নাস্তিক হওয়ার জন্য ঈশ্বর নেই বলে বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই।
একজন নাস্তিক কখনো অজ্ঞেয়বাদী হতে পারে না বা একজন অজ্ঞেয়বাদী কখনো নাস্তিক হতে পারে না এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। একইসাথে একজন মানুষ এবং একজন নারী কিংবা পুরুষ হওয়ার মতো একইসাথে আপনি একজন নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদী হতে পারেন।
নাস্তিকতা এবং অজ্ঞেয়বাদ দুটি ভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। নাস্তিকতা হচ্ছে ‘আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?’ এ প্রশ্নের উত্তর। অন্যদিকে, অজ্ঞেয়বাদ হচ্ছে ‘আপনি কি জানেন ঈশ্বর বলে কিছু আছে কিনা?’ এ প্রশ্নের উত্তর।
‘আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরে আপনি যদি বলেন, ‘না, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা’, তাহলে আপনি নাস্তিক।
‘আপনি কি জানেন ঈশ্বর বলে কিছু আছে কিনা?’ এ প্রশ্নের উত্তরে আপনি যদি বলেন, ‘আমি জানিনা, ঈশ্বর বলে কিছু থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে’, তাহলে আপনি অজ্ঞেয়বাদী।
আমি একইসাথে একজন নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদী। আমি নাস্তিক কারণ আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনা। আর, আমি অজ্ঞেয়বাদী কারণ, আমি জানিনা ঈশ্বর আছে কিনা।
যারা ঈশ্বর আছে বলে বিশ্বাস করেননা, আবার ঈশ্বর নেই বলেও দাবী করেননা তারা হচ্ছেন অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিক। আর, যারা ঈশ্বর আছে বলে বিশ্বাস করেননা এবং সেইসাথে ঈশ্বর নেই বলেও দাবী করেন তারা হচ্ছেন জ্ঞেয়বাদী নাস্তিক।
আরও পড়ুন
তথ্যসূত্র
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"
খুব ভালো লাগলো অনেক কিছু জানতে পারলাম
জেনে ভালো লাগলো।