মুসলমানদের মধ্যে অভিশাপ সংস্কৃতি
কয়েকদিন আগে আমার একটা পোস্টের নিচে দেখলাম, একজন সাচ্চা মুমিন মুসলমান কমেন্ট করেছে। কমেন্টে সে রীতিমত আমাকে, আমার স্ত্রী এবং আমার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে অভিশাপ দিয়েছে। অভিশাপ দিয়ে বলেছে, আমার ওপর যেন আল্লাহর গজব নাজিল হয়, আমার সন্তানের যেন অমঙ্গল হয়, তার হাত পা যেন বাঁকা হয়ে যায়, সে যেন খেতে না পারে, তার যেন অসুখ বিসুখ হয় ইত্যাদি। এই ধরণের কমেন্ট বা মেসেজ আমি যে শুধু একবারই পেয়েছি তা নয়। প্রায় প্রতিদিনই আমি ৮-১০ টা মেসেজ পাই ঠিক একই রকম। কমেন্টে এরকম পাই অসংখ্য। সেই মেসেজগুলোতে ঠিক একই ধরণের অভিশাপ দেয়া হয়। আমি মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়েই ভাবি, এত বিপুল পরিমাণ মানুষ কী ভয়াবহ রকমের বিকৃত মনের হলে কাউকে এরকম অভিশাপমূলক মেসেজ বা কমেন্ট করে। কাউকে অভিশাপ দেয়ার মত মন মানসিকতা একজন সভ্য মানুষের থাকে কীভাবে? শুধু আমাকে অভিশাপ দিয়েই থাকছে না, আমার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকেও অভিশাপের পর অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। সেই সব অভিশাপে কাজ কতটুকু হচ্ছে তা পরের হিসেব, তবে এদের এত অভিশাপ দেয়ার এই যে মানসিকতা, এই মানসিকতার উৎপত্তি কোথা থেকে? কতটা বর্বর হলে মানুষ কাউকে এরকম অভিশাপের চর্চা সাংস্কৃতিকভাবে ব্যাপকহারে করতে পারে!
এই যে খুবই ঘিনঘিনে বিকৃত মন মানসিকতা, যা একটি সদ্যজাত সন্তানকে পর্যন্ত অভিশাপ দিতে ছাড়ে না, এর পেছনে কোন মানসিকতা রয়েছে? কে এদের শিখিয়েছে এভাবে অভিশাপ দিতে? এগুলো কী আসলে গুটিকয় মুসলমানের কাজ, নাকি এর সাথে ইসলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত? এই বিষয়ে ইসলামের দিক নির্দেশনা কী? ইসলাম কী এগুলো শিক্ষা দেয়?
ছোটবেলা শুনতাম, হযরত মুহাম্মদকে নাকি পাথর মারলেও তিনি তাদের অভিশাপ দিতেন না, বা তাদের অকল্যান চাইতেন না। শুনে বেশ ভালই লাগতো। ভাবতাম, এগুলো যারা করে, তারা হয়তো ইসলামের বিষয়ে ভালভাবে না বুঝেই এগুলো করছে। কিন্তু আসলেই কী তা? মুহাম্মদ কী এই ধরণের কাজ কখনো করেছে? এই ধরণের শিক্ষা দিয়েছে? একটু বড় হওয়ার পরে, নিজেই হাদিস কোরান সিরাত গ্রন্থ ভালভাবে যখন পড়তে লাগলাম, দেখতে পেলাম, মুহাম্মদ সম্পর্কে এতদিন যা জেনে এসেছি, সেগুলো আদৌ সত্য নয়।
অভিশাপ কাকে বলে? অভিশাপ মানে হচ্ছে, দুখে বা রাগে অন্যের অনিষ্ট কামনা, অভিসম্পাত, শাপ দেয়া। অভিশাপ মানুষ তখনই দেয়, যখন তার আসলে কিছু করার থাকে না। অক্ষম অসমর্থ অসভ্য মানুষরাই অন্য মানুষকে অভিশাপ দেয়। অতিরিক্ত অভিশাপ দেয়া একটি মানসিক সমস্যাও বটে। আমাদের এলাকায় এক পাগল ছিল। পাগলটা সবাইকে সারাক্ষণ অভিশাপ দিতো। অমুকের মুখে কুষ্ঠ হবে, তমুকের হাত খসে পরবে, অমুকের ছেলে মারা যাবে, তমুকের মেয়ে বেশ্যা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সারাক্ষণ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা তার কাজ ছিল একে ওকে অভিশাপ দেয়া। খুব নোংরা মুখের ভাষা ছিল পাগলটার, এবং অভিশাপ দেয়ার এই অভ্যাসের কারণে আমরা তাকে এড়িয়ে চলতাম। তার অভিশাপে কারও কিছু না হলেও, সেই নানা ধরণের বিশ্রী সব অসুখ বিসুখে ভুগতো। সেই পাগলটা না হয় পাগল ছিল বলে এরকম করতো, কিন্তু একটি সম্প্রদায় যখন ব্যাপকভাবে একই অভিশাপ দেয়ায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, একে ওকে অভিশাপ দেয়াই যদি কোন সম্প্রদায়ের কাজ হয়ে ওঠে, তখন এর উৎস খুঁজে দেখার প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ওয়াজ মাহফিলে, এবং নামাজের খুতবায় আমি নিজেই শুনেছি, ইহুদী নাসারা মালাউন নাস্তিকরা যেন ধ্বংস হয়, ইউরোপ আমেরিকার ওপর যেন আল্লাহ গজব নাজিল করে, এই ধরণের অসংখ্য কথাবার্তা। ছোটবেলা এইসব শুনতাম আর ভাবতাম, ইহুদী নাসারাদের ওপর আমাদের মোল্লাদের এত রাগ! ইউরোপ আমেরিকার ওপর গজব নাজিল করতে এরা আল্লাহকে অনুরোধ করছে, ইউরোপ আমেরিকায় যে সব শিশু বৃদ্ধা সাধারণ মানুষেরা আছেন, তারা কেন গজবে কষ্ট পাবে? তারা মুসলমানদের কী ক্ষতি করেছে? আর এত এত মোল্লা দিনরাত নামাজে বসে ইউরোপ আমেরিকার ওপর গজবের দোয়া করে যাচ্ছে, ইউরোপ আমেরিকা তো এতদিনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছুই তো হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? ঐসব মোল্লাদের প্রার্থনা কী কবুল হচ্ছে না? বরঞ্চ দেখছি, মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ইহুদী নাসারা নাস্তিকদের দেশগুলো ক্রমশ উন্নতি করছে। তাহলে কী আল্লাহ আর এইসব মোল্লাদের প্রার্থণা কবুল করছে না? সমস্যাটা কোথায়?
অভিশাপ দেয়ার এই নোংরা অভ্যাসটি নিয়ে যদি আমরা একটি কোরান হাদিস ঘাঁটাঘাঁটি করি, আমার মনে হয়, মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতরে এই অভিশাপ দেয়া প্রবণতার কারণ আমরা খুঁজে পাবো। যেমন ধরুন, আল্লাহ পাক নিজেই কোরানে আবু লাহাবকে অভিশাপ দিচ্ছে,
” ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।
তার ধন-সম্পদ আর সে যা অর্জন করেছে তা তার কোন কাজে আসল না।
অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে,
আর তার স্ত্রীও- যে কাঠবহনকারিণী।
আর তার গলায় শক্ত পাকানো রশি বাঁধা থাকবে।”
বিষয়টি অদ্ভুত নয়, রীতিমত হাস্যকর যে- মহাবিশ্ব গ্রহ নক্ষত্র ধুমকেতু ম্যাটার এন্টিম্যাটারের স্রষ্টা একজন তুচ্ছ মানুষকে উদ্দেশ্য করে এত অভিশাপ দিয়ে মনের জ্বালা মেটাচ্ছে। আবার ধরুন, হযরত মুহাম্মদ আল্লাহ পাকের কাছে প্রার্থনা করছে, অমুক গোত্রে দুর্ভিক্ষ দেয়ার জন্য! দুর্ভিক্ষে যেন অমুক গোত্রটি শিশু বৃদ্ধ প্রতিবন্ধী সব মানুষ সহ সমূলে ধ্বংস হয়! কী ভয়াবহ চিন্তা!
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুনূতে নাযিলায় এই দু‘আ করতেন, ‘ইয়া আল্লাহ! …..মুযার গোত্রকে সমূলে ধ্বংস করুন। ইয়া আল্লাহ! (মুশরিকদের উপর) ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর সময়কালীন দুর্ভিক্ষের মত দুর্ভিক্ষ নাযিল করুন’।
( পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৪৮/ জিহাদ (كتاب الجهاد والسير)
হাদিস নাম্বার:২৭৩১ | 2731 | ۲۷۳۱)
হে আল্লাহ! মুযার গোত্রের উপর আপনার শাস্তি কঠোর করে দিন। হে আল্লাহ! ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর যমানার দুর্ভিক্ষের বছরগুলোর ন্যায় (এদের উপর) কয়েক বছর দুর্ভিক্ষ দিন।
( পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১৫/ বৃষ্টির জন্য দু’আ (كتاب الاستسقاء)
হাদিস নাম্বার: 952)
আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন লোকদেরকে ইসলাম বিমুখ ভুমিকায় দেখলেন, তখন দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর যামানার সাত বছরের (দুর্ভিক্ষের) ন্যায় তাঁদের উপর সাতটি বছর দুর্ভিক্ষ দিন।
( পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১৫/ বৃষ্টির জন্য দু’আ (كتاب الاستسقاء)
হাদিস নাম্বার: 953)
দুর্ভিক্ষ একটি ভয়াহব ব্যাপার। একজন সভ্য মানুষ হিসেবে আমি আমার চরম শত্রুকেও দুর্ভিক্ষের অভিশাপ দিতে পারি না। কারণ কোন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হলে সেখানে দলে দলে শিশুরা মারা যায়, নারী এবং বৃদ্ধরা মারা যায়, প্রতিবন্ধীরা মারা যায়। এমনকি, কেউ চিহ্নিত অপরাধী হয়ে থাকলেও, দুর্ভিক্ষে না খেতে পেয়ে কেউ তিলে তিলে মারা যাক, এমনটাও আমি কখনো কামনা করি না। আমার চরম শত্রুও যদি দুর্ভিক্ষের সময় আমার কাছে একটু খাদ্য চায়, আমি তাকে খাদ্য দেবো। যদি আমার কাছে থাকে। ধর্ম বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তাকে সাহায্য করবো না। তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মাথাই ঘামাবো না। তাদের অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হোক, এমনটা কামনা করা বা এমনটা অভিশাপ দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
হযরত মুহাম্মদের এই অভিশাপ দেয়ার অভ্যাসের মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। হাদিস খুললেই পাওয়া যায়। ভেবে দেখুন, এরকম মন মানসিকতার একজন মানুষ পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমানের আদর্শ পুরুষ! সেই সব অভিশাপে কতটা কাজ হয়েছে তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য যদিও নেই, তবে মুহাম্মদ যে মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল, তা হাদিসগুলো থেকেই জানা যায়। সেই সাথে, মুহাম্মদের চারজন প্রধান খলিফার তিনজনই খুন হয়েছিল, মুসলমানদের দ্বারাই। মুহাম্মদের নাতিদেরও খুব নৃশংস মৃত্যু ঘটেছিল। মুহাম্মদ একসময় বলেছিল, কেউ কাউকে ভুল কারণে অভিশাপ দিলে, অভিশাপটি তার দিকেই ফিরে আসে। মুহাম্মদ, তার বংশধর এবং তার সাহাবীদের নির্মম পরিণতির জন্য তাহলে আমরা কাকে দায়ী করতে পারি?
আমি একজন নাস্তিক। কখনই কোন মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান বা কোন মানুষকেই অভিশাপ দিই নি। দেবোও না। সবাই ভাল থাকুক, সুস্থ এবং উন্নত জীবন যাপন করুক। পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকুক, এই কামনা করি। কেউই কখনো দুর্ভিক্ষে পতিত না হোক, কিংবা কোন অসুখে না পরুক। কেউ আমাকে হত্যা করতে আসলেও আমি কাউকে এরকম অভিশাপ দেবো না। সেই সাথে, আমি চাইবো, তারা পড়ালেখা করুক, জ্ঞান অর্জন করুক। তাহলে হয়তো তারা এই বর্বর অভিশাপ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
কারণ একজন সভ্য এবং ভদ্র মানুষ কখনো অন্যের অনিষ্ট কামনা করতে পারে না। আপনারা আপনাদের ধর্মের শিক্ষা অনুসারে অভিশাপ দিতে পারেন।
আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস থাকলে কেউ অভিশাপ দিলে তাতে আপনার কষ্ট লাগার ত কথা না।
রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন কোনো বান্দা কোনো ব্যক্তিকে অভিশাপ দেয়, তখন অভিশাপ আকাশে চলে যায়, আকাশের দরজাগুলো তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, অতঃপর তা জমিনের দিকে নেমে আসে। তখন জমিনের দরজাগুলোও তার থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়, অতপর তা ডানে বাঁয়ে ঘুরতে থাকে, যখন কোনো উপায় না পায়, তখন যাকে অভিসম্পাত করা হয়েছে, সে যদি এর যোগ্য হয়, তাহলে তার প্রতি পতিত হয়। অন্যথায় অভিশাপকারীর দিকেই ধাবিত হয়। (আবু দাউদ, হাদিস নং: ৪৯০৭)
উপরে উল্লেখিত হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি রাসুল(সা) এর অভিশাপ ফলে গিয়েছিল এবং প্রকৃত মন্দ লোকদেরকেই অভিশাপ দিলেন যখন কোন নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টি বর্ষিত হয় তখন সবার উপরে এক সাথে বর্ষিত হয় ।ইতিহাস কি বলে? আবু লাহাব ধ্বংস হয়েছিল এবং আবু লাহাব বদর যুদ্ধ হবার কিছুকাল আগে গোশতের পঁচন রোগে আক্রান্ত হয় আর দীর্ঘ সময় ধরে অসহনীয় কষ্ট ভোগ করার পর মারা যায়। তার পরিবার তাকে ফেলে চলে যায় এবং তিন দিন পর্যন্ত লাশ পড়ে থাকে। কি নিকৃষ্ট মৃত্যু ! এভাবে আল্লাহ শাস্তি দেন জালিমদের।
আর রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর আল্লাহর লানত, তার গজব ও জাহান্নামের অভিশাপ দেবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ১৯৮৬) ইসলামে অভিশাপের কোন সংস্কৃতি নেই।বরং মুহাম্মদ (সা) তাদের উপরই অভিশাপ দিয়েছিলেন যারা প্রকৃতপক্ষে সীমা অতিক্রম করেছিল কিন্তু তাদের সেইসব মূর্তিরা যাদের তারা উপাসনা করত এবং তাদের ধন সম্পদ লোকবল তাদেরকে রাসুল (সা) এর বিরুদ্ধে জয়ী করতে পারে নি।
অবিশ্বাসীদের ধন-সম্পদ যা তারা অর্জন করেছে এবং ব্যয় করেছে বিশ্বাসীদের হত্যা করার কাজে কোন কাজে আসল না সে সকল সম্পদ,তারা দুনিয়াতেও ধ্বংস হলো হবে তাদের পরকালও ভয়ংকর।
বিশ্বাসীরা মৃত্যুবরন করার পরেও অপর বিশ্বাসীরা সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন কিন্তু অবিশ্বাসীরা তাদের কথা স্মরণও করে না।