সম্পাদকীয়যুক্তিবাদ

বহুল প্রচলিত কিছু কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস

সূচিপত্র

ভূমিকা

শুরুতেই কুযুক্তি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস বা Logical fallacy আসলে কাকে বলে, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এর মানে হচ্ছে, প্রতারণামূলক কিছু, বা কুতর্ক, বা কুযুক্তি অথবা ন্যায়সঙ্গত কর্মে ফাঁকি দেয়া। যুক্তিবিদ্যায় প্রচলিত কিছু অনর্থক কথার মারপ্যাঁচ কিংবা ভুলযুক্তি/কুযুক্তি/অপযুক্তি বা কুতর্ক জুড়ে দেয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্যণীয় ছিল, এবং এগুলো সবই যে কুতর্ক তা দ্বিধাহীনভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই বর্তমান সময়ে বিতর্ক কিংবা একাডেমিক আলোচনার সময় কিছু কিছু যুক্তিকে কুতর্ক বা হেত্বাভাস বা logical fallacy হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আসুন তাহলে আমরা শুরু করি, কুযুক্তি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস কাকে বলে, ইহা কত প্রকার এবং কী কী। এই আলোচনার বেরশিরভাগ অংশই আন্তর্জাতিক যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক নানা বই থেকে সংগৃহীত। পৃথিবীর প্রায় সকল যুক্তিবাদী মানুষই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত। অনুন্নত অসভ্য এবং অশিক্ষিত সমাজে যদিও এই কুতর্কগুলোই এখনো যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু এগুলো কোনটাই আসলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুক্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সহজভাবে বলতে গেলে, এই ধরণের কুযুক্তিগুলো সবই যুক্তিবিদ্যার শুরুতেই বাতিল করে দেয়া হয়। সেগুলো আলোচনাতে আসবার যোগ্যতাই রাখে না। কেন এগুলো ফ্যালাসি বা হেত্বাভাস তা উদাহরণ সহকারে এই লেখাটিতে ব্যাখ্যা করা হবে। আপনি যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকলে, এই লেখাটি সবার আগে মন দিয়ে পড়ে নেয়া জরুরি। কারণ, হয়তো আপনি নিজেই মনের অজান্তে নানা ধরণের ফ্যালাসি দিয়ে যুক্তিতর্ক করে যাচ্ছেন।


যুক্তি কাকে বলে?

যুক্তি হচ্ছে কিছুর সত্যতা নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত কিছু পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আমরা তার যথার্থতা নিরুপণ করতে পারি। যুক্তি একটি প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন প্রস্তাবনা বা তথ্যের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা কোন বিষয়ে সত্যতা নির্ণয় করতে পারি অথবা কোন যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। যুক্তি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে—ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এবং আইনি বিতর্ক পর্যন্ত। যুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো চিন্তা ও সিদ্ধান্তে শৃঙ্খলা আনা এবং ভুল সিদ্ধান্ত বা মিথ্যা প্রস্তাবনা থেকে বাঁচা।


যুক্তির প্রকারভেদ

যুক্তি সাধারণত দুই ধরনের হয়: প্রমাণিত যুক্তি এবং ভুল যুক্তি

১. প্রমাণিত যুক্তি (Valid Reasoning)

প্রমাণিত যুক্তিতে প্রস্তাবনা এবং সিদ্ধান্তের মধ্যে সম্পর্ক থাকে, যা সঠিকভাবে অনুসরণ করলে নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। উদাহরণ হিসেবে নিচের দুইটি প্রস্তাবনা দেখা যাক:

  • প্রস্তাবনা ১: সকল মানুষ মরণশীল।
  • প্রস্তাবনা ২: কলিমুদ্দীন একজন মানুষ।

এখন, এই দুইটি প্রস্তাবনা থেকে আমরা স্বাভাবিকভাবে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি:

  • সিদ্ধান্ত: কলিমুদ্দীন একজন মরণশীল জীব।

এটি একটি প্রমাণিত যুক্তি কারণ প্রস্তাবনা থেকে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সত্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে। এখানে প্রথম প্রস্তাবনা একটি সাধারণ নিয়ম দেয়, আর দ্বিতীয়টি ব্যক্তিবিশেষকে নিয়মের অধীনে নিয়ে আসে। ফলে সিদ্ধান্তের সঠিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকে না।

২. ভুল যুক্তি (Fallacious Reasoning)

অন্যদিকে, কিছু যুক্তির কাঠামো ভুল হতে পারে, যা থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। এমন একটি উদাহরণ দেখা যাক:

  • প্রস্তাবনা ১: গরু ঘাস খায়।
  • প্রস্তাবনা ২: মানুষ গরুর দুধ ও মাংস খায়।

এখন, এই দুইটি প্রস্তাবনা থেকে যদি আমরা সিদ্ধান্ত নিই:

  • সিদ্ধান্ত: মানুষ ঘাস খায়,

তাহলে এটি একটি ভুল যুক্তি হবে। এখানে প্রস্তাবনা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় কারণ প্রস্তাবনাগুলির মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যা এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। এই ধরনের যুক্তি ভ্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয় কারণ এটি কোনো ভিত্তি ছাড়াই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে।


যুক্তির বৈধতা এবং যথার্থতা

একটি নিপুণ যুক্তি তার উপসংহার বা সিদ্ধান্তকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় শুধুমাত্র তখনই যখন তা বৈধ (valid) এবং যথার্থ (sound) হয়।

বৈধতা (Validity):

যখন কোনো যুক্তির সমস্ত প্রস্তাবনা সত্য বলে ধরা হয় এবং সেগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবে একটি নির্দিষ্ট উপসংহার টানা যায়, তখন সেই যুক্তিকে বৈধ বলা হয়। অর্থাৎ, একটি যুক্তি বৈধ তখনই হয় যখন তার প্রস্তাবনাগুলি সত্য হলে, তার উপসংহারও বাধ্যতামূলকভাবে সত্য হতে হবে।

একটি বৈধ যুক্তি হলো সেই যুক্তি যেখানে উপসংহার স্বভাবতই প্রস্তাবনা থেকে অনুসৃত হয়। এর অর্থ, যদি প্রস্তাবনাগুলি সত্য হয়, তবে উপসংহার মিথ্যা হওয়া অসম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, একটি বৈধ যুক্তি:

  1. সমস্ত দর্শন কোর্সই অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ কোর্স।
  2. সমস্ত যুক্তি কোর্সই দর্শন কোর্স।
  3. সুতরাং, সমস্ত যুক্তি কোর্সই অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ।

বিঃদ্রঃ ১: যদি (১) এবং (২) সত্য হয়, তবে (৩) অবশ্যই সত্য হবে।
বিঃদ্রঃ ২: বৈধতার ক্ষেত্রে, প্রস্তাবনাগুলি সত্য কি না তা বিবেচ্য নয়; বরং এটি বলে যে যদি প্রস্তাবনাগুলি সত্য হয়, তবে উপসংহার অবশ্যই অনুসৃত হবে। সুতরাং, বৈধতা যুক্তির কাঠামো সম্পর্কে, প্রস্তাবনার সত্যতা সম্পর্কে নয়।

এর মানে, একটি যুক্তি বৈধ হতে পারে যদি তার সঠিক কাঠামো থাকে। একটি যুক্তি সঠিক কাঠামো রাখতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা হতে পারে। যেমন:

  1. ড্যাফি ডাক একটি হাঁস।
  2. সমস্ত হাঁস স্তন্যপায়ী প্রাণী।
  3. সুতরাং, ড্যাফি ডাক একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী।

এই যুক্তিটি বৈধ। তবে, প্রস্তাবনা ২ এবং উপসংহার উভয়ই মিথ্যা। কিন্তু লক্ষ্য করুন, যদি প্রস্তাবনাগুলি সত্য হতো, তাহলে উপসংহারও সত্য হতো। বৈধতার জন্য এটিই প্রয়োজন। একটি বৈধ যুক্তির সত্য প্রস্তাবনা বা সত্য উপসংহার থাকার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে, একটি যথার্থ (sound) যুক্তির ক্ষেত্রে প্রস্তাবনাগুলি অবশ্যই সত্য হতে হবে এবং উপসংহারও সত্য হতে হবে।

যথার্থতা (Soundness):

একটি যুক্তি তখনই যথার্থ হয় যখন এটি দুটি শর্ত পূরণ করে: (১) এটি বৈধ হতে হবে এবং (২) এর প্রস্তাবনাগুলি সত্য হতে হবে। অর্থাৎ, একটি যথার্থ যুক্তির সঠিক কাঠামো থাকবে এবং তার প্রস্তাবনাগুলি বাস্তবেও সত্য হবে।

একটি যথার্থ যুক্তি সবসময়ই সত্য উপসংহার দেবে। যখন এই দুই শর্ত পূরণ হবে, তখন উপসংহারও সবসময়ই সত্য হবে। এটি কেন ঘটে তা বোঝা সহজ। প্রথমে মনে রাখুন যে, একটি যথার্থ যুক্তি বৈধ এবং এর প্রস্তাবনাগুলি সত্য। বৈধ যুক্তির সংজ্ঞা অনুযায়ী, যদি তার প্রস্তাবনাগুলি সত্য হয়, তবে উপসংহারও অবশ্যই সত্য হতে হবে। সুতরাং, সমস্ত যথার্থ যুক্তির উপসংহার সত্য হবে।

ড্যাফি ডাক সংক্রান্ত উপরের যুক্তির দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, এটি বৈধ, কিন্তু যথার্থ নয়। কারণ, এতে সমস্ত প্রস্তাবনা সত্য নয়। বিশেষ করে, “সমস্ত হাঁস স্তন্যপায়ী প্রাণী” এই প্রস্তাবনা সত্য নয়।

সুতরাং, ড্যাফি ডাক সম্পর্কে যুক্তিটি বৈধ, কিন্তু যথার্থ নয়। এখন আমরা একটি বৈধ এবং যথার্থ যুক্তির উদাহরণ দেখব:

  1. সমস্ত খরগোশ স্তন্যপায়ী প্রাণী।
  2. বাগস বানি একটি খরগোশ।
  3. সুতরাং, বাগস বানি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী।

এই যুক্তিতে, যদি প্রস্তাবনাগুলি সত্য হয়, তবে উপসংহারও অবশ্যই সত্য হবে (এটি বৈধ)। এবং, বাস্তবে প্রস্তাবনাগুলি সত্য (সব খরগোশই আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণী, এবং বাগস বানি আসলে একটি খরগোশ)—সুতরাং, উপসংহারও সত্য হতে হবে (এটি যথার্থ)।

এভাবে, একটি যথার্থ যুক্তি কেবল সঠিক কাঠামোযুক্ত নয়, বরং এর প্রস্তাবনাগুলিও বাস্তবসম্মতভাবে সত্য হতে হয়, এবং ফলস্বরূপ এর উপসংহারও সত্য হয়।


যুক্তি বিজ্ঞানের ভূমিকা

যে শাস্ত্রে অশুদ্ধ যুক্তি থেকে বৈধ বা শুদ্ধ যুক্তিকে পৃথক করার নিয়মাবলি আলোচনা করা হয়, তাকে যুক্তি বিজ্ঞান বলা হয়। যুক্তি বিজ্ঞান বা লজিক আমাদের শেখায় কিভাবে যুক্তির সঠিক প্রয়োগ করা যায় এবং কোন পরিস্থিতিতে কোন ধরনের যুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এটি মূলত গণিত, দর্শন, এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়, যেখানে সঠিক যুক্তির প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তি বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন নিয়মাবলি প্রতিষ্ঠা করা যার মাধ্যমে আমরা অশুদ্ধ এবং শুদ্ধ যুক্তির মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা জটিল সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করতে পারি এবং ভুল ধারণা বা মতামত এড়াতে পারি। এটি আমাদের যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তাভাবনার দক্ষতা বাড়ায়, যা ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সহায়ক।


কুযুক্তির প্রকারভেদ

আধুনিক যুক্তিবিদ্যায় কুযুক্তিকে সাধারণত দুইটি ভাগে বিভক্ত করা হয়:

“সব বড় বড় নেতা ধনী, তাই ধনী হলেই নেতৃত্বের যোগ্য।”
এখানে যুক্তিটি অসম্পূর্ণ এবং ভিত্তিহীন।

ফরমাল ফ্যালাসি (Formal Fallacy):

এটি কাঠামোগত ভুল যুক্তি, যা এর গঠন বা ফর্ম দেখেই শনাক্ত করা যায়।

উদাহরণ:

“যদি বৃষ্টি হয়, মাটি ভিজে যাবে। মাটি ভেজা আছে, তাই বৃষ্টি হয়েছে।”
এখানে যুক্তির গঠনগত ত্রুটি রয়েছে, কারণ মাটি ভেজা থাকার অন্যান্য কারণও থাকতে পারে।

ইনফরমাল ফ্যালাসি (Informal Fallacy):

আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও, এর ভিত্তি বা ফলাফলের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত সম্পর্ক নেই।

উদাহরণ:

কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি হচ্ছে যুক্তির ভান করে আপনাকে মিথ্যা বা অযৌক্তিক কিছু বোঝাবার কৌশল। যুক্তিতর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত, সততার সাথে বিতর্কে অংশ নেয়া এবং আপনার যুক্তি ভুল হয়ে থাকলে শুদ্ধটি দ্বারা তা শুধরে নেয়া। অসৎ ভাবে যারা বিতর্ক করে বা চালাকিপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরে, তাদের থেকে সাবধান থাকা খুবই জরুরি। কারণ তারা আপনাকে ভুল বা চালাকিপূর্ণ কথা বলে আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবে। এই ধরণের প্রতারণামূলক যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে সেগুলো বাতিল করে সঠিক ভাবে গঠনমূলক যুক্তিতর্ক আলাপ আলোচনা করাটাই এই লেখাটির উদ্দেশ্য।

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 1

যুক্তিবিদ্যার ইতিহাস ও বিবর্তন

যুক্তিবিদ্যা, যা যুক্তিযুক্ত চিন্তা, অনুমান ও সিদ্ধান্ত গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে, মানব সভ্যতার প্রাচীনতম শাস্ত্রগুলোর একটি। এটি মানুষের চিন্তাশীলতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা মানবিক, বৈজ্ঞানিক, এবং দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক মৌলিক ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতা যুক্তিবিদ্যার চর্চা শুরু করে এবং সময়ের সাথে সাথে এটি বিভিন্ন শাস্ত্রে বিকাশ লাভ করে। এই নিবন্ধে, আমরা যুক্তিবিদ্যার উদ্ভব, বিকাশ এবং এর বিভিন্ন ধাপ ও গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

প্রাচীন সভ্যতায় যুক্তিবিদ্যার সূচনা

মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতা

যুক্তিবিদ্যার প্রাথমিক চর্চা শুরু হয়েছিল প্রাচীন মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। মিশরীয় সভ্যতায় খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে থেকেই জ্যামিতিক জ্ঞান বিকাশ লাভ করে, যা মূলত ভূমি পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। মিশরীয়রা পিরামিড নির্মাণের জন্য জ্যামিতিক সূত্রগুলো ব্যবহার করে। এ সময়ের জ্যামিতিক জ্ঞান এবং প্রমাণ ভিত্তিক চিন্তা, প্রাচীন গ্রিসের দর্শন ও বিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে। একইভাবে, ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে জ্যোতির্বিদ্যায় যুক্তিবিদ্যার ব্যবহার দেখা যায়। ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদরা গ্রহ-নক্ষত্রের গতি পর্যবেক্ষণ করতে একটি প্রাথমিক যুক্তিবিদ্যক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

চীনের যুক্তিবিদ্যা

চীনে যুক্তিবিদ্যার প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১০০০ বছর আগে। চীনের মোহিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা চীনা দার্শনিক মোজি (মাস্টার মোহ) তাঁর রচনায় বৈধ অনুমান ও সিদ্ধান্ত গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। মোজির যুক্তিবিদ্যার কাজ আইন এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল। চীনা দর্শনে যুক্তিবিদ্যা মূলত নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তার সাথে সম্পর্কিত ছিল, যা পরবর্তীকালে চীনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলে।

ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার বিকাশ

ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন

ভারতীয় সভ্যতায় বাইরের কোনো প্রভাব ছাড়াই স্বাধীনভাবে যুক্তিবিদ্যার বিকাশ ঘটে। ভারতীয় দর্শনের প্রতিটি শাস্ত্রে যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ ও মননশীলতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষত ন্যায় ও বৈশেষিক সম্প্রদায়গুলো সরাসরি যুক্তিবিদ্যার আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে অক্ষপাদ গৌতম রচিত ন্যায়সূত্র হলো ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ, যা যুক্তির পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ ও গঠন নিয়ে আলোচনা করে।

পঞ্চাবয়বী ন্যায় নামে পরিচিত পাঁচটি যুক্তি বাক্য এই দর্শনে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে ভারতীয় দর্শনে যুক্তির গঠন এবং তার সঠিক প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এছাড়াও, বৌদ্ধ দর্শনের অন্যতম দার্শনিক নাগার্জুন তাঁর রচিত মূল-মধ্যমিক কারিকা গ্রন্থে চতুষ্কোটি নামক একটি যুক্তি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যা দার্শনিক বিতর্কে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে।

দিঙনাগ ও ধর্মকীর্তির যুক্তিবিদ্যা

ভারতীয় যুক্তিবিদ্যায় দিঙনাগ এবং তাঁর শিষ্য ধর্মকীর্তি বিশেষ অবদান রাখেন। দিঙনাগ আকারগত সহানুমান বা সমানুপাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছেন, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার একটি ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মকীর্তি যুক্তির বিস্তৃতি এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন, যা ভারতীয় যুক্তিবিদ্যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে।প্রখ্যাত ভারতবিদ ফিওদর শ্কেরবাৎস্কি ধর্মকীর্তিকে ইমানুয়েল কান্টের সঙ্গে তুলনা করে ভারতের কান্ট বলে অভিহিত করেন।

গ্রিক সভ্যতায় যুক্তিবিদ্যার বিকাশ

এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলকে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার জনক বলা হয়। যদিও এরিস্টটলের পূর্ববর্তী দার্শনিকরা যুক্তি খণ্ডনের দিকে বেশি আগ্রহী ছিলেন, এরিস্টটলই প্রথম যুক্তিবিদ্যাকে একটি পদ্ধতিগত জ্ঞানশাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এরিস্টটলের সহানুমানিক যুক্তিবিদ্যা বা Syllogism যুক্তিবিদ্যার আকারগত দিকের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যা বর্তমানে যুক্তিবিদ্যার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এরিস্টটলের মতে, যুক্তিবিদ্যা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি চিন্তার আকার ও গঠনের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর সহানুমানিক যুক্তিবিদ্যা বিভিন্ন শর্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে। এখানে তিনটি মৌলিক পদ বা টার্ম ব্যবহার করা হয়, যা আকারগতভাবে সঠিকভাবে বিন্যস্ত হলে একটি বৈধ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।

ক্রিসিপ্পাসের যুক্তিবিদ্যা

এরিস্টটলের পরবর্তী সময়ে স্টোয়িক দার্শনিক ক্রিসিপ্পাস যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ক্রিসিপ্পাস সমগ্র যুক্তিবাক্য বা whole proposition এর উপর ভিত্তি করে যুক্তি গঠন করেন এবং যৌগিক বচনের সত্যতা বা মিথ্যাতা নির্ধারণের জন্য পাঁচটি মৌলিক অনুমান প্রণয়ন করেন। ক্রিসিপ্পাস যুক্তিবিদ্যার একটি নতুন ধারা তৈরি করেন, যা পরবর্তীকালে স্টোয়িক দর্শনের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

ইসলামিক সভ্যতায় যুক্তিবিদ্যার বিকাশ

আল-ফারাবি ও ইবনে সিনা

মুসলিম দার্শনিকগণ যুক্তিবিদ্যার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আল-ফারাবি ছিলেন এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার একজন প্রধান সমর্থক। তিনি ধারণা, অবধারণ (judgements), এবং যুক্তির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর রচনায় এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন উপাদান নতুন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইবনে সিনা (Avicenna) এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যাকে আরও বিকশিত করে আবেসিনীয় যুক্তিবিদ্যার প্রচলন করেন। তিনি শর্তমূলক সহানুমান ও বাচনিক ক্যালকুলাস নিয়ে কাজ করেন, যা পরবর্তীকালে পশ্চিমা দার্শনিকদের প্রভাবিত করে।

ইউরোপে যুক্তিবিদ্যার পুনর্জাগরণ

মধ্যযুগে ইউরোপে যুক্তিবিদ্যা পুনরায় আলোচনায় আসে। পিটার আবেলার্ড এবং উইলিয়াম অব ওকাম এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। আবেলার্ড বস্তুগতভাবে বৈধ এবং আকারগতভাবে বৈধ যুক্তির মধ্যে পার্থক্য করেন। তাঁর মতে, শেষ পর্যন্ত আকারগতভাবে বৈধ যুক্তিই গ্রহণযোগ্য। উইলিয়াম অব ওকাম প্রকরণ যুক্তিবিদ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যা শব্দ, পদ এবং বচন নিয়ে কাজ করে।

আধুনিক যুগের যুক্তিবিদ্যার বিকাশ

লাইবনিজ ও প্রতীকী যুক্তিবিদ্যা

গণিত ও দর্শনের ক্ষেত্রে আধুনিক যুক্তিবিদ্যার প্রবর্তক হিসেবে জার্মান দার্শনিক লাইবনিজের নাম উল্লেখযোগ্য। লাইবনিজ যুক্তির গাণিতিক ক্যালকুলাস এবং প্রতীকী ভাষা নিয়ে কাজ করেন, যা পরবর্তীকালে প্রতীকী যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি তৈরি করে। তাঁর কাজের মাধ্যমে গণিত, যুক্তিবিদ্যা এবং ভাষাতত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, যা আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ফ্রেগে ও গণিতীয় যুক্তিবিদ্যা

উনিশ শতকের শেষ দিকে জার্মান দার্শনিক গটলব ফ্রেগে আধুনিক গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কাজ যুক্তিবিদ্যার ভাষাকে গণিতের মতো আকারগত ভাষায় রূপান্তর করে, যা পরবর্তীকালে বাট্রান্ড রাসেলএ.এন. হোয়াইটহেড এর কাজের ভিত্তি তৈরি করে। তাদের Principia Mathematica গ্রন্থে গণিতকে যুক্তিবিদ্যার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।


অজ্ঞতার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Argument from Ignorance Fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 3

অজ্ঞতার কুযুক্তি বা কুতর্ক হলো সেই যুক্তি, যেখানে বলা হয় যে কোনো কিছুর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি, তাই এটি মিথ্যা হতে পারে না, অথবা মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি, তাই এটি সত্য। এই ধরনের যুক্তি সাধারণত যুক্তির অভাব থেকে তৈরি হয় এবং তা মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, নিচের দাবীগুলি দেখা যাক:

  1. দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, বিগ ব্যাং এর আগে কী ছিল, তাই আমার ঈশ্বরই বিগ ব্যাং ঘটিয়েছে!
    • এখানে দাবি করা হচ্ছে, বিগ ব্যাং-এর আগে কী ঘটেছিল তা যেহেতু এখনো অজানা, তাই ঈশ্বরের দ্বারা তা ঘটেছে। কিন্তু এটি কোনো যৌক্তিক প্রমাণ নয়। অজ্ঞতার কারণে আমরা যদি কিছু না জানি, সেটি কোনো নতুন সত্য প্রতিষ্ঠার প্রমাণ হতে পারে না।
  2. দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, মিশরের পিরামিডগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাই পিরামিড তৈরির পেছনে এলিয়েনদের হাত রয়েছে!
    • এই দাবিটি পিরামিডের তৈরি নিয়ে অজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। আমরা হয়তো এখনো পিরামিড নির্মাণের সমস্ত পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে জানি না, কিন্তু এর মানে এই নয় যে এলিয়েনরা এটি তৈরি করেছে।
  3. দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, আমার মাথায় কয়টি চুল আছে, তাই আমার মাথায় ১৩ লক্ষ ২৫৬টি চুল রয়েছে!
    • এখানে অজানা তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট সংখ্যা দেওয়া হচ্ছে, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। “জানি না” মানে সঠিক সংখ্যাটি আমরা এখনো জানি না, কিন্তু এটি অযৌক্তিক কোনো সংখ্যা নিশ্চিত করার প্রমাণ হতে পারে না।
  4. দাবী: যেহেতু তুমি জানো না, প্রশান্ত মহাসাগরে কত লিটার পানি আছে, মেনে নাও যে সেখানে ৬ কোটি ৫৮ লক্ষ ১২৮ লিটার পানি আছে!
    • এই দাবিটিও পূর্বের মতো একই ভুল যুক্তি ব্যবহার করছে। কোনো কিছু না জানার কারণে এমন সুনির্দিষ্ট একটি সংখ্যা সঠিক হবে, এমন দাবি অজ্ঞতার কুতর্কের আরেকটি উদাহরণ।

কেন এই দাবীগুলি ভুল?

এই ধরনের দাবি বা যুক্তি ভুল কারণ এগুলি কোনো প্রমাণিত তথ্যের উপর নির্ভর করে না। এখানে কেবল অজানাকে হাতিয়ার করে দাবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের বিপরীতে দাঁড়ায়। কোনো কিছু না জানার মানে সেই বিষয় সম্পর্কে অন্য কোনো অসঙ্গত ধারণা সঠিক হবে, এমন দাবি করা সম্পূর্ণ অনুচিত এবং তা যৌক্তিক চিন্তার পরিপন্থী।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রমাণের গুরুত্ব

বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন সঠিক পদ্ধতিতে, তথ্য ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে। বিগ ব্যাং-এর আগের পরিস্থিতি সম্পর্কে যেমন বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি পিরামিডের নির্মাণ নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইঞ্জিনিয়াররা ক্রমাগত গবেষণা করছেন। বিজ্ঞান কিছু অজানা বিষয়কে স্বীকার করে, কিন্তু সেটিকে যুক্তির সাহায্যে সমাধানের চেষ্টা করে।

আমাদের অজানা বিষয়ের প্রতি মনোভাব হওয়া উচিত, “আমরা জানি না,” কিন্তু জানার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মাধ্যমে। অজানা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কল্পিত ধারণা গ্রহণ করা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। অজ্ঞতার মানে নতুন কোনো ধারণা বা ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা নয়, বরং গবেষণা এবং অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া।

যৌক্তিক অবস্থানঃ “জানি না” বলতে কোনো অপরাধ নেই

যখন আমরা কোনো বিষয় সম্পর্কে জানি না, তখন সেই বিষয়ে আমাদের সঠিক ও যৌক্তিক অবস্থান হওয়া উচিত, “আমি জানি না।” এই বক্তব্যের মধ্যে কোনো দুর্বলতা নেই, বরং এটি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার প্রতিফলন। জানি না মানে এটাও বোঝায় না যে আমরা মিথ্যা বা ভিত্তিহীন দাবিকে সত্য বলে মেনে নেব। বরং জানি না মানে হলো জানার জন্য চেষ্টা করা এবং গবেষণা করা।

অজ্ঞতার কুতর্ক হলো যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া কেবল অজানা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কোনো দাবীকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা। এটি একটি ভুল যুক্তি এবং প্রমাণহীন দাবির পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা মাত্র। বিজ্ঞান এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণ আমাদের শিখায়, অজানা বিষয় নিয়ে দাবি না করে বরং প্রমাণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করতে হবে।


প্রাধিকারের কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Argument from authority fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 5

প্রাধিকারের কুযুক্তি বা Argument from Authority হলো একটি যুক্তিক ত্রুটি, যেখানে কোনো দাবীকে প্রমাণ করার জন্য কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম, পদমর্যাদা বা অবস্থানকে ব্যবহার করা হয়। যদিও কখনো কখনো বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে শুধুমাত্র তার অবস্থান বা পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে কোনো দাবীর সত্যতা নির্ধারণ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে প্রমাণের বা যুক্তির পরিবর্তে ব্যক্তির ক্ষমতা বা খ্যাতির ওপর নির্ভর করা হয়, যা প্রকৃত সত্যতা প্রমাণ করে না।

  • উদাহরণ ১:
    • দাবী: অমুক বিজ্ঞানী ভাগ্য পরিবর্তনের আংটি পরতেন, তাই আংটি ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
    • এখানে বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করে দাবি করা হচ্ছে যে আংটি পরলে ভাগ্য পরিবর্তন হয়। তবে বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অভ্যাস কোনো প্রমাণ নয় যে আংটি সত্যিই ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। বিজ্ঞান নিজেই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, আর এখানে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যা আংটি পরার ফলে ভাগ্য পরিবর্তনের সত্যতা নিশ্চিত করে।
  • উদাহরণ ২:
    • দাবী: অমুক দর্শনের পণ্ডিত পীরবাবার পানিপড়া খেতেন, অতএব পানিপড়া খেলে অসুখ সারে।
    • এই দাবীতে কোনো পণ্ডিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভ্যাস বা বিশ্বাসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই করতে হয়। পণ্ডিত ব্যক্তির আচরণকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে দাবি করা হচ্ছে পানিপড়া অসুখ সারাতে পারে, যা প্রমাণিত নয়।
  • উদাহরণ ৩:
    • দাবী: অমুক বিখ্যাত ডাক্তার ওঝার শরণাপন্ন হয়েছিলেন, অর্থাৎ ওঝা রোগ সারাতে পারে।
    • এখানে বিখ্যাত ডাক্তার কোনো ওঝার শরণাপন্ন হয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে, এবং সেই ডাক্তারকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির কোনো ওঝার শরণাপন্ন হওয়া কোনোভাবেই ওঝার কার্যকারিতা প্রমাণ করে না। এটি আবারো প্রাধিকারের কুযুক্তির একটি উদাহরণ।

প্রাধিকারের কুযুক্তি: সমস্যা ও ফলাফল

প্রাধিকারের কুযুক্তিতে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়, তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অভ্যাসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে এটি একটি বড় সমস্যার কারণ। ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে কোনো যুক্তি প্রমাণ করা উচিত নয়, কারণ—

  1. ব্যক্তিগত বিশ্বাস সব সময় যৌক্তিক নয়: একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হোক না কেন, তার ব্যক্তিগত মতামত বা বিশ্বাস ভুল হতে পারে। তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা বিশ্বাস কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের বিকল্প নয়।
  2. খ্যাতি বা প্রভাব সত্যের মানদণ্ড নয়: কোনো ব্যক্তি যতই বিখ্যাত বা বিশেষজ্ঞ হোন না কেন, তার কথার সত্যতা যাচাই করতে হলে প্রমাণ এবং যুক্তির প্রয়োজন হয়। ব্যক্তির অবস্থান সত্যতার একমাত্র নির্ধারক হতে পারে না।
  3. যুক্তির ভিত্তিতে প্রমাণ: যে কোনো দাবি প্রমাণ করার জন্য প্রমাণ এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শুধু কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কী বলেছেন, তা যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রাধিকারের কুযুক্তি বুঝতে কিছু ভুল ধারণা

অনেকে প্রাধিকারের কুযুক্তি ভুলভাবে বুঝতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত যদি তার গবেষণা বা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে হয়, তবে তা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। এটি তখন আর প্রাধিকারের কুযুক্তি নয়। উদাহরণস্বরূপ:

বৈধ উদাহরণ:

উদাহরণ: একজন চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে কোনো নতুন ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছেন।
এটি প্রাধিকারের কুযুক্তি নয়, কারণ চিকিৎসক তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এবং তার দাবীর সপক্ষে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিয়েছেন। এখানে তার পদ বা অবস্থান প্রমাণ নয়, বরং তার প্রমাণিত গবেষণা তার দাবীকে সমর্থন করে।

অযৌক্তিক উদাহরণ:

উদাহরণ: একজন বিখ্যাত চিকিৎসক বলেছেন যে মন্ত্র পড়লে রোগ সেরে যায়, তাই মন্ত্র পড়া কার্যকর।
এটি প্রাধিকারের কুযুক্তি। চিকিৎসক যতই বিখ্যাত হোন না কেন, মন্ত্র পড়ার কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া প্রমাণ করা যায় না। চিকিৎসকের খ্যাতি এখানে যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

আরও কিছু উদাহরণ:

উদাহরণ ৪:

দাবী: আলবার্ট আইনস্টাইন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।
এটি প্রাধিকারের কুযুক্তির উদাহরণ, যেখানে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্ধারণে বিজ্ঞান, দর্শন বা ধর্মীয় প্রমাণই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, আইনস্টাইনের বিশ্বাস নয়।

উদাহরণ ৫:

দাবী: অমুক বিখ্যাত নেতা বলেছেন এই ওষুধ কার্যকর, তাই এটি সত্যিই কাজ করে।
এখানে নেতার খ্যাতি এবং অবস্থান ব্যবহার করে ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একটি ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং গবেষণার প্রয়োজন হয়, কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য তা প্রমাণ করতে পারে না।

প্রাধিকারের কুযুক্তি হলো যুক্তির এমন একটি ত্রুটি, যেখানে কোনো বিখ্যাত বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির নাম বা মতামতকে যুক্তির প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যদিও বিশেষজ্ঞের মতামত গুরুত্ব রাখে, তা প্রমাণ হতে পারে না যদি তা প্রমাণিত যুক্তি এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে না হয়। কোনো দাবী প্রমাণ করতে হলে অবশ্যই প্রমাণ, গবেষণা এবং যুক্তির প্রয়োজন, শুধুমাত্র খ্যাতি বা অবস্থানের ওপর নির্ভর করা যুক্তিসঙ্গত নয়।


জনপ্রিয়তার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Argument from popularity/ Argumentum ad populum

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 7

“জনপ্রিয়তার কুযুক্তি” (Argument from Popularity) একটি সাধারণ যুক্তির ত্রুটি বা কুযুক্তি। এতে কোনো মতবাদ বা বিশ্বাসের যথার্থতা নির্ধারণ করা হয় তার অনুসারীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ, যদি কোনো মতবাদে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, তবে সেটি সঠিক হতে হবে—এমন একটি ভিত্তিহীন ধারণা থেকে এই কুযুক্তি উদ্ভূত হয়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, কোনো ধারণা বা মতবাদের জনপ্রিয়তা কখনোই তার সঠিকতা বা বৈধতার প্রমাণ নয়। সঠিক যুক্তি সবসময় তথ্য, প্রমাণ, এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের ওপর নয়।

উদাহরণ ১:

দাবী: ইসলাম যদি সত্য না হয়, তাহলে ১৬০ কোটি মুসলমান কেন ইসলামে বিশ্বাস করে?

এই দাবীতে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু ১৬০ কোটি মানুষ ইসলামে বিশ্বাস করে, তাই ইসলামকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। কিন্তু এ ধরনের যুক্তি একটি জনপ্রিয়তার কুযুক্তির (Argumentum ad populum) উদাহরণ। কোনো ধর্মে কতজন মানুষ বিশ্বাস করে, তা সেই ধর্মের সত্যতা নির্ধারণ করে না। একইসাথে, পৃথিবীতে ৮০০ কোটি মানুষ থাকলে বাদবাকি ৬৪০ কোটি মানুষ ইসলামকে মিথ্যা ধর্ম বলে মনে করে। তাহলে তাদের মতামত যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই তাদের মতকেই বেশি সঠিক বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ, এই যুক্তি দিয়েই দেখানো সম্ভব, কেন এই যুক্তিটি একটি যুক্তির ত্রুটি বা কুযুক্তি বা হেত্বাভাস।

ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষ বহু সময় ভুল ধারণায় বিশ্বাস করেছে। যেমন, একসময় পৃথিবীকে সমতল মনে করা হতো, এবং তাতে পৃথিবীর অনেক মানুষই বিশ্বাস করত। কিন্তু, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এর মানে হলো, বৃহৎ জনসংখ্যার বিশ্বাস কোনো ধারণার সত্যতার নিশ্চয়তা নয়।

উদাহরণ ২:

দাবী: বিবর্তনতত্ত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে পৃথিবীর সব আব্রাহামিক ধর্মের ধার্মিক মানুষ কেন তা অবিশ্বাস করে?

এই দাবীটিও জনপ্রিয়তার কুযুক্তির একটি উদাহরণ। এখানে বলা হচ্ছে, যেহেতু বেশিরভাগ ধর্মীয় মানুষ বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করে না, তাই সেই তত্ত্বটি সঠিক নয়। কিন্তু, কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সত্যতা মানুষ কীভাবে তা বিশ্বাস করছে, তার ওপর নির্ভর করে না। বিবর্তনতত্ত্ব একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত সত্য, যা প্রচুর গবেষণা ও প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষ কী মানল কী মানল না, তার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ উপাত্তের ওপর। তবে, বিশেষভাবে সেই বিষয়ের বিজ্ঞানীদের মত এবং যুক্তি এখানে গুরুত্ব বহন করে।

কেন জনপ্রিয়তার কুযুক্তি ভুল?

জনপ্রিয়তার কুযুক্তি এই ধারণার ওপর নির্ভর করে যে, যেহেতু কোনো বিশ্বাস বা ধারণায় অনেক মানুষ একমত, সেহেতু সেটি সঠিক। কিন্তু গণতন্ত্রের মতো যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক সত্য কোনো ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। যদি আমরা যুক্তিকে মানুষের সংখ্যা দ্বারা পরিমাপ করি, তাহলে অনেক সময় ভুল ধারণাও সঠিক বলে প্রমাণিত হতে পারে, যা মূলত সঠিক নয়।

  • ১. সংখ্যাগরিষ্ঠের ভুল ধারণা সম্ভব: ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনো বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করেছে। যেমন, একসময় পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র মনে করা হতো, এবং পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এই ধারণায় বিশ্বাস করত। কিন্তু পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণে দেখা গেছে, এই ধারণাটি ভুল।
  • ২. প্রমাণ ও তথ্যের গুরুত্ব: যুক্তি সবসময় প্রমাণ ও তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কিছু জনপ্রিয় বলেই সেটি সঠিক হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই। বিজ্ঞান, যুক্তি এবং সত্য সবসময় প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে চলে। যেমন, একমাত্র যুক্তিসঙ্গত প্রমাণই বিবর্তন তত্ত্বকে সঠিক প্রমাণ করে, যদিও তা অনেক ধর্মীয় ব্যক্তি মানতে নারাজ।
  • ৩. অসংখ্য জনের বিশ্বাসেও ভুল থাকতে পারে: অসংখ্য মানুষ ভুল ধারনা পোষণ করতেই পারে। যেমন, একসময় মানুষ বিশ্বাস করত পৃথিবী স্থির এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। কিন্তু এই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং, কোনো কিছুতে কত মানুষ বিশ্বাস করে, তা সেই বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করে না।

যৌক্তিক অবস্থান:

যখন কোনো দাবী বা মতবাদ উত্থাপন করা হয়, তখন তার সত্যতা নির্ধারণের জন্য তথ্য, প্রমাণ এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জনপ্রিয়তা কখনো কোনো মতবাদ বা দাবীর সত্যতা নির্ধারণ করতে পারে না।

প্রকৃত সত্যের বৈশিষ্ট্য হলো এটি তথ্য, গবেষণা, ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। যদি পৃথিবীর মাত্র কয়েকজন মানুষও সঠিক কোনো বিষয়ের পক্ষে থাকে, এবং তারা সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন করে, তবে সেই প্রমাণই মাপকাঠি হবে, জনসংখ্যার বিশ্বাস নয়।

“জনপ্রিয়তার কুযুক্তি” হলো একটি ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি যা কোনো মতবাদ বা ধারণাকে তার অনুসারীর সংখ্যা দ্বারা সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে, কোনো ধারণার সত্যতা তার প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, না যে কতজন সেটাতে বিশ্বাস করে। জনসংখ্যার বিশ্বাস কোনো বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না, এবং সঠিকভাবে চিন্তা করলে প্রমাণ ও যুক্তিই আসল বিচারক।


কুপ্রশ্নের কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Begging the question

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 9

দাবীঃ আপনি কেন খুন করেছেন?
দাবীঃ আপনি আগে যেমন চুরি করতেন এখনো কী করেন?
দাবীঃ আল্লাহ না থাকলে কোরানে আল্লাহর কথা লেখা থাকবে কেন?

উপরের দাবী প্রথম ও দ্বিতীয় দাবীগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি প্রশ্ন করেছেন, তিনি শুরুতেই ধরে নিয়েছেন, যাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি খুনি, বা তিনি চোর। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তিনি প্রশ্ন করেছেন, যেই প্রশ্নটিই ভুল। যদি আগে থেকেই শ্রোতা খুনি বা চোর প্রমাণিত না হয়ে থাকে, তাহলে এই ধরণের যুক্তিকে কুযুক্তি হিসেবেই গণ্য করা হয়।

তৃতীয় দাবীতে, উনি ধরে নিয়েছেন কোরানে যা লেখা তা সত্য, এবং আল্লাহ না থাকলে কোরানে আল্লাহর কথা কেন লেখা থাকবে? যুক্তিবিদ্যায় এরকম যুক্তি প্রদানকে কুযুক্তি বা ফ্যালাসি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Straw man Fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 11

খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি বা স্ট্রোম্যান ফ্যালাসি হলো এক ধরনের কুযুক্তি, যেখানে বিপক্ষের আসল যুক্তিকে বিকৃত বা ভুলভাবে উপস্থাপন করে তা পরাজিত করা হয়। একজন বক্তা যখন কোনো বিতর্কে তার আসল প্রতিপক্ষের যুক্তিকে উপেক্ষা করে, তার পরিবর্তে সেই যুক্তির একটি বিকৃত, সরলীকৃত বা মিথ্যা রূপ তৈরি করেন, এবং সেই মিথ্যা রূপকে আক্রমণ করে নিজেকে জয়ী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন, তখন সেই যুক্তি স্ট্রোম্যান ফ্যালাসি বলে বিবেচিত হয়।

এটি এমন এক ধরনের কৌশল, যার মাধ্যমে বিতর্কের প্রকৃত বিষয়বস্তু থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনা হয়, এবং কোনো ভুল ধারণার ভিত্তিতে যুক্তি উপস্থাপন করে বিতর্কে জয়লাভের ভান করা হয়। এভাবে আসল যুক্তি বা সমস্যার সমাধান করা হয় না, বরং বিষয়টি বিভ্রান্তিমূলক করে তোলা হয়।

উদাহরণসমূহ:

উদাহরণ ১:

  • প্রথম বক্তা (ক): “আমি বিশ্বাস করি না যে জলবায়ু পরিবর্তন অতটা জরুরি সমস্যা।”
  • দ্বিতীয় বক্তা (খ): “তাহলে তুমি আসলে বলছ যে, আমরা পরিবেশের প্রতি একেবারেই যত্ন না নিয়ে শুধু ব্যবসা করে যাই এবং প্রাকৃতিক সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলি। এটা খুবই বিপজ্জনক চিন্তা!”

এখানে বক্তা খ প্রথম বক্তা ক-এর বক্তব্যকে বিকৃত করেছে। ক আসলে বলেছিলেন যে, তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব নিয়ে সন্দিহান, কিন্তু তিনি কখনোই বলেননি যে সম্পূর্ণভাবে পরিবেশের অবহেলা করা উচিত। খড়ের মানুষ হারানোর মাধ্যমে বক্তা খ তার নিজের তৈরি কুযুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

উদাহরণ ২:

  • প্রথম বক্তা (ক): “আমি মনে করি আমাদের দেশের সামরিক খাতে বাজেট কমানো উচিত।”
  • দ্বিতীয় বক্তা (খ): “তাহলে তুমি বলছ যে, তুমি চাও আমাদের দেশের সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ুক এবং শত্রুদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ুক!”

এখানে ক-এর বক্তব্য ছিল সামরিক বাজেট কমানো, কিন্তু খ তার বক্তব্যকে বিকৃত করে এই ধারণা দিয়েছেন যে, ক আসলে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে চান, যা ক কখনোই বলেননি। এই ধরনের বিকৃত যুক্তি খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তির স্পষ্ট উদাহরণ।

উদাহরণ ৩:

  • প্রথম বক্তা (ক): “আমি মনে করি পশুদের ওপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা অন্যায়।”
  • দ্বিতীয় বক্তা (খ): “তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছ যে, আমাদের বিজ্ঞান ও চিকিৎসার অগ্রগতি বন্ধ করে দিতে হবে এবং আমরা যেন নতুন নতুন রোগের কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার না করতে পারি!”

এখানে খড়ের মানুষ হারানোর মাধ্যমে খ এমন একটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, যা ক কখনো বলেননি। ক-এর বক্তব্য ছিল পশুদের প্রতি নির্দিষ্ট পরীক্ষার বিরুদ্ধে, কিন্তু খ এটিকে বিকৃত করে একটি বড় এবং অপ্রাসঙ্গিক সমস্যার দিকে নিয়ে গেছেন।

খড়ের মানুষ কুযুক্তির প্রভাব

স্ট্রোম্যান ফ্যালাসি যুক্তি-তর্কের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং বিতর্ককে প্রকৃত বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এটি বেশ কয়েকটি প্রভাব ফেলতে পারে:

  • বিতর্কের মূল বিষয় থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া: এই কৌশল ব্যবহার করার মাধ্যমে বিতর্ককারী মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যান এবং একটি বিকৃত যুক্তির উপর জোর দেন। এতে আসল সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
  • বিপক্ষকে দুর্বল প্রমাণ করা: খড়ের মানুষ কুযুক্তির মাধ্যমে বিপক্ষের বক্তব্যকে বিকৃত করে তাকে দুর্বল দেখানো হয়, এবং সেই সাথে বক্তা নিজেকে শক্তিশালী যুক্তির অধিকারী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।
  • মিথ্যা বর্ণনা: এটি একটি বিকৃত বা মিথ্যা বর্ণনা তৈরি করে এবং সেই ভিত্তিতে বিতর্ক করা হয়, যা যুক্তির প্রকৃত প্রাসঙ্গিকতাকে নষ্ট করে দেয়। এর ফলে অনেক সময় শ্রোতারা বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং আসল সত্যের থেকে দূরে চলে যেতে পারেন।

খড়ের মানুষ কুযুক্তির বাস্তব প্রভাব এবং সমাধান

এই ধরনের কুযুক্তির প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত বিতর্কে সীমাবদ্ধ নয়, এটি রাজনীতি, সামাজিক আলোচনাসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। খড়ের মানুষ কুযুক্তি রাজনৈতিক বক্তৃতা ও প্রচারণায় খুবই সাধারণ, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা তাদের প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে বিকৃত করে সেই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে নিজেদের পক্ষে সমর্থন জোগানোর চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো রাজনৈতিক নেতা কোনো সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন, তখন প্রতিপক্ষ সেই প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেন।

সমাধান:

  1. যুক্তির সঠিক উপস্থাপনা: বিতর্ক বা আলোচনায় বিপক্ষের বক্তব্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরা উচিত এবং তা বিকৃত করা উচিত নয়।
  2. প্রশ্ন করা: যদি মনে হয় যে বিপক্ষের বক্তব্য বিকৃত করা হচ্ছে, তাহলে সরাসরি প্রশ্ন করা উচিত—”তুমি কি বলতে চাচ্ছ যে…?”—এভাবে মূল বক্তব্যকে পরিষ্কারভাবে জানা যায়।
  3. তথ্য-প্রমাণের ব্যবহার: যুক্তি তর্কে বাস্তব তথ্য ও প্রমাণ ব্যবহার করে আলোচনা করা উচিত, যাতে খড়ের মানুষ কুযুক্তির মতো বিকৃতির সম্ভাবনা কমে যায়।

খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি যুক্তি-তর্কের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ কিন্তু বিভ্রান্তিকর কৌশল, যা বিতর্ককে মূল বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এর মাধ্যমে একজন বক্তা তার বিপক্ষের বক্তব্যকে বিকৃত বা ভুলভাবে উপস্থাপন করে এবং সেই বিকৃত বক্তব্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে বিজয়ী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। এটি যুক্তির প্রকৃত গুণমানকে নষ্ট করে এবং সমস্যার প্রকৃত সমাধান খুঁজে পাওয়াকে কঠিন করে তোলে। এই ধরনের কুযুক্তি এড়ানোর জন্য আমাদের উচিত সতর্ক থাকা, সঠিকভাবে যুক্তি প্রদান করা এবং বিপক্ষের বক্তব্যকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা।


চক্রাকার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Circular logic Fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 13

চক্রাকার কুযুক্তি (Circular Logic বা Circular Reasoning) একটি সাধারণ যুক্তির ত্রুটি, যেখানে কোনো দাবীর সত্যতা প্রমাণ করতে সেই দাবী বা তার সাথে সম্পর্কিত আরেকটি দাবীকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, যুক্তির শুরু এবং শেষ একই স্থানে থাকে। এতে দাবি ও প্রমাণের মধ্যে কোনো নতুন তথ্য বা যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি হয় না, ফলে এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ এবং অযৌক্তিক যুক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।

উদাহরণ ১:

দাবী ১: বাইবেল যে সত্য, তার প্রমাণ কী?
উত্তর ১: বাইবেল সত্য কারণ ঈশ্বর বলেছেন বাইবেল সত্য।
দাবী ২: ঈশ্বর যে সত্য, তার প্রমাণ কী?
উত্তর ২: ঈশ্বর সত্য কারণ বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর সত্য।

এই উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, দাবী এবং প্রমাণ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এখানে বাইবেলের সত্যতা প্রমাণের জন্য ঈশ্বরকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, এবং ঈশ্বরের সত্যতা প্রমাণের জন্য বাইবেলকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি চক্রাকার যুক্তি, যেখানে কোনো নিরপেক্ষ বা বাহ্যিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় না। এমন যুক্তি প্রায়শই ধর্মীয় বা দার্শনিক বিতর্কে পাওয়া যায়, তবে এটি বাস্তব বা বৈজ্ঞানিক যুক্তির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এতে মূল দাবী প্রমাণের জন্য প্রমাণিত কোনো যুক্তি বা প্রমাণ উপস্থাপিত হয় না।

চক্রাকার যুক্তির ত্রুটি:

চক্রাকার যুক্তির মূল সমস্যা হলো, এতে যুক্তির প্রতিটি অংশ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং কোনো বাহ্যিক বা নিরপেক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় না। এটি একটি ‘Begging the Question’ ফ্যালাসি, যেখানে যুক্তির শুরুতেই যা প্রমাণ করতে হবে, তা ধরেই নেওয়া হয়।

আরও উদাহরণ:

উদাহরণ ২:
প্রশ্ন: কেন আমরা সংবিধান মেনে চলবো?
উত্তর: কারণ সংবিধান বলে আমরা সংবিধান মেনে চলতে হবে।
এখানে যুক্তি চক্রাকারে ঘুরছে। সংবিধানকে মেনে চলার কারণ হিসেবে সংবিধানকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা সঠিক যুক্তি নয়। সংবিধান মেনে চলার জন্য বাইরের কারণ, যেমন সামাজিক নিয়ম, নৈতিকতা বা আইনশৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা উচিত।
উদাহরণ ৩:
প্রশ্ন: কেন তোমার শিক্ষক সবসময় সঠিক?
উত্তর: কারণ শিক্ষক সবসময় সঠিক থাকে।
এখানেও একটি চক্রাকার যুক্তির উদাহরণ পাওয়া যায়। শিক্ষকের সঠিকতা প্রমাণের জন্য সঠিকতার দাবীকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কোনো নিরপেক্ষ বা বাহ্যিক তথ্য নেই যা শিক্ষককে সঠিক বলে প্রমাণিত করতে পারে।
উদাহরণ ৪:
প্রশ্ন: কেন গণতন্ত্র সেরা শাসনব্যবস্থা?
উত্তর: গণতন্ত্র সেরা কারণ মানুষ গণতন্ত্রকে পছন্দ করে।
এটি চক্রাকার যুক্তির আরেকটি উদাহরণ, যেখানে গণতন্ত্রকে সেরা প্রমাণের জন্য সেই সিস্টেমের জনপ্রিয়তাকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে অন্য কোনো প্রমাণ, যেমন গণতন্ত্রের সাফল্য, মানবাধিকার রক্ষা, বা ন্যায়বিচার ইত্যাদির ভূমিকা উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল।

চক্রাকার যুক্তির বৈশিষ্ট্য:

  • ১. আত্মনির্ভরশীলতা: চক্রাকার যুক্তিতে কোনো তথ্য প্রমাণ করার জন্য সেই তথ্যকেই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের যুক্তি নতুন কিছু উপস্থাপন করে না বা কোনো প্রমাণ দেয় না।
  • ২. বাহ্যিক প্রমাণের অভাব: চক্রাকার যুক্তিতে বাইরের বা স্বাধীন প্রমাণের অভাব থাকে। দাবীটি প্রমাণ করার জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের যুক্তি বা প্রমাণ থাকে না, যা দাবীর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারে।
  • ৩. যৌক্তিক ভিত্তি নেই: চক্রাকার যুক্তি প্রমাণিত হতে গেলে তথ্য বা প্রমাণের মাধ্যমে যুক্তির ভিত্তি তৈরি হওয়া প্রয়োজন। চক্রাকার যুক্তিতে কোনো বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয় না।
কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 15

চক্রাকার কুযুক্তি থেকে মুক্ত থাকার উপায়:

  • ১. বাহ্যিক প্রমাণ উপস্থাপন: কোনো দাবী প্রমাণ করার জন্য অবশ্যই বাহ্যিক বা স্বাধীন প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে, যা দাবীর সত্যতা নিশ্চিত করবে। দাবীকে প্রমাণ করার জন্য নিজস্ব ভিত্তিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা অযৌক্তিক।
  • ২. সমালোচনামূলক চিন্তা: চক্রাকার যুক্তি শনাক্ত করতে সমালোচনামূলক চিন্তা প্রয়োজন। যুক্তির প্রতিটি অংশ পর্যবেক্ষণ করে দেখুন, কোনো অংশই অন্য অংশের ওপর ভিত্তি করে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না।
  • ৩. নতুন তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ: যুক্তির সত্যতা নিশ্চিত করতে নতুন তথ্য বা প্রমাণের প্রয়োজন। প্রতিটি দাবীর পক্ষে স্বতন্ত্র প্রমাণ থাকা উচিত, যা দাবি এবং প্রমাণের মধ্যে একটি লজিক্যাল সম্পর্ক তৈরি করবে।

চক্রাকার কুযুক্তি যুক্তির একটি প্রচলিত ত্রুটি যেখানে দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য সেই দাবীকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি পদ্ধতি, কারণ এতে নতুন কোনো তথ্য বা প্রমাণ উপস্থাপিত হয় না। যুক্তিবাদ এবং বাস্তব প্রমাণের আলোকে সত্য খুঁজে পাওয়ার জন্য চক্রাকার যুক্তি থেকে মুক্ত থেকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ উপস্থাপন করাই হলো সঠিক পদ্ধতি।

চক্রাকার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

শুন্যস্থানের ঈশ্বর কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

God of the gaps

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 18

শূন্যস্থানের ঈশ্বর বা God of the Gaps হলো একটি বিশেষ কুযুক্তি, যেখানে কোনো অজানা বা ব্যাখ্যাতীত বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরকে ব্যবহৃত করা হয়। এ ধরনের যুক্তি মূলত মানুষের অজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল। যখন বৈজ্ঞানিকভাবে কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না বা তার জ্ঞানের শূন্যতা থাকে, তখন সেই শূন্যস্থান ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের যুক্তি বিজ্ঞান এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যার পরিবর্তে ধর্মীয় বিশ্বাস বা অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়।

শূন্যস্থানের ঈশ্বরের উদাহরণ

  • উদাহরণ ১:
    • দাবী: মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা বিজ্ঞান এখনো পুরোপুরি জানে না, তাই ঈশ্বরই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।
    • এখানে বিজ্ঞান এখনো মহাবিশ্বের সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বলে, সেই অজানা শূন্যস্থানকে ঈশ্বর দিয়ে পূর্ণ করা হচ্ছে। কিন্তু এটি যুক্তির একটি ত্রুটি, কারণ শুধুমাত্র একটি বিষয় অজানা থাকার কারণে তা ঈশ্বরের কাজ বলে দাবি করা যায় না। বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে, এবং নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হচ্ছে। অতএব, এই শূন্যতাকে ঈশ্বরের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যৌক্তিক নয়।
  • উদাহরণ ২:
    • দাবী: আমরা জানি না, কীভাবে প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে, তাই এটা নিশ্চিত যে ঈশ্বরই প্রাণ সৃষ্টি করেছেন।
    • এটি আবারো একটি God of the Gaps কুযুক্তি। প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে বিজ্ঞান এখনো চূড়ান্ত উত্তর দিতে পারেনি, কিন্তু তা মানে এই নয় যে, ঈশ্বরই তা সৃষ্টি করেছেন। বিজ্ঞানীরা এখনও প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বিভিন্ন তত্ত্ব ও প্রমাণ তুলে ধরছেন। অজানা কোনো কিছু ঈশ্বরের কর্ম বলে ধরে নেওয়া হলো একটি বড় ধরনের যুক্তিগত ত্রুটি।
  • উদাহরণ ৩:
    • দাবী: প্রাচীনকালে মিশরের পিরামিডগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে, তা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি, তাই এটা ঈশ্বরের কাজ।
    • এখানে পিরামিড তৈরির প্রকৃত প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ঈশ্বরের কাজ বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, মিশরের মানুষ পিরামিড নির্মাণে অত্যন্ত দক্ষ ছিল। অজানা বা অনির্ধারিত কোনো বিষয়কে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা কুযুক্তি ছাড়া কিছু নয়।

শূন্যস্থানের ঈশ্বর কুযুক্তির মূল সমস্যা

  1. অজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত: এই যুক্তির মূল সমস্যা হলো, এটি অজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি। যখনই কোনো বিষয় সম্পর্কে জানা হয় না, তখন সেই শূন্যস্থান ঈশ্বর দিয়ে পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অজানা বিষয়কে ঈশ্বরের কর্ম বলে গ্রহণ করা বিজ্ঞান বা যৌক্তিক চিন্তার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। অজ্ঞতার ভিত্তিতে করা সিদ্ধান্ত কোনো সঠিক প্রমাণ নয়।
  2. বিজ্ঞান সর্বদা অগ্রসরমান: বিজ্ঞান ক্রমাগত অজানা বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করছে। অনেক বিষয় যা একসময় অজানা ছিল, তা পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে জানা গেছে। যেমন, প্রাচীনকালে বজ্রপাতকে ঈশ্বরের ক্রোধের নিদর্শন হিসেবে ধরা হতো। কিন্তু এখন আমরা জানি, বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তাই অজানা কোনো বিষয়কে ঈশ্বরের কর্ম বলে মেনে নেওয়া কোনভাবেই প্রমাণিত হতে পারে না।
  3. ধর্ম এবং বিজ্ঞানের চিরন্তন দ্বন্দ্ব: শূন্যস্থানের ঈশ্বর তত্ত্ব মূলত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আসে, যেখানে বিজ্ঞান এবং যুক্তি-প্রমাণের চেয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের ওপর জোর দেওয়া হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যক্তিগত হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রমাণের পরিবর্তে কোনো ধর্মীয় মতবাদকে সত্য বলে দাবি করা যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
  4. যুক্তির অপব্যবহার: শূন্যস্থানের ঈশ্বর কুযুক্তি মূলত একটি ধরনের Argument from Ignorance বা অজ্ঞতার কুযুক্তি। এটি এমন একটি কৌশল যেখানে কোনো অজানা বিষয়কে প্রমাণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানে মূল যুক্তি হলো: “আমি জানি না, তাই এটা ঈশ্বর করেছে।” কিন্তু অজ্ঞতা কোনো প্রমাণ নয়। অজানা কোনো বিষয়কে জানার একমাত্র উপায় হলো গবেষণা, পরীক্ষা, এবং যুক্তি দ্বারা উত্তর খোঁজা, অমুক ঈশ্বরের অস্তিত্ব ধরে নেওয়া নয়।

বিজ্ঞান বনাম ধর্মঃ জ্ঞানের দাবী যাচাই

বিজ্ঞান এবং ধর্ম, এই দুইটি বিষয়ী মহাবিশ্বের উদ্ভব এবং অন্যান্য সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের দাবী করে। বিজ্ঞান প্রশ্ন করে এবং প্রমাণের ভিত্তিতে জবাব খোঁজে। অন্যদিকে, ধর্ম বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে চলে, যেখানে প্রমাণ প্রয়োজন হয় না। শূন্যস্থানের ঈশ্বর যুক্তি বিজ্ঞানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ বিজ্ঞান পরীক্ষানির্ভর প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ:

  • মহাবিশ্বের সৃষ্টি: একসময় মানুষ মনে করত যে, মহাবিশ্ব ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, কারণ তখন কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল না। এখন বিগ ব্যাং তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছে, যা ঈশ্বরের কোনো সরাসরি প্রয়োজন ছাড়াই ঘটতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করা হয়, কারণ তারা শূন্যস্থান পূরণের জন্য ঈশ্বরকে ব্যবহার করে।
  • বজ্রপাত: একসময় বজ্রপাতকে ঈশ্বরের ক্রোধ বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখন আমরা জানি এটি একটি বৈজ্ঞানিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে আকাশের বৈদ্যুতিক চার্জের অস্থিরতা বজ্রপাতের কারণ। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করা শূন্যস্থানের ঈশ্বর যুক্তির একটি উদাহরণ।
গড অফ দ্যা গ্যাপস কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

ব্যক্তির চরিত্র বিশ্লেষণী কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Ad Hominem Fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 21

যুক্তির জবাব যুক্তিতেই দেওয়া উচিত। তবে অনেক সময় যুক্তির মাধ্যমে সঠিক উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে, মানুষ যুক্তির পরিবর্তে বক্তার ব্যক্তিগত জীবন, চরিত্র বা সামাজিক অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে তার যুক্তি খণ্ডন করতে চেষ্টা করে। এই ধরনের কুযুক্তিকে বলা হয় “এড হোমিনেম ফ্যালাসি” বা “ব্যক্তির চরিত্র বিশ্লেষণী কুযুক্তি”। এটি যুক্তির ভুল প্রয়োগ, যেখানে ব্যক্তির চেহারা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মবিশ্বাস বা অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়ে আক্রমণ করে মূল যুক্তির ওপর প্রশ্ন তোলা হয় বা যুক্তিটিকে নাকচ করার চেষ্টা করা হয়।

১. এড হোমিনেম ফ্যালাসি কী?

এড হোমিনেম ফ্যালাসি (Ad Hominem Fallacy) হলো সেই যুক্তিক্রম বা কুযুক্তি, যেখানে যুক্তি বা তথ্যের পরিবর্তে বক্তার চরিত্র বা ব্যক্তিগত বিষয়ে আক্রমণ করা হয়। মূল যুক্তিকে খণ্ডন না করে বক্তার ব্যক্তিগত জীবন বা সামাজিক অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে তাকে অবমাননা করার মাধ্যমে তার যুক্তিকে বাতিল প্রমাণের চেষ্টা করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ:

  • দাবি: “তুমি যেহেতু ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্ব করো, তাদের দ্বারা আর্থিক সুবিধা নাও, তাই তোমার ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নাই।”
  • দাবি: “তুমি মুসলমান নও, তাই তোমার ইসলাম সম্পর্কে যুক্তিগুলো ভুল।”
  • দাবি: “তোমার চেহারা খারাপ, তাই তোমার যুক্তি ভুল।”

এই ধরনের মন্তব্যগুলিতে আসল যুক্তির কোনো খণ্ডন নেই, বরং বক্তার ব্যক্তিগত বিষয়ে আক্রমণ করে তাকে ছোট করা হয়, যেন তার যুক্তিকে মূল্যহীন করে তোলা যায়। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণের মাধ্যমে কোনো নিরপেক্ষ যুক্তি তৈরি হয় না।

২. এড হোমিনেম ফ্যালাসির ধরণ

এড হোমিনেম ফ্যালাসির বিভিন্ন ধরন রয়েছে, যা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি সাধারণ ধরন নিচে দেওয়া হলো:

  • অ্যাবিউজিভ এড হোমিনেম (Abusive Ad Hominem): এ ক্ষেত্রে বক্তার ব্যক্তিগত চরিত্রের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা হয়। যেমন, “তুমি সব সময় মিথ্যা বলো, তাই তোমার বক্তব্যও মিথ্যা।”
  • সারকামস্ট্যানশিয়াল এড হোমিনেম (Circumstantial Ad Hominem): এখানে বক্তার পরিস্থিতি, ধর্মবিশ্বাস, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে তার যুক্তিকে খারিজ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, “তুমি নাস্তিক, তাই তোমার ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলার অধিকার নেই।”
  • টুকোকুয় (Tu Quoque): এটি ব্যক্তির দ্বৈতনীতির ওপর আক্রমণ করে তার যুক্তিকে খারিজ করা হয়। যেমন, “তুমি নিজেও এই নিয়ম মেনে চল না, তাহলে আমি কেন মানব?”

৩. যুক্তির খণ্ডন নয়, ব্যক্তির অবমাননা

এড হোমিনেম ফ্যালাসি কুযুক্তি হিসেবে বিবেচিত কারণ এতে আসল সমস্যাটি বা যুক্তির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বক্তার ব্যক্তি চরিত্রে আক্রমণ করা হয়। এটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের অভাবকে তুলে ধরে, যেখানে বক্তার বক্তব্যের ভিত্তিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। এর মাধ্যমে মূল বক্তব্যকে অস্বীকার না করে বক্তাকে তার ব্যক্তিগত পরিচিতি বা সামাজিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে অবমাননা করা হয়।

যেমন, “তুমি মুসলমান না, সুতরাং ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার তোমার নেই” — এটি একটি এড হোমিনেম ফ্যালাসির সেরা উদাহরণ। এখানে বক্তার বক্তব্যের যুক্তি বা সঠিকতা নিয়ে কোনো আলোচনা করা হচ্ছে না, বরং তার ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে তার বক্তব্যকে খারিজ করা হচ্ছে। অথচ, একজন মানুষ কোন ধর্মের অনুসারী কিনা, সেটি তার জ্ঞানের উৎস হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়।

৪. এড হোমিনেম ফ্যালাসি ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট

ধর্মীয় আলোচনা বা বিতর্কে এড হোমিনেম ফ্যালাসির প্রচলন অত্যন্ত বেশি দেখা যায়। যখন কেউ ধর্মীয় বিধান বা প্রথা নিয়ে সমালোচনা বা প্রশ্ন করে, তখন সেই ব্যক্তির চরিত্র বা সামাজিক পরিচয়কে আক্রমণ করে তার বক্তব্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ:

  • “তুমি মুসলমান নও, সুতরাং তোমার ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই।”
  • “তুমি নাস্তিক, তাই তোমার কোনো নৈতিক মূল্যবোধ নেই।”

এ ধরনের যুক্তি ধর্মীয় সমালোচনা থেকে সরিয়ে আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি করে। কিন্তু এ ধরনের আক্রমণ যুক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কোনো ব্যক্তি তার ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে সত্য-মিথ্যার বিচার করতে পারেন না, বরং যুক্তি এবং প্রমাণের ভিত্তিতেই এর সমাধান হওয়া উচিত।

৫. মৌলিক যুক্তির গুরুত্ব

যুক্তি এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো, যুক্তির মাধ্যমে একটি সঠিক উপসংহার বের করা। এটি কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন বা পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে না। সত্যিকারের আলোচনা তখনই সফল হয়, যখন যুক্তি, প্রমাণ এবং তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বক্তার ব্যক্তিগত জীবন, ধর্মবিশ্বাস, পরিচয় বা সামাজিক সম্পর্ক যুক্তির বিশ্লেষণে কোনো ভূমিকা রাখে না।

৬. উদাহরণ: ইহুদি বন্ধু এবং ইসলাম সমালোচনা

ধরুন, একজন ব্যক্তি ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করছে এবং সে একই সময়ে ইহুদিদের বন্ধু বা ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের কারো সাথে তার কোন আর্থিক লেনদেন রয়েছে। এখন যদি কেউ তার যুক্তি বা সমালোচনাকে খণ্ডন করতে না পেরে বলে, “তুমি যেহেতু ইহুদিদের বন্ধু, তোমার যুক্তি ভুল,” তাহলে এটি একটি এড হোমিনেম ফ্যালাসির উদাহরণ। বক্তার বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কারণ মূল বিষয় হলো তার যুক্তি। তার বন্ধুত্ব বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তার যুক্তির মূল্যায়ন বদলাবে না।

৭. এড হোমিনেম ফ্যালাসি এবং যুক্তিবাদী সমাজ

একটি যুক্তিবাদী সমাজে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভ করে, এবং সেই মতামতের ভিত্তিতে যুক্তি বিশ্লেষণ করা হয়। ব্যক্তিগত আক্রমণ বা এড হোমিনেম ফ্যালাসি একটি যুক্তিবাদী সমাজে স্থান পাওয়ার কথা নয়, কারণ এটি প্রকৃত আলোচনা ও সমালোচনার পথ রুদ্ধ করে। যুক্তির মাধ্যমে একটি সমাজ গড়ে ওঠে, যেখানে সত্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

এড হোমিনেম ফ্যালাসি একটি কুযুক্তি যা যুক্তির যথার্থতাকে খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয় এবং পরিবর্তে ব্যক্তির চরিত্র বা ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে আক্রমণ করে। এটি যুক্তির সঠিক ধারাকে ভ্রান্তপথে নিয়ে যায় এবং প্রকৃত আলোচনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ধর্মীয় বা সামাজিক আলোচনায় এ ধরনের ফ্যালাসির প্রচলন থাকলেও, এটি যুক্তিবাদী সমাজে অগ্রহণযোগ্য। সত্যিকারের যুক্তিতর্ক তখনই সঠিক উপায়ে হয়, যখন আলোচনায় ব্যক্তিগত আক্রমণের পরিবর্তে প্রমাণ, যুক্তি এবং তথ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।


কুমতলব বা খারাপ উদ্দেশ্য কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Ad Hominem (Circumstantial)/ Appeal to motive

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 23

Appeal to motive is a pattern of argument which consists in challenging a thesis by calling into question the motives of its proposer. It can be considered as a special case of the ad hominem circumstantial argument.
কোন যুক্তির পেছনে যুক্তিদানকারীর স্বার্থ রয়েছে এমনটা দেখিয়ে যুক্তি বা দাবীকে ভুল বললে বা নাকোচ করলে এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়। এখানে যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি নয়, যুক্তিদানকারী কী উদ্দেশ্যে যুক্তি দিচ্ছে, সেই নিয়েই আলোচনা চলে।

Appeal to Motive কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

উদাহরণঃ

১। ধরা যাক, ইসলামে শিশু বিবাহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরকম অবস্থায় একজন বললো, আপনি ইসলামের বিরুদ্ধে যুক্তি দিচ্ছেন, নিশ্চয়ই আপনি ইহুদীদের থেকে টাকা পয়সা নিচ্ছেন।
– এখানে, ইসলামের পক্ষে যিনি বলছেন, তিনি শিশু বিবাহের ভাল খারাপ দিক নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা না করে কী উদ্দেশ্যে কেউ এই যুক্তি দিচ্ছে, কার থেকে টাকা পয়সা পাচ্ছে, তার দিকে নির্দেশ করছেন। যুক্তিবিদ্যায় একে এড হোমিনেম ফ্যালাসি বলে। উল্লেখ্য, কল্পিত ইহুদীদের থেকে যদি কেউ টাকা নিয়েও থাকে, তাতেও শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে যিনি যুক্তি দিচ্ছেন, সেই যুক্তিটি ভুল প্রমাণ হয় না।

২। গাড়ির ডিলার – কনজিউমার রিপোর্ট অনুযায়ী এই আমাদের গাড়ি এভারেজ গ্যাস মাইলেজের গাড়িগুলোর থেকে ভাল, আর এটা বর্তমানে গাড়ির সবচেয়ে রিলায়াবল ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে একটি।
ক্রেতা – এর সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, তুমি তো বিক্রির জন্য এটা বলবেই, এটাই তো তোমাদের ব্যবসা।

লক্ষ্য করে দেখুন, ক্রেতা এখানে গাড়ির যন্ত্রাংশ নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা না করে, এটাই যে গাড়ির ডিলারের ব্যবসা সেই দিকে নির্দেশ করছেন। তাই এটি একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি। গাড়ি বিক্রেতার গাড়ি বিক্রির জন্য ইন্টারেস্ট আছে এই অজুহাত দিয়ে এখানে গাড়ির মানকে অস্বীকার করা হচ্ছে, যেখানে বিক্রেতার সেরকম কোন ইন্টেনশন নাও থাকতে পারে, বা বিক্রেতার বক্তব্যে সেরকম ইন্টেনশনের প্রভাব নাও পড়তে পারে।

৩।
– মব যদি উত্তেজিত হয়ে ধর্ষককেও গণপিটুনি দেয় তা সঠিক হবে না, এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রকাশিত হয়, তাকে পুলিসে দেয়া প্রয়োজন।
– তুমি ধর্ষককে সমর্থন করছ, ধর্ষকের প্রতি সমবেদনা দেখাচ্ছ, এদেশের লোকেদের তো ইন্টেনশনই আছে ধর্ষকদের পক্ষ নেবার, তুমিও সেই পথে যাচ্ছ
(অতএব তোমার কথাগুলো ভুল)।

এখানে কাল্পনিকভাবে ধর্ষণের সপক্ষের মোটিভকে নিয়ে এসে অপরাধীর প্রতি মব জাস্টিসের বিরুদ্ধের যুক্তিকে নাকোচ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ভণ্ডামি আশ্রিত কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Appeal to hypocrisy/ Tu quoque

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 26

১।
ধরুন, আওয়ামী লীগ নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপি নেতা তারেক জিয়াকে বললো, তুমি একজন দুর্নীতিবাজ।
উত্তরে তারেক জিয়া বললো, তুমিও তো দুর্নীতি করো, বা ডোনাল্ড ট্রাম্পও তো দুর্নীতি করে বা এরশাদও তো দুর্নীতি করেছিল।

২।
প্রস্তাব – ইসলামে নারীর মানবিক অবস্থান খুবই অসম্মানজনক।
কুযুক্তি – হিন্দু ধর্মে নারীর অধিকার কতটুকু? সেখানেও তো অসম্মানজনক।

এই ধরণের উত্তর একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি, যাকে বলা হয় এপিল টু হিপোক্রেসি বা ট্যু ক্যুও- ক্যুই। মানে হচ্ছে, ইউ ট্যু বা তুমিও। কিন্তু অন্য আরেকজন দুর্নীতি করলেই প্রথম জনার দুর্নীতির দাবীটি মিথ্যা হয়ে যায় না। বা হিন্দু ধর্মে নারী অসম্মানজনক অবস্থানে থাকলেই ইসলামে নারীর অবস্থান সম্মানজনক তা প্রমাণ হয় না। এই কুযুক্তিটি ধার্মিক সমাজে বহুল প্রচলিত এবং এই যুক্তি দ্বারাই সাধারণত বিপক্ষকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করা হয়। ইসলামি জঙ্গিবাদের সমালোচনার সময় তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের উদাহরণ তুলে আনেন, কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতিত হয়ে থাকলে ইসলামি জঙ্গিবাদ তাতে জাস্টিফায়েড হয় না। আরেকটি অন্যায়ের উদাহরণ প্রথম অন্যায়টিকে ন্যায় বানাতে পারে না।

ভণ্ডামি আশ্রিত কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Burden of proof

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 29

অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি” হচ্ছে একটি সাধারণ যুক্তির ত্রুটি বা কুযুক্তি, যেখানে কেউ কোন দাবী উত্থাপন করে কোন প্রমাণ সরবরাহ না করে অপর পক্ষকেই তার দাবীটি ভুল প্রমাণের জন্য উৎসাহিত করে, এবং সেটি করতে না পারলে তার দাবীটিকে মেনে নেয়ার আহবান জানায়। “অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি” বা Burden of Proof বা “অপ্রমাণের বোঝা” যুক্তিবিদ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কুযুক্তি, যা সাধারণত বিতর্ক বা যুক্তি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই কুযুক্তি দ্বারা বোঝা যায়, যে ব্যক্তি কোনো দাবী করছে, সেই ব্যক্তির ওপরই প্রমাণ উপস্থাপনের দায়িত্ব বর্তায়। অপরপক্ষকে তার দাবী অপ্রমাণ করতে হবে না। অর্থাৎ, দাবীকর্তারই তার বক্তব্যের যথার্থতা নিশ্চিত করতে হবে, প্রমাণ দিতে হবে যে তার দাবী সত্য।

ঘটনা-১

দাবী: আমি তোমার কাছে দশ লক্ষ টাকা পাই।
প্রশ্ন: টাকা যে পাও, তার প্রমাণ কী? কোনো কাগজপত্র বা এভিডেন্স আছে?
কুযুক্তি: আমি যে টাকা পাই না, তা কি তুমি প্রমাণ করতে পারবে?


এই ঘটনায় দাবী করা হয়েছে, “আমি তোমার কাছে দশ লক্ষ টাকা পাই।” সাধারণত এমন ধরনের আর্থিক দাবীতে চুক্তিপত্র বা অন্যান্য প্রমাণ থাকা উচিত। প্রশ্নকারী যুক্তিযুক্তভাবে প্রমাণের দাবী করছে—টাকা পাওয়ার কোনো লিখিত কাগজপত্র বা চুক্তি কি আছে?
দাবীকারী তার পক্ষের প্রমাণ না দিয়ে প্রশ্নকারীকে চ্যালেঞ্জ করছে, “আমি যে টাকা পাই না, তা কি তুমি প্রমাণ করতে পারবে?” এটি অপ্রমাণের বোঝা অন্যের ওপর চাপানোর একটি উদাহরণ। দাবীকর্তার উচিত তার দাবীকে প্রমাণ করা, কিন্তু তিনি প্রমাণের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং অপ্রমাণের বোঝা অন্যের উপর চাপাচ্ছেন। অর্থাৎ, তার দাবি প্রমাণিত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাবিটি বাতিল হবে।

ঘটনা-২

দাবী: আমি রোজ সকালে আকাশে উড়তে পারি।
প্রশ্ন: উড়তে পারো, তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তি: আমি রোজ সকালে উড়তে যে পারি না, তা তুমি প্রমাণ করতে পারবে?


এখানেও দাবীকর্তা একটি অদ্ভুত ও অসম্ভব দাবি করেছেন—”আমি রোজ সকালে আকাশে উড়তে পারি।” প্রশ্নকারী যৌক্তিকভাবে প্রমাণের দাবী করেছে, যেমন উড়ার ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি। কিন্তু দাবীকর্তা আবারো প্রমাণের দায়িত্ব অস্বীকার করে উল্টো প্রশ্ন করছে, “আমি উড়তে পারি না, তা তুমি প্রমাণ করতে পারবে?”
এটি স্পষ্টতই অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর উদাহরণ। দাবীকর্তা অসাধারণ এক দাবি করছেন, কিন্তু সেটি প্রমাণের জন্য উপযুক্ত কোনো প্রমাণ দিচ্ছেন না। এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি কারণ অসাধারণ দাবি অসাধারণ প্রমাণের দাবী করে।

ঘটনা-৩

দাবী: স্যুপারম্যানের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয়।
প্রশ্ন: স্যুপারম্যান যে আছে, তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তি: স্যুপারম্যান নেই, তা প্রমাণ করতে পারবে?


এই উদাহরণে দাবীকর্তা বলেছেন, “স্যুপারম্যানের সাথে প্রতিদিন কথা হয়।” এটি একটি কাল্পনিক চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত দাবি, যা বাস্তবতার সাথে মেলে না। প্রশ্নকারী সঠিকভাবে জানতে চেয়েছে, “স্যুপারম্যান আছে, তার প্রমাণ কী?” কিন্তু দাবীকর্তা প্রমাণ না দিয়ে আবারও প্রশ্নকারীকে চ্যালেঞ্জ করছে, “তুমি প্রমাণ করতে পারবে স্যুপারম্যান নেই?”
এটিও অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর একটি ক্লাসিক উদাহরণ। দাবীকর্তার দায়িত্ব ছিল প্রমাণ করা যে স্যুপারম্যান সত্যিই আছে, কিন্তু তিনি তা না করে প্রতিপক্ষকে তার দাবিটি অপ্রমাণ করার দায়িত্ব দিচ্ছেন।

অপ্রমাণের বোঝা (Burden of Proof) এর মূলনীতি

যুক্তিবিদ্যায় এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে “অপ্রমাণের বোঝা” এই ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মূলনীতি হলো:

  1. দাবী উত্থাপনের দায়: যে ব্যক্তি কোনো দাবি উত্থাপন করেন, তারই দায়িত্ব সেই দাবী প্রমাণ করার। অন্য কেউ সেই দাবী অপ্রমাণ করার জন্য বাধ্য নয়।
  2. যথাযথ প্রমাণের প্রয়োজন: দাবীর সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ না থাকলে সেই দাবীকে গ্রহণযোগ্য বা সঠিক বলে বিবেচনা করা যায় না।
  3. বিশেষ দাবী, বিশেষ প্রমাণ: কোনো অসাধারণ বা বিশেষ দাবী করা হলে, সেটির সপক্ষে বিশেষ বা শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। যেমন, কেউ যদি দাবি করে যে সে আকাশে উড়তে পারে, তবে তার জন্য শক্তিশালী প্রমাণ, যেমন ভিডিও বা প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রয়োজন।
  4. অপ্রমাণের বোঝা চাপানো: প্রমাণের অভাবে কেউ যদি প্রতিপক্ষকে তার দাবী অপ্রমাণ করতে বাধ্য করে, তাহলে এটি যুক্তি ত্রুটির উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।

কুযুক্তির পরিচয়: অপ্রমাণের বোঝা চাপানো

অপ্রমাণের বোঝা চাপানোর কৌশল প্রায়শই তর্কবিতর্ক বা মিথ্যা দাবীগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহৃত হয়। দাবীকর্তা যখন নিজে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তিনি অপ্রমাণের দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন। এতে তার দাবীকে সঠিক প্রমাণ করতে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও, প্রশ্নকারীকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। যুক্তিবিদ্যায় এটি একটি কুযুক্তি হিসেবে পরিচিত এবং এর মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।

“অপ্রমাণের বোঝা” হলো যুক্তি এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে প্রমাণের সঠিক দায়িত্বের ধারণা। যে কেউ কোনো দাবী করে, তারই দায়িত্ব সেই দাবী প্রমাণ করা, অন্যের ওপর প্রমাণের দায় চাপানো যৌক্তিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। উপরোক্ত ঘটনাগুলিতে প্রতিটি দাবীকর্তা প্রমাণ না দিয়ে অপ্রমাণের দায় অন্যের ওপর চাপিয়েছেন, যা যুক্তির নিয়মের পরিপন্থী। সঠিক প্রমাণ ছাড়া কোনো দাবী গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, এবং এরকম দাবী খারিজ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।


অপ্রাসঙ্গিক তর্কের কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Red herring

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 31

Red Herring কুযুক্তি তখন ঘটে যখন কেউ মূল তর্ক বা প্রশ্ন থেকে মনোযোগ সরিয়ে ভিন্ন, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে নিয়ে যায়। এটি যুক্তির একটি বিকৃত রূপ, যেখানে প্রাথমিক প্রশ্ন বা দাবির যথাযথ জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়া হয়।

কেন Red Herring কুযুক্তি একটি ফ্যালাসি?

Red Herring fallacy যুক্তি বা আলোচনা ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়ে মূল সমস্যাটি সমাধান বা পরিষ্কার করতে বাধা সৃষ্টি করে। এটি জ্ঞানের পরিসরে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সত্য থেকে দূরে সরিয়ে ফেলে। যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা, কারণ শ্রোতারা মূল প্রসঙ্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।

  • উদাহরণ ১: ভুতের অস্তিত্বের প্রসঙ্গ
    • দাবীঃ আমার মনে হয় ভুত আছে।
    • প্রশ্নঃ ভুত যে আছে, তার প্রমাণ কী?
    • দাবীঃ এই যে আমরা জন্মেছি, মারা যাচ্ছি, এগুলো তো সত্য, তাই না? মারা যে যাচ্ছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
    • উপরের দাবীগুলো লক্ষ্য করুন। দাবীকারী প্রথমে বললো ভুত আছে। প্রমাণ চাওয়া মাত্রই তিনি আলোচনা ভিন্ন একদিকে নিয়ে গেলেন, যেই আলোচনায় তার কথাগুলো আপাত দৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও, তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবেই আসলে জন্ম মৃত্যুর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। যার সাথে ভুত থাকা না থাকা সম্পর্কহীন। পরের ধাপে তিনি যতই যৌক্তিক কথা বলুন না কেন, তার সকল যুক্তিই কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলে বিবেচিত হবে। কারণ তিনি মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্যদিকে চলে গেছেন।
  • উদাহরণ ২: রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ইস্যু
    • একজন রাজনীতিবিদ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নের জবাবে আগের সরকারের সমালোচনা বা জনস্বাস্থ্য বা ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন, তখন এটি Red Herring fallacy-এর উদাহরণ। মূল প্রশ্ন অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে, কিন্তু মনোযোগ সরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
  • উদাহরণ ৩: পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
    • ধরা যাক, কেউ প্রশ্ন তুলল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ কী? এর উত্তরে যদি বলা হয়, “মানুষের সামাজিক আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে, এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ,” এবং এরপরে যদি মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মানুষের সামাজিক আচরণ নিয়ে বক্তা কথা বলতে শুরু করে, সেই কথাগুলো যত যৌক্তিকই হোক না কেন, সেগুলো এক একটি Red Herring। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে সামাজিক আচরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও, এটি মূল প্রশ্নের সরাসরি জবাব নয়।

Red Herring fallacy একটি সাধারণ কৌশল যা মূল প্রসঙ্গ থেকে সরিয়ে দেয় এবং আলোচনাকে বিভ্রান্ত করে। এটি যুক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে নষ্ট করে দেয় এবং মানুষকে সত্য জানতে বাধা দেয়। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এই ধরনের কুযুক্তিকে শনাক্ত করা এবং এড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Red herring কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

মিথ্যা উভসঙ্কট কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

False dilemma

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 34

ধরুন, কেউ সমাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে বাক স্বাধীনতা নেই, সেখানে ধর্ম পালনের অধিকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হয় ইত্যাদি। এবং কঠোর সমালোচনার ফলাফল হিসেবে নিয়ে আসছে শরিয়া আইনকে। বোঝাতে চাচ্ছে, যেহেতু সমাজতন্ত্র বাক স্বাধীনতা হরণ করে, তাই দেশে শরিয়া আইনের কোন বিকল্প নেই। যেন মানুষের সমাজতন্ত্র এবং শরীয়া আইন, এই দুইয়ের মধ্যেই পছন্দ করতে হবে। আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সমাজতন্ত্র বাক স্বাধীনতা খর্ব করলে শরীয়া আইন তার শতগুণ বেশি করে। মানুষের কাছে সমাজতন্ত্র এবং শরীয়া আইন ছাড়াও অনেকগুলো অপশন রয়েছে। যেমন সোশ্যাল ডেমোক্রেসি, এরকম আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। তাই সবগুলো পছন্দ সামনে না আনাকে ফলস ডিলেম্মা বলা হয়। যুক্তিবিদ্যায় এই চালাকিপূর্ণ কুযুক্তি বা ফ্যালাসি খারিজ করে দেয়া হয়।

মিথ্যা উভসঙ্কট কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

সহি ইসলাম নহে কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

No true scotsman

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 37

এটি আরেকটি বহুল প্রচলিত কুযুক্তি। কোন বিপদ দেখলেই উনি সত্যিকারের স্কটসম্যান নহেন, সহিহ নহেন, ইত্যাদি বলতে থাকাকে যুক্তি বিদ্যায় নো ট্রু স্কটসম্যান কুযুক্তি বলা হয়। নিচের উদাহরণগুলো লক্ষ্য করুন-


দাবীঃ জামাতে ইসলামির একজন নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন।
কুযুক্তিঃ উনি সত্যিকারের জামাতি নহেন।


দাবীঃ আওয়ামী লীগের এক নেতা দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন।
কুযুক্তিঃ উনি সহিহ আওয়ামী লীগার নহেন।


দাবীঃ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বার্মিজরা অত্যাচার চালাচ্ছে।
কুযুক্তিঃ যারা অত্যাচার করছে তারা সহিহ বার্মিজ নহেন।


দাবীঃ প্যালেস্টাইনে ইসরাইল আবারো আক্রমণ করেছে।
কুযুক্তিঃ ওরা সহিহ ইসরাইলী নহেন।


দাবীঃ হোলি আর্টিজানে ইসলামি জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে।
কুযুক্তিঃ ওরা সহিহ মুসলমান নহেন।

লক্ষ্য পরিবর্তন কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Moving the goalposts

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 39

মুভিং দ্যা গোলপোস্ট হচ্ছে একটি ইনফরমাল লজিক্যাল ফ্যালাসি। বিতর্ক বা আলোচনার মূলবিষয়বস্তু থেকে সরে গিয়ে নতুন আরেকটি বিষয় নিয়ে বিতর্কের সুচনা করা, বা বিতর্কের মধ্যেই বিতর্কের নিয়ম পরিবর্তনের চেষ্টাকে লক্ষ্য পরিবর্তন কুযুক্তি বা কৌশল বলা হয়।

ধরুন, দুটি দল ফুটবল খেলছে। কিন্তু একপক্ষ বিপরীতদিকে কিছুতেই গোল দিতে পারছে না। অপরপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়ারগণ তাদের আটকে দিচ্ছে। তাই তারা নিজেদের দিকেই বিপরীতপক্ষের গোলপোস্ট বানিয়ে সেখানেই গোল দেয়া শুরু করলো। কারণ নিজেদের দিকে গোল দেয়াই সহজ। তারা দাবী করতে লাগলো, এটাই অপরপক্ষের গোলপোস্ট, তারা এখানে গোল দিলেই হবে। কিন্তু একই নিয়ম বিপরীতপক্ষের জন্য প্রযোজ্য হবে না। মানে, বিপরীত পক্ষ তাদের দিকে গোলপোস্ট বানিয়ে গোল দিতে পারবে না। এই সুবিধাটি শুধুমাত্র তাদের জন্যেই প্রযোজ্য।

খেলার মাঝখানে এই নতুন নিয়ম আরোপ করে, নতুন লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে, সুবিধাজনক অবস্থানে গোলপোস্ট বানিয়ে গোল দেয়া, এটি কোন অবস্থাতেই ন্যায়সঙ্গত নয়। এইসব যুক্তি শুধুমাত্র অশিক্ষিত মূর্খ মানুষদেরই তর্কে জয়ী হওয়ার কৌশল। তাদের সৎভাবে যুক্তি প্রমাণকে যাচাই বাছাইয়ের চাইতে, তর্কে জেতাই মূখ্য। তা যেভাবেই হোক না কেন।

উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন আলোচনা হচ্ছে, নবী মুহাম্মদ দাসীর সাথে যৌনকর্ম করতো নাকি করতো না। এই আলোচনায় সমস্ত তথ্য প্রমাণই বলবে, নবী মুহাম্মদ দাসীর সাথে যৌনকর্ম করতো। এখন মুমিন ভাইটি তর্কে কীভাবে জিতবে? তথ্যপ্রমাণ তো বলছে, রেফারেন্স তো বলছে ঘটনা সত্য! তাহলে উপায় কী?

এই অবস্থায় মুমিন ভাইটির কাজ হবে, মুভিং দ্যা গোলপোস্ট ফ্যালাসি ব্যবহার করা। আলোচনার মূল লক্ষ্যবস্তুটি ঘুরিয়ে ফেলতে হবে। এমনভাবে ঘোরাতে হবে যেখানে মুমিন ভাইটিই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। যেমন, মুমিন ভাইটি বলতে শুরু করলো, তৎকালীন সমাজে দাসীদের ওপর অনেক অত্যাচার করা হতো। অনেক নির্যাতন হতো। নবী মুহাম্মদ সেইখানে কয়েকজন দাসদাসীকে মুক্ত করেছিলেন।

নিঃসন্দেহে নবী মুহাম্মদ কোন দাসদাসীকে ধর্ম বর্ণ ইত্যাদি ভেদাভেদ না করে মুক্ত করে থাকলে সেটি প্রশংসনীয় বিষয়। সেইসময়ে দাসদাসীদের ওপর নির্যাতনের কথাও মিথ্যা নয়। একইসাথে এটাও সত্য, সেই সময়ের কাফেরদের অনেকেই অনেক দাস মুক্ত করেছেন। মুহাম্মদের জন্মের সময়ই মুহাম্মদের চাচা আনন্দিত হয়ে কয়েকজন দাসকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাই এখানে নবী মুহাম্মদকে কোন অতুলনীয় কৃতিত্ব দেয়া যায় না। কিন্তু সেই আলোচনাটিই একদম অন্য একটি আলোচনা। আমাদের মূল আলোচনা ছিল, নবী তার দাসীর সাথে সহবত করতেন কিনা। মুমিন ভাইটি খুব কৌশলে মুভিং দ্যা গোলপোস্ট কুযুক্তি বা ফ্যালাসি ব্যবহার করে গোলপোস্টটি তার সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে গেছেন। বিতর্কের ক্ষেত্রে এই কাজটি অসততা। তবে অশিক্ষিত মানুষদের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার কৌশল।

তালগাছ আমার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Argument from final Consequences

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 41

উপস্থাপিত যুক্তি তথ্য প্রমাণ যাই হোক না কেন, যুক্তিতর্কের ফলাফল আপনি আগেই নির্ধারণ করে সেই বিশ্বাসে স্থির থাকলে তাকে আমরা বলি আর্গুমেন্ট ফরম ফাইনাল কন্সিকুয়েন্সেস। ধরুন আপনার বিশ্বাস হচ্ছে, বিবর্তনতত্ত্ব মিথ্যা। আপনি বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করতে আসলেন, এবং বিবর্তনের সপক্ষে সমস্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি শোনার পরেও, তার বিপরীতে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও আপনি বলতে থাকলেন, যত যাই হোক, বিবর্তনতত্ত্ব মিথ্যা। কারণ আপনার আস্থা যুক্তি বা প্রমাণে নয়, আপনার আস্থা বিশ্বাসে। এরকম অবস্থায় আপনার অবস্থানকে তালগাছবাদী কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলা হবে।

তালগাছ আমার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

পক্ষপাতদুষ্ট নিশ্চিত কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Confirmation Bias Fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 44

যেহেতু আপনি মুসলিম পরিবারে জন্মেছেন এবং ছোটবেলা থেকে ইসলাম ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাই আপনার দাবী হচ্ছে, পৃথিবীর ৪২০০ টি ধর্মের মধ্যে আপনার ধর্মটিই একমাত্র সত্য এবং সঠিক। বাদবাকি সবই ভুয়া এবং বিকৃত। আপনি ভারতের কোন হিন্দু পরিবারে জন্মালে ঠিক একইভাবে একই যুক্তিতে হিন্দু ধর্মটিই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে তখন আপনার মনে হতো। যেহেতু আপনি কোন ধর্মটি সঠিক তা তথ্য প্রমাণ দিয়ে যাচাই বাছাই না করে শুরুতেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জন্মসূত্রে পাওয়া আপনার ধর্মটিই একমাত্র সঠিক, তাই আপনার দাবী পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। তাই এই যুক্তিটি একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষই মনে করেন, তিনি যেই পরিবারে ঘটনাচক্রে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ধর্মটিই একমাত্র সত্য। তিনি তার ধর্মের সপক্ষে যেসকল যুক্তি আছে, সেগুলো খুঁজে বের করেন, এবং সেইগুলোই প্রচার করেন। তার ধর্মের বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে তিনি এড়িয়ে যান বা বাতিল করে দেন।

Confirmation Bias Fallacy কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Special Pleading Fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 47

আপনার দাবীঃ সব কিছুরই স্রষ্টা থাকতে হবে। স্রষ্টা ছাড়া কোনকিছু এমনি এমনি হওয়া সম্ভব না।
প্রশ্নঃ তাহলে স্রষ্টার সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে? কে করেছে? তিনি কী এমনি এমনি হয়েছেন?
দাবীঃ হ্যাঁ তিনি এমনি এমনিই হয়েছেন। তার কোন স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বয়ম্ভু, স্বয়ংসম্পূর্ণ।
প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি কিছুক্ষণ আগেই তো বললেন, সবকিছুরই স্রষ্টা থাকতে হবে। সেই একই যুক্তিতে, স্রষ্টার স্রষ্টা না থাকাটা আপনার যুক্তির বরখেলাপ হয়ে গেল না?
দাবীঃ আল্লাহ একটি স্পেশাল ক্যারেকটার। উনি সৃষ্টির উর্ধ্বে। উনার স্রষ্টার প্রয়োজন নেই।

উপরের দাবী অনুসারে, প্রথমে তিনি একটি প্রস্তাব দিয়েছেন যে, সবকিছুরই স্রষ্টা থাকা অত্যাবশ্যক। পরে তিনি নিজেই আবার আল্লাহ বা ঈশ্বরকে সেই প্রস্তাবের বাইরে কিছু স্পেশাল সুবিধা দেয়ার দাবী জানিয়েছেন, এই বলে যে, উনি এই প্রস্তাব বা নিয়মের উর্ধ্বে। এটি একটি কুযুক্তি। একে বলা হয় স্পেশাল প্লিয়েডিং ফ্যালাসি। যখন কারও দেয়া সূত্র বা প্রস্তাব বা রুল সে বা অন্য কেউ ভঙ্গ করে, এবং সেই ভঙ্গ করাকে তিনিই স্পেশাল কিছু সুবিধা বলে চালিয়ে দিতে চান, তাকে আমরা স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলতে পারি।

Special Pleading Fallacy কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

ব্যাখ্যা ও অজুহাত বা ন্যায্যতা প্রতিপাদনকে গুলিয়ে ফেলা

Confusing an explanation with an excuse

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 50

কোন ঘটনার ব্যাখ্যা (explanation), অজুহাত (excuse) এবং ন্যায্যতা প্রদান(justification) তিনটি আলাদা বিষয়। কোন ঘটনার ব্যাখ্যাকে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন বা অজুহাত হিসেবে মনে করলে এই হেত্বাভাস হয়। অনেক মানুষই নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তথাকথিত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে, যা আসলে ব্যাখ্যা নয়, এক ধরণের অজুহাত। কোনটি ন্যায্যতা প্রতিপাদন, ব্যাখ্যা আর কোনটি অজুহাত, তা গুলিয়ে ফেলা অনেক মানুষেরই স্বভাব।

Explanation: A statement or account that makes something clear.
Justification: Justification is about giving ‘reasonable reason’ for what was done (or not). It considers the context and concludes that fair play was served.
Excuse: a reason or explanation given to justify a fault or offence.

Explanation or Excuse কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

উদাহরণ:

১।
বক্তা ১ – পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল।
বক্তা ২ – আপনার এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে হবে। পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে! সেসব না বুঝে আপনি এই কথা বলতে পারেন না।
বক্তা ১ – গণহত্যার আপনি কী ব্যাখ্যা দিতে পারেন?
বক্তা ২ – ঐ সময় খুব কঠিন সময় ছিল। ভারতের দালালরা পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল পাকিস্তানের ক্ষতি করতে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন হয়েছিল জানেন? সেই সময়ে কিছু বাঙালি দুর্বৃত্ত পাকিস্তানের সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। সেই সময়ে দেশপ্রেমিক পাক সেনাবাহিনী কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে।

লক্ষ্য করে দেখুন, একটি গণহত্যাকে ন্যায্যতা প্রদান(Justification) করতে বক্তা ২ নানা রকম অজুহাত তৈরি করছেন। গণহত্যার সপক্ষে তিনি অজুহাত তৈরি করে সেগুলোকে ব্যাখ্যা মনে করছেন। কিন্তু ন্যায্যতা প্রদান, ব্যাখ্যা এবং অজুহাত একদমই আলাদা বিষয়। এই দুটো গুলিয়ে ফেলাকে Confusing an explanation with an excuse বলা হয়। উল্লেখ্য, গণহত্যা বা জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায় ধরে নিধন চালানো কোন ব্যাখ্যাতেই বৈধ বলে গণ্য হয় না। কোন অবস্থাতেই ন্যায্যতা পায় না।

২।
– ভাবি, আপনার ছেলে কিন্তু আমাকে মোটেও সম্মান করেনা।
– কারণ সে মনে করে আপনার “আপনার চেহারা ডাইনির মত, যে বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না”।
– কিন্তু এটা কোন অজুহাত হতে পারে না।
– না, এখানে অজুহাতের কিছু নেই, এটা কেবলই তার আপনাকে পছন্দ না করার কারণ।

এখানে বাচ্চাটি মহিলাটিকে কেন সম্মান করে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে মাত্র, কিন্তু বাচ্চাটি যে ঠিকই ভাবছে বা ব্যায্য কাজটি করছে বা বাচ্চার ভাবনাটাই যে ঠিক বা ন্যায্য সেটা বলা হয় নি, যা মহিলাটি ধরে নিয়েছিলেন।

৩।
– তুমি কেন বিগফুটকে মানুষ ও বানরের মধ্যকার মিসিং লিংক বলে মনে করছ?
– কারণ বিবর্তনগত প্রক্রিয়ায় দুটো প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতিকেই মিসিং লিংক বলে।

এখানে মিসিং লিংক কাকে বলে তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, মানে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কেন সে বিগফুটকেই মিসিং লিংক বলে মনে করে এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়নি।

৪।
– ধর্ষণের পিছনে বিবর্তনগত কারণ রয়েছে। জীববিজ্ঞানী থর্নহিল ও এনথ্রোপলজিস্ট পালমার বলেন, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হারেম-বিল্ডিং স্ট্রাগলের কারণে লুজাররা ধর্ষণকে বিকল্প জিন প্রমোটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যায়, আর এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে আসায় পুরুষেরা ধর্ষণের প্রবণতা লাভ করেছে।
– এভাবে বলে তুমি ধর্ষণকে জাস্টিফাই(Justification) করছ, যেন ধর্ষণ খুব ন্যাচারাল, এটা হতেই পারে!

ধর্ষণের ইভোল্যুশনারি এক্সপ্লানেশন ধর্ষণের ব্যাখ্যা দেয়, অর্থাৎ মানুষ কেন ধর্ষণপ্রবণ হয় তার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। কিন্ত এই ব্যাখ্যা কখনই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে না, বা ন্যায্যতা প্রদান করে না। অর্থাৎ ধর্ষণের পেছনে প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে বলেই এটা নৈতিক এমন কিছু বলে না। আর সেই সাথে ইভোল্যুশন থেকে আসা প্রবণতা ধর্ষণের জন্য কোন এক্সকিউজ বা অজুহাতও হতে পারে না। এটা তাই অপরাধই থাকবে, কারণ মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা থাকলেও নিজেকে কন্ট্রোল করার অপশন আছে। বিবর্তনের দ্বারা মানুষ নৈতিকতা ও সামাজিকতার বৈশিষ্ট্যই লাভ করেছে। এছাড়া মানুষের আচরণ কেবল জিনই নয়, পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া অপরাধ অর্থ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজ, আর অপরাধী অর্থ যে এই ক্ষতিকর কাজটি করেছে।
রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের বিধান অনুসারে অপরাধী যাতে অপরাধ থেকে নিবৃত হয় তাই শাস্তির প্রয়োজন, যেখানে শাস্তি অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করবার একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কেন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে কিছু আসে যায় না, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এখন অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই মুখ্য, তাই এক্সকিউজ বা এক্সপ্লানেশনে কিছু আসছে যাচ্ছে না।
তবে বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানে এবং মানুষের চরিত্র বুঝবার জন্য স্বাধীনভাবে বিবর্তনগত কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে যেখানে নৈতিক সিদ্ধান্ত আরোপনের মাধ্যমে এটা ঠিক কি ভুল- এই বিষয়ক মন্তব্য করার কিছু নেই, বরং এই অনুসন্ধান অপরাধ নিবৃতির কাজে সহায়তা করতে পারে, যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
উপরের উদাহরণে একটি ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান এবং সেই ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য ব্যাখ্যা প্রদানকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই এটি একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি।তাহলে আমরা ব্যাখ্যা প্রদান এবং অজিহাতের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করবো?
অজুহাত > ধরুন, যখন কেউ বলবে, মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে, এখানে মেয়েটিরই দোষ ছিল। মেয়েটাই হয়তো কম কাপড় পরেছে, ছেলেটিকে উত্তেজিত করেছে, মেয়েটারই চরিত্রে দোষ আছে ইত্যাদি।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা > লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে ধর্ষণের ইচ্ছা পরিলক্ষিত হয় বলে গবেষনায় দেখা গেছে। বিবর্তনের ধাপে ধাপে যেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটছে, সেখানে শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একজন পুরুষ, যারা সাধারণত অন্য পুরুষের সাথে লড়াইতে কুলিয়ে ওঠে নি, তারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। সেখান থেকে হওয়া বাচ্চারা সেইসব জিন বহন করেছে। সেই সাথে পারিপার্শ্বিক ঘটনা, সামাজিক নিয়মকানুন এবং শিক্ষা সেই সব বাচ্চাদের ভেতরে সেই সব জিন সচল করতে সাহায্য করেছে।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যখন দেয়া হচ্ছে, সেটি কাজটির ন্যায্যতা প্রদান নয়। এখানে কোনভাবেই কাজটি নৈতিক নাকি অনৈতিক, সেই সিদ্ধান্তে যাওয়া হয় না। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যও তা নয়। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য এইসব ঘটনার পেছনে কারণ অনুসন্ধান করা। যখন কারণগুলো সঠিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে, সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যাবে তার উপায়ও মিলতে থাকবে।

প্রকৃতিগত হেত্বাভাস বা কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Naturalistic fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 53

অনেকসময় যুক্তি হিসেবে বলা হয়, যেহেতু অমুক বিষয়টি প্রাকৃতিক, তাই ভাল বা নৈতিক। অথবা তমুক বিষয়টি অপ্রাকৃতিক, তাই মন্দ বা অনৈতিক। এরকম দাবীগুলোকে সাধারণভাবে প্রকৃতিগত হেত্বাভাস বলে। “সাধারণত কী হয়”, “সাধারণত কী হয় না”- এর উপর ভিত্তি করে “কী হওয়া উচিৎ”, “কী হওয়া বাধ্যতামূলক”, “কী হওয়া উচিৎ নয়”, “কী করা যাবে না” এরকম নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন এই বিশেষ হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়। এই হেত্বাভাসটি খুব সাধারণ, এবং বেশিরভাগ লোকই স্বীকৃতি সামাজিক ও নৈতিক রীতির জন্য এটি নজরে নেন না। এর কারণে আমরা যুক্তি থেকে সরে এসে, যা হয় তাকে হতেই হবে বলে মনে করি।

যেমন- সতীদাহ প্রথা যুগযুগ ধরে চলে আসছে। তাই এটি স্বাভাবিক এবং ভাল।
কিন্তু, যুগযুগ ধরে চলে আসা মানেই কোন কিছু ভাল বা সঠিক হয় না। যুগযুগ ধরে চলে আসছে, তাই এটি ভাল মনে করার কোন যুক্তি নেই।
আবার, “যেহেতু ইতিহাসের সূচনা থেকেই যুদ্ধ হয়ে আসছে, সব জাতিই কমবেশী যুদ্ধ করেছে, তাই এটা নৈতিকভাবে খারাপ হতে পারে না!”
কিন্তু যুদ্ধ অবশ্যই একটি খারাপ বিষয়। সেটি সাধারণভাবে অনেকবার ঘটে থাকলেও তা খারাপ।

Appeal to Nature Fallacy কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

এই হেত্বাভাসটির গতানুগতিক ব্যবহারটি লক্ষ্য করা যায় যখন “ভাল” এর সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করা হয়। দার্শনিক জি. ই. মুর (১৮৭৩-১৯৫৮) যুক্তি দেন, কোন কিছু প্রাকৃতিক বলে একে “ভাল” বা “নৈতিক” বলে সংজ্ঞায়িত করলে ভুল হবে। এই হেত্বাভাসে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ভাল মন্দের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করা হয় বলেই এর নাম “ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি”।

উদাহরণ:
প্রস্তাবঃ নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ককে সাধারণ মানুষ প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক বিষয় বলে ধরা নেয়। তারা মনে করেন, যেহেতু এটা প্রাকৃতিক, সন্তান উৎপাদনের সাথে জড়িত, সেহেতু এটি ভাল এবং নৈতিক কাজ। এবং যেহেতু সমকামিতা প্রাকৃতিক নয়, তাই এটি অনৈতিক কাজ।
কিন্তু, প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়ে কোন কিছুকে যদি নৈতিক বা ভাল মনে করা হয়, তাহলে একই যুক্তিতে প্রকৃতি মানুষকে অসুখবিসুখ এবং রোগব্যাধি দেয়। তাই একই যুক্তিতে ধরে নিতে হয়, অসুখ বিসুখ যেহেতু প্রাকৃতিক তাই নৈতিক এবং ভাল। এবং ঔষধের দ্বারা প্রকৃতির কাজে বাঁধা দেয়া এবং অসুস্থের চিকিৎসা করা নৈতিকভাবে ভুল। তাই বোঝা যাচ্ছে, প্রাকৃতক বা স্বাভাবিক বলেই কোন কিছু নৈতিক এবং ভাল, তা বলা যায় না।
আবার ধরুন, রাস্তাঘাট নির্মান, বিমান গাড়ি চালানো, এগুলো কোনটাই প্রাকৃতিক নয়। বরঞ্চ প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই রাস্তাঘাট বানাতে হয়, বিমান গাড়ি ইত্যাদি চালাতে হয়। তাই প্রাকৃতিক তাই ভাল বা নৈতিক, এমনটা দাবী করা একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি।

নীতিগত হেত্বাভাস বা কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Moralistic fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 56

যখন কোন নৈতিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে “কী হতে হবে” বা “কী হওয়া যাবে না” বা কী ঘটতে পারে না, এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়। এডওয়ার্ড সি. মুর তার ১৯৫৭ সালের পেপারে এই হেত্বাভাস সম্পর্কে লেখেন।

উদাহরণ:

১। পরকীয়া নৈতিকভাবে খারাপ (নৈতিক বৈশিষ্ট্য), তাই মানুষের একাধিক যৌনসঙ্গী লাভ করার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না (প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য)।
> কিন্তু নৈতিকভাবে পরকীয়া খারাপ হলেও কারো মনে তার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে।
২। পরকালের না থাকাটি ন্যায্যতা, সমতা বা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না (নৈতিক বৈশিষ্ট্য), সুতরাং পরকাল ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে (প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য)।
> কিন্তু পৃথিবীতে ন্যায় বিচার নেই, এটি পরকালে ন্যায় বিচার আছে তার পক্ষে প্রমাণ হতে পারে না।
৩। খারাপ চরিত্রের অধিকারী হওয়া নৈতিকভাবে ঠিক নয়, তাই কেউই খারাপ হতে পারে না, সবাই ভাল মানুষ।
> কিন্তু অনেকেই খারাপ মানুষ হতে পারেন।
৪। নারী ও পুরুষের সমতাবিধান হতে হবে, তাই নারীরাও পুরুষের মত শক্তিশালী হয়।
> কিন্তু কোন নারী পুরুষের মত শারিরিক ক্ষমতার অধিকারী নাও হতে পারেন।

এফারমিং দ্য কনসিকোয়েন্ট কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Affirming the Consequent

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 58

এটি ফরমাল লজিকের একটি সাধারণ ভ্রান্তি, যেখানে কন্সিকোয়েন্ট বা ফলাফল সঠিক হলে, এন্টিসিডেন্ট বা পূর্বসত্যকেও সঠিক ধরা হয়।

উদাহরণ:
কেউ একজন আমাদেরকে উপর থেকে দেখছেন বলেই, এখনও জগতে ভালো মানুষ আছে।

এক্ষেত্রে সিলোলিজম:
A। ঈশ্বর থাকলে ভালো মানুষ থাকবে
B। ভালো মানুষ আছে
C। সুতরাং, ঈশ্বর আছে।

এখানে সমস্যাটা হচ্ছে A এর কারণে B হয় বলে, B হয়েছে বলে A যে হতেই হবে এমন নয়, কারণ B এর কারণ A ছাড়াও C, D, E সহ আরও অনেক কিছু হতে পারে। এক্ষেত্রে, ঈশ্বর থাকলে ভাল মানুষ থাকবে, এর অর্থ এই নয় যে শুধু ঈশ্বর থাকলেই ভাল মানুষ থাকবে, আরও অনেক কারণেই ভাল মানুষ থাকতে পারে। তাই এটি একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি, যাকে আমরা বলি, এফারমিং দ্য কনসিকোয়েন্ট।

Affirming the Consequent কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

চেরি পিকিং কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Cherry picking fallacy

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 61

যখন আমরা বিভিন্ন রকম এভিডেন্স, ডেটা বা সম্ভাবনা থেকে আমাদের অনুকূলে যায় এরকম ডেটা বা এভিডেন্সকেই বা সম্ভাবনাকেই গ্রহণ করি তখন এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়।

উদাহরণ:
১।
দাবীঃ কোরানে বলা হয়েছে, পৃথিবী এবং আকাশ(মহাবিশ্ব) এক সময় একসাথে ছিল। আল্লাহ পাক তা আলাদা করেন যা বিগ ব্যাং তত্ত্বের দিকেই নির্দেশ করে।
প্রশ্নঃ বিগ ব্যাং তত্ত্বে কোথাও বলা হয় নি, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব এক সময় একই বিন্দুতে ছিল। আমাদের অবজারভেবল মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। এবং পৃথিবীর বয়স ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ, পৃথিবী নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পরের ঘটনা। তাহলে, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব একসাথে ছিল, এরকম বলার পেছনে যুক্তি কী?
এছাড়াও, কোরান অনুসারে পৃথিবীকে আগে সৃষ্টি করা হয়েছে(সুরা ফুসসিলাত আয়াত ৯-১২), এরপরে আল্লাহ আকাশের দিকে মনোযোগ দেন। অর্থাৎ আকাশে আমরা যা দেখতে পাই, কোরান অনুসারে সে সবের বয়স পৃথিবী থেকে কম। অথচ, আমাদের কাছে এরকম তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, মহাবিশ্বের অসংখ্য নক্ষত্র পৃথিবীর চাইতে অনেক পুরনো, অনেক প্রাচীন। তাহলে, কোরানের দাবীগুলো সত্য কীভাবে?
> লক্ষ্য করুন, প্রথম কথাটির দাবীদার চেরি পিকিং করছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তথ্যের সাথে যতটুকু মিলছে, ততটুকুই উনি বলছেন। অন্যান্য বিষয়াদি উহ্য রেখে। তাই এটি একটি ফ্যালাসি, যাকে আমরা বলি চেরি পিকিং।

২।
আমাদের পলিটিকাল ক্যান্ডিডেট তার আয়ের ১০% অভাবীদেরকে দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চে যান, এবং সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। তিনি একজন সৎ ও যোগ্য ক্যান্ডিডেট।

এখানে যে বিশেষগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোই যে তার সকল বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করবে এমন কোন কথা নেই। হতে পারে তিনি অভাবী সেক্স ওয়ার্কারকে নিজের লাভের বিনিময়ে অর্থ দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চ থেকে বেরিয়ে পাশের স্ট্রিপক্লাবে যান, আর প্রতি সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে যাবার কারণ সেখানে ড্রাগ ডিলারদের ঠেক বসে।

৩।
– আপনার সিভিতে লেখা যে আপনি খুব হার্ড ওয়ার্কার, সব কিছুতে আপনার অনেক মনোযোগ, এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে আপনার কোন সমস্যাই নেই।
– ইয়েস স্যার।
– আমি আপনার আগের অফিসের বসের সাথে কথা বলেছি। তিনি বললেন, আপনি বারবার বিভিন্ন জিনিস পরিবর্তন করেন যা পরিবর্তন করা উচিৎ নয়, আপনি অন্যের প্রাইভেসি নিয়ে খুব একটা কেয়ার করেন না, আর কাস্টোমার রিলেশনের ক্ষেত্রে আপনার স্কোর খুবই খারাপ।
– ইয়েস স্যার। এগুলোও সত্যি।
– খুব ভাল। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া টিমে তোমাকে স্বাগতম!

সিভি, রেজিউম এসব চেরি পিকিং ইনফরমেশনের ক্লাসিক উদাহরণ। একটি রেজিউমে কেবল এই লেখা থাকে যে কেন আপনি পদটির জন্য যোগ্য। তবে বেশিরভাগ নিয়োগদাতাই বোঝেন যে এগুলো একপাক্ষিক, তাই তারা আরও বেশি এভিডেন্সের জন্য ইন্টারভিউ ও রিকমেন্ডেশন এর দ্বারস্থ হন।

৪। লোকটি ধর্ষকদের গণপিটুনির বিরুদ্ধে লিখছেন, নিশ্চই তিনি ধর্ষণ সমর্থন করেন ও তাদের প্রতি তার সমবেদনা কাজ করে।

ধর্ষকদের প্রতি সমবেদনা কাজ করা, ধর্ষকদের প্রতি সমর্থন থাকে, এসব ধর্ষকদেরকে গণপিটুনি দেবার বিরোধিতার কারণ হতেই পারে, কিন্তু এটাই এর একমাত্র কারণ নয়। মব জাস্টিস সমর্থন না করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে থাকা, অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগে বিশ্বাস করা ইত্যাদি অনেক কারণ থাকতে পারে এটা নিয়ে লেখার। কিন্তু এদের মধ্যে নিজের অনুকূলে কাজ করে এমন একটি সম্ভাবনা নিয়েই যদি দাবী করা হয় তাহলে চেরি পিকিং ঘটবে।

চেরি পিকিং কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

আপিল টু নরমালিটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Appeal to normality

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 64

এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয় যখন কী স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক নয়, কী হয়ে আসছে, কী কখনও হয় নি, এর উপর ভিত্তি করে যখন কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত টানা হয়, কোনটাকে ভাল, কোনটাকে মন্দ বলা হয়। অন্যভাবে বললে, সচরাচর ঘটে কিংবা সচরাচর ঘটে না, সবাই করে কিংবা সবাই করে না, এর ওপর ভিত্তি করে যদি কোন কাজকে নৈতিক/ ভাল বা অনৈতিক/মন্দ কাজ বলে সিদ্ধান্ত টানা হয়, তাহলে তাকে আপিল টু নরমালিটি ফ্যালাসি বলা হবে।

উদাহরণ:

১। ১৪০০ বছর আগে পরাজিত বাহিনীর লোকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী কন্যাদের তুলে এনে গনিমতের মাল নাম দিয়ে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক করাটাই স্বাভাবিক ছিল। তাই এই কাজকে খারাপ বলা যাবে না।
> কিন্তু ১৪০০ বছর আগে কোন কাজ খুবই স্বাভাবিক ছিল, সকলেই করতো, সেই কারণেই তা নৈতিক বা ভাল কাজ বলে গণ্য হতে পারে না।
২। বাঙলাদেশে সব সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিই ঘুষ খায়। তাই ঘুষ খাওয়ায় খারাপ কিছু নেই।
> কিন্তু সকল কর্মকর্তা কর্মচারি ঘুষ খেলেই, দুর্নীতি করলেই দুর্নীতি করা বৈধ বা নৈতিক বা ভাল কাজ বলে গণ্য হতে পারে না।
৩। বাঙলাদেশে তারেক জিয়া দূর্নীতি সৃষ্টি করেন নাই। তার আগেও দূর্নীতি হতো। তারেক জিয়ার আগে আওয়ামী লীগও দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতিই বাঙলাদেশের মত দেশে এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক বিষয়। সবাই করে। পুলিশ আমলা কর্মচারী কর্মকর্তা সকলেই। তাহলে তারেক জিয়া করে কী অপরাধ করেছে?
> কিন্তু তারেক জিয়া দুর্নীতি সৃষ্টি করে নি, তার আগেও দুর্নীতি হতো, সকলেই করতো, সেটাই সেই সময়ে স্বাভাবিক ছিল, এগুলো কোনটাই দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দান করে না। দুর্নীতি করা, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করা খারাপ এবং সকলে করলেও সেটা খারাপই থাকে। সকলেই করতো এই দোহাই দিয়ে কাজটিকে ভাল কাজ বলে প্রমাণ করা যায় না।
৪। হযরত মুহাম্মদ ৬ বছরের আয়শাকে বিয়ে করে ৯ বছরে বৈবাহিক যৌনজীবন শুরু করেন। ঐ সময়ে এটাই ছিল স্বাভাবিক। সকলেই করতো। আওয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগেও এটি প্রচলন ছিল। তাই নবী মুহাম্মদ কোন খারাপ কাজ করেন নি।
> কিন্তু ঐ সময়ে সকলে করে থাকলেও, সকলের কাজই খারাপ কাজ বলে গণ্য হবে। সকলে করতো তাই একজনার কোন অসভ্য খারাপ কাজকে ভাল কাজ আমরা বলতে পারি না। সকলে করলেও একটি খারাপ কাজ খারাপ থাকে।
৫। আমি একটু ওবিস। এরকম একটু ওবিস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রে নরমাল। সুতরাং আমি ঠিকই আছি।
> যুক্তরাষ্ট্রে একটু ওবিস হওয়া নরমাল হলেও, এটা যে স্বাস্থ্যের জন্য ভাল হবে এমন নয়।
৬। গ্রামে সব নারীরই তো বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা এখানে একটা নরমাল ব্যাপার, সুতরাং এটায় ক্ষতির কিছু নেই…
> একই কারণে এটি হেত্বাভাস।
৭। এরকম ধর্ষককে ধরে গণপিটুনি দেবার ঘটনা আগে কোনদিন ঘটেছে? এগুলো আমাদের সমাজে খুব একটা নরমাল না। তাই এটা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই। গণপিটুনি দেয়াটা ঠিকই হয়েছে।
> ধর্ষককে গণপিটুনি দেবার ঘটনাটা আগে কখনও না ঘটলেও, এটি নরমাল না হলেও, এই বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ না, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মব জাস্টিসের সংস্কৃতি ও মানব নৈতিকতায় এর কোন প্রভাব থাকবে না, বা ধর্ষকের প্রতি মব জাস্টিস যে নৈতিক হয়ে যাবে এমন কোন কথা নেই। বরং এরকম ক্রিটিকাল কিছু ইস্যুতে, যেখানে অনেকেই মব জাস্টিসের পক্ষে থাকে, এমন ক্ষেত্রেই এসবের আলোচনা বেশি হওয়া উচিৎ, যুক্তিতর্ক হওয়া উচিৎ কারণ এই ক্রিটিকাল টাইমেই ক্রিটিকাল থিংকিং এর বিকাশ ঘটে।

ঈশ্বরের দোহাই দেয়া বা আপিল টু হ্যাভেন

Appeal to heaven

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 66

যখন কোন দাবীকে এই যুক্তিতে গ্রহণ করতে বলা হয় যে “ঈশ্বর এটাই চেয়েছেন”, “এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা” বা “তিনি ঈশ্বর তাই তিনি এটা করতে পারেন”, তাহলে এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়। এই কুযুক্তিটিকে ঈশ্বরের দোহাই বা আপিল টু হেভেন বলে।

উদাহরণ:

১।
বিচারক: কেন তুমি ওদেরকে হত্যা করেছ?
অভিযুক্ত: কারণ ঈশ্বর আমাকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন।

আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ, কারণ বিচারব্যবস্থা এভাবে কাজ করে না। কিন্তু মুশকিল হল মানব-চিন্তা অনেক সময়ই এভাবে কাজ করে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ এই ভেবে কোন কাজ করছে যে ঈশ্বর তাই চান, ঈশ্বর এতে খুশি হবেন, এসব কাজ করলে কোন সমস্যা নেই কারণ এটাই ঈশ্বরের বিধান। আর এরকম চিন্তার কারণে অনেকে অন্যের ক্ষতিও করে ফেলেন। আধুনিক বিচারব্যবস্থা এসবের তোয়াক্কা করেনা বলেই হয়তো অন্যের ক্ষতি করার পেছনে এরকম যুক্তি আর খাটে না, অপরাধ তো অপরাধই থাকে।

২।
– কেন আব্রাহাম ও আইজ্যাকের গল্পটিকে একটি “অসাধারণ” খ্রিস্টীয় গল্প হিসেবে পড়ানো হয়? লোকটা তো তার সন্তানকে প্রায় জীবিত পুড়িয়েই ফেলেছিল!
– কারণ আব্রাহাম ঈশ্বরের ইচ্ছারই অনুসরণ করছিল। এটা আব্রাহামের জন্য অনেক কষ্টকর হলেও সে ঈশ্বরভক্তির কারণে করতে যাচ্ছিল। এটা কি অসাধারণ গল্প নয়?

এখানে বোঝাই যাচ্ছে যে, নিজের সন্তানকে আগুনে পোড়ানোর গল্প ততক্ষণ পর্যন্তই “অসাধারণ” যতক্ষণ পর্যন্ত এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের ভক্তির জন্য সন্তান হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করলেই সন্তান হত্যা করার চেষ্টা ভাল কাজ হয়ে যায় না, তাতে যতই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ পাক। আর তাই এই গল্পটিও “অসাধারণ” হয় না। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরকম ঈশ্বরের ইচ্ছার ব্যাপারটি আনা অর্থ যুক্তিকে ত্যাগ করা। এক্ষেত্রে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই প্রধান হয়ে যায়, আর সেজন্য যেকারও ক্ষতি করার ব্যাপারটি নৈতিকতার ঊর্ধ্বেও চলে যেতে পারে। যেমনটা গল্পে আব্রাহামের ক্ষেত্রে হয়েছিল, আর তাই এরকম কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা হেত্বাভাস বিপজ্জনকও হতে পারে।

৩।
– নিজের ধর্ম ব্যাতীত অন্য ধর্মের লোকজন অধস্তন বা নিকৃষ্টতম প্রাণী- এই কথা কোন মানুষ বলেনি, ধর্মগ্রন্থে স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন। এরকম কথা মানুষ বললে তিনি সাম্প্রদায়িক হবেন, কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সবার সৃষ্টিকর্তা, তাই তিনি এই কথা বলতেই পারেন।

এখানে মানুষের সাথে ঈশ্বরের একটি পার্থক্য সূচিত করে বলা হচ্ছে যে মানুষ এরকম কথা বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে, কিন্তু ঈশ্বর এরকম বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে না। ঈশ্বর এই কথাটি বলছে বলেই এটা সাম্প্রদায়িক হবে না, এটা সত্য এবং সঠিক হয়ে যাবে। এই কথাগুলোতেও যুক্তি ত্যাগ করা হয়, এবং এটি আপিল টু হ্যাভেন নামক যৌক্তিক হেত্বাভাসের মধ্যে পরে। এছাড়া ঈশ্বরের এই কথাটি মানুষের উদ্দেশ্যেই বলা, মানুষকে জানানোর জন্য ঈশ্বর যেসব আদেশ দেন তাই ধর্মগ্রন্থে সংকলিত হয়। কাজেই এই এরকম বিধান দেয়া হয়েছে যাতে ঈশ্বরের কথা ভেবে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে, আর ঈশ্বর এক্ষেত্রেও ঈশ্বর এভাবে বলেছেন বলে ভিন্ন ধর্মের লোকেরা অধস্তন, লেস হিউম্যান বা ঊনমানব এরকম দাবী করাটাও এই হেত্বাভাসটির অন্তর্গত হয়।

যেমন ধরুণ, হিটলার দাবী করতে পারে, ঈশ্বরের নির্দেশেই সে ৬০ লক্ষাধিক ইহুদি নিধন করেছে। বা মাওলানা মওদুদি যখন আহমদীয়াদের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণের উষ্কানি দিয়েছে, সেও একই দাবী করতে পারে। যে এটি ছিল আল্লাহর আদেশ। তারা বলতেই পারে, ঈশ্বর ভাল বোঝেন বলেই এই কাজ করতে আদেশ দিয়েছেন। এভাবে আসলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজকে ন্যায্যতা প্রদান করতে পারে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে। সেই কারণে এই যুক্তি কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। এই লজিক্যাল ফ্যালাসি বা হেত্বাভাসটি শুধু কুযুক্তি বা ফ্যালাসিই নয়, বিপদজনক ধারণাও বটে।

এই প্রসঙ্গে কথিত ঈশ্বরের আদেশে Deanna Laney murders , Sharon Dalson , আল্লাহর আদেশে রেজওয়ানা হত্যাকাণ্ড, ঈশ্বরের নির্দেশে Samuel Warren Shaffer এর ৮ বছরের বালিকা বিবাহ উল্লেখযোগ্য। এরকম হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে যারা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজ করেছে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি

Argument from personal experience

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 68

প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও লেখক রিচার্ড ডকিন্স তখন আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট ছিলেন। সে সময় তার এক ধার্মিক বন্ধু তার বান্ধবী সহ স্কটল্যান্ডের একটি দ্বীপে ক্যাম্পিং করতে যান এবং মাঝরাতে দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায় ‘শয়তানের কন্ঠস্বর’ শুনতে পেয়ে। তাদের মতে এত ভৌতিক, পৈশাচিক, নারকীয় শব্দ কেবলমাত্র শয়তানেরই হতে পারে। পরবর্তীতে সেই বন্ধু পাদ্রী হিসেবেও দীক্ষা নেন।

বেশ কিছুদিন পর রিচার্ড ডকিন্স আড্ডার ফাঁকে এই গল্পটি বলেন। সেখানে আবার উপস্থিত ছিলেন দুজন অভিজ্ঞ পাখি বিশেষজ্ঞ। তারা একসাথে হেসে ওঠেন। এবং সমস্বরে বলে ওঠেন ‘Manxs Shearwater‘। শয়তানের মত কন্ঠ হওয়ার কারণে এই পাখিকে পৃথিবীর অনেক স্থানেই স্থানীয় ভাষায় ‘ডেভিল বার্ড’ও বলে। ডকিন্সের বন্ধু ও তার বান্ধবীও ওই ‘শয়তান পাখি’র ডাকই শুনেছিলেন। কিন্তু তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদেরকে ঐ ডাককে শয়তানের ডাক ভাবতে বাধ্য করে। কি হত যদি তারা ‘শয়তান’ বিষয়টার সাথেই পরিচিত না থাকতো? এই ডাক শুনে হয়ত তাদের একটু গা ছমছম করতো অথবা সেটিও করতো না। তাদের কাছে হয়ত খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনাই মনে হত। তারা কোন প্রকার বিচার বিশ্লেষণ না করেই একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনাকে শুধুমাত্র ‘বিশ্বাসের সাহায্যে’ অলৌকিক ঘটনায় রুপান্তরিত করেছেন।

এই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা প্রায়ই শুনে থাকবেন। কোন মুসলিম হয়ত বলবে সে জ্বিন দেখেছে। আবার কোন হিন্দু হয়ত দেখেছে ভূত বা পেত্নী। এসবের পেছনে তারা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কাহিনীও শুনিয়ে দেবে।

এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় ‘নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে কুযুক্তি বা ফ্যালাসি’। দাবীকারী এখানে কোন অলৌকিক সত্ত্বার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। দাবীকারী ‘আসলে কি ঘটেছিল’ সেটা যাচাইয়ের কোন চেষ্টাই করেননা বা এ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ থাকেন। অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দাবী উত্থাপিত হয় বলে এটি ‘অজ্ঞতার কুযুক্তি’ও বটে। পুরো ঘটনাটিকে তিনি তার নিজস্ব বিশ্বাসের স্থান থেকেই বিবেচনা করে থাকেন। এধরনের কুযুক্তি বা ফ্যালাসি কোন অবাস্তব চরিত্রের অস্তিত্ব প্রমাণে হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

যেকোন অজানা বিষয়কে জানার পদ্ধতি হচ্ছে, তা নিয়ে পড়ালেখা করা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিয়ে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। অজানা বিষয় অপ্রমাণিত কোন কিছুর সপক্ষের যুক্তি বা প্রমাণ হতে পারে না।

ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প

Just-world hypothesis

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 70

কগনিটিভ বায়াস অর্থ হচ্ছে জ্ঞানীয় পক্ষপাত যা আসলে আরোহী যুক্তির একটি পদ্ধতিগত ভুল। মানুষের আবেগ, পূর্ব থেকে নিয়ে আসা বিশ্বাস তার সামনে থাকা তথ্যপ্রমাণগুলোর মধ্যে গ্রহণ বর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ সে যা শুনতে চায়, যা শুনলে সে আনন্দিত হয়, যা তার বিশ্বাসকে স্বস্তি দেয়, সেই ধরণের তথ্য প্রমাণ সম্পর্কে অবচেতনভাবেই তার পক্ষপাত। একজন ব্যক্তি যখন বিষয়ীগতভাবে তথ্য সংগ্রহ বা স্মরণ রাখে, তখন তার পূর্ব ধারণা বা সংস্কার বা বিশ্বাসের সাথে যা মিলে যায়, সেই সব তথ্যের প্রতি তার এক ধরণের পক্ষপাত থাকে। তার মধ্যে তাড়না থাকে যে, সে যেই মতবাদ বা বিশ্বাস লালন করে, সেগুলো যেন সত্য প্রমাণ করা যায়। শুধুমাত্র সেইসবের পক্ষে থাকা তথ্যপ্রমাণই তার কাছে সত্যিকারের তথ্যপ্রমাণ বলে মনে হয়। অপরদিকে, যেসব তথ্য প্রমাণ তার মতবাদ বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তা যত শক্তিশালী বা স্পষ্টই হোক না কেন, সে সেগুলো এড়িয়ে যায় বা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করে। তথ্যপ্রমাণ থেকে যতটুকু তার পক্ষে গেছে, সেগুলো সে কাজে লাগায় এবং মনে রাখে তার বিশ্বাস বা মতবাদকে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এই প্রবণতাটিই হলো ‘কনফার্মেশন বায়াস’।

ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প একটি কগনিটিভ বায়াজ বা জ্ঞানীয় পক্ষপাত। এই পক্ষপাতের কারণে মানুষ অন্তর্নিহিতভাবেই তার কাজের জন্য নৈতিকভাবে ন্যায্য ফলাফল আশা করে। সে মনে করে যে, পরিশেষে তার সমস্ত মহৎ কাজকেই পুরস্কৃত করা হবে, এবং সমস্ত অন্যায় কার্যের শাস্তি দেয়া হবে। এই অনুকল্পে ধরে নেয়া হয় যে, কোন অতিপ্রাকৃতিক সত্তা রয়েছে যা সমাজের ভাল ও মন্দের মধ্যে একটি নৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে, যার কারণে কোন সৎ মানুষের সাথে অন্যায় কিছু ঘটে না, আর যদি ঘটেও থাকে তাহলে সেই সৎ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, এবং অন্যায়কারীকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হয়। এই বিশ্বাসটি আধ্যাত্মিক বিচার, পরকাল ইত্যাদিকেও নির্দেশ করে, আর সেই সাথে এর কারণে মানুষের কুযুক্তি গ্রহণ করার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয় যেখানে সে মনে করে যে, তার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে কারণ সে এটিই ডিজার্ভ করে।

এই কগনিটিভ বায়াজ নিয়ে মনোবিজ্ঞানী মেলভিন জে. লারনার গবেষণা করেছেন। লারনারের মনে প্রশ্ন তৈরি হয় যে, কোন রাজতন্ত্রের রাজা যদি নিষ্ঠুরভাবে তার প্রজাদেরকে অত্যাচার করত, এবং প্রজারা সেই কষ্ট সহ্য করত, তাহলে কেনই বা তারপরও রাজাদের প্রতি প্রজাদের জনসমর্থন বলবৎ থাকত! এবং এই ভোগান্তিমূলক ও কষ্টদায়ী আইন ও রীতিকে কেন মানুষ সমাজস্বীকৃত প্রথা হিসেবেই মেনে নিত? লারনার অনুসন্ধান করে বের করেন যে, মানুষের মধ্যে ভিক্টিম ব্লেমিং বা ভুক্তভোগীকেই দায়ী করার প্রবণতা কাজ করে। লারনার যখন মনোবিজ্ঞানী হবার ক্লিনিকাল ট্রেইনিং নিচ্ছিলেন তখন তিনি দেখেন, অনেক শিক্ষিত দয়ালু ব্যক্তিই রোগীদের ভোগান্তির জন্য সেই রোগীদেরকেই দায়ী করেন। লারনার অবাক হয়ে দেখলেন যে, তার ছাত্র ছাত্রীরা গরীবদেরকে অপমান করছে, কারণ তারা মনে করছে যে, তাদের এই দারিদ্র্যের জন্য তারাই দায়ী। তিনি তার একটি গবেষণায় দেখলেন, দুইজন মানুষের মধ্যে র‍্যান্ডমলি বা যাদৃচ্ছিকভাবে একজনকে বেছে নিয়ে তাকে পুরস্কৃত করলে, এই ঘটনার পর্যবেক্ষক বা অবজারভারগণ পুরস্কৃত ব্যক্তিকেই অধিকতর শ্রেয় হিসেবে মূল্যায়িত করে, তাকেই বেশি ভাল মানুষ হিসেবে ভাবে। পূর্ববর্তী কোন সাইকোলজিকাল থিওরি যেমন কগনিটিভ ডিজোনেন্স বা অন্য কিছু এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে নি, আর এভাবেই তিনি নতুন এক সাইকোলজিকাল ফেনোমেনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন। তিনি উত্তর পেলেন যে, কেন প্রজারা রাজার নিষ্ঠুরতাগুলো সহজেই মেনে নিতো, নিতো কারণ তারা মনে করত যাদেরকে অত্যাচার করা হয় তারাই তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। একটি অতিপ্রাকৃত শক্তি সবসময় ভাল খারাপকে ব্যালেন্স করে, সবসময় অন্যায়কারীর অমঙ্গল করে ও ভাল মানুষকে পুরস্কৃত করে, মানুষের এইরকম পক্ষপাত তাদের ভিক্টিম ব্লেমিং এর দিকে নিয়ে গেছে। এজন্য তারা, যারা সমাজের নিষ্ঠুরতার বলি হয়, অন্যায়ের স্বীকার হয়, তার দায় সেই ভুক্তভোগীদের উপরেই চাপায়। এজন্যই মানুষ ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করে। লারনার তার আবিষ্কৃত এই ফেনোমেনার নাম দিলেন জাস্ট ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিজ, বাংলায় “ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প”

অনেকে বলে, আপনার সাথে এত বড় অন্যায় হল, কিন্তু আপনি এর বিচারই পাবেন না, এটা কি লজিকাল হল? নৈতিক হল? হ্যাঁ, এটা লজিকাল হল, অন্যায় হলেই যে বিচার হতে হবে এটা লজিক নয়, বরং ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প নামক জ্ঞানীয় পক্ষপাত এর কারণে ঘটা লজিকাল ফ্যালাসি। নৈতিক কিনা জিজ্ঞেস করছেন? হ্যাঁ, কেউ অপরাধ করে যদি অপরাধের শাস্তি না পায় তা অবশ্যই অন্যায় হবে, কিন্তু এই জ্ঞানীয় পক্ষপাতে আক্রান্ত হবার জন্য, অর্থাৎ ভালর সাথে ভাল হবে, আর খারাপের সাথে খারাপ হবে এই ধারণায় বিশ্বাস করে যদি আমি ভুক্তভোগীকে দায়ী করতাম, তাহলে ভুক্তভোগীর সাথেও অনেক বড় অনৈতিক কাজ করা হত।

যেমন ধরুন, কোরআনে খুব পরিষ্কারভাবেই বলা আছে,

নিশ্চয়ই তোমার রব যার জন্য ইচ্ছে তাঁর রিযক বাড়িয়ে দেন এবং যার জন্য ইচ্ছে তা সীমিত করেন; নিশ্চয় তিনি তাঁর বান্দাদের সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত, সর্বদ্রষ্টা
( কোরআন ১৭:৩০ )

তাহলে, অপুষ্টির শিকার এই বালকটির রিজিক কে সংকুচিত করে দিয়েছে? তার রিজিক কে সীমিত করে দিয়েছে?

অপুষ্টির শিকার বালক

আবার ধরুন, ছয়মাসের একটি বাচ্চা মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ম অনুসারে, ছয়মাসের এই বাচ্চাটির সাথে এ কেমন পরীক্ষা? নাকি, এই শিশুরাই তাদের অবস্থার জন্য দায়ী? অনেক ধার্মিক মানুষই মনে করেন, এগুলো এই মানুষদেরই কর্মফল, পরীক্ষা অথবা যা হচ্ছে ভালোর জন্যেই হচ্ছে!

গাঁথন বা বিভাজনের কুযুক্তি

Fallacy of composition or Division

কুযুক্তি বা ফ্যালাসি 73

অনেক সময় কোন একটি জিনিস বা বিষয়ের কোন একটি অংশের জন্য কোন তথ্য সত্য হলেও, সামগ্রিক বিষয়টির জন্য সেটি সত্য নাও হতে পারে। Aristotle তাঁর Sophistical Refutations গ্রন্থে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন ধরুন, পানি আমাদের ভিজিয়ে দেয়, সেটি আমরা পান করি। পানি হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দ্বারা গঠিত। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনও আমাদের ভিজিয়ে দিতে পারে বা হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনও আমরা পান করতে পারবো। বরঞ্চ, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দ্বারা যেই পদার্থটি গঠিত হয়, সেটি পানি হয়ে থাকলে শুধুমাত্র তখনই সেটি আমাদের ভিজিয়ে দিতে সক্ষম হবে এবং তখনই সেটি পান যোগ্য হবে।

আবার ধরুন, একটি ক্রিকেট টিমে শচীন, ব্রায়ান লারা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব সেরা খেলোয়ারদের নেয়া হলো। প্রত্যেকেই বিশ্বসেরা খেলোয়াড়। কিন্তু দল হিসেবেই সেটি সেরা হবে, এমন কোন কথা নেই। ধরা যাক, সকল সেরা ব্যাটসম্যান দিয়ে যদি দলটি গঠিত হয়, তাহলে বোলিং করার সময় তারা খারাপ বোলিং করবে। ফলাফল হিসেবে তারা হেরে যেতে পারে। আবার, প্রত্যেকের মধ্যে যদি বন্ধুত্বপূর্ব সম্পর্ক না থাকে, তাহলে তারা হেরে যেতে পারে। প্রত্যেকে খুবই ভাল খেলোয়ার হওয়ার পরেও, তাদের দলটি যে বিশ্বসেরা হবে, এমন কিন্তু বলা যায় না। এভাবে অংশ বিশেষের জন্য কিছু তথ্যের সত্যতার ওপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হচ্ছে ‘ফ্যালাসি অব কম্পোজিশন’।

গাঁথন বা বিভাজনের কুযুক্তির একটি ভাল উদাহরণ মানুষ সম্পর্কে প্রায়শই দেয়া হয়ে থাকে। বলা হয়, মানুষ হাত পা হৃদপিণ্ড কিডনি ফুসফুস এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর একটি সমন্বয়। এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো আলাদা আলাদাভাবে যেহেতু স্বাধিনভাবে চিন্তা করতে অক্ষম, তাই মানুষের পক্ষেও চিন্তা করা বা চেতনাসম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। বা ধরুন, মানুষ অণু পরমাণুর সম্ন্বয়ে একটি সত্তা। অণু পরমাণুর চেহেতু চিন্তা করার সামর্থ্য নেই, তাই মানুষেরও চিন্তা করার সামর্থ্য থাকার কথা নয়। এই দাবী করে আস্তিক মানুষেরা আসলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এটি গাঁথন বা বিভাজনের কুযুক্তির একটি ধ্রুপদী উদাহরণ। অণু পরমাণুর দ্বারা গঠিত কিছুর বৈশিষ্ট্য যে অণু পরমাণুর মতই হবে, আলাদা কিছু হবে না, এরকম ধারণা খুবই অমূলক। বা ফুসফুস কিডনি মগজ দিয়ে গঠিত হলেই যে মানুষ ঐ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে, এমনটিও। যেমন, একটি বই হচ্ছে কিছু কাগজ আর কালির সমন্বয়। তাই বলে যে পৃথিবীর সকল বই মানেই কাগজ আর কালি, এমনটি নয়। বইগুলোতে যা লেখা, তা আলাদা আলাদা অর্থ বহন করে।

ফ্যালাসি অফ রিলেটিভ প্রাইভেশন

Fallacy of relative privation / Appeal to worse problems/ Not as bad as

যুক্তিবিদ্যায় এটি একটি ইনফর্মাল লজিক্যাল ফ্যালাসি। যখন কেউ এক্স নামক একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করে, এবং এটি কেন একটি সমস্যা তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে, তখন এক্স এর পক্ষের বক্তা যদি ওয়াই নামক আরেকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করে, এবং এক্স ও ওয়াইকে তুলনা করার মাধ্যমে এক্সকে অপেক্ষাকৃত কম সমস্যাযুক্ত বলে প্রমাণের চেষ্টা করে- যার মাধ্যমে বস্তুতপক্ষে ওয়াইককে অবজেকটিভলি ভাল বা উত্তম বা আদর্শিক কাজ বলে চালিয়ে দেয়া যায়, তখন “নট এস ব্যাড এস” বা “ফ্যালাসি অফ রিলেটিভ প্রাইভেশন” নামক লজিক্যাল ফ্যালাসিটির উদ্ভব ঘটে। এর অর্থ হচ্ছে, যখনই কেউ আপনার কোন কাজের সমালোচনা করতে আসবে, আপনি স্রেফ তাকে আরেকজনার আরেকটি অধিক বাজে কাজের উদাহরণ উল্লেখ করে আপনার বাজে কাজটিকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করবেন, তখনই এই ফ্যালাসিটি ঘটে।

উদাহরণঃ-

  • কলিমুদ্দীন স্বর্ণের দোকানে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
  • কলিমুদ্দীন বলছে, “আরে, দেশে কত বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে। তারেক জিয়া কত দুর্নীতি করছে, সালমান এফ রহমান শেয়ার মার্কেটের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে দিলো। আর হাসিনার ছেলে জয় আমেরিকায় কতগুলা বাড়ি কিনেছে। সেই তুলনায় আমি তো অনেক ভাল। তাই আমার চুরিটি কোন অপরাধ হতে পারে না।
  • ( কিন্তু অন্য সকলে চুরি করলেও, কলিমুদ্দীনের চুরিটি তো তাতে বৈধতা পায় না। সেটি অপরাধই থাকে। )
  • বাঙলাদেশে প্রায় প্রতিটি সরকারী অফিসেই দুর্নীতি হয়।
  • কিন্তু উগান্ডায় তো আরো বেশি দুর্নীতি হয়। পাকিস্তানেও দুর্নীতি হয়। উগান্ডা বা পাকিস্তানের চাইতে বাঙলাদেশে অনেক কম দুর্নীতি হয়। সেই সাথে, বিএনপি সরকারের আমলেও তো দুর্নীতি হতো। আপনার প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। আমার দল আওয়ামী লীগ দেশে দুর্নীতি চালু করে নি। এটি দেশে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তৎকালীন বিএনপি জামাতের সময়ে জোর করে ঘুষ আদায় করা হতো। কিন্তু আমার দল ক্ষমতায় আসার পরে আর বেশী জোর করা হয় না। ঘুষ নেয়ার পরে সরকারী অফিসে কফিও খাওয়ানো হয়। তাই বলা যায়, বাঙলাদেশে কোন দুর্নীতি হয় না। বা হলেও, সেটি বৈধ দুর্নীতি।
  • ( কিন্তু অন্য দেশে দুর্নীতি হয়, বা আগের আমলে দুর্নীতি ছিল, এগুলো তো এটি প্রমাণ করে না যে, এখনকার সময়ে দুর্নীতি হয় না। এগুলো তো দুর্নীতিকে বৈধতা দেয় না। )
  • বাঙলাদেশে মেয়েরা পথে ঘাটে চলতে গেলে নানাধরণের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
  • কিন্তু ভারতে তো মেয়েদেরকে রাস্তায় সরাসরি গ্যাং রেইপ করা হয়। এই সেইদিনও দিল্লীতে একটি মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হলো। সেই সাথে, বিএনপি সরকারের আমলেও তো এগুলো হতো। আপনার প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। আমার দল এগুলো চালু করে নি। এটি দেশে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তৎকালীন বিএনপি জামাতের সময়ে ঘরে ঢুকে মেয়েদের ধর্ষণ করা হতো। কিন্তু আমার দল ক্ষমতায় আসার পরে ঘরে ঢুকে আর ধর্ষণ করা হয় না। মেয়েরা বাইরে গেলে একটু আধটু করা হয়। তাই বলা যায়, বাঙলাদেশে কোন নারীর ওপর যৌন নির্যাতন হয় না। আর যেটা করা হয়, তা খারাপ কিছু না।
  • ( কিন্তু অন্য দেশে ধর্ষণ হয়, বা আগের আমলে ধর্ষণ হতো, এগুলো তো এটি প্রমাণ করে না যে, এখনকার সময়ে যৌন নির্যাতন হয় না। )
  • খ্রিস্ট ধর্মে নারীর সম্পর্কে অসম্মানজনক বক্তব্য রয়েছে। বাইবেলের নতুন নিয়ম তিমথি ১ অধ্যায় ২ এর ১১,১২ তে বলা হয়েছে, ” ১১. নারীরা সম্পূর্ণ বশ্যতাপূর্বক নীরবে নতনম্র হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করুক৷ ১২. আমি কোন নারীকে শিক্ষা দিতে অথবা কোন পুরুষের ওপরে কর্তৃত্ত্ব করতে দিই না; বরং নারী নীরব থাকুক৷”
  • কিন্তু হিন্দুদের ধর্মে তো আরো খারাপ কথা বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে নারীদের স্বামীর দাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বিক্রি করে দেয়ার কথাও বলা আছে। আপনার সেই সময়ের প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। আমার ধর্ম এগুলো চালু করে নি। এগুলো সমাজে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তৎকালীন পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারীরা মেয়েদের কোন অধিকারই দিতো না। কিন্তু যীশু আসার পরে মেয়েরা পেয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। তার মানে, খ্রিস্ট ধর্মে আসলে নারীকে অনেক সম্মান দেয়া হয়েছে।-
  • ( কিন্তু অন্য ধর্মে নারীর প্রতি অসম্মানজনক বক্তব্য রয়েছে, বা আগের আমলে মেয়েদের অধিকার ছিল না, এগুলো তো এটি প্রমাণ করে না যে, খ্রিস্ট ধর্ম নারীকে সম্মান দিয়েছে! বা বাইবেলের ঐ আয়াতটি খুব ভাল আয়াত!)
  • আপনার ধর্মে(একটি কাল্পনিক ধর্মে) ধর্ষণকে বৈধতা দেয়া হয়েছে কেন?
  • কিন্তু অমুক ধর্মে তো আরো বাজে কথা বলা আছে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত আপনার বুঝতে হবে। আমার ধর্ম ধর্ষণ চালু করে নি। এটি সমাজে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তৎকালীন বর্বর সমাজে খুব অত্যাচার করে ধর্ষণ করা হতো। মারপিট করা হতো, অনেক সময় হাত পা কেটে নেয়া হতো। ধর্ষিতার কোন অধিকারই ছিল না। কিন্তু আমার ধর্ম ধর্ষণ করার পরে ধর্ষিতা নারীকে বিরিয়ানী খাওয়াতে বলেছে। বিরিয়ানীর সাথে হালকা সালাদ এবং বোরহানীও দিতে বলেছে। দেখুন, আমার ধর্ম ধর্ষিতাকে কতটা সম্মান দিয়েছে। এরপরেও নাস্তিকরা বাজে কথা বলবে, জানি। কারণ তারা তো ইহুদিদের থেকে টাকা পায়।
  • ( কিন্তু অন্য ধর্মে আরো খারাপ কিছু রয়েছে, বা আগের আমলে আরো খারাপ কিছু ছিল, এগুলো তো এটি প্রমাণ করে না যে, যেই বিষয়ের সমালোচনা হচ্ছে, সেটি ভুল! )
  • ইসলামে দাসপ্রথাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।
  • সেই সময়ের প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত আপনার বুঝতে হবে। ইসলাম ধর্ম দাসপ্রথা চালু করে নি। এটি সমাজে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ইসলাম শুধু তাকে বৈধতা দিয়েছে। তৎকালীন বর্বর আইয়্যামে জাহিলিয়াতের সময়ে সমাজে দাসদের খুব অত্যাচার করা হতো। মারপিট করা হতো, অনেক সময় হাত পা কেটে নেয়া হতো। দাসদের কোন অধিকারই ছিল না। কিন্তু আমার ধর্ম দাসদেরকে নান্নার কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়াতে বলেছে। বিনিময়ে ইসলামে মালিকেরা দাসীদের সাথে যৌনকর্ম করতে পারে, এই বিধান করা হয়েছে। দেখুন, আমার ধর্ম দাসদাসীদের কতটা সম্মান দিয়েছে। এরপরেও নাস্তিকরা বাজে কথা বলবে, জানি। কারণ তারা তো ইহুদিদের থেকে টাকা পায়। তাই বলা যায়, দাসপ্রথা খারাপ কিছু নয়। ইসলামই দাসদের দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। সুতরাং ইসলামী দাসপ্রথা খুবই ভাল ব্যবস্থা এবং আবারো সারা পৃথিবীতে ইসলামি দাসপ্রথা চালু করা উচিত।
  • ( কিন্তু অন্য ধর্মে আরো খারাপ কিছু রয়েছে, বা আগের আমলে আরো খারাপ কিছু ছিল, এগুলো তো এটি প্রমাণ করে না যে, যেই বিষয়ের সমালোচনা হচ্ছে, সেটি ভুল! দাসপ্রথা মানব ইতিহাসে সবচাইতে ভয়ঙ্কর অপরাধ। মানবতার সাথে অন্যায়। মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ মৌলিক অধিকার হচ্ছে, স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকার। দাসপ্রথা দাসের একদম মৌলিক একটি অধিকার, স্বাধীনতাকে হরণ করে। তাকে একটি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে। মালিক চাইলে তাকে বিক্রি করতে পারে, মালিক চাইলে তাকে যেকোন কাজ করাতে পারে! শুধু তাই নয়, তাকে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহারও করতে পারে। এরকম ভয়াবহ ব্যাপারকে বৈধতা দেয়া অবজেকটিভলি খুব বড় অনৈতিক কাজ। )

শেষ কথা

লেখাটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। অংশবিশেষ লিখে সাহায্য করেছেন সুলেখক সুমিত রয় এবং নাফিস শাতিল সাদিক। ইচ্ছা আছে, কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বিষয়ক এই লেখাটি ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হবে। আপনি কিছু যুক্ত করতে চাইলে অনুগ্রহ করে আপনার নাম সহকারে কমেন্টে উল্লেখ করবেন। বানান ভুল সংশোধনকে স্বাগত জানাই। যুক্তি তর্ক বিতর্ক আলাপ আলোচনা সমালোচনা চলুক, সেটাই আমাদের সকলের কাম্য। চাপাতি নয়, যুক্তি ধারালো হয়ে উঠুক। মুক্তচিন্তার জয় হোক।

আসিফ মহিউদ্দীন

আসিফ মহিউদ্দীন সম্পাদক সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন [email protected]

38 thoughts on “বহুল প্রচলিত কিছু কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস

  • মাহমুদ রেজা

    অসাধারণভাবে লিখেছেন আসিফ ভাই। খন্ডিত সিরিজ আকারে ফেসবুকে তুলে ধরতে পারেন।

    Reply
  • Snehangsu Mondal

    অনেক ভালো লাগলো৷৷অনেক কিছু জানতে পারলাম৷৷ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে৷৷

    Reply
  • আইরিন ইরা

    খুবই সত্য কথা বলেছেন।

    Reply
  • আল্লাহ

    চমৎকার লেখা

    Reply
    • Biswajit Kundu

      আসিফ মহিউদ্দিন বাবু নমস্কার ! আপনার/আপনাদের এই প্রচেষ্টাকে আগেই কুর্নিশ জানিয়েছি । একটি সত্য কথা না জানালে কিছু ত্রুটি স্থায়ী থেকে যাবে । অনেক বাংলা শব্দের বানানে ভুল রয়েছে, যেগুলি ছাপার কারণে নয়, বরং লেখকের ব্যাকরণ গত অজ্ঞতার কারণে । একজন বাংলা ভাষাবিদ কে দিয়ে সংশোধন করিয়ে নিলে সর্বাঙ্গসুন্দর হবে । এটি আপনার কাছ থেকে প্রাপ্ত এক চিরস্থায়ী অমূল্য সম্পদ । পঃ বঙ্গ থেকে ।

      Reply
      • মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। “সংশয় – চিন্তার মুক্তির আন্দোলন” – অসংখ্য লেখা এবং তথ্যের ভাণ্ডার। বানান ঠিক রাখা অলাভজনক ওয়েবসাইট হিসেবে আমাদের জন্য সময় সাপেক্ষ এবং প্রায় অসম্ভব। আপনার চোখে কোন বানান ভুল ধরা পড়লে অনুগ্রহ করে ঠিক করে দিন।

        Reply
        • Zamshad

          You can add this one as an example of confusing explanations with excuses

          Reply
  • Mufti Abdullah Shahriar

    ‌লেখাটা অসাধারন কিন্তু অন্ধরা এস‌বের ধার ধা‌রে না।

    Reply
  • Sumit Roy

    প্রকৃতিগত হেত্বাভাস (Naturalistic fallacy)

    যখন “কী হয়”, “কী হয় না”- এর উপর ভিত্তি করে “কী হওয়া উচিৎ”, “কী হওয়া বাধ্য”, “কী হওয়া উচিৎ নয়”, “কী করা যাবে না” এরকম নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন এই বিশেষ হেত্বাভাসটি সংঘতিত হয়। এই হেত্বাভাসটি খুব সাধারণ, এবং বেশিরভাগ লোকই স্বীকৃতি সামাজিক ও নৈতিক রীতির জন্য এটি নজরে নেন না। এর কারণে আমরা যুক্তি থেকে সরে এসে, যা হয় তাকে হতেই হবে বলে মনে করি।

    এই হেত্বাভাসটির আরও গতানুগতিক ব্যবহারটি লক্ষ্য করা যায় যখন “ভাল” এর সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করা হয়। দার্শনিক জি. ই. মুর (১৮৭৩-১৯৫৮) যুক্তি দেন, কোন কিছু প্রাকৃতিক বলে একে “ভাল” বা “নৈতিক” বলে সংজ্ঞায়িত করলে ভুল হবে। এই হেত্বাভাসে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ভাল মন্দের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করা হয় বলেই এর নাম “ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি”।

    উদাহরণ:
    সমকামিতা নৈতিকভাবে ভুল (নৈতিক বৈশিষ্ট্য) কারণ এটা স্বাভাবিক নয় (প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য)।
    অথবা, সমকামিতা স্বাভাবিক নয় (প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য) তাই এটা নৈতিকভাবে ভুল (নৈতিক বৈশিষ্ট্য)।

    Reply
  • Sumit Roy

    নীতিগত হেত্বাভাস (Moralistic fallacy)

    যখন “কী হতে হবে” বা “কী হওয়া যাবে না” এই নৈতিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কী হয় – এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়। এডওয়ার্ড সি. মুর তার ১৯৫৭ সালের পেপারে এই হেত্বাভাস সম্পর্কে লেখেন।

    উদাহরণ:

    ১। পরকীয়া নৈতিকভাবে খারাপ (নৈতিক বৈশিষ্ট্য), তাই মানুষের একাধিক যৌনসঙ্গী লাভ করার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না (প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য)।

    ২। পরকালের না থাকাটি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না (নৈতিক বৈশিষ্ট্য), সুতরাং পরকাল ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে (প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য)।

    Reply
  • Sumit Roy

    আরও কিছু উদাহরণ:

    প্রকৃতিগত হেত্বাভাস-
    ২। প্রকৃতি মানুষকে অসুস্থতা ও রোগ দেয়, তাই ঐষধের দ্বারা প্রকৃতির কাজে বাঁধা দেয়া এবং অসুস্থের চিকিৎসা করা নৈতিকভাবে ভুল।
    ৩। যেহেতু ইতিহাসের সূচনা থেকেই যুদ্ধ হয়ে আসছে, এটা নৈতিকভাবে খারাপ হতে পারে না।

    নীতিগত হেত্বাভাস-
    ৩। খারাপ চরিত্রের অধিকারী হওয়া নৈতিকভাবে ঠিক নয়, তাই কেউই খারাপ হতে পারে না, সবাই ভাল মানুষ।
    ৪। নারী ও পুরুষের সমতাবিধান হতে হবে, তাই নারীরাও পুরুষের মত শক্তিশালী হয়।

    Reply
  • Sumit Roy

    এফারমিং দ্য কনসিকোয়েন্ট (Affirming the Consequent)

    বর্ণনা: ফরমাল লজিকের একটি সাধারণ ভ্রান্তি, যেখানে কন্সিকোয়েন্ট বা ফলাফল সঠিক হলে, এন্টিসিডেন্ট বা পূর্বসত্যকেও সঠিক ধরা হয়।

    উদাহরণ:
    কেউ একজন আমাদেরকে উপর থেকে দেখছেন বলেই, এখনও জগতে ভালো মানুষ আছে।

    এক্ষেত্রে সিলোলিজম:
    ঈশ্বর থাকলে ভালো মানুষ থাকবে
    ভালো মানুষ আছে
    সুতরাং, ঈশ্বর আছে।

    এখানে সমস্যাটা হচ্ছে A এর কারণে B হয় বলে, B হয়েছে বলে A যে হতেই হবে এমন নয়, কারণ B এর কারণ A ছাড়াও C, D, E সহ আরও অনেক কিছু হতে পারে। এক্ষেত্রে, ঈশ্বর থাকলে ভাল মানুষ থাকবে, এর অর্থ এই নয় যে শুধু ঈশ্বর থাকলেই ভাল মানুষ থাকবে, আরও অনেক কারণেই ভাল মানুষ থাকতে পারে।

    Reply
  • Sumit Roy

    ব্যাখ্যা ও অজুহাত বা ন্যায্যতা প্রতিপাদনকে গুলিয়ে ফেলা (Confusing an explanation with an excuse)

    বর্ণনা: কোন ঘটনার ব্যাখ্যাকে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন বা অজুহাত হিসেবে মনে করলে এই হেত্বাভাস হয়।

    উদাহরণ:
    ১।
    – ভাবি, আপনার ছেলে কিন্তু আমাকে মোটেও সম্মান করেনা।
    – কারণ সে মনে করে আপনার “আপনার চেহারা ডাইনির মত, যে বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না”।
    – কিন্তু এটা কোন অজুহাত হতে পারে না।
    – না, এখানে অজুহাতের কিছু নেই, এটা কেবলই তার আপনাকে পছন্দ না করার কারণ।

    এখানে বাচ্চাটি মহিলাটিকে কেন সম্মান করে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে মাত্র, কিন্তু বাচ্চাটি যে ঠিকই ভাবছে বা বাচ্চার ভাবনাটাই যে ঠিক বা ন্যায্য সেটা বলা হয় নি, যা মহিলাটি ধরে নিয়েছিলেন।

    ২।
    – তুমি কেন বিগফুটকে মানুষ ও বানরের মধ্যকার মিসিং লিংক বলে মনে করছ?
    – কারণ বিবর্তনগত প্রক্রিয়ায় দুটো প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতিকেই মিসিং লিংক বলে।

    এখানে মিসিং লিংক কাকে বলে তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, মানে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কেন সে বিগফুটকেই মিসিং লিংক বলে মনে করে এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়নি।

    ৩।
    – ধর্ষণের পিছনে বিবর্তনগত কারণ রয়েছে। জীববিজ্ঞানী থর্নহিল ও এনথ্রোপলজিস্ট পালমার বলেন, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হারেম-বিল্ডিং স্ট্রাগলের কারণে লুজাররা ধর্ষণকে বিকল্প জিন প্রমোটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যায়, আর এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে আসায় পুরুষেরা ধর্ষণের প্রবণতা লাভ করেছে।
    – এভাবে বলে তুমি ধর্ষণকে জাস্টিফাই করছ, যেন ধর্ষণ খুব নেচারাল, এটা হতেই পারে।

    ধর্ষণের ইভোল্যুশনারি এক্সপ্লানেশন ধর্ষণের ব্যাখ্যা দেয়, অর্থাৎ মানুষ কেন ধর্ষণপ্রবণ হয় তার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়, কিন্ত এই ব্যাখ্যা কখনই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে না, অর্থাৎ ধর্ষণ প্রাকৃতিক বলেই এটা নৈতিক এমন কিছু বলে না। আর সেই সাথে ইভোল্যুশন থেকে আসা প্রবণতা ধর্ষণের জন্য কোন এক্সকিউজ বা অজুহাতও হতে পারে না, এটা তাও অপরাধই থাকবে, কারণ প্রবণতা থাকলেও নিজেকে কন্ট্রোল করার অপশন আছে, বিবর্তনের দ্বারা মানুষ নৈতিকতা ও সামাজিকতার বৈশিষ্ট্যও লাভ করেছে, এছাড়া মানুষের আচরণ কেবল জিনই নয়, পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া অপরাধ অর্থ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজ, আর অপরাধী অর্থ যে এই ক্ষতিকর কাজটি করেছে। রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের বিধান অনুসারে অপরাধী যাতে অপরাধ থেকে নিবৃত হয় তাই শাস্তির প্রয়োজন, যেখানে শাস্তি অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করবার একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কেন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে কিছু আসে যায় না, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এখন অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই মুখ্য, তাই এক্সকিউজ বা এক্সপ্লানেশনে কিছু আসছে যাচ্ছে না, তবে বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানে এবং মানুষের চরিত্র বুঝবার জন্য স্বাধীনভাবে বিবর্তনগত কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে যেখানে নৈতিক সিদ্ধান্ত আরোপনের মাধ্যমে এটা ঠিক কি ভুল- এই বিষয়ক মন্তব্য করার কিছু নেই, বরং এই অনুসন্ধান অপরাধ নিবৃতির কাজে সহায়তা করতে পারে, যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

    Reply
  • Sumit Roy

    ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প (Just-world hypothesis)

    এটি একটি কগনিটিভ বায়াজ বা জ্ঞানীয় পক্ষপাত। এই পক্ষপাতের কারণে মানুষ অন্তর্নিহিতভাবেই তার জন্য নৈতিকভাবে ন্যায্য ফলাফল আশা করে, সে মনে করে যে পরিশেষে তার সমস্ত মহৎ কাজকেই পুরস্কৃত করা হবে, এবং সমস্ত অন্যায় কার্যের শাস্তি দেয়া হবে। এই অনুকল্পে ধরে নেয়া হয় যে কোন অতিপ্রাকৃতিক সত্তা রয়েছে যা সমাজের ভাল ও মন্দের মধ্যে একটি নৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে, যার কারণে কোন সৎ মানুষের সাথে অন্যায় কিছু ঘটে না, আর যদি ঘটেও থাকে তাহলে সেই সৎ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, এবং অন্যায়কারীকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হয়। এই বিশ্বাসটি আধ্যাত্মিক বিচার, পরকাল ইত্যাদিকেও নির্দেশ করে, আর সেই সাথে এর কারণে মানুষের কুযুক্তি গ্রহণ করার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয় যেখানে সে মনে করে যে, তার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে কারণ সে এটাই ডিজার্ভ করে।

    এই কগনিটিভ বায়াজ নিয়ে মনোবিজ্ঞানী মেলভিন জে. লারনার গবেষণা করেছেন। লারনারের মনে প্রশ্ন তৈরি হয় যে, কোন রাজতন্ত্রের রাজা যদি নিষ্ঠুরভাবে তার প্রজাদেরকে অত্যাচার করত, এবং প্রজারা সেই কষ্ট সহ্য করত, তাহলে কেনই বা তারপরও রাজাদের প্রতি প্রজাদের জনসমর্থন বলবৎ থাকত, এবং এই ভোগান্তিমূলক ও কষ্টদায়ী আইন ও রীতিকে কেন মানুষ সমাজস্বীকৃত প্রথা হিসেবেই মেনে নিত? লারনার অনুসন্ধান করে বের করেন যে, মানুষের মধ্যে ভিক্টিম ব্লেমিং বা ভুক্তভোগীকেই দায়ী করার প্রবণতা কাজ করে। লারনার যখন মনোবিজ্ঞানী হবার ক্লিনিকাল ট্রেইনিং নিচ্ছিলেন তখন তিনি দেখেন, অনেক শিক্ষিত দয়ালু ব্যক্তিই রোগীদের ভোগান্তির জন্য সেই রোগীদেরকেই দায়ী করে। লারনার অবাক হয়ে দেখলেন যে, তার ছাত্র ছাত্রীরা গরীবদেরকে অপমান করছে, কারণ তারা মনে করছে যে তাদের এই দারিদ্র্যের জন্য তারাই দায়ী। তিনি তার একটি গবেষণায় দেখলেন, দুইজন মানুষের মধ্যে র‍্যান্ডমলি বা যাদৃচ্ছিকভাবে একজনকে বেছে নিয়ে তাকে পুরস্কৃত করলে, এই ঘটনার পর্যবেক্ষক বা অবজারভারগণ পুরস্কৃত ব্যক্তিকেই অধিকতর শ্রেয় হিসেবে মূল্যায়িত করে, তাকেই বেশি ভাল মানুষ হিসেবে ভাবে। পূর্ববর্তী কোন সাইকোলজিকাল থিওরি যেমন কগনিটিভ ডিজোনেন্স বা অন্য কিছু এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে নি, আর এভাবেই তিনি নতুন এক সাইকোলজিকাল ফেনোমেনার অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন, তিনি উত্তর পেলেন যে কেন প্রজারা রাজার নিষ্ঠুরতাগুলো সহজেই মেনে নিত, নিত কারণ তারা মনে করত যাদেরকে অত্যাচার করা হয় তারাই তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। একটি অতিপ্রাকৃত শক্তি সবসময় ভাল খারাপকে ব্যালেন্স করে, সবসময় অন্যায়কারীর অমঙ্গল করে ও ভাল মানুষকে পুরস্কৃত করে, মানুষের এইরকম পক্ষপাত তাদের ভিক্টিম ব্লেমিং এর দিকে নিয়ে গেছে। এজন্য তারা যারা সমাজের নিষ্ঠুরতার বলি হয়, অন্যায়ের স্বীকার হয়, তার দায় সেই ভুক্তভোগীদের উপরেই চাপায়। এজন্যই মানুষ ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দায়ী করে। লারনার তার আবিষ্কৃত এই ফেনোমেনার নাম দিলেন জাস্ট ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিজ, বাংলায় “ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প”।

    অনেকে বলে, আপনার সাথে এত বড় অন্যায় হল, কিন্তু আপনি এর বিচারই পাবেন না, এটা কি লজিকাল হল? নৈতিক হল? হ্যাঁ এটা লজিকাল হল, অন্যায় হলেই যে বিচার হতে হবে এটা লজিক নয়, বরং ন্যায্য বিশ্ব অনুকল্প নামক জ্ঞানীয় পক্ষপাত এর কারণে ঘটা লজিকাল ফ্যালাসি। নৈতিক কিনা জিজ্ঞেস করছেন? হ্যাঁ, কেউ অপরাধ করে যদি অপরাধের শাস্তি না পায় তা অবশ্যই অন্যায় হবে, কিন্তু এই জ্ঞানীয় পক্ষপাতে আক্রান্ত হবার জন্য, অর্থাৎ ভালর সাথে ভাল হবে, আর খারাপের সাথে খারাপ হবে এই ধারণায় বিশ্বাস করে যদি আমি ভুক্তভোগীকে দায়ী করতাম, তাহলে ভুক্তভোগীর সাথেও অনেক বড় অনৈতিক কাজ করা হত…

    Reply
  • Sumit Roy

    জাস্ট ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিজ একটি কগনিটিভ বায়াজ, এই লিস্টে আরেকটি কগনিটিভ বায়াজ আছে দেখলাম (কনফারমেশন বায়াজ)। এভাবে কয়েকটি কগনিটিভ বায়াজ নিয়ে এখানে লেখা হয়ে গেলে, কগনিটিভ বায়াজগুলোকে এই লজিকাল ফ্যালাসির পাতায় না রেখে, এর জন্য একটি আলাদা পেইজ খোলার আবেদন করছি।

    Reply
  • Sumit Roy

    এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল) বা আপিল টু মোটিভ

    কোন যুক্তির পেছনে যুক্তিদানকারীর স্বার্থ্য রয়েছে এমনটা দেখিয়ে যুক্তি বা দাবীকে ভুল বললে বা নাকোচ করলে এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়।

    ১।
    – কনজিউমার রিপোর্ট অনুযায়ী এই আমাদের গাড়ি এভারেজ গ্যাস মাইলেজের গাড়িগুলোর থেকে ভাল, আর এটা বর্তমানে গাড়ির সবচেয়ে রিলায়াবল ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে একটি
    – এর সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, তুমি তো বিক্রির জন্য এটা বলবেই…

    গাড়ি বিক্রেতার গাড়ি বিক্রির জন্য ইন্টারেস্ট আছে এই অজুহাত দিয়ে এখানে গাড়ির মানকে অস্বীকার করা হচ্ছে, যেখানে বিক্রেতার সেরকম কোন ইন্টেনশন নাও থাকতে পারে, বা বিক্রেতার বক্তব্যে সেরকম ইন্টেনশনের প্রভাব নাও পড়তে পারে।

    ২।
    – মব যদি উত্তেজিত হয়ে ধর্ষককেও গণপিটুনি দেয় তা সঠিক হবে না, এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রকাশিত হয়, তাকে পুলিসে দেয়া প্রয়োজন
    – তুমি ধর্ষককে সমর্থন করছ, ধর্ষকের প্রতি সমবেদনা দেখাচ্ছ, এদেশের লোকেদের তো ইন্টেনশনই আছে ধর্ষকদের পক্ষ নেবার, তুমিও সেই পথে যাচ্ছ
    (অতয়েব তোমার কথাগুলো ভুল)।

    এখানে ধর্ষণের সপক্ষের মোটিভকে নিয়ে এসে অপরাধীর প্রতি মব জাস্টিসের বিরুদ্ধের যুক্তিকে নাকোচ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

    Reply
    • Sumit Roy

      Ad Hominem (Circumstantial) or appeal to motive or conflict of interest (স্বার্থ্যের দ্বন্দ্ব)

      Reply
      • Sumit Roy

        আরও একটি উদাহরণ:

        অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ:
        “রবীন্দ্রনাথের এই বাইশ শ’ গানের অনেকগুলোই বিশুদ্ধ নয়, রবীন্দ্রনাথের মৌলিক গান নয়। অন্য কোনো গানের সুর থেকে সরাসরি নকল করা বা সেগুলোকে ভেঙেচুরে রবীন্দ্রনাথ নিজের মত করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান আছে বিদেশী সুর থেকে নেয়া, অনেক গান আছে লোকসংগীত থেকে নেয়া, অনেক গান আছে বাউল সুর থেকে নেয়া।” “তবে, হুবহু অন্যের সৃষ্টিকে নকল করা অর্থাৎ সরাসরি কুম্ভীলকতা বা চৌর্যবৃত্তি কীভাবে ‘অনুপ্ররেণাযোগ্য’ হয় সেটা অবশ্য আমরা জানি না।” “(রবীন্দ্রনাথের) এই স্তাবকবাহিনী তাঁদের পূজনীয় ঠাকুরকে বাঁচানোর জন্য গালভরা এক শব্দ ‘অনুপ্রেরণা’কে বেছে নিয়েছেন, ‘ভাঙা গানে’র ভরাট ঢালের আড়ালে অত্যন্ত সুকৌশলে নিয়ে গিয়েছেন শতাব্দীর সেরা চৌর্যবৃত্তিকে।”

        তথ্যসূত্র:

        কুলদা রায়:
        “তাদের (অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ) কোনো কোনো লেখা বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লেখাটা অসত্য এবং পাকিপ্রচারণাপূর্ণ হওয়ায় সেটাকে জামাতি এজেন্ডার অংশ মনে করাটা খুব স্বাভাবিক। এবং পরবর্তীতে এই জামাতি এজেন্ডামূলক লেখাটা ছাগুরা ব্যবহার করছে। এবং করবে। পাকিছাগুদের ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্যই সেটা লেখা হয়েছে।”
        “রবীন্দ্রবিদ্বেষ পাকজমানা থেকেই সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল চক্র করে আসছে। এখানে রবীন্দ্রনাথ নয়–একটি চেতনার বিরুদ্ধেই অপপ্রচারের মত গুপ্ত অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং তাকে বা তাদেরকে অবৈজ্ঞানিক-অযৌক্তিক-বিভ্রান্তিকর লেখক হিসেবে সনাক্ত করা কি ভুল?”

        তথ্যসূত্র:

        উপরের কথায় কেবল রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করা হয়েছিল, কোন বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা সেখানে ছিল না। সেখানে এখানে এই লেখাকে জামাটি এজেন্ডার লেখা হিসেবে ধরে নিয়ে লেখাটির সমালোচনা করা হয়।

        Reply
  • Sumit Roy

    ২। চেরি পিকিং

    যখন আমরা বিভিন্ন রকম এভিডেন্স, ডেটা বা সম্ভাবনা থেকে আমাদের অনুকূলে যায় এরকম ডেটা বা এভিডেন্সকেই বা সম্ভাবনাকেই গ্রহণ করি তখন এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়।

    উদাহরণ:
    ১। আমাদের পলিটিকাল ক্যান্ডিডেট তার আয়ের ১০% অভাবীদেরকে দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চে যান, এবং সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। তিনি একজন সৎ ও যোগ্য ক্যান্ডিডেট।

    এখানে যে বিশেষগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোই যে তার সকল বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করবে এমন কোন কথা নেই। হতে পারে তিনি অভাবী সেক্স ওয়ার্কারকে নিজের লাভের বিনিময়ে অর্থ দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চ থেকে বেরিয়ে পাশের স্ট্রিপক্লাবে যান, আর প্রতি সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে যাবার কারণ সেখানে ড্রাগ ডিলারদের ঠেক বসে।

    ২।
    – আপনার সিভিতে লেখা যে আপনি খুব হার্ড ওয়ার্কার, সব কিছুতে আপনার অনেক মনোযোগ, এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে আপনার কোন সমস্যাই নেই।
    – ইয়েস স্যার।
    – আমি আপনার আগের অফিসের বসের সাথে কথা বলেছি। তিনি বললেন, আপনি বারবার বিভিন্ন জিনিস পরিবর্তন করেন যা পরিবর্তন করা উচিৎ নয়, আপনি অন্যের প্রাইভেসি নিয়ে খুব একটা কেয়ার করেন না, আর কাস্টোমার রিলেশনের ক্ষেত্রে আপনার স্কোর খুবই খারাপ।
    – ইয়েস স্যার। এগুলোও সত্যি।
    – খুব ভাল। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া টিমে তোমাকে স্বাগতম!

    সিভি, রেজিউম এসব চেরি পিকিং ইনফরমেশনের ক্লাসিক উদাহরণ। একটি রেজিউমে কেবল এই লেখা থাকে যে কেন আপনি পদটির জন্য যোগ্য। তবে বেশিরভাগ নিয়োগদাতাই বোঝেন যে এগুলো একপাক্ষিক, তাই তারা আরও বেশি এভিডেন্সের জন্য ইন্টারভিউ ও রিকমেন্ডেশন এর দ্বারস্থ হন।

    ৩। লোকটি ধর্ষকদের গণপিটুনির বিরুদ্ধে লিখছেন, নিশ্চই তিনি ধর্ষণ সমর্থন করেন ও তাদের প্রতি তার সমবেদনা কাজ করে।

    ধর্ষকদের প্রতি সমবেদনা কাজ করা, ধর্ষকদের প্রতি সমর্থন থাকে, এসব ধর্ষকদেরকে গণপিটুনি দেবার বিরোধিতার কারণ হতেই পারে, কিন্তু এটাই এর একমাত্র কারণ নয়। মব জাস্টিস সমর্থন না করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে থাকা, অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগে বিশ্বাস করা ইত্যাদি অনেক কারণ থাকতে পারে এটা নিয়ে লেখার। কিন্তু এদের মধ্যে নিজের অনুকূলে কাজ করে এমন একটি সম্ভাবনা নিয়েই যদি দাবী করা হয় তাহলে চেরি পিকিং ঘটবে।

    Reply
  • Sumit Roy

    ৫। আপিল টু নরমালিটি

    এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয় যখন কী স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক নয়, কী হয়ে আসছে, কী কখনও হয় নি, এর উপর ভিত্তি করে যখন কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত টানা হয়, কোনটাকে ভাল, কোনটাকে মন্দ বলা হয়।

    উদাহরণ:

    ১।
    – আমি একটু ওবিস। এরকম একটু ওবিস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রে নরমাল। সুতরাং আমি ঠিকই আছি।

    যুক্তরাষ্ট্রে একটু ওবিস হওয়া নরমাল হলেও, এটা যে স্বাস্থ্যের জন্য ভাল হবে এমন নয়।

    ২।
    – গ্রামে সব নারীরই তো বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা এখানে একটা নরমাল ব্যাপার, সুতরাং এটায় ক্ষতির কিছু নেই…

    একই কারণে এটি হেত্বাভাস।

    ৩।
    – এরকম ধর্ষককে ধরে গণপিটুনি দেবার ঘটনা আগে কোনদিন ঘটেছে? এগুলো আমাদের সমাজে খুব একটা নরমাল না। তাই এটা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই।

    ধর্ষককে গণপিটুনি দেবার ঘটনাটা আগে কখনও না ঘটলেও, এটি নরমাল না হলেও, এই বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ না, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মব জাস্টিসের সংস্কৃতি ও মানব নৈতিকতায় এর কোন প্রভাব থাকবে না, বা ধর্ষকের প্রতি মব জাস্টিস যে নৈতিক হয়ে যাবে এমন কোন কথা নেই। বরং এরকম ক্রিটিকাল কিছু ইস্যুতে, যেখানে অনেকেই মব জাস্টিসের পক্ষে থাকে, এমন ক্ষেত্রেই এসবের আলোচনা বেশি হওয়া উচিৎ, যুক্তিতর্ক হওয়া উচিৎ কারণ এই ক্রিটিকাল টাইমেই ক্রিটিকাল থিংকিং এর বিকাশ ঘটে।

    Reply
  • Sumit Roy

    আপিল টু হ্যাভেন

    কোন দাবীকে এই যুক্তিতে গ্রহণ করা হয় যে “ঈশ্বর এটাই চেয়েছেন”, “এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা” বা “তিনি ঈশ্বর তাই তিনি এটা করতে পারেন”, তাহলে এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়।

    উদাহরণ:
    ১।
    বিচারক: কেন তুমি ওদেরকে হত্যা করেছ?
    অভিযুক্ত: কারণ ঈশ্বর আমাকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন।

    আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ, কারণ বিচারব্যবস্থা এভাবে কাজ করে না। কিন্তু মুশকিল হল মানব-চিন্তা অনেক সময়ই এভাবে কাজ করে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ এই ভেবে কোন কাজ করছে যে ঈশ্বর তাই চান, ঈশ্বর এতে খুশি হবেন, এসব কাজ করলে কোন সমস্যা নেই কারণ এটাই ঈশ্বরের বিধান। আর এরকম চিন্তার কারণে অনেকে অন্যের ক্ষতিও করে ফেলেন। আধুনিক বিচারব্যবস্থা এসবের তোয়াক্কা করেনা বলেই হয়তো অন্যের ক্ষতি করার পেছনে এরকম যুক্তি আর খাটে না, অপরাধ তও অপরাধই থাকে।

    ২।
    – কেন আব্রাহাম ও আইজ্যাকের গল্পটিকে একটি “অসাধারণ” খ্রিস্টীয় গল্প হিসেবে পড়ানো হয়? লোকটা তো তার সন্তানকে প্রায় জীবিত পুড়িয়েই ফেলেছিল!
    – কারণ আব্রাহাম ঈশ্বরের ইচ্ছারই অনুসরণ করছিল। এটা আব্রাহামের জন্য অনেক কষ্টকর হলেও সে ঈশ্বরভক্তির কারণে করতে যাচ্ছিল। এটা কি অসাধারণ গল্প নয়?

    এখানে বোঝাই যাচ্ছে যে, নিজের সন্তানকে আগুনে পোড়ানোর গল্প ততক্ষণ পর্যন্তই “অসাধারণ” যতক্ষণ পর্যন্ত এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের ভক্তির জন্য সন্তান হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করলেই সন্তান হত্যা করার চেষ্টা ভাল কাজ হয়ে যায় না, তাতে যতই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ পাক, আর তাই এই গল্পটিও “অসাধারণ” হয় না। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরকম ঈশ্বরের ইচ্ছার ব্যাপারটি আনা অর্থ যুক্তিকে ত্যাগ করা। এক্ষেত্রে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই প্রধান হয়ে যায়, আর সেজন্য যেকারও ক্ষতি করার ব্যাপারটি নৈতিকতার ঊর্ধ্বেও চলে যেতে পারে যেমনটা গল্পে আব্রাহামের ক্ষেত্রে হয়েছিল, আর তাই এরকম হেত্বাভাস বিপজ্জনকও হতে পারে।

    ৩।
    – নিজের ধর্ম ব্যাতীত অন্য ধর্মের লোকজন অধস্তন- এই কথা কোন মানুষ বলেনি, ধর্মগ্রন্থে স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন। এরকম কথা মানুষ বললে তিনি সাম্প্রদায়িক হবেন, কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সবার সৃষ্টিকর্তা, তাই তিনি এই কথা বলতেই পারেন।

    এখানে মানুষের সাথে ঈশ্বরের একটি পার্থক্য সূচিত করে বলা হচ্ছে যে মানুষ এরকম কথা বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে, কিন্তু ঈশ্বর এরকম বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে না। ঈশ্বর এই কথাটি বলছে বলেই এটা সাম্প্রদায়িক হবে না, এটা সত্য হয়ে যাবে এই কথাগুলোতেও যুক্তি ত্যাগ করা হয়, এবং এটি আপিল টু হ্যাভেন নামক যৌক্তিক হেত্বাভাসের মধ্যে পড়ে। এছাড়া ঈশ্বরের এই কথাটি মানুষের উদ্দেশ্যেই বলা, মানুষকে জানানোর জন্য ঈশ্বর যেসব আদেশ দেন তাই ধর্মগ্রন্থে সংকলিত হয়। কাজেই এই এরকম বিধান দেয়া হয়েছে যাতে ঈশ্বরের কথা ভেবে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে, আর ঈশ্বর এক্ষেত্রেও ঈশ্বর এভাবে বলেছেন বলে ভিন্ন ধর্মের লোকেরা অধস্তন, লেস হিউম্যান বা ঊনমানব এরকম দাবী করাটাও এই হেত্বাভাসটির অন্তর্গত হয়।

    Reply
  • Anonymous

    নিয়মিত পড়ি। এই প্রথম কমেন্ট না করে পারলাম না..চমৎকার লিখেছেন ভাই।

    Reply
  • Straw-man Fallacy কে কি আমরা বাংলায় “কুশপুত্তলিকা দাহ কুযুক্তি” বলতে পারি?

    Reply
  • ধন্যবাদ

    Reply
  • মোমেনা নাটক-০৪ঃ ফরমুজলের ভাগ্নীর বিয়ে
    ফরমুজল হক – (টেলিফোনে) ভাইজান, আমি সকালে সিঙ্গাপুর থেকে এসেছি। ফরিদার বিয়ের খবর কি? কি যেন শুনলাম?
    রহমান- হ্যা, আমাদের ও মন খারাপ। ছেলেটা ভালো ছিল। আমরা খুব আশা করেছিলাম।
    ফরমুজল – হয়েছিল কি?
    রহমান- ছেলের বড় চাচা, একটু হুজুর গোছের, জানতে চেয়েছিল, ফরিদা নামাজ রোজা করে কিনা, কোরান শরীফ পড়ছে কি না, এই সব।
    ফরমুজল- তারপর?
    রহমান- আমরা বললাম, ছোট বেলায় কোরান খতম দিয়েছে। তারা জানতে চাইলো, কোন বয়সে। আমি বলেছিলাম, ছয় বছর বয়সে, আব্বা বললেন, নয় বছরে। ছেলে একটু হাসলো।
    ফরমুজল- তারপর?
    রহমান- চাচা জানতে চাইলো, যে হুজুরের কাছে পড়েছে তার বয়স কত ছিল। আব্বা উত্তর দিলেন, ষাটের উপরে।
    ফরমুজল – তারপর?
    রহমান- ছেলে হেসে বলে, তা ছয় বছর নয় বছর আর ষাট বছর, ব্যাপার তো সেই একই।
    ফরমুজল- আর কিছু?
    রহমান- না, আর কিছু না। খাওয়া দাওয়া করলো, চলে গেল। দুই ঘন্টা পরে টেলিফোন করে জানালো, “না”। আব্বা আম্মার মন খারাপ। ফরমুজ, তুমি আর একটা ছেলে দেখো।
    ফরমুজল- কত আর দেখবো? আপনাদের যে হুজুর কানেকশন, পীর বাবা কানেকসন । এই যুগের মানুষ কি আর আগের মতন বলদ আছে? আমি নিজেও তো বলদামী করে ফেলেছি। এখন তো আর ফেলতে পারবো না।
    রহমান- এই সব কথা আর মনে রেখো না, ভাই। এখন থেকে তুমি যা বলবে আমরা, আব্বা, চাচা তাইই করবো।
    ফরমুজল- কথা তো একটাই। ঐ সব পীর হুজুর কানেকশন একেবারে বাদ।
    রহমান- বেশ, তাই হবে।
    ফরমুজল- শুধু কথায় কাজ হবে না। ওনাদের বলবেন, দাড়ি ক্লিন শেভ করে ফেলতে। সেই ছবি হোয়াটস আপে আমাকে পোষ্ট করে দেবেন। আমি দেখবো, তার পরে দেখি কিছু করা যায় কিনা ।
    রহমান- বেশ তাই হবে। ওরা রাজী না হলে আমি ঘুমের মধ্যে কাচি দিয়ে কেটে দেবো।

    Reply
  • প্রণব নাইয়া

    false dilemma -র বাংলা আছে মিথ্যা ‘উভসঙ্কট’।
    হবে মিথ্যা উভয়সঙ্কট।

    Reply
  • SadiaParomita

    আমার মোল্লা শ্বশুর always আমাকে বিয়ের পর থেকে বলতেন, শুন বউ, মেয়ে মানুষ বিয়ের পর জামাই এর মা বাবা এর সেবা করবে, তাইলে সে বেহেশতে যাইতে পারবে..জামাই এর মন জোগায় চলবে… তাইলে পুলিসিরাত সহজে পার হৈতে পারবে বউ রা … ঘর এর বউ রা থাকবে পর্দা পুর shiday …এরপর তিনি আমাকে কিছু hadith বললেন… মা বাবা এর হক ও অধিকার নিয়ে… মা বাবার পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত… তখন আমি বললাম… আব্বু আম্মু এতক্ষণ তো মা বাবা এর অধিকার নিয়ে কথা বললেন এখন বউ এর অধিকার নিয়ে hadith বলেন… তিনি hochkochiye গেলেন.. .বললেন,, “বউ এর অধিকার নিয়ে আরেকদিন বলব”…দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি এই কাঠ মোল্লা shoshur এর ছেলে আমার স্বামী এর কাছ থেকে বউ এর মর্যাদা এখনও পাইনি…

    Reply
  • just wow ………………..asif vi….

    Reply
  • sankar

    অনেক কিছু শিখতে পারলাম

    Reply
  • jewel sarker

    প্রতিটি লেখাই যুক্তিনির্ভর তথ্যবহুল। যতবার পড়ি মনে হয় এই প্রথম পড়লাম, আবার ও পড়তে ইচ্ছা করে। এই তথ্যগুলো আপনাদের খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে, অনেক পরিশ্রম হয়েছে। কিন্তু আমাদের জন্য বিষয়টা খুবই সহজ করে দিয়েছেন। খুব সহজেই আমরা বিভিন্ন বিষয় এখান থেকে জানতে পারি। আপনাদেরকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ ।

    Reply
    • RAIHAN KABIR

      প্রথমে ভেবেছিলাম একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করবেন কিন্তু দেখলাম লজিক্যাল ফ্যালাসি বোঝাতে গিয়ে আপনি এমন সব ধর্মের বিষয় উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছেন যা দিয়ে আপনি নিজেই একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি এপ্লাই করছেন আপনার পাঠকদের উপর। এটা তো বিশাল ধোকা!

      Reply
  • Ashaduzzaman Chowdhury

    উপস্থাপিত যুক্তি তথ্য প্রমাণ যাই হোক না কেন, যুক্তিতর্কের ফলাফল আপনি আগেই নির্ধারণ করে সেই বিশ্বাসে স্থির থাকলে তাকে আমরা বলি আর্গুমেন্ট ফরম ফাইনাল কন্সিকুয়েন্সেস। ধরুন আপনার বিশ্বাস হচ্ছে, বিবর্তনবাদ মিথ্যা। আপনি বিবর্তনবাদ নিয়ে বিতর্ক করতে আসলেন, এবং বিবর্তনের সপক্ষে সমস্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি শোনার পরেও, তার বিপরীতে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও আপনি বলতে থাকলেন, যত যাই হোক, বিবর্তনবাদ মিথ্যা। কারণ আপনার আস্থা যুক্তি বা প্রমাণে নয়, আপনার আস্থা বিশ্বাসে। এরকম অবস্থায় আপনার অবস্থানকে তালগাছবাদী কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলা হবে।

    এখানে বিবর্তনবাদ শব্দটি কি যৌক্তিক? বিবর্তন তত্ত্ব শব্দটি এখানে দেয়া যেতো কি? কারণ,আমার যতটুকু জানা যে, বিবর্তনবাদ তো মতবাদকে নির্দেশ করে।কিন্তু এটি তো মতবাদ নয়। এটি তত্ত্ব।

    Reply
    • Biswajit Kundu

      ‘ Logical Fallacy ‘ এক অসাধারণ সম্পদ , সংক্ষিপ্ত, সহজবোধ্য, এবং খুবই প্রয়োজনীয় fundamental জ্ঞান । এটি প্রকাশের জন্য আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই । অভিনন্দন রইলো । পঃ বঙ্গ থেকে ।

      Reply
  • লেখাটি খুবই ভালো লাগলো। আপনাদের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

    Reply
  • ভালো লেগেছে

    Reply
  • ওদিকে নাকে দড়ি বাধা মুমিন ভাইলোগেরা shongshoy.com এর এই আর্টিকেলটি চুরি করে, লেখার ভিতরের যুক্তিটাকেই একদম ১৮০ ডিগ্রি কোণে উল্টিয়ে দিয়ে ‘লজিক্যাল ফ্যালাসি’ নামেই তাদের তাকিয়াবাজি ব্লগে লেখা পাবলিশ করছে আর মুমিন ভাবছে “মুই কি যুক্তিবাদী হনু রে”….
    হাইস্যকর।
    তাদের সাইটের চুরিকৃত সেই আর্টিকেল এর link নিচে:
    https://www.frommuslims.com/কুযুক্তি-লজিক্যাল-ফ্যাল/#apramanera_bojha_kuyukti_-_Burden_of_proof_fallacy

    Reply
  • An excellent article in Bengali. Although I have read books on Logical Fallacy (in English) but this is the first time I have read in Bengali. Credits go to the author. Thank you. Keep it up.

    Reply

Leave a Reply