কোরআন এবং মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়
সূচিপত্র
সূচনা
কোরআনকে একটি বিজ্ঞানময় কিতাব বলে প্রমাণ করতে বা কোরআনের ঐশীগ্রন্থ হওয়ার প্রমাণ হিসেবে ইসলাম প্রচারকগণ যেসকল দাবি আমাদের সামনে উপস্থাপন করে থাকেন তারমধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত একটি দাবি হচ্ছে, কোরআনে মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়সমূহের একটি নির্ভুল বর্ণনা রয়েছে। তারা কোরআনের সূরা ফুসসিলাতের ১১তম আয়াতটিকে কেন্দ্র করে দাবিটি করেন, আয়াতটি বলে যে একটি পর্যায়ে আকাশ ছিল ধোঁয়া। তারা তাদের দাবির স্বপক্ষে বলেন যে মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ের এই তথ্য সপ্তম শতাব্দীর আরবদের কাছে পরিচিত ছিল না এবং কেবল বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে আলোর মুখ দেখেছে। এই প্রবন্ধে আমরা বহুল প্রচলিত দাবিটি পর্যালোচনা করে দাবিটির সত্যতা কতটুকু সেটি তুলে ধরবো।
দাবি
ইসলামিক অ্যাপোলজিস্ট আই. এ. ইব্রাহীম তার “এ ব্রিফ ইলাস্ট্রেটেড গাইড টু আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইসলাম” শীর্ষক বইটিতে কোরআনের বৈজ্ঞানিক মিরাকলের একটি উদাহরণ হিসেবে দাবিটি উপস্থাপন করেন। [1] আসুন তার পুরো বক্তব্যটি পড়ে দেখি,
বাংলা অনুবাদ
“পর্যবেক্ষণীয় এবং তত্ত্বীয় আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞান অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই জানায় যে পুরো মহাবিশ্বই একসময় এক ‘ধোঁয়ার মেঘ’ (একটি অস্বচ্ছ অত্যন্ত ঘন এবং উষ্ণ বাষ্পীভূত মিশ্রণ) ব্যতীত কিছু ছিল না। এটি আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানের একটি অন্যতম নীতি। বিজ্ঞানীরা এখন সেই ধোঁয়ার অবশিষ্টাংশ থেকে নতুন নক্ষত্র গঠিত হওয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। (ছবি ১ ও ২ দেখুন)
রাতেরবেলা আমরা যেসব উজ্জ্বল তারকা দেখে থাকি, পুরো মহাবিশ্বের মতো সেসব তারকাও সেই ধোঁয়ার উপাদান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহতা’আলা কোরআনে বলেছেন:
“অতঃপর তিনি আসমানের দিকে মনোযোগ দেন, যা ছিলো ধোঁয়া…”
(কোরআন ৪১:১১)চাঁদ, নক্ষত্রসমূহ, গ্রহসমূহ, ছায়াপথসমূহ ইত্যাদি) সেই একই ধোঁয়া থেকে গঠিত হয়েছে, সেহেতু আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, পৃথিবী এবং আসমানসমূহ একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিলো। তারপর সেই সমপ্রকৃতির ধোঁয়া থেকে তারা গঠিত হয় এবং একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। আল্লাহতা’আলা কোরআনে বলেছেন:
“যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখেনা যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম…”
(কোরআন ২১:৩০)ড. আলফ্রেড ক্রোনার পৃথিবীর অন্যতম প্রখ্যাত একজন ভূতত্ত্ববিদ। তিনি জার্মানির মাইনজ শহরে অবস্থিত জোহানেস গুটেনবার্গ ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব জিওসায়েন্সেসের ভূতত্ত্ব অধ্যাপক এবং ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, “ভাবছি মুহাম্মদ কোথা থেকে এলো . . . আমার মনে হয় এটা প্রায় অসম্ভব যে সে মহাবিশ্বের উৎসের মতো বিষয়সমূহ জানতে পারতো, কেননা বিজ্ঞানীরা গত কয়েকবছরেই খুব জটিল এবং উন্নত প্রযুক্তিক পদ্ধতির সাহায্যে এসকল বিষয়ে জানতে পেরেছে।” তিনি আরও বলেছেন, “চৌদ্দ’শ বছর আগের একজন মানুষ যিনি পারমাণবিক পদার্থবিদ্যার সামান্যও জানতেন না তিনি, আমি মনে করি, নিজে নিজেই জানতে পারতেন না যে, পৃথিবী এবং আকাশের উৎস একই ছিলো।”“
বিশ্লেষণ
আমাদের ছায়াপথ
বিশ্লেষণের সূচনাতেই পৃথিবী থেকে ধারণকৃত রাতের আকাশের একটি দৃশ্য তুলে ধরবো যেখানে আমাদের ছায়াপথের অংশবিশেষ দেখা যায়,
উপরের দৃশ্যটি দেখে কারো মনে হতে পারে রাতের আকাশে ধোঁয়ার মেঘ দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, দৃশ্যটিতে আমাদের ছায়াপথের একটি অংশ দেখা যাচ্ছে। খালি চোখেই পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চল থেকে অনুরূপ দৃশ্য দেখা সম্ভব যদি আকাশ মেঘমুক্ত হয় এবং আলো দূষণের পরিমাণ অত্যন্ত কম হয়। আর তাই, সপ্তম শতাব্দীতে কোনো মরুবাসীর মরুভূমি থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়ার মেঘ সদৃশ্য আমাদের ছায়াপথের অংশবিশেষ দেখে একটি পর্যায়ে আকাশ কেবলই ধোঁয়া ছিল মনে করাটা অসম্ভব ছিল না।
আগে পরের আয়াত
যে আয়াতটিকে কেন্দ্র করে আলোচ্য দাবিটি উপস্থাপন করা হয়েছে সেই আয়াতের আগে পরের আয়াত বিবেচনায় আনা হয়নি। আগের পরের আয়াতসমূহের দিকে লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায় যে আলোচ্য দাবিটি অর্থহীন।
۞ قُلْ أَئِنَّكُمْ لَتَكْفُرُونَ بِٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْأَرْضَ فِى يَوْمَيْنِ وَتَجْعَلُونَ لَهُۥٓ أَندَادًۭا ۚ ذَٰلِكَ رَبُّ ٱلْعَـٰلَمِينَ ٩,
“Do you indeed disbelieve in He who created the earth in two days and attribute to Him equals? That is the Lord of the worlds.”
— Saheeh Internationalবল, ‘তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবে যিনি দু’দিনে যমীন সৃষ্টি করেছেন? আর তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ বানাতে চাচ্ছ? তিনিই সৃষ্টিকুলের রব’।
(কোরআন ৪১:৯)
— Rawai Al-bayan
وَجَعَلَ فِيهَا رَوَٰسِىَ مِن فَوْقِهَا وَبَـٰرَكَ فِيهَا وَقَدَّرَ فِيهَآ أَقْوَٰتَهَا فِىٓ أَرْبَعَةِ أَيَّامٍۢ سَوَآءًۭ لِّلسَّآئِلِينَ ١٠
And He placed on it [i.e., the earth] firmly set mountains over its surface, and He blessed it and determined therein its [creatures’] sustenance in four days without distinction – for [the information of] those who ask.
— Saheeh Internationalআর তার উপরিভাগে তিনি দৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে বরকত দিয়েছেন, আর তাতে চারদিনে প্রার্থীদের জন্য সমভাবে খাদ্য নিরূপণ করে দিয়েছেন।
(কোরআন ৪১:১০)
— Rawai Al-bayan
ثُمَّ ٱسْتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ وَهِىَ دُخَانٌۭ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ٱئْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًۭا قَالَتَآ أَتَيْنَا طَآئِعِينَ ١١
Then He directed Himself to the heaven while it was smoke and said to it and to the earth, “Come [into being], willingly or by compulsion.” They said, “We have come willingly.”
— Saheeh Internationalতারপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করেন। তা ছিল ধোঁয়া। তারপর তিনি আসমান ও যমীনকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় আস’। তারা উভয়ে বলল, ‘আমরা অনুগত হয়ে আসলাম’।
(কোরআন ৪১:১১)
— Rawai Al-bayan
فَقَضَىٰهُنَّ سَبْعَ سَمَـٰوَاتٍۢ فِى يَوْمَيْنِ وَأَوْحَىٰ فِى كُلِّ سَمَآءٍ أَمْرَهَا ۚ وَزَيَّنَّا ٱلسَّمَآءَ ٱلدُّنْيَا بِمَصَـٰبِيحَ وَحِفْظًۭا ۚ ذَٰلِكَ تَقْدِيرُ ٱلْعَزِيزِ ٱلْعَلِيمِ ١٢
And He completed them as seven heavens within two days and inspired [i.e., made known] in each heaven its command. And We adorned the nearest heaven with lamps [i.e., stars, for beauty] and as protection. That is the determination of the Exalted in Might, the Knowing.
— Saheeh Internationalতারপর তিনি দু’দিনে আসমানসমূহকে সাত আসমানে পরিণত করলেন। আর প্রত্যেক আসমানে তার কার্যাবলী ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। আর আমি নিকটবর্তী আসমানকে প্রদীপমালার দ্বারা সুসজ্জিত করেছি আর সুরক্ষিত করেছি। এ হল মহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নির্ধারণ।
(কোরআন ৪১:১২)
— Rawai Al-bayan
উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহে কোরআন বলে যে আল্লাহ আকাশ সৃষ্টি করার আগে পৃথিবী সৃষ্টি করেন। সর্বপ্রথম তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তারপর পৃথিবীপৃষ্ঠে পর্বতমালা স্থাপন করেন এবং পৃথিবীর বাসিন্দাদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। পৃথিবী সৃষ্টি করার পরই তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ধোঁয়া অবস্থায় বিরাজ করছিল। আকাশ সৃষ্টি করার আগেই যে আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সেটি সূরা ফুসসিলাতের ১১তম আয়াতের দ্বিতীয়ার্ধে আরও স্পষ্ট হয়ে যায় যখন তিনি আকাশ এবং পৃথিবী উভয়ের সাথে কথা বলেন। তিনি যদি আগেই পৃথিবী সৃষ্টি না করে থাকেন, তাহলে তিনি কিভাবে তার সাথে কথা বলতে পারলেন? অতএব, যদি সূরা ফুসসিলাতের ১১তম আয়াতে ব্যবহৃত ‘ধোঁয়া’ শব্দটি মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বর্ণনা প্রদান হয়ে থাকে, তাহলে কোরআন অনুসারে, মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল। তবে, রেডিওমেট্রিক ডেটিং থেকে জানা যায়, পৃথিবী প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়, মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের সূচনার প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পরে। [2] সুতরাং, পরিষ্কারভাবেই, কোরআন মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়সমূহের একটি নির্ভুল বর্ণনা প্রদান করে না।
ড. আলফ্রেড ক্রোনার
এটি সত্য যে ড. আলফ্রেড ক্রোনার জার্মানির একজন ভূতত্ত্ব অধ্যাপক ছিলেন, তবে তিনি কখনোই কোরআনকে বৈজ্ঞানিক তথ্যে একটি নির্ভুল উৎস হিসেবে সমর্থন করেননি। ২০১১ সালে ক্রোনারের সাথে পরিচালিত একটি ভিডিও ইন্টারভিউ থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে তার আশির দশকের কিছু মন্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। [3] কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব তিনি বর্তমানেও সমর্থন করেন না এবং মূল ইন্টারভিউয়ের সময়ও করতেন না। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে কোরআনের কিছু অংশ আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করে না এবং সেসব পুরোপুরিই অবৈজ্ঞানিক এবং পৌরাণিক।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনা এবং তথ্যপ্রমাণের প্রেক্ষিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে কোরআন মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়সমূহের একটি নির্ভুল বর্ণনা নয়, বরং একটি ভুল বর্ণনা প্রদান করে।
আরও পড়ুনঃ
- কুরআনে ব্ল্যাকহোল?
- কুরআনে আইন্সটাইনের টাইম রিলেটিভিটি?
- সুনিতা উইলিয়ামসকে নিয়ে মুসলিমদের জালিয়াতি
- তথাকথিত চন্দ্র দ্বিখণ্ডনের তথাকথিত ফটোগ্রাফিক প্রমাণ এবং মুসলিমদের জালিয়াতি
- কুরআনই সর্বপ্রথম জানিয়েছে চাঁদের নিজস্ব আলো নেই?
তথ্যসূত্র
- “The Quran on the Origin of the Universe” (archived)
I. A. Ibrahim, Islam-Guide, accessed December 3, 2018. [↑] - “Age of the Earth“, U.S. Geological Survey, July 9, 2007 (archived). [↑]
- TheRationalizer, “Alfred Kröner – Quote mined scientist denounces Quran miracle claims“, YouTube (video), March 21, 2011. [↑]
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"
ভাই মুমিনরা এখন বলছে, বাকারার উক্ত আয়াতে ছুম্মা অর্থ অতঃপর ব্যবহ্যার হয় নি। বরং moreover বা তাছাড়া ব্যবহৃত হয়েছে
Thanks for these useful true works.i hope your work will a logical society in future.
Very much informative, keep it up. Thanks.
nice