07.জন্মগতভাবে কাফির?

Print Friendly, PDF & Email

নবী মুহাম্মদ বলেছেন, মুমিনদের নাবালেগ বাচ্চারা যদি ছোট অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করে, তবে তারা তাদের বাপ-দাদার অনুসারী হবে, অর্থাৎ জান্নাতে যাবে। আবার, মুশরিকদের নাবালেগ বাচ্চারা তাদের পিতামাতার আমল অনুসারে জাহান্নামে যাবে। কোন আমল ছাড়াই [1]

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১ঃ ঈমান (বিশ্বাস)
পরিচ্ছেদঃ ৩. দ্বিতীয় ‘অনুচ্ছেদ – তাকদীরের প্রতি ঈমান
১১১-(৩৩) ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! মু’মিনদের (নাবালেগ) বাচ্চাদের (জান্নাত-জাহান্নাম সংক্রান্ত ব্যাপারে) কী হুকুম? তিনি উত্তরে বললেন, তারা বাপ-দাদার অনুসারী হবে। আমি বললাম, কোন (নেক) ‘আমল ছাড়াই? তিনি বললেন, আল্লাহ অনেক ভালো জানেন, তারা জীবিত থাকলে কী ‘আমল করতো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা মুশরিকদের (নাবালেগ) বাচ্চাদের কী হুকুম? তিনি বললেন, তারাও তাদের বাপ-দাদার অনুসারী হবে। (অবাক দৃষ্টিতে) আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন (বদ) ‘আমল ছাড়াই? উত্তরে তিনি বললেন, সে বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকলে কী ‘আমল করত, আল্লাহ খুব ভালো জানেন। (আবূ দাঊদ)(1)
(1) সহীহ : আবূ দাঊদ ৪০৮৯। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন : হাদীসটি দু’টি সানাদে বর্ণিত যার একটি সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূত্র ধরে সহিহ মুসলিম শরীফের একটি হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, খিজির নামক এক ব্যক্তি একবার এক বালককে বিনা কারণেই হত্যা করে। এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে, সে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয় যে, ছেলেটি জন্মগতভাবেই কাফের ছিল। তাই কুফরি কর্ম করার আগেই, তার পিতামাতাকে কুফরি কাজে বাধ্য করার আগেই তাকে হত্যা করে ফেলা হলো। খিযির আগেই জানতেন, এই ছেলেটি বড় হয়ে কুফরি করবে, বা আল্লাহকে মানবে না। ভেবে দেখুন, এই ছেলেটি সেই মূহুর্ত পর্যন্ত কোন অপরাধই করেনি। অথচ, অপরাধ করার আগেই বিনা অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো, কোন বিচার সাক্ষী প্রমাণ সব ছাড়াই। এবং এই কাজটি আবার হাদিসে খুব ভাল কাজ হিসেবে উল্লেখও করা হলো! যেই কাজ একজন করেই নি, তার জন্য তাকে কীভাবে শাস্তি দেয়া যেতে পারে?

এই ছেলেটি জাহান্নামে যাবে, নাকি জান্নাতে? সে তো কোন অপরাধই করেনি। যার জন্মই হয়েছে কাফির হিসেবে, সে নিশ্চয়ই জাহান্নামেই যাবে। এ কেমন বিচার! আল্লাহ তাকে কাফির হিসেবেই জন্ম দিলেন, আবার হত্যা করালেন বিনা অপরাধে, আবার জাহান্নামেও পাঠাবেন- এর নাম ইনসাফ? আসুন হাদিসগুলো পড়ি [2] [3] [4]

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৪৭। তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রত্যেক শিশু ইসলামী স্বভাবের উপর জন্মানোর মর্মার্থ এবং কাফির ও মুসলিমদের মৃত শিশুর বিধান
৬৬৫৯-(২৯/২৬৬১) আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামাহ্ ইবনু কা’নাব (রহঃ) ….. উবাই ইবনু কা’ব (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই যে ছেলেটিকে খাযির (আঃ) (আল্লাহর আদেশে) হত্যা করেছিলেন তাকে কফিরের স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছিল। যদি সে জীবিত থাকত তাহলে সে তার পিতামাতাকে অবাধ্যতা ও কুফুরী করতে বাধ্য করত। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৫২৫, ইসলামিক সেন্টার ৬৫৭৬)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৫/ ফযীলত
পরিচ্ছেদঃ ৪২. খিযির (আঃ) এর ফযীলত
৫৯৪৯। মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল আলা কায়সী (রহঃ) … সাঈদ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) কে বলা হলো, নাওফ দাবি করে যে, মূসা (আলাইহিস সালাম) যিনি জ্ঞান অন্বেষণে বের হয়েছিলেন। তিনি বনী ইসরাঈলের মূসা নন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, হে সাঈদ, তূমি কি তাকে এটা বলতে শুনেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, নাওফ মিথ্যা বলেছে। কেননা উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, মূসা (আলাইহিস সালাম) একদা তার জাতির সামনে আল্লাহ তা’আলার নিয়ামত এবং তাঁর শাস্তি পরীক্ষাসমূহ স্মরণ করিয়ে নসীহত করছিলেন। (কথা প্রসঙ্গে কারো প্রশ্নের জবাবে) তিনি বলে ফেললেন, পৃথিবীতে আমার চেযে উত্তম এবং বেশি জ্ঞানী কোন ব্যক্তি আছে বলে আমরে জানা নেই।
রাবী বলেন। আল্লাহ মূসা (আলাইহিস সালাম) এর প্রতি ওহী পাঠালেনঃ আমি জানি তার (মূসা) থেকে উত্তম কে বা কার কাছে কল্যাণ রয়েছে। অবশ্যই পৃথিবীতে আরো ব্যক্তি আছে যে তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আয় রব্ব! আমাকে তার পথ বাতলিয়ে দিন। তাকে বলা হলো লবণাক্ত একটি মাছ সঙ্গে নিয়ে যাও। যেখানে এ মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই সে ব্যক্তি। মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর খাদিম রওনা হলেন, অবশেষে তাঁরা একটি বিশাল পাথরের কাছে পৌছলেন। তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথীকে রেখে অগোচরে চলে গেলেন। এরপর মাছটি নড়েছরে পানিতে চলে গেল এবং পানিও খোপের মত হয়ে গেল মাছের পথে মিলিত হল না।
মূসা (আলাইহিস সালাম) এর খাদিম বললেন, আচ্ছা আমি আল্লাহর নাবীর সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে এ ঘটনা বলবো। পরে তিনি ভুলে গেলেন। যখন তারা আরো সামনে অগ্রসর হলেন, তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমার নাশতা দাও, এ সফরে তো আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যতক্ষন তারা এ স্থানটি অতিক্রম করেন নি, ততক্ষণ তাদের ক্লান্তি আসে নি।
রাবী বলেন, তাঁর সাথীর যখন স্মরণ হল, এবং সে বলল, আপনি কি জানেন যখন আমরা পাথরে আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন আমি মাছের কথা ভুলে গেছি। আর শয়তানই আমাকে আপনার কাছে বলার কখা ভুলিয়ে দিয়েছে এবং বিস্ময়করভাবে মাছটি সমুদ্রে তার পথ করে নিয়েছে। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এ-ই তো ছিল আমাদের উদ্দীষ্ট। অতএব তাঁরা পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে ফিরে চললেন। তখন তার খাদিম মাছের স্থানটি তাকে দেখালো।
মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এ স্থানের বিবরনই আমাকে দেওয়া হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এরপর মূসা (আলাইহিস সালাম) খুজতে লাগলেন, এমন সময় তিনি বস্ত্রাবৃত খিযির (আলাইহিস সালাম) কে গ্রীবার উপর চিৎ হয়ে শায়িত দেখতে পেলেন। অথবা (অন্য বর্ননায়) সোজাসুজি গ্রীবার উপর। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আসসালামু আলাইকুম। খিযির (আলাইহিস সালাম) মুখ খেকে কাপড় সরিয়ে বললেন, ওয়া আলাইকুম সালাম, তুমি কে? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি মূসা। তিনি বললেন, কোন মূসা? মূসা (আলাইহিস সালাম) উত্তর দিলেন, বনী ইসরাঈলের মূসা। খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, কোন মহান ব্যাপারই আপনাকে নিয়ে এসেছে? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি এসেছি যেন আপনাকে যে সৎজ্ঞান দান করা হয়েছে, তা থেকে কিছু আপনি আমায় শিক্ষা দেন।
খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমার সঙ্গে আপনি ধৈর্যধারণ করতে সক্ষম হবেন না। আর কেমন করে আপনি ধৈর্য ধারণ করবেন এমন বিষয়ে, যার জ্ঞান দেওয়া হয় নি। এমন বিষয় হতে পারে যা করতে আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি যখন তা দেখবেন, তখন আপনি সবর করতে পারবেন না। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। আর আমি আপনার কোন নির্দেশ অমান্য করব না।
খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি যদি আমার অনুগামী হন তবে আমাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না যতক্ষণ না আমি নিজেই এ বিযয়ে উল্লেখ করি। এরপর উভয়ই চললেন, অবশেষে তারা একটি নৌকায় চড়লেন। (খিযির (আলাইহিস সালাম) তখন( তা ছিদ্র করলেন অর্থাৎ তাতে (একটি তক্তায়) সজোরে চাপ দিলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বললেন, আপনি কি নৌকাটি ভেঙ্গে ফেলেছেন, আরোহীদের ডুবিয়ে দেয়ার জন্যে? আপনি তো বড় আপত্তিকর কাজ করেছেন। খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনাকে বলিনি যে, আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্যধারণ করতে সক্ষম হবেন না? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি ভুলে গিয়েছি, আমাকে আপনি দোষী করবেন না। আমার বিষয়টিকে আপনি কঠোরতাপূর্ণ করবেন না।
আবার দু’জন চলতে লাগলেন। এক জায়গায় তাঁরা বালকদের পেলেন যারা খেলা করছে খিযির (আলাইহিস সালাম) অবলীলাক্রমে একটি শিশুর কাছে গিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এতে মূসা (আলাইহিস সালাম) খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, আপনি প্রাণের বিনিময় ব্যতীত একটি নিষ্পাপ প্রাণকে হত্যা করলেন? বড়ই গর্হিত কাজ আপনি করেছেন। এ স্থলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহর রহমত বর্ষণ করুন আমাদের ও মূসা (আলাইহিস সালাম) এর উপর। তিনি যদি তাড়াহুড়া না করতেন তাহলে আরো বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে পেতেন। কিন্তু তিনি সহযাত্রী (খিযির (আলাইহিস সালাম)) এর সামনে লজ্জিত হয়ে বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন প্রশ্ন করি, তবে আপনি আমায় সঙ্গে রাখবেন না। তখন আপনি আমার ব্যাপারে অবশ্যই চূড়ান্ত অভিযোগ করতে পারবেন (এবং দায়মুক্ত হবেন)।
যদি মূসা (আলাইহিস সালাম) ধৈর্য ধরতেন, তাহলে আরো বিস্ময়কর বিষয় দেখতে পেতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন নাবীর উল্লেখ করতেন, প্রথমে নিজকে দিয়ে শুরু করতেন, বলতেন, আল্লাহ আমাদের উপর রহম করুন এবং আমার অমুক ভাইয়ের উপরও। এভাবে নিজেদের উপর আল্লাহর রহমত কামনা করতেন।
তারপর উভয়ে চললেন এবং ইতর লোকের একটি জনপদে গিয়ে উঠলেন। তাঁরা লোকদের বিভিন্ন সমাবেশে ঘুরে তাদের কাছে খাবার চাইলেন। তারা তাঁদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। এরপর তাঁরা একটি পতনোন্মুখ দেয়াল পেলেন। তিনি (খিযির (আলাইহিস সালাম)) সেটি ঠিকঠাক করে দিলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি চাইলে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, এবার আমার আর আপনার মধ্যে বিচ্ছেদ (এর পালা)।
খিযির (আলাইহিস সালাম) মূসা (আলাইহিস সালাম) এর কাপড় ধরে বললেন, আপনি যেসব বিষয়ের উপর অধৈর্য হয়ে পড়েছিলে সে সবের তাৎপর্য বলে দিচ্ছি।
‘নৌকাটি ছিল কতিপয় গরীব লোকের যারা সমুদ্রে কাজ করতো’– আয়াতের শেষ পর্যন্ত। তারপর যখন এটাকে দখলকারী লোক আসলো তখন ছিদ্রযুক্ত দেখে ছেড়ে দিল। এরপর তারা একটা কাঠ দিয়ে নৌকাটি ঠিক করে নিলো। আর বালকটি সৃষ্টিতেই ছিল জন্মগত কাফির। তার মা-বাবা তাকে বড়ই স্নেহ করতো। সে বড় হলে ওদের দুজনকেই অবাধ্যতা ও কুফরির দিকে নিয়ে যেতো। সুতরাং আমি ইচ্ছে করলাম, আল্লাহ যেন তাদেরকে এর বদলে আরো উত্তম, পবিত্র স্বভাবের ও অধিক দয়াপ্রবন ছেলে দান করেন। ‘আর দেয়ালটি ছিল শহরের দুটো ইয়াতীম বালকের’ আয়াতের শেষ পর্যন্ত (সূরা কাহফঃ ৬০-৮২)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সা‘ঈদ ইবনু যুবায়র (রহঃ)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৪৫/ ফযীলত
পরিচ্ছেদঃ ৪২. খিযির (আঃ) এর ফযীলত
৫৯৪৮। আমর ইবনুু মুহাম্মাদ আন-নাকিদ, ইসহাক ইবনু ইবরাহীম হানযালী, উবায়দুল্লাহ ইবনু সাঈদ ও মুহাম্মাদ ইবনু আবূ উমর মাক্কী (রহঃ) … সাঈদ ইবনু জুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নাওফ বিকালী বলেন যে, বনী ইসরাঈলের নাবী মূসা খিযির (আলাইহিস সালাম) এর সাথী মূসা নন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আল্লাহর দুশমন মিথ্যা বলেছে। আমি উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) থেকে শুনেছি, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন, মূসা (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরাঈলের মধ্যে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। তাকে প্রশ্ন করা হলো, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে বড় আলিম? তিনি উত্তর দিলেন, আমি সবচেয়ে বড় আলিম। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। কারণ মূসা (আলাইহিস সালাম) জ্ঞানকে আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করেননি।
অতঃপর আল্লাহর তার ওহী পাঠালেন যে, দু’সাগরের সঙ্গম স্থলে আমার বান্দাদের মধ্যে এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়েও অধিক জ্ঞানী। মূসা (আলাইহিস সালাম) প্রশ্ন করলেন আয় রব্ব! আমি কী করে তাঁকে পাব? তাঁকে বলা হলো, থলের ভেতর একটি মাছ নাও। মাছটি যেখানে হারিয়ে যাবে, সেখানেই তাঁকে পাবে। তারপর তিনি রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর খাদিম ইউশা ইবনু নূনও চললেন এবং মূসা (আলাইহিস সালাম) একটি মাছ থলিতে নিয়ে নিলেন।
তিনি ও তাঁর খাদিম চলতে চলতে একটি বিশাল পাথরের কাছে উপস্থিত হলেন। এখানে মূসা (আলাইহিস সালাম) ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁবু সাথীও ঘুমিয়ে পড়ল। মাছটি নড়েচড়ে থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়লো। এদিকে আল্লাহ তা’আলা পানির গতিরোধ করে দিলেন। এমনকি তা একটি খোপের মত হয়ে গেল এবং মাছটির জন্য একটি সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেল। মূসা (আলাইহিস সালাম) ও তার খাদিমের জন্য এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হল।
এরপর তাঁরা আবার দিন-রাতভর চললেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) এর সাথী খবরটি দিতে ভুলে গেলো। যখন সকাল হলো, মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর খাদিমকে বললেন, আমাদের নাশতা বের কর। আমরা তো এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আদেশকৃত (নির্ধারিত) স্থান অতিক্রম না করা পর্যন্ত তাঁরা ক্লান্ত হন নি। খাদিম বলল, আপনি কি জানেন, যখনই আমরা পাথরের উপর আশ্রয় নিয়েছিলাম, তখন আমি মাছের কথাটি ভুলে যাই, আর শয়তানই আমাকে আপনাকে বলার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে মাছটি সমুদ্রে তার নিজের পথ করে চলে গেল।
মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এ জায়গাটই তো আমরা খুজছি। অতঃপর উভয়েই নিজ নিজ পদচিহ্ন অনুসরণ করে পাথর পর্যন্ত পৌছলেন। সেখানে (পানির উপরে ভাসমান অবস্থায়) চাঁদরে আচ্ছাদিত একজন লোক দেখতে পেলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম দিলেন। খিযির বললেন, তোমার এ দেশে সালাম কোত্থেকে? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি মূসা। তিনি প্রশ্ন করলেন, বনী ইসরাঈলের মূসা? তিনি বললেন, হ্যাঁ। খিযির বললেন, আল্লাহ তার জ্ঞানের এমন এক ইলম আপনাকে দিয়েছেন যা আমি জানি না। আর আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের এমন এক ইলম আমাকে দিয়েছেন যা আপনি জানেন না।
মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি আপনার সাথে থাকতে চাই যেন আপনাকে প্রদত্ত জ্ঞান আমাকে দান করেন। খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেন না। আর কী করে ধৈর্য ধারণ করবেন, ঐ বিষয়ের উপর যা সম্পর্কে আপনি জ্ঞাত নন? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। আর আপনার কোন নির্দেশ আমি অমান্য করব না। খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আচ্ছা আপনি যদি আমার অনুসরণ করেন, তবে আমি নিজে কিছু উল্লেখ না করা পর্যন্ত কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আাচ্ছা।
খিযির এবং মূসা (আলাইহিস সালাম) উভয়ে সমুদ্র তীর ধরে চলতে লাগলেন। সম্মুখ দিয়ে একটি নৌকা আসল। তারা নৌকাওয়ালাকে তাঁদের তুলে নিতে বললেন। তারা খিযির (আলাইহিস সালাম) কে চিনে ফেললো, তাই দু’জনকেই বিনা ভাড়ায় তুলে নিল। এরপর খিযির (আলাইহিস সালাম) নৌকার একটি তক্তার দিকে লক্ষ্য করলেন এবং তা উঠিয়ে ফেললেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এরা তো এমন লোক যে, আমাদের বিনা ভাড়ায় নিয়েছে আর আপনি তাদের নৌকাটি ছিদ্র করে দিলেন যাতে নৌকা ডুবে যায়? আপনি তো সাংঘাতিক কাজ করেছেন! খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনাকে বলি নি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে সক্ষম হবেন না? মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনি আমার এ ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিবেন। আর আমাকে কঠিন অবস্থায় ফেলবেন না। তারপর নৌকার বাইরে এলেন এবং উভয়ে সমুদ্র তীর ধরে চলতে লাগলেন।
হঠাৎ একটি বালকের সম্মুখীন হলেন, যে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করছিল। খিযির (আলাইহিস সালাম) তার মাথাটি হাত দিয়ে ধরে ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁকে বললেন, আপনি কোন প্রাণের বিনিময় ছাড়াই একটা নিষ্পাপ প্রাণকে শেষ করে দিলেন? আপনি তো বড়ই খারাপ কাজ করলেন। খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমি কি আপনাকে বলি নি যে, আমার সাথে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হবেন না? রাবী বলেন, আর এ ভুল প্রথমটার চেয়ে আরো গুরুতর। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আচ্ছা, এরপর যদি আর কিছু সম্পর্কে প্রশ্ন করি, তাহলে আমাকে সাথে রাখবেন না। নিঃসন্দেহে আমার ব্যাপারে আপনার আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে যাবে।
এরপর উভয়েই চলতে লাগলেন এবং একটি গ্রামে পৌঁছে গ্রামবাসীর কাছে খাবার চাইলেন। তারা তাঁদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করলো। তারপর তাঁরা একটি দেয়াল পেলেন, যেটি ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে অর্থাৎ ঝুঁকে পড়েছে। খিজির (আলাইহিস সালাম) আপন হাতে সেটি ঠিক করে সোজা করে দিলেন। মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, আমরা এ সম্প্রদায়ের কাছে এলে তারা আমাদের মেহমানদারী করে নি এবং খেতে দেয় নি। আপনি চাইলে এদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন? খিযির (আলাইহিস সালাম) বললেন, এবার আমার ও আপনার মাঝে বিচ্ছেদের পালা।
এখন আমি আপনাকে এসবের তাৎপর্য বলছি, যে সবের উপর আপনি ধৈর্যধারণ করতে সক্ষম হন নি (সূরা কাহফঃ ৬০-৮২)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ মূসা (আলাইহিস সালাম) এর উপর রহম করুন, আমার আকাঙ্ক্ষা হয় যে, যদি তিনি ধৈর্যধারণ করতেন, তাহলে আমাদের কাছে তাঁদের আরো ঘটনাসমূহের বিবরণ দেওয়া হতো।
রাযী বলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ প্রথমটা মূসা (আলাইহিস সালাম) ভুলে যাওয়ার কারণে করেছিলেন। এও বলেছেন, একটি চড়ুই এসে নৌকার পার্শ্বে বসে সমুদ্রে চঞ্চু মারল। তখন খিযির (আলাইহিস সালাম) মূসাকে বলেন, আমার ও আপনার জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় এতই কম, যতখানি সমূদ্রের পানি থেকে এ চড়ুইটি কমিয়েছে।
সাঈদ জ্যুায়র বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) পড়তেনঃوَكَانَ أَمَامَهُمْ مَلِكٌ يَأْخُذُ كُلَّ سَفِينَةٍ صَالِحَةٍ غَصْبًا (এদের সম্মুখে একজন বাদশাহ ছিল, যে সমস্ত ভালো নৌকা কেড়ে নিতো) তিনি আরো পড়তেনঃوَأَمَّا الْغُلاَمُ فَكَانَ كَافِرًا (আর সে বালকটি ছিল কাফির)।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ সা‘ঈদ ইবনু যুবায়র (রহঃ)

তথ্যসূত্র

  1. মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), হাদিসঃ ১১১ []
  2. সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিস নম্বর- ৬৬৫৯ []
  3. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বর- ৫৯৪৯ []
  4. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বর- ৫৯৪৮ []
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন