“আল-আমীন” মুহাম্মদ – অতিরঞ্জন নাকি বাস্তবতা?

ভূমিকা

ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদের ওপর আসলেই যে ওহী নাজিল হয়েছিল, তা প্রমাণের উদ্দেশ্যে একটি খুব বিখ্যাত দাবী হচ্ছে, নবী মুহাম্মদকে নাকি সেই সময়ে আরবের জনগণ আল আমীন বা সত্যবাদী বলে ডাকতো। এই তথ্যটি দ্বারা ইসলামপন্থীগণ বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, নবী মুহাম্মদ মিথ্যা বলতেই পারেন না। মুহাম্মদের নৈতিক উচ্চতা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম প্রধান প্রমাণ হিসেবে তার উপর আরোপিত “আল-আমীন” বা “বিশ্বস্ত” খেতাবের কথা বারবার উচ্চারিত হয়। মুসলিম ঐতিহাসিক কিছু বর্ণনায় উল্লেখ করে দাবি করা হয়, নবী মুহাম্মদ ইসলাম প্রচার শুরুর পূর্বেই মক্কার সর্বসাধারণের নিকট এতটাই বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন যে তারা তাকে “আল-আমীন” নামে ডাকতো। এই বক্তব্যটি এতটাই বহুল প্রচারিত যে, মুসলিম শিশুরা ইসলামের প্রাথমিক পাঠেই তা শিখে থাকে।

কিন্তু ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ও যৌক্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই দাবি নানা প্রশ্ন ও অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ। এই প্রবন্ধে আলোচিত হবে কেন “আল-আমীন” খেতাবটিকে একটি পরবর্তীকালের ধর্মটিকে সত্য হিসেবে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত নির্মাণ হিসেবে বিবেচনা করা যুক্তিযুক্ত, এবং এই দাবির পেছনে কী ধরনের সামাজিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত থাকতে পারে।


“আল-আমীন” খেতাবের উৎস: প্রাথমিক ঐতিহাসিক তথ্য

একটি বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক দাবির মূল্যায়নের অন্যতম উপাদান হলো—তথ্যটির প্রাথমিক উৎস এবং সেই উৎস কতটা সেই সময়ের, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ। সেই তথ্যটি উল্লেখ যারা করেছেন, তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা পক্ষপাত সেখানে প্রভাব বিস্তার করেছে কিনা।

“আল-আমীন” খেতাবের যে বর্ণনাগুলো পাওয়া যায়, তা মূলত নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর ১০০ থেকে ২০০ বছর পর লেখা ইসলামি জীবনীগ্রন্থ বা সীরাহ (যেমন: ইবনে ইসহাকের জীবনী, যা ইবনে হিশাম পরিমার্জিত করেন) এবং কিছু তারিখ গ্রন্থে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সময়কালটি ইতিহাসবিদদের মতে একটি “পরিকাল্পিত পুনর্গঠন”-এর যুগ। এই সময়ের ইসলামী ইতিহাস রচয়িতারা নবীর ব্যক্তিত্বকে অলৌকিক, নৈতিকভাবে নিখুঁত এবং সামাজিকভাবে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলেই ইতিহাসের গবেষকগণ মনে করেন। কারণ পুরো ইসলামী সাম্রাজ্য পরিচালিত হয়েছে নবী মুহাম্মদের নামে, তাই তার নামটি সমস্ত কলঙ্ক থেকে মুক্ত করে তার নৈতিক চরিত্রকে সবচাইতে উত্তম হিসেবে প্রমাণ করাই তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে জরুরি ছিল। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, এই খেতাবের কোনো নিরপেক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ উল্লেখ পাওয়া যায় নাঃ

  • কাফেরদের লিখিত আরবি কবিতায়,
  • বাইজান্টাইন বা পারস্য পর্যবেক্ষকদের বিবরণে,
  • হিরাক্লিয়াস বা আল-মুকাওকাসের চিঠিপত্রে,
  • কোরআনের আয়াতে কিংবা সহিহ হাদিসে।

তাহলে প্রশ্ন জাগে—যদি মুহাম্মদ বাস্তবেই সমাজব্যাপী “আল-আমীন” নামে খ্যাত হতেন, তবে কেন এই উল্লেখগুলো সমসাময়িক বা বাইরের কোনো নিরপেক্ষ উৎসে নেই? এমনকি হাদিস গ্রন্থগুলোতেও কেন সেগুলো অনুপস্থিত?


হাদিসগ্রন্থে “আল-আমীন” শব্দের উপস্থিতি

খুব অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এত বহুল প্রচলিত একটি দাবীর সপক্ষে কোনো সহীহ হাদিসগ্রন্থে নবী মুহাম্মদের জন্য “আল-আমীন” উপাধির সরাসরি কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এই ধারণা এসেছে পরবর্তীকালের সীরাহ গ্রন্থগুলো থেকে, যেখানে প্রমাণের চেয়ে মুহাম্মদের চরিত্রকে গ্লোরিফাই করার মত বর্ণনা বেশি। কোরআনেও মুহাম্মদের জন্য এই খেতাবের কোন উল্লেখ নেই (যদিও ফেরেশতা জিবরাঈলের জন্য আছে)। তাই, “আল-আমীন” খেতাব মুহাম্মদের জন্য মক্কার জনগণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করত—এই ধারণাটি ঐতিহাসিকভাবে অসমর্থিত এবং হাদিসভিত্তিক নয়।হাদিস গ্রন্থগুলোতে “আল-আমীন” শব্দটি কেবলমাত্র একটি প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে, তা হলো ফেরেশতা জিবরাঈল সম্পর্কে।

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৬: মন-গলানো উপদেশমালা
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা) ও সবর (ধৈর্যধারণ) প্রসঙ্গে
৫৩০০-[৬] ইবনু মাস্’উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে লোক সকল! যে ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে আদেশ করেছি তাছাড়া এমন কোন জিনিসই নেই যা তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। আর যা থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করেছি তাছাড়া এমন কোন জিনিসই নেই যা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রূহুল আমীন আরেক বর্ণনায় আছে রূহুল কুদুস (জিবরীল আলাইহিস সালাম) আমার অন্তরে এ কথাটি ঢেলে দিয়েছেন যে, কোন দেহ তার (নির্ধারিত) রিযক পরিপূর্ণভাবে ভোগ না করা পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। সাবধান! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ধনসম্পদ উপার্জনে উত্তম নীতি অবলম্বন কর। কাঙিক্ষত রিযক পৌছার বিলম্বতা যেন তোমাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার খোঁজার পথে তা অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা নির্ধারিত রিযক আছে তা আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া অর্জন করা যায় না। (আল্লামা বাগাবী’র “শারহুস্ সুন্নাহ্” এবং বায়হাক্বী’র শুআবূল ঈমান বর্ণনা করেছেন। তবে (وَإنَّ رُوحَ اوقُدُسِ) “আর নিশ্চয় রূহুল কুদুস (জিবরীল আলায়হিস সালাম)” এ বাক্যটি বায়হাক্বী বর্ণনা করেননি)
সহীহ: শুআবূল ঈমান ১০৩৭৬, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব ১৭০০, সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৮৬৬, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৩৪৩৩২, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ২১৩৬, শারহুস্ সুন্নাহ ৪১১১, ৪১১২।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ‌ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ)

এই রেফারেন্সে “আল-আমীন” বলতে মুহাম্মদ নয়, জিবরাঈলকে বোঝানো হয়েছে।


তাহলে কোথা থেকে এই ধারণার উৎপত্তি?

সর্বপ্রথম ইবনে ইসহাক (৮ম শতক) কর্তৃক সংকলিত সীরাত রসূল আল্লাহ গ্রন্থ থেকেই এই ধারণা প্রথম জনপ্রিয় হয়। যদিও মূল বইটি সংরক্ষিত নেই, ইবনে হিশাম তার পরিমার্জিত সংস্করণে এটি সংযুক্ত করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে যে:

“Before his prophethood, he was known among his people as ‘Al-Amin’ because of his honesty and trustworthiness.”
— Ibn Hisham, Sirah (edited version of Ibn Ishaq)

তবে এটিও কোন সূত্র ছাড়া উপস্থাপিত এবং প্রায় দেড় শতাব্দী পরের সংকলন। ফলে একে হাদিস নয়, বরং একটি পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক পুনর্গঠন বা ধারাবিবরণী হিসেবে গণ্য করা হয়। আসুন আল আমীন দাবীর সপক্ষে একটি দলিল দেখি এবং তার প্রাথমিক তথ্যসূত্রটিও একইসাথে দেখে নিই, [1]

আল-আমীন

সামাজিক বাস্তবতা ও ব্যাপক বিরোধিতা

ইসলাম প্রচারের শুরুতেই নবী মুহাম্মদ যে মাত্রায় মক্কাবাসীদের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা শুধু ধর্মীয় মতবিরোধ নয়—একটি পূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রত্যাখ্যানের চিত্র তুলে ধরে। এমনকি তার নিকট আত্মীয়রাও, যেমন চাচা আবু লাহাব, তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। যদি মুহাম্মদ পূর্বে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে থাকতেন, তাহলে এমন সর্বব্যাপী বিরোধিতা অযৌক্তিক হতো। কারণ সাধারণভাবে মানুষ এমন কারো বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে না, যাকে তারা দীর্ঘদিন ধরে নৈতিকভাবে শ্রদ্ধা করে এসেছে।

বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনায় দাবি করা হয়, মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের বার্তার সত্যতা বুঝেও কেবল তাদের গোত্রীয় মর্যাদা ও পুরনো ধর্মবিশ্বাস রক্ষার স্বার্থে তাকে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু এই দাবিটি বাস্তবিকভাবে অসঙ্গত। কোন সমাজই সচেতনভাবে এমন একজন সত্যবাদী ও ধার্মিক মানুষকে “পাগল”, “মিথ্যাবাদী” কিংবা “কাব্যের যাদুকর” বলে আক্রমণ করে না, যদি না তারা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে তার দাবিগুলো বিভ্রান্তিকর, ক্ষতিকর বা অসত্য। শুধু গোত্রীয় গৌরব বাঁচাতে সত্য জেনে কারো বিরোধিতা করাটা খুবই অবাস্তব এবং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতো।

এমনকি কোরআনের নিজস্ব বর্ণনায়ও (সূরা সাদ ৩৮:৫) দেখা যায়, মুহাম্মদের বার্তাকে মক্কার নেতৃত্ব হাস্যকর ও অদ্ভুত বলে আখ্যায়িত করেছে—তারা বলেছে, “এই লোক কি আমাদের দেবতাগুলোকে এক দেবতায় পরিণত করেছে?” এ বক্তব্য স্পষ্ট করে যে, মুহাম্মদের তাওহিদের দাবিকে তারা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য বা ন্যায্য বলে মনে করেনি। অর্থাৎ, মুহাম্মদকে তারা ‘আল-আমীন’ বা সত্যনিষ্ঠ বলে বিশ্বাস করত—এমন ধারণা তাদের আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাস্তবতা বলছে, তারা মুহাম্মদকে মিথ্যাবাদী, বিভ্রান্ত অথবা বিপজ্জনক ভাবতেই বাধ্য হয়েছিল। নতুবা জেনেশুনে বুঝেশুনে তারা সকলে জাহান্নামে যেতে চাচ্ছে শুধুমাত্র বংশমর্যাদার কথা ভেবে, পুরনো পৌত্তলিক ধর্মের কথা ভেবে, এমনটি হওয়া কখনওই সম্ভব নয়। কোন সুস্থ মাথার মানুষই নিজের ধর্মকে মিথ্যা জেনেও, এই মিথ্যা ধর্ম পালনের ফলে অনন্তকাল শাস্তির সম্মুখীন হবে তা সত্য জেনেও অনর্থক শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করবে, এমনটি হওয়া খুবই অস্বাভাবিক।


খণ্ডিত বা সীমিত খ্যাতি ≠ সর্বজনগ্রাহ্য খেতাব

ধরুন, একজন যুবক তার এলাকার চায়ের দোকানে বিজ্ঞান, ইতিহাস বা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করে, ফলে কিছু মানুষ মজা করে বা সম্মান দিয়ে তাকে “প্রফেসর” বা “বিজ্ঞানী” বলে ডাকতে শুরু করে। পরে সে যদি বিদেশে গিয়ে দাবি করে—”বাংলাদেশে আমি একজন বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত ছিলাম”, তাহলে সেটা হবে অতিরঞ্জিত এবং বিভ্রান্তিকর দাবি।

একইভাবে, মুহাম্মদ যদি কুরাইশদের কিছু পরিচিত মানুষ বা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কিছু ব্যবসায়িক লেনদেনে বিশ্বস্ত ছিলেন—তাতে প্রমাণিত হয় না যে, তিনি মক্কার প্রতিটি শ্রেণি ও গোষ্ঠীর নিকট “আল-আমীন” নামে পরিচিত ছিলেন।


কোরআন ও হাদিসে নৈতিক অসঙ্গতি

কোরআন ও হাদিসে এমন কিছু নিয়ম অনুমোদন করা হয়েছে যা সত্যবাদিতা ও নৈতিকতা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন:

ক. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বৈধতা

হযরত মুহাম্মদ ছিলেন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী মিথ্যুক। কিন্তু খুব কৌশলে তিনি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায় আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজের অপরাধকে আল্লাহর নির্দেশ বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। যার একদম সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় কোরআনে এবং সহিহ হাদিসেই। নিচের হাদিসটি পড়ুন, এখানে বলা হচ্ছে, কোন বিষয়ে কেউ যদি প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু পরে যদি তার বিপরীতটি তার কাছে উত্তম মনে হয়, তাহলে প্রতিশ্রুতির কাফফারা দিয়ে বিপরীত কাজটিই করা যাবে। এতো সরাসরি মিথ্যাচার, এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। কাফফারা দিলেই কি সব মাফ হয়ে যায়?[2]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
৯৩/ আহ্‌কাম
পরিচ্ছেদঃ ৯৩/৬. যে ব্যক্তি নেতৃত্ব চায়, তা তার উপরই ন্যস্ত করা হয়।
৭১৪৭. ‘আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ হে ‘আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ! নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা, যদি চাওয়ার পর তোমাকে তা দেয়া হয়, তাহলে তার সকল দায়িত্বভার তোমার উপরই অর্পিত হবে। আর যদি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে তা দেয়া হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সহযোগিতা করা হবে। আর কোন বিষয়ে কসম করার পর তার বিপরীত দিকটিকে যদি উত্তম বলে মনে কর, তাহলে উত্তম কাজটিই করবে আর তোমার কসমের কাফ্‌ফারা আদায় করে দিবে। (৬৬২২) (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৪৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আব্দুর রহমান ইবন সামুরা (রাঃ)

শুধু তাই নয়, নবী নিজেও এই কাজটি করতেন। কাউকে কোন প্রতিশ্রুতি দিলে, তিনি পরে যদি মনে করতেন প্রতিশ্রুতির বিপরীত কাজটিই উত্তম বা লাভজনক, তিনি কিছু কাফফারা দিয়ে বিপরীত কাজটি, অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেন [3] [4]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৯/ যবাহ করা, শিকার করা
পরিচ্ছেদঃ ২১৯২. মুরগীর গোশত
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৫১২১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫৫১৭ – ৫৫১৮
৫১২১। ইয়াহইয়া (রহঃ) … আবূ মূসা আশ-আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মুরগীর গোশত খেতে দেখেছি।
আবূ মা’মার (রহঃ) … যাহদাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) এর কাছে ছিলাম। জারমের এ গোত্র ও আমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ছিল। আমাদের কাছে খাবার আনা ছিল। তাতে ছিল মোরগের গোশত। দলের মধ্যে লালচে রংয়ের এক ব্যাক্তি বসা ছিল। সে খাবারের দিকে অগ্রসর হল। আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) তখন বলেনঃ এগিয়ে এসো, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মোরগের গোশত খেতে দেখেছি। সে বললঃ আমি এটিকে এমন কিছু খেতে দেখেছি, যে কারণে তা খেতে আমি অপছন্দ করি। তখন আমি কসম করেছি যে, আমি তা খাব না। তিনি বললেনঃ এগিয়ে এসো, আমি তোমাকে জানাবো। কিংবা তিনি বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে হাদীস বর্ননা করবো।
আমি আশআরীদের এক দল সহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলাম। এরপর আমি তার সামনে এসে উপস্থিত হই যখন তিনি ছিলেন রাগান্বিত। তখন তিনি বণ্টন করছিলেন সাদাকার কিছু জানোয়ার। আমরা তার কাছে সাওয়ারী চাইলাম। তখন তিনি কসম করে বললেনঃ আমাদের কোন সাওসারী দিবেন না এবং বললেনঃ তোমাদের সাওয়ারীর জন্য দিতে পারি এমন কোন জন্তু আমার কাছে নেই। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গনীমতের কিছু উট আনা হল। তিনি বললেনঃ আশআরীগণ কোথায়? আশআরীগণ কোথায়?
আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) বলেনঃ এরপর তিনি আমাদের সাদাচুল বিশিষ্ট বলিষ্ট পাঁচটি উট দিলেন। আমরা কিছু দুরে গিয়ে অবস্থান করলাম। তখন আমি আমার সঙ্গীদের বললাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কসমের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আল্লাহর কসম যদি আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তার কসমের ব্যাপারে গাফিল রাখি, তাহলে আমরা কোনদিন সফলকাম হবো না। কাজেই আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ফিরে গিয়ে তাকে বলা হলঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আপনার নিকট সাওয়ায়ী চেয়েছিলাম তখন আপনি আমাদের সাওসারী দেবেন না বলে কসম করেছিলেন। আমাদের মনে হয় আপনি আপনার কসমের কথা ভুলে গিয়েছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ নিজেই তো আমাদের সাওয়ারীর জানোয়ার দিয়েছেন। আল্লাহর কসম, আমি যখন কোন ব্যাপারে কসম করি এরপর কসমের বিপরীত কাজ তার চাইতে মঙ্গলজনক মনে করি, তখন আমি মঙ্গলজনক কাজটিই করি এবং কাফফারা দিয়ে হালাল হয়ে যাই।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ মূসা আল- আশ’আরী (রাঃ)

আল-আমীন 1

এবারে আসুন দেখি, আবু বকরও আল্লাহ তথা মুহাম্মদের ঐ শপথ ভঙ্গের অনুমতির আয়াত নাজিলের পরে শপথ ভঙ্গ করা শুরু করে [5]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৭১/ শপথ ও মানত
পরিচ্ছেদঃ আল্লাহর বাণীঃ তোমাদের নিরর্থক শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে দায়ী করবেন না, কিন্তু যে সব শপথ তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে দৃঢ় কর … তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা পর্যন্ত
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৬১৬৮, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৬৬২১
৬১৬৮। মুহাম্মাদ ইবনু মূকাতিল আবূল হাসান (রহঃ) … আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, আবূ বকর (রাঃ) কখনও কসম ভঙ্গ করেননি, যতক্ষন না আল্লাহ তা’আলা কসমের কাফফারা সংক্রান্ত আয়াত নাযিল করেন। তিনি বলতেন আমি যেকোন ব্যাপারে কসম করি। এরপর যদি এর চেয়ে উত্তমটি দেখতে পাই তবে উত্তমটিই করি এবং আমার কসম ভঙ্গের জন্য কাফফারা আদায় করে দেই।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আয়িশা বিনত আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ)


এবারে আসুন দেখি, কোরআনে আল্লাহ পাকও মুমিনদের শপথ ভঙ্গ বা ওয়াদা ভঙ্গের অনুমতির দিয়ে আয়াত নাজিল করে মুমিনদের শপথ বা ওয়াদা ভঙ্গের অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন[6] [7]

আল্লাহ তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু তোমাদের অন্তরের সংকল্পের জন্য দায়ী করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।
— Taisirul Quran
তোমাদের নিরর্থক শপথসমূহের জন্য তোমাদেরকে আল্লাহ পাকড়াও করবেননা, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ সব শপথ সম্বন্ধে ধরবেন যেগুলি তোমাদের মনের সংকল্প অনুসারে সাধিত হয়েছে; এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, ধৈর্যশীল।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য পাকড়াও করবেন না। কিন্তু পাকড়াও করবেন যা তোমাদের অন্তরসমূহ অর্জন করেছে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, সহনশীল।
— Rawai Al-bayan
তোমাদের অনর্থক শপথের [১] আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না; কিন্তু তিনি সেসব কসমের ব্যাপারে পাকড়াও করবেন, তোমাদের অন্তর যা সংকল্প করে অর্জন করেছে। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাপরায়ণ, পরম সহিষ্ণু।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু বুঝে সুঝে যে সব শপথ তোমরা কর তার জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। (এ পাকড়াও থেকে অব্যাহতির) কাফফারা হল দশ জন মিসকিনকে মধ্যম মানের খাদ্যদান যা তোমরা তোমাদের স্ত্রী পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদেরকে বস্ত্রদান অথবা একজন ক্রীতদাস মুক্তকরণ। আর এগুলো করার যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন রোযা পালন। এগুলো হল তোমাদের শপথের কাফফারা যখন তোমরা শপথ কর। তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করবে। আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের জন্য বিষদভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।
— Taisirul Quran
আল্লাহ তোমাদের অর্থহীন কসমের জন্য তোমাদের পাকড়াও করবেননা, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ কসমসমূহের জন্য পাকড়া করবেন যেগুলিকে তোমরা (ভবিষ্যত বিষয়ের প্রতি) দৃঢ় কর, সুতরাং ওর কাফফারা হচ্ছে দশজন অভাবগ্রস্তকে মধ্যম ধরণের খাদ্য প্রদান করা, যা তোমরা নিজ পরিবারের লোকদেরকে খাইয়ে থাক, কিংবা তাদেরকে পরিধেয় বস্ত্র দান করা (মধ্যম ধরণের), কিংবা একজন গোলাম কিংবা বাঁদী মুক্ত করা। আর যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখেনা সে (একাধারে) তিন দিন সিয়াম পালন করবে; এটা তোমাদের কসমসমূহের কাফ্ফারা যখন তোমরা কসম কর এবং অতঃপর ভঙ্গ কর এবং নিজেদের কসমসমূহকে রক্ষা করবে। এই রূপেই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় বিধানসমূহ বর্ণনা করেন যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যাপারে, কিন্তু যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করেন। সুতরাং এর কাফফারা হল দশ জন মিসকীনকে খাবার দান করা, মধ্যম ধরনের খাবার, যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস-দাসী মুক্ত করা। অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটা তোমাদের কসমের কাফ্ফারা, যদি তোমরা কসম কর, আর তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত কর। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।
— Rawai Al-bayan
তোমাদের বৃথা শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন না, কিন্তু যেসব শপথ তোমরা ইচ্ছে করে কর সেগুলোর জন্য তিনি তোমাদেরকে পাকড়াও করবেন। তারপর এর কাফফারা দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্য দান, যা তোমরা তোমাদের পরিজনদেরকে খেতে দাও, বা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি [১]। অতঃপর যার সামর্থ নেই তার জন্য তিন দিন সিয়াম পালন [২]। তোমরা শপথ করলে এটাই তোমাদের শপথের কাফফারা। আর তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করো [৩]। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria


যুদ্ধের সময় ধোঁকা দেয়ার বৈধতা

নবী মুহাম্মদ বলেছেন, যুদ্ধ হচ্ছে ধোঁকার জায়গা। তাই যুদ্ধে ধোঁকাবাজী এবং প্রতারণার মাধ্যমে কাফেরদের পরাজিত করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতারণা কিংবা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে শত্রুকে যুদ্ধে পরাজিত করা অত্যন্ত নোংরা কাজ।

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৩৩। জিহাদ ও সফর
পরিচ্ছেদঃ ৫. যুদ্ধের মধ্যে শক্রকে ধোঁকা দেয়ার বৈধতা
হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৪৪৩১, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৩৯
৪৪৩১-(১৭/১৭৩৯) আলী ইবনু হুজুর সাদী, আমর আন্‌ নাকিদ ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ….. জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যুদ্ধ কৌশল ও ছলনারই নাম। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৩৮৯, ইসলামিক সেন্টার ৪৩৮৯)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
৩৩। জিহাদ ও সফর
পরিচ্ছেদঃ ৫. যুদ্ধের মধ্যে শক্রকে ধোঁকা দেয়ার বৈধতা
হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৪৪৩২, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৭৪০
৪৪৩২-(১৮/১৭৪০) মুহাম্মাদ ইবনু আবদুর রহমান ইবনু সাহম (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ্ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যুদ্ধ কুটকৌশলেরই নাম। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৪৩৯০, ইসলামিক সেন্টার ৪৩৯০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

এই হাদিসের ব্যাখ্যা আসুন নসরুল বারী থেকে পড়ে নিই, [8]

নবী 76

লাল চাদর চুরির অভিযোগ

কিছু ঐতিহাসিক দলিল ও হাদিসে এমন অভিযোগ পাওয়া যায় যেখানে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে বদর যুদ্ধের গনিমতের মাল থেকে একটি নকশী করা লাল চাদর চুরির সন্দেহ খোদ সাহাবীদের পক্ষ থেকেই প্রচার হয়েছে। যদিও অভিযোগটি প্রমাণিত নয়, কারণ এরপরেই নবীর ফেইক আইডি আল্লাহ নবীর পক্ষে উকালতি করে আয়াত নাজিল করে, এবং নবী যে আসলে চোর না তা সাহাবীদের জানিয়ে দেয়। তবুও এই অভিযোগের অস্তিত্ব কিছু মূল্যবান প্রশ্ন উত্থাপন করে যা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রশ্ন হচ্ছে, খোদ নবীর সাহাবীগণের মধ্যে এরকম একটি অভিযোগ কীভাবে প্রচার পেলো? যদি কাফেরদের মধ্যে নবী আল আমীন বা সত্যাবাদী বা বিশ্বস্ত বলে পরিচিত হয়ে থাকেন, তাহলে খোদ নবীর উম্মতগণ কেন নবীর বিরুদ্ধে এরকম একটি অভিযোগ করবেন? আসুন অভিযোগটি দেখে নেয়া যাক।

অভিযোগের প্রেক্ষাপট

আসুন শুরুতেই এই সম্পর্কিত আয়াতটি পড়ে নেয়া যাক, [9]

কোন নাবী খিয়ানাত করতে পারে না, যে ব্যক্তি খিয়ানাত করবে, সে খিয়ানাতকৃত বস্তুসহ ক্বিয়ামাতের দিন উপস্থিত হবে, অতঃপর প্রত্যেককে যা সে অর্জন করেছে তা পুরোপুরি দেয়া হবে, কারও প্রতি কোন প্রকার যুলম করা হবে না।
— Taisirul Quran
আর কোন নাবীর পক্ষে কোন বিষয় গোপন করা শোভনীয় নয়; এবং যে কেহ গোপন করবে তাহলে সে যা গোপন করেছে তা উত্থান দিনে আনয়ন করা হবে; অনন্তর প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করেছে তা পূর্ণরূপে প্রদত্ত হবে এবং তারা নির্যাতিত হবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর কোন নবীর জন্য উচিত নয় যে, সে খিয়ানত করবে। আর যে খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে তা নিয়ে যা সে খিয়ানত করেছে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে এবং তাদেরকে যুলম করা হবে না।
— Rawai Al-bayan
আর কোনো নবী ‘গলুল’ [১] (অন্যায়ভাবে কোনো বস্তু গোপন) করবে, এটা অসম্ভব। এবং কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কেয়ামতের দিন সে তা সাথে নিয়ে আসবে [২]। তারপর প্রত্যেককে যা সে অর্জন করেছে তা পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে। তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না [৩]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এবারে আসুন একটি হাদিস পড়ি,

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
২৫/ কুরআনের কিরআত ও পাঠের নিয়ম
পরিচ্ছেদঃ কুরআনের কিরআত ও পাঠের নিয়ম
৩৯৭১ ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’’আর নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানাত করবেন।’’ এই আয়াত বদরের যুদ্ধের সময় অবতীর্ণ হয়েছে, বদরের যুদ্ধের সময় একটা লাল চাঁদর হারিয়ে গেলে কতিপয় লোক বলাবলি করলো, সম্ভবত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিয়েছেন। তখন আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ ’’আর নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানাত করবেন। অথচ যে ব্যক্তি খিয়ানাত করবে সে খিয়ানাতকৃত বস্তুসহ কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কৃতকর্মের পূর্ণ বিনিময় পাবে এবং তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবে না।’’ (সূরা আল-ইমরানঃ ১৬১)। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, ’ইয়াগুলু’ শব্দের ইয়া-তে যবর হবে।[1]
সহীহ।
[1]. তিরমিযী। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ এই হাদসিটি হাসান গরীব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

এবারে আসুন তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে জালালাইন এবং তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে এই আয়াতটির তাফসীর থেকে একটি অংশ দেখে নিই, [10] [11] [12]

আল-আমীন 3
আল-আমীন 5
আল-আমীন 7

এ থেকে আমরা জানতে পারলাম, বদর যুদ্ধের পর লুটের মাল ভাগ-বন্টন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং নবীর বিরুদ্ধে চাদর চুরির অভিযোগ তোলা হয়। যদিও ইসলামী বর্ণনায় শেষ পর্যন্ত নবীকে নির্দোষ প্রমাণিত করা হয়, কিন্তু এই অভিযোগটি নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দেয়, যদি তিনি সততার সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলেন বলে সেই সময়ের কাফেরদের কাছে আল আমীন বলে গণ্য হয়ে থাকেন, তবে কেন খোদ নবীর সাহাবীদের পক্ষ থেকেই এমন অভিযোগ উঠল? সাধারণভাবে, একজন অত্যন্ত সৎ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে চুরি বা অনৈতিক আচরণের অভিযোগ সহজে উঠে আসে না, কারণ তার চারপাশের মানুষ তার সততায় সম্পূর্ণ আস্থাশীল থাকে। এই অভিযোগের অর্থ দাঁড়ায় যে, কমপক্ষে কিছু মানুষের মনে তখনও তার সততা নিয়ে সন্দেহ ছিল। এ প্রশ্নটি ইতিহাসের পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করে যে, আসলেই কি নবীর সততা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতো না? দেখা যাচ্ছে, তার সততা নিয়ে খোদ সাহাবীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতো। এই বিষয়ে সম্পূর্ণ লেখাটি এখান থেকে পড়তে পারেন।


অভিযোগ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইতিহাসের পাঠকরা জানেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও কখনো কখনো অবিশ্বাস বা হিংসা থেকে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। তবে, নবীর জীবন ও কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। একজন সত্যিকারের ন্যায়পরায়ণ ও সদাচারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের মানে কি তার চারপাশের মানুষদের আস্থার ঘাটতি, নাকি এটি কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক কৌশলের ফল? আমি কোন সিদ্ধান্তে যাচ্ছি না। নবী লাল চাদর চুরি করেছিলেন, এরকমও বলছি না। কারণ সেটি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা এই সময়ে আর সম্ভব না। তবে এটি পরিষ্কার যে, তার বিরুদ্ধে খোদ সাহাবীগণই চুরির অভিযোগ তুলেছিল। এবং একইসাথে, নবী মুহাম্মদের একটি লাল চাদর থাকার বিবরণ পাওয়া যায়, মৃত্যুর সময়ও যেই লাল চাদরটি তার কবরে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেন দিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেটি গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে এ উপরের হাদিসগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নবীর সম্ভবত খুবই প্রিয় একটি লাল নকশি করা চাদর ছিল। যার কারণে হয়তো মৃত্যুর পরেও সেই চাদরটি তার কবরে দিয়ে দেয়া হয়েছিল! যদিও এত বছর পরে আর এই সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না, কিন্তু অনেক প্রশ্নই জাগে,

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
১২/ জানাযা সম্পর্কিত
পরিচ্ছেদঃ ২৪. কবরে চাদর ব্যবহার
২১১৩। ইয়াহয়া ইবনু ইয়াহহিয়া, আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা ও মুহাম্মদ ইবনুল মুসান্না (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরে লাল একটি চাঁদর দেয়া হয়েছিল।
ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেন, রাবী আবূ জামরার নাম নাসর ইবনু ইমরান। আর রাবী আবূ তায়্যাহ এর নাম হল ইয়াযিদ ইবনু হুমায়দ। তাঁরা দু-জন সারাখ্‌স এ মারা যান।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

সুনান আন-নাসায়ী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২১/ জানাজা
পরিচ্ছেদঃ ৮৮/ কবরে কাপড় রাখা
২০১৬। ইসমাঈল ইবনু মাসউদ (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যখন দাফন করা হয়েছিল, তখন তার নীচে একটি লাল চাদরের টুকরা রাখা হয়েছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)

মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৫: জানাযা
পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ – মৃত ব্যক্তির দাফনের বর্ণনা
১৬৯৪-[২] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরে একটি লাল চাদর বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। (মুসলিম)[1]
[1] সহীহ : মুসলিম ৯৬৭, আত্ তিরমিযী ১০৪৮, নাসায়ী ২০১২, ইবনু আবী শায়বাহ্ ১১৭৫৪, আহমাদ ৩৩৪১, ইবনু হিব্বান ৬৬৩১।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)


ঐতিহাসিক পুনর্গঠনের উদ্দেশ্য

“আল-আমীন” খেতাব নবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নৈতিক আখ্যান নির্মাণের অংশ। ইতিহাসের সকল ধর্মীয় নেতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অনুসারীরা তাদের নেতার শৈশব, কৈশোর, এবং নবুওয়তের পূর্বজীবনকে পবিত্র, অলৌকিক এবং মহান করে তুলেছেন।

যেমন:

  • গৌতম বুদ্ধ জন্মের সময় হাঁটতে পেরেছিলেন—এই গল্প পরে সংযোজন,
  • যিশুর মাতার কুমারীত্ব ও যিশুর অলৌকিক জন্ম,
  • কৃষ্ণের জন্মেই রাক্ষস হত্যা করার উপাখ্যান।

ইসলামেও এমন অলৌকিক এবং অতিনায়কতান্ত্রিক চরিত্র নির্মাণের একটি অনিবার্য ধারার অংশ হিসেবে মুহাম্মদকে “আল-আমীন” নামে স্থাপন করা হয়েছে।


উপসংহার

“আল-আমীন” খেতাবের ইতিহাস-ভিত্তিক প্রমাণ অপ্রতুল, কোরআনে সরাসরি অনুপস্থিত, হাদিসে পরবর্তীকালের সংযোজন, এবং সামাজিক বাস্তবতা ও নবীর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই খেতাবটি সম্ভবত পরবর্তী মুসলিম সমাজের একটি ধর্মীয় কল্পনাচিত্র যা নবীর চরিত্রকে অলৌকিক ও সর্বজনগ্রাহ্য রূপ দেয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। একজন ঐতিহাসিক গবেষক বা নিরপেক্ষ বিশ্লেষক হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো এই ধরনের দাবির মূল উৎস, প্রাসঙ্গিকতা এবং সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং ধর্মীয় আখ্যান ও ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে পৃথক করে দেখা।



তথ্যসূত্রঃ
  1. নবীদের কাহিনী-৩, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), আসাদুল্লাহ আল গালিব, হাদিছ ফাউন্ডেশন প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৭৫ ↩︎
  2. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিসঃ ৭১৪৭ ↩︎
  3. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৫১২১ ↩︎
  4. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৮১, ১৮২ ↩︎
  5. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৬১৬৮ ↩︎
  6. সূরা বাকারা, আয়াত ২২৫ ↩︎
  7. সূরা মায়িদা, আয়াত ৮৯ ↩︎
  8. সহজ নসরুল বারী, শরহে সহীহ বুখারী, আরবি-বাংলা, সহজ তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, হযরত মাওলানা উসমান গনী, আল কাউসার প্রকাশনী, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৭, ২২৮ ↩︎
  9. সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৬১ ↩︎
  10. তাফসীরে মাযহারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫২ ↩︎
  11. তাফসীরে জালালাইন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩৮ ↩︎
  12. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৫১-৬৫২ ↩︎