04.সন্তানের চেহারা কার মত হবে

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানের সাদৃশ্য নির্ধারণের বিষয়টি জেনেটিক্সের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে বীর্যপাতের ক্রমধারা বা সময়ের সাথে সন্তানের সাদৃশ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। আধুনিক জেনেটিক গবেষণা অনুসারে, সন্তানের চেহারা এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রধানত বাবা-মায়ের ডিএনএ বা জেনেটিক উপাদান দ্বারা নির্ধারিত হয়। মানুষের শরীরে প্রতিটি কোষে ডিএনএ থাকে, যা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী থাকে। যখন একটি শুক্রাণু একটি ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়, তখন উভয়ের থেকে ডিএনএ মিলে সন্তানের জিনোম তৈরি করে। এই জিনোমে ৫০ শতাংশ আসে পিতার থেকে এবং ৫০ শতাংশ মায়ের থেকে। সাদৃশ্য নির্ভর করে সেই সব জিনের উপর যা সন্তানের মধ্যে ক্রিয়াশীল হয়। ক্রিয়াশীল বা ডমিন্যান্ট জিনের বৈশিষ্ট্যগুলো সন্তানের মধ্যে প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি পিতার একটি ডমিন্যান্ট জিন থাকে এবং মাতার একটি রিসেসিভ জিন থাকে, তাহলে পিতার বৈশিষ্ট্য বেশি স্পষ্ট হতে পারে। তবে এটি সব ক্ষেত্রে নির্ধারিত নয়, কারণ ডিএনএর মিশ্রণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং বিভিন্ন ধরনের জিনের প্রভাব একত্রে সন্তানের বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ধারণ করে।

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে সন্তানের জিনোম সম্পূর্ণভাবে সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে এবং বীর্যপাতের সময় বা ক্রমধারাড় সাথে কোনভাবেই এটি সম্পর্কিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, শুক্রাণুর এককোষী ডিএনএ এবং ডিম্বাণুর এককোষী ডিএনএ সমানভাবে অংশগ্রহণ করে সন্তানের জিনোম তৈরি করতে, তাই এর মধ্যে পুরুষ বা নারীর প্রথমে অবদান রাখা অথবা বীর্যপাতের সময়ের সাথে সন্তানের সাদৃশ্য নির্ধারণের কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। সন্তানের জেনেটিক সাদৃশ্য নির্ধারণে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, যা হলো ক্রোমোজোমের বিন্যাস। মানুষের প্রতিটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে, যার মধ্যে ২২ জোড়া অটোসোমাল ক্রোমোজোম এবং ১ জোড়া লিঙ্গ ক্রোমোজোম। পিতা-মাতার থেকে সমানভাবে প্রাপ্ত এই ক্রোমোজোমের উপর নির্ভর করে সন্তানের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত Y বা X ক্রোমোজোম সন্তানের ছেলে বা মেয়ে হওয়ার জন্য দায়ী।

জেনেটিক্সের পাশাপাশি পরিবেশগত কারণও সন্তানের কিছু বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং মাতৃগর্ভের অবস্থান ইত্যাদি সন্তানের শারীরিক গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই কারণগুলোও সন্তানের মুখাবয়ব বা বংশগত সাদৃশ্যের উপর খুব কম প্রভাব ফেলে। আধুনিক বিজ্ঞান এই ধারণা একেবারেই বাতিল করে যে, সন্তান তার পিতার সাদৃশ্য পাবে যদি পিতার বীর্য প্রথমে স্খলিত হয়। বরং এটি একটি পুরনো বিশ্বাস যা বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে অবাস্তব রূপকথার গল্প।

আরও উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, একজনার শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে একই গর্ভে থাকা সত্ত্বেও তাদের চেহারা এবং ব্যক্তিত্ব আলাদা হতে পারে, কারণ তাদের জেনেটিক উপাদান আলাদা। এভাবেই বোঝা যায় যে সাদৃশ্য নির্ধারণ একটি জেনেটিক প্রক্রিয়া, এবং এটি নির্ভর করে ক্রোমোজোম, ডিএনএ এবং জিনের সংমিশ্রণ ও ক্রিয়াকলাপের উপর। সুতরাং, বৈজ্ঞানিকভাবে বীর্যপাতের সময় বা ক্রমধারা সন্তানের সাদৃশ্য নির্ধারণ করে না, বরং সন্তানের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে জেনেটিক ফ্যাক্টর, যা বাবা এবং মা উভয়ের থেকেই সমানভাবে আসে। আসুন হাদিস থেকে জেনে নিই, সন্তান কার মত হয়, ইসলাম অনুসারে সেটি কীসের ওপর নির্ভর করছে! [1]

সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫০/ আম্বিয়া কিরাম (আঃ)
পরিচ্ছদঃ ২০০০. আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের সৃষ্টি। আল্লাহর বাণীঃ স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফিরিশতাগণকে বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করছি। (২ঃ ৩০) صَلْصَالٌ বালি মিশ্রিত শুকনো মাটি যা শব্দ করে যেমন আগুনে পোড়া মাটি শব্দ করে। আরো বলা হয়, তাহল দুর্ঘন্ধযুক্ত মাটি। আরবরা এ দিয়ে صَلَّ এর অর্থ নিয়ে থাকে। যেমন তারা দরজা বন্ধ করার শব্দের ক্ষেত্রে صَرَّ الْبَابُ এবং صَرْصَرَ শব্দদ্বয় ব্যবহার করে থাকে। অনুরূপ كَبْكَبْتُهُ এর অর্থ كَبَبْتُهُ নিয়ে থাকে। فَمَرَّتْ بِهِ তার গর্ভ স্থিতি লাভ করল এবং এর মিয়াদ পূর্ণ করল। أَنْ لاَ تَسْجُدَ এর لاَ শব্দটি অতিরিক্ত। أَنْ تَسْجُدَ অর্থ সিজদা করতে হবে। মহান আল্লাহর বাণীঃ এবং স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফিরিশতাগণকে বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করছি। (২ঃ ৩০) ইবন আব্বাস (রাঃ) বললেন, لَمَّا عَلَيْهَا حَافِظٌ এর অর্থ কিন্তু তার উপর রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক। فِي كَبَدٍ সৃষ্টিগত ক্লেশের মধ্যে وَرِيَاشًا এর অর্থ সম্পদ। ইবন আব্বাস (রাঃ) ছাড়া অন্যরা বলেন, الرِّيَاشُ এবং الرِّيشُ উভয়ের একই অর্থ। আর তা হল পরিচ্ছেদের বায্যিক দিক। مَا تُمْنُونَ স্ত্রীলোকের জরায়ুতে পতিত বীর্য। আর মুজাহিদ (রহঃ) আল্লাহর বাণীঃ إِنَّهُ عَلَى رَجْعِهِ لَقَادِرٌ এর অর্থ বলেছেন, পুরুষের লিঙ্গ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ সক্ষম। আল্লাহ সকল বস্তুকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন। আকাশেরেও জোড়া আছে, কিন্তু আল্লাহ বেজোড়। فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ উত্তম আকৃতিতে। যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত সকলেই হীনতাপ্রাপ্তদের হীনতমে। خُسْرٍ পথভ্রষ্ট। এরপর আল্লাহ استثناء করে আল্লাহ বলেন, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত। لاَزِبٍ অর্থ আঠালো। نُنْشِئَكُمْ অর্থ যে কোন আকৃতিতে আমি ইচ্ছা করি তোমাদেরকে সৃষ্টি করব। نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ অর্থ আমরা প্রশংসার সাথে আপনার মহিমা বর্ণনা করব। আর আবুল আলীয়া (রহঃ) বলেন, অতঃপর আদম (আঃ) যা শিক্ষা করলেন তা হল তার উক্তি “হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নফসের উপর যুলম করেছি।“ তিনি আরো বলেন, فَأَزَلَّهُمَا শয়তান তাঁদের পদস্খলিত করল। يَتَسَنَّهْ পরিবর্তিত হবে। آسِنٌ পরিবর্তিত। الْمَسْنُونُ পরিবর্তিত। حَمَإٍ শব্দটি حَمْأَةٍ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ গলিত কাদা মাটি। يَخْصِفَانِ তারা উভয়ে (আদম ও হাওয়া) জান্নাতের পাতাগুলো জোড়া জোড়া দিতে লাগলেন। (জোড়া দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান ঢাকতে শুরু করলেন) سَوْآتُهُمَا দ্বারা তাঁদের উভয়ের লজ্জাস্থানের প্রতি ইশারা করা হয়েছে। আর مَتَاعٌ إِلَى حِينٍ এর অর্থ এখানে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত। আর আরববাসীগণ الْحِينُ শব্দ দ্বারা কিছু সময় থেকে অগনিত সময়কে বুঝিয়ে থাকেন। قَبِيلُهُ এর অর্থ তার ঐ দল যাদের মধ্যে সেও শামিল।
৩০৯৪। ইবনু সালাম (রহঃ) … আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু সালামের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনায় আগমনের খবর পৌঁছল, তখন তিনি তাঁর কাছে আসলেন। এরপর তিনি বলেছেন, আমি আপনাকে এমন তিনটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই যার উত্তর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কেও অবগত নয়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন কি? আর সর্বপ্রথম খাবার কি, যা জান্নাতবাসী খাবে? আর কি কারণে সন্তান তার পিতার সা’দৃশ্য লাভ করে? আর কিসের কারণে (কোন কোন সময়) তার মামাদের সাদৃশ্য হয়? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এইমাত্র জিব্‌রাঈল (আলাইহিস সালাম) আমাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। রাবি বলেন, তখন আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেন, সে তো ফিরিশতাগণের মধ্যে ইয়াহুদীদের শত্রু।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন হল আগুন যা মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে তাড়িয়ে নিয়ে একত্রিত করবে। আর প্রথম খাবার যা জান্নাতবাসীরা খাবেন তা হল মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। আর সন্তান সদৃশ হওয়ার রহস্য এই যে পুরুষ যখন তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্য প্রথমে স্খলিত হয় তখন সন্তান তার সাদৃশ্যতা লাভ করে। তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি-নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসুল।
এরপর তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইয়াহুদিরা অপবাদ ও কুৎসা রটনাকারী সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করার পূর্বে তারা যদি আমার ইসলাম গ্রহণের বিষয় জেনে ফেলে, তাহলে তারা আপনার কাছে আমার কুৎসা রটনা করবে। তারপর ইয়াহুদিরা এলো এবং আবদুল্লাহ (রাঃ) ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনুু্‌ সালাম কেমন লোক? তারা বলল, তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যাক্তি এবং সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যাক্তির পুত্র। তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যাক্তি এবং সর্বোত্তম ব্যাক্তির পুত্র।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি আবদুল্লাহ ইসলাম গ্রহন করে, এতে তোমাদের অভিমত কি হবে? তারা বলল, এর থেকে আল্লাহ তার তাঁকে রক্ষা করুক। এমন সময় আবদুল্লাহ (রাঃ) তাদের সামনে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তখন তারা বলতে লাগল, সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাক্তি এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাক্তির সন্তান এবং তারা তাঁর গীবত ও কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয়ে গেল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

তথ্যসূত্র

  1. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩০৯৪ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"