Table of Contents
ভূমিকা
ইসলাম ধর্মের হাদিস, সীরাত ও তাফসীর সমূহের কারণে বর্তমান সময়ের নীতি নৈতিকতার আলোকে ইসলামের অনেক বিষয়কে মেনে নিতে না পারার কষ্টে লজ্জিত হওয়া এবং হাদিসকে অস্বীকার করে ইসলামের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করার এক আন্দোলন শুরু হয়েছে, যাকে বলা হয় আহলে কোরআন আন্দোলন। ইসলামকে টিকিয়ে রাখার এক আকুল আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া আহলে কোরআন বা কুরানিস্ট মতবাদটি মৌলিকভাবে এক ঘোষণার ওপর দাঁড়িয়ে—মানবজাতির হেদায়াতের জন্য কেবলমাত্র কোরআনই যথেষ্ট। নবী মুহাম্মদের জীবন, তার কর্ম, তার উক্তি—এসব হাদিসের আকারে সংরক্ষিত হলেও কুরানিস্টদের মতে তা ধর্মের উৎস হতে পারে না। কারণ, তা মানুষের মুখনিঃসৃত, ত্রুটিপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর। তাদের দৃষ্টিতে, কেবল কোরআনই আল্লাহর সরাসরি বাণী—একমাত্র নির্ভরযোগ্য পাঠ, একমাত্র বৈধ পথনির্দেশ।
এই উচ্চারণের পেছনে রয়েছে এক ধরনের অসততা। নবীকে ইসলামকে রক্ষা করার স্বার্থে কোরবানী দিয়ে হলেও ইসলামকে রক্ষা করার আকুলতা তাদের থাকলেও, যখন এই মতবাদকে ভাষা, জ্ঞান ও মানব-সৃষ্ট ব্যাখ্যার বাস্তবতায় দাঁড় করানো হয়, তখন তা এক অদ্ভুত আত্মবিরোধে রূপ নেয়। বিশেষত, যখন তারা কোরআনের অর্থ বোঝার জন্য অনুবাদ, অভিধান ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাহায্য নেন—যা নিছকই মানুষের সৃষ্টি।
কোরআন ও ভাষার ঐতিহাসিক বাস্তবতা
কোরআন নাজিল হয়েছে সপ্তম শতকের হিজায অঞ্চলের কোরাইশদের আরবি ভাষায়। এটি সেই সময়ের আরবদের জন্য অর্থবহ ছিল, যাঁরা নবীর সমাজে বসবাস করতেন, তাদের ভাষাভঙ্গি, প্রতীক, কাব্য ও বাগধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। আজকের কালের একজন বাঙালি, তুর্কি কিংবা মালয় ব্যক্তি কোরআনের মূল সেই ১৪৫০ বছর আগে ব্যবহৃত ভাষা না জেনে সরাসরি এর অর্থ বোঝার দাবি করলে, তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ কিছু নয়।
এখানেই কুরানিস্টরা পড়েন একটি মৌলিক সংকটে। তারা কোরআনের বাইরে কিছু মানেন না, অথচ কোরআনের অর্থ বোঝার জন্য যেসব অনুবাদ তারা পড়েন, তা একাধিক ব্যক্তির ব্যাখ্যা, ভাষানুবাদ, ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ এবং সাংস্কৃতিক অনুবর্তিতার ওপর দাঁড়িয়ে। উদাহরণস্বরূপ, “صلاة (সালাত)” শব্দটি কোরআনে ব্যবহৃত হলেও, তার প্রকৃত অর্থ কী—”দোয়া”, নাকি প্রথাগত নামাজ—তা নির্ভর করে পাঠকের ভাষা ও ব্যাখ্যার পদ্ধতির ওপর। একইভাবে, “ضرب (দারাবা)” শব্দটি “আঘাত” না “বিচ্ছিন্ন হওয়া” বোঝায়, তা নির্ধারণ করতে গিয়ে ব্যাখ্যাকারীরা বহু দিক থেকে বিতর্ক করেছেন।
তাহলে প্রশ্ন আসে—এই অনুবাদগুলো কে করছে? অভিধানগুলো কারা তৈরি করেছে? মানুষ? কোরআনের শব্দবিশ্লেষণ, ব্যাকরণগত গঠন, ছন্দপতন—সবই কি মানুষের চিন্তা ও গবেষণার ফসল নয়? যদি মানুষের রচিত হওয়ার কারণে হাদিস বাতিল হয় “মানুষের কথা” বলে, মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয় এই অজুহাতে, তবে মানুষেরই করা অনুবাদ, অভিধান, ব্যাকরণগ্রন্থ, ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কিভাবে বৈধ হয়?
ভাষা প্রবাহমান, অর্থ পরিবর্তনশীল
ভাষা কোনো জড় বস্তু নয়, এটি স্রোতস্বিনী নদীর মত এক জীবন্ত প্রবাহ—সময়ের সাথে যার রূপ বদলায়, অর্থ বদলায়, প্রেক্ষিত বদলায়। একটি শব্দ এক যুগে যা বোঝায়, পরবর্তী কালে তা ভিন্ন ব্যঞ্জনা গ্রহণ করতে পারে। বাংলাভাষায় এর চমৎকার উদাহরণ রয়েছে:
- “মাগী” শব্দটি মধ্যযুগীয় সাহিত্যে নারীর প্রতিরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো—একটি নিরপেক্ষ ও প্রায় শ্রুতিমধুর শব্দ। অথচ আজকের দিনে এটি গালিসূচক, অপমানজনক। একজন আধুনিক পাঠক যদি লালন বা চণ্ডীদাসের কোনো পদ্য পড়েন এবং সেখানে “মাগী” শব্দের বর্তমান অর্থ আরোপ করেন, তাহলে পাঠ হবে বিকৃত, অসত্য।
- ইংরেজি ভাষায় “gay” শব্দটি ১৮শ শতক পর্যন্ত ছিল “happy, lively, carefree” অর্থে ব্যবহৃত। বর্তমানে তা একান্তভাবেই “homosexual” বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
- “awful” শব্দটি একসময় বোঝাত “awe-inspiring”—মহানতা ও বিস্ময়কর ক্ষমতার প্রতীক। এখন এটি শুধুই নেতিবাচক—“very bad”।
এই বাস্তবতা আমাদের বাধ্য করে ভাবতে—যে কোরআন নির্দিষ্ট সময়, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছে, তার শব্দসমূহকে আজকের মানদণ্ডে বোঝার জন্য যে কোনো অনুবাদই একটি ভাষাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত, যা সময় ও চিন্তার পরিশ্রমে গঠিত।
১৪৫০ বছর আগের কোরআনের অর্থ
বর্তমান সময়ে যদি কেউ ১৪৫০ বছর আগের কোরআনের অনুবাদ করতে যায়, তাহলে তার অবশ্যই বর্তমান ও সেই সময়ের অনুবাদ, ভাষার বিবর্তন এবং শব্দের অর্থের পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে হবে। কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে জানতে হলে তো মানুষের তৈরি কোন গ্রন্থ বা মানুষের জ্ঞানকেই ব্যবহার করতে হবে। শুধুমাত্র কোরআনের জ্ঞান তো সেখানে যথেষ্ট নয়। তাহলে তারা সেইসব জ্ঞান দ্বারা কোরআনকে ব্যাখ্যা করছেন কীভাবে?
কুরানিস্টদের নীরব নির্ভরতা
এই প্রেক্ষাপটে কুরানিস্টদের ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থান এক আত্মবিভ্রান্তিক চক্রে আবদ্ধ। তারা মুখে বলেন, কেবল কোরআনই গ্রহণযোগ্য। বাদবাকি সকল গ্রন্থ যেহেতু মানুষের রচিত, তাই সেগুলো ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়। তাই তারা কোন তাফসীর, কন হাদিস গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, এবং অস্বীকার করার পরেই নিজেই কোরআনের অনুবাদ বা তফসির করা শুরু করে। অথচ কোরআন বোঝার জন্য তারা অনুবাদ, অভিধান, এমনকি প্রাচীন আরবি কবিতার ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন—যা সবই মানুষের তৈরি। আর একবার যখন তারা ভাষা ও ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করেন, তখনই তারা স্বীকার করে ফেলেন, মানুষ ছাড়া ঈশ্বরের বাণী উপলব্ধি করা অসম্ভব। অর্থাৎ, তারা নিজেরাই প্রমাণ করেন, হেদায়াতের পথ কেবল কোরআনে যথেষ্ট নয়—মানুষের ব্যাখ্যা ও ভাষাবোধও তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
উপসংহার
আহলে কোরআনের “শুধু কোরআনই যথেষ্ট” নীতি বর্তমানে অনেকের কাছেই এক আকর্ষণীয় ঈশ্বর-কেন্দ্রিক ধর্মতাত্ত্বিক আহ্বান। কিন্তু ভাষা, সময়, এবং মানবিক উপলব্ধির বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তা এক রূপকথার মতো হয়ে পড়ে। কারণ ঈশ্বরের বাণী হলেও, তা পাঠ করেন মানুষই; আর মানুষের পাঠ কখনোই নিরপেক্ষ নয়, ভুক্লের উর্ধ্বেও নয়, তাদেরই নীতি অনুসারে। ব্যাখ্যা ছাড়া ধর্ম নেই, ভাষা ছাড়া ব্যাখ্যা নেই, এবং মানুষ ছাড়া ভাষা নেই।
তাই কোরআনবাদীদের উচিত নিজেদের আত্মবিরোধ স্বীকার করে নেওয়া—তারা চাইলেও মানুষের জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া কোরআনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন না। এবং সেটাই বাস্তবতা।