কোরআনে একেশ্বরবাদ বনাম বহু-সত্তার প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি

ভূমিকা

ইসলাম নিজেকে একটি কঠোর একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করে, যার মূল ভিত্তি হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ – অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই বা উপাসনা পাওয়ার যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। এই বিশ্বাস ইসলামের মৌলিক ভিত্তি এবং এর ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু, যা এক আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা ও একমাত্র উপাস্য হওয়ার উপর জোর দেয়। তবে, কুরআনের কিছু আয়াত এবং তাদের ধ্রুপদী ব্যাখ্যার গভীর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে ইসলামের দাবী আল্লাহ ব্যতীত “উপাস্য কেউ না থাকলেও” অন্য ঐশ্বরিক সত্তার অস্তিত্বের প্রতি এক ধরনের কার্যকর (functional) বা অস্তিত্বগত (ontological) সম্মতির সন্ধান পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো কুরআনের এমন কিছু বক্তব্য বিশ্লেষণ করা, যা একদিকে একেশ্বরবাদের কথা বললেও বহু ঐশ্বরিক সত্তার শাস্তি, বিচার এবং চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের প্রচ্ছন্ন অস্তিত্বকে মেনে নেয়। বিশেষত, সূরা আল-মু’মিনুন (২৩:১৪) এর মতো আয়াতগুলোতে ব্যবহৃত ভাষা, যেখানে আল্লাহকে ‘সর্বোত্তম স্রষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তা একটি স্পষ্ট ধারনা তৈরি করে এবং একাধিক ঐশ্বরিক বা অলৌকিক সত্তার ধারণাকে ইঙ্গিত করে, যা ইসলামের কঠোর একত্ববাদী ভাষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই প্রবন্ধে আমরা এই আয়াতগুলোর ভাষাতাত্ত্বিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বৈপরীত্য, মাক্কী পর্বে মুহাম্মদের ধর্মতাত্ত্বিক বিকাশে পৌত্তলিক সমাজের প্রভাব, ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং মক্কা ও মদিনা পর্বে ‘আল্লাহ’ সত্তার চরিত্রগত রূপান্তরের মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করব। পরিশেষে, এই সমস্ত উপাদান কীভাবে ইসলামি ঈশ্বরতত্ত্বের মৌলিকতা ও অভ্রান্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, সে বিষয়ে একটি সমন্বিত চিত্র উপস্থাপন করা হবে।


কুরআনের অভ্যন্তরীণ সাংঘর্ষিকতাঃ ‘সর্বোত্তম স্রষ্টা’ বনাম একচ্ছত্র একত্ব

কুরআন নিজেকে একটি পরিপূর্ণ ও স্ববিরোধহীন গ্রন্থ হিসেবে দাবি করলেও, এর কিছু আয়াত একে অপরের সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলির একটি হলো সূরা আল-মু’মিনুন (২৩:১৪) যেখানে বলা হয়েছে:

“فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ” “অতএব, বরকতময় আল্লাহ, যিনি সর্বোত্তম স্রষ্টা।” [1]

ভিন্ন অনুবাদে,

“فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ”
“সুতরাং ধন্য মহান আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।”
—সূরা মু’মিনুন ২৩:১৪ [2]

এই আয়াতে ব্যবহৃত দুটি আরবি শব্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: “الخالقين” (al-khaliqīn) যা একটি বহুবচন রূপ এবং এর অর্থ “স্রষ্টাগণ”, এবং “أحسن” (ahsanu) যা একটি তুলনামূলক বিশেষণ এবং এর অর্থ “সবচেয়ে উত্তম” বা “সর্বশ্রেষ্ঠ”। এই বাক্যগঠন শুধুমাত্র তখনই যৌক্তিক যখন একাধিক স্রষ্টা বিদ্যমান থাকে এবং সেই প্রেক্ষাপটে একজনকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। কিন্তু এই বক্তব্য কুরআনের অন্যান্য একাধিক আয়াতের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক, যেখানে আল্লাহ নিজেকে একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে দাবি করেছেন:

  • “আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা।” – সূরা জুমার (৩৯ঃ৬২)
  • “আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো স্রষ্টা কি আছে?” – সূরা ফাতির (৩৫ঃ৩)
  • “তারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং নিজেরাই সৃষ্ট।” – সূরা নাহল (১৬ঃ২০)

যদি আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা হন এবং অন্য কোনো স্রষ্টা না থাকে, অন্য কোন দেবদেবী বা গডস না থাকে, তাহলে আল্লাহর নিজেকে ‘সর্বোত্তম স্রষ্টা’ বলার কোনো অর্থ থাকে না; এবং সেখানে এই ধরণের তুলনার প্রশ্নই ওঠে না। এই বৈপরীত্য ইসলামি ঈশ্বরতত্ত্বের একত্ববাদের দাবির মৌলিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনেক ইসলামি ভাষ্যকার এই আয়াতটিকে নিছক একটি ভাষাগত অলংকার বা কাব্য সৌন্দর্য্য হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তবে, এমন অলংকার যদি ঈশ্বরতত্ত্বে মৌলিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তবে সেটিকে ঈশ্বরপ্রদত্ত ‘সর্বশ্রেষ্ঠ, নিখুঁত ও স্বচ্ছ ভাষা’ বলা যায় না, বিশেষ করে যখন কুরআন নিজেই দাবি করে: “এই কিতাবের আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাযুক্ত এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুস্পষ্ট ভাষায় নাজিল করা হয়েছে।” [3]। যে ঈশ্বরের বাণী এমন ভাষায় রচিত, যার অর্থ বোঝাতে বহু শতকের শত শত তাফসিরকারের সাহায্য নিতে হয়, সেই ভাষাকে কি আসলেই ‘সুস্পষ্ট’ বলা যায়? এই ভাষাগত দ্ব্যর্থতা কি ঈশ্বরের পক্ষ থেকে কাম্য?


মানুষ ও জ্বীনদের তুলনায় আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্তা?

ক্লাসিকাল তাফসিরকারকগণ, বিশেষত আল-তাবারী ও আল-করতুবি, কোরআনের “আহসানুল খালিকীন” (সর্বোত্তম স্রষ্টা) আয়াতের ব্যাখ্যায় “খালিক” শব্দটির ব্যপ্তি প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “স্রষ্টা” কেবল আল্লাহর একচেটিয়া বৈশিষ্ট্য নয়, বরং মানুষকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যেহেতু মানুষও কিছু না কিছু সৃষ্টি বা নির্মাণ করে—যেমন ভাস্কর্য তৈরি করা, ঘর নির্মাণ করা ইত্যাদি। এইভাবে তারা দাবি করেন যে, আল্লাহ তাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি নিখুঁত, আর মানুষের সৃষ্টি সীমাবদ্ধ। মূলত এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তারা “সর্বোত্তম স্রষ্টা” বাক্যাংশের তুলনামূলক চরিত্রকে মানুষের মত সৃষ্টিশীল সত্তার সাথে যুক্ত করে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু এই ব্যাখ্যা কোরআনের ভাষাগত শৈলী ও একেশ্বরবাদের ঈশ্বরতাত্ত্বিক ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলে। মানুষের তৈরি বস্তুকে “সৃষ্টি” বলাটি মৌলিকভাবে একটি ভুল শব্দ, একইসাথে তা আল্লাহর সৃষ্টির মত মৌলিক বা অস্তিত্বগত সৃষ্টি নয়; বরং মানুষের “নির্মাণ” হলো বিদ্যমান প্রাকৃতিক উপাদানকে নতুন রূপ দেয়া। সুতরাং, মানুষের সৃষ্টি বলতে যা বোঝানো হয় তা মৌলিকভাবে কোন সৃষ্টি নয়, বড়জোর রূপান্তর মাত্র। তার সাথে আল্লাহর সৃষ্টির তুলনা টানা একদমই অবান্তর। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের আকীদাও হচ্ছে, আল্লাহর সাথে কোনকিছুই তুলনীয় নয়। সেটি হয়ে থাকলে, আল্লাহ নিজেই কীভাবে মানুষ বা জ্বীনদের সাথে নিজেকে তুলনা করে সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টিকর্তা বলে দাবী করছেন? এই নিয়ে আমাদের প্রশ্ন ওঠে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই নিজের বক্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে কেন এমন তুলনার অবতারণা করবেন, যেখানে তিনি মানুষ কিংবা অন্য কোন সত্তাদের সাথে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করছেন? এটি কোরআনের একত্ববাদের দাবি ও আল্লাহর স্বয়ম্ভূ সত্তার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক।

ইসলামের মৌলিক আকীদা বা বিশ্বাস হচ্ছে, কোনকিছুই আল্লাহর সাথে তুলনীয় নয়। আল্লাহর সাথে অন্য কোন সত্তার তুলনা করাই ইসলামের দৃষ্টিতে সবচাইতে মারাত্মক অপরাধ, যাকে শিরক বলা হয়। যেখানে এই বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিতে সবচাইতে মারাত্মক অপরাধ, সেই কাজটি আল্লাহ নিজেই কেন করতে যাবেন? তিনি কেন সামান্য মানুষের সাথে নিজেকে তুলনা করে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টিকর্তা হিসেবে দাবী করবেন? এখানেই তো সামান্য মানুষের সাথে আল্লাহর তুলনা করে ফেলা হচ্ছে, তাই না? ঐসকল আয়াতের এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে, আল্লাহ নিজেই যে সামান্য মানুষের সাথে নিজেকে তুলনা করে নিজের বড়াই করছেন, শিরক করছেন, সেটি প্রতীয়মান হয়। যা আরও বড় সমস্যা সৃষ্টি করে।


উপাস্য সত্তার শাস্তি ও বিচারঃ অস্তিত্বের প্রচ্ছন্ন স্বীকারোক্তি

কুরআনের এমন কিছু আয়াত রয়েছে যেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্য উপাস্য সত্তাদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যা তাদের বাস্তব অস্তিত্বের প্রতি একটি ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নের সৃষ্টি করে। সূরা আম্বিয়া (২১:৯৮-১০০)- তে বলা হয়েছে, [4]

তোমরা (কাফিররা) আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর সেগুলো জাহান্নামের জ্বালানী। তাতে তোমরা প্রবেশ করবে।
— Taisirul Quran
তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদাত কর সেগুলিতো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে।
— Sheikh Mujibur Rahman
নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের পূজা কর, সেগুলো তো জাহান্নামের জ্বালানী। তোমরা সেখানে প্রবেশ করবে।
— Rawai Al-bayan
নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তারা যদি ইলাহ হত, তাহলে তারা তাতে প্রবেশ করত না, তাতে তারা সবাই স্থায়ী হয়ে থাকবে।
— Taisirul Quran
যদি তারা উপাস্য হত তাহলে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না; তাদের সবাই তাতে স্থায়ী হবে।
— Sheikh Mujibur Rahman
যদি তারা ইলাহ হত তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না। আর তারা সবাই তাতে স্থায়ী হয়ে থাকবে।
— Rawai Al-bayan
যদি তারা ইলাহ হত তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না; আর তাদের সবাই তাতে স্থায়ী হবে,
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

সেখানে তারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে, সেখানে কিছুই শুনবে না।
— Taisirul Quran
সেখানে থাকবে তাদের আর্তনাদ এবং সেখানে তারা কিছুই শুনতে পাবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
সেখানে থাকবে তাদের আর্তনাদ, আর সেখানে তারা শুনতে পাবে না।
— Rawai Al-bayan
সেখানে থাকবে তাদের নাভিশ্বাসের শব্দ [১] এবং সেখানে তার কিছুই শুনতে পাবে না;
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

ধ্রুপদী তাফসিরকারকেরা এই “উপাস্য” শব্দটি দিয়ে বোঝেন সেই সকল সত্তা – যেমন লাত, মানাত, উজ্জা, হুবল – যাদের মানুষ আল্লাহর পরিবর্তে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এখানে মৌলিক প্রশ্ন হলো: এই দেবদেবী যদি নিছক কাল্পনিক চরিত্র বা জড় মূর্তি হয়, তাহলে তাদের জাহান্নামে পাঠানো সম্ভব কিভাবে? শাস্তি প্রাপ্তি একটি সত্তার অস্তিত্ব এবং সচেতনতা নির্ধারণ করে। কোনো অস্তিত্বহীন বস্তু বা নিছক কাল্পনিক মূর্তি শাস্তির আওতাভুক্ত হয় না।

কোরআনের এই বক্তব্য সরাসরি একটি সচেতন, নৈতিক দায় এবং ইচ্ছাশক্তি আরোপ করে “মিথ্যা উপাস্যদের” উপর। এর অর্থ এই উপাস্যরা সচেতন ছিল, নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ ছিল, এবং ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সত্তা ছিল – যা তাদের নিছক কল্পনার বাইরে একটি বাস্তব অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়।


ইসা বা যীশু জাহান্নামে যাবে না

প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তো একই যুক্তিতে ইসা নবী বা খ্রিস্টানদের যীশুরও জাহান্নামে যাওয়ার কথা, কারণ ইসা নবীকেও খ্রিস্টানদের একটি বড় অংশ ঈশ্বর বলে উপাসনা করেছে। এই প্রশ্ন মুহাম্মদের আমলেও উঠেছিল, এবং এটি নিয়ে আল্লাহ কোরআনেই জবাব দিচ্ছে। আসুন যাকারিয়ার তাফসীর থেকে একটি পাতা দেখে নেয়া যাক [5]

সত্তা

একই যুক্তির প্রতিফলন দেখা যায় সূরা মা’ইদাহ (৫:১১৬–১১৭) এ, যেখানে আল্লাহ ঈসা (যীশু) কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হে ঈসা, তুমি কি মানুষদেরকে বলেছিলে যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমার উপাসনা করো?’ ঈসা তখন তা অস্বীকার করে বলবে, ‘না আমি কখনোই এমনটি বলিনি!’ আসুন আয়াতগুলো পড়ি, [6]

স্মরণ কর, যখন আল্লাহ ঈসা ইবনু মারইয়ামকে বললেন, তুমি কি লোকেদেরকে বলেছিলে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে আর আমার মাতাকে ইলাহ বানিয়ে নাও।’ (উত্তরে) সে বলেছিল, ‘পবিত্র মহান তুমি, এমন কথা বলা আমার শোভা পায় না যে কথা বলার কোন অধিকার আমার নেই, আমি যদি তা বলতাম, সেটা তো তুমি জানতেই; আমার অন্তরে কী আছে তা তুমি জান কিন্তু তোমার অন্তরে কী আছে তা আমি জানি না, তুমি অবশ্যই যাবতীয় গোপনীয় তত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণরূপে ওয়াকেফহাল।
— Taisirul Quran
আর যখন আল্লাহ বলবেনঃ হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলেঃ তোমরা আল্লাহর সাথে আমার ও আমার মায়েরও ইবাদাত কর? ঈসা নিবেদন করবেঃ আপনি পবিত্র! আমার পক্ষে কোনক্রমেই শোভনীয় ছিলনা যে, আমি এমন কথা বলি যা বলার আমার কোন অধিকার নেই; যদি আমি বলে থাকি তাহলে অবশ্যই আপনার জানা থাকবে; আপনিতো আমার অন্তরে যা আছে তাও জানেন, পক্ষান্তরে আপনার জ্ঞানে যা কিছু রয়েছে আমি তা জানিনা; সমস্ত গাইবের বিষয় আপনিই জ্ঞাত।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আল্লাহ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তুমি কি মানুষদেরকে বলেছিলে যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর?’ সে বলবে, ‘আপনি পবিত্র মহান, যার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার জন্য সম্ভব নয়। যদি আমি তা বলতাম তাহলে অবশ্যই আপনি তা জানতেন। আমার অন্তরে যা আছে তা আপনি জানেন, আর আপনার অন্তরে যা আছে তা আমি জানি না; নিশ্চয় আপনি গায়েবী বিষয়সমূহে সর্বজ্ঞাত’।
— Rawai Al-bayan
আরও স্মরণ করুন, আল্লাহ্‌ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়াম –তনয় ‘ঈসা! আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া আমাকে আমার জননীকে দুই ইলাহরূপে গ্রহণ কর? ‘তিনি বলবেন, ‘আপনিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভনীয় নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে আপনি তো তা জানতেন। আমার অন্তরের কথাতো আপনি জানেন, কিন্তু আপনার অন্তরের কথা আমি জানি না; নিশ্চয় আপনি অদৃশ্য সম্বদ্ধে সবচেয়ে ভালো জানেন।’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তুমি আমাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ করেছ তা ছাড়া আমি তাদেরকে অন্য কিছুই বলিনি, (তা এই) যে, তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদাত কর যিনি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক, আর তাদের কাজ কর্মের ব্যাপারে সাক্ষী ছিলাম যদ্দিন আমি তাদের মাঝে ছিলাম, অতঃপর যখন তুমি আমাকে উঠিয়ে নিলে, তখন তুমিই ছিলে তাদের কার্যকলাপের তত্ত্বাবধায়ক, আর তুমি হলে প্রত্যেক ব্যাপারে সাক্ষী।
— Taisirul Quran
আমি তাদেরকে উহা ব্যতীত কিছুই বলিনি যা আপনি আমাকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, যিনি আমার রাব্ব এবং তোমাদেরও রাব্ব। আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম, অতঃপর আপনি যখন আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই ছিলেন তাদের রক্ষক, বস্তুতঃ আপনিই সর্ব বিষয়ে পূর্ণ খবর রাখেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
‘আমি তাদেরকে কেবল তাই বলেছি, যা আপনি আমাকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আললাহর ইবাদাত কর। আর যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিলেন তখন আপনি ছিলেন তাদের পর্যবেক্ষণকারী। আর আপনি সব কিছুর উপর সাক্ষী।
— Rawai Al-bayan
‘আপনি আমাকে যে আদেশ করেছেন তা ছাড়া তাদেরকে আমি কিছুই বলিনি, তা এই যে, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহ্‌র ইবাদত কর এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি ছিলাম তাদের কাজ-কর্মের সাক্ষী, কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন [১] তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের কাজ-কর্মের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনিই সব বিষয়ে সাক্ষী [২]।’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ইসলামিক দৃষ্টিকোণে ইসা নির্দোষ, কারণ তিনি নিজেকে উপাস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। অর্থাৎ, শুধুমাত্র উপাস্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া নয়, বরং সেই দাবি বা অবস্থান গ্রহণ করাটাই এই কাজের নৈতিক দায়ের উৎস।

এ থেকে বিপরীত যুক্তি দাঁড়ায় – যেসব দেবদেবী উপাসনা পেতে সম্মত হয়েছিল বা নিজেরা দাবি করেছিল, কেবল তারাই দোষী, তাদেরকেই শুধুমাত্র জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে। সুতরাং, ইসলাম যেসব মিথ্যা উপাস্যকে “জাহান্নামে যাওয়ার যোগ্য” বলে মনে করে, তাদের নিছক কল্পনানির্ভর মূর্তি হিসেবে নয়, বরং সচেতন ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে, যা তাদের প্রচ্ছন্ন অস্তিত্বকে স্বীকার করে।[7]

সত্তা 1
সত্তা 3

ওযযা নামে বাস্তব জগতে কিছুর অস্তিত্ব আছে?

ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়, মক্কা বিজয়ের পর নবী মুহাম্মদ সাহাবী খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে পাঠিয়েছিলেন ‘উযযা’ নামের বিখ্যাত দেবীমূর্তি ধ্বংস করতে। এটি ছিল কুরায়েশ এবং বনু কেনানাহ গোত্রের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দেবী। খালিদ প্রথমবার গিয়ে ওই মূর্তিটি ভেঙে ফিরে এলে নবী মুহাম্মদ তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি কিছু দেখেছ?” খালিদ উত্তর দেন, না। তখন মুহাম্মদ বলেন, “তাহলে তুমি মূর্তিটি ধ্বংস করোনি। আবার যাও।” দ্বিতীয়বার খালিদ মন্দিরের কাছে পৌঁছে দেখতে পান, এক কৃষ্ণাঙ্গ নগ্ন নারী, যার চুল বিশৃঙ্খল, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। স্থানীয় মন্দির-প্রহরী তাকে দেখে চিৎকার শুরু করলে খালিদ সেই নারীকে এক কোপে হত্যা করেন। এরপর যখন তিনি নবীর কাছে ফিরে এসে ঘটনাটি বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ বলেছিলেন—“হ্যাঁ, সেই নারীই ছিল উযযা। সে তোমাদের দেশে পূজা পাওয়ার আশা চিরতরে হারাল।”[8]

সত্তা 5

এই বর্ণনায় ইসলামী একেশ্বরবাদের সঙ্গে একটি মৌলিক মতাদর্শিক সংকট উন্মোচিত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ওযযা বা উযযা ছিল একটি মিথ্যা দেবী, নিছক একটি পাথরের মূর্তি মাত্র। যার ভাল বা মন্দ কিছু করারই কোন সামর্থ্য নেই। কিন্তু নবীর বক্তব্য অনুযায়ী, উযযা কেবল একটি মূর্তি ছিল না; বরং তার বাস্তব, শারীরিক এবং চেতনাসম্পন্ন এক সত্তা, যে মক্কার মানুষের পূজা পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই দেবীর আগে পূজা পাওয়ার কিছু আশা ছিল। এখানে উযযাকে কল্পিত চরিত্র না বলে একটি অলৌকিক চেতনা সম্পন্ন, ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।

তাহলে এই সত্তাগুলো কী নিজেদের উপাসনা চেয়েছিল? উপাসনা চাওয়ার কারনেই কী এই সত্তাগুলো জাহান্নামের জ্বালানি হবে?

সুতরাং প্রশ্ন জাগে, উযযা কি কেবল একটি মানুষের কল্পিত মূর্তি ছিল, নাকি একটি কার্যকর অস্তিত্ব? মুহাম্মদের বক্তব্য অনুযায়ী, উযযা ছিল এমন এক সত্তা, যার উপাসনা পাওয়ার বাসনা ও প্রত্যাশা ছিল, এবং হত্যা করা না হলে সেই উপাসনা চলতেই থাকত। এখানে আমরা দেখতে পাই একপ্রকার ধর্মতাত্ত্বিক সংশয়: যেখানে একদিকে ইসলাম দাবি করছে দেবদেবী কাল্পনিক, অন্যদিকে তাদের অস্তিত্ব, ইচ্ছাশক্তি ও শারীরিক রূপ থাকার কথাও বলা হচ্ছে, যা নেহাত কাল্পনিক কোনো কল্পনা নয়। মূলত উযযা দেবীর এই শারীরিক রূপ ও হত্যা-বর্ণনা ইসলামে বহু দেবতা-সংক্রান্ত চর্চার একটি গুপ্ত বাস্তবতা উন্মোচন করে, যা ইসলামিক একেশ্বরবাদের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মতাত্ত্বিক আপস: মাক্কী পর্যায় থেকে মদিনার রূপান্তর

ইসলামের প্রাথমিক ধর্মতাত্ত্বিক বিকাশে মক্কার পৌত্তলিক সমাজের প্রভাব গভীরভাবে লক্ষণীয়। সূরা আল-মু’মিনুন একটি মাক্কী সূরা, যা মুহাম্মদের ধর্মপ্রচারের শুরুর পর্যায়ে অবতীর্ণ। এই সময়ে তিনি আরবের পৌত্তলিক সমাজে একজন সংখ্যালঘু নবী ছিলেন, যেখানে কাবার চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি পূজিত হতো এবং আল-লাত, আল-উজ্জা, ও মানাত নামে তিন নারী-দেবীকে “আল্লাহর কন্যা” বলা হতো [9]। এই পৌত্তলিক পটভূমির ফলে মুহাম্মদ এক ধরনের ধর্মতাত্ত্বিক আপস করেন, যেখানে তিনি সকল দেবতাকে সরাসরি অস্বীকার না করে বরং আল্লাহকে তাঁদের মধ্যে “সর্বশ্রেষ্ঠ” হিসেবে উপস্থাপন করেন। এটি একটি হেনোথেইস্টিক (Henotheistic) অবস্থান – যেখানে বহু সত্তার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে, একটিকে সর্বোচ্চ হিসেবে মান্য করা হয়। এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে ২৩:১৪ আয়াতের “স্রষ্টাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ” বাক্যে।

এই প্রেক্ষাপটে আলোচিত হওয়া জরুরি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হল “স্যাটানিক ভার্সেস”। ইসলামি ঐতিহাসিক গ্রন্থ যেমনঃ আল-তাবারী, ইবনে সা’দ, ওয়াকিদি ইত্যাদি অনুসারে, সূরা আন-নাজম পাঠের সময় মুহাম্মদ বলেছিলেন: “এই তিন নারী দেবী—আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাত—উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। নিশ্চয়ই তাঁদের সুপারিশ প্রত্যাশিত।” এই আয়াত শুনে মক্কার পৌত্তলিকরা খুশি হয়ে সিজদা করে। পরে মুহাম্মদ বলেন, শয়তান তাঁকে এই আয়াত মুখে দিয়েছিল এবং তিনি তা বাতিল করেন। এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে যে, মুহাম্মদ প্রাথমিক পর্যায়ে পৌত্তলিক সমাজকে তুষ্ট করতে ধর্মতাত্ত্বিক আপস করেন। তখন তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন যে, এই দেবতারা আছে, তবে আল্লাহ তাঁদের উপরে। ২৩:১৪ আয়াত সেই মনোভাবেরই অনুরূপ – একাধিক স্রষ্টা আছে, তবে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।

মুহাম্মদের মদিনা পর্বে কোরআনের বক্তব্য ও আল্লাহর চরিত্রে একটি বিশাল রূপান্তর ঘটে। মক্কায় তিনি ছিলেন নিপীড়িত প্রচারক; মদিনায় তিনি হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক নেতা, সেনানায়ক ও বিচারক। এই পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায় কোরআনের ভাষায়ও। মদিনায় আল্লাহ এখন আর “সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা” নন – তিনি একচ্ছত্র ঈশ্বর, রাজা, সেনানায়ক। এমনকি তাঁর শত্রুরাও শাস্তির উপযুক্ত, শুধু তাওহিদের অস্বীকার করলেই। মদিনায় অবতীর্ণ কিছু উদাহরণ:

  • “আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই তত্ত্বাবধায়ক।” – সূরা জুমার (৩৯:৬২)
  • “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তিনি সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান।” – সূরা আল-ইমরান (৩:৬২)
  • “যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে, তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম দেওয়া হবে।” – সূরা আন-নিসা (৪:১৪)
  • “যুদ্ধ করো আল্লাহর পথে… হত্যা করো, শাস্তি দাও।” – সূরা মুহাম্মদ (৪)

এইসব আয়াতে আল্লাহ এখন আর তুলনামূলকভাবে “শ্রেষ্ঠ” নন – তিনি নিরঙ্কুশ ও একমাত্র উপাস্য, সর্বশক্তিমান শাসক, যুদ্ধদাতা ও শাস্তিদাতা, আইনদাতা ও সমাজ নিয়ন্ত্রক। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ‘আল্লাহ’ ধারণাটি মুহাম্মদের রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক চাপ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে।


উপসংহার: প্রশ্ন, সন্দেহ এবং এর প্রভাব

এই প্রবন্ধে আমরা কুরআনের অভ্যন্তরে নিহিত একটি মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক সংশয় বিশ্লেষণ করেছি, যা ইসলামের ঘোষিত কঠোর একেশ্বরবাদী অবস্থানের সাথে বহু উপাস্য সত্তার প্রচ্ছন্ন অস্তিত্বের ধারণার সাংঘর্ষিকতাকে তুলে ধরে। বিশেষত, সূরা আল-মু’মিনুন (২৩:১৪) এর ‘আল্লাহ, যিনি সর্বোত্তম স্রষ্টা’ বাক্যটি ভাষাতাত্ত্বিকভাবে একাধিক স্রষ্টার অনুমানকে সমর্থন করে, যা সূরা ফাতির (৩৫:৩) এবং সূরা জুমার (৩৯:৬২) এর মতো অন্যান্য আয়াত যেখানে আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে দাবি করা হয়েছে, তার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই বৈপরীত্য কেবল ভাষাগত অলংকার নয়, বরং ইসলামি ঈশ্বরতত্ত্বের একটি অন্তর্নিহিত সংকটের প্রতীক।

এছাড়াও, কুরআনের আয়াত (সূরা আয-যুখরুফ ৪৩:৭৭-৭৮, সূরা মা’ইদাহ ৫:১১৬-১১৭) যেখানে ‘মিথ্যা উপাস্যদের’ জাহান্নামের শাস্তি বা তাদের নির্দোষতার মানদণ্ড আলোচনা করা হয়েছে, তা ইঙ্গিত দেয় যে এই উপাস্য সত্তাগুলো নিছক কাল্পনিক নয়, বরং সচেতন ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অস্তিত্ব। এটি শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সত্ত্বাকে স্বীকার করে নেয়, যা ‘আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই’ এই মৌলিক তাওহীদের ঘোষণার সঙ্গে এক ধরনের জটিলতা তৈরি করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিশেষত মাক্কী পটভূমি এবং ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এর ঘটনা, মুহাম্মদের প্রাথমিক ধর্মপ্রচারে পৌত্তলিক সমাজের প্রভাব এবং তার ধর্মতাত্ত্বিক আপসের ইঙ্গিত দেয়। সেই সময়কার ‘হেনোথেইস্টিক’ মনোভাব, যেখানে বহু সত্তার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে একটিকে সর্বোচ্চ হিসেবে মান্য করা হয়, তা ২৩:১৪ আয়াতের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরবর্তীতে মদিনা পর্বে, মুহাম্মদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে সাথে ‘আল্লাহ’ সত্তার চরিত্রেও রূপান্তর ঘটে, যেখানে তিনি কেবল ‘সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা’ নন, বরং একচ্ছত্র শাসক, সেনানায়ক ও আইনদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ইসলামি ধর্মতত্ত্বে ‘আল্লাহ’ কোনো চিরস্থায়ী পরম সত্তা নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গঠিত চরিত্র, যার গঠনপ্রক্রিয়া ধর্মপ্রচারক মুহাম্মদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই নির্ধারিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কুরআনের এই অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যগুলো ইসলামের মৌলিক একত্ববাদের দাবির সাথে একটি গভীর ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করে, যা ইসলামে অন্ধবিশ্বাসীগণ নানাভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে ব্যাখ্যাগুলো একটু পর্যালোচনা করলেই সেসব ব্যাখ্যার অযৌক্তিক অবস্থান পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।



তথ্যসূত্রঃ
  1. কোরআন ২৩ঃ১৪ ↩︎
  2. কোরআন ২৩ঃ১৪ ↩︎
  3. সূরা হুদ ১১:১ ↩︎
  4. কোরআন ২১:৯৮-১০০ ↩︎
  5. কুরআনুল কারীম ২য় খণ্ড – ড. যাকারীয়া, পৃষ্ঠা ১৭৩১ ↩︎
  6. কোরআন ৫:১১৬–১১৭ ↩︎
  7. কুরআনুল কারীম ১ম খণ্ড – ড. যাকারীয়া, পৃষ্ঠা ৬১২-৬১৩ ↩︎
  8. আর রাহীকুল মাখতুম, আল কোরআন একাডেমী, পৃষ্ঠা ৪২৬ ↩︎
  9. Ibn Ishaq, Sirat Rasul Allah ↩︎