আল্লাহর কী ফ্রিউইল আছে, নাকি আল্লাহ নিজেই তাকদীর দ্বারা শৃঙ্খলিত?

ভূমিকা

ইসলামী বিশ্বাসমতে আল্লাহ তাআলা সবকিছু সৃষ্টির সূচনা লগ্নেই আগামীতে যা কিছু ঘটবে তার সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত করে রেখেছেন। একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে আছে যে আল্লাহ প্রথমে একটি “কলম” সৃষ্টি করেন এবং তাকে সমস্ত ভবিষ্যতের ঘটনা লিখে রাখতে আদেশ দেন। কলম জিজ্ঞেস করল: “আমি কী লিখব?” আল্লাহ বললেন: “কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, সব লিখে রাখ।” সেই কলম আল্লাহর আদেশ অনুসারে অনন্তকাল পর্যন্ত ঘটবে এমন সম্ভাব্য সব কিছু লিপিবদ্ধ করে ফেলে। ইসলামী আকীদা অনুযায়ী এরপর আল্লাহ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন, শুরুতে আসমান ও জমিনকে পৃথক করেন এবং পরবর্তীতে ক্রমে সমস্ত সৃষ্টিজগৎ তাঁর পূর্বলিখিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রমে ক্রমে আস্তিত্বে আনেন, যা আগে ছিল না।

এই প্রেক্ষাপটে মৌলিক প্রশ্ন ওঠে: আল্লাহ কি তাঁর নিজ হাতে লিখিত সেই তাকদীর (ভাগ্যলিপি) থেকে বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছু ঘটানোর “স্বাধীন ইচ্ছা” অর্থাৎ ফ্রি উইল প্রয়োগ করতে পারেন? যদি আল্লাহ তাঁর লিখিত স্ক্রিপ্টের বাইরে কিছু করতে সক্ষম হন, তাহলে শুরুতে কলমকে দিয়ে লিখিয়ে রাখা তাকদীর মিথ্যা প্রমাণিত হয় – যা আল্লাহর সর্বজ্ঞাতা (Omniscience) বা بودن বৈশিষ্ট্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর যদি আল্লাহ কোনোভাবেই সেই লিখিত ভাগ্যের বাইরে কিছু করতে না পারেন, তাহলে তিনি এক অর্থে নিজ তাকদীরের শৃঙ্খলে আবদ্ধ – অর্থাৎ তাঁর সর্বশক্তিমত্তা (Omnipotence) এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এই দার্শনিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণই নিচের প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হবে।


ইসলামী আকীদায় সর্বপ্রথম সৃষ্টি

বহু হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতে একটি কলম বানিয়েছিলেন, যার দায়িত্ব ছিল তাকদীরের ভালমন্দ সব লেখা। অর্থাৎ আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্ট বস্তু হচ্ছে কলম। মহাবিশ্বের সর্বপ্রথম সৃষ্ট বস্তু হচ্ছে কলম, যে কথাটি অত্যন্ত হাস্যকর। যাইহোক, আসুন হাদিসটি পড়ি [1]

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
৩৫/ সুন্নাহ
পরিচ্ছেদঃ ১৭. তাকদীর সম্পর্কে
৪৭০০। আবূ হাফসাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাঃ) তার ছেলেকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পাবে না যতক্ষণ না তুমি জানতে পারবে ’’যা তোমার উপর ঘটেছে তা ভুলেও এড়িয়ে যাওয়ার ছিলো না। পক্ষান্তরে, যা এড়িয়ে গেছে তা তোমার উপর ভুলেও ঘটবার ছিলো না।
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম যে বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে কলম। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, লিখো! কলম বললো, হে রব! কি লিখবো? তিনি বললেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক বস্তুর তাকদীর লিখো। হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাস ছাড়া মারা যায় সে আমার (উম্মাতের) নয়।[1]
সহীহ।
[1]. তিরমিযী, আহমাদ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সেই কলমের কালি শুকিয়ে গেছে বলেই অন্যান্য হাদিসে বলা আছে, যার অর্থ হচ্ছে সেই তাকদিরে আর কোন সংশোধন সম্ভব নয়। যা লিখিত আছে পূঙ্খানুপূঙ্খ্যভাবে সেটিই ঘটবে, সেটি ভিন্ন কিছুই ঘটবে না [2] [3]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৮২/ তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ ৮২/২. আল্লাহর ইলম-মুতাবিক (লেখার পর) কলম শুকিয়ে গেছে।
আল্লাহর বাণীঃ ‘‘আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে গুমরাহ করেছেন’’- (সূরাহ জাসিয়াহ ৪৫/২৩) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ যার সম্মুখীন তুমি হবে (তোমার যা ঘটবে) তা লেখার পর কলম শুকিয়ে গেছে। ইবনু ‘আব্বাস(রাঃ) বলেছেন,(لَهَا سَابِقُوْنَ) তাদের উপর নেকবখতি প্রাধান্য বিস্তার করেছে।
৬৫৯৬. ‘ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! জাহান্নামীদের থেকে জান্নাতীদেরকে চেনা যাবে কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। সে বলল, তাহলে ‘আমলকারীরা ‘আমল করবে কেন? তিনি বললেনঃ প্রতিটি লোক ঐ ‘আমলই করে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা যা তার জন্য সহজ করা হয়েছে। [৭৫৫১; মুসলিম ৩৮/১, হাঃ ২৬৪৯] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬১৩৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬১৪৪)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ)


ইসলামে তাকদীর (Predestination) এর ধারণা

ইসলামে বিশ্বাসের ছয়টি মৌলিক স্তম্ভের একটি হল “তাকদীরের ওপর বিশ্বাস”, অর্থাৎ ভাগ্যের পূর্বলিখিত অভ্রান্ততাকে মেনে নেওয়া। কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকটি ঘটনাকে পূর্ব থেকেই নির্ধারণ ও লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে: “পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজের জীবনে কোনো বিপদ-আপদ আসেনা, যা আমি ঘটানোর আগে একটি কিতাবে লিপিবদ্ধ না থাকে। নিশ্চয় আল্লাহর পক্ষে এটি খুবই সহজ।” [4]। এই আয়াতের তাফসীরে হাদিসের উদ্ধৃতি রয়েছে: নবী মুহাম্মদ বলেছেন, “আল্লাহ আসমান-জমিন সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত সৃষ্টি জীবের তাকদীর লিখে দিয়েছেন।” অর্থাৎ সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই কে কী করবে, কে নেক বা বদ আমল করবে, কার রিজিক কেমন হবে, এমনকি কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে – সবকিছু আল্লাহর কাছে পূর্বনির্ধারিত ও লিখিত। একটি হাদিসে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ আছে যে আল্লাহ যে কিতাব লিখেছেন, তাতে “ফেরাউন জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত” বলে আগেই লেখা ছিল, আবার কুরআন অবতরণের বহু আগে থেকেই “তবলত ইয়দা আবি লাহাব…” (আবু লাহাবের ধ্বংস অবধারিত) লিখিত ছিল। [5]

এখানে সবচাইতে জরুরি যেই বিষয়টি তা হচ্ছে, আল্লাহ কিন্তু শুধু বান্দার কার্যক্রম লিখেই থামেননি, তিনি নিজের কর্মকাণ্ড কখন কী হবে, সেটিও লিখে রেখেছেন। কারণ তার নিজের কর্মকাণ্ড ছাড়া শুধুমাত্র বান্দার কর্মকাণ্ড লেখা অসম্ভব। কারণ মহাবিশ্ব সৃষ্টি, সবকিছু পরিকল্পনা এবং এই ঐশ্বরিক নাটকে আল্লাহ নিজেও একটি চরিত্র। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। ধরুন সেই তাকদীরে লিখিত আছে, “জনৈক বান্দা আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করবে একটু পানির জন্য। আল্লাহ তখন তার প্রার্থণা শুনে তার জন্য পানির বন্দোবস্ত করবেন।” এখন এই লিখিত তাকদীর কিন্তু শুধু পানি প্রার্থণা করা বান্দার তাকদীর নয়, এই তাকদীর একইসাথে আল্লাহর তাকদীরও বটে। আসুন সেই হাদিসটি পড়ি,

সূনান তিরমিজী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৩৫/ তাকদীর
পরিচ্ছেদঃ পরিচ্ছেদ নাই।
২১৫৮. ইয়াহইয়া ইবন মূসা (রহঃ) ….. আবদুল ওয়াহিদ ইবন সালিম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার মক্কায় এলাম। সেখানে আতা ইবন আবূ রাবাহ (রহঃ) এর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁকে বললামঃ হে আবূ মুহাম্মদ, বাসরাবাসরীরা তো তাকদীরের অস্বীকৃতিমূলক কথা বলে। তিনি বললেনঃ প্রিয় বৎস, তুমি কি কুরআন তিলাওয়াত কর? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ সূরা আয-যুখরুখ তিলাওয়াত কর তো। আমি তিলাওয়াত করলামঃ
হা-মীম, কসম সুস্পষ্ট কিতাবের, আমি তা অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআন রূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পার। তা রয়েছে আমার কাছে উম্মূল কিতাবে, এ তো মহান, জ্ঞান গর্ভ (৪৩ঃ ১, ২, ৩, ৪)।
তিনি বললেনঃ উম্মূল কিতাব কি তা জান? আমি বললামঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ এ হল একটি মহাগ্রন্থ, আকাশ সৃষ্টিরও পূর্বে এবং যমীন সৃষ্টিরও পূর্বে আল্লাহ তাআলা তা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এতে আছে ফির‘আওন জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত, এতে আছে তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাবীও ওয়া তাব্বা ‏(‏تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ‏) আবূ লাহাবের দুটি হাত ধ্বংস হয়েছে আর ধ্বংস হয়েছে সে নিজেও।
আতা (রহঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম সাহাবী উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র ওয়ালীদ (রহঃ)-এর সঙ্গে আমি সাক্ষাত করেছিলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ মৃত্যুর সময় তোমার পিতা কি ওয়াসীয়ত করেছিলেন?
তিনি বললেনঃ তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেনঃ হে প্রিয় বৎস, আল্লাহকে ভয় করবে। যেনে রাখবে যতক্ষণ না আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং তাকদীরের সব কিছুর ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনবে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কখনো আল্লাহর ভয় অর্জন করতে পারবে না। তা ছাড়া অন্য কোন অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয় তবে জাহান্নামে দাখেল হতে হবে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। এরপর একে নির্দেশ দিলেন, লিখ, সে বললঃ কি লিখব? তিনি বললেনঃ যা হয়েছে এবং অনন্ত কাল পর্যন্ত যা হবে সব তাকদীর লিখ। সহীহ, সহিহহ ১৩৩, তাখরিজুত তহাবিয়া ২৩২, মিশকাত ৯৪, আযযিলাল ১০২, ১০৫, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২১৫৫ (আল মাদানী প্রকাশনী)
(আবূ ঈসা বলেন) এ হাদীসটি এ সূত্রে গারীব।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে ইসলামী মতানুসারে আল্লাহ তাআলার জ্ঞান ও পরিকল্পনা সম্পূর্ণ পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। নবী মুহাম্মদ স্পষ্টভাবেই বলছেন: “কলম তুলে নেওয়া হয়েছে, কালি শুকিয়ে গেছে”, অর্থাৎ যা ভাগ্যে লিপিবদ্ধ হওয়ার হয়ে গেছে, তাতে আর পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। ভাগ্যলিপি একবার শুকিয়ে গেলে তাতে নতুন করে কিছু লেখা বা মুছে ফেলার সুযোগ নেই – তাকদীর চূড়ান্ত। একজন সাহাবী তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন: “…জেনে রেখো, পুরো মানবজাতি উপকার করতে জড়ো হলেও পারবে না, তারা কেবল তাই করতে পারবে যা আল্লাহ আগেই তোমার জন্য লিখে রেখেছেন; এবং সবাই মিলে ক্ষতিও করতে চাইলে তেমন ক্ষতিই করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, পাতাগুলো শুকিয়ে গেছে।” এই বিশ্বাস অনুযায়ী মানবজাতির প্রতিটি ব্যাপার আল্লাহর লিখিত স্ক্রিপ্টমাফিকই ঘটে, এবং সে লিখিত স্ক্রিপ্ট ভুল বা মিথ্যা হওয়ার কোন সুযোগ নেই, পরিবির্তনেরও সুযোগ নেই [6]

সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
৩৫/ কিয়ামত ও মর্মস্পর্শী বিষয়
পরিচ্ছেদঃ ৫৯. (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে সাহাবীগণের এক অবস্থা এবং পরে অন্য অবস্থা)
২৫১৬। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক সময় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পিছনে ছিলাম। তিনি বললেনঃ হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি- তুমি আল্লাহ্ তা’আলার (বিধি-নিষেধের) রক্ষা করবে, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ্ তা’আলাকে তুমি কাছে পাবে। তোমার কোন কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তা’আলার নিকট চাও, আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহ্ তা’আলার নিকটেই কর।
আর জেনে রাখো, যদি সকল উন্মাতও তোমার কোন উপকারের উদ্দেশে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা’আলা তোমার জন্যে লিখে রেখেছেন। অপরদিকে যদি সকল ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ্ তা’আলা তোমার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে।
সহীহঃ মিশকাত (৫৩০২), যিলালুল জান্নাত (৩১৬-৩১৮)।
আবূ ঈসা বলেন, এই হাদীসটি হাসান সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)


আল্লাহর সর্বজ্ঞান ও সর্বশক্তিমত্তা: সংকটের সূত্রপাত

ঈশ্বরের দুটি প্রধান গুণ ইসলামে সর্বত্র ঘোষিত: সর্বজ্ঞাতা (সবকিছু জানা, আল-আলীম) এবং সর্বশক্তিমান (সর্ব শক্তির অধিকারী, আল-কাদির বা আল-ক্ষমতাবান)। কুরআনে বলা হয়: “আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম”, আবার একই সাথে “আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত” – এ দুটো গুণে ইসলামে বিশ্বাসী কারো কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। কিন্তু এই দুটি গুণের সংমিশ্রণে একটি যৌক্তিক সমস্যার উদ্ভব হয় যখন আমরা তাকদীরের ধারণাকে বিবেচনা করি।

আল্লাহ সর্বজ্ঞানী হওয়ায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সমস্ত কিছু তিনি প্রথম থেকেই অবগত। সুতরাং ভবিষ্যতে তিনি নিজে কী কী করবেন তাও তিনি অনন্তকালের জ্ঞান দ্বারা আগে থেকেই জানেন এবং সেই অনুযায়ী ভবিষ্যতের ঘটনাপঞ্জী নির্ধারণ করে লিখে রেখেছেন। আবার আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তাই আভিধানিক অর্থে তিনি ইচ্ছা করলেই যেকোনো কিছু করতে সক্ষম, কোনোকিছুই তাঁর সাধ্যাতীত নয়। এখানে প্রশ্ন হল: আল্লাহ কি ভবিষ্যতের সেই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার ক্ষমতা এবং ইচ্ছা রাখতে পারেন?

দ্বন্দ্বটির মূলকেন্দ্র হল – আল্লাহর নিজের “ফ্রি উইল” বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি রয়েছে কিনা। যদি ধরি আল্লাহ সর্বশক্তিমান, সে হিসাবে চাইলে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে বা পূর্বনির্ধারিত স্ক্রিপ্ট (তাকদীর) ভেঙে নতুন কিছু করতেও পারেন, তাহলে বলতে হয় তাঁর পূর্বের সর্বজ্ঞানমূলক ঘোষণা (যা কলম দ্বারা লিখিত) ভুল ছিল। আবার যদি বলি না, আল্লাহ কখনোই সেই লিখিত তাকদীরের বাইরে যাবেন না/যেতে পারবেন না, অক্ষরে অক্ষরে সেই তাকদীরে লিখিত বিষয়ই তার মেনে চলতে হবে, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি আসলে শুরুতেই নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা – তিনি চাইলেও নতুন কোন সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন না বা ভিন্ন কিছু ‘বেছে’ নিতে পারেন না। যে পথ একবার নির্ধারিত হয়েছে তাকদীরের খাতায়, সে পথেই তাঁকে চলতে হবে। প্রথম ক্ষেত্রে আল্লাহর সর্বজ্ঞাতার দাবী ভুল প্রমাণিত হয়; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা ও স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা সংকুচিত হয়ে যায়। এটা একপ্রকার ট্র্যাপের মত: “Heads I lose, tails you win” – যেদিকেই যাই একটা গুণের বিপরীতে আরেকটা গুণের বিপাকে পড়ছে। আল্লাহ কি এই সিলমারা ভাগ্যলিপি ভাঙার ক্ষমতা রাখেন, নাকি তিনি নিজেই নিজের লিখে দেওয়া ভাগ্যের অনুগামী?

সম্ভাব্য অবস্থাযুক্তির ফলাফল/সমস্যাকোন গুণাবলী প্রশ্নবিদ্ধ হয়
১. আল্লাহ চাইলে নিজের লিখিত তাকদীর ভেঙে নতুন কিছু করতে পারেনতাহলে তাঁর পূর্বের সর্বজ্ঞানমূলক ঘোষণা (কলমের লিখিত ভাগ্য) ভুল বা অসম্পূর্ণ প্রমাণিত হয়আল্লাহর সর্বজ্ঞাতা (Omniscience)
২. আল্লাহ কখনোই লিখিত তাকদীরের বাইরে যেতে পারেন নাতাহলে আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি ও সর্বশক্তিমত্তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে; তিনি চাইলেও নতুন কিছু করতে পারেন নাআল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা (Omnipotence) ও তার স্বাধীন ইচ্ছা (Free will)

যৌক্তিক ধাঁধার চার্ট

নিচের চিত্রে এই দ্বন্দ্বটির যুক্তিগত কাঠামো তুলে ধরা হলো। আল্লাহ ভবিষ্যতের সমগ্র পরিকল্পনা পূর্বেই কলম দিয়ে লিখিয়ে রেখেছেন (তাকদীর)। এখন প্রশ্ন: আল্লাহ কি সেই লিখিত স্ক্রিপ্টের বাইরে কোনো ভিন্ন কাজ করতে পারেন? এখানে দুইটি সম্ভাবনা তৈরি হয় – “হ্যাঁ” বা “না”। যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে দেখা যাচ্ছে আল্লাহর পূর্বলিখিত তাকদীর (যা ধরে নেওয়া হয়েছিল অচूक) আসলে ভুল বা অসম্পূর্ণ ছিল, কারণ আল্লাহ পরে এসে নতুন কিছু করলেন। এটি আল্লাহর সর্বজ্ঞাতা হওয়ার বৈশিষ্ট্যের সাথে সাংঘর্ষিক, কেননা সর্বজ্ঞানী সত্তা কখনও এমন কিছু “নতুন” করবে না যা তাঁর নিজ জ্ঞানে পূর্বে ছিল না। অপরদিকে যদি উত্তর না হয়, অর্থাৎ আল্লাহ কোনোভাবেই নিজের পূর্বলিখিত পরিকল্পনার বাইরে যেতে পারেন না, তাহলে আল্লাহর সর্বশক্তিমান এবং স্বাধীন ইচ্ছাশীল হওয়ার ধারণাটি সংকটে পড়ে – এক্ষেত্রে আল্লাহ আসলে নিজেরই নির্মিত ভাগ্য-স্রোতের এক অনুগত বন্দী মাত্র, যেখানে তিনি ইচ্ছে থাকলেও স্ক্রিপ্টের বাইরে পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। সংক্ষেপে:

আল্লাহ লিখিত তাকদীর নির্ধারণ করেছেন
আল্লাহ কি নিজের লিখিত তাকদীরের বাইরে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন?
হ্যাঁ
তাহলে পূর্বলিখিত তাকদীর মিথ্যা
(সর্বজ্ঞতা প্রশ্নবিদ্ধ)
না
তাহলে আল্লাহর ইচ্ছা ও সর্বশক্তিমত্তা প্রশ্নবিদ্ধ

  • সম্ভাবনা ১: আল্লাহ তাকদীরের বাইরে কিছু করেন ⇒ পূর্বের লিখিত তাকদীর মিথ্যা প্রমাণিত (সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ পূর্বে ভুল তথ্য লিখেছেন!)।
  • সম্ভাবনা ২: আল্লাহ তাকদীরের বাইরে কিছু করতে পারেন না ⇒ আল্লাহ সর্বশক্তিমান নন (নিজেরই নির্ধারিত কাঠামো ভাঙার ক্ষমতা তাঁর নেই)।

এ দ্বৈত সমস্যাকে কখনো কখনো “ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা বনাম স্বাধীন ইচ্ছা” এর দ্বন্দ্ব হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, আল্লাহ সময়ের ঊর্ধ্বে থাকা এক সত্তা হওয়ায় তাঁর জ্ঞানে “ভুল” বা “পরে শুধরে নেওয়া” বলার সুযোগ নেই; আবার একইসাথে তিনি ইচ্ছাশক্তির অধিকারী এক الشخصية যিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। কিন্তু দুটি বৈশিষ্ট্য একসাথে ধরা হলে এই যৌক্তিক ধাঁধার মুখোমুখি হতে হয়।


মানব উদাহরণ দিয়ে বিশ্লেষণ

এটি আরও সহজভাবে বোঝার জন্য মানবীয় একটি উদাহরণ বিবেচনা করা যাক। ধরুন, একজন ব্যক্তি আজ পরিকল্পনা করলেন যে তিনি আগামী মাসে আমেরিকা ভ্রমণে যাবেন। তিনি আগেভাগে তার ভ্রমণসূচী একটি ডায়রিতে লিখে রাখলেন – কোন তারিখে কোন শহরে যাবেন সব বিস্তারিত উল্লেখ করলেন। এরপর তিনি আমেরিকার ভিসা সংগ্রহ করলেন, প্লেনের টিকিটও কেটে ফেললেন। এখন যাত্রার আগমুহূর্তে হঠাৎ তাঁর মত পাল্টে গেল। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আর আমেরিকা নয়, তার বদলে তিনি ইংল্যান্ড ঘুরতে যাবেন। সেই মোতাবেক তিনি প্লেনের গন্তব্য বদলে ইংল্যান্ডে গিয়ে ভ্রমণ সম্পন্ন করলেন। ফলাফল হিসেবে কী হলো? – শুরুতে ডায়রিতে লেখা তাঁর সম্পূর্ণ ভ্রমণ-তাকদীরটিই ভুল প্রমাণিত হল, কেননা বাস্তবে তা আর ঘটে নি। যদি ধরা হত যে ডায়রিতে লিখিত তার পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত ও অচল সত্য (একটি “অপরিবর্তনীয় ভাগ্য”), তাহলে কখনও তার পক্ষে সিদ্ধান্ত বদলে ইংল্যান্ড যাওয়া সম্ভব হতো না। আবার বাস্তবে সে সিদ্ধান্ত বদলেছে বলেই প্রমাণিত হচ্ছে যে ডায়রিতে লিখিত ভাগ্য-ভাবনাটি সর্বজ্ঞানীর ভাবনা ছিল না – অর্থাৎ সেই ব্যক্তি সর্বজ্ঞানী নন। এই উদাহরণটি মানবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও একই যুক্তি আমরা আল্লাহর পূর্বলিখিত ভাগ্যের ক্ষেত্রে তুলনা করে দেখতে পারি। আল্লাহর ক্ষেত্রে পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ অজ্ঞ হওয়ায় পরিকল্পনা বদলাতে বাধ্য হতে পারে, কিন্তু সর্বজ্ঞ আল্লাহর তো “ভাবনা পরিবর্তন” বা নতুন করে কিছু উপলব্ধি করে নতুন চিন্তা করা বা নতুন জ্ঞানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা নয়। তাহলে কি আল্লাহর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দিকটি সত্য, অর্থাৎ তিনি নিজের পরিকল্পনা কখনোই বদলান না? বদলান না, সেটি মানা গেল। কিন্তু তিনি বদলাতে বা পরিবর্তন করতে সক্ষম কী? যদি তাই হয়, তবে উপরের উদাহরণ অনুযায়ী ডায়রির লেখার মতোই আল্লাহর লিখিত ভাগ্য-লেখন চিরন্তনভাবে স্থির এবং আল্লাহ নিজেও তার ব্যতিক্রম ঘটাতে অক্ষম – যেটি তাঁর ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের সাথে একেবারেই খাপ খায় না।

এক্ষেত্রে আরেকটি তুলনা করা যায়: ধরুন একটি নাটকের পরিচালক পুরো নাটকের চিত্রনাট্য শুরুতেই লিখে দিলেন এবং তা অনুযায়ী অভিনয় এগোচ্ছে। পরিচালক যদি হঠাৎ মাঝপথে স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে নতুন সংলাপ যোগ করেন, তবে আগের চিত্রনাট্য মিথ্যা হয়ে যাবে। আর যদি তিনি কখনোই স্ক্রিপ্টের বাইরে না যান, তাহলে নাটকের গল্পটি পুরোটাই পূর্বনির্ধারিত – পরিচালকের তাৎক্ষণিক সৃজনশীলতার বা নতুন কিছু যুক্ত করার বা সংশোধন করার সুযোগ নেই। আল্লাহর লিখিত লওহে মাহফুজের (প্রিজার্ভড ট্যাবলেট) ক্ষেত্রেও একই ছবি উঠে আসে: এটি এমন একটি “চলচ্চিত্রের ফিতা”, যা সৃষ্টির শুরুতেই সম্পূর্ণ রেকর্ড হয়ে গেছে এবং তার বাইরে এক বিন্দুও নড়চড় হবার জো নেই। আল্লাহ যদি সেই রেকর্ডে কোনো পরিবর্তন আনতে চান, তবে মানতেই হবে আসল ফিতাটি সর্বজ্ঞ সত্তার রেকর্ড ছিল না। আর যদি কোনো পরিবর্তন একেবারেই না আসে, তবে ভেবে দেখতে হবে আল্লাহ কি তবে মূলত একটি পূর্ব-লিখিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী “অভিনয়” করে চলেছেন? এই তুলনাগুলো মানবীয় সীমিত বুদ্ধি দিয়ে করা বটে, তবে মূল সমস্যাটিকে স্পষ্ট করে: তাকদীর ও আল্লাহর গুণাবলীর মাঝে এক নিগূঢ় দার্শনিক ও যৌক্তিক জটিলতা রয়েছে।


ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও প্রতিক্রিয়া

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা অনুসারে, ইসলামি শিক্ষায় তাকদীর ও মানবের ফ্রি উইল নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সাহাবা ও পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ একাধিকবার কৌতূহলভরে এই বিষয়ের তর্কে জড়িয়েছেন এবং বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে এসেছে যে এ বিষয়ে বেশি প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে: “যখন তাকদীরের প্রসঙ্গ আসবে, থেমে যাও” — অর্থাৎ কদর নিয়ে গভীরে বিতর্কে না যাওয়াই ভালো। খলিফা হযরত আলীর একটি উক্তি আছে: “তাকদীর আল্লাহর একটি গোপন রহস্য; এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে না”। ইসলামী আইনবিদ ইমাম আবু হানিফা বলেছেন, “তাকদীর নিয়ে গভীর মননে ডোবা মানে সূর্যের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকার মতো” – এর অর্থ, এ প্রসঙ্গে গভীর অনুসন্ধান মানুষের জ্ঞানের সামর্থ্যের বাইরে এবং ফলশ্রুতিতে কেবল দৃষ্টি ঝলসে যাবে। এইসব বাণী থেকে প্রতীয়মান হয় যে মুসলিম আলিমগণ স্বীকার করতেন, কদর/তাকদীরের বিষয়টি খুবই জটিল এবং সাধারণ যুক্তিতে এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর। তাই “আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান, তাই তাকদীরও সত্য এবং মানুষের কাজ হচ্ছে সেগুলো বোঝার চেষ্টা না করেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করা – এসব আল্লাহরই গোপন ব্যবস্থা, মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য এটুকু মেনে নেওয়া” – এমন এক ধরনের বিশ্বাসভিত্তিক অবস্থান গড়ে উঠেছে মূলধারার ইসলামি ভাবধারায়। অর্থাৎ, এই সমস্যাকে অনেকে “প্রমাণের নয়, ঈমানের ব্যাপার” হিসেবে গণ্য করে যুক্তিতর্ক এড়িয়ে গেছেন।

তবে আধুনিক কালে ও মধ্যযুগীয় ইসলামি দর্শন উভয় ক্ষেত্রেই কিছু চিন্তাবিদ এই সঙ্কটের সুরাহা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন ফিরকা বা মতবাদে বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: প্রাচীন মু’তাযিলারা মানুষকে স্বেচ্ছাস্বাধীন মনে করতেন এবং তারা আল্লাহকে অবিচার ও জুলুমের অভিযোগ থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছেন, তাই মানুষের কর্মফলকে সম্পূর্ণ তার নিজের সিদ্ধান্ত বলে জোর দিতেন; অপরদিকে ঐতিহ্যবাদী আশআরী মতবাদ জোর দেয় আল্লাহর পূর্ণ পূর্বনির্ধারণের ওপর, মানুষের ইচ্ছাকে তাঁরা সীমিত অর্থে স্বীকৃতি দেন (কসব তত্ত্ব) তবে চূড়ান্তভাবে আল্লাহর লিখিত সিদ্ধান্তকেই ফলাফল নির্ধারক বলেন। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা প্রধানত মানবের ফ্রি উইল বনাম আল্লাহর সর্বজ্ঞাতা প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে; আল্লাহর নিজের ফ্রি উইল প্রসঙ্গে সরাসরি তারা তেমন আলোকপাত করেননি।

আধুনিক কিছু ইসলামি পণ্ডিত দর্শন এবং যুক্তির এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে বলে থাকেন, আল্লাহ অতীত-ভবিষ্যৎ সব একসাথে দেখেন, তাই আল্লাহর কাছে “আগে-পরে” বলে কিছু নেই – তিনি কালাতীত (Timeless) সত্তা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, “আল্লাহ পরিকল্পনা পাল্টালেন” – এ ধরনের প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক, কারণ পরিবর্তনের ধারনাটাই সময়নির্ভর; আল্লাহ সময়ের মাঝে প্রবেশ করেন না বরং সমগ্র সময় জগতটাই তাঁর দৃষ্টিতে এক স্থির চিত্রের মত। তাই “আল্লাহর মত বদলানো” বা “নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া” – এসব কথা আল্লাহর ক্ষেত্রে লাগসই নয়।

তবে আল্লাহর কালাতীত অবস্থার ধারণা নিয়ে অন্য পক্ষের অনেক বড় বড় সালাফী আলেমদের আপত্তিও আছে; সালাফী আলেমদের মধ্যে প্রধান অংশ নির্দেশ করেন যে, কুরআন-হাদিসে আল্লাহকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয় যেন তিনি কাল প্রবাহে মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছেন (কখনো রুষ্ট হন, কখনো প্রসন্ন হন, ইত্যাদি)। তাই ইবনু তাইমিয়া বা ইবনু কইয়্যিম প্রমুখ স্কলারগণ আল্লাহকে কালাতীত বলা ঠিক নয় বলেই মত দিয়েছেন, বরং আল্লাহ সময়ের মধ্যেই নিজের ইচ্ছানুসারে কাজ করেন, সময়ের সাথে তার আবেগ অনুভূতি ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটে – যদিও তাঁর জ্ঞান সবসময় পরিপূর্ণ থাকে। যেমন ধরুন, একটি বিখ্যাত হাদিসে রয়েছে, আল্লাহ রাতের কোন এক সময়ে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন, বান্দার প্রার্থণা শোনার জন্য। বান্দার প্রার্থনা শুনে আল্লাহ খুশি হন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন, আল্লাহর আবেগ অনুভূতির পরিবর্তন।

আধুনিক অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ এই প্যারাডক্স মোকাবিলায় একটি যুক্তি উপস্থাপন করেন: আল্লাহর “ফ্রি উইল” বলতে এমন ইচ্ছাশক্তি বোঝায় না যা হুট করে মত পাল্টাতে হবে; বরং আল্লাহ সর্বজ্ঞানের অধিকারী বিধায় শুরুতেই তিনি সর্বোত্তম সিদ্ধান্তটি নেন এবং তা পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে না। আল্লাহর কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয় না মানেই এই নয় যে তিনি অসামর্থ্যবশত পরিবর্তন করতে পারেন না, বরং তিনি সবকিছু জানার কারণে তাঁর নেয়া প্রথম সিদ্ধান্তটিই চূড়ান্তভাবে সেরা সিদ্ধান্ত। পরিবর্তন সাধারণত তখনই প্রয়োজন হয় যখন পূর্ব সিদ্ধান্তে অজানা তথ্য ছিল বা ভুল ছিল; আল্লাহর ক্ষেত্রে এমন কোন অজ্ঞতা বা ভুলের অবকাশ নেই। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়ে থাকে আল্লাহ সর্বাধিক “স্বাধীন” এ অর্থে যে তিনি যা করেন, নিজের ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী করেন, তাঁর উপর বাইরের কোনো শক্তির প্রভাব নেই। অতএব আল্লাহ কখন কী করবেন তা তিনি পূর্ব থেকেই জানেন এবং সেটাই করেন – এটিকে তাঁর স্বাধীন ইচ্ছার পরিপূর্ণ প্রকাশ হিসেবেই উপস্থাপন করা যায়। এই ব্যাখ্যায় পারস্পরিক বিরোধ মিটে যায় বলে মনে হতে পারে, কারণ এখানে আল্লাহর সর্বজ্ঞান ও সর্বশক্তিমত্তা দুটিই রক্ষা পায়: আল্লাহ সব জানেন, তাই তিনি এমন কোনো ইচ্ছা পোষণ করেন না যা তার জ্ঞানের বিপরীতে যায়; আবার তিনি সর্বশক্তিমান, কেননা তাঁর জ্ঞানবহির্ভূত কোনোকিছু ঘটছে না এবং তিনি যা চান তা ঘটাতেই সক্ষম, বাইরের কেউ তাঁকে বাঁধা দিচ্ছে না। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আবার কোরআনের কিছু আয়াতের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ তৈরি করে।


কোরআনের নাসেখ-মানসুখ : বাতিল ও প্রতিস্থাপিত বিধান এবং আল্লাহর ইচ্ছার পরিবর্তন

ইসলামি আকীদায় নাসেখ-মানসুখ (অর্থাৎ, বাতিল ও প্রতিস্থাপিত আয়াত/বিধান) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয়। মূল ধারণা হচ্ছে, কোরআনের কোনো কোনো আয়াত বা বিধান পরে আসা নতুন আয়াত/বিধান দ্বারা বাতিল বা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই ধারণার মূল উৎস হচ্ছে সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১০৬:

“আমরা যখনই কোনো আয়াত রহিত করি বা ভুলিয়ে দেই, তখন তার চেয়ে উত্তম বা অনুরূপ নিয়ে আসি।…”
— [সূরা বাকারা ২:১০৬]

তাফসীরকারীরা ব্যাখ্যা করেছেন, এখানে ‘রহিত’ অর্থাৎ বাতিলকরণ (নাসখ) মানে আল্লাহ পূর্বে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে নতুন নির্দেশ দিয়ে বাতিল বা প্রতিস্থাপিত করেছেন। উপড়ে দেখুন, আল্লাহ বলেছেন তিনি উত্তম বা অনুরূপ আয়াত নিয়ে আসেন। অর্থাৎ, নতুন আয়াতটি হয় অনুত্তম ছিল, নতুবা তার অনুরূপ সমপর্যায়ের আরও কিছু আয়াত থাকা সম্ভব। কিন্তু পরের আয়াতটি উত্তম হলে, আল্লাহ প্রথমে যেই আয়াতটি দিয়েছিলেন, সেটি অপেক্ষাকৃত কম উত্তম বলে প্রমাণিত হয়, বা পারফেক্ট ছিল না বলেই প্রমাণিত হয়। এই বিষয়কে বহু সহীহ হাদিস ও তাফসীরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, প্রথমে বিধবা নারীর ইদ্দত (অপেক্ষাকাল) ছিল এক বছর

“তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং স্ত্রীদের রেখে যাবে, তাদের স্ত্রীদের জন্য নিজেদের (ঘরে) এক বছর পর্যন্ত উপকৃত হয়ে অবস্থান করা ফরজ…”
— [সূরা বাকারা ২:২৪০]

এরপর কিছু নারী এসে নবীকে অভিযোগ করল—এক বছর ইদ্দত পালন করা তাদের জন্য কঠিন। তখন নতুন আয়াত নাজিল হলো:

“আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং স্ত্রী রেখে যাবে, সেই নারীরা নিজেদের জন্য চার মাস দশ দিন অপেক্ষা করবে…”
— [সূরা বাকারা ২:২৩৪]

এই নতুন আয়াত পুরাতন আয়াতকে বাতিল বা বিধানটি প্রতিস্থাপিত করে। অর্থাৎ, আল্লাহ প্রথমে এক বছর ইদ্দতের বিধান দিলেন, পরে নারীদের প্রশ্ন/অভিযোগ বা সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তা কমিয়ে চার মাস দশ দিন নির্ধারণ করলেন। কিছু তাফসীরকারীর মতে, এই আয়াতটি একাধিকবার বাস্তব পরিস্থিতির কারণে সংশোধিত হয়। এরকম আরও অনেকগুলো উদাহরণ আছে। উদাহরণস্বরূপ:

  • কিবলা পরিবর্তন: প্রথমে মুসলিমরা নামাজে কিবলা হিসেবে বাইতুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) মুখ করে নামাজ পড়তেন; পরে কোরআনের নির্দেশে কাবার দিকে কিবলা পরিবর্তন হয় (সূরা বাকারা ২:১৪৪)।
  • মদ নিষিদ্ধকরণ: ধাপে ধাপে বদল; প্রথমে বৈধতা, পরে নামাজের সময় নিষিদ্ধ, পরে পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
  • যুদ্ধ ও ক্ষমা: প্রথম দিকে মুসলিমদের সহ্য ও ক্ষমা করতে বলা হয়েছিল (৭৩:১০, ১৫:৮৫), পরে জিহাদের অনুমতি (২২:৩৯-৪০), আর শেষের দিকে কঠোর যুদ্ধের আদেশ (৯:৫, ৯:২৯) আসে।

এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে একাধিকবার পূর্বের কোনো বিধান বাতিল করে নতুন বিধান দেয়া হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির বদল ঘটে, অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে আলাহর বিধানেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আল্লাহর মতের পরিবর্তন ঘটা সম্ভব। এই ধারনাটি আল্লাহর “ইচ্ছার পরিবর্তন” বা “প্রথমে এক রকম সিদ্ধান্ত, পরে আরেক রকম” নেওয়া এক জটিল দার্শনিক প্রশ্নের জন্ম দেয়:

  • যদি আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তাহলে কেন তিনি প্রথমে এক ধরনের বিধান দেন, পরে সেটি পরিবর্তন বা বাতিল করেন?
  • নাসেখ-মানসুখের ব্যাখ্যায় মুসলিম স্কলাররা সাধারণত বলেন, মানব সমাজের প্রয়োজন ও পরিস্থিতির বিবর্তন অনুযায়ী আল্লাহ নতুন নতুন বিধান দিয়েছেন; কিন্তু যৌক্তিক বিবেচনায়, এটি আল্লাহর পূর্বের বিধানটির ত্রুটিপূর্ণ হওয়াকে নির্দেশ করে।

এ প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, নাসেখ-মানসুখ কেবল মানবীয় সমাজ ও আইন পরিবর্তনের প্রয়োজনেই নয়, বরং আল্লাহর লিখিত স্ক্রিপ্টও ইতিহাসে একাধিকবার আপডেট করা হয়েছে—এ ধারণা সামনে আসে, যা আল্লাহর সর্বজ্ঞাতা ও তাকদীর নিয়ে আরও নতুন দার্শনিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। এই প্রশ্নগুলো ইসলামের মধ্যে ইশ্বরের ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত, এবং তাকদীর–এর সীমা নিয়ে যোক্তিক বিশ্লেষণ আরও জোরালো করে তোলে।


উপসংহার

আল্লাহর ফ্রি উইল বনাম পূর্বনির্ধারিত তাকদীরের এই দার্শনিক সমস্যাটি চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য এক গভীর উপলব্ধির জায়গা তৈরি করে। একদিকে, ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ তাআলার জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বব্যাপী এবং অপরিমেয়; অন্যদিকে, একই সূত্রে টানা হলে সেই অপরিবর্তনীয় গুণাবলীর যৌথ উপস্থিতিই একটি যৌক্তিক জটিলতা সৃষ্টি করে। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের মূলগ্রন্থ ও হাদিস থেকে তাকদীর-সংক্রান্ত বর্ণনাগুলি তুলে ধরে দেখেছি কীভাবে আল্লাহর সব জেনে রাখা পরিকল্পনা এবং তার তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইসলামের প্রাচীন ও আধুনিক আলেমগণ এই সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন – কেউ একে ঈশ্বরের গোপন রহস্য বলে হাত গুটিয়েছেন, কেউ যুক্তির খাতিরে আল্লাহকে কালাতীত বা সর্বোত্তম সিদ্ধান্তের অধিকারী বলে প্যারাডক্স দূর করতে চেয়েছেন। শেষমেশ বিষয়টি দাঁড়ায় এই যে, বিশ্বাসের জায়গা থেকে আল্লাহ একইসঙ্গে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান হতে পারেন, কিন্তু দার্শনিক ও যৌক্তিক বিবেচনায় এই দুইয়ের সহাবস্থান একটি বড় ধরণের টানাপোড়েন বা বৈপরীত্য তৈরি করে, যার পূর্ণ সমাধান দিতে না পেরে ইসলামের প্রখ্যাত স্কলারগণ একে ‘অলৌকিক রহস্য’ হিসেবে মেনে নিয়েছেন, এবং সবাইকে উৎসাহ দিয়েছেন এগুলো না বুঝেই অন্ধভাবে মেনে নিতে, এগুলো নিয়ে বেশি চিন্তা না করতে, বা এগুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নেই বলে গণ্য করতে। এই যৌক্তিক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে ইসলামের তাকদীর ও ফ্রি উইল সংক্রান্ত ধারণার ভিতে একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে – যা একদিকে আল্লাহর সর্বজ্ঞানী হওয়ার দাবীকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়, আবার অন্যদিকে তার সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণাতেও সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়। এই দ্বন্দ্ব Faith vs Reason-এর চিরন্তন বিতর্কের আরেকটি নিদর্শন, যা পাঠককে নিজ নিজ যুক্তিবোধ বা অন্ধবিশ্বাস অনুযায়ী বিবেচনা করতে হবে।



তথ্যসূত্রঃ
  1. সুনান আবু দাউদ(তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৭০০ ↩︎
  2. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ৬৫৯৬ ↩︎
  3. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ৩৩৪২ ↩︎
  4. সূরা আল-হাদীদ ৫৭:২২ ↩︎
  5. সূনান তিরমিজী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ২১৫৮ ↩︎
  6. সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিসঃ ২৫১৬ ↩︎