Table of Contents
- 1 প্রস্তাবনা
- 2 সাধারণ ন্যায়ভিত্তিক অসিয়তের নির্দেশ
- 3 নাসখ তত্ত্বের ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি
- 4 উত্তরাধিকারে নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ
- 5 মানসুখ ঘোষণা ও ফিকহি অবস্থান
- 6 সাহাবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ
- 7 হাদিস দ্বারা কোরআন রহিত হওয়ার সমস্যা
- 8 কোরআন ও হাদিসের মধ্যে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব
- 9 আল্লাহর সর্বজ্ঞতার সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা
- 10 উপসংহার
প্রস্তাবনা
ইসলামি ঐতিহ্যে কোরআনকে বলা হয় “আল্লাহর কালাম”, অর্থাৎ এমন একটি গ্রন্থ যা সর্বজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে, সময় ও স্থান নির্বিশেষে, চিরন্তন সত্য হিসেবে নাজিল হয়েছে। ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে, কোরআন শুধুমাত্র একটি গ্রন্থ নয়, সরাসরি আল্লাহর সিফাত বা বৈশিষ্ট্য, যা চিরন্তনঃ অনাদি ও অনন্ত। কিন্তু কোরআনের পাঠ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একই বিষয়ের উপর ধারাবাহিকভাবে নানা সময়ে ভিন্ন নির্দেশ এসেছে, যেগুলোর মধ্যে কিছু একে অপরকে কার্যত রহিত করেছে বা স্থানচ্যুত করেছে বলে ইসলামী তাফসীর ঐতিহ্যে ব্যাখ্যা করা হয়। নতুন বা আপডেটেড আয়াত দ্বারা পুরনো আয়াতকে রহিত করে দিয়ে নতুন বিধানকে প্রতিষ্ঠা করার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় নাসখ। ঠিক যেমনটি মানুষের তৈরি আইন করার পরে আইনটি ভাল ভাবে কাজ করছে কিনা, সেটি কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করা হয়, বিভিন্ন কেইস স্ট্যাডি এনালাইসিস করা হয়, এরপরে সেই কেইস স্ট্যাডির ওপর ভিত্তি করে আইনটিকে পুনরায় সংশোধন করা হয়। এটি মানুষের আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনীয়, যেখানে একটি বিধান বাস্তব প্রয়োগে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে সেটিকে সংশোধন করা হয়—কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে এই ধরনের পরীক্ষামূলক বা সংশোধনমূলক আচরণ কল্পনাতীত, কারণ তিনি তো সর্বজ্ঞ। ইসলামের বিধানগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ শুরুতে একটি আয়াত দেন, এরপরে দেখেন আইনটি ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, কাজ না করলে সংশোধিত আয়াত পাঠান, বা আগের আইনটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিয়ে নতুন বিধান দেন। কিন্তু আইন পরিবর্তনের এই বিষয়টি মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাভাবিক হলেও, আল্লাহর মত সর্বজ্ঞানী সত্তা কীভাবে এই কাজ করেন তা একটি জটিল প্রশ্ন।
এটি শুধুমাত্র কোরআনের অভ্যন্তরীণ আয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বহু ক্ষেত্রে হাদিস বা প্রফেটিক ব্যাখ্যাও কোরআনের সরাসরি ফরজ বিধানকে বাতিল করে দিয়েছে। এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় উত্তরাধিকার (মীরাস) বা ওয়াসিয়ত সংক্রান্ত আয়াতসমূহে। এখানে সেই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা হবে।
সাধারণ ন্যায়ভিত্তিক অসিয়তের নির্দেশ
কোরআনের প্রথমদিককার আয়াতগুলোতে উত্তরাধিকার বা সম্পদ বণ্টনের নির্দিষ্ট অনুপাত নির্ধারণ করা হয়নি; বরং মানুষকে বলা হয়েছিল যেন তারা মৃত্যুর আগে পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য অসিয়ত বা উইল করে যায় এবং তা যেন ন্যায় ও সৎভাবে করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ এই বিষয়ে খুব বেশি স্পেসিফিক ছিলেন না, কাকে কতটুকু দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেননি, মানুষকেই এই এখতিয়ার দিয়েছিলেন তারা যেন তাদের জ্ঞানবুদ্ধি মোতাবেক তারা যা ন্যায়সঙ্গত মনে করে সেই হিসেবে অসিয়ত করে যায় [1]
“তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে, যদি তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, এবং সে সম্পদ রেখে যায়, তবে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ন্যায়সংগত ওয়াসিয়ত করো। এটি মুত্তাকিদের উপর এক কর্তব্য।”
এখানে শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ — “কুতিবা ‘আলাইকম”, অর্থাৎ “তোমাদের উপর ফরজ করা হলো।” অর্থাৎ, পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য উইল করা ছিল এক বাধ্যতামূলক ফরজ বিধান বা মুসলিমদের জন্য অবশ্য কর্তব্য বিধান। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে, ইসলামি সমাজে বংশ, শক্তি ও ব্যক্তির ইচ্ছার ভিত্তিতে সম্পদ বণ্টন চলত; তাই এই আয়াতটি ছিল তাদের জন্য একটি নৈতিক ও ন্যায়ভিত্তিক নির্দেশনা — যা মানুষকে উইল করার স্বাধীনতা দিয়েছিল এবং কোরআন তাদেরকে সেই উইলটি ন্যায়ের ভিত্তিতে করার ব্যাপারে জোর দিয়েছিল। তবে সেই ন্যায়টি কেমন হবে, তা নির্দেশ দেয়নি, অর্থাৎ কাকে কতটুকু দিতে হবে সেই ন্যায়ের বিষয়টি মানুষের হাতেই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
নাসখ তত্ত্বের ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তি
ناسخ (নাসিখুন) ইস্মে ফায়িল এর একবচন। نسخ (নাস্খুন) মূলধাতু থেকে নির্গত। যার লুগাতী বা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বদল করা, দূরীভূত করা, স্থলাভিষিক্ত করা, বাতিল করা, পরিবর্তণ করা, চুড়ান্ত ব্যাখ্যা করা ইত্যাদি। তবে ناسخ (নাসিখুন) শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যাখাকারী। منسوخ (মানসূখুন) শব্দটি অনুরূপ نسخ (নাস্খুন) মূলধাতু থেকে উদগত। যার লুগাতী বা আভিধানিক অর্থ হলো, বদল করা, দূরীভূত করা, স্থলাভিষিক্ত করা।
ইসলামী আইনতত্ত্বে “নাসখ” বা আয়াত রহিত হওয়ার ধারণাটি একটি মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। তাফসীরবিদ ও উসূলুল ফিকহবিদগণ একে আল্লাহর প্রজ্ঞার অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন—যে আল্লাহ সময় ও সমাজ অনুযায়ী বিধান পরিবর্তন করে মানবজাতিকে ধাপে ধাপে পরিপক্ব করে তোলেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যা দার্শনিকভাবে একটি স্পষ্ট সংশয় তৈরি করে, কারণ সময় ও পরিস্থিতির প্রভাবে পরিবর্তন ঘটে এমন কোনো জ্ঞান বা বিধানকে “চিরন্তন” বা “অপরিবর্তনীয়” বলা যৌক্তিকভাবে অসঙ্গত। ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে এই বিষয় নিয়ে আল-শাতিবি, ইবনুল-কাইয়্যিম, এবং আল-গাযালীর মতো চিন্তাবিদদের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা যায়।
নাসখ ধারণাকে সমর্থনকারীরা যুক্তি দেন যে, ইসলামী বিধানগুলো এক ধাপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি—বরং নবী মুহাম্মদের জীবনের নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন: মদ নিষিদ্ধকরণ, যুদ্ধনীতি, বা নারীদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান ধীরে ধীরে কঠোর রূপ নিয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো যদি সামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী হয়, তাহলে এগুলো স্পষ্টতই মানবীয় ঐতিহাসিক আইন, চিরন্তন ঈশ্বরীয় বিধান নয়। যারা এই ধরণের বাস্তববাদী প্রেক্ষাপটকে আমলে নিয়ে ব্যাখ্যা করেন, তারা আল্লাহর সর্বজ্ঞতার ধারনাকেই যে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেন, তারা সেটি বোঝেন না। উল্লেখযোগ্য যে, কোরআনে নাসখের ধারণা সরাসরি স্বীকৃত একটি বিষয়—যেমন, কোরআনে [2] বলা হয়েছে, “আমি কোনো আয়াত রহিত করি না বা ভুলিয়ে দিই না, কিন্তু তার চেয়ে উত্তম বা অনুরূপ কিছু আনয়ন করি।” এই আয়াতের মাধ্যমেই ইসলামী আইনতত্ত্বে নাসখের শাস্ত্রীয় ভিত্তি তৈরি হয়। কিন্তু এই স্বীকৃতিই আবার একটি গভীর প্রশ্ন তৈরি করে: যদি পূর্বের আয়াত আল্লাহপ্রদত্ত হয়, তবে তার “ভুলিয়ে দেওয়া” বা “প্রতিস্থাপন” করার প্রয়োজন কেন?”
এই ব্যাখ্যা আল্লাহর জ্ঞানের পরিপূর্ণতার সঙ্গে একটি যৌক্তিক টানাপোড়েন তৈরি করে। কারণ, যদি আল্লাহর জ্ঞান কালাতীত ও সম্পূর্ণ হয়, তবে কোনো নির্দেশ “সময় অনুযায়ী” পরিবর্তনের প্রয়োজন হওয়া তাঁর পরিপূর্ণতার ধারণার বিপরীত। ইসলামি চিন্তায় আল-গাযালী এই সংকট সমাধানে যুক্তি দেন যে, “নাসখ” আল্লাহর জ্ঞানে নয়, বরং মানুষের উপলব্ধিতে পরিবর্তন আনে; কিন্তু এই ব্যাখ্যা সমালোচিত হয়েছে কারণ এতে বাস্তব পরিবর্তনকে কেবল ধারণাগত পরিবর্তন হিসেবে দেখানো হয়। এবারে প্রখ্যাত আলেম ড. আবু বকর যাকারিয়ার মুখ থেকেই সরাসরি শুনি, নাসেখ মানসুখ বিষয়টি সম্পর্কে,
এবারে আসুন শায়েখ আহমদুল্লাহর বক্তব্য শুনি,
উত্তরাধিকারে নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারণ
পরবর্তীতে কোরআনে আরও স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট আইন নাজিল হলো। [3] [4]
“আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের বিষয়ে নির্দেশ দেন: পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান…”
এবং
“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের পর উত্তরাধিকার পাবে নির্ধারিত অংশ অনুযায়ী…”
এখানে দেখা যায়, কে কত অংশ পাবে, তা বিস্তারিতভাবে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো। ফলে, পিতামাতা এবং নিকটাত্মীয়গণ কে কতটুকু উত্তরাধিকার পাবে সেটি আর মানুষের বোধবুদ্ধির ওপর থাকলো না, সেটি আল্লাহর দ্বারা নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই নির্দিষ্ট অংশগুলো এমনভাবে নির্ধারিত যাতে পুরুষদের অংশ সবসময় নারীদের দ্বিগুণ হয়। ইসলামী তাফসিরে একে ন্যায়ের প্রতিফলন বলা হলেও, আধুনিক ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় এটি একটি সামাজিক কাঠামোগত পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব হিসেবে দেখা হয়, যা সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য হারায়। এই প্রেক্ষিতে অনেক সমকালীন ইসলামি চিন্তাবিদ এই অংশগুলোকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পড়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
মানসুখ ঘোষণা ও ফিকহি অবস্থান
আল্লাহ সূরা নিসাতে সম্পত্তি কে কতটুকু পাবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়ার কারণে, পূর্বে বর্ণিত ইনসাফমূলক ওয়াসিয়ত করার বিধানটি আর কার্যকর রইলো না। অর্থাৎ সেটি রহিত হয়ে গেল। সেটি কোরআনে এখনো আছে, কিন্তু এই আয়াতের আর কোন কার্যকারীতা নেই। আসুন এই বিষয়ে তাফসীরে ইবনে কাসীরে কী বলা আছে দেখে নিই, [5]



অর্থাৎ, যে বিধানকে কোরআন নিজেই ফরজ বা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছিল, তা পরবর্তীতে নতুন আয়াত দ্বারা অকার্যকর ঘোষিত হয়েছে—যা পাঠ বিশ্লেষণে একপ্রকার স্ববিরোধ তৈরি করে। আবার, আরেকজন প্রখ্যাত তাফসীরকারক কুরতুবি তার তাফসিরে (Al-Jami‘ li Ahkam al-Qur’an) লিখেছেন,
এটি প্রথমে ফরজ ওয়াজিব ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে উত্তরাধিকার বণ্টনের আয়াতসমূহ দ্বারা রহিত হয়ে যায়। এখন এটি শুধুমাত্র অ-উত্তরাধিকারীদের জন্য প্রযোজ্য।
এই ব্যাখ্যাগুলো ইসলামী ঐক্যমতের অবস্থানকে পরিষ্কার করে — সূরা বাকারার ১৮০ নম্বর আয়াতটি মানসুখ, অর্থাৎ রহিত। অর্থাৎ আল্লাহ শুরুতে সকলের জন্য এই ফরজ বিধান দিলেও, পরবর্তীতে এই আয়াতটি আর সকলের জন্য ফরজ রইলো না। ফিকাহশাস্ত্রে নাসখের প্রয়োগ কেবল এই আয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়; আলেমদের মতে, প্রায় ২০০-৫০০ টি আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ বা অমুসলিমদের সাথে মিলেমিশে সহাবস্থান সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে “আয়াতুস সাইফ” বা তরবারির আয়াত অর্থাৎ সূরা আত-তাওবার ৫ এবং ২৯ নম্বর আয়াত দ্বারা রহিত করা হয়েছে। এই ব্যাপক নাসখ-ধারণা ইসলামী শরিয়াহকে একটি গতিশীল আইনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তা আল্লাহর বাণীর অভ্যন্তরীণ সামঞ্জস্য নিয়ে আরও প্রশ্ন তোলে।
সাহাবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ
তবে সব সাহাবী এই বিষয়ে একমত ছিলেন না। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আব্বাস দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করতেন যে সূরা বাকারার ১৮০ নম্বর আয়াতটি মানসুখ হয়নি, বরং তা এখনও প্রযোজ্য। তিনি বলেছিলেন, [6]
ওয়াসিয়তের ফরজিয়ত রহিত হয়নি; বরং এটি সেই উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রে নয়, বরং যারা উত্তরাধিকারী নয় তাদের জন্য।
একইসাথে, ইবনে আব্বাস পরবর্তীতে তার মতামত বদলে ফেলেছিলেন বলেও জানা যায়, যা নিচে হাদিসের অংশে বর্ণিত হবে। অন্যদিকে, ইবনে উমর, আয়েশা ও অন্যান্য সাহাবীদের মতে এটি সম্পূর্ণভাবে রহিত — কোনো দ্ব্যর্থতা নেই। এই মতভেদ প্রমাণ করে যে, কোরআনের আয়াতগুলোর মানে ও প্রযোজ্যতা নিয়ে প্রথম প্রজন্মের মধ্যেই বিভ্রান্তি ছিল। অথচ কোরআন নিজেই দাবি করে, [7]
“আমি কোরআনকে সহজ করেছি, যাতে মানুষ তা বুঝতে পারে।”
তাহলে যদি কোরআন সত্যিই “সহজ ও স্পষ্ট” হতো, তবে কেন প্রথম প্রজন্মের মুসলিমরাই বুঝতে পারেননি কোন আয়াত কার্যকর আর কোনটি রহিত?
হাদিস দ্বারা কোরআন রহিত হওয়ার সমস্যা
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো — শুধু পরবর্তী আয়াত নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে হাদিস দ্বারা কোরআনের ফরজ বিধান রহিত হয়েছে।উদাহরণস্বরূপ, 2:180 আয়াতে ওয়াসিয়ত করার নির্দেশ স্পষ্টভাবে “ফরজ” বলা হয়েছিল, কিন্তু হাদিসে এসেছে, [8] [9]
সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
১২/ ওসিয়াত প্রসঙ্গে
পরিচ্ছেদঃ ৫. পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ওসিয়াত বাতিল
২৮৬৯। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন (আল্লাহর বাণীঃ) ’’তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়ের জন্য প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ওসিয়াত করা তোমাদের উপর ফরয’’[সূরা আল-বাকারাহঃ ১৮০] ওসিয়াতের নিয়ম এভাবেই ছিলো। পরে উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধান অবতীর্ণ হলে এ আয়াত মানসূখ হয়ে যায়।[1]
[1]. হাসান সহীহ।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)
সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
২৮/ ওয়াসিয়াত
পরিচ্ছেদঃ ৫. উত্তরাধিকারীদের জন্য ওয়াসিয়াত করার বৈধতা নেই
২১২০। আবূ উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, বিদায় হাজের খুৎবায় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক হক্দারের হক (নির্দিষ্ট করে) দিয়েছেন। অতএব, উত্তরাধিকারীদের জন্য ওয়াসিয়াত করা বৈধ নয়। সন্তান বিছানার (মালিকের); আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর। তাদের সর্বশেষ ফায়সালার ভার আল্লাহ্ তা’আলার উপর। যে লোক নিজের বাবাকে পরিত্যাগ করে আরেকজনকে বাবা বলে পরিচয় দেয় এবং যে গোলাম নিজের মনিব ব্যতীত অন্য মনিবের পরিচয় দেয় তার উপর অব্যাহতভাবে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলার অভিশাপ। স্ত্রী তার স্বামীর বিনা অনুমতিতে তার ঘর হতে কোন কিছু ব্যয় করবে না। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। খাদ্যদ্রব্যও নয়? তিনি বললেনঃ এটাতো আমাদের সর্বোত্তম সম্পদ। তিনি আরো বললেনঃ ধারকৃত বস্তু ফেরত যোগ্য, মানীহা (দুধপানের উদ্দেশ্যে ধার করা পশু) ফেরত দিতে হবে, ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং যামিনদার দায়বদ্ধ থাকবে।
সহীহ, ইবনু মা-জাহ (২৭১৩)।
আবূ ঈসা বলেন, আমর ইবনু খা-রিজাহ (রাঃ) ও আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছেদে হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি হাসান সহীহ। এ হাদীসটি আবৃ উমামা (রাঃ) হতে অপরাপর সূত্রেও বর্ণিত আছে।
ইরাক ও হিজাযবাসীদের হতে ইসমাঈল ইবনু আইয়্যাশের একক বর্ণনাগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তিনি তাদের সূত্রে বহু মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে সিরিয়াবাসীদের সূত্রে বর্ণিত তার হাদীসসমূহ অনেক বেশি সহীহ। মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী এরকম কথাই বলেছেন।
তিনি আরো বলেছেন, আমি আহমাদ ইবনু হাম্বলকে বলতে শুনেছি যে, বাকিয়্যার তুলনায় ইসমাঈল ইবনু আইয়্যাশের অবস্থা সন্তোষজনক। বাকিয়া সিকাহ্ বর্ণনাকারীদের সূত্রেও মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছেন। আমি আবদুল্লাহ ইবনু আবদুর রাহমানকে বলতে শুনেছি, আমি যাকারিয়া ইবনু আদীকে বলতে শুনেছি, আবূ ইসহাক আল-ফাযারী বলেন, সিকাহ বর্ণনাকারীদের সূত্রে বাকিয়া যা কিছু বর্ণনা করেন তোমরা তা গ্রহণ কর। আর নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য যাদের সূত্রেই ইসমাঈল ইবনু আইয়্যাশ হাদীস বর্ণনা করুন না কেন তোমরা তা গ্রহণ করো না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ উমামাহ্ বাহিলী (রাঃ)
এই হাদিসের মাধ্যমে কোরআনের ফরজ বিধান সরাসরি বাতিল করে দেওয়া হলো। অর্থাৎ, আল্লাহর “ফরজ করা” আদেশকে একটি হাদিসের বর্ণনা নাকচ করে দিল — যা যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন তোলে, কোরআন আসলেই সর্বশেষ কর্তৃত্ব কি না। অর্থাৎ, আল্লাহর হুকুম এবং নবীর হুকুম পরস্পরবিরোধী হলে, দেখা যাচ্ছে, মুসলিমদের কাছে আল্লাহর চাইতে নবীর হুকুমই প্রাধান্য পাচ্ছে।
আর সেই নবীর হুকুমটিও যদি আসলে আল্লাহই হুকুম হয়ে থাকে, তাহলে কেন তিনি পূর্বে এমন একটি আয়াত নাজিল করলেন, তা আবার রহিত করে দেয়ার প্রয়োজন হলো? উনার কাছে তো সম্পূর্ণ কোরআনটিই পূর্ব থেকেই লিখিত ছিল। একবারে আসল আয়াতটি নাজিল করলেই হতো। তাহলে তো আর নবীর দ্বারা আল্লাহর আয়াত বাতিল করার দরকার হতো না। আলাহর মান সম্মান কী তাতে রক্ষা পেতো না?
কোরআন ও হাদিসের মধ্যে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব
ইসলামী ফিকহের অন্যতম গভীর প্রশ্ন হলো, কোরআন ও হাদিসের মধ্যে কে সর্বোচ্চ উৎস? কোরআন নিজেকে আল্লাহর সরাসরি বাণী হিসেবে দাবি করে, অন্যদিকে হাদিস হলো নবীর কথামালা—যা অনেক সময় শ্রুতান্তর, অনুমান ও সনদনির্ভর। কিন্তু বাস্তবে ফিকহে দেখা যায়, হাদিসের একটি বর্ণনা কোরআনের স্পষ্ট ফরজ বিধানকেও রহিত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামী আইন ব্যবস্থা একটি হায়ারার্কিক্যাল অস্পষ্টতা তৈরি করে—যেখানে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব কোরআনের না নবীর, তা একটি বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়। দার্শনিকভাবে এটি ইসলামের এই বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, কারণ একই ঐশ্বরিক উৎস থেকে আসা দুটি বার্তা যদি পরস্পরবিরোধী হয়, তবে ঐ উৎসের অপরিবর্তনীয়তার দাবিটি যৌক্তিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই প্রশ্নটি শুধু ধর্মীয় ব্যাখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ‘authority of revelation’ বা ‘epistemic hierarchy’–এর প্রশ্নও। যদি নবীর হাদিস কোরআনের উপরে প্রাধান্য পায়, তবে ইসলামের জ্ঞানের উৎস দুটি নয় বরং পরস্পরবিরোধী দুটি স্তরে বিভক্ত হয়ে পড়ে—যা ইসলামী আকীদার একত্ববাদী কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আল্লাহর সর্বজ্ঞতার সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা
যদি কোরআনকে আল্লাহর চূড়ান্ত ও নিখুঁত বাণী ধরা হয়, তবে এই আয়াত পরিবর্তন ও রহিতকরণ (নাসখ) ধারণাটি এক গভীর যৌক্তিক সংকট তৈরি করেঃ এক সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞাতা সত্তা যদি প্রকৃত অর্থে সবকিছু পূর্বেই জানেন, তবে তাঁর প্রদত্ত নির্দেশ পরে সংশোধনের প্রয়োজন কেন দেখা দেয় — এটি একটি গভীর ধর্মতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। আল্লাহর কেন নিজের দেয়া বিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে? কোরআনের প্রতিটি আয়াতই তো সর্বজ্ঞানীর কাছ থেকে আসা সর্বশেষ এবং শতভাগ ত্রুটিমুক্ত বিধান হওয়ার কথা। যা সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তা ত্রুটিহীন কীভাবে হয়? যদি প্রতিটি আয়াত সর্বজ্ঞানীর পক্ষ থেকে আগত, পরিপূর্ণ ও ত্রুটিমুক্ত হয়, তবে তা পরবর্তী আয়াতে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আল্লাহর বাণীর স্থায়িত্ব ও চূড়ান্ততার দাবিকে ভুল প্রমাণ করে। কোরআন নিজেই বলে, [10]
আল্লাহর বাণীতে কোনো পরিবর্তন নেই।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, সেই বাণীতেই পরিবর্তন ঘটছে — নতুন আয়াত পুরনো আয়াতকে বাতিল করছে। এই পরিবর্তনগুলো মানুষিক আইন প্রণয়নের মতো মনে হয়, যেখানে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিয়ম পরিবর্তন করা হয় — যা “সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞাতা”র ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাফসির ইবন কাসির ও কুরতুবি উভয়েই সূরা ইউনুসের ৬৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, “আল্লাহর বাণীতে কোনো পরিবর্তন নেই” — এটি তাঁর প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যা একটি ব্যাকরণিক ফাঁক তৈরি করে: যদি কোরআন সম্পূর্ণই আল্লাহর বাণী হয়, তবে তার অংশবিশেষকে প্রতিশ্রুতি ও অংশবিশেষকে বিধান হিসেবে আলাদা করা নিজেই মানবিক ব্যাখ্যা, ঐশ্বরিক নয়।
উপসংহার
উত্তরাধিকারবিষয়ক আয়াতের ইতিহাস কোরআনের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের একটি শক্ত উদাহরণ। প্রথমে আল্লাহ যা “ফরজ” করেছিলেন, তা পরে নিজেই “মানসুখ” করে দিয়েছেন; আবার হাদিসের মাধ্যমে সেই ফরজকেও “নিষিদ্ধ” ঘোষণা করা হয়েছে। এ থেকে দুটি মৌলিক প্রশ্ন উদ্ভব হয়:
- সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা কেন এমন একটি আয়াত নাজিল করবেন, যা পরে পরিবর্তন করতে হয়?
- যদি কোরআন “সহজ ও স্পষ্ট” হয়, তবে কেন প্রথম প্রজন্মের সাহাবীরাই বুঝতে পারেননি কোন বিধান কার্যকর আর কোনটি রহিত?
এই প্রশ্নগুলো ইসলামী আইনশাস্ত্রের সীমা ছাড়িয়ে, ওহির উৎসের সত্যতা, ঐশ্বরিক বার্তার সামঞ্জস্য এবং সর্বজ্ঞতার ধর্মতত্ত্ব — এই তিনটি মূল স্তম্ভের উপর যৌক্তিক পুনর্বিবেচনার দাবি তোলে।
তথ্যসূত্রঃ
- সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১৮০ ↩︎
- সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২০৬ ↩︎
- সূরা আন-নিসা, আয়াত ১১ ↩︎
- সূরা আন-নিসা, আয়াত ১২ ↩︎
- তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৬-৮৮ ↩︎
- তাফসির ইবনে আবি হাতিম, ব্যাখ্যা 2:180 ↩︎
- সূরা আল-কামার, আয়াত ১৭ ↩︎
- সুনান আত-তিরমিজি, হাদিসঃ ২১২০ ↩︎
- সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ২৮৬৯ ↩︎
- সূরা ইউনুস, আয়াত ৬৪ ↩︎