Table of Contents
ভূমিকা
ইসলামি বর্ণনামতে, মুহাম্মদের কাছে কোরআন একাধিক উপভাষায় বা ‘আহরুফ’ এ নাজিল হয়েছিল, যার সংখ্যা সাতটি বলে বলা হয়। এই সাত ‘আহরুফ’ বা ডায়ালেক্ট বা উপভাষা নিয়ে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে বহু বিতর্ক রয়েছে, কেউ কেউ এটিকে আরবদের বিভিন্ন গোত্রভিত্তিক উচ্চারণ ও বাক্যগঠনের পার্থক্য হিসেবে দেখেন, আবার কেউ ব্যাখ্যা করেন অর্থগত দিক থেকে কিছুটা ভিন্ন হলেও গ্রহণযোগ্য পাঠ হিসেবে। মূলত, আরব সমাজের ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে এই বহুবিধ পাঠ রূপ অনুমোদন করা হয়েছিল বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীকালে তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফান নবী মুহাম্মদের কোন নির্দেশনা ছাড়াই কুরআনের একটি নির্দিষ্ট পাঠ রূপ (হাফস বা কুরাইশি উপভাষা) নির্ধারণ করে অন্য পাঠ রূপগুলিকে ধ্বংস করার আদেশ দেন। তার যুক্তি ছিল, উম্মাহর মধ্যে বিভ্রান্তি যেন না ঘটে সে কারণেই তিনি এমনটি করেছিলেন। ফলে বর্তমানে প্রচলিত কুরআন পাঠ মূলত ঐ নির্দিষ্ট উপভাষার উপর ভিত্তি করেই সংরক্ষিত।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সমস্যা
সহীহ বুখারীতে একাধিক হাদিসে বর্ণিত আছে যে নবী মুহাম্মদ নিজেই বলেছেন—জিবরাইল তাকে একভাবে কোরআন শিক্ষা দেন, পরে তার অনুরোধে পাঠের ধরন সাতবার পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ, ঐশ্বরিক দূত নিজেই কোরআনের একাধিক রূপ শিক্ষা দিয়েছেন। কোরআন যদি “পরিপূর্ণ, অপরিবর্তনীয় ও সংরক্ষিত” ঈশ্বরীয় বাণী হয়, তাহলে তার সাতটি পৃথক রূপ থাকা মানে এই যে—ঈশ্বর নিজেই নিজের বাণীতে বৈচিত্র্য, পরিবর্তন ও বিকল্প স্বীকার করেছেন। এই সম্পর্কে মুহাম্মদের নির্দেশ ছিল যে, তোমাদের জন্য যেই পদ্ধতি সহজতর, তোমরা সেই পদ্ধতিতেই পড় [1] [2] [3]
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৩/ ফাজায়ীলুল কুরআন
পরিচ্ছেদঃ ২৩৯৯. কুরআন সাত উপ (আঞ্চলিক) ভাষায় নাযিল হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৬২৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯৯১
৪৬২৯। সাঈদ ইবনু উফায়র (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিবরীল(আলাইহিস সালাম) আমাকে একভাবে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। এরপর আমি তাকে অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলাম এবং পুনঃ পুনঃ অন্যভাবে পাঠ করার জন্য অব্যাহতভাবে অনুরোধ করতে থাকলে তিনি আমার জন্য পাঠ পদ্ধতি বাড়িয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তিনি সাত উপ (আঞ্চলিক) ভাষায় তিলাওয়াত করে সমাপ্ত করলেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৩/ ফাজায়ীলুল কুরআন
পরিচ্ছেদঃ ২৩৯৯. কুরআন সাত উপ (আঞ্চলিক) ভাষায় নাযিল হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৬৩০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯৯২
৪৬৩০। সাঈদ উব্ন উফায়র (রহঃ) … উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হিশাম ইবনু হাকীম (রাঃ) কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় সূরা ফুরকান তিলাওয়াত করতে শুনেছি এবং গভীর মনোযোগ সহকারে আমি তার কিরাআত শুনেছি। তিনি বিভিন্নভাবে কিরাআত পাঠ করেছেন; অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এভাবে শিক্ষা দেননি। এ কারনে সালাত (নামায/নামাজ)-এর মাঝে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্যত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু বড় কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর সে সালাম ফিরালে আমি চাঁদর দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে এ সূরা যে ভাবে পাঠ করতে শুনলাম, এভাবে তোমাকে কে শিক্ষা দিয়েছে? সে বলল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই আমাকে এভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। আমি বললাম, তুমি মিথ্যা বলছ। কারন, তুমি যে পদ্ধতিতে পাঠ করেছ, এর থেকে ভিন্ন পদ্ধতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
এরপর আমি তাকে জোর করে টেনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে গেলাম এবং বললাম, আপনি আমাকে সূরা ফুরকান যে পদ্ধতেত পাঠ করতে শিখিয়েছেন এ লোককে আমি এর থেকে ভিন্ন পদ্ধতিতে তা পাঠ করতে শুনেছি। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। হিশাম, তুমি পাঠ করে শোনাও। তারপর সে সেভাবেই পাঠ করে শোনাল, যেভাবে আমি তাকে পাঠ করতে শুনেছি। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এভাবেই নাযিল করা হয়েছে। এরপর বললেন, হে উমর! তুমিও পড়। সুতরাং আমাকে তিনি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন, সেভাবেই আমি পাঠ করলাম। এবারও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এভাবেও কুরআন নাযিল করা হয়েছে। এ কুরআন সাত উপ (আঞ্চলিক) ভাষায় নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের জন্য যা সহজতর, সে পদ্ধতিতেই তোমরা পাঠ কর।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
অর্থাৎ মুহাম্মদের নির্দেশ ছিল, যেকোন মুসলিম এই সাতটি উপভাষার যেকোনটি অনুসরণ করে, যেকোনভাবে পড়তে পারে। যার কাছে যেটি সহজ মনে হবে, সে সেইটিই পড়বে। যেকোন পদ্ধতিতে পড়ার যেখানে স্বয়ং নবীর অনুমতি ছিল, সেগুলো উসমানের নির্দেশনাতে নষ্ট করে ফেলা হয় কীভাবে? উসমানকে এই ক্ষমতা কে দিলো, যে সে আল্লাহর প্রেরিত ছয় উপভাষার কোরআন পুড়িয়ে ফেলে?
উসমানের কোরআন পোড়ানো
বর্তমান সময়ে আমরা যেই কোরআন দেখি, সেটি আসলে সংকলন করেছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান। সংকলনের পরে হযরত উসমান ঘোষণা দিলেন যে, যার কাছে যত কোরআন আছে সেগুলো সব পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যখন কুফাতে শোনা গেল যে, তাদের কাছে সংরক্ষিত সব কোরআনের আয়াত পুড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র যায়েদ ইবন সাবেতের মুসহাফ এখন থেকে ব্যবহার করতে হবে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ এর তীব্র বিরোধিতা করলেন। কিন্তু যায়েদ ইবন সাবেটের কোরআন তো মাত্র একটি ডায়ালেক্ট অনুসারে ছিল। বাদবাকি ছয়টি ডায়ালেক্ট, যা মুহাম্মদের ওপর নাজিল হয়েছিল, সেগুলোর কী হলো?
উসমান যখন কোরআন সংকলন করেন, তিনি কুরাইশদের আঞ্চলিক ভাষার কোরআন ছাড়া বাদবাকি সকল কোরআনের কপি, কাগজে লিখিত কিংবা পাতায় লিখিত সমস্ত কোরআনের অংশ পুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সেইসকল খণ্ড খণ্ড অংশ বা পাতা তো ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল ছিল, যা খুব সহজেই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রাখা যেতো। সেটি না করে তিনি সব পুড়িয়ে ফেললেন কেন? [4]
সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৩/ ফাজায়ীলুল কুরআন
পরিচ্ছেদঃ কুরআন সংকলন
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৬২৬, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯৮৭ – ৪৯৮৮
৪৬২৬। মূসা (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) একবার উসমান (রাঃ) এর কাছে এলেন। এ সময় তিনি আরমিনিয়া ও আযারবাইজান বিজয়ের ব্যাপারে সিরীয় ও ইরাকী যোদ্ধাদের জন্য রণ-প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কুরআন পাঠে তাঁদের মতবিরোধ হুযায়ফাকে ভীষণ চিন্তিত করল। সুতরাং তিনি উসমান (রাঃ) কে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! কিতাব সম্পর্কে ইহুদী ও নাসারাদের মত মত পার্থক্যে লিপ্ত হবার পূর্বে এই উম্মতকে রক্ষা করুন। তারপর উসামান (রাঃ) হাফসা (রাঃ) এর কাছে জনৈক ব্যাক্তিকে এ বলে পাঠালেন যে, আপনার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের সহীফাসমূহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা সেগুলোকে পরিপূর্ণ মাসহাফসমূহে লিপিবদ্ধ করতে পারি। এরপর আমরা তা আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব।
হাফসা (রাঃ) তখন সেগুলো উসমান (রাঃ) এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এরপর উসমান (রাঃ) যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ), সাঈদ ইবনু আস (রাঃ) এবং আবদুর রহমান ইবনু হারিস ইবনু হিশাম (রাঃ) কে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মাসহাফে তা লিপিবদ্ধ করলেন। এ সময় উসমান (রাঃ) তিনজন কুরাইশী ব্যাক্তিকে বললেন, কুরআনের কোন বিষয়ে যদি যায়দ ইবনু সাবিতের সঙ্গে তোমাদের মতপার্থক্য দেখা দেয়, তাহলে তোমরা তা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে। কারণ, কুরআন তাদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তাঁরা তাই করলেন। যখন মূল লিপিগুলো থেকে কয়েকটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয়ে গেল, তখন উসমান (রাঃ) মূল লিপিগুলো হাফসা (রাঃ) এর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি কুরআনের লিখিত মাসহাফ সমূহের এক একখানা মাসহাফ এক এক প্রদেশে পাঠিয়ে দিলেন এবং এতদভিন্ন আলাদা আলাদা বা একত্রে সন্নিবেশিত কুরআনের যে কপিসমূহ রয়েছে তা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
ইবনু শিহাব (রহঃ) খারিজা ইবনু যায়দ ইবনু সাবিতের মাধ্যমে যায়দ ইবনু সাবিত থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা যখন গ্রন্থকারে কুরআন লিপিবদ্ধ করছিলাম তখন সূরা আহযাবের একটি আয়াত আমার থেকে হারিয়ে যায়; অথচ আমি তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পাঠ করতে শুনেছি। তাই আমরা অনুসন্ধান করতে লাগলাম। অবশেষে আমরা তা খুযায়মা ইবনু সাবিত আনসারী (রাঃ) এর কাছে পেলাম। আয়াতটি হচ্ছে এইঃ “মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সঙ্গে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে, তাদের কেউ কেউ শাহাদত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তাঁরা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি”। (৩৩: ২৩)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
একইভাষাভাষী উমর ও হিশামের কিরআত পার্থক্য
উপরে বর্ণিত হাদিসটি একটি বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। পাঠক লক্ষ্য করুন, উমর ইবনু খাত্তাব বা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন মক্কার কোরাইশ বংশের মানুষ। একইসাথে, হিশাম ইবনু হাকীম বা হিশাম ইবনু হাকীম ইবনু হিযামও মক্কার কোরাইশ ভাষাভাষী। বর্ণিত আছে, তিনিই আরবের একমাত্র সন্তান যে কাবার অভ্যন্তরে ভূমিষ্ট হয়েছেন। তার মা সন্তান প্রসবের অন্তিম সময়ে বান্ধবীদের সাথে কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেলে সেখানে প্রসব বেদনা হয়ে হাকিম ইবনে হিযাম জন্ম গ্রহণ করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, একই কোরাইশ বংশের দুইজন মানুষ, যাদের ভাষা সম্পূর্ণভাবে একই, তাদের দুইজনকে দুইটি ভিন্ন উপভাষায় বা ডায়ালেক্টে কোরআন শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন হলো কেন? নবী মুহাম্মদ কেন দুইজন ব্যক্তি যাদের উচ্চারণরীতি একই এবং যাদের জন্ম একই স্থানে, তাদের ভিন্ন ডায়ালেক্টে কোরআন শিক্ষা কেন দিলেন? [5]

এখানেই যুক্তিগত অসঙ্গতি সবচেয়ে স্পষ্ট। যখন দুইজন একই ভাষা, উচ্চারণ ও গোত্রভুক্ত, তখন ভিন্ন “আহরুফে” কোরআন শেখানোর কোনো অর্থই দাঁড়ায় না। এটি কেবল বোঝায় যে, মুহাম্মদ নিজেই বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে পাঠ করেছেন, এবং পরবর্তী অনুসারীরা তার ভিন্ন পাঠরূপগুলোকে “আল্লাহর মোজেজা” হিসেবে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
ভাষাগত ও সামাজিক ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা
ইসলামী আলেমগণ বলেন, আরব সমাজের গোত্রীয় ভাষাগত বৈচিত্র্যের কারণে বহুভাষিক পাঠ অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু এই যুক্তিও টেকে না। কারণ, কোরআন নিজেকে সর্বজনীন বার্তা দাবি করে—যা আরব নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। তাহলে কেন সেই “সর্বজনীন বাণী” শুরু থেকেই কেবল আরবদের ভাষাগত দুর্বলতা সামলাতে সাত ভিন্ন রূপে পাঠাতে হবে? আল্লাহই বা কেন এরকম একটি ভাষা বেছে নিলেন, যেই ভাষাতে তাঁর কথাকে সাতটি ভিন্ন রূপে পাঠাতে হবে?
আরও গুরুতর প্রশ্ন: কোরআন যদি “মহান আল্লাহর কালাম”, তবে তিনি কি এতটাই ভাষাগত সীমাবদ্ধ যে একই বার্তা সাতভাবে পাঠাতে হলো? বরং এটি স্পষ্ট করে যে, কোরআন একটি মানবসৃষ্ট মৌখিক নির্দেশনাবলী বা সেই সময়ে প্রচলিত কবিতার সংস্কৃতির একটি রূপ, যা বিভিন্ন সময়ের ভাষাগত ও স্মৃতিগত বিভেদের কারণে ভিন্নভাবে প্রচলিত ছিল—এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ঐক্যের প্রয়োজনে একটি রূপকে “ঈশ্বরপ্রদত্ত” বলে স্থির করা হয়েছে। এই পার্থক্যটি বোঝাতে বাংলা ভাষার একটি উদাহরণ ধরা যাক। একই সাধারণ বাক্য—“আমি আজ খুব ক্লান্ত”—বাংলাদেশের সাতটি ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্নভাবে বলা হয়, অথচ অর্থ একই থাকে। উদাহরণ: “আমি আজ খুব ক্লান্ত” — সাতটি আঞ্চলিক রূপ
| ক্রম | অঞ্চল / উপভাষা | বাক্যরূপ | মন্তব্য |
|---|---|---|---|
| ১ | কেন্দ্রীয় বাংলা | আমি আজ খুব ক্লান্ত। | স্ট্যান্ডার্ড বা প্রচলিত রূপ |
| ২ | চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা | আইজ আমি বেকায়দায় আছি। | “আজ” → “আইজ”; “ক্লান্ত” → “বেকায়দা” |
| ৩ | সিলেটি | আইজ আমি হালা গেছাম। | “ক্লান্ত” বোঝাতে “হালায় যাওয়া” ব্যবহৃত |
| ৪ | বরিশালের উপভাষা | আইজ আমি একেবারে গ্যাঞ্জাইয়া গেছি। | স্থানীয় রূপক শব্দ “গ্যাঞ্জাইয়া” |
| ৫ | রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষা | আজক্যাই আমি দম ফুরায়ে গেছি। | “আজক্যাই” ও “দম ফুরানো” শব্দ ব্যবহৃত |
| ৬ | ময়মনসিংহ / টাঙ্গাইল অঞ্চল | আহ্নে তগো আমি হদিস নাই। | “ক্লান্ত” বোঝাতে মানসিক বিভ্রান্তি বোঝানো |
| ৭ | কুষ্টিয়া / ঝিনাইদহ দিক | আইজ মইরা যাইতেছি, দেহে আর জোর নাই। | আবেগপ্রবণ ও অতিরঞ্জিত আঞ্চলিক রূপ |
উসমানের সম্পাদনা: ঐশ্বরিকতা নাকি রাজনীতি?
ইতিহাসবিদরা একমত যে, উসমানের পদক্ষেপ ছিল রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়। কারণ সেই বিষয়ে নবীর কোন নির্দেশনা ছিল না, বরঞ্চ নবীর নির্দেশনা ছিল যার যেটি সহজ লাগবে সে সেটি পড়বে। সেসময়ে সিরিয়া, কুফা, ও মদিনায় ভিন্ন ভিন্ন পাঠ প্রচলিত হয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। ফলে “ঐক্যের” নামে উসমান অন্যসব সংস্করণ ধ্বংস করেন। এ প্রক্রিয়া এক প্রকার মানবিক সম্পাদনা—যা পবিত্র বাণীর সংরক্ষণের ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ, বর্তমান কোরআন আল্লাহর নয়, উসমানের সম্পাদিত সংস্করণ। এবং এই ইতিহাস স্বীকার করলেই “কোরআনের অপরিবর্তনীয়”-হওয়ার দাবি ভেঙে পড়ে।
উপসংহার
“সাত আহরুফ” সমস্যা আসলে ইসলামি ধর্মগ্রন্থের মানবিক উৎপত্তির জ্বলন্ত প্রমাণ। এটি দেখায়, কোরআনের ভাষা, পাঠভঙ্গি ও ব্যাখ্যা সময়, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। যদি ঈশ্বর সত্যিই “সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান” হন, তবে তিনি কখনও তাঁর বাণী সাত রূপে পাঠিয়ে পরে ছয়টি বিলুপ্ত হতে দিতেন না। কারণ সেগুলো বিলুপ্ত করে দিতে চাইলে এতগুলো পাঠাবারই প্রয়োজন হতো না। এই বহুভাষিক, পরিবর্তনশীল ও সম্পাদিত কোরআন কোনও “অপরিবর্তনীয় স্বর্গীয় বাণী” নয়—বরং একটি মানবীয় চিন্তাভাবনার ধারাবাহিক ফল, যা পরবর্তীকালে ধর্মীয় কর্তৃত্বের বলয়ে “অমর” করে তোলা হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৬২৯ ↩︎
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৬৩০ ↩︎
- সহিহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অষ্টম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪১, হাদিসঃ ৪৬২৬ ↩︎
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৬২৬ ↩︎
- তাহক্বীক মিশকা-তুল মাসা-বীহ (মিশকাত), ৩য় খণ্ড, হাদীস একাডেমী, তাহক্বীকঃ আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী, পৃষ্ঠা ১৮০ ↩︎
