মানব সভ্যতার ইতিহাসে নৈতিকতা, মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো ব্যক্তির ঘরের ভিতরে উঁকি দেওয়া বা গোপনে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে অনৈতিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই অনৈতিক কাজের শাস্তি কী হওয়া উচিত?সাধারণত আধুনিক আইনে কিংবা সভ্য সমাজের নীতিতে এই অপরাধের শাস্তি হয় আইনি সতর্কতা, জরিমানা, বা মানসিক চিকিৎসা বা অতি সামান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা—যাতে অপরাধীর শিক্ষাও হয়, আবার তার মানবাধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু ইসলামের নবী মুহাম্মদের প্রদত্ত নির্দেশনায় এই অপরাধের প্রতিক্রিয়ায় এমন শাস্তি অনুমোদিত হয়েছে যা একবিংশ শতাব্দীর মানবিক মানদণ্ডে চূড়ান্তভাবে নৃশংস ও অমানবিক বলে বিবেচিত হবে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক, বোধসম্পন্ন সমাজে অপরাধ ও শাস্তির মধ্যে একটি সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। উঁকি দেয়া নৈতিকভাবে অন্যায়, কিন্তু তাতে চোখ উপড়ে ফেলা কোনোভাবেই সুবিচার হতে পারে না। এমন প্রতিক্রিয়া মূল অপরাধের চেয়ে বহুগুণ নির্মম ও অমানবিক।
আধুনিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটিকে বলা হয় “disproportionate retaliation”। একজন ব্যক্তি যদি কেবল উঁকি দেয়, এবং তার শাস্তি হয় চোখ নষ্ট করে দেয়া, তাহলে তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং নাগরিক সুরক্ষার পরিপন্থী। হাদিস থেকে জানা যায়, মুহাম্মদ স্বয়ং নিজেই একজন উঁকিদাতার চোখে ছুরি নিক্ষেপ করতে উদ্যত হন। প্রশ্ন জাগে—এটি কি ছিল আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ, নাকি প্রতিশোধ? ঘটনার প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায়, এতে কোনো জরুরি আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছিল না। উঁকিদাতা সশস্ত্র বা হুমকিস্বরূপ ছিলেন না, তিনি শুধু গোপনে উঁকি দিয়েছিলেন। তাহলে নবীর আচরণ প্রতিরক্ষা নয়, বরং একটি প্রতিশোধমূলক সহিংসতা হিসেবে চিত্রিত হয়।
বর্তমান বিশ্বে (বিশেষত মানবিক, গণতান্ত্রিক সমাজে) যদি কেউ উঁকি দেয় বা গোপনে কারও বাসায় নজরদারি করে, তাহলে তা হয়তো “invasion of privacy” বা “trespassing” হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে সাধারণত আইনি হুঁশিয়ারি, জরিমানা বা সর্বোচ্চ কিছুদিনের জেল হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী শরীয়তভিত্তিক এই হাদিসে ব্যক্তিগত প্রতিশোধকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে এমনভাবে, যা রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোকেই অস্বীকার করে। এমনকি ‘বিচারকের কাছে মামলা পেশ না করে নিজের হাতে প্রতিশোধ নেওয়া’কেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি একটি রাষ্ট্রবিরোধী, নৈরাজ্যবাদী দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী।
এই হাদিসদ্বয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো—এগুলো ‘সহীহ’ বা বিশুদ্ধ হাদিস হিসেবে বিবেচিত, যার কারণে এগুলো ইসলামী শরিয়ত বা আইনে সংযোজিত এবং বহু মুসলিম এগুলোকে অনুশীলনের জন্য গ্রহণ করে থাকে। এ ধরণের হাদিস ধর্মীয় উগ্রতার পৃষ্ঠপোষকতা করে, যেখানে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মনে করতে পারেন—শরীয়ত তাকে অনুমতি দিয়েছে একজন অপরাধীকে চোখ উপড়ে শাস্তি দিতে। এটি সরাসরি ‘vigilante justice’-এর একটি ধর্মীয় রূপ। এই হাদিসগুলো কেবল ইতিহাস বা ধর্মগ্রন্থের একটি অংশ নয়, বরং ধর্মীয় অনুশাসনের নামে সহিংসতা বৈধ করার একটি হাতিয়ার। এসব বাণী ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে এবং সহিংসতা উসকে দেয়।
উঁকি দেওয়া অনৈতিক, কিন্তু চোখ উপড়ে ফেলা তার সমান নয়। কোনো সমাজ বা ধর্ম যদি এমন সামান্য অপরাধের জন্য অঙ্গহানি বা শারীরিক হিংসার অনুমোদন দেয়, তাহলে সেই সমাজ মানবিকতার নয়, বর্বরতার ধারক।[1] –
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৮৭/ রক্তপণ
পরিচ্ছেদঃ ৮৭/১৫. হাকিমের কাছে মামলা পেশ করা ছাড়া আপন অধিকার আদায় করে নেয়া বা কিসাস গ্রহণ করা।
৬৮৮৮. উক্ত হাদীসের সূত্রে এও বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ যদি কেউ তোমার ঘরে তোমার অনুমতি ব্যতীত উঁকি মারে আর তুমি পাথর মেরে তার চক্ষু ফুটা করে দাও, তাতে তোমার কোন গুনাহ্ হবে না। [৬৭০২; মুসলিম ৩৮/৯, হাঃ ২১৫৮, আহমাদ ১৯৫৩০] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪০৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪২২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৮৭/ রক্তপণ
পরিচ্ছেদঃ ৮৭/১৫. হাকিমের কাছে মামলা পেশ করা ছাড়া আপন অধিকার আদায় করে নেয়া বা কিসাস গ্রহণ করা।
৬৮৮৯. হুমায়দ (রহ.) হতে বর্ণিত যে, এক লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘরে উঁকি মারল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে চাকু নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, (এ হাদীস) আপনাকে কে বর্ণনা করেছেন? তিনি বললেন, আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)। [৬২৪২] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৪০৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৪২২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ হুমায়দ (রহঃ)

আসুন একটি প্রাসঙ্গিক ভিডিও দেখি,
তথ্যসূত্রঃ
- সহীহুল বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৯ ↩︎