দোয়া দিয়ে রোগ ও বিপদ প্রতিরোধের অন্ধবিশ্বাস

ভূমিকা

মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতি যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের চাকা যত এগিয়েছে, মানুষ তত ভয়ঙ্কর সব রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু ইতিহাসজুড়ে বারবার দেখা গেছে—অযৌক্তিক বিশ্বাস ও কুসংস্কার মানবসভ্যতার পথরোধ করেছে। “অমুক দোয়া পড়লে ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে” বা “বিপদ আসবে না”—এমন দাবি তারই আধুনিক রূপ। এসব বিশ্বাস কেবল প্রমাণহীনই নয়, বরং ব্যক্তি ও সমাজ—দুই স্তরেই ক্ষতিকর। কারণ এসব বিশ্বাস সমাজে জ্ঞান বিজ্ঞানের চাইতে অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব বৃদ্ধি করে। আজকের আলোচনা শুরুর আগে আসুন একটি ওয়াজ শুনি,


রোগ প্রতিরোধে ঈশ্বরের ভূমিকার ভ্রান্ত ধারণা

ক্যান্সার, সংক্রামক রোগ বা দুর্ঘটনা—এসবের মূল কারণ সুস্পষ্টভাবে প্রাকৃতিক ঘটনা। জীববিদ্যা দেখায়, রোগের সূত্রপাত হয় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবী, জিনগত ত্রুটি, কিংবা পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে। দুর্ঘটনা আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার—যা ভৌত জগত ও মানুষের কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত।

তবুও, কিছু মানুষ বিশ্বাস করে যে, প্রার্থনা বা দোয়া উচ্চারণের মাধ্যমেই এসব বিপদ প্রতিহত করা সম্ভব। এই দাবি যদি সত্য হতো, তবে প্রার্থনায় অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ ও দুর্ঘটনার হার পরিসংখ্যানগতভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকার কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক স্বাস্থ্যতথ্য ও মহামারীসংক্রান্ত গবেষণা স্পষ্ট করে দেখায়—এমন কোনো পার্থক্য নেই। বরং, দোয়া-নির্ভর সমাজগুলোতেও রোগের প্রকোপ ও মৃত্যুহার প্রায় একই অথবা কখনও বেশি। কারণ অনেক ধার্মিক পরিবারই দোয়ার ওপর এমনভাবে নির্ভরশীল যে, তারা আর চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন না।

সবচেয়ে বড় যৌক্তিক বৈপরীত্য দেখা যায় সেই সময়গুলোতে, যখন কোনো মারাত্মক রোগের প্রতিরোধক বা চিকিৎসা আবিষ্কারের আগে ও পরে ফলাফলের তুলনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • পোলিও ছিল একসময় ভয়ঙ্কর ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া রোগ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ প্রার্থনা করেছে, মসজিদ-মন্দিরে দোয়া ও পূজা হয়েছে, তবুও ঈশ্বরেরা কাউকে পোলিও থেকে রক্ষা করতে “সক্ষম” হননি।
  • কিন্তু ২০শ শতকে বিজ্ঞানীরা পোলিওর টিকা উদ্ভাবন করার পর হঠাৎ করেই পৃথিবীজুড়ে পোলিও আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত কমে আসে। ঈশ্বরদের পক্ষ থেকে তখনই যেন সুরক্ষা সম্ভব হয়ে গেল!
  • একইভাবে গুটি বসন্ত (smallpox), হাম (measles), ডিপথেরিয়া বা টিটেনাস—সবগুলো ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রকৃত সুরক্ষা এসেছে মানব মস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন থেকে, কোনো অলৌকিক হস্তক্ষেপ থেকে নয়।
  • এর আগে শত শত বছর ধরে কোটি কোটি ধার্মিক মানুষ এ রোগগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করলেও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

এই পর্যবেক্ষণ থেকে একটি সরল কিন্তু অস্বস্তিকর সত্য সামনে আসে—ঈশ্বরগণ মানুষের রক্ষা করতে পারেন কেবল তখনই, যখন মানুষ নিজেই সেই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলে। এর আগে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে কোনো সুরক্ষা দেখা যায় না।

এটি প্রমাণ করে যে রোগ প্রতিরোধ বা বিপদ এড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে প্রমাণ-ভিত্তিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তি, অলৌকিক প্রার্থনা নয়। যদি ঈশ্বরের ক্ষমতা সত্যিই সীমাহীন হতো, তবে পোলিও টিকার আগে থেকেই তিনি মানুষকে রক্ষা করতে পারতেন। বাস্তবে, রোগের ইতিহাস স্পষ্ট করে যে—সুরক্ষা আসে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, প্রার্থনার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে নয়।


বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি

ক্যান্সার, সংক্রামক রোগ বা দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে—জীববিদ্যা, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, জিনগত ত্রুটি, বা পরিবেশগত ঝুঁকি এর মূল কারণ।

  • কোনো প্রার্থনা বা দোয়া উচ্চারণের মাধ্যমে এসব প্রাকৃতিক কারণ দূর হয়—এমন কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই।
  • যদি এই দাবি সত্য হতো, তবে ধারাবাহিকভাবে দোয়া পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ ও বিপদের হার পরিসংখ্যানগতভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকার কথা, যা বাস্তবে দেখা যায় না।

মিথ্যা নিরাপত্তাবোধের সমস্যা

দোয়া রোগ প্রতিরোধে সক্ষম—এমন বিশ্বাস অনেককে বাস্তব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তারা মনে করে, অলৌকিক সুরক্ষার ওপর নির্ভর করলেই যথেষ্ট, ফলে চিকিৎসা, টিকা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা বা স্যানিটেশন—এসব বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর পদক্ষেপ উপেক্ষিত হয়। এর ফলে রোগের ঝুঁকি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাড়তে থাকে।

এমন মানসিকতার কারণে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের অভাব কিংবা অনিরাপদ জীবনযাপন নিয়েও অনেকের মধ্যে উদাসীনতা দেখা যায়। “দোয়া আছে” বা “আল্লাহ রক্ষা করবেন” এই ধারণা বাস্তব স্বাস্থ্যঝুঁকিকে অবমূল্যায়ন করে, যেন প্রাকৃতিক নিয়ম ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গুরুত্ব কেবল গৌণ বিষয়। এর ফলেই প্রতিরোধযোগ্য অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংখ্যা অকারণে বৃদ্ধি পায়। এরসাথে যুক্ত হয় চিকিৎসা বিলম্বিত করার কারণে তৈরি হওয়া ঝুঁকি।


সামাজিক ও নৈতিক সমস্যা

অলৌকিক প্রতিরোধে বিশ্বাসের আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো অসুস্থ মানুষদের প্রতি অযৌক্তিক দোষারোপ। অনেকে ধরে নেয়, কেউ অসুস্থ হলে তা নাকি তার পর্যাপ্ত দোয়া না করা, যথেষ্ট ইবাদত না করা, বা ঈমান দুর্বল থাকার ফল। এই ধরনের অভিযোগ শুধু ভুল নয়, বরং গভীরভাবে মানসিক আঘাতমূলক। একজন রোগী, যে ইতোমধ্যেই শারীরিক কষ্টে ভুগছে, তাকে এমন অভিযোগ শুনতে হয় যা তার অপরাধবোধ বাড়ায় এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে। এর ফলে অসুস্থতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা কমে যায়, মানুষ চিকিৎসা নিতে বা রোগের লক্ষণ জানাতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়, কারণ তারা ভয় পায় ধর্মীয় বা নৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগের সম্মুখীন হতে।

এছাড়া, অলৌকিক প্রতিরোধের নামে বিপুল অর্থ ও সময় অপচয় হয়। অনেক পরিবার অসুস্থতার সময় বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার পরিবর্তে তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানের পেছনে টাকা খরচ করে, যা কার্যকর স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা গেলে রোগ নিরাময়ে বাস্তব ফল পাওয়া যেত। এমনকি সুস্থ মানুষও “প্রতিরোধমূলক দোয়া” বা “আধ্যাত্মিক সুরক্ষা”র নামে নিয়মিত অর্থ ব্যয় করে, অথচ সেই বিনিয়োগ যদি টিকা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বা পুষ্টিকর খাদ্যে ব্যবহৃত হতো তবে দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার অনেক কমে যেত। এইভাবে অলৌকিক সুরক্ষার মায়া শুধু মানুষের মানসিক যুক্তি ক্ষয় করে না, বরং সরাসরি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।


ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিরোধ

ধর্মীয় ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে নবী, সাহাবি বা গভীরভাবে ধার্মিক ব্যক্তিরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বা কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, নবী মুহাম্মদ বিষক্রান্ত হয়ে রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তার সহচরদের মধ্যে ওমর, উসমান, আলী—সকলেই বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এছাড়া হজরত আবু বকর, হজরত ওমর, হজরত আলী প্রমুখ সাহাবিরাও বিভিন্ন রোগ, দুর্ঘটনা এবং যুদ্ধের সময় গুরুতর আহত হয়েছিলেন।

যদি প্রার্থনা বা দোয়া সত্যিই রোগ ও বিপদ প্রতিরোধের নিশ্চিত উপায় হতো, তবে এই ব্যক্তিরা অবশ্যই ব্যতিক্রম হতেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবন প্রমাণ করে যে—এমনকি যারা গভীরভাবে ধার্মিক, প্রার্থনা-নিয়মিত এবং আল্লাহভক্ত ছিলেন—তাদেরও প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে রোগ, মৃত্যু ও বিপদ প্রাকৃতিক এবং মানবিক কারণের ওপর নির্ভরশীল, এবং প্রার্থনা বা দোয়ার ওপর নির্ভর করে এই ঘটনাগুলি প্রতিরোধ করা যায় না।


উপসংহার

দোয়া পড়া রোগ প্রতিরোধ বা বিপদ এড়ানোর উপায় হিসেবে কোনো যৌক্তিক ভিত্তি বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বহন করে না। এটি মূলত এক ধরনের অন্ধবিশ্বাস—যা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হ্রাস করে, চিকিৎসা বিলম্বিত করে, এবং সমাজকে কুসংস্কারে আবদ্ধ করে রাখে। ব্যক্তিগত মানসিক সান্ত্বনার বাইরে, দোয়ার মাধ্যমে বাস্তব জগতে কোনো শারীরিক বা প্রাকৃতিক ঘটনা পরিবর্তিত হয়—এমন প্রমাণ নেই। অতএব, যুক্তিবাদী ও প্রমাণনির্ভর সমাজ গঠনের জন্য এ ধরনের বিশ্বাস পরিত্যাগ করা জরুরি।