Table of Contents
ভূমিকা
নীতিগত হেত্বাভাস বা কুযুক্তি (Moralistic Fallacy) হলো একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি যেখানে কেউ নৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে বাস্তবতাকে বিচার করার চেষ্টা করে। সহজ কথায়, যদি কিছু নৈতিকভাবে সঠিক বা গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে সেটা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে বা অসম্ভব হওয়া উচিত—এই ধারণা থেকে সিদ্ধান্তে আসা হয়। কিন্তু বাস্তবতা এবং নৈতিকতা একে অপরের সমান নয়। প্রকৃতির যে কোনো ঘটনা বা বৈশিষ্ট্য নৈতিক হতে পারে বা নাও হতে পারে, তবে সেই ঘটনাটি প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে বা ঘটেই থাকে।
এডওয়ার্ড সি. মুর তার ১৯৫৭ সালের প্রবন্ধে নীতিগত হেত্বাভাসকে বিশ্লেষণ করেন এবং দেখান যে কিভাবে নৈতিক ধারণা এবং বাস্তব জগৎকে গুলিয়ে ফেলা মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।
উদাহরণসমূহ
- ১. পরকীয়া নৈতিকভাবে খারাপ, তাই মানুষের একাধিক যৌনসঙ্গী লাভ করার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না।
- এখানে নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা হয়েছে। যদিও পরকীয়া নৈতিকভাবে খারাপ হতে পারে, তবুও মানুষের মধ্যে একাধিক যৌনসঙ্গীর আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, এবং এটাই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের বিভিন্ন আচরণ জৈবিক, সামাজিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে, যা নৈতিকতার বাইরেও প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে।
- ২. পরকালের না থাকাটা ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, তাই পরকাল ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।
- এই উদাহরণে বলা হচ্ছে যে, নৈতিকতা এবং ন্যায় বিচার প্রয়োজন বলে ঈশ্বরের এবং পরকালের অস্তিত্বও আছে। কিন্তু পৃথিবীতে ন্যায় বিচার না থাকা প্রমাণ করে না যে, অন্য কোনো জগতে (যেমন পরকাল) বিচার হবে। এটি একটি নৈতিক ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে বাস্তবতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা, যা যুক্তিসঙ্গত নয়।
- ৩. খারাপ চরিত্রের অধিকারী হওয়া নৈতিকভাবে ভুল, তাই কেউ খারাপ হতে পারে না, সবাই ভালো মানুষ।
- যদিও নৈতিকতা বলে যে মানুষকে ভালো হওয়া উচিত, তবে বাস্তবে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা খারাপ কাজ করে বা খারাপ চরিত্রের অধিকারী। এই উদাহরণে নৈতিক চিন্তাধারা বাস্তবতাকে পরিবর্তন করতে পারে না। প্রকৃত ঘটনা হল, মানুষ বিভিন্ন প্রকারের হয়, ভালো এবং খারাপ উভয়ই হতে পারে।
- ৪. নারী ও পুরুষের সমতাবিধান হতে হবে, তাই নারীরাও পুরুষের মতো শারীরিকভাবে শক্তিশালী।
- সমতাবিধান নৈতিকতার দৃষ্টিতে সঠিক হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারীদের শারীরিক গঠন পুরুষদের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে। নারীরা পুরুষদের মতো শারীরিকভাবে শক্তিশালী নাও হতে পারেন, কারণ এটি জৈবিকভাবে নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য। এই ধারণা নৈতিকতাকে প্রাকৃতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে বিচার করে ফেলেছে, যা একটি ভুল বিচার।
- ৫. প্রাণী হত্যা খারাপ, তাই প্রাণীরা কখনোই একে অপরকে হত্যা করে না।
- প্রাণী জগতে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে খাদ্য চক্রের কারণে শিকার এবং হত্যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যদিও মানুষ হিসেবে আমরা প্রাণী হত্যা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে করতে পারি, কিন্তু প্রকৃতিতে এই ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটে।
- ৬. প্রাণীর উপর নির্যাতন নৈতিকভাবে ভুল, তাই মানুষ কখনো পশুর ওপর নির্যাতন করে না।
- নৈতিকভাবে এটি একটি ভুল কাজ হলেও, অনেক মানুষ পশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে। এটি প্রমাণ করে যে নৈতিকভাবে কিছু সঠিক বা ভুল হলে বাস্তবে তা ঘটবে না বা ঘটতে পারে না, এমনটি ধরে নেওয়া নীতিগত হেত্বাভাস।
- ৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ খারাপ, তাই এগুলো পৃথিবীতে ঘটতে পারে না।
- যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটি প্রাকৃতিক এবং নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ। প্রকৃতির এই ঘটনাগুলো নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং ভৌগলিক ও বৈজ্ঞানিক কারণেই ঘটে।
- ৮. যুদ্ধ নৈতিকভাবে ভুল, তাই পৃথিবীতে যুদ্ধ ঘটতে পারে না।
- যুদ্ধ একটি বাস্তব জগতের ঘটনা যা অনেক কারণে ঘটে, যেমন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ, বা জাতীয় নিরাপত্তা। যদিও যুদ্ধকে আমরা নৈতিকভাবে ভুল বলে মনে করি, তবুও ইতিহাস জুড়ে এটি ঘটে এসেছে এবং এখনও ঘটে চলছে।
নীতিগত হেত্বাভাসের প্রভাব
এই ধরনের কুযুক্তি বিশেষত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কে বেশি দেখা যায়। নীতিগত হেত্বাভাস মানুষকে যুক্তিসঙ্গত চিন্তা থেকে বিচ্যুত করে নেয়। যখন কোনো বিষয়কে আমরা শুধুমাত্র নৈতিকতার ভিত্তিতে বিচার করি এবং প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করি, তখন সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা একটি নৈতিক ইস্যু, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নারীরা পুরুষদের মতো সব ক্ষেত্রে একই শারীরিক ক্ষমতা বা সুযোগ পাবে।
উপসংহার
নীতিগত হেত্বাভাস হলো একটি কুযুক্তি যেখানে নৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রকৃত বাস্তবতা ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করা হয়। প্রকৃতি এবং বাস্তবতা অনেক সময় নৈতিকতার বাইরেও চলে যায়। এটি বোঝা প্রয়োজন যে নৈতিকতা মানুষের তৈরি ধারণা, যেখানে প্রাকৃতিক ঘটনা ও বৈশিষ্ট্য স্বাধীনভাবে কাজ করে। নৈতিকভাবে কিছু ভুল হলেও তা প্রকৃতিতে ঘটতে পারে এবং সেই ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হবে। নৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির সহায়তা নেওয়া উচিত।