দ্বিতীয় আদি অনন্ত সত্তা কোরআনঃ সৃষ্টি নাকি আল্লাহর অংশ?

ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম জটিল ও গভীর তাত্ত্বিক প্রশ্ন হলো—কোরআনের অস্তিত্বগত স্বরূপ (ontological status) আসলে কী? কোরআন কি আল্লাহর চিরন্তন, অনাদি ও অনন্ত সিফাৎ (গুণাবলীর অংশ), নাকি এটি আল্লাহর তৈরি বা সৃষ্ট কোনো স্বতন্ত্র বস্তু? এই প্রশ্নটি শুধু একটি তাত্ত্বিক আলোচনা নয়; বরং ইসলামি ঈমান ও তাওহিদের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। প্রাচীন গ্রীক যুক্তিবাদের প্রভাবে গড়ে ওঠা মুতাযিলা চিন্তাবিদরা কোরআনকে একটি সৃষ্ট বস্তু হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, অপরদিকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আশআরী ও মাতুরিদী চিন্তাবিদরা কোরআনকে আল্লাহর শাশ্বত ও অনন্ত সিফাৎ বলে দাবি করেছেন। হাদিস থেকে আবার জানা যায়, কোরআন আল্লাহর থেকে স্বতন্ত্র এক সচেতন সত্তা, যা আল্লাহর অংশ নয়। এই কারণে কোরআনের অস্তিত্বগত স্বরূপ ইসলামেই একটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়, যা নিয়ে বহু প্রাচীন আলেমগণ বেশি চিন্তা করতে নিষেধ করে গেছেন। কিন্তু দর্শনের কাজী হচ্ছে চিন্তা করা, নিষিদ্ধ করে তো আমাদের চিন্তার গতি থামিয়ে রাখা যাবে না। তাই আসুন তথ্যগুলো যাচাই করি এবং গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখি।

এই কয়েকটি পরস্পর বিরোধী অবস্থান বিশ্লেষণ করলে একটি গভীর দার্শনিক ও যুক্তিগত সংকট উন্মোচিত হয়, যা ইসলামের একত্ববাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব ও ওহির প্রকৃতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই প্রবন্ধে আমরা কোরআনের স্বরূপ নিয়ে ইসলামের এই মৌলিক স্ববিরোধিতা এবং তার দার্শনিক জটিলতাগুলো যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরব।


কোরআন আদি অনন্ত শ্বাশত চিরন্তন (ভিডিও)

আসুন শুরুতেই কিছু আলেমের বক্তব্য শুনি,


কোরআন সচেতন সত্তা এবং সাক্ষ্যদাতা

ইসলাম ধর্মের আকীদা হচ্ছে, কোরআন একটি সচেতন সত্তা যে কিয়ামতের দিনে তার পাঠকদের পক্ষে সুপারিশ করবে। সচেতন চিন্তাশীল সত্তা না হোলে এই কাজগুলো করা সম্ভব নয়। এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, ইসলাম অনুসারে কোরআন দেখে, শোনে, বোঝে এবং স্মরণ রাখে। এটি আল্লাহর মতই আরেকটি আদি অনন্ত সত্তা, যে আল্লাহর কাছে নিজেই সাক্ষ্যও দেয়ার সামর্থ্য রাখে।

হাদীস সম্ভার
১২/ কুরআন
পরিচ্ছেদঃ কুরআন পাঠের ফযীলত
(১৪১০) আবূ উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে।
(মুসলিম ১৯১০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ উমামাহ্ বাহিলী (রাঃ)

হাদীস সম্ভার
১২/ কুরআন
পরিচ্ছেদঃ কুরআন পাঠের ফযীলত
(১৪১১) জাবের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন এই কুরআন (কিয়ামতে) সুপারিশকারী; তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে। (কুরআন) সত্যায়িত প্রতিবাদী। যে ব্যক্তি তাকে নিজ সামনে রাখবে, সে ব্যক্তিকে সে জান্নাতের প্রতি পথপ্রদর্শন করে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তাকে পিছনে রাখবে, সে ব্যক্তিকে সে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করবে।
(ইবনে হিব্বান ১২৪, সহীহ তারগীব ১৪২৩)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ)

হাদীস সম্ভার
১২/ কুরআন
পরিচ্ছেদঃ কুরআন পাঠের ফযীলত
(১৪১২) আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শুনেছি, তিনি বলেছেন, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীদের জন্য সুপারিশকারীরূপে উপস্থিত হবে। তোমরা দুই জ্যোতির্ময় সূরা; বাক্বারাহ ও আ-লে ইমরান পাঠ কর। কারণ উভয়েই মেঘ অথবা উড়ন্ত পাখীর ঝাঁকের ন্যায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হয়ে তাদের পাঠকারীদের হয়ে (আল্লাহর নিকট) হুজ্জত করবে। তোমরা সূরা বাক্বারাহ পাঠ কর। কারণ তা গ্রহণ করায় বরকত এবং বর্জন করায় পরিতাপ আছে। আর বাতেলপন্থীরা এর মোকাবেলা করতে পারে না। মুআবিয়াহ বিন সাল্লাম বলেন, আমি শুনেছি যে, বাতেলপন্থীরা অর্থাৎ যাদুকরদল।
(মুসলিম ১৯১০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ উমামাহ্ বাহিলী (রাঃ)

হাদীস সম্ভার
১২/ কুরআন
পরিচ্ছেদঃ কুরআন পাঠের ফযীলত
(১৪২৬) আবু হুরাইরা (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন কুরআন উপস্থিত হয়ে বলবে, হে প্রভু! ওকে (কুরআন পাঠকারীকে) অলংকৃত করুন। সুতরাং ওকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। পুনরায় কুরআন বলবে, হে প্রভু! ওকে আরো অলংকার প্রদান করুন। সুতরাং ওকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। অতঃপর বলবে, হে প্রভু! আপনি ওর উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। সুতরাং আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হবেন। অতঃপর তাকে বলা হবে, তুমি পাঠ করতে থাক আর মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক। আর প্রত্যেকটি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব বৃদ্ধি করা হবে।
(তিরমিযী ২৯১৫, হাকেম ২০২৯, দারেমী ৩৩১১, সহীহুল জামে ৮০৩০)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)


কোরআন শ্বাশত ও চিরন্তন

তাফসীরে জালালাইনে এই বিষয়ে বলা হয়েছে [1]

কুরআন সৃষ্ট নয়; বরং চিরন্তন ও শাশ্বতঃ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিশুদ্ধ আকিদা হলো, কুরআন সৃষ্ট নয়; বরং চিরন্তন ও শাশ্বত। কারণ, কুরআন আল্লাহর কালাম ও বাণী। আর আল্লাহর ন্যায় আল্লাহর বাণী কাদীম তথা চিরন্তন।
কিন্তু মুতাযিলা সম্প্রদায় বলে যে, কুরআন মাখলুক বা সৃষ্ট। তারা দলিল দিতে গিয়ে বলে, আল্লাহ পাক স্বয়ং কুরআনে বলেন:
“আমি একে (কুরআন) বানিয়েছি আরবি ভাষায়।”
তাদের ব্যাখ্যায়, যেহেতু আল্লাহ ‘বানিয়েছি’ বলেছেন, তাই কুরআন নতুন, মাখলুক ও সৃষ্ট বলে তারা দাবি করে।
তাদের এই দাবির জবাবে ইমাম রাযী (রহ.) বলেন:
“আল্লাহর কালাম বাস্তবিক অর্থে ও প্রকৃতগত দিক থেকে কাদীম ও চিরন্তন। অতএব, আল্লাহর বাণীকে সাধারণ শাব্দিক বা জাহেরী কথাবার্তার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।”
আল্লামা আলূসী (রহ.) বলেন:
“উক্ত আয়াতে ‘বানিয়েছি’ শব্দের অর্থ কুরআনের সৃষ্ট হওয়া নয়। বরং এর অর্থ হলো, আল্লাহ লওহে মাহফুযে কুরআনকে আরবি ভাষায় লিখেছেন। তাই মুতাযিলাদের উত্থাপিত প্রশ্ন সঠিক নয়।”
বর্ণিত আছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলেন:
“আপনি বলুন, কুরআন কি আল্লাহর বাণী, নাকি আল্লাহর সৃষ্ট কোনো বস্তু?”
তিনি (রা.) উত্তরে বললেন:
“এটা আল্লাহর বাণী। তুমি কি শুননি, আল্লাহ নিজেই বলেছেন…”
লোকটি আবার বলল:
“আপনি কি আল্লাহর বাণীর মধ্যে ‘লা ইসা কমিসলিহি শাইউন’ অর্থাৎ ‘তার মতো কিছুই নেই’— এই আয়াত নিয়ে চিন্তা করেননি?”
ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন:
“এখানে কুরআনের অর্থ আল্লাহর কালাম, যা লওহে মাহফুযে আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।”
— [তাফসীরে রূহুল মা’আনী]

কোরআন

কোরআন কি আল্লাহর শাশ্বত সিফাৎ?

আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতে, কোরআন আল্লাহর কালাম এবং আল্লাহর অন্যান্য গুণাবলীর মতো চিরন্তন ও অনাদি। অর্থাৎ আল্লাহ যেমন চিরন্তন, তেমন তার বাণীও চিরন্তন। তারা এটিকে আল্লাহর “সিফাতে কালাম” বলে গণ্য করেন। কিন্তু এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন দেখা দেয়:

  • যদি কোরআন আল্লাহর সিফাৎ হয়, তবে সেটি আল্লাহর সঙ্গে চিরকাল অস্তিত্বশীল থাকা উচিত।
  • কিন্তু বাণীর প্রকৃতি হলো, সেটি নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তে উচ্চারিত বা ব্যক্ত হয়। কোরআনের আয়াতসমূহ নির্দিষ্ট সময়ে নাজিল হয়েছে।
  • চিরন্তন কিছু সময়ের নির্দিষ্ট বিন্দুতে নতুনভাবে প্রকাশিত হতে পারে না।

কোরআন পাঠ করলে দেখা যায়, এর আয়াতগুলো বিভিন্ন সময়, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে নাজিল হয়েছে। যেমন মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটিত ঘটনা, স্থানীয় বিরোধ বা শত্রুতার পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে বিভিন্ন সূরা। সূরা লাহাব এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ: মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাবের সঙ্গে শত্রুতার প্রতিক্রিয়ায় নাজিল হয় সম্পূর্ণ একটি সূরা, যেখানে তাকে এবং তার স্ত্রীকে অভিশপ্ত ও শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়। আবার ধরুন, সূরা তাহরীম নাজিলের প্রেক্ষাপট, যেখানে নবী তার দাসীর সাথে সঙ্গম করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু স্ত্রীদের চাপে কাজটি তিনি হারাম করতে বাধ্য হন। এই সুরাটি কী অনাদি অনন্তকাল ধরে অস্তিত্বশীল? এখানে প্রশ্ন ওঠে:

  • মুহাম্মদের জীবনের একটি ক্ষুদ্র সামাজিক ঘটনা কীভাবে অনন্ত ও চিরন্তন কোনো বাণীর অংশ হতে পারে?
  • এই সূরা লাহাবই কী তবে অনাদি ও অনন্ত?
  • একজন সাধারণ মানুষের (আবু লাহাব) শত্রুতা ও তার স্ত্রী সম্পর্কে ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক ঘোষণা কীভাবে চিরন্তন হতে পারে?
  • নবী মুহাম্মদের ঘরোয়া ঝগড়া নিয়ে নাজিল হওয়া সূরা তাহরীম কী অনাদি অনন্তকাল ধরে অস্তিত্বশীল?

একাধিক অনন্ত ও চিরন্তন সত্তা কি সম্ভব? ইসলামি তাওহিদের সংকট

এই সমস্যার আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস আল্লাহ এক (Ahad), তিনিই একমাত্র চিরন্তন ও অনাদি সত্তা। যদি কোরআনও আল্লাহর মতো চিরন্তন, অনন্ত ও অসীম সত্তা হয়, তবে:

  • এক আল্লাহর সঙ্গে আরেকটি অনন্ত, অসীম ও চিরন্তন সত্তার অস্তিত্ব মানতে হয়।
  • অথচ চিরন্তন বস্তুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, কারণহীনভাবে অস্তিত্বশীল এবং একমাত্রিক।
  • দুইটি চিরন্তন সত্তা কীভাবে একত্রে থাকতে পারে? কোনটি আগে? নাকি একই সঙ্গে দুটো কারণহীনভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে? এটি তো দার্শনিকভাবে অসম্ভব এক অবস্থান।
  • কোরআনের কারণ হিসেবে যদি আল্লাহকে ধরা হয়, তাহলে কোরআন তো অনাদি অনন্ত হতে পারে না। কারণ তার আগে আল্লাহকে অস্তিত্বে থাকতে হবে।

তাহলে কোরআন যদি চিরন্তন হয়, তবে তা আল্লাহর একত্ববাদের (Tawhid) ধারণাকেই ভেঙে দেয়। একমাত্র আল্লাহ চিরন্তন—এই মৌলিক দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিকভাবে আরেকটি অনন্ত সত্তা কোরআনকে আল্লাহর মতই অনাদি অনন্ত রূপে স্বীকার করে নিতে হয়।যা ইসলামের একটি মৌলিক সমস্যা।


কোরআনের পরিবর্তনশীলতা ও ক্বিরাআত সংকট

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো—কোরআনের পাঠ ও উচ্চারণের ভিন্নতা।

  • ইসলামের ইতিহাসে সাত হার্ফ বা সাত উপভাষায় কোরআন নাজিল হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
  • পরবর্তীতে তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফান ভিন্ন উচ্চারণ ও পাঠের কপি সংগ্রহ করে আগুনে পুড়িয়ে দেন এবং কুরাইশদের উপভাষা-ভিত্তিক একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ প্রণয়ন করেন। নবী বা আল্লাহর কোন নির্দেশনা ছাড়াই উসমান এই কাজ করেন।

এখানে প্রশ্ন ওঠে—

  • কোরআন যদি আল্লাহর শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় সিফাৎ হয়, তবে কীভাবে সেটি বিভিন্ন পাঠ ও উচ্চারণের রূপে পরিবর্তিত হতে পারে?
  • আল্লাহ কি সাতটি উপভাষায় একইসঙ্গে আলাদা আলাদা বাণী উচ্চারণ করেছিলেন?
  • আর যেসব পাঠ উসমানের সময় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল, সেগুলো কি আল্লাহর কালামের বিকৃত বা ভ্রান্ত সংস্করণ ছিল?
  • কিয়ামতের ময়দানে কোন উপভাষার কোরআনটি সাক্ষ্য দেবে?

এ সমস্ত প্রশ্ন কোরআনকে একটি পরিবর্তনশীল পাঠ্যরূপেই প্রতিষ্ঠিত করে, যা আল্লাহর অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য হওয়ার দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


কোরআন কি সৃষ্ট একটি সচেতন সত্তা? হাদিসসমূহের বিশ্লেষণ

হাদিসসমূহ কোরআনকে আল্লাহর গুণাবলী বা অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য নয়, বরং সচেতন, স্বতন্ত্র ও ক্রিয়াশীল সত্তা হিসেবে চিত্রিত করে। কিয়ামতের দিনে কোরআন তার পাঠকের পক্ষ বা বিপক্ষে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

  • কোরআন বিচার দিবসে সুপারিশ করবে।
  • কোরআন তার পাঠকদের জান্নাতে নিয়ে যাবে, যারা অবহেলা করবে তাদের জাহান্নামে পাঠাবে।
  • কোরআন বিচার দিবসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, কথোপকথন করবে, পুরস্কার দাবি করবে।

এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়: আল্লাহর কোনো সিফাৎ কি স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তি ও বাক্-ক্ষমতা সম্পন্ন সত্তায় পরিণত হতে পারে? আল্লাহর দয়া, জ্ঞান, শক্তি ইত্যাদি কখনো স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে কাজ করে না। অথচ হাদিসসমূহ কোরআনকে চিন্তাশীল, কার্যকর এবং আলাদা সত্তা হিসেবে স্থাপন করে। এতে বোঝা যায়, কোরআনকে আল্লাহর সিফাৎ হিসেবে মানলে হাদিসের বর্ণনা অস্বীকার করতে হয়; আর হাদিস মানলে কোরআন স্বতন্ত্র সত্তা হয়ে যায়। এই দুই ধারণা পরস্পরবিরোধী।


কোরআনের ধ্বংস ও উঠিয়ে নেয়া: শাশ্বতত্বের প্রশ্ন

হাদিস ও ইসলামী বর্ণনায় বলা হয়েছে, কিয়ামতের আগে আল্লাহ পৃথিবী থেকে কোরআন উঠিয়ে নেবেন[2] । ফলে পৃথিবীতে আর কোনো কোরআন পাওয়া যাবে না। কিন্তু কোরআন যদি চিরন্তন হয়, ধ্বংস অযোগ্য হয়, তবে সেটি কীভাবে উঠিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হবে কেন? সেটি তো ধ্বংসযোগ্যই নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়:

  • কোরআন ধ্বংস হবে, অর্থাৎ চিরন্তন নয়।
  • অথবা কোরআন কেবল দুনিয়ার জন্যই ছিল, যা ঈশ্বরীয় শাশ্বতত্ব ধারণার সঙ্গে বেমানান।

উল্লেখ্য, চিরন্তন কোনো কিছুর অস্তিত্ব কখনো বিলুপ্ত হতে পারে না। তাই কোরআনের ধ্বংসের ধারণা সরাসরি শাশ্বতত্বের দাবিকে খণ্ডন করে।


আল্লাহর অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কি শুধুই মানবজাতির হিদায়াত?

কোরআনের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের জন্য হিদায়াত। আল্লাহ কোরআন নাজিল করেছেন মানুষকে পথ দেখানোর জন্য। কিন্তু যদি কোরআন চিরন্তন হয়, তবে এর চিরন্তনত্বের অর্থ দাঁড়ায়:

  • আল্লাহর অস্তিত্বের প্রধান কাজ বা উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের হিদায়াত দেয়া।
  • অর্থাৎ আল্লাহর অস্তিত্বও মানুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়।

এতে ঈশ্বরের স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একজন সর্বশক্তিমান, চিরন্তন ঈশ্বরের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী শুধুই মানুষের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল হতে পারে?


উপসংহার

উপরের দার্শনিক, যুক্তিতর্ক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, কোরআনের অস্তিত্ব ও স্বরূপ বিষয়ে ইসলামের মধ্যে এক মারাত্মক স্ববিরোধিতা রয়েছে। কোরআনকে চিরন্তন ও আল্লাহর সিফাৎ হিসেবে মানলে ইসলামি তাওহিদের ভিত্তি ভেঙে পড়ে। আবার কোরআনকে সৃষ্ট বস্তু বললে ইসলামের ঐতিহ্যগত বিশ্বাস ও আহলে সুন্নাহর আকিদা ভেঙে যায়। দুটি অবস্থানের মধ্যে উভয়সংকটে পতিত ইসলামি ধর্মতত্ত্ব এই বিষয়ে কোনো যৌক্তিক বা দার্শনিক সমাধান দিতে অক্ষম। একারণেই এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা, প্রশ্ন তোলা বা বিশ্লেষণ করা ইসলামী আলেমরা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।

এইসব দার্শনিক সংকট ইসলামের ঈশ্বরতত্ত্বকে একটি স্ববিরোধী, অসংগতিপূর্ণ ও দুর্বল মতবাদ হিসেবে প্রকাশ করে।


তথ্যসূত্রঃ
  1. তাফসীরে জালালাইন, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮২১ ↩︎
  2. মুস্তাদরাক হাকেম, তাহক্বীক আলবানীঃ সহীহ, সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ৮৭। ↩︎