Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 সংক্ষেপে মূল ঘটনা (শরহে বুখারী)
- 3 সহিহ হাদিসের বিবরণ
- 4 শরহে মুসলিম থেকে ব্যাখ্যা
- 5 আর রাহিকুল মাখতুম থেকে
- 6 সিরাতে রাসুলাল্লাহ থেকে
- 7 ইসলামিস্টদের ভণ্ডামি
- 8 ইসলামে সাহাবীদের সমালোচনা নিষিদ্ধ
- 9 ঘোড়ায় বেঁধে দ্বিখণ্ডিত করাঃ ভীতির রাজনীতির নির্মম উদাহরণ
- 10 ঐতিহাসিক সত্যতাঃ অস্বীকারের অযোগ্য একটি হত্যাকাণ্ড
- 11 উপসংহার
ভূমিকা
মুহাম্মদের সাহাবীগণ মানুষকে কীভাবে হত্যা করতো, তার কিছু নমুনা দেখে নেয়া যাক। উল্লেখ্য, এই কাজে নবী মুহাম্মদের সম্পূর্ণ সমর্থন থাকতো। আসুন উম্মে কিরফা নামক একজন মহিলা নেত্রীকে নবীর পালিত পুত্র কীভাবে হত্যা করেছিল সেটি দেখে নিই। অনেকগুলো সীরাত গ্রন্থেই আল-উম্মে কিরফা (উম্মে কিরফা আল‑ফাযারিয়্যাহ) নামে এক বৃদ্ধ মহিলার বিষয়ে যে হত্যাকাণ্ড বর্ণিত হয়, তা সীরাত ছাড়াও অনেকগুলো তারিখ গ্রন্থেও উঠে এসেছে। ইবন ইসহাক ও তাবারীর মতো সীরাত গবেষকেরা উল্লেখ করেন, যে উম্মে কিরফা বণু ফাযারা গোত্রের নেত্রী ছিলেন, অর্থাৎ সেই সময়ে বিভিন্ন গোত্রে নারী নেত্রী থাকাটি স্বাভাবিক বিষয় ছিল। এই গোত্রটির কিছু সদস্য যায়িদ বিন হারিসার কাফেলার ওপর হামলা ও লুটপাট চালিয়েছিলেন, এর প্রেক্ষিতে শাস্তি হিসেবে আবু বকর তার দুই পা ঘোড়া বা উটের সাথে বেঁধে উটকে ধাবিত করে তার দেহ দুইভাগে বিভক্ত হয়েছিল।
যদিও এই ঘটনা সীরাত-হালাবিয়্যাহ, তাবাকাত ও ইবন সা‘দ-তাবাকাত গ্রন্থে উল্লেখ, তবে এটি কোনো বিশ্বস্ত হাদিস গ্রন্থে তার কথা সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। তবে অনেকগুলো সহিহ হাদিসে বনু ফাযারার একজন নেত্রীর কথা বলা হয়েছে, নাম উল্লেখ ব্যাতীত। আমরা আজকের এই প্রবন্ধে এটিই প্রমাণ করবো যে, উল্লিখিত সেই নারী নেত্রীই আসলে উমে কিরফা ছিলেন, একইসাথে আমরা আলোচনা করবো তার মৃত্যু নিয়ে, এবং মৃত্যু পরবর্তী তার সুন্দরী মেয়ের অবস্থা নিয়ে।
সংক্ষেপে মূল ঘটনা (শরহে বুখারী)
পুরো ঘটনাটি সংক্ষেপে যদি জানতে চাই, তাহলে জানতে পারবো বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ নসরুল বারী থেকে। আসুন পড়ি, [1] –
হাফিজ আসকালানী র. বলেন, এখানে ইমাম বুখারী র. এর উদ্দেশ্য এই সর্বশেষ যুদ্ধই। যাকে বলে সারিয়্যায়ে উম্মে কিরফা।
উম্মে কিরফা (কাফের নিচে যের, রায়ের উপর জযম, পরবর্তীতে ফা।) এটি এক মহিলার উপনাম। যার আসল নাম ছিল ফাতিমা বিনতে রাবীআ । এ মহিলা ছিল বনু ফাযারার নেত্রী। এ যুদ্ধকে সারিয়্যায়ে বনু ফাযারাও বলতে পারেন ।
সারিয়্যায়ে উম্মে কিরফা
হযরত যায়েদ ইবনে হারিসা রা. বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে শাম গিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কিরামের মাল সম্পদও তাঁর সাথে ছিল। প্রত্যাবর্তনকালে বনু ফাযারার লোকজন তাঁকে মেরে আহত করে এবং সমস্ত মালসামান ছিনিয়ে নেয়। হযরত যায়েদ রা. মদীনায় ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দমনের জন্য হযরত যায়েদ রা. এর নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। এবার হযরত যায়েদ রা. বনু ফাযারা থেকে প্রতিশোধ নেন । কিছু সংখ্যককে হত্যা করেন, অবশিষ্টরা পালিয়ে যায়। হাফিজ আসকালানী র. লিখেন, বনু ফাযারার নেত্রী উম্মে কিরাকে হযরত যায়েদ রা. দু’টি ঘোড়ার লেজে বেঁধে টেনে আনেন। ফলে সে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তার এক কন্যা ছিল খুবই রূপসী। তাকে গ্রেফতার করে মহিলাদের সাথে মদীনায় নিয়ে আসেন।

সহিহ হাদিসের বিবরণ
আসুন এই ঘটনাটি ভালভাবে বোঝার জন্য একটি হাদিস পড়ে নিই,। হাদিসে দেখুন ফাযারা গোত্রের কথা বলা আছে, চামড়ার পোশাক পরিহিত এক মহিলা ও তার সাথে তার অত্যন্ত সুন্দরী এক কন্যার বর্ণনা দেয়া আছে। [2]
সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৩৩/ জিহাদ ও এর নীতিমালা
পরিচ্ছেদঃ ১৪. নফল (বিশেষ পুরস্কার ও অনুদান) হিসাবে কিছু দেওয়া এবং বন্দীদের বিনিময়ে (আটকে পড়া) মুসলিমদের মুক্ত করা
৪৪২১। যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) … ইয়াস ইবন সালামা (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার পিতা বলেছেন, আমরা ফাযারা গোত্রের সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। আমাদের আমীর ছিলেন আবূ বকর (রাঃ)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আমাদের আমীর নিযুক্ত করেছিলেন যখন আমাদের এবং (গোত্রের) পানির স্থানের মাঝে এক ঘণ্টা সময়ের ব্যবধান ছিল, তখন আবূ বকর (রাঃ) আমাদেরকে শেষ রাতের অবতরণের (বিশ্রামের) নির্দেশ দিলেন। সুতরাং আমরা রাতের শেষাংশেই সেখানে অবতরণ করলাম। এরপর বিভিন্ন দিক দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালালেন এবং পানি পর্যন্ত পৌছলেন। আর যাদের পেলেন হত্যা করলেন এবং বন্দী করলেন।
আমি লোকদের একটি দলের দিকে দেখছিলাম যাদের মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছে। আমি আশংকা করছিলাম যে, তারা হয়তো আমার আগেই পাহাড়ে পৌছে যাবে। অতএব, আমি তাদের ও পাহাড়ের মাঝে তীর নিক্ষেপ করলাম। তারা যখন তীর দেখতে পেল থেমে গেল। তখন আমি তাদেরকে হাঁকিয়ে নিয়ে এলাম। তাদের মাঝে চামড়ার পোশাক পরিহিত বনী ফযরার একজন মহিলাও ছিল এবং তার সঙ্গে ছিল তার এক কন্যা। সে ছিল আরবের সব চাইতে সুন্দরী কন্যা। আমি সকলকেই হাকিয়ে আবূ বকর (রাঃ) এর কাছে নিকট এলাম। আবূ বকর (রাঃ) কন্যাটিকে আমাকে নফল হিসাবে প্রদান করলেন।
এরপর আমি মদিনায় ফিরে এলাম। আমি তখনও তার বস্ত্র উন্মোচন করিনি। পরে বাজারে আমার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেনঃ হে সালামা! তুমি মহিলাটি আমাকে দিয়ে দাও। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাকে আমার খবুই পছন্দ হয়েছে এবং এখনও আমি তার বস্ত্র উন্মোচন করিনি। পরের দিন আবারও বাজারে আমার সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাৎ হলো। তখন তিনি বললেনঃ হে সালামা! তুমি মহিলাটি আমাকে দিয়ে দাও। “আল্লাহ তোমার পিতাকে কতই সুপুত্র দান করেছেন।” তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে আপনার জন্যই আল্লাহর কসম! আমি তার বস্ত্র উমোচন করিনি। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ কন্যাটিকে মক্কায় পাঠিয়ে দিয়ে তার কয়েকজন মুসলিমের মুক্তির ব্যবস্থা করলেন, যারা মক্কায় বন্দী ছিল।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ ইয়াস ইবনু সালামাহ ইবনু আকওয়াহ (রহঃ)
শরহে মুসলিম থেকে ব্যাখ্যা
উপরের হাদিসে লক্ষ্য করুন, ফাযারা গোত্রের সাথে যুদ্ধের সময় চামড়ার পোশাক পরিহিত বনী ফযরার একজন মহিলা ও তার অত্যন্ত সুন্দরী এক কন্যাকে বন্দী করার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ মা এবং মেয়ে। এই মা এবং মেয়ে কে বা কারা, আসুন সেটি আমরা বিশ্লেষণ করি। আসুন সহিহ মুসলিমের এই হাদিসটির ব্যাখ্যা পড়ে নেয়া যাক শরহে মুসলিম গ্রন্থ থেকে, [3] –
(আর তাহাদের মাঝে বনু ফাযারার একজন মহিলাও ছিল)। সে হইল উম্মু কারফা। তাহার নাম ফাতিমা বিনতে রবী’আ বিন বদর। আর সে ছিল মালিক বিন হুযায়ফা বিন বদরের অধীনে প্রবীন বৃদ্ধা। তাহার সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহার ঘরটিই ছিল সম্মানিত। -(সীরাতে ইবন হিশাম মা’আ সুহায়লী ২:৩৫৭)-(তাকমিলা ৩:৭৪)
(আর আমি তখনও তাহার পরিধেয় কাপড় উন্মোচন করি নাই)। অর্থাৎ আমি তাহাকে সম্ভোগ করি নাই)। ইহা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মহিলার সহিত সম্ভোগের বিষয়টি বুঝাইতে কিনায়া তথা ইঙ্গিতমূলক শব্দ ব্যবহার করা মুস্তাহাব ৷ -(তাকমিলা ৩:৭৪)

আর রাহিকুল মাখতুম থেকে
সহিহ মুসলিম গ্রন্থে সরাসরি এই মহিলার নামটি না বললেও, আর রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থে এই মহিলার নাম বলে দেয়া হয়েছে। আর রাহিকুল মাখতুম সবচাইতে নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। এবং চামড়ার পোশাক, সাথে তার এক সুন্দরী কন্যার বিষয়টিও খুব পরিষ্কার এই বিবরণ থেকে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, এই মানুষটির কথাই বলা আছে সহিহ হাদিসে [4] –
সালমান বিন আকওয়ার বিবরণ সূত্রে জানা যায়, তিনি বলেছেন যে, ‘এ অভিযানে আমিও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। ফজরের সালাত আদায় করার পর তাঁর নির্দেশক্রমে আমরা শত্রুপক্ষের উপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে ঝর্ণার উপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলাম। অধিকার প্রতিষ্ঠার পর শত্রুপক্ষের কিছু সংখ্যক লোককে হত্যা করা হল। এদের অন্য একটি দলের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। এদের সঙ্গে মহিলা এবং শিশুও ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল যে, লোকজন আসার পূর্বে এরা পর্বতের উপর পৌঁছে না যায়। এ জন্য দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়ে তাদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলাম এবং তাদের ও পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে একটি তীর নিক্ষেপ করলাম। তীর দেখে তারা থেমে গেল।
এ দলের মধ্যে ছিল উম্মু কুরফা নাম্নী এক মহিলা, যিনি পুরাতন চর্ম নির্মিত পোশাক পরিহিতা ছিলেন। তার সঙ্গে ছিল তার এক কন্যা। এ কন্যাটি আরবের সুন্দরী মহিলাদের দলভুক্ত ছিল। আমি তাদেরকে আবু বকর (স)-এর নিকট নিয়ে এলাম। অতঃপর এ কন্যাটিকে আমার নিকট সমর্পণ করা হল। কিন্তু সে যে পোশাকে ছিল, সে পোশাকেই রইল। এর মধ্যে তার পোশাক পরিবর্তন করা হয়নি।’ পরে রাসূলে করীম এ মহিলাকে সালমা বিন আকওয়ার নিকট থেকে চেয়ে নিয়ে মক্কায় প্রেরণ করেন এবং বিনিময়ে কিছু সংখ্যক মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করিয়ে নেন।
উম্মু কুরফা ছিল একজন শয়তান মহিলা। নাবী করীম -কে হত্যার জন্য সে এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং এতদ্দেশ্যে স্বীয় পরিবার থেকে ত্রিশটি সওয়ারীর ব্যবস্থা করেছিল। তার এ ষড়যন্ত্র ও দুষ্কর্মের প্রতিফলস্বরূপ ত্রিশ জন সওয়ারীকেই হত্যা করা হয়েছিল।

সিরাতে রাসুলাল্লাহ থেকে
এবারে আসুন ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলাল্লাহ গ্রন্থ থেকে উম্মে কিরফার মৃত্যু সম্পর্কিত বিবরণ পড়ে নেয়া যাক, [5] –
জায়েদ ইবনে হারিসা বনু ফাজারা আক্রমণ করেন । উম্মে কুরফার মৃত্যু
জায়েদ ওয়াদিল কুরাও আক্রমণ করেছিলেন। সেখানে তাঁর মোকাবিলা হয় বনু ফাজারার এবং তাঁর কতিপয় অনুচর নিহত হন। তিনি নিজেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জখম হয়ে ফিরেন। বনু সাদ ইবনে হুদায়লের ওয়ার্দ ইবনে আমর বন্ধু বদরের একজনের হাতে নিহত হন। জায়েদ এসে তা শুনে প্রতিজ্ঞা করলেন, বনু ফাজারায় আক্রমণ না করা পর্যন্ত তিনি পানি স্পর্শ করবেন না। জখম ভালো হতেই রাসুল (সা.) তাঁকে সৈন্যদল নিয়ে পাঠালেন তাদের বিরুদ্ধে। ওয়াদিল কুরায় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো, তাদের কয়েকজনকে তিনি হত্যা করলেন। কায়েস ইবনে আল-মুসাহহার আল-ইয়ামুরির হাতে নিহত হলো মাসাদা ইবনে হাকামা। উম্মে কিরফা ফাতেমা বিনতে রাবিয়া বন্দী হলেন। তিনি ছিলেন মালিকের স্ত্রী। তাঁর মেয়ে ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসাদাও বন্দী হয়। কায়েস ইবনে আল-মুসাহহারকে জায়েদ হুকুম দিলেন উম্মে কিরফাকে হত্যা করতে। নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করা হলো। উম্মে কিরফার মেয়ে ও মাসাদার ছেলেকে আনা হলো রাসুলের (সা.) কাছে। উম্মে কিরফার মেয়ের মালিক ছিল সালামা ইবনে আমর, তিনিই তাকে বন্দী করেন। সমাজে বিশেষ আসন ছিল এই মহিলার। আরবরা বলত, “উম্মে কিরফার চেয়ে বেশি ক্ষমতা থাকলেও এর বেশি কিছু তোমরা করতে পারতে না। সালামা রাসুলের (সা.) কাছ থেকে তাকে চেয়ে নিয়ে তার চাচা হাজন ইবনে আবু ওয়াহবকে তাকে উপহার দিলেন। তার গর্ভে জন্ম হয় আবদুর রহমান ইবনে হাজনের।’
মাসাদা হত্যা সম্পর্কে কায়েস ইবনে মুসাহহার বলেন :
তার মায়ের ছেলের মতো আমি চেষ্টা করেছি
ওয়ার্দের প্রতিশোধ নিতে।
যত দিন বাঁচব ওয়ার্দের বদলা নেব।
ওকে দেখেই ওকে আক্রমণ করলাম,
বদর পরিবারের দুর্ধর্ষ সেই যোদ্ধাকে।
কাদাবি বর্ণায় তাকে বিদ্ধ করলাম।
বিদ্ধ হওয়ার সময় আগুনের মতো তা ঝলসে উঠেছিল।

ইসলামিস্টদের ভণ্ডামি
এবারে আসুন ইসলামিস্টদের একটি বাটপারি দেখিয়ে দিই। পাঠক একটু লক্ষ্য করে পড়ুন। হাদিসে বর্ণিত আছে, আমি এখনো এর বস্ত্র উন্মোচন করিনি। একজন লোক যখন গনিমতের মাল হিসেবে একজন যুদ্ধবন্দিনী সুন্দরী যুবতী নারীকে পায়, এরপরে এই কথার অর্থ কী হয়, তা আমরা সকলেই বুঝি। হাদিসের শরাহ গ্রন্থেও এমনটিই বলা আছে, যা উপরে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদের এই সাহাবী বোঝাচ্ছে, মাকে মেরে তুলে নিয়ে আসা এই মেয়েকে সে এখনো ধর্ষণ করেনি। অথচ, এই বাক্যের পরিবর্তন করে আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী লিখেছে, সে এখনো একই পোশাকে রয়েছে! এই দুইটি বাক্যের অর্থ কী এক? দেখুন, সাহাবীদের চরিত্রের নোংরামি ঢাকতে আলেমগণ কীভাবে চালাকি করেন। লক্ষ্য করে দেখুন, বামদিকে হাদিসটি দেয়া হয়েছে, আর ডানদিকে আর রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থ থেকে দেয়া হয়েছে। সীরাত লেখার সময় লেখক কীভাবে বাক্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ অর্থই বদলে দিয়েছেন, তার নমুনা দেখুন।

ইসলামে সাহাবীদের সমালোচনা নিষিদ্ধ
ইসলামের বিশ্বাস হচ্ছে, নবীর সাহাবীদের সম্পর্কে কোন সমালোচনা করা যাবে না। অর্থাৎ নবীর সাথে সাথে নবীর সাহাবীদের সমালোচনাও নিষিদ্ধ। কিন্তু সমালোচনা নিষিদ্ধ হলে, সত্য জানার পথ তো বন্ধ হয়ে যায়। আর ইসলামের বিশ্বাস যদি এমনই হয়, তাহলে তো সাহাবীদের হাজারো দোষ প্রমাণ হলেও একজন মুসলিম ঈমান হারাবার ভয়ে সেগুলো মানতে চাইবে না। নানা ধরণের অযৌক্তিক কথা বলে অন্ধভাবেই বিশ্বাস করবে যে, এগুলো সত্য নয়। কী অদ্ভুত কথা। আসুন শুরুতেই একটি বক্তব্য শুনে নিই,
ঘোড়ায় বেঁধে দ্বিখণ্ডিত করাঃ ভীতির রাজনীতির নির্মম উদাহরণ
উম্মে কিরফাকে হত্যার ক্ষেত্রে যে নির্যাতনমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল, সেটি নিছক হত্যা নয়; বরং নির্মম শাস্তি এবং জনমনে ভয়ভীতি সৃষ্টির একটি স্পষ্ট কৌশল ছিল। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, তাকে দুই ঘোড়া বা ভিন্ন বিবরণে উটের পায়ে বেঁধে জীবিত অবস্থায় টেনে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল। এই ধরনের হত্যাকৌশল শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্রমাগত ছিন্নভিন্ন করার মাধ্যমে মৃত্যুকে দীর্ঘায়িত করে, ফলে শিকার ব্যক্তি প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে মৃত্যু বরণ করে।
এই পদ্ধতির উদ্দেশ্য কেবল শত্রু নিধন নয়; বরং তাকে ভয়াবহ পরিণতির শিকার বানিয়ে বাকিদের আতঙ্কিত করা। এটিকে আধুনিক পরিভাষায় public deterrence বা ভয়ভীতির রাজনীতি বলা যেতে পারে। যুদ্ধের ময়দানে বা বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এরকম নির্মম শাস্তি মধ্যযুগীয় অনেক সাম্রাজ্যে দেখা যায়। ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসেও এমন ভীতিকর নির্যাতন পদ্ধতির উপস্থিতি মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় ভয়কে একটি কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। বলা যায়, ইসলামী সামরিক নেতৃত্বের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিপক্ষ গোত্রগুলোর মনোবল চূর্ণ করা এবং মুহাম্মদের নেতৃত্বের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য নিশ্চিত করা। যারা বিদ্রোহ করতো বা বিরোধিতা করতো, তাদের জন্য এই ধরনের শাস্তি ছিল এক প্রকার terror tactic, যার মাধ্যমে ইসলামের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার ভয়ঙ্কর পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হতো।
ঐতিহাসিক সত্যতাঃ অস্বীকারের অযোগ্য একটি হত্যাকাণ্ড
উম্মে কিরফার হত্যাকাণ্ড কোনো কাহিনি বা কিংবদন্তি নয়। বরং ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের অন্যতম সুসংরক্ষিত একটি অধ্যায়। এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ইসলামি ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের রচিত সীরাতুর রাসুল-এ, যা মুহাম্মদ ও তার যুদ্ধাভিযানের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবনচরিত। ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের সংরক্ষিত সংস্করণ ইবনে হিশামের দ্বারা সংকলিত হলেও, উম্মে কিরফার হত্যার ঘটনার উল্লেখ সেখানে অবিকৃতভাবে রয়েছে। পাশাপাশি, আল-তাবারির তারিখ উর-রুসুল ওয়াল-মুলুক (রাসূল ও রাজাদের ইতিহাস) নামক বিশাল ইতিহাসগ্রন্থেও এই হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যান্য তাফসীর বা তারিখ গ্রন্থগুলোতেও এই ঘটনার বেশ বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
সমালোচকরা কখনও কখনও সনদের দুর্বলতার দোহাই দিয়ে এ ঘটনার ঐতিহাসিকতা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামী ইতিহাসবিদদের মূলধারা কখনোই এই ঘটনাকে জাল বা ভিত্তিহীন বলে বিবেচনা করেনি। বরং প্রামাণ্য জীবনচরিত ও ইতিহাসগ্রন্থগুলোতে ঘটনাটি স্থান পেয়েছে এবং মুহাম্মদের রাজনৈতিক অভিযানগুলোর অংশ হিসেবেই এটি বিবেচিত হয়ে আসছে। একইসাথে, সহিহ হাদিসগুলোর বিবরণ পর্যালচনা করলেও দেখা যায়, এরকম একজন নারীর কথা নাম উল্লেখ না করেই উল্লিখিত হয়েছে। সেই নামতই যে উম্মে কিরফা, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ইসলামি ইতিহাস সংকলনের সময় মুহাম্মদ ও তার সাহাবিদের কর্মকাণ্ডকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা থাকলেও এই হত্যাকাণ্ডের নির্মমতার বর্ণনা কোনো রূপ পরিমার্জন ছাড়াই সংরক্ষণ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ঘটনাটি ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে তখনকার সমাজেও পরিচিত ছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক সামরিক ও রাজনৈতিক অভিযানের নির্মম দিকগুলোর একটি দলিল হিসেবেই তা উপস্থাপিত হয়েছিল। এবং নবী মুহাম্মদের অনুসারীগণ এই ঘটনাটিকে নবীর সাহাবীদের বীরত্ব এবং শৌর্যবীর্যের উদাহরণ হিসেবেই তাদের গ্রন্থগুলোতে এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং, উম্মে কিরফার হত্যা ইসলামের ইতিহাসে অস্বীকারের অযোগ্য এক নির্মম সত্য, যা বর্তমান সময়ের নৈতিক মানদণ্ডে লজ্জিত মুসলিমদের মিথ্যাচার এবং ভণ্ডামির আবরণে ঢাকা দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
উপসংহার
ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করা যেকোন সত্যান্বেষী মানুষের কর্তব্য হওয়া উচিত। কিন্তু নিরপেক্ষ হওয়ার পথে যদি ইমান এসে বাধা দেয়, তাহলে তো বিপদ। আমাদের উচিত, সত্য জানার জন্য নিরপেক্ষভাবে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করা, কোন অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে নয়। উম্মে কিরফার বিবরণগুলো ভালভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল কোন ধরণের বিচার আচার ছাড়াই। শুধু নির্মমভাবে হত্যাই নয়, তার মেয়েকে গনিমতের মাল হিসেবে ভাগ করেও দেয়া হয়েছিল, যার ফোলে সেই মেয়েটির জীবনে কী ঘটেছিল আমরা অনুমান করতে পারি। এরকম ভয়াবহ নির্মমতার পরেও ইসলাম যখন শান্তির ধর্ম হিসেবে নিজেকে দাবী করে, তখন আসলে হাসিই পায়।
তথ্যসূত্রঃ
- সহজ নসরুল বারী, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৩ ↩︎
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৪৪২১ ↩︎
- সহিহ মুসলিম শরীফ (প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ বঙ্গানুবাদ), মাকতাবাতুল হাদীছ প্রকাশনী, ১৭ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১ ↩︎
- আর রাহীকুল মাখতূম, আল্লামা সাফিউর রহমান মোবারকপুরী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ৩৮০, ৩৮১ ↩︎
- সিরাতে রাসুলাল্লাহ (সাঃ), অনুবাদ, শহীদ আখন্দ, প্রথমা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৭০৬ ↩︎