সর্বশক্তিমান আল্লাহর ছয়দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি

ভূমিকা

কোরআন দাবি করে যে এই বিশাল মহাবিশ্ব আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় মাত্র ছয় দিনে সৃষ্টি হয়েছে—আরেক জায়গায় আবার বলা হয়েছে আট দিনে। এটি শুধু সংখ্যাগত অসঙ্গতি নয়; বরং একটি মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক সংকট। কারণ, এই দুটি পরস্পরবিরোধী বর্ণনা একই গ্রন্থে, একই স্রষ্টার বাণী হিসেবে বিদ্যমান। এই প্রবন্ধে আমরা অনুসন্ধান করব, কোরআনের এই দাবিগুলির পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক ভিত্তি আদৌ আছে কিনা, নাকি এগুলো কেবল প্রাচীন পৌরাণিক ধারণার পুনরাবৃত্তি।

আমরা দেখব—কোরআন একদিকে বলে, আল্লাহ্‌ কিছু সৃষ্টি করতে চাইলে কেবল “হও” (كُنْ) বললেই তা সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায়; অন্যদিকে একই গ্রন্থে বলা হচ্ছে, মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে তাঁর ছয় দিন লেগেছে। এই দুটি বক্তব্য একে অপরের বিপরীত। যদি “হও” বললেই তা তৎক্ষণাৎ হয়ে যায়, তাহলে সময়ের প্রয়োজন কেন? ছয় দিন, বা আট দিন—এই সময়কাল আল্লাহ্‌র সর্বশক্তিমান সত্তার ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক। এমন এক সত্তা, যিনি সময়ের বাইরে অবস্থিত বলে দাবি করা হয়, তিনি সময়নির্ভর হয়ে পড়লেন কীভাবে?

কোরআনের সৃষ্টিবর্ণনা শুধু ধর্মতাত্ত্বিক নয়, বরং বিজ্ঞানবিরোধীও বটে। দিন ও রাতের ধারণা কেবল তখনই অর্থবহ, যখন কোনো গ্রহ একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণন করে। কিন্তু কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী সূর্য ও নক্ষত্র সৃষ্টির আগেই দিন, রাত, পাহাড় ও উদ্ভিদ বিদ্যমান ছিল। এই ধারণা পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়ম, এমনকি প্রাথমিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথেও সামঞ্জস্যহীন।

এই প্রবন্ধে আমরা প্রথমে আলোচনা করব—কোরআনের “ছয় দিনে সৃষ্টি” ধারণাটি কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, এবং এর সাথে “হও” তত্ত্বের মৌলিক বিরোধ কোথায়। এরপর পর্যালোচনা করব সূরা ফুসসিলাতের “আট দিনের” বর্ণনা, যা ভাষাগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা হিসাব প্রদান করে। আমরা দেখব কীভাবে প্রাচীন তাফসিরকাররা এই স্ববিরোধিতা মেরামত করতে গিয়ে একের পর এক যুক্তিহীন ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন। পাশাপাশি দেখব, হাদিসে মুহাম্মদ নিজে কীভাবে প্রতিটি দিনের সৃষ্টি ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করেছেন—যা বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক উভয় দৃষ্টিতেই হাস্যকর।

সবশেষে এই প্রবন্ধে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাই করা হবে, আদৌ “ছয় দিন” বা “আট দিন” নামের এই সময়কাল কোনো ভৌত বাস্তবতায় প্রযোজ্য হতে পারে কিনা। আমরা দেখব, কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব আধুনিক মহাবিশ্বতত্ত্বের (cosmology) সাথে শুধু অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয়, বরং এর বিপরীতে অবস্থান করে। এবং এই অসামঞ্জস্যই প্রমাণ করে যে কোরআনের সৃষ্টিবর্ণনা একটি ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক কল্পকাহিনি, যার মূল উৎস বাইবেলিক উপাখ্যান ও প্রাচীন সেমিটিক মিথ।


সর্বশক্তিমান সত্তার দীর্ঘ সময়

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ সর্বশক্তিমান—তিনি যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করতে চান, তখন কেবল “হও” (كُنْ) বলেন, আর তা সঙ্গে সঙ্গেই অস্তিত্বে আসে। [1] কোরআন অসংখ্য আয়াতে এই ধারণা পুনরাবৃত্তি করেছে যে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য কোনো সময়, মাধ্যম বা প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না। তাঁর একমাত্র আদেশেই সৃষ্টি ঘটে। কিন্তু এখানেই দেখা যায় এক মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক ও যৌক্তিক সংকট। যদি সত্যিই “হও” বললেই সবকিছু সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যায়, তবে মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে তার ছয় দিন বা আট দিন লাগল কেন? কেন একজন সর্বশক্তিমান সত্তা ধাপে ধাপে কাজ করবেন, সময় ব্যয় করবেন, যখন তার ইচ্ছাতেই তা তৎক্ষণাৎ সম্পন্ন হতে পারে?

এই প্রশ্ন শুধু সময়ের নয়, বরং সত্তাগত সীমাহীনতারও। ছয় দিনের সৃষ্টিকাল আল্লাহকে সময়ের অধীন করে তোলে—অর্থাৎ তিনি সময়ের ভেতরে ক্রিয়াশীল এক অস্তিত্ব, সময়ের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু ইসলাম আবার দাবি করে যে আল্লাহ সময় ও স্থানের বাইরে অবস্থান করেন। ফলে দুটি বিশ্বাস একে অপরকে বাতিল করে দেয়। যদি আল্লাহ সময়ের বাইরে থাকেন, তবে “ছয় দিন” বলে কোনো সময়কাল তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; আর যদি ছয় দিন সত্যিই লাগে, তবে তিনি সময়ের ভেতরেই কাজ করেছেন—যা সর্বশক্তিমান, কালাতীত সত্তার ধারণার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

অতএব, “হও” বললেই সবকিছু হয়ে যায়—এই ধারণা একদিকে আল্লাহর সীমাহীন শক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, একই গ্রন্থে “ছয় দিনে সৃষ্টি” বলা হলে সেটি সেই শক্তির সীমাবদ্ধতাকেই স্বীকার করে। এই অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য কোরআনের সবচেয়ে মৌলিক যুক্তিহীনতার একটি উদাহরণ, যা ধর্মতত্ত্ব ও যুক্তিবিদ্যা—দুই দিক থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ।

মারইয়াম বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! কীভাবে আমার পুত্র হবে, অথচ আমাকে কোন মানব স্পর্শ করেনি’। তিনি বললেন, ‘এভাবেই’ আল্লাহ সৃজন করেন যা তিনি ইচ্ছে করেন, তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘‘হয়ে যাও’’ সুতরাং তা হয়ে যায়।
— Taisirul Quran
সে বলেছিলঃ হে আমার রাব্ব! কিরূপে আমার পুত্র হবে? কোন পুরুষ মানুষতো আমাকে স্পর্শ করেনি; তিনি বললেনঃ এরূপে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, সৃষ্টি করে থাকেন, যখন তিনি কোন কাজের মনস্থ করেন তখন তিনি ওকে ‘হও’ বলেন, ফলতঃ তাতেই হয়ে যায়।
— Sheikh Mujibur Rahman
মারইয়াম বলল, ‘হে আমার রব, কিভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি’! আল্লাহ বললেন, ‘এভাবেই’ আল্লাহ যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাকে শুধু বলেন, ‘হও’। ফলে তা হয়ে যায়।
— Rawai Al-bayan
সে বলল, ‘হে আমার রব! আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি, এমতাবস্থায় আমার সন্তান হবে কিভাবে?’ তিনি (আল্লাহ্‌) বললেন, ‘এভাবেই’, আল্লাহ্‌ যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায় [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

মহাবিশ্ব 13

আসুন কোরআনের আরেকটি আয়াতটি পড়ে নিই, [2]

Originator of the heavens and the earth. When He decrees a matter, He only says to it, “Be,” and it is.
— Saheeh International
The Originator of the heavens and the earth! When He decreeth a thing, He saith unto it only: Be! and it is.
— M. Pickthall
আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনকারী, যখন কোন কাজ করতে মনস্থ করেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন, হয়ে যাও, তক্ষুনি তা হয়ে যায়।
— Taisirul Quran
তিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং যখন তিনি কোন কাজ সম্পাদন করতে ইচ্ছা করেন তখন তার জন্য শুধুমাত্র ‘হও’ বলেন, আর তাতেই তা হয়ে যায়।
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়।
— Rawai Al-bayan
তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের উদ্ভাবক। আর যখন তিনি কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার জন্য শুধু বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এই আয়াতটির তাফসীরও একইসাথে পড়ে নেয়া জরুরি, [3]

মহাবিশ্ব 15
মহাবিশ্ব 17

আল্লাহর একদিন সমান কতদিন?

কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে আল্লাহ যেখানে অবস্থান করেন, সেখানেও দিন ও রাতের হিসাব বিদ্যমান। তবে সেই সময়মান নাকি মানুষের সময়ের তুলনায় বহু গুণ দীর্ঘ। ইসলাম দাবী করে, মানুষের একদিন আল্লাহর কাছে এক হাজার বছরের সমান। এই বক্তব্যটি আপাতদৃষ্টিতে আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করতে চাইলেও, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে একাধিক যৌক্তিক ও জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি।

প্রথমত, “দিন” বা “রাত” এমন ধারণা কেবল তখনই প্রযোজ্য যখন কোনো গ্রহ তার অক্ষে ঘুরে একটি নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। যদি আল্লাহ সময় ও স্থানের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন, তবে তাঁর নিকটে “দিন” বা “রাত” বলে কিছু থাকারই কথা নয়। কিন্তু কোরআনের এই আয়াতগুলো ইঙ্গিত দেয় যে আল্লাহর অবস্থানও এমন কোনো স্থানে, যেখানে দিন-রাতের পার্থক্য বিদ্যমান—অর্থাৎ সেখানে ঘূর্ণায়মান একটি গ্রহ এবং আলোদানকারী কোনো নক্ষত্র থাকতে হয়। অন্যভাবে বললে, এই বর্ণনা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে যে আল্লাহও এক ধরনের ভৌত স্থানের বা গ্রহের অধিবাসী।

দ্বিতীয়ত, যদি তার একদিন মানুষের এক হাজার বছরের সমান হয়, তবে তা সময়ের একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ নির্দেশ করে—যা তাকে সময়ের সীমাবদ্ধতার ভেতরে নিয়ে আসে। অথচ ইসলাম দাবি করে আল্লাহ সময়ের বাইরের এক সত্তা। ফলে এই আয়াত সময় ও কালাতীত- এই ধারণাকে একইসঙ্গে সত্য ধরে, যা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব।

অতএব, কোরআনের এই “আল্লাহর একদিন = মানুষের এক হাজার বছর” ধারণাটি ঈশ্বরের অসীমত্বের বদলে তাকে সময় ও স্থান-নির্ভর সত্তা হিসেবে চিত্রিত করে। এটি একদিকে ধর্মতাত্ত্বিকভাবে আত্মবিরোধী, অন্যদিকে ভৌত বাস্তবতার সাথেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। [4] [5]-

তোমার প্রতিপালকের একদিন হল তোমাদের গণনায় এক হাজার বছরের সমান।
— Taisirul Quran
তোমার রবের একদিন তোমাদের গণনায় সহস্র বছরের সমান।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তোমার রবের নিকট নিশ্চয় এক দিন তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান।
— Rawai Al-bayan
আর নিশ্চয় আপনার রবের কাছে একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান;
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

তিনি আকাশ হতে পৃথিবী পর্যন্ত কার্য পরিচালনা করেন, অতঃপর সকল বিষয়াদি তাঁরই কাছে একদিন উত্থিত হবে যার পরিমাপ তোমাদের গণনা অনুযায়ী হাজার বছর।
— Taisirul Quran
তিনি আকাশ হতে পৃথিবী পর্যন্ত সমুদয় বিষয় পরিচালনা করেন, অতঃপর একদিন সব কিছুই তাঁর সমীপে সমুত্থিত হবে, যে দিনের পরিমাপ হবে তোমাদের হিসাবে হাজার বছরের সমান।
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সকল কার্য পরিচালনা করেন। তারপর তা একদিন তাঁর কাছেই উঠবে। যেদিনের পরিমাণ হবে তোমাদের গণনায় হাজার বছর।
— Rawai Al-bayan
তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সমুদয় বিষয় পরিচালনা করেন, তারপর সব কিছুই তাঁর সমীপে উত্থিত হবে এমন এক দিনে যার পরিমাণ হবে তোমাদের গণনা অনুসারে হাজার বছর [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

আবার আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে আরোহণ করে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর [6]

ফেরেশতা এবং রূহ (অর্থাৎ জিবরীল) আল্লাহর দিকে আরোহণ করে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।
— Taisirul Quran
মালাইকা/ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে, যা পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বৎসরের সমান।
— Sheikh Mujibur Rahman
ফেরেশতাগণ ও রূহ এমন এক দিনে আল্লাহর পানে ঊর্ধ্বগামী হয়, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।
— Rawai Al-bayan
ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে উর্ধ্বগামী হয় [১] এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর [২]
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

উপরের আয়াতটি থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ যেখানে থাকেন সেখানেও দিনরাত রয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে তিনি কোন গ্রহে বসবাস করেন, সেই গ্রহটিও ঘূর্ণায়মান এবং গ্রহটির নিকটবর্তী একটি নক্ষত্র রয়েছে যা গ্রহটিকে আলো দেয়। নতুবা তার দিনের হিসেব থাকার কথা নয়। আমরা জানি, এক বছরে ৮৭৬০ ঘণ্টা। অর্থাৎ, এক হাজার বছরে ৮৭৬০০০০ ঘণ্টা। অর্থাৎ গ্রহটি নিজ অক্ষের ওপর একবার ঘুরতে এই সময় প্রয়োজন হয়। এরকম গ্রহ আদৌ থাকা সম্ভব কিনা, সেটি একটি প্রশ্ন বটে। সেটিও মেনে নিলে, আল্লাহ পাক যে কোন একটি গ্রহে বসবাস করেন, সেই গ্রহের নিকটবর্তী যে একটি নক্ষত্র রয়েছে, সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। নইলে সেখানে দিন আসবে কোথা থেকে? দিন থাকলে অবশ্যই সেই গ্রহে অন্তত একটি নিকটবর্তী নক্ষত্র প্রয়োজন, তাই না?


আল্লাহ ছয়দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন

আসুন শুরুতেই কোরআনের আয়াতগুলো পড়ে নেয়া যাক, [7] [8] [9]

নি:সন্দেহ, তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ , যিনি আসমান ও জমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করিয়াছেন, অনন্তর সিংহাসনে সমাসীন হইয়াছেন, তিনিই দিনকে রাত্রির দ্বারা আচ্ছাদিত করেন, যাহা উহার পিছনে দৌড়াইয়া চলে এবং তিনিই চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রসমূহকে তাহার নির্দেশাধীন করিয়াছেন।

তোমাদের প্রতিপালক সেই আল্লাহ তিনি আকাশ ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করিয়াছেন ছয় দিবসে, তৎপর তিনি অধিষ্ঠিত হন আরশের উপর।

আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’এর মাঝে যা কিছু আছে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন- অতঃপর তিনি ‘আরশে সমুন্নত হন। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য কোন অভিভাবক নেই, সুপারিশকারীও নেই। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?
— Taisirul Quran
আল্লাহ, তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও এতদুভয়ের অন্তবর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক নেই এবং সাহায্যকারীও নেই, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা?
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীন এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের জন্য কোন অভিভাবক নেই এবং নেই কোন সুপারিশকারী। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?
— Rawai Al-bayan
আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই ও সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এবারে আসুন উপরের আয়াতটির তাফসীর পড়ে নিই তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে [10]

মহাবিশ্ব 19
মহাবিশ্ব 21

এবারে আসুন তাফসীরে মাযহারী থেকে দেখে নেয়া যাক, এই বিষয়ে সেখানে কী বলা হয়েছে, [11]

মহাবিশ্ব 23

এবারে আসুন তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ে নিই, এই ছয়দিনে মহাবিশ্ব সম্পর্কে, [12]

মহাবিশ্ব 25

আল্লাহ আট দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন

কোরআনের অধিকাংশ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ছয় দিনে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু সূরা ফুসসিলাত (৪১:৯–১২)-এর বিবরণে গিয়ে দেখা যায়, সংখ্যাগতভাবে হিসাব দাঁড়ায় আট দিন। অর্থাৎ একই কোরআনে সৃষ্টির সময় দুইভাবে বলা হয়েছে—এক জায়গায় ছয় দিন, অন্য জায়গায় আট দিন। এটি ইসলামী পাঠ্যের অন্যতম স্পষ্ট স্ববিরোধী উদাহরণ।

সূরা ফুসসিলাতে ধারাবাহিক আয়াতগুলো পড়লে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ঃ

(৪১:৯) — “বল, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করছ, যিনি পৃথিবী দুই দিনে সৃষ্টি করেছেন…”
(৪১:১০) — “তিনি পৃথিবীতে পাহাড় স্থাপন করেছেন, তাতে আশীর্বাদ দিয়েছেন, জীবিকার উপকরণ নির্ধারণ করেছেন — চার দিনে, যারা তা চায় তাদের জন্য।”
(৪১:১১–১২) — “তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, তখন তা ধোঁয়া ছিল। তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, ‘এসো, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।’ … তারপর তিনি দুই দিনে সাত আকাশ বানালেন…”

এই ধারাবাহিক বর্ণনা অনুযায়ী সহজ গণনা দাঁড়ায়ঃ

বিবরণসময়
পৃথিবী সৃষ্টি২ দিন
পৃথিবীর স্থিতিশীলতা ও জীবিকার ব্যবস্থা৪ দিন
আকাশ সৃষ্টি২ দিন
মোট৮ দিন

অর্থাৎ সূরা ফুসসিলাতে বর্ণিত সময় অনুযায়ী মোট আট দিন লাগে। অথচ সূরা আরাফ (৭:৫৪), ইউনুস (১০:৩), সাজদা (৩২:৪) প্রভৃতি স্থানে বলা হয়েছে—সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মানে, কোরআনের দুই জায়গার বর্ণনা পরস্পরকে সরাসরি বিরোধ করে।


তাফসিরকারদের সমন্বয়ের চেষ্টা

প্রাচীন ইসলামী ব্যাখ্যাকারকগণ এই সাংঘর্ষিক অবস্থাটি টের পেয়ে বিভিন্নভাবে তা গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে ইবন কাসীর, তাবারী ও কুরতুবি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যাগুলি পরস্পরবিরোধী ও ভাষাগতভাবে দুর্বল।

তাফসির ইবন কাসীর বলেন—৪১:১০-এর “চার দিনে” আসলে পূর্বের দুই দিনের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ পৃথিবী সৃষ্টি ও জীবিকার প্রস্তুতি মিলিয়ে মোট চার দিন, আলাদা নয়। তাই তার ব্যাখ্যায় মোট হিসাব দাঁড়ায়: পৃথিবী ও জীবিকা = ৪ দিন + আকাশ = ২ দিন → মোট ৬ দিন।

কিন্তু এখানে আরবি শব্দ “ثُمَّ” (থুম্মা) ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ “তারপর” — এটি কোরআনের ব্যাকরণে ক্রমানুসারে আলাদা ধাপ নির্দেশ করে, একই সময়ের মধ্যে নয়। তাই “চার দিনে” অংশটি আগের দুই দিনের অন্তর্ভুক্ত বলা ভাষাগতভাবে দুর্বল। বহু আরবি ব্যাকরণবিদ (যেমন: আল-ফারর, জামাখশারী, এবং আধুনিক ভাষাবিদ Mustansir Mir, 1989) দেখিয়েছেন যে “ثم” কখনো একসাথে সংঘটিত কাজ বোঝায় না; এটি “ধাপে ধাপে পরবর্তী ঘটনা” নির্দেশ করে।

তাফসির আল-তাবারী একই যুক্তি অনুসরণ করে বলেন, “চার দিনে” অর্থ “দুই যোগ দুই”, অর্থাৎ পূর্বের ধাপসহ। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে “ثم” ক্রমবাচক, তাই পাঠ্যগত সামঞ্জস্যতা এখানে দুর্বল হয়ে পড়ে।


ভাষাগত বিশ্লেষণ

আরবি ভাষার “ثم” ও “في أربعة أيام” গঠনটি (in four days) সাধারণত নতুন ধাপ বোঝায়, পূর্ববর্তী সময়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন, “সে শহর নির্মাণ করল দুই দিনে, তারপর চার দিনে তাতে বাগান ও রাস্তা বানালো”—এই বাক্যে মোট ছয় দিনের ধাপ বোঝায়, চার নয়। ঠিক তেমনই সূরা ফুসসিলাতেও “দুই দিনে সৃষ্টি, তারপর চার দিনে জীবিকা, তারপর দুই দিনে আকাশ” — এই ক্রম আট দিনের মোট হিসাব দেয়।

অতএব, কোরআনের ভাষাগত কাঠামো নিজেই দেখায় যে “ছয় দিনে সৃষ্টি” ও “আট দিনে সৃষ্টি” — এই দুই বর্ণনা সমান্তরাল নয়, বরং পরস্পরবিরোধী। একে একীভূত করতে হলে কোরআনের মূল আরবি বাক্যকেও বিকৃতভাবে পুনরায় ব্যাখ্যা করতে হয়, যা ধর্মতাত্ত্বিক সততার পরিপন্থী।


আধুনিক ইসলামিক এপোলোজিস্ট

বর্তমান যুগের ইসলামপন্থী ব্যাখ্যাকারীরা সাধারণত দাবি করেন—“চার দিনে” মানে “মোট চার দিন”, অতিরিক্ত নয়। অর্থাৎ প্রথম দুই দিনের কাজসহ মিলিয়ে মোট চার দিন, তারপর আরও দুই দিন আকাশ — সবমিলিয়ে ছয় দিন। কিন্তু এই সমাধানকে ব্যাকরণ ও প্রেক্ষিত উভয় দিক থেকেই অযৌক্তিক বলা হয়, কারণ “في أربعة أيام” গঠনটি সাধারণ আরবিতে “অতিরিক্ত চার দিন” বোঝায়, “মোট চার দিন” নয়। ফলে এটি প্রকৃত অর্থে একটি পাঠ্যবিরোধ দূর করার কৃত্রিম প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়।


সারসংক্ষেপ

সূরাবর্ণনাদিন সংখ্যামন্তব্য
সূরা আল-আ’রাফ, ইউনুস, ক্বাফ ইত্যাদিসবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টিহও বললেই হয়ে গেলে ৬ দিন কেন?
সূরা ফুসসিলাত ৪১:৯–১২পৃথিবী ২ + জীবিকা ৪ + আকাশ ২৬ দিন বাকি ৮ দিন?

অতএব, ভাষা, যুক্তি ও গণনা—সবদিক দিয়েই সূরা ফুসসিলাত কোরআনের ছয় দিনের সৃষ্টিবর্ণনার সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে। আল্লাহ যদি সর্বজ্ঞ ও অপরিবর্তনীয় হন, তবে তাঁর বাণীতে এই মৌলিক সংখ্যাগত বিভ্রান্তি থাকা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং এটি প্রমাণ করে, এই গ্রন্থটি ধাপে ধাপে সংকলিত ও সম্পাদিত মানুষের রচনাই বেশি—যেখানে বিভিন্ন সময় ও উৎসের পুরনো মিথ এবং বাইবেলিক কাঠামো মিশে গিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি তৈরি করেছে।


হাদিসে আরও বিস্তারিত বিবরণ

শুধু তাই নয়, সহিহ হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, মুহাম্মদ একদম ধরে ধরে বলে দিয়েছেন, কোন দিন আল্লাহ কী কী সৃষ্টি করেছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টি বা সূর্যের সৃষ্টির পুর্বে শনি রবি সোমবার কোথা থেকে আসলো, সেটিই প্রশ্ন। কারণ এই বারগুলো সূর্য বা নিকটবর্তী নক্ষত্রের ওপর নির্ভরশীল। সেইসাথে লক্ষ্য করুন, নূর সৃষ্টির আগেই আল্লাহপাক গাছপালা সৃষ্টি করে বসে আছেন। এরকম নির্বোধ আল্লাহকে কে বোঝাবে যে, গাছপালার সালোক সংশ্লেষণের জন্য আলোর প্রয়োজন? [13] [14]

সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী)
অধ্যায়ঃ ৫২। কিয়ামাত, জান্নাত ও জান্নামের বর্ণনা
পাবলিশারঃ হাদিস একাডেমি
পরিচ্ছদঃ ১. সৃষ্টির সূচনা এবং আদাম (আঃ) এর সৃষ্টি
৬৯৪৭-(২৭/২৭৮৯) সুরায়জ ইবনু ইউনুস ও হারূন ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রহঃ) ….. আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেন, আল্লাহ তা’আলা শনিবার দিন মাটি সৃষ্টি করেন এবং এতে পর্বত সৃষ্টি করেন রবিবার দিন সোমবার দিন তিনি বৃক্ষরাজি সৃষ্টি করেন। মঙ্গলবার দিন তিনি বিপদাপদ সৃষ্টি করেন। তিনি নূর সৃষ্টি করেন বুধবার দিন। তিনি বৃহস্পতিবার দিন পৃথিবীতে পশু-পাখি ছড়িয়ে দেন এবং জুমুআর দিন আসরের পর জুমুআর দিনের শেষ মুহূর্তে অর্থাৎ আসর থেকে নিয়ে রাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যবর্তী সময়ে সর্বশেষ মাখলুক আদাম (আঃ) কে সৃষ্টি করেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৭৯৭,ইসলামিক সেন্টার ৬৮৫১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫৩/ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ
পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
পরিচ্ছদঃ ২. সৃষ্টির সূচনা এবং আদম (আঃ) এর সৃষ্টি
৬৭৯৭। সুরায়জ ইবনু ইউনুস ও হারুন ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেন, আল্লাহ তাআলা শনিবার দিন মাটি সৃষ্টি করেন। রোববার দিন তিনি এতে পর্বত সৃষ্টি করেন। সোমবার দিন তিনি বৃক্ষরাজি সৃষ্টি করেন। মঙ্গলবার দিন তিনি আপদ বিপদ সৃষ্টি করেন। বুধবার দিন তিনি নূর সৃষ্টি করেন। বৃহস্পতিবার দিন তিনি পৃথিবীতে পশু-পাখি ছড়িয়ে দেন এবং জুমুআর দিন আসরের পর তিনি আদম (আলাইহিস সালাম) কে সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ জুমুআর দিনের সময়সমূহের শেষ মুহূর্তে (মাখলূক) আসর থেকে রাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এবারে আসুন চার্ট আকারে দেখি,

দিনসৃষ্টিকর্মবর্ণনা উৎসমন্তব্য
শনিবার (سبت)মাটি (Earth / Dust)সহীহ মুসলিম, হাঃ একাডেমী ৬৯৪৭; ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৭৯৭সৃষ্টির সূচনা—“আল্লাহ শনিবার দিন মাটি সৃষ্টি করেন।”
রবিবার (أحد)পর্বত (Mountains)একইমাটির পরে পৃথিবীতে পর্বত স্থাপন করা হয়।
সোমবার (إثنين)বৃক্ষরাজি (Vegetation / Trees)একইআল্লাহ সোমবার দিন উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি সৃষ্টি করেন।
মঙ্গলবার (ثلاثاء)বিপদ-আপদ (Calamities / Misfortunes)একইমঙ্গলবার দিন “বালা-মুসিবত” বা বিভিন্ন বিপদ সৃষ্টি করেন।
বুধবার (أربعاء)নূর (Light)একইনূর (আলো) সৃষ্টি—অর্থাৎ সূর্য বা আলোক উৎসের সৃষ্টির পূর্বে।
বৃহস্পতিবার (خميس)পশু-পাখি (Animals and Birds)একইপৃথিবীতে জীবজন্তু ও পাখিপ্রজাতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
জুমুআর দিন (جمعة)আদম (আঃ)একইআসরের পর থেকে রাত পর্যন্ত সময়ে আদম (আঃ) সৃষ্ট। মানবজাতির সূচনা।
আদম ছাড়া মোট ধাপ৬ টিএখানে মোট ছয়টি স্বতন্ত্র দিনের হিসেব আছে, যা সবই পৃথিবী কেন্দ্রিক। কোরআনে বলা আছে পৃথিবী সৃষ্টির পরে আল্লাহ মহাকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং সেগুলো বানালেন। আসমান যদি আরও দুইদিনে বানান তাহলে সর্বমোট হিসেব হয় আট দিনের।

বাইবেলের কপিপেস্ট?

কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের বিবরণ, বিশেষ করে “ছয় দিনে সৃষ্টি” এবং প্রতিদিন নির্দিষ্ট উপাদান তৈরি হওয়ার ধারণা, মূলত বাইবেলের আদিপুস্তকের বর্ণনার প্রায় হুবহু অনুকরণ। এতে দেখা যায়, আল্লাহ প্রথমে পৃথিবী ও পাহাড়, পরে উদ্ভিদ, এরপর আলো ও আকাশ, তারপর জীবজন্তু এবং শেষে মানুষ সৃষ্টি করেছেন—একই ক্রম বাইবেলের ‘Genesis’ অধ্যায়ে উপস্থিত। পার্থক্য শুধু নামের: বাইবেলে “God”, কোরআনে “Allah”; বাক্যগঠন, ঘটনার ক্রম ও ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামো প্রায় অভিন্ন।

এটি কেবল ধর্মীয় অনুপ্রেরণার সামঞ্জস্য নয়, বরং একটি স্পষ্ট টেক্সচুয়াল ধারাবাহিকতা। সপ্তম শতাব্দীর আরব উপদ্বীপে ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রভাব ছিল ব্যাপক, বিশেষত ইয়াসরিব (মদিনা) অঞ্চলে। ইসলামী কাহিনির বহু উপাদান, যেমন আদম-হাওয়া, নূহ, ইব্রাহিম, লুত, ইউসুফ, এমনকি ফেরেশতা ও শয়তানের কাঠামো পর্যন্ত, সরাসরি পুরনো বাইবেলিক বা মিদ্রাশিক সূত্র থেকে পুনরাবৃত্ত। এই প্রভাব কোরআনের সৃষ্টিবর্ণনাতেও একইভাবে প্রতিফলিত।

বৈজ্ঞানিকভাবে সবচেয়ে স্পষ্ট অসঙ্গতি হলো: কোরআন যেমন বলে, সূর্য ও নক্ষত্র সৃষ্টির আগে পৃথিবীতে পাহাড় ও উদ্ভিদ বিদ্যমান ছিল, তেমনি বাইবেলেও বলা হয় গাছপালা সূর্যের পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছে। অথচ আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি অসম্ভব। কারণ সালোক সংশ্লেষণ (photosynthesis) ছাড়াই কোনো উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারে না, আর সালোক সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন সূর্যের আলো। ফলে দেখা যায়, কোরআনিক বর্ণনা কেবল বাইবেলের আক্ষরিক পুনরাবৃত্তি নয়, তার ভুল বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোকেও অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছে।

এছাড়া উভয় গ্রন্থেই “ঈশ্বর ছয় দিনে সৃষ্টি করলেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিলেন” এই প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যের কসমোলজিকাল ছাঁচ বজায় আছে। ইসলামী ব্যাখ্যাকারীরা পরবর্তীকালে “বিশ্রাম” অংশটি বাদ দিয়ে “আরশে সমাসীন হওয়া” রূপ দিয়েছেন—কিন্তু মূল সময়বিন্যাস ও ঘটনাক্রম একই থেকে গেছে। এটি স্পষ্ট করে যে কোরআনের সৃষ্টিবর্ণনা কোনো স্বাধীন প্রকাশ নয়, বরং পুরনো মিথের ধর্মীয় পুনর্লিখন মাত্র।

অতএব, কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব বাইবেল থেকে “ধর্মীয় ধারাবাহিকতা” নয়, বরং “বুদ্ধিবৃত্তিক নির্ভরতা” প্রদর্শন করে। এটি দেখায় যে মুহাম্মদ সময়ের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান ইহুদি-খ্রিষ্টান পৌরাণিক কাহিনিগুলোকেই নিজের নবুয়তের অংশ হিসেবে পুনরাবৃত্ত করেছেন। ভাষার দিক থেকে কোরআন হয়তো আলাদা, কিন্তু ভাবগত ও কাঠামোগতভাবে এটি বাইবেলের এক প্রাচ্য সংস্করণ—যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রায় প্রতিটি বক্তব্যই প্রতীকী নয়, বরং নিরেটভাবে ভুল। আসুন বাইবেলে কী বলা আছে সেটিও দেখে নিই [15]। উল্লেখ্য, বাইবেলেও বলা হয়েছে সূর্যের আগেই পৃথিবীতে গাছপালা সৃষ্টি করা হয়েছে, যেই কথাগুলো কতটা হাস্যকর তা পাঠকই বিবেচনা করবেন।

10 ঈশ্বর শুকনো জমির নাম দিলেন, “পৃথিবী” এবং এক জায়গায় জমা জলের নাম দিলেন, “মহাসাগর।” ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে।
11 তখন ঈশ্বর বললেন, “পৃথিবীতে ঘাস হোক, শস্যদায়ী গাছ ও ফলের গাছপালা হোক। ফলের গাছগুলিতে ফল আর ফলের ভেতরে বীজ হোক। প্রত্যেক উদ্ভিদ আপন আপন জাতের বীজ সৃষ্টি করুক। এইসব গাছপালা পৃথিবীতে বেড়ে উঠুক।” আর তাই-ই হল।
12 পৃথিবীতে ঘাস আর শস্যদায়ী উদ্ভিদ উত্পন্ন হল। আবার ফলদায়ী গাছপালাও হল, ফলের ভেতরে বীজ হল। প্রত্যেক উদ্ভিদ আপন আপন জাতের বীজ সৃষ্টি করল এবং ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে।
13 সন্ধ্যা হল এবং সকাল হল। এভাবে হল তৃতীয় দিন।
14 তারপর ঈশ্বর বললেন, “আকাশে আলো ফুটুক। এই আলো দিন থেকে রাত্রিকে পৃথক করবে। এই আলোগুলি বিশেষ সভা শুরু করার বিশেষ বিশেষ সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আর দিন ও বছর বোঝাবার জন্য এই আলোগুলি ব্যবহৃত হবে।
15 পৃথিবীতে আলো দেওয়ার জন্য এই আলোগুলি আকাশে থাকবে।” এবং তা-ই হল।
16 তখন ঈশ্বর দুটি মহাজ্যোতি বানালেন। ঈশ্বর বড়টি বানালেন দিনের বেলা রাজত্ব করার জন্য আর ছোটটি বানালেন রাত্রিবেলা রাজত্ব করার জন্য। ঈশ্বর তারকারাজিও সৃষ্টি করলেন।
17 পৃথিবীকে আলো দেওয়ার জন্য ঈশ্বর এই আলোগুলিকে আকাশে স্থাপন করলেন।
18 দিন ও রাত্রিকে কর্তৃত্ব দেবার জন্য ঈশ্বর এই আলোগুলিকে আকাশে সাজালেন। এই আলোগুলি আলো আর অন্ধকারকে পৃথক করে দিল এবং ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটা ভাল হয়েছে।
19 সন্ধ্যা হল এবং সকাল হল। এভাবে চতুর্থ দিন হল।
20 তারপর ঈশ্বর বললেন, “বহু প্রকার জীবন্ত প্রাণীতে জল পূর্ণ হোক আর পৃথিবীর ওপরে আকাশে ওড়বার জন্য বহু পাখি হোক।”
21 সুতরাং ঈশ্বর বড় বড় জলজন্তু এবং জলে বিচরণ করবে এমন সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করলেন। অনেক প্রকার সামুদ্রিক জীব রয়েছে এবং সে সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি। যত রকম পাখি আকাশে ওড়ে সেইসবও ঈশ্বর বানালেন। এবং ঈশ্বর দেখলেন ব্যবস্থাটি ভাল হয়েছে।
22 ঈশ্বর এই সমস্ত প্রাণীদের আশীর্বাদ করলেন। ঈশ্বর সামুদ্রিক প্রাণীদের সংখ্যাবৃদ্ধি করে সমুদ্র ভরিয়ে তুলতে বললেন। ঈশ্বর পৃথিবীতে পাখিদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে বললেন।
23 সন্ধ্যা হয়ে গেল এবং তারপর সকাল হল। এভাবে পঞ্চম দিন কেটে গেল।
24 তারপর ঈশ্বর বললেন, “নানারকম প্রাণী পৃথিবীতে উত্পন্ন হোক। নানারকম বড় আকারের জন্তু জানোয়ার আর বুকে হেঁটে চলার নানারকম ছোট প্রাণী হোক এবং প্রচুর সংখ্যায় তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হোক।” তখন য়েমন তিনি বললেন সব কিছু সম্পন্ন হল।
25 সুতরাং ঈশ্বর সব রকম জন্তু জানোয়ার তেমনভাবে তৈরি করলেন। বন্য জন্তু, পোষ্য জন্তু আর বুকে হাঁটার সবরকমের ছোট ছোট প্রাণী ঈশ্বর বানালেন এবং ঈশ্বর দেখলেন প্রতিটি জিনিসই বেশ ভালো হয়েছে।
26 তখন ঈশ্বর বললেন, “এখন এস, আমরা মানুষ সৃষ্টি করি। আমাদের আদলে আমরা মানুষ সৃষ্টি করব। মানুষ হবে ঠিক আমাদের মত। তারা সমুদ্রের সমস্ত মাছের ওপরে আর আকাশের সমস্ত পাখির ওপরে কর্তৃত্ব করবে। তারা পৃথিবীর সমস্ত বড় জানোয়ার আর বুকে হাঁটা সমস্ত ছোট প্রাণীর উপরে কর্তৃত্ব করবে।”
27 তাই ঈশ্বর নিজের মতোই মানুষ সৃষ্টি করলেন। মানুষ হল তাঁর ছাঁচে গড়া জীব। ঈশ্বর তাদের পুরুষ ও স্ত্রীরূপে সৃষ্টি করলেন।
28 ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করে বললেন, “তোমাদের বহু সন্তানসন্ততি হোক। মানুষে মানুষে পৃথিবী পরিপূর্ণ করো এবং তোমরা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণের ভার নাও, সমুদ্রে মাছেদের এবং বাতাসে পাখিদের শাসন করো। মাটির ওপর যা কিছু নড়েচড়ে, যাবতীয় প্রাণীকে তোমরা শাসন করো।”
29 ঈশ্বর বললেন, “আমি তোমাদের শস্যদায়ী সমস্ত গাছ ও সমস্ত ফলদায়ী গাছপালা দিচ্ছি। ঐসব গাছ বীজযুক্ত ফল উৎপাদন করে। এই সমস্ত শস্য ও ফল হবে তোমাদের খাদ্য।
30 এবং জানোয়ারদের সমস্ত সবুজ গাছপালা দিচ্ছি। তাদের খাদ্য হবে সবুজ গাছপালা। পৃথিবীর সমস্ত জন্তু জানোয়ার, আকাশের সমস্ত পাখি এবং মাটির উপরে বুকে হাঁটে যেসব কীট সবাই ঐ খাদ্য খাবে।” এবং এই সব কিছুই সম্পন্ন হল।
31 ঈশ্বর যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সেসব কিছু দেখলেন এবং ঈশ্বর দেখলেন সমস্ত সৃষ্টিই খুব ভাল হয়েছে। সন্ধ্যা হল, তারপর সকাল হল। এভাবে ষষ্ঠ দিন হল।


বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ

আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে “ছয় দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি” ধারণাটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক এবং ভৌতভাবে অসঙ্গত। প্রথমত, “দিন” বলে কোনো সময় একক কেবল তখনই অর্থপূর্ণ যখন কোনো গ্রহ নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণন করে এবং তার কাছাকাছি একটি নক্ষত্র থাকে যার আলো ও তাপ গ্রহের এক অংশে দিবালোক ও অন্য অংশে রাত্রি সৃষ্টি করে। কিন্তু মহাবিশ্বের উৎপত্তির প্রারম্ভে (প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে) এমন কোনো গ্রহ বা নক্ষত্রই ছিল না। বৃহৎ বিস্তার তত্ত্ব (Big Bang Theory) অনুযায়ী সময়, স্থান ও পদার্থ সবই একই ঘটনায় উদ্ভূত হয়েছিল — অর্থাৎ বিগ ব্যাংয়ের আগে ‘সময়’ বলে কোনো ধারণাই প্রযোজ্য ছিল না (see: Hawking, 1988; Carroll, 2010)। তাহলে প্রশ্ন উঠে: সময় নিজেই যখন সৃষ্টির অংশ, তখন আল্লাহ ছয় ‘দিনে’ তা সৃষ্টি করলেন কীভাবে?

আরও গভীরে গিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয় যে কোরআনিক ‘ছয় দিন’ ধারণাটি মৌলিকভাবে একটি পৃথিবীকেন্দ্রিক (geocentric) ধারণা — যেখানে “দিন” ধরা হয়েছে পৃথিবীর ঘূর্ণনকাল অনুযায়ী। কিন্তু যে সময় পৃথিবী ছিলই না, সেই সময় এই “দিন” সংখ্যা কোন ভৌত পরিমাপে গণনা করা হলো? এটি একটি মৌলিক লজিক্যাল ত্রুটি। এছাড়া, কোরআনের অন্যান্য আয়াতে (যেমন সূরা হাজ্জ ২২:৪৭ ও সূরা মাআরিজ ৭০:৪) আল্লাহর এক দিনের পরিমাপ মানুষের হাজার বা পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান বলা হয়েছে। কিন্তু এই দুই আয়াত নিজে নিজেই পরস্পর বিরোধী — একদিকে এক দিন হাজার বছরের সমান, অন্যদিকে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। তাহলে আল্লাহর সময় মানদণ্ড কোনটি? যদি সময় তাঁর উপর প্রযোজ্য নয় (যেমনটি থিয়োলজিয়ানরা দাবি করেন), তাহলে এই “এক দিন = হাজার বছর” বা “এক দিন = পঞ্চাশ হাজার বছর” ধারণাগুলির অর্থ হীন। আর যদি প্রযোজ্য হয়, তাহলে তাঁর অবস্থান সময়–স্থান বাঁধা একটি জৈবিক অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়।

পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, সময় এবং স্থান (Spacetime) একটি একীভূত মাত্রা যেখানে “ঘটনা” ঘটে। অর্থাৎ কোনো “দিন” বা “সময়কাল” ধারণা তখনই সার্থক যখন বিশ্বে গতি, বিকিরণ ও ঘূর্ণন অস্তিত্বে আসে। বিগ ব্যাংয়ের আগে না ছিল কোনো ঘূর্ণন, না ছিল কোনো বিকিরণ — ছিল শুধু একটি অসীম ঘনত্বের অবস্থা (Planck epoch, 10⁻⁴³ seconds)। তাহলে “ছয় দিনে সৃষ্টি” বলে যে সময়কাল উল্লেখ করা হয়েছে, তা কোন রেফারেন্স ফ্রেমে গণনা হলো? একজন অলৌকিক সত্তা যদি সময় ও স্থান উভয়কেই সৃষ্টি করেন, তাহলে সময় তাঁর আগে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। ফলে ‘ছয় দিনে সৃষ্টি’ বাক্যটি কারণিক বিরোধ (temporal paradox) তৈরি করে।

কসমোলজিক্যাল তথ্য অনুযায়ী মহাবিশ্বের বিকাশ একটি ক্রমিক ভৌত প্রক্রিয়া। প্রথম ১০⁻³⁵ সেকেন্ডে inflation পর্যায়ে মহাবিশ্ব হঠাৎ বিস্তার লাভ করে, এরপর প্রায় ৩,৮০০০০ বছর পর recombination পর্যায় ঘটে যেখানে আলো প্রথমবারের মত বাধাহীন ভাবে ছড়াতে পারে — অর্থাৎ “আলো” এর আগে অন্ধকার পর্যায় ছিল। এই ঘটনা এতটাই ভালভাবে পরিমাপযোগ্য যে cosmic microwave background (CMB) এর মাধ্যমে আজও তার চিহ্ন দেখা যায়। কোরআনের বর্ণনায় তবে এই ধাপে ধাপে ঘটনার কোনো ধারণা নেই; বরং এখানে আছে একটি মানবকেন্দ্রিক সময়ধারণা ও একটি বাইবেলিক কপি গঠন — যা তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক বোধের ফল (see: Collins 2006, Templeton 2013)।

অতএব, বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে “ছয় দিনে সৃষ্টি” বলে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে তা সময়, অস্তিত্ব, এবং কারণ–ফল নীতির (Principle of Causality) সাথে সংঘর্ষপূর্ণ। এর মাধ্যমে একটি অলৌকিক সত্তাকে সময়–নির্ভর সৃষ্টির মধ্যে আটকে দেওয়া হয় — যা তাঁর “অসীম ও অক্লান্ত” পরিচয়ের সাথে বিরোধী। আরও বিরোধ দেখা যায় যখন হাদিসে দেখা যায় নূর (আলো) সৃষ্টির আগেই গাছপালা সৃষ্টি করা হয়েছে। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি একটি পরম অবৈজ্ঞানিক ধারণা কারণ সালোক সংশ্লেষণ (Photosynthesis) ছাড়া কোনো উদ্ভিদই বেঁচে থাকতে পারে না। অতএব, কোরআনিক ও হাদিসিক বর্ণনা একদিকে বৈজ্ঞানিক ভাবেই অসম্ভব, অন্যদিকে তাত্ত্বিক ভাবেও স্ববিরোধী।

এই কারণে “ছয় দিনে সৃষ্টি” ধারণা কেবল একটি প্রাচীন মিথ যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নিরর্থক। এটি একটি সাংস্কৃতিক উপাখ্যান মাত্র, যা মানবসমাজ তখনো বৈজ্ঞানিক ধারণার আলোতে পৌঁছায়নি বলেই গঠিত হয়েছিল। আজকের পদার্থবিজ্ঞান যেখানে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বিস্তার এবং তাপমৃত্যুর সম্ভাবনা সম্বন্ধে নির্দিষ্ট গাণিতিক মডেল দিতে পারে, সেখানে “হও বলে হয়ে যাওয়া” ধারণা মানবিক কল্পনার একটি অবশেষ মাত্র। এই কারণেই একজন বুদ্ধিবাদী গবেষক যখন কোরআনিক বিবরণ ও বৈজ্ঞানিক তথ্য একসাথে পড়েন, তখন তিনি স্পষ্ট দেখেন — এটি অলৌকিক উন্মোচন নয়, বরং মানবীয় কল্পনা ও প্রাচীন বাইবেলিক উৎস থেকে কপি করা একটি বিশ্বাসগাথা।


উপসংহার

যদি একটি ধর্মীয় গ্রন্থকে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান স্রষ্টার বাণী হিসেবে দাবি করা হয়, তবে সেটিতে কোনো যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক অসঙ্গতি থাকার কথা নয়। কিন্তু কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্বে দেখা যায় এমন এক ধারাবাহিক ত্রুটি ও স্ববিরোধিতা, যা কেবল ধর্মতাত্ত্বিক গোঁজামিল দিয়েই টিকিয়ে রাখা যায়। “ছয় দিনে সৃষ্টি” এবং “আট দিনে সৃষ্টি”—এই দুটি পরস্পরবিরোধী বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, কোরআনের রচনাগুলি কোনো অতিপ্রাকৃত উৎস থেকে নয়, বরং সময়, সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত মানুষের তৈরি একটি সংকলন।

আরও গুরুতর হলো, এই ধর্মগ্রন্থ সময় ও স্থান—দুইয়ের ক্ষেত্রেই পৃথিবীকেন্দ্রিক (geocentric) দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে। “দিন”, “রাত”, “আকাশ”, “পাহাড়”—সবকিছুই এমনভাবে বর্ণিত, যেন লেখক নিজেই পৃথিবীর সীমিত ধারণা অনুযায়ী মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান স্পষ্টভাবে দেখায়, মহাবিশ্বের উদ্ভব কোনো দিনের গণনা অনুযায়ী নয়, বরং কোটি কোটি বছরের ভৌত প্রক্রিয়ার ফল। কোরআন সেই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার সামান্যতম আভাসও দেয় না; বরং প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের পৌরাণিক কাহিনিগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

যেসব তাফসিরকার ও ইসলামি ব্যাখ্যাকারীরা এই অসঙ্গতিগুলোকে গোঁজামিল দিয়ে “দৈব রহস্য” হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, তারা মূলত ধর্মতত্ত্বকে যুক্তির ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে চেয়েছেন। কিন্তু যুক্তিকে উপেক্ষা করে কোনো সত্যকে চিরস্থায়ী করা যায় না। ভাষাগত, ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যায়—কোরআনের সৃষ্টিবর্ণনা কেবল বাইবেলের পৌরাণিক কাঠামোর অনুকরণ, যার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।

অতএব, এই সমগ্র বিশ্লেষণ থেকে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসা যায়: কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্ব কোনো বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক সত্য নয়, বরং প্রাচীন মানুষের অজানাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা মাত্র। এটি একদিকে ধর্মীয় কল্পকাহিনি, অন্যদিকে ইতিহাসে একটি জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন। আর এই সীমাবদ্ধতাকে চিরন্তন সত্য বলে প্রচার করা কেবল জ্ঞানের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। যদি মানবজাতি সত্যিই “আল্লাহর সৃষ্টি” হয়, তবে যুক্তি ও প্রমাণই সেই স্রষ্টার প্রকৃত ভাষা—কল্পকাহিনি নয়।


Independent AI Review

Note: The post content was very long; a truncated portion was analyzed.

- **তথ্যগত সঠিকতা**: প্রবন্ধে কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের উল্লেখ করা হয়েছে যা সৃষ্টির সময়কাল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রদান করে। তবে, এসব দাবির পেছনে বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব রয়েছে। বাইবেলের সাথে তুলনা করা হলেও, বাইবেলের তথ্যও বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাইযোগ্য নয়।

- **যুক্তির গঠন**: লেখাটি মূলত কোরআনের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনার মধ্যে স্ববিরোধিতা তুলে ধরেছে। তবে, যুক্তির গঠন কিছুটা একপেশে এবং ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

- **উৎস ও প্রমাণ**: প্রবন্ধে কোরআনের আয়াত এবং হাদিসের উল্লেখ রয়েছে, তবে বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব রয়েছে। বাইবেলের উল্লেখ থাকলেও, তা কেবল তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

- **বৈজ্ঞানিক/সমসাময়িক মানদণ্ড**: আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কোরআন বা বাইবেলের বর্ণনা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক নয়। সালোক সংশ্লেষণ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের বর্ণনা অসঙ্গতিপূর্ণ।

- **মূল শক্তি**: লেখাটি কোরআনের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনার মধ্যে স্ববিরোধিতা তুলে ধরেছে এবং বাইবেলের সাথে তুলনা করেছে।

- **মূল দুর্বলতা**: লেখাটি কিছুটা একপেশে এবং ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব রয়েছে।

- **সংশোধন ও সুপারিশ**: লেখাটি আরও তথ্যসমৃদ্ধ করতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

- **সারাংশ রায়**:
- তথ্যগত সঠিকতা: ৫/১০
- যুক্তির গুণমান: ৬/১০
- উৎসব্যবহার: ৫/১০
- মোটামুটি সামগ্রিক স্কোর: ৫.৫/১০

এই রিভিউটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি; এটি কোনো মানব সম্পাদকীয় মতামত নয়।

তথ্যসূত্রঃ
  1. সূরা আল ইমরান, আয়াত ৪৭ ↩︎
  2. সূরা বাকারা, আয়াত ১১৭ ↩︎
  3. তাফসীরে জালালাইন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৮ ↩︎
  4. কোরআন, সূরা হাজ্ব, আয়াত ৪৭ ↩︎
  5. কোরআন, সূরা সাজদা, আয়াত ৫ ↩︎
  6. কোরআন, সূরা মাআরিজ, আয়াত ৪ ↩︎
  7. কোরআন, সূরা আরাফ, আয়াত ৫৪ ↩︎
  8. কোরআন, সূরা ইউনুস, আয়াত ৩ ↩︎
  9. কোরআন, সূরা আস সাজদা, আয়াত ৪ ↩︎
  10. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৭০৯, ৭১০ ↩︎
  11. তাফসীরে মাযহারী, নবম খণ্ড, কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী, হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া, পৃষ্ঠা ৩৬৬, ৩৬৭ ↩︎
  12. তাফসীরে জালালাইন, ইসলামিয়া কুতুবখানা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০০ ↩︎
  13. সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী), হাদিসঃ ৬৯৪৭ ↩︎
  14. সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৬৭৯৭ ↩︎
  15. বাইবেল, আদিপুস্তক ১ ↩︎