Table of Contents
- 1 ভূমিকা
- 2 আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও আধুনিক যুদ্ধনীতি
- 3 দাসপ্রথা ও যুদ্ধবন্দী নারীর যৌন অধিকার
- 4 হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রে দাসীর যৌন কর্তব্য
- 5 আলেমদের মতামতঃ ইসলামে স্ত্রী বা দাসী সহবাস করতে বাধ্য
- 6 সম্মতির অনুপস্থিতি ও যৌন শোষণ
- 7 আধুনিক মুসলিম সমাজ ও শরিয়তের স্থবিরতা
- 8 মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা ও নৈতিক প্রশ্ন
- 9 ঐতিহাসিক উদাহরণসমূহ
- 10 উপসংহার
ভূমিকা
মানব সভ্যতার ইতিহাসে দাসপ্রথা এক অন্ধকারতম অধ্যায়। প্রাচীন গ্রিস, রোম, ভারত, চীন কিংবা আরব— প্রায় প্রতিটি সভ্যতাই কোনো না কোনোভাবে দাসপ্রথা চর্চা করেছে। ইসলামের উদ্ভবও এমন এক সময়ে, যখন আরব সমাজে দাস ও দাসী ছিল সাধারণ বাস্তবতা। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো— ইসলাম কি দাসপ্রথা বিলোপ করেছে, নাকি নতুন আঙ্গিকে বৈধতা দিয়েছে? নবী নিজে কি দাসদাসী রেখেছেন, কেনাবেচা করেছেন, অর্থাৎ নবী নিজেই একজন দাসও ব্যবসায়ী ছিলেন কিনা। বিশেষত যুদ্ধবন্দী নারীকে দাসী বা উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাদের সম্মতি ছাড়াই যৌনসম্পর্ক স্থাপনের অনুমোদন ইসলামি আইন ও ফিকহে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই প্রবন্ধে আমরা কোরআন, হাদিস, ফিকহশাস্ত্র এবং আধুনিক মানবাধিকারের আলোকে এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করব।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও আধুনিক যুদ্ধনীতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা যুদ্ধাপরাধ রোধ ও মানবাধিকার রক্ষায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সনদ ও আইনের প্রবর্তন করেছে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (Universal Declaration of Human Rights) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে “কেউ দাসত্ব বা ক্রীতদাসত্বের শিকার হবে না; সব ধরনের দাস প্রথা ও দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ” (UDHR, অনুচ্ছেদ ৪)। এছাড়াও, যুদ্ধাবস্থায় বেসামরিক ব্যক্তি ও বন্দীদের সুরক্ষা দিতে ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনসমূহ গৃহীত হয়, যা যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আবশ্যিকভাবে মানবিক আচরণ পালনের জন্য বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধবন্দীদের নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, দাসত্বে নিযুক্ত করা প্রভৃতি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) ও বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ ধরনের অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও গণধর্ষণের অপরাধে দায়ীদের বিচার করতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা এসব চুক্তি ও আইনের মাধ্যমে যুদ্ধকালে ন্যূনতম মানবিক মানদণ্ড রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং এর ব্যত্যয় ঘটালে সেটিকে অপরাধ হিসেবে দেখে। সুতরাং আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধবন্দীদের হত্যা, নির্যাতন বা যৌনদাসত্বে পরিণত করা সার্বজনীনভাবে নিন্দিত ও নিষিদ্ধ একটি কাজ।
দাসপ্রথা ও যুদ্ধবন্দী নারীর যৌন অধিকার
কোরআনে বহুবার “ملک اليمين” (মালাকাত আইমানুকুম / তোমাদের ডান হাত যা অধিকার করে) শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে, যা যুদ্ধবন্দী নারী কিংবা বাজার থেকে কিনে আনা দাসীদের বোঝাতে ব্যবহৃত। এই বিষয়ে অন্য একটি লেখায় খুব বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে, আগ্রহী পাঠক সেই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন [1]। এখানে স্ত্রী (যার সাথে চুক্তি ও সম্মতি বিদ্যমান) এবং দাসী (সরাসরি যার ক্ষেত্রে কোন চুক্তি বা তার সম্মতি নেই) একই সঙ্গে বৈধ যৌনসঙ্গী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কোরআনে সূরা আন-নাহলের ৭৫ নম্বর আয়াতে [2] দাসকে এমন একজনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যে “কোনো কিছুতেই ক্ষমতাহীন।” এই দৃষ্টিভঙ্গিই ইসলামি ফিকহের ভিত্তি তৈরি করে— দাস বা দাসী নিজস্ব ইচ্ছা ও সম্মতি থেকে বঞ্চিত, তার শরীর-শ্রম-যৌনতা সবকিছুই প্রভুর অধিকার।
আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেনঃ অন্যের মালিকানাভুক্ত এক দাস যে কোন কিছু করারই ক্ষমতা রাখে না। আর এক লোক যাকে আমি আমার পক্ষ হতে উত্তম জীবিকা দান করেছি আর তাত্থেকে সে গোপনে প্রকাশ্যে দান করে, (এ) দু’জন কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।
— Taisirul Quran
আল্লাহ উপমা দিচ্ছেন অপরের অধিকারভুক্ত এক দাসের, যে কোন কিছুর উপর শক্তি রাখেনা। এবং অপর এক ব্যক্তি যাকে তিনি নিজ হতে উত্তম রিয্ক দান করেছেন এবং সে তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে; তারা কি উভয়ে একে অপরের সমান? সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য; অথচ তাদের অধিকাংশ এটা জানেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ উপমা পেশ করেছেন; একজন অধিনস্ত দাস যে কোন কিছুর উপর ক্ষমতা রাখে না। আর একজন যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে উত্তম রিযক দিয়েছি, অতঃপর সে তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে। তারা কি সমান হতে পারে? সমস্ত প্রশংসা আল্লা্হর। বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।
— Rawai Al-bayan
আল্লাহ্ উপমা দিচ্ছেন [১] অন্যের অধিকারভুক্ত এক দাসের, যে কোনো কিছুর উপর শক্তি রাখে না এবং এমন এক ব্যক্তির যাকে আমরা আমার পক্ষ থেকে উত্তম রিযক দান করেছি এবং সে তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে; তারা কি একে অন্যের সমান [২]? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্রই প্রাপ্য [৩]; বরং তাদের অধিকাংশই জানে না [৪]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রে দাসীর যৌন কর্তব্য
ইসলামী ফিকহে বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। Mawsoo’ah al-Fiqhiyyah-তে বলা হয়েছে [3]
كَضَرْبِ أُمَيَّتِكَ (١) وَقَوْلِهِ: لاَ يَجْلِدُ أَحَدُكُمُ امْرَأَتَهُ جَلْدَ الْعَبْدِ ثُمَّ يُجَامِعُهَا فِي آخِرِ الْيَوْمِ (٢) . وَلِلسَّيِّدِ أَنْ يُقَيِّدَ عَبْدَهُ إِذَا خَافَ عَلَيْهِ الإِْبَاقَ (٣) .
١٩ – سَابِعًا: لِلسَّيِّدِ حَقُّ وَطْءِ مَمْلُوكَتِهِ مَا لَمْ يَمْنَعْ مِنْ ذَلِكَ مَانِعٌ شَرْعِيٌّ، كَأَنْ تَكُونَ حَائِضًا أَوْ نُفَسَاءَ أَوْ مُزَوَّجَةً، أَوْ كَافِرَةً غَيْرَ كِتَابِيَّةٍ، أَوْ تَكُونَ مُرْتَدَّةً أَوْ غَيْرَ ذَلِكَ، أَوْ فِيهَا شِرْكٌ لِغَيْرِهِ، فَإِذَا وُطِئَتْ تَكُونُ سَرِيَّةً، إِلاَّ أَنَّهَا إِنْ كَانَتْ مُزَوَّجَةً ثُمَّ مُلِكَتْ بِالسَّبْيِ جَازَ لِمَالِكِهَا فَسْخُ نِكَاحِهَا ثُمَّ وَطْؤُهَا بَعْدَ الاِسْتِبْرَاءِ. وَلِلاِسْتِمْتَاعِ بِالإِْمَاءِ أَحْكَامٌ وَضَوَابِطُ شَرْعِيَّةٌ تُنْظَرُ فِي مَوْضِعِهَا مِمَّا يَلِي. وَفِي مُصْطَلَحِ: (تَسَرِّي) . وَيَجِبُ عَلَى الْمَمْلُوكَةِ أَنْ تُمَكِّنَ سَيِّدَهَا مِنْ نَفْسِهَا لِلاِسْتِمْتَاعِ، وَيَحْرُمُ عَلَيْهَا الاِمْتِنَاعُ مِنْ ذَلِكَ لأَِنَّهُ مَنْعُ حَقٍّ، مَا لَمْ تَكُنْ مُحَرَّمَةً عَلَيْهِ، أَوْ
১৯। মালিকের অধিকার আছে তার মালিকানাধীন দাসীকে (যাকে বন্দি বা ক্রয় করে আনা হয়েছে) ভোগ করার, যদি এর মাঝে কোনো শরয়ী (ধর্মীয় আইনসম্মত) বাধা না থাকে। যেমনঃ
– যদি সে ঋতুমতী হয়,
– সন্তান জন্মের পর প্রসূতি অবস্থায় থাকে,
– সে যদি বিবাহিতা হয়,
– যদি সে অমুসলিম হয় এবং কিতাবি (ইহুদি/খ্রিস্টান) না হয়,
– যদি সে ইসলাম ছেড়ে মুরতাদ হয়ে যায়,
– অথবা অন্য কারো অধিকারে থাকে।
এইসব ক্ষেত্রে সহবাস বৈধ নয়।
তবে, যদি সে বিবাহিতা থাকে এবং যুদ্ধবন্দি হয়ে মালিকানায় আসে, তাহলে মালিকের অধিকার আছে তার আগের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার (নিকাহ ফাসখ) পর, ইস্তিবরার (অর্থাৎ তার গর্ভে সন্তান আছে কিনা যাচাই করার জন্য এক মাসিককাল অপেক্ষা করা) পর তাকে ভোগ করার।
‘তাসাররি’ (تَسَرِّي) পরিভাষাঃ দাসীদের সাথে ভোগ-সুখ (সহবাস) গ্রহণ করার বিষয়টি ইসলামে একটি নির্দিষ্ট শরয়ী বিধান ও নিয়মাবলীর অধীনে স্থির করা হয়েছে। এটি “তাসাররি” নামে পরিচিত।
দাসীর কর্তব্য
দাসীর জন্য এটি আবশ্যক ও অবশ্য কর্তব্য যে, সে তার মালিককে নিজের দেহ-উপভোগ করতে দেবে। তার জন্য এটি থেকে বিরত থাকা নিষিদ্ধ, কারণ এটি মালিকের অধিকার বলে ধরা হয়েছে। তবে, যদি সে এমন অবস্থায় থাকে যেখানে মালিকের জন্য হারাম (নিষিদ্ধ)—যেমন ঋতুমতী, প্রসূতি, বা অন্য কোনো শরয়ী কারণ—তাহলে সে বাধা দিতে পারবে।

অর্থাৎ, দাসীর সম্মতির কোনো মূল্য নেই; তার কর্তব্য হলো তার মালিককে খুশি রাখা, সন্তুষ্ট রাখা এবং যখনই তার মাইল চাইবে শরীয়া সম্মত কোন কারণ( যেমন মারাত্মক অসুস্থতা) না থাকলে তাকে যৌনসুখ প্রদান করা।
ইসলামের আরেকটি সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ফতোয়া ওয়েবসাইট Islamqa-এর একটি ফতোয়া Fatwa No. 33597- এ বলা হয়েছে [4] –
إجبار الزوج زوجته على الجماع
السؤال: 33597
هل يجوز للرجل أن يُجبر زوجته أو أمته على الجماع إذا رفضت ؟.
الجواب
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله، وبعد:
ليس للمرأة أن تمنع نفسها من زوجها ، بل يجب عليها أن تلبي طلبه كلما دعاها ما لم يضرها أو يشغلها عن واجب .
روى البخاري (3237) ومسلم (1436) عن أبي هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ( إذا دعا الرجل امرأته إلى فراشه فأبت فبات غضبان عليها لعنتها الملائكة حتى تصبح ) .
فإن امتنعت من غير عذر كانت عاصية ناشزا ، تسقط نفقتها وكسوتها .
وعلى الزوج أن يعظها ويخوفها من عقاب الله ، ويهجرها في المضجع ، وله أن يضربها ضرباً غير مُبَرِّح، قال الله تعالى :
( وَاللاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا ) النساء/34 .
وسئل شيخ الإسلام ابن تيمية رحمه الله عما يجب على الزوج إذا منعته من نفسها إذا طلبها ؟ فأجاب : ( لا يحل لها النشوز عنه ، ولا تمنع نفسها منه ، بل إذا امتنعت منه وأصرت على ذلك فله أن يضربها ضربا غير مبرح ، ولا تستحق نفقة ولا قسما ) مجموع الفتاوى 32/279 .
وسئل عن رجل له زوجة وهي ناشز تمنعه نفسها فهل تسقط نفقتها وكسوتها وما يجب عليها ؟
فأجاب : ( تسقط نفقتها وكسوتها إذا لم تمكنه من نفسها ، وله أن يضربها إذا أصرت على النشوز . ولا يحل لها أن تمتنع من ذلك إذا طالبها به ، بل هي عاصية لله ورسوله ، وفي الصحيح : ” إذا طلب الرجل المرأة إلى فراشه فأبت عليه كان الذي في السماء ساخطا عليها حتى تصبح ” )
انتهى من مجوع الفتاوى 32/278 ، والحديث رواه مسلم (1736) .
فينبغي وعظ الزوجة أولا ، وتحذيرها من النشوز وغضب الله عليها ولعنة الملائكة لها ، فإن لم تستجب هجرها الزوج في الفراش ، فإن لم تستجب ضربها ضربا غير مبرح ، فإن لم ينفع معها ذلك ، منع عنها النفقة والكسوة ، وله أن يطلقها أو يخالعها لتفتدي منه بمالها .
وكذلك الأمة ليس لها أن تمتنع من تلبية رغبة سيدها إلا من عذر ، فإن فعلت كانت عاصية ، وله أن يؤدبها بما يراه مناسباً وأذن الشرع به .
والله أعلم .
প্রশ্ন নং: 33597
প্রশ্ন:
কোনো পুরুষ কি তার স্ত্রী বা দাসীকে জোর করে সহবাসে বাধ্য করতে পারবে, যদি সে অস্বীকার করে?
উত্তর
আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূল ﷺ-এর প্রতি দরূদ ও সালাম:
নারীর জন্য বৈধ নয় যে, সে নিজেকে স্বামী থেকে বিরত রাখবে। বরং তার উচিত স্বামীর আহ্বানে সাড়া দেওয়া, যখনই স্বামী তাকে আহ্বান করে, যদি না এমন কোনো ক্ষতি বা অজুহাত থাকে যা তাকে বৈধভাবে বিরত রাখে।
সহীহ বুখারী (হাদিস 3237) ও সহীহ মুসলিমে (হাদিস 1436) আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে শয্যায় আহ্বান করে, আর সে অস্বীকার করে, তখন স্বামী রাগ করে রাত কাটালে ফেরেশতারা তাকে (স্ত্রীকে) সকাল পর্যন্ত লানত করতে থাকে।”
সুতরাং, যদি কোনো নারী অকারণে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তাকে অবাধ্য গণ্য করা হবে, এবং এর ফলে তার ভরণপোষণ ও পোশাকের অধিকার নষ্ট হয়ে যাবে।
স্বামীর কর্তব্য হলো, তাকে (স্ত্রীকে) আল্লাহর ভয় দেখানো ও উপদেশ দেওয়া; যদি না শোনে, তবে তাকে শয্যা থেকে পৃথক করা; আর তাতেও কাজ না হলে হালকা প্রহার করা—কিন্তু এমন প্রহার নয় যা আঘাত বা ক্ষত সৃষ্টি করে। আল্লাহ বলেন:
“আর যেসব নারীর অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদের উপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর, এবং প্রহার কর; তারপর যদি তারা অনুগত হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো পথ অবলম্বন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোচ্চ, মহান।” (সূরা নিসা ৪:৩৪)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেছেন:
স্ত্রীর জন্য বৈধ নয় যে, সে নিজেকে স্বামী থেকে বিরত রাখবে। বরং যখন স্বামী আহ্বান করবে, তখনই তার সাড়া দেওয়া ওয়াজিব, যদি না শরীয়তসম্মত কোনো কারণ থাকে যা তাকে বিরত রাখে। (মাজমূআ ফাতাওয়া ৩২/২৭৯)
প্রশ্ন:
যদি কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর ভরণপোষণ ও পোশাক দেয়, অথচ স্ত্রী তাকে (সহবাসে) নিজেকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়—এক্ষেত্রে কী হবে?
উত্তর:
সে (স্ত্রী) যদি বৈধ অজুহাত ছাড়াই স্বামীকে নিজেকে না দেয়, তবে তার ভরণপোষণ ও পোশাকের অধিকার বাতিল হয়ে যাবে। আর তাকে প্রহার করা বৈধ হবে, তবে এমনভাবে নয় যে এতে গুরুতর ক্ষতি হয়।
কিন্তু, যদি অস্বীকৃতি শরীয়তসিদ্ধ কোনো কারণে হয়, তবে স্ত্রী গোনাহগার হবে না। বরং গোনাহ হবে স্বামীর, যদি সে তখনও জোর করে।
উপসংহার
স্ত্রীর জন্য স্বামীর আহ্বান অকারণে প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়।
অকারণে অস্বীকার করলে ফেরেশতাদের লানতের শিকার হবে, এবং তার ভরণপোষণ ও পোশাকের অধিকার নষ্ট হবে।
স্বামীকে প্রথমে উপদেশ দিতে হবে, তারপর শয্যা আলাদা করতে হবে, এবং প্রয়োজনে হালকা প্রহার করতে পারবে।
শরীয়তসম্মত কারণ থাকলে স্ত্রী অস্বীকৃতি জানাতে পারবে, এবং সেক্ষেত্রে দায় স্বামীর ওপর বর্তাবে।
ইবনে তাইমিয়ার মাজমু’আ ফাতাওয়া থেকে উদ্ধৃতি শেষ হলো (৩২/২৭৮)। আর হাদিসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে (১৭৩৬)।
অতএব, প্রথমে স্বামীর উচিত স্ত্রীকে উপদেশ দেওয়া, তাকে অবাধ্যতার (নুশূজ) ভয় দেখানো, আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখানো, ফেরেশতাদের লানতের কথা স্মরণ করানো। যদি স্ত্রী তারপরও সাড়া না দেয়, তবে স্বামী শয্যা ত্যাগ করে তার থেকে দূরে থাকবে। যদি তবুও সে সাড়া না দেয়, তবে তাকে এমনভাবে প্রহার করতে পারবে, যা ব্যথাদায়ক হলেও ক্ষতিকর নয়। যদি তবুও কোনো উপকার না হয়, তবে স্বামী তার ভরণপোষণ ও পোশাক বন্ধ করে দিতে পারে, এমনকি চাইলে তাকে তালাক দিতে পারে বা তার থেকে আলাদা হয়ে অন্য বিয়ে করতে পারে।
একইভাবে, দাসীর ক্ষেত্রেও—তার জন্য বৈধ নয় যে, সে কোনো অজুহাত ছাড়া মালিকের যৌন চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকবে। যদি বিরত থাকে, তবে সে গুনাহগার হবে। আর মালিকের অধিকার আছে তাকে শাস্তি দেওয়ার এবং যেভাবে উপযুক্ত মনে করে, শরীয়তের অনুমোদিত সীমার মধ্যে তার ওপর ব্যবস্থা নেওয়ার।
আল্লাহই সর্বাধিক জানেন।
আরেকটি অত্যন্ত বিখ্যাত ফতোয়া ওয়েবসাইট Islamweb-এর ফতোয়াতেও একই কথা পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে: [5]
معلومات الكتاب
المحلى بالآثار
ابن حزم الأندلسي – علي بن أحمد بن سعيد بن حزم
إظهار / إخفاء التشكيل بحث في الكتاب
1883 – مسألة : وفرض الأمة والحرة أن لا يمنعا السيد والزوج الجماع متى دعاهما ، ما لم تكن المدعوة حائضا ، أو مريضة تتأذى بالجماع ، أو صائمة فرض ، فإن امتنعت لغير عذر ، فهي ملعونة . روينا من طريق مسلم نا ابن أبي عمر نا مروان – هو ابن معاوية الفزاري – عن يزيد بن كيسان عن أبي حازم عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم { والذي نفسي بيده ما من رجل يدعو امرأته إلى فراشها فتأبى عليه إلا كان الذي في السماء ساخطا عليها حتى يرضى عنها } .
نا حمام نا عباس بن أصبغ نا محمد بن عبد الملك بن أيمن نا بكر بن حماد نا مسدد نا يحيى – هو ابن سعيد القطان – نا شعبة عن قتادة عن زرارة بن أوفى عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وآله وسلم قال : { إذا باتت المرأة مهاجرة إلى زوجها أو فراش زوجها لعنتها الملائكة حتى ترجع } .
ومن طريق أحمد بن شعيب نا هناد بن السري عن ملازم بن عمرو نا عبد الله بن بدر عن قيس بن طلق عن أبيه طلق بن علي قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم يقول : { إذا دعا الرجل زوجته لحاجته فلتأته وإن كانت على التنور } .
এবারে আসুন ফতোয়াটি বাংলা অনুবাদ দেখি, ( AI দ্বারা অনুদিত )
ফতোয়া নম্বর ১৮৮৩
দাসী এবং স্ত্রী — উভয়ের জন্যই স্বামী বা মালিক যখন যৌন সম্পর্কের জন্য আহ্বান জানায়, তখন তা মেনে নেওয়া আবশ্যক।
যদি স্ত্রী ঋতুমতী না হয়, প্রসূতি অবস্থায় না থাকে, অসুস্থ না হয়, অথবা কোনো বৈধ অজুহাত ছাড়া অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে সে গোনাহগার ও অবাধ্য (ناشزة/নাশিজা) হিসেবে গণ্য হবে।
এ ব্যাপারে মুসলিম ইমাম ইবনু আবী উমর আল-মারওয়ান, ইবনু মু’আবিয়া আল-ফারাযী, ইয়াজীদ ইবনু কিসান, আবূ হাযিম, এবং আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে পুরুষ তার স্ত্রীকে শয্যায় ডাকে, আর স্ত্রী অস্বীকার করে, ফলে স্বামী রাগ করে রাত কাটায়—তাহলে আসমানের ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ দিতে থাকে।”
(সহীহ হাদিস: বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত)
হাম্মাম ইবন আব্বাস, ইবন আসবাহ, মুহাম্মদ ইবন আবদুল মালিক, ইবন আইয়ূব, ইবন জাহাদ, ইবন মাসউদ ইত্যাদি রাবিদের সূত্রেও এসেছে।
শা’বী থেকে হাদিস: আয়েশা (রা.) বলেছেন, নবী ﷺ বলেছেন:
“যদি কোনো নারী রাত কাটায় এভাবে যে তার স্বামী তার শয্যা থেকে তাকে ডাকছে অথচ সে সাড়া দেয়নি, তাহলে ফেরেশতারা তাকে সকাল পর্যন্ত অভিশাপ দিতে থাকে।”
অন্য সূত্রে আলী (রা.) বলেছেন: আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ -কে বলতে শুনেছি:
“যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে শয্যায় আহ্বান করে, আর সে অস্বীকৃতি জানায়, তখন আসমানের মালিক (আল্লাহ) তার প্রতি ক্রোধান্বিত থাকেন, যতক্ষণ না সে স্বামীর ডাকে সাড়া দেয়।”
সারসংক্ষেপঃ
স্ত্রী বা দাসী উভয়ের জন্য স্বামী/মালিকের যৌন আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়, যদি না কোনো বৈধ শরয়ী অজুহাত থাকে।
অকারণে অস্বীকার করলে ফেরেশতাদের লানত ও আল্লাহর ক্রোধের শিকার হতে হবে।
এই হাদিসগুলোকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে ফিকহবিদরা স্ত্রীর ওপর স্বামীর যৌন অধিকারের বাধ্যতামূলকতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।


এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে ইসলামি শরিয়াহ যুদ্ধবন্দী নারীর সম্মতি অস্বীকার করে এবং যৌন সম্পর্ককে প্রভুর আইনগত অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে।
আলেমদের মতামতঃ ইসলামে স্ত্রী বা দাসী সহবাস করতে বাধ্য
আধুনিক সভ্য সমাজে নারীরা পুরুষের মতোই সমান অধিকার ভোগ করেন। তারা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্ব এবং সমাজসেবার ক্ষেত্রে পুরুষের সমানভাবে অংশগ্রহণ করছেন। আধুনিক সমাজে এরকম ঘটনা অসংখ্য, যেখানে স্বামী তার স্ত্রীর ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়াই তার সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্কে করে বা স্ত্রীকে তা করতে বাধ্য করে। আধুনিক সভ্য সমাজে এটি ধর্ষণ হিসেবে গণ্য, যদিও ইসলামিক দেশগুলোতে স্বামীকে এই ধর্ষণের বৈধতা দেয়া হয়। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, স্বামীর চাহিবা মাত্রই তার সাথে স্ত্রী যৌন কাজ করতে বাধ্য, এরকম আইন আরোপ করে। যা বৈবাহিক ধর্ষণের মত মারাত্মক এবং ভয়াবহ ঘটনার জন্য দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসুন হেফাজতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হারুন ইজহারের বক্তব্য শুনে নিই,
এবারে আসুন স্ত্রী এবং দাসীর সাথে তার স্বামী বা মালিক জোর জবরদস্তি করতে পারবে কিনা, সেটি জেনে নেয়া যাক,
সম্মতির অনুপস্থিতি ও যৌন শোষণ
আধুনিক সভ্য প্ররতিহিবীতে ধর্ষণ হলো— কোনো ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া তার সাথে যৌন সম্পর্ক। ইসলামি আইনে যুদ্ধবন্দী নারী বা দাসীর ক্ষেত্রে এটাই অনুমোদিত হয়েছে। তাদের জন্য সম্মতি অপ্রাসঙ্গিক, কারণ তারা প্রভুর মালিকানাধীন বস্তু।
স্বাধীন নারীর ক্ষেত্রে বিবাহ একটি চুক্তি (contract), যেখানে সম্মতির সামান্য কিছু ভূমিকা থাকে, যদি না স্ত্রী অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে বিবাহের পুর্বে তার কাছ থেকে সম্মতি গ্রহণের কথা ইসলামে বলা আছে, তবে নিয়মিত যৌন সম্পর্কের বেলায় সেই সম্মতির কোন প্রয়োজন ইসলামে নেই। কিন্তু দাসীর ক্ষেত্রে কোনো চুক্তি বা ইচ্ছার প্রয়োজন নেই— এটি নিছক মালিকানার অধিকার। এই ভয়ঙ্কর বিধান যুদ্ধবন্দী নারীদের ক্ষেত্রে তাদের মানবাধিকারকে চরম ভাবে লঙ্ঘিত করে, পুরো মানবতাকেই অসম্মান করে
দাসীদের প্রতি যৌন অধিকার ইসলাম কেবল অনুমোদনই করেনি, বরং এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণ করেছে। ইসলামী আইন দাসপ্রথা বিলোপ না করে বরং দাসপ্রথার ওপর নতুন ধর্মীয় বৈধতা আরোপ করেছে। যুদ্ধবন্দী নারীকে পুরুষের ভোগ্যবস্তু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
আধুনিক মুসলিম সমাজ ও শরিয়তের স্থবিরতা
আজকের অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে দাসপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ এবং সাধারণ মুসলমানরা দাস বা দাসী রাখেন না। এটা মূলত বৈশ্বিক চাপ ও মানবাধিকার মূল্যবোধের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে – ইসলামী নৈতিকতা থেকে নয়। সত্য কথা হলো, কোরআন-হাদিসে দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত করার আদেশ নেই; শুধু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে দাসদের সাথে সদ্ব্যবহার, মুসলিম দাস মুক্তির সওয়াবের ইত্যাদি উল্লেখ আছে। ঔপনিবেশিক যুগে পাশ্চাত্যের দেশগুলো দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর মুসলিমবিশ্বও ধীরে ধীরে তা অনুসরণ করেছে, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে ইসলামী বিধান গ্রন্থে দাসপ্রথার বৈধতা রয়ে গেছে। ইসলামী স্কলারগণ সাধারণত এ নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থানে থাকেন। অনেকে বলেন “ইসলাম দাসপ্রথা ধীরে ধীরে উঠিয়ে দিয়েছে” – কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এই তথ্য আসলে সত্য নয়। নবী মৃত্যুর বহু শতাব্দী পর পর্যন্ত মুসলিম সমাজে দাসত্ব বিদ্যমান ছিল এবং ক্রীতদাস ও হারেম প্রথা চালু ছিল। আসলে, আজকের মুসলিমরা দাস না রাখার নীতি মেনে চলছেন মূলত আধুনিক রাষ্ট্রের আইন ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে, ধর্মীয় কারণে নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ইসলামের বিধানকে মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন কিয়ামত পর্যন্ত অপরিবর্তনীয়। মূলধারার আলেমদের মত অনুযায়ী কোরআন ও সহীহ হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত যে কোনো শরিয়তি আইন চিরকাল বহাল থাকবে – “ইসলামের যেসব বিধান কোরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত, সেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না”। অর্থাৎ মানুষের তৈরি আইনে পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত আইন অপরিবর্তনীয় ও সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানোর যে অনুমতি ইসলাম প্রাথমিক যুগে দিয়েছে, তা এখন আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও শরিয়তের দৃষ্টিতে তা নৈতিকভাবে ভুল বা খারাপ হয়ে যায়নি। শুধুমাত্র বর্তমান বাস্তবতায় ইসলামী দেশগুলো জাতিসংঘ চার্টার ও অন্যান্য আইনের অধীন বলে তারা দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত করেছে; কিন্তু কাল আবারো যদি ইসলামী খিলাফত কায়েম হয়, আবার এ প্রথা চালু করা “শরিয়তসম্মত” বলেই বিবেচিত হবে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, আইএস যখন সিরিয়া-ইরাকে খিলাফতের দাবিতে এলাকা দখল করে, তখন তারা আন্তর্জাতিক আইনে বেআইনি হলেও কোরআনের বর্ণনার আলোকে ইয়াজিদি ও শিয়া নারী বন্দীদের দাসী বানিয়ে যৌনদাসত্বে বাধ্য করেছে, শিশুদের বাজারে বিক্রি করেছে। তাদের তত্ত্ব ছিল: “রাসুলের সুন্নাত পুনর্জীবিত” করা।
মূলধারার মুসলিমরা আইএসের এই কাজ দেখে স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ হলেও তাত্ত্বিকভাবে কোরআন-হাদিসের কোথায় এটা ভুল তা দেখাতে পারেননি, বরং মানবিক ও আধুনিক মূল্যবোধ থেকেই একে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। ঠিক একইভাবে, ইসলামের অন্য অনেক অনুশাসন (যেমন বহুবিবাহ, শিশু বিবাহ, বিধর্মীদের প্রতি বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর ইত্যাদি) আজ বহু মুসলিম দেশেও আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও ধর্মীয়ভাবে সেগুলোর বৈধতা অটুট রয়েছে। এই দ্বৈত বাস্তবতা মুসলিম চিন্তাবিদদের এক বড় নৈতিক সংকটে ফেলেছে: চিরন্তন ধর্মীয় আইন বনাম পরিবর্তনশীল মানবিক মূল্যবোধ। অনেকেই প্রকাশ্যে এ বিতর্ক করতে চান না, কিন্তু বাস্তবতা হলো – যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে মানুষ নৈতিকতার মানদণ্ড পরিবর্তন করেছে, অথচ ধর্মীয় গ্রন্থের বিধান অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা ও নৈতিক প্রশ্ন
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি মৌলিক মানবিক প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে: ন্যায়-অন্যায় বা নৈতিকতার মানদণ্ড কি দল বা ধর্মভেদে আলাদা হতে পারে? যুদ্ধক্ষেত্রে “আমাদের পক্ষ” কোনো কাজ করলে সেটি ন্যায়সঙ্গত, অথচ শত্রুপক্ষ একই কাজ করলে তা অন্যায়—এমন দ্বিমুখী অবস্থান যুক্তিসঙ্গত নয়।
ইসলামী ফিকহে অমুসলিম নারীদের বন্দী করা, দাসী বানানো ও যৌনসঙ্গী হিসেবে ব্যবহার বৈধ বলা হয়েছে। কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে?—অর্থাৎ কোনো অমুসলিম বাহিনী মুসলিম নারীদের বন্দী করে একই আচরণ করে, তখন কি কোনো মুসলমান এটিকে ন্যায় ও নৈতিক বলবে? ইতিহাসের নিরপেক্ষ দলিল বলছে: বাস্তবে যখন মুসলিম নারীরা এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, তখন মুসলিম সমাজ একে ভয়াবহ অন্যায় ও লজ্জাজনক অপরাধ হিসেবেই দেখেছে।
ইতিহাসে অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে উভয় পক্ষই অপর পক্ষের নারীকে বন্দী করেছে এবং যৌন দাসত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। যেমন—
ঐতিহাসিক উদাহরণসমূহ
সময়কাল / ঘটনা | বিজেতা পক্ষ | পরাজিত পক্ষ | নারী বন্দী/দাসত্বের বিবরণ |
---|---|---|---|
৭১১ খ্রিস্টাব্দ, সিন্ধু বিজয় | আরব সেনারা (উমাইয়া খিলাফত) | হিন্দু রাজ্যসমূহ | হাজার হাজার হিন্দু নারী বন্দী হয়ে দাসী রূপে আরব ভূমিতে প্রেরিত। |
মোঘল আমল (১৬-১৭ শতক) | মুসলিম সুলতান ও সম্রাটগণ | হিন্দু রাজপরিবার | পরাজিত হিন্দু রাজকুমারীরা বিজেতা সুলতানদের হারেমে অন্তর্ভুক্ত। |
ক্রুসেড যুদ্ধ (১১-১৩ শতক) | ইউরোপীয় খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা | মুসলিম জনগোষ্ঠী | মুসলিম নারী ও শিশুদের বন্দী করে ইউরোপে বিক্রি করা হয়েছিল। |
আন্দালুস পতন (১৪৯২) | খ্রিস্টান ক্যাথলিক রাজা-রানী | আন্দালুসের মুসলিমরা | মুসলিম নারী-পুরুষ দাস বাজারে বিক্রি; অসংখ্য নারী যৌন দাসত্বে বাধ্য। |
দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসের প্রতিটি উদাহরণে বিজেতা পক্ষ তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধ বা “ধর্মযুদ্ধের গনিমত” বলেছে, অথচ ভুক্তভোগী পক্ষ একে যৌন সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেই দেখেছে। পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তাই ন্যায়কে দ্বিমুখী রূপে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু ন্যায়নীতির প্রকৃত স্বরূপ সর্বজনীন। নৈতিকতার গোল্ডেন রুলে বলা হয়,
“নিজের সাথে যে ব্যবহার পছন্দ নয়, অন্যের সাথে তা কোরো না।”
ধর্ম যাই হোক না কেন, যদি আপনার মা-বোন বা কন্যা যুদ্ধবন্দী হয়ে শত্রুপক্ষের হারেমে দিন কাটাতেন—আপনি কখনোই সেটিকে ন্যায় বা নৈতিক বলতেন না। তাহলে অন্যের মা-বোনের ক্ষেত্রেও সেটি ন্যায় হতে পারে না। এই সত্যটাই মানবিকতার আসল পরীক্ষা। সভ্যতার অগ্রগতি আমাদের শিখিয়েছে যে মানবাধিকারের মূল্যবোধ সর্বজনীন, “আমাদের দল” বা “তাদের দল” ভেদে নয়। সেই কারণে আজ কোনো রাষ্ট্র প্রকাশ্যে যুদ্ধবন্দীদের ধর্ষণ বা দাসত্ব সমর্থন করে না; যারা করে তারা বিশ্বসভ্যতার চোখে অচ্ছুত হয়ে যায়।
অতএব, ধর্মীয় অনুমতি কোনো অনৈতিক কাজকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলে না। যা নিজের পরিবারের নারীর ক্ষেত্রে অন্যায়, অন্যের পরিবারের ক্ষেত্রেও সেটাই অন্যায়।
উপসংহার
অতীতে যেটা স্বাভাবিক ছিল, আধুনিক নৈতিক মানদণ্ডে সেটাই বেআইনি ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে – মানব সভ্যতার এই অগ্রগতি আমাদের গর্বের বিষয়। তবে এ অগ্রগতির পথে ধর্মীয় আইনের স্থবিরতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি তা পরিবর্তন অস্বীকার করে চিরকাল পুরনো নীতিকেই আঁকড়ে ধরে। ইসলামসহ অন্যান্য বহু ধর্মের মৌলিক আইন প্রাচীন সমাজের প্রেক্ষাপটে রচিত, যেখানে দাসপ্রথা, যুদ্ধ লুণ্ঠন ছিল সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আজ মানুষের বিবেক সেই ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মানুষের বহু রক্ত-অশ্রুর ফসল এবং তা মানবিক ন্যায়বোধের প্রতিনিধিত্ব করে। ধর্মের নামে বর্বরতা আজ আর মানবসমাজ মানবে না – কালের চাকা সে যুগ পেরিয়ে এসেছে। তাই মুসলিম সমাজের উচিত সততা সঙ্গে স্বীকার করা যে ইসলামের কিছু ঐতিহাসিক বিধান (যেমন যুদ্ধবন্দীদের দাসত্ব) আধুনিক মানদণ্ডে অনুপযুক্ত, এবং সে বিষয়গুলোতে ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে ধর্মীয় যুক্তির চাইতে মানবিক যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া। নচেৎ, দ্বিচারিতা ও নৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে যাওয়ার ফলে ধর্মের মূল্যবোধও প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।
তথ্যসূত্রঃ
- ইসলামে অমানবিক দাসপ্রথা ↩︎
- কোরআন 16:75 ↩︎
- Mawsoo’ah al-Fiqhiyyah, Vol. 31, p. 44, https://shamela.ws/book/11430/13787#p1 ↩︎
- Islamqa, Fatwa No. 33597 ↩︎
- مسألة فرض الأمة والحرة أن لا يمنعا السيد والزوج الجماع متى دعاهما ↩︎