জিবরাইলের কুফরি কর্ম

ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাসে বনু কুরাইযা গোত্রের ঘটনাটি একটি অত্যন্ত বিতর্কিত অধ্যায়। প্রচলিত ইসলামি বর্ণনা অনুসারে, এই ইহুদি গোত্রটি নাকি “মদীনার চুক্তি” ভঙ্গ করেছিল এবং যুদ্ধের সময় মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তাফসীর ইবনে কাসীরের মতে, নবী মুহাম্মদকে এই চুক্তিভঙ্গের খবরটি জানানো হয় সরাসরি আসমানি ওহীর মাধ্যমে — অর্থাৎ ফেরেশতা জিবরাইল এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে খবর দেন যে, বনু কুরাইযা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যার অর্থ হচ্ছে, বানু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার বাস্তব কোন প্রমাণ ছিল না। আমাদের এই লেখাটির আলোচনা তা ণ ইয়ে নয়, জিবরাইলের আগমন নিয়ে তৈরি হওয়া একটি জটিলতা সম্পর্কে।


জিবরাইলের মানুষের ছদ্মবেশে আগমন

বনু কুরাইজা যে আসলেই বিশ্বাসঘাতকতা বা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল, নবী মুহাম্মদকে নাকি এই তথ্যটি আল্লাহর তরফ থেকে খোদ জিবরাইল এসে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তাই ঐ ঘটনাটি পর্যালোচনা করে বোঝা প্রয়োজন, আসলেই সেই সময়ে জিবরাইল এসে মুহাম্মদকে বিষয়টি জানিয়েছিল, নাকি অন্য কেউ? আসুন ঘটনাটি জানি। এই সম্পর্কে জানা যায়, মুহাম্মদ উম্মে সালমাহর ঘরে আসার পরে জিবরাইলের আগমন ঘটে এবং জিবরাইল নাকি বনু কুরাইজার চুক্তিভঙ্গ এবং বিশ্বাসঘাতকতার গোপন খবরটি নবীকে জানায় [1]

বনু কুরায়যা চুক্তি ভঙ্গ করিল । রাসূলুল্লাহ্ ও সাহাবায়ে কিরাম ইহা জানিতে পারিয়া বড়ই দুঃখিত ও ব্যথিত হইলেন। অবশেষে আল্লাহ্ তা’আলা যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বিজয়ী করিলেন, সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হইয়া ব্যর্থতার গ্লানি লইয়া প্রত্যাবর্তন করিল, রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম মদীনায় প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং অস্ত্র খুলিয়া ফেলিলেন। রাসূলুল্লাহ্ হযরত উম্মে সালমাহ (র)-এর ঘরে প্রবেশ করিয়া গোসল করিতেছিলেন, এমন সময় হযরত জিবরীল (আ)-এর আগমন ঘটিল। তিনি ইস্তাবরাক (রেশম)-এর পাগড়ী পরিহিত অবস্থায় একটি খচ্চরের উপর আরোহণ করিয়া আসিয়াছিলেন এবং খচ্চরের উপর ছিল রেশমের একটি গদি। তিনি আগমন করিয়াই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কি অস্ত্র খুলিয়া ফেলিয়াছেন? তিনি বলিলেন, হাঁ। জিবরীল (আ) বলিলেন, কিন্তু ফেরেশতাগণ এখনও তাহাদের অস্ত্র খুলিয়া ফেলেন নাই। আমি তো এখন কাফিরদিগকে ধাওয়া করিয়া ফিরিয়া আসিতেছি। অতঃপর তিনি বলিলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে বনু কুরায়যার বিরুদ্ধে অভিযান চালাইতে নির্দেশ দান করিয়াছেন। তিনি ইহাও বলিলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে হুকুম দিয়াছেন, আমি যেন তাহাদিগকে উলট-পালট করিয়া দেই

জিবরাইল

ওহী নাকি আক্রমণের অজুহাত?

প্রশ্ন হলো: একটি গোত্রের রাজনৈতিক বা সামরিক অবস্থান সম্পর্কে “আসমানি বার্তা” আসার ধারণাটি কি বাস্তবসম্মত, নাকি এটি ছিল একটি কৌশলগত উপস্থাপন, যাতে নবীর সিদ্ধান্তকে ঈশ্বরিক অনুমোদনপ্রাপ্ত হিসেবে তুলে ধরা যায়? মানব ইতিহাসে ধর্মীয় নেতাদের প্রায়শই দেখা যায়, তারা নিজেদের সিদ্ধান্তকে “ঈশ্বরের আদেশ” হিসেবে উপস্থাপন করে জনসমর্থন নিশ্চিত করেন। সেক্ষেত্রে এই ঘটনাও রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ধর্মীয় বয়ানের এক মিশ্রণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

সহীহ বুখারীতে পাওয়া এই বর্ণনা পুরো বিষয়টিকে অন্য দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেখানে উম্মে সালমাহ নিজেই বর্ণনা করেছেন, তিনি ঐ সময় নবীর ঘরে উপস্থিত ছিলেন এবং দেখেছেন — নবীর সঙ্গে যে ব্যক্তি কথা বলছিলেন, তিনি ফেরেশতা নন, বরং ছিলেন সাহাবি দাহিয়া কালবী। পরে নবী নিজেই ঘোষণা দেন, “ওই দাহিয়া নন, বরং জিবরাইল তাঁর রূপে এসেছিলেন।” [2]

সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
৫৩/ ফাজায়ীলুল কুরআন
পরিচ্ছেদঃ ওহী কিভাবে নাযিল হয় এবং সর্বপ্রথম কোন আয়াত নাযিল হয়েছিল। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, الْمُهَيْمِنُ মানে- আমীন। কুরআন পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী গ্রন্থের জন্য আমীন স্বরূপ।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৪৬১৯, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৪৯৮০
৪৬১৯। মূসা ইবনু ইসমাঈল (রহঃ) … আবূ উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে অবগত করা হয়েছে যে, একদা জিব্‌রাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমন করলেন। তখন উম্মে সালামা (রাঃ) তাঁর কাছে ছিলেন। জিবরীল(আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সালামা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? অথবা তিনি এ ধরনের কোন কথা জিজ্ঞেস করলেন। উম্মে সালামা (রাঃ) বললেন, ইনি দাহইয়া (রাঃ)। তারপর জিবরীল(আলাইহিস সালাম) উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষণে জিবরীল(আলাইহিস সালাম) এর খবর না শুণা পর্যন্ত আমি তাঁকে সে দাহইয়া (রাঃ)-ই মনে করেছি। অথবা তিনি (বর্ণনাকারী) অনুরূপ কোন কথা বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী মুতামির (রহঃ) বলেন, আমার পিতা সুলায়মান বলেছেন, আমি উসমান (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কার থেকে এ ঘটনা শুনেছেন? তিনি বললেন, উসামা ইবনু যায়দের কাছ থেকে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ ‘উসমান (রহঃ)

এখানেই আসে যৌক্তিক প্রশ্ন: যদি জিবরাইল সত্যিই নবীর কাছে আসতেন, তবে কেন তাকে অন্য কারো রূপ ধারণ করতে হতো? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন — একজন সবচাইতে সম্মানিত ফেরেশতা কি মানুষকে প্রতারণা বা বিভ্রান্ত করার মতো আচরণ করতে পারেন? যদি জিবরাইল আল্লাহর বার্তাবাহক হন, তবে অন্যের ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণামূলক কাজ, মানুষের চোখকে ধোঁকা দেয়ার কাজ তিনি কীভাবে করেন?

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, ঐ ঘটনার সাক্ষী ছিলেন একজন মানুষ, যিনি স্পষ্টভাবে বলছেন যে, তিনি ফেরেশতা নয়, দাহিয়া নামের এক সাহাবীকেই দেখেছেন। অর্থাৎ নবীর পরবর্তী ব্যাখ্যা ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণ ছিল না যে এটি জিবরাইল ছিলেন। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করা যেতে পারে — একধরনের আত্মনির্ভর “দৈব বৈধতা” বা divine validation, যা রাজনৈতিক বা যুদ্ধকালীন সিদ্ধান্তে নেতৃত্বের কর্তৃত্ব বাড়াতে সহায়ক।


অন্যের ছদ্মবেশ ধারণ ইসলামে হারাম

অন্য একটি সহীহ বুখারীর হাদিসে নবী স্পষ্টভাবে বলেছেন — অন্য কারো রূপ ধারণ করা, ছদ্মবেশ নেওয়া, কিংবা কারও চরিত্রে অভিনয় করা নিষিদ্ধ। [3]। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়: যদি ছদ্মবেশ ধারণকে নবী নিজে “অন্যকে ধোঁকা দেয়া”, “কৃত্রিমতা” বলে নিন্দা করেন, ইসলামের দৃষ্টিতে তা যদি অনৈতিক এবং মন্দ কাজ বলে বিবেচিত হয়, তবে জিবরাইলের এমন ছদ্মবেশ ধারণ ইসলামি নীতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?

এই দুটি হাদিসের পাশাপাশি পড়লে দেখা যায়—একদিকে নবী আল্লাহর হুকুমে অন্যের ছদ্মবেশ ধারণ করা বা নাটক করা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করছেন, অপরদিকে আল্লাহর ওহী নিয়ে যিনি আসতেন তিনি নিজেই সেই নিষিদ্ধ কাজটি করতেন, অর্থাৎ অন্যের ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। এই বৈপরীত্য ইসলামি তত্ত্বে একটি গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে: ইসলামি গ্রন্থসমূহে বর্ণিত “ওহীর আসমানি প্রকৃতি” কতটা কল্পকাহিনী বা নবীর ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি, আর কতটা বাস্তব? এবারে আসুন হাদিসটি পড়ি, [4] [5]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন)
৯৬/ কুরআন ও সুন্নাহকে শক্তভাবে ধরে থাকা
পরিচ্ছেদঃ ৯৬/৩. বেশি বেশি প্রশ্ন করা এবং অকারণে কষ্ট করা নিন্দনীয়।
৭২৯৩. আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা ’উমার (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তখন তিনি বললেনঃ (যাবতীয়) কৃত্রিমতা হতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে।[1] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৯৫)
[1] যাবতীয় মুনাফেকী নীতি অবলম্বন করা, ইবাদাতের ক্ষেত্রে অনর্থক বাড়তি কষ্ট করা, নাটক করা, অন্যের চরিত্রে অভিনয় করা, নকল চুল, দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে অন্যের মত হওয়া, যেমন খুশি তেমন সাজা, ছেলেদের পাকা চুল, দাড়ি লাগিয়ে মুরুবিব সাজা ইত্যাদি যাবতীয় কৃত্রিমতা গ্রহণ করতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিষেধ করেছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)

জিবরাইল 1

অতএব, যখন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা একইসঙ্গে “মানবিক”“আসমানি” ব্যাখ্যা পায়, তখন সংশয়বাদী দৃষ্টিতে প্রশ্ন করা ন্যায্য হয়ে পড়ে—ঐ ঘটনাটি কি সত্যিই আধ্যাত্মিক ছিল, নাকি রাজনৈতিক? বনু কুরাইযার ওপর হামলা ইসলামি ইতিহাসে একটি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেছিল; হাজারো বন্দি পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং নারীদের দাসত্বে নেওয়া হয়। যদি এই অভিযানের সূচনা “জিবরাইলের বার্তা”র ওপর নির্ভর করে থাকে, তাহলে এটি কেবল ধর্মীয় নয়, মানবতাবাদী দিক থেকেও গভীর পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।


উপসংহার

ইতিহাস আমাদের দেখায়, ঈশ্বরের নামে যুদ্ধ পরিচালনা, ডিভাইন অনুমোদনের দাবি, এবং ফেরেশতাদের বার্তায় মানব রক্তপাতের বৈধতা — এগুলো বহু ধর্মেই দেখা গেছে। যুক্তিবাদী মানুষ মাত্রই এইসব ঐশ্বরিক গল্প সরিয়ে যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে কিছু বাস্তব প্রশ্ন তুলবে। বনু কুরাইযার ঘটনাটি সেই প্রশ্নের একটি স্পষ্ট উদাহরণ—যেখানে ইতিহাস, ধর্ম ও নৈতিকতার সীমারেখা একদমই এলোমেলো হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব বাদেও, জিবরাইলের এই ছদ্মবেশ ধারণ আমাদের ইসলামের স্ববিরোধীতা স্পষ্ট করে তোলে।



তথ্যসূত্রঃ
  1. তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৯ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৬৪, ৬৫ ↩︎
  2. সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস: ৪৬১৯ ↩︎
  3. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস: ৭২৯৩ ↩︎
  4. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ৭২৯৩ ↩︎
  5. সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪১ ↩︎