Table of Contents
ভূমিকা
ইসলামী বর্ণনায় অর্থাৎ কোরআন ও হাদিসে ইসা (ইসা ইবনে মারইয়াম) ও নবী মুহাম্মদ দুইজনই নবী হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, তাদের চরিত্র ও অবস্থান একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। ইসলামে যীশু বা ইসা নবীকে আল্লাহর “কালিমাতুল্লাহ” বা আল্লাহর কালাম এবং “রুহুল্লাহ” বা আল্লাহর রূহ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে [1] [2], অন্যদিকে মুহাম্মদকে শেষ নবী ও রাসুল হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু যখন তাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বেশ কিছু সমস্যা সামনে চলে আসে। সমস্যাগুলো হচ্ছে, ইসলামী বিশ্বাস অনুসারেই, মুহাম্মদ এবং যীশু বা ঈসাকে তুলনা করলে, কাকে বেশি গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়? সেই সমস্যাগুলো নিয়েই এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে। আশাকরি পাঠকগণ মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ লেখাটি পড়বেন এবং যাচাই করে দেখবেন।
জন্ম ও বংশ
মুহাম্মদের জন্ম ছিল আরবের মক্কায়, স্বাভাবিক মানব জন্মের মাধ্যমে একটি মূর্তি পূজারী পৌত্তলিক পরিবারে। তার পিতা-মাতা দাদা-দাদী চাচা-চাচী কেউই আব্রাহামিক ধর্মের একেশ্বরবাদী ছিলেন না, মুশরিক ছিলেন এবং সহিহ হাদিসে তাদের জাহান্নামী বলা হয়েছে [3] [4] [5] [6] [7] [8]। কোরআনে বহুবার মুশরিকদের অপবিত্র এবং নোংরা বলে বর্ণনা করা হয়েছে, অর্থাৎ কোরআনের দাবী মোতাবেকই মুহাম্মদের জন্ম একটি অপবিত্র ও নোংরা পরিবারে। বিপরীতে, ঈসার জন্ম একটি ইহুদী অর্থাৎ একেশ্বরবাদী ও আহলে কিতাব বংশে, কুমারী মাতা মারিয়মের গর্ভে, পিতাহীনভাবে। কোরআনে মারিয়মকে বলা হয়েছে সকল নারীর মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত [9]। ফলে জন্মসূত্রেই ঈসা এক ব্যতিক্রমী ও অলৌকিক মর্যাদা লাভ করেন।
স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলেছিল, ‘হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে বেছে নিয়েছেন এবং তোমাকে পবিত্র করেছেন, আর তামাম দুনিয়ার নারীদের উপর তোমাকে মনোনীত করেছেন’।
— Taisirul Quran
এবং যখন মালাক/ফেরেশতা বলেছিলঃ ওহে মারইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন ও তোমাকে পবিত্র করেছেন এবং বিশ্ব জগতের নারীগণের উপর তোমাকে মনোনীত করেছেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলল, ‘হে মারইয়াম, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন ও পবিত্র করেছেন এবং নির্বাচিত করেছেন তোমাকে বিশ্বজগতের নারীদের উপর’ ।
— Rawai Al-bayan
আর স্মরণ করুন, যখন ফেরেশতাগণ বলেছিল, ‘হে মার্ইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ্ আপনাকে মনোনীত করেছেন এবং পবিত্র করেছেন আর বিশ্বজগতের নারীগণের উপর আপনাকে মনোনীত করেছেন [১]’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
ঈসার অতিপ্রাকৃত মর্যাদা
কোরআনে ঈসাকে শুধু নবী হিসেবে নয়, আল্লাহর “কালিমাতুল্লাহ” (আল্লাহর কালাম) এবং “রুহুল্লাহ” (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে [10] [11]। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর সিফাতের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত এক সত্তা। কারণ ইসলামের আকীদা অনুসারে, কোরআন হচ্ছে আল্লাহর বানী বা আল্লাহর সিফাত, অর্থাৎ আল্লাহর সরাসরি বৈশিষ্ট্য। যা মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে সবার ওপর। অন্যদিকে মুহাম্মদকে পরিচিত করা হয়েছে “আল্লাহর দাস এবং প্রেরিত রাসুল” এবং “খাতামুন নবিয়্যীন” হিসেবে [12]। মর্যাদার এই পার্থক্য ইঙ্গিত করে যে, ঈসার অবস্থান ইসলামে সাধারণ নবীর বাইরে গিয়েও এক ধরণের ঐশী সত্তার কাছাকাছি বা সমকক্ষ।
…ঈসা মাসীহ তো আল্লাহর রসূল আর তাঁর বানী যা তিনি মারইয়ামের নিকট প্রেরণ করেছিলেন, আর তাঁর পক্ষ হতে নির্দেশ…
— Taisirul Quran
…নিশ্চয়ই মারইয়াম নন্দন ঈসা মাসীহ্ আল্লাহর রাসূল ও তাঁর বাণী – যা তিনি মারইয়ামের প্রতি সঞ্চারিত করেছিলেন এবং তাঁর আদিষ্ট আত্মা;…
— Sheikh Mujibur Rahman
…মারইয়ামের পুত্র মাসীহ ঈসা কেবলমাত্র আল্লাহর রাসূল ও তাঁর কালিমা, যা তিনি প্রেরণ করেছিলেন মারইয়ামের প্রতি এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ। …
— Rawai Al-bayan
…মারইয়াম-তনয় ঈসা মসীহ কেবল আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী [২], যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন ও তাঁর পক্ষ থেকে রূহ।…
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
(স্মরণ কর) যখন ফেরেশতারা বলল, ‘হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে তাঁর একটি কথার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মারইয়ামের পুত্র ঈসা-মসীহ, সে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত ও সান্নিধ্য প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
— Taisirul Quran
যখন মালাইকা/ফেরেশতারা বলেছিলঃ হে মারইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নিকট হতে একটি বাক্য দ্বারা তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন নন্দন ঈসা মসীহ – সে ইহলোক ও পরলোকে সম্মানিত এবং সান্নিধ্য প্রাপ্তগণের অন্তর্ভুক্ত।
— Sheikh Mujibur Rahman
স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বলল, ‘হে মারইয়াম, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম মসীহ ঈসা ইবনে মারইয়াম, যে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত’।
— Rawai Al-bayan
স্মরণ করুন, যখন ফেরেশ্তাগণ বললেন, ‘হে মারিয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আপনাকে তাঁর পক্ষ থেকে একটি কালেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন [১]। তার নাম মসীহ্, মারিয়াম তনয় ঈসা, তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবেন [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
মৃত্যু ও পরিণতি
মুহাম্মদের মৃত্যু বিষক্রিয়াজনিত কষ্টের মাধ্যমে ঘটে। হাদিসে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে খায়বারে ইহুদী নারীর দেয়া বিষ তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় [13] [14] [15] [16]। মৃত্যুর পূর্বে নবী নিজেকে সুস্থ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনকিছুতেই কোন কাজ হয় না। আক্কাহ পাক তার কোন চিকিৎসাকেই পাত্তা না দিয়ে তাকে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেন। আর ঈসার ক্ষেত্রে কোরআন স্পষ্ট করে বলছে তাকে হত্যা করা হয়নি বা ক্রুশবিদ্ধও করা হয়নি, বরং আল্লাহ তাকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ নেয়ামত দ্বারা তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন [17]। অর্থাৎ ঈসা কোনো মৃত্যুই ভোগ করেননি, কষ্ট তো দূরের কথা। এই পার্থক্যটি বেশ চোখে লাগাড় মত। যেখানে ইসা নবীকে মৃত্যু ও কষ্টের হাত থেকে রক্ষার জন্য আসমানে তুলে নেয়া, অন্যদিকে সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ নবীকে এভাবে কষ্টকর মৃত্যু দেয়া, এটি কোনভাবেই মেলে না।
আর ‘আমরা আল্লাহর রসূল মাসীহ ঈসা ইবনু মারইয়ামকে হত্যা করেছি’ তাদের এ উক্তির জন্য। কিন্তু তারা না তাকে হত্যা করেছে, না তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে, কেবলমাত্র তাদের জন্য (এক লোককে) তার সদৃশ করা হয়েছিল, আর যারা এ বিষয়ে মতভেদ করেছিল তারাও এ সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হয়েছিল। শুধু অমূলক ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত সত্য যে, তারা তাকে হত্যা করেনি।
— Taisirul Quran
এবং ‘‘আল্লাহর রাসূল ও মারইয়াম নন্দন ঈসাকে আমরা হত্যা করেছি’’ বলার জন্য। অথচ তারা না তাকে হত্যা করেছে আর না শুলে চড়িয়েছে; বরং তারা ধাঁধাঁয় পতিত হয়েছিল। তারা তদ্বিষয়ে সন্দেহাচ্ছন্ন ছিল, কল্পনার অনুসরণ ব্যতীত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান ছিলনা। প্রকৃত পক্ষে তারা তাকে হত্যা করেনি।
— Sheikh Mujibur Rahman
এবং তাদের এ কথার কারণে যে, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম পুত্র ঈসা মাসীহকে হত্যা করেছি’। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদেরকে ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি।
— Rawai Al-bayan
আর ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারঈয়াম তনয় ‘ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং তাদের জন্য (এক লোককে) তার সদৃশ করা হয়েছিল [১]। আর নিশ্চয় যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা অবশ্যই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি,
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
বরং আল্লাহ তাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন, আর আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞানী।
— Taisirul Quran
পরন্ত আল্লাহ তাকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন, এবং আল্লাহ পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানী।
— Sheikh Mujibur Rahman
বরং আল্লাহ তাঁর কাছে তাকে তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
— Rawai Al-bayan
বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
জন্ম থেকে কৈশোর
ঈসার জন্মের মুহূর্ত থেকেই তাকে এক অলৌকিক চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, শৈশবকালেই তিনি কোলে বা দোলনায় শুয়ে শিশু অবস্থাতেই কথা বলেছিলেন এবং মায়ের সতীত্ব ও নিজের নবুয়তের ঘোষণা দিয়েছিলেন [18]।
তখন মারইয়াম তার ছেলের দিকে ইশারা করল। তারা বলল, ‘আমরা কোলের বাচ্চার সঙ্গে কীভাবে কথা বলব?’
— Taisirul Quran
অতঃপর মারইয়াম ইঙ্গিতে সন্তানকে দেখাল; তারা বললঃ যে কোলের শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?
— Sheikh Mujibur Rahman
তখন সে শিশুটির দিকে ইশারা করল। তারা বলল, ‘যে কোলের শিশু আমরা কিভাবে তার সাথে কথা বলব’?
— Rawai Al-bayan
তখন মারইয়াম সন্তানের প্রতি ইংগিত করল। তারা বলল, ‘যে কালের শিশু তার সাথে আমারা কেমন করে কথা বলব?’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
শিশুটি বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর বান্দাহ, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আর আমাকে নবী করেছেন।
— Taisirul Quran
সে (ঈসা) বললঃ আমিতো আল্লাহর দাস; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নাবী করেছেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
শিশুটি বলল, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন’।
— Rawai Al-bayan
তিনি বললেন, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন,
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
পরবর্তীতে তিনি এমন সব কাজ করেছেন যা প্রাকৃতিক নিয়ম অতিক্রম করে যায়: অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগী নিরাময়, মৃতকে জীবিত করা, এমনকি মাটির পাখিকে প্রাণ দেওয়া [19]। অর্থাৎ শৈশবকাল থেকেই ঈসার অবস্থান অলৌকিকতার সাথে মিশে আছে, যা তাকে সাধারণ মানবজন্মের সীমার বাইরে এক ঐশী সত্তার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
‘আর তিনি তাকে বানী ইসরাঈলের নিকট রসূল হিসেবে প্রেরণ করবেন’। সে বলবে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিদর্শনসহ তোমাদের নিকট এসেছি, আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখীর মত একটা কায়া গঠন করব, অতঃপর তাতে ফুঁৎকার দেব, ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখি হয়ে যাবে এবং আল্লাহর হুকুমে আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য করব ও আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবিত করব এবং আমি তোমাদেরকে বলে দেব তোমাদের গৃহে তোমরা যা আহার কর এবং সঞ্চয় করে রাখ; নিশ্চয়ই এ কাজে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মু’মিন হও।’
— Taisirul Quran
আর তাকে ইসরাঈল বংশীয়গণের জন্য রাসূল করবেন। নিশ্চয়ই আমি (ঈসা) তোমাদের রবের নিকট হতে নিদর্শনসহ তোমাদের নিকট আগমন করেছি; নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য মাটি হতে পাখির আকার গঠন করব, অতঃপর ওর মধ্যে ফুৎকার দিব, অনন্তর আল্লাহর আদেশে ওটা পাখি হয়ে যাবে, এবং জন্মান্ধকে ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করি এবং আল্লাহর আদেশে মৃতকে জীবিত করি এবং তোমরা যা আহার কর ও তোমরা যা স্বীয় গৃহের মধ্যে সংগ্রহ করে রাখ তদ্বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছি – যদি তোমরা বিশ্বাসী হও তাহলে নিশ্চয়ই এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর বনী ইসরাঈলদের রাসূল বানাবেন (সে বলবে) ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানাব, অতঃপর আমি তাতে ফুঁক দেব। ফলে আল্লাহর হুকুমে সেটি পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রুগীকে সুস্থ করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা যা আহার কর এবং তোমাদের ঘরে যা জমা করে রাখ তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। নিশ্চয় এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা মুমিন হও’।
— Rawai Al-bayan
আর তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য রাসূলরূপে’ (প্রেরণ করবেন, তিনি বলবেন) ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি যে, অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দ্বারা একটি পাখিসদৃশ আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুঁ দেব; ফলে আল্লাহ্র হুকুমে সেটা পাখি হয়ে যাবে। আর আমি আল্লাহ্র হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থকে নিরাময় করব এবং মৃতকে জীবিত করব। আর তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং মজুদ কর তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব। নিশ্চয় এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা মুমিন হও।’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
অন্যদিকে মুহাম্মদের শৈশব কাহিনিতে ভিন্ন এক রূপকথার মতো দৃশ্য পাওয়া যায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি শিশু অবস্থায় অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, তখন হঠাৎ জিবরাইল এসে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেন, হৃদপিণ্ড বের করে আনেন এবং সেখান থেকে এক রক্তপিণ্ড টেনে বের করেন। জিবরাইল তখন বলেন, “এ অংশটি শয়তানের।” এরপর হৃদপিণ্ড যমযমের পানিতে ধৌত করে পুনরায় স্থাপন করা হয়। শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে গিয়ে মুহাম্মদের দুধমাকে জানায়, “মুহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে।” লোকজন এসে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন। হাদিসটি মন দিয়ে পড়ুন এবং দেখুন, শিশু মুহাম্মদের শরীরের ভেতরে শয়তানের অংশ ছিল কিনা [20] [21] –
সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ১/ কিতাবুল ঈমান
পরিচ্ছদঃ ৭৩. রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মি’রাজ এবং নামায ফরয হওয়া
৩১০। শায়বান ইবনু ফাররুখ (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এলেন, তখন তিনি শিশুদের সাথে খেলছিলেন। তিনি তাঁকে ধরে শোয়ালেন এবং বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর হৎপিন্ডটি বের করে আনলেন। তারপর তিনি তাঁর বক্ষ থেকে একটি রক্তপিন্ড বের করলেন এবং বললেন এ অংশটি শয়তানের। এরপর হৎপিণ্ডটিকে একটি স্বর্ণের পাত্রে রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন এবং তার অংশগুলো জড়ো করে আবার তা যথাস্থানে পূনঃস্থাপন করলেন। তখন ঐ শিশুরা দৌড়ে তাঁর দুধমায়ের কাছে গেল এবং বলল, মুহাম্মাদ -কে হত্যা করা হয়েছে। কথাটি শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল তিনি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে আছেন! আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বক্ষে সে সেলাই-এর চিহ্ন দেখেছি।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
এ বর্ণনায় এক খুবই জরুরি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। একদিকে ইসলাম দাবি করে মুহাম্মদ জন্মগতভাবেই নির্বাচিত নবী, অন্যদিকে আবার বলা হচ্ছে তার হৃদয়ে “শয়তানের অংশ” ছিল, যা জিবরাইল কর্তৃক শৈশবেই অপসারণ করা হয়। অর্থাৎ ঈসার জন্ম অলৌকিকতার সাথে জড়িত এবং কোনো “অশুভ উপাদান” ছাড়াই নির্মলভাবে শুরু হয়, কিন্তু মুহাম্মদের শৈশবের বর্ণনায় তার কলবকে শয়তানের প্রভাব থেকে পরিষ্কার করার নাটকীয় কাহিনি পাওয়া যায়। ইসলামী পরম্পরায় এটি নবী মুহাম্মদের জীবনের পবিত্রতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, তুলনামূলকভাবে দেখলে দুইজনের শৈশবকাহিনি ভিন্ন দুই দিকের বার্তা বহন করে: ঈসার ক্ষেত্রে জন্ম থেকেই পাপ মুক্ত নির্মলতা, আর মুহাম্মদের ক্ষেত্রে জন্ম থেকেই হৃদয়ে শয়তানের অংশ থাকা।
অলৌকিকতা বনাম বাস্তবধর্মীতা
ইসা বা যীশুকে জন্ম থেকেই নানারকম অলৌকিক কর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে—অন্ধকে সুস্থ করা, কুষ্ঠ রোগ নিরাময়, মৃতকে জীবিত করা ইত্যাদি। এসব মিরাকল অপ্রমাণিত হলেও, ধর্মীয় মিথোলজি হিসেবে নিলে সেই সময়ের মানুষের কাছে দৃশ্যমান, প্রত্যক্ষযোগ্য এবং সমাজে আলোচিত ঘটনাবলি। অপরদিকে, মুহাম্মদের ক্ষেত্রে যখন মানুষ বা সমালোচকরা তার কাছে অলৌকিকতার দাবি পেশ করত, তখন তিনি বেশিরভাগ সময়ই কোরআনকেই একমাত্র মিরাকল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেন [22]। অর্থাৎ, তার অলৌকিকতার দাবিটি ছিল এমন এক বই, যা ভাষার সৌন্দর্য ও রচনারীতির মধ্যে নিহিত বলে দাবি করা হয়।
তারা বলে- তার কাছে তার প্রতিপালকের নিকট হতে কোন নিদর্শন অবতীর্ণ হয় না কেন? বল, নিদর্শন তো আছে আল্লাহর কাছে, আমি কেবল একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী।
— Taisirul Quran
তারা বলেঃ রবের নিকট হতে তার প্রতি নিদর্শন প্রেরিত হয়না কেন? বলঃ নিদর্শন আল্লাহর ইচ্ছাধীন, আমিতো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র।
— Sheikh Mujibur Rahman
আর তারা বলে, ‘তার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না কেন’? বল, ‘নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহর কাছে, আর আমি তো কেবল একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী’।
— Rawai Al-bayan
তারা আরও বলে, ‘তার রবের কাছ থেকে তার কাছে নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না কেন?’ বলুন, ‘নিদর্শনসমূহ তো আল্লাহরই কাছে। আর আমি তো একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র।’
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট (নিদর্শন) নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যা তাদের সম্মুখে পাঠ করা হয়, বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই এতে অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে।
— Taisirul Quran
এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার নিকট কুরআন অবতীর্ণ করেছি যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়? এতে অবশ্যই মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদের নিকট তিলাওয়াত করা হয়? নিশ্চয় এর মধ্যে রহমত ও উপদেশ রয়েছে সেই কওমের জন্য, যারা ঈমান আনে।
— Rawai Al-bayan
এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমরা আপনার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি, যা তাদের কাছে পাঠ করা হয় [১]। এতে তো অবশ্যই অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ঈমান আনে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
ঐতিহাসিক বিবরণে দেখা যায়, ইহুদি রাব্বিরা মুহাম্মদকে প্রায়শই নানা প্রশ্ন করতেন এবং বিভিন্ন উপায়ে পরীক্ষা করতেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি বহু সময় উত্তর দিতে ব্যর্থ হতেন, কিংবা এমন উত্তর দিতেন যা ইহুদী রাব্বিদের কাছে সঠিক মনে হতো না। অপরদিকে, যীশুর ক্ষেত্রে ইহুদিদের মূল অভিযোগ ছিল তিনি নিজেকে আল্লাহর পুত্র দাবি করে ব্লাসফেমি করেছেন। তার অলৌকিক কার্যক্রমকে নিয়ে রাব্বিদের বিশেষ কোনো আপত্তি পাওয়া যায় না, বরং তারা যীশুর সমস্যাটি মূলত শিরক ও ইহুদী ধর্মের তাওহীদের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক, এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
যুদ্ধ, গনিমত ও দাসপ্রথা
মুহাম্মদের জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধারাবাহিক যুদ্ধ ও সামরিক অভিযান—বদর, উহুদ, খন্দক, খায়বার, হুনাইন, তাবুক প্রভৃতি। এই যুদ্ধগুলো ইসলামী ইতিহাসে “গাযওয়া” বা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে বর্ণিত, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়কে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদেশ দেওয়া হয়। কোরআনে এমন সরাসরি নির্দেশ পাওয়া যায়: “অতঃপর কাফেরদের যেখানে পাও, হত্যা করো” [23], এবং “যারা আল্লাহ ও রাসুলে বিশ্বাস করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো” [24]. এই আয়াতগুলো পরবর্তী ইসলামী ইতিহাসে যুদ্ধ ও বিজয়ের ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই যুদ্ধগুলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধানগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করেছে। এগুলো মুসলিম সমাজে গনিমত বা লুণ্ঠিত সম্পদের বিতরণব্যবস্থাকেও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়।
যুদ্ধের পর লুণ্ঠিত সম্পদকে গনিমাহ বলা হত, যা কোরআনের নির্দেশ অনুসারে আল্লাহ ও তার রাসুলের জন্য নির্ধারিত অংশটুকু বাদ রেখে ব্যাকই অংশ যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো [25]। এর মধ্যে যুদ্ধবন্দী নারীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদেরকে “দক্ষিণ হস্তের অধিকারী” বা মা মালাকাত আইমানুকুম — অর্থাৎ “তোমাদের ডান হাতের অধিকারভুক্ত নারী” বলা হয়েছে। কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, এই নারীদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধন ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন বৈধ করা হয়েছে [26] [27]। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ইসলামী সমাজে যুদ্ধবন্দী নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার একটি অনুমোদিত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রথা হয়ে ওঠে। সহীহ হাদিস ও তাফসির গ্রন্থগুলোতেও দেখা যায়, নবী মুহাম্মদ নিজে যুদ্ধবন্দী নারীদের দাসী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তার সাথীরাও একইভাবে বন্দী নারীদের ভাগ পেয়েছিলেন, তাদের সম্মতি ছাড়া তাদের সাথে সঙ্গমও করেছিলেন।
ঈসার বর্ণনায় এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। তিনি কখনও কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করেননি, কারও বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেননি, বরং শান্তি, ক্ষমা ও মানবিক ভালোবাসার আদর্শ প্রচার করেছেন। তার ব্যক্তিগত জীবনে দাসপ্রথা, লুণ্ঠন বা প্রতিশোধের ধারণার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না, যদিও সেগুলোর পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়।
ইসলামী বর্ণনায় যেমন মুহাম্মদ একাধিক স্ত্রী ও দাসী নারীর মালিক ছিলেন—তাফসির ও হাদিস সূত্রে যার প্রমাণ পাওয়া যায়—তেমনি ঈসার জীবনে এমন কোনো দাম্পত্য বা যৌন সম্পর্কের ইঙ্গিতও নেই। ফলে তুলনামূলক দৃষ্টিতে দেখা যায়, মুহাম্মদের চরিত্র ইসলামী আইনের যুদ্ধ ও দাসপ্রথার অনুমোদনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, যেখানে ঈসার চরিত্র তুলনামূলকভাবে অহিংসা, সংযম ও ক্ষমার আদর্শের প্রতীক।
ধর্মত্যাগ ও শাস্তি
ইসলামিক হাদিসগ্রন্থে এমন বর্ণনা আছে যা থেকে ইসলামী ফিকহে বা আইনে ধর্মত্যাগ (রিদ্দা) সম্পর্কিত কঠোর শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। ক্লাসিকাল হাদিস বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, যে ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করবে তাকে নবী হত্যা করতে, গর্দান উড়াইয়া দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন [28]।
আধুনিক সময়ে বিষয়টি তীব্র বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রয়ে গেছে: কিছু দেশে ঐতিহ্যগত শাস্তিগত ধারা এখনও আইনগতভাবে বিদ্যমান, অন্যদিকে বহু আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদ ও মানবাধিকার-ভিত্তিক গবেষক এই ধারা পুনর্বিবেচনার দাবি করেন এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড ও ধর্মসম্প্রদায়ের ভেতরের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক – ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে হাদিস ও ফিকহের বিধান সমূহ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করেন। কাজেই ধর্মত্যাগ ও তার শাস্তি নিয়ে নিরপেক্ষ বিচার করতে চাইলে কোরআন, হাদিস, ক্লাসিকাল ফিকহি মতভেদ ও আধুনিক আইনী-নৈতিক তর্ক—এই সকল স্তরের উৎস ও প্রাসঙ্গিকতা সমানভাবে যাচাই করা আবশ্যক।
অন্যদিকে যীশু বা ঈসার জীবনে এরকম কোন ঘটনার প্রমাণ মেলে না। বরঞ্চ শেষ সময়ে তিনি বলেছেন, এদের ক্ষমা করো প্রভু, এরকম কিছু বক্তব্য খ্রিস্ট ধর্মের গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়।
নৈতিকতা ও বিচার
ইসলামী বর্ণনায় মুহাম্মদের বিচারব্যবস্থা মূলত তৎকালীন আরব সমাজে প্রচলিত এবং ইহুদি শরিয়াহ-ভিত্তিক শাস্তিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, বরঞ্চ কিছু ক্ষেত্রে সেই সময়ের ইহুদীদের সামাজিক আইনকানুন থেকেও কঠোর এবং হিংস্র ছিল। সহীহ হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, নবী মুহাম্মদ ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত ইহুদি নারী ও পুরুষকে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড দেন—যা রজম নামে পরিচিত [29]. এই রজম-প্রথা পরবর্তীতে ইসলামী শরিয়াহর অংশ হয়ে যায় এবং মধ্যযুগীয় ফিকহে এটি ব্যভিচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। নৈতিকতার দৃষ্টিতে এটি ছিল কঠোর প্রতিশোধমূলক বিচারব্যবস্থা, যেখানে শাস্তির উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও ভয় সঞ্চার।
অন্যদিকে, বাইবেলীয় বর্ণনায় ঈসা (যীশু) সম্পূর্ণ বিপরীত নৈতিক মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। যোহনের সুসমাচারে দেখা যায়, যখন এক ব্যভিচারিণী নারীকে জনতা পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ঈসা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে নিরপরাধ, সে-ই প্রথম পাথর ছুঁড়ুক।” ফলস্বরূপ, কেউই নারীর ওপর পাথর নিক্ষেপ করেনি, আর ঈসা তাকে ক্ষমা করে মুক্তি দেন [30]. এই কাহিনিতে বিচারব্যবস্থা শাস্তি থেকে নৈতিক পুনর্জাগরণে রূপান্তরিত হয়; এখানে আইনের চেয়ে করুণা ও মানবিক বোধই মুখ্য হয়ে ওঠে।
যদিও কোরআনে এই ঘটনাটির উল্লেখ নেই, তবুও তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মুহাম্মদের বিচারিক চরিত্র ছিল প্রাচীন আইনের কঠোর বাস্তবায়নে বিশ্বাসী, আর ঈসার চরিত্র ছিল আধুনিক, নৈতিকতার বিবর্তন ও ক্ষমাশীলতার প্রতীক। একদিকে শরিয়াহভিত্তিক কঠোরতা, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক নরমতা—এই দুই ভিন্ন ধারা ইসলামী ও খ্রিষ্টীয় নৈতিকতাকে সম্পূর্ণ বিপরীত দুই প্রান্তে স্থাপন করে।
সামগ্রিক বৈপরীত্য
মুহাম্মদ ইসলামে সর্বশেষ নবী, যিনি বাস্তব জীবনে সামরিক, রাজনৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মাধ্যমে যুদ্ধ, দাসপ্রথা, বিধর্মীদের অধীনস্থ করা, এবং মুরতাদদের মৃত্যুদণ্ড প্রতিষ্ঠা পায়। অন্যদিকে ঈসার চিত্র ইসলামী বর্ণনায়ও সম্পূর্ণ ভিন্ন—তিনি যুদ্ধহীন, সহিংসতাহীন, অলৌকিকতায় ভরপুর এবং এমনকি মৃত্যুহীন। তাকে আল্লাহর “কালাম” ও “রূহ” বলা হয়েছে, যা ইসলামে অন্য কোনো নবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
বিষয় | মুহাম্মদ | রেফারেন্স | ইসা | রেফারেন্স |
---|---|---|---|---|
পিতামাতা | মাতা আমিনা ও পিতা আবদুল্লাহ, দাদাদাদী চাচাচাচী মুশরিক ছিলেন; নবীর বক্তব্য অনুযায়ী তারা ‘জাহান্নামী’। | সহিহ মুসলিম 203, সহিহ বুখারি 1284 | ইসার মাতা মারিয়মকে কোরআনে বলা হয়েছে “বিশ্বজগতের সকল নারীর উপরে মনোনীত ও পবিত্র”। | সূরা আলে ইমরান 3:42 |
জন্ম | স্বাভাবিক মানবজন্মে, পৌত্তলিক পরিবারে। | সীরাত ইবনে হিশাম | অলৌকিকভাবে পিতাহীন জন্ম, আল্লাহর আদেশে কুমারী মারিয়মের গর্ভে। | সূরা মারইয়াম 19:16–21, সূরা আল ইমরান 3:45–47 |
শিশু অবস্থায় শয়তানের প্রভাব | মুহাম্মদের শরীরে শয়তানের অংশ ছিল, যা জিবরাইল এসে বের করে ফেলে | সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩১০ | ইসা বা যীশু জন্ম থেকেই পবিত্র ও নবী | সূরা মারইয়াম 19:29–30 সূরা আলে ইমরান 3:49 |
অলৌকিকতা (মুজিজা) | লোকেরা মুজিজা চাইলে বলতেন, “এই কোরআনই আমার মুজিজা।” | সূরা আনকাবুত 29:50–51 | শিশুকালেই কথা বলা, মৃতকে জীবিত করা, অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান, মাটির পাখিকে প্রাণ দান। | সূরা মারইয়াম 19:29–30, সূরা আল ইমরান 3:49 |
যুদ্ধ | বদর, উহুদ, খন্দক, হুনাইন, খায়বারসহ একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। | সীরাত ইবনে হিশাম, সহিহ বুখারি 3953 | কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করেননি; তুলনামূলকভাবে শান্তি ও অহিংসার শিক্ষা দেন। | ইসলামী ও বাইবেলীয় বর্ণনায় যুদ্ধহীন |
বিধর্মীদের প্রতি অবস্থান | “অবিশ্বাসীদের হত্যা কর” ও “কিতাবীদের জাজিয়া দিয়ে অধীন কর” — এমন নির্দেশ প্রদান। | সূরা তওবা 9:5, 9:29 | কাউকে ধর্মে প্রবেশে বাধ্য করেননি; অপেক্ষাকৃত ক্ষমা, প্রেম ও অনুগ্রহের শিক্ষা দেন। | বাইবেল: মথি 5:44; কোরআন: সূরা মারইয়াম 19:36 |
গনিমতের মাল | যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গনিমাহ) আল্লাহ ও রাসুলের জন্য নির্ধারিত অংশসহ যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করা হত। | সূরা আনফাল 8:41 | কোনো গনিমত বা লুণ্ঠনের ধারণা নেই। | অনুপস্থিত |
দাসপ্রথা ও যৌন সম্পর্ক | যুদ্ধবন্দী নারীদের যৌনদাসী হিসেবে গ্রহণ বৈধ করা হয়েছে: “যাদের উপর তোমাদের ডান হাত অধিকার করেছে।” | সূরা নিসা 4:24, সূরা মুমিনুন 23:5–6 | দাসপ্রথা, যুদ্ধবন্দী বা যৌন সম্পর্কের কোনো অনুমোদন নেই; মানবসমতা ও সংযমের শিক্ষা দেন। | ব্যক্তিজীবনে চর্চা না করলে দাসপ্রথা, যুদ্ধবন্দী রাখার পুরনো বিধানকে সমর্থন করেছেন |
মুরতাদদের শাস্তি | “যে ইসলাম ত্যাগ করবে, তাকে হত্যা করো।” — নবীর নির্দেশ; পরবর্তী ফিকহে এটি রাষ্ট্রীয় আইন হয়। | সহিহ বুখারি 6922, সহিহ মুসলিম 1676 | ধর্মত্যাগে কোনো শাস্তি নেই; মানুষ স্বাধীনভাবে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। | বাইবেল: যোহন 6:66; |
আইন ও বিচার | ব্যভিচারীদের রজম (পাথর নিক্ষেপে হত্যা) শাস্তি কার্যকর করেন। | সহিহ মুসলিম 1691 | ব্যভিচারিণীকে রক্ষা করেন, বলেন: “যে নিরপরাধ, সে-ই প্রথম পাথর ছুঁড়ুক।” | যোহন 8:3–11 |
মৃত্যু | খায়বারে বিষমিশ্রিত খাবার খাওয়ার পর দীর্ঘ যন্ত্রণায় মৃত্যু। | সহিহ বুখারি 4428, সহিহ মুসলিম 2190 | হত্যা বা মৃত্যু হয়নি; আল্লাহ তাকে রক্ষা করে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। | সূরা নিসা 4:157–158, সূরা আলে ইমরান 3:55 |
যন্ত্রণার মাত্রা | মৃত্যুর পূর্বে প্রবল শারীরিক কষ্টভোগ করেন। | সহিহ বুখারি 4440 | কোনো শারীরিক যন্ত্রণা ছাড়াই আল্লাহ তাকে উত্তোলন করেন। | সূরা নিসা 4:158 |
মর্যাদা ও উপাধি | “আল্লাহর রাসুল”, “আবদুল্লাহ” এবং “খাতামুন নবিয়্যীন” — শেষ নবী। | সূরা আহযাব 33:40 | “কালিমাতুল্লাহ” (আল্লাহর বাণী) ও “রুহুল্লাহ” (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহ)। | সূরা নিসা 4:171, সূরা আল ইমরান 3:45 |
উপসংহার
ইসলামী টেক্সটে ঈসা ও মুহাম্মদের মধ্যে বৈপরীত্য এতটাই স্পষ্ট যে বলা যায়, ঈসা উপস্থাপিত হয়েছেন এক আধ্যাত্মিক চরিত্র হিসেবে, আর মুহাম্মদ উপস্থাপিত হয়েছেন রাজনৈতিক নেতা এবং যোদ্ধা হিসেবে। এর ফলে প্রশ্ন জাগে, ইসলাম কেন “শ্রেষ্ঠ আদর্শ” মুহাম্মদের চেয়ে ঈসাকে অতিপ্রাকৃত মর্যাদা দিয়েছে? এই বৈপরীত্যের মধ্যেই ইসলামের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং স্ববিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্রঃ
- সূরা নিসা 4:171 ↩︎
- সূরা আলে ইমরান 3:45 ↩︎
- সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ১২৭৭ ↩︎
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৯ ↩︎
- আল-লুলু ওয়াল মারজান, হাদিসঃ ১৬ ↩︎
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩৯৪ ↩︎
- সুনানে ইবনে মাজাহ, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ১/১৫৭২ ↩︎
- সূনান নাসাঈ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ২০৩৮ ↩︎
- সূরা আল ইমরান ৩ঃ৪২ ↩︎
- সূরা নিসা 4:171 ↩︎
- সূরা আলে ইমরান 3:45 ↩︎
- সূরা আহযাব 33:40 ↩︎
- সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিসঃ ৪৪৪৯ ↩︎
- তাফসীরে মাযহারী, দশম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৯৬ ↩︎
- সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৫১৩ ↩︎
- সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), হাদিসঃ ৪৫১২ ↩︎
- সূরা নিসা 4:157–158 ↩︎
- সূরা মারইয়াম 19:29–30 ↩︎
- সূরা আলে ইমরান 3:49 ↩︎
- সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিসঃ ৩১০ ↩︎
- সহিহ মুসলিম খণ্ড ১ পৃষ্ঠা ১৯৮, ১৯৯ ↩︎
- সূরা আনকাবুত 29:50–51 ↩︎
- সূরা তওবা 9:5 ↩︎
- সূরা তওবা 9:29 ↩︎
- সূরা আনফাল 8:41 ↩︎
- সূরা নিসা 4:24 ↩︎
- সূরা মুমিনুন 23:5–6 ↩︎
- সহীহ বুখারী 6922, সহীহ মুসলিম 1676 ↩︎
- সহীহ মুসলিম 1691 ↩︎
- যোহন 8:3–11 ↩︎