Table of Contents
ভূমিকা
মানবসভ্যতার অর্থনৈতিক কাঠামো হাজার বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বাণিজ্য, বিনিময় প্রথা, বাজারব্যবস্থা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে সুদ বা ঋণের উপর অতিরিক্ত অর্থপ্রদান প্রায় সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে সুদ বা রিবাকে কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনে এবং হাদিসে এটি পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং সুদভোগী, সুদদাতা, এমনকি সুদের হিসাব রক্ষক পর্যন্ত সমানভাবে গোনাহগার হিসেবে বর্ণিত।
কিন্তু আধুনিক বিশ্বে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সুদ ছাড়া এক সেকেন্ডও চলা প্রায় অসম্ভব। এখানে আমরা বিশ্লেষণ করবো কেন ইসলামের সুদবিরোধী অবস্থান আধুনিক অর্থনীতি ও বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
ইসলামে সুদ নিষিদ্ধকরণ
সপ্তম শতকের আরব সমাজে ধনী মহাজনরা গরিবদের অত্যন্ত উচ্চ সুদে ঋণ দিত এবং সুদ দাবী করত। ঋণ শোধ করতে না পারলে ঋণগ্রহীতা চরম শোষণের শিকার হতো, কখনো দাসে পরিণত হতো। এই প্রেক্ষাপটে সেই সময়ে সুদ গ্রহণকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ধনীদের লোভ ও শোষণ বন্ধ করা এবং সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সুদের বিরোধিতা করা তাই সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য ছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই কোরআন ও হাদিসে সুদ (রিবা)কে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুদ গ্রহণ এবং সুদের সাথে সম্পর্ক রাখাকে এতটাই ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে ইসলাম গণ্য করে যে, হাদিসের পরিভাষায় তা নিজ মায়ের সাথে জিনা করার মতই ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে গণ্য। আসুন শুরুতেই দেখে নিই, ইসলামের আকীদা অনুসারে, সুদের সাথে জড়িত যাবতীয় সবকিছুই একদম হারাম।
সুদের ব্যাপারে কোরআন
সুদের ব্যাপারে কোরআনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে [1] [2]
যারা সূদ খায়, তারা সেই লোকের মত দাঁড়াবে যাকে শয়ত্বান স্পর্শ দ্বারা বেহুশ করে দেয়, এ শাস্তি এজন্য যে, তারা বলে, ‘ক্রয়-বিক্রয় সূদের মতই’, অথচ কারবারকে আল্লাহ হালাল করেছেন এবং তিনি সূদকে হারাম করেছেন। সুতরাং যার নিকট তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে উপদেশবাণী পৌঁছল এবং সে বিরত হল, পূর্বে যা (সূদের আদান-প্রদান) হয়ে গেছে, তা তারই, তার বিষয় আল্লাহর জিম্মায় এবং যারা আবার আরম্ভ করবে তারাই অগ্নির বাসিন্দা, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।
— Taisirul Quran
যারা সুদ ভক্ষণ করে তারা শাইতানের স্পর্শে মোহাভিভূত ব্যক্তির অনুরূপ কিয়ামাত দিবসে দন্ডায়মান হবে; এর কারণ এই যে, তারা বলে, ব্যবসা সুদের অনুরূপ বৈ তো নয়; অথচ আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন; অতঃপর যার নিকট তার রবের পক্ষ হতে উপদেশ সমাগত হয়, ফলে সে নিবৃত্ত হয়; সুতরাং যা অতীত হয়েছে তার কৃতকর্ম আল্লাহর উপর নির্ভর; এবং যারা পুনরায় সুদ গ্রহণ করবে তারাই হচ্ছে জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানেই চিরকাল অবস্থান করবে।
— Sheikh Mujibur Rahman
যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।
— Rawai Al-bayan
যারা সুদ [১] খায় [২] তারা তার ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে [৩]। এটা এ জন্য যে, তারা বলে [৪], ‘ক্রয়-বিক্রয় তো সূদেরই মত।’ অথচ আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সূদকে হারাম করেছেন [৫]। অতএব, যার নিকট তার রবের পক্ষ হতে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, তাহলে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহ্র ইখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় আরম্ভ করবে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
আল্লাহ সূদকে বিলুপ্ত করেন এবং খয়রাতকে বৃদ্ধি করেন, আল্লাহ অকৃতজ্ঞ পাপীদেরকে ভালবাসেন না।
— Taisirul Quran
আল্লাহ সুদকে ক্ষয় করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন, বস্তুতঃ আল্লাহ অতি কৃতঘ্ন পাপাচারীদেরকে ভালবাসেননা।
— Sheikh Mujibur Rahman
আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ কোন অতি কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।
— Rawai Al-bayan
আল্লাহ্ সূদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন [১]। আর আল্লাহ্ কোনো অধিক কুফরকারী, পাপীকে ভালবাসেন না [২]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং বাকী সূদ ছেড়ে দাও, যদি তোমরা ঈমানদার হও।
— Taisirul Quran
হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং যদি তোমরা মু’মিন হও তাহলে সুদের মধ্যে যা অবশিষ্ট রয়েছে তা বর্জন কর।
— Sheikh Mujibur Rahman
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও।
— Rawai Al-bayan
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ্র তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
হাদিসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা
হাদিসে আরও ভয়াবহ কঠোর ভাষায় সুদ এবং সুদের সাথে সম্পর্কিত সকল কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে,
সুনান ইবনু মাজাহ
১২/ ব্যবসা-বাণিজ্য
পরিচ্ছেদঃ ১২/৫৮. সুদ সম্পর্কে কঠোর বাণী
২/২২৭৪। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সুদের গুনাহর সত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্তর হলো আপন মাকে বিবাহ (যেনা) করা।
হাদিসটি ইমাম ইবনু মাজাহ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আত-তালীকুর রাগীব ৩/৫০, ৫১।
তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১২: ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা)
পরিচ্ছেদঃ ৪. তৃতীয় অনুচ্ছেদ – সুদ
২৮৩০-[২৪] ’উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সুদ হারাম হওয়ার আয়াতই (কুরআন মাজীদের) সর্বশেষ আয়াত। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকাল হয়ে গেছে অথচ সুদের পরিপূর্ণ বর্ণনা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের কাছে (স্পষ্ট করে) রেখে যাননি। সুতরাং কুরআন সুন্নাহ্’য় বর্ণিত সুদ এবং যে সব ক্ষেত্রে সুদের কোনো প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তাও বর্জন করবে। (ইবনু মাজাহ, দারামী)[1]
[1] হাসান : ইবনু মাজাহ ২২৭৬, আহমাদ ২৪৬।
হাদিসের মানঃ হাসান (Hasan)
বর্ণনাকারীঃ উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
এগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইসলামে সুদকে কেবল একটি আর্থিক লেনদেন নয়, বরং একটি গুরুতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে।
সুদের ওপর দাঁড়িয়ে আধুনিক অর্থনীতি
- ব্যাংকিং সিস্টেম
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলো ব্যাংক। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র—সকলেই ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ব্যাংকের মূল ব্যবসা হলো ঋণ প্রদান এবং সেই ঋণের বিনিময়ে সুদ গ্রহণ। গৃহঋণ, গাড়িঋণ, শিক্ষা ঋণ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই সুদ হলো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। - বন্ড ও শেয়ারবাজার
আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে বন্ড হলো সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম। কিন্তু বন্ডের আসলেই হলো সুদভিত্তিক রিটার্ন। সরকার কিংবা বড় কোম্পানি ঋণ তোলে এবং বিনিয়োগকারীদের সুদ দেয়। এমনকি শেয়ারবাজারেও কোম্পানির কার্যক্রম মূলত ব্যাংক ঋণ ও বন্ডের ওপর নির্ভরশীল। - আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও ঋণনীতি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF), বিশ্বব্যাংক, কিংবা ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক—সব প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয় সুদসহ। কোনো দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে বৈদেশিক ঋণই তাদের ভরসা। কিন্তু এই ঋণের কাঠামো সুদ ছাড়া অকল্পনীয়। - দৈনন্দিন জীবন
আমরা প্রতিদিন সুদের স্পর্শে থাকি—যদিও অনেক সময় অজান্তে। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল ফোনে যে ইএমআই স্কিমে ফোন কেনা হয়, তাতে সুদ লুকানো থাকে। গাড়ি কেনা, বাড়ি ভাড়া নেওয়া, এমনকি রাষ্ট্রীয় বাজেটেও সুদের প্রভাব ছড়িয়ে আছে।প্রতিটি ব্রিজ, রাস্তাঘাট, বিমান থেকে শুরু করে ট্রেন, টোল দেয়া, সবই সুদের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান বিশ্বে জঙ্গলে বসবাস করলেও সুদ ছাড়া কোন উপায় নেই।
ইসলামের নিষেধাজ্ঞার সাথে বাস্তবতার সংঘাত
সপ্তম শতকে যখন ইসলাম আবির্ভূত হয়, তখন আরবের অর্থনীতিতে ঋণগ্রস্ত সাধারণ মানুষকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে সুদ ব্যবহৃত হতো। ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি সামাজিক ন্যায়বিচারের লড়াই হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
- আজকের অর্থনীতিতে সুদ শুধু শোষণের হাতিয়ার নয়, বরং অর্থপ্রবাহের নিয়ন্ত্রক।
- রাষ্ট্রীয় বাজেট, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন—সবকিছুই সুদের নীতির ওপর নির্ভরশীল।
- এমনকি যারা “ইসলামি ব্যাংক” চালায় তারাও বাস্তবে সুদের বিকল্প নাম (মুনাফা, লাভের হার, সার্ভিস চার্জ) দিয়ে একই কাঠামো ব্যবহার করছে।
অতএব, ইসলামের মূল নিষেধাজ্ঞা আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় অকার্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদাহরণ: সুদ ছাড়া পৃথিবী কল্পনা
- গৃহঋণ নিষিদ্ধ হলে
অধিকাংশ মানুষ কখনোই বাড়ি কিনতে পারত না, কারণ নিজের আয়ে বিশাল অঙ্ক জমাতে কয়েক দশক সময় লেগে যেত। ফলে শহরায়ণ এবং আধুনিক আবাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। - রাষ্ট্রীয় ঋণ বাতিল হলে
যুদ্ধ, মহামারি বা অর্থনৈতিক মন্দার সময় সরকারগুলো সাধারণত বিদেশি ঋণ নেয়। সুদ ছাড়া ঋণ দিলে কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান টাকা ধার দিত না। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ভেঙে পড়ত। - শিক্ষা ঋণ না থাকলে
আমেরিকা বা ইউরোপের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারত না, কারণ টিউশন ফি বহন করা সম্ভব হতো না। সুদভিত্তিক শিক্ষা ঋণই তাদের পড়াশোনা সম্ভব করেছে।
উপসংহার
ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপট মূলত শোষণবিরোধী ও নৈতিকতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতি যেভাবে বিকশিত হয়েছে, সেখানে সুদ অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার অবিচ্ছেদ্য উপাদান। বাস্তবে সুদ ছাড়া আধুনিক বিশ্বে এক সেকেন্ডও চলা অসম্ভব।
অতএব, ইসলামের সুদবিরোধী অবস্থানকে কেবল একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন হিসেবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু এটি আধুনিক বৈশ্বিক বাস্তবতায় কার্যকর বা প্রযোজ্য নয়। আজকের দিনে এটি একেবারেই অবাস্তব একটি ধারণা।