বিজ্ঞানের জগতে আকাশ বা আসমান বলতে নির্দিষ্ট কিছু বা কোন বস্তুকে বোঝানো হয় না। বরঞ্চ আমরা উপরে যা দেখি সবই আকাশের অন্তর্ভূক্ত। আমরা দিনের বেলা পৃথিবীর আকাশকে নীল দেখতে পাই। বস্তুতপক্ষে এটি আমাদের এক ধরণের দৃষ্টিবিভ্রম। আলোর বিক্ষেপণের কারণে আকাশ নীল দেখায়। কোন কণিকার ওপর আলো পড়লে সেই কণিকা আলোকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়, যাকে আলোর বিক্ষেপণ বলে। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম, সেই আলোর বিক্ষেপণ তত বেশি হয়। আলোর বিক্ষেপণ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্ঘাতের ব্যস্তানুপাতিক। বেগুনি ও নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। তাই আকাশে এই আলো দুইটির বিক্ষেপণ বেশি হয়। আবার আমাদের চোখ বেগুনি অপেক্ষা নীল বর্ণের আলোর প্রতি অধিক সংবেদনশীল। তাই আকাশ নীল দেখায়।
ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে আল্লাহ সাতটি আসমান এবং সাতটি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন [1] –
আল্লাহই সাত আসমান বানিয়েছেন আর ওগুলোর মত পৃথিবীও, সবগুলোর মাঝে (অর্থাৎ সকল আসমানে আর সকল যমীনে) নেমে আসে আল্লাহর নির্দেশ যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান আর আল্লাহ (স্বীয়) জ্ঞানে সব কিছুকে ঘিরে রেখেছেন।
— Taisirul Quran
আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণ। ওগুলির মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; ফলে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি আল্লাহ, যিনি সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন সৃষ্টি করেছেন; এগুলির মাঝে তাঁর নির্দেশ অবতীর্ণ হয় যেন তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞানতো সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে।
— Rawai Al-bayan
তিনি আল্লাহ্, যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন, তাদের মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং জ্ঞানে আল্লাহ্ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এসব কারণেই অনেক ইসলামিক আলেম প্রায়শই দাবী করেন যে, মাটির নিচে আরো পৃথিবী রয়েছে, সেখানেও মানুষ আছে। বিশেষ করে এই বিষয়ে মুফতি ইব্রাহীমের অনেকগুলো ভিডিও রয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে একটি ভিডিও দেয়া হচ্ছে –
অনেক মুসলিমই এই সাত আসমানকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাতটি স্তরের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন কোরআনকে বিজ্ঞানসম্মত করার ইচ্ছে নিয়ে। তবে তাদের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় কোরআনেরই আয়াত দ্বারা, যেখানে বর্ণিত আছে, আল্লাহ নিকটবর্তী আসমানকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছেন। আসমানগুলোকে বায়ুমণ্ডলের স্তর হিসেবে ব্যাখ্যা দিলে এটিও মেনে নিতে হবে যে, সূর্য নামক নক্ষত্রটি বায়ুমণ্ডলের প্রথম স্তরে অবস্থিত। যেটি হবে আরো হাস্যকর ব্যাখ্যা। আসুন কোরআনের সেই আয়াত দুইটি পড়ে নিই [2] [3] –
নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। এবং তাকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান থেকে। ওরা উর্ধ্ব জগতের কোন কিছু শ্রবণ করতে পারে না এবং চার দিক থেকে তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয়। ওদেরকে বিতাড়নের উদ্দেশে। ওদের জন্যে রয়েছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ ছোঁ মেরে কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে।
আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জত করেছি; সেগুলোকে শয়তানদের জন্যে ক্ষেপণাস্ত্রবৎ করেছি এবং প্রস্তুত করে রেখেছি তাদের জন্যে জলন্ত অগ্নির শাস্তি।
প্রাচীনকালের ধর্মীয় বা পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বে ধারণা করা হতো যে, পৃথিবীর ওপর সাতটি আসমান বা আকাশমণ্ডলের সাতটি স্তর রয়েছে, একই সাথে মাটির নিচেও রয়েছে সাতটি পৃথিবী। প্রাচীনকালে এগুলি দেবদেবী বা অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বা সমূহের আবাসস্থল হিসেবে গণ্য করা হতো। দৃশ্যমান জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যেমন গ্রহ-নক্ষত্র, এসবকে এই আসমানসমূহের সাথে সম্পর্কিত করা হত।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতায় সপ্ত আসমানের ধারণা বিকশিত হয়েছিল [4]। সুমেরীয় ভাষায় স্বর্গ (আসমান বা আকাশ) ও পৃথিবীকে (জমিন) বলা হত “আন” এবং “কি”। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে সুমেরীয় জাদুমন্ত্রে সপ্তস্বর্গের উল্লেখ আছে, যেমন একটিতে এরকম লেখা “আন-ইমিনবি কি-ইমিনবি” (“স্বর্গ সাতটি, পৃথিবী সাতটি”) [5]। মেসোপটেমীয় ধর্মে সাধারণত স্বর্গ মানুষের জন্য কোন স্থান নয়। যেমন গিলগামেশের মহাকাব্যে বীর গিলগামেশ তার বন্ধু এনকিদুকে বলছেন, “স্বর্গে কে যেতে পারে বন্ধু? শুধু দেবতারাই শামাশের (সূর্যদেবের) সঙ্গে চিরকাল থাকবে।”
হিন্দু ধর্মেও সাত স্বর্গের কথা বলা হয়েছে। স্বর্গকে”স্বর্গলোক” বা ঊর্ধ্বলোকও বলা হয়। পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডের ঊর্ধ্বাংশ সাতটি লোক বা জগতের সমন্বয়ে গঠিত। পর্যায়ক্রমে এগুলি হচ্ছেঃ ভূলোক (পৃথ্বীলোক বা পৃথিবী), ভুবর্লোক, স্বর্লোক, মহর্লোক, জনলোক, তপোলোক এবং সবার ঊর্ধ্বে সত্যলোক বা ব্রহ্মলোক। হিন্দু পুরাণ এবং অথর্ববেদে ১৪ টি লোকের কথা বলা হয়েছে। এর সাতটি স্বর্গ; বাকি সাতটি পাতাল বা নরক। সপ্তস্বর্গের ঠিক নিচেই সপ্তপাতাল অবস্থিত [6]। স্বর্গের রাজধানী হচ্ছে অমরাবতী এবং ঐরাবত স্বর্গের প্রবেশদ্বার পাহারা দিচ্ছে। দেবরাজ ইন্দ্র সেখানে স্বসভায় (ইন্দ্রলোক/ইন্দ্রপুরী) বিরাজমান।
ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদ অনুসারে মহাবিশ্ব সপ্ত স্বর্গ বা সাত আসমানসমূহ (হিব্রু ভাষায়: שָׁמַיִם “শামাইম”; এই শব্দেরই আরবি স্বগত্রীয় শব্দ “সামাওয়াত”) সমন্বয়ে গঠিত [7]। এগুলির নামঃ
- বিলোন (וילון)
- রাকিয়া (רקיע)
- শেহাকিম (שחקים)
- যেবুল (זבול)
- মা’ওন (מעון)
- মাখোন/মাকোন (מכון)
- আরাবথ (ערבות) – সপ্তম স্বর্গ যেখানে ‘ওফানিম’ (যিহিষ্কেলের পুস্তকে বর্ণিত ঈশ্বরের স্বর্গীয় রথের চক্ররূপী রক্ষী), সরাফগণ (‘সেরাফিম’ – উচ্চপদের স্বর্গদূত বা ফেরেশতা অথবা এক জাতের আগ্নেয় স্বর্গীয় সত্তা), ‘হায়োথ’ বা ‘খায়োৎ’ (আরশ বহনকারী ফেরেশতা বা ঈশ্বরের আসনবাহক স্বর্গদূত) এবং প্রভুর সিংহাসন অবস্থিত [8]।
ইহুদিদের ‘মেরকাবাহ’ (স্বর্গীয় রথ) ও ‘হেখালৎ’ (“প্রাসাদসমূহ”) সাহিত্যে সপ্তস্বর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হনোকের ৩য় পুস্তকে এর বর্ণনা পাওয়া যায় [9]।
খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারেও বাইবেলে কয়েকটি আসমানের কথা বলা হয়েছে। বাইবেলের নূতন নিয়মে তৃতীয় স্বর্গের একটি স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। ৫৫ খ্রিষ্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের অধীন ম্যাসেডোনিয়ায় লিখিত একটি পৌলীয় পত্র এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাটি তুলে ধরে [10]। যদিও মধ্যযুগীয় কালক্রমে খ্রিস্টান চিন্তাবিদরা মূল সপ্ত স্বর্গের দশ স্বর্গ করে ফেলেন, তবে পূর্বযুগের খ্রিস্টানগণ আসমানকে সাতটিই ভাবতেন বলে বোঝা যায়।
আমি খ্রীষ্টে আশ্রিত একটি লোককে জানি, চোদ্দ বছর আগে যে তৃতীয় স্বর্গে ধরা পড়েছিল, সশরীরে না অশরীরে তা জানি না, ঈশ্বর জানেন৷ এই লোকটির ব্যাপার আমি জানি, সশরীরে কি অশরীরে, তা আমি জানি না, ঈশ্বর জানেন৷ সে স্বর্গোদ্যানে ধরা পড়ায় এমন সব বিস্ময়কর কথা শুনেছিল, যা নিয়ে মানুষের কথা বলা উচিত নয়৷
ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে মহাবিশ্ব তৈরি সাতটি শক্ত পদার্থে তৈরি আসমান দ্বারা, যেগুলোর প্রত্যেকটিতেই দরজা রয়েছে। সেই সাতটি আসমানে আবার মৃত নবীরা বসবাস করেন, যা সহিহ হাদিস থেকে পরিষ্কারভাবে জানা যায়। মুহাম্মদ মিরাজের রাতে নিজে নাকি সেই সাতটি আসমান ঘুরে এসেছেন। একইসাথে, সেখানে তিনি একটি বিরাট বরই গাছও দেখেছেন। যেটার নাম নাকি সিদরাতুল মুনতাহা। আসুন হাদিসগুলোর একটি হাদিস পড়ে দেখি [11] –
সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)
১। ঈমান [বিশ্বাস]
পরিচ্ছেদঃ ৭৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর মি’রাজ এবং সালাত ফরয হওয়া।
হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৩০০, আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ১৬২
৩০০-(২৫৯/১৬২) শাইবান ইবনু ফার্রূখ (রহঃ) ….. আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমার জন্য বুরাক পাঠানো হল[1]। বুরাক গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট একটি সাদা রঙের জন্তু। যতদূর দৃষ্টি যায় এক পদক্ষেপে সে ততদূর চলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি এতে আরোহণ করলাম এবং বাইতুল মাকদাস পর্যন্ত এসে পৌছলাম। তারপর অন্যান্য আম্বিবায়ে কিরাম তাদের বাহনগুলো যে খুঁটির সাথে বাঁধতেন, আমি সে খুঁটির সাথে আমার বাহনটিও বাঁধলাম। তারপর মসজিদে প্রবেশ করলাম ও দু’ রাকাআত সালাত আদায় করে বের হলাম। জিবরীল (আঃ) একটি শরাবের পাত্র এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার কাছে এলেন। আমি দুধ গ্রহণ করলাম। জিবরীল (আঃ) আমাকে বললেন, আপনি ফিতরাহকেই গ্রহণ করলেন।
তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গেলেন এবং আসমান পর্যন্ত পৌছে দ্বার খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিবরীল। জিজ্ঞেস কলা হলো, আপনার সাথে কে? বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনাকে কি তাকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খুলে দেয়া হল। সেখানে আমি আদম (আঃ) এর দেখা পাই তিনি আমাকে মুবারাকবাদ জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে উর্ধ্বলোক নিয়ে চললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, তাকে কি আনতে পাঠানো হয়েছিল? বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হল। সেখানে আমি ঈসা ইবনু মারইয়াম ও ইয়াহইয়া ইবনু যাকারিয়া (আঃ) দুই খালাত ভাইয়ের দেখা পেলাম। তারা আমাকে মারহাবা বললেন, আমার জন্য কল্যাণের দু’আ করলেন।
তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে চললেন এবং তৃতীয় আসমানের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনাকে কি তাকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হল। সেখানে ইউসুফ (আঃ) এর দেখা পেলাম। সমুদয় সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছিল তাকে। তিনি আমাকে মারহাবা বললেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে নিয়ে চতুর্থ আসমানের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনাকে কি তাকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হল। সেখানে ইদরীস (আঃ) এর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে মারহাবা বললেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন। আল্লাহ তা’আল তার সম্পর্কে ইরশাদ করেছেনঃ “এবং আমি তাকে উন্নীত করেছি উচ্চ মর্যাদায়” (সূরাহ আল হাদীদ ৫৭ঃ ১৯)।
তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে নিয়ে পঞ্চম আসমানের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কে?”[2] তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনাকে কি তাকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হল। সেখানে হারূন (আঃ) এর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে মারহাবা বললেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনাকে কি তাকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হল। সেখানে মূসা (আঃ) এর দেখা পেলাম। তিনি আমাকে মারহাবা বললেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর জিবরীল (আঃ) সপ্তম আসমানের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দরজা খুলতে বললেন। জিজ্ঞেস করা হলো, কে? তিনি বললেন, জিবরীল। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনাকে কি তাকে আনতে পাঠানো হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ! পাঠানো হয়েছিল। তারপর আমাদের জন্য দ্বার খুলে দেয়া হল। সেখানে ইবরাহীম (আঃ)-এর দেখা পেলাম। তিনি বাইতুল মামুরে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন[3]। বাইতুল মামুরে প্রত্যেহ সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের উদ্দেশে প্রবেশ করেন যারা আর সেখানে পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ পান না। তারপর জিবরীল (আঃ) আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায়[4] নিয়ে গেলেন। সে বৃক্ষের পাতাগুলো হাতির কানের ন্যায় আর ফলগুলো বড় বড় মটকার মত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে বৃক্ষটিকে যখন আল্লাহর নির্দেশে যা আবূত করে তখন তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। সে সৌন্দর্যের বর্ণনা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর আল্লাহ তা’আলা আমার উপর যে ওয়াহী করার তা ওয়াহী করলেন। আমার উপর দিনরাত মোট পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করলেন, এরপর আমি মূসা (আঃ) এর কাছে ফিরে আসলাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনার প্রতিপালক আপনার উপর কি ফরয করেছেন। আমি বললাম, পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত। তিনি বললেন, আপনার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যান এবং একে আরো সহজ করার আবেদন করুন। কেননা আপনার উম্মত এ নির্দেশ পালনে সক্ষম হবে না। আমি বনী ইসরাঈলকে পরীক্ষা করেছি এবং তাদের বিষয়ে আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তখন আমি আবার প্রতিপালকের কাছে ফিরে গেলাম এবং বললাম, হে আমার রব! আমার উম্মতের জন্য এ হুকুম সহজ করে দিন। পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হল। তারপর মূসা (আঃ)-এর নিকট ফিরে এসে বললাম, আমার থেকে পাঁচ ওয়াক্ত কমানো হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এও পারবে না। আপনি ফিরে যান এবং আরো সহজ করার আবেদন করুন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এভাবে আমি একবার মূসা (আঃ) ও একবার আল্লাহর মাঝে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম। শেষে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ হে মুহাম্মাদ! যাও দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্ধারণ করা হল। প্রতি ওয়াক্ত সালাতে দশ ওয়াক্ত সালাতের সমান সাওয়াব রয়েছে। এভাবে (পাঁচ ওয়াক্ত হল) পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সমান। যে ব্যক্তি কোন নেক কাজের নিয়্যাত করল এবং তা কাজে রূপায়িত করতে পারল না, আমি তার জন্য একটি সাওয়াব লিখব; আর তা কাজে রূপায়িত করলে তার জন্য লিখব দশটি সাওয়াব। পক্ষান্তরে যে কোন মন্দ কাজের নিয়্যাত করল অথচ তা কাজে পরিণত করল না তার জন্য কোন গুনাহ লিখা হয় না। আর তা কাজে পরিণত করলে তার উপর লিখা হয় একটি মাত্র গুনাহ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তারপর আমি মূসা (আঃ) এর নিকট নেমে এলাম এবং তাকে এ বিষয়ে অবহিত করলাম। তিনি তখন বললেন, প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান এবং আরো সহজ করার প্রার্থনা করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ বিষয়টি নিয়ে বারবার আমি আমার প্রতিপালকের নিকট আসা-যাওয়া করেছি, এখন আবার যেতে লজ্জা হচ্ছে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩০৮, ইসলামিক সেন্টারঃ ৩১৯)
1. কায়ী ইয়ায (রহঃ) বলেন যে, মি’রাজ স্বশরীরে হয়েছিল না স্বপ্নযোগে হয়েছিল এটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, স্বপ্নযোগে হয়েছিল। এটা অত্যন্ত দুর্বল কথা। অধিকাংশ পূর্ব ও পরের উলামা, ফুকাহা ও মুহাদ্বিসীনের অভিমত হল প্রিয়নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। হাদীসসমূহে প্রকাশ্যভাবে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এর বিপরীত হাদীসের অন্য ব্যাখ্যার কোন কারণ বা সুযোগ নেই যে, অন্য তা’বীল করা যাবে। (সংক্ষিপ্ত নাবাবী)
খাদীজাহ (রাযিঃ)-এর মৃত্যু মিরাজের পূর্বেই হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু নুবুওয়াতের দশম বর্ষের রমযান মাসে হয়েছিল বলে জানা যায়। কাজেই মিরাজের ঘটনা এর পরেই ঘটেছে, আগে নয়। (আর রাহীকুল মাখতুম, অনুবাদ- খাদীজাহ আক্তার রেজায়ী ১৬৬ খৃঃ)
2. ইমান নাবাবী (রহঃ) বলেন, এ হাদীস থেকে কয়েকটি কথা জানা যায়। (১) বাড়ীর মধ্যে হতে কোন আগন্তুককে যদি বলা হয় কে? তার উত্তরে বলবে নাঃ “আমি”; বরং নাম বলতে হবে। (২) আকাশের দরজা আছে। (৩) দরজার নিকটে পাহারাদার আছে। (৪) মেহমানের সম্মানে মারহাবা বলে অভিবাদন জানানো যাবে। এটাই নাবীদের আদর্শ।
3. “বাইতুল মামুর” নামে বাইতুল্লাহর সামনে আকাশের উপরে একটি ঘর আছে। বাইতুল মামুর এজন্য বলা হয় যে, সব সময় এ ঘরটি সমৃদ্ধ থাকে অর্থাৎ প্রত্যেকদিন নতুনভাবে সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদাতের জন্য আসে। যে একবার আসে সে কোনদিন পুনরায় আসার সুযোগ পাবে না। এ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর ফেরেশতা কত আছে। বাইতুল মামূর সপ্তম আকাশে আছে। ইবরাহীম (আঃ) বাইতুল মামুর এর দিকে পিঠ ফিরে বসে ছিলেন। এ হাদীস হতে এটাও প্রমাণ হয় যে, বাইতুল্লাহর দিকে পিঠ করে বসা যাবে।
4. “সিদরাতুল মুনতাহা” সপ্তম আকাশের উপরের একটি বরই গাছ এবং ফেরেশতাদের বিচরণের শেষ সীমা। অথবা গমনের শেষ সীমা। অর্থাৎ সিদরাতুল মুনতাহার উপর কি আছে আল্লাহ ছাড়া কারও জ্ঞান নেই। ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, যে সিদরাতুল মুনতাহা এজন্য বলা হয় যে, ফেরেশতাদের জ্ঞান বিচরণ ওখান পর্যন্ত শেষ হয়েছিল। তার আগে তারা যেতে পারেনি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত। আর যারা উপরে আছে তারা এখানে এসে থেমে যায়। নিচে আসতে পারে না এবং যারা নিচে আছে তারা এখানে এসে থেমে যায়। উপরে যেতে পারে না। এটা আল্লাহর নির্দেশ।
এ হাদীস হতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন আছেন এবং প্রিয় নাবীর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। যার কোন অপব্যাখ্যার সুযোগ নেই। এ কথোপকথনের মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্ত হতে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে নিয়েছেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)
তাফসীরে জালালাইনে আবার এই আসমানগুলো কী পদার্থে তৈরি তার পরিষ্কারভাবেই বলা আছে [12]

আসমানগুলো ধাতব শক্ত পদার্থে তৈরি এবং সেগুলোর দরজা আছে, দরজায় আবার পাহারাদার আছে, এগুলো কতটা সত্য আর কতটা শিশুদের রূপকথার গল্প, তা পাঠকের বিচার বিবেচনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।
তথ্যসূত্রঃ
- কোরআন, সূরা তালাক, আয়াত ১২ ↩︎
- কোরআন ৩৭ঃ ৬-১০ ↩︎
- কোরআন ৬৭ঃ৫ ↩︎
- Barnard, Jody A. (2012). The Mysticism of Hebrews: Exploring the Role of Jewish Apocalyptic Mysticism in the Epistle to the Hebrews. Mohr Siebeck. p. 62. ISBN 978-3-16-151881-2. Retrieved 3 June 2015 ↩︎
- Horowitz, Wayne (1998). Mesopotamian Cosmic Geography. Eisenbrauns. p. 208. ISBN 0-931464-99-4. Retrieved 3 June 2015 ↩︎
- শিব পুরাণ, বি. কে. চতুর্বেদী (২০০৪), ডায়মন্ড পকেট বুকস, পৃষ্ঠা ১২৪, আইএসবিএন 8171827217 ↩︎
- “Angelology”. Jewish Encyclopedia. Retrieved 16 June 2015 ↩︎
- Hagigah 12b ↩︎
- Scholem, Gershom (1965). Jewish Gnosticism, Merkabah Mysticism, and the Talmudic Tradition. New York: Jewish Theological Seminary of America. OCLC 635020 ↩︎
- ২য় করিন্থীয় ১২.২-৪ ↩︎
- সহীহ মুসলিম, হাদীস একাডেমী, হাদিসঃ ৩০০ ↩︎
- তাফসীরে জালালাইন, ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশনী, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫ ↩︎