02.সাত আসমান ও সাত জমিন

বিজ্ঞানের জগতে আকাশ বা আসমান বলতে নির্দিষ্ট কিছু বা কোন বস্তুকে বোঝানো হয় না। বরঞ্চ আমরা উপরে যা দেখি সবই আকাশের অন্তর্ভূক্ত। আমরা দিনের বেলা পৃথিবীর আকাশকে নীল দেখতে পাই। বস্তুতপক্ষে এটি আমাদের এক ধরণের দৃষ্টিবিভ্রম। আলোর বিক্ষেপণের কারণে আকাশ নীল দেখায়। কোন কণিকার ওপর আলো পড়লে সেই কণিকা আলোকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়, যাকে আলোর বিক্ষেপণ বলে। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম, সেই আলোর বিক্ষেপণ তত বেশি হয়। আলোর বিক্ষেপণ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্ঘাতের ব্যস্তানুপাতিক। বেগুনি ও নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। তাই আকাশে এই আলো দুইটির বিক্ষেপণ বেশি হয়। আবার আমাদের চোখ বেগুনি অপেক্ষা নীল বর্ণের আলোর প্রতি অধিক সংবেদনশীল। তাই আকাশ নীল দেখায়।

ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে আল্লাহ সাতটি আসমান এবং সাতটি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন [1]

আল্লাহই সাত আসমান বানিয়েছেন আর ওগুলোর মত পৃথিবীও, সবগুলোর মাঝে (অর্থাৎ সকল আসমানে আর সকল যমীনে) নেমে আসে আল্লাহর নির্দেশ যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান আর আল্লাহ (স্বীয়) জ্ঞানে সব কিছুকে ঘিরে রেখেছেন।
— Taisirul Quran
আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণ। ওগুলির মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; ফলে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।
— Sheikh Mujibur Rahman
তিনি আল্লাহ, যিনি সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন সৃষ্টি করেছেন; এগুলির মাঝে তাঁর নির্দেশ অবতীর্ণ হয় যেন তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞানতো সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে।
— Rawai Al-bayan
তিনি আল্লাহ্‌, যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং অনুরূপ যমীন, তাদের মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান এবং জ্ঞানে আল্লাহ্‌ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

এসব কারণেই অনেক ইসলামিক আলেম প্রায়শই দাবী করেন যে, মাটির নিচে আরো পৃথিবী রয়েছে, সেখানেও মানুষ আছে। বিশেষ করে এই বিষয়ে মুফতি ইব্রাহীমের অনেকগুলো ভিডিও রয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে একটি ভিডিও দেয়া হচ্ছে –

অনেক মুসলিমই এই সাত আসমানকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাতটি স্তরের সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন কোরআনকে বিজ্ঞানসম্মত করার ইচ্ছে নিয়ে। তবে তাদের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় কোরআনেরই আয়াত দ্বারা, যেখানে বর্ণিত আছে, আল্লাহ নিকটবর্তী আসমানকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছেন। আসমানগুলোকে বায়ুমণ্ডলের স্তর হিসেবে ব্যাখ্যা দিলে এটিও মেনে নিতে হবে যে, সূর্য নামক নক্ষত্রটি বায়ুমণ্ডলের প্রথম স্তরে অবস্থিত। যেটি হবে আরো হাস্যকর ব্যাখ্যা। আসুন কোরআনের সেই আয়াত দুইটি পড়ে নিই [2] [3]

নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। এবং তাকে সংরক্ষিত করেছি প্রত্যেক অবাধ্য শয়তান থেকে। ওরা উর্ধ্ব জগতের কোন কিছু শ্রবণ করতে পারে না এবং চার দিক থেকে তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয়। ওদেরকে বিতাড়নের উদ্দেশে। ওদের জন্যে রয়েছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ ছোঁ মেরে কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে।

আমি সর্বনিম্ন আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জত করেছি; সেগুলোকে শয়তানদের জন্যে ক্ষেপণাস্ত্রবৎ করেছি এবং প্রস্তুত করে রেখেছি তাদের জন্যে জলন্ত অগ্নির শাস্তি।

প্রাচীনকালের ধর্মীয় বা পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বে ধারণা করা হতো যে, পৃথিবীর ওপর সাতটি আসমান বা আকাশমণ্ডলের সাতটি স্তর রয়েছে, একই সাথে মাটির নিচেও রয়েছে সাতটি পৃথিবী। প্রাচীনকালে এগুলি দেবদেবী বা অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বা সমূহের আবাসস্থল হিসেবে গণ্য করা হতো। দৃশ্যমান জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যেমন গ্রহ-নক্ষত্র, এসবকে এই আসমানসমূহের সাথে সম্পর্কিত করা হত।

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতায় সপ্ত আসমানের ধারণা বিকশিত হয়েছিল [4]। সুমেরীয় ভাষায় স্বর্গ (আসমান বা আকাশ) ও পৃথিবীকে (জমিন) বলা হত “আন” এবং “কি”। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে সুমেরীয় জাদুমন্ত্রে সপ্তস্বর্গের উল্লেখ আছে, যেমন একটিতে এরকম লেখা “আন-ইমিনবি কি-ইমিনবি” (“স্বর্গ সাতটি, পৃথিবী সাতটি”) [5]। মেসোপটেমীয় ধর্মে সাধারণত স্বর্গ মানুষের জন্য কোন স্থান নয়। যেমন গিলগামেশের মহাকাব্যে বীর গিলগামেশ তার বন্ধু এনকিদুকে বলছেন, “স্বর্গে কে যেতে পারে বন্ধু? শুধু দেবতারাই শামাশের (সূর্যদেবের) সঙ্গে চিরকাল থাকবে।”

হিন্দু ধর্মেও সাত স্বর্গের কথা বলা হয়েছে। স্বর্গকে”স্বর্গলোক” বা ঊর্ধ্বলোকও বলা হয়। পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মাণ্ডের ঊর্ধ্বাংশ সাতটি লোক বা জগতের সমন্বয়ে গঠিত। পর্যায়ক্রমে এগুলি হচ্ছেঃ ভূলোক (পৃথ্বীলোক বা পৃথিবী), ভুবর্লোক, স্বর্লোক, মহর্লোক, জনলোক, তপোলোক এবং সবার ঊর্ধ্বে সত্যলোক বা ব্রহ্মলোক। হিন্দু পুরাণ এবং অথর্ববেদে ১৪ টি লোকের কথা বলা হয়েছে। এর সাতটি স্বর্গ; বাকি সাতটি পাতাল বা নরক। সপ্তস্বর্গের ঠিক নিচেই সপ্তপাতাল অবস্থিত [6]। স্বর্গের রাজধানী হচ্ছে অমরাবতী এবং ঐরাবত স্বর্গের প্রবেশদ্বার পাহারা দিচ্ছে। দেবরাজ ইন্দ্র সেখানে স্বসভায় (ইন্দ্রলোক/ইন্দ্রপুরী) বিরাজমান।

ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তালমুদ অনুসারে মহাবিশ্ব সপ্ত স্বর্গ বা সাত আসমানসমূহ (হিব্রু ভাষায়: שָׁמַיִם‎ “শামাইম”; এই শব্দেরই আরবি স্বগত্রীয় শব্দ “সামাওয়াত”) সমন্বয়ে গঠিত [7]। এগুলির নামঃ

  • বিলোন (וילון)
  • রাকিয়া (רקיע)
  • শেহাকিম (שחקים)
  • যেবুল (זבול)
  • মা’ওন (מעון)
  • মাখোন/মাকোন (מכון)
  • আরাবথ (ערבות) – সপ্তম স্বর্গ যেখানে ‘ওফানিম’ (যিহিষ্কেলের পুস্তকে বর্ণিত ঈশ্বরের স্বর্গীয় রথের চক্ররূপী রক্ষী), সরাফগণ (‘সেরাফিম’ – উচ্চপদের স্বর্গদূত বা ফেরেশতা অথবা এক জাতের আগ্নেয় স্বর্গীয় সত্তা), ‘হায়োথ’ বা ‘খায়োৎ’ (আরশ বহনকারী ফেরেশতা বা ঈশ্বরের আসনবাহক স্বর্গদূত) এবং প্রভুর সিংহাসন অবস্থিত [8]

ইহুদিদের ‘মেরকাবাহ’ (স্বর্গীয় রথ) ও ‘হেখালৎ’ (“প্রাসাদসমূহ”) সাহিত্যে সপ্তস্বর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হনোকের ৩য় পুস্তকে এর বর্ণনা পাওয়া যায় [9]

খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারেও বাইবেলে কয়েকটি আসমানের কথা বলা হয়েছে। বাইবেলের নূতন নিয়মে তৃতীয় স্বর্গের একটি স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। ৫৫ খ্রিষ্টাব্দে রোম সাম্রাজ্যের অধীন ম্যাসেডোনিয়ায় লিখিত একটি পৌলীয় পত্র এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাটি তুলে ধরে [10]। যদিও মধ্যযুগীয় কালক্রমে খ্রিস্টান চিন্তাবিদরা মূল সপ্ত স্বর্গের দশ স্বর্গ করে ফেলেন, তবে পূর্বযুগের খ্রিস্টানগণ আসমানকে সাতটিই ভাবতেন বলে বোঝা যায়।

আমি খ্রীষ্টে আশ্রিত একটি লোককে জানি, চোদ্দ বছর আগে যে তৃতীয় স্বর্গে ধরা পড়েছিল, সশরীরে না অশরীরে তা জানি না, ঈশ্বর জানেন৷ এই লোকটির ব্যাপার আমি জানি, সশরীরে কি অশরীরে, তা আমি জানি না, ঈশ্বর জানেন৷ সে স্বর্গোদ্যানে ধরা পড়ায় এমন সব বিস্ময়কর কথা শুনেছিল, যা নিয়ে মানুষের কথা বলা উচিত নয়৷ 

আসমানগুলো ধাতব শক্ত পদার্থে তৈরি এবং সেগুলোর দরজা আছে, দরজায় আবার পাহারাদার আছে, এগুলো কতটা সত্য আর কতটা শিশুদের রূপকথার গল্প, তা পাঠকের বিচার বিবেচনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।

তথ্যসূত্র

  1. কোরআন, সূরা তালাক, আয়াত ১২ []
  2. কোরআন ৩৭ঃ ৬-১০ []
  3. কোরআন ৬৭ঃ৫ []
  4. Barnard, Jody A. (2012). The Mysticism of Hebrews: Exploring the Role of Jewish Apocalyptic Mysticism in the Epistle to the Hebrews. Mohr Siebeck. p. 62. ISBN 978-3-16-151881-2. Retrieved 3 June 2015 []
  5. Horowitz, Wayne (1998). Mesopotamian Cosmic Geography. Eisenbrauns. p. 208. ISBN 0-931464-99-4. Retrieved 3 June 2015 []
  6. শিব পুরাণ, বি. কে. চতুর্বেদী (২০০৪), ডায়মন্ড পকেট বুকস, পৃষ্ঠা ১২৪, আইএসবিএন 8171827217 []
  7. “Angelology”. Jewish Encyclopedia. Retrieved 16 June 2015 []
  8. Hagigah 12b []
  9. Scholem, Gershom (1965). Jewish Gnosticism, Merkabah Mysticism, and the Talmudic Tradition. New York: Jewish Theological Seminary of America. OCLC 635020 []
  10. ২য় করিন্থীয় ১২.২-৪ []


সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৪ "সংশয় - চিন্তার মুক্তির আন্দোলন"