ইসলামে সমকামীদের হত্যার অমানবিক বিধান

ভূমিকা

ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী সমকামিতা একটি গুরুতর অপরাধ, যার শাস্তি হিসেবে অনেক ফিকাহ ব্যাখ্যাকার মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করেছেন। ইসলামী বিশ্বাস, বিশেষ করে কুরআন, হাদিস ও প্রাথমিক আমলের ফিকাহ গ্রন্থে এই বিষয়টি ‘লওয়াত’ বা ‘কওমে লূতের কর্ম’ নামে পরিচিত। কুরআনে “কওমে লূত”-এর কাহিনি বারবার উল্লেখিত হয়েছে [1] [2] [3], যেখানে লূত জাতির পুরুষরা নারীদের পরিবর্তে পুরুষদের প্রতি যৌন আকর্ষণ প্রদর্শন করেছিল বলে বর্ণিত আছে, এবং ফলস্বরূপ তারা ‘আল্লাহর আযাবে’ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ইসলামী ব্যাখ্যা মতে, এই কাহিনি থেকেই ইসলামী শরীয়তের ‘লওয়াত’ সংক্রান্ত আইনগত ভিত্তি গড়ে ওঠে।

তবে ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লিখিত এই গল্পটি ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক নয়; বরং এটি একটি ধর্মীয় বর্ণনা, যার ভিত্তিতে পরবর্তী যুগের ফিকাহবিদরা নৈতিক ও আইনি বিধান রচনা করেন। ইসলামী সভ্যতার প্রাথমিক যুগে যখন সামাজিক কাঠামো ছিল গোত্রনির্ভর, তখন যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণকে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার অংশ হিসেবে দেখা হতো। সেখান থেকেই সমকামিতাকে কেবল পাপ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় ব্যক্তিগত যৌন পরিচয়কে ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ফলে এই শরীয়তীয় বিধান বর্তমান মানবাধিকার ও নৈতিক দর্শনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে পড়ে।


হাদিসে সমকামীদের হত্যার বিধান

হাদিস সমূহে সমকামিতার বিষয়ে ইসলামী আইন গঠনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। নবী মুহাম্মদ-এর বর্ণিত একাধিক হাদিসে সমকামীদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই হাদিসগুলোকে বিভিন্ন আলেম ও মুফাসসির তাদের নিজ নিজ ফিকাহ মতবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন—সুনান আত-তিরমিযী (হাদীস ১৪৫৬), সুনান আবূ দাউদ (৪৪৬২), সুনান ইবন মাজাহ (২৫৬১), ও আল-বায়হাকী (৮/২৩২)-এ বর্ণিত হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি কওমে লূতের কাজ করে, তাকে এবং তার সঙ্গীকে হত্যা করো।” ইমাম নাসাঈ, ইমাম তিরমিজী ও পরবর্তীতে ইমাম আল-আলবানী এই হাদিসকে সহীহ বলেছেন [4]

সুনানে ইবনে মাজাহ
অধ্যায়ঃ ১৪/ হদ্দ (দন্ড)
১৪/১২. যে ব্যক্তি লূত জাতির অনুরূপ অপকর্মে লিপ্ত হয়
১/২৫৬১। ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা কাউকে লূত জাতির অনুরূপ অপকর্মে লিপ্ত পেলে তাকে এবং যার সাথে তা করা হয় তাকে হত্যা করো।
তিরমিযী ১৪৫৬, আবূ দাউদ ৪৪৬২, বায়হাকী ফিস সুনান ৮/২৩২, ইরওয়া ২৩৫০, মিশকাত ৩৫৭৫। তাহকীক আলবানীঃ সহীহ। উক্ত হাদিসের রাবী আবদুল আযীয বিন মুহাম্মাদ সম্পর্কে মুহাম্মাদ বিন সা’দ বলেন, তিনি হাদিস বর্ণনায় সংমিশ্রণ করেন। ইবনু হিব্বান বলেন, তিনি হাদিস বর্ণনায় ভুল করেন। মালিক বিন আনাস তাকে সিকাহ বলেছেন। আহমাদ বিন শু’আয়ব আন নাসায়ী বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য নয়। ইবনু হাজার আল-আসকালানী বলেন, তিনি সত্যবাদী তবে নিজ কিতাব ছাড়া অন্যত্র থেকে হাদিস বর্ণনায় ভুল করেন। (তাহযীবুল কামালঃ রাবী নং ৩৪৭০, ১৮/১৮৭ নং পৃষ্ঠা)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত)
অধ্যায়ঃ ৩৩/ অপরাধ ও তার শাস্তি
২৯. কেউ কওমে লূতের অনুরূপ অপকর্ম করলে
৪৪৬৩। ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, অবিবাহিতদের লাওয়াতাতে (পায়ুকামে) লিপ্ত পাওয়া গেলে রজম করা হবে। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, ‘আসিম (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত হাদীস আমর ইবনু আবূ আমরের হাদীসকে দুর্বল প্রমাণিত করে।(1)
সনদ সহীহ মাওকুফ।
(1). বায়হাক্বী।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

এই হাদীসগুলো ইসলামী ফিকাহের প্রধান ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও হাম্বলিরা একে সরাসরি হদ্দ অপরাধের আওতায় ফেলেছেন, আর ইমাম আবু হানিফা একে তাযীর হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ, বিচারকের বিবেচনায় শাস্তি নির্ধারিত হতে পারে — কিন্তু সর্বাধিক প্রচলিত মত হলো মৃত্যু। মধ্যযুগীয় ফিকাহ গ্রন্থ যেমন আল-মুয়াত্তা, আল-হিদায়া, আল-মুগনী, বদায়েউস-সানায়ি প্রভৃতিতে এই শাস্তি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।


ইসলামী ফিকহে সমকামীদের হত্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইসলামী ইতিহাসে সমকামিতা বা লওয়াত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের একাধিক দলিল পাওয়া যায়। খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময় থেকে শুরু করে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামলে লওয়াত অপরাধের দায়ে শিরচ্ছেদ, রজম, এমনকি জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নজির পাওয়া যায়। ইবন কুদামা (আল-মুগনী) উল্লেখ করেন যে, উমর (রা.) একদল ব্যক্তিকে লওয়াতের অভিযোগে হত্যা করেন এবং বলেন, “তোমরা তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি প্রয়োগ করো।” আল-জাসাস তাঁর আহকামুল কুরআন-এ বলেন, “লওয়াত এমন অপরাধ যা আল্লাহর ক্রোধ ডেকে আনে, তাই এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।”

আধুনিক ইসলামিক গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, এই আইনি প্রক্রিয়া মূলত ধর্মীয় শাস্তির চেয়ে বেশি ছিল সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। মধ্যযুগীয় মুসলিম সমাজে রাষ্ট্র, ধর্ম ও নৈতিকতা ছিল একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ফলে যৌনতার যে কোনো ভিন্নতা রাষ্ট্রবিরোধী বা ধর্মবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিছু গবেষক যেমন খালেদ এল-রুয়াইহেব (Harvard University, Before Homosexuality in the Arab-Islamic World, 1500–1800) দেখিয়েছেন, ইসলামি সমাজে প্রকৃত সমকামী আচরণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতো সামাজিক লজ্জা ও সম্মানরক্ষা। অর্থাৎ, সমকামিতা নিয়ে ভয় ও নিষেধাজ্ঞা মূলত সামাজিক রক্ষণশীলতা ও ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদের অংশ।


খিলাফত আমলে খলিফাদের প্রকাশ্য সমকামিতা

যদিও ইসলামী শরীয়তে সমকামিতার শাস্তি কঠোর ও মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলা হয়েছে, ইতিহাসে দেখা যায় — খিলাফতের রাজদরবারে ঠিক বিপরীত প্রবণতা বিদ্যমান ছিল। বহু খলিফা, আমির ও রাজপুরুষ নিজের প্রাসাদে প্রকাশ্যে পুরুষপ্রেমে লিপ্ত ছিলেন এবং তরুণ দাস বা “আমরদ” (beardless youths)-এর প্রতি অস্বাভাবিক আকর্ষণ দেখাতেন। ইসলামী ইতিহাসবিদ আল-মাসউদী, আল-তাবারী, ইবন খাল্লিকান ও ইবন আল-জাওযী সহ বহু প্রাচীন লেখক তাঁদের গ্রন্থে এই ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করেছেন।

আব্বাসীয় খলিফা আল-আমিন (শাসনকাল ৮০৯–৮১৩ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত শাসক। আল-মাসউদী তাঁর Muruj al-Dhahab-এ লিখেছেন, “আল-আমিন নারীদের প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন এবং সুদর্শন তরুণ দাসদের সঙ্গেই সময় কাটাতেন; তাদের তিনি ‘প্রিয়জন’ বলে ডাকতেন” [5]. ইবন আল-জাওযী তাঁর Al-Muntazam fi Tarikh al-Umam wal-Muluk-এ উল্লেখ করেছেন যে, আল-আমিনের প্রাসাদে শতাধিক তরুণ গায়ক ও দাস ছিল, যাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গুজব ছড়িয়ে পড়ে [6]. আল-তাবারীর Tarikh al-Rusul wa al-Muluk-এও একই তথ্য পাওয়া যায়, যেখানে তিনি বলেন, “খলিফা তাঁর সভায় তরুণ দাসদের সঙ্গে কবিতা পাঠ করতেন এবং তাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন” [7].

আরেক আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাসিম বিল্লাহ (শাসনকাল ৮৩৩–৮৪২) সম্পর্কে ইবন খাল্লিকান লিখেছেন যে, তিনি তুর্কি সৈন্যদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন এবং তাঁদের মধ্য থেকেই রাজপ্রাসাদের রক্ষীবাহিনী গঠন করেন [8]. আল-মাসউদীর বিবরণে দেখা যায়, তাঁর প্রিয় সৈন্য আফশিনের সঙ্গে অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা ছিল, যা প্রাসাদীয় রাজনীতির মূল বিষয় হয়ে ওঠে [9]. আধুনিক ইতিহাসবিদ Hugh Kennedy এই সম্পর্ককে “personal intimacy and political favoritism intertwined with homoerotic overtones” বলে বর্ণনা করেছেন [10].

ফাতেমীয় খলিফা আল-আমির ফি আহকমিল্লাহ (শাসনকাল ১১০১–১১৩০ খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। মিশরের ইতিহাসবিদ আল-মাকরিজী তাঁর al-Khitat গ্রন্থে লিখেছেন যে, “খলিফা যুবকদের প্রতি প্রবল আকৃষ্ট ছিলেন; তাঁর প্রাসাদে প্রায়শই নগ্ন নর্তক ও দাসদের নৃত্য আয়োজন হতো” [11]. এই সমকামী আচরণের কারণে প্রাসাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে এবং পরবর্তীতে তিনি আততায়ী হামলায় নিহত হন।

আন্দালুসে উমাইয়া রাজবংশের খলিফাদের মধ্যেও সমকামিতার প্রবণতা স্পষ্ট দেখা যায়। কর্ডোভার খলিফা আল-হাকাম দ্বিতীয় (শাসনকাল ৯৬১–৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর প্রাসাদে এক তরুণ গায়ক “সান্দাল”-এর প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ দেখাতেন, যাকে তিনি প্রায় স্ত্রীর মর্যাদা দিতেন [12]. আধুনিক ইতিহাসবিদ Reinhart Dozy লিখেছেন, “আল-হাকামের রাজসভায় পুরুষপ্রেম ছিল এক ধরণের রোমান্টিক ফ্যাশন, যা কবিতা, সংগীত ও রাজকীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়” [13].

এ সময়ের প্রখ্যাত কবি আবু নুয়াস (৭৫৬–৮১৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন আল-আমিনের রাজদরবারের ঘনিষ্ঠ। তাঁর কবিতায় পুরুষপ্রেম ও তরুণদের প্রতি যৌন আকর্ষণ প্রকাশ্যে বর্ণিত হয়েছে, যেমন—“হে তরুণ, তোর গালের গোলাপ আর ঠোঁটের মদে মত্ত আমি” [14]. আবু নুয়াসের এই সাহসী কবিতা ও আল-আমিনের সমর্থন মধ্যযুগীয় ইসলামী সভ্যতার অন্তর্গত বৈপরীত্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে—যেখানে শরীয়ত সমকামিতার জন্য মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেয়, অথচ রাজদরবারে সেটিই ছিল একধরনের বিলাসিতা ও সংস্কৃতি।

উল্লেখ্য, এই তথ্যগুলো শুধু গুজব নয়; বরং সমকালীন আরবি ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বিস্তৃতভাবে নথিবদ্ধ। যদিও কিছু বিবরণ পরবর্তীতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিকৃত হতে পারে, তবুও বহুসূত্রে মিলে যায় এমন দলিলগুলো ইঙ্গিত দেয় যে খিলাফতের সময় প্রকাশ্য সমকামিতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, রাজকীয় সংস্কৃতিরই অংশে পরিণত হয়েছিল। এটি প্রমাণ করে, ইসলামী খিলাফতের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্মীয় বিধানের মধ্যে গভীর দ্বিচারিতা এবং নৈতিক বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান ছিল।


আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রে সমকামিতার শাস্তি

২১ শতকেও বহু ইসলামি দেশ এই প্রাচীন শরীয়ত বিধান অনুসারে আইন প্রণয়ন করেছে। ইরান, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, মাওরিতানিয়া, সুদান এবং নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সমকামিতাকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইরানের ইসলামী দণ্ডবিধির ২৩৪ ধারায় (Islamic Penal Code, 2013) বলা আছে—“দুই পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রমাণিত হলে উভয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।” সৌদি আরবের শরীয়ত আদালতে বিচারক ফিকাহের ব্যাখ্যা অনুসারে সমকামিতাকে “ফাহিশা” (অশ্লীলতা) হিসেবে গণ্য করে মৃত্যুদণ্ড, রজম বা চাবুকের শাস্তি নির্ধারণ করেন। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ২০২১ সালের নির্দেশিকাতেও সমকামীদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পুনর্ব্যক্ত হয়েছে।

এই দেশগুলোর আইনি কাঠামো মূলত শরীয়তভিত্তিক, যেখানে আধুনিক সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির কোনো বাস্তব প্রতিফলন নেই। Human Rights Watch, Amnesty International এবং United Nations Human Rights Council বারবার এই শাস্তির নিন্দা জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামি দেশগুলোর এই আইনগুলো “religiously justified violence” বা ধর্মীয়ভাবে বৈধ ঘোষিত সহিংসতার উদাহরণ। ২০২৩ সালে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিবেদনে (A/HRC/52/45) উল্লেখ করা হয়, “ধর্মীয় নীতির নামে মানুষের যৌন পরিচয়ের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সবচেয়ে জঘন্য লঙ্ঘন।”


মানবাধিকার, বিজ্ঞান ও নৈতিকতার আলোকে সমালোচনা

সমকামিতা সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের ধারণা প্রাচীনকালীন সামাজিক মনোভাবের প্রতিফলন, যা আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গত। মনোবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা আজ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে, যৌন অভিরুচি মানুষের জিনগত ও মানসিক গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত, এটি পছন্দনির্ভর নয়। ১৯৭৩ সালে American Psychiatric Association সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং ২০১৯ সালে WHO ICD-11 সমকামিতাকে “অস্বাভাবিকতা” নয়, বরং “মানব বৈচিত্র্য”-এর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ—বিশেষত Universal Declaration of Human Rights (UDHR, অনুচ্ছেদ ৩, ৫, ৭ ও ১২) এবং International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR, Article 6)—জীবন, স্বাধীনতা, এবং বৈষম্যহীনতার অধিকার নিশ্চিত করেছে। সুতরাং কোনো ব্যক্তির যৌন পরিচয় বা আচরণের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া মানবাধিকারের মৌলিক লঙ্ঘন। ধর্মীয় যুক্তির নামে এই শাস্তি কেবল একটি সামাজিক সহিংসতা বৈধ করার প্রক্রিয়া।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: ইসলামী শরীয়ত সমকামিতাকে ‘নৈতিক অপরাধ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলেও, কোনো ভুক্তভোগী বা ক্ষতির প্রমাণ ছাড়াই শাস্তি নির্ধারণ করে। এটি ‘retributive justice’-এর মৌলিক ধারণারও পরিপন্থী। কোনো অপরাধে যদি সরাসরি অন্যের ক্ষতি না হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডের মতো চরম শাস্তি যুক্তিসঙ্গত নয়। এই কারণেই অধিকাংশ আধুনিক আইনব্যবস্থায় সমকামিতা অপরাধের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। আজকের দিনে ১৩০টিরও বেশি দেশে সমকামী সম্পর্ক আইনত বৈধ।


উপসংহার

ইসলামী শরীয়তের সমকামী হত্যার বিধান মূলত একটি ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অংশ, যা মানুষের ব্যক্তিগত পরিচয় ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এই বিধান যে যুগে গঠিত হয়েছিল, তখনকার সমাজে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুপস্থিত ছিল; নৈতিকতা নির্ধারিত হতো ধর্মীয় ধারণার দ্বারা। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় আইন ও ন্যায়বিচারকে প্রমাণ, যুক্তি ও মানবাধিকারের আলোকে পর্যালোচনা করতে হয়। ফলে হাজার বছর আগের এই শাস্তি আজ ন্যায়ের বদলে অন্যায়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই আইন শুধু সমকামীদের নয়, বরং পুরো মানব সমাজের বিবেকের ওপর আঘাত। ধর্মীয় গ্রন্থের পুরনো ব্যাখ্যা আধুনিক রাষ্ট্রে মানবাধিকারের ভিত্তি হতে পারে না। মানবসভ্যতা যদি যুক্তি, করুণা ও সহানুভূতির ওপর দাঁড়িয়ে এগোতে চায়, তবে এমন শরীয়তীয় শাস্তিগুলোকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে রেখে দিতে হবে—চিরন্তন বিধান হিসেবে নয়। যে ধর্মব্যবস্থা কেবল ভয়, শাস্তি ও হত্যার মাধ্যমে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে, তা সভ্যতার নয়; বরং বর্বরতার প্রতীক। ইসলামী শরীয়তের এই সমকামী হত্যার বিধান তাই শুধু একটি ধর্মীয় আইন নয়—এটি মানবতার বিরুদ্ধে প্রণীত এক নির্মম রায়, যা সময়ের প্রেক্ষাপটে পুনর্মূল্যায়ন অপরিহার্য।


তথ্যসূত্রঃ
  1. সূরা আল-আ‘রাফ ৭:৮০-৮৪ ↩︎
  2. সূরা আন-নামল ২৭:৫৪-৫৮ ↩︎
  3. সূরা আল-আনকাবূত ২৯:২৮-৩৫ ↩︎
  4. ইরওয়া আল-গালীল, হাদীস ২৩৫০ ↩︎
  5. Muruj al-Dhahab, vol. 4, p. 61 ↩︎
  6. Al-Muntazam, vol. 9, p. 28 ↩︎
  7. Tarikh al-Tabari, vol. 31, p. 28–29 ↩︎
  8. Ibn Khallikan, Wafayat al-A’yan, vol. 5, p. 241 ↩︎
  9. Muruj al-Dhahab, vol. 4, p. 102 ↩︎
  10. Kennedy, The Prophet and the Age of the Caliphates, 2004, p. 165 ↩︎
  11. al-Maqrizi, al-Khitat, vol. 2, p. 148 ↩︎
  12. Ibn Hayyan, al-Muqtabis fi Tarikh al-Andalus, vol. 5, p. 312 ↩︎
  13. Dozy, Spanish Islam: A History of the Moslems in Spain, 1913, p. 458 ↩︎
  14. Abu Nuwas: The Libertine Poet of Baghdad, Philip Kennedy, 2005, p. 72 ↩︎