Table of Contents
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে উম্মে হানীর শৈশব-কৈশাের জীবনের কথা তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বিয়ে সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন মুহাম্মদের নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে মুহাম্মদ তার চাচা আবূ তালিবের নিকট উম্মু হানীর বিয়ের পয়গাম পাঠান। একই সঙ্গে হুমায়রা ইবনে আবি ওয়াহাব বা হুবায়রা ইবন ‘আমর ইবন ‘আয়িয আল-মাখযুমী (Hubayra ibn Abi Wahb)-ও পাঠান। চাচা হুবায়রার প্রস্তাব গ্রহণ করে উম্মু হানীকে তার সাথে বিয়ে দেন। মুহাম্মদ সেই সময়ে অত্যন্ত দুঃখিত হন এবং দুঃখ নিয়ে বলেন, চাচা! আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হুবায়রার সাথে তার বিয়ে দিলেন? চাচা বললেন : ভাতিজা! আমরা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করেছি। সম্মানীয়দের সমকক্ষ সম্মানীয়রাই হয়ে থাকে।
এর থেকে বোঝা যায়, নবী মুহাম্মদকে তার চাচা আবূ তালিব সম্মানীয় এবং তাদের সমকক্ষ মনে করেন নি। শুধুমাত্র পিতামাতাহীন এতিম এবং সহায় সম্বলহীন দরিদ্র হওয়ার অপরাধে তার নবী মুহাম্মদের মনের এই সুপ্ত কামনা, তার বাল্যকালের প্রেম পূর্ণতা পায় নি। পরবর্তীতে অর্থবিত্তহীন মুহাম্মদ রাগে দুঃখে কষ্টে বেশি বয়সী এবং ধনকুবের হযরত খাদিজাকে তিনি বিয়ে করেন কিনা, তা জানা যায় না। তবে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আসমাউর রিজাল
আসুন আসমাউর রিজাল গ্রন্থ থেকে উম্মে হানীর পরিচয় এবং বাল্যকালে মুহাম্মদের বিবাহের প্রস্তাবের কথাগুলো জেনে নেয়া যাক [1] –
উম্মে হানী বিনতে আবু তালেব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
নামঃ ফাখতা, বা হিন্দ।
উপনাম- উম্মে হানী। পুত্র হানীর নামানুসারে তিনি উম্মে হানী নামে প্রসিদ্ধ।
পিতার নাম- আবু তালেব।
মাতার নাম- ফাতেমা বিনতে আসাদ।
তিনি হলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাতো বোন এবং হযরত আলী ও জাফর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার সহোদরা বোন।
ইসলাম গ্রহণঃ মক্কা বিজয়ের সময় ৮ম হিজরীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাঁর ঘরে রাসুল সা. এর অবস্থানঃ মক্কা বিজয়ের সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানীর ঘরে অবস্থান করে গোসল করেন এবং চাশতের নামাজ আদায় করেন। শিআবে আবু তালেবে বন্দী থাকাকালীন উম্মে হানীর ঘরে রাত যাপন অবস্থায় মিরাজের ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয় ।
বিবাহঃ নবুয়তের পূর্বে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । কিন্তু তখন আবু তালেব হুবাইবা ইবনে আবু ওহাব মাখযুমীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। মক্কা বিজয়ের পর তাঁর স্বামী হুবাইবা ইসলাম গ্রহণ না করে পালিয়ে যায়। তখন পুনরায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। উম্মে হানী এই বলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন যে, আমি এখন অনেক সন্তানের জননী হয়ে গেছি।
হাদীস বর্ণনায় তাঁর অবদানঃ তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ৪৬টি হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন। বুখারী ও মুসলিমে যৌথভাবে তাঁর বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ আছে।
মৃত্যুঃ তিনি ৫০ হিজরীর পরে ইন্তেকাল করেন।
………………………
তথ্যসূত্র- ১. সিয়ার ৩/৫৩৭, ২. উসদুল গাবা ৫/৫০১, ৩. আলইসাবা ৪/৫০৩, ৪. তাযকিরা ১/৩৮ ।

আসহাবে রাসুলের জীবনকথা
একই বিবরণ আসুন পড়ে নিন আসহাবে রাসুলের জীবনকথা গ্রন্থ থেকে [2] –
উম্মু হানী বিন্ত আবী তালিব (রা)
ইতিহাসে তিনি উম্মু হানী – এ ডাকনামে প্রসিদ্ধ । আসল নাম ফাতা, মতান্তরে হিন্দ। হযরত রাসূলে কারীমের (সা) মুহতারাম চাচা আবূ তালিব এবং মুহতারামা চাচী ফাতিমা বিত আসাদের কন্যা। ‘আকীল, জা’ফার, তালিব ও আলীর (রা) সহোদরা(১)। তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবনের কথা তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বিয়ে সম্পর্কে দু’একটি বর্ণনা দেখা যায়। যেমন রাসূল (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে চাচা আবূ তালিবের নিকট উম্মু হানীর বিয়ের পয়গাম পাঠান। একই সংগে হুবায়রা ইবন ‘আমর ইবন ‘আয়িয আল-মাখযূমীও পাঠান । চাচা হুবায়রার প্রস্তাব গ্রহণ করে উম্মু হানীকে তার সাথে বিয়ে দেন। নবী (সা) বললেন : চাচা! আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হুবায়রার সাথে তার বিয়ে দিলেন? চাচা বললেন : ভাতিজা! আমরা তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করেছি। সম্মানীয়দের সমকক্ষ সম্মানীয়রাই হয়ে থাকে(২)। এতটুকু বর্ণনা। এর অতিরিক্ত কোন কথা কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় না। তবে হুবায়রা ইবন ‘আমরের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, সে কথা বিভিন্নভাবে জানা যায়(৩)।
উম্মু হানী কখন ইসলাম গ্রহণ করেন সে ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে একটু ভিন্নতা দেখা যায়। ইমাম আয-যাহাবী বলেনঃ(৪)
تأخر اسلامها وأسلمت يوم الفتح
“তাঁর ইসলাম গ্রহণ বিলম্বে হয়। তিনি মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন।’
তবে রাসূলুল্লাহর (সা) মি’রাজ সম্পর্কিত যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার মধ্যে উম্মু হানীর (রা) একটি বর্ণনাও বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়। তাতে বুঝা যায় রাসূলুল্লাহর (সা) মি’রাজ উম্মু হানীর ঘর থেকে হয়েছিল এবং তিনি তখন একজন মুসলমান। আর এটা হিজরাতের পূর্বের ঘটনা। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহর (সা) ইসরা’ (মক্কা থেকে বাইতুল মাকদাসে রাত্রিকালীন ভ্রমণ) আমার ঘর থেকেই হয়। সে রাতে তিনি ‘ঈশার নামায আদায় করে আমার ঘরে ঘুমান। আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ফজরের অব্যবহিত পূর্বে তিনি আমাদের ঘুম থেকে জাগান। তারপর তিনি ফজরের নামায পড়েন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়ি। তারপর তিনি বলেন : উম্মু হানী! তুমি দেখেছিলে, গতরাতে আমি এই উপত্যকায় ‘ঈশার নামায আদায় করেছিলাম। তারপর আমি বাইতুল মাকদাসে যাই এবং সেখানে নামায আদায় করি। আর এখন আমি ফজরের নামায তোমাদের সাথে…
১. সীরাতু ইবন হিশাম, ২/৪২০; আ’লাম আন-নিসা, ৪/১৪ আল-ইসতী আব, ২/৭৭২ ২. আ’লাম আন-নিসা-৪/১৪ ৩. উসুদুল গাবা- ৫/624 ৪. সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা-২/৩১

মার্টিন লিংসের লাইফ অফ মুহাম্মদ
এবারে আসুন পশ্চিমা বিশ্বে সর্বাধিক বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ মার্টিন লিংসের বই থেকে পড়ি [3]
cousin’s love with a devotion that proved to be lasting. Abū Ṭālib also had daughters, and one of these was already of marriageable age. Her name was Fākhitah, but later she was called Umm Hani’, and it is by that name that she is always known. A great affection had grown up between her and Muḥammad, who now asked his uncle to let him marry her. But Abū Ṭālib had other plans for his daughter: his cousin Hubayrah, the son of his mother’s brother, of the clan of Makhzūm, had likewise asked for the hand of Umm Hani’; and Hubayrah was not only a man of some substance but he was also, like Abū Ṭālib himself, a gifted poet. Moreover the power of Makhzüm in Mecca was as much on the increase as that of Hashim was on the wane; and it was to Hubayrah that Abu Talib married Umm Häni’. When his nephew mildly reproached him, he simply replied: “They have given us their daughters in marriage” – no doubt referring to his own mother “and a generous man must requite generosity.” The answer was unconvincing inasmuch as ‘Abd al-Muttalib had already more than repaid the debt in question by marrying two of his daughters, ‘Atikah and Barrah, to men of Makhzūm. Muḥammad no doubt took his uncle’s words as a courteous and kindly substitute for telling him plainly that he was not yet in a position to marry. That, at any rate, is what he now decided for
AI অনুবাদঃ তাঁর কাজিন (চাচাতো ভাই/বোন)-এর প্রতি যে গভীর অনুরাগ ছিল, তা স্থায়ী প্রমাণিত হয়। আবু তালিবের কন্যাও ছিল এবং তাদের মধ্যে একজন বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছেছিলেন। তাঁর নাম ছিল ফাখিতাহ, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি উম্মে হানি নামে পরিচিত হন এবং তিনি এই নামেই সর্বদা পরিচিত। তাঁর এবং মুহাম্মদের মধ্যে একটি গভীর স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং মুহাম্মদ তখন তাঁর চাচাকে তাঁকে বিবাহ করার জন্য অনুরোধ করেন।
কিন্তু আবু তালিবের তাঁর মেয়ের জন্য অন্য পরিকল্পনা ছিল: তাঁর মায়ের ভাইয়ের পুত্র, মাখজুম গোত্রের তাঁর কাজিন হুবায়রা-ও উম্মে হানির হাত চেয়েছিলেন; এবং হুবায়রা কেবল একজন ধনী ব্যক্তিই ছিলেন না, বরং তিনি আবু তালিবের মতোই একজন প্রতিভাবান কবি ছিলেন। অধিকন্তু, মক্কায় মাখজুম গোত্রের ক্ষমতা যেমন বাড়ছিল, তেমনি হাশিম গোত্রের প্রভাব কমছিল। আর এই হুবায়রার সাথেই আবু তালিব উম্মে হানির বিবাহ দিলেন।
মুহাম্মদ যখন তাঁর চাচাকে বিনম্রভাবে তিরস্কার করলেন, তিনি কেবল উত্তর দিলেন: “তারা আমাদের তাদের কন্যাদের বিবাহে দিয়েছে”—নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর নিজের মায়ের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন—”এবং একজন উদার ব্যক্তিকে অবশ্যই উদারতার প্রতিদান দিতে হয়।”
এই উত্তরটি অগ্রহণযোগ্য ছিল, কারণ আব্দুল মুত্তালিব ইতিমধ্যেই তাঁর দুই কন্যা আতিকাহ এবং বাররাহ-কে মাখজুম গোত্রের পুরুষদের সাথে বিবাহ দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ এই ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ সম্ভবত তাঁর চাচার কথাটিকে নিছকই একটি সৌজন্যমূলক ও সদয় বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যার মাধ্যমে তাঁকে সরাসরি বলা হয়েছিল যে, তিনি তখনো বিবাহের মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না। অন্ততপক্ষে, সেই সিদ্ধান্তই তিনি তখন নিলেন।

উপসংহার
এই বিষয়ে সম্পুর্ণ বিস্তারিত জানার জন্য এই লেখাটি পড়তে পারেন [4] । এখানে শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত আকারে নবীর বাল্যকালের প্রেম ও বিবাহের প্রস্তাবের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। আশাকরি পাঠকগণ মূল লেখাটি পড়ে দেখবেন।
তথ্যসূত্রঃ
- আসমাউর রিজাল, মুফতি গোলাম রাব্বানী ভুঁইয়া, প্রকাশকঃ জনাব লোকমান হোসাইন, পৃষ্ঠা ৫১, ৫২ ↩︎
- আসহাবে রাসুলের জীবনকথা, মহিলা সাহাবী, মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৮ ↩︎
- MUHAMMAD his life based on the earliest sources, Martin lings, Page 33 ↩︎
- উম্মে হানী- মুহাম্মদের গোপন প্রণয় ↩︎
