Table of Contents
- 1 ভূমিকা: ভাষা যখন ধর্ম ও রাজনীতির রক্ষাকবচ
- 2 ‘আল-লাহন’ বা উচ্চারণ বিভ্রাট: ব্যাকরণ উদ্ভবের প্রেষণা
- 3 সাত-উপভাষার কোরআন এবং উসমানের একক-সংস্করণীকরণ
- 4 উৎস-পুরাণ: আলী (রা.) ও আবু আল-আসওয়াদ আদ-দুয়ালির আখ্যান
- 5 লিপি সংস্কার ও প্রমিতকরণ: বিন্দু থেকে ব্যাকরণ
- 6 বসরা ও কুফা স্কুল: ধর্মীয় ও প্রশাসনিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
- 7 চক্রকার যুক্তি (Circular Logic): কোরআন যখন উৎস এবং মাপকাঠি
- 8 সিবাওয়াইহ ও ‘আল-কিতাব’: কৃত্রিম বনাম প্রাকৃতিক ভাষা
- 9 বেদুইন ভাষার মিথ: বিশুদ্ধতার অন্বেষণ
- 10 উপসংহার
ভূমিকা: ভাষা যখন ধর্ম ও রাজনীতির রক্ষাকবচ
আরবি ব্যাকরণের ইতিহাস শুধু একটি ভাষাতাত্ত্বিক পরম্পরার স্বাভাবিক বিবর্তনের কাহিনি নয়; বরং এটি একটি সভ্যতার ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক ঐক্য রক্ষার সচেতন প্রকল্পের ইতিহাস। সপ্তম শতাব্দীর আরব উপদ্বীপে আরবি ছিল প্রধানত মৌখিক ঐতিহ্য—প্রচুর উপভাষাগত ভিন্নতা, আলাদা গোত্রীয় ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য, এবং কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাকরণ-সংকলন ছাড়াই তার অস্তিত্ব ছিল। ভাষাটি ছিল গতিশীল ও পরিবর্তনশীল, যার মূল শক্তি ছিল কবিতা ও মুখের ভাষা। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাব, দ্রুত বিস্তার, এবং অল্প কয়েক দশকের মধ্যেই একটি বহু-ভাষিক সাম্রাজ্যে আরবিকে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় ও প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন—সমগ্র চিত্রটি আমূল বদলে দেয়।
ইসলামী রাষ্ট্রের কাঠামো যতই বিস্তৃত হতে থাকে, ভাষাগত বৈচিত্র্য ততই রাজনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। নতুন নতুন জাতি ও গোত্র ইসলাম গ্রহণ করলে কোরআন পাঠের ভুল (اللحن) এবং অর্থবিকৃতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। ধর্মীয় বয়ানের নির্ভুলতা বজায় রাখা রাজনৈতিকভাবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে—কারণ কোরআন ছিল রাষ্ট্রীয় বৈধতার মূল উৎস। ফলস্বরূপ, আরবি ভাষাকে স্থির ও মানিকরণ করার ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীর আগ্রহ তীব্রতর হয়।
ভাষাকে স্থির করার এই রাজনৈতিক উদ্বেগ কেবল ইসলামী ঐতিহ্যের অভ্যন্তরে নয়, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানেও স্বীকৃত। ভার্স্টেগ [1] এবং ইয়াসের সুলাইমান [2] দেখান যে আরবি ব্যকরণ—বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়—ছিল ধর্মগ্রন্থের পাঠ সুরক্ষার জন্য নির্মিত একটি “grammatical ideology,” যেখানে ভাষাতাত্ত্বিক বাস্তবতা নয়, বরং ধর্মীয় কর্তৃত্বই নিয়ম নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রথম শতকে যে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়—সিরিয়া, ইরাক, মিশর, পারস্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রশাসনিক দপ্তরগুলোতে আরবি প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা, মুদ্রা ও রাষ্ট্রীয় দলিল আরবিতে রূপান্তর, এবং বিচারব্যবস্থাকে আরবি টেক্সট-নির্ভর করা—এসবই ভাষার ওপর এক ধরনের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ভাষা হয়ে ওঠে ধর্মীয় বৈধতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সাম্রাজ্যের সংহতি বজায় রাখার রক্ষাকবচ।
এই প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হলো—আরবি ব্যাকরণের জন্মকে একটি ভাষাবিজ্ঞানীয় ঘটনা হিসেবে নয়, বরং ধর্মীয় পাঠ সংরক্ষণ ও রাজনৈতিক কেন্দ্রায়নের অনিবার্য ফল হিসেবে বুঝতে হবে। অর্থাৎ, ব্যাকরণের জন্ম কোন জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে আসা স্বতঃস্ফূর্ত কৌতূহল কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ নয়; এটি ছিল এক জটিল বৌদ্ধিক ও কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ার ফল। এবং এই বিবর্তনে ‘উচ্চারণ বিভ্রাট’ বা লাহন ছিল প্রধানতম প্রেরণা।
‘আল-লাহন’ বা উচ্চারণ বিভ্রাট: ব্যাকরণ উদ্ভবের প্রেষণা
ইসলামের দ্রুত বিস্তারের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই আরবি ভাষা আরবর বাইরে এমন সম্প্রদায়ের মুখে পৌঁছায়, যারা আরবি ভাষাগত কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত ছিল না। ফলে কোরআন পাঠে ভুল উচ্চারণ—‘আল-লাহন’—একটি বড় সংকটে রূপ নেয়। ‘লাহন’ শব্দটির অর্থ শুধু বানান-ভুল নয়; এর অর্থ এমন একটি উচ্চারণ, যা কোরআনের অর্থ পরিবর্তন করে দিতে পারে। প্রাচীন মুসলিম ইতিহাসের বহু উৎসে উল্লেখ আছে যে লাহন ধর্মীয়ভাবে বিপজ্জনক, কারণ আল্লাহর বাণী ভুলভাবে উচ্চারণ করলে তা পুরোপুরি ভিন্ন বার্তা বহন করতে পারে [3]।
ইসলামের বিস্তারের প্রথম শতকেই মাওয়ালি—অনারব মুসলিমদের—সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যায়। তারা আরবি ব্যাকরণের ই’রাব (বিভক্তি) বোঝেনি; ফলে রাসুলাহু, রাসুলিহি ধরনের পার্থক্য সম্পর্কে তারা অসচেতন ছিল। কিন্তু এই সূক্ষ্ম পার্থক্য অর্থে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। প্রাচীন সূত্রে উল্লেখ আছে যে সূরা আত-তাওবার একটি আয়াত পড়তে গিয়ে একজন ব্যক্তি ‘রাসুলুহু’ (তাঁর রাসুল) এর স্থলে ‘রাসুলিহি’ পড়লে, সে অর্থ দাঁড়ায়—আল্লাহ মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং (নাউজুবিল্লাহ) তাঁর রাসুল থেকেও সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনাই লাহনকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সংকটে পরিণত করে [4]।
আরেকটি সুপরিচিত ঘটনা পাওয়া যায় ইবনে কুতাইবার Adab al-Kātib এবং অন্যান্য ভাষাতাত্ত্বিক উৎসে। খলিফা উমর (রা.) মদিনার মিম্বারে দাঁড়িয়ে ভুল উচ্চারণ শুনে ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন, “এই ভুলগুলো চলতে থাকলে কোরআনই একদিন বিকৃত হয়ে যাবে।” যদিও এই বর্ণনাগুলো পরবর্তী যুগে সংগৃহীত, তবু এগুলো প্রাথমিক মুসলিম সমাজে লাহনের ভয়াবহতা কতটা গভীরভাবে অনুভূত হতো তা নির্দেশ করে।
লাহন শুধু ধর্মীয় সমস্যা ছিল না—এটি প্রশাসনিক সংকটও তৈরি করেছিল। কোরআনই যখন আইন ও রাজনৈতিক নির্দেশনার প্রধান উৎস, তখন এর ভুল পাঠ সরাসরি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারত। ফলে শাসকদের কাছে ভাষার স্থিরতা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অংশ। আধুনিক গবেষকেরা যেমন আনোয়িন্স [5] দেখান, ব্যাকরণের প্রথম প্রজন্মের কাজ ছিল “তরিকাত আল-তাশিহ” অর্থাৎ ভুল সংশোধনের পদ্ধতিগত কাঠামো তৈরি করা।
এটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আরবি ব্যাকরণ যদি লাহনের মোকাবিলায় জন্ম নিয়ে থাকে, তবে ব্যাকরণ ছিল একটি প্রতিরোধমূলক ধর্মীয়-রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ—স্বাধীন ভাষাবিজ্ঞান নয়। এই বাস্তবতা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিশেষত যখন দেখি কিভাবে ব্যাকরণকে কোরআনের “প্রমাণ” হিসেবে ব্যবহার করা হয়, অথচ একইসঙ্গে ব্যাকরণ নির্মাণের উৎসই ছিল কোরআন।
সাত-উপভাষার কোরআন এবং উসমানের একক-সংস্করণীকরণ
ইসলামী ঐতিহ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো—কোরআন “সাতটি আহরুফ” বা সাতটি ভিন্ন ভাষাগত রূপে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রাচীন হাদিসসূত্রে এই বিবরণ বহুবার এসেছে; তবে “আহরুফ” শব্দের সুনির্দিষ্ট অর্থ নিয়ে প্রাচীন বিদ্বানদের মধ্যেই চরম মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন এটি ছিল সাত ধরনের উপভাষা, কেউ বলেন সাত ধরণের বাক্যগঠন, কেউ বলেন সাত ধরণের পাঠরীতি। আধুনিক গবেষকদের মতে, “সাত” সংখ্যাটি প্রায়ই আরবি সাহিত্যে “বহু” অর্থে প্রতীকী ভাবে ব্যবহৃত হতো—অতএব এটিকে আক্ষরিক সংখ্যা হিসেবে গ্রহণ করা ভাষাবিদ্যাগতভাবে নির্ভরযোগ্য নয় [6]।
সাহিহ বুখারীতে উল্লেখিত একটি সুপরিচিত হাদিসে উমর ও হিশাম ইবনে হাকিমের ভিন্ন পাঠ নিয়ে দ্বন্দ্বের কথা এসেছে। দুজনেই আলাদা ধাঁচে সূরা পাঠ করলে উমর হিশামকে টেনে নবীর সামনে নিয়ে যান। নবী উভয় পাঠই অনুমোদন করেন এবং বলেন যে কোরআন “সাত আহরুফে” নাজিল হয়েছে [7]। এই আখ্যান ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান, কারণ এটি নির্দেশ করে যে নবীর জীবদ্দশাতেই কোরআনের পাঠে পার্থক্য ছিল এবং সেই পার্থক্যকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন ওঠে: যদি কোরআন একটিমাত্র ভাষাগত রূপে নাজিল হতো, তবে নবীর শিক্ষা ও বাস্তব চর্চায় পাঠভেদকে কেন অনুমোদন করতে হতো? একাধিক প্রাচীন সূত্র ইঙ্গিত করে যে আরব উপদ্বীপের গোত্রগুলো ভাষাগতভাবে সমজাতীয় ছিল না; এমনকি দুই বেদুইন গোত্রের শব্দ ও উচ্চারণেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল। প্রাক-ইসলামিক কবিতার ভাষাকাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আরবরা বিভিন্ন উপভাষা ব্যবহার করত [8]। তাই কোরআন পাঠকে বহুপাঠের অনুমতি দিয়ে সহজতর করা হয়েছিল—যাতে প্রতিটি গোত্র নিজস্ব উচ্চারণে পাঠ করতে পারে।
কিন্তু ইসলামী সাম্রাজ্য নবীর মৃত্যুর পর অল্প সময়ের মধ্যেই যে ভৌগোলিক বিস্তৃতি অর্জন করে—সিরিয়া, মিশর, ইরাক, পারস্য—তা ভাষাগত বৈচিত্র্যকে বিশাল প্রশাসনিক সংকটে রূপান্তরিত করে। মদিনা ও কুফার পাঠে পার্থক্য, শাম ও মিশরের পাঠে ভিন্নতা, এমনকি একই শহরের মসজিদে ভিন্ন পাঠ তৈরি হওয়া পর্যন্ত অবস্থার অবনতি হয়। ইবনে আবি দাউদ, যিনি কোরআন-সংশ্লিষ্ট প্রাচীন নথির অন্যতম প্রধান সংগ্রাহক, তাঁর Kitab al-Masahif গ্রন্থে এই পাঠভেদ সম্পর্কিত অসংখ্য বিবরণ সংগ্রহ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, কুফার বিখ্যাত ক্বারি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কোরআনের কিছু সূরাকে কোরআনের অংশ মনে করতেন না এবং তাঁর মুসহাফের বিন্যাসও ভিন্ন ছিল। অন্যদিকে উবাই ইবনে কাবের মুসহাফে অতিরিক্ত দু’টি দোয়ার মত পাঠ ছিল [9]। এসব তথ্য প্রমাণ করে যে কোরআনের পাঠে বৈচিত্র্য ছিল প্রকৃত ও নথিভুক্ত। এই পরিস্থিতি ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক শাসনের স্থিতিশীলতার জন্য কঠিন হুমকি ছিল।
এই পটভূমিতে তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফান একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন—সকল ভিন্নপাঠ বা আহরুফের বাস্তবচর্চা বন্ধ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি একক কোরআন সংস্করণ প্রতিষ্ঠা করা। সাহিহ বুখারীর বর্ণনা অনুযায়ী, হুদাইফা ইবনে ইয়ামান আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের অভিযানে দেখেন মুসলিম সেনাদের মধ্যেই পাঠভেদ নিয়ে তীব্র বিবাদ তৈরি হয়েছে। ফিরে এসে তিনি উসমানকে সতর্ক করেন: “এই উম্মত ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মতো বিভক্ত হয়ে পড়বে।” এরপর উসমান হাফসা (নবীর স্ত্রী)-এর কাছে সংরক্ষিত মূল মুসহাফ কপি করার নির্দেশ দেন এবং কোরায়শী উপভাষা অনুসারে একটি সরকারী মানসংস্করণ প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন [10]।
এই সিদ্ধান্ত কার্যত কোরআনের বহুপাঠ-আহরুফ নীতি বাতিল করে দেয়। উসমান ঘোষণা করেন যে নতুন মানসংস্করণের সঙ্গে ভিন্নতা থাকা সব কপি জ্বালিয়ে ফেলতে হবে। ইবনে আবি দাউদের বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে বিভিন্ন শহরে পাঠানো সব মুসহাফ ছাড়া অন্য সব কপি ধ্বংস করা হয় [11]। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীদের বহুজন মনে করেন—এটাই আরবি ভাষার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগত প্রমিতকরণ (Standardization) প্রকল্প।
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে: যদি কোরআন বাস্তবেই সাত আহরুফে নাজিল হয়ে থাকে এবং নবী এগুলোকে বৈধ বলে ঘোষণা করেন, তাহলে উসমান কেন সেই বৈধ পাঠগুলোর ছয়টি বাতিল করতে বাধ্য হলেন? এক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ একটি সাম্রাজ্য—যা তখন আরবদের চেয়ে অনারবের সংখ্যা বেশি—তার ধর্মগ্রন্থে অনিশ্চয়তা বরদাস্ত করতে পারে না। পাঠভেদ ধর্মীয় কর্তৃত্বকে দুর্বল করত, রাজনৈতিক ঐক্যকে বিপন্ন করত এবং আইন ও বিচারব্যবস্থায় বিভ্রান্তির কারণ হতো।
অন্য দৃষ্টিতে এটি ভাষাগত বাস্তবতা। ব্যাকরণ যখনো সংগঠিত হয়নি এবং লিখনব্যবস্থা বিন্দু-চিহ্নহীন ছিল, তখন সাত আহরুফের বহুমুখিতা বহন করা প্রযুক্তিগত ও সামাজিকভাবে অসম্ভব ছিল। তাই উসমানের সংস্কার আরবি ভাষাকে একক দিকনির্দেশে ঠেলে দেয়—অর্থাৎ কোরায়শী উপভাষাকে রাষ্ট্রীয় জমিনে প্রমিতকরণের কেন্দ্রে স্থাপন করে।
আনুষ্ঠানিক বহু-পাঠের বিলুপ্তি বাস্তবে নতুন একটি সমস্যা সৃষ্টি করে। পরে কিরাআত বা পাঠরীতির যে দশটি প্রধান ধারা প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সেগুলো বহু ক্ষেত্রে উসমানের মুসহাফের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে ব্যুৎপত্তিগত বা ব্যাকরণিক ব্যাখ্যা দিয়ে সংরক্ষিত হয়। অর্থাৎ “আহরুফ” বিলুপ্ত হলেও “কিরাআত” পরে আবার ভাষাগত বৈচিত্র্যের একটি সীমিত রূপে ফিরে আসে—যা নিজেই নির্দেশ করে যে ভাষাকে একক মানে বেঁধে ফেলা একটি কৃত্রিম রাজনৈতিক প্রয়াস ছিল।
সাত আহরুফ—যা ছিল আরবের ভাষাবৈচিত্র্যের প্রতি নবীর বাস্তবসম্মত সমন্বয়—পরে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বৈচিত্র্যরূপে পরিণত হয়। উসমানের একক-সংস্করণীকরণ সেই ঝুঁকি হ্রাস করলেও এটি একই সাথে কোরআনের প্রাথমিক ভাষাগত বিবর্তনকে আড়াল করে দেয়। আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেখায় যে আরবি ব্যাকরণের পরবর্তী বিকাশ—বিশেষত আহরুফ বিলুপ্তির পর নিয়ম তৈরি—মূলত ছিল বিনির্মাণমূলক। কোরআনকে ব্যাকরণের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আগে কোরআনকেও একটি নির্দিষ্ট, একক ভাষাগত রূপে স্থাপন করতে হয়েছিল।
উৎস-পুরাণ: আলী (রা.) ও আবু আল-আসওয়াদ আদ-দুয়ালির আখ্যান
আরবি ব্যাকরণের উদ্ভব নিয়ে ইসলামী বৌদ্ধিক ঐতিহ্যে একটি সুপরিচিত কাহিনি প্রচলিত—যেখানে এই শাস্ত্রটির সূচনা সরাসরি খলিফা আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর নির্দেশের সাথে যুক্ত করা হয়। অনেক পরবর্তী গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, আলী (রা.) আরবি ভাষার বিশৃঙ্খলতার ভয় দেখে তাঁর শিষ্য আবু আল-আসওয়াদ আদ-দুয়ালিকে বলেন: “كَلِّمَةٌ فِي النَّحْوِ”—অর্থাৎ, ব্যাকরণের ভিত্তি স্থাপন করো বা নিয়মের দিকে এই পথ ধরো। বলা হয়, আলী একটি কাগজে শুধু তিনটি শব্দ লিখেছিলেন—ইসম (বিশেষ্য), ফে’ল (ক্রিয়া) এবং হারফ (অব্যয়)—এবং সেটিকে আরবি ব্যাকরণের প্রথম কাঠামো বলে ঘোষণা করা হয় [12]।
এই গল্পটি ইসলামী বৌদ্ধিক পরম্পরায় এতটাই প্রচলিত যে অনেক পাঠকের কাছে এটি প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের মতো গ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু আধুনিক গবেষণা এই বিবরণের প্রকৃতি নিয়ে সন্দেহ উত্থাপন করেছে। ভাষা-ইতিহাসবিদ কার্টার এবং অন্যান্য বিশ্লেষকরা দেখিয়েছেন যে এই ‘উৎস-পুরাণ’ সম্ভবত নবম–দশম শতাব্দীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রয়োজন থেকে নির্মিত। কারণ একটি ধর্মীয় ভাষা-শাস্ত্রকে সর্বোচ্চ পবিত্রতা দিতে হলে সেটির উৎপত্তি কোনো মহৎ সাহাবী বা খলিফার মাধ্যমে দেখানো অত্যন্ত কার্যকর ছিল [13]।
প্রকৃতপক্ষে, আবু আল-আসওয়াদের ঐতিহাসিক অবদান ছিল সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ—তিনি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ তৈরি করেননি; বরং কোরআনের পাঠ সহজ করার জন্য বিন্দু-রঙ বা স্বরচিহ্নের প্রথম রূপ উদ্ভাবন করেন। প্রাচীন সূত্রে উল্লেখ আছে যে বসরা শহরে কোরআন পাঠে ভুল শোনার ফলে তিনি ভাষার উচ্চারণগত সংকট উপলব্ধি করেন। একদিন তাঁর কন্যা ভুল ব্যাকরণে বাক্য বললে তিনি exclaimed করেন: “ما أشدُّ اللَّحْن!”—এবং উপলব্ধি করেন যে ভুল উচ্চারণ ভাষা-সমস্যাকে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঐতিহাসিক বিবরণগুলো প্রচলিত থাকলেও এগুলোর ভাষাগত নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে [14]।
উৎস-পুরাণটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক দিক রয়েছে। এই আখ্যানটি এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যাতে বোঝানো যায়—আরবি ব্যাকরণের জন্ম ছিল ঐশ্বরিক বাণীর সুরক্ষা প্রকল্প, কোনো মানবিক চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তন নয়। ফলে আলী (রা.)-এর নামকে ব্যাকরণের সূচনায় জুড়ে দিয়ে ভাষাশাস্ত্রকে একধরনের ‘‘পবিত্র উৎস’’ প্রদান করা হয়েছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা একে বলেন “sacralized origin narrative”—যা ধর্মীয় শাস্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাধারণ একটি প্যাটার্ন।
এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয় কারণ পরবর্তী শতকে বসরা-কুফা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সিবাওয়াইহের যুগে ব্যাকরণের শক্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। সেই কর্তৃত্বকে অতীতের একটি ‘ঐশ্বরিক বা মহৎ’ ভিত্তি দেখিয়ে বৈধতা দেওয়া ছিল অত্যন্ত কার্যকর কৌশল। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো—ব্যাকরণ একদিনে জন্ম নেয়নি, এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে তৈরি হয়নি—বরং এটি কয়েক প্রজন্ম ধরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা একটি বৃহৎ বৌদ্ধিক প্রকল্প।
লিপি সংস্কার ও প্রমিতকরণ: বিন্দু থেকে ব্যাকরণ
আরবি ব্যাকরণের জন্মের আগে ছিল আরবি লিপির সংকট—একটি লিখনপদ্ধতি যা মূলত বিন্দুহীন ও স্বরচিহ্নবিহীন ছিল, এবং যা কোরআন পাঠে অনারব মুসলিমদের জন্য বড় বাধা তৈরি করেছিল। প্রাচীন উসমানীয় লিপি (الرسم العثماني) ছিল অত্যন্ত সরল—‘বা’, ‘তা’, ‘থা’, ‘নুন’, ‘ইয়া’—সবগুলোর আকার ছিল প্রায় অভিন্ন; আলাদা করার জন্য কোনো বিন্দু ছিল না। ফলে শব্দভেদ বোঝা অনেকাংশে নির্ভর করত পাঠকের স্মৃতি ও শ্রবণশক্তির ওপর। এটি কেবল সাধারণ ভাষিক বিভ্রান্তিই নয়—ধর্মীয় পাঠকে বিপন্ন করার মতো একটি গুরুতর সংকট ছিল।
এই পরিস্থিতিতে আবু আল-আসওয়াদের ভূমিকা প্রথম দিকের। বলা হয়, তিনি প্রথম কোরআনের অক্ষরের ওপর ‘লাল বিন্দু’ দিয়ে স্বরচিহ্ন (যবর, যের, পেশ) নির্দেশ করতেন—যেমন একটি লাল বিন্দু উপরে = ফাথা, নীচে = কাসরা, সামনে = দম্মা। যদিও এই বর্ণনা পরবর্তী যুগে অধিক সম্পাদিত, তবুও এটি যে আরবদের উচ্চারণ সমস্যার বাস্তব সমাধান হিসেবে স্বরচিহ্ন উদ্ভাবিত হয়েছিল—সে বিষয়ে আধুনিক গবেষকেরা একমত [15]।
পরবর্তীকালে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ—উমাইয়া প্রশাসনের অন্যতম শক্তিশালী গভর্নর—আরও গভীর ভাষাগত সংস্কার শুরু করেন। তাঁর নিযুক্ত পণ্ডিত নাসর ইবনে আসিম এবং ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামুর ব্যঞ্জনবর্ণ-ভেদকারী বিন্দু প্রবর্তন করেন। এ বিন্দুর মাধ্যমে ‘बा’ এবং ‘تا’ বা ‘জিম’ এবং ‘হা’-কে আলাদা করা সম্ভব হয়। বলা যায়, আরবি লিপির প্রকৃত রূপ তখনই প্রথম দৃশ্যমান হলো। আধুনিক পাণ্ডুলিপি-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিন্দুসংস্কার প্রাচীন আরবি গ্রন্থকে পাঠযোগ্য ও স্ট্যান্ডার্ড করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল [16]।
এই লিপি সংস্কারের একটি রাজনৈতিক মাত্রাও ছিল। উমাইয়া আমলে যখন প্রশাসনিক দপ্তরগুলোতে আরবি বাধ্যতামূলক করা হয় এবং সাসানীয়-রোমান নথিপত্র আরবিতে অনুবাদ করা হয়, তখন ভুল পাঠ পুরো রাজস্ব ব্যবস্থা, কর কাঠামো এবং আদালতের দলিলকে বিপন্ন করতে পারত। তাই লিপিকে স্থির ও একরূপ করা ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এছাড়া একটি গভীর ভাষাবিজ্ঞানীয় বিষয় এখানে স্পষ্ট—ব্যাকরণ লিপির আগে নয়; বরং লিপি সংস্কার ব্যাকরণের পূর্বশর্ত। কারণ ভুল পাঠ যদি সংশোধনযোগ্য না হয়, তবে ভাষার নিয়ম-কানুন স্থাপন করার চেষ্টা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এজন্য বিন্দুকরণ পদ্ধতি ছিল ব্যাকরণিক চেতনার জন্মমুহূর্ত। এটি ভাষাকে প্রথমবারের মতো “দৃশ্যমান নিয়ম” দিয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রশ্ন হলো: এই লিপি সংস্কারের আগে কোরআনের পাঠ কতটা স্থির ছিল? ইবনে আবি দাউদ, তাবারি এবং অন্যান্য আদি মুসলিম ইতিহাসবিদ দেখান যে উসমানের মুসহাফ-কেন্দ্রিক একীকরণ (standardization) এবং বিন্দুকরণ—উভয়ই ছিল কোরআনকে একক, নির্দিষ্ট, রাজনৈতিকভাবে বৈধ ভাষায় রূপান্তরের অংশ [17]।
অর্থাৎ, ব্যাকরণ আসার আগে লিপিই প্রথম মানিকৃত হতে হয়েছিল। লিপি সংস্কার না হলে বসরা-কুফার ব্যাকরণিক বিতর্ক, অথবা সিবাওয়াইহের ভাষাতত্ত্ব নির্মাণ—সবই অসম্ভব হতো।
বসরা ও কুফা স্কুল: ধর্মীয় ও প্রশাসনিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
আরবি ব্যাকরণের ইতিহাসে বসরা ও কুফা—ইরাকের এই দুই শহর—দুটি শক্তিশালী বৌদ্ধিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। উভয়ই ছিল সাম্রাজ্যের সীমানাসংলগ্ন বন্দর ও সামরিক শহর; ফলে ভাষাগত বৈচিত্র্যের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। কিন্তু আরো গভীরে গেলে দেখা যায়, এই দুই স্কুলের পার্থক্য শুধু ভাষা বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত দ্বন্দ্ব নয়—বরং ধর্মীয় ব্যাখ্যা, প্রশাসনিক নীতি এবং ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতাও ছিল।
বসরা স্কুল—যাকে অনেক গবেষক “যুক্তিবাদী” বা কিয়াস-নির্ভর ধারা বলে বর্ণনা করেন—ভাষার জন্য একটি আদর্শিক, নিয়ম-ভিত্তিক কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিল। তাদের মতে ভাষা একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা, যেখানে ব্যতিক্রমকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে হবে। তারা বেদুইনদের মুখের ভাষাকে ‘বিশুদ্ধ’ বলে প্রচার করতেন এবং সেই ভাষার ভিত্তিতে নিয়ম তৈরি করতেন। কিন্তু একই সময়ে তারা এমন উদাহরণগুলোকে বর্জন করতেন যেগুলো নিয়মের সঙ্গে মেলে না; এগুলোকে বলা হতো ‘شاذ’—অস্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য নয়। বসরার যুক্তি-প্রধান পদ্ধতিকে পরবর্তীকালে সিবাওয়াইহ ও তাঁর উত্তরসূরিরা আরও সুসংহত রূপ দেন [18]।
কুফা স্কুল, অন্যদিকে, নির্ভর করত ‘সামা’—অর্থাৎ ভাষার শ্রুতি-উদাহরণে। তাদের মতে মানুষের মুখের ভাষাই ছিল শেষ সত্য; নিয়ম পরে আসবে। ফলে তারা বেশি গ্রহণযোগ্যতা দিত বেদুইনদের কথ্য ভাষার বহুমাত্রিক উদাহরণকে, এমনকি সেটি বসরার প্রস্তাবিত নিয়মের সঙ্গে মেলেনি হলেও। কুফার পণ্ডিতরা প্রায়শই বসরা স্কুলকে অতিরিক্ত বিমূর্ত, অতিরিক্ত আদর্শবাদী বলে সমালোচনা করতেন। এ কারণে বসরা–কুফা বিভাজন শুধু ভাষা তত্ত্বের ভিন্নতা নয়, বরং সংস্কৃতিগত কর্তৃত্বের দুই আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে।
এই দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক মাত্রা আরও গভীর। উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রশাসন মূলত বসরাকেন্দ্রিক ছিল, যেখানে ভাষাকে প্রমিত করার প্রবণতা ছিল ক্ষমতা-কেন্দ্রীকরণের অংশ। প্রশাসনিক দলিল, করব্যবস্থা এবং বিচারব্যবস্থাকে একক ভাষায় স্থির করতে একটি “স্ট্যান্ডার্ড” নিয়ম প্রয়োজন ছিল। বসরার নিয়মমুখীতা তাই সাম্রাজ্যিক প্রকল্পের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সংযুক্ত ছিল [19]।
কুফা, বিপরীতে, ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিয়াপন্থী বিদ্রোহ এবং ইরাকি সমাজের বহুবর্ণতার কেন্দ্র। ফলে এখানকার পণ্ডিতরা ভাষার বহুত্বকে বৈধতা দিতেন—এটি শুধু ভাষাবিজ্ঞান নয়, বরং কুফার সামাজিক বাস্তবতারও প্রতিফলন। কুফা বহুভাষিক পরিবেশে অবস্থিত হওয়ায় তাদের ভাষা-চেতনা ছিল বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক।
ফলাফল হলো—আরবি ব্যাকরণ কখনোই একটি একক বৌদ্ধিক দৃষ্টিভঙ্গির ফল ছিল না। বরং এটি ছিল বসরা ও কুফার বৌদ্ধিক–রাজনৈতিক সংঘাতের নিষ্পত্তি, যেখানে শেষ পর্যন্ত সিবাওয়াইহের বসরাকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রাধান্য লাভ করে। কিন্তু কুফার বহু উদাহরণ, বহু শব্দরীতি এবং বহু পাঠ—পরবর্তী ব্যাকরণবিদদের হাতে ব্যতিক্রম, বিশেষ নিয়ম অথবা কিরাআতের অংশ হিসেবে টিকে থাকে।
চক্রকার যুক্তি (Circular Logic): কোরআন যখন উৎস এবং মাপকাঠি
আরবি ব্যাকরণের তাত্ত্বিক নির্মাণের সবচেয়ে সমস্যাসঙ্কুল ভিত্তি হচ্ছে এর চক্রকার যুক্তি—একটি epistemological circle—যা ভাষাতাত্ত্বিক বৈধতার প্রশ্নকে জটিল করে তোলে। ব্যাকরণবিদরা ঘোষণা করেছেন:
১) ব্যাকরণের নিয়ম উদ্ভূত হয়েছে কোরআন, হাদিস ও প্রাক-ইসলামিক কবিতা থেকে।
২) যে নিয়ম তৈরি হয়েছে, তাকে আবার কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
৩) যেখানে কোরআন নিয়মের সঙ্গে মেলেনি, সেখানে নিয়ম পরিবর্তন হয়নি; বরং নতুন অলঙ্কারিক বা ব্যতিক্রমী তাত্ত্বিক শ্রেণি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এই আত্ম-নির্ভর (self-validating) পদ্ধতি মূলত দুইটি পরস্পরবিরোধী দাবি একই সঙ্গে সত্য ধরে নেয়। কোরআন যদি ভাষার উৎস হয়, তবে কোরআনের ব্যাকরণ নিখুঁত—এটি অনুমান। আবার কোরআন যদি ব্যাকরণের মানদণ্ড হয়, তবে ব্যাকরণের নিয়মের বিচ্যুতিকে ব্যাকরণ নয়, বরং কোরআনের বিশেষত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ফলে কোরআন কখনোই ভুল হতে পারে না—এটি পদ্ধতির মধ্যে পূর্বনির্ধারিত।
উদাহরণস্বরূপ—ইলতিফাত (সর্বনাম, সম্বোধন, ক্রিয়া-রূপের হঠাৎ পরিবর্তন)। এটি প্রাচীন আরবি কবিতায় পাওয়া গেলেও কোরআনে এর মাত্রা অনেক বেশি। ব্যাকরণিক দৃষ্টিতে এটি অনিয়মিত; কিন্তু ইসলামী ব্যাকরণবিদরা একে ত্রুটি না বলে উচ্চশ্রেণির বালাগা বা অলঙ্কার নামে ব্যাখ্যা করেছেন। একইভাবে, ব্যাকরণে অসঙ্গত মনে হওয়া বহু আয়াতকে ব্যাখ্যা করতে “الحمل على المعنى” (অর্থের ভিত্তিতে নিয়ম প্রয়োগ), “زيادة” (অতিরিক্ত কিন্তু অদৃশ্য শব্দ অনুমান), “حذف” (উহ্য শব্দ), এবং “قطع”—এর মতো তত্ত্ব জন্ম নেয় [20]।
এই ব্যাখ্যাগুলো ব্যাকরণকে অভ্যন্তরীণভাবে আরও জটিল করেছে, তবে ভাষাতাত্ত্বিক শৃঙ্খলাকে কম করেনি। বরং এগুলো দেখায় যে ব্যাকরণ ছিল কোরআন-প্রমাণকেন্দ্রিক (Qur’an-justifying), ভাষা-বিশ্লেষণকেন্দ্রিক নয়। ফলে ব্যাকরণ হয়ে ওঠে একটি normative theology of language—যেখানে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ নয়, বরং ধর্মীয় পূর্বধারণাই নিয়ম নির্ধারণ করে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন হলো—যদি কোরআনকে ব্যাকরণের উৎসধারা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে ভাষার বিবর্তন বা প্রাকৃতিক পরিবর্তন ব্যাকরণে কোথায় স্থান পায়? আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল; কোনো “শুদ্ধ” বা “চূড়ান্ত” ভাষাগত রূপ থাকে না। কিন্তু আরবি ব্যাকরণ কোরআনের ভাষাকে সপ্তম শতকের কাঠামোয় স্থির করে দিয়েছে—এটি একটি অত্যন্ত কৃত্রিম ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থান।
আরেকটি গভীর সমস্যা হলো—প্রাক-ইসলামিক কবিতা, যা ব্যাকরণের আরেক উৎস, সেগুলোর সংকলন হয়েছে ইসলামোত্তর যুগে। ভাষাবিদ ব্লাউ এবং রবিনস দেখান যে বহু কবিতা পরবর্তীকালে সম্পাদিত বা নির্বাচন করা হয়েছে ব্যাকরণের নিয়মকে সমর্থন করার জন্য [21]। এই অর্থে উৎসগুলোও ব্যাকরণ নির্মাণের সঙ্গে প্রাকৃতিক নয়—বরং কৌশলগতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।
ফলাফল হলো:
ব্যাকরণ → কোরআনকে বৈধ করে
কোরআন → ব্যাকরণকে পবিত্র করে
এই দ্বন্দ্বময় বৃত্তই আরবি ব্যাকরণের তাত্ত্বিক কাঠামোকে অন্যান্য ভাষার তুলনায় মৌলিকভাবে ভিন্ন করে তোলে।
আগে থেকেই ধরে নেওয়া হলো—আরবি ভাষার সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও মানদণ্ডরূপ হলো কোরআনের ভাষা। ভাষা-নিয়ম কী হবে, তার চূড়ান্ত রেফারেন্স আগে থেকেই নির্ধারিত: কোরআন ভুল হতে পারে না—এটা একটি পূর্বধারণা।
কোরআনের বাক্যগঠন, ই’রাব, সর্বনাম, ক্রিয়ারূপ এবং কিছু কবিতাকে ধরে আরবি ব্যাকরণের মূল নিয়ম-কানুন সংকলন করা হলো। অর্থাৎ ব্যাকরণের কাঁচামালও এল সেই একই কোরআন থেকে, যাকে আগে থেকেই নিখুঁত ধরে নেওয়া হয়েছে।
এখন বলা হলো—আরবি ব্যাকরণের এই নিয়মগুলোর আলোকে কোরআনে কোনো ব্যাকরণগত ভুল নেই। অর্থাৎ, কোরআন থেকে নিয়ম বানিয়ে, সেই নিয়ম দিয়ে আবার কোরআনকে ত্রুটিহীন ঘোষণা করা হলো।
কোরআনের কোনো উদাহরণ সাধারণ ব্যাকরণিক নিয়মের সঙ্গে না মেললে সেটিকে ভুল বলা হলো না; বরং নতুন তত্ত্ব যোগ করা হলো—‘ইলতিফাত’, ‘বালাগা’, ‘উহ্য শব্দ’, ‘ব্যতিক্রম’ ইত্যাদি— যাতে শেষ পর্যন্ত সব অবস্থায় কোরআনকেই সঠিক ধরে রাখা যায়।
প্রথমে কোরআনকে “অবশ্যই শুদ্ধ” ধরে নেওয়া হয় → সেই ভিত্তিতে ব্যাকরণের নিয়ম বানানো হয় → তারপর সেই একই নিয়ম দিয়ে আবার কোরআনকে “শুদ্ধ প্রমাণ” করা হয় → যেখানে না মেলে সেখানে ব্যতিক্রম জুড়ে আবার কোরআনকেই মানদণ্ড ধরে রাখা হয়। যুক্তির শুরু ও শেষ—দু’টোই একই অনুমানে আটকে থাকায় পুরো কাঠামোটি একটি বন্ধ circular logic হয়ে দাঁড়ায়।
সিবাওয়াইহ ও ‘আল-কিতাব’: কৃত্রিম বনাম প্রাকৃতিক ভাষা
পারস্য বংশোদ্ভূত ব্যাকরণবিদ সিবাওয়াইহ (Sībawayh, প্রায় ৭৬১–৭৯৬ খ্রি.) আরবি ব্যাকরণের ইতিহাসে এক মোড়-ফেরানো নাম। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-কিতাব আরবি ভাষাতত্ত্বকে প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ, সুসংহত, প্রায় গাণিতিক কাঠামোতে বন্দি করে। আইরনি হলো—যে মানুষটিকে “আরবি ব্যাকরণের ইমাম” বলা হয়, তিনি নিজেই ছিলেন অনারব; তাঁর মাতৃভাষা আরবি নয়। তাই তাঁর প্রকল্পকে একদিকে দেখা যায় অনারবদের জন্য আরবি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হিসেবে, অন্যদিকে আরবির ওপর একটি প্রায় যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা হিসেবে [22]।
সিবাওয়াইহের বিশ্লেষণে কোরআনের প্রতি আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা থাকলেও, তাঁর প্রকৃত কাজ গড়ে উঠেছে “কালাম আল-আরব”—বেদুইনদের মুখের ভাষা—এই ধারণাকে কেন্দ্র করে। বসরা স্কুলের ঐতিহ্য অনুযায়ী, তিনি ধরে নেন মরুভূমির আরবেরা যে ভাষায় কথা বলে, সেটিই “সবচেয়ে বিশুদ্ধ” আরবি; শহুরে উপভাষা, দৈনন্দিন কথ্য রূপ, এমনকি অনারবদের ব্যবহৃত আরবিও তাঁর কাছে দ্বিতীয় শ্রেণির। এইভাবে প্রাকৃতিকভাবে পরিবর্তনশীল ভাষাকে তিনি একটি আদর্শ বা ধ্রুপদী, স্থির রূপে রূপান্তর করতে চান [23]।
কিন্তু এখানেই সিবাওয়াইহের প্রকল্প মূলত “প্রাকৃতিক ভাষা” থেকে সরে “কৃত্রিম ভাষা”-র দিকে চলে যায়। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা সবসময় গতিশীল—ধ্বনি, ব্যাকরণ, শব্দভাণ্ডার সব কিছু বদলায়। সিবাওয়াইহ এই প্রাকৃতিক গতিশীলতাকে মানতে নারাজ। তিনি এমন একটি সিস্টেম তৈরি করেন যেখানে প্রতিটি শব্দের “আআমিল” ও “মা’মূল”, প্রতিটি ই’রাব, প্রতিটি বাক্যগঠনের জন্য তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা চাই। বাস্তব ভাষা যদি ব্যাখ্যার সঙ্গে না মেলে, তবে বাস্তব ভাষা নয়, বরং ব্যাখ্যাই “সঠিক” ধরে নিয়ে ভেতরে ভেতরে ভাষাকে সে ব্যাখ্যার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় [24]।
এই কাজ করতে গিয়ে সিবাওয়াইহ ও তাঁর উত্তরসূরিরা একটি বিশাল “ব্যাখ্যা-উপকরণ” কিট তৈরি করেন—‘তাকদীর’ (ঊহ্য শব্দ অনুমান), ‘যিয়াদাহ’ (অতিরিক্ত বা ‘অনর্থক’ শব্দ ধরে নেওয়া), ‘হাজফ’ (বর্জিত কিন্তু ধারণাগত শব্দ), ‘তাখসিস’, ‘তাকদিম-তা’খির’ ইত্যাদি। যে জায়গায় কোরআন, কবিতা বা বেদুইন ভাষা সোজা নিয়মের সঙ্গে মেলে না, সেখানে এইসব উপকরণ দিয়ে যেন ব্যাকরণকে বাঁচানো হয়। ফলাফল দাঁড়ায় এরকম: ভাষা কীভাবে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে, তা বোঝার বদলে ভাষাকে কীভাবে একটি পূর্বনির্ধারিত আদর্শ কাঠামোর মধ্যে “ফিট” করানো যায়, সেটাই হয়ে ওঠে প্রধান কাজ।
এখানেই “কৃত্রিম” আর “প্রাকৃতিক” ভাষার দ্বন্দ্বটি স্পষ্ট। প্রাকৃতিক ভাষা হলো মানুষ যেমন কথা বলে, লিখে, পরিবর্তন করে; কৃত্রিম ভাষা হলো ব্যাকরণবিদদের মাথায় নির্মিত একটি তাত্ত্বিক ভাষা, যেটাকে বাস্তব ভাষার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। সিবাওয়াইহের আল-কিতাব এই অর্থে আরবি ব্যাকরণের ক্ল্যাসিক; একই সঙ্গে এটি আরবি ভাষাকে সপ্তম–অষ্টম শতকের ফ্রেমে স্থির করে দেওয়ার এক দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্পের সূচনাপত্র।
বেদুইন ভাষার মিথ: বিশুদ্ধতার অন্বেষণ
আরবি ব্যাকরণের প্রায় সব প্রাচীন গ্রন্থেই একটি বারবার পুনরাবৃত্ত ধারণা দেখা যায়—শহরের ভাষা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই “বিশুদ্ধ” আরবি শিখতে হলে মরুভূমির বেদুইনদের কাছে যেতে হবে। বসরা ও কুফার ব্যাকরণবিদরা উভয়েই বেদুইনদের ভাষাকে প্রায় পবিত্র মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। তারা দূর মরুভূমিতে ভ্রমণ করে বেদুইন কবি ও সাধারণ মানুষের মুখ থেকে বাক্য সংগ্রহ করতেন, এগুলোকে “শাহিদ” হিসেবে কিতাবে লিখতেন এবং বলতেন—এটাই সত্যিকারের আরবি।
এই ধারণাই পরে “বেদুইন ভাষার মিথ” হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আধুনিক গবেষক জশুয়া ব্লাউ এবং অন্যেরা দেখিয়েছেন যে বেদুইনদের ভাষা মোটেও অপরিবর্তিত, বন্ধ, বাইরের প্রভাবমুক্ত ছিল না। তাদের ভাষাও সময়ের সঙ্গে বদলেছে, পার্শ্ববর্তী গোত্র, বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে বিভক্ত ও মিশ্রিত হয়েছে। “বিশুদ্ধ বেদুইন ভাষা” আসলে একটি আদর্শায়ন—বাস্তব ভাষাগত অবস্থা নয় [25]।
এই আদর্শায়নের রাজনৈতিক গুরুত্বও আছে। যখন বলা হয় “শহরের ভাষা দূষিত”, তখন আসলে শহরের ভাষাভাষী—অনারব, মওয়ালা, মিশরীয়, ইরাকি, সিরিয়ান—এদের ভাষাগত ভূমিকা খাটো করা হয়। আর মরুভূমির “অদূষিত” বেদুইনকে ভাষার শেষ বিচারক বানিয়ে তাদের মাধ্যমে কোরআনের ভাষাকে বৈধতা দেওয়া হয়। এইভাবে বেদুইনকে ব্যবহার করা হয় এক ধরনের “symbolic pure Arab”-এর প্রতিনিধিত্ব হিসেবে, যার সঙ্গে বাস্তব বেদুইন সমাজের সম্পর্ক আংশিকই।
ব্যাকরণবিদদের কাজে দেখা যায়, যদি শহুরে আরবির একটা রূপ কোরআনের সঙ্গে মেলে, কিন্তু বেদুইনের উদাহরণ তার সঙ্গে না মেলে, তাহলে প্রায়ই বেদুইনের উদাহরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কারণ বেদুইন = বিশুদ্ধ = কোরআনের ভাষার কাছাকাছি—এই অনুমান আগে থেকেই বসানো আছে। ফলে “বিশুদ্ধ বেদুইন ভাষা” আসলে আরেকটি বাঁকানো আয়না, যার মাধ্যমে কোরআনের ভাষাকে সব ধরনের সমসাময়িক উপভাষার ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়।
এই মিথের ফলাফল হলো—আরবি ভাষার বাস্তব বহুত্ব, শহুরে আরবি, সাধারণ মানুষের কথা, অনারবদের আরবি—সবকিছুকে দ্বিতীয় সারিতে সরিয়ে দেওয়া। ব্যাকরণে যে আরবিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তা আর দৈনন্দিন সামাজিক বাস্তবতায় ব্যবহৃত আরবির সঙ্গে একই জিনিস নয়; বরং এটি রাষ্ট্র-ধর্ম-উলামা জোটের নির্মিত এক ধরনের “high language”, যার পেছনে বেদুইন এবং কোরআনের “বিশুদ্ধতার” যৌথ প্রতীকী পুঁজি কাজ করে।
উপসংহার
আরবি ব্যাকরণের উৎপত্তি ও বিকাশের এই পুরো ইতিহাসটাকে একসাথে দেখলে একটি পরিষ্কার চিত্র উঠে আসে—এটি সংস্কৃত বা গ্রিক ব্যাকরণের মতো কোনো নিরুদ্বেগ দর্শনচর্চা বা সাহিত্য-ভাষার সৌন্দর্য বিশ্লেষণ নয়; বরং একটি গভীর অস্তিত্ব সংকটের রাজনৈতিক–ধর্মীয় জবাব। একদিকে ছিল কোরআনের পাঠ বিকৃত হওয়ার ভয়, অনারব মুসলিমদের লাহনের বাস্তব সমস্যা, সাত আহরুফের বহুপাঠ থেকে তৈরি গোলযোগ, উসমানের যুগে একক মুসহাফ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রয়োজন; আরেকদিকে ছিল এক বহুভাষিক, দ্রুত বিস্তৃত সাম্রাজ্যকে একটি অভিন্ন ভাষিক কাঠামোতে বেঁধে রাখার প্রশাসনিক চাহিদা।
এই দুই চাপের ভেতরেই আরবি ব্যাকরণ জন্ম নেয় এবং বড় হয়।
- উৎস-পুরাণের মাধ্যমে ব্যাকরণকে আলী ও আবু আল-আসওয়াদের সঙ্গে যুক্ত করে একটি পবিত্র উৎস দাঁড় করানো হয়;
- লিপি সংস্কারের মাধ্যমে বিন্দুহীন, স্বরচিহ্নহীন লিপিকে ধাপে ধাপে এমন অবস্থায় আনা হয়, যা কোরআনের একক পাঠকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক;
- বসরা–কুফা দ্বন্দ্ব দেখায়, ব্যাকরণ ছিল একই সঙ্গে ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও প্রশাসনিক ভাষা নির্ধারণের যুদ্ধক্ষেত্র;
- সাত আহরুফ এবং উসমানের একক-সংস্করণীকরণ প্রমাণ করে, বহুপাঠ বাস্তবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছিল—একটি রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ একক ভাষা সংস্করণ প্রয়োজন ছিল;
- চক্রকার যুক্তি দেখায়, কোরআন থেকেই নিয়ম নেওয়া, তারপর সেই নিয়ম দিয়ে কোরআনকে ত্রুটিহীন ঘোষণা করা—একটি স্ববিরোধী epistemological circle;
- সিবাওয়াইহের কৃত্রিম ভাষা-প্রকল্প এবং
- বেদুইন ভাষার মিথ যৌথভাবে ভাষাকে প্রাকৃতিক বিবর্তন থেকে সরিয়ে একটি স্থির, ধ্রুপদী এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোতে বন্দি করে।
ফলত, আরবি ব্যাকরণ হয়ে ওঠে ধর্ম, রাজনীতি এবং ভাষাতত্ত্বের এক জটিল সংমিশ্রণ, যেখানে “সত্য ভাষা” বলতে বোঝায় সেই ভাষা, যা কোরআন ও ক্ষমতার দাবি—দুটোকেই একসঙ্গে সন্তুষ্ট করতে পারে। ভাষাতাত্ত্বিক সত্য, বাস্তব উপভাষার বৈচিত্র্য, ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন—সবকিছুই এই কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করে কেবল তখনই, যখন তা কোরআনের নির্ধারিত মান এবং রাজনৈতিক-ধর্মীয় কর্তৃত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে আরবি ব্যাকরণের ইতিহাস আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এনে দেয়: কোনো ভাষা-ব্যবস্থা কখনোই কেবল “ভাষা” নিয়ে কাজ করে না। ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ মানে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ, এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের ওপর ক্ষমতার কাঠামোকে স্থায়ী করে তোলা। আরবি ব্যাকরণের প্রাথমিক নির্মাণ এই ক্ষমতাবাদী ভাষা-রাজনীতির এক ক্লাসিক উদাহরণ—যেখানে ব্যাকরণ ছিল কেবল ভাষার নিয়ম নয়, বরং এক সাম্রাজ্যের মতাদর্শিক সুরক্ষা-ব্যবস্থা।
তথ্যসূত্রঃ
- Versteegh, Kees. The Arabic Language. Edinburgh University Press, 2014 ↩︎
- Suleiman, Yasir. The Arabic Grammatical Tradition: A Study in Ta’lil. Edinburgh University Press, 1999 ↩︎
- Al-Suyuti, Al-Itqan fi Ulum al-Qur’an ↩︎
- Fück, Johann. Arabiya: Untersuchungen zur arabischen Sprach- und Stilgeschichte. Akademie-Verlag, 1950 ↩︎
- Owens, Jonathan. The Foundations of Grammar: An Introduction to Medieval Arabic Grammatical Theory. John Benjamins, 1988 ↩︎
- Al-Suyuti. Al-Itqan fi Ulum al-Qur’an ↩︎
- Sahih Bukhari, Kitab al-Tafsir ↩︎
- Blau, Joshua. The Emergence and Background of Judaeo-Arabic. Oxford, 1965 ↩︎
- Ibn Abi Dawud, Kitab al-Masahif ↩︎
- Sahih Bukhari, Kitab al-Tafsir ↩︎
- Ibn Abi Dawud, Kitab al-Masahif ↩︎
- Ibn al-Nadim, al-Fihrist ↩︎
- Carter, Arabic Grammar, Cambridge History of Arabic Literature ↩︎
- Al-Zubaydi, Tabaqat al-Nahwiyyin ↩︎
- Déroche, Qur’ans of the Umayyads ↩︎
- Déroche 2014 ↩︎
- Ibn Abi Dawud, Kitab al-Masahif ↩︎
- Bohas & Kouloughli, The Arabic Linguistic Tradition ↩︎
- Brockelmann, History of the Islamic Peoples ↩︎
- Fück, Johann. Arabiya: Untersuchungen zur arabischen Sprach- und Stilgeschichte. Akademie-Verlag, 1950 ↩︎
- Blau, Joshua. The Emergence and Background of Judaeo-Arabic. Oxford, 1965 ↩︎
- Carter, M.G. Sibawayhi. Oxford University Press, 2004 ↩︎
- Carter, Arabic Grammar, in The Cambridge History of Arabic Literature ↩︎
- Owens, Jonathan. The Foundations of Grammar: An Introduction to Medieval Arabic Grammatical Theory. John Benjamins, 1988 ↩︎
- Blau, Joshua. The Emergence and Background of Judaeo-Arabic. Oxford, 1965 ↩︎
